2 of 3

২.২০ One learns to know oneself best

One learns to know oneself best behind one’s back.

সেই বহুমূল্য হারটা মেঝেতেই পড়ে আছে অবহেলিত। প্রাণহীন দেহ মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে ঝুলছে। কোনও এক রন্ধ্রপথে সকালের বাতাস ঢুকছে, দেহটা অল্প অল্প দুলছে। অভাবনীয় দৃশ্য। ঘণ্টা কয়েক আগেও মানুষটা ছিল। বাঁচতে চেয়েছিল করুণভাবে। জীবনকে কে আর স্বেচ্ছায় ফুরোতে চায়। আমি আর মুকু চলে যাবার পর, আমাদের ঘৃণা নিয়ে বসে ছিল বহুক্ষণ। অবশেষে। এই সহজ সিদ্ধান্ত। আবার কোথায় কোন অনিশ্চিত জায়গায় যাওয়া যায়, তার চেয়ে একেবারেই চলে যাই। অনেক খেলাই তো হল, আর কী হবে! আর সে তো কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার! দেহের খাঁচা খুলে জীবন-পাখির উড়ে যেতে কতটুকুই বা সময় লাগে!

কে খুনি?

খুন তো বটেই। কিন্তু কে? আমাদের তিন জনের মধ্যে কে খুনি? আমি, মুকু, গগন? না চতুর্থ আর একজন কেউ? যে আমার দিদির অতীতকে তাড়া করে ফিরছে অলক্ষে বসে, তার এজেন্টের মাধ্যমে। আগুন দেখে যে লাফিয়ে ঘরের বাইরে চলে গিয়েছিল তার এই সাহস দেখে নিজেই অবাক। সামনে দু’হাত দূরে দিদির দেহ ঝুলছে। অল্প অল্প পাক খাচ্ছে। মুখটা সামান্য বিকৃত। চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। তবু আমার ভয় করছে না। আমি ভাবতে পারছি। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ভাবনা। এরপর কী হবে! কীভাবে পার পাওয়া যাবে আইনের হাত থেকে। এখন তো ডবল ফ্যাকড়া বেরোল। এক, চোরাই মাল, দুই, আত্মহত্যা। বুকের কাছে মাঝে মাঝেই কী একটা দলামতো ঠেলে উঠছে। আমার জমাট কান্না। একটা পুঁটলি, কয়েকখানা আটপৌরে কাপড়, দু-একটা ব্লাউজ, ছোট্ট একটা গীতা, এই সামান্য সম্বল ফেলে, জীবনের খেলা শেষ করে চিরতরে চলে গেল সংগ্রামী এক জীবন। এই দেখেই গাইতে ইচ্ছে করে, ঊ্যা করে জন্মে আমি কী পেলাম!

মুকু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে। খুব কঠিন হতে গিয়েছিল। পাপ পুণ্যের বিচারক। কেমন শিক্ষা দিয়ে গেলেন মহিলা। এইবার ঠেলা সামলাও। দেখাও তোমার তেজ। আঁচলে চোখ মুছে মুকু বললে, তা হলে তো থানায় যেতে হয়।

তা তো হয়ই। তুমি যাও। সারাপাড়া এইবার ভেঙে পড়ুক। অপমানের একশেষ। আমার পক্ষে আর কিছুই সম্ভব নয়। তোমার হাত ধরে চলতে গিয়ে আমার পতন হল খানায়।

এই মুহূর্তে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া না করে সমস্যার সমাধানে লাগাই উচিত। মাথা ঠান্ডা রাখো।

উপদেশটা নিজেকেই দাও।

আমার মাথা খুবই ঠান্ডা। সবার আগে হারটা সরাও।

তাতে লাভ! পরে হারটা যখন আমাদের কাছ থেকে বেরোবে তখন কী হবে? হাজতে? যেখানে যা আছে ঠিক সেইরকমই থাক। চালাকি করে লাভ নেই। এতদিন তোমার কথায় চলেছে, এইবার আমার কথায় চলুক। আমি একটা গাড়ি ধরে সুরঞ্জনাদের বাড়ি যাই। সুরঞ্জনার বাবার সাহায্য এখন কাজে আসবে। পুলিশের ওপরমহলের মানুষ।

দেরি হয়ে যাবে। তুমি বরং তোমার বিষ্টুদার সাহায্য নাও। পুলিশকে জানাতে যত দেরি করবে, ততই তাদের সন্দেহ বাড়বে।

পুলিশ যখন এসে দেখবে কোনও সুইসাইডাল নোট নেই, দেহের কিছুটা অংশ পোড়া, সামনে পড়ে আছে দামি একটা হার, তখন কেসটা কোন দিকে যাবে তুমি জানো?

যে-দিকেই যাক, জানাতে তো হবেই।

অভিজ্ঞ মানুষের পরামর্শ নিয়ে জানাব। সেইটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

তুমি চলে গেলে আমি একা থাকব নাকি? এখুনি তো কাজের মেয়েটি আসবে।

মুকুর কথা শেষ হতে না-হতেই সদরের কড়া নড়ে উঠল। দু’জনেই ভয়ে কাঠ। সর্বনাশ করেছে। এখন কী হবে! যে বাসন মাজে সে এসেছে। এখুনি সারা পাড়ায় রাষ্ট্র হয়ে যাবে। কাতারে কাতারে লোক ছুটে আসবে গলায় দড়ি দেখতে। এর চেয়ে দর্শনীয় আর কী আছে!

মুকু বললে, আমি দরজা বন্ধ করে রাখছি, তুমি কোনওরকমে ওকে ভাগাও।

দরজা খুলেই অবাক হয়ে গেলুম, সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন অক্ষয় কাকাবাবু। জীবন্ত স্তম্ভের মতো। পাঞ্জাবির ঝুল প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। পরিষ্কার ধুতি। পায়ে চপ্পল। কাঁধে একটা গেরুয়া সাইড ব্যাগ। মনে হল, হাতে স্বর্গ পেলুম। পিতার সর্বাধিক প্রিয় বন্ধু পিতার মতোই। যেন হরিশঙ্করই ফিরে এলেন। ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বললেন, অনেক দিন তোমাদের কোনও খবর নিতে পারিনি। তোমাকে একদিন অবশ্য ট্রামে দেখলুম মাথা নিচু করে একটি মেয়ের পাশে বসে আছ। বুঝলুম আমাকে অ্যাভয়েড করতে চাইছ, তাই আর বিরক্ত করলুম না।

অক্ষয় কাকাবাবুকে প্রণাম করে যখন উঠে দাঁড়ালুম তখন আমার দু’চোখে জল। তিনি তার বিশাল চওড়া বুকে আমার মাথাটা টেনে নিয়ে বললেন, কীসের এত দুঃখ? সময় কি সবসময় সমান যায়! কখনও ভাল, কখনও খারাপ। নীলকণ্ঠের সেই গানের মতো, শ্যামাপদে আশ, নদীর তীরে বাস, কখন কী যে ঘটে ভেবে হই মা সারা। এক কূল নদী ভাঙে নিরবধি আবার অন্য কূলে আকুলে সাজায়। খবর আমি পেয়েছি, হরিদা চলে গেছেন। কোথায় গেছেন, সেইটাই হল প্রশ্ন।

কাকাবাবু, তার চেয়ে বড় সমস্যা, এই মুহূর্তে ঘরে একটা ডেডবডি ঝুলছে।

সেকী? এ তোমার কোনও হেঁয়ালি নয় তো!

না কাকাবাবু, আপনি জানেন না, কী ঘোর সংকটের মুহূর্তে আপনি এসেছেন! ঈশ্বর আপনাকে পাঠিয়েছেন।

কাকাবাবু ওপরে উঠতে উঠতে সংক্ষেপে সব শুনলেন। একটাই মন্তব্য করলেন, অজ্ঞাত কুলশীল কারওকে আশ্রয়ে রাখার আগে একটু খোঁজখবর নেওয়ার দরকার ছিল পিন্টু। তুমি যাকে কখনও দেখোনি, যার ঠিকানাও তুমি জানো না, তাকে সোজা বলে দিলেই পারতে, আমার বাবা নেই, আপনি পরে আসবেন।

দোতলার বারান্দার রেলিং-এ হাত রেখে কাকাবাবু গুম মেরে দাঁড়ালেন। একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি। সেকালের কোনও মুনি যেন একালে ছাড়া পেয়েছেন। মুকু এসে প্রণাম করল। আমার খুব অদ্ভুত লাগছে, সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। দিদির মৃত্যু নয়, সময়ের মৃত্যু হয়েছে। প্রাণহীন ঘটনা ঘটে চলেছে। কাকাবাবুর আসা, মুকুর প্রণাম, কথাবার্তা, জল্পনা কল্পনা, সবই যেন স্থিরচিত্র।

কাকাবাবুকে সামান্য ধরিয়ে দিতে হল মুকুর পরিচয়। মৃদু হাসলেন। মৃতের হাসির মতো। আমরা সকলেই মরে গেছি যেন। দম নেই। আগের বেগেই চাকা ঘুরছে।

কাকাবাবু ঘরে এসে পিতার চেয়ারে বসলেন। হরিশঙ্করের মতোই এক ব্যক্তিত্ব। হাতের আঙুলগুলো বিশাল বিশাল। তর্জনী তুলে আছেন, মনে হচ্ছে সমস্ত ঘটনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে পরবর্তী আদেশের অপেক্ষায়। টেবিলে একটা টোকা মেরে বললেন, আমার প্ল্যান রেডি। কোনও লুকোছাপা নয়, সোজা থানায় গিয়ে আমরা অফিসারকে বলব, মশাই এই এই ব্যাপার। তুমি বলবে আমার বিধবা দিদি আত্মহত্যা করেছে। কারণ একটাই– ছেলের অত্যাচার।

কাকাবাবু, ছেলের কথা বললেই প্রশ্ন হবে ছেলে কোথায়? আমরা তো তার ঠিকানা জানি না। কাকাবাবু। বাবা জানলেও জানতে পারতেন।

সেই প্রশ্নেরও উত্তর আছে। বাউন্ডুলে ছেলে, কখনও আসে, কখনও হারিয়ে যায়।

পুলিশ যখন পাড়ার লোককে প্রশ্ন করবেন তারা তো বলবে, এই মহিলা এখানে থাকতেন না। এই কয়েক দিন হল দেখছি। পুলিশ আসামাত্রই শয়ে শয়ে লোক এসে জুটবে। তখন কী হবে। তা ছাড়া পিঠের দিকে ওই আগুনে পোড়া। পুলিশ যদি বলে, এটা আত্মহত্যা নয়, খুন!

কাকাবাবু নিজের কপালে তিনবার আঙুলের টোকা মেরে বললেন, উঃ, কী কঠিন সমস্যা। এ যে দেখি ডাঙায় বাঘ, জলে কুমির। এগোলেও নির্বংশের ব্যাটা, পেছোলেও নির্বংশের ব্যাটা। ঠিক আছে, দেখাই যাক না কী হয়! জলে নেমেই দেখা যাক। সমস্যা আসুক তারপর দেখা যাবে। চলো, থানায় যাই।

কাকাবাবু, ওই চোরাই হারটা?

পড়ে থাক। অথবা ওটাকে আবার ময়দার তালেই ঢুকিয়ে দেওয়া যাক।

সেটা কি ঠিক হবে? দ্বিতীয়বার যখন পুলিশ আসবে হারের খোঁজে, তখন এই আত্মহত্যাটা হয়ে দাঁড়াবে খুন। আমি আর মুকু হারের লোভে মহিলাকে খুন করেছি। তখন সোজা হাজতে।

কাকাবাবু আবার গুম। অবশেষে বললেন, আঃ, আচ্ছা একটা দাবার চাল চেলে গেছে। একেবারে কিস্তিমাতের চাল। তা হলে থাক। যেখানে পড়ে আছে সেইখানেই পড়ে থাক হারটা। আচ্ছা তাই বা কেন? হারের সন্ধান পুলিশ পাবে কী করে?

সহজেই পাবে কাকাবাবু। যাঁদের হার তারা থানায় ডায়েরি করবেন। পুলিশ অনুসন্ধানে বেরোবে। গন্ধে গন্ধে চলে আসবে এখানে। তখন কেস আরও জটিল হবে।

তোমার মাথা দেখছি আমার চেয়ে অনেক সাফ। হরিশঙ্করদার মাথা। চলো, যা হয়েছে তাই বলব, তারপর যা হবার তাই হবে। কেমন? সাহস আছে তো?

আপনি সঙ্গে আছেন আর আমি ভয় পাই না।

.

থানার বড় দারোগামশাই কোমরে বেল্ট বাঁধছিলেন। সব দারোগার মতোই, এঁরও ভুড়ি সমস্যা। এতটাই স্বাধীনতা পেয়ে এসেছে, যে এই মুহূর্তে আর শাসনে আসতে চাইছে না কিছুতেই। এত দুষ্টের দমন করেন, নিজের মধ্যপ্রদেশকে দমন করতে পারছেন না কিছুতেই। বেল্ট বাঁধা হলে তিনি আসনে বসবেন। তিনিও দাঁড়িয়ে, আমরাও দাঁড়িয়ে, একজন হাবিলদারও দাঁড়িয়ে। সময়ও যেন দাঁড়িয়ে পড়েছে। রিভলভারটা টেবিলের ওপর। তার পাশেই শুয়ে আছে তেলচুকচুকে ব্যাটন।

পেছনের একটা জানলা খোলা। জানলার ওপাশে পাঁচিল। পাঁচিলের মাথায় স্বর্ণগোধিকার মতো একফালি রোদ। পাঁচিলের ওপিঠ থেকে ছোট্ট একটা লতা সবে তার দুটি পাতাকে জাগাতে পেরেছে, যেন গোপনে চুমু খাচ্ছে রোদ। কড়ির পাশে কোমল। অতি কষ্টে প্রথম ফুটোয় বেল্ট বেঁধে দারোগাসায়েব চেয়ারে বসে ভুরু কুঁচকে আমাদের দিকে তাকালেন। কাকাবাবুর শালপ্রাংশু চেহারা টেবিলে ছায়া ফেলেছে। কর্কশতম গলায় বললেন, কী চাই?

কাকাবাবু সামান্যতম ঘাবড়ে না গিয়ে বললেন, আপনার সাহায্য।

কে মরেছে?

কী করে বুঝলেন?

আরে মশাই এই সময় গলায় দড়ি দিয়েই তো সব আসে। এত বছর দারোগাগিরি করছি কী কারণে? এইটুকুই যদি না বুঝব! ঠিকানা বলুন।

কাকাবাবু খুব নরম গলায় বললেন, আপনার অদ্ভুত ক্ষমতা। এমন আমি দেখিনি কোথাও।

দারোগাসায়েব গম্ভীর গলায় বললেন, বসুন।

পুবের জানলা দিয়ে এক চিলতে রোদ চোরের মতো ঢুকেছে। টেবিলের তলায় অন্ধকার খুঁজতে এসেছে। শেষ শত্ৰুটিকেও আর আস্ত রাখবে না।

কাকাবাবু সবিনয়ে বললেন, আপনার যদি মন ভাল থাকে তা হলে সামান্য কিছু নিবেদন করতে চাই।

দারোগাবাবু বুক চিতিয়ে বললেন, আমি ঘুষ নিই না, এমনকী একটা চালকুমড়োও না।

আমি কিন্তু ঘুষ নিবেদন করতে চাইনি। এপাশে বসে আপনার হাতের যতটুকু আমি দেখেছি, আঙুল, বুড়ো আঙুল, নখ, তাতে আমি বুঝেছি, আপনি আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ। সেন্ট পারসেন্ট স্পিরিচুয়াল। বৃহস্পতি তুঙ্গী, মঙ্গল ক্ষেত্রী। কেবল একটাই সমস্যা মাথায় আঘাত লাগতে পারে।

লাগতে পারে কী মশাই, লেগে গেছে একবার। আবার লাগবে?

ওইটাই তো আপনার উইক পয়েন্ট। আর ওই পয়েন্ট থেকেই স্ত্রীর সঙ্গে অবনিবনা। ওইটাই আপনার জীবনের একটা কার্স। সংসারে ঢোকার আগে আমার সঙ্গে পরামর্শ করলে আমি আপনার রাইট পার্টনার সিলেক্ট করে দিতুম। আপনার স্ত্রীর বৃহস্পতিও প্রবল। প্রবলে প্রবলে একটু বেশি বলাবলি হয়ে যায়। তবে স্ত্রীভাগ্যেই আপনার জীবনের উন্নতি।

দারোগামশাই কেমন যেন হা হয়ে গেছেন। চোখদুটো স্থির পটলের মতো।

কাকাবাবু কোনওরকম দয়ামায়া না করে একটা বম্বশেল ছাড়লেন, আপনার দ্বিতীয়বার বিবাহ। হবে এবং আপনার জীবন তখন মহাসুখে ভরপুর হবে।

দারোগামশাই হাবিলদারের দিকে তাকিয়ে বললেন, অ্যায় তুমি বাইরে যাও।

তিনি সঙ্গে সঙ্গে স্যালুট করে বেরিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক কাকাবাবুর দিকে একটু ঝুঁকে এসে বললেন, এসব আপনি বলছেন কী করে? সেন্ট পারসেন্ট মিলে যাচ্ছে!

কাকাবাবু হাতির দাঁতের মতো হেসে বললেন, আমার গুরু হলেন তারাখেপা। সবই তার কৃপা, তারই শক্তি। আর যৎসামান্য জ্যোতিষী।

আপনি আমার হাত দেখছেন কী করে? আমি তো টেবিলের এপাশে?

যা বলছি সব আপনার হাতের এ পিঠ, এপারে বসে দেখে বলছি। ও পিঠে আরও কী আছে কে জানে? তারপর বাঁ হাত! বাঁ হাতে আছে আপনার প্রারব্ধ, যা নিয়ে এসেছেন। জানেন তো মানুষ নিয়ে এসে দিয়ে যায়। কীরকম জানেন, একজন সেলসম্যান, হাতে ফোলিও ব্যাগ, এসেছে। একে একে সব বের করে হাতে হাতে তুলে দিচ্ছে। এই নাও সাহিত্য, এই নাও সংগীত, এই নাও চিত্রকলা, আচ্ছা এই নাও সেবা, পরোপকার, এই নাও ভালবাসা, এই নাও সাধনা, আবার, এই নাও নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার, হত্যা। ব্যাগ থেকে সব একে একে নামিয়ে রাখছে। এই হল মানুষের জীবনের কাঠামো। জ্যোতিষীর সঙ্গে সাধনা, আধ্যাত্মিকতা যুক্ত না হলে মানুষকে স্টাডি করা যায় না। গুরু কৃপায় আমি শতকরা নব্বই ভাগ মেলাতে পারি। কিন্তু আমার কোনও গর্ব নেই।

দারোগাসাহেব একেবারে অভিভূত। আরও খানিকটা ঝুঁকে পড়ে বললেন, চলুন না আমার কোয়ার্টারে, কিছুক্ষণ হয়ে যাক। আমার বউয়ের হাতটাও একবার দেখবেন।

নিশ্চয় দেখব, দ্যাটস মাই প্লেজার। শুধু আমাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করে দিন। বড় । সমস্যায় পড়ে গেছি। মানসম্মান নিয়ে টানাটানি। কেসটা মন দিয়ে শুনুন।

অফকোর্স অফকোর্স। দাঁড়ান চা আনাই আগে।

পুলিশের হুকুম, সে যেন মাথায় ছাত ভেঙে পড়ল। যেন চা নয়, হাবিলদারকে তিনটে মুণ্ডু কেটে আনতে বললেন। চা এসে গেল। কাকাবাবু একটু একটু করে সব বললেন। স্তরে স্তরে। সব শুনে দারোগাসায়েব বললেন, র‍্যাশন কার্ড ছিল?

র‍্যাশন কার্ড থাকবে কী করে? এ বাড়িতে তো সবে এসেছিল।

একটা ঠিকানা, কিছু আত্মীয়স্বজন থাকলে জিনিসটার চেহারা অন্যরকম হত। কিছুটা রিস্ক থেকে যাবেই। যাক সে কী আর করা যাবে! লাশ নামিয়ে এনে পোস্টমর্টেমে ঠেলে দিই। হাপিস করে দোব?

হাপিস কাকে বলে?

একেবারে হাওয়া। আনক্লেমড বডি।

দিদির মুখ ভেসে উঠল চোখের সামনে। পাঁচিলের মাথার ওপর দিয়ে উঁকি মারা লতার দুটো কচি পাতার মতো। নিষ্ঠুর পৃথিবীকে দেখতে চাইছে ভীরু মুখে। একটু বাঁচতে চাই। একটু রোদের ছোঁয়া। আমি ফুল হব, আমি ফল হব। আমি সংসার করব, ভালবাসব, ভালবাসা পাব। আমার। একটা অর্থ থাকবে। আমার একটা মূল্য থাকবে। আমি আলোর অভিসারী। দিদির ধারালো মুখ দেখতে পাচ্ছি। সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। দিদির এই আত্মহত্যার পশ্চাৎপটেও গভীর একটা রহস্য আছে, আমি ধরতে পারছি না। আর যাই হোক অজ্ঞাত মৃতদেহ হিসেবে গাদায় ফেলে দেবে, তারপর কঙ্কাল করে বেচে দেবে ডাক্তারির ছাত্রর কাছে, এ আমি চাই না। মৃত্যু আমারও হবে– আজ হোক, কি চল্লিশ বছর পরে হোক। আমার মৃত্যু আমাকে তখন ক্ষমা করবে না। আচমকা গলা দিয়ে প্রতিবাদ বেরিয়ে এল, না, না, তা কেন করবেন, যতই হোক আমার দিদি তো!

দারোগাসায়েব মুচকি হেসে বললেন, এই হল হিন্দু। কিছুতেই সংস্কার ছাড়তে পারে না। বেশ ঠিক আছে। আমি লাশ নামিয়ে পোস্টমর্টেমে পাঠাচ্ছি। সন্ধেবেলা আপনারা ডেলিভারি নিয়ে আসবেন। এক মুহূর্ত বিরতি। নিমেষে চলে গেলেন জ্যোতিষে, আচ্ছা কোনও স্টোন ধারণ করলে পারিবারিক অশান্তি কমা, কি কুইক প্রমোশন, এইসব হতে পারে?

কেন পারে না? কাকাবাবু আবার খেলাতে লাগলেন, জেম থেরাপিতে কিছু কাজ অবশ্যই হয়। তবে দেখেশুনে, কোষ্ঠীবিচার করে পাথর দিতে হবে। আপনার কোষ্ঠী আছে?

শুধু কোষ্ঠী, গাছ কোষ্ঠী। আপনার আজ সময় হবে?

এই যে এক ফ্যাচাং। সারাটা দিন তো এইতেই যাবে। তা না হলে আজ দিন তো ভালই ছিল।

আপনাদের কিছু করতে হবে না। সব আমি করিয়ে দিচ্ছি। এই থানা থেকেই বডি পাইয়ে দোব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আজ আপনি আমার গেস্ট। কী পছন্দ করেন চিকেন না মাটন?

আমি তান্ত্রিক, মাটনই আমার পথ্য।

আমরা সদলে বেরিয়ে এলুম থানা থেকে। কানে লেগে রইল একটি প্রশ্ন, চিকেন না মাটন। পৃথিবী বেলাভূমির মতো, জীবনের ঢেউয়ে মৃত্যুর পদচিহ্ন মুছে যেতে এক লহমা সময় লাগে। গত সন্ধ্যায় দিদি লুচি ভাজার আয়োজন করছিলেন। ময়ান দেওয়া ময়দার তাল এখনও পড়ে আছে ডেকচি চাপা। কড়ায় পড়ে আছে শুকনো আলুর দম। পেটের খিদে, মনের খিদে, খিদে নিয়েই চির বিদায়। পৃথিবীর যতেক মানুষের খিদে কিন্তু রয়েই গেল। এঁরা কী করে চিকেন-মাটনের কথা ভাবছেন!

পুলিশ-পুলিশ করে সারাপাড়া ভেঙে পড়ল। যাঁরা বাজারে যাচ্ছিলেন তাঁরা থমকে গেলেন। কাজের মহিলারা ময়লা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। ট্র্যাক থেকে খইনির পুরিয়া বের করে নীচের দাঁত আর ঠোঁটের মাঝখানে পুরে পিচ পিচ করে থুতু ফেলতে লাগল। চারিদিকে দন্ত্য স-এর ছড়াছড়ি। শাড়ি আর তেলচিটে খোঁপা আর বিনুনির মেটেমেটে গন্ধ। বারান্দায় বারান্দায় বউ আর লুঙ্গি-পরা কর্তাদের ঝুঁকে থাকা ঝুল মূর্তি। কারও কারও মুখে সিগারেট। গবেষণার অন্ত নেই। ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া। এ পাড়ায় কবে কে আত্মহত্যা করেছিল। সেই মেনিদার খ্যানখ্যানে গলা।

দারোগাসায়েব ঘটনাস্থলে ঢুকেই জাত-দারোগা হয়ে গেলেন। ঝুলে থাকা দিদির দেহটাকে যৎপরোনাস্তি পর্যবেক্ষণ করলেন। যে-অংশে আগুনের ঝলসানি সেই অংশটা দেখলেন। মেঝে থেকে হারটা তুলে নিয়ে বললেন, এর দাম অনেক।

কাকাবাবু বললেন, ওটার যা হয় একটা ব্যবস্থা করবেন। দেখবেন মালিক যেন ফিরে পায়।

এরই ফাঁকে একবার বাইরে বেরিয়ে গিয়ে জমায়েতকে ধমকধামক লাগিয়ে এলেন। পুলিশের। কালো গাড়ি চেপে দিদি চলে গেলেন কাটাই-ঘেঁড়াই হতে। আমরা দুজনে আবার থানায়। পাড়া। থেমে পড়েছিল আবার চালু হয়ে গেল। উত্তেজনা থিতিয়ে গেল।

থানায় আমাদের একটা স্টেটমেন্ট লিখে সই করতে হল। যা জানি, যা ঘটেছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। এক মহিলার চকিত জীবনকাহিনি। গগনচন্দ্রের চেহারার বর্ণনা। সব জমা পড়ে গেল। মহাফেজখানায়। দিদির সেই পোঁটলা পড়ে আছে একপাশে। হারের সঙ্গে আমাদের দু’জনের সই করা একটা স্টেটমেন্টও জমা পড়ল।

কাকাবাবু সবশেষে জিজ্ঞেস করলেন, এরপর কী ধরনের ঝামেলা আসতে পারে?

দারোগাসায়েব ঠোঁটে সিগারেট খুঁজতে খুঁজতে বললেন, পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। প্রবলেম হল ওই পুড়ে যাওয়াটা। মনে হতে পারে প্রথমে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছিল, তারপর ঝোলানো হয়েছে। এখন ঝুলোতে গেলে একটা কিছুর ওপর উঠতে হয়। সেরকম কিছু কি ছিল ঘরে? খেয়াল করতে পারছি না তো। ছিল কি?

আমরা তিনজনে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইলুম। সিগারেটের ধোঁয়া রোদের রেখায় পাক মারছে ছিন্নমস্তার ধূমল চুলের মতো। দাঁড়িয়ে আছেন সেকেন্ড অফিসার। হাতের তালুতে ব্যাটন ঠুকছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *