1 of 2

২.২১ ঢেউটা আনলেন জয়াবতী

ঢেউটা আনলেন জয়াবতী।

সুবৰ্ণলতার সঙ্গে যার চিরকালের সখীত্ব বন্ধন।

নিত্য দেখা হয় তা নয়, চিঠিপত্রের সেতু রচনা করেই যে হৃদয়ের আদানপ্ৰদান বজায় তাও নয়, অথচ আছে সেই বন্ধন অটুট অক্ষয়। সেই শৈশবের মতই নিৰ্মল, উজ্জ্বল, স্নেহ আর সম্ভ্রমের সীমারেখায় সুন্দর।

জয়াবতী এখানে কদাচিৎই আসেন।

যদিও বাপের বাড়িতেই থাকেন অধিকাংশ সময় এবং সে বাড়িটা বড়লোকের বাড়ি, কাজেই তার গতিবিধির উপর যেমন কোনো নিয়ন্ত্রণাদেশের চাপ নেই, তেমনি আসা-যাওয়ার অসুবিধেও নেই, তথাপি  যোগাযোগ রাখার কৃতিত্বটা বরং সুবৰ্ণলতাকেই দিতে হয়। অনেককাল দেখা না হলে সুবৰ্ণই গিয়ে পড়ে এক একদিন জীয়াবতীর বাপের বাড়ি।

প্ৰবোধ এতে মান-অভিমানের প্রশ্ন তুললেও সুবৰ্ণ সেটা গ্রাহ্য করে না। সুবৰ্ণ সে প্রশ্নের উত্তরে বলে, ও এসে হবেটা কি? আমার এই নিরবচ্ছিন্ন সংসারের মধ্যে নিশ্চিন্দি হয়ে দুটো গল্প করবার সময় পায়? এই এটা, এই সেটা, চোদ্দবার উঠছি আর ছুটছি। তার থেকে আমি যে সংসারের দায় থেকে খানিক ছুটি নিয়ে চলে গিয়ে বসি, সেটা অনেক স্বস্তির। ওর তো ওখানে কোন কাজের দায় নেই!… তোমার যদি গাড়িভাড়ার পয়সাটা গায়ে লাগে তো বল, মান-সম্মানের কথা তুলতে এসো না।

কুটুমবাড়ি?

তাতে কি?

আপন-পর নির্ধারণের বাধা সড়ক ধরে কোনোদিনই চলতে পারে না। সুবর্ণ, কাজেই ওকথা বলে লাভ নেই। সামান্য একটা অনুষ্ঠানের সূত্রে মুক্তকেশীর সংসার-পরিজনের পোষা বিড়ালটি পর্যন্ত সুবৰ্গ আপন, আর তার বাইরে দুনিয়ার আর কেউ আপনা হতে পারবে না, এ নিয়মে বিশ্বাসী নয় সুবর্ণ।

কাজেই মন কেমন করলে সুবৰ্ণই গিয়েছে প্ৰবোধের খুঁৎখুঁতেমি উপেক্ষা করে।

কিন্তু ইদানীং বহুকাল বুঝি যায় নি।

তাই জয়াবতীই এলেন একদিন।

উকিল ভাই কোটে যাবার সময় গাড়ি করে এনে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। ফেরার সময় নিয়ে যাবেন!

সুবৰ্ণর দাদাও উকিল, আর তারও নাকি গাড়ি আছে। সুবৰ্ণলতার ছেলেরও গাড়ি আছে। কিন্তু যাক সে কথা। জয়াবতী এলেন, একটা ঢেউ নিয়ে এলেন। সেটাই হচ্ছে আসল কথা।

জয়াবতীরা কয়েকজন দল বেঁধে বদরিকাশ্রম যাচ্ছেন, সুবৰ্ণলতাও চলুক না! বাইরের কেউ নয়, জয়াবতীর দুই বোন, একজন ভাজ আর একটি ননদ। তা সে তো সুবর্ণরও ননদ।

সঙ্গে যাবে বাড়ির এক পুরানো সরকার, আর ওখানকার পাণ্ডা। অতএব দলটা ভালোই।

আর জয়াবতীরও খুব ইচ্ছে হচ্ছে, সুবর্ণ চলুক।

সুবৰ্ণলতার জুরের মত যাচ্ছে কদিন, সুবৰ্ণলতা শুয়েছিল। উঠে বসলো, বললো, হ্যাঁ যাবো।

জয়াবতী হাসলেন, দাঁড়া বাপু! আগে বরের মত নে, তবে দলিলে সই কর। যাব বললেই তো হবে না!

সুবৰ্ণ সংক্ষেপে বলে, হবে। তুমি আমার ব্যবস্থা কর। আর কি কি সঙ্গে নিতে হবে, কত কি লাগবে সেটাও—

মেজ ঠাকুরপো আবার এতদিনের বিরহে চোখে অন্ধকার দেখবে না তো? জয়াবতী হেসে বললেন, তাড়াতাড়ির কিছু নেই, ভেবে-চিন্তে বললেই হবে, এখনো মাসখানেক সময় হাতে আছে।

সুবৰ্ণলতা বলে, ভেবে চিন্তেই বলেছি। ভেবে-ভেবেই মরছিলাম, কোথায় পালাই, তুমি ভগবান হয়ে এলে!

জয়াবতী ভগবান হয়ে এলেন সুবৰ্ণকে দুদিনের জন্যে কোথাও পালাবার জায়গা খুঁজে দিতে। কিন্তু সুবর্ণর ভাগ্যের ভগবান? দুঃসাহসী সুবর্ণ যাকে জিজ্ঞেস না করেই দলিলে সই করে বসলো? সে কি চুপ করে থাকবে?

নাকি আহ্লাদে গলে গিয়ে বলবে, তা বেশ তো! এমন একটা সুযোগ যখন এসেছে, যাও না! যাও নি তো কখনো কোথাও!

তা বললে হয়তো মহত্ত্ব হতো, কিন্তু অন্ত মহৎ হওয়া সবাইয়ের কুষ্ঠীিতে লেখে না। বাড়ি ফিরে খবরটা শুনে উত্তাল হবো প্ৰবোধ, ঢেউটি আনলেন কে? ঢেউটি? ও-বাড়ির গিন্নী? তা তার উপর্যুক্ত কাজই করেছেন, চিরটাকালই তো মনসার মন্দিরে ধুনোর ধোঁয়া দিয়ে এসেছেন তিনি! বলে দিও, যাওয়া সম্ভব হবে না।

সুবৰ্ণ শান্ত গলায় বলে, বলে দিয়েছি। যাব।

বলে দিয়েছ? একেবারে কথা দেওয়া হয়ে গেছে? প্ৰবোধ ক্ষুব্ধ ক্রোধের গলায় বলে, আমি একটা বুড়ো যে আছি বাড়িতে, তা বুঝি মানেই পড়ল না? বলতে পারলে না। না জিজ্ঞেস করে কি করে বলবো?

সুবৰ্ণ অনেকদিন পরে আবার আজ একটু হাসলো, বললো, তা আমিও তো বুড়ো হয়েছি গো! নিজের ব্যাপারে একটা ইচ্ছে-অনিচ্ছে চলবে না, এটাও তো দেখতে খারাপা!

একটা ইচ্ছে-অনিচ্ছে!

প্ৰবোধ যেন মাথায় লাঠি খায়।

একটা ইচ্ছে-অনিচ্ছে? কোন কাজটা না তোমার ইচ্ছেয় হচ্ছে?

সুবৰ্ণ আবারও হাসে, তাই বুঝি? তা হলে তো গোল মিটেই গেল। সবই হচ্ছে, এটাও হবে।

না, না, হবে-টবে না।

প্ৰবোধ যেন ফুঁ দিয়ে তুলোর ফুলকি ওড়ায়।

এই শরীর খারাপ, নিত্য জুরের মতন, এখন চলবেন মরণবাচনের তীর্থে! তীর্থ পালিয়ে যাচ্ছে!

তীৰ্থ পালিয়ে যাচ্ছে না। সত্যি, সুবর্ণমুদু হাসির সঙ্গে বলে, আমি তো পালিয়ে যেতে পারি?

সহজ কথার পর অনেকদিন রুদ্ধ ছিল, হঠাৎ একবার এক অলৌকিক মন্ত্রে খুলে গিয়েছিল সেই বন্ধ দরজা। শ্যামাসুন্দরী দেবীর ছেলে জগন্নাথ চাটুয্যের নিচের তলার একটা স্যাঁতসেতে ঘরে প্রাণ পাচ্ছিল সেই মন্ত্র, তারপরে ভেস্তে গেল সব, মন্ত্র গেল হারিয়ে। আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজা। শুধু আবরণ একটা থাকলো। জ্বরভাব। নিত্যই যদি জ্বরভাব হয় মানুষটার, সহজ ভাব আর আসবে কোথা থেকে?

আজ আবার অনেকদিন পরে হেসে কথা বললো সুবর্ণ, আমি তো পালিয়ে যেতে পারি?

কিন্তু প্ৰবোধ কি এই ছেলেভোলানো কথায় ভুলবে? প্ৰবোধ হাঁ-হাঁ করে উঠবে না? বলবে না, মেজাজ খারাপ করে দিও না মেজবৌ, ওই সব ছাইভস্ম কথা বলে। আমি বলে দিচ্ছি—এই শরীর নিয়ে কোথাও যাওয়া-টাওয়া হবে না তোমার। ভানু কাল কোর্টে নতুন গিন্নীর দাদার কাছে খবরটা দিয়ে আসবে।

তা হয় না— সুবর্ণ বলে, কথা দিয়েছি। শরীর বরং পাহাড়ে-হাওয়ায় ভালই হবে।

ভাল হবে? বললেই হলো? প্ৰবোধ দুপাক ঘুরে হঠাৎ বলে ওঠে, যাব বলছো মানে? বড়বৌমার ছেলে।পুলে হবে না?

সুবৰ্ণ শ্রান্ত গলায় বলে, সে হবে, ওর মার কাছে হবে। ও নিয়ে তুমি পুরুষ মানুষ মাথা ঘামাচ্ছো কেন?

আমি মাথা ঘামাব না? আমি বাড়ির কেউ নাই? হঠাৎ জামার হাতটা একবার চোখে ঘষে প্ৰবোধ, তারপর ভাঙা গলায় বলে, বৌমা বাপের বাড়ি চলে যাবে, আর আমি আমার কাজকর্ম ফেলে তোমার ওই ধাড়ি আইবুড়ো মেয়েকে আগলাবো?

সুবৰ্ণর ইচ্ছে হয়। চাদরটা মুখ অবধি টেনে পাশ ফিরে শোয়, তবু সে ইচ্ছে দমন করে আস্তে বলে, আগালাবার কথা উঠছে কেন? ছোট বৌমা তো কোথাও যাচ্ছে না? দুজনে থাকবে—

থাকবে! হঠাৎ যেন গর্জন করে ওঠে প্ৰবোধ, থাকবে কি উড়বে তা ভগবানই জানে! তোমার রাগের ভয়ে বলি না কিছু, বোবোকালা সেজে বসে থাকি। কিন্তু এই বলে দিচ্ছি, তোমার এই ছোট মেয়েটির ভাবভঙ্গী ভাল নয়। পরিমলবাবুর ছেলেটার সঙ্গে তো যখন-তখন গুজগুজ! কেন? ওর সঙ্গে এত কিসের কথা? আমি বলে দিচ্ছি। মেজবৌ, তুমি যদি তীৰ্থ করতে উধাও হও, এসে মেয়েকে ঘরে দেখতে পাবে কিনা সন্দেহ! হয়তো—

সুবৰ্ণ উঠে বসে, সুবৰ্ণ প্ৰবোধের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকায় একটু, তারপর তেমনি স্থির গলায় বুলে, তা যদি দেখি, সে সাহস যদি দেখাতে পারে ও, বুঝবো আমার রক্তমাংস একেবারে বৃথা হয় নি। একটা সন্তানও মাতৃঋণ শোধ করেছে।

শুয়ে পড়ে আবার।

প্ৰবোধ সহসা একটা যেন চড় খেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপর ভাবে, বৃথা দোষ দিচ্ছি, মাথাটা খারাপই! ছটফটিয়ে বেড়ায় খানিক, তারপর আবার ঘুরে আসে। আর আবারও নির্লজের মত বলে ওঠে, রাগের মাথায় বলে তো দিলে একটা কথা, কিন্তু সব দিক বিবেচনা করে তবে তো পরের কথায় নাচা-

হয়তো ঠিক এমনভাবে কথা বলার ইচ্ছে তার ছিল না, তবু অভ্যাসের বশে এ ছাড়া আর কিছু আসে না মুখে।

সুবৰ্ণ এবার সত্যিই পাশ ফিরে শোয়।

শুধু তার আগে আরো একবার উঠে বসে। রুদ্ধ কণ্ঠে বলে, তোমার কাছে হাতজোড় করে কটা দিন ছুটি চাইছি, সেটুকু দাও তুমি আমাকে। সব চাকরিরই তো কিছু না কিছু ছুটি পাওনা হয়, তোমার সংসারে এই ছত্রিশ বছর দাসত্ব করছি আমি, দুটো মাসও কি ছুটি পাওনা হয় নি আমার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *