২.১.৩ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (শাসনকাল : ১৪৯৩ সাল থেকে ১৫১৯ সাল)

আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (শাসনকাল : ১৪৯৩ সাল থেকে ১৫১৯ সাল)

আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ছিলেন মধ্যযুগের স্বাধীন বাংলার সুলতান। তিনি হোসেন শাহি রাজবংশের পত্তন। করেন। চতুর্থ হাবসি সুলতান শামসউদ্দিন মুজাফফর মাহ হোসেন নামে এক অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তিকে তাঁর সরকারের অধীনে চাকরিতে নিযুক্ত করেন। ক্রমশ তাঁর পদোন্নতি হতে থাকে এবং অবশেষে মুজাফফর শাহের প্রধানমন্ত্রীর আপন প্রভুকে নিহত করে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। তিনি বাংলার ইতিহাসে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ শরিফ মক্কি’ নামে পরিচিত। পরে তিনি খলিফাতুল্লাহ’ উপাধিও ধারণ করেন। হোসেন শাহের রাজত্বকালে হিন্দু প্রজাদের প্রতি উদার দৃষ্টভঙ্গির জন্য পরিচিত।

কীভাবে হোসেন ক্ষমতা লাভ করেন এবং ক্ষমতা লাভের পর তাঁর কার্যকলাপ কী ছিল সেটা সামান্য খতিয়ে দেখা যেতে পারে। হাবসি শাসক মুজাফফর শাহ হোসেনকে প্রথমত সামান্য চাকরিতে নিযুক্ত করেন। অতঃপর প্রখর বুদ্ধিবলে হোসেন তাঁর প্রভুকে প্রীত ও সন্তুষ্ট করে অবশেষে প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ লাভ করেন। সুচতুর হোসেন বুঝতে পেরেছিলেন হাবসি শাসকরা বাংলার লোকের কাছে ছিলেন অনভিপ্রেত। অতএব আপন প্রভুকে সেনাবাহিনী, অমাত্যবর্গ ও জনসাধারণের কাছে অধিকতর অপ্রিয় করে তুলে হোসেন স্বয়ং ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তিনি তাঁর প্রভু মুজাফফর শাহকে নানাভাবে কুপরামর্শ দিতে থাকেন।

ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যয় বলেন, “সৈয়দ হোসেন শরিফ মক্কি মুজাফফর শাহের উজির ও প্রধান কর্মচারী নিযুক্ত হইয়াছিলেন। তাঁহার পরামর্শ অনুসারে মুজাফফর শাহ সৈনিকদিগের বেতন হ্রাস করিয়া অর্থ সঞ্চয়ে মনঃসংযোগ করিয়াছিলেন।” রিয়াজুস সালাতিন ও তারিখে ফেরেশতায় বলা হয়েছে যে, হোসেন উজির হওয়ার পর জনসাধারণের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদেরকে একথাও বলতে থাকেন যে, মুজাফফর শাহ অত্যন্ত নীচ প্রকৃতির লোক এবং বাদশাহ হওয়ার সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। হোসেন শাহের পরামর্শে মুজাফফর শাহ অবাঞ্ছিত কাজ করতেন। ফলে হোসেন তাঁকে জনসাধারণের কাছে দোষী ও হেয় প্রতিপন্ন করার সুযোগ পেতেন। এভাবে তিনি সেনাবাহিনী, আমির-ওমরাহ ও জনগণকে মুজাফফর শাহের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তোলেন। অবশেষে তাঁর নেতৃত্বে এক বিরাট বাহিনী মুজাফফর শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ঐতিহাসিকরা বলেন, যুদ্ধে উভয়পক্ষের ১,২০,০০০ সৈন্য নিহত হয়। তৎকালীন সময়ে এত বড়ো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পৃথিবীর অন্য কোথাও হয়েছে বলে জানা যায় না। যুদ্ধে মুজাফফর শাহ নিহত হন। কেউ বলেন, হোসেন প্রাসাদরক্ষীকে হাত করার পর প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে স্বহস্তে আপন প্রভুকে হত্যা করেন।

মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর মুসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেন, “সকল শ্রেণির মুসলমান সামন্ত এবং হিন্দুরাজগণ তাঁহাকেই (সৈয়দ হোসেন) রাজ সিংহাসনের উপযুক্ত পাত্র বিবেচনা করিয়া রাজপদে অভিষিক্ত করেন। তিনিও তাঁহাদের মনোরঞ্জনার্থ নির্দিষ্ট সময়মতো গৌড় রাজধানী লুণ্ঠনের আদেশ দেন। ওই সময়ে গৌড়নগরে অনেক ধনশালী হিন্দু প্রজা সর্বস্বান্ত হইয়াছিলেন”। মজার ব্যাপার এই যে, হোসেনেরই আদেশে যাঁরা লুণ্ঠন করেছিল, তাঁদেরকে আবার হোসেনের আদেশেই হত্যা করা হয়। এদের সংখ্যা ছিল বারো হাজারেরও বেশি। হোসেন তাঁর আপন হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে লক্ষ লক্ষ লোকের রক্তে নিজের হাত রঞ্জিত করেন। হয়তো লুণ্ঠনের আদেশ কিছু সংখ্যক মুসলমান হত্যার বাহানা মাত্র। এত গণহত্যার পর, যার মধ্যে ছিল সেনাবাহিনীর লোক, আমির-ওমরাহ, অমাত্যবর্গ, জ্ঞানীগুণী প্রভৃতি৷ হোসেনের বিরুদ্ধে টু শব্দ করার আর কেউ থাকল না। ফলে তিনি হয়ে পড়েন বঙ্গদেশের সর্বময় কর্তা।

আলাউদ্দিন হুসেনের সময়েই মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের উত্থান হয়। ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার তাঁর “The History of Bengal’ গ্রন্থে প্রকৃতপক্ষে চৈতন্যের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য কী ছিল, তা তাঁর নিজের কথায় আমরা সুস্পষ্টরূপে জানতে পারি। কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ (আদি লীলা) গ্রন্থে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন— “পাষণ্ডি সংহারিতে মোর এই অবতার।/পাষণ্ডি সংহারি ভক্তি করিমু প্রচার।”

এ থেকে বোঝা যায় পাষণ্ডি সংহার করাই তাঁর জীবনের আসল লক্ষ্য। ইতিহাস আলোচনা করলে জানা যায়, মুসলমানরা বাংলা অধিকার করার সময় বৌদ্ধ মতবাদ দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল। নিম্নশ্রেণির হিন্দুদের যে বিপুলসংখ্যক লোক এদেশে বাস করত, ব্রাহ্মণরা তাদেরকে সনাতন ধর্মের আশ্রয়ে আনতে অস্বীকার করেন। তার ফলে তাঁরা বৈষ্ণব সমাজে প্রবেশ করতে থাকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে এদেশে (বাংলা) তখন হিন্দু, বৈষ্ণবসমাজ ও মুসলমান ব্যতীত সে সময়ে আর কোনো ধর্মাবলম্বীর অস্তিত্ব প্রায় ছিলই না। তাহলে ‘পাষণ্ডি’ ছিল কারা, যাঁদের সংহারের জন্যে চৈতন্যের আবির্ভাব হয়েছিল? মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর ‘মুসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেন—”মনুর মতে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী অহিন্দু মাত্রই এই পর্যায়ভুক্ত (সরল বাংলা অভিধান)। আভিধানিক সুবলচন্দ্র মিত্র তাঁহার Beng-Eng Dictionary-তে পাষণ্ডি শব্দের অর্থে বলিতেছেন— “Not conforming himself to the tenets Vedas: Atheistic. Jaina or Buddha. A non-Hindu– বেদ অমান্যকারী, অন্য বর্ণের চিহ্নধারী এবং অহিন্দু— পাষণ্ডির এই তিনটি বিশ্লেষণ সর্বত্র প্রদত্ত হইয়াছে।” অতএব ‘পাষণ্ড’ বলতে যে একমাত্র মুসলমানদেরকেই বোঝায়, তাতে আর সন্দেহের অবকাশ রইল না।

এখন প্রশ্ন হল এই যে, সত্য সত্যই কী চৈতন্য পাষণ্ড তথা মুসলমানদেরকে এদেশ থেকে উচ্ছেদ করতে পেরেছিলেন? নাকি সেই চেষ্টা বিন্দুমাত্র করেছিলেন? নাকি করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি? খালি চোখেই দেখা যায়, চৈতন্যের সমসাময়িক সুলতান হোসেন শাহের পরেও এদেশে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু হোসেন শাহ কর্তৃক চৈতন্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ ও বৈষ্ণবসমাজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সাহায্য সহযোগিতার দ্বারা মুসলমানদের আকিদাহ বিশ্বাসের মধ্যে শির্ক বিদয়াতের যে আবর্জনা জমে উঠেছিল তাই-ই পরবর্তী যুগে মুসলিম সমাজের অধঃপতনের কারণ হয়। মুসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থ প্রণেতা বলেন— “প্রকৃত কথা এই যে, বৌদ্ধ সমাজ ও বৌদ্ধ ধর্মকে তাহাদের মাতৃভূমি হইতে সমূলে উৎখাত করার পর তাঁহাদের নেকনজর পড়িয়াছিল মুসলমান সমাজের উপর। তাই যুগপৎভাবে তাঁহারা চেষ্টা করিতে লাগিলেন ‘যবন’ রাজাদিগকে রাজনৈতিক কৌটিল্যের মাধ্যমে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত করিয়া ফেলিতে। পক্ষান্তরে ধর্মের নামে একটা মোহজাল বিস্তার করিয়া মুসলমান সমাজকে আত্মবিস্মৃত ও সম্মোহিত করিয়া রাখিতে। পূর্বে বলিয়াছি, ইহাই তঙ্কালের অবতার ও তাঁহার ভক্ত ও সহকারীদের চরম ও পরম উদ্দেশ্য।”

স্মর্তব্য, সত্যনারায়ণের পুজো-পদ্ধতির উল্লেখ হিন্দু পুরাণে আছে। হিন্দুদের প্রায় প্রতি ঘরেই এই পুজো হয়ে থাকে। কিন্তু মুসলমানকে দিয়ে এ সত্যনারায়ণের পুজো কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তাই হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ মিটানোর উদ্দেশ্য সুলতান হোসেন সত্যপিরের প্রতিষ্ঠা ও তাঁর পুজো-পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। প্রকৃতপক্ষে সত্যপিরের দরগাহ প্রতিষ্ঠা, সত্যপিরের নামে মানত ও শিরনি বা সিন্নি বিতরণ, ঢাক-ঢোলের বাদ্য বাজনাসহ সত্যপিরের দরগায় অনুষ্ঠানাদি পালন প্রকৃতপক্ষে সত্যনারায়ণ পুজোরই মুসলিম সংস্করণ, যার প্রবর্তক ছিলেন হোসেন শাহ। এসব কারণেই হোসেন শাহকে ‘অবতার’ বলে মান্য করে হিন্দুসসমাজ— “নৃপতি হুসেন শাহ হয়ে মহামতি।/পঞ্চম গৌড়েতে যার পরম সুখ্যাতি।/অস্ত্রশস্ত্রে সুপণ্ডিত মহিমা অপার।/কহিকালে হবু যেন কৃষ্ণ অবতার।”

অনেকে মনে করেন— হোসেন শাহ আদৌ মুসলমান ছিলেন না। একজন সাইয়েদ বংশীয় মুসলমান হিসাবে পরিচয় দিয়ে মুসলমানদের ভক্তি-শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে প্রতারণার মাধ্যমে ক্রমশ উচ্চতম ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। অথবা বাংলারই অজ্ঞাতকুলশীল হিন্দু অথবা মুসলমান কোনো নিরাশ্রয় বালককে মুর্শিদাবাদের চাঁদপাড়া গ্রামের জনৈক ব্রাহ্মণ আশ্রয় দান করে রাখালের কাজে নিযুক্ত করেন। উক্ত ব্রাহ্মণ এই বালকের মধ্যে এক বিরাট প্রতিভা দেখতে পান এবং ‘পাষণ্ড সংহার নিমিত্ত তাঁকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মুজাফফর শাহের দরবারে পরিচয় দেওয়া হয়। মুজাফফর শাহের অনুগ্রহে তাঁর ভাগ্য দ্রুত পরিবর্তন শুরু হয়। তাঁর গোটা জীবন, তাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের পরস্পরবিরোধী বিবরণ, তাঁর পরবর্তীকালের ধর্মবিশ্বাস, কার্যকলাপ ও আচার-আচরণ, অসংখ্য প্রতিভাবান মুসলিমদের হত্যা করে হিন্দু ও বৈষ্ণব সমাজের লোকদের দ্বারা তাঁর মন্ত্রীসভা ও রাজদরবারের শোভাবর্ধন প্রভৃতি লক্ষ করার পর তাঁর জাতিধর্ম সম্পর্কে উপরোক্ত ধারণা পোষণ করলে ভুল হয় না হয়তো। হোসেনের প্রশাসনের দুজন উচ্চ পর্যায়ের হিন্দু কর্মকর্তা ব্যক্তিগত সচিব (দবিরে খাস) রূপ গোস্বামী ও তাঁর ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী (সগির মালিক) সনাতন গোস্বামী মহাপ্রভু চৈতন্যের অনুসারী হন।

মোটকথা, হোসেন শাহ মুসলমানই হন, আর যাই-ই হন, অসংখ্য অগণিত মুসলমান সৈন্য, আমির ওমরাহ ও সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের হত্যার পর শক্তিশালী হিন্দু সামন্তপ্রভুদের তুষ্টিসাধন করেছেন। তাঁর আমলে বাংলা ভাষার মাধ্যমে হিন্দু জাতির রেনেসাঁ আন্দোলন জোরদার হয়েছিল। বাংলা গ্রন্থ-প্রণেতা মালাধর বসু, বিপ্রদাস, বিজয়গুপ্ত এবং যশোরাজ খান তাঁদের সাহিত্যে হোসেন শাহের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাসহ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন। যেমন— মালাধর বসু ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্ধ বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়লীলা বিষয়ক শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ নামক একখানি বাংলা মহাকাব্য রচনা করেন। হোসেন প্রীত হয়ে তাঁকে ‘গুণরাজ খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি বলেন—”নিগুণ অধম মুঞি নাহি কোন ধান,/গৌড়েশ্বর দিল নাম গুণরাজ খান।” বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ থেকে জানা যায় হোসেন শাহ গৌড়ে গিয়ে চৈতন্যদেব সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছিলেন– “শ্রীচৈতন্যর নগর-সংকীর্তনের সময় যদি কেউ তাঁকে বিরক্ত করে সে কাজি হোক বা কোতোয়াল হোক, তাঁর মৃত্যুদণ্ড হবে।”

বাংলার ইতিহাস আলোচনা করলে জানা যায় যে, সর্বপ্রথম হোসেন শাহি আমলেই মুসলমানদের আচার-আচরণ ও ধর্মবিশ্বাসে পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। শ্রীচৈতন্য ও বৈষ্ণবসমাজের বিরাট প্রভাব যে মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসকে প্রভাবিত করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হোসেন শাহ কর্তৃক লক্ষ লক্ষ সম্ভ্রান্ত মুসলমান আমির-ওমরাহ, ধার্মিক ও পির-অলি নিহত হওয়ার এবং হোসেন শাহের স্বয়ং শ্রীচৈতন্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার কারণে মুসলিম সমাজে পৌত্তলিক ভাবধারার অনুপ্রবেশ সহজতর হয়েছিল। এম আর তরফদার তাঁর ‘Husain Shahi Bengal’ গ্রন্থে বলেন— “Some of the influential Muslims used to worship the snake goddess. Mannasa. Out of fear for snake bite. It is probabely the result of the Hindu influence on the Muslims. Nasrat Shah constructed a building in order to Prophet. But the preservation of the Prophet’s footprint does not find support in Orthodox Islam.”

ডাঃ জেসম ওয়াইজ বলেন, গয়ার ব্রাহ্মণরা তীর্থযাত্রীদেরকে বিষ্ণুপদ দেখিয়ে প্রচুর রোজগার করে। তাঁদের অনুকরণে মুসলমান সমাজে কদম রসুলের পুজোর প্রচলন শুরু হয় হোসেন শাহর বাংলায়। হুসেন শাহের রাজত্বেই বিকশিত হয়েছিল বৈষ্ণব কাব্য ও মঙ্গলকাব্যের মতো মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের দুটি প্রধান ধারা। বাংলার অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূত্রপাত ঘটেছিল সুলতান হুসেন শাহের আমলেই। হোসেন শাহের তাঁর পুত্র নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ বাংলার সুলতান (শাসনকাল ১৫১৯ থেকে ১৫৩৩ সাল) হন। নুসরাত শাহের পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ বাংলার সুলতান (শাসনকাল ১৫৩৩ সাল) হন। ফিরোজ শাহের অকালমৃত্যুর তাঁর পিতৃব্য গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ বাংলার সুলতান হন। তিনি ছিলেন দুর্বল, বিলাসিতাপ্রবণ ও সহজ-সরল শাসক। কূটনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব ছিল। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতেও তিনি ব্যর্থ ছিলেন। ইনিই বাংলার শেষতম সুলতান। ফিরোজ শাহের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হোসেন শাহি রাজবংশও নিশ্চিহ্ন হয়। এরপর শের শাহ, সুর ও কররানি বংশ ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত থাকে। অতঃপর দিল্লির মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে নিযুক্ত গভর্নররা বাংলার শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। তবে ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ আকবরের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গির কর্তৃক হিন্দু রাজপুত মানসিংহ দ্বিতীয়বারের জন্যে বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শান্তির সঙ্গে বাংলায় শাসনকার্য পরিচালনা সম্ভব হয়নি। কারণ খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলার মোগল আধিপত্য বার বার প্রতিহত ও বিপন্ন হয়। মানসিংহের পর জাহাঙ্গির কুতুবউদ্দিন খান কোকাকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। ১৬০৭ সালে জাহাঙ্গির কুলি খান এবং ১৬৩৯ সাল পর্যন্ত আরও নয়জন বাংলার সুবাদার গভর্নর হিসাবে শাসন পরিচালনা করেন। ১৬৩৯ সালে যুবরাজ সুজা বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হওয়ার পর সর্বপ্রথম ইংরেজগণ ব্যবসায়ীর বেশে বাংলায় আগমন করে এবং ১৭৫৭ সালে সিরাজের পতনের মধ্য দিয়ে তাঁরা চিরতরে মুসলিম শাসনের মূলোৎপাটন করে বাংলা বিহারের হর্তাকর্তা বিধাতা হয়ে পড়ে।

যুবরাজ মোহাম্মদ সুজার পর ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যাঁরা বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তাঁরা হলেন— যুবরাজ মোহাম্মদ সুজা (১৬৩৯-১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ), মোয়াজ্জাম খান মিরজুমলা (১৬৬০-৬৩ খ্রিস্টাব্দ), দিলির খান-দাউদ খান (১৬৬৩-১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দ), শায়েস্তা খান (মমতাজ মহলের ভ্রাতা) (১৬৬৪-১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দ), ফিদা খান আজন খান কোকা (১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দ), যুবরাজ মোহাম্মদ আজম (১৬৭৮-১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দ), শায়েস্তা খান। (১৬৭৯-১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দ), খানে জাহান (১৬৮৮-১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দ), ইব্রাহিম খান (১৬৮৯-১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দ), যুবরাজ আজিমউদ্দিন (১৬৯৮-১৭১৭ খ্রিস্টাব্দ), মুর্শিদকুলি খান (১৭১৭-১৭২৭ খ্রিস্টাব্দ), সুজাউদ্দিন মোহাম্মদ খান (১৭২৭-১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দ), সরফরাজ খান (১৭৩৯-১৭৪০ খ্রিস্টাব্দ), আলিবর্দি খান (১৭৪০-১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ), সিরাজদ্দৌলা (১৭৫৬-১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ)।

সিরাজউদ্দৌল্লার পতনের পর মির জাফর (পুরো নাম মির মোহম্মদ জাফর আলি খান বাহাদুর) ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত বাংলার নবাব হন। ৭৪ বছর বয়সে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত নবাব ছিলেন। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ মনোনীত মির কাশিম বাংলার নবাব হন। তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হন। এরপর মির জাফরের দ্বিতীয় পুত্র নাজিমউদ্দিন আলি খান মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাংলার নবাব হন। শাসনকাল ১৭৬৫ থেকে ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এরপর নাজিমউদ্দিন আলির ছোটো ভাই নাজাবুত আলি খান বাহাদুর মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাংলার নবাব হন। তাঁর শাসনকাল ছিল ১৭৬৬ থেকে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। নাজাবুত আলির পর বাংলার নবাব হন মির জাফরের চতুর্থ পুত্র সৈয়দ আশরাফ আলি খান বাহাদুর। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ রাজ্যাভিষেক হয় এবং একই বছরের ২৪ মার্চ গুটিবসন্তে মৃত্যু হয়। মির জাফরের শাসনামলেই ভারতে কোম্পানির শাসন (তখনও পর্যন্ত ব্রিটেন সরকার যুক্ত হয়নি) প্রতিষ্ঠার শুরু এবং উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকেই দ্বৈত সরকার (নবাব ও কোম্পানি) প্রবর্তন করা হয়, যে আইনে নবাবরা ব্রিটিশদের অধীনে শাসন করত এবং তাঁরা ব্রিটিশদের হাতের পুতুল ছিল। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে আইনটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে শাসন ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে নবাবদের কাছ থেকে গভর্নরের অধিকারও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, তখন তাঁদের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে শুধু সামান্য অবসরকালীন ভাতা দেওয়া হত। বাংলার শেষ পরাধীন নবাব মনসুর আলি খান ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের জন্য ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করেন। যেহেতু ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলার ‘নবাব’ উপাধিটি বিলুপ্ত হয়েছিল, সেইহেতু মনসুর আলির পদত্যাগের পর মুর্শিদাবাদের নবাবরা ‘বাহাদুর’ হিসাবে পরিচিত হয়। নবাব শাসনের অবসানের পরপরই ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়ে যেত।

আমি এরপর ব্রিটিশ শাসন নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিতে পারতাম। কিন্তু আর-একজন মুসলিম শাসকের কথা না-বললেই নয়। তিনি টিপু সুলতান। আমরা ছোটোবেলায় ইতিহাসে পড়েছি ইঙ্গ-মহিশূরের যুদ্ধ। অর্থাৎ টিপু সুলতানের সঙ্গে ব্রিটিশদেরকে বেশ ভালোরকম যুঝতে হয়েছিল। প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল ব্রিটিশসেনাদের। ব্রিটিশরা সেদিন টিপু সুলতানের কাছে এত মার খেয়েছিল যে ব্রিটিশরা কোনোদিন সেই যন্ত্রণার কথা ভুলতে পারেনি। সেই একই যন্ত্রণা অনুভব করে আরএসএসের সদস্যরা। ব্রিটিশদের মার খাওয়াটা ওরা কোনোদিন মেনে নিতে পারেনি। একটু দেখে নিতেই হয় কেমন ছিল সেই ঘাত-প্রতিঘাত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *