2 of 3

২.২৪ Who can go out without using the door

Who can go out without using the door?
Why, then, does no one follow this way?

একটা খাট তো কিনতে হবে। কিছু ফুল। কয়েক প্যাকেট ধূপ। আবার কাধ দেবার জন্যেও তো কয়েকজনকে চাই। একা তো পারব না। ভীষণ অসহায় বোধ করছি। আশ্চর্য করে দিলেন মেনিদা। পাড়ার কেউ না, এগিয়ে এলেন তিনিই। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তার তিন ছেলেকে।

মৃদু হেসে বললেন, অবাক হচ্ছ? সন্দেহ হচ্ছে, তাই না? ভাবছ আমার মতো একটা ইতর লোক আবার কী মতলবে এসেছে! কোনও মতলব নেই পিন্টুচন্দ্র। আমি নির্ভেজাল এক বাঙালি। জানো। তো, বাঙালির কান বড় হয়। পরের কথা শুনতে ভালবাসে। বাঙালির জিভ চেরা হয়। সাপের মতো ছোবল মারতে পছন্দ করে। কিন্তু বাবা হৃদয়টা খুব নরম হয়। আর একটা কী গুণ বলো তো? বিস্মৃতিপ্রবণ। ভুলে যায়। মনে রাখে না কিছু। তুমি আমাকে চড় মেরেছিলে। ভুলে গেছি। মনে। রাখিনি। কেন এসেছি জানো? তোমার পিতামহ ছিলেন আমার শিক্ষক। তাকে ভোলা যায় না। তার নখের যোগ্য তোমরা হতে পারোনি। আর ওই যে দেখছ আমার তিনটে দামড়া, ওদের আমি মানুষ করতে পারিনি, কিন্তু অমানুষ করতে পেরেছি। একালের মানুষের ডেফিনিশন কী জানেন? যে যার সে। তার। কেউ কারও নয়। মানুষ হলে, ওরা আমার কথায় ওঠ-বোস করত না। তোমার জন্যে ছুটেও আসত না। বক্তৃতাটা একটু লম্বা হয়ে গেল। এটাও বাঙালির লক্ষণ। কাজ কম, কথা বেশি। দাও, ওদের এখন টাকাপয়সা বুঝিয়ে দাও। সব কিনে আনুক। তোমার ভয় নেই, পাইপয়সার হিসেব বুঝিয়ে দেবে। পকেটে নিয়ে বেরিয়েছ তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

বুদ্ধিমান ছেলে তুমি।

কত লাগবে বলে মনে হয়?

শ’দুয়েক ছেড়ে দাও। অত লাগবে না। তবু কাছে থাক।

ছেলে তিনটিকে এখন আর মোটেই খারাপ লাগছে না। অথচ এরাই একদিন মুকুকে লক্ষ করে অশ্লীল কথা বলেছিল। আমাকে একদিন রাস্তায় ধরে শাসিয়েছিল। বলেছিল, আমার খোলনলচে আলাদা করে দেবে। দাঁতগুলো খুলে মালা করে আমার গলায় পরিয়ে দেবে। যা হবার তা হয়ে গেছে। এরা এখন সম্পূর্ণ অন্য চরিত্র। দুশো টাকা নিয়ে তারা চলে গেল। মন এমনই এক জিনিস, বারেকের জন্য সন্দেহ খেলে গেল, কেটে পড়বে না তো!

অক্ষয় কাকাবাবু অফিসারের ঘরে গিয়ে বসেছেন। ছেচল্লিশের দাঙ্গার কথা হচ্ছে। সুরাবর্দি সরকারের কেচ্ছা চলেছে নতুন করে। থানার পাশেই চায়ের দোকান। মেনিদা আর আমি বসে আছি। পাশাপাশি। জিজ্ঞেস করলুম, চা খাবেন?

তুমি খাবে?

তা একটু খেতে পারি।

চায়ের অর্ডার দিলুম দু’গেলাস। মেনিদা হঠাৎ বললেন, মানুষ কেন এমন হয় বলো তো?

কীরকম বলুন তো?

এই আমার মতো। জটিলে কুটিলে টাইপ। সবাই ঘেন্না করে, সন্দেহ করে। দুরদুর করে। মানে অধমেরও অধম। অথচ দেখো লেখাপড়া শিখেছি। সারাজীবন ভাল চাকরি করেছি। দেশবিদেশ ঘুরেছি। কেন এমন হয়? রক্তের দোষ। তাই না?

কী করে বলি বলুন? আমার তো তেমন জ্ঞান নেই।

দেখো সংসার করেছি। এতগুলো ছেলেমেয়ে, তবু কিন্তু কাম গেল না। আড়ে আড়ে তাকাই। ঘেঁকছোঁক করি। অসভ্যতার চূড়ান্ত। যেন হেগো রুগি। আমার মতো জ্ঞানপাপীকে তুমি কী বলবে? যেখানে যখন গেছি সেইখানেই একটা কেলেঙ্কারি বাধিয়ে বসেছি। তোমার বউদি তো আমাকে সারাজীবন উঠতে ঝাটা বসতে কোস্তা মেরে এল। এখন তো ফিরেও তাকায় না। বলে, আমি নাকি তাকে উঁটার মতো সারাজীবন চিবিয়েছি!

চা এসে গেল। মেনিদা এক চুমুক খেয়ে আঃ করে একটা প্রকাণ্ড শব্দ করলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, একে বলে পরিতৃপ্তির শব্দ। একধরনের অসভ্যতা। কী আর করা যাবে বলো, যার যেমন স্বভাব।

হঠাৎ আমার সন্দেহ হল, সাহস করে জিজ্ঞেস করলুম, আপনি কি কিছু খেয়েছেন আজ?

মেনিদা লাজুক লাজুক হেসে বললেন, এক ডেলা মোদক।

মোদক আবার কী?

সে কী! এত বড় ছেলে তুমি, মোক কাকে বলে জানো না? ভেরি পাওয়ারফুল অ্যাফ্রোডিসিয়াক। বুড়োরা খায়। খেলে শক্তি খুব বাড়ে। যৌবনশক্তি। বিজ্ঞাপন দেখোনি? মদনানন্দ মোক। কবিরাজি দাওয়াই। সিদ্দির অংশই বেশি। ভীষণ টেস্টফুল।

আপনি এইসব খান কেন?

খাব না? যৌবন চলে যাবে, আর আমি বসে বসে দেখব হেপলেস হয়ে। আমার থিয়োরি, যতদিন দেহ, ততদিন ভোগ।

তা হলে সকালে হরিনাম করেন কেন?

বাঃ, পাপীদের জন্যই তো মহানামের বিধান। রাতে পাপ করি, সকালে ইরেজার দিয়ে ইরেজ করি। পাপও হল না, পুণ্যও হল না। নিউট্রাল। মেনি মেনিই রইল। না হুলো, না পুষি!

মোদকের নেশায় আত্মবিশ্লেষণ হচ্ছে। তার মানে এই নয় যে মানুষটির চরিত্র বদলাচ্ছে। কুকুরের বাঁকা লেজ কি সোজা হয়! গঙ্গায় স্নানে নামলে, পাপ দেহ ছেড়ে গাছের ডালে উঠে বসে থাকে। স্নান সেরে ওঠামাত্রই ঝুপঝাঁপ লাফিয়ে পড়ে ঘাড়ে।

মেনিদার ফ্লো এসে গেছে, এই দেখো না আমার কেমন রেপুটেশন! আমি খুব ভাল মনেই প্রতিবেশীর বউকে হয়তো জিজ্ঞেস করলুম, বউমা, ছেলে কেমন আছে গো? সে অমনি ফোঁস করে। উঠবে, কেন বলুন তো? আপনার বুঝি ঘুম হচ্ছে না? তারপরেই রটিয়ে দেবে–আমি কোনও কু প্রস্তাব দিয়েছি। আচ্ছা জ্বালা বাবা!

যখন জানেনই, আপনার ওই আদিখ্যেতার কী দরকার?

বাঃ, বেশ বললে যা হোক। প্রতিবেশী হয়ে প্রতিবেশীর খবর নোব না! বেশ করব নোব। তাতে তোমার কী?

তা হলে বদনাম হোক।

হবেই তো। এর মধ্যে একটা-দুটো কেস তো অন্যরকম আছে। কেউ না-জানুক আমি তো জানি। আমার চরিত্র তো ধোয়া তুলসীপাতা নয়। জীবনভর অনেক কেচ্ছাই তো করেছি।

আচ্ছা এইসব কথা আপনি আমাকে কেন শোনাচ্ছেন?

তুমি ভাল শ্রোতা বলে। তোমারও তো জানা উচিত মানুষের সংসারে কতরকম পাপ আছে। মানুষ কীভাবে তিলে তিলে নিজেকে দগ্ধ করে! চিরটা কাল নাবালক হয়ে থাকবে নাকি! জীবনে অনুশোচনারও প্রয়োজন আছে। সাপ ছোবল মারে বলেই মানুষ সাপ থেকে সাবধান হয়। সাপ আর পাপ এক জিনিস। শোনো, জ্ঞানপাপীর নাম জানো?

সে আবার কে?

এই যে তোমার পাশে বসে আছে। নাম তার মেনি। অনেক আগে পড়েছিলুম, এখনও মনে আছে। কী সুন্দর কথা দেখো, In his errors a man is true to type. Observe the errors and you will know the man. আমাকে চিনতে তোমার কোনওদিন অসুবিধে হবে না, কারণ আমার অপকর্ম। কিন্তু ভায়া, তুমি নিজেকে কোনওদিন চিনতে পারবে না। এ এক মজার কল। আমারই আমি অথচ আমিই চিনি না। আচ্ছা গ্যাড়াকল শালা!

মেনিদা মেয়েলি গলায় গান ধরলেন, কথা কয় রে দেখা দেয় না/ নড়ে চড়ে হাতের কাছে/ খুঁজলে জনম-ভর মেলে না/ খুঁজি তারে আসমান-জমি/ আমারে চিনিনে আমি/ একী বিষম ভুলে ভ্রমি/ আমি কোন জন, সে কোন জনা।

তাল মারতে গিয়ে গেলাস উলটে গেল। ভাগ্য ভাল ভাঙেনি। মেনিদা বললেন, একসময় আমি মনোহর সাঁই কীর্তন করতুম। সিল্কের পাঞ্জাবি। গলায় ফুলের মালা। পায়ের ওপর কেঁচা লুটোচ্ছে। এতখানিখানি চুল। কপালে নাকে তিলকসেবা। সে এক ফাটাফাটি কাণ্ড। যাঃ শালা, যৌবনটাই চলে গেল। আবার জন্মব, আবার তবে যৌবন ফেরত পাব। সে এখনও বহুত দেরি। শোনো, যৌবনটাকে প্রপারলি ইউটিলাইজ করো। বড় ক্ষণস্থায়ী। অবশ্য তুমি ঠিকই করছ।

তার মানে?

আবার কেন প্রশ্ন করছ? বুঝতে তো পারছই, অন্যায় তো কিছু নয়, এই তো বয়েস।

এতক্ষণ তো বেশ হচ্ছিল, আবার কেন উলটোপালটা কথা বলছেন?

ওই তো, ওইটাই তো আমার রোগ। পেট-পাতলার মতো মন-পাতলা। চিন্তা লিক করে যায়। ওই রোগেই তো ঘোড়া মরেছে। তবে হ্যাঁ, মেয়েটি একেবারে চোখা, সারের সার। আমার চোখ কেড়েছে। তা হলে বুঝতেই পারছ?

এই কথাটা বলা কি সভ্যতা হল! এখন একটা সত্য কথা বলুন তো, ওরা কি টাকাটা মেরে পালাল?

তুমি কি ওদের অতটাই অসভ্য ভাবো?

দু’হাঁটুর ওপর দুটো হাত টানটান করে রেখে মেনিদা বসে আছেন। মুখে সবসময় যে ভুবনমোহিনী হাসিটি লেগে থাকে সেই হাসি। আমার নিজের মন নিদাঘের প্রান্তরের মতো শূন্যাকার হয়ে আছে বলেই মানুষটিকে এতক্ষণ সহ্য করতে পারছি। সবসময়েই একটা ভয় খেলা করছে, যেন পরীক্ষার ফল বেরোবে। হঠাৎ যদি আইনের প্রভুরা বলে বসেন, না মশাই এটা হত্যা, আত্মহত্যা নয়। গলায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে। হয়ে গেল! কিছুতেই মনকে বোঝাতে পারছি না, তা কেন বলবে! মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, আমিই যেন খুনি। কেসটাকে সেইভাবে যদি সাজায়। মাঝে যে একটা লোভ ঢুকে আছে। একটা হার। গগনের অস্তিত্ব শুধু আমার মনে। সে যে এসেছিল, এমন। কোনও প্রমাণ আমার কাছে নেই। আমার কথা ছাড়া। আমাকে ফাঁসিয়ে কার কী লাভ! সে কি বলা যায়! অক্ষয় কাকাবাবুরও লাভ হতে পারে। ওই বাড়িতে আঁকিয়ে বসে গেলেন হয়তো। জড়িবুটির কারবার করেন। সেইটাই আরও ফলাও হবে। মুকুর ওপর রাগের অনেক কারণ থাকতে পারে। তার একটা হয়তো, মুকুকে তিনি নিজেই একটু নেড়েচেড়ে দেখতে চান। আকর্ষণটাই বিকর্ষণের কারণ। মানুষের মন দুর্গম অরণ্যের মতো। কত জন্তুজানোয়ার যে লুকিয়ে আছে! এমন ঘৃণা দেহবাসনা থেকেই আসে।

মেনিদা বললেন, ভেবে মরছ কেন? আরে আমি তো রয়েছি তোমার সঙ্গে। লোকটা জাতখচ্চর। সে আমি জানি। অনেকদিন পরে একটা গলায়-দড়ি কেস পেয়েছে। চেষ্টা করবে নেংড়াবার। আমিও কাঠপিঁপড়ে। সহজে ছাড়ছি না। লোকটা আমায় হাড়ে হাড়ে চেনে। এই বসেছি, ডেডবডি নিয়ে উঠব। আর এক দলা মোদক মেরে দিই। এক গেলাস চা বলো তো। স্ট্রেংথ কমে আসছে।

হাত চেপে ধরে বললুম, প্লিজ, আর মোদক খাবেন না। চা খান কোনও ক্ষতি নেই।

তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? এ হল মহাদেবের নেশা। ভভম ভভম ববম ভাল/ ঘন বাজে শিঙ্গা ডমরু গাল/ রুদ্ৰতালে তাল দেয় বেতাল/ ভৃঙ্গী নাচে অঙ্গ ভঙ্গিয়া।–বুঝলে? লিঙ্গেশ্বর জেগে ওঠেন।

বিরক্ত হয়ে বললুম, কিছুক্ষণ চুপ করে বসুন না, কথা না বলে।

তা হলেই তোমার যে দুশ্চিন্তা বেড়ে যাবে ভায়া। আমি যে তোমার কারণেই বকরম বকরম করছি গো। এও দেখো মেনির বরাত। যার জন্য চুরি করি সে-ই বলে চোর।

কালো রঙের বিশাল একটা গাড়ি ঝাড়াং ঝাড়াং শব্দ করতে করতে থানার সামনে এসে দাঁড়াল। মেনিদা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন, যাক এসে গেছে।

কিন্তু খাট কোথায়?

ওই তো, আসছে পেছন পেছন। তোমার দুটো দুশ্চিন্তাই দূর হল।

একটু লজ্জাই পেলুম। একটু আগে চোর ভেবেছিলুম। মধ্যবিত্ত বাঙালি তো! সবেতেই সন্দেহ। সকলকেই সন্দেহ। অসম্ভব একটা ব্যস্ততার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললুম। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন কাকাবাবু। আমার ডাক পড়ল। দারোগামশাই বেশ আয়েশ করে বসে আছেন। দুপুরে মাংস খেয়েছেন। দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁচছেন। আর ফুঃ ফুঃ করছেন। এঁর আগের অফিসারের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল। বড় সুন্দর মানুষ ছিলেন তিনি। আমার মামার গানের ভক্ত।

অফিসার বললেন, যাও, লাশ এসে গেছে। বেশি নাড়াচাড়া কোরো না, পেট খুলে মাল বেরিয়ে পড়বে। ওরা কোনওরকমে ট্র্যাক সেলাই দিয়ে ছেড়ে দেয়। যাও নিয়ে গিয়ে চাপিয়ে দাও। কাগজপত্তর সব সই করো। পকেটে টাকা আছে?

ফস করে বেরিয়ে গেল, আবার টাকা?

হেসে বললেন, হ্যাঁ টাকা। অনবরত টাকা। যারা তোমার জন্যে সারাটা দিন এত করল, তাদের একটু মিষ্টিমুখ করাবে না! তিনজন আছে, তিনশো হলেই চলবে।

তিনশোটা টাকা তার হাতে দিতে গেলুম, তিনি ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠলেন, আমাকে না আমাকে না। গাড়ির ড্রাইভারকে।

সব ঝামেলা মেটাতে আধ ঘণ্টার মতো সময় লাগল। দিদিকে নিয়ে এসেছে চট দিয়ে মুড়ে। পাতলা মুখ আরও পাতলা হয়ে গেছে। রংটা কালচে। রক্ত জমে গেছে। দড়ি দিয়ে ঝোলার সময় ঘাড়টা ভেঙে গেছে, লটরপটর করছে। মৃত্যু যেন অদৃশ্য বাঘ। কখন যে ঝাঁপিয়ে পড়বে ঘাড়ে! কেউ জানে না। জানতেও পারে না। চটের রং দেখে আমার ভীষণ ঘেন্না করছিল। রক্তের দাগ। ময়লা। আঁশটে একটা গন্ধ। এই মৃত্যুর মধ্যে কোনও শোভা নেই। পবিত্রতা নেই। জীবন থেকে বেরিয়ে যাবার দরজা দিদি খুঁজে পেয়েছিলেন, তবে সদর দরজা নয়, খিড়কির দোর।

মেনিদার ছেলেরা মেনিদার মতোই। কোনও ঘেন্নাপিত্তি নেই। দু’দিক থেকে দু’জন ধরে ঝপ করে তুলে ফেলল।

আমি বললুম, সাবধান, পেট খুলে যাবে।

একজন বললে, আবার প্যাক করে দেব।

কারও কথাই আমার ভাল লাগছে না। কোথাও কোনও দুঃখ নেই, এক ফোঁটা চোখের জল নেই। একজন মানুষের চিরতরে চলে যাওয়াটা কি কিছুই নয়! চারদিকে চড়া চড়া আলো জ্বলছে। টেলিফোনের কর্কশ বাদ্য। উচ্চকণ্ঠের হ্যালো। জিপগাড়ির স্টার্ট নেওয়ার শব্দ। এ যেন এক ধাতব জান্তব পৃথিবী। হাতকড়ার ক্ল্যাং আওয়াজ। ইউনিফর্মের বিকট গন্ধ।

প্রায় একটা বোঝার মতো দিদিকে খাঁটিয়ার ফেলা হল। কোনওরকমে চাপিয়ে দেওয়া হল কিছু ফুল, একটা মালা। সবই আমার হাতের বাইরে চলে গেছে। আমি এক দর্শক মাত্র। তিন জন তিন দিকে। আর একটা কাঁধের দরকার ছিল। সেই কাঁধ আমার। চাপা হরিধ্বনি। দিদি চললেন। এখানে বাঁচতে এসে মরে গেলেন। জীবন খুঁজতে এসে পেয়ে গেলেন মৃত্যুকে। চিরমুক্তি। মেনিদার পকেট থেকে বেরোল করতাল। তিনি আসছেন সবার পেছনে, নাম করতে করতে।

শ্মশানে গিয়ে এক নাটক হয়ে গেল। কাকাবাবু চাইলেন, কোনওরকমে চিতায় তুলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিতে। অনুষ্ঠানাদির কোনও প্রয়োজন নেই। নিজের দোষে মারা গেছেন। পাপী। যেমন কর্ম তেমন ফল। যাবে তো নরকেই, তার আবার অত কী!

মেনিদা রুখে দাঁড়ালেন। মৃত্যু আর আগুন দুটোই মানুষকে পবিত্র করে। প্রথা যা তা পালন করতেই হবে। লেগে গেল দু’জনের ঝটাপটি। কাকাবাবু রেগে একপাশে সরে গেলেন। আমাকে একটু খোঁচা মেরে গেলেন, তোমার দেখছি আপন লোকের অভাব নেই। এখন মনে হচ্ছে আমি উড়ে এসে জুড়ে বসেছি।

এসব এত বাইরের কথা, আমার আর কানে নিতে ইচ্ছে করল না। শ্মশানের পুরোহিত এগিয়ে এলেন। শুরু হল যাবতীয় অনুষ্ঠান আর মন্ত্রপাঠ। চিতা জ্বলে উঠল। কিছু দূরে বটতলায় এসে বসলুম। কাকাবাবু ওপাশে ধ্যানস্থ। আমাদের মুখদর্শন করবেন না তিনি। মনে হল কিছু একটা জপ করছেন। এক এক মানুষের এক এক রকম বিচার। আচরণ।

দিদির লম্বা লম্বা চুল বিদ্যুতের মতো লিকলিকে হয়ে জ্বলে কিছু সূক্ষ্ম ছাই আকাশের দিকে উড়িয়ে দিল। পশ্চিমে গঙ্গা। বাতাস আসছে হুহু করে। ঈশ্বরের কী অপূর্ব খেলা! সংসার ছাড়াবার আগে শ্মশানটা একবার দেখিয়ে দিলেন। মানুষের অনিবার্য পরিণতি দেখছি চোখের সামনে। পুড়ে ঝুল কালো হতে হতে দপ করে জ্বলে ওঠা। এক কিশোর মায়ের চিতাভস্ম গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে গলায় কাছা নিয়ে এগিয়ে আসছে টলতে টলতে। মেনিদার তিন ছেলে সিনেমার গল্প করছে। চিতা জ্বলছে দাউদাউ করে। বিশাল চেহারার এক মানুষ খাটের বাঁশ খুলে নিবে-আসা একটা চিতা দমাস দমাস করে পেটাচ্ছে। আগুনের ফুলকি উড়ছে।

মেনিদা বসে ছিলেন আমার পাশে। শান্তশিষ্ট হয়ে। হঠাৎ ফোঁসফোঁস করে কেঁদে উঠলেন। মাথার ওপর বাতাস কাঁদছে বটের পাতায়। তলায় কাঁদছেন মেনিদা। আমি বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলুম, কাঁদছেন কেন?

কাঁদব না? শ্মশানে কেউ হাসে! তোমার দিদিকে আমি ভালবেসে ফেলেছিলুম।

সে আবার কী? আপনি দেখলেন কবে?

এই তো আজ সকালে। আমার নিজের দিদির কথা মনে পড়ে গেল। এমনি পাতলা পাতলা চেহারা ছিল। চোখা মুখের গড়ন। দেখেই চমকে উঠেছিলুম, এ কে? এই তো আমার দিদি। জানো

তো আমার দিদি মাত্র আঠাশ বছর বয়সে টিবিতে মারা গিয়েছিলেন। আর আমার মহাবিষয়ী কৃপণ বাবা বলেছিলেন, যাক বাবা বিয়ে দেবার খরচটা বেঁচে গেল। সেই বাপের ছেলে আমি। তুমি যে আমাকে চড় মেরেছিলে, বেশ করেছিলে।

কেন আমাকে বারেবারে লজ্জা দিচ্ছেন?

লজ্জা দেবার জন্যে বলিনি। আমার নিজের ওপরে নিজেরই বিশ্রী একটা ঘৃণা এসে গেছে। কবে যে এই স্টেশনে এসে টিকিট কাটব। এ এমন এক স্টেশন যেখান থেকে ট্রেন শুধু ছেড়েই যায়, ফিরে আর আসে না। ওই গানটা আমি কান খাড়া করে শুনি, যেথায় গেলে হারায় সবাই ফেরার ঠিকানা গো, ডাক এসেছে আমার সে দেশ থেকে বিদায় নেব একটিবার শুধু তোমায় দেখে। মেনিদার গলা ধরে এল আবার। মাথা নিচু করলেন। পিঠের দিকটা ফুলছে। হঠাৎ আমার হাতদুটো খামচে ধরে বললেন, জানো, পৃথিবীতে ভালবাসা ছাড়া কিছু নেই। ভালবাসা হিরের চেয়েও দামি। তুমি আমাকে কোহিনুর দিতে চাইলে আমি বলব, ভালবাসা দাও। এ লিটল লাভ। এবারের বাঁচাটা গেঁজিয়ে গেল। পরের বার আসছি একটু ভাল ঘরে। সাত্ত্বিক পিতামাতার সন্তান হয়ে। আমারও দিন আসবে টুডে অর টুমরো।

চিতাটা ভুসভুস করে ধসে গেল। জোনাকির মতো চারপাশে উড়ে গেল একরাশ ফুলকি।

মেনিদা বললেন, যাও, বাকি কাজটা করে এসো।

অনেকক্ষণ একভাবে বসে থাকার ফলে, পায়ে ঝিনঝিন ধরে গেছে। দাঁড়ানোমাত্রই উলটে পড়ে যাচ্ছিলুম। মেনিদা ধরে ফেললেন, সামলে ভাই সামলে।

চিতায় জল ঢালা হল। ধোঁয়ায় সোঁদাসোঁদা গন্ধ। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। এত বছরের বেঁচে থাকা একমুঠো ছাই মাত্র! নাভিটা খুঁজে খুঁজে বের করল মেনিদার বড় ছেলে। একতাল গঙ্গামাটিতে পুরে বললে, চলো, গঙ্গায় ফেলতে হবে।

মাঝরাতের গঙ্গার কী শোভা! যেন তরল মৃত্যু। কুলকুল করে বয়ে চলেছে। কিন্তু অক্ষয় কাকাবাবু কোথায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *