২৫
তিষ্যভদ্র! তিষ্যভদ্র!—তিষ্যকে তিষ্য ডাকবার লোক এখানে কেউই নেই। সকলেই বলে পাঞ্চাল। হরিৎ উত্তরীয়টি কাঁধে গুছিয়ে নিয়ে তিষ্য দাঁড়িয়ে পড়েন। বিশাখা। অদূরে পূর্বারাম মহাবিহার। বিশাখার শিবিকা থেমে আছে। বিশাখা নেমে এসেছে।
—বলুন দেবি!
—দেবি নয় সাকেতকুমার, সখি বিশাখাকে বিশাখা বললেই তো যথেষ্ট হবে!
শ্রাবস্তীর শালতরুর তলায় সরযূ বহে যায়, মল্লিকার গন্ধ ভেসে আসে।
—আপনি নাকি যুদ্ধে হতাহত সৈনিকদের জন্য সর্বস্ব দিয়ে দিচ্ছেন!
—সর্বস্ব? এ কথা কে বলে বিশাখা?
—সারা সাবত্থি বলছে।
—সর্বস্ব নয়। সামান্যই।
—কখনও সামান্য নয় ভদ্র, আপনার কাজই ঠিক। ঠিক স্থানে পৌঁছচ্ছে। আজ মনে হয় আমি বড় বাহুল্য করেছি, যৌবনের অফুরন্ত শক্তির, কল্পনার অপব্যয়…
—এ কথা কেন বিশাখা?
—জেতবন মহাবিহার তো ছিলই। তা সত্ত্বেও পূর্বারাম নির্মাণ করাতে শক্তি দিলাম। সমস্ত শক্তি।
—দান করে খেদ করতে নেই বিশাখা।
গ্রীবা ঋজু করে পঞ্চকল্যাণী নারী বলে—দেবী সুমনার কন্যা সত্য স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হয় না। ভদ্র, পিতার কাছে শিখেছিলাম ধন উপার্জন করার সুযোগ ও প্রতিভা সবার থাকে না, তাই যার থাকে তাকে সে ধন ভাগ করে নিতে হয়। স্বকুল, স্বগোত্র, স্বগ্রাম। যদি আরও থাকে তো দানের সীমা আরও বাড়াতে হয়। তাতেই আসে ধনসাম্য। নইলে বসুন্ধরা কুপিত হন, সৃষ্টি নষ্ট হয়ে যায়। পিতার শিক্ষার মূল কথাটি বুঝিনি। ভগবান তথাগতও বলেছিলেন—যারা সংসার ত্যাগ করে আসছে তাদের জন্য কি দ্বিতীয় সংসার গড়ছো, বিশাখা? তখনও বুঝিনি। মোহগ্রস্ত ছিলাম ভদ্র। আজ দেখছি পূর্বারামের মধ্যে চীবরের পেটিকা নিয়ে কলহ করছে ভিক্ষুরা। কয় তলিকা পর্যন্ত পাদুকা পরার অনুমতি পাবে, ভেষজ বলে ঘৃত, মধু, মাংসভক্ত কীভাবে সংগ্রহ করা যায় এই নিয়ে চিন্তা করছে। বিহার প্রাঙ্গণে একদিন শ্ৰেষ্ঠীদের পাঠানো অন্ন ইত্যাদি দিয়ে পাকসাক হচ্ছিল মহাভোজের জন্য জানেন? থের সারিপুত্তর তিরস্কারে থামে। নিমন্ত্রণে কে দধির অগ্র পায়নি, কার ভাগের মাংসে অস্থি অধিক ছিল এই নিয়ে নিমন্ত্রককে কটু কথা শুনতে হয়। তিষ্য ভদ্র, প্রতিদিন পাঁচ শত ভিক্ষুকে আহার দিতে প্রতিশ্রুত আমি, আমি জানি মুষ্টিমেয় অর্হন, আদি-ভিক্ষু ও সৎ-কয়েকজনকে বাদ দিলে সংঘ একটি অলস, পরভোজী, অপদার্থ মানব সম্প্রদায় সৃষ্টি করে চলেছে। শুধু মুণ্ডিত মাথা আর রক্তকাষায়ের জন্য আজ মানুষের শ্রদ্ধা ও দান অবলীলায় নিয়ে যাচ্ছে এবং তাইতে এদের আত্মাভিমান, অধিকার বোধ আরও বেড়ে যাচ্ছে। আমি তাদেরই পুষ্ট করছি।
বিশাখা ম্লান মুখে চেয়ে থাকে।
—এত বিরাট একটি সম্প্রদায় সকলেই কি সমান হয় বিশাখা?—তিষ্য সান্ত্বনা দিতে বললেন।
—বলেন কী? এরা যে অনাগারী। নির্বাণ পথের পথিক, কামনাকে জয় করবে বলে এসেছে! জানেন, থের সারিপুত্ত ও মোগ্গল্লানের প্রয়াণের পরে এরা কী বলাবলি করছিল?
—কী?
—ভালই হল—এঁরা গেলেন। এবার তথাগত গেলেই আমরা ইচ্ছামতো চলতে পারব। এত তিরস্কার, উপদেশ, বাঁধাবাঁধি, নিয়ম আর ভালো লাগে না।
—বলো কী বিশাখা?
—হ্যাঁ। এইরূপই অবস্থা। ভগবান নাকি ভিক্ষুণীসংঘ প্রতিষ্ঠার সময়ে বলেছিলেন, নারীদের স্থান দেওয়ায় ধম্মের আয়ু পাঁচশ বৎসর অল্প হয়ে গেল। আমি জানি ধম্মের আয়ু আরও অল্প। কিন্তু তা নারীদের স্থান দেওয়ার জন্য নয়। …এমনকি ভগবানের সব আচরণও আমি বুঝতে পারি না। মেনে নিতে পারি না ভদ্র! পরম খেদে বিশাখা নতমুখী হয়ে বলল।
তিষ্য দাঁড়িয়ে থাকেন।
—আমার কন্যাসমা ভগ্নী সুজাতা মাতৃহারা, পিতার বড় আদরের, সাকেতের গৃহে সে ছিল মুক্ত, সম্রাজ্ঞী। মহাসেট্ঠি সুদত্তর ঘরে তার বিবাহ হয়েছে। বিশাল পরিবার, বহু প্রকারের মানুষ সেখানে, হতভাগিনী সেখানে বালিকাস্বভাবে আগের মতোই আহার-বিহার করে। দিনকাল পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে তিষ্যভদ্র, আমি আমার অধিকার, মর্যাদা রক্ষার জন্য মিগারগৃহে সংগ্রাম করেছি। ভগ্নী আমার তা পারে না। তার নামে ভগবানের কাছে অভিযোগ এলো সে দুর্বিনীত, কাউকে মান দেয় না। অমনি ভগবান সেখানে গিয়ে তাকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে এলেন সে দাসীর মতো থাকবে। ধনঞ্জয়ের কন্যা দাসী? আমি…আমি ভগবানের সঙ্গে এ নিয়ে কলহ করেছি তিষ্যভদ্র, বলেছি তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইচ্ছানুযায়ী চলছেন, বলেছি প্রব্রজিতদের গুহায় কন্দরে থাকাই ভালো—স্থবির দেবদত্ত এ কথাটি অন্তত ঠিকই বলেছিলেন। আরও বলেছি, সমাজের শক্তি তাঁর চেয়ে অনেক অধিক। তিনি কি পেরেছেন মহারাজ বিম্বিসারের হত্যা রোধ করতে? তিনি কি পেরেছেন নারীদের অধিকার সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে? পেরেছেন কি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থামাতে? অন্ত্যজদের দুঃখ দূর করতে? তা হলে কেন তিনি বহুজনহিতের কথা, বহুজনসুখের কথা, শ্রামণ্যফলের কথা বলবেন—বিশাখার দু’ চোখে অভিমানের অশ্রু।
—শান্ত হও সখি, তিষ্য তাড়াতাড়ি বলেন—শান্ত হও। তোমার সে অপূর্ব স্থৈর্য কোথায় গেল? উপাসিকার মহাসম্পদ প্রশান্তি! তুমি না সাত বছর বয়সে স্রোতাপত্তি মার্গে প্রবেশ করেছিলে?
—তিষ্য, আমার চারপাশের পৃথিবী যখন ভেঙে যেতে থাকে, আমার সন্তানরা বিপথে চলে যেতে থাকে, তখন আমি মাতা কেমন করে স্থির থাকি? পারি। নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারি। কিন্তু জীবনের প্রথম থেকেই কিছু সংকল্প ছিল। নারীদের জন্য, দাসেদের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম। পারিনি…আমি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছি।
সেই বিশাখা। সাকেত সুন্দরী গরবিনী কিশোরী যে হতে পারতো রানী। কোনও পদই যার পক্ষে অধিক মর্যাদার হত না। জীবন তাকে এক ধরনের সার্থকতা দিয়েছে। ভাবতেন তিষ্য। আজ সেই সখী বিশাখা অশ্রুমুখী, নিজের শূন্যতার কথা নিজেই বলে গেল। তিষ্যর চেয়ে আপন আর কেউ নেই তার এ কথা বলবার। ম্লানমুখী বিশাখাকে শিবিকায় তুলে দিয়ে গৃহে ফিরতে লাগলেন তিষ্য।
সন্ধ্যা বহুক্ষণ অতিক্রান্ত। বর্ষা আসব আসব করছে। মেঘেরা জলসঞ্চয় করছে। কাননের মধ্যে হরিৎ অন্ধকার। শেষ গ্রীষ্মের কুসুমের সুগন্ধে মন কেমন করে। কী প্রবল আত্মপ্রত্যয় নিয়ে একেকটি অমূল্য জীবন আরম্ভ হয়—ভাবলেন তিষ্য। তারপর একদিন যখন ফেরবার পথ থাকে না তখন উপলব্ধি হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছি। কিছুই পারিনি। এ কি শুধু মিগারমাতা বিশাখারই অনুভব? অধিকাংশ কর্মী মানুষেরই তো এই এক অনুভব! বিম্বিসার কি পারলেন রাজসংঘ প্রতিষ্ঠা করতে? চণক কি পারলেন বৈদেশিক আক্রমণের বিরুদ্ধে জম্বুদ্বীপকে সংহত করতে? ঐক্যবোধ আনতে? ভগবান বুদ্ধ কি পারলেন পারস্পরিক হিংসা, যা দেখে তিনি উন্মন হয়েছিলেন, তা বন্ধ করতে? উপরন্তু বলা যায় বহু হিংসার অনুষ্ঠানের পরোক্ষ কারণ তিনিই। হত না বিম্বিসার-হত্যা তিনি না এলে, অহিংসার বাণী প্রচার না করলে, কারণ রাজগৃহের আপামর মানুষ প্রাণপণে সাম্রাজ্যের গৌরব চেয়েছিল, আজ যে বিরূঢ়ক শাক্যদের ধ্বংস করতে ছুটছে তা-ও হত না, শাক্যমুনিকে দেখে মুগ্ধ পসেনদির মনে শাক্য-কন্যার লোভ না জাগলে। মগধ-কোশল বন্ধুভাবে এক বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারত হয়ত। হয়ত রূপ পেত রাজসংঘ। হয়ত বা।
তিষ্যর মনে হল পশু-পাখি-বৃক্ষ-লতা এবং সমস্ত মানুষের নির্যাস দিয়ে গড়া একটি রূপ যেন ভেদ করতে চাইছে ক্রান্তিকালের কঠিন প্রাচীর। ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা পার হয়ে এসেছে সে। তার পরেও নতুন ব্যর্থতার পাষাণ প্রাচীরে এসে মাথা ঠুকে যায়। ব্যর্থতাই কি তবে মানুষের নিয়তি? কোথায় দৈবরাত? এতো ভালোবেসে ছিলেন মহারাজ বিম্বিসারকে যে নির্বাসন দণ্ডের অভিমানে একেবারে হারিয়ে গেলেন? আজ তিনি থাকলে ইতিবৃত্ত অন্যপ্রকার হত। কিছু না হোক নক্ষত্রালোকে ছাদে বসে তাঁরা তিনজনে অলোচনা করতেন রাজনীতি, মানবনীতি।
কানন পার হয়ে নক্ষত্রালোকিত প্রান্তরে পড়লেন তিষ্য। একটি তীক্ষ্ণ ছুরিকা পেছন থেকে এসে আমূল বিঁধে গেল তাঁর পিঠের বাঁদিকে। পুষ্পিত বকুলের তলায় তিষ্য পড়ে গেলেন। একটি আর্তনাদের শব্দও মুখ থেকে বেরল না। এমনই নিপুণতা ঘাতকের। শুধু তরুতলে ঝরা বকুলগুলি গাঢ় রক্তে রাঙিয়ে যেতে থাকল।
অচিরবতীর শুষ্ক খাত। শিবিরের পর শিবির পড়েছে। রথ, হাতি, ঘোড়া, গো-শকট। শাক্যদের শিশু-বৃদ্ধ-নারীদের গরম রক্তে হাত ধুয়ে প্রতিহিংসার শপথ পূর্ণ করেছে বিরূঢ়ক। শিবিরে শান্তিঃ। সাবাত্থিতেও একমাত্র পথের কাঁটা যে নির্মূল, সে-সংবাদ পৌঁছে গেছে। হৃদয়ে শান্তির ঢল। গভীর রাতে গাঢ় কল্লোল জাগে। সুখশয্যায় পাশ ফিরতে ফিরতে কুমার ভাবে এ আমার রক্তেরই কল্লোল। বড় আহ্লাদিত রক্তকণাগুলি। বইছে, নিষ্কণ্টক বইছে। অহো কী শান্তিঃ! আর্তনাদ কিসের? অশ্বের হ্রেষা, হাতিদের বৃংহণ? যেন রাত্রি ফাটিয়ে ফেলতে চায়? অচিরবতীর শুষ্ক খাতে ঢল নেমেছে। উজানে বৃষ্টি। মুষলধার। পশুগুলি মুক্ত হবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, শত শত সৈন্য পায়ের তলায় পিষ্ট করে ছুটোছুটি করে। তুমুল বন্যায় বিরূঢ়কের সেনা, রথ, পশু, অস্ত্র, শিবির ভেসে যায়। ফেনিল গর্জন করতে করতে বর্ণময় বস্ত্রগুলি ঊর্ধ্বে তুলে অচিরবতী ছোটে। পাণং ন হানে…পাণং ন হানে…পাণং ন হানে…
এবং মাৎস্যন্যায়ে পূর্ণ অরাজক শ্রাবস্তী নগরী ছেড়ে অবশেষে গান্ধারের দিকেই যাত্রা করেন একাকিনী সোমা। কোলে শিশুপুত্র। সার্থবাহ নন্দিয় যাচ্ছেন উত্তর পথ ধরে। সিন্ধু সৌবীর ঘুরে গান্ধার যাবেন। পার্সরা বহু নতুন পণ্য আনছে, অনেক মূল্য দিয়ে কিনছেও পূর্বাঞ্চলের পণ্য। তাই সার্থ যায়। নন্দিয়র সঙ্গ নিয়েছেন পাঞ্চালপত্নী সোমা। কখনও শকটে, কখনও অশ্বে, কখনও পদব্রজে পথ চলেন। শিশুটিকে সাবধানে নিয়ে চলে রক্ষীরা। চলতে চলতে গান্ধারী ভাবেন—সারাজীবন কি তিনি প্রবাসেই কাটালেন? মধ্যদেশ…এই মধ্যদেশ তাঁকে মুক্তি দিয়েছে, কর্ম দিয়েছে, প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, প্রেম দিয়েছে, শোক দিল মর্মান্তিক বিচ্ছেদের, মর্মান্তিক মৃত্যুর। ব্যাকুল আশঙ্কায় এখন মাতৃভূমির কোলে ফিরছেন তিনি। পার্সপুরীর রাজা ধারদ্বসুর সামন্তরাজ্য এখন গান্ধার। পরপদানত। তা হোক। মা দেবদত্তার নিঃশ্বাস মিশে আছে তক্ষশিলার বাতাসে। পিতা দেবরাতের ভাবনা। যেমন করেই হোক তক্ষশিলার মহাবিদ্যালয়ে পৌঁছতে হবে। আছেন মিত্র অনঘ আঙ্গিরস। নিশ্চয় সাহায্য করবেন। পিতা দেবরাতের স্বভূমিতে বেড়ে উঠুক তাঁর কন্যার বংশ। তিষ্যপুত্র চণক…তার পুত্র চণক…তার পুত্র, তার পুত্র…সোমা চণকের রক্ত এবং স্বপ্ন নিয়ে নতুন গোত্র জন্ম নেবে নাকি? সেই চাণক্য গোত্রসম্ভব কোনও প্রতিভাধর দূর ভবিষ্যতে যদি চণকের স্বাধীনতার স্বপ্ন বুঝতে পারে, যদি বন্ধন মোচন করতে পারে।
২৬
…গৌতম জানেন এই তাঁর শেষ যাত্রা। এই শেষবার বেণুবন, কলণ্ডক নিবাপ, মোর নিবাপ, গিজঝ্কুট, জীবকাম্ববন…এই শেষ। কেউ জানে না। তিনি একা জানেন। রাজগহ পেরিয়ে চলেছেন মেঘের সঙ্গে সমান তালে। অম্বলট্টিকা। পাবারিক অম্ববন। দলে দলে মানুষ আসছে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে একটি নতুন সংঘারামের। পণ্ডিত শ্রেষ্ঠ সারিপুত্তর জন্মস্থান নালকগ্রামের অদূরে এই পাবারিক সংঘারাম।
বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য আমি দীর্ঘ আশি বছর জীবিত রয়েছি? সাধনা করেছি। প্রথমেই মানুষের করণীয় সম্পর্কে সব বুঝে যাইনি। আজ সদ্ধম্ম বলে তোমরা যা জানো তার সবটাই নিমেষের উদ্ভাস নয়। দিনে দিনে তিলে তিলে একে গড়েছি। গড়েছেন এই নালক গ্রামের সারিপুত্ত, যিনি অতি সাধারণ মানুষের মতো রক্তবমন করে মারা গেলেন, গড়েছেন মোগ্গল্লান যিনি ধ্যানরত অবস্থায় নিতান্ত অসহায়ের মতো দস্যুদের হাতে, সম্ভবত অনঙ্গ চণ্ডাল ও তার দলবলের হাতে নিহত হলেন, গড়ছে প্রতিভাবান কিশোর কুমার কাশ্যপ যে মাতৃগর্ভে সঙেঘ এসেছিল, রাজপুরীর সুখে লালিত হয়েও যে এখন অনাগারী, কূট দার্শনিক প্রশ্নের মীমাংসা করছে ছোট থেকে। গড়ে চলেছেন অগ্গসাবিকা খেমা ও উপ্পলবন্না তাঁদের বিশ্বাস দিয়ে, গড়ছে বিসাখা মিগারমাতা তার সংশয় দিয়ে। নালক থেকে পাটুলি যাই তবে? নালক যদি বৌদ্ধবিদ্যার মহাবিদ্যালয় হয় তবে পাটুলি হবে আর্যাবর্তের এক শ্রেষ্ঠ নগরী। শোন হে মগধবাসী, কোনও ঋদ্ধি থেকে বলছি না, বর্ষকার ও সুনীথ যে-দুর্গের পত্তন করেছেন, দেখে এসো, তার সঙ্গে মেলাও তার অবস্থান। আমাকে বুঝতে পারবে। অগ্নি, জল আর অন্তঃকলহ এই তিন ভয় থাকবে এ নগরীর। সাবধান নগরবাসী, সকল ঐশ্বর্যশালী নগরীরই এই তিন ভয় থাকে। বর্ষকার, পূর্বের বিরুদ্ধাচরণের ক্ষতিপূরণ করতেই কি এই দ্বারের নাম দিলে ‘গৌতমদ্বার’? এই ঘাটের নাম দিলে ‘গৌতমঘাট’? তা দাও, কিন্তু সেই সঙ্গে বৈশালীকে পরাজিত করার মন্ত্রটিও তো জেনে নিলে! জেনে নিলে না অনুমতি নিলে? ভেদনীতির কথা কি আর তোমরা জানো না? জানে, লিচ্ছবিরাও জানে, তবু ভুল হয়ে যায়।
—কোটিগ্রাম ছেড়ে চলি নাতিকাগ্রামে। ভিক্ষু সাল্হ, ভিক্ষু সুদত্ত, ভিক্ষুণী নন্দা এই নাতিকাগ্রামের মানুষ। এখন নির্বাণ লাভ করেছেন। না গ্রামবাসীজন, তোমাদের প্রিয়জনদের পারলৌকিক গতি সম্পর্কে কোনও প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না। কেন এ প্রশ্ন করো? অবান্তর। দূরে দেখা যায় আমার বড় প্রিয় বৈশালী নগরী। না ছেটক, কূটাগারশালায় যাব না এখন, আপনাদের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করব না, যাব অম্বপালীর অম্ববন। এসো মা অম্বিকা, তোমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি তো! অম্ববনটি তথাগতকে দেবে? দাও—সম্মতি দিলাম। বিহারে বিহারে ভরে যাক মগধ। চলো ভিক্ষুগণ—স্মৃতি জাগ্রত রাখো। সমাদর, দান, বহু জনসমাগম এসব উদ্ভ্রান্ত করে দেয় চিত্ত। স্মৃতি জাগ্রত রাখো। স্মৃতি…। সম্মা সতি।
বর্ষা আসছে। বেলুব গ্রামে বর্ষাযাপন করলেন গৌতম। জীবনের শেষ বর্ষা! তাই বোধহয় নিয়ে এলো কঠিন আন্ত্রিক পীড়া। নিদারুণ যাতনা।
—ভগবন, এই ব্যাধিই কি আপনার শেষ ব্যাধি? যদি তা-ই হয় ভিক্ষুসংঘকে জানিয়ে যাবেন না?
—কেন আনন্দ? সংঘ আমার কাছ থেকে আর কী প্রত্যাশা করে? যা করণীয় বলে, ধর্ম বলে মনে করেছি সব নিঃশেষে জানিয়ে দিয়েছি, মুষ্টিবদ্ধ তো রাখিনি কিছুই। অতি সরল সহজ, কিন্তু দারুণ কঠিন সেই উৎকৃষ্ট জীবনের দ্বার খোলার সংকেতসূত্র। কঠিন। কিন্তু গোপন, রহস্যময় তো নয়? হে আনন্দ, মনে করো না আমিই তোমাদের পরিচালক, ভেবো না ভিক্ষুসংঘ আমার আশ্রিত। তোমরা নিজেরাই নিজেদের আশ্রয়। আত্মদীপ হও। এ দেহ জরাজীর্ণ। ভাঙা শকটের মতো, এখন একে পরিত্যাগ কারবার সময় এসেছে।
তবে ঋদ্ধিপাদ ব্যক্তি ইচ্ছা করলে আয়ুর সীমা বাড়িয়ে নিতে পারেন। এ কী? এ কথা কেন বললাম? আনন্দ উন্মন? শোনেনি কি? কেন বললাম? বহুজনের বহু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বাকি রয়ে গেল—তাই? মহাকাল তাদের প্রশ্নের উত্তর দিক। সত্যই কি সমাজের প্রভাববলয়ের বাইরে যেতে পারিনি? যদি সমাজের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ স্রোতে যেতাম, যেটুকু সম্পাদিত হয়েছে সেটুকুও হত না, মঝ্ঝিম পন্থা আমার, সর্ব অর্থেই মধ্যম। নারীরা ক্রমে পুরুষের ইচ্ছার দাস হয়ে যাচ্ছে, বর্ণভেদ বাড়ছে। আমার ব্যক্তিগত বিদ্রোহ আমি রেখে গেলাম রাজাকে উপেক্ষা করে নটীর নিমন্ত্রণ নিয়ে জীবনের এই অন্ত্য পর্বে, চণ্ডাল সোপাক, নীচকুলজাত সুনীতকে সংঘে গ্রহণ করে, নহাপিত উপালিকে শ্রেষ্ঠ বিনয়ধরের সম্মান দিয়ে। হে বিরুদ্ধবাদীরা, আমি অন্তর্যামী, আবার অন্তর্যামী নইও। কিছু অনুমান করতে পারি, কিছু পারি না। বিপুল চরিত্ৰজ্ঞান, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আর করুণা দিয়ে পৌঁছতে পারি অনেক সময়েই দ্বন্দ্বের মূলে। সমস্যার মূলে। আমি যেখানে পৌঁছেছি ধ্যানস্তিমিত সেই প্রশান্তির পারাবারে বিক্ষোভ ওঠে না। তবু চেষ্টা করেছি লোকচিত্তের কাছাকাছি থাকতে। লোকভাষায় কথা বলতে।
ডেকো না আনন্দ, আমাকে ডেকো না, আমি এখন সমাধিমগ্ন থাকলেই ভালো থাকি।
বর্ষাকাল শেষ। মহাবনে বহু ভিক্ষু সমবেত হয়েছেন। তাদের তিনি উপদেশ দিলেন: ‘ব্যয়ধম্মা ভিক্খবে সঙ্খারা অপ্পমাদেন সম্পাদেথ’—তোমরা অপ্রমত্ত হয়ে কর্তব্য সম্পাদন করো। ভাণ্ডগ্রাম-ভোগনগর…আনন্দ চৈত্য। এখানে বললেন : যদি কেউ এসে বলে তথাগত এই বলেছিলেন, তথাগত তাই বলেছিলেন তা হলে বিনয়সুত্তের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখবে। জানবে বিনয়ই হল তোমাদের মূলশাস্ত্র! এবার মল্লভূমি পাবা। ভিক্ষুসংঘ-সহ গৌতম নিমন্ত্রিত চুন্দর আম্রকাননে। কম্মার চুন্দ বহু আয়োজন করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে সূকরমদ্দব নামে একপ্রকার ছত্রাকের ব্যঞ্জন। বুদ্ধ খেয়ে বললেন—চুন্দ, এগুলি আর কাউকে দিও না। মাটিতে পুঁতে ফেলো।
বিষম রোগযন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়লেন তিনি। উপস্থিত সবাইকে বললেন—তথাগত সমস্ত জীবন যা যা খেয়েছেন তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল সুজাতার দেওয়া পরমান্ন যা বোধিলাভের পূর্বাহ্ণে খাই আর চুন্দর দেওয়া এই পাক্কান্ন যা…। ভিক্ষুগণ তোমরা যেন চুন্দকে দোষ দিও না।
অসুস্থ দেহেই তিনি পথ চলতে আরম্ভ করলেন। ক্রমে ককুত্থা নদী পার হয়ে গেল। জলপান করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলেন। মল্লপূত্র পুক্কুস তাঁর শরণ নিল। নদীতে স্নান করে আম্রকুঞ্জে আশ্রয় নিলেন। আবার চলতে থাকেন। হিরণ্যবতীর তীরে কুশিনারা দেখা যায়। পায়ে হেঁটে নদী পার হয়ে মল্লদের শালবন। আর পারেন না। যুগ্মশালের অন্তরালে তাঁর শেষ শয্যা পাতা হল। বৈশাখী পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় বনভূমি প্লাবিত। শালের কুসুম ঝরছে। সিংহ শয়নে শুয়ে গৌতম বললেন—আমার যা সাধ্য তা করেছি হে আনন্দ। পাঁচ সহস্র বছর পরে সদ্ধম্মের প্রভাব যখন লুপ্ত হয়ে যাবে তখন আসবেন আরেক বুদ্ধ—মেত্তেয্য (মৈত্রেয়)।
২৭
শোন ও মহানদীর মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ পাহাড় জঙ্গলময় মালভূমির নানান অঞ্চলে বন কামানো ও জারানো শেষ হয়ে যায়। ছোট গাছপালা ঝোপঝাড় সবই কেটে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরু ছাইয়ের পরত পড়ে গাভিন হয় জমি। পরিষ্কৃত এলাকায় লোহার লকুট দিয়ে গর্ত করে বীজ বুনতে বুনতে আকাশের দিকে তাকান চণক। বৃষ্টি আসছে। বৃষ্টি। নৈর্ঋৃত থেকে অগ্নিকোণে মোড় নিয়ে ছুটে আসছে পরিমিত বৃষ্টিদায়ী ছাই-রঙা মেঘের দল। দেখতে দেখতে ব্যাখ্যাতীত আহ্লাদে ভরে যেতে থাকে মন। ক্রমে শস্য ফলে। চারদিকে আগুনের কুণ্ড জ্বেলে, রেখা টেনে, খুঁট গেড়ে গ্রাম পত্তন হয়। ব্রীহি থেকে ঢেঁকিতে কুটে চাল হয়। সারনায় সারনায় পবিত্র পাকুড় কিংবা শ্যাওড়া গাছের তলায় কালো মোরগ কেটে সূর্যদেবতা সিঙবোঙার পুজো হয়। পুজো হয় গ্রাম-দেবতা বুঢ়ামবুঢ়া বুঢ়ামবুঢ়ির। তাঁর কেশবতী শবরী পত্নী রগ্গা মিশ্রবর্ণের স্বাস্থ্যল সন্তান প্রসব করে। শিশুর শুভজন্ম উপলক্ষে আখারায় আখারায় ধিমি ধিমি চাঙ্গু বাজে। ক্রমে তাঁরা খুঁজে পান স্বর্ণপ্রসূ এক গাঙের অবারিত বেলা। নতুন জনপদ গড়তে গড়তে এগিয়ে যান অপরিমেয় লোহা ও তামার আকরের শিরা চেঁছে নিয়ে, রত্নখনি মাড়িয়ে, তৃণগুলুময় বুরুগুলির ওপর দিয়ে পুবে আরও পুবে! পথে পড়ে প্রাচীন সব সাসান-দিরি। খাড়া খাড়া পাথরগুলি পিতৃপুরুষের চিহ্ন নিয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে। ক্ষণেক দাঁড়ান তিনি। কারা তাঁর পিতর্? তিনি কে? কী যেন তাঁর করার ছিল? মনে পড়ে, পড়ে, পড়ে না। আগুনে টান টান করে সেঁকা চাঙ্গুর ধিমি ধিমি বোল ভেসে আসে। স্তব্ধ কোনও দুপুরে ভূমি চষতে চষতে শোনেন ভিন্ন কিল্লির ভিন্ন পাঢ়ায় ছাগপালক রাখালিয়ার বাঁশের বাঁশি তিরি-লিরি করে বাজছে। উন্মন থেমে দাঁড়ান। মনে পড়ে, পড়ে, পড়ে না। তিনি মিশে যান পারাপারহীন জীবনস্রোতে। বইতে থাকেন পাঁচ হাজার বছর পরেকার কোনও সময়বিন্দুর দিকে। বইতে থাকেন। মৈত্রেয় হবেন বলে।
টীকা
অগ্নিস্টোম—অতি ব্যয়সাধ্য এবং কঠিন এক সোমযাগ।
অচিরবতী—বর্তমান রাপ্তী।
অট্ঠগুরুধম্ম—আটটি নিয়ম যা মেনে নেওয়ার পর মহাপ্রজাবতীর নেতৃত্বে ভিক্ষুণীসংঘ স্থাপিত হয়। ১. ভিক্ষুদের প্রতি সম্ভ্রম দেখাতে হবে। ২. যেখানে ভিক্ষু নেই সেখানে ভিক্ষুণীরা বাস করতে পারবেন না। ৩. সব বিষয়ে ভিক্ষুসংঘের অনুমতি নিয়ে চলতে হবে…ইত্যাদি ইত্যাদি।
অট্টালক—Watch-tower
অঙ্কধাত্রী—ধাত্রী তখন নানারকম হত, মেয়েদের এটি একটি বহুপ্রচলিত জীবিকা। অঙ্কধাত্রী শিশুকে কোলে নিয়ে যত্ন করবে, স্তন্যধাত্রী—দুধ-মা, মালধাত্রী বা মণ্ডনধাত্রী পোশাক পরিচ্ছদের ভার নেবে, ক্রীড়াপনিক ধাত্রী—শিশুর সঙ্গে খেলবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
অনাগামি—বৌদ্ধ ধর্মে শ্রাবকদের চার শ্রেণীতে ভাগ করা হত। সোতাপন্ন—তিনটি বন্ধন নাশ করলে, সকদাগামি—আর দুটি বন্ধন কাম-ক্রোধ নাশ হলে, অনাগামি—এই পাঁচটি বন্ধন সম্পূর্ণ ক্ষয় হলে, তারপর আরও পাঁচটি বন্ধন নাশ হলে হয় অর্হন।
অবীচি—বৌদ্ধশাস্ত্রের অষ্ট নরকের অষ্টমতম।
অরুর্মুখ—লালমুখো। কৌষিতকী উপনিষদে আছে ইন্দ্র বলছেন: অরুর্মুখান্ যতীন সালাবৃকেভ্যঃ প্রাযচ্ছম—অর্থাৎ আমি লালমুখো মুনিদের সালাবৃক (হায়েনা বা নেকড়ে)দের মুখে দিয়েছি, অর্থাৎ ভক্ষণ করিয়েছি।
আজানেয় অশ্ব—Throughbred horse
অসুর—আসিরীয়
আবুস—সমপর্যায়ের ব্যক্তিকে সম্বোধন।
আর্য—অর্থ—noble man. পরে জাতিবাচক অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। এঁরা ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করে দ্রাবিড় সভ্যতা ধ্বংস করে সিন্ধুর তীরে বসবাস শুরু করেন। এমন ঐতিহাসিক মত। তবে প্রশ্নটি এখনও গবেষণাধীন।
ইন্দ্রকীল—নগরতোরণের সামনে সুদৃঢ় স্তম্ভ, যাতে হাতি এসে সোজাসুজি ধাক্কা মারতে না পারে।
উদকশুদ্ধিক—বিশেষ নদী বা দিঘির জলে স্নান করলে পাপ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে এমন বিশ্বাস যার। অনুরূপ শ্মশানশুদ্ধিক, নামসিদ্ধিক।
উপসয়—উপাশ্রয়। ভিক্ষুসংঘের কাছাকাছি ভিক্ষুণীদের থাকবার জায়গা।
উপায়কুশল—resourceful
কম্মারগাম—কর্মকারগ্রাম—কর্মকারদের পল্লীও হতে পারে, আবার একটি পুরো গ্রাম শুধু কর্মকারদের বসতি এমনও হতে পারে। তুলনীয়—লোণকারগাম, বর্ধকিগাম…
কর্মান্ত—estate বা factory
কর্মস্থান—ধ্যানের বিষয়, বুদ্ধ ভিক্ষুদের ধ্যানের বিষয় বলে দিতেন তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী।
কামানো ও জারানো—বন কেটে জ্বালিয়ে চাষের জমি প্রস্তুতের আদিবাসী পদ্ধতি। জুম চাষ।
ককায়বন্ধন—কোমরবন্ধ। বেল্ট, ভিক্ষুদের পোশাকের অঙ্গ।
কাষ্ঠকুট্ট—কাঠঠোকরা পাখি
কার্ষাপন—পালি কহাপন > কাহন। স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র তিন ধাতুরই হত এই মুদ্রা।
কিলিঞ্জক—মাদুর।
কিল্লি—গোত্র।
কুম্ভথুনিক—হাঁড়ি-বাজিয়ে।
কূটাগার—চিলেকোঠা
কুরুস—পারস্যরাজ Cyrus (558-530) B.C); ইনি পুব দিকে গাণ্ডারাইটিস জয় করেছিলেন এমন অনুমান আছে। সম্ভবত ইরান (পারস্য) ও ভারতের সীমান্ত প্রদেশ তিনি জয় করেছিলেন। এবং সেখান থেকে কর আদায় করতেন। এই গাণ্ডারাইটিসই গান্ধার হতে পারে। নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না।
কুলপুত্র—ভদ্রলোকের ছেলে।
কুলপতি—দশ হাজার ছাত্র যাঁর তেমন আচার্যকে কুলপতি বলা হত। Universityর Vice-Chanceller?
কেতুকাম্যতা—ambition
কোমারভচ্চ—কৌমারবৎস, শিশু-চিকিৎসক। জীবকের উপাধি ছিল, কিন্তু তিনি সবার চিকিৎসাই করতেন।
খজ্জ—শুকনো খাবার > খাজা।
গহপতি—সংস্কৃত গৃহপতি। সাধারণভাবে সম্পন্ন গৃহস্থকেই বোঝাতো। কিন্তু বিশেষার্থে বুদ্ধযুগে বণিকদের বোঝাত। শুধু বৈশ্য নয়, ব্রাক্ষণ বা ক্ষত্রিয় গহপতিরও উল্লেখ পাওয়া যায়।
গান্ধারদেশ—বর্তমান পেশোয়ার (পুরুষপুর) ও রাওয়ালপিণ্ডি। রাজধানী তক্ষশিলায় প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। গান্ধাররাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল কাশ্মীরও।
চত্তার আর্যসচ্চ—চতুরার্যসত্য—দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ বাসনা, বাসনা নিবৃত্তি করেই মানুষ দুঃখ থেকে মুক্তি পাবে, বাসনা নাশের উপায় হচ্ছে অষ্টাঙ্গিক মার্গ।
সোমযাগ—সোমরস আহুতি দেওয়া হয় এমন ব্যয়সাধ্য কঠিন যজ্ঞ। ব্রাহ্মণদের জীবনে একবার করতেই হত।
চাঙ্গু—ধামসা জাতীয় পশুচর্মের বাজনা।
চতুর্মাসা—আষাঢ়ি পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত চারমাস বৌদ্ধরা বাস করতেন।
চেল—বস্ত্রখণ্ড বা প্রান্ত, রুমালের মতো ওড়ানো হত।
ছন্দ—বেদের ভাষা ও ছন্দ
ছয় তীর্থংকর—১. অজিত-কেশকম্বলী—নাস্তিক, চার্বাকের মতো। ২. মস্করী গোশাল—বা মকখালি গোসাল—নিয়তিবাদ মানতেন। অর্থাৎ ভালো-মন্দ কিছুতেই কিছু হয় না। সংসারের সবগুলি চক্রের ভেতর দিয়ে যাবার পরই দুঃখের অন্ত হবে। ৩। পুরণ কাশ্যপ, বা পূরণ কাস্সপ পাপ-পুণ্য বলে কিছু নেই, কর্মফল নেই—অক্রিয়বাদী। ৪. নির্গ্রন্থ জ্ঞাতপুত্র বা নিগ্গণ্ঠ নাতপুত্ত—মহাবীর নামে পরিচিত। চাতুর্যাম ও তপস্যার দ্বারা বিগতজন্মসমূহের পাপ ক্ষয় করা সম্ভব—এই ছিল এঁর মত। ৫. প্রক্রুধ কাত্যায়ন পকুধ। কচ্চায়ন—অন্যোন্যবাদী। পৃথিবী, জলবায়ু, তেজ, সুখ দুঃখ ও জীবন অচল ও কূটস্থ পদার্থ। এদের কেউ নষ্ট করতে পারে না। ৬। সঞ্জয় বৈরট্টিপুত্র— বা বেলট্ঠিপুত্ত—ইনি বিক্ষেপবাদী। অজ্ঞেয়বাদী বলা যায়।
ছোটিকা—তুড়ি।
ঠারে—কাছে, আপন করে।
দর্শযাগ—প্রতি অমাবস্যায় করণীয় যাগ।
দহর ভিক্ষু—অল্পবয়স্ক ভিক্ষু।
দ্বিজ—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য তিন বর্ণই উপনয়নান্তে উপবীত ধারণ করত, ও দ্বিজ আখ্যা পেত।
ধর্মনাটক—নিঃসন্তান রাজা প্রথমে দাসীদের, পরে অপ্রধান রাণীদের। তারপরে অগ্রমহিষীদেরও অবরোধের বাইরে ছেড়ে দিতেন। ইচ্ছে মতো বিচরণ করে সন্তানসম্ভবা হয়ে আসবার জন্য।
ধারদ্বসু—দরায়ুস, দরায়বৌস, পারস্যরাজ (522-486 B.C.) আনুমানিক 518 B.C.-র মধ্যে উত্তর পাঞ্জাব অর্থাৎ গান্ধারের কিছু অংশ অধিকার করেন। তাঁর পার্সিপোলিস লেখতে (520-518 B.C.) গান্ধার এবং সিন্ধু উভয়েরই উল্লেখ আছে। ৩৬০ ট্যালেন্ট সোনা তিনি রাজস্ব হিসেবে আদায় করতেন। অজাতশত্রুর রাজত্বকালেই কোনও সময়ে এই ঘটনা ঘটে। দরায়ুস কীভাবে বিজিত প্রদেশ শাসন করতেন জানা যায় না।
নবকম্মকুটির—ভিক্ষুণীদের নির্জনবাস ও ধ্যানের জন্য ছোট কুটির।
নলপট্টিকা—পাটি, একরকম মাদুর।
নিগমগ্রাম—বাজার হাট আছে এমন গ্রাম। গঞ্জ।
নিয়োগপ্রথা—সন্তান না হলে স্বামীর অনুমতিক্রমে ভিন্ন পুরুষের ঔরসে গর্ভধারণ। পঞ্চপাণ্ডব যেভাবে জন্মেছিলেন।
পঞ্চকল্যাণী—চুল সুন্দর (কেশকল্যাণী), দাঁত সুন্দর (অস্থিকল্যাণী)। গড়ন সুন্দর (মাংসকল্যাণী) ত্বক সুন্দর (ছবি কল্যাণী) ও চিরযুবতী (বয়ঃ কল্যাণী) কন্যা।
পঞ্চরাজচিহ্ন—খড়্গ, ছত্র, উষ্ণীষ, পাদুকা ও চামর।
পর্ণ—শাক।
