কিন্তু চিরদিনের উল্টো-পাল্টা সুবৰ্ণতা কি সেদিন উল্টো কথা বলেছিল? না ওই কোটি কল্পকালের কথাটাই একবার উচ্চারণ করেছিল?
কে জানে!, তারপরও তো আবার দেখা যাচ্ছে সুবৰ্ণলতা দুঃসহ স্পর্ধায় তার ষোল বছরের আইবুড়ো মেয়েকে বলছে, সুনিমিলকে একবার ডেকে দে তো!
যে ছেলেটা নাকি বাইশ বছরের।…
প্রবোধের নিজের আর সাহস হয় নি, এবার ছেলেকে এসে ধরেছিল, কিন্তু ছেলে মুখের ভঙ্গীতে একটা তাচ্ছিল্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে মুখের ওপর জবাব দিল, আমার দ্বারা হবে-টবে না। আমার কী দরকার? যে যার নিজের ছাগল ল্যাজে কাটবে, আমি বাধা দেবার কে?
তা ও যদি পাগল হয়, সবাইকে তাই হতে হবে?
হবে। পাগলের কাজীর মধ্যে থাকতে হলেই হবে তাই!
ঠিক আছে আমি পরিমলবাবুকেই বলছি গিয়ে।
কী বলবেন?
আগে বলত না, ইদানীং ব্যাপকে আপনি বলছে ভানু।
বলব। আবার কি! প্ৰবোধ ক্রুদ্ধ। গলায় বলে, বলব, তোমার ওই জোয়ান ছেলের এসে এসে আর আমার ওই ধাড়ি ধিঙ্গী মেয়েকে পড়াতে হবে না।
পরিমলবাবু যদি বলেন, নিজের মেয়েকে না সামলে আমায় বলতে এসেছি কেন?
কথাটা প্ৰণিধানযোগ্য, তাই প্ৰবোধ গুম হয়ে যায়, তারপর আবার বলে ওঠে, ঠিক আছে, ওই ছেলেটাকেই শাসিয়ে দিচ্ছি।
ভানু যেন একটা মজা দেখছে এইভাবে বলে, দিতে পারেন। তবে সেখানেও অপমানিত হবার ভয় আছে! এযুগের ছেলে, ওদের গুরু-লঘু জ্ঞানটা ঠিক তো আপনাদের হিসেবমত নয়!
প্ৰবোধের একটা কথা মুখে এসেছিল, সামলে নিয়ে বলে, তবে ওই হারামজাদা মেয়েকেই শায়েস্তা করছি আমি, রোসো। সুনিৰ্মলদার কাছে পড়া করছেন! পড়ে আমার গুষ্টির মাথা উদ্ধার করবেন! কী করবো–শাখের করাতের নিচে পড়ে আছি আমি, নিজের সংসারে চোর, তা নইলে—
তা নইলে কি হতো তা আর বলে না, চলে যায়।
ভানু কেমন একটা ব্যঙ্গমিশ্ৰিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কী ফুটে ওঠে সেই দৃষ্টিতে?
মানুষটা কী অপদাৰ্থ?
যাক, ভানুর দৃষ্টিতে কিছু গেল এল না, সুনির্মলের ওই বকুলকে পড়াতে আসা নিয়ে সংসারে এক ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি করলেন প্রবোধচন্দ্র এবং পদার্থের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সেটি বন্ধ করতেও সমর্থ হলেন। কে জানে কি কলকাঠি নাড়লেন, পরিমলবাবুর স্ত্রী দীর্ঘদিন পরে এ বাড়িতে এলেন, এবং আগুনের সেই চিরন্তন উদাহরণটি নতুন করে আর একবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বললেন– বুঝতাম। যদি মেয়েকে ঘোষাল বামুনের ঘরে দিতে! শুধু শুধু কেন আমার ছেলেটাকে চঞ্চল করা ভাই! একেই তো ছোট থেকে-
সুবৰ্ণ সহসা প্রতিবেশিনীর একটা হাত চেপে ধরে রুদ্ধকণ্ঠে বলে ওঠে, নেবেন আপনি বকুলকে?
ভদ্রমহিলা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলেন, আমি নিতে চাইলেই কি বকুলের বাবা দেবেন? তুমি না হয় আলাভোলা মানুষ, অত ধরবে না, তোমার ছেলেরা? তোমার কর্তা? না ভাই, গৃহবিচ্ছেদ বাধাতে চাই না। আমি। মেয়ে পাহাড় হয়ে উঠেছে, বিয়ে দিয়ে ফেল, আর পড়িয়ে কি হবে? চাকরি করতে তো যাবে না? মনে কিছু কোরো না ভাই, সুনি আর আসবে না।
এরপরও কি সুবর্ণ বলবে, হাঁ, তাকে আসতে হবে!
তা বলা সম্ভব নয়, তবু সেই সুনিৰ্মলকে ধরেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল সুবর্ণ। মাইনে করা মাস্টার ঢুকিয়েছিল বাড়িতে ষোল বছরের মেয়ের জন্যে।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক, কোন এক সরকারী স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন, এখন টিউশনি করে চালাচ্ছেন। চুক্তিপত্রে সই করে ছাত্র-ছাত্রীকে তালিম দেন। অনেক মেয়েই তো প্রাইভেটে পড়ে পরীক্ষা দিচ্ছে আজকাল।
বকুলের জ্যাঠামশায়ের চাইতে বয়েস বেশি, এ মাস্টারকে নিয়ে আর কিছু বলবার আছে?
রাস্তায় দেখার সুযোগ ক্রমশই কমছে, বাড়িতে আসার পাটটাও এই একটা ক্লেদাক্ত আলোড়নে বন্ধ হয়ে গেছে, তবু একসময় দেখা হলো। মৃদু হাসলো বকুল, কি সুনিৰ্মলদা, পেয়েছ খুঁজে নিশ্চিত নিরাপত্তা? টাক মাথা, কুজো পিঠ—
সুনিৰ্মল এদিক-ওদিক তাকিয়ে টুক করে ওর মাথায় একটা টোকা মেরে বলে, পেলাম। ওঁদের জন্যে না হোক, আমার নিজের নিরাপত্তার জন্যেই খুঁজতে হলো!
তোমাদের বাড়িটা তো আমাদের বাড়ির থেকে এক তিলও অগ্রসর নয়, সাহস করেছিলে কি করে তাই ভাবছি! হয়েছ তো এখন জব্দ?
জব্দ আবার কি, ভারি ফাজিল হয়েছিস! বলে চলে যায় তাড়াতাড়ি।
তা জব্দ সে সত্যিই হয় নি। আগে থেকেই আঁটাঘাট বেঁধেছিল।
সুবৰ্ণলতা যখন প্ৰস্তাব করেছিল, তখন সুনিৰ্মল বিপুল পুলক গোপন রেখে আচ্ছা, আসবো সময় করে। এই আহাদী, নভেল পড়াটা একটু কমাস— বলে চলে গেলেও বাড়ি গিয়ে মার কাছে বলেছিল, এই এক হলো ঝ ঞােট! এমন সব অন্যায় অনুরোধ করে বসে মানুষ! ও-বাড়ির খুড়ীমা ডেকেড়ুকে অনুরোধ করে বসলেন কি জানো? রোজ গিয়ে ওই মেয়েটাকে পড়াতে হবে!
বলা বাহুল্য সুনির্মলের মা এতে পুলকিত হলেন না, ক্রুদ্ধই হলেন। বললেন, তার মানে?
মানে আর কি! ঘষাটাচ্ছে তো এখনো থার্ড ক্লাসে। অথচ বুদ্ধি-সুদ্ধি আছে মন্দ নয়। তাই বাসনা, গড়িয়ে-পিটিয়ে সামনের বছরেই প্ৰাইভেটে পাস দেওয়াবেন।
পাস দেওয়াবেন! মেয়েকে পাস দিইয়ে কি চতুর্বর্গ হবে শুনি?
তা কে জানে বাবা! বললেন! কথা এড়াবো কি করে?
কথা এড়াবো কি করে? চমৎকার! কেন— বললেই তো পারতিস আমার এখন এম-এ ক্লাসের পড়া-
বলেছিলাম, বললেন, একটু সময়-টময় করে। মুখের ওপর না করা যায়?
পরিমল-গৃহিণীও এটা স্বীকার করেন। তাই শেষতক বলেছিলেন, বেশ, পাড়াও তো ওর মার সামনে বসে পড়াবে। তাই চলছিল, এটাই জানতেন পরিমল-গিনী। কিন্তু জল অনেকদূর গড়ালো। অতএব রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হলো তাকে, বাষট্টি বছরের গণেশবাবুকে আসন ছেড়ে দিয়ে।
গণেশবাবু সম্পর্কে কী আর আপত্তি তুলবে সুবর্ণর সনাতনী সংসার?
এদিকে তো চতুর্দিকে থেকে রকম রকম খবর আসছে ঝপাঝপ।
সুরাজের ছোট ছেলে বিলেতে ব্যরিস্টারী পড়তে গিয়ে মেম বিয়ে করে এনেছে, সুরাজ সেই ছোটবৌকে সমাদরে ঘরে তুলেছে। বৌ-ছেলের জন্যে আলাদা বাবুর্চি ঢুকেছে বাড়িতে।
এদিকে সুবালা যে সুবালা, সেও নাকি একটা মেয়েকে বারেন্দ্র বামুনের ঘরে বিয়ে দিতে বসেছে, আর অমূল্য বলেছে, ঠিক আছে বাবা, আমায় সবাই যদি জাতে ঠেলে তো বাকি যে কটা পড়ে আছে ওই বারেন্দর-টারেন্দর দেখেই দিয়ে দেব!
এদিকে…
উনিশ বছর বয়েস থেকে হবিষ্যি গিলে আর শুচিবাই করে করে যে মল্লিকার জন্মের শোধ আমাশার ধাত, হাতে-পায়ে হাজা, সেই মল্লিকার নিজের খুড়শ্বশুর ব্রাহ্মধর্ম না নিয়েও বিধবা মেয়ের বিয়ে দলেন।
আত্মীয়রা বলুক বেম্ম করুক পতিত, অগ্নি-নারায়ণ সাক্ষী করেই হলো সে বিয়ে।
তা ছাড়া হরদমই তো পথে-ঘাটে মেয়ে দেখা যাচ্ছে, ট্রামগাড়িতেই যেয়ে উঠে বসছে। মেয়েটুলুর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে মাস্টারনীও বাড়ছে, এই বন্যার মুখে মাস্টার নিয়ে খুঁতখুঁত করে আর
হবে?
তবু শেষ চেষ্টা করেছিল প্ৰবোধ আমার অত পয়সা নেই বলে। সুবর্ণ সংক্ষেপে বলেছে, তোমায় দিতে হবে না। তারপর ঈশ্বর জানেন, সুবৰ্ণ কাকে দিয়ে দুখানা গহনা বিক্রি করে ফেলেছে।
কে জানে গিরি তাঁতিনী এই কাজে সহায় হয়েছে কিনা। বৌদের তো তাই বিশ্বাস। নইলে আজকাল এত আসে। কেন ও?
আচ্ছা প্ৰবোধই বা নিজে কি করছে? এত বড় আইবুড়ো মেয়ে নিয়ে বসে আছে না? কারণ? কারণ ঘরে ঘরে বড় বড় মেয়ে রয়েছে পড়ে, সেই সাহস!