2 of 3

২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি

ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি। এই নদী, এই ছায়াবট
আমাকে ফিরিয়ে দেয় ফেরত চিঠির মতো বিবর্ণ বিকেলে ॥

সবই অদ্ভুত। কোথা থেকে কী হচ্ছে বোঝার উপায় নেই। টাকাটা বেরোল কোথা থেকে? আলমারিতে কাপড়ের ভাজে ছিল না। ছিল রান্নাঘরের তাকে, একটা খালি কৌটোর ভেতরে। কারণটা কী? কে সরিয়েছিল ওখান থেকে এখানে!

মুকু আর আমি দু’জনেই এলিয়ে পড়েছি বারান্দার মেঝেতে। সামনেই বিবর্ণ রেলিং। গাছপাতার আড়ালে আড়ালে ফালি ফালি নীল আকাশ। আমাদের শরীরে আর এক বিন্দু শক্তিও অবশিষ্ট নেই। মনের জোরটাই এখন আমাদের মেরুদণ্ড। আলগা হয়ে গেলেই শুয়ে পড়ব। হরিশঙ্করের ছেলে বলেই বসে আছি। মুকু বসে আছে হরিশঙ্করকে গুরু বলে মানার ফলে। সেই শক্তির নদী থেকে আঁজলাভর তুলে পান করেছে বলে।

দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছি। যেন আকাশ তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আমার মনে যে অনুভূতি খেলা করছে তা বড় অদ্ভুত। যেন আমরা দুজনে স্বামী-স্ত্রী। এইমাত্র আদালতের রায় আমাদের হাতে এসেছে–বিবাহবিচ্ছেদের রায়। একটু পরেই আমাদের সম্পর্ক, সংসার সব ভেঙে যাবে। দুদিনের তরে মিলেছিলুম। দু’দিনের খেলা শেষ।

মুকু বললে, আমার কী মনে হচ্ছে জানো, দিদি ছিলেন এক অসাধারণ চরিত্রের মহিলা। তিনি আমাদের বাঁচাতেই চেয়েছিলেন। গগনকে যখন পাখা দিয়ে পেটাচ্ছিলেন তখন ওই টাকাটা গগনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। টাকাটা গগনই আলমারির তালা ভেঙে হাতিয়েছিল। আর গগনই দিদিকে কায়দা করে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল। আমরা আমাদের বন্ধুকে শত্রু ভেবে কী অন্যায়টাই করে ফেললুম! আর তো তাকে ফেরানো যাবে না।

সদর খোলাই ছিল। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। একজোড়া পা উঠে আসছে ওপরে। প্রথমে টিপ। পেছনে টিপের মা। পা টিপে টিপে দু’জনে এগিয়ে আসছেন। কারও মুখে কোনও কথা নেই। উদ্বেগ-মাখানো মুখ। কোনও শব্দ না করে নিঃশব্দে দু’জনে মুকুর দু’পাশে বসলেন। আমি কোনওরকমে সামান্য একটু হাসি আনার চেষ্টা করলুম। ফল হল উলটো। এতক্ষণের জমাট কান্না গলে বেরিয়ে এল। কিছুতেই আর থামাতে পারলুম না নিজেকে। টিপের মা এগিয়ে এসে আমার কাঁধে একটা হাত রাখলেন। কমলালেবু রঙের শাড়ি। সবে স্নান করেছেন। পিঠে ছড়িয়ে আছে এলো চুল। ছোউ কপালে সিঁদুরের টিপ। চুলের তেলের মিষ্টি গন্ধ। ফরসা হাতে মোটা শাখা। মনে হল আমার মা এসেছেন। তিনি কোনওরকম সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন না। তার নরম ভারী হাত আমার পিঠ বেয়ে নামছে আর উঠছে। আর আমার ভেতরটা ফেটে যাওয়ার মতো হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। শাড়ির আঁচলের একটা কোণ দিয়ে তিনি আমার চোখ মোছাতে লাগলেন। বহুকাল পরে এই প্রবল দুঃখের মুহূর্তে আমি যে স্নেহ পেলাম, তা যেন নদীর মতো। ভোরবেলা মুকুলিত। আম্রকুঞ্জে গেলে যে অনুভূতি হয় সেইরকম এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে আমার মনে। শীতল পূর্ণচন্দ্রের দিকে তাকালে এমন হয়। বহু ক্রোশ হেঁটে ক্লান্ত সন্তান ফিরেছে মায়ের কোলে। মনে হচ্ছে, কোলে মাথা রেখে তলিয়ে যাই গভীর ঘুমে। যেমন করে ঝিনুক তলিয়ে যায় সমুদ্রের অতলে।

এমন একটা নীরব সভা তছনছ হয়ে গেল। মূর্তিমান দৈত্যের মতো উদিত হলেন অক্ষয় কাকাবাবু। এগিয়ে আসতে গিয়ে থমকে গেলেন। এত মেয়ের মাঝে কেন বসে আছি আমি? আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন এক মহিলা। এ তো ভয়ংকর অপরাধ! অক্ষয় কাকাবাবুর হাতে একটা ব্যাগ। ব্যাগটা নতুন। ব্যাগ কিনে বাজার করে ফিরেছেন। কাঁধে একটা নতুন গামছা। কোনও কথা না বলে একপাশ দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন রাগরাগ মুখে।

টিপের মা সরে বসলেন। টিপই প্রথম কথা বললে, আমরা ছুটে এসেছি রান্নাবান্নার ব্যবস্থা দেখতে। এই অবস্থায় তো আপনারা কিছু করতে পারবেন না। উঠুন, চানটান করুন। সকালে চা-টা। কিছু খেয়েছেন?

প্রথমে মনে হল মিথ্যে কথাই বলি। মুকু কিছুই খায়নি, আমি থানায় পাঁচনের মতো এক কাপ চা কোনওরকমে গিলেছি। উত্তর আর আমাকে দিতে হল না। কাকাবাবু গম্ভীর গলায় ডাকলেন, এদিকে উঠে এসো। নষ্ট করার মতো সময় নেই। আসল কাজই বাকি। সারারাত শ্মশানে জাগতে হবে।

টিপের মা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কে উনি?

আমি ফিসফিস করে বললুম, আমার বাবার বন্ধু। আজই হঠাৎ এসেছেন। আসায় খুব উপকার হয়েছে। আমরা তো খুব বিপদে পড়েছিলুম।

আমরা তো কিছুই জানি না। এইমাত্র শুনলুম। শুনেই ছুটে এসেছি। রান্নার ব্যবস্থা করব, আগে একটু চা খাবে?

আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, জানি না। আমরা এখন কাকাবাবুর হাতে।

ওঁকে জিজ্ঞেস করব?

যদি রেগে যান?

রাগবেন কেন?

বউদি উঠে গেলেন। সোজা কাকাবাবুর সামনে গিয়ে পা স্পর্শ করে নমস্কার করলেন। কাকাবাবু আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে হাত তুললেন।

বউদি বললেন, উনুন ধরিয়ে আগে আপনাদের একটু চা করে দিই।

আমি জানি কাকাবাবু চা ভীষণ ভালবাসেন। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, মুখের ভাব নরম হল। প্রশ্ন করলেন, আপনি কে?

আপনি বলবেন না। তুমি বলুন। আমার স্বামী পিন্টুকে ভীষণ ভালবাসেন।

কাকাবাবু বললেন, বুঝেছি। একটু চা হলে মন্দ হয় না। আমি উনুনটা ধরিয়ে দিই।

আমরা থাকতে আপনি উনুন ধরাবেন? আপনি শান্ত হয়ে একটু বসুন। আমরা সব করে দিচ্ছি। রান্নাও আমরা করে দেব।

কাকাবাবু বললেন, ওইখানেই আমি একটু গোলমাল করে রেখেছি, স্বপাক ছাড়া আমি কিছু খেতে পারি না। আমার গুরুর নির্দেশ। একটু আগে থানার দারোগা আমাকে খুব চিকেন মাটনের লোভ দেখাচ্ছিলেন।

বউদি বললেন, স্বপাক খুব ভাল। আমার বাবাও স্বপাকে খান। তবে ভাত ছাড়া তরকারি অন্যের হাতে খাওয়া চলে।

কাকাবাবু এইবার হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, বউমা, রান্না করতে আমার কোনও কষ্ট হয় না। রাঁধতে আমি ভালই বাসি। তুমি চিন্তা কোরো না। তুমি চা করো। বাকিটা আমরাই করে নোব।

কাকাবাবু ইশারায় আমাকে ডেকে ঘরে নিয়ে গেলেন। মুকুর দিকে তাকাচ্ছেনই না। আমার খুব খারাপ লাগছে। সে এমন কী করেছে যে তাকে এইভাবে হেয় করতে হবে। একটা চেয়ারে তিনি বসলেন। আমাকে বললেন, বোসো।

দু’জনেই চুপচাপ বসে রইলুম কিছুক্ষণ। হঠাৎ কাকাবাবু বললেন, তোমার প্ল্যানটা কী?

প্ল্যান মানে?

তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাটা কী?

কোনও উত্তর দিতে পারলুম না। আমার তো কোনও পরিকল্পনাই নেই। ঘটনা যেদিকে নিয়ে যায় ঠেলতে ঠেলতে।

কাকাবাবু বললেন, তোমার পরিকল্পনা হল, ডেস্ট্রাকশন ধ্বংস। তুমি ক্লীব হয়ে যাচ্ছ। মেয়েদের সঙ্গে অষ্টপ্রহর থাকলে পুরুষ ক্রমশ ভেড়া হয়ে যায়। আমার কথা শুনবে?

বলুন।

ওই মেয়েটিকে প্রশ্ন করো, সে এখানে কেন আছে? কীসের জন্যে আছে? একটা যুবক ছেলে একটা যুবতী মেয়ে একসঙ্গে রয়েছে, বাড়িতে তৃতীয় আর কোনও প্রাণী নেই। এ কেমন কথা? এতটা অনাচার, এতটা স্বাধীনতা কি ভাল? তোমার কী মনে হয়?

আমি মনে মনে হাসলুম। ভদ্রলোক কিছুই জানেন না। মুকুর চরিত্র সম্পর্কে মানুষটির কোনও ধারণা নেই। মানুষের চিন্তা বাঁধা রাস্তা ধরেই চলে। সহজ হিসেব, দুই আর দুয়ে চার।

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আপনি কিছু জানেন না।

বলেই চমকে উঠলুম, উত্তরটা বড় উদ্ধত হল। ভয়ংকর অসম্মানজনক। তাই তাড়াতাড়ি যোগ করলুম, মুকুর চরিত্র আমার বাবার চেয়েও কঠোর। সে এখানে আছে, তিনি নেই বলে। আমাকে ধরে রেখেছে, যাতে আমি টলে না যাই।

স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ংকরী বলে একটা প্রবাদ আছে শুনেছ? নিজের সিদ্ধান্ত নিজে করার মতো বয়স তোমার হয়নি? তুমি কি এখনও নাবালক?

কাকাবাবু, ক’টা লোক নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে! পরামর্শ শব্দটা তা হলে আসত না।

মেয়েছেলের পরামর্শ!

কেন মেয়েরা কম কীসের?

জানো, মেয়েদের শাস্ত্রে অধিকার নেই।

কোন শাস্ত্র? সংসার-শাস্ত্রে মেয়েদের দ্বিতীয় আছে? বেদ-বেদান্ত নিয়ে কে মাথা ঘামায় কাকাবাবু?

শোনো, বাঁচতে যদি চাও ওকে বলো ওর জায়গায় ফিরে যেতে, আর তুমি বাড়িতে একটি তালা ঝুলিয়ে কিছুকালের জন্যে সরে পড়ো। তা না হলে বিপদে পড়ে যাবে। চাকরিবাকরি ছেড়ে দিয়েছ?

না ছাড়িনি, তবে ছাড়ব।

ছেড়ে?

দেখা যাক।

আমার ইন্টারফিয়ারেন্স তোমার ঠিক সহ্য হচ্ছে না, তাই না? হরিশঙ্করদার পরামর্শও তোমার পছন্দ হত না। জানো কি তোমার হাতে গার্ডল অফ ভেনাস আছে?

দেখুন জ্যোতিষে আমার তেমন বিশ্বাস নেই। যা আছে তা আছে। যা হবে তা হবে। আমি ভগবানকে বিশ্বাস করি। আত্মসমর্পণে বিশ্বাস করি। যা করার তিনি করবেন। তিনি করছেন।

তা হলে তুমি মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করো, চাকরিবাকরি ছেড়ে উচ্ছন্নে যাও, বিষয়সম্পত্তি বেচে দাও। ঘি আর আগুন পাশাপাশি থাকলে যা হয় তাই হোক। তুমি কি নিজেকে জিতেন্দ্রিয় ভাবো?

আমি জিতেন্দ্রিয় নই। মুকু জিতেন্দ্রিয়।

মেয়েদের তুমি কিছুই চেনো না। যখন ফেলে দেবে তখন আর উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা থাকবে না। তোমার অবস্থা এখন অরক্ষিত সীমান্তের মতো। হুহু করে শত্রু ঢুকছে। রাজত্ব দখল হয়ে গেল বলে।

দেখাই যাক না, আপনার জ্যোতিষী জেতে না আমার আত্মবিশ্বাস!

কাকাবাবু বেশ অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন, বিপদ আর ধ্বংস আসার আগে মানুষ বুদ্ধিভ্রংশ হয়, তোমারও তাই হয়েছে। আমার কথা যখন শুনবেই না, তখন আমারই বা কী দরকার পড়েছে বৃথা সময় নষ্ট করার! আগে তুমি গুরুজনদের ভক্তিশ্রদ্ধা করতে। তোমার সেই ভাবটাও চলে গেছে। কাম এক প্রবল রিপু। তোমাদের এই বয়েসটা তো ভাল নয়, তায় মাথার ওপর কেউ নেই। সোনায় সোহাগা।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন কাকাবাবু। নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, আমার তা হলে এখন কী করা উচিত? যেচে অপমানিত হওয়া, না কি নিজের মানসম্মান গুছিয়ে নিয়ে সরে পড়া!

এইবার আমি একটু ভয় পেয়ে গেলুম। থানার দৃশ্য ভেসে উঠল। সন্ধের সময় ডেডবডি আসবে। ডেলিভারি নিতে হবে। ডেথ সার্টিফিকেট, শ্মশান। দারোগা যদি আবার পাঁচ মারে! একেবারে একা আমি। চারপাশ থেকে হিমশীতল ভয় আমাকে ঘিরে আসছে। এতক্ষণ নেশার ঘোরে তর্ক করছিলুম। অক্ষয় কাকাবাবুর জীবন সন্ন্যাসীর জীবন। নিজের কোনও সংসার নেই। যে-সংসার যখন বিপদে পড়ে ছুটে গিয়ে হাল ধরেন। জীবনের রোজগার সবই পরার্থে। কোনও কিছুর ওপর নির্ভরশীল নন।

আমি উঠে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। বিশাল শরীর। একসময় প্রচণ্ড ব্যায়াম করতেন। তাঁর হাতদুটো ধরে বললুম, ঠিকই বলেছেন, আমার মনে পাপ ঢুকেছে। আপনি যা বলবেন, আমি তাই করব। তর্ক করেছি বলে ক্ষমা চাইছি।

দুকাপ চা নিয়ে টিপ ঢুকছে। আমাদের নাটক থেমে গেল। টিপ চায়ের কাপ হাতে তুলে দিতে দিতে বললে, একেবারে খালি পেটে চা খাবেন? কিছুই যে আর খুঁজে পেলুম না।

কাকাবাবু টিপের মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি বড় ভাল মেয়ে, সর্বসুলক্ষণা। তোমার চন্দ্র তুঙ্গী। তোমার লেখাপড়া খুব ভাল হবে। তোমার মন সরল। সেখানে সবসময় উচ্চ চিন্তা খেলা করবে।

টিপ ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে রইল কাকাবাবুর মুখের দিকে।

কাকাবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, তোমার মা সংসারের লক্ষ্মী। বলশালী মঙ্গল। লটারি পাবার সম্ভাবনা আছে।

টিপ আমতা আমতা করে বললে, মাকে ডাকব?

আজ নয়। একদিন তোমাদের বাড়িতে গিয়ে ভাল করে সব দেখে, যা বলার বলব। শুধু শুনে রাখো, তোমরা দু’জন যেখানে থাকবে, সেই জায়গা স্বর্গ হয়ে থাকবে।

কথা বলতে বলতে কাকাবাবু কেঁদে ফেললেন। এমন আবেগপ্রবণ মানুষ আমি দেখিনি। প্রশ্ন করলুম, কাকাবাবু, আপনি কাঁদছেন কেন?

আনন্দে। ভাল কিছু দেখলে আমার ইমোশন আমি সামলাতে পারি না। এই মেয়েটির চুল দেখেছ, মুখের গড়ন দেখেছ, বাদামের মতো চোখ, ভুরু দেখেছ, হাতের আঙুল দেখেছ, পায়ের পাতা দেখেছ, শরীরের শ্রী দেখেছ? জ্যান্ত সরস্বতী।

কাকাবাবুর চোখে আবার জল এসে গেল। আমার শরীর জ্বলতে লাগল। কাকাবাবুর এই উচ্ছ্বাসের কারণ আমি জানি। আমাকে প্রকারান্তরে জানাতে চাইছেন, তোমার মুকু টিপের পায়ের নখের যোগ্য নয়। টিপের সব ভাল। লক্ষ্মী সরস্বতী কমবাইন্ড। মুকুর সবটাই অলক্ষণের। মুকু অপয়া, টিপ পয়া। তুমি দেখে দেখে এমন এক মেয়ের পাল্লায় পড়লে কেন? এখুনি ওকে বিদায় করো। বেরিয়ে এসে ওর খপ্পর থেকে। সমস্ত তিরই ছোঁড়া হচ্ছে আমাকে লক্ষ্য করে। আমাকে লজ্জা দেবার জন্যে। আমার অপদার্থতা প্রমাণ করার জন্যে। এইসব কায়দা আমার জানা আছে। আমি আর বসতে পারলুম না, ঘরের বাইরে চলে এলুম। এই মানুষটির অদ্ভুত জীবন আমি বুঝতে পারি না। নিজের সংসার ফেলে অন্যের সংসার সামলাতে ছোটেন। অযাচিত উপদেশ দেন সব মানুষকে।

চা শেষ করে কাকাবাবু রান্নায় লেগে গেলেন। মুকুকুটনো কুটে বাটনা বেটে একটু সাহায্য করতে চেয়েছিল। হাঁ হাঁ করে তেড়ে গেলেন, কোনও প্রয়োজন নেই, কোনও প্রয়োজন নেই। কোনও কোনও শাশুড়ি পুত্রবধূকে এইভাবে খেদিয়ে দেন। মুকুকে অপমান করা মানে আমাকেই অপমান করা। মুকু আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকাল। এ-ও সেই চোখ, যে-চোখে দিদি আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, আমি তো তোমারই আশ্রয়ে এসেছিলুম ভাই। তফাত এই, মুকু আমাকে একটা কথাও বললে না। পরিস্থিতির কাছে কীভাবে আমি বিকিয়ে গেছি! কাকাবাবুকে আমি জোর গলায় বলতে পারছি না এ বাড়ি আমার, সংসার আমার, হু আর ইউ! দিদির ডেডবডি আসবে। সৎকারের পরেও ঝামেলা শেষ হবে না। হারের সমস্যা। হার হাড় হয়ে গলায় ফুটে আছে। আমি অসহায়।

মুকু ঘরে গিয়ে সুটকেস গুছোচ্ছে। আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি মাত্র। হয়তো বলতেও চেয়েছিলুম, মুকু, কিছুক্ষণের জন্যে একটু সহ্য করো। মুকু আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিলে। খুবই খারাপ লাগল। আমি যেন একটা পিংপং বল। একবার এ এদিক থেকে মারছে, তো ও ওদিক থেকে। মুকুর অন্তত বোঝা উচিত ছিল, আমি কোন অবস্থার শিকার।

ঘরের বাইরে চলে এলুম। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা আর করব না। এবার যা কিছু ঈশ্বরের সঙ্গে। বিশ্বাস কোনও বুদ্ধিগ্রাহ্য মানসিক অবস্থা নয়। ফেথ ইজ নট ইন্টেলেকচুয়াল। পাহাড় চূড়া থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ মারার মতো একটা সমর্পণ। যা করার তুমি করো। মানুষকে আর তেল দেব না। মানুষের অনেক বাহানা, অনেক বায়নাক্কা। টিপ আর বউদি দু’জনেই এইবার যাবে। মুকুর সঙ্গে দেখা করতে চায়। মুকু ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। দুজনেই মনমরা হয়ে সিঁড়িতে নামছে। টিপ আমার ডান হাতটা ধরে বললে, আমরা আবার আসব।

আমি কোনওরকমে ঘাড়টা নাড়লুম মাত্র। মনের পিত্ত হয়েছে। জীবনটা তেতো লাগছে। সবকিছু অর্থহীন তামাশা। একটু পরেই মুকু বেরিয়ে এল, শাড়িটাড়ি পরে একেবারে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত। হাতে সুটকেস।

আমি পথ আগলে বললুম, চললে কোথায়?

তোমার জানার কোনও প্রয়োজন নেই।

কেন নেই?

তুমি বেশ ভালই জানো, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি?

এই সময় রাগারাগিটা না করলেই নয়?

কেন? এটা কোন সময়?

তোমাকে বোঝাতে হবে? আমার কে আছে বলো?

কেন? তোমার ওই কাকাবাবু আছেন। তোমার সর্বসুলক্ষণা টিপও আছে, তার মা আছে, তুমি নিজে আছ। প্রশ্নটা বরং আমারই করা উচিত নিজেকে। আমার কে আছে?

আমি আছি।

তুমি? তুমি হলে এ যুগের হ্যামলেট। সারাটা জীবন শুধু টু বি অর নট টু বি করে যাও। তুমি হলে নাচের পুতুল। ঝড়ের এঁটো পাতা।

এঁটো পাতা শব্দটা তিরের মতো ফুটল। আমি এঁটো পাতা! হরিশঙ্করের পুত্র আমি। যাও তোমার যেখানে যেতে ইচ্ছে করে সেইখানেই যাও। সারাজীবন অনেকের কাছে অনেক নাকে কেঁদেছি। পায়ে পায়ে ঘোরার চেষ্টা করেছি লেজ-তোলা বেড়ালের মতো। মন দেখার মতো কেউ নেই। সবাই বাইরেটা দেখে। আমার বলতে ইচ্ছে করছিল, মুকু, ভালবাসা বোঝো? তারপরেই মনে হল, প্যানপ্যানে শোনাবে। ভালবাসা শব্দটাই ভালবাসার শত্রু। ভালবাসা একটা ভাবমিশ্রিত, সেবা, সাহচর্য, অবস্থিতি, সহ্যশক্তি। হাত ধরে নীরবে হাঁটা। ওটা বোধের ব্যাপার, বলার নয়।

মুকু নামছে সিঁড়ি দিয়ে। কাঁধের কাছে হাত রেখে কোনওরকমে বললুম, আমাকে ছেড়ে এইভাবে চলে যাচ্ছ মুকু? আমার যে কেউ নেই।

মুকু এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। জল-ভরা দুটি চোখ। পাতলা ঠোঁটদুটি থিরথির করে কাপল কয়েকবার। কোনও বাণী ফুটল না। যেন পাখির ছানা, ওড়ার চেষ্টা করেও উড়তে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *