২০
বাসুদেব অগ্রজের কাছে ক্ষাত্রধর্ম বা ধর্মযুদ্ধের যে ব্যাখ্যাই করুন, উপস্থিত বীরগণ যে তাতে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না— চতুর্দিক-উত্থিত দুর্যোধনের জয়ধ্বনি ও সাধুবাদে এবং ভীমের উদ্দেশে বর্ষিত ধিক্কার বাক্যেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠল। যুধিষ্ঠিরের কুণ্ঠা ও আত্মগ্লানির অন্ত রইল না, অর্জুনও লজ্জায় অধোবদন এবং ভীমের প্রতি বিমুখ হয়ে রইলেন। শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু পুনশ্চ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘শত্রু সংখ্যায় বা বলবীর্যে বহুগুণ হলে ন্যায়যুদ্ধের রীতি লঙ্ঘন ক’রে কূট উপায় অবলম্বন করা অশাস্ত্রীয় নয়, ইতিপূর্বে বহুক্ষেত্রেই এমন হয়েছে। বহু সৎ যোদ্ধা এ উপায় অবলম্বন করেছেন বারম্বার সুরাসুর সংঘর্ষ কালেও দেবতাদের বিজয়েতিহাসে এ দৃষ্টান্ত বিরল নয়। ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতি মহাত্মাদের এমন কি দুর্যোধন প্রভৃতিকেও আপনারা ধর্মযুদ্ধে পরাজিত বা নিহত করতে পারতেন না। ধর্মবুদ্ধির জয় এবং জনসমাজের কল্যাণ যেখানে লক্ষ্য, সেখানে জড়পদার্থের মতো ন্যায়ের এত সূক্ষ্ম নীতি অবলম্বন ক’রে থাকলে চলে না। এসব নীতি বা অনুশাসন মনুষ্যগণই প্রচলিত করেছেন, তা লঙ্ঘন করার ক্ষমতাও অবশ্যই তাঁদের আছে। আমি যা করেছি, যে উপদেশ নির্দেশ ইঙ্গিত দিয়েছি তা দেশবাসীর চূড়ান্ত কল্যাণ এবং পাপের বিনষ্টির কারণেই—তার জন্য আমি লজ্জিত নই।’
বাসুদেবের এই বলিষ্ঠ ও আত্মবিশ্বাসপূর্ণ উক্তিতে ভীম হৃষ্ট হয়ে সিংহনাদ ক’রে উঠলেন, পাণ্ডবপক্ষীয় অপর বীরগণও বিজয়োল্লাস প্রকাশ করলেন। তবু তখনই যেন কারও আর নিজ শিবিরে প্রত্যাবর্তনের উদ্যম বা ইচ্ছা রইল না। যুধিষ্ঠির প্রমুখ পাণ্ডবপ্রধানগণ কিছু দূরে নদীতীরের শষ্পাচ্ছাদিত উন্মুক্ত ভূমিতে গিয়ে অবসন্নভাবে বসে পড়লেন। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, তাঁরা বিজয়ী হয়েছেন কিন্তু লাভবান হয়েছেন কি? কি নিয়ে, কাদের নিয়ে তাঁরা সুখী হবেন! আত্মীয় বান্ধব বীরগণ প্রায় সকলেই নিহত হয়েছেন ভারতবর্ষে বীর বলতে, শাসক ও যোদ্ধা বলতে কেউই রইল না রণভূমি লক্ষ লক্ষ শবে সমাচ্ছন্ন,–শিবা, কুক্কুর, বৃক ও নর-মাংসভোজী পিশাচের ক্রীড়াভূমি হয়ে উঠেছে।… তাঁদের উপদেশ নির্দেশ দিতে, কঠিন কর্তব্যে সহায়তা করতে কেউ কি আর অবশিষ্ট রইল? অগণিত বিধবা ও অনাথ শিশুদের নিয়ে তাঁরা কি করবেন? জীবনে আনন্দ বা সুখ উপভোগ বলতে, উৎসব বলতে আর কিছুই রইল না আনন্দ ও উৎসবের সঙ্গীরাই তো সকলে চলে গেল। গৌরব? কাদের নিয়ে কাদের কাছে সে গৌরব প্রকাশ করবেন?
তবু, ভাববিলাসের অবসর সেটা নয়, কর্তব্য তখনও কিছু অবশিষ্ট ছিল। যে কোন কর্মের অবতারণা করলেই ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, তার পূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। স্বল্পাবশিষ্ট বিজয়ী পাণ্ডব সৈন্যগণ অতঃপর যুদ্ধের রীতি অনুযায়ী কৌরবশিবির লুণ্ঠনে প্রবৃত্ত হবে, এ তাঁরা জানতেন। সেখানে এখনও বৃদ্ধ অমাত্য ও সচিবগণ আছেন বিশেষ —কিছু কিছু কৌরব পুরনারীও আছেন তৈজসপত্র, শয্যা, বস্ত্র, মূল্যবান ধাতুনির্মিত পাত্রাদি, দাসদাসী, অর্থ ও ভোজ্য— এগুলি লুণ্ঠিত হোক—তাঁদের না অমর্যাদা হয়।
সুতরাং অগত্যাই, ইচ্ছাশক্তির কশাঘাতে, পাণ্ডুপুত্রগণ তাঁদের ক্লিষ্ট দেহ ও ক্ষিণ্ণ মনকে সক্রিয় ক’রে তুললেন। কৌরবশিবিরে পৌঁছতে প্রবীণ অমাত্যরা যেন মৃতদেহে প্রাণ পেলেন। সকলে এসে নতজানু হয়ে পাণ্ডবদের আনুগত্য স্বীকার করলেন এবং আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। স্ত্রীলোকেরা বেণী মোচন ক’রে নতমস্তকে দীনভাবে এসে দণ্ডায়মান হলেন। তাঁদের আশ্বস্ত ও শান্ত ক’রে পাণ্ডবরা স্বপক্ষের যোদ্ধাগণকে কোন প্রকার অশোভন আচরণ না করার জন্য সতর্ক ক’রে দিলেন, অন্যথায় কঠোর শাস্তি বা প্রাণদণ্ড হতে পারে সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিলেন।
অতঃপর কোন লজ্জাজনক ঘটনা ঘটবে না, এটা অনুমান করা যায়—তত্রাচ শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের পরামর্শ দিলেন, সন্নিকটস্থ নদীতীরে সে রাত্রি যাপন করতে, কারণ তাহলে লুব্ধ সাধারণ সৈনিকরা কৌরবঅমাত্য, পরিচর বা স্ত্রীলোকদের উপর কোন অত্যাচার করতে সাহস করবে না।
পাণ্ডবরাও সহজেই এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন—বরং সাগ্রহে বলাই উচিত। কারণ নানা কারণেই তাঁরা অবসন্ন—এ অবসাদ দেহে ও মনে সমান ভাবেই বিশাল পর্বতের ন্যায় ভার সৃষ্টি করেছে। বিশেষ এই কৌরব শিবিরে এসে পৌঁছানো মাত্র এক দুর্ঘটনায় অর্জুন আরও বিষাদগ্রস্ত, এই ঘটনার মধ্যে ভবিষ্যতের একটা চিত্র দেখতে পেয়ে কিছু আতঙ্কগ্রস্তও হয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত কপিধ্বজরথ—যা শত্রুপক্ষের ত্রাসস্বরূপ ও চির বিস্ময়স্থল ছিল, পৌনঃপুনিক আক্রমণেও এতদিনে ভগ্ন বা বিনষ্ট হয় নি—ওঁরা রথ থেকে অবতরণ করা মাত্র সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গেল।
বাসুদেব এ সম্ভাবনা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। তাঁরই উপদেশে অর্জুন তাঁর অক্ষয় দুটি তূণীর ও গাণ্ডীব ধনুসহ অবতরণ করেছিলেন, নচেৎ এগুলিও বিনষ্ট হ’ত। বাসুদেব বললেন, ‘তোমার নানাবিধ প্রচণ্ড শক্তিসম্পন্ন বিস্ফোরক অস্ত্র থাকার জন্যই—তার অন্তর্নিহিত অদৃশ্য তেজঃপুঞ্জে রথের কাষ্ঠে এই অগ্নি সঞ্চারিত হয়েছে, কাষ্ঠের উপর মূল্যবান ধাতুর বহিরাবরণ থাকার জন্য সে অগ্নি প্রকাশে কিছু বিলম্ব ঘটেছে। আমি সে অগ্নির তেজ অনুভব করেছিলাম কিন্তু অনাবশ্যক বোধেই তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করি নি। অদৃশ্য-তেজ-বিকিরণকারী অস্ত্রসমূহের সঞ্চারিত বহ্নি নিবারণ করার সাধ্য তোমাদের ছিল না।’
বাসুদেবও এই দীর্ঘ অষ্টাদশ দিবসব্যাপী—অষ্টাদশ বৎসরের কষ্ট ভোগের মতোই যা দুঃসহ—যুদ্ধের পর তাঁদের সঙ্গে সেই উন্মুক্ত, অনন্ত অসংখ্য তারকাখচিত আকাশের নিচে কলস্বনা নদীতীরে শান্তিতে রাত্রি যাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু যুধিষ্ঠির কুণ্ঠিত দ্বিধার সঙ্গে সবিনয়ে বললেন, ‘বাসুদেব, তুমি আমাদের সকল অবস্থায় সতত রক্ষা করেছ—এখন একটি সর্বশেষ এবং কঠিনতম বিপদ থেকেও যদি ত্রাণ করো তবেই আমরা রক্ষা পাই। জননী গান্ধারী অলোকসামান্য সতীত্বে, ঐকান্তিক সত্যনিষ্ঠায় ও সকল-অবস্থাতেই-অখণ্ড-ধর্মরক্ষায় মহতী শক্তি লাভ করেছেন। তিনি শতপুত্র ও অসংখ্য পৌত্রাদির মৃত্যুসংবাদে ব্যথিত ও বিচলিত সন্দেহ নেই, এখন দুর্যোধনের এই শোচনীয়ভাবে নিহত হওয়ার সংবাদে তিনি অধিকতর ক্রুদ্ধ হবেন তা সুনিশ্চিত। বিশেষ, কথিত আছে তাঁর করুণাসম্পাতেই ভীমের অঙ্গ সর্বপ্রকার আঘাত সহ হয়েছে–এ অবস্থায় আমাদের অভিসম্পাত দেওয়াও অসম্ভব নয়। তাঁর অভিশাপকে আমি ঋষিদের অভিশাপ অপেক্ষাও ভয় করি। তুমি অপর কেউ যাওয়ার পূর্বে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ক’রে সাধ্যমত সান্ত্বনা দিয়ে যদি একটু শান্ত ক’রে এসো তবে আমরা তাঁর ক্রোধবহ্নি থেকে অব্যাহতি লাভ করতে পারি।’
শ্রীকৃষ্ণের সুচারু ওষ্ঠপ্রান্তে কি সেই মুহূর্তে এক অবোধ্য হাস্যরেখা ফুটে উঠেছিল?
নিয়তির নিষ্ঠুর বিধানে বুদ্ধিমান ব্যক্তিকেও নির্বোধের ন্যায় অসতর্ক আচরণ করতে এবং আত্মরক্ষায় বিমুখ হতে দেখে দুরদর্শী ব্যক্তির মুখে যে ধরনের করুণাসূচক হাসি ফুটে ওঠে—তদ্রুপ?
কিন্তু তেমন বক্রহাস্যরেখা এক অবর্ণনীয় সুন্দর ওষ্ঠপ্রান্তকে রঞ্জিত করল কি না— সেই প্রায়ান্ধকার সায়াহ্নবেলায় তা শোকসন্তপ্ত বিষণ্ণ পাণ্ডবদের দৃষ্টিগোচর হ’ল না।
শ্রীকৃষ্ণ ‘তাই হোক’ এই মাত্র উক্তি ক’রে নিজরথে আরূঢ় হলেন।
সেই ঘোরা কালান্তক নিশীথে কয়েক যোজনব্যাপী কুরুক্ষেত্রের মহাশ্মশানে মহামানী মহাদাম্ভিক শক্তিমদমত্ত, একচ্ছত্র-রাজ্যশাসন-প্রতিষ্ঠাভিলাষী কুরুপ্রধান দুর্যোধন তখন একা অসহায় ভাবে পড়ে ছিলেন। কৌরব বা পাণ্ডবদের কারও এ কথা মনে হয় নি যে, তিনি এখনও জীবিত অথচ আত্মরক্ষায় অসমর্থ—তাঁকে মাংসলোলুপ প্রাণীদের হিংস্র আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য কিছুসংখ্যক প্রহরী নিয়োগ আবশ্যক।
যুদ্ধান্তে এ দায়িত্ব বিজয়ীপক্ষেরই সমধিক। কিন্তু পাণ্ডবরা অসংখ্য চিন্তা ও দুশ্চিন্তা, দায়িত্ব এবং এতদিনের দুর্ভাবনা দূর হওয়ার প্রতিক্রিয়া, অবসাদ, শোক ও বিপুল কর্মভার সম্বন্ধে সচেতনতার মধ্যে এই অবশ্যপালনীয় প্রধান কর্তব্য বিস্মৃত হয়েছিলেন। কৌরবপক্ষীয় মুষ্টিমেয় সৈনিক ও সেনানায়কগণ আত্মরক্ষার চিন্তায় ব্যস্ত এবং উদ্বিগ্ন—এই ঘোর বিপদের মূল কারণ দুর্যোধন সম্বন্ধে তাদের দায়িত্ববোধ থাকার প্রশ্নই ওঠে না। পাণ্ডবপক্ষীয় যোদ্ধারা লুণ্ঠনে ও নিশ্চিত বিজয়ানন্দ আস্বাদে তৎপর—ভগ্নোরু হতভাগ্য দুর্যোধনের কথা তাদের মনে আসবে তা সম্ভব নয়।
অগত্যা দুর্যোধন সেই গলিত অর্ধগলিত শবের পূতিগন্ধ শ্মশানভূমিতে শিবা সারমেয় বৃক প্রমুখ নরমাংসাশী অপর পশু বা পশুর অধম পিশাচস্বভাব মানুষের বিকট উল্লাসধ্বনি ও কলহসঞ্জাত কর্কশ চিৎকারের মধ্যে একাকী রাত্রি যাপন করছিলেন। মৃত্যুর অধিক বিলম্ব নেই তা তিনি বহুক্ষণই অনুভব করেছেন কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই সর্বদুঃখহর অন্তিম শান্তিস্বরূপ মহানিদ্রা নেমে আসে, ততক্ষণ দেহটা রক্ষার প্রয়োজন আছে। নিম্নাঙ্গ একেবারেই অক্ষম—তাতে যন্ত্রণা অনুভব করা যায়, তা চালনা করা যায় না। কোনমতে দুই জানুতে ভর দিয়ে অর্ধোত্থিত অবস্থায় এক-একবার সেই করালদংষ্ট্রা বীভৎসমূর্তি প্রাণীদের তাড়না করছেন—পরক্ষণে, সেই সামান্য প্রচেষ্টার ফল স্বরূপই, আহত বক্ষে চাপ পড়ায় রক্ত বমন করতে করতে অবসন্ন হয়ে শুয়ে পড়ছেন।
এই অবস্থাতেই কয়েক দণ্ড—এখানে সময়ের পরিমাণ অনুমান-সাপেক্ষ, ঘোষকদের দণ্ডযাম ঘোষণা গত কয়েকদিন পূর্বেই স্তব্ধ হয়ে গেছে—অতিবাহিত হলে অকস্মাৎ তাঁর কর্ণে প্রথমে রথচক্র-ঘর্ঘর ও পরে একাধিক নরপদশব্দ প্রবেশ করল। কোনমতে মাথা তুলে দেখলেন সত্যই তিনজন সশস্ত্র পুরুষ এইদিকে আসছেন। একবার মনে হ’ল পাণ্ডবরাই তাঁর অবশিষ্ট প্রাণটুকু সংহার ক’রে নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য শস্ত্রপাণি ঘাতক পাঠিয়েছেন—পরক্ষণেই, পাণ্ডবদের স্বভাব উত্তমরূপে অবগত থাকায় নিজের এই ক্ষণেক কূট সন্দেহের জন্য লজ্জাবোধ করলেন। তখন কোন মিত্র বা স্বপক্ষীয় অনুমানে আবার অতিকষ্টে অর্ধোত্থিত হয়ে দেখলেন—গুরুপুত্র অশ্বত্থামা, তাঁর মাতুল কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা।
ওঁরা—সর্ববিধ ভোগবিলাসে ও মহার্ঘ শয্যায় অভ্যস্ত, দুর্যোধনকে এইভাবে অসহায় পঙ্গুর মতো কঠিন বন্ধুর মৃত্তিকায় শায়িত দেখে—অশ্রু সম্বরণ করতে পারলেন না। সেইখানেই সেই শোণিতসিক্ত মৃত্তিকার উপর বসে পড়ে অশ্বত্থামা ওঁর হস্ত স্পর্শ ক’রে বললেন, ‘কুরুরাজ, আপনি শোক করবেন না। এখনও আপনার পক্ষের বীরগণ নিঃশেষিত হন নি। এই আমি আপনাকে স্পর্শ করে শপথ করছি আমি আপনার শত্রু পাঞ্চালগণকে বিমথিত করব, পাণ্ডবগণ এবং আমার পিতৃঘাতী ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করব।’
দুর্যোধন বললেন, ‘অশ্বত্থামা, মৃত্যুর পূর্বে এই যে সান্ত্বনাটুকু লাভ করলাম এর জন্যই তোমাকে সাধুবাদ দিচ্ছি। এঁরা দুজন আছেন, এঁদের সম্মুখেই আমি তোমাকে সৈন্যাপত্যে বরণ করলাম, তুমি যদি আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে এই প্রতিজ্ঞা পালনের সংবাদ দিতে পারো তাহলেই শান্তিতে পরলোকে যাত্রা করতে পারি।’
ভাবাবেগে প্রতিজ্ঞা করা আপন আয়াস-সাধ্য, সেজন্য, অতি সহজ কাজ—কিন্তু তা কার্যে পরিণত করা বহু ক্ষেত্রেই দুঃসাধ্য—এক্ষেত্রে তো প্রায় অসাধ্য।
তিনজন রথী চিন্তিত চিত্তেই পুনশ্চ দূরস্থিত রথে আরোহণ করলেন এবং রণক্ষেত্র থেকে নির্গত হয়ে পাণ্ডবশিবিরের পথে নিজেদের চিন্তা ও পরিকল্পনা স্থির বা তা সম্ভাব্য করার জন্য পথিপার্শ্বস্থ গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন, এবং রথের অশ্বদের আহার ও বিশ্রামের জন্য বল্গামুক্ত ক’রে দিয়ে নিজেরাও এক বৃক্ষতলে বসে ক্লান্তি অপনোদনের চেষ্টা দেখলেন। আহারাদির কোন উপায় নেই, সে কথা কারও মনে উদয়ও হ’ল না। নিরতিশয় ক্লান্ত বৃদ্ধ কৃপাচার্য ও মধ্যবয়সী কৃতবর্মা দুজনেই ইষ্ট আরাধনা সমাপন ক’রে কিছুক্ষণ পাণ্ডববধের নানাবিধ অবাস্তব উপায় আলোচনা করতে করতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন।
অশ্বত্থামা কিন্তু এক অতীব দুরূহ প্রতিজ্ঞা ক’রে আপন বন্ধনে বদ্ধ—তাঁর অক্ষিপল্লবপ্রান্তে নিদ্রার লেশমাত্র দেখা দিল না।
যত সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে—প্রথম প্রহর দ্বিতীয় প্রহর অভিমুখে যাত্রা করছে ক্রমশ—ততই এই অসম্ভব প্রতিজ্ঞার অবাস্তবতা তাঁর বোধগম্য হচ্ছে। তিনি অস্থির এবং এই দুই সঙ্গীর নিশ্চিন্ত বিশ্রাম-ব্যবস্থায় বিরক্ত ও নিজের উদ্দেশ্য সাধনের কিছুমাত্র উপায় চিন্তা করতে না পেরে অস্থির হয়ে উঠে পদচারণা করতে লাগলেন।
ক্রমে সত্যই রাত্রির প্রথম প্রহর বিগত হ’ল। যাম-নির্ঘোষে সে বার্তা পেলেন অশ্বত্থামা। একা এখন তিনি কি করবেন কিছুই স্থির করতে না পেরে যখন যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় উদভ্রান্তপ্রায় হয়ে উঠেছেন, তখন একটি তুচ্ছ ঘটনার প্রতি তাঁর মন আকৃষ্ট হ’ল। যে বটবৃক্ষের নিম্নে কৃতবর্মা ও কৃপাচার্য নিদ্রিত, সেই বৃক্ষের উচ্চশাখাসমূহ সহসা প্রবলভাবে আন্দোলিত হওয়ার শব্দ ও কৃষ্ণ-পেচকের কর্কশ রব তাঁর কর্ণগোচর হ’ল। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি পক্ষীর রক্তাক্ত দেহাংশ ও ছিন্ন পক্ষ বৃক্ষতলের চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল।
আর—ঠিক সেই মুহূর্তেই, সে গাঢ় অন্ধকার বনচ্ছায়ারই এক অংশ যেন গাঢ়তর হয়ে মূর্তি পরিগ্রহ ক’রে প্রায় সর্পগর্জন-শব্দে প্রশ্ন করল, ‘নির্বোধ অপদার্থ ব্রাহ্মণ, এ শব্দের অর্থ কিছু বুঝলে কি?’
‘কে তুমি, আমাকে এভাবে সম্বোধন করছ তোমার স্পর্ধাও তো কম নয়!’ অশ্বত্থামা বিদ্যুৎ-চমকবৎ দ্রুত তাঁর খড়্গা নিষ্কাশন করলেন।
‘থাক, থাক।’ বিদ্রুপবিকৃত কণ্ঠে মূর্তিটি বলল, ‘ও অস্ত্র আগামী জন্মে পাণ্ডববধের জন্যই সযত্নে রক্ষা করো। আমাকে প্রাণের ভয় দেখিও না। আমি তো নিরস্ত্র তোমার সম্মুখে এসেছি। আমার সে ইচ্ছা থাকলে আমি বহুপূর্বেই তোমাকে বধ করতে পারতাম। ঐ দেখ ঐ দূরে আমার ধনুর্বাণ পড়ে আছে, আমি নিষাদ, বাল্যকাল হতে অন্ধকারে সুদ্ধমাত্র সামান্য পদশব্দ বা পত্রআন্দোলনে লক্ষ্যস্থির ক’রে পশুবধ করতে অভ্যস্ত।… শোন, মিথ্যা বাকবিতণ্ডার আবশ্যক নেই। তোমার উদ্দেশ্য আমি জানি, শক্তিহীন প্রতিজ্ঞার কথাও স্বকর্ণে শুনেছি। সম্মুখযুদ্ধে ওদের পরাস্ত করতে তোমার পিতাই পারেন নি, তুমি কি পারবে! ঐ কালপেঁচার কাছ থেকে শিক্ষা নাও, নিশীথ অন্ধকারে অতর্কিতে গিয়ে পড়ে নিদ্রিত শত্রুকে বধ করো, তার বেশী শক্তি তোমার নেই।’
কথা শেষ ক’রেই, যেন এক-পলক-পাত মাত্র সময়ে সেই গাঢ় অন্ধকারে অশরীরী কোন অভিশপ্ত আত্মার মতোই মিলিয়ে গেল নিষাদ—দ্রুত পশ্চাদ্ধাবন ক’রেও অশ্বত্থামা তার চিহ্নমাত্র দেখতে পেলেন না।
কিন্তু তাকে দেখতে না পান—নিজের কর্মপন্থা দেখতে পেয়েছেন। তিনি তখনই দুই সঙ্গীকে জাগরিত ক’রে তাঁর সিদ্ধান্ত জানালেন, এখনই যতটা সম্ভব অতর্কিতে পাণ্ডবশিবিরে প্রবেশ ক’রে ধৃষ্টদ্যুম্ন ও পাণ্ডবদের বধ করবেন— দুর্যোধনের কথঞ্চিৎ শান্তিলাভ ঘটবে, তাঁর প্রীতিসাধন করা যাবে।
তাঁর প্রস্তাব শুনে এই দুই যোদ্ধা স্তম্ভিত হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, লজ্জারও পরিসীমা রইল না। কোন যোদ্ধা এমন প্রস্তাব করতে পারে তা তাঁদের স্বপ্নেরও অতীত।
অবশেষে কৃপ বললেন, ‘দ্যাখো, অপ্রাপ্যলোভী অদূরদর্শী পাপী দুর্যোধনকে তাঁর হিতৈষীরা বহু সৎ পরামর্শ দিয়েছিলেন—তিনি তাতে কর্ণপাত করেন নি। শকুনি প্রভৃতি অসৎলোকের পরামর্শে পাণ্ডবদের সঙ্গে অকারণ শত্রুতা করেছেন, সেই দুর্বুদ্ধির ফলই তিনি ভোগ করছেন। আমাদের মনের যথেষ্ট দৃঢ়তা না থাকায় তাঁর সেবা ক’রে এখন নিরাশ্রয় ও বিজয়ী প্রবলপক্ষের বিদ্বেষের পাত্র হয়েছি। আবার এই পাপকার্যে আমি মত দিতে পারি না, এতে আমরা চিরদিনের মতো বিশ্ববাসীর নিন্দাভাজন হবো। তুমি বরং হস্তিনায় গিয়ে ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুরের পরামর্শ গ্রহণ করো।’
অশ্বত্থামা অসহিষ্ণু হয়ে বললেন, ‘রোগ বিশেষে বৈদ্যরা ভয়ঙ্কর বিষও প্রয়োগ ক’রে থাকেন। তাতে সব সময় হয়ত রোগী রক্ষা পায় না, তবে সেজন্য কেউ বৈদ্যকে দায়ী করে না। আমি ব্রাহ্মণ হয়েও পিতার দারিদ্র্যবশত ক্ষাত্রধর্ম অবলম্বন করেছি। রাজা দুর্যোধন আমার বন্ধু ও আশ্রয়দাতা। আমার পিতৃদেব আমরণ তাঁর পক্ষ অবলম্বন ক’রে যুদ্ধ করেছেন। এক্ষেত্রে দুর্যোধনের প্রীতিসাধনই আমার ধর্ম—সেইসঙ্গে পিতৃবধের প্রতিশোধ গ্রহণও। আজ বিজয়ী পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ নিশ্চিন্ত সুখে নিদ্রামগ্ন—আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধির এ-ই প্রকৃষ্ট অবসর। এক্ষেত্রে শোকার্ত বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মত নেওয়ার প্রয়োজন কি?’
কৃপ তবু, ওঁকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘বৎস, তুমি ক্লান্ত সাধ্যের অতীত কর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে উদভ্রান্তও। কোন সতযুক্তি এখন তোমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করবে না। তুমি বরং ক্ষণকাল বিশ্রাম গ্রহণ করো, রাত্রিপ্রভাতে আমরা তিনজনেই যথাবিধি প্রস্তুত হয়ে সম্মুখযুদ্ধে শত্রুবধে যাত্রা করব।’
অশ্বত্থামা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ক্রদ্ধ ও প্রতিশোধ-চিন্তাক্লিষ্ট ব্যক্তির বিশ্রাম গ্রহণের চেষ্টা হাস্যকর। আমি ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ না ক’রে স্থির হতে পারব না। কেবল তাই নয়, দুর্যোধনের যে দূরবস্থা আমি দেখে এসেছি তাতে আমার হৃদয় দগ্ধ হচ্ছে। আর সে উদ্দেশ্য সিদ্ধির এ-ই প্রকৃষ্ট অবসর। রাত্রিপ্রভাতে বাসুদেব ও অর্জুন শিবিরে প্রত্যাবর্তন করলে সাক্ষাৎ ইন্দ্রেরও সাধ্য হবে না তাঁদের বধ করার। স্বয়ং ভীষ্ম, কর্ণ, আমার পিতৃদেব যা পারলেন না, আমরা তা কেমন ক’রে পারব! না, আমি মনস্থির করেছি, শত্রুদের এই গাঢ় সুপ্তির সুযোগই নেব।’
কৃপ তত্রাচ বললেন, ‘ভাগ্যহীন ব্যক্তিই সুহৃদগণের সদুপদেশ উপেক্ষা ক’রে পাপে লিপ্ত হয়। সেই পথে গিয়ে রাজা দুর্যোধন সবংশে ধ্বংস হলেন। আমি তোমার মাতুল, হিতাকাঙ্ক্ষী, আমি অনুরোধ করছি তুমি নিবৃত্ত হও,
নিরস্ত্র সুপ্ত ব্যক্তিকে গুপ্তঘাতকের মতো বধ করলে অনতিকাল নরকবাস করতে হয়। তাকে কেউ ভদ্রবংশজাত বলে গণ্য করে না । তুমি ব্রাহ্মণ, শ্রেষ্ঠ শস্ত্রজ্ঞদের অন্যতম। এ কার্য তোমার পক্ষে একান্ত গর্হিত ও নিতান্ত অধর্মাচরণ।’
অশ্বত্থামা বললেন, ‘পাণ্ডবরা আমার অস্ত্রত্যাগী পিতাকে হত্যা করে নি? নিরস্ত্র কর্ণকে বধ করে নি? শত্রুক্ষয়ই যেখানে লক্ষ্য, সেখানে সেই উদ্দেশ্যসিদ্ধিই আমি ধর্মাচরণ বলে মনে করি। তাতে যদি বিশ্ববাসী অনন্তকাল আমাকে ধিক্কার দেয়—সেও আমার সহ্য হবে।’
অশ্বত্থামা নিজেই রথে অশ্বযোজনা ক’রে পাণ্ডবশিবিরের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। অগত্যা কৃপাচার্য ও কৃতবর্মাও নিজ নিজ রথ প্রস্তুত ক’রে তাঁর অনুবর্তন করলেন।
দ্বিতীয় প্রহরের মধ্যেই অশ্বত্থামা—প্রধানত কৃতবর্মার সহায়তায়—অতর্কিতে পাণ্ডবশিবিরে প্রবেশ ক’রে সাক্ষাৎ কালান্তক যমের মতো পাণ্ডবদের পঞ্চপুত্র, কয়েকটি বালক পৌত্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, অন্যান্য বাধাদানকারী পাঞ্চাল ও মৎস্যদেশীয় বীর এবং রক্ষীগণ সকলকে বধ করলেন। কৃতবর্মা বাহিরে শিবিরদ্বার রক্ষা করছিলেন। যারা পলায়নের চেষ্টা করেছিল তাদেরও অধিকাংশ ওঁর হস্তে নিহত হ’ল। এমন কি শিবিরের হস্তী অশ্ব প্রভৃতি যুদ্ধের পক্ষে অপরিহার্য পশুগণও অশ্বত্থামার ক্রোধাগ্নি হতে অব্যাহতি পেল না।
এই সার্বিক হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন ক’রে আবার তাঁরা দ্রুতগতিতে সমন্তপঞ্চক ক্ষেত্রে আসন্ন-মৃত্যু দুর্যোধনের নিকট প্রত্যাবৃত্ত হলেন। তাঁর তখন প্রায় শেষ অবস্থা—ক্ষণে ক্ষণে রক্তবমন করছেন, মাংসাশী পশুগণকে হস্তআন্দোলনে প্রতিনিবৃত্ত করার শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই। তারা চারিদিক ঘিরে বসে সূক্কণী পরিলেহন করছে, বোধ করি কিছু সাহস সঞ্চয় করতে পারলে, বা ওঁর অসহায় অবস্থা সম্পূর্ণ বোধগম্য হলে যে কোন মুহূর্তে, জীবিত অবস্থাতেই তাঁর দেহ থেকে মাংসখণ্ড কর্তন ক’রে নিতে আরম্ভ করবে।
অশ্বত্থামা নিকটে গিয়ে অর্ধনমিত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ‘রাজা দুর্যোধন, তুমি মৃত্যুর পূর্বে সুসংবাদ শুনে যাও, শত্রুপক্ষে কেবল পঞ্চপাণ্ডব, সাত্যকি ও শ্রীকৃষ্ণ জীবিত আছেন। তদ্ব্যতীত পাঞ্চাল ও মৎস্যদেশীয় সমস্ত বীরগণ, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, বালক পৌত্রাদি—দ্রোণঘাতী পাষণ্ড ধৃষ্টদ্যুম্ন ও ভীষ্মের অন্তিম শত্রু শিখণ্ডীও নিহত হয়েছে। এমন কি পাণ্ডবশিবিরের কোন পশু পর্যন্ত জীবিত নেই।’ ।
অতি কষ্টে, প্রাণপণ প্রয়াসে—দীর্ঘদিনের যুদ্ধশিক্ষা ও অভ্যাসের ফলেই, এইটুকু দৈহিক শক্তি সেই মৃত্যুমুহূর্তেও তাঁকে ত্যাগ করে নি—শেষবারের মতো জানুতে ভর দিয়ে অর্ধোত্থিত হলেন দুর্যোধন। বললেন, ‘তোমাদের ধন্যবাদ, তোমরা অসাধ্য সাধন করেছ। কিন্তু পাণ্ডবরা জীবিত থাকতে আমার শান্তি বা সুখ কোথায়? পাণ্ডবদের বধ করবে এই আশ্বাসে ও আশাতেই আমি তোমাকে সেনাপতি-পদে বরণ করেছিলাম। বিশেষ পাণ্ডবপুত্রগণকে বধ ক’রে তুমি আমাদেরও পিণ্ডদানের পথ লোপ করলে। বোধ হচ্ছে তস্করের মতো গোপনে ওদের শিবিরে প্রবেশ ক’রে এই হত্যাকার্য সাধন করেছ। পাণ্ডবদের বধ করতে পারলেও এ গর্হিত হীন কার্য সমর্থন করতাম—মিথ্যা কতকগুলো নিদ্রিত নিরীহ প্রাণীকে বধ করতে গেলে কেন? হা, আমার এ সমরায়োজনের মধ্যে এই একটিই কলঙ্ক হয়ে গেল! ধিক!’
বলতে বলতেই—অথবা এই বলার পরিশ্রমেই প্রবল একঝলক রুধির নির্গত হ’ল তাঁর কণ্ঠ থেকে—কণ্ঠস্বর রোধ ক’রে—এবং সেই উদগত রক্তের উপরই মৃত দুর্যোধনের কনক-নির্মিত মণিমাণিক্যখচিত-শিরোভূষণ-শোভিত মস্তক পতিত হ’ল শেষবারের মতো।
অপ্রীতি ও ব্যর্থতার গুরুভার বক্ষে নিয়েই তাঁর আত্মা সম্ভবত পরলোকের পথে যাত্রা করল।
২১
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির কোনক্রমে বাসুদেবের বাহুতে ভর ক’রে সৎকারভূমিতে উপনীত হলেন। বিগত-দিনের ঘটনার পর তাঁর মনে ও দেহে কিছুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। কেবলমাত্র কর্তব্যবোধেই—জ্ঞাতি, আত্মীয়, আত্মজ ও বান্ধবগণের সৎকার অবশ্য-করণীয় এই বোধেই তিনি প্রায়-অবশ শিথিল চরণকে চালিত করেছেন।
তাঁদের পুরোহিত ধৌম্য, সংবাদ-সংগ্রাহক সঞ্জয়, সারথি ইন্দ্রসেন প্রভৃতিকে তিনিই গতকাল রাত্রিতে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। নদীতীরে এই অগণিত দেহ বহন ক’রে নেওয়া সম্ভব হবে না, তদপেক্ষা পুণ্যভূমি—অগণিত বীরের প্রাণ বিসর্জনেই আরও পবিত্র হয়েছে এ প্রান্তর—কুরুক্ষেত্রেই সৎকার বাঞ্ছনীয়। চন্দন কাষ্ঠ অপ্রতুল, বনের অপর কাষ্ঠের সঙ্গে ভগ্নরথগুলিকেও ব্যবহার করা যাবে, সেইসঙ্গে যোজনব্যাপী চিতাগ্নিতে গলিত শবের পূতিগন্ধও বিনষ্ট হবে— মহামনা বিদুরের এই পরামর্শ সকল বিচারেই শ্রেয়, এই হিসাবেই এঁরা—কুরুপাণ্ডব উভয় পক্ষ তা গ্রহণ করেছেন।
সেই প্রায়-অন্তহীন, দৃষ্টিসীমাতীত, চিতাস্তূপরাশি প্রস্তুত—এ সংবাদেও যুধিষ্ঠির তাঁর কুশশয্যা থেকে উত্থিত হন নি, ক্লান্তভাবে জড়বৎ পড়ে ছিলেন, কিন্তু যখন সাশ্রুলোচন জনৈক সেবক এসে জানাল স্বয়ং গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্র তাঁর শত শত পুত্র-পৌত্রবধূকে সমভিব্যাহারে মহাশ্মশানভূমির উদ্দেশে হস্তিনাপুর প্রাসাদ থেকে নির্গত হয়েছেন, তখন আর বিলম্ব করতে পারলেন না।
উঠে এলেন, দুই পদ যন্ত্রবৎই চলতে লাগল—এবং একসময় সেই সাম্প্রতিক কিছু-পূর্ব দিনের অসংখ্য রথচক্র, হয়- হস্তী-পদশব্দ, কর্ণপটহভেদী অস্ত্রঝনৎকার এবং নিজ নিজ পক্ষের জয়ধ্বনি-কোলাহল-মুখরিত কুরুক্ষেত্র ভূমিতে পৌঁছলেন। তার পর অবসন্ন অর্ধ-নিমীলিত চক্ষুও উন্মীলন করলেন একসময়।
কিন্তু এ কী দেখলেন!
এই দৃশ্য দেখার জন্যই কি তিনি এতকাল এত কষ্ট সহ্য করেছেন, উদ্বেগাকুল চিত্তে বিনিদ্র বসে, দিনের পর দিন, নিজের বিবেক ও শুভবুদ্ধির সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে এই মহা-আহবে মত দিয়েছেন? তারপর তেমনি দিবারাত্র অবিরাম চিন্তা ও আলোচনা ক’রে এই সর্বনাশা সংগ্রামের আয়োজন করেছেন! এই বিজয়গৌরব, এই বিত্তলাভের জন্য!
তাঁকে ধিক, রাজকুলে জন্মগ্রহণে ধিক, এ-জয়লাভেও ধিক।
যতদূর দৃষ্টি যায়—বোধ করি হস্তিনাপুর থেকে কুরুক্ষেত্র পর্যন্ত—সহস্ৰ সমগ্ৰ শোকাকুলা বিধবা স্ত্রীলোক দীন বেশে, আলুলায়িত কুন্তলে, হাহাকার রবে ক্রন্দন করতে করতে আসছেন—সঙ্গে কিছু শিশু ও পঙ্গু দুর্বল শোকাহত বৃদ্ধের দল
তার মধ্যেই বৃদ্ধ অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্র, পুণ্যশীলা মহাসতী জননী গান্ধারী—তাদের ধরে আনছেন বিদুর ও সঞ্জয়—সঙ্গে ভগ্নী দুঃশলা, দুর্যোধন, দুঃশাসন প্রভৃতির স্ত্রীগণ, তাঁদের পুত্রবধূগণ—
কত, কত!
হে ভগবান, এতগুলি নারীকে বিধবা করার জন্যই কি তাঁরা এই মরণপণ যুদ্ধ করেছেন!
দৃষ্টিশাসন ক’রে বিপরীতাভিমুখী করবেন সে উপায়ও তো নেই। তাঁর দিক থেকেও তেমনি অগণন সংখ্যাতীত বিধবা —শোকাকুলা উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দনরতা নারীর সমুদ্র। যেন এক অনন্ত বহ্নিসাগরে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যেই দুই সমুদ্র অগ্রসর হচ্ছে। সমুদ্র গর্জনের মতোই সেই শোকোচ্ছ্বাস-আকুল মর্মভেদী বিলাপের বিপুল তরঙ্গ-ভঙ্গ শব্দ।
হ্যাঁ, তাঁরও বিধবা পুত্রবধূগণ আসছেন, তার সঙ্গেই!
হে ভগবান, হে পাণ্ডবদের ভাগ্যবিধাতা, তাঁরা এত কি অপরাধ করেছিলেন বিশ্বনিয়ন্তার কাছে যে, এই কঠোর শাস্তিবিধান করলেন। অদ্যকার এ দৃশ্য দেখার পূর্বে তাঁদের মৃত্যু হল না কেন! এটুকু সান্ত্বনাও কি দিতে পারতেন না ভাগ্যবিধাতা! গতকালই তো তাঁর মৃত্যু হতে পারত। এ কি ভয়ঙ্কর পরমায়ু তাঁদের!
সে রাত্রের সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ড থেকে ধৃষ্টদ্যুম্নের এক সারথি কোনক্রমে রক্ষা পেয়েছিল। মৃতদেহের স্তূপে আত্মগোপন ক’রে মৃতবৎ স্থির হয়ে থাকাতেই অব্যাহতি পেয়েছিল সে।
সে-ই রোদন করতে করতে রাত্রিপ্রভাতে এসে দুঃসংবাদ দিল—কুরুপাণ্ডবদের সমৃদ্ধ রাজ্যের বর্তমান একমাত্র অধিপতিকে।
চিরদিনের স্থিতধী, দুঃখে অনুদ্বিগ্নমনা, সুখে অনুচ্ছ্বসিত, সম্পদে বিনত—যিনি শত বিপদে শত ধিক্কার-লাঞ্ছনাতেও কখনও ধৈর্যচ্যুত হন নি—তিনি নদীতীরের কঠিন মৃত্তিকায় লুণ্ঠিত হয়ে হাহাকার শব্দে রোদন করতে লাগলেন, পুত্রপৌত্রাদির জন্য। হায় আজ বুঝি কুরুবংশ লোপ সম্পূৰ্ণ হ’ল। শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর, বিশ্বত্রাস, অপ্রতিদ্বন্দ্বী রথীরা যা করতে পারেন নি, সামান্য এক নিশাচরবুদ্ধি তস্করবৃত্তি ব্রাহ্মণ তাই সম্পূর্ণ ক’রে দিয়ে গেল—তাঁরা জীবিত থাকতেও।
অন্য সময়—যুধিষ্ঠিরের প্রশান্তি কোন কারণে নষ্ট হলে কনিষ্ঠ ভ্রাতারা, বিশেষ অর্জুন সান্ত্বনা দেন। কিন্তু আজ তিনিও বালকের মতো শোকে ব্যাকুল অধীর হয়ে পড়েছিলেন মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে তাঁর জীবনের দুটি শ্রেষ্ঠ পুরস্কার, দুটি পুত্ররত্ন বিনষ্ট হ’ল—এ যুদ্ধ তিনি কার জন্যে জয় করলেন! বহু কষ্টে ত্রিভুবনের সকল ভয়াবহ অমোঘ অস্ত্রই বা আয়ত্ত করলেন কোন ইষ্টসিদ্ধির জন্য!
ভাগ্যক্রমে বাসুদেব ঊষাগমনের পূর্বেই হস্তিনাপুর থেকে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন—তিনি যতটা সম্ভব সান্ত্বনা দিলেন অভিমন্যুর সন্তান আছে উত্তরার গর্ভে— পাণ্ডবদের বংশলোপের সম্ভাবনা নেই—সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং তৎক্ষণাৎ দ্রুতগামী রথ প্রেরণ করলেন উপপ্লব্য নগর থেকে দ্রৌপদীকে আনয়নের জন্য।
দ্রৌপদী এলেন তাঁর দুই চক্ষুতে বজ্রগর্ভ বাষ্পরাশি নিয়ে। সাগরোপম সুনীল দুটি আশ্চর্য নেত্র যদি আকাশ হয়— বাসুদেব মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে দেখলেন—তাতে জলভরা মেঘ ও প্রখর বিদ্যুতের এক বিস্ময়কর সম্মিলন ঘটেছে। জল ও জলদ? না জল ও অগ্নি? বিশ্বদাহী দাবানল-সৃষ্টিকারী ঘনীভূত অগ্নি? এমন সমাবেশ বুঝি এই দেব-ইচ্ছাসম্ভূত মানবোত্তর লাবণ্যবতী নারীর দৃষ্টিতেই সম্ভব!
দ্রৌপদী হাহাকার করলেন না, বিলাপ করলেন না, রথ হতে অবতীর্ণ হয়ে সর্বপ্রথমেই বাসুদেবের সম্মুখে গেলেন অসহক্রোধ-ক্রন্দন-বিকৃত তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘বাসুদেব, এ তুমি জানতে। তোমার অজ্ঞাতে কিছুই হয় না আমাদের কুলে, কিছুই হয় নি। কেন, কেন এ কাজ করালে! এতে তোমার কি অভীষ্ট সিদ্ধি হ’ল? আমার একটি সন্তানকেও বাঁচতে দিলে না! আর ওই অবোধ শিশু পৌত্ররা? ওরা কি অপরাধ করেছিল তোমার কাছে?’
বাসুদেব আপাত-বিস্মিত বেদনার্ত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে উত্তর দিলেন, ‘কল্যাণী, তুমি জান না, আমি রাজাদেশেই হস্তিনাপুর গিয়েছিলাম। আমার প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই এই পৈশাচিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। এঁরা তো নিকটে ছিলেন, এঁরাও কোন সংবাদ পান নি, এত নিঃশব্দে ওই নরকলঙ্কটা কাজ করেছে।’
এই পাষাণাপেক্ষা কঠিন সর্বপ্রকার মমতাবর্জিত ব্যক্তিটির সঙ্গে বাক্যব্যয় বৃথা জেনেই দ্রৌপদী শুধু এক উদ্যত বজ্রের মতো প্রজ্বলন্ত ভয়ঙ্কর দৃষ্টি নিক্ষেপ ক’রে দ্রুত ভীমের কাছে গেলেন, তাঁর দুটি বাহু চেপে ধরে বললেন, ‘বৃকোদর তুমিই বিরাটপুরীতে কীচক ভ্রাতাদের বধ ক’রে আমার মানরক্ষা করেছিলে, তুমিই দুর্যোধন দুঃশাসনকে সমুচিত শাস্তি দিয়ে আমার প্রতি জঘন্য পশুবৎ আচরণের উপযুক্ত প্রত্যুত্তর দিয়েছ—তুমি ভিন্ন আমার স্বামীদের মধ্যে প্রকৃত পুরুষ কেউ নেই আমি জানি। একজন বোধ হয় দেবতা, পাষাণনির্মিত, পাষাণের মতোই জড় ও নির্বিকার আর একজন বাসুদেবের হস্তে ক্রীড়নক মাত্র আর দুটি তোমাদের ও জননী কুন্তীর অপরিমিত স্নেহে লালিত চিরদিনের বালক একমাত্র তুমিই আমার মান-রক্ষাকারী স্বামী। তুমি আমার এই সন্তান বধের প্রতিশোধ নাও। অদ্য সূর্যাস্তের পূর্বে এর প্রতিফল না দিলে আমি প্রায়োপবেশনে প্রাণত্যাগ করব। আমার স্বামীদের নামে, শ্বশুরকুলের নামে শপথ ক’রে এই প্রতিজ্ঞা করছি। কেউ এ প্রতিজ্ঞা থেকে আমাকে বিচলিত করতে পারবে না।’
তারপর ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ গাঢ়তর কণ্ঠে আরও বললেন, ‘অশ্বত্থামার শিরোভূষণে এক অত্যাশ্চর্য মণি আছে শুনেছি, তাকে শাস্তি দিয়ে সেই মণি নিয়ে এলে তা ধর্মরাজের উষ্ণীষে বিলগ্ন ক’রে তবে আমি উপবাস ভঙ্গ করব!’
ভীম নিজেই শোকানলে দগ্ধ হচ্ছিলেন, এখন দ্রৌপদীর এই সরোষ করুণ আবেদনে আর পলার্ধ স্থির থাকতে পারলেন না, তৎক্ষণাৎ ধনুর্বাণ ও অপর আয়ুধাদি নিয়ে ভীষণ সঙ্কল্প ঘোষণা ক’রে রথে আরোহণ করলেন।
‘যে পাপিষ্ঠ ব্রাহ্মণ হয়ে নিষাদের অপেক্ষাও অবজ্ঞেয়, পিশাচের মতো ঘৃণ্য—হীন হত্যাকারীর কার্য করেছে, তাকে বধ করলে কোন অন্যায় হয় না। আমি আজ তার রক্ত মোক্ষণ করব। ভদ্রে, তুমি শান্ত হও, আমি জীবিত থাকতে তোমার প্রায়োপবেশনের প্রয়োজন হবে না। ‘
পেচক-বৃত্তিধারী দ্রোণপুত্র পেচকের মতোই এঁদের ভয়ে দিবালোকে কোথাও আত্মগোপন করবেন—এ তো নিশ্চিত, কিন্তু পাণ্ডবশিবিরের প্রবেশদ্বার থেকে ওঁদের তিনটি রথচক্রচিহ্নই তো দিক নির্দেশ করতে পারে ভীম সেই পথই অবলম্বন করলেন।
ভীমের এই হঠকারিতায় বাসুদেব যৎপরোনাস্তি উদ্বিগ্ন হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘এ কী করছেন! ভীম একা অশ্বত্থামাকে বধ করতে গেলে মহাসর্বনাশ হবে। ওই পাপিষ্ঠটার কাছে এক সাংঘাতিক অস্ত্র আছে। দ্রোণ ব্রহ্মশির নামে এক সর্বলোক-বিধ্বংসী অস্ত্র আয়ত্ত করেন, এবং তা—উপযুক্ত পাত্র বিবেচনায়–অর্জুনকেই প্রদান করেন। এই শিষ্যপ্রীতিতে দ্রোণের কুলপাংশুল পুত্র অভিমান প্রকাশ করলে, পুত্রস্নেহান্ধ আচার্য পুনর্নির্মাণ ক’রে তাকেও একটি প্রদান করেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সতর্ক ক’রে দেন, ‘এর প্রয়োগ ও সম্বরণের সমস্ত কৌশল ও নিয়ম আয়ত্ত করবে বা সেগুলি স্মরণে রাখবে এমন ধৈর্য ও স্মৃতিশক্তি তোমার নেই। এ অস্ত্র অমোঘ ও ভয়ানক, একটি বিরাট দেশও এক মুহূর্তে দগ্ধ করতে পারে। আর এ দেশ যদি যায় তুমিও বিনষ্ট হবে। সুতরাং খুব সতর্ক থেকো।’ ওই পাষণ্ডটা অতঃপর—অস্ত্র হস্তগত হওয়া মাত্র—অত্যধিক লোভবশত অথবা ওই অস্ত্রের গুরুদায়িত্ব পরিহার করার উদ্দেশ্যেই—স্পর্ধা ক’রে এসে আমাকে বলেছিল, ‘এই অস্ত্র নিয়ে তুমি আমাকে তোমার বিখ্যাত চক্রান্ত্র প্রদান কর।’
‘আমি হেসে বলেছিলাম, ‘এ অস্ত্রে আমার প্রয়োজন নেই, কারণ কোথায় কার ওপর এ প্রয়োগ করব? তুমি অনায়াসে চক্রাস্ত্র নিয়ে যাও।’ লুব্ধ কদাচারী 1ব্রাহ্মণ তৎক্ষণাৎ সাগ্রহে সে অস্ত্র নিতে চেয়েছিল কিন্তু তা নিয়ে আসা তো দূরের কথা—প্রাণপণ শক্তিতেও তা উত্তোলিত করতে পারেনি। লজ্জিত হয়ে ফিরে এসেছিল। সেই সময়ই ওর কাছে ব্রহ্মশির অস্ত্রের অস্তিত্বের কথা জেনেছি। ও নির্বোধ—যদি ভয়ার্ত হয়ে ওই অস্ত্র প্রয়োগ করে, একমাত্র ধনঞ্জয় ব্যতীত কেউ তার যোগ্য অস্ত্র প্রতি-প্রয়োগ করতে পারবে না। আপনারা এখনই চলুন।’
গিয়েছিলেনও তাঁরা। দারুক চালিত নিজ রথে শ্রীকৃষ্ণ তুলে নিয়েছিলেন যুধিষ্ঠির ও অর্জুনকে। বায়ুবেগে সে রথ যথাসময়ে যথাস্থানে তাঁদের পৌঁছেও দিয়েছিল। অশ্বত্থামা ইতিমধ্যে নিজের দুষ্কার্যের পরিমাণ ও তার আশঙ্কিত পরিণাম সম্বন্ধে সচেতন হয়ে কুশবস্ত্র পরিধান ক’রে সর্বাঙ্গে ঘৃত ও তদুপরি ধূলি লেপন ক’রে নদীতীরে বেদব্যাসের সাময়িক আশ্রমে অপর তপস্বী ও ব্রহ্মচারী কিশোরদের মধ্যে আত্মগোপন ক’রে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তীক্ষ্ণদৃষ্টি কুশাগ্রবুদ্ধি বাসুদেবের সে আশ্রয় আবিষ্কার ও তাঁকে চিহ্নিত করতে বিলম্ব হয় নি।
কিন্তু তৎপূর্বেই বিষম ক্রোধাগ্নিতাড়িত ভীমসেনের রথ সে স্থানে উপনীত হয়েছে। ভীমেরও বাল্যসহচর ছদ্মবেশধারী অশ্বত্থামাকে চিনতে অসুবিধা হয় নি।
ভীমের ঐ শরাসন-সমন্বিত মূর্তি ও উগ্র দৃষ্টিতে অশ্বত্থামা মৃত্যু-আতঙ্ক অনুভব করবেন—এও স্বাভাবিক, বিশেষ ঠিক পিছনেই যখন শ্রীকৃষ্ণর মহাবেগবান রথে অর্জুনকে দেখলেন তখন যেন মৃত্যুকেই সম্মুখে প্রত্যক্ষ করলেন। ফলে— শ্রীকৃষ্ণ যা অনুমান বা আশঙ্কা করেছিলেন তাই ঘটল, অশ্বত্থামা নিদারুণ মৃত্যুভয়ে দিগ্বিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে পিতৃপ্রদত্ত সেই অমোঘ ব্রহ্মশির অস্ত্রই প্রয়োগ করলেন—’পাণ্ডবরা ধ্বংস হোক’ এই বাক্য উচ্চারণ ক’রে।
শ্রীকৃষ্ণ ওঁর মনের গতি সম্যক অনুধাবন করেছিলেন বলেই— সে অস্ত্র নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বেই ক্লান্ত ও শোকার্ত অর্জুনকে উত্তেজিত ও সতর্ক ক’রে দিয়ে বললেন, ‘ফাল্গুনী, কি দেখছ? সর্বনাশ হয়ে যাবে—তুমিও এখনই গুরুদত্ত ব্রহ্মশির অস্ত্র নিক্ষেপ করো। আর মুহূর্ত বিলম্ব করো না।’
অর্জুন মনে মনে গুরু ইষ্ট এবং বাসুদেবকে প্রণাম ক’রে ‘বিশ্ববাসী তথা গুরুপুত্রেরও কল্যাণ হোক, অস্ত্র দ্বারা অস্ত্র নিবারিত হোক’ এই বলে ব্রহ্মশির অস্ত্র ত্যাগ করলেন।
সৃষ্টিবিধ্বংসী বহ্নিমণ্ডল-সৃষ্টিকারী সেই সমতেজ-সম্পন্ন অস্ত্র শূন্যে উত্থিত হ’তেই মনে হ’ল প্রলয়কাল আসন্ন! সে প্রখর তেজে রথী সারথি অশ্ব এবং তপস্বীগণ সকলেই মূর্ছাহতপ্রায় হয়ে পড়লেন, প্রচণ্ড তাপে মুহূর্তমধ্যে অনেকের কেশ ও অক্ষিপল্লব দগ্ধ হ’ল।
বিশ্বনাশ অনিবার্য দেখে মহর্ষি ব্যাস তাঁর আসন থেকে উত্থিত হয়ে মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘বৎসগণ, এ কী করছ! ক্ষান্ত দাও, অবিলম্বে এ ভয়াবহ অস্ত্র সম্বরণ করো—নচেৎ কেউ বা কিছু থাকবে না। সমগ্র এই জনপদ ধ্বংস হয়ে অচিরে এমন মরুভূমিতে পরিণত হবে যে দ্বাদশ বৎসরের প্রবল বর্ষণেও তা পুনরায় শস্যপ্রসূ হবে না।’
ব্যাসদেবের আকুলতা দর্শনে ও অস্ত্রের বিভীষিকাময় পরিণাম শ্রবণে অর্জুন ব্যস্ত হয়ে অবিলম্বে অস্ত্র সম্বরণ করলেন, ব্যাসদেবকে করজোড়ে বললেন, ‘প্রভু, আমি ঐ অস্ত্র থেকে আত্মরক্ষা করার জন্যই সমশক্তিশালী অস্ত্র ত্যাগ করেছি। আপনার আদেশে আমি তা সম্বরণ করছি—এক্ষণে অশ্বত্থামাকে নিবারিত করার দায়িত্ব আপনার।’
ব্যাসদেব অতঃপর অশ্বত্থামার দিকে দৃষ্টিপাত করতেই বিমূঢ় বিপন্ন অশ্বত্থামা বললেন, ‘ঋষিবর, প্রাণনাশের সম্ভাবনা দেখে নিদারুণ ভীত হয়েই আমি এ অস্ত্র ত্যাগ করেছি, কিন্তু এর সংহরণের কৌশল আমার স্মরণে নেই। আমি তো কিছু করতে পারব না। তবে এর তেজ সঙ্কুচিত করতে পারি কিন্তু পাণ্ডবরা ধ্বংস হোক বলে এ অস্ত্র নিক্ষিপ্ত হয়েছে— পাণ্ডবপক্ষের কাউকে অন্তত নিধন না করা পর্যন্ত তো এ অস্ত্র নিবারিত হবে না।’
ব্যাস কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললেন, ‘তবে উত্তরার গর্ভে অভিমন্যুর যে সন্তান আছে তার উদ্দেশেই এ অস্ত্র ধাবিত হোক। তাঁদের সমগ্র দেশ ধ্বংস ও বিপুল প্রাণহানি অপেক্ষা পাণ্ডবদের এ আত্মত্যাগই শ্রেয় মনে করছি। তাঁরা বিবেচক ও ধর্মবুদ্ধিসম্পন্ন, আশা করছি জাতি ও দেশের প্রয়োজন তাঁরা বুঝবেন। ‘
ক্রদ্ধ ভীমসেন ক্রদ্ধতর হয়ে মহাতপস্বী ব্যাসদেবকেও অগ্রাহ্য করে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ‘তার অর্থ আমরা নির্বংশ হবো! কখনও না। অর্জুন, তুমি পুনশ্চ অস্ত্র ত্যাগ করো, ঐ দুরাচারী নৃশংস পামরটা মরুক!’
বাসুদেব ভ্রূকুটি ক’রে বলে উঠলেন, ‘তুমি নিজেকে সংযত করো ভীমসেন, সাধ্যের অতীত আস্ফালন ক’রো না। এ জনপদ শ্মশানভূমিতে পরিণত হলে তোমরা ও ঐ গর্ভস্থ ভ্রূণ—কেউই থাকবে না। না মুনিবর, ঐ অস্ত্র উত্তরার গর্ভেই আঘাত করুক, কয়েক পলের জন্য শিশুর হয়ত মৃত্যু ঘটবে কিন্তু ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের অসীম পুণ্যবলে, আজীবন নিষ্ঠাসহকারে ধর্মরক্ষার জন্য তা পুনরুজ্জীবিত হবে—আমি পাণ্ডবদের এ আশ্বাস দিচ্ছি। তবে অশ্বত্থামার শিরোভূষণ যে মণিটি আছে, সেটা দণ্ডস্বরূপ দিতে হবে—পুত্রশোকার্তা কৃষ্ণার পদতলে ওটি রক্ষা ক’রে তাঁকে কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা দিতে পারব।’
অধোবদন অশ্বত্থামা দীর্ঘনিঃশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ‘এ মণি মহার্ঘ্য বললেও যথেষ্ট বলা হয় না। কৌরব ভাণ্ডারের সকল মণিরত্ন একত্র করলেও এর সমমূল্য হবে না। তবু শান্তির জন্য আমি তাই দিচ্ছি, আশা করি এইটেই আমার যথেষ্ট শাস্তি বলে গণ্য হবে!’
‘তোমার শাস্তি!’ এবার বাসুদেবের কণ্ঠ উচ্চ ও শাণিত হয়ে ওঠে, ‘তোমার পাপের শাস্তি এই সামান্যতে শেষ হওয়া সম্ভব নয়। তুমি দীর্ঘকাল বাঁচবে—বহু বংশের উত্থান পতন প্রত্যক্ষ করবে। ভাবীকালে জগতে তুমি শিশুপ্রাণহন্তা বলে পরিচিত ও ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকবে। তোমার নাম উচ্চারণের সঙ্গে লোকে নিষ্ঠীবন ত্যাগ করবে। তুমি আর কারও সঙ্গে কখনও কথোপকথন করতে পারবে না, নিজের রোগযন্ত্রণার কথাও কাউকে জানাতে পারবে না। জনসমাজে তোমার স্থান হবে না—সহায়শূন্য হয়ে দুর্গম মরুভূমিতে বা গভীর অরণ্যে বিচরণ করতে হবে তোমাকে অসংখ্য
পাপজব্যাধি-সমন্বিত ও পুঁজশোণিতগন্ধী হয়ে থাকবে, কোন ঔষধ এমন কি পিপাসার জল পর্যন্ত পাবে না।’
বাসুদেবের সেই সুউচ্চ ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর সেই নদীতীরের মুক্ত প্রান্তরে বহুদূর পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হয়ে এক ভয়াবহ আবহাওয়ার সৃষ্টি করল, সেই অমোঘ দণ্ডাদেশ বা অভিসম্পাতের সম্মুখে স্বয়ং ব্যাসদেব পর্যন্ত মাথা নত করে রইলেন, অশ্বত্থামাকে আশ্বাস দেবার মতো একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারলেন না।
বিগত দুদিনের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার তবু এ-ই শেষ নয়।
ইতিপূর্বে কোন ব্যক্তি বোধ করি জয়ী হওয়া সত্বেও এমন শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয় নি দুঃসহ বেদনা নিদারুণ অশান্তি সহ্য করে নি, সুখের, শান্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও। এই কথাটাই বারংবার যুধিষ্ঠিরের মনে হতে লাগল।
এঁরা নিজ শিবিরে প্রত্যাবর্তন করার পর নিষাদ কীলক এসেছিল বাসুদেবের কাছে বিদায় নিতে। এবার তার জীবনের ব্রত সমাপ্ত—বাসুদেব কর্তৃক ন্যস্ত কার্যভারও সম্পন্ন হয়েছে—আর এই ধরনের জনপদে সে থাকবে না, বহু দূরে কোন অরণ্যে বা পর্বতে গিয়ে ইহজন্মের পাপের কিছু প্রায়শ্চিত্ত করবে, তার পর, অনুশোচনা যথেষ্ট—তার সাধ্যমতো—হয়েছে মনে হলে জাহ্নবীর জলে প্রাণত্যাগ করবে।
খুবই মৃদু কণ্ঠে শ্রীকৃষ্ণর কাছে এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছিল নিষাদ—সুদ্ধমাত্র তাঁর কর্ণের জন্যই ওর এই বক্তব্য— দূরে উপবিষ্ট যুধিষ্ঠিরের তা শ্রুতিগোচর হয় নি, তবে কীলককে দেখে একটি তথ্য তাঁর স্মরণে এসেছে—এই লোকটিই দুর্যোধনের গোপন আশ্রয়ের সংবাদ তাঁকে দিয়েছিল। সে সংবাদ তখন না পেলে যুদ্ধ সমাপ্তির হয়ত আরও বহু বিলম্ব ঘটত। তার জন্য এ ব্যক্তিকে কিছু পুরস্কার দেওয়া আবশ্যক। এটা রাজকীয় কর্তব্যেরই অঙ্গ। নচেৎ এই সব অসামরিক সংবাদদাতারা উৎসাহিত হয় না। ।
উপর্যুপরি নানা অপ্রিয়—অনভিপ্রেত ঘটনায় মন বিষাদগ্রস্ত হতাশাচ্ছন্ন দেহও ক্রমাগত পরিশ্রমে, রাত্রি জাগরণে ও অনাহারে অবসন্ন—তবু কর্তব্য কর্তব্যই—অপরিহার্য। এবং এখনই তা সম্পন্ন না করলে ভবিষ্যতে বিস্মরণ ঘটতে পারে
অন্যান্য ভ্রাতারাও নিকটে ছিলেন পুরোহিত ধৌম্য ছিলেন,—ব্যয়-সচিবও ছিলেন—তবুও এটা তাঁরই করণীয় মনে হ’ল। তিনি কোন মতে নিজের শষ্পশয্যা ত্যাগ করে নিকটে এসে বললেন, ‘নিষাদ, তুমি কাল আমাদের প্রভূত উপকার করেছ—ভ্রাতা দুর্যোধনের গোপন আশ্রয়ের সন্ধান দিয়ে। পরন্তু তোমার এই কার্যে শুধু যে আমরাই উপকৃত হয়েছি তা নয়, দুর্যোধনের পতন না হলে এই যুদ্ধে অযথা বিলম্বিত হত, সেই সম্ভাবনা নিবারিত হতে অবশিষ্ট কিছু লোকের অকারণ মৃত্যু থেকে অব্যাহতি লাভ ঘটেছে। তোমাকে তার জন্য কোন পারিতোষিক দেওয়া হয় নি, আমাদের ত্রুটি ঘটেছে। এখন তা সংশোধন করতে চাই। এক্ষণে তোমার কি অভিলাষ বা কোন দ্রব্যের বিশেষ আসক্তি তা যদি একটু জানাও তো ভালো হয়। অর্থ? সুবর্ণ? গাভী, ভূসম্পত্তি অথবা দাস-দাসী, সেবিকা—যা ইচ্ছা নিঃসঙ্কোচে জানাও।’ কীলক ভয়ঙ্কর এক ভ্রূকুটি করে যুধিষ্ঠিরের কথা শুনছিল, এক্ষণে তাঁর বক্তব্য শেষ হতে ‘পুরস্কার!!’ অতিশয় উচ্চ এবং এক প্রকারের বিষতিক্ত কণ্ঠে এই শব্দটি মাত্র উচ্চারণ ক’রে অকস্মাৎ অট্টহাস্য ক’রে উঠল। তার পর, সে হাস্যের বেগ প্রশমিত হলে বলল, ‘পুরস্কার আমার মিলে গেছে রাজা, গত রাত্রে ঐ ব্রাহ্মণের বংশের পিশাচটাই সে পুরস্কার আমাকে দিয়ে গেছে। আর কিছুতে আমার প্রয়োজন নেই!’
‘তার অর্থ?’ বিহ্বল যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলেন।
‘অর্থটা বুঝতে পারছ না, না? অপরাধ বা কুকর্ম কত সহজে ভুলে যায় মানুষ, আশ্চর্য! নিজেদের প্রাণ বাঁচাতেও নয় —তখন তোমাদের প্রাণ যাওয়ার কোন কারণ ছিল না, ভবিষ্যতের অজানা বিপদ থেকে মুক্ত থাকতে–বেশ হিসাব ক’রেই পৈশাচিক নিষ্ঠুরতাকে নিজেদের বুদ্ধির শ্রেষ্ঠতা মনে ক’রে আত্মগৌরব বোধ করতে করতে আমার স্ত্রী আর পাঁচটি ছেলেকে আহারের লোভ দেখিয়ে আমন্ত্রণ ক’রে এনে প্রচুর সুখাদ্য, তার সঙ্গে অপরিমাণ গৌড়ী খাইয়ে—তাদের নিদ্রাচ্ছন্ন কেন—অজ্ঞান ক’রে রেখে চারদিক থেকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলে—মনে পড়ে সে-কথা? না—বহুদিনের সে কুকীর্তি, বারণাবতের স্মৃতি ভুলে গেছ এরই মধ্যে! আসলে স্মরণ করাটাও বড় পীড়াদায়ক—তাই না? আমার পাঁচ পুত্র তোমাদের পাঁচ পুত্র অপেক্ষা অনেক বেশী যন্ত্রণা পেয়ে মরেছে। আমার পূর্ণ তৃপ্তি হত যদি ঐ রাক্ষসটা অস্ত্র দিয়ে না মেরে ওদেরও পুড়িয়ে মারত!… আরও আহ্লাদ হত ঐ সঙ্গে ওদের মা–তোমাদের রাণীটাকেও পুড়িয়ে মারলে ওজনে সমান থাকত!… যাও রাজা, আমি যা চাই আজ আর কিছুই দেবার সাধ্য তোমার নেই। পারবে তাদের ফিরিয়ে দিতে? ইহজগতের কোন ভোগ সুখেই আমার সাধ নেই। আমি যাচ্ছি এই প্রাণটা শেষ করতেই—অনাহারে নানাবিধ কষ্ট সহ্য ক’রে—তুমি আমাকে আজ কিসের লোভ দেখাবে রাজা?’
তারপর, যেন নিঃশ্বাস নেবার জন্যই একটু থেমে আবারও বলল, তেমনি ব্যঙ্গ-বিষাক্ত কণ্ঠে—’কিন্তু তোমাদের প্রায়শ্চিত্ত শেষ হতে এখনও অনেক দেরি। শ্মশানের সিংহাসনে বসেছ—এইখানে দীর্ঘকাল রাজত্ব করবে—এই আশাই করি। রাজত্বে সুখ, বেঁচে থাকার সুখ ভোগ করবে না? করবে বৈকি। নইলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বধ ক’রে যুদ্ধ জিতলে কেন? এই যে ক্ষমতা—এরও পরিণাম দেখে যেন যেতে পারো। তোমরা যখন যাবে নিজেদের জন্যই নিজেদের শোক করতে হবে, সেদিন বুঝবে মরা কত সুখের—বুঝবে কখনও কখনও বেঁচে থাকাটাই মৃত্যুযন্ত্রণা হয়ে ওঠে। তোমাকে লোকে ধর্মরাজ বলে না! ধর্মের বিবেকের নীতির সঙ্গে নিজেদের আচরণ, কাজগুলো মিলিয়ে দেখো— অবসর মতো–হয়ত শিউরে উঠবে!’
২২
ধৃতরাষ্ট্র প্রথমে মহাশ্মশানভূমিতে উপস্থিত হতে সম্মত হন নি। প্রস্তাবমাত্রে নিদারুণ হাহাকার শব্দে বিলাপ করতে করতে বারম্বার মূর্ছাগ্রস্ত হয়েছেন। বলেছেন, ‘কেন আমাকে সৎকারভূমিতে যাওয়ার জন্য এ অকরুণ অনুরোধ করছ, সঞ্জয়! উপর্যুপরি নিদারুণ আঘাতে ক্ষতবিক্ষত এই বক্ষে অধিকতর কঠোর আঘাত হানতে উদ্যত হলে কেন! ঈশ্বর অন্ধ ক’রে মৃত পুত্র-পৌত্রদের গলিত দেহের, পশু-দন্তাহত মুখের দৃশ্যাবলোকনের নিদারুণ যন্ত্রণা থেকে যখন অব্যাহতি দিয়েছেন তখন অকারণে আমাকে কেন কুরুবংশ কুরুগৌরবের সেই শ্মশানে নিয়ে যেতে চাইছ! যদি যেতেই হয়—আমার ও রাজ্ঞী গান্ধারীর জন্যও একটা চিতা প্রস্তুত করো, আমরা জীবিতাবস্থাতেই তার জ্বলন্ত হুতাশনে প্রবেশ ক’রে এই মৃত্যুর অধিক—জীবিত থাকার মহাযন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ করি!
আবার কখনও বা মূর্ছা-ঘোর উপশমিত হলে ভূতলে লুণ্ঠিত হয়ে আকুল ভাবে রোদন করতে করতে বলেছেন, ‘সঞ্জয়, আমার জীবন্ত দগ্ধ হওয়াই উচিত। অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী বীর্যবান পুরুষ, নানা দেশের বীর খ্যাতিমান ক্ষত্রিয় নরপতি, আমার পুত্র পৌত্র সকলের অকাল-মৃত্যুর জন্য আমিই যে মূলত দায়ী। আমি সুহৃদগণের অনুরোধে কর্ণপাত করি নি, মহাতপস্বী পরশুরাম, নারদ ও ব্যাস প্রভৃতি প্রজ্ঞাবানদের উপদেশ অবহেলা করেছি, সাত্বত-শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ— যুক্তিপ্রয়োগ সহকারে বলেছেন, এ বৈরভাব সর্বনাশেরই পূর্বদূত, সে যুক্তি অনুধাবন করতে চাই নি কেবল দুর্মতি জ্যেষ্ঠপুত্রের জন্যই সমস্ত শুভ ও শ্রেয়-বুদ্ধির প্রতি বিমুখ থেকেছি। আমি বাধা দিলে তার সাধ্য ছিল না এই আত্মনাশা যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়। আমি সর্বদাহিতব্রত পিতৃব্য ভীষ্মের, আচার্য দ্রোণের উপদেশও উপেক্ষা করেছি, এক্ষণে জীবিত থেকে পাণ্ডবদের আন্তরিক ঘৃণা ও মৌখিক করুণার পাত্র হয়ে লাভ কি! আমার মৃত্যুরই আয়োজন করো, অথবা গভীর অরণ্যে পাঠিয়ে দাও, সেখানে প্রায়োপবেশনে প্রাণত্যাগ করি।’
সঞ্জয় সান্ত্বনা দেবার যথাসাথ্য চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, ‘রাজন, আপনার পুত্র দুর্যোধন অল্পবুদ্ধি, অতিলোভী, অহঙ্কারী, ভ্রূর ও দুর্মর্ষণ ছিলেন। সুচরিত্র, যথার্থ বুদ্ধিমান, হিতাকাঙ্ক্ষী সকলের উপদেশ উপেক্ষা করেছেন চিরদিন, আপনিও তাঁকে নিবারণ করার প্রয়াস পান নি—সর্বদা উদাসীন থেকে পরোক্ষ প্রশ্রয় দিয়েছেন। অথবা, এ সকল তথ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাও আমার মূঢ়তা মাত্র। আপনি সকল শাস্ত্রজ্ঞ, মেধাবী, সত্যব্রত। আপনি এক্ষণে পূর্ব ইতিহাস স্মরণ ক’রে শোক সম্বরণ করুন। যে পুরুষ মধুলোভে উচ্চ বৃক্ষচূড়ে আরোহণ করতে গিয়ে পতিত হয়ে বিলাপ করে, আপনার এ শোকও তদ্রুপ। আপনি দুর্যোধনের সঙ্গে বাক্যরূপ বায়ুর দ্বারা স্বয়ং পাণ্ডবরূপ অগ্নিকে প্রজ্বলিত ক’রে তাতে লোভরূপ আজ্য সেচন করেছেন। সে অনলে আপনার সন্তানগণ পতঙ্গের মতো দগ্ধ হয়েছে— এখন তার জন্য অনুতাপ ও শোক প্রকাশ করা মূর্খের কাজ নয় কি? আপনার উচিত এই বৃথা পশ্চাত্তাপ থেকে নিবৃত্ত হয়ে পাণ্ডবদেরই অবলম্বন করা, তাদের মঙ্গল কামনা করা।’
ধৃতরাষ্ট্রের এই আকুল বিলাপের বার্তা পেয়ে মহাত্মা বিদুরও এসেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘মহারাজ, আপনি গাত্রোত্থান করুন, আপনাকে আপনি ধারণ করুন, নিজ মর্যাদা বিস্মৃত হবেন না। সকল জীবেরই যখন এই এক গতি নির্ধারিত আছে, তখন কারও মৃত্যুতে শোক করা উচিত নয়। ধরাতলে জনবৃদ্ধি হলেই কোন না কোন উপলক্ষে তার মহান ক্ষয় আবশ্যক হয়। এও বিধিনির্দেশ। যুদ্ধ ক’রেও তো কত লোক জীবিত থাকে যুদ্ধ না ক’রেও অকাল-মৃত্যু লাভ করেছে এমন দৃষ্টান্ত তো বিরল নয়। মানুষ কোথা থেকে আসে কেউ জানে না, কোথায় যায় তাও তার অজ্ঞাত। আপনার পুত্ররাও এককালে আপনার কাছে অদৃশ্য অজ্ঞাত ছিল, আবারও তাই হয়েছে। কোন ব্যক্তিই কারও যথার্থ আপন নয়, আপনিও তাদের আপন ছিলেন না। মনুষ্য-জীবনে শোকের ও ভয়ের কারণ প্রতিদিনই বহুবার আবির্ভূত হয়, মূঢ় ব্যক্তিরাই তাতে বিচলিত ও অভিভূত হয়ে থাকে, প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা হন না। কালের কেউ প্রিয় বা অপ্রিয় নেই, কাল মমতার বশবর্তী হয়ে কাউকে ত্যাগ করে না, কারও প্রতি উদাসীন থাকে না। প্রতি ব্যক্তিরই পরমায়ুর সীমা নির্দিষ্ট আছে, সে সীমায় উপস্থিত হলেই কাল তাকে আকর্ষণ করে। এ যখন অপরিহার্য তখন তার জন্য শোক করছেন কেন? মানুষ লোভের বশে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে পরস্পরের বৈরাচরণ করে, অপরের নিন্দা ও নিজের গৌরব করে। পণ্ডিত ও মূর্খ, ধনবান ও ভিক্ষুক সকলকেই একদা চিতাশয্যায় সকলের সমান হতে হয়, একই পরিণতি লাভ ক’রে। সেক্ষেত্রে ইহজীবনের কুল মান ঐশ্বর্য নিয়ে গর্ব করাও যেমন নির্বুদ্ধিতা, তেমনি তথাকথিত আত্মীয়দের মৃত্যুর পর শোক প্রকাশ করাও বালকোচিত কাৰ্য।’
এই প্রকার যুগপৎ প্রবোধিত ও তিরস্কৃত হয়ে ধৃতরাষ্ট্র অতঃপর কুরুক্ষেত্রের মহাশ্মশানে আসতে সম্মত হয়েছিলেন ।
গান্ধারীকে কোন যুক্তি প্রয়োগে সান্ত্বনা দিতে কেউ সাহস করেন নি, প্রয়োজনও হয় নি। তিনি নীরবেই স্বামীর অনুগমন করেছেন। কিন্তু তাঁদের এই সৎকারযাত্রার সংবাদ পেয়ে সহস্র সহস্র পুরনারী যখন হস্তিনা থেকে নির্গত হয়ে তাঁদের সহযাত্রিণী হলেন, তখন তাঁদের সেই গগনবিদারী ক্রন্দনধ্বনি ও আকুল আক্ষেপ কি তাঁকে বিচলিত করে নি! বিশেষ তাঁর চর্মচক্ষু আবরিত থাকলেও, অথবা থাকে বলেই, তাঁর মানসদৃষ্টি আচ্ছন্ন হয় নি কিছুমাত্রও। তিনি কল্পনাতে সেই হতভাগিনীদের অবস্থা অবলোকন করতে পারলেন।
যাঁরা কখনও চন্দ্রসূর্যের দৃষ্টিগোচর হয়েছেন কি না সন্দেহ, তাঁরা আজ অবদ্ধবেণী মুক্ত কুন্তলে, বিস্রস্তবসনে, নিরাভরণ অবস্থায়, অনবগুণ্ঠিত মুখে সামান্যা রমণীদের সঙ্গে আকুল উচ্চ শব্দে হাহাকার করতে করতে চলেছেন। যাঁরা ভগ্নী বা সখীগণের সম্মুখেও লজ্জা ত্যাগ করেন নি, তাঁরা আজ শ্বশুর ও শ্বশু+দের সম্মুখেই নির্লজ্জার মতো প্রকাশ্য দিবালোকে একবস্ত্রে অন্তঃপুর থেকে নির্গত হয়েছেন, সেই অবস্থাতেই বক্ষে ললাটে করাঘাত করতে করতে চলেছেন
এই দৃশ্য, এই শোকোন্মত্ততা দিব্য দৃষ্টিতে অবলোকন ক’রে, বিশাল হস্তিনা নগরীর প্রায় সকল গৃহ হতে উত্থিত বিপুল ক্রন্দনধ্বনি শ্রুত হয়ে মহাপ্রজ্ঞাবতী, মহাতপস্বিনী, সাক্ষাৎ ধর্মস্বরূপিণী গান্ধারীও যদি সাধারণ রমণীর মতো নির্বিচারে ক্রদ্ধ হয়ে ওঠেন তো বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীকে নিকটবর্তী দেখে পাণ্ডবরা যখন নতমস্তকে ধীরপদে দ্রৌপদী ও কুন্তী সমভিব্যাহারে অগ্রসর হচ্ছেন তখন রোরুদ্যমানা সেই অনাথা, সদ্যবিধবা কৌরব-পুরনারীরা শোক বিস্মৃত হয়ে অনুযোগ ব্যঙ্গোক্তি—ও কেউ কেউ অভিসম্পাতে যেন ফেটে পড়লেন। আশ্চর্য, এই অপ্রিয় বাক্যবর্ষণ-ক্ষেত্রে অকস্মাৎ পাণ্ডবপক্ষীয় অনাথিনীরাও এঁদের সঙ্গে মিলিত হলেন। চতুর্দিক থেকে যেন চক্রবলয়াকারে প্রবল ধিক্কার ধ্বনি বর্ষিত হতে লাগল।
‘হে ধর্মরাজ, তুমি যখন আমাদের পিতা ভ্রাতা পতি গুরু পুত্র ও সখা সকলকে বধ করলে, তখন আমাদের বাঁচিয়ে রাখলে কেন? এই অনাথিনীদের ক্রন্দনমাত্র সম্বল ক’রে দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করানোতেই বুঝি তোমার সমধিক তৃপ্তি, তাই এই ধর্মজ্ঞতা, ন্যায় নীতি ও অনৃশংসতা প্রবল হয়ে উঠল! পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ, ভগ্নীপতি জয়দ্রথ, দুই মহান বংশের যোগসূত্র সকলের নয়নমণি অভিমন্যু— কোটি কোটি আত্মীয় বান্ধব, এখন নিজেদের পুত্রসকল হারিয়ে কি নিয়ে রাজত্ব করবে! সে রাজ্যে সুখই বা কি, গৌরবই বা কি!’
পাণ্ডবরা শোকে আকুল ছিলেন, এখন এই ধিক্কারে যেন অভিভূত বোধ করলেন! শুধু দ্রৌপদী নিজে লজ্জার কোন কারণ না দেখে এই ধিক্কারকে অবিচার বোধে ক্রদ্ধ হয়ে উঠলেন। তবে যুধিষ্ঠির যেমন অবিচলিত ধীর পদক্ষেপে পিতৃব্য অভিমুখে যাচ্ছিলেন, তেমনিই যেতে লাগলেন—এইসব অনুযোগ ও কটুবাক্য তাঁর কর্ণগোচর হচ্ছে বলেও বোধ হল না।
কিন্তু এইবার, যেন তাঁর অবিচল স্থৈর্যকে পরিহাস করতেই, বাসুদেব তাঁর পিতৃসা পাণ্ডবজননী কুন্তীর সমীপবর্তী হয়ে মৃদু অথচ যুধিষ্ঠিরের শ্রুতিগোচর কণ্ঠে বললেন, ‘আর্যা, এবার বোধ হয় সেই নির্ঘাৎ সত্য প্রকাশের চরমকাল সমুপস্থিত হয়েছে। আপনার পুত্রদের কাছে কর্ণর যথার্থ পরিচয় এখনও প্রকাশ না করলে প্রত্যবায় ঘটবে। কারণ তাঁর সমুচিত সৎকার ও তর্পণ আবশ্যক— আর পাণ্ডবদেরই সেটা করণীয়।’
কুন্তী গতরাত্রে বিদুরাশ্রম থেকে এসে পৌঁচেছেন—তখনও পৌত্রদের জন্য ক্রন্দনের অবধি ছিল না, এতক্ষণ ও নীরবেই অশ্রু-বিসর্জন করছিলেন, এখন হাহাকার রবে ক্রন্দন করে উঠে সেইখানেই ভূলুণ্ঠিত হলেন, ‘বাসুদেব বাসুদেব, এ মর্মান্তিক লজ্জা ও যন্ত্রণা থেকে আমাকে পরিত্রাণ করো, তুমিই ওদের জানাও।’
পাণ্ডবরা নিরতিশয় বিস্মিত হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন।
কৰ্ণ!
কর্ণর সৎকার তাঁদের করণীয়! তাঁরা কর্ণর শ্রাদ্ধাধিকারী!
সে আবার কি! সে কেমন ক’রে হবে!
তাঁরা নির্বাক বিস্ময়ে বাসুদেবের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।
বাসুদেব শান্ত কোমল কণ্ঠে বললেন, ‘সখা অর্জুন, চিরদিন তুমি যাকে তোমার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী, প্ৰতিযোদ্ধা ভাবতে, যাকে বধ করতে তুমি আযৌবন কৃতসংকল্প— সেই কর্ণ প্রকৃতপক্ষে রাধেয় নন, তিনিও কৌন্তেয়, তোমাদের অগ্রজ, সহোদর ভ্রাতা। এ সত্য তোমাদের বলা হয় নি, কিন্তু মহানহৃদয় কর্ণ শেষ পর্যন্ত জেনে ছিলেন, সেই জন্যই বহুবার সুযোগ পাওয়া সত্বেও তোমার অপর ভ্রাতাদের বিনষ্ট করেন নি।’…
আঘাত বহুতর সহ্য করেছেন এঁরা, কঠোর নির্মম আঘাত, দুঃসহ—কিন্তু এই চরম দুঃখের দিনে–আত্মীয়- বান্ধবগণের শুধু নয়, নিজেদের গৌরবাকাঙ্ক্ষা, কীর্তি ও জীবনের মহাশ্মশানে দাঁড়িয়ে এই যে আঘাত পেলেন পাণ্ডবপঞ্চভ্রাতা, অবিশ্বাস্য সত্যের আঘাত—এমন অসহ বোধ করি তাদের কোনটাই নয়।
একটা অখণ্ড নীরবতা নেমে এসেছিল তাঁদের মধ্যে—দ্রৌপদীও পুত্রশোকের নিদারুণ দুঃখ ভুলে বিস্ফারিত নেত্রে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। তারপর একসময়, কোনমতে শব্দ উচ্চারণের শক্তি সঞ্চয় ক’রে আকুল …লিত কণ্ঠে ধর্মরাজ বলে উঠলেন, ‘কর্ণ আমাদের অগ্রজ! সহোদর ভ্রাতা!… না না, এ কী করছ! বলো তুমি পরিহাস করছ! বলো বলো জনার্দন।’
বাসুদেবের চিরপ্রশান্ত ললাটে বিন্দুমাত্র কুঞ্চন দেখা দিল না, সত্য সে বোধ করি সম্ভবও নয়, বহুমার্জিত পাষাণের মতোই বহু দুশ্চিন্তা, অগণিত বিপদ, জীবনের অসংখ্য ঝড়ঝঞ্ঝা, পরিকল্পনা, তার সংঘটন-সমস্যার, দুঃসাহসিক সংগঠন-কার্যের আঘাতে মসৃণ সে ললাট—তবু দৃষ্টিকোণে মুহূর্তকালের জন্য কি ঈষৎ ব্যথা, ঈষৎ অপ্রতিভতা প্রকাশ পেল না—অত্যল্প, নিমেষপাতমাত্র সময়ের জন্য?
অন্তত কৃষ্ণার তাই মনে হ’ল।
বাসুদেব বললেন, ‘মহারাজাধিরাজ, এ সময়ে এমন কথা নিয়ে কেউ পরিহাস করে না, গুরুজন সম্পর্কে তো নয়ই। বিশেষ আপনার সম্মুখে লঘু চাপল্য প্রকাশের দুঃসাহস আমার নেই। অবিশ্বাস্য হলেও এ সত্য। আপনি আর্যা কুন্তীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বুঝবেন। এক বালিকাসুলভ চাপল্য, ক্ষণিকের দুর্বলতা ও নিরতিশয় লজ্জার এই ইতিহাস লোপ করতেই চেয়েছিলেন তিনি,–কিন্তু কৃতকর্মের ফল সহস্রগুণ দুঃখ যন্ত্রণা ও লজ্জা বহন ক’রে ফিরে এসেছে। আপনারা তাঁর এই দীর্ঘদিনের অসহ্য যন্ত্রণার কথা স্মরণ করেই তাঁকে ক্ষমা করুন—এই আমার অনুরোধ।’
অতঃপর সেই অস্বাভাবিক ক্ষণে, স্বল্প দুই চারিটি বাক্যে কর্ণর জন্ম-ইতিহাস বিবৃত ক’রে শ্রীকৃষ্ণ নীরব হলেন। তাঁর এই অদ্ভুত বিশ্বাসোত্তর কাহিনী শেষ হতে অর্জুন নিতান্ত প্রাকৃত লোকের মতোই হা হা শব্দে উচ্চৈঃস্বরে রোদন ক’রে উঠলেন, ‘বাসুদেব, এই কারণেই কি চিরদিন এক অদ্ভুত ও অমোঘ আকর্ষণ বোধ করেছি কর্ণ সম্বন্ধে! বিদ্বেষ পোষণ করলেও তাঁর বহু সুকীর্তির কথা স্মরণ ক’রে ঈষৎ শ্রদ্ধা বহন না ক’রেও পারি নি! হায়, জননীর এক অকারণ অপরাধবোধের জন্যই আজ ভ্রাতৃঘাতীর কলঙ্ক ও পাপ গ্রহণ করতে হ’ল। অথচ কর্ণ ও অর্জুন একত্র হলে স্বর্গের সুরগণকেও জয় করা অসাধ্য হত না। স্বাভাবিক যে বন্ধন ও মৈত্রী পৃথিবীতে চিরস্মরণীয় চিরবিস্ময়ের নিদর্শন হয়ে থাকতে পারত তাই এক অস্বাভাবিক বৈরতায় পরিণত হয়ে চিরদিনের জন্য বিপুল ও অনপনেয় লজ্জার ইতিহাস হয়ে রইল!’
যুধিষ্ঠির বাষ্পাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে কুন্তীর দিকে চেয়ে বললেন, ‘জননী, আপনি এ কী করলেন! কর্ণর মতো সন্তানকে স্বীকার করতে কোন অগৌরব, কোন লজ্জার কারণ ছিল না। এ সিংহাসন তো তাঁরই প্রাপ্য, আমরা আজ পরস্বাপহরণের দোষে দুষ্ট হলাম। তাঁকে সিংহাসনে বসিয়ে তাঁর সেবা করতে পারলে আমি অনেক প্রীত ও নিশ্চিন্ত হতাম।’
বাসুদেব তাঁর দক্ষিণ বাহুমূলে ঈষৎ চাপ দিয়ে বললেন, ‘থাক মহারাজ! দেবী কুন্তী যৎপরোনাস্তি লজ্জা ও মর্মান্তিক দুঃখ ভোগ করেছেন। জ্যেষ্ঠ সন্তান—বিশেষ মহামনা কর্ণর মতো পুত্র নিহত হয়েছেন শুনেও উচ্চকণ্ঠে হাহাকার শব্দে রোদন করতে পারেন নি—এই তো যথেষ্ট শাস্তি ভোগ হয়েছে তাঁর—তদুপরি আর নিষ্ঠুর বাক্যকশাঘাতে তাঁকে জর্জরিত করবেন না। ভ্রান্তি মহাশক্তিরই অংশ, সকলেই তার দ্বারা মোহগ্রস্ত হয়। এই যুদ্ধই তো এক মহা ভ্রান্তির ফল। এক ভ্রম সহস্র ভ্রমকে আহ্বান করে, সংসারের এ নিয়ম তো আপনার অজানা নেই!’
বলতে বলতেই তাঁর মুগ্ধ দৃষ্টি—বিশ্বসংসারের এই একক্মিাত্র প্রাণী সম্বন্ধে কিছু দুর্বলতা ও মোহ বুঝি আজও যায় নি, চির-অবিচলিত চিরনির্মম, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান বাসুদেবের—দ্রৌপদীর অনবগুণ্ঠিত মুখে নিবদ্ধ হয়েছিল।
সেই আশ্চর্য আয়ত চক্ষুর বিস্তৃত সীমার কূল ছাপিয়ে অবিরল ধারায় অশ্রু ঝরে দুই কপোল প্লাবিত করছে— বাষ্পবর্ষণ-অস্পষ্টতা ভেদ ক’রেও দেখা যাচ্ছে কি অপরিসীম বেদনা ও অনুতাপ দুই চোখে।
বাসুদেব কেমন যেন একটা অস্থিরতা বোধ করলেন, বোধ হয় কুরুকুলমহিষীর সম্বিৎ ফিরিয়ে আনার জন্যই তাঁর কাছে গিয়ে সামান্য একটু আনত হয়ে বললেন, ‘সখি, আমি জানি তুমিই পৃথিবীর একমাত্র নারী হৃদয়াবেগ যার কর্তব্য সম্পাদনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। তোমার এখন প্রধান ও প্রথম করণীয়—পাণ্ডবজননীকে সান্ত্বনা দান। তুমি নিজে পুত্র-শোকাতুরা—সন্তান-বিয়োগের ব্যথা কি তা বিলক্ষণ অনুভব করেছ, এখনও করছ—তুমিই ওঁর এই দুঃসহ অবস্থা উপলব্ধি করবে। সদ্য পুত্র-বিয়োগ ব্যথার সঙ্গে নিদারুণ লজ্জা অপমান ও অনুশোচনার অনুত্তরণীয় দুঃখ যোগ হয়েছে। ওঁকেই সর্বাগ্রে সান্ত্বনা দান প্রয়োজন। উনি তোমারও জননী, তুমি পুত্রীর কার্য করো।’
পাণ্ডবঘরণী বুঝি এই সুযোগের জন্যই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন—নিজের অজ্ঞাতসারেই। কুন্তীর পাশে, সেই অংসখ্য বীররক্তরঞ্জিত মৃত্তিকার উপরই বসে পড়ে দেবী কুন্তীর মস্তক নিজের অঙ্কে নিয়ে সান্ত্বনা দেবার ছলে তাঁর কণ্ঠের উপর মুখ গুঁজে আকুলভাবে কেঁদে উঠলেন।
তাঁরও যে লজ্জা ও অনুশোচনার শেষ নেই!
তবে সান্ত্বনা দান ও সান্ত্বনা লাভের তখন আর বেশী অবসরও ছিল না।
ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী একেবারেই নিকটে এসে গেছেন। কুরুপুত্রদের চিতা একই স্থানে সজ্জিত হয়েছিল। স্থানাভাবকারণে এক এক চিতায় কয়েকটি করে শব রক্ষিত হয়েছে কেবল দুর্যোধনের জন্য একটি স্বতন্ত্র একক চিতার ব্যবস্থা। অন্ধরাজা প্রায় অনুভূতি-নির্দিষ্ট হয়েই সেই চিতার নিকটে এসে গতি বন্ধ করলেন।
বহু যোজন বিস্তৃত সেই শ্মশানভূমে লক্ষ লক্ষ নারী-কণ্ঠে গগনভেদী হাহাকার এক নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তখন, সেই অভাগিনীদের বক্ষ ও ললাটে করাঘাতের শব্দ একত্রে প্রায় অসংখ্য বজ্রনির্ঘোষের মতো শ্রুতি-দুঃসহ হয়ে উঠেছে। তার মধ্যে অসহায় বৃদ্ধ শূন্যে হস্ত প্রসারিত করে যেন কাকে অবলম্বন বা অনুসন্ধান করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরও ততক্ষণে তাঁর সন্নিকটে পৌঁছে গেছেন। তিনি এবার সসঙ্কোচে তাঁর চরণ স্পর্শ ক’রে অশ্রুরুদ্ধ বেদনার্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আপনার নিকটে ক্ষমাপ্রার্থী, আমি আপনার দুর্ভাগা সন্তান—যুধিষ্ঠির!’
তাঁর সরোদন বিনয় বচনে ধৃতরাষ্ট্রের বিদ্বেষ দূর হ’ল না। এমন কি কপট ঔদার্য ও স্নেহাভিনয়ে চির-অভ্যস্ত বৃদ্ধও তাঁর মুখভাবের অপ্রীতি গোপন করতে পারলেন না। তথাপি কোনমতে যুধিষ্ঠিরকে দুই হাতে আকর্ষণ ক’রে বক্ষসমীপে এনে আলিঙ্গন করলেন। তারপরই আবার শূন্যে দুই বাহু প্রসারিত ক’রে ব্যগ্র কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘বৎস ভীম, ভীমসেন কোথায় গেলেন, তাঁকে আমার কাছে আসতে বলো, আশীর্বাদ করব।’
ভীম এতক্ষণ একটা অস্বস্তিকর আশঙ্কা বোধ করছিলেন, এখন কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে দ্রুত পিতৃব্যর নিকটে যেতে উদ্যত হলেন। কিন্তু বাসুদেব তাঁর অভিপ্রায় অনুমান ক’রে সবলে তাঁকে পিছনের দিকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই ধৃতরাষ্ট্রের সম্মুখে এলেন। অতঃপর, এই একান্ত দুঃখের মধ্যেও পুত্রশোকার্ত বৃদ্ধকে কঠোর বচনে সম্বোধন করলেন, ‘মহারাজ, আপনি মিথ্যাচরণ ও কপটতাকে আপনার চরিত্রের সঙ্গী করেছেন, অন্তরের গোপন প্রদেশে লোভকে লালন করেছেন, সেই লোভেরই প্রত্যক্ষ মূর্তি আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্র। সেইজন্যই তাকে সংযত করার একটা বাহ্যিক কৃত্রিম অনিচ্ছাসঞ্জাত চেষ্টা মাত্র করেছেন। প্রকৃতপক্ষে আপনারও পাণ্ডবদের প্রাপ্য ও তাঁদের বাহুবলে অর্জিত সম্পত্তি ভোগ করার একটা প্রবল ইচ্ছা ছিল।
‘মহারাজ, আপনি সকল শাস্ত্রজ্ঞ, বেদপুরাণাদি থেকে রাজধর্মশাস্ত্র পর্যন্ত সকলই আপনার অধীত ও আয়ত্ত। তত্রাচ আপনি নিজের অপরাধের দায়ে অপরের প্রতি এতাদৃশ ক্রোধ প্রকাশ করছেন কেন? আপনি অন্ধ হলেও অন্যুন দশটি মত্ত হস্তীর বল ধারণ করেন। বাহুবন্ধনে পিষ্ট করে হত্যা করার অভিপ্রায়েই কি আপনি ভীমকে ডাকেন নি? শতপুত্রের শ্মশানশয্যা সম্মুখে রেখে মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না, সত্য ক’রে বলুন দেখি আপনার সেই কুটিল অভিপ্রায়ই ছিল কি না!
‘রাজন, আমি সন্ধি প্রস্তাব প্রসঙ্গে সভামধ্যে আপনাকে যে সকল কথা বলেছিলাম, ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর সঞ্জয়ও তা মুক্তকণ্ঠে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু আপনি সে সকল শুভকর বাক্যে কর্ণপাত করেন নি। আপনি এক প্রকার স্বেচ্ছায় সর্বনাশের বাড়বাগ্নির দিকে অগ্রসর হয়েছেন। পাণ্ডবদের বল বীর্য আপনার অজ্ঞাত ছিল না। তারা আপনার সন্তানদের অপেক্ষা সর্বাংশে প্রবল, উপরন্তু ধর্মবলে বলীয়ান ও সেই কারণেই অপরাজেয়— জেনেও আমাদের উপদেশে অনুরোধে কর্ণপাত করেন নি।… যে নৃপতি স্থির বুদ্ধি সহকারে দেশ ও কালের গতি এবং পরিবর্তন লক্ষ্য করেন, অধস্তনদের দোষ ও দুর্বলতা সম্বন্ধে সচেতন ও সে সকল নিমলার্থে সদা সক্রিয় থাকেন—তিনিই শ্রেয় লাভ করেন। আপনি কোন উপদেশ বিবেচনা করেন নি, উন্মত্ত পুত্রস্নেহে প্রত্যক্ষ ভীষণ সত্যকেও অবহেলা করেছেন নিজের স্বভাবকে সংশোধিত, প্রবৃত্তিকে সংযত করতে পারেন নি। এক্ষণেও আত্ম-অপরাধে আপন্ন হয়ে ভীমকে হননরূপ অধিকতর অন্যায়ে প্রবৃত্ত হয়েছেন। আপনি নিজের ও পুত্রের দুষ্কৃতি স্মরণ করুন। পাঞ্চালীকে প্রকাশ্য সভায় এনে আপনার পুত্ররা যে গর্হিততম অন্যায় করেছেন, ভীম তারই প্রতিশোধ নিয়েছেন মাত্র। আপনি নিজের অসৎ কার্য ও দুর্মতির কথা স্মরণ ক’রে এখনও এসব পাপ-চিন্তা থেকে নিবৃত্ত হোন!
ধৃতরাষ্ট্র কিছুক্ষণ অধোবদনে নীরব থেকে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, ‘ধর্মাত্মা বাসুদেব, তুমি প্রকৃত কথাই বলেছ। তোমার প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টিতেই আজ এক চূড়ান্ত কুকীর্তি থেকে রক্ষা পেলাম।… তুমি এবার নিশ্চিন্ত মনে ভীমকে আহ্বান করো, আর কোন ভয় নেই। ‘
শুধু ভীম নন, তিনি অপর তিনজন পাণ্ডবকেও আলিঙ্গন ও আশীর্বাদ ক’রে সন্তানদের সৎকারের পূর্বকৃত্য হিসাবে স্নানের জন্য প্রস্তুত হলেন।
প্রকৃত আশঙ্কা যে ধৃতরাষ্ট্রের সম্মুখীন হওয়ায় তত নয়—যতটা গান্ধারীর নিকটস্থ হওয়ায়—সে বিষয়ে সকলেই অবহিত। সকলেই শুষ্ক মুখে অপেক্ষা করছেন অপর কারও পূর্বগামী হওয়ার জন্য।
অবহিত ও সচেতন ছিলেন শ্রীকৃষ্ণও।
শুদ্ধচিন্তা, মহাপুণ্যবতী, মহাতপস্বিনী গান্ধারী সমুদয় পুত্র নিহত হওয়ার দুঃখ এই কয়দিন যে ভাবেই সহ্য ক’রে থাকুন, এক্ষণে এই শতপুত্রের অন্তিম শয্যার সম্মুখে এসে ক্রদ্ধ হয়ে উঠবেন পুত্রনিহন্তাদের উপর–এ সত্য দিবালোকের মতোই স্বচ্ছ ও অবধারিত, স্বাভাবিকও। অন্তত বাসুদেবের নিকট, আর তার জন্য তিনি প্রস্তুতও ছিলেন। পূর্বদিন অশ্বত্থামাকে শাসন ক’রে প্রত্যাবর্তনের পথে ব্যাসদেবকে অনুরোধ ক’রে এসেছিলেন, গান্ধারীকে শান্ত করার দায়িত্ব যেন তিনিই গ্রহণ করেন।
ব্যাসদেব সে কথা বিস্মৃত হন নি। তিনি সিদ্ধতপস্বী হলেও এরা তাঁরই সন্তান। পাণ্ডবরাও যদি মহাসতীর অব্যর্থ অভিশাপে ধ্বংস হয়—কুরুবংশেরই নাম পর্যন্ত বিলুপ্ত হবে।
তিনি যথাসময়েই কুরুক্ষেত্র শ্মশানভূমে এসেছিলেন, এখন সংকটকাল সমাগত দেখে অগ্রসর হয়ে গান্ধারীর সম্মুখে এলেন।
আর তিলার্ধ অবসরও ছিল না বোধ হয় ইতস্তত করার। আবৃতদৃষ্টি গান্ধারীর ললাটে ক্রোধের রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ন্যায় অন্যায় যা-ই হোক, গান্ধারীর এমনই চরিত্র মহিমা, এমনই অখণ্ড পুণ্যবল যে তিনি অভিসম্পাত দিলে সে অভিশাপ যার বা যাদের উপর বর্ষিত হবে তারা কেউই পরিত্রাণ পাবে না। সে অভিশাপ অব্যর্থ ও অমোঘ। স্বয়ং বাসুদেব—এমন কি দেবরাজ ইন্দ্ররও সাধ্য নেই তাঁর রোষানল থেকে পাণ্ডু-পুত্রদের রক্ষা করেন।
ব্যাসদেব এসে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা ক’রে বললেন, ‘কন্যা গান্ধারী, তুমি মহা-ধর্মবতী, চিরদিন কায়-মন ও বাক্যে ধর্মকেই অবলম্বন ক’রে আছ। আজ, জীবনের এই প্রায় শেষপ্রান্তে পৌঁছে অকারণে ক্রদ্ধ হয়ে ধর্মকে ত্যাগ ক’রো না। ক্রোধ এ- পৃথিবীতে সকল অনিষ্ট ও অধর্মের মূল। তুমি পাণ্ডবদের প্রতি ক্রুদ্ধ হলে ঘোরতর অবিচার করা হবে, তার দ্বারা তোমার সত্যধর্ম লঙ্ঘিত হবে।
‘সুবলনন্দিনী, তোমার পুত্র দুর্যোধন এই বিগত অষ্টাদশ দিন যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে তোমাকে প্রণাম করতে গেলে তুমি একটি আশীর্বাদের বাণীও উচ্চারণ করো নি, শুধু একটি কথাই প্রতিদিন বলেছ, ‘যে-পক্ষে ধর্ম সে-পক্ষেরই জয় হবে’
তোমার মতো সতী ও পুণ্যবতীর বাক্য মিথ্যা হয় নি–ধর্ম ও সত্যেরই জয় ঘটেছে। তোমার পুত্ররা যে অধর্মাচারী ছিল, নীচজনোচিত অতি গর্হিত আচরণ করেছে—সে তথ্য তোমার অজ্ঞাত নয়। সেইজন্যই তো জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নও উপেক্ষা ক’রে যুদ্ধযাত্রার ক্ষণে সন্তানের কল্যাণ বা জয় কামনা করতে পারো নি। তবে এখন নিরপরাধ পাণ্ডবদের অভিশাপ দিতে উদ্যত হয়েছ কেন। তারা বিনা অপরাধে বহু ক্লেশ সহ্য করেছে, অকারণে বহু লাঞ্ছনা—তাদের আরও দুঃখ দেওয়াই কি তোমার অভিপ্রায়? আমার অনুরোধ তুমি চিরদিনের মতোই, পুত্রদের স্বর্গযাত্রার কালেও ধর্মে নিযুক্ত থাকো—অন্যায় ক্রোধের বশবর্তিনী হয়ে তপস্যার ফল ক্ষয় ক’রো না।’
গান্ধারী একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ঋষিবর, আপনার সকল বাক্যই আমি মেনে নিলাম। পাণ্ডবদের অপর চারজন সম্বন্ধে আমার অসূয়া কি ক্রোধ নেই, আমার দুরাচারী পুত্ররা নিজেদের কর্মফলই ভোগ করেছে—পাপের ঋণ প্রাণদানে শোধ হয়— সে বিষয়ে আমি সম্যক সচেতন কিন্তু তাত, আপনি বার বার ধর্মের কথা উল্লেখ করছেন, ভীমসেন ক্ষত্রিয়সন্তান হয়েও অন্যায় যুদ্ধে নাভির নিম্নে গদাঘাত ক’রে আমার পুত্রকে বধ করেছে—সেটা কি চরম অধর্ম নয়? আপনারা তাকে তো কোন তিরস্কার করছেন না!’
বাসুদেব এবার ভীমকে প্রায় বাহুবলেই টেনে গান্ধারীর চরণপ্রান্তে নিক্ষেপ করলেন। ভীমও সে ইঙ্গিত বুঝে শুষ্ক মুখে ভীতকণ্ঠে বললেন, ‘মাতা, আপনি অবশ্যই জানেন সেই দিন কোনমতেই ন্যায়যুদ্ধে দুর্যোধনকে নিপাতিত করতে পারতাম না। দুর্যোধন অসামান্য গদাযুদ্ধ-বিশারদ—তাঁর প্রাণ রক্ষা পেত না সে কথা নিশ্চিত—তবু আরও হয়ত দুই কি তিন দিন—সেই তাঁর পক্ষে একান্ত ক্লেশজনক যুদ্ধ বিলম্বিত হত। ভগ্ন দেহ ভগ্ন মন ক্ষতবিক্ষত আহত দুর্যোধন তাতে প্রচণ্ড কষ্ট ভোগ করতেন।
‘আপনি এ সত্যও নিশ্চিত অবগত আছেন এই যুদ্ধটাই সম্পূর্ণ অধর্মবুদ্ধিপ্রণোদিত, তার পরিসমাপ্তিতে আমাকে যেটুকু সামান্য অধর্মাচরণ করতে হয়েছে—আপনি সকল শাস্ত্রজ্ঞান-সম্পন্না—আমাকেও সন্তানজ্ঞানে তা মার্জনা করুন। আমি তাঁকে বধ না করলে তিনিই আমাকে বধ করতেন গুরুজনদের মুখে শুনেছি প্রাণরক্ষার্থ কোন রীতি-বিগর্হিত যুদ্ধই অন্যায় নয়।
‘দেবী, আপনি দয়া ক’রে আরও স্মরণ করুন, কপট দ্যূতসভায় দুর্যোধন যখন পাঞ্চালীকে চূড়ান্ত অবমাননার জন্য নিজের অনাবৃত ঊরু দেখিয়ে জঘন্য ইঙ্গিত করেন, তখন আমি সর্বজনসমক্ষে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তাঁর ঐ ঊরু আমি একদা গদাঘাতে চূর্ণ করব। সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা না করলে আমি প্রত্যবায়ভাগী ও ক্ষাত্রধর্মে পতিত হতাম, আমার অধর্ম ঘটত। পূর্বাপর এই সকল দিক বিবেচনা ক’রে আমাকে মার্জনা করুন।
ভীমের বিনয়বাক্যে গান্ধারীর রোষবহ্নি ঈষৎ প্রশমিত হয়ে তার ভয়াবহ উষ্ণতা বাষ্পবারিতে পরিণত হ’ল, চক্ষুবন্ধনীর মধ্য দিয়ে অবিরল ধারায় অশ্রু নেমে এল এবার। তিনি বাষ্পগাঢ় করুণ কণ্ঠে বললেন, ‘বৎস, আমার সকল পুত্রই তো তোমাদের প্রতি অসূয়াপূর্ণ কি শত্রুতাপূর্ণ আচরণ করে নি, তাদের সমান দণ্ড দিলে কেন অন্তত একজনকেও কেন অব্যাহতি দিলে না? এই দুই অন্ধ বৃদ্ধর যষ্টিস্বরূপ যদি একজনকেও বাঁচিয়ে রাখতে, আমি এই মুহূর্তে তোমাদের অজস্র আশীর্বাদ করতাম ও সাধুবাদ দিতাম। এটুকু করুণাও তোমাদের বোধ হ’ল না কেন!
বলতে বলতেই সম্ভবত তাঁর মানবদৃষ্টি-অগোচর দুই চোখে পুনশ্চ অসহ বহ্নি প্রজ্বলিত হ’ল। নিয়ত ব্রতধারিণী, উগ্রতপস্যাশালিনী, সদাসত্যবাদিনী অদ্বিতীয় পতিব্রতা এই মনস্বিনী নারী নিজের চরিত্র-মহিমায় অলৌকিক শক্তির অধিকারিণী হয়েছিলেন। তিনি দিব্যদৃষ্টি বলে এই রণভূমির বর্ণনাশক্তির অতীত দুর্দশা স্পষ্ট নিকটস্থ বস্তুর মতোই প্রত্যক্ষ করেছেন, দেখেছেন নিজের পুত্রদের অর্ধভক্ষিত অর্ধগলিত শবগুলিও। তাদের চিতাশয্যা।
দেখেছেন দৃষ্টিসীমাতীত এই বিশাল প্রান্তরের চতুর্দিকেই অস্থি ও কেশ, এর মৃত্তিকা শোণিতের দ্বারা কদমে পরিণত, তাও বহু সহস্র মৃতদেহে আচ্ছন্ন ও আবৃত— অশ্ব, গজ, মানবদের গলিত দেহের পূতিগন্ধে আকৃষ্ট হয়ে বহুদূর থেকে শিবা, গৃধ্র, কাক, দ্রোণকাক, নরখাদক রাক্ষস জাতীয় প্রাণী ও মাংসাশী অপর পক্ষীকুল ছুটে এসেছে এবং সেই প্রখর দিবালোকেই স্বয়ং সমস্ত খাদ্য অধিগত করার প্রয়াসে পরস্পরের সঙ্গে বিবাদে মত্ত হয়ে উঠেছে, তাদের সেই কর্কশ লুব্ধ স্বর শ্রবণে প্রবেশ ক’রে জীবিতদের দেহ কণ্টকিত হচ্ছে।
দেখলেন শোকার্তা রমণীদের উন্মাদ লজ্জা-ভয়হীন অবস্থা। সেই মহাবীরদের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কোথাও বা স্তূপীকৃত শিরোভূষা, কাঞ্চনময় কবচ, অঙ্গদ, কেয়ূর, মণিহারের উপর নিজেদের অলঙ্কারসকল নিক্ষেপ করছেন। কেউ বা এক হাতের বলয় খুলেছেন, অপর বলয়ের কথা স্মরণে নেই।…
এই আশ্চর্য-অবিশ্বাস্য-তপোপ্রভাবে প্রাপ্ত দিব্য দৃষ্টিশক্তিতেই দেবী গান্ধারী বাসুদেবের অবস্থান লক্ষ্য করেছিলেন। তাঁকে দেখেই ওঁর কিঞ্চিৎ প্রশমিত ক্রোধানল পুনঃপ্রজ্বলিত হয়েছে। এখন তাঁকেই সম্ভাষণ ক’রে তীব্র তিক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘বাসুদেব, তোমার কীর্তি দেখতে এসেছ এই শ্মশানভূমে? দেখে তৃপ্তিলাভ করছ তো? এই দৃশ্যই তো তোমার ঈপ্সিত ছিল—তাই না! মানবজগতের শ্রেষ্ঠ পুষ্পরাশি দলিত মথিত গলিত হওয়ার দৃশ্য? দেখছ তোমার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে—উচ্চবংশের কুলনারীরা বারনারীর মতো সকলের দৃশ্য হয়েছেন, অচিরে ইতরজনের ভোগ্যাও হবেন। শ্রেষ্ঠ বিখ্যাত রাজ্যগুলি নৃপতিশূন্য বীরশূন্য হ’ল, ভারতভূমি অনাথিনী হলেন। অনার্য নিষাদ পিশাচ প্রভৃতির ঔরসে যে বর্ণসংকর সৃষ্টি হবে—অনাগত সেই অর্ধনরদের উপরই ভারতভূমির গৌরবরক্ষার ভার ন্যস্ত করলে তুমি। সাধু! সাধু!
‘বাসুদেব, আমি জানি আমাদের এই দুই পরিবারের কিছুই তোমার অজ্ঞাত ছিল না। পাণ্ডবরা একান্ত ভাবে তোমার আশ্রিত। তুমি ইচ্ছা করলে এই ভয়ঙ্কর সর্বকল্যাণনাশী গৃহযুদ্ধ আত্মীয়-বিরোধ বন্ধ করতে পারতে। তোমার লোকবল -তোমার বংশেরই অগণন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা আছেন—বাহুবল ও বুদ্ধিবল অপরিসীম তুমি চেষ্টা করলে দুর্যোধনকে বশীভূত করতে পারতে, তোমার ইঙ্গিতে পাণ্ডবরা এ যুদ্ধ থেকে বিরত থাকত। তোমার বুদ্ধিতে ও দূরদর্শিতায় আর তাদের শৌর্যে অপর রাজ্য জয় ক’রে তারা শান্তিতে রাজ্যসুখ ভোগ করতে পারত। সেক্ষেত্রে, তারা সর্বাংশে সমান বা অধিকতর বলশালী হয়েছে দেখলে দুর্যোধন তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সাহস করত না।
‘তুমি এসবের কোন চেষ্টাই করো নি। বরং সুকৌশলে বুদ্ধি ও পরিচালনা শক্তির দ্বারা এই সর্বনাশা যুদ্ধ সংঘটিত করিয়েছ, ভারতভূমি বীরশূন্যা হবেন জেনেও।
‘কংসনিসূদন, আত্মীয়বধের দ্বারাই তোমার কর্মজীবন আরম্ভ হয়েছে। অপরের আত্মীয়বধ-দুঃখে তাই তোমার এত ঔদাসীন্য। আমি পাণ্ডবদের ক্ষমা করেছি—তাদের তত দোষও দেখি না, কেবল জ্ঞাতিরক্তপান ও নাভির নিম্নে গদাঘাত করা, এই দুটি হীন নৃশংস কর্ম ছাড়া–কিন্তু তোমাকে আমি ক্ষমা করব না।
‘আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি, তোমার দ্বারা তোমার জ্ঞাতিকুল—বৃষ্ণি অন্ধক ও যদুকুল ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, তোমার পুরনারীরা দস্যু-তস্কর নিষাদদের সম্ভোগনীয়া হবেন। অতঃপর তুমিও হতজ্ঞাতি, হতমিত্র, হতামাত্য, হতপুত্র এবং সর্বোপরি শক্তিহীন হয়ে বনচরের জীবন যাপন ক’রে শেষ পর্যন্ত অপঘাতমৃত্যু লাভ করবে। যদি কায়মনোবাক্যে তপশ্চর্যার মতো পতিসেবা ও অখণ্ড সত্যপরায়ণতার দ্বারা কোন পুণ্য অর্জন ক’রে থাকি, আমার এ অভিশাপ ব্যর্থ হবে না। কেউ তোমার বংশ রক্ষা করতে পারবে না।’
গান্ধারীর এই নিদারুণ বজ্রসম বাক্য উচ্চারণ শেষ হলে পাণ্ডবরা উদ্বিগ্ন, ভীত ও দুঃখিত হয়ে মূর্ছাহতের মতো স্তম্ভিত নির্বাক হয়ে রইলেন। কেবল বাসুদেবের সেই অনিন্দ্যসুন্দর মুখ চিরাভ্যস্ত এক দুয়ে মধুর হাস্যে রঞ্জিত হয়ে উঠল।
সেইসঙ্গে কি ঈষৎ একটু বেদনার ছায়াপাতও হয়েছিল তাঁর চিরমমতাহীন উদাসীন দৃষ্টিতে?
কে জানে সে-বেদনা কিসের। সে কি নিজের বংশের নিজের কর্মের পরিণাম চিন্তা ক’রে?
অথবা কতখানি বেদনায় গান্ধারীর মতো মহীয়সী নারীও তাঁর স্থৈর্য হারিয়েছেন সেই কথা ভেবে?
তা কেউই ঠিক বুঝতে পারলেন না। সে অবসরও দিলেন না বসুদেবপুত্র। ধীর শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘মনস্বিনী, যে কার্য আমিই সম্পন্ন করতে কৃতসঙ্কল্প সেইটেই আমার প্রতি অভিশাপ রূপে উচ্চারণ ক’রে মিথ্যা নিজের তপশ্চর্যার ফল ক্ষয় করলেন! আমার বংশকে আমি ছাড়া কারও বিনাশ করার শক্তি নেই। সেজন্য আমিই তাদের বধ সংঘটন করব। রাজশক্তি ক্ষাত্রশক্তির যে পাপ নষ্ট করার জন্যে আমার এত আয়োজন–সে পাপের সর্বাধিক বাস যে আমার কুলেই তা আমি বিলক্ষণ জানি। সে পাপ নির্মূল ক’রেই আমার আরব্ধ কাজ শেষ হবে। তার পর, আমার অবস্থা? আমাকে কেউ দুঃখ দিতে পারে না, আমি সাধারণ মানবমানসবৃত্তির অধীন নই। আর মৃত্যু যখন অবধারিত, শরীরধারী মাত্রেরই মৃত্যু ঘটতে বাধ্য, তখন সে-মৃত্যু কি ভাবে আসবে তা নিয়ে চিন্তা করা বৃথা। তত্রাচ, মহা-তপস্বিনী, আপনার অভিশাপ-বাক্য মাথা পেতে নিলাম। আপনি শান্ত হোন, আপনার তপস্যা না বিনষ্ট হয়। দেবী, যদি কনিষ্ঠের স্পর্ধাপ্রকাশ না মনে
করেন—আমি আপনাকে বর দান করছি—আজকের এই যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতিও একদা বিনষ্ট হবে হয়ত, কিন্তু আপনার মনোবল চরিত্রবল ধর্মপরায়ণতা ও পতিপূজারূপ তপস্যার কথা এদেশে কিম্বদন্তীতে পরিণত হয়ে চিরদিন লোকের বিস্ময় ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করবে।’
উপসংহার
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মহানায়ক ও পরিকল্পনাশিল্পী বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ অবসন্ন ভাবে একটি বৃক্ষতলে বসে পড়লেন। তৃণবিরল, কঙ্কর, ও বালুময় মৃত্তিকা। কঠিন ও কষ্টদায়ক। তা হোক, তাতে তাঁর আর কোন ক্লেশ বোধ হবে না। কিছুতেই আর কোন ক্ষতিবৃদ্ধি বা উল্লাস কি দুঃখের কারণ নেই তাঁর। বৃক্ষের এই ছায়াটুকু না থাকলেও কিছু ক্ষতি হত না। শুধু কোথাও অবসন্ন পৃষ্ঠভার রক্ষা করতে হবে বলেই একবার মাত্র চারিদিকে দেখে নিয়ে এই বৃক্ষটির তলদেশে এসে বসেছেন। এর কঠিন বিশাল কাণ্ডে অবসন্ন দেহ এলিয়ে দেবেন বলে। কোন একটা কিছুকে আশ্রয় বা অবলম্বন না করলে আর চলছে না। কোথাও সামান্যতম শক্তিও আর বোধ করি অবশিষ্ট নেই তাঁর।
ক্লান্তি এই প্রথম বোধ করছেন না। বহু পূর্ব হতেই এই ভাবটা এসেছে—নিজেকে বড় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মনে হয়েছে। তবু, ইতিপূর্বে কোন দিন এতখানি অবসাদ বোধ করেন নি। বিষাদ আর অবসাদ। সেইসঙ্গে একটা হতাশাও।
পরাজয়ের হতাশা? ব্যর্থতার গ্লানি? এ কথা কয় বৎসর পূর্বে হলেও স্বীকার করতেন না। এখন ঠিক অতটা নিশ্চিত নন তিনি। নিত্য আনন্দময় পুরুষ তিনি দুঃখে অনুদ্বিগ্নচিত্ত, সুখে বীতস্পৃহ, অনাসক্ত দ্রষ্টা। কোন কারণে কিছুতেই কোন চাঞ্চল্য জাগে না তাঁর—কোন অবস্থাতেই বিচলিত বোধ করেন না। কখনও ক্রোধ হয় না তাঁর, স্থিরবুদ্ধি মানুষ। সেই তিনি এমন অবসন্ন হয়ে পড়লেন কেন? কেন এক সর্ব-অস্তিত্ব-বিহ্বলকারী হতাশা আর অপরিমেয় বিষাদ তাঁকে এমন ক’রে আচ্ছন্ন করছে, গ্রাস করছে—মৃত্যুর আগে মৃত্যুর মতো?
আসলে একটা কথা ভুলে গিয়েছিলেন তিনি।
এ-ই বিশ্বের সৃষ্টি-রহস্য ঈশ্বরের অলঙ্ঘ্য নিয়ম প্রকৃতির অমোঘ বিধান। দেহ ধারণ করলেই দেহের নিয়ম মানতে হবে। ক্লান্তি অবসাদ জরা মৃত্যু—দেহীর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এসব। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এগুলি আসবে—কোনমতেই তাদের নির্দিষ্ট-পরিণতি-ক্রমাগ্রসরে বাধা দেওয়া চলবে না, এড়ানো যাবে না।
তাও তো—বহুদিনই এদিকে দৃষ্টি রুদ্ধ ক’রে ছিলেন তিনি। জোর ক’রেই। সত্য জেনেও সেটা অস্বীকার করার চেষ্টা করেছিলেন। দেহ ও মনের এই অবসাদ ও ক্লান্তি–আর, আর সবার কারণ এই বার্ধক্য।
লোকে বলে তিনি নারায়ণ। পুরাকালের প্রখ্যাত ঋষি—তপস্যাবলে ঐশীশক্তিসম্পন্ন হয়ে দেহান্তর ধারণ করেছেন। কেউ বলে তিনিই সাক্ষাৎ ভগবান, কেউ বা বলে ভগবানের অংশ।
তিনি কে তা তিনি জানেন না। সে আত্মোপলব্ধি আত্মপরিচয় লাভের চেষ্টাও করেন নি কখনও।
কারণ, এ তিনি জানেন, যদি কোন দিন বুঝতে পারেন তিনি ঈশ্বরের অংশে জন্মগ্রহণ করেছেন—বা ঈশ্বরের ইচ্ছা ও প্রজ্ঞাই দেহ ধারণ করেছে তাঁর মধ্যে—তা হলে সেইদিন সেই মুহূর্তেই তাঁকে এ দেহ ত্যাগ করতে হবে। ঈশ্বরজানিত পুরুষ, দৈব কার্যে দৈব অংশে যাঁরা জন্মগ্রহণ করেন—স্বরূপ উপলব্ধির পর আর এই মর্ত্যের মৃত্তিকায়, এই মরদেহে থাকা তাঁদের সম্ভব নয়।
না, বাঁচতেই চেয়েছিলেন তিনি। কর্মরূপ-তপস্যায় ব্রতী হতে চেয়েছিলেন।
অনেক কাজ তাঁর।
এই কাজকেই তাঁর জীবনের ব্রত, লক্ষ্য বলে মনে করেছিলেন। দায়িত্ব—জীবন-ধারণের কারণ।
সে-ব্রত অসমাপ্ত রেখে তাঁর মরা চলবে না, এইটেই মনে করেছিলেন। তাই প্রাণপণে দেহীর পরিণতি—আসন্ন জরা ও বার্ধক্য, অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর চিন্তাকে পশ্চাতে রেখে দৃষ্টি আবৃত ক’রে ছিলেন।
হায় রে মানুষের দস্ত!
তবে এও তো সেই দেহেরই ধর্ম, এই আত্ম-অহঙ্কার। এই শূন্যগর্ভ দম্ভ।
নিজের সম্বন্ধে অকারণ উচ্চ ধারণা পোষণ করা, কল্পিত দায়িত্বের গৌরবে স্ফীত হওয়া।
বার বারই দেহের ধর্মের কাছে নতি স্বীকার করতে হচ্ছে তাঁকে, বাসুদেবকে— যিনি মাত্র এই কয়েক বছর পূর্বেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তাঁর ভ্রাতা ও বন্ধু অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছেন—একেবারে অনাসক্তভাবে কর্মে নিরত হতে বুঝিয়েছেন যে, কর্মেই মানুষের অধিকার, ফলে নয় বুঝিয়েছেন যে, যোগস্থ হয়ে, সিদ্ধি অসিদ্ধিতে সমান অবিচল থেকে কর্ম করাই উচিত দেহধারী আত্মার কৌমার যৌবন জরা অনিবার্য বুঝিয়েছেন যা করবার তা ঈশ্বরই ক’রে রেখেছেন, ক’রে রাখেন মানুষ নিমিত্ত মাত্র, তার বেশী তার কোন শক্তি বা অধিকার নেই, তাকে দিয়ে প্রকৃতিই ভিন্ন ভিন্ন কাজ করিয়ে নেয়।
বুঝিয়েছেন, অর্জুনও বুঝেছেন!
কিন্তু তিনি নিজে?
নিজে কি বিশ্বাস করেছিলেন এসব কথা?
তা যদি করতেন, তা হলে ভারতের এই ভার-বিমুক্তির—পাপহরণের দায়িত্ব, এখানে এক অখণ্ড ধর্মরাজ্য স্থাপনের দায়িত্ব তাঁরই—এ-কথা মনে হবে কেন?
কেন এত চিন্তা, পূর্ব-পরিকল্পনা, এত কৌশল ক’রে এতগুলি লোকের মৃত্যু ঘটাবেন? এত বিধবার হাহাকার, এত অনাথের ক্রন্দন, এত কোটি কোটি লোকের বিপুল বিনষ্টি বা সর্বনাশ ঘটিয়ে, সে সম্বন্ধে সকল সদয় বিবেচনা উপেক্ষা ক’রে—কঠিন নির্মম হয়ে থেকে—এই স্বয়ং-আরোপিত দায়িত্ব বহন করতে যাবেন?
শুরু হয়েছে নিজের মাতুল-নিধন থেকে।
কংস তার নিজের মৃত্যু প্রতিরোধের জন্যে যদি ভগ্নী-ভগ্নীপতিকে কারারুদ্ধ ক’রে থাকে, যদি ভাগিনেয়দের মৃত্যুর কারণ হয়—তাহলে তাকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় কি? আত্মরক্ষার ইচ্ছা শুধু মানুষের নয়—প্রাণী মাত্রেরই সহজ প্রবৃত্তি। যাদের বুদ্ধি-বিবেচনা ন্যায়ান্যায়বিচার কিছু নেই—ইতর কীট-পতঙ্গ—তাদেরও এটা সহজাত।
অবশ্য তাঁর কথাও চিন্তা করতে হবে বৈকি এক্ষেত্রে।
বাসুদেবের নিজের কথা।
তাঁরও সহজ প্রবৃত্তি হ’ল পিতামাতার শত্রু, নিজের বংশের শত্রুকে বিনষ্ট করা। তিনি তাই-ই করেছেন। দেহের ধর্ম, দেহীর ধর্মই পালন করেছেন। তার বেশী কিছু নয়।
না, কংস-বধ তাঁর পক্ষে কোন অন্যায় কর্ম, অধর্ম হয় নি!
তবে অন্যায়—মানুষের চোখে সমাজের চোখে যা অন্যায়—তাও কিছু কিছু করেছেন! লোককে বুঝিয়েছেন—মানে তাদের ভ্রম অপনোদনের চেষ্টা করেন নি যে, তিনি মানুষের থেকে উচ্চতর কোন মানুষ, মহামানব বা অবতার, লোকের পক্ষে যা অধর্ম তাঁর পক্ষে তা নয়,–আর নিজেকে বুঝিয়েছেন যে,–লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য যেখানে মহান, সেখানে একটু-আধটু হীন কৌশল অবলম্বন করায় দোষ নেই।
জরাসন্ধকে বধ করায় কোন দোষ হয় নি—কিন্তু যে-উপায়ে বধ করেছেন তা দোষাৰ্হ বৈকি! ক্ষত্রিয় বা বীরের কাজ হয় নি সেটা। আতিথ্যের সুযোগ নিয়ে, গোপনে ছদ্ম পরিচয়ে গেছেন তাঁরা, অতর্কিতে যুদ্ধে আহ্বান করেছেন—নইলে জরাসন্ধকে হয়ত কোন দিনই বধ করা যেত না। ভীম অর্জুন দু’জনে মিলেও পারতেন কি না সন্দেহ।
কিন্তু এই জরাসন্ধ-বধ কি শুধুই তাঁর মহান দায়িত্ব পালন, ভারতকে পাপমুক্ত, ভারমুক্ত করার জন্যেই করেছেন— সিদ্ধি অসিদ্ধিতে সমান থেকে, ফলে উদাসীন হয়ে,—যে-উপদেশ বা নির্দেশ তিনি পরে ধনঞ্জয়কে দিয়েছেন? শুধুই কি ধর্মের রক্ষার কথা, পীড়িত শোষিত মানবের মুক্তির চিন্তাই মনে ছিল তাঁর? তাঁর ব্যক্তিগত বৈরই কি এ কাজে প্রণোদিত করে নি তাঁকে? বারম্বার আক্রান্ত হয়ে অশেষ দুঃখ সহ্য ক’রে শেষে প্রাণভয়ে মথুরা ত্যাগ ক’রে তাঁদের রৈবতক পাহাড়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল, সে অপমানবোধ কি তাঁর মনের অবচেতনে তাঁকে প্ররোচিত করে নি যুধিষ্ঠিরকে জরাসন্ধ-বধে প্রবৃত্ত করতে?
জরাসন্ধ-বধের জন্য যেসব হীন কৌশল ও ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলেন—বিদ্বেষশূন্য হয়ে করলে—তাতেও দোষ হত না।
তা কি সম্ভব হয়েছিল আদৌ?
দীর্ঘকাল ধরে অপমান সহ্য ক’রে থাকতে হয়েছিল, অপমান আর ভয়। বহু জ্ঞাতি নাশ হয়েছে তাঁর—বহু লক্ষ সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে, জরাসন্ধর সঙ্গে যুদ্ধে— তাতেও সে ভয় থেকে, সে অপমান থেকে অব্যাহতি পান নি।
সে জ্বালা অহরহ তাঁর ভাবনার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। তাই পাঞ্চাল স্বয়ম্বরসভায় ভীম-অর্জুনকে দেখে এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন—আত্মীয়তার দাবি প্রতিষ্ঠিত ক’রে তাদের স্বপক্ষে আনবার জন্যে। এই দুই তরুণ বীরের মধ্যে সেদিন ভাবী জরাসন্ধ-নিধনকারীদের দেখেছিলেন বলেই আসলে এত উল্লাস!
না, জীবনের প্রদোষবেলায় পৌঁছে আর আত্মপ্রবঞ্চনা করতে চান না তিনি। স্বকর্ম সাধন করতে এমন অনেক কৌশল অবলম্বন করেছেন তিনি–ন্যায় ও সত্যের বিচারে মনুষ্যত্বের মাপে যা সঙ্গত হয় নি। বিবেককে যতই বোঝান যে, এটা তাঁর দায়িত্ব পালনের জন্য, ধর্মরাজ্য স্থাপনের জন্য, সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্যই করতে হচ্ছে—মনে মনে বেশ জানেন যে, সংকল্প ও কার্যসিদ্ধির জন্যই তিনি সত্য পথ থেকে, বীরের পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছেন বার বার।
এই এত বড় যুদ্ধও তো তাঁরই রচনা।
কৌরবরা যখন কপট দ্যূতক্রীড়ায় আমন্ত্রণ জানাতে এল ইন্দ্রপ্রস্থে, তখনই তিনি জানতেন সে আমন্ত্রণের পরিণাম কি। তাঁর উচিত ছিল পাণ্ডবদের নিষেধ করা, নিবৃত্ত করা। তিনি নিষেধ করলে যুধিষ্ঠির কখনওই এ কাজে যেতেন না। কিন্তু তা তিনি করেন নি। পাছে কাছাকাছি থাকলে যুধিষ্ঠির তাঁর মতামত জিজ্ঞাসা করেন—সে কারণেই, তিনি সব জেনেও দ্বারকা ছেড়ে এমন স্থানে চলে গিয়েছিলেন, যাতে চেষ্টা করলেও ওঁরা যোগাযোগ না করতে পারেন। তিনি চেয়েছিলেন যে, দ্যূতসভায় পাণ্ডবগণ তথা পাঞ্চালী যেন অবর্ণনীয় লাঞ্ছনা ভোগ করেন। পাপ চরম সীমায় না পৌঁছলে দৈব-কোপ জাগ্রত হয় না, আর–তা না হলে পাপের বিনাশও হয় না।
হ্যাঁ, এই যুদ্ধই তিনি চেয়েছিলেন। এই লোকক্ষয়কারী নিষ্ঠুর যুদ্ধ। প্রজানাশেই আনন্দ তাঁর—যাঁকে লোকে প্রজাপতিরই অন্য রূপ বলে জানে। চেয়েছিলেন অধর্মশক্তির সম্পূর্ণ বিনষ্টি, চেয়েছিলেন উদ্ধত ক্ষাত্রশক্তির শ্মশানের উপর ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে।
প্রকাণ্ড ভুল করেছিলেন তিনি। পরশুরাম ভারতকে একবিংশতিবার নিঃক্ষত্রিয় বীরশূন্য ক’রেও পারেন নি তাকে পাপশূন্য করতে। ভারতবাসী তার স্বভাব ও স্বধর্ম ভুলতে পারে নি। কাম, ক্রোধ, মাৎসর্য এবং লোভ—এতেই তারা অন্ধ হয়ে যায়, আর কোন কিছু বিবেচনা থাকে না, ক্ষুদ্র স্বার্থে বৃহৎ স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়, নিজের ইষ্ট নিজের ভবিষ্যৎ কিছুই দেখতে পায় না, সামান্য দূরেও দৃষ্টি চলে না তার।
তবু যে বাসুদেব এই ভারতভার-হরণের স্বপ্ন দেখেছিলেন—সেও কি তাঁর আত্ম-অহমিকারই একটা প্রমাণ নয়? ভেবেছিলেন তিনি পরশুরামের থেকে বেশী বুদ্ধিমান। সেই ক্রোধী তপস্বী নিজ ভুজবলের উপর নির্ভর ক’রেই ব্যর্থ হয়েছেন মস্তিষ্ক বাহুর থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী—এই সত্য নূতন ক’রে প্রতিষ্ঠা ক’রে সার্থক হবেন তিনি। নিজে নয়—অপরকে দিয়ে এই মহামৃত্যুযজ্ঞ সমাপন করাবেন।
এই মাদক কল্পনাতে মত্ত হয়েছিলেন, তাই পাণ্ডবদের শোকের সময়—ঘটোৎকচের মৃত্যুতে—তাদের হতচকিত ক’রে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করেছিলেন। কারণ কর্ণের একাঘ্নীতে ভয় ছিল তাঁর। ইন্দ্রের দেওয়া অমোঘাস্ত্র নিক্ষিপ্ত হলে শূরশ্রেষ্ঠ অর্জুনও রক্ষা পেতেন না। সেই অস্ত্র ঘটোৎকচের ওপর দিয়ে নষ্ট হতেই এত আনন্দ তাঁর, এত নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিলেন। এ আনন্দ উদ্দেশ্যসিদ্ধিরও বটে। জেনেশুনেই ঘটোৎকচকে তিনি ঐ নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। ঘটোৎকচ যখন ভয়ঙ্কর সংহারমূর্তি ধারণ ক’রে কুরুসৈন্যনাশে প্রবৃত্ত হয়েছে তখনই তো বাসুদেব জানতেন এর ফলাফল কি। মানুষ মাত্রেরই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের থেকে প্রত্যক্ষ বর্তমানের ভয় বেশী এখন বাঁচলে তবে কোন একদিন মরার আশঙ্কা। কৌরবরা যত নির্বোধই হোক—বর্তমানকালের বিপুল সর্বনাশ এড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠবে না, ভবিষ্যতের সুদূর সম্ভাবনা ধরে বসে থাকবে—এত নির্বোধ নয়।
তিনিই পাণ্ডবদের ভীষ্মবধের কৌশল ভীষ্মকে দিয়েই বলিয়ে দিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যা বলিয়েছেন তিনিই অর্জুনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কর্ণরথচক্র মেদিনীগ্রস্ত হবার সুযোগে কর্ণকে বধ করতে তিনিই সূর্য অস্ত যাবার মিথ্যা রোল তুলে কয়েক মুহূর্তের জন্য জয়দ্রথকে অন্যমনস্ক ক’রে দিয়ে—অর্জুনকে সেই মিথ্যার সুযোগ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনিই দ্বৈরথ গদাযুদ্ধের সমস্ত নিয়ম লঙ্ঘন ক’রে ভীমকে ইঙ্গিত করেছিলেন দুর্যোধনের ঊরুতে আঘাত করতে, এরা ভুলে গেলেও তিনি ভোলেন নি যে, দুর্যোধনের দেহের মধ্যে ঐ অংশটুকু মাত্র দুর্বল, ভঙ্গুর।
এসবই তাঁর কীর্তি, তাঁর সংগঠন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দ্রষ্টা হয়ে থাকার কথা তাঁর, নিরস্ত্র হয়ে ছিলেনও প্রায় তাই—মাত্র দু’একবার ছাড়া সে যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন নি, অথচ এ-কথা আজ আর কে না জানে যে, আসল যুদ্ধ তিনিই করেছেন। বাহু দিয়ে হয়ত নয়—তিনি যুদ্ধচালনা করেছেন মস্তিষ্ক দিয়ে। বাহুকে যে মস্তিষ্কই চালনা করে— এ সর্বজনবিদিত সত্য। সেদিনও বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের সে তথ্য অবিদিত ছিল না। কৌরবদের শবদেহ সৎকারের আগেই আর্যা গান্ধারী সে অনুযোগ করেছিলেন, অভিসম্পাত দিয়েছিলেন। সে অভিসম্পাতই তো এইমাত্র সফল হ’ল। তিনি নিজেই তা সফল ক’রে এলেন।
মহাসতী গান্ধারীর অভিসম্পাতে সেদিন হেসেছিলেন বাসুদেব, প্রশান্ত, প্ৰসন্ন হাসি।
এ যে হবেই, অনিবার্য—তা তো তিনি জানতেনই, তাই বিচলিত হন নি।
কিন্তু আজ আর সে হাসি নেই তাঁর—সেদিনের সে চিত্তস্থৈর্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বীতরাগভয়ক্রোধ স্থিতধী বলে যা অহঙ্কার ছিল তাঁর—তা চূর্ণ হয়েছে।
তিনি ক্রদ্ধ হয়েছিলেন। হ্যাঁ—মানবিক অর্থে যাকে ক্রদ্ধ হওয়া বলে তাই হয়েছিলেন। ক্ষণকালের জন্য বিচার- বিবেচনা দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি।
ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন নিজের জ্ঞাতিদের উপরই। সেই ক্রোধের ফলেই তাদের বিনাশ ঘটেছে। সদ্যোজাত শিশু, অথব বৃদ্ধ ও অবলা নারী ছাড়া বৃষ্ণি অন্ধক যাদব বংশে কেউ জীবিত নেই। একটি সমর্থ বালকও না।
তাঁর নিজের বংশের এ পরিণাম তিনি জানতেন, এতটা জানতেন না। নারী ও সুরায় উন্মত্ত হয়ে উঠল তারা। সর্বজনসমক্ষে সর্বক্ষণ সুরাপান করতে লাগল। অহোরাত্র সুরাপান, মাংসাহার ও স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক যৌনসম্ভোগে রত রইল। শ্রদ্ধেয়দের অবজ্ঞা করতে লাগল, যা শুভ ও হিতকর তা উপেক্ষা করল। শুধু তাদের দেহটাই নয়—মনে হ’ল তাদের আত্মা-মনও নানাবিধ পাপ ও ব্যসনে ডুবে গেছে, তা থেকে উঠে আসার আর কোন আশা নেই
তার ফল যা হবার তাই হ’ল।
তুচ্ছ কারণে কলহ বাধল, সে কলহ ঘোরতর আত্মযুদ্ধে পরিণত হতেও বিলম্ব ঘটল না।
কেশি-নিসূদন বাসুদেব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন তাঁর পুত্র-পৌত্ররা, তাঁর জ্ঞাতিরা অকারণেই মূঢ়ের মতো পরস্পরকে হত্যা করছে।
সেই সময়েই অকস্মাৎ ঐ দিকদাহকারী ক্রোধ অনুভব করেছিলেন বাসুদেব।
ক্রোধ নিজের ভাগ্যের উপর, নিজের নির্বুদ্ধিতার উপর।
বহু আশা ক’রে বহুদিনের বহু আয়াসে তিনি ভারতভার হরণ করতে গিয়েছিলেন কৌরবদের সর্বনাশা জ্ঞাতিযুদ্ধ ঘটিয়ে ভারত থেকে পাপ ও অন্যায়, অধর্ম ও অসত্য লোপ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। হায় রে বুদ্ধির অহঙ্কার! এত কাণ্ড না করলে বুঝি ভাগ্যের টনক নড়ত না—এত লক্ষ পতিহীনা অনাথিনীর হাহাকার আর অশ্রুজল মিলিত না হলে বোধ করি বিধাতার স্থৈর্য নষ্ট হত না। এমন বিচলিত হয়ে উঠতেন না তিনি।
ওঁর উত্তুঙ্গ অহঙ্কার দেখে এমন ভ্রূর পরিহাসের হাসি হাসতেন না অদৃষ্টদেবতা!
হ্যাঁ, অদৃষ্টের পরিহাস তো একেই বলে।
সেই সমস্ত পাপ, সেই সমস্ত অন্যায় ও অধর্ম তাঁর রাজ্যে তাঁর বংশে এসেই জুটল।
ভারতের সমস্ত প্রান্তেই তাঁর দৃষ্টি ছিল, মৎস পাঞ্চাল মদ্র বিদর্ভ প্রাগজ্যোতিষপুর মণিপুর—ছিল না শুধু নিজের ঘরের দিকে। একেবারে ছিল না বললে ভুল হবে—এটার সংশোধন তাঁর আয়ত্তাধীন ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলেন। সেটাই বরং ভুল। দীপাধারের ছায়ার মতো তাঁরই আড়াল পড়েছিল বুঝি বা, তাই একবারও লক্ষ্য করেন নি—কী পুঞ্জীভূত অনাচার জমছিল তাঁর কুলে, তাঁর গৃহে। যা সংশোধন করার শক্তি তাঁরও নেই।
সেই পরাজয়েরই ক্রোধ তাঁর, দর্পচূর্ণ হওয়ার গ্লানি। আশাভঙ্গের ক্ষোভ।
সেই ক্রোধেই উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন বাসুদেব। উন্মত্ত না হলে এমনভাবে কেউ নিজের বংশ ধ্বংস করে না, এমনভাবে সর্বনাশের সুরা পান ক’রে মরণোৎসবে মাতে না।
তিনি এক সন্তানের হাতে অস্ত্র যুগিয়েছেন আর এক সন্তানের হত্যার জন্য। তাঁর চোখের সামনে তাঁর পুত্রকল কলহে ও বিগ্রহে মেতে উঠেছে—স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে দেখেছেন তিনি, বাধা দেবার কি তাদের সংযত করার কোন চেষ্টা করেন নি। ক্রমশ পিতা পুত্রকে, পুত্র পিতাকে নিধন করেছে, কে কাকে হত্যা করছে তা দেখার কি জানারও সাধ্য থাকে নি। সেই চরম সময়ে—যখন মৃত্যুর নেশায় লোহিতবর্ণ ধারণ করেছে অন্ধক, বৃষ্ণি ও ভোজবংশীয় যাদবের দৃষ্টি —তখন নিজেও সংহারমূর্তি ধারণ করেছেন।
কঠিন লৌহমুষলে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছেন তাঁরই প্রিয় স্বজনদের মস্তক। আত্মনিধনাবশিষ্ট একটি পুরুষকেও বাঁচতে দেন নি যাদব বংশের—তিনি এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ অগ্রজ ছাড়া! আর বাদ দিয়েছেন অতিবৃদ্ধ উগ্রসেন ও বৃদ্ধ বসুদেবকে— নিজের পিতাকে—যেন এই দুঃসহ শোক বহন করার জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁকে।
ক্লান্ত অবসন্ন বাসুদেব যেন ছটফট ক’রে উঠে বসলেন।
সে বীভৎস দৃশ্য এখনও তাঁর চোখের সামনে ভাসছে। নিজের বংশের সেই সর্বাত্মক বিনষ্টির দৃশ্য।
কিন্তু শুধু কি আত্মীয়নাশেই এত অবসাদ তাঁর—এত হতাশা?
যাদবকুলের মহাশ্মশানে দাঁড়িয়ে শুধু কি মানুষগুলোর মৃত্যুই তিনি প্রত্যক্ষ ক’রে এলেন এই মাত্র?
না, আরও কিছু দেখেছেন তিনি। আরও অনেক কিছু।
দেখেছেন তাঁর কল্পনা, তাঁর জীবনসাধনারও মহা বিলুপ্তি।
দেখেছেন পুণ্যভূমি ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ, তার পরিণাম। দেখেছেন একটা দেশ, একটা জাতির শোচনীয় মৃত্যু।
মহাসতী জননী গান্ধারীর অভিশাপ তাঁর বংশে সফল হয়েছে, কিন্তু সেইখানেই তার অবসান ঘটে নি। যুগ থেকে যুগান্তরে, শতাব্দী থেকে শতাব্দীতে এই অভিশাপ এদেশের আকাশ-বাতাস-মৃত্তিকায় লেগে থাকবে, অনাগত বহুশত বৎসর ধরেই অভিসম্পাত বহন করতে হবে—এই দেশকে, এই জাতিকে। কুরুবংশনাশের জন্য যারা দায়ী তারা কেউ বেঁচে থাকবে না সত্য কথা—কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর অভিসম্পাত থাকবে। পিতৃপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে উত্তরপুরুষদের—বংশানুক্রমে। তাঁর—তাঁদের পাপের ঋণ শত-শতাব্দীতেও শেষ হবে না।
আত্মকলহ ও জ্ঞাতিবিরোধ—এ-ই ভারতভূমির অদৃষ্টলিপি। আত্মকলহ ও আত্মসর্বনাশ। আত্মনাশা বুদ্ধি। ক্ষুদ্র স্বার্থ, ক্ষুদ্র কলহ থেকে গৃহযুদ্ধ, দেশের সর্বনাশ। এই অভিসম্পাত সেই ভাবীকালের মানুষদের দৃষ্টি রাখবে আচ্ছন্ন ক’রে, শুভবুদ্ধিতে এনে দেবে জাড্য—তারা কেউ খণ্ডকালের, অতিনিকট-বর্তমানের বাইরে কিছু দেখতে পাবে না। বিনাশ করবে ও বিনষ্ট হবে। এ-ই তাদের ভাগ্যলিপি।
মূলত বুদ্ধিভ্রংশই হয়েছিল তাঁর।
পরিকল্পনার ঔজ্জ্বল্যে দৃষ্টিপথ আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল বলে তার ত্রুটি-বিচ্যুতি, দুর্বল অংশগুলি লক্ষিত হয় নি। তিনি চেয়েছিলেন—এই কলুষিত ক্ষাত্রশক্তি বিনষ্ট হয়ে ধর্মবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ দেশবাসী ক্ষমতা লাভ করুক, তারাই দেশের নায়ক ও শাসক হোক।
কিন্তু আজ উপলদ্ধি করছেন—বিশাল ত্রুটি ছিল এ চিন্তায়। মহাভ্রম। এভাবে শাসনব্যবস্থা উপর থেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না, ক্ষাত্রশক্তি অপসারণের ব্যবস্থা সেই ক্ষাত্রশক্তি শস্ত্রশক্তি দিয়েই করা সম্ভব নয়। সে আয়োজন সাধারণ দেশবাসীকে দিয়েই করাতে হয়, সে নূতন শাসনতন্ত্রের সৃষ্টি ও লালন-পালন সেই জনসাধারণকেই করতে হবে।– অপর কোন ব্যক্তির বুদ্ধি ও সাহায্য ব্যতিরেকেই। ঐ গলিত রাজশক্তির সাধ্য নেই এ কার্য সম্পন্ন করা।
কে জানে অন্য কোন এমনি মহাশক্তিমান যথার্থ বুদ্ধিমান মহাপুরুষের আবার আবির্ভাব হবে কি না এই ভারতখণ্ডে, যে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের স্বপ্ন, তাঁর আরব্ধ কার্য সফল করতে পারবে। তিনি ব্যর্থ হলেন, সে হবে না।
আবারও সেই বৃক্ষকাণ্ডে দেহ এলিয়ে দিয়ে বসলেন যাদবকুলের—বুঝি ভারতেরও শ্রেষ্ঠ পুরুষ বাসুদেব। অবসাদ। অবসাদ আর হতাশা। অবসাদে হিম হয়ে আছে তাঁর সমস্ত দেহ। বহুজনপূজিত বহুজনবাঞ্ছিত তাঁর চরণযুগল থেকে সেই হিম অবসন্নতা এগিয়ে আসছে—শিরা উপশিরা ধমনী বেয়ে, তাঁর কৌস্তুভলাঞ্ছিত ভৃগুপদচিহ্নশোভিত বক্ষের দিকে। এই লক্ষণ তিনি চেনেন। মৃত্যু, মৃত্যুই আসছে তাঁর দেহের রক্তধারাকে গাঢ় শীতল ক’রে দিয়ে। অসাড় অবশ হয়ে আসছে স্নায়ু, পেশী। আর একটু পরে এই চৈতন্য ও চিন্তাশক্তিও লোপ পাবে। সমস্ত একাকার করা এক অবশতায়।
কে জানে তার আর কতটুকু বিলম্ব। তাঁর নিধনকারী আগমন পর্যন্ত সবুর সইবে কি না।
হ্যাঁ, নিধনকারীই।
আসবে তা তিনি জানেন।
জরা। সকল শক্তি সকল বুদ্ধি অবসান হবে তার আগমনে। দেহের মধ্যে, ধমনীর রক্তকণিকায় তার আসার পূর্বাভাস পেয়েছেন। শুধু এখন শেষটুকু বাকি। শেষ উপলক্ষটুকু। তাঁকেও নিহত হতে হবে বৈকি। সুস্থ স্বাভাবিক সহজ মৃত্যু, কিংবা দেহত্যাগ বা ইচ্ছামৃত্যু তাঁর জন্য নয়। সে ভাগ্য তিনি ক’রে আসেন নি। অথবা বলা যায়, এইটেই তাঁর ইচ্ছা-মৃত্যু, এই মৃত্যুই তিনি চেয়েছেন, এইটেই নির্দিষ্ট ক’রে রেখেছেন।
না চাইলেও পেতে হত তাঁকে অবশ্য। বহু লোকের অপঘাত মৃত্যুর কারণ হয়েছেন, বহু লোককে বধ করেছে – করিয়েছেন। এই মাত্র তো কত স্বজন হত্যা ক’রে এলেন, তাঁর যদি সহজ স্বাভাবিক মৃত্যু হয়—সেটা ঈশ্বরের অবিচার বলে গণ্য হবে যে, তাঁর রাজ্যে অনিয়ম। ত্রিভুবনের লোক ধিক্কার দেবে সৃষ্টিকর্তা বিধাতাকে। যেমন পাপ তেমনি প্রায়শ্চিত্ত হওয়া চাই বৈকি, তিনি জেনেশুনেই তো এইখানে বসে অস্বাভাবিক অপঘাত মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন—প্রার্থনা করছেন তার আগেই না এই দেহযন্ত্রটা থেমে যায়, এই সামান্য প্রায়শ্চিত্তটুকু অন্তত করবার সুযোগ পান।
পাপ? পাপ বৈকি!
দেহে শুধু নয়—শুধু এই উচ্চাশা বহনের পাপ নয়, যে উচ্চাশার অনলে এতগুলি বীর প্রাণ দিল, এতগুলি নারী ও শিশু অনাথা হ’ল, এত গৃহের সর্বনাশ হ’ল—পাপ তাঁর মনেও কি ছিল না? এই অকারণ উচ্চাশা ও অহঙ্কার ছাড়া?
যাকে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি লোক পূজনীয় মনে করে—তারও মনে কিছু পাপ থাকে তাঁরও ছিল। তবে সেও দেহেরই ধর্ম।
দেহ আর মন অঙ্গাঙ্গী জড়িত, অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা। চোখে দেখে বলেই লালসা জাগে, রসনা সুখাদ্যের স্মৃতি বহন করে বলেই স্বাদু আহার্যের সন্নিধানে মানুষ লুব্ধ হয়ে ওঠে
দেহ ধারণ করলেই ইন্দ্রিয়ের অধীন হতে হবে, মনও সে নিয়মের বাইরে নয়। সাধুরা নির্জন পর্বতে বা অন্ধকার গুহায় বসে তপস্যা করেন,—নিজেরই ইন্দ্রিয় তথা মনের কাছ থেকে আত্মগোপন করতে।
এ তথ্য নিজের জীবনেই উপলব্ধি করেছেন। মনের অগোচরে পাপ নেই, এতকাল প্রশ্নটা বা সত্যটা প্রাণপণে এড়িয়েই এসেছেন। আজ সেটা মনে মনে অন্তত স্বীকার ক’রে যাবেন, এর এই প্রায়শ্চিত্ত।
কর্ণবধ তাঁর এই রকমেরই একটি পাপ।
কর্ণকে নিজের হাতে বধ করেন নি—কিন্তু তিনিই ওঁর মৃত্যুর প্রধান কারণ, তিনিই সেটা সংঘটন করিয়েছেন। ইচ্ছে করলে বাঁচাতে পারতেন। পাণ্ডবদের কাছে কর্ণের সত্য পরিচয় দিলে পাণ্ডবরা কখনওই তাঁকে বধ করতেন না। ওঁরা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলে সম্মান দিয়ে পদপ্রান্তে নত হ’লে কর্ণও সব বিদ্বেষ ভুলে যেতেন। মিলিত হতেন ভাইদের সঙ্গে। সে উদারতা তাঁর ছিল। আসলে অতি কোমল মন কর্ণের—সেটা বাসুদেবের অজানা ছিল না। ।
কিন্তু বাসুদেব সে চেষ্টাই করেন নি। আর কেউ না জানুক, তিনি বরাবরই জানতেন কর্ণই তাঁর পিতৃসা পৃথার প্রথম সন্তান। জ্যেষ্ঠ পার্থ।
তিনি কর্ণর সর্বাপেক্ষা অনিষ্ট করেছেন এই পরিচয় কর্ণকে জানিয়ে। আত্মরক্ষার পথ বন্ধ ক’রে দিয়েছেন। যুদ্ধে আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই শত্রু-বধ করতে হয়—কিন্তু কর্ণর মতো ব্যক্তি ভ্রাতৃবধ করবেন না—এ সত্য শ্রীকৃষ্ণ জানতেন বৈকি।
এতেও নিশ্চিন্ত হতে পারেন নি তিনি। বহুদিন ধরে চক্রান্তই করেছেন কর্ণবধের জন্যে। ঘটোৎকচকে জেনেশুনে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন অর্জুনের-জন্য-চিহ্নিত ক’রে রাখা একাঘ্নী অস্ত্র নষ্ট করতে। নিরস্ত্র শত্রুকে অর্জুন কখনওই বধ করতেন না, তাই বিদ্রূপছলে কর্ণের বিবিধ কুকীর্তি স্মরণ করিয়ে উত্তেজিত ক’রে তুলেছেন।… শল্যকে কর্ণের সারথ্য গ্রহণে অনুরোধ করার মূলেও তিনি শল্য নানা ভাবে মনোবল হরণ না করলে কর্ণ অত বিভ্রান্ত হতেন না, অভ্যস্ত অস্ত্রের কথাও বিস্মৃত হতেন না। অভিশাপ ছিল সত্য কথা—গুরু ও ব্রাহ্মণের—কিন্তু সে কথা মনে করিয়ে না দিলে অত শীঘ্র হয়ত তা ফলত না।
কেন এই কাজ করেছেন বাসুদেব? কর্ণ নিহত না হলে কৌরবরা অজেয় থাকবে চিরকাল—এই আশঙ্কায়? শুধুই কি ওঁর কল্পিত ধর্মরাজ্য স্থাপনের ব্যগ্রতায়?
অথবা কর্ণের দুষ্কৃতির জন্যেই তাঁকে শাস্তিদান করতে চেয়েছিলেন? নানা দুষ্কৃতি কর্ণের, বিশেষ কপট দ্যূতসভায় তাঁর আচরণ অমার্জনীয়। তবু, সেই কি একমাত্র বা প্রধান কারণ? কর্ণের স্বভাবে দোষ ছিল অনেক—তবে তার চেয়ে ঢের বেশী কি গুণও ছিল না? বরং কর্ণ বেঁচে থেকে পাণ্ডবদের মিত্র ও সহায় হলে বহু উপকার হত মানুষের। আর, আর হয়ত ঠিক এতটা জনক্ষয়েরও প্রয়োজন হত না।
না, ওসব কোন কারণই নয়। আসল কারণ ছিল ওঁর মনে।
অসূয়া? বিদ্বেষ? হীনম্মন্যতা?
কে জানে কি! অত কিছু ভেবেও দেখেন নি তিনি।
বোধ হয় মূল কারণ স্ত্রীলোক। দেহী পুরুষমাত্রেরই অশান্তির মূল কারণ এরা।
পাণ্ডবমহিষীই সেই স্ত্রীলোক। হোমাগ্নিসম্ভবা দ্রৌপদী। বিশ্বে অতুলনীয়া নারী।
কৃষ্ণ আর কৃষ্ণা। শুধু নামেই নয়, শুধু গাত্রবর্ণেই নয়—আরও অনেক মিল দু’জনের। সিংহের উপযুক্ত সিংহিনী। অবশ্য যদি নিজেকে সিংহ মনে করেন বাসুদেব—আজ আর সে-অহঙ্কার ওঁর নেই—তবুও মনে হয়, ওঁরই সহধর্মিণী হওয়া উচিত ছিল কৃষ্ণার। সখী, বান্ধবী ঠিকই—যথেষ্ট অন্তরঙ্গতা ছিল ওঁর সঙ্গে, কিন্তু তাতে মন ভরে নি।
মন ভরে নি বাসুদেবের অগণিত স্ত্রীতেও। তারা কেউ বা শুধুই ধর্মপত্নী, কেউ বা প্রেয়সী। তারা সকলেই নমসহচরী, কর্মসহচরী কেউ নয়। এমন কি সহধর্মিণীও নয়। মহিষী হবার উপযুক্ত তো নয়ই। কে জানে কৃষ্ণা যদি পাণ্ডবমহিষী না হয়ে যদুকুল-অধিরাজ্ঞী হতেন, তাহলে হয়ত ওঁর আশা এমন দুরাশার মতো স্বপ্নেই বিলীন হত না। এমন শোচনীয় পরিণাম হত না সে মহৎ পরিকল্পনার।
আর একটিও মানুষ পান নি বাসুদেব ওঁর দীর্ঘ জীবনে—যার কাছে সব গোপন কথা, একান্ত অভিলাষ ব্যক্ত করা যায়, যার সঙ্গে বসে একটা দেশ একটা জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করা যায়।
দ্রুপদনন্দিনীই সেই মানুষ—যার সঙ্গে সেসব প্রসঙ্গ আলোচনা করা চলত, যে সেসব কথা বুঝত, যে বিপুল এই দেশটাকে অক্ষক্রীড়ার ছক বলে ভাবতে পারত। যাজ্ঞসেনীর মর্যাদা পাণ্ডবরা বোঝেন নি, তার শক্তি কাজে লাগাতে পারেন নি। এমন কি স্বয়ং অর্জুনও নয়।
সে মহতী সম্ভাবনা সামান্য জীবনযাত্রায় ব্যয় হয়ে গিয়েছে, মহা ব্রহ্মাস্ত্র ক্ষুদ্র কীটনাশে প্রবৃত্ত হয়েছে।
কিন্তু সেই অসামান্য নারীরও একটা দুর্বলতা বোধ হয় ছিল,–সামান্য-নারীসুলভ দুর্বলতা। আর কেউই জানত না, আজও কেউ জানে না। কেবল তিনি জানেন—বাসুদেব। দ্রৌপদীর মনের সব সুড়ঙ্গ পথেই আনাগোনা আছে তাঁর। ওঁর সকল নিরুক্ত বাসনা-কামনার ইতিহাসই তিনি জানেন।
কর্ণই সেই দুর্বলতা। অঙ্গাধিপতি পাণ্ডব-সহোদর কর্ণ—ধার্মিক, বলবান, বীর্যবান, কান্তিমান, বুদ্ধিমান। এবং মানুষ। তবে কি পাণ্ডবদের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর? না, তা নয়। তাঁরা স্বামী হিসাবে অবশ্যই আদর্শ। কিন্তু সব দিকে আদর্শ স্বামীতে বুঝি কোন মেয়েরই মন ভরে না, দ্রৌপদীও বুঝি চান নি এমন মহাপুরুষ, এমন আদর্শ পুরুষ। তিনি চেয়েছিলেন রক্তমাংসের মানুষ,—আবেগে উদ্বেল, উদারতায় বিশাল, বীর্যে অনন্যসাধারণ, শৌর্যে দেবকল্প, একটা পরিপূর্ণ পুরুষ যার কীর্তিকথা জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তী হয়ে ওঠে, যাকে ঘিরে মানুষের জল্পনা-কল্পনা কৌতূহলের শেষ থাকে না, যে সামান্য অবস্থা থেকে অসংখ্য জনশ্রুতির নায়ক, রূপকথার রাজা হয়ে ওঠে। যার দানশক্তি ত্রিভুবনে অতুলন, সহ্যে যে অদ্বিতীয়, যে বহু আত্মত্যাগে তপস্যার মতো ক্লেশ সহ্য ক’রে স্বয়ং পরশুরাম প্রভৃতি শস্ত্রগুরুদের কাছ থেকে আয়ুধ সংগ্রহ করেছে, যে জেনেশুনে শত্রুর হাতে আত্মরক্ষার বর্ম তুলে দিয়েছে অথচ যে কামনায় অস্থির, অসূয়ায় দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য, যে তার গোপন স্বপ্নের মানসীকে প্রকাশ্য অপমানে লাঞ্ছনায় ক্ষতবিক্ষত করতে পারে, এমন সাধারণে অসাধারণে মেশা, বাস্তবে আদর্শে জড়ানো একটি মানুষ, যাকে শুধু শ্রদ্ধা বা ভয় নয়—ভালোবাসাও যায়। যাকে প্রভাতের প্রণামের সঙ্গে রাত্রিশেষের একটি চুম্বন উপহার দেওয়া যায়, যাকে অনুরোধ নয়–নিঃসঙ্কোচে আদেশ করা যায়।
লালসা? কামনা? রিরংসা? না না, সেসব কিছুই নয়, শুধুই একটা দুর্বলতা, একটা হয়ত বা বেদনাবোধও। সেই স্বয়ম্বর সভায় যে আঘাত দিয়েছিল, সেই আঘাতের ব্যথাটুকু মুছে নেবার একটা অভীপ্সা, কোন এক অবসরে একটু ক্ষমা প্রার্থনা ক’রে নেবার ইচ্ছা একটু বুঝি সান্তনা দেবারও। জানিয়ে দেবার যে আজ আর তাঁকে অনুপযুক্ত মনে করে না কৃষ্ণা বরং মনে করে যে, সেদিন তাকে পেলেও সে সুখী হত।
আরও একটু জানাতে চায় সে। জানাতে চায় যে, তাঁর মনের গোপন ক্ষতটির কথাও সে জানে, কেন সে কৌরব দ্যূতসভায় অমন ক্ষিপ্ত, অমন হিংস্র, অমন বর্বর হয়ে উঠেছিলেন অঙ্গাধিপতি—তা আর কেউ না জানুক, যাকে সবচেয়ে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতে হয়েছে, সে জানে, জানে যে, সে কেবল কঠিন আঘাতে পাণ্ডবদের পৌরুষ উদ্বুদ্ধ করারই চেষ্টা। কৃষ্ণার অপমান বুকে বেজেছিল বলেই অমানুষের মতো আচরণ করেছিলেন সেদিন কর্ণ।
কেবল এটুকুই, আর কিছু না, ক্ষমা প্রার্থনা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
তথাপি, সেই সামান্য দুর্বলতাটুকুও সহ্য করতে পারেন নি বাসুদেব। কেমন যেন মনে হয়েছে যে, ওঁর নিজস্ব প্রাপ্যটুকু থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন উনি। আদর্শ পুরুষ হিসেবে ওঁর যেটা পাওয়া উচিত—সেটা অন্যত্র, অপাত্রে চলে যাচ্ছে।
সেই ক্ষোভটাই কি ক্রমশ বিদ্বেষে পরিণত হয়েছে? ক্ষোভ বলে আর লাভ নেই। ঈর্ষাই বোধ করেছেন স্বয়ং বাসুদেব । সেই ঈর্ষাই কালের হস্ত ত্বরান্বিত করেছে, কর্ণকে তাঁর অমোঘ নিয়তির দিকে দ্রুত ঠেলে দিয়েছে।
এই একান্ত কাপুরুষোচিত মনোভাবই আজ বাসুদেবকে পীড়া দিচ্ছে সব চেয়ে বেশী। কর্ণ বেঁচে থাকলে উনি তার হাত দুটি ধরে অশ্রুজলে এই কলুষ ধুয়ে দিতেন, ক্ষমাপ্রার্থনায় প্রায়শ্চিত্ত করতেন।
ক্ষমা প্রার্থনা করতেন কৃষ্ণার কাছেও।
কৃষ্ণা অবশ্য আজও, এখনও বেঁচে আছেন। বাসুদেবেরই সে শক্তি সে পরমায়ু আর নেই। আজ এই জীবনের অন্তিম বেলায় সেই অপরাধ স্বীকারের জন্যেই প্রাণটা আকুলিবিকুলি করছে তাঁর, প্রায়শ্চিত্তের জন্যেই অস্থির হয়ে উঠেছেন।
অবশ্য বেশী দেরিও নেই আর। দেনা-পাওনা যার যা বাকি আছে তা নিয়েই হয়ত যাত্রা করতে হবে, এখানের পাট চুকিয়ে। জরা গ্রাস করছে সকলকেই, কেউ আর সুস্থ স্বাভাবিক নেই।
যাদবকুলের কুলনারীদের রক্ষা করার জন্যে ধনঞ্জয়কে আসতে বলেছেন বটে, তবে তিনি এও জানেন যে, তারা রক্ষা পাবে না। গাণ্ডীবীর শক্তিতে কুলোবে না আর। তাঁর বিধবা অনাথা পুরনারীরা বর্বর লম্পটের অঙ্কশায়িনী হবে, এ- ই তাদের ললাটলিপি। এও বাসুদেবেরই কৃতকর্মের ফল হয়ত—তবু এ অবশ্যম্ভাবী, এ দুঃখ তাদের ভোগ করতেই হবে। ইন্দ্রপ্রস্থ যাওয়ার পথে পঞ্চনদের দ্যসুরা যখন আক্রমণ করবে তখন আর গাণ্ডীবে জ্যা রোপণের সামর্থ্য থাকবে না অর্জুনের, কোন শক্তিশালী অস্ত্র প্রয়োগকৌশলও মনে পড়বে না আর। এ তো দিব্যচক্ষেই দেখতে পাচ্ছেন তিনি— অচির ভবিষ্যতের এই দৃশ্য।
কাল ফুরিয়ে এসেছে ওঁদেরও। লোকক্ষয়কারী কাল জরাকে পাঠিয়েছেন দূতরূপে, সে আহ্বান এখনও শুনতে পান নি ওঁরা—তাই এ দুর্গতি। পাণ্ডবদের এবার যাত্রা করতে হবে প্রাণীমাত্রেরই অবশ্যপরিণতির পথে—মহাপ্রয়াণের পথে।
তাহলে এ প্রহসনের প্রয়োজন কি ছিল? অর্জুনকে ডেকে পাঠাবার?
ছিল বৈকি! ম্লান ক্লিন্ন হাসি হাসলেন বাসুদেব, আপন মনেই। অর্জুনেরও কিছু পাপ ছিল বৈকি-—অহমিকার পাপ— তাঁর প্রাপ্য ছিল এই অপমানটুকু।
কিন্তু সে কথা আজ থাক। আজ আর কারুরই দোষ ধরবেন না তিনি। তাঁর মতো লোকোত্তর চরিত্র মানুষের অন্তরেই যদি গ্লানি, কলুষ, দৈন্য থাকে—অপর কার ছিদ্র অন্বেষণ করতে যাবেন তিনি?
‘আঃ—!’
এই বুঝি মৃত্যু এল এবার, এল পরিসমাপ্তি, সকল সুখ-দুঃখের মহা অবসান, এতকাল পরে।
চোখ মেলে চাইলেন বাসুদেব একবার, ‘ও কে? কে তুমি? অমন হাহাকার করছ কেন? আমাকে আঘাত করেছ এই অনুশোচনায়? কিছুই করো নি তুমি বন্ধু, কোন অন্যায় করো নি, আজ এই দুর্দিনে, শেষদিনের বন্ধুর কাজই করেছ। এর জন্যে আমি প্রতীক্ষাই করছিলুম যে,–মুক্তি দিয়েছ আমাকে। সকল মহাপুরুষদেরই—যাদের দেহধারণ করলেও লোকোত্তর হবার সাধ যায় না, অহঙ্কার যায় না ঐশীশক্তির—তাদের নির্বুদ্ধিতা স্মরণ করাবার জন্য যুগে যুগে তোমার মতো বন্ধুর প্রয়োজন হবে। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ঐ শর উদ্ধার ক’রে নিয়ে যাও, না না, কোন সঙ্কোচ করো না—ভবিষ্যতে তোমার কাজে লাগবে, নষ্ট করে লাভ কি? পুরস্কার দেবার মতো আর কিছুই নেই আমার—তাই আশীর্বাদই করছি। কল্যাণ হোক।’—
আর একবার চারিদিকে চাইলেন বাসুদেব। জন্মেছিলেন অন্ধ-কারাগারে—কিন্তু তারপর, জ্ঞান হতে যে শ্যামা সুন্দরী ধরিত্রীকে দেখেছিলেন, পুষ্পিতা, নদী-পর্বত-অরণ্যানীশোভিতা,—মৃত্যুকালে দেখে গেলেন তাকে কামনা-কলুষ, উচ্চাভিলাষ-পাপবিধ্বস্ত এক মহাশ্মশান। সেখানে সত্য নেই, সেখানে ক্ষমা নেই, সেখানে উদারতা, প্রসন্নতা, তৃপ্তি— কিছুই নেই আর। আছে শুধু দুর্বার লোভ আর লালসা আর রিরংসা রিপুর প্রাধান্য আর হিংসা। আছে সর্বনাশা আত্মঘাতী বুদ্ধি। যুগযুগান্তরের জন্যেই বুঝি এই উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছেন বাসুদেব।
ক্ষমা করো হে ঈশ্বর, হে ঈশ্বরের ঈশ্বর, ক্ষমা করো তুমি বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে, ক্ষমা করো!
‘পাঞ্চজন্য’ সমাপ্ত