1 of 2

২.২০ সুবৰ্ণর অগাধ সমুদ্রের এক অঞ্জলি জল

সুবৰ্ণর অগাধ সমুদ্রের এক অঞ্জলি জল, অগাধ স্মৃতিকথার একমুঠো কথা এবার আলোর মুখ দেখবে। তাই সুবৰ্ণলতা মর্মরিত হচ্ছে। তাই সুবর্ণ তাকিয়ে দেখছে না তার অন্তঃপুরে লোকাঁচারিবিধির সমস্ত অনুশাসনগুলি নির্ভুল পালিত হচ্ছে কিনা।

এখন সুবর্ণ অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কাটিয়ে তার সেই প্রথম কবিতার দিনটির কাহিনীখানি অক্ষরের বন্ধনে বন্দী করে নিয়ে একবার মামীশাশুড়ীর বাড়ি যাবার জন্যে স্পন্দিত হচ্ছিল।…

তাই ছেলেকে ডেকে বলছিল, সুবল, একখানা গাড়ি ডেকে এনে দিতে পারবে?

তা এই রকমই কথা সুবর্ণর।

সুবল, একটা গাড়ি ডেকে এনে দে না বলে এনে দিতে পারবে?

মা-ছেলের সহজ সম্বন্ধের ধারার মধ্যে যেন দূরত্বের পাথর পড়ে আছে চাই চাই, তাই জলটা বয়ে যায় ঘোরাপথে।

কে জানে এই পাথরটা কার রাখা?

মায়ের না ছেলের?

সুবলিও তো বলল না, কী আশ্চৰ্য, পারব না কেন? যাবে কোথায়? চল পৌঁছে দিচ্ছি গিয়ে।

সুবল শুধু যান্ত্রিক গলায় উচ্চারণ করলো, কখন দরকার?

সুবৰ্ণলতা আহত দৃষ্টিতে তাকায়।

সুবৰ্ণলতা যেন বড় অপমান বোধ করে।

সুবৰ্ণলতা তো জানে, ওর এই ছোট ছেলেটার ভিতরে হৃদয় আছে। তবে সুবৰ্ণলতার বেলায় কেন সে হৃদয়ের এতটা কার্পণ্য? যেন চেষ্টা করে হৃদয়টাকে শক্ত মুঠোয় আটকে রাখে সুবৰ্ণলতার ছোট ছেলে। কিছুতেই যাতে না অসতর্কে একটু স্থলিত হয়ে পড়ে।

আশ্চর্য!

মা বলে কতদিন ডাকে নি সুবল?

ইচ্ছে করে না। এই কাঠিন্যের সামনে এসে কোনো আবেদন করতে। তবু একআধ-সময় উপায়ও তো থাকে না। একা একটা ভাড়াটে গাড়ি করে এবাড়ি-ওবাড়ি করার সাহসটাই তো অসমসাহসিকতা। তবু সে সাহস দেখায় সুবর্ণ, দুটো শ্বশুরবাড়ি একাই যাওয়া-আসা করে। তাই বলে পথে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে গাড়ি ধরে নিয়ে যাওয়া তো চলে না? সেটা যেন সাহস নয়, অসভ্যতা। অন্তত সুবর্ণর মাপকাঠিতে।

সুবল না হোক, অন্য ছেলেরা এই নিয়ে শোনাতে ছাড়ে না। বলে, আর গাড়ি ডেকে দেওয়ার ফার্স কেন বাবা? বেশ তো স্বাধীন হয়েছ, যাও না, বেরিয়ে পড়ে ডেকে নাও গে না একখানা।

বলে আরো বৌদের কাছে তীক্ষ্ণ হুল খেয়ে।

বৌদের একা এক পা বেরোবার হুকুম নেই; অথচ শাশুড়ী দিব্বি—

তা সুবল কিছু শোনাল না। শুধু বললো, কখন দরকার?

সুবৰ্ণও অতএব সেই যান্ত্রিক গলাতেই উত্তর দেয়, এখনই দরকার। তা নইলে বলতে আসবো কেন? বি আসে নি এখনো—

কথা শেষ হয় না, হঠাৎ বুকটা ধড়াস করে ওঠে সুবর্ণর।

নিচে ও কার গলা?

জগু বাঁটুঠাকুরের না?

কেন?

এমন অসময়ে কেন উনি?

তবে কি বলতে এসেছেন ও বই উনি ছাপতে পারবেন না?

পড়ে কি বিরক্ত হয়েছেন?

অবাক হয়েছেন সুবর্ণর নির্লজ্জতায়?

কিন্তু সেই নির্লজ্জতার বিস্ময়ে আমন গলা ছেড়ে বাদ-বিতণ্ডা করবেন?

কার সঙ্গে করছেন?

একটা হিন্দুস্থানীর গলা না?

গাড়োয়ান? পয়সা নিয়ে কচকচি করছেন?

আর বেশিক্ষণ ভাবতে হয় না।

ছাপাখানার মালিক জগন্নাথচন্দ্রের হেঁড়ে গলা আকাশে ওঠে, সুবল, কই রে সুবল! এই যে বৌমা, তুমিই এসে গেছ। তোমার বই এনে দিলাম। পাঁচশ কপি ছাপিয়েছি, বুঝেছ? প্রথম বই, বিয়ের পদ্যর মত বিলোবে তো চাট্টি! বেশি থাকাই ভাল। মুটে ব্যাটা কি কম শয়তান! ওই কখানা বই এপাড়া-ওপাড়া করতে কিনা ছ। পয়সা চায়। চার পয়সার বেশি হওয়া উচিত? বল তো বৌমা? রাগ করে দুআনিটাই ছুঁড়ে দিলাম। বলি, নে ব্যাটা, পান খেগে যা।

এই বাক্যস্রোতের মাঝখানে বকুল এসে নীরবে জ্যাঠাকে প্ৰণাম করে, তাদের জগু জ্যাঠামশাইয়ের এমন অসময়ে আবির্ভাবের কারণ ঠিক অনুধাবন করতে পারে না। সঙ্গে ওগুলোই বা কি?

তা জগু কাউকে বেশিক্ষণ অন্ধকারে ফেলে রাখেন না। সহৰ্ষে বলেন, এই যে তোমাদের মার বই হয়ে গেছে। নাও এখন বন্ধুবান্ধবকে বিলোও। সার্থক মা তোমাদের, লোকের কাছে বলতে কইতে মুখ উজ্জ্বল। ছাপাখানার লোকেরা তো শুনে তাজ্জব।

বলা বাহুল্য, বকুল এর বিন্দু-বিসর্গও বুঝতে পারে না।

মার বই! সেটা আবার কি জিনিস!

তাই অবাক হয়ে মার মুখের দিকে তাকায়।

বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে সুবৰ্ণও।

বই ছাপা হয়ে গেছে!

ছাপা এত শীগগির হয়!

নতুন পরিচ্ছেদটা আর দেয়া গেল না তাহলে? না যাক। কিন্তু কোথায় বই? ওই ঝুড়িটায়? যে বুড়িটা সিঁড়ির তলায় বসানো রয়েছে?

পুরনো খবরের কাগজে মোড়া দড়িবাঁধা স্তুপীকৃত কতকগুলো প্যাকেটিভর্তি মস্ত ঝুড়িটা জগন্নাথচন্দ্ৰ এবার টেনে সামনে নিয়ে আসেন।

একটা অপ্ৰত্যাশিত স্তব্ধতায় আবহাওয়াটা যেন নিথর হয়ে গেছে।

মোটা বুদ্ধি জগন্নাথও যেন টের পান, কোথায় একটা সুর কেটে গেছে। ভাদ্রবৌ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে পুলক প্রকাশ করবে না। সত্যি, তবু ভাবে-ভঙ্গীতে তো বোঝা যাবে!

যেদিন সুবর্ণ খাতাখানা নিয়ে ছাপার কথা বলতে গিয়েছিল, সেদিনও কিছু আর ভদ্রবৌয়ের রীতি পুরোপুরি রক্ষিত হয় নি। আহ্লাদের একটি প্রতিমূর্তি দেখিয়েছিল মানুষটাকে।

আর এখন?

যেন হঠাৎ সাপে কেটেছে।

ঘোমটা তো দীর্ঘ নয় ও-বাড়ির বৌদের মত, মুখ দেখতেই পাওয়া যায়।

অপ্ৰতিভের মত এদিক-ওদিক তাকান জগন্নাথ, তারপর শুকনো-শুকনো গলায় বলেন, বাবা বাড়ি নেই?

বকুল আস্তে বলে, না, পাশের বাড়ি দাবা খেলতে গেছেন।

অন্যদিন হলে নিৰ্ঘাত জগন্নাথ সঙ্গে সঙ্গে হেঁকে বলে উঠতেন, গেছে তো জানি। চিরকেলে নেশা। কথায় আছে, তাস দাবা পাশা, তিন সর্বনাশা। আর ভায়া আমার ওই তিনটিতেই ড়ুবে আছেন।

কিন্তু আজ আর জগন্নাথের বাকস্মৃতি হয় না, আচ্ছা আমি এখন যাচ্ছি, আমি এখন যাচ্ছি। চটিটা পায়ে গলান।

আর এতক্ষণে সুবৰ্ণ মাথায় ঘোমটা টানে। আঁচলটা গলায় দিয়ে আস্তে পায়ের কাছে একটি প্ৰণাম করে।

থাক থাক, হয়েছে হয়েছে—, বলে চলে যান জগু।

আর পথে বেরিয়ে ভাবতে ভাবতে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছান-আর কিছু নয়, অতি আহ্লাদ। কথাতেই আছে, অল্প সুখে হাস্যমুখে নানা কথা কয়, বেশি সুখে চোখে জল—চুপ করে রায়।

আর বকুলটা?

ও বেচারা হকচকিয়ে গেছে আর কি!

বোঝাই যাচ্ছে বাড়িতে কিছু জানান নি বৌমা।

আহ্লাদে নিশ্চিন্ততায় এবার জোরে জোরে পা ফেলেন জগু, ওঃ, প্ৰবোধচন্দ্র এসে চোখ কপালে তুলবেন! সাতপুরুষে কেউ কখনো বই লেখে নি, লিখল। কিনা ঘরের বৌ!

মাকে গিয়ে বলতে হবে, বুঝলে মা, আহ্লাদে তোমার মেজবৌমার আর মুখ দিয়ে কথা সরে না!

তা প্ৰবোধচন্দ্রের প্রথমটা চোখ কপালে উঠেছিল বৈকি।

তারপরই বাড়িতে উঠলো হাসির হুল্লোড়।

ছেলেরা বোধ করি এমন হৈ-চৈ করে হাসাহাসি করে নি। বহুকাল। বাবা বলে ডেকে কথাই বা কয় কবে?

বাবা, মার বই! জগু জ্যাঠামশাইয়ের ছাপাখানার মাল! দেখো দেখো! উঃ!

প্ৰবোধ আকাশ থেকে পড়ে, মার বই! তার মানে?

তার মানে? হচ্ছে, আমরা তো কেউ কখনো মার কিছু করলাম না, তাই মা নিজেই হাল ধরেছিলেন, চুপি চুপি জগু জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি গিয়ে ছাপতে দিয়ে এসেছিলেন। সেই বই ছেপে এসেছে।

প্ৰবোধ মেয়েদের মত গালে হাত দিয়ে বলে ওঠে, বলিস কি রে ভানু, এ যে সত্যি সেই কলাপাতে না এগোতে গ্ৰন্থ লেখা সাধ! তোদের গর্ভধারিণীর একেবারে গ্রন্থকার হবার বাসনা!

হুঁ। ভানু হেসে ফর ফর করে বইয়ের পাতাগুলো উড়িয়ে দিয়ে বলে, আহা, গ্ৰন্থই বটে। গ্রন্থের নমুনাটি লোককে দেখাবার মত!

তা হাস্যটা নেহাৎ অপরাধ নয়। ভানুর, সুবৰ্ণলতার স্মৃতিকথার নমুনা দেখলে কে-ই বা না হেসে থাকতে পারতো!

মোটা বুদ্ধি জগন্নাথচন্দ্ৰ পয়সায় দুখানা বর্ণপরিচয়ের কাগজে বই ছেপে দিয়েছেন সুবৰ্ণলতার, ভাঙা টাইপ আর পুরু কালি দিয়ে। অবশ্য সেটা ঠিক জগুরা দোষ নয়, জগুর ছাপাখানার দোষ। অথবা সুবৰ্ণলতার ভাগ্যেরই দোষ।

বই দেখে পর্যন্ত বুঝি সুবৰ্ণ তার ভাগ্যের স্বরূপটা স্পষ্ট করে দেখতে পেয়েছে। নাঃ, আর কোনো সংশয় নেই, আর কারো দোষ নেই, সবটাই সুবৰ্ণলতার ভাগ্যের দোষ!

শুধুই কাগজ? শুধুই মুদ্রাযন্ত্রের প্রমাদ?

মুদ্রাকরের প্রমাদ নেই?

যা নাকি ছুরির মত বুকে এসে বিধছে!

রসিয়ে রসিয়ে আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আগেই পড়া হয়ে গিয়েছিল, আর একবার পড়া হতে থাকে বাপের সামনে, শুনুন বাবা, শুনে যান। এই অপূর্ব প্রেস, আর এই অপূর্ব প্রুফরীডার নিয়ে ব্যবসা চালান জগু জ্যাঠামশাই। নাম-ধাম কিছু নেই বইয়ের, বই ছাপা হয়েছে নাম হয়নি। প্রথমেই শুরু শুনুন, ভূমিকা— আমি একটি নিরুপায় রঙ্গনাড়ি, আমার একমাত্র পরিচয় আমি একটি অন্ধপুরির মেজবৌ! আমার-

প্ৰবোধ হঠাৎ প্ৰায় ধমকে ওঠে, ও আবার কি রকম পড়া হচ্ছে? কী ভাষা ওসব?

বাংলা ভাষাই। যা লেখা আছে তাই পড়ছি। আরো নমুনা আছে দেখুন না। কৌতুকের হাসিতে চঞ্চল দ্রুতকণ্ঠে পড়তে থাকে ভানু, আমার মন আচে বুদ্দি আচে, মস্তিষ্ক আচে, আত্মা আচে, কিন্তু কেহ আমার সত্মাকে শীকার করে না। আমি যে—

খুক খুক করে একটা হাসির শব্দ শোনা যায়। বৌয়েরা হাসছে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে। ভানুর ভঙ্গীতেও যে হাসির খোরাক!

কিন্তু হঠাৎ একটা বিপর্যয় ঘটে যায়।

একটা অপ্ৰত্যাশিত ঘটনা ঘটে।

কোথায় ছিল সুবৰ্ণলতা, অকস্মাৎ ক্রুদ্ধ ব্যাখীর মত এসে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বিয়ে-হয়ে-যাওয়া মস্ত বড় ছেলের ওপর।

ব্যাঘ্রীর মতই একটা গো গো শব্দ শোনা যায় সুবৰ্ণলতার গলা থেকে! বইখানা কেড়ে নিয়ে কুচিকুচি করছে।

বহুকাল আগের মত আবার একদিন ছাদে আগুন জুললো। সুবৰ্ণলতার গোলাপী রঙের বাড়ির ছাদে।… না, যত উদভ্ৰান্তই হোক সে, তদণ্ডেই বাড়ির যেখানে-সেখানে আগুন জেলে একটা অগ্নিকাণ্ড করে বসে নি।

ধীরে-সুস্থে সময় নিয়ে জ্বলিয়েছে আগুন, অনেক সময় নিয়ে।

পয়সায় দুখানা বর্ণপরিচয় এর কাগজে ছাপা, তেমনি মলাটেই বাধাই, পাঁচশোখানা বই পুড়ে ছাই হতে এতক্ষণ লাগলো? না, সেগুলো বেশী সময় নেয় নি। সময় নিয়ে আর চোখ-জ্বালানো ধোঁয়া উদগিরণ করে যেগুলো পুড়লো, সেগুলো হচ্ছে অনেক কালের হলদে হয়ে যাওয়া পাতা, আর বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কালিতে লেখা অনেকগুলো খাতা! সদ্য কেনা নতুন চকচকে মলাটের খাতা! খাতার রাশি!

ধ্বংস হয়ে গেল। আজীবনের সঞ্চয়, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল চিরকালের গোপন ভালবাসার ধনগুলি। সুবৰ্ণলতার আর কোনো খাতা রইল না।

যে খাতাগুলি দীর্ঘকালের সঙ্গী ছিল, তিলে তিলে ভরে উঠেছিল বহু সুখ-দুঃখের অনুভূতির সম্বলে! লোকচক্ষুর অন্তরালে কত সাবধানেই লেখা আর তাদের রাখা! এক-একখানি খাতা সংগ্রহের পিছনেই ছিল কত আগ্রহ, কত ব্যাকুলতা, কত চেষ্টা, আর কত রোমাঞ্চময় গোপনতার ইতিহাস!

হাতে পয়সার অভাব তার কখনই ছিল না একথা সত্যি, উমাশশীর মত বিন্দুর মত দুঃখময় শূন্যহাতের অভিজ্ঞতা কদাচ না, প্ৰবোধের ভালবাসার প্রকাশই ছিল খরচ কোরো বলে কিছু টাকা পয়সা হাতে গুঁজে দেওয়া। কিন্তু দেওয়াটা লোকের চোখের আড়ালে হলেও, সেই খরচটা তো আড়াল দিয়ে হওয়া সম্ভব ছিল না? সুবর্ণ তো আর নিজে দোকানে যাবে না?

কাউকে দিয়ে আনানো?

তা সদর রাস্তার পথ ধরে যে বেরোবে আর ঢুকবে সে মশা-মাছি হয়ে করবে না। সেই কাজটা? প্রথমবার যখন সুবৰ্ণ অবোধ ছিল, অতএব অসতর্কও ছিল, দুলোকে আনতে দিয়েছিল মলাট-বাধানো খাতা একখানা। সহস্ৰ কথার জনক হলো সেই খাতা!

কেন, কি দরকার, এমন দামী আর শৌখিন খাতা কোন কাজে লাগবে, পয়সা থাকলে ধোপাগয়লার হিসেবও তাহলে চোর আনা ছ। আনার খাতায় ওঠে ইত্যাদি ইত্যাদি।

সেই থেকে সাবধান হয়ে গিয়েছিল সুবৰ্ণ।

গোপনতা সে ভালবাসে না। কিন্তু এমন উদঘাটিত হতেও ভাল লাগে না। তাই ঘরের জানলা থেকে পাশের বাড়ির একটা ছোট ছেলের হাতে সুকৌশলে খাতার পয়সা এবং তার ঘুড়ি-লান্টুর পয়সা চালান করে করে মাঝে মাঝে খাতা আনাতো। বাধানো রুলটানা খাতা।

লোকচক্ষুর অগোচরে আনিয়েছে তাদের মালিক, লোকচক্ষুর অন্তরালেই রেখে দিয়েছে। লালন করেছে হৃদয়ারস দিয়ে, পুষ্ট করেছে জীবন-বেদনার আবেগ দিয়ে।

কতদিন কত নিভৃত ক্ষণে ভালবাসার হাতে হাত বুলিয়েছে তাদের গায়ে, ভালবাসার চোখে তাকিয়েছে। যেন তারা শুধু প্ৰাণতুল্য কোনো বস্তুই নয়, প্ৰাণাধিক কোনো জীবন্ত প্ৰিয়জন।

সেই তাদের অহঙ্কার হলো, আলোর মুখ দেখতে চাইল তারা।

অন্ধকারের জীব তোরা, কিনা আলোর মুখ দেখবার বাসনা? অতএব পেতে হলো সেই দুঃসহ স্পর্ধার শান্তি!

সেই ভালবাসার হাতই তাদের গায়ে আগুন লাগালো, সেই ভালবাসার চোেখই নিষ্পলক বসে বসে দেখল তাদের ভস্ম হয়ে যাওয়া!

ছাতের সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল সুবর্ণ, ভেবেছিল এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী না থাকে।

কিন্তু সিঁড়ির দরজাটায় ছিটিকিনি আলগা ছিল, দরজাটা ধরে টানতেই খুলে গিয়েছিল। তাই রয়ে গেল একজন সাক্ষী।

হঠাৎ স্তব্ধ দুপুরে কাগজ-পোড়া-গন্ধে আশঙ্কিত হয়ে এঘর-ওঘর দেখে ছুটে ছাতে উঠে এসেছিল। সে।

দরজাটা টেনে খুলেছিল, আর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

ওখানটায় চিলেকোঠার দেওয়ালের ছায়া পড়েছিল, তাই এই প্ৰচণ্ড রোদের মাঝখানেও সুবর্ণর মুখে আগুনের আভার ঝলক দেখা যাচ্ছিল। সেই আভায় চিরপরিচিত মুখটা যেন অদ্ভুত একটা অপরিচয়ের প্রাচীর নিয়ে স্থির হয়ে ছিল।

কিন্তু ওই অপরিচিত মুখটার প্রত্যেকটি রেখায় রেখায় ও কিসের ইতিহাস আঁকা?

জীবনব্যাপী দুঃসহ সংগ্রামের?

না পরাজিত সৈনিকের হতাশার, ব্যর্থতার, আত্মধিক্কারের?

কে জানে কি!

যে দেখেছিল, তার কি ওই রেখার ভাষা পড়বার ক্ষমতা ছিল?

হয় তো ছিল না। তাই মুহূর্তকাল বিহ্বল বিচলিত দৃষ্টি মেলে দেখেই ভয় পাওয়ার মত ছুটে পালিয়ে এসেছিল সিঁড়ি বেয়ে।

তারপর?

তারপর সেই হত্যাকাণ্ডের দর্শক এক নতুন চেতনার অথৈ সমুদ্রে হাতড়ে বেড়িয়েছে সেই রেখার ভাষার পাঠোদ্ধারের আশায়।

অজ্ঞাতে কখন তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে, মনে মনে উচ্চারণ করেছে সে, চিরদিন তোমাকে ভুল বুঝে এসেছি আমরা, তাই অবিচার করেছি।

তারপর? তারপর এল এক নতুন ঢেউ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *