২.২১
আসার পথে ওয়াটারস্টোনস থেকে এক কপি অ্যালসেস্টিস কিনলাম। ভূমিকায় লেখা যে এটা ইউরিপিডেসের প্রথম দিককার কাজ। ট্র্যাজেডি হিসেবে অতটা বিখ্যাত নয়।
মেট্রোরেলে বসেই পড়া শুরু করে দিলাম বইটা। আর যা-ই হোক, টানটান উত্তেজনার-এটা বলা যাবে না। একটু অদ্ভুতও বটে। গল্পের নায়ক অ্যাডমেতাসের মাথার ওপর মৃত্যু পরোয়ানা ঝুলছে। তবে অ্যাপোলো তিন ভাগ্যদেবীকে কথার প্যাঁচে ফেলে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার একটা উপায় বাতলে দেয় তাকে। সেজন্যে তার স্থানে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণের জন্যে রাজি করাতে হবে কাউকে।
অ্যাডমেতাস তার বাবা আর মাকে বলে তার হয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে, কিন্তু তাদের কেউই রাজি হয় না। অ্যাডমেতাস চরিত্রটা নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার নেই। গতানুগতিক ট্র্যাজেডির নায়কদের চেয়ে একদম ভিন্ন। গ্রিকরা নিশ্চয়ই তাকে কাপুরুষ বলেই গণ্য করতো। এর চেয়ে অ্যালসেস্টিস অনেক সাহসী একটা চরিত্র। সবকিছু শোনার পর স্বামীর জায়গায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিতে রাজি হয় সে। হয়তো ভেবেছিল অ্যাডমেতাস তার প্রস্তাবে রাজি হবে না, কিন্তু রাজি হয় যায় আমাদের ‘নায়ক’। মারা যাবার পর পাতাললোকে উদ্দেশ্যে রওনা হয় অ্যালসেস্টিস। হেডিসের রাজত্ব সেখানে।
গল্প কিন্তু এখানেই শেষ হয় না। বলা যায় শেষে মোটামুটি শুভ সমাপ্তিই অপেক্ষা করছে। জিউসের পুত্র বীর হেরাকলস হেডিসের কাছ থেকে ছিনিয়ে মতলোকে ফিরিয়ে আনে অ্যালসেস্টিসকে। আবারো বেঁচে ওঠে সে। স্ত্রীকে ফিরে পেয়ে পানি ঝরতে থাকে অ্যাডমেতাসের চোখ থেকে। কিন্তু অ্যালসেস্টিসের মনে কি চলছিল সেটা পরিস্কার হয় না। কারণ মতলোকে ফেরার পরে একবারের জন্যেও মুখ খোলেনি সে।
এই অংশটুকু পড়ে সোজা হয়ে বসলাম। বিশ্বাসই হচ্ছে না। সমাপ্তির অংশটুকু আবারো পড়লাম।
পাতাললোক থেকে ফিরে আসে অ্যালসেস্টিস। কিন্তু এরপর আর কথা ফোটেনি তার মুখে। সেটা ইচ্ছেকৃত না অনিচ্ছাকৃত তাও স্পষ্ট নয়। মরিয়া হয়ে এক সময় হেরাকলসকে প্রশ্ন করে অ্যাডমেটাস : “আমার স্ত্রী কোন কথা বলছে না কেন?”
এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়নি। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় নীরব অ্যালসেস্টিসকে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে অ্যাডমেটাস।
কেন?
কেন কথা বলা থামিয়ে দেয় অ্যালসেস্টিস?
.
২.২২
অ্যালিসিয়া বেরেনসনের ডায়েরি
অগাস্ট ২
আজকে আরো বেশি গরম পড়েছে। লন্ডনের তাপমাত্রা অ্যাথেন্সকেও ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু অ্যাথেন্সে অন্তত সৈকত আছে একটা।
ক্যামব্রিজ থেকে পল ফোন দিয়েছিল আজকে। সত্যি বলতে এতদিন পর ওর কলটা পেয়ে একটু অবাকই হয়েছে। অনেকদিন হয়ে গেল কথা হয় না আমাদের। প্রথমেই যে ভাবনাটা মাথায় এসেছিল-লিডিয়া ফুপি নিশ্চয়ই মারা গেছে। অস্বীকার করার সুযোগ নেই, ভাবনাটা ক্ষণিকের জন্যে হলেও স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছিল আমার চিত্তে।
কিন্তু পল সেজন্যে কল দেয়নি। আসলে আমি এখনও জানি না যে তার ফোন দেয়ার উদ্দেশ্যটা কি ছিল। বারবার কথা পেঁচাচ্ছিল। আমি অপেক্ষা করছিলাম কখন দরকারের কথায় আসবে, কিন্তু ওরকম কিছুই বললই না শেষ পর্যন্ত। বারবার জিজ্ঞেস করছিল আমি ঠিক আছি কি না, গ্যাব্রিয়েলের চাকরি কেমন যাচ্ছে-এসব। এক ফাঁকে বিড়বিড় করে কিছুক্ষণ লিডিয়াকে গালমন্দও করেছে।
“তোদের সাথে দেখা করতে আসবো আমি,” বলেই ফেলি আলাপের এক পর্যায়ে। “যাবো যাবো করেও যাওয়া হচ্ছেনা অনেকদিন ধরে।”
সত্যটা হচ্ছে ওখানে আবার যাওয়ার কথা ভাবতেই নার্ভাস লাগে আমার। সেজন্যেই এতদিন যাইনি। কিন্তু না যাওয়ার কারণে তীব্র অনুশোচনা বোধও কাজ করে। বাড়িটা আমার জন্যে শাঁখের করাত।
“তোর সাথে অনেকদিন আলাপও হয় না।” পল আমতা আমতা করে যেন কি বলল জবাবে। “তাড়াতাড়িই আসবো দেখি। আচ্ছা, আমি একটু বাইরে যাবো-”
আবারো নিচুস্বরে কিছু একটা বলল পল।
“কি বললি? বুঝিনি। আবার বল।”
“বললাম আমি খুব বড় বিপদে পড়েছি, অ্যালিসিয়া। তোর সাহায্য লাগবে।”
“কি হয়েছে?”
“ফোনে বলা যাবে না। দেখা করতে হবে।”
“ইয়ে, মানে আমি তো এখন ক্যামব্রিজ আসতে পারবো না।”
“আমি আসছি তোর ঐখানে। আজ বিকালে?”
পলের কন্ঠে এমন কিছু একটা ছিল যে দ্বিতীয়বার কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলাম। বড় মরিয়া শোনাচ্ছিল।
“ঠিক আছে। এখন কি কোনভাবেই বলা সম্ভব না?”
বিকেলে দেখা হচ্ছে,” লাইন কেটে দেয় পল।
বাকিটা দিন পল কি বলতে পারে সেটা নিয়ে ভেবেই কাটিয়েছি। কি এমন হতে পারে যেটা ফোনে বলা যাবে না? লিডিয়া সম্পর্কে কিছু বলবে? নাকি বাড়িটা সম্পর্কে? বুঝতেই পারছিলাম না।
লাঞ্চের পর আর কোন কাজ করা সম্ভব হয়না আমার পক্ষে। মুখে গরমকে দোষ দিলেও আসলে কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। একটু পরপর রান্নঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছিলাম, একসময় পলকে দেখতে পাই রাস্তায়।
“হাই, অ্যালিসিয়া,” হাত নেড়ে বলে ও।
ওর চেহারাটাই প্রথম ধাক্কা দেয় আমাকে। শুকিয়ে গেছে ভীষণ, গোলগাল মুখটা চেনাই যায় না প্রায়। চোয়ালও ভেতরে ঢুকে গেছে। চোখেমুখে সদা সন্ত্রস্ত একটা ভাব।
পোর্টেবল ফ্যানটা চালিয়ে রান্নাঘরের টেবিলেই বসি আমরা। বিয়ার দেব কি না জিজ্ঞেস করলে বলে যে আরো কড়া কিছুর প্রয়োজন। একটু অবাক হই কারণ আগে ওকে সেভাবে কখনো ড্রিঙ্ক করতে দেখিনি। একটা গ্লাসে অল্প একটু হুইস্কি ঢেলে এগিয়ে দিলাম। আমি অন্য দিকে তাকাতেই সেটা এক নিমেষে মুখে চালান করে দিয়ে আবারো গ্লাসটা ভরে নিল পল।
প্রথম কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম দুজনই। এরপর ফোনে যা বলেছিল সেটারই পনুরাবৃত্তি করলো সে :
“খুব বড় বিপদে পড়েছি।”
খুলে বলতে বললাম ওকে। বিপদটা কি বাড়ি নিয়ে?
শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় পল। বাড়ি নিয়ে কোন সমস্যা হয়নি।
“তাহলে?”
“আমি বিপদে পড়েছি।” এরপর মাথা নেড়ে দ্বিধা ঝেড়ে আসল কথাটা বলল। “জুয়া খেলা নিয়ে সমস্যা।”
গত কয়েক বছর ধরেই নিয়মিত জুয়া খেলে পল। প্রথম দিকে বাড়ির বাইরে সময় কাটানোর ছুতোয় জুয়ার আড্ডায় যেত। তাকে ঠিক দোষারোপও করা যাবে না, কে চাইবে লিডিয়ার সাথে এক ছাদের নিচে থাকতে? কিন্তু ওর জুয়া ভাগ্য ভাল না। জেতার চেয়ে হারেই বেশি। গত কয়েক মাস ক্রমাগত হেরেই চলেছে। পারিবারিক সেভিংস অ্যাকাউন্টের টাকার দিকে হাত বাড়ায় এক পর্যায়ে। তবে সেখানে এমনিতেও খুব বেশি টাকা ছিল না।
“কত লাগবে তোর?”
“বিশ হাজার।”
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। “বিশ হাজার পাউন্ড হেরেছিস?”
“একবারে না। কয়েকজনের কাছ থেকে কিছু ধারও করেছিলাম। ওরা টাকা ফেরত চাইছে এখন।”
“কাদের কাছ থেকে নিয়েছিলি?”
“শুধু জেনে রাখ, টাকা দিতে না পারলে আমাকে আর না-ও দেখতে পারিস।”
“তোর মা-কে বলেছিস?” উত্তরটা জানাই ছিল, তাও জিজ্ঞেস করলাম। পল এতটাও বোকা না।
“না! পাগল নাকি তুই? মেরেই ফেলবে আমাকে। তোর সাহায্য দরকার অ্যালিসিয়া, সেজন্যেই এসেছি। মুখ ফিরিয়ে নিস না।”
“আমার কাছে এত টাকা নেই, পল।”
“আমি ফেরত দিয়ে দিব তোকে। পুরোটা না পারলি, অল্প কিছু হলেও দে।”
জবাবে কিছু বলি না আমি। কিন্তু অনুনয় করতেই থাকে পল। আজ রাতেই নাকি টাকা নিতে আসবে পাওনাদারদের লোকজন। তখন তাদের আশ্বস্ত করার জন্যে সামান্য কিছু হলেও দিতে হবে। তাই খালি হাতে ফেরত যাওয়া চলবে না ওর। কি করবো বুঝে উঠতে পারিনি প্রথমে। ওকে সাহায্য করতে চাইছিলাম, কিন্তু এভাবে টাকা দেয়াটা উচিৎ হবে কি না সেটা ভাবনার বিষয়। এটাও জানতাম যে টাকা দিয়ে পাওনাদারদের শান্ত না করলে লিডিয়া ফুপির কাছ থেকে ওর ধার-কর্যের ব্যাপারটা লুকোনো সহজ হবে না। পলের জন্যে আসলেও খুব বাজে একটা পরিস্থিতি। আমার তো মনে হয় টাকা ধার দেয়া এসব মহাজনদের চাইতে লিডিয়ার মুখোমুখি অনেক বেশি ভয়ংকর।
“দাঁড়া, একটা চেক লিখে দিচ্ছি তোকে,” অবশেষে বলি আমি।
কৃতজ্ঞতার ছাপ ফোটে পলের চেহারায়। “ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।” বিড়বিড় করে বলতেই থাকে।
ওকে দু’হাজার পাউন্ডের একটা চেক দেই। জানি পরিমাণটা ওর জন্যে খুব কম, কিন্তু আগে কখনো এরকম পরিস্থিতিতে পড়িনি আমি। আমার জন্যেও ব্যাপারটা নতুন। তাছাড়া ওর কথা পুরোপুরি বিশ্বাসও হচ্ছিল না। কোন একটা ফাঁক তো নিশ্চয়ই আছে।
“গ্যাব্রিয়েলের সাথে কথা বলে হয়তো আরো বেশি দিতে পারবো,” বলি আমি। “কিন্তু আমাদের অন্য কোন সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। গ্যাব্রিয়েলের ভাই কিন্তু একজন আইনজীবী। হয়তো-”
লাফিয়ে ওঠে পল, আতঙ্কিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকায় কয়েকবার। “না, না, না। গ্যাব্রিয়েলকে বলিস না। ওকে এসবের সাথে জড়ানোর কোন দরকার নেই। আমি দেখি সবকিছু কিভাবে সামলানো যায়।”
“আর লিডিয়া? তুই কতদিন লুকোবি-”
আবারো আগের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকায় পল। চেকটা একরকম ছিনিয়ে নেয় আমার হাত থেকে। পাউন্ডের পরিমাণটা দেখে হতাশ হলেও কিছু বলে না। বিদায় নিয়ে চলে যায় কিছুক্ষণ পরেই।
বারবার মনে হচ্ছিল ওকে আশাহত করেছি আমি। পলের ব্যাপারে সবসময় এই অনুভূতিটা কাজ করে আমার মনে, ছোটবেলা থেকেই। অবচেতন মনে সে হয়তো আশা করতো যে একজন অভিভাবকের মত তাকে আগলে রাখবো আমি। কিন্তু কিভাবে বোঝাবো, আসলে এই ব্যাপারটা আমার সাথে যায় না।
গ্যাব্রিয়েল ফেরার পর ওকে সবকিছু জানাই। একটু বিরক্তই হয় সে আমার প্রতি। পলকে নাকি এক পাউন্ডও দেয়া উচিৎ না, তার ভুলের মাশুল তাকেই গুণতে হবে। তাছাড়া এটা আমার দায়িত্বও না।
জানি যে গ্যাব্রিয়েল ঠিকই বলেছে, তবুও ভেতর থেকে অপরাধবোধ দূর হয় না। ওই বাড়িটা থেকে আমি পালিয়ে আসতে পেরেছি, কিন্তু তার সেই সুযোগটা নেই। এখনও পলের মন মানসিকতা আট বছরের একটা ছেলের মতনই। আর সেই ছেলেটাকেই সাহায্য করতে চাই আমি।
কিন্তু জানি না কিভাবে করবো।
.
অগাস্ট ৬
আজকে সারাদিন পেইন্টিং নিয়েই কাটিয়েছি। জিশুর ছবিটার ব্যাকগ্রাউন্ডে কি আঁকা যায় সেটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি কিছুক্ষণ। মেক্সিকোতে বেড়ানোর সময় যে ছবিগুলো তুলেছিলাম, ওগুলো দেখে কিছু স্কেচ করছি, এমন সময় জিন-ফিলিক্সের ডাক শুনতে পেলাম।
একবার ভাবলাম জবাব দেব না, তাহলে হয়তো চলে যাবে। কিন্তু গেট খোলার শব্দ কানে এলো পরক্ষণেই। দেরি হয়ে গেছে। বাইরে মাথা বের করে দেখি বাগানে ঢুকে পড়েছে সে।
আমার উদ্দেশ্যে হাত নাড়লো জিন-ফিলিক্স। “কি অবস্থা? তোমাকে বিরক্ত করলাম নাকি? কাজ করছিলে?”
“হ্যাঁ।”
“বাহ! করো করো। আর মাত্র ছয় সপ্তাহ আছে প্রদর্শনীর। একটু পিছিয়েই আছে কিন্তু,” বলেই ওর সেই বিরক্তিকর হাসিটা হাসলো। আমার চেহারায় নিশ্চয়ই বিরক্তির ছাপটা ফুটে উঠেছিল। “মজা করছি কিন্তু। তোমার কাজের তদারকি করতে আসিনি,” পরক্ষণেই তড়িঘড়ি করে যোগ করলো।
জবাবে কিছুই বললাম না আমি। আবারো স্টুডিওতে ফিরে গেলাম, সে-ও এলো আমার পিছুপিছু। একটা চেয়ার নিয়ে এসে ফ্যানের সামনে বসে সিগারেট ধরালো। বাতাসের কারণে পুরো ঘরেই ছড়িয়ে পড়লো গন্ধটা। আমি আবারো ইজেলের সামনে ফিরে গিয়ে তুলি তুলে নিলাম। একমনে কথা বলে চললো জিন-ফিলিক্স। লন্ডনের আবহাওয়া নিয়ে অভিযোগ করলে কিছুক্ষণ, বলল যে এখানকার পরিবেশের সাথে এরকম গরম যায় না। প্যারিস আর অন্যান্য অনেক শহরের সাথে যুক্তিহীন তুলনা করলো কতক্ষণ। আমি এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিচ্ছিলাম। জিন-ফিলিক্সের কথা শুনলে মনে হয় দুনিয়াতে হেন কোন বিষয় নেই যা সম্পর্কে জানে না সে। রীতিমত বিশেষজ্ঞ। সে বাদে অন্য সবার ধারণায় কোন না কোন গলদ আছে। আমাকে কখনো কিছু জিজ্ঞেস করে না, ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকে। এতগুলো বছর ধরে একে অপরকে চিনি আমরা, তবুও আমি ওর কাছে একজন শ্রোতা বাদে কিছু না।
হয়তো আমি একটু বেশি বেশিই বলে ফেলছি। ও আমার সবচেয়ে পুরনো বন্ধুদের একজন-সবসময় বিপদে আপদে আমার পাশে থেকেছে। একটু একাকী, এই যা। কিন্তু আমিও তো ওর মতনই। আমার কাছে সবসময়ই মনে হয়েছে যে ভুল কারো সাথে সম্পর্কে জড়ানোর চাইতে একা থাকাই ভালো। সেজন্যেই গ্যাব্রিয়েলের আগে কারো সাথে সেরকম কোন সম্পর্কে জড়াইনি। একমনে অপেক্ষা করে গেছি ওর মত কারো জন্যে; যে আমাকে আমার সব ত্রুটি মেনে নিয়েও ভালোবাসবে। জিন-ফিলিক্স আমাদের সম্পর্কটা কখনোই ভালো চোখে দেখেনি। অবশ্য সামনাসামনি কিছু বলেনি কখনো, তবে আমি ঠিকই বুঝতে পারি। গ্যাব্রিয়েলকে পছন্দ করে না সে। সবসময় ওকে নিয়ে উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে। আমার প্রতিভার সাথে গ্যাব্রিয়েলের প্রতিভার নাকি কোন তুলনাই চলে না, কতটা আত্মকেন্দ্রিক আমার স্বামী-এসব। জিন-ফিলিক্স হয়তো ভাবে যে এভাবে কানপড়া দিতে থাকলে তার কথা একসময় মেনে নেব আমি। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে, ওর প্রতিটা বাজে মন্তব্য আমাকে আরো বেশি করে গ্যাব্রিয়েলের দিকে ঠেলে দেয়।
আরেকটা বিষয়, সবকিছুতে আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের দোহাই দেয় সে। এত বছরের বন্ধু আমরা, এক সময় তো আমার আর তোমার পাশে কেউ ছিল না’-এই কথাগুলো দিয়ে বশ করতে চায় আমাকে। কিন্তু জিন ফিলিক্স বোধহয় বোঝে না যে সে আমার জীবনের এমন একটা সময়ের কথা বলে যখন আমি প্রকৃতপক্ষে সুখি ছিলাম না। আর ওর প্রতি আমার যে আবেগটুকু কাজ করতো তখন সেটাও ভুলে যেতে চাই। আমাদের সম্পর্কটা ছিল একপ্রকার বিবাহিত জুটিদের মতন, যাদের মধ্যে আর ভালোবাসার ছিটেফোঁটা নেই। কে চায় এমন কিছু মনে রাখতে? তাকে যে আসলে আমি কতটা অপছন্দ করি সেটা আজ টের পেয়েছি।
“আমি কাজ করছি,” এক পর্যায়ে বলেই ফেলি। “এটা শেষ করতে হবে, তাই যদি কিছু মনে না করো…”।
“তুমি কি আমাকে চলে যেতে বলছো?” চেহারার অভিব্যক্তি পাল্টে যায় জিন ফেলিক্সের। “তুমি যেদিন প্রথম হাতে তুলি নিয়েছে, সেদিন থেকে তোমার পাশে আছি আমি। যদি তোমার কাজে বিরক্তই করে থাকি, তাহলে এতদিন বলোনি কেন?”
“এতদিন বলিনি, কিন্তু এখন বলছি।”
মনে হচ্ছিল, রুমের তাপমাত্রা যেন হঠাৎই বেড়ে গেছে। রাগ লাগছিল ভীষণ। চেষ্টা করেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। আবারো ছবি আঁকায় মনোযোগ ফেরাতে গিয়ে দেখি হাত কাঁপছে। জিন-ফিলিক্স যে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। আমার কথায় রেগে গেছো তুমি,” অবশেষে বলে সে। “কিন্তু কেন?”
“বললাম তো আমি ব্যস্ত। তাছাড়া এভাবে আগে থেকে না জানিয়ে হুট করে বাসায় চলে আসতে পারো না তুমি। অন্তত ফোন তো করবে।”
“দুঃখিত, আমি আসলে বুঝতে পারিনি যে আমার বেস্টফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতেও অনুমতি দরকার এখন।”
কেউই কথা বলি না কিছুক্ষণ। আমার কথায় আসলেও কষ্ট পেয়েছে জিন-ফিলিক্স। কিন্তু এখন তো আর কথাগুলো ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব না। বরং এতদিন ধরে যে কথাগুলো তাকে বলবো বলে ভেবে এসেছি, সেগুলোও বলে দেয়াই ভালো মনে হয়েছিল তখন। জানতাম যে অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, তাকে তখন ইচ্ছে করেই কষ্ট দিতে চাইছিলাম।
“জিন-ফিলিক্স, শোনো।”
“বলো, শুনছি।”
“কথাটা অন্যভাবে নিওনা, কিন্তু এবারের প্রদর্শনীর পর…একটু পরিবর্তন দরকার আমার জীবনে।”
“কিরকম পরিবর্তন?”
“গ্যালারি পরিবর্তন করতে চাই আমি।”
হতভম্ব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল জিন-ফিলিক্স। মনে হচ্ছিল যেন ছোট কোন ছেলের হাত থেকে তার পছন্দের খেলনাটা আকস্মিক কেড়ে নেয়া হয়েছে। ওকে এভাবে দেখে বিরক্তি আরো বেড়ে গিয়েছিল আমার।
“আমাদের দু’জনেরই নতুন করে শুরু করা উচিৎ সবকিছু।”
“বুঝতে পারছি,” আরেকটা সিগারেট ধরায় সে। “পুরোটাই নিশ্চয়ই গ্যাব্রিয়েলের বুদ্ধি?”
“গ্যাব্রিয়েলের সাথে এসবের কোন লেনদেন নেই।”
“আমাকে দেখতে পারে না ও।”
“আহাম্মকের মতন কথা বলল না।”
“ও-ই আমার বিরুদ্ধে তোমাকে কানপড়া দিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই দিয়ে আসছে।”
“এটা তোমার ভুল ধারণা।”
“এছাড়া আর কি ব্যাখ্যা আছে, বলো? তার প্ররোচনা ছাড়া কেন আমার সাথে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করবে তুমি?”
“নাটক কোরো না তো। আমি শুধু গ্যালারি পরিবর্তনের কথা বলেছি। তোমার আর আমার বন্ধুত্ব তো বদলাবে না। চাইলেই একসাথে আড্ডা দেয়া যাবে।”
“কিন্তু সেজন্যে আগে আমাকে ফোন বা মেসেজ দিয়ে অনুমতি নিতে হবে?” হেসে উঠে একনাগাড়ে কথা বলতে শুরু করে সে, যেন আমি থামানোর আগেই সব বলে ফেলতে চাইছে। “বাহ, বাহ, বাহ! এতদিন ধরে আমি ভেবে এসেছি তোমার আর আমার বন্ধুত্বটা আসলেও অন্যরকম, কেউ এর মাঝে নাক গলাতে পারবে না। ভুল ভেবেছি আমি? আমার মত করে তোমার জন্যে কেউ কখনো ভাবেনি, ভাববেও না। এটা ভুলে যেও না।
“জিন-ফিলিক্স, প্লিজ-”
“তুমি যে এভাবে হঠাৎ করে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললে, এটাই অবাক করেছে আমাকে।”
“আসলে অনেকদিন ধরেই কথাটা তোমাকে বলবো বলে ভাবছিলাম।”
এই কথাটা বলা একদমই উচিৎ হয়নি আমার। চেহারা একদম ফ্যাকাসে হয়ে যায় জিন-ফিলিক্সের। “অনেকদিন ধরে মানে? কি বলছো এসব?”
‘এটাই সত্যি।”
“তাহলে এতদিন আমার সাথে অভিনয় করে এসেছো, তাই তো? অ্যালিসিয়া! এভাবে সব কিছু শেষ করে দিও না। আমার পিঠে ছুরি বসিও না, দোহাই লাগে।”
“তোমার পিঠে ছুরি বসানোর মত তো কিছু করছি না আমি! নাটক বাদ দাও। আমাদের বন্ধুত্ব আগের মতনই থাকবে।”
“আচ্ছা, এ বিষয়ে আমরা আপাতত আর কিছু না বলি। আসলে আজকে কেন এসেছিলাম আমি জানো? শুক্রবারে তোমার সাথে থিয়েটারে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল।” পকেট থেকে দুটো টিকেট বের করে দেখায় ও। ইউরিপিডেসের একটা ট্র্যাজেডি চলছে ন্যাশনাল থিয়েটারে। “আমি চাই সেদিন তুমি আমার সাথে যাবে। এভাবেই নাহয় একে অপরকে বিদায় বলি * আমরা? আমাদের পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরে হলেও না বলো না, প্লিজ।”
ইতস্তত করছিলাম। ওর সাথে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু তখন যদি মানা করতাম তাহলে খুব বেশি অপরাধবোধ হতো। সত্যি বলতে ওকে স্টুডিও থেকে বের করার জন্যে যে কোন কিছু করতে রাজি ছিলাম। তাই হ্যাঁ বলে দেই।
রাত ১০:৩০
গ্যাব্রিয়েল বাসায় ফিরলে তাকে সব জানাই। জবাবে ও বলে যে জিন ফিলিক্সের সাথে আমার বন্ধুত্বের ব্যাপারটা কখনোই নাকি বোঝেনি।
“তোমার দিকে ও যেভাবে তাকায় সেটা পছন্দ না আমার।”
“কিভাবে তাকায়?”
“যেন তোমার ওপর ওর একটা দাবি আছে। আমার কি মনে হয় জানো? এখনই গ্যালারিটা ছেড়ে দেয়া উচিৎ তোমার-প্রদর্শনীর আগে।”।
“সেটা সম্ভব না, বড় দেরি হয়ে গেছে। তাছাড়া আমি তো ওকে ইচ্ছেকৃতভাবে কষ্ট দিতে চাই না। ওর মত মানুষ যে কতটা প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারে….”।
“তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে ওকে ভয় পাও।”
“ভয়ের তো কিছু নেই। ভয় পাবো কেন? ধীরে ধীরে ওর কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়াটাই ভালো হবে আমার জন্যে।”
“যত তাড়াতাড়ি সরে আসবে, তত ভালো। তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে ও, সেটা তো বোঝো, নাকি?”
আর তর্ক বাড়াইনি তখন, কিন্তু গ্যাব্রিয়েলের ধারণা ভুল।
আমার প্রতি বাড়তি কোন আকর্ষণ নেই জিন-ফিলিক্সের। বরং আমার আঁকা ছবিগুলো বেশি আকৃষ্ট করে ওকে। এজন্যেই ওর কাছ থেকে দূরে সরে আসতে চাইছি। আমাকে নিয়ে কিছুই যায় আসে না তার।
তবে গ্যাব্রিয়েল একটা কথা ঠিকই বলেছে। ওকে ভয় পাই আমি।
.
২.২৩
ডায়োমেডেসকে তার অফিসেই খুঁজে পেলাম। হার্পটার সামনে একটা টুল নিয়ে বসে ছিলেন। বেশ বড় একটা কাঠের ফ্রেমে ঘেরা হাপটার মাঝে সোনালী রঙের তারের সমাবেশ।
“খুবই সুন্দর জিনিসটা,” বলি আমি।
মাথা নাড়েন ডায়োমেডেস। “কিন্তু বাজানো খুব কঠিন।” তারগুলো আলতোভাবে স্পর্শ করতেই অপূর্ব কঙ্কনধ্বনিতে ভরে উঠলো ঘরটা। “তুমি একবার চেষ্টা করে দেখবে নাকি?”
হেসে মানা করে দিলাম।
জবাবে তার মুখে হাসি ফুটলো। “তোমাকে বারবার বলি এই আশায় যে হয়তো মত বদলাবে কোনদিন। সহজে কিন্তু হাল ছাড়ব না, আগেই বলে দিচ্ছি।”
“আসলে সংগীত বিষয়ে একদমই প্রতিভা নেই আমার। আমাদের স্কুলের মিউজিক টিচার প্রথম দিনই একথা আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।”
“আসলে থেরাপির মত সঙ্গিতের ক্ষেত্রেও প্রশিক্ষক হিসেবে কাকে বেছে নিচ্ছো, তার ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করে।”
“সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।”
বাইরের কালো হয়ে আসা আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন প্রফেসর। “মেঘগুলো দেখছো না? এগুলোর ভেতরে কিন্তু তুষার আছে।”
“আমার তো দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে।”
“না, তুষার ঝরবে আজ। আমার কথার ওপর ভরসা করতে পারো, গ্রীসে আমাদের পূর্বপুরুষদের অনেকেই রাখাল ছিল। তুষারপাতই হবে।”
আশাতুর দৃষ্টিতে আরো কিছুক্ষণ মেঘের দিকে তাকিয়ে থেকে আমার দিকে নজর ফেরালেন ডায়োমেডেস। “কেন এসেছো, থিও?”
“এটার জন্যে।”
অ্যালসেস্টিসের কপিটা তার দিকে ঠেলে দিয়ে বলি।
“কি এটা?”
“ইউরিপিডেসের লেখা একটা ট্র্যাজেডি।”
“সেটা তো বুঝতেই পারছি। আমাকে এটা দেখাচ্ছো কেন?”
“যেন তেন ট্র্যাজেডি নয়, এটার নাম অ্যালসেস্টিস। একটু ভেবে দেখুন, গ্যাব্রিয়েলের খুন হবার পর অ্যালিসিয়া তার আঁকা ছবিটার নাম কি দিয়েছিল?”
“তাই তো!” এবারে মনোযোগ দিয়ে বইটার দিকে তাকালেন ডায়োমেডেস। “নিজেকে ট্র্যাজেডির নায়িকা হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে সেখানে।” মজাচ্ছলেই কথাটা বললেন তিনি।
“হতেও পারে। কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারছি না ট্র্যাজেড়িটা কি ইঙ্গিত করছে। সেজন্যেই ভাবলাম আপনি হয়তো এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন।”
“কারণ আমি গ্রিক?” উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন ডায়োমেডেস। “তুমি কি ভেবেছো? সব গ্রিক ট্র্যাজেডি সম্পর্কে জ্ঞান রাখি আমি?”
“আমার চেয়ে অন্তত বেশি।”
“কেন যে সবাই এটা মনে করে। তাহলে তো বলতে হয় ইংরেজ মাত্রই শেক্সপিয়ারের সব রচনা মুখস্থ করা উচিৎ তোমাদের,” বলে আমার উদ্দেশ্যে করুণার একটা হাসি দিলেন প্রফেসর। কিন্তু তোমার ভাগ্য ভাল, আমাদের দেশের মধ্যে এটাই পার্থক্য। জন্মসূত্রে গ্রিক এমন সবাই ট্র্যাজেড়িগুলো পড়েছে। এগুলো আমাদের ঐতিহ্যের অংশ।”
“তাহলে তো কথাই নেই। আমাকে নিশ্চয়ই সাহায্য করতে পারবেন। আপনি।”
বইটা একবার উল্টেপাল্টে দেখলেন ডায়োমেডেস। “কি বুঝতে পারছো না?” |
“অ্যালসেস্টিসের কথা না বলার ব্যাপারটা। স্বামীর জন্যে আত্মাহুতি দেয় সে। কিন্তু শেষে যখন পাতাললোক থেকে ফিরে আসে, কোন কথা বলে না।”
“হুম, অ্যালিসিয়ার মতন।”
“হ্যাঁ।”
“আবারো জিজ্ঞেস করছি, ঠিক কি বুঝতে পারছো না?”
“আপনার কি মনে হচ্ছে না দুটো ঘটনার মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে? অ্যালসেস্টিস কেন কথা বলেনি শেষে?”
“তোমার কি মনে হয়?”
“বুঝতে পারছি না আসলে। হয়তো আবেগের বশে?”
“হয়তো। কোন আবেগের কথা বলছো?”
“আনন্দ?”
“আনন্দ?” হেসে উঠলে প্রফেসর। “আচ্ছা, একটা কথা বলো থিও। ধরো তুমি একজনকে ভালোবাসো, এখন সে যদি কাপুরুষের মতন নিজের জায়গায় তোমাকে মরতে বলে, তাহলে তোমার কেমন লাগবে? মনে হবে না যে সে তোমার ভালোবাসার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?”
“মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন সে কষ্ট পেয়েছিল?”
“কেউ কি কখনো তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি?”
প্রশ্নটা ছুরির ফলার মত এসে বিধলো আমার বুকে। বুঝতে পারছি যে চেহারা লাল হয়ে উঠছে। মুখ খুললেও কিছু বলতে পারলাম না।
“জবাবটা আন্দাজ করতে পারছি,” মুচকি হেসে বললেন ডায়োমেডেস। “তাহলে…এবার বলল, অ্যালসেস্টির কেমন লাগছিল?”
“রাগ। ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছিল সে।”
“হ্যাঁ, মাথা নেড়ে আমার সাথে সম্মতি প্রকাশ করলেন ডায়োমেডেস। “ভবিষ্যতে অ্যাডমেতাস আর অ্যালসেস্টিসের মধ্যকার সম্পর্কটা কোন দিকে মোড় নিবে সেটা কিন্তু ভাবনার বিষয়। কারো প্রতি ভরসা উঠে গেলে সেটা ফিরে পাওয়াটা কঠিন।”
কয়েক সেকেন্ড পর মুখের ভাষা ফিরে পেলাম। “আর অ্যালিসিয়া?”
“অ্যালিসিয়া কি?”
“স্বামীর কাপুরুষতার জন্যে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে হয়েছিল অ্যালসেস্টিসকে। আর অ্যালসিয়া-”
“না, অ্যালিসিয়া মারা যায়নি…অন্তত শারীরিকভাবে।”তার কথায় প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত। “কিন্তু মানসিকভাবে…”।
“মানে বলতে চাইছেন যে এমন কিছু একটা হয়েছে যেটায় ওর আত্মার মৃত্যু ঘটেছে…ঘটনাটা ওর বেঁচে থাকার স্পৃহা কেড়ে নিয়েছে।”
“সম্ভবত।”
কেন যেন আমার মনঃপুত হলো না ব্যাখ্যাটা। বইটা হাতে নিয়ে প্রচ্ছদের দিকে তাকালাম। অনিন্দ্য সুন্দর একটা নারীমুর্তি শোভা পাচ্ছে সেখানে, মার্বেলের তৈরি। জিন-ফিলিক্সের বলা কথাটা মনে হলো এসময়।
“তাহলে এখন আমাদের উচিৎ হবে অ্যালসেস্টিসের মতন অ্যালিসিয়াকেও উদ্ধার করা।”
“ঠিক বলেছো।”
“আচ্ছা, আমি একটা কথা ভাবছিলাম। আঁকাআঁকি হচ্ছে অ্যালিসিয়ার মত প্রকাশের মাধ্যম। আমরা যে সেই সুযোগটা করে দেই তাকে?”
“কিভাবে করবে সেটা?”
“ছবি আঁকতে দেই?”
বিস্মিত মনে হলো ডায়োমেডেসকে। পরক্ষণেই হাত নেড়ে প্রস্তাবটা নাকচ করে দিলেন। “ইতোমধ্যে আর্ট থেরাপি সেশনে বেশ কয়েকবার অংশ নিয়েছে ও।”
“আর্ট থেরাপির কথা বলছি না আমি। তাকে একা একা নিজের মত করে আঁকার সুযোগ করে দেয়া যায় কিন্তু ভেতরে আটকে থাকা আবেগগুলো হয়তো ক্যানভাসে চিত্রায়িত করতে পারবে সে।”
কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন ডায়োমেডেস। ভাবছেন বিষয়টা নিয়ে। “তোমাকে এ ব্যাপারে ওর আর্ট থেরাপিস্টের সাথে কথা বলতে হবে। তার সাথে পরিচয় আছে তোমার? রোয়েনা হার্ট? ওকে রাজি করানোটা সহজ হবে না”
“না, কিন্তু কথা বলে নেব। আপনার অনুমতি আছে তাহলে?”
কাঁধ ঝাঁকালো ডায়োমেডেস। “তুমি যদি রোয়েনাকে রাজি করাতে পারো, তাহলে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আগে থেকেই সাবধান করে দিচ্ছি। ওর পছন্দ হবে না বুদ্ধিটা। একটুও না।”
.
২.২৪
“চমৎকার বুদ্ধি,” রোয়েনা বলল।
“আসলেও?” বিস্ময় গোপন করলাম।
“হ্যাঁ। কিন্তু একটাই সমস্যা, অ্যালিসিয়া ছবি আঁকবে না।”
“এতটা নিশ্চিত হয়ে বলছেন কি করে?”
বিদ্রুপের ভঙ্গিতে নাক দিয়ে শব্দ করে রোয়েনা। “কারণ অ্যালিসিয়ার মত ফালতু কাউকে নিয়ে আগে কাজ করিনি আমি। এত চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুতেই সাড়া দেয়নি সে।”
“ওহ।”
রোয়েনার পিছু পিছু আর্ট রুমে চলে এলাম। মেঝের ওপরে রঙ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেয়ালে নানারকমের চিত্রকর্ম। কয়েকটা সুন্দর কিন্তু বেশিরভাগই অদ্ভুত। রোয়েনার সোনালী চুল ছোট করে ছটা। জোড়া কুঁচকেই থাকে সর্বদা। অবশ্য সার্বক্ষণিক এতজন রোগিকে সামলাতে হলে স্বভাব চরিত্রে চাঁছাছোলা ভাব আসবেই। আর রোগিদের বেশিরভাগই নিশ্চয়ই তার কথা শোনে না। অ্যালিসিয়াও সেরকমই একজন।
“আর্ট থেরাপিতে কি আদৌ কখনো কোন আগ্রহ দেখিয়েছে অ্যালিসিয়া?”
“নাহ,” কথা বলার ফাঁকে রুমের তাকগুলো গোছগাছ করছে রোয়েনা। “তবে প্রথমে যখন আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিল, ভেবেছিলাম সবাই যদি সহযোগিতা করি তাহলে হয়তো সাড়া দিবে। কিন্তু চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করে না সে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনের সাদা পেজের দিকে। এমনকি একবারের জন্যে পেন্সিলটাও ওঠায়নি। যারা তাও টুকটাক আঁকত, তারাও দমে যায় ওকে দেখে।”
সহানুভূতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। আর্ট থেরাপির উদ্দেশ্যই হচ্ছে রোগিদের মনের ভাব রংতুলির মাধ্যমে কাগজে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করা, তখন বিষয়টা নিয়ে বিস্তারিত আলাপও করতে পারি আমরা। মানুষের অবচতেন মনের ইচ্ছেগুলো কিন্তু চাইলে একটা কাগজে বিনা প্ররোচনায় ফুটিয়ে তোলা যায়। অবশ্য কাজের ব্যাপারে থেরাপিস্টের নৈপুন্যও বড় একটা ভূমিকা পালন করে এক্ষেত্রে। রুথ প্রায়ই বলতো যে খুব কম থেরাপিস্টেরই ক্ষমতা আছে নিজের সজ্ঞা থেকে রোগিদের সাহায্য করার, বাকিরা এটাকে নিতান্ত সাধারণ একটা পেশা হিসেবেই দেখে। আমার মতে রোয়েনা দ্বিতীয় দলেই পড়বে। রোয়েনার নিশ্চয়ই ধারণা অ্যালিসিয়া তাকে আমলেই নিচ্ছে না। হয়তো ব্যাপারটা তার জন্যে কষ্টদায়ক,” গলার স্বর যতটা সম্ভব নরম করে বললাম।
“কষ্টদায়ক?”
“একজন শিল্পী নিশ্চয়ই অন্যান্য রোগিদের সামনে ছবি আঁকার ব্যাপারটা ভালোভাবে নেবেনা।”
“না নেয়ার কি আছে? কি এমন করেছে সে শুনি? ওর আঁকা ছবিগুলো দেখেছি আমি। ওরকম আহামরি কিছু মনে হয়নি,” বিরক্ত কণ্ঠে বলল রোয়েনা।
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম কেন অ্যালিসিয়াকে দেখতে পারে না সে। ঈর্ষা।
“যে কেউ ওরকম ছবি আঁকতে পারবে,” রোয়েনা বলল। “বাস্তব ছবির মত করে কোন কিছু আঁকা খুব সহজ। কিন্তু নিজ থেকে কল্পনা করে কিছু আঁকতে বললেই এদের ঘাম ছুটে যায়।”
অ্যালিসিয়ার আঁকা ছবিগুলোর শিল্পমান নিয়ে তার সাথে তর্কের কোন ইচ্ছে নেই আমার। “তাহলে আমি যদি ওকে আর্ট থেরাপি সেশন থেকে সরিয়ে নেই, আপনার কোন আপত্তি থাকবে না?”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো রোয়েনা। “না, আপত্তি করবো কেন। খুশিই হবে বরং।”
“ধন্যবাদ।”
“তবে ওর আঁকাআঁকির সরঞ্জামের ব্যবস্থা আপনাকেই করতে হবে। তেলরঙের জিনিসপত্র কেনার মত বাজেট নেই আমার।”
.
২.২৫
“একটা কাজ করে ফেলেছি আমি, শুনে বোধহয় একটু অবাকই হবেন।”
মেঝের দিক থেকে মুখ তুলল না অ্যালিসিয়া।
আমি কথা চালিয়ে গেলাম। “সোহোতে গিয়েছিলাম একটা কাজে। সেখানে আপনার পুরনো গ্যালারিটা দেখে আর নিজেকে থামাতে পারিনি। ম্যানেজার নিজে আগ্রহ করে আমাকে আপনার আঁকা সব ছবি দেখিয়েছে। তিনি তো আপনার পুরনো বন্ধু বোধহয়। মি. জিন-ফিলিক্স মার্টিন?”
কোন উত্তর এলো না এবারেও।
“আশা করি আপনি ব্যাপারটায় কিছু মনে করেননি। আপনার ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাচ্ছি না কিন্তু। তবে আপনার সাথে প্রথমে কথা বলে নিলেই বোধহয় ভালো করতাম।”
মনে হচ্ছে যেন কোন মূর্তির সাথে কথা বলছি।
“আপনার কিছু পেইন্টিং আগে দেখিনি আমি, সেগুলোও দেখলাম কালকে। একটা আপনার মা’র দুর্ঘটনা নিয়ে আঁকা, আরেকটা আপনার ফুপি লিডিয়া রোজকে নিয়ে।”
এবারে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো অ্যালিসিয়া। তার চোখে আগে কখনো এরকম অভিব্যক্তি খেলা করতে দেখিনি। বিদ্রূপ?
“আপনার থেরাপিস্ট হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই ছবিগুলোর ব্যাপারে কৌতূহল ছিল আমার। কিন্তু আমি যদি আপনাকে না-ও চিনতাম, তবুও ছবিগুলো দেখে অভিভূত হতাম নিশ্চিত। আমি কোন শিল্প-বিশারদ নই, কিন্তু আপনার পেইন্টিংগুলোর শিল্পমান নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।”
চোখ নামিয়ে নিল অ্যালিসিয়া। আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
“তবে কিছু জিনিস একটু অদ্ভুত লেগেছে আমার কাছে,” দ্রুত বললাম। “যেমন আপনার মা’র দুর্ঘটনার পেইন্টিংটায় আপনি ইচ্ছে করেই নিজেকে আঁকেননি। কিন্তু দুর্ঘটনার সময় আপনিও তো গাড়িতেই ছিলেন।”
কোন প্রতিক্রিয়া নেই।
“আচ্ছা, এর কারণটা ঠিক কি হতে পারে? আপনি হয়তো নিজেকে পেইন্টিংয়ে না রেখে এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে ট্র্যাজেডিটা শুধুমাত্র আপনার মায়ের? কারণ তিনি মারা গিয়েছিলেন? কিন্তু গাড়িতে তো তখন ছোট্ট একটা মেয়েও ছিল। দুর্ঘটনাটা তার মনে কি প্রভাব ফেলেছিল, হয়তো সেটা কেউ বুঝতে চায়নি সে মুহূর্তে, নাকি?”
আবারো আমার দিকে তাকালো অ্যালিসিয়া। এবারে তার দৃষ্টিতে কৌতূহল। ঠিক পথেই এগোচ্ছি।
“জিন-ফিলিক্সকে আমি আপনার অ্যালসেস্টিস ছবিটার ব্যাপারেও কিছু প্রশ্ন করেছিলাম। আসলে আত্মপ্রতিকৃতিটা আঁকার কারণ জানতে চাচ্ছিলাম। তখন উনি বললেন এটা পড়তে।”
অ্যালসেস্টিস নাটকের কপিটা বের করে কফি টেবিলে রাখলাম। ওটার দিকে তাকালো অ্যালিসিয়া।
“ও কথা বলছে না কেন?’-নাটকের শেষ অঙ্কে জিজ্ঞেস করে অ্যাডমেতাস। আমিও আপনাকে একই প্রশ্ন করছি, অ্যালিসিয়া। কি এমন ঘটেছে যেটা বলতে পারছেন না আপনি? কেন মুখ বন্ধ রেখেছেন?”
চোখ বন্ধ করে ফেললো অ্যালিসিয়া। আমাকে দৃষ্টির আড়াল করতে চাইছে। তার জন্যে আজকের মতন কথোপকথনের এখানেই সমাপ্তি। পেছনের দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটার দিকে তাকালাম। সেশনের সময়ও শেষ হতে চলেছে। আর দুই মিনিট বাকি।
তবে তুরুপের তাসটা এতক্ষণ অবধি লুকিয়ে রেখেছিলাম। ভেতরে ভেতরে নার্ভাস লাগলেও যতটা সম্ভব স্বাভাবিক স্বরে বললাম, “জিন ফিলিক্স একটা পরামর্শ দিয়েছেন। আমার কাছেও পরামর্শটা ভালোই মনে হয়েছে। তার মতে আপনাকে ছবি আঁকতে দেয়া উচিৎ। আঁকবেন? চাইলে আপনার জন্যে আলাদা ঘরের ব্যবস্থাও করে দেয়া যাবে।”
চোখ খুলল অ্যালিসিয়া। বিস্ময় ফুটেছে চেহারায়। দেখে মনে হচ্ছে একটা বাচ্চা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। তার নিষ্পাপ চাহনিতে সন্দেহ বা ঘৃণার কোন ছায়া নেই। হঠাৎ করেই তাকে বড় বেশি জীবন্ত মনে হচ্ছে।
“এ বিষয়ে প্রফেসর ডায়োমেডেসের সাথে কথা হয়েছে আমার, তিনি আপত্তি করেননি। রোয়েনাও রাজি। বল এখন পুরোপুরি আপনার কোর্টে, অ্যালিসিয়া। কি মনে হচ্ছে আপনার? আঁকবেন?”
অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার দিকে একমনে তাকিয়েই আছে অ্যালিসিয়া।
এরপর হঠাৎ করেই যা চাইছিলাম সেটা পেয়ে গেলাম, অবশেষে। তার এই প্রতিক্রিয়ার অর্থ ঠিক পথেই এগোচ্ছি আমি।
খুবই সামান্য একটা প্রতিক্রিয়া, কিন্তু এর প্রভাব বিস্তর।
হাসি ফুটেছে অ্যালিসিয়ার ঠোঁটে।