পরিবৃত্তী—রাজাদের চারজন বৈধপত্নী থাকতা—মহিষী, বাবাতা, পরিবৃত্তী ও পলাগালী। মহিষী সম্মানে শ্রেষ্ঠ, বাবাতা প্রিয়া, পরিবৃত্তী পুত্রহীনা, ইনি ও পালাগলী—একেবারেই দুয়োরানী।
পরিস্রাবণ—ছাঁকনি, ভিক্ষুদের ব্যবহার্য।
পাণং হানে—প্রাণী বধ করো না। বুদ্ধোক্ত পঞ্চ শীলের প্রথমটি।
পার্স—পারসিক।
পুণ্যশিষ্য —Charity Scholar
পূর্ণমাস যাগ—প্রতি পূর্ণিমায় করণীয় যাগ।
পোষধ—পালি উপোসথ > উপোস। প্রতি পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় পালনীয় ছিল। শুধু বৌদ্ধদের নয়, ধর্মপ্রাণ অন্য মানুষদেরও। কিন্তু পোষধ হচ্ছে সংযম পালন। অনাহারে থাকা নয়।
বাসি—ছোট ক্ষুর।
বাহাসিঁদড়ি—মাটি, ভূমি, বসুন্ধরা।
ব্যক্তিমায়া—Charisina
বির—অরণ্য।
বুঢ়ামবুঢ়া বুঢ়ামবুঢ়ি—জুয়াঙ্গদের গ্রামদেবতা।
বেগাবেগি—তাড়াতাড়ি
ব্রীহি—ধান—দ্রাবিড় শব্দ।
মজাঙ্—মাচাং—গ্রামের প্রথমে একটি বড় ঘর যেখানে যুবকেরা রাত কাটায়। নাচ গান এরই চাতালে হয়। অতিথি এলে এখানেই থাকে।
মহানসী—রান্নার যোগাড়ে
মাণ্ডলিক রাজা—সার্বভৌম রাজার অধীনে কোনও অঞ্চলের রাজা।
রজ্জুক—Surveyor.
লকুট—ধাতুর খন্তা।
শম্বোষ্ঠী —মোটা-ঠোঁট অলা
শাক—তরি-তরকারি
সম্মা সতি—সম্যক স্মৃতি, ধারণা ঠিক রাখা, অষ্টাঙ্গিক মার্গের অন্যতম।
সারনা—পবিত্র বৃক্ষ সম্বলিত স্থান।
সুমের—বর্তমান ইরাক।
সৌভঞ্জন—সজনে
হড়—মানুষ।
যেসব গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি:
1. Political History of Ancient India : H.C. Ray Chaudhuri.
2. The Age of Imperial Unity : History and Culture of the Indian People, Vol. II by Bharatiya Vidya Bhavan.
3. The Vedic Age :,, Vol I
4. Buddhist India : T.W. Rhys Davids
5. Social Organisation in North-East India in Buddha’s Time : Richard Fick
6. Society at the Time of Buddha : Narendra K. Wagle
7. Genesis of Buddhism—Its social Content : Dr. Bratindranath Mukherjee
8. Studies in the Buddhist Jatakas : B.C.Sen.
9. Buddhist Legends : 6 Vol. E.W.Burlingame
10. Tribal Life of India : Nirmal Kumar Bose
11. Introduction to Ancient Indian History and Culture : D.D.Kosambi
12. জাতক—ছয় খণ্ড-অনুবাদ : ঈশানচন্দ্র ঘোষ
13. কৌটলীয় অর্থশাস্ত্র—দুই খণ্ড—,, : ডাঃ রাধাগোবিন্দ বসাক
14. ধম্মপদ,, : নারদ মহাথের
15. উপনিষৎ প্রসঙ্গ ৫ম—অনুবাদ—,, কৌষিতকী : শ্রীমৎ অনির্বাণ
16. থেরী গাথা—অনুবাদ : ভিক্ষু শীলভদ্র
17. মিলিন্দ-প্রশ্ন,, : শ্রীমৎ ধমাধার মহাস্থবির
18. বুদ্ধ কথা : ডঃ অমূল্যচন্দ্র সেন
19. ভগবান বুদ্ধ : ধৰ্মানন্দ কোসাম্বি
20 তথাগত বুদ্ধ : শান্তিপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়
21. বৌদ্ধ ধর্ম : সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
22. দর্শন দিগ্দর্শন : রাহুল সাংকৃত্যায়ন
23. যজ্ঞ কথা : রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
24. বেদের কবিতা : গৌরী ধর্মপাল
25. প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য : ড. সুকুমারী ভট্টাচার্য
26. পালি সাহিত্যে নারী : ডঃ বাণী চট্টোপাধ্যায়
27. প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে : ডঃ রণবীর চক্রবর্তী
28. বাংলার ইতিহাস : ডঃ নীহাররঞ্জন রায়
29. বিজ্ঞানের ইতিহাস—১ম খণ্ড : সমরেন্দ্রনাথ সেন
30. বৌদ্ধযুগের ভূগোল : ডঃ বিমলাচরণ লাহা
31. প্রাচীন ভারতের পথপরিচয় : গৌরাঙ্গগোপাল সেনগুপ্ত
32. হিন্দুসমাজের গড়ন : নির্মলকুমার বসু
33. সায়ণ মাধবীয় সর্বদর্শন সংগ্রহ : সত্যজ্যোতি চক্রবর্তী।