দ্বিতীয় চরণ
সাগিয়া কাণ্ড
ঢোঁড়াইয়ের জমি ও জাতের রাজ্যে আগমন
কোথায় যাচ্ছে, কোথায় যাবে, ঢোঁড়াই সে কথা ভেবে আসেনি। দুনিয়ার সব জায়গাই এখন সমান তার কাছে তবে সে চলেছিল পাক্কী ধরে, বোধ হয় নিজের অজ্ঞাতেই। বিকারের ঘোরটা কিছুক্ষণ পরে কেটে এলেও মনের জ্বর যাবার নয়। তাৎমাটুলি থেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা, চোখ-আঁধার করা আধির প্রচণ্ডতা কমে এসেছে, কিন্তু আকাশের আঁধার হয়তো কোনো দিনও কাটবে না; দুনিয়ার কাউকে সে আর বিশ্বাস করবে না, সব বেইমান। জ্বরে জিভে সব বিস্বাদ লাগে।…সেই একবার বকরহাট্টার মাঠের সব চেয়ে উঁচু শিমুল গাছটার উপর আঁধির সময় বাজ পড়েছিল। গাছের মাথাটা যেন এক কোপে একেবারে পুঁচিয়ে কেটে নিয়ে গিয়েছিল। কন্ধকাটা গাছটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে।…দমকা রাগের আঁধির মধ্যে নিজের অপমানের কথাটা এতক্ষণ ভাল করে ভাববার সময়ই পায়নি। তার রামিয়া হয়ে গেল অন্য লোকের! নিজে ইচ্ছা করে! ভিতরঘুন্না [৪১০] হারামজাদী কোথাকার! ঢোল, গবার, শূদ্র, পশু, নারী [৪১১] এদের সবসময় মারের উপর রাখতে বলেছে রামায়ণে। প্রথম থেকে যদি এ কথা সে মনে রাখত! কি ভুলই করেছে সে রামায়ণের কথা না মেনে। তার বলদজোড়ার চাইতেও সে অনেক বেশি ভালবাসত রামিয়াকে। বলদজোড়া কেন বৌকাবাওয়ার চাইতেও। রামিয়ার জন্য সে বৌকাবাওয়াকেও ছেড়েছিল। ভাত খাওয়ার সময় আর একটু ডাল নিতে ইচ্ছে করলেও সে কোনদিন চায়নি, পাছে রামিয়ার কমে যায় সেই ভেবে। রামিয়া জোর করে দিতে এলেও নেয়নি। এত ভালবাসত সে রামিয়াকে। তার গাড়ির চাকার জন্য রেড়ির তেল সে একবার না কিনে সেই পয়সা দিয়ে রামিয়ার জন্য নারকেল তেল এনে দিয়েছিল। সব কি এইজন্য? আপন থেকে পর ভাল, পর থেকে জঙ্গল ভাল। কুকুর আপনার হয়, কিন্তু মেয়েমানুষ আপনার হয় না, যতই তাকে কাপড় কাঁচবার জন্য সাবান কিনে দাও না কেন। দুনিয়াটা আগাগোড়াই যে ভিতরঘুন্না। ভাল কিছু নেই। তাই ভাল লোকেরা সব চলে যায় অযোধ্যাজীতে। সে হাড়ে হাড়ে চিনেছে মেয়েমানুষ জাতটাকে। দুখিয়ার মা, রামিয়া, যে-কোনো মেয়ের সম্পর্কে সে এসেছে, সব ঐ একরকম। মুখে এক আর মনে এক। তাৎমাদের মধ্যে বাওয়াই এক শাদি করেনি।
সেইজন্যই সে বেঁচে গিয়েছে, অযোধ্যাজতে যেতে পেরেছে। অযোধ্যাজীতে এখন বাওয়ার কাছে যেতে পারলে একটু মনে শান্তি পেত। বাওয়া আবার তাকে ছোটবেলার মতো কাছে টেনে নিত। সর্বন [৪১২]-এর পাতার গন্ধের চাইতেও তার ভাল লাগে বাওয়ার জটার গন্ধটা, ঘুটোর ছাইয়ের চাইতেও ভাল গন্ধ, হাওয়াগাড়ির গন্ধটার চাইতেও ভাল। কতদূর এখান থেকে অযোধ্যাজী; সেই মুঙ্গের জেলার কাছে। একটাও পয়সা নেই সঙ্গে, না হলে টিকিট কাটত সে অযোধ্যাজীর। তাৎমাটুলিতে তার বাড়ি গাড়ি বলদ জিনিসপত্র রয়েছে। কত টাকা পেতে পারে তা বেচে। কিন্তু এ মুখ আর যে তাৎমাটুলিতে দেখাতে পারে না। খাক সাতভূতে তার সম্পত্তি লুটেপুটে। পঞ্চরা যাকে ইচ্ছা দিয়ে দিক। বলদ বেচা পয়সা দিয়ে কেলে আসুক সামুয়রটা জুয়ো নেপালে। তার গাড়ি বিক্রির পয়সা দিয়ে মাখুক রামিয়া জবজবে করে নারকেল তেল, ঐ কটা মর্কটটার বুকে ঢেলে পড়বার আগে। ঢোঁড়াই তার থেকে এক পয়সাও চায় না। কী কুক্ষণেই যে বাওয়া উকিলবাবুর কাছ থেকে টাকা পেয়েছিল। ঐ টাকাটাই হল ঢোঁড়াইয়ের কাল। ওটা ছিল বাওয়ার হকের টাকা। তাই না সে ঐ টাকা দিয়ে অযোধ্যাজীতে যেতে পারল। কিন্তু ঢোঁড়াইয়ের ঐ টাকার উপর কোন হক ছিল না। সেইজন্যই না ঐ টাকা দিয়ে কেনা একটা আওরৎ তার জীবনটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিতে পারল। এই রকমই হয় দুনিয়ার। সব জিনিসের ফলাফল সকলের উপর কখনও কি একই রকম হয়ে? খাক তো দেখি তাৎমারা মুসলমানদের মতো মুরগীর আণ্ডা? কুষ্ঠ বেরিয়ে যাবে গায়ে।…আর সে ঐ পয়সার উপর লোভ করবে। লাথি মারে সে অমন পয়সায়। বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলটা জ্বালা করছে। হয়তো কেটে গিয়ে থাকবে পাথরে ঠোকর লেগে। এতক্ষণ খেয়াল করেনি।…
না না, কাছে পয়সা থাকলেও সে যেত না অযোধ্যাজীতে। বাওয়ার কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে। বাওয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও সম্মতি দিয়েছিল এ বিয়েতে, তার জিদ দেখে। কেবল বাওয়া কেন, কোনো চেনা লোকের সঙ্গে সে আর জীবনে দেখা করবে না। কী করে সে মুখ দেখাবে। একটা পিঁপড়ের সমান মেয়েকে সে সামলাতে পারেনি এমনি মরদ সে। একটা বিড়ালচোখা বীটপালং-এর কাছে সে হেরে গিয়েছে। যে এ কথা শুনবে সেই মুখ টিপে টিপে হাসবে তাকে দেখে। সে রুগ্ন নয়, কমজোর নয়। গায়ের জোরে পারবে তার সঙ্গে সামুয়র? মরদের বাচ্চা হলে সে আসত ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে লড়তে। পিষে শেষ করে দিতে পারে সে সামুয়রকে, আঙুলের মধ্যে টিপে মেরে ফেলে দিতে পারে ছারপোকার মতো। আর উঠতি জোয়ানীর মুখে তারই সঙ্গে গেল হেরে! কারও কাছে হার মানবার ছেলে সে নয়। কিন্তু রামজীর সঙ্গে লড়াই করা চলে না। তাই সে হার মেনেছে তাৎমাটুলির সমাজের কাছে, পরাজয় স্বীকার করেছে সামুয়রের কাছে। সেইজন্যই না সে পালিয়ে এসেছে তাৎমাটুলি থেকে। যে সমাজের মাথাদের সে একদিনও নিঃশ্বাস নেওয়ার ফুরসত দেয়নি, সেগুলো সুযোগ পেয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল তার বিরুদ্ধে। ডালের মধ্যে মাছি পড়লে যেমন করে তুলে ফেলে দেয়। আঙুলে করে তেমনি করে তারা দূরে ফেলে দিয়েছে ঢোঁড়াইকে। সিঁদুর আর গাঁটের টাকা দিয়ে কেনা বৌ কি পাক্কীর ধারের গাছের পাকা আম, যে যার ইচ্ছা পেড়ে নেবে? তার দোরগোড়া থেকে গরুর গাড়িখানা দিয়ে দিতে পারত পঞ্চরা সামুয়রকে? হয়ে যেত তাহলে একটা রক্তারক্তি কাণ্ড তাৎমাটুলিতে। কিন্তু এখানে যে ছিল গোড়ায় গলদ; আমটাই যে ছিল পচা পোকাড়ে।
…খালি বুড়ো আঙুলটা নয়, পায়ের তলটা জ্বলতে আরম্ভ করেছে। দাবিয়ে রাখতে না পারলে রাস্তায় পাথরগুলো পর্যন্ত দাঁত দেখায়, তার আবার মেয়েমানুষ!…
তাকত দিয়েছেন রামজী তার শরীরে। একটা চনমনে আওরৎকে সামলাতে পারেনি সে শরীরের তাকত সত্ত্বেও। কিন্তু একটা পেট সে যেখানেই থাকুক হেসে খেলে চালিয়ে নেবে। একেবারে একা সে দুনিয়ায়। তার মন চেয়েছিল বাঁধা পড়তে। কিন্তু তার কপালই আলাদা, ছোটবেলা থেকে সে দেখে আসছে। নইলে তার মা তাকে পর করে দিয়েছিল! নইলে ভারী গা [৪১৩] স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যেতে চায়।…ভারী গা…। সেই যেটা আসবে, তার উপর পর্যন্ত কোনো অধিকার তার থাকল না। তার মন বলছে যে সেটা নিশ্চয়ই হবে ছেলে। সেটা সুষ্ঠু হয়ে যাবে সামুয়রের। জল চড়াবে [৪১৪] ঢোঁড়াইয়ের বাপ-ঠাকুরদাকে নয়, কতকগুলো ধাঙড়কে, হয়তো বা গলকট্টা সাহেবের পিরেতকে। এ জন্ম তো গিয়েইছে, পরের জন্মও তার অন্ধকার। বিনা দোষে তাকে নরকে পচে মরতে হবে, আর জল পেয়ে যাবে আজন্ম কিরিস্তান সামুয়রটা।
নিজের ক্ষমতার বিশ্বাসটুকু কাল রাতে শিকড়সুদ্ধ নাড়া খেয়েছে। তাই আক্রোশে বিষিয়ে উঠেছে তার মন, জাতের উপর, সমাজের উপর, দুনিয়ার উপর। ক্ষমতা থাকলে সে এখনি চুরচুর করে ফেলে দিত এটাকে। রামজী কি জেনে শুনেও লোকের উপর অবিচার করেন! ছি ছি! একি ভাবছে সে, সীত্তারাম! সীত্তারাম!..সারা রাত একবারও বসেনি সে। রোদ্দুরটারও আস্তে আস্তে গরম হয়ে উঠছে। পা আর চলতে চায় না, তাৎমাটুলি থেকে অনেক দূর চলে যেতে চায় সে, যত দূরে পারে। রোদ্দুরে গা দিয়ে ঘাম ঝরছে। জলতেষ্টাও পেয়েছে। নিজের মনকে সে বুঝোয়, বোধহয় অনেক দূর চলে এসেছি তাৎমাটুলি থেকে।
দূরে পাক্কী থেকে কোশখানেক পচ্ছিমে একখান গাঁ দেখা যাচ্ছে। একসার ডালছাটা শিশুগাছ খাড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে আকাশ ছুঁড়ে। বর্শার মতো দেখতে লাগছে। তারই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা চিলেকোটার দেওয়ালের ছাতলাধরা সাদা রঙ। পাকা দালান থাকলেই ইঁদারা থাকবে কাছে। তাই সে ঐ বাড়ি লক্ষ্য করে পাক্কী থেকে নামে; অন্তত খানিকটা জিরিয়েও তো নেওয়া যাবে। ঐ বাড়িটা পর্যন্ত যেতে হয়নি। তার আগেই গাঁয়ে আর একটা কুয়ো দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
কুয়োর পাশে একটা কঞ্চির বেড়া। বেড়াটা পলতার লতায় ঢাকা। পাশের বাড়ির সম্মুখটা ঝকঝকে নিকানো। চালের উপরটা লকলকে লাইভগায় ঢেকে গিয়েছে। একসার গাঁদাফুলের গাছ আলো করে রেখেছে উঠোনখানাকে। উঠোনের মধ্যেখানে দোতলার সমান উঁচু একটা মাচাতে বীজের জন্য রাখা ভুট্টার মালা ঝোলানো। ঢোঁড়াই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। তার বুকের ধুকধুকুনিটা ঠেলে গলা বেয়ে উঠে আসতে চায়। দম বন্ধ হয়ে আসে। সেঁক গিলে ঠোঁট চেপে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয়। তার দুঃখ তার নিজের জিনিস, অন্য কারও কাছে বলবার নয়।
পাশের তামাক-ক্ষেত থেকে একটা ছুচলোমুখো লোক এসে কুয়োতলায় হাত-মুখ ধুচ্ছিল। ঢোঁড়াই গিয়ে দাঁড়াল জল খাবার জন্য।
ঘর কোথায়? পুরুব? পাক্কী থেকে কত দূরে! কী জাত?
তন্ত্রিমাছত্রি।
আরে, তাৎমা বল; তাৎমা বল।
জল খাবার পরে আরও অনেক কথা হয় লোকটির সঙ্গে।
কোথায় যাবি? রোজগারের জন্যে যদি হয়, তাহলে এ গাঁয়েও থেকে যেতে পারিস। আমি কাজ দিতে পারি। এখনই। এই সম্মুখে তামাক-ক্ষেত্রে। গাঁয়ের লোক রাখতে চাই না। কী আর কাজ? তামাক-ক্ষেত্রের কাজ জানিস না? পুরুবের লোক, জানবি কোথা থেকে। মিয়ার দেশের লোক তোরা; তোরা বুঝিস পিয়াজের ক্ষেতি! বুদ্ধি যদি কিছু থাকে তাহলে দুদিনে শিখে যাবি তামাকের ডগা ছিঁড়তে। পিয়াজের চাষেও পয়সা আছে বটে।…ঢোঁড়াই চাষবাসের কাজ কোনোদিন করেনি। যদি না পারে, যদি মন না-লাগে। আরও দূরে গেলে হত! লোকটার হাবভাব রতিয়া ছড়িদারের সঙ্গে কোথায় যেন মিল আছে। ঢোঁড়াইয়ের ধারণা ছুঁচলো মুখের লোকগুলো হয় অতি বদ।
কী রে? গরু মরেছে নাকি রে তোদের বাড়িতে? কথা বলিস না কেন? খুব গরজ ভাবলি বুঝি আমাদের?
ঢোঁড়াই অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করে।
শেষ পর্যন্ত ঢোঁড়াই এখানেই থেকে যায়। যখন ইচ্ছা চলে গেলেই হবে। সেটা তো নিজের হাত। গেদা ফুলে ভরা বাড়িটার গোয়ালঘরের মাচায় ঢোঁড়াই জায়গা পেয়ে যায়। লোকটি যাওয়ার সময় ঢোঁড়াইকে শুনিয়ে যায়, এ গাঁয়ের বাবুসাহেবের দেড়শ গরু আছে। তাঁর রাখাল পায় মাসে চার আনা করে, আর বছরে একজোড়া কাপড়, শীতে একটা কুর্তা।….
ঢোঁড়াইয়ের তখন পাওনা নিয়ে দর কষাকষি করবার মতো মনের অবস্থা নয়। কোনো রকমে একটা মাথা গুঁজবার আস্তানা আর দুটি খাওয়ার সংস্থান হলেই তার দিন চলে যাবে। সেইজন্য সে ঐ লোকটি আরও কী সব বলছিল সেসব কথা ভাল করে শোনেওনি।
———-
[৪১০. ভিতরে ঘুণধরা; যার মনের কুটিলতার কথা বাইর থেকে দেখে বুঝার উপায় নেই। ৪১১. তুলসীদাস থেকে : ঢোল, গঁবার অর্থাৎ দুর্বিনীত লোক, শুদ্র, পশু, নারী। ৪১২. একপ্রকার সুগন্ধ; Lemon Grass. ৪১৩. সন্তানসম্ভবা। ৪১৪. অর্পণ করবে।]
.
বিল্টা আদির সহিত কথোপকথন
গাঁয়ের নাম বিসকাঙ্কা। কাজেই যে ভাঙা বাড়িটার উপর অশ্বত্থ গাছ উঠেছে সেকানে সাঁঝের পর ঢোলকের বোল উঠলে ঢোঁড়াইও সেখানে পৌঁছায়। লোভটা অবিশ্যি খয়নি তামাকের! কালকে থেকে খাওয়া হয়নি। হঠাৎ কিছুক্ষণ থেকে এই অভাবটাই সবচেয়ে বড় বলে মনে হচ্ছিল। তাই ঢোলের আওয়াজের ঢালাও আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারেনি। লোক তখনও বেশি জোটেনি। ঢোঁড়াইয়ের হঠাৎ মনে পড়ে এরা জিজ্ঞাসা করবে এখনই যে তার বাড়ি কোথায়। মহতোগিন্নীর বাপের বাড়ি মলহরিয়াতে। এ ছাড়া আর অন্য কোনো গাঁয়ের নাম মনে আসছে না। তাৎমাটুলির কথা সে চেপে যাবে একেবারে। সকলে আপাঙ্গে তার দিকে তাকায়। কে? কোথায় বাড়ি? এদিকে কুটুম্বিতা নেই তো? তবে এদিকে কি রোজগারের জন্য? ঢোঁড়াইয়ের মনে হয় দু-একজনের মুখে একটু কাঠিন্যের রেখা পড়ে। তারা তার পৈতার দিকে তাকাচ্ছে।
জাত? তন্ত্রিমাছত্রি? তবু ভাল যে রাজপুত ছত্রি-টত্রি নও।
আমরা কুশবাহাছত্রি [৪১৫]।
এই নাও বলে লোকটা হুঁকো থেকে কলটো ঢোঁড়াইয়ের হাতে দেয়। ইঙ্গিত সুস্পষ্ট,-তন্ত্রিমাছত্রি জাতটা কুশবাহাছত্রি জাতের চাইতে অনেক নিচু। রাত থেকে মনটা বিষিয়ে আছে নিজের জাতের উপর। পারলে সে ভুলে যেতে চায় নিজের জাতের কথা। কিন্তু কারও জাত কি গায়ের ময়লা যে, ডলে ফেলে দেবে। তাই জাতের অপমান এখনও তার গায়ে গিয়ে বেঁধে। ইচ্ছে হয় বলে যে, কোয়েরী আবার কুশবাহাছত্রি হল কবে থেকে?
চিরকাল গেল লোকের বাড়ি বাসন মেজে, আর বাবুভাইয়াদের পাতের এঁটো কুড়িয়ে, আজ এসেছেন হুঁকো থেকে ছিলিম নামিয়ে দিতে। না, প্রথম দিন এসেই সে গাঁয়ের লোকের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করতে পারে না।
না, না, তামাক আমি খাই না।
তকলিফের পরোয়া করে না সে।
এতক্ষণে সকলে তার দিকে ফিরে বসে। বলে কী লোকটা! পয়সার অভাবে তামাক কিনতে পারে না এমন লোক তারা বহু দেখেছে; কিন্তু মাঙনার তামাক একজন সুস্থ শরীরের লোক খায় না, এমন জীব এর আগে তাদের চোখে পড়েনি।
খয়নি?
না, খয়নিও না।
এই আত্মনিগ্রহের মধ্যে দিয়ে ঢোঁড়াইয়ের মন অপমানের প্রতিবাদ জানায়। গিরিদাস বাবাজী পর্যন্ত খয়নি তামাক খান, আর এ লোকটা খায় না! বিবি আছে?
না।
এই সরাধ-এর কানুনের [৪১৬] যুগেও। মোচ উঠে গিয়েছে তবুও। এরকম পরদেশীর সঙ্গ গল্প না করে তাচ্ছিল্য দেখানো চলে না। সকলের পাল্লা দিয়ে ঢোঁড়াইকে গাঁয়ের কথা শোনাতে আরম্ভ করে। কত খবর!
…যে লোকটির সঙ্গে দারাতলায় দেখা হয়েছিল, সে কি নাম বলেছিল নিজের? গিরিধারী মণ্ডল? ছুঁচলো মুখ, শিয়ালের মতো? ওকে আমরা বলি গিধর [৪১৭] মণ্ডল। ওর ওখানেই কাজ নিয়েছে বুঝি। তবে যে বললে কুয়োর ধারের তামাক ক্ষেতের কথা? সে তো মোসম্মতের [৪১৮]। গিধরটা মিছে কথা বলছে। আমাদের জাতের মোড়ল হলে কী হবে, ও পরিবারটাই হাড়-বজ্জাতের ঝাড়। এক কুড়ি দুকুড়ি সালের কথা হল- এই বুড়হাদাদাকে দেখছ, এর তখনও কোমরে নেংটি ওঠেনি। তাই না বুড়োদাদা? সেই সময় নীলকর সাহেবদের সঙ্গে একটা ভারি হল্লা হয়, একেবারে তুলকালাম ব্যাপার। বিলসন সাহেবের কাটা মাথা পাওয়া যায় থানার বারান্দায়। সেই সময় সব গায়ে হিন্দু কিষাণরা [৪১৯] মন্দিরে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল, আর মুসলমান কিষাণরা মসজিদে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে তাদের মধ্যে যে নীলকার সাহেবদের দিকে যাবে সে গরু শুয়োর খাবে। তখন গিধর মণ্ডলের ঠাকুর্দা গিয়েছিল নীলকর সাহেবদের দিকে। সেই থেকে গিধর মণ্ডলের পরিবারটার নাম হয় গরুখোর পরিবার।…হ্যাক থু! থু! জয় মহাবীরজী! তখনও গাঁয়ের বাবুসাহেব বচ্চন সিং যায় রাজপারভাঙার সেপাইগিরি করতে বোধ হয়। ঐ গরুখোর পরিবারটাই তখন গাঁয়ের মধ্যে বড়লোক। শিকারে, কি মোকদ্দমার তদন্তে দারোগা হাকিম এলে ঐ গরুখোরদের আঙিনাতেই তার ঘোড়া বাঁধা হত।…
ঐ তামাক ক্ষেতটা তোমাকে দেখিয়ে দেওয়ার সময় গিধরটা বলেছিল নাকি যে ক্ষেতটা তার? ও তাই বলল, তুমি হাবভাবে ভেবে নিয়েছিলে যে, ওটা তারই। গিধর বললেও খুব মিছে বলত না। মোসম্মতের বিধবা মেয়ে আছে সাগিয়া। সেই মেয়ের দেওয়া ঐ গিধর মণ্ডল। বক যে রকম মাছের উপর তাক করে বসে থাকে, তেমনি করে গোরুখখারটা কবছর ধরে লেগে আছে মোসম্মতের মেয়েটাকে চুমৌনা [৪২০] করবে বলে। বেশ জমিজিরেত আছে মোসম্মতের, ত্রিশ চল্লিশ বিঘা হবে বৈকি। আরে ওরই উপর তো নজর গিধর মণ্ডলের। সোজা জমি নয়তো। চল্লিশ বিঘা। এদিকে আবার সাড়ে-ছহাতের লগার বিঘা। আর জমি কী! মাঘের শেষেও কালো হয়ে থাকে। বসলে পাছার কাপড় ভিজে ওঠে।…না না, ও বুড়িকে কেউ সাগিয়ার মা বলে ডাকে না গাঁয়ে। কেন তা জানি না। সবাই বলে মোসম্মত।
তারপর গলার স্বর নামিয়ে বলে- এ গাঁয়ের গুনীর সর্দার ছিল কানো মুহর! সে দেহ রেখেছে অনেকদিন হল। কিন্তু কোনো চেলা রেখে যায়নি। তাই না সাপে কামড়ালে, দাঁতের পোকা ঝাড়তে হলে, কিম্বা পায়ে ঘা হয়ে গরু মোষ মরতে আরম্ভ করলে যেতে হয় আজকাল রহুয়ার গুণীর কাছে।
…হাঁ, যে কথাটা বলছিলাম…ঐ কানোয়া মসহরটা এককালে মোসম্মতের জমি চাষ করত। নামকরা গুণী হওয়ার পরও, পুরনো মনিবের বাড়ি তার আসা যাওয়া ছিল, আর মোসম্মতকে বলত বৌমা। কোনোয়া মুসহর, ডাকিনী বিদ্যা কিছু শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে ঐ বুড়িটাকে…।
যে লোকটিকে সকলে বুড়হাদাদা বলে ডাকছিল, সে এতক্ষণে ঢোঁড়াই য়ের সঙ্গে গল্প আরম্ভ করবার জন্য সোজা হয়ে বসে।
…তুমি আবার গিয়ে এসব গল্প কারো না যেন মোসম্মতের কাছে।…ভাল গা বেছে রোজগারের জন্য! আমাদেরই আজকাল খাওয়া জোটে না। যা দিনকাল পড়েছে। দিন দিনই খারাপ হচ্ছে। বিধিগতি বাম সদা সব কাহু [৪২১]। ভগবান সব সময় সকলের উপর নারাজ!…দেখা যাক ধানটা পাকলে যদি কিছু হালত বদলায়।…
যে ছেলেটি ঢোলক নিয়ে বসেছিল সে ঢোঁড়াইয়ের বয়সী। দুষ্টুমিতে ভরা মুখ। সে বলে এই আরম্ভ হল বুড়াদাদার নাকি কান্না। সন্ধ্যাবেলা একটু হাসি তামাসা ভজন কীর্তন হবে, তাও এই বুড়োর জন্য হওয়ার জো নেই। চুপ কর বলছি বিল্টা। পরদেশী লোকের সম্মুখে অমন লবড় বড় কথা বলবি না বলীছ।
ঢোঁড়াই অবাক হয়, এখানে পঞ্চায়ত আর বুড়োদের তাকত এত কম দেখে।…বিল্টা বুড়হাদাদার কথা বন্ধ করবার জন্য দমাদ্দম ঢোলক বাজাতে আরম্ভ করে, তার পর গানের কলি আরম্ভ করে। বাকি সকলে ধুয়ো ধরে।
জমিদারের সেপাই এসেছে খাজনা নিতে, রে বিদেশিয়া।
সকালবেলা ধরে নিয়ে গিয়েছে ভাসুরকে, রে বিদেশিয়া।
বেঁধে রেখেছে তাকে কুঠি খুঁটিতে, রে বিদেশিয়া,
থালা বাটি নিয়ে যা সেপাই, বাকি খাজনার দাবিতে,
তা নয়, সেপাই আসে, রাতের বেলায় জ্বালাতে
রে বিদেশিয়া…
মহাবীরজীকে প্রণাম করে গান শেষ হয়। ঢোঁড়াইয়ের ইচ্ছা করে বিল্টার সঙ্গে আলাপ জামাতে।
বলে, আমাদের ওদিকে মহাবীরজীর চাইতে রামচন্দ্রজীর নামই বেশি চলে।
তোদের কলিজা বোধ হয় আমাদের চাইতেও ছোট। তাই বোধ হয় মহাবীরজীর মালিক না হলে মানায় না তাদের।
হেসে গড়িয়ে পড়ে সকলে। বিল্টার সঙ্গে কথায় কেউ পারবে না। বিল্টা কিন্তু ঢোঁড়াই কে অপ্রস্তুত হওয়ার অবকাশ দেয় না। জিজ্ঞাসা করে, তুমি গান জানো না?
লজ্জা পাচ্ছ কেন? একার গান বলছি না; একলা কি আবার গান হয় নাকি? সে তো যারা মোষ চরায় তারা ভোররাত্রে শীতের জ্বালায় গায়; রাতদুপুরে পথিক ভয় ভাঙানোর জন্য গায়। সে কি গান নাকি। আমি বলছি এই সবাই মিলে গান গাইবার কথা। গানের সময় তোমাকে চুপ করে দেখলাম কিনা, তাই বলছি।
ঢোঁড়াই স্বীকার করে যে, বিদেশিয়ার গান সেও জানে। তবে সে মহাৎমাজীর নিমক তৈরির বিদেশিয়ার গান।
বিল্টাও সে গান জানে। সকলেই জানে। কিন্তু খবরদার না। মহাৎমাজীর বিদেশিয়া এখানে গাওয়া বারণ। গাইলেই দারোগা সাহেব হাল বলদ ক্রোক করবে। ঐ শালা হাড়ীর বাচ্চা লচুয়া চৌকিদার আছে, সে গিয়ে সব খবর দিয়ে দেয় দারোগা সাহেবের কাছে।
আরও কত কথা হয়। বেশ লাগে তার বিল্টাকে।
রাতে যখন সে বাড়ি ফেরে তখনও সাগিয়া আর সাগিয়ার মা তার জন্য জেগে বসে রয়েছে।
আমরা মা বেটিতে বলাবলি করছিলাম যে, পরদেশী লোকটা না বলেই পালাল নাকি। মেয়ে আবার বলল যে, না; চেহারা দেখে না বলে পালানোর মতো বলে তো মনে হয় না। নিশ্চয়ই ভজনের ওখানে গিয়েছে!
গোয়ালঘরের মাচার উপর পাতবার জন্য সাগিয়া একখানা কম্বল দিয়ে যায়। লোটা থাকল মাথার নীচে।
অনেকক্ষণ চোখ বুজে, ভেবেও ডাইনীর কোনো লক্ষণ ঢোঁড়াই মোসম্মতের মধ্যে খুঁজে পায় না। রাতে শুয়ে পাশ থেকে নারকেল তেলের গন্ধ পাওয়া অভ্যাস হয়ে গিয়েছে তার, গত এক বছরের মধ্যে। তামাকেরই মতো, না পেলে মন খুঁত খুঁত করে। মনে না পড়েছে যতক্ষণ, ততক্ষণ বেশ। এখন ঘুম এলে হয়।
——-
[৪১৫. এই জাতের নাম কোয়েরি! আজ কাল এই জাতের লোকেরা নিজেদের কুশবাহাছত্রি বলে। ৪১৬. সর্দা আই। (শব্দার্থ) শ্রাদ্ধের আইন। ৪১৭. গিধর শব্দের অর্থ শিয়াল। ৪১৮. বিধবা। ৪১৯. জিরানিয়া জেলায় কিষাণ শব্দের অর্থ ধনী কৃষক। ৪২০. নিকা, সাঙ্গা প্রভৃতির ন্যায় একপ্রকার বিবাহ ব্যবস্থা। ৪২১. ভগবান সব সময় সকলের উপর বিরূপ।-তুলসীদাস।]
.
মোসম্মতের খেদ
গাঁয়ের প্রাণ গাঁয়ের দলাদলি। দিন কয়েকের মধ্যে গাঁয়ের ঝগড়াঝাটির নাড়ীনক্ষত্র ঢোঁড়াই জেনে গেল। বড় গ্রাম, অনেক দল, অনেক রকম স্বার্থ। বড়র নিচে মেজ, মেজর নিচে সেজ। এখানকার ব্যাপারটা তাই, তাৎমাটুলি থেকে অনেক বেশি জটিল। সকলেরই নজর মাটির উপর, জমির উপর। মাটির রস মরলে তাকায় উপরের দিকে, তারপর চোখ বুজে তাকায় আটপৌরে মহাবীরজীর দিকে।
তাৎমাটুলিতে জমির গল্প কেউ করত না। জমিদারের গল্প করত কালেভদ্রে। কিন্তু এখানকার হাওয়াই অন্যরকম। এখানকার হাসিকান্না গল্পরঙ্গ তামাশা সবই চাষাবাস আর জমিদারকে নিয়ে। অর্ধেক কথার সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ ঢোঁড়াই ধরতেই পারে না।
এ পাড়াটার নাম, কোয়েরীটোলা; এখানে সব জাতে কোয়েরী। এদের অধিকাংশই রাজপুতদের আধিয়ার। রাজপুতরা থাকে, এই কাছেই রাজপুতটোলায়। জমিজিরেতের মালিক তারাই। কোয়েরীদের মধ্যে কেবল দুচার ঘর লোকের নিজের জমি আছে।
আইনত এ অঞ্চলের জমিদার রাজপারভাঙা। সরসৌনিতে, যেখানে সেকালে উইলসন সাহেবের নীলকুঠি ছিল, সেইখানেই জমিদারের সার্কেল কাছারি। লোকে বলে সার্কিল। গায়ে কাউকে তেল মাখতে দেখলে, বুড়োরা শ্লেষ করে জিজ্ঞাসা করে, কি রে আজ সার্কিলে যেতে হবে নাকি? প্রত্যেক জায়গার নিজস্ব কথাবার্তা রীতরেওয়াজ না জানলে সেখানকার লোকেরা কাউকে আমলই দিতে চায় না।
আইনের চোখে যাই হোক, আসলে কিন্তু গাঁয়ের জমিদার বচ্চন সিং-গাঁয়ের বাবুসাহেব। জোত আর রায়তি জমি মিলিয়ে এঁর জমি হবে প্রায় তিন হাজার বিঘা। কিন্তু ইনি নিজেকে বলেন কিসান। আজকাল নিজেকে কিসান বললে লাভ আছে। বাবুসাহেবের জমি এখনও বাড়ছে। ও যে. বাড়তেই হবে। জমি যে মানুষের পরিবারের মতো। ছেলেপিলে হয়ে ক্রমাগত বেড়ে চলে, না হয় মরে হেজে ছোট হয়ে আসে। একই রকম কখনও থাকে না। এইতো বাবুসাহেবকেই দেখ না। একখানা বাঁশের লাঠি নিয়ে বালিয়া জেলা থেকে এদিকে এসেছিলেন, পুরুব-এ পয়সা সস্তা বলে। সার্কিলে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মজকুরী সেপাই-এর পদে বহাল হন। মজকুরী সেপাইরা এক পয়সাও মাইনে পায় না। পায় কেবল পিতলের তকমাআঁটা একটা চাপরাস, একটা পাগড়ি; আর সার্কেলের খরচে তার লাঠির উপর পিতল দিয়ে, নিচেটা লোহা দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়। কড়া হুকুম আছে লাঠি যেন কিছুতেই এস্টেট থেকে দেওয়া না হয়। বিয়ে করা স্ত্রী আর লাঠি একই রকম জিনিস। যে লোকটা পরের লাঠি দিয়ে কাজ চালাতে চায়, খবদ্দার বিশ্বাস করো না তাকে। আরা, ছাপরা আর বালিয়া জেলার রাজপুত ছাড়া, আর সকলের দরখাস্ত খাস্তা খাতায় ফেলে দিও।
সেই মজকুরী সেপাই কেমন করে আস্তে আস্তে এখানকার বাবুসাহেব হয়ে গেলেন, সেটা এদিককার প্রতি গ্রামের গতানুগতিক ইতিহাস। তার মধ্যে নূতনত্ব কিছুই নেই। যে ভাঙা বাড়িটার উপর অশত্থ গাছ উঠেছে, ঐ যে যার সম্মুখের মাঠে সাঁজের ভজন হয়, সেটা ছিল ভাইদের [৪২২] মঠ। মঠের জমি-জিরেত বেশ ছিল। এর আগের মোহন্ত একটি মুসলমানের মেয়েকে রেখেছিলেন মঠে এনে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে চলে যেতে হয় গ্রাম ছেড়ে। আজকাল ভাইদের ছেলেরাও আর নিজেদের ভক্তাই বলে পরিচয় দিতে চায় না। তাই আজ মঠের এই অবস্থা। যার লাঠি তার মোষ। স্বাভাবিক নিয়মের এই সব জমি চলে যাচ্ছে বাবুসাহেবের পেটে।
এমনি করেই জমি বাড়ে। জলে জল আনে। কোথা থেকে কেমন করে যে জমি বাবুসাহেবের হাতে চলে যায়, তা আগে থেকে লোকে টেরও পায় না। গাঁয়ের ডাইনীবুড়ি পর্যন্ত তাঁর হাত থেকে নিজের জমিটুকু বাঁচাতে পারবে বলে ভরসা পায় না। হাজার হলেও মেয়েমানুষ। মেয়েমানুষ পারে পেটে ছেলে ধরতে। সে কৃপাটুকুও করেনি রামজী! এমনি আমার বরাত! দেওয়ার মধ্যে দিয়েছিলে তো কেবল ঐ সাগিয়াকে। কাছে রাখব বলে গাঁয়ের ঘরে বিয়ে দিয়েছিলাম। বিয়ের পরে পাঁচ বছরও সিঁদুর থাকল না কপালে মেয়েটার। নিজের ভাতার পুত অনেক কাল আগেই খেয়ে বসেছিলাম। তারপর খেলাম জামাইটাকে, তারপর সাগিয়ার একচিমটি ছেলেটাকে পর্যন্ত। সাত মুলুকে আমার সম্পর্কের কোনো মরদ জেঁকে না রে ঢোঁড়াই। এখানে আসবার তিন-চারদিনের মধ্যেই মোসম্মত ডুকরে কেঁদে এই সব কথা ঢোঁড়াইয়ের কাছে বলেছিল। আরও কী কী যেন সব বলেছিল। কখনও বলে জামাইটা ছিল চিররুগ্ন। মেয়েকে কাছে পাব বলেই জেনেশুনেও তার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলাম। আর ভেবেছিলাম, জামাই আমার জমিটমিগুলোর দেখাশুনা করতে পারবে। আমার মনের পাপ রামচন্দ্রজী সবই দেখেছিলেন, তাই বোধ হয় আমাকে এমন করে শাস্তি দিলেন। কখনও বলে, সরসৌনির বৈদজীই আমার নাতিটাকে মারল: ঐ যদি তখন জিরানিয়ায় নিয়ে যাই ডাক্তারের কাছে, তাহলে কি আমার কপাল এমনি করে পোড়ে! জিরানিয়ার ডাক্তারের ওষুধের ধক বড় বেশি। অতটুকু ছেলে তা কি সহ্য করতে পারত। তুই-ই বল না। সেবার একটা কোমরের ব্যথার ওষুধ আনিয়েছিলাম জিরানিয়া থেকে। বেনাঘাসের কাঠাটার মধ্যে করে রোদ্দুরে দিয়েছিলাম শিশিটাকে। ছিটকে ছিপি বেরিয়ে গিয়ে লেগেছিল বারান্দার খুঁটিতে। এখনও সে গন্ধ লেগে আছে কাঠাটাতে।
মোসম্মত ঢোঁড়াইকে নিয়ে গিয়ে কাঠাটা শোকায়। কোনো গন্ধ না পেলেও ঢোঁড়াই বলে, বাপরে! বড়ডো ধক! এ কি বাচ্চারা সহ্য করতে পারে! সাগিয়া পাটের দড়ি পাকাচ্ছিল দূরে বসে। হঠাৎ তার উপর নজর পড়ে ঢোঁড়াই য়ের। তার মুখের কোণের হাসি দেখে ঢোঁড়াইয়ের মনে হয় যে সে তার মিথ্যে কথাটা ধরে ফেলেছে। তবে তার জন্য বিরক্ত হয়নি। তার চোখ বলছে, আহা বুড়ি মানুষ ওর কি কথার ঠিক আছে। যা বলেছে বলুক। তুই হাতে হঁ মেরে যাঃ [৪২৩]।… বাচ্চাটার কথা না বললেই হত। সাগিয়া শুনছে জানলে সে কিছুতেই বলত না।…জিরানিয়ার দাবাখানার[৪২৪] ওষুধের শিশিটার সঙ্গেও তার কোথায় যেন আত্মীয়তার সম্বন্ধ আছে। স্টেশন থেকে গরুরগাড়ি করে সে ডাক্তারবাবুর মাল এনে দিয়েছিল একবার।… বেনার কাঠাটাও আর একটা বেনার কাঠার কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। তার মধ্যে ছিল একখানা কাঠের চিরুনি, একখানা ছোট টিনেমোড়া আয়না, রঙ-বেরঙের ফোঁটা দেওয়া।…সাগিয়া ঢোঁড়াইয়ের চাইতে পাঁচ-সাত বছরের বড় নিশ্চয়ই হবে।…
আবার বিল্টার কাছ থেকে ঢোঁড়াই শোনে ঐ হাড়কঞ্জুস গিধর মণ্ডলটার বৌ ছেলেপিলে সব আছে তবু চুমৌনা করতে চায় সাগিয়াকে, জমির লোভে। মোসম্মতেরও আপত্তি নেই তাতে। গিধরটাই ভাই মারা যাবার পর থেকে মোসম্মতের জমির দেখাশোনা করে কি না; কিন্তু সাগিয়া হাড়ে চটা দেওরের উপর। ও হারামজাদাটা আবার পাশের টোলার কানী মুসহরনীর [৪২৫]? ওখানে যায় রোজ। সাঁঝের পর একদিনও গিধরটাকে টোলার মধ্যে খুঁজে বার করিস তো তবে বুঝব।
গাঁয়ের চৌকিদার লচুয়া হাড়ী, ঢোঁড়াইয়ের খোঁজ-খবর নিতে এসে গল্প করে যায়, কোয়েরীটোলার মেয়েদের কথা। কার কার নাম যেন করে; ঐ শুনতেই বাবুদের বাড়ির ঝি। আর দিনকতক থাক না সবই জানতে পারবি। এই জন্যই তো এদের আধিয়াদার রাখে রাজপুতরা। না হলে, ঐ সাঁওতালটুলিতে গিয়ে দেখে আসিস; তাদের চাষ, আর এদের চাষ।
এই পরিবেশের মধ্যে ঢোঁড়াই এসে পড়েছে।
——-
[৪২২. ভক্তাইরা কবীরপন্থীদের একটা শাখা। সাধারণ লোকের ধারণা এই দুই সম্প্রদায়ের ভিতরে পার্থক্য কেবল তিলকের আকারপ্রকার নিয়ে। ৪২৩. সায় দেওয়া। ৪২৪. ডিসপেনসারি। ৪২৫. একচক্ষুহীন মুসহর স্ত্রীলোক। মুসহরেরা এই অঞ্চলের অনুন্নত শ্রেণীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা গরীব। এরা সাধারণত ক্ষেতমজুরের কাজ করে।]
.
সাগিয়ার নিকট নূতন শাস্ত্র শিক্ষা
সাগিয়া আর সাগিয়ার মা দুজনেই তোক ভাল। পরকে আপনার করে নিতে জানে। কিন্তু বুড়িটা বড় বাজে বকে। এক মিনিটও জিভের কামাই নেই। ঢোঁড়াইকে তামাক ক্ষেতের কাজ শিখিয়ে দেয়। এই, এমনি করে উপরের পাতা আলগোছে হালকা হাতে ছিড়বি। জঙ্গল নিড়িয়ে এইখানে জড় করবি। একটি মুথোর ডগা গজালে পাশের পাতা নষ্ট হয়ে যায়, এমনি আদুরে দুলাল গাছ তামাকের। আগে মুথো ছিল না ক্ষেতে। গত বছর যখন কুশীস্নানে গিয়েছিলাম, তখন হাড়ীর বাচ্চাগুলো শুয়োর চরিয়েছিল ক্ষেতে। আর যাবে কোথায়! সেই থেকে মুথোয় ভরে গিয়েছে ক্ষেত [৪২৬]। ও বেলা একবার আমাদের আধিয়াদারগুলো কী করছে না করছে দেখে আসিস… তোর ছেলে-পিলে কী?
একটা মিথ্যা কথা ঢাকতে অজস্র মিথা কথা বলতে হয়। তাৎমাটুলির বাইরের জীবনে এত মুশকিলও থাকতে পারে তা ঢোঁড়াই আগে কল্পনাও করতে পারেনি। এ জীবন ভাল না লাগলেও আস্তে আস্তে সয়ে যায় ঢোঁড়াইয়ের। তামাকের ক্ষেতটা ক্রমেই আপন আপন মনে হয়। তামাকের নধর পাতাগুলো তার চোখের সামনে পুরু হয়ে উঠেছে, বেড়ে উঠছে, আস্তে আস্তে ঢেকে ফেলছে তারি হাতে নিড়ানো জমিটুকু, ছুঁতে চাচ্ছে পাশের গাছকে।…
পৌষ মাসে একদিন শিলাবৃষ্টি হয়ে অর্ধেক পাতা ছিঁড়ে চিরুনের মত দেখতে হয়েছিল। সেদিন সাগিয়া আর সাগিয়ার মার সঙ্গে ঢোঁড়াইও এসে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল ভিজে ঠাণ্ডা ক্ষেতের মধ্যে। মন বদলাচ্ছে তার, বিসকান্ধার জিনিসের উপর মায়া বসছে। অথচ এই সেদিন তাৎমাটুলিতে শিলাবৃষ্টি হলে, তারা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠেছে; ভাঙ মটমট করে ভাঙ খাপড়া বাবুভাইয়াদের বাড়ির। সাগিয়াদের মুখের দিকে ঢোঁড়াই তাকাতে পারেনি সেদিন সংকোচে। সাগিয়াই প্রথম কথা বলে। বাড়িতে ব্যবহারের তামাক হবেখন ঐ ছেঁড়া পাতাগুলো দিয়ে। সাগিয়াই উলটে ঢোঁড়াইকে সান্তনা দিতে চায়। ঢোঁড়াইয়েরও এটা অস্বাভাবিক মনে হয় না।
তবু কি পুরনো জীবন মুছে ফেলা যায় ন্যাতা দিয়ে। ও লেগে থাকে মনের গায়ে এঁটুলির মতো। রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল হয়ে কখন আপনা থেকে ঝরে পড়বে, টেরও পাবে না।
ভুলতে চাইলেও ভোলা যায় না। যার উপর রাগ তাকে পর্যন্ত না। এখানে গরুকে জাবনা দেওয়ার সময় তাৎমাটুলির বলদজোড়ার কথা মনে পড়ে। কেই বা তাদের খেতে দিচ্ছে এখন? হয়তো নাদাতে এক ফোঁটা জল পর্যন্ত পড়ছে না। যে লোকটা আজীবন অখাদ্য মাংস খেয়েছে, সেটা আজ হিন্দু হয়েছে বলে কি আর গরুর যত্ন। করতে পারবে। …চারদিকে কেউ আছে কিনা দেখে নিয়ে ঢোঁড়াই হালের বলদটার গলা জড়িয়ে ধরে। …আবার গা ঝাড়ছে! বলদটাও বোধ হয় বোঝে যে, সে তার মালিক না। অধিকারের সম্বন্ধটুকুই বুঝিস। তোকে আর কি দোষ দিই। মানুষে সেটুকু পর্যন্ত মনে রাখে না।
ভারী ঠাণ্ডা স্বভাব সাগিয়ার; বিরক্ত হয় না কিছুতেই। আনাড়ী ঢোঁড়াই কোনো কাজ ঠিক করে করতে না পারলে বলে, ও শিখে যাবি দুদিনেই। ওর মধ্যে কী আছে। কেবল আশ্বাসের স্বর না। তার সঙ্গে আরও কী যেন মেশানো, যা ঢোঁড়াইকে কুণ্ঠিত হওয়ার অবকাশ পর্যন্ত দেয় না। ঢোঁড়াই যেদিন প্রথম ভকত হয়ে নিজ হাতে তিলক কেটেছিল কপালে, সেদিন বাওয়ার ঠোঁটের কোণে এই রকমই শান্ত হাসির ছাপ দেখেছিল। ঠিক এই রকম। পারবি রে ঢোঁড়াই পারবি। খাসা মানিয়েছে নতুন ভকতকে। বাওয়ার কাছে যে রকম অপ্রস্তুত হওয়ার কথাই উঠত না, এখানেও সেই রকম।
তামাকের পাতা মজলে, সাগিয়া ঢোঁড়াইকে বুঝিয়ে দেয় কী করে আঙিনার দড়িতে বেঁধে পাতাগুলোকে টেনে বড় আর লম্বা করতে হবে। তবে ব্যাপারীরা গায়ে তামাক কিনতে এলে বেশি দাম পাওয়া যাবে। দেখিস ঢোঁড়াই, শাগরেদের নামেই গুরুর নাম। মংটুমলের লোক পরশুই আসবে গাঁয়ে।
মজা পাতায় এত ঝাঁঝ হতে পারে তা ঢোঁড়াইয়ের জানা ছিল না। বিকাল বেলাটায় তার গা বমি বমি করতে আরম্ভ করে। কিন্তু সাগিয়া বলেছে, আজকে এই বোঝ শেষ করতে। শেষ সে করবেই করবে। তাকতে সে কারও চাইতে কম নয়। সন্ধ্যার সময় মাথাটা ঘুরে ওঠে। শরীরটা একটু আনচান করে। জ্বর আসবে নাকি? তামাকের বোঝাটা শুদ্ধ তার পিছনে লেগেছে, উঠে পড়ে লেগেছে তাকে হারাবার জন্য, অন্য চোখে তাকে ছোট দেখাবার জন্য।…দড়ির ফাঁসের মধ্যে তামাক পাতার উঁটাটা আর সে ঢুকোতে পারছে না। কেমন যাচ্ছে।…তারপর বাড়ি ঘর, উঠোন, তামাক সব অস্পষ্ট হয়ে আসে তার কাছে।
সে রাত্রে সাগিয়া খুব খেটেছিল তার জন্য। সারা রাত মাথায় বাতাস করেছিল। বলেছিল, তার দোষেই অমন হল; সে আগে সাবধান করে দেয়নি। গা বমি বমি আরম্ভ হলে তখনই তামাকপাতা বড় করবার কাজ ছেড়ে দিতে হয়। তখনই গুড় আর এক লোটা জল খেয়ে শুয়ে পড়তে হয়। তুমি পুরুবের লোক এসব জানা নেই, তা খেয়ালই হয়নি; মাথায় লাউয়ের বীচির তেল দিয়ে তার রগ দুটো সাগিয়া টিপে দিয়েছিল বহুক্ষণ।
…সকলেরই তাহলে এ কাজ করতে গেলে কখনও কখনও এমন হতে পারে।…হবেই যে এমন কোনো কথা নেই।…
এর মধ্যে হেরে যাওয়ার অপমান আছে কি নেই ঢোঁড়াই বুঝবার চেষ্টা করে। ভাববে কী! সব ভাবনাগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে, কানে যে খসখসানি সেইটার জন্য। মাথা টিপবার সময় এই শব্দটা হচ্ছে। বেশ লাগে সাগিয়ার এই দরদটুকু। এখানে তাহলে মরলে কুকুর-শিয়াল টেনে নিয়ে যাবে না। এখানেও দুটো মিষ্টি কথা বলবার লোক তাহলে আছে।
মেয়েদের উপর রাগটা ঢোঁড়াই য়ের মনের একটা খোলস। তার স্নেহ বুভুক্ষু মন নিজেকে ফাঁকি দেবার জন্য ঐ আবরণের আড়ালে যেতে চায়।
তাই কথার ধুকড়ি মোসম্মত রাতে তামাক খেতে উঠে সাগিয়ার কাছ থেকে যখন তাঁর খোঁজ নিয়ে যায়, তখন তার স্নেহকাঙাল মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে।
[৪২৬. এ জেলায় চাষীদের ধারণা যে শুয়ের চরলে ক্ষেতে মুথাঘাস হয়।]
.
ভূস্বামীর যশোকীর্তন
বাবু সাহেবের মনটা আজ খুব খারাপ আছে। আজ তার আর একটা দাঁত পড়েছে। মাত্র তিন-চারটে তো অবশিষ্ট ছিল। তাও পড়ল কিনা পাঁপড়াভাজা খাওয়ার সময়! তাঁর বয়স হয়ে আসছে। মরবার কথাটা মনে করতে ভয় ভয় করে। কত লোক একশ বছরও তো বাঁচে। হাতের শিরাগুলো বেরুলে কী হয়, এখনও যথেষ্ট তাকত আছে তাঁর শরীরে। লোকে ভাবে যে, তার লাঠির জোর কমেছে। সে বুঝেছে হাড়ীর ব্যাটা লচুয়া চৌকিদার সেদিন। কিছু মানেই লাগাতে চায় না [৪২৭] গাঁয়ের চৌকিদার হয়েছে বলে। এখান থেকে বসেই তিনি সেদিন দেখেন কী গাঁয়ের মধ্যে দিয়ে হাড়ীর ব্যাটা যাচ্ছে। ঘোড়ায় চড়ে, রাজপুত্তর বিজাসিংয়ের মতো। রামজীর কৃপায় বাবু সাহেবের চোখের তেজ এখনও কমেনি। তাই না এই দোতলা থেকেও দেখতে পেয়েছিলেন। বলে কিন দারোগাসাহেব খুব জলদি যেতে বলেছিল বলে গাঁয়ের মধ্যে ঘোড়ায় চড়েছিলাম। শুনে আপাদমস্তক জ্বলে গিয়েছিল বাবুসাহেবের। তিনি আজকাল ভজনপূজন নিয়েই বেশি থাকেন। সংসারের কাজকর্ম দেখেন বড় ছেলে অনোখীবাবু। [৪২৮] তবু তিনি থাকতে পারেননি। গুনে পঁচিশ জুতো মেরেছিলেন বাবুসাহেব লচুয়া চৌকিদারকে। তার এক টাকা জরিমানা। ভেবেছিস কী? পঁচা তেলী নয়শ আধুলী। এখনও। বুঝলি? সরকার আমার উপর নারাজ থাকলেও। আমার ছোট ছেলে লাডলীবাবু নেংটাগুলোর সঙ্গে জেলে গেলেও। বুঝলি?
জরিমানার টাকাটা অবিশ্যি তিনি নিজে নেননি। তিনি আর আজকাল ঐ সব টাকা পয়সার ব্যাপারে থাকেন না। তাঁর নিজের কামানো পয়সা থেকে ছেলেরা চারটি খেতে দেয়, তাইতেই তিনি খুশি, জরিমানার টাকাটা নিয়েছিল তাঁর বড় নাতি। তার নিজের ছেলে দুটো তো অপগণ্ড। বড় আনোখবাবু ভাং খেয়ে ঘুমোয়, আর ছোট লাডলীবাবু নেংটাগুলোর সঙ্গে জেলে ছত্রিশ জাতের এঁটো খায়। মহাৎমাজীর কাজ না ছাই! নাতিটার তবু বিষয়বুদ্ধি আছে এই বয়সেই। গাঁয়ের লোকের কাছ থেকে জরিমানার পয়সা তুলে, তাই দিয়ে আসাসোটা মকমলের বিছানা টিছানা আনিয়েছে। আশ-পাশের গাঁয়ের বিয়ের মাইফেলের সময় ভাড়া দেয়। শরীরটাও ভাল। রাজপুতী ঠাট রাখতে পারবে। ঐ তো নিচে মোষের নাদার কাছে বসে রয়েছে। মোষের বাচ্চাগুলোর শিঙ গজাবার সঙ্গে সঙ্গেই ও রোজ সেগুলোকে নেড়ে নেড়ে দেয় স্নানের আগে এক ঘণ্টা। তবে না ওগুলো মারকুটে হবে; গোপাষ্টমীর দিন শুয়ারের পেট ফুড়বে শিং দিয়ে গুঁতিয়ে। [৪২৯] রাজপুতের ছেলের এই তো চাই! এ নাতিটা তার গুণ পেয়েছে; বাপকাকার মতো নয়। তাই এটাকে তিনি এত ভালবাসেন। একে তিনি নিজের মনের মতো করে তৈরি করে যাবেন। এর মনের মধ্যে গেঁথে দিয়ে যাবেন, দুনিয়াদারি অ আ ক খ। বাড়িয়ে যাও হাত যতদূর পৌঁছায়, ঐ লাঠিসমেত হাত। হাত গুটিয়ে বসে থেকো না কখনও। আলের মাটি কেটে এগিয়ে যাও একটু একটু করে। কচার ডালের খুঁটি নতুন করে সরিয়ে পেতো। জমির সীমানার বেড়া ক্রমে এগিয়ে নিয়ে যাও রাস্তার দিকে, নইলে পরে নিঃশ্বাস ফেলবার জায়গা পাবে না। আগে নেবে পবলিস-এর[৪৩০] জমি। আস্তে আস্তে এগুবে যাতে কারও নজরে না পড়ে প্রথমটায়। তবুও যদি পিঁপড়েগুলো কামড়ায়, তাহলে বুঝিয়ে দিও যে, তুমি রাজপুত। মঠের জমি; নিকাশর জমি; কুশীর ধারের জমি; এক দিনে নয়, আস্তে আস্তে। নদীর ধারে প্রথমে খেসারি কুর্থি ফেলতে আরম্ভ করো। প্রথম দুএক বছর গরু চরবে এই জায়গায়। তার পর আস্তে আস্তে অন্যের গরু সেদিকে যাওয়া বন্ধ করে দাও। লাঠি নিয়ে দাঁড়াও। জমি হচ্ছে কদুর কাছের মতো। লাঠির ঠেকনা পেলে তবে লকলকে হয়ে লতিয়ে ওঠে। বাকি সব পরে আসবে। আপনা থেকে আসবে। রসিদ, আঙুলের ছাপ, ফৌজদারী আদালত, দারোগা, হাকিম কোনোটা ফেলনা নয়। যাক এখন ছেলেদের সংসার। তারা জিজ্ঞেস করলে সলাপরামর্শ না দিয়ে পারেন না, তাই একেবারে সব ছাড়তে পারেননি। কেউ কেঁদেকেটে এসে পড়লে, অবিশ্যি বলেন, ছেলেদের কাছে যেতে, তারাই মালিক।…
একটা মাত্র তাঁর বাসনা আছে, রামজী পূর্ণ করবেন কিনা জানি না। এরকম ইচ্ছাগুলো যখন আসে তখন আর সুস্থির হতে দেয় না এক দণ্ডও। অন্য সব খুচরো আটপৌরে ইচ্ছাগুলো ডুবিয়ে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি লেগেই থাকে, মাথা রুক্ষ থাকলে মাথার মধ্যেটা যেমন করে, তেমনি। এর আগে যখনই তাঁর এইরকম একটা কিছুর জন্য আকাঙ্ক্ষা হয়েছে, তখনই রামজী তাঁর কৃপাদৃষ্টি করেছেন। জজ সাহেবের পাশে কুর্শিতে বসবার বাসনা [৪৩১] তাঁর রামজী পূরণ করেছিলেন; রান্নাঘর বাড়ির বাইরে আনবার আকক্ষা৪৩২ রামজী পূরণ করেছিলেন। সে-বিশ্বাস তার নিজের উপর আর রামজীর উপর ছিল। এবারে একটু অধৈর্য হয়ে পড়েছেন রামজীর দেরি দেখে। লোচন সহস ন সূঝ সুমেরু। [৪৩৩] হাজারটা চোখ থাকতেও কি তুমি সুমেরু পর্বতটা পর্যন্ত দেখতে পাও না? ঐ যে এখান থেকে চোখের সম্মুখে সবুজ কালো রেখাটা দেখা যাচ্ছে আকাশের নিচে, ওটা পাকীর ধারের বট অশথের সার। কোশখানেক দূর হবে। এখান থেকে ঐ রাস্তা পর্যন্ত এটুকুনি তিনি এক চক-এ [৪৩৪] দেখে যেতে চান। নিজের দোরগোড়া থেকে পাক্কীতে যেতে হলে যেন অন্যের জমির মধ্যে পা না দিতে হয়। নিজের জমির মধ্যে দিয়ে তাঁর বলদের শ্যাম্পানিটা [৪৩৫] চলেছে তো চলেইছে, পথ শেষ হয়ই না, হয়ই না; কারও খোসামোদ করবার, মুখের দিকে তাকাবার দরকার নেই, দুপাশের ক্ষেত থেকে নিজের আধিয়াদাররা হালচালানো থামিয়ে বন্দেগী করছে। একথা ভাবতেও আনন্দ।
রমজী তাঁর ইচ্ছা প্রায় পূরণ করে এনেছেন। এখন মধ্যে পড়ছে কেবল দুচার টুকরো ছিটেফোঁটা খুচরো জমি। তারই মধ্যে আছে মোসম্মতের জমি। এগুলোকে দেখতে বড় খারাপ লাগে! তেতো হয়ে ওঠে মনটা। তাঁর সেই আগেকার যুগ হলে ভাববার কিছুই ছিল না। চারিপাশের বিরাট সমুদ্র ও দুফোঁটা গণ্ডুষের জলকে হুস করে টেনে নিত পেটের ভিতর। আজকাল দিনকাল হয়ে আসছে অন্যরকম। সত্যি কথা নিজের কাছে স্বীকার করতে কষ্ট নেই, লাঠির জোরও কমেছে। তার ছেলেরা বড় লোকের ছেলে, তাঁর মতো লঠিসম্বল গরীবের ছেলে নয়তো। তারপর নরম পানিতে জন্ম। পারবে কোথা থেকে?…তবে এই বুড়ো বয়সে চোখে ছানি পড়বার আগে এইটুকু আমায় দেখিয়ে দাও রাজমী!
তবে অনোখীবাবুকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না, এ কথা তিনি জানেন। কাল বলতে এসেছিল যে, লাডলীবাবুর যে তিন শ টাকা জরিমানা হয়েছে তাইতে হাকিম আমাদের গরুর গাড়ি ক্রোক করার হুকুম দিয়েছে। মুখ্যু কোথাকার! কী করে চালাবি এত বড় সম্পত্তি। এজমালি সম্পত্তি একজনের জরিমানা উশুল করবার জন্য ক্রোক করলেই হল। এই তো ঘটে বুদ্ধি!…
সিঁড়িতে একটা পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। অনোৰীবাবু বোধ হয় আসছে আবার আর একটা কিছু জিজ্ঞাসা করতে।… ও! না, ঘরবালী [৪৩৬]। উল্কিতে ভরা হাতটা প্রথমে নজরে পড়ে। আবার কী মতলবে! বয়স হওয়ার পর আজকাল কিছুদিন থেকে বাবুসাহেব ঘরবালীকে একটু শ্রদ্ধা ও প্রশংসার চোখে দেখতে আরম্ভ করেছেন। বোধ হয়, পুত্রবধূদের সঙ্গে তার তুলনা করে। ঘরবালী চিরকালের অভ্যাস মত প্রত্যহ স্নানের আগে বাবুসাহেবের পুরনো লাঠিখানাতে তেল দিয়ে রাখে। সে জানে যে, লাঠি তার সতিন; কিন্তু ও সতিনে কোঁদল করে না। লাঠি তো নয়, লক্ষি আটকে রাখবার হৃড়কো। ও একা হাতে একদিন সব করেছে; আর আজকাল ওর ছেলের বৌরা নিজের পানটা পর্যন্ত সেজে খায় না। রান্নাবাড়ির কথা ছেড়েই দাও। ও সব পাট তো বাড়ির বাইরেই চলে গিয়েছে আজকাল।
…এলাচ লবঙ্গ চাইতে নয় তো? কালই আটা এলাচ দিয়েছি।…
বাড়ির মেয়েদের হাতে যাতে এক পয়সাও না যায় সে বিষয়ে এ অঞ্চলের গেরস্তদের সজাগ দৃষ্টি আছে। এলাচ-লবঙ্গটা পর্যন্ত বাড়ির কর্তা বৈঠকখানায় তালাবদ্ধ রাখেন।
বাবুসাহেব ঠিক ভেবেছেন। গিন্নী এসেছেন আবার এলাচ চাইতে। ইচ্ছে হয়, জিজ্ঞাসা করেন, কালকের অতগুলো এলাচের কী হল।…না ওর নিজেরই এটা খেয়াল হওয়া উচিত। তা যখন হয়নি তখন আর এসব নিয়ে খিচখিচ করতে ভাল লাগে না। একটা প্রশান্ত উদারতার ভাব দেখিয়ে তিনি খড়ম জোড়া পায়ে দেন। বৈঠকখানার গা-আলমারির চাবি খুলে এলাচ বার করে এনে দিতে হবে। বেশি দিলেও একদিন চলে, আবার কম দিলেও ঐ একদিন চলে। চিরকাল তিনি এই দেখে আসছেন। তবে, বেশি দেওয়ার দরকার কী! আর যখনই বলবে, তখনই চাই। একেবারে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে আসে। এক মিনিট দেরী হলে চলবে না।…এর থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে আবার সাওজীর দোকানে বিক্রি হচ্ছে না তো? গত বছর খুব বার করেছিল নাতিটা তার ঠাকুরমার বালিশ কেটে সতরটা টাকা। কোথা থেকে কী করে যে লুকিয়ে গোলার ধান বেচে দেয় মেয়েরা, বুঝবার জো নেই।…
———-
[৪২৭. তাচ্ছিল্য করে। ৪২৮. জিরানিয়া জেলার যেসব পরিবার নিজেদের অভিজাত শ্রেণীর বলে মনে করেন, সেই সব পরিবারের বয়স্ক লোকেরাও ছেলে এবং নাতিকে পর্যন্ত তুমি না বলে আপনি বলেন; সম্বোধনের সময় প্রত্যেক নামের শেষে বাবু শব্দটি যোগ করে দেন। ৪২৯- প্রচলিত উৎসব। ৪৩০. পাবলিক। ৪৩১. দায়রা কোর্টের অ্যাসেসর। ৪৩২. গ্রামে এটা আভিজাত্যের একটি লক্ষণ বলে গণ্য হয়! বাহির থেকে বেঁধে পাচকেরা মেয়েদের জন্য ভিতরে খাবার পৌঁছে দেয়। ৪৩৩. তুলসীদাস থেকে। ৪৩৪. এক টুকরোতে, এক plot-এ ৪৪৫. লোহার স্প্রিংওয়ালা গরুর গাড়ি। ৪৩৬. গিন্নী।]
.
গিধরের উপদ্রব
এই বুড়ো শকুনের নজর থেকে নিজের জমিটুক বাঁচানোর জন্যই মোসম্মতের দরকার ছিল একজন বেটাছেলের। সেইজন্যই সে এতদিন ঝুঁকেছিল গিধর মণ্ডলের দিকে। সাগিয়া কিন্তু দেওরের সঙ্গে সাঙা করতে রাজী নয়, রাজী হয় বা কী করে। একপাল নেণ্ডিগেণ্ডিওয়ালা সতিনের ঘর কে আর সাধ করে করতে চায়। আর যখন তার বাড়িতে দুমুঠো খাওয়ার সংস্থান আছে।
মেয়েমানুষের স্বাভাবিক বৈষয়িক বুদ্ধিতে মোসম্মত বোঝে যে, ঢোঁড়াই লোকটা খাঁটি। বিশ্বাস করা যায় ওকে। পয়সার খাঁই নেই একেবারে। হাতে করে কিছু দিলে খাবে, না দিলে খাবে না। গিধর মণ্ডলের মতো রামায়ণ পড়তে না জানুক, তাহলেও রামায়ণ বেশ মুখস্থ। আপন করে রাখতে পারলে টিকবে। কথাবার্তায় মনে হয়, তীরথ করবার দিকে ঝোঁক, আবার পালিয়ে টালিয়ে না যায়। তার নিজেরও ইচ্ছে, একবার অযোধ্যাজী সেরে আসে। আর কত দিনই বা বাঁচবে। আর এই পোড়াকপালী মেয়েটাকেও একবার গয়াজীতে নিয়ে যাওয়া দরকার; মরা জামাইটার একটা সদগতি করাতে হবে। তার জন্য আধ বিঘা জমি যদি বিক্রিও করতে হয়। তাহলেও ক্ষতি নেই। গতবার এ কথা গিধর মণ্ডলের কাছে তুলতেই সে চটে লাল। বলে কী না, মেয়ের দেওয়া পিণ্ডি তুমিই নিও হাত পেতে গয়াজীতে। জমি বিক্রি করার কথাটা তার মনঃপূত হয়নি। লজ্জায় ঘেন্না মাথাকাটা গিয়েছিল মোসম্মতের। মেয়েকে সাঙা করার আগেই এই!…
আর একটু শিখলেই ঢোঁড়াইটা পারবে মোসম্মতের জমি-জিরেত ভালো করে দেখতে। এবার আধিয়াদারদের কাছ থেকে ফসল ভালই পেয়েছে মোসম্মত। পাবে না? এতদিন গিধর মণ্ডলই ছিল মালিক। মোসম্মত জানে যে, গিধরের হাতের তেলোয় আঠা মাখানো। টাকাকড়ি ফসল তার হাত দিয়ে যা কিছু যায় আসে, কিছুটা অংশ তার হাতেই লেগে থাকে। দুদশ বোঝা ধান কোন বছর না পৌঁছত তার বাড়িতে, সাঁঝের আঁধারের পর? বাঙালী ব্যাপারীদের কাছে থেকে পাওয়া, তামাকবেচা টাকাটাও গিধরের হাত দিয়েই আসত।
রাগে গিধর মণ্ডলের নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছা হয়। বেশি সাবধান হতে গিয়ে সে গাঁয়ের বাইরের লোককে এনে ঢুকিয়েছিল, মোসম্মতের বাড়ির চাকরিতে! দেখতে হাবাগবা বলেই মনে হয়েছিল তখন। ভাবতেই পারেনি যে, ওটার পেটে পেটে এত শয়তানি। দুদুটো আরওতকে তিন মাসের মধ্যে একেবারে হাতের মুঠোর মধ্যে করে নিল! কোথাকার না কোথাকার একটা পরদেশী ছেঁড়া! মোসাম্মত আর তাকে আগের মতো আমলই দিতে চায় না আজকাল। গিয়ে পড়লে এসেছ? বেশ। বসেছ? তাও বেশি এমনি একটা ভাব দেখায়। এ কী খাল কেটে কুমীর আনল সে। এর একটা কিছু বিহিত করতেই হয়।
সেদিন ভোরে মোসম্মতের বাড়ির সম্মুখে ঢোঁড়াই , মোসম্মত, সাগিয়া, আরও দু একজন প্রতিবেশি আগুন পোয়াচ্ছে। পাশের বাড়ির নেংটা ছেলেটা আগুনের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, তবু ঠক ঠক করে কাঁপছে। ছেলেটা আগুনে একটা রাঙা আলু দিয়েছে পোড়াতে। ঢোঁড়াই তাকে ক্ষেপাচ্ছে, ওরে তোর দিদিমার মাথায় ধবল হয়েছে; আর সাগিয়া, সাগিয়ার মা সকলে হেসে উঠছে ছেলেটার রাগ দেখে।
কি? কার দিদিমার ধবল হয়েছে? গিধর মণ্ডলের গলা না? এত ভোরে?
মোসম্মত আগুনের ধারের একটি ঘাসের বিড়ে চাপড় মেরে পরিষ্কার করে দেয়, গিধরের বসবার জন্য। কোথা থেকে?
কোথা থেকে আবার ক্ষেত থেকে। নিত্য ক্ষেতী দুসরে গাই। ক্ষেত দেখতে হয় রোজ, আর গরু একদিন অন্তর একদিন।
কথাগুলো শুনতে কিছুই না। কিন্তু সবাই বোঝে, রোজ, কথাটার উপর জোরটা। গিধর মণ্ডল খোঁচা দিয়ে বলতে চায় যে, তোমাদের ক্ষেতখামারেরর দেখাশুনো ঠিক হচ্ছে না। অথচ কেউই ধরা পড়তে চায় না গিধরের কাছে। মোসম্মত ভাবে ঢোঁড়াই বোধ হয় বুঝতে পারেনি। সাগিয়াও ঢোঁড়াইয়ের ব্যঞ্জনাহীন মুখের দিকে তাকিয়ে জানিয়ে দিতে চায়, আরে বলতে দে। বললেই তো আর তোর গায়ে ফোঁসকা পড়ছে। না।
তার কথার খোঁচাটা কেউ গায়ে মাখল না দেখে গিধর একটু ক্ষুব্ধ হয়। ঢোঁড়াই তখন খুব মনোযোগ গিয়ে ঘুরের ছাই সরাচ্ছে একটা কাঠি দিয়ে। ধোয়ার জন্য চোখদুটো বুজে এসেছে তার। সেদিকে দেখে বুঝবার উপায় নেই, কী ভাবছে।
হঠাৎ ঢোঁড়াইকে এক তাড়া দিয়ে ওঠে গিধর মণ্ডল। ঘুরের আগুনের ছাই নিচে থেকে উপরের দিকে ওঠাচ্ছিস কেন দিনের বেলায়? বেকুব কোথাকার! মোচ উঠেছে, আর এটুকু জানিস না যে, ঘুরের ছাই সাঁঝের পর নিচ থেকে উঁচুতে ঠেলে তুলতে হয়, আর সকালে উপর থেকে নিচে নামাতে হয়। [৪৩৭]
–তারপর ছোট ন্যাংটা ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করে, তুই জানিস না এ কথা? ছেলেটা ঘাড় নেড়ে জানায় যে হ্যাঁ সে জানে এ কথা। এখানকার ছোট ছেলেটা পর্যন্ত যে কথা জানে, পুরুবের জানোয়ারগুলো তা জানে না। আমরা এসব বাপ ঠাকুর্দার কোলে বসে শিখেছিলাম।
ঢোঁড়াই কিছুতেই চটবে না। যতই বলো। সত্যিই তো সে এখানকার আচার-ব্যবহার জানে না কিছুই। সে আগুন সরিয়ে রাঙা আলুটা সিদ্ধ হয়েছে কিনা দেখে। মোসম্মত কলকেতে ফুঁ দিতে দিতে বলে, শিখে যাবে সব। ছেলেমানুষ। নতুন এসেছে এদেশে।
দেওরের ব্যবহারে অপ্রস্তুত হয়ে যায় সাগিয়া। ভোরবেলা কোথায় সীতাজী, রামজী, মহাবীরজীর নাম নেবে, তা নয় এ কী আরম্ভ হল বাড়িতে। বয়সে বড় দেওর। কিছু বলাও যায় না মুখের উপর। ঠিক যেসব কথাগুলো ঢোঁড়াইয়ের সম্মুখে বলা উচিত, অনবরত কি সেই কথাগুলোই ওর মুখে আসবে। এই তো আবার মাকে বলল, ঢোঁড়াইয়ের মাইনে দেওয়া হয়েছে তো? চার আনা করে মাইনে আমি ঠিক করে দিয়েছিলাম! আমি, আমি আমি। কে বলেছে যে তুমি বহাল করোনি ঢোঁড়াইকে। ঢোঁড়াই তো বলছে না যে, সে চাকর নয়। কী দরকার তাকে এ কথা মনে করিয়ে দেওয়ার।
মোসম্মতেরও মাইনের কথাটাতে লজ্জা লজ্জা করে। সব ফসল, টাকা-পয়সা ঢোঁড়াই য়ের হাত দিয়েই আসে। ওর হাতে কি চার আনা পয়সা মাইনে বলে তুলে দেওয়া যায়। একথা সে গিধরকেও জানাতে চায় না। বলে, সে হবেখন।
এবার শুনলাম- তোমাদের ঢোঁড়াই ফসল ভাগ করেছেন আধিয়াদারের বাড়িতে [৪৩৮]। একেও পরদেশী ছেলেমানুষের কাণ্ড বলে উড়িয়ে দাও। গাঁ-সুদ্ধ সব গেরস্তর বিরুদ্ধে যাওয়া! ছেলেমানুষ তো ওর মুখে তেল মাখিয়ে দিয়ে তার উপর বসে বসে হাত নাড়ো। যাতে একটাও মাছি না বসতে পারে।
এবার আধিয়াদারের বাড়িতে ভাগ করে ফসল তো অন্যবারের চাইতে কম পাইনি আমি।
গিধর মণ্ডলের মনে হয় তার সতোকে লক্ষ্য করেই মোসম্মত কথাটা বলল। সে চটে ওঠে।
তোমার একার কথা ভাবলেই তো দুনিয়া চলবে না। গাঁয়ের অন্য সকলের কথাও ভাবতে হবে।
কথার ঝাঁঝে মোসম্মত একটু মিইয়ে পড়ে। বলে, তা তো হবেই।
আর ঢোঁড়াই থাকতে পারে না। অনেকক্ষণ নিজের মনের সঙ্গে লড়েছে।
গাঁয়ের লোকের ক্ষতিটা কোথায় হয়েছে শুনি। তোমার সেপাই ওজন করলে কিয়ালি [৪৩৯] কেটে নিতে, আধিয়াদার ওজন করেছে কিয়ালি না নিয়ে। তোমার বাড়ির গুরু পুরুতের অংশ ভাগ হওয়ার আগে কেটে রাখতে, সেইটা পাবে না। নিজের অংশ থেকে খাওয়াক না রাজপুতরা তাদের পুরুতকে চার আঙুল সরের দই। চার-পাট করা কম্বলের আসনে বসাক না তাদের বামুন ঠাকুরকে। আধিয়াদাররা নিজের অংশ থেকে তা দেবে কেন? সে বামুন কি আধিয়াদারদের বাড়ি পূজো করে?
মোসম্মত ঢোঁড়াইকে চুপ করতে বলে। এক রকম ধমক দিয়েই ওঠে। কথা হচ্ছে আমার সঙ্গে গিধরের, তার মধ্যে তুই কথা বলতে আসিস কেন, ঢোঁড়াই?
গিধর ঢোঁড়াইয়ের কথার উপযুক্ত জবাব খুঁজে পায় না। হাতের একটা মুদ্রা দেখিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে বলে, তুমি নিজের বটুয়া ভরো না যেন, ম্যানজার সাহেব।
কী! কী! বললি? ঢোঁড়াই উঠে দাঁড়িয়েছে। এক মুহূর্তের মধ্যে তার মুখের চেহারা বদলে গিয়েছে।
সাগিরা তার মোসম্মত তাদের দুজনের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দুয়ারে গিধরের অপমান হলে লজ্জায় মুখ দেখানো যাবে না। না না তুই থাম ঢোঁড়াই।
আমি কি ওর ক্ষেতের মুসহরনী [৪৮২] যে ও আমাকে গালাগালি করবে, আমি হেসে আদর করব? আমি কি ওর টাকা কর্জ খেয়েছি? ওই গোরুখোরটার?
গিধর মণ্ডল কথা বাড়ায় না। এরকমটা সে ঠিক আশা করেনি। ঢোঁড়াইটা যে মুসহরনীর কথা বলল, সেটা কানী মুসহনীকে লক্ষ্য করে না তো? এখনই হয়তো সাগিয়া আর মোসম্মতের সম্মুখে সেই কথা নিয়ে আরও চিৎকার আরম্ভ করে দেবে। সাগিয়ার আশা অর্থাৎ সাগিয়ার মার জমির আশা সে এখনও ছাড়েনি।
যাই, রোদ উঠে গেল বলে সে গুটি-গুটি বেরিয়ে যায়। দূর থেকে বলে যায়, দ্যাখ, ছোট মুখে বড় কথা বলা ভাল নয়।
ঢোঁড়াই এ কথার জবাব দেয় না। গিধর চলে গেলে সে মোসম্মত সাগিয়া কারও সঙ্গে কথা বলে না।…মোসম্মত কিনা বলে, আমাদের কথার মধ্যে কথা বলিস না। যাদের জন্য করি এত, তারাই এই বলে। এই নিমকহারাম স্বার্থপর মেয়েমানুষের বাড়ি তার দানাপানি নেই। রামজীর সৃষ্টি সারা দুনিয়া তার সম্মুখে পড়ে রয়েছে। হাতদুটো আর দুমুঠো খাওয়া জুটেই যাবে। কোনো জিনিস সে এখানে আসবার সময় আনেনি, এখান থেকে যাওয়ার সময় নিয়েও যেতে চায় না। মেয়েমানুষ দুজনের কারও দিকে না তাকিয়ে সে বাইরের দিকে পা বাড়ায়।
সাগিয়া তাকে লক্ষ্য করছে মায়ের সেই কথাটার পর থেকে।
মা বুড়ি মানুষ তার কথার কি কিছু ঠিক আছে। তার কথায় রাগ কোরো না ঢোঁড়াই।
যা ভাবা যায় সব কি করা যায়! আর সাগিয়ার চোখের জল দেখবার পরও। মোসম্মত পর্যন্ত বেটা বলে তার কাছে এসে দাঁড়ায়।
বড় বোকা তুই। এই পরদেশী বেটাকে নিয়ে আচ্ছা মুশকিলে পড়লাম দেখি। বোস। দাঁতন কর। আমি ততক্ষণ ভুট্টার খই ভেজে আনি।
সাগিরা মনে করিয়ে দেয় মাকে, দেখো, খই আবার বেশি ফুটে না যায়।
সে আর বলতে হবে না বুড়িকে।
আসলে ঢোঁড়াইয়ের রাগের থেকে অভিমানটা হয়েছিল বেশি। রাগ তো সব লোকের উপরই হতে পারে। এখানে ঢোঁড়াইয়ের অভিমান করবার দাবি জন্মেছে এরই মধ্যে। নইলে ঢোঁড়াইয়ের রাগ কি অত তাড়াতাড়ি থামে; না অত নিঃশব্দে আসে যায়।
———-
[৪৩৭. সন্ধ্যায় সকলের লক্ষ্য থাকে যাতে আগুনটি সারারাত জ্বলে। আর সকালে চায় যে রোদ উঠবার পর আগুনটি নিবে যাক। এই জন্যই বোধ হয় গ্রামাঞ্চলে এই নিয়ম প্রচলিত। ৪৩৮. যে স্থানে ফসল কেটে জড়ো করা হয়, তাকে বলে খলিহানি! ভাগ-চাষীদের ফসল, ভূস্বামীর খলিহানে জড়ো করাই প্রথা। কিন্তু এতে জমিদার যথেচ্ছ ফসল ভাগ করার সুবিধা পেয়ে যায়। ৪৩৯. ওজন করবার পারিশ্রমিক বাবদ একটি ফসলের অংশ। ৪৮২. মুসহর জাতের স্ত্রীলোক। এরা ক্ষেতমজুরের কাজ করে।]
.
জমি-জাতির রাজ্যে শনির দৃষ্টি
খালি বিসকান্দায় কেন, সারা জিরানিয়া জেলা জুড়েই আকাল এসেছে। আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে আসছিল কবছর ধরেই। পয়সার আকাল। বড় কিসানদের বাড়ি ধান আছে। এতদিন ঘুমিয়ে ছিল না কেউ; কিন্তু কী করতে হবে কারও জানা ছিল না। বচ্চন সিংহের পর্যন্ত না। সবাই নিজের নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। পুরনো ধানে বাবুসাহেবের আটা পাঁচশমণী গোলা ভরা। না চাইলেও যে ধানটা আসবে, সেইটা রাখবার জায়গা করাই শক্ত। গতকাল পাট পচেছিল মাচার উপর। জলের দরে বিক্রি করতে হয়েছিল মংটুরামের আড়তে। তাই আবার কত খোসামোদ। বলে যে তার গুদামে জায়গা নেই। পাট তো তাও বিক্রি হয়েছিল, ধান মকাই বিক্রিই করতে পারেননি অনোর্থীবাবু। বছর ঘুরতে না ঘুরতে মকাইতে পোকা ধরে। মকাই বিক্রিই করতে পারেননি অনোথীবাবু। বছর ঘুরতে না ঘুরতে মকাইতে পোকা ধরে। তাই গাঁয়ের মধ্যে খয়রাত করতে হয়েছিল। না চাইতে ফসল দেওয়ার নামই খয়রাত। একটা লম্বা খাতায় টিপসই দিয়ে নিতে হয়। শীতের শেষে এর দেড়গুণ ওজনের রবির ফসলে শোধ দিতে হবে। এবারে সস্তা রেটে খয়রাত ছেড়েছেন; অন্য অন্য বার লাগত দ্বিগুণ। তবে তিনি দেওয়ার সময় সাফ সাফ বলে রেখেছেন; বাজে কথা নেই তার কাছে; অন্য কিষাণদের মতো তিনি লুকিয়ে কিছু করতে চান না, ষাটের ওজনে নিতে হবে, ফেরত দিতে হবে আশির ওজনে, যা এখানে চলে। এ রেট খাওয়ার জন্য মকাই নিলে। বীজের জন্য নিলে তার রেট আরও বেশি।
এই পোকাড়ে ভুট্টার দানাগুলো বীজের জন্য কেউ নেয়নি। এ দিয়ে কেবল খাওয়া চলে।
পয়সার আকালটা এবার কী করে ধানের আকালে বদলে গেল তা কেউ বুঝতে পারেনি। রবির ফসলের পর লাঠির জোরেও এবার বিশেষ কিছু পাওয়া যাবে না, তা সব কিষাণই জানত। তাই এবার বহু জমি অনাবাদী রেখেছিলেন বাবুসাহেব। বিক্রি না করতে পারলে ফসলে লাভ কী। গোলায় আর কত আঁটবে। ফসল যদিই বা বিক্রি হয় তো যা দাম পাওয়া যায় তাতে খরচে পোষায় না।
এই আকালের গল্পই হয় আজকাল প্রত্যহ, মাঠের সম্মুখের ভজনের আসরে। আষাঢ় মাস শেষ হয়ে গিয়েছে, তবু ধান রুইবার মতো জল হল কই। ইন্দ্রাসন আগুন লেগেছে এবার। আমটা ভাল ফললেও না হয় তলা কুড়িয়ে [৪৪১] কিছু দিন চলত। মেয়েরা যে পূর্ণিমার রাতে জাট-জট্টিনের গান গাইল [৪৪২] ক্ষেতের মধ্যে, তবু বৃষ্টি হল কই? খায় কী লোকে? জাম ফুরিয়েছে