একদিন এক দিল খোলা আমুদে লোক একটা রশিতে বেঁধে একটা গাধাকে টানতে টানতে বাজারের পথ দিয়ে যাচ্ছিল। তাই দেখে, একটা সেয়ানা চোর গাধাটাকে চুরি করার মতলব ভাজতে লাগলো। চোরটা তার সাগরেদকে বললো, গাধাটাকে হাওয়া করতে হবে। কিন্তু খুব সাবধান, লোকটা যেন জানতে না পারে। কী করে করা যায় বলো তো?
সঙ্গীটা বলে, কিসসু ভেবো না ওস্তাদ, তুমি আমার পিছনে পিছনে এসো। দেখ, আমার কীরকম হাত সাফাই।
এমন সময় রাত্রির আঁধার কাটতে থাকে, শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
তিনশো আশিতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :
সাগরেদটা অতি সন্তৰ্পণে গাধা-মালিকের পিছনে পিছনে চলতে থাকে। দাঁও বুঝে এক সময় সে গাধার গলা থেকে দডির ফাঁসটা খুলে নিজের গলায় পরে নেয়। এই ফাঁকে ওস্তাদ গাধাটাকে নিয়ে উধাও হয়ে যায়। লোকটা গাধার গলার দড়ি নিজের গলায় পরে এমন ল্যাকপ্যাক করে চলতে থাকে যে লোকটার বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগে না। সে ভাবে, গাধাটা কুঁড়ের বাদশা। গতরটাকে একেবারে চালাতে চায় না।
কিছুক্ষণ পরে সাগরেদটা যখন দেখলো তার ওস্তাদ গাধাটাকে নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেছে, তখন সে হঠাৎ অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মাঝ রাস্তায়। গাধার মালিক তখনও দড়ি ধরে টান দিতে থাকে। আর ভাবে গাধাটা কী ঘ্যাচড়া। কিন্তু একপাও যখন তাকে নড়াতে পারে না তখন সে রাগে জ্বলে ওঠে, পিছন ফিরে তাকায়। মুহূর্তের মধ্যে সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়, একী? গাধা-তার গা-ধা-, এ সে জলজ্যান্ত একটা মানুষ! নিজের চোখকেই সে বিশ্বাস করতে পারে না। সে কী ভুল দেখছে না কী? কিন্তু না, ভুল হবে কী করে? পথ-চলতি আর পাঁচটা মানুষের মতো। এ-ও তো দেখছি একটা মানুষ। তা হলে তার গাধা—গাধা কোথায় গেলো? বোকার মতো সে প্রশ্ন করে, তুমি কী?
–আমি আপনার গাধা, মালিক। কেন আমাকে চিনতে পারছেন না?
চোরের সাগরেদটা খুব ধীর শান্তভাবে কথাগুলো বলে।
এবার গাধার মালিক ভড়কে যায়, গাধা আবার কথা বলে নাকি?
লোকটা বলে, আমি কিন্তু জন্মাবধি গাধা নাই, মালিক। আমি মানুষেরই বাচ্চা। কিন্তু আমার কর্মদোষে আজ আমি অভিশপ্ত–তাই গাধা হয়েছি।
মালিক অবাক হয়, সে কেমন?
–আমি ছোটবেলায় বড় দুরন্ত, বেয়াড়া ছিলাম। এই নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই মা-এর সঙ্গে আমার ঝগড়া লাগতো। আমি পাড়াপাড়শীরবাড়ি ঘর গাছপালা তছনছ করে ফেলতাম। তাদের ছেলেমেয়েদের বিনা কারণে মারধোর করতাম। সেই জন্যে মা আমার ওপর ভীষণ ক্রুব্ধ হয়ে একদিন আমাকে অভিশাপ দিয়ে গাধা বানিয়ে ফেললো। সেই থেকে আমার এই হাল! আমি মনের দুঃখে ঘর ছেড়ে চলে গেলাম। কিন্তু রেহাই পেলাম না। একটা লোক আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বাজারে বিক্রি করে দিলো। এবং সেখান থেকে কিনে আনলেন। আপনি। সেই থেকে আমি আমার সাধ্যাতীত মোট বয়ে চলেছি আপনার। যখন একান্তই বইতে পারিনি, হয়তো বা একটুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে জিরিয়ে নিতে চেয়েছি। কিন্তু আপনি আমাকে দাঁড়াতে দেন নি, পেটের মধ্যে খোঁচা মেরে আমাকে তখুনি চলতে বাধ্য করেছেন। এতকাল আমার মুখে কোনও ভাষা ছিলো না। তাই শত চেষ্টা করেও আপনাকে আমার মনের কথা জানাতে পারি নি। আজ আমার মুখে কথা ফুটেছে। আপনার কাছে আমার আজি, আমাকে মেহেরবানী করে খালাস করে দিন। আমি আমার মা-এর কাছে ফিরে যাই। তিনি আমাকে অভিশাপ থেকে মুক্তি দিলে আবার আমি পুরোপুরি আগের মতো মানুষ হতে পারবো।
লোকটার কথা শুনে গাধার মালিক হা হুতাশ করতে লাগলো, হায় হায় এ আমি কী পাপ করেছি। না জেনে তোমাকে কত কষ্টই না দিয়েছি! দোহাই আল্লাহ, তুমি আমার অপরাধ নিও না। আমার অনুতাপের শেষ নাই। ছিঃ ছিঃ, এ আমি কী করেছি। আমি তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি। আজই তোমার মা-এর কাছে ফিরে যাও তুমি। জানি না, আল্লাহ আমার এ গোস্তাকি মাফ করবেন। কিনা।
আর তিল মাত্র দেরি না করে গাধার মালিক তার গলার দড়ি খুলে দিলো। অনুতাপে দগ্ধ হতে হতে সেবাড়ি ফিরে বিছানায় ঢলে পড়লো।
দিন কয়েক পরে গাধার মালিক বাজারে এলো অন্য একটা গাধা কেনার জন্য। হঠাৎ তার নজর পড়লো একটা গাধার ওপর। আরে! এ যে তারই সেই আগের গাধাটা! বিক্রির জন্যে বাজারে তোলা হয়েছে! কী ব্যাপার, কিছু ঠাওর করতে পারে না সে। মনে মনে ভাবে হয়তো, এই পাজী বদমাইশটা আবার তার মাকে জালিয়েছে। তাই আবার তাকে গাধা করে বাজারে বেচে দিয়ে গেছে। যাই হোক, এই নচ্ছারটাকে আর সেবাড়ি নিয়ে যাবে না।
রাগে গাধাটার মুখের ওপর থুথু করে থুথু ছিটিয়ে দিয়ে সে অন্য একটা গাধার দিকে চলে গেলো। সারা বাজার ঘুরে ঘুরে সে অন্য একটা গাধা কিনে নিলো। লোকটা বুঝতেও পারলো না, হাড়ে হাড়ে বজাত, খাল সেই গাধাটার জুড়ি সারা বাজারে পাওয়া যাবে না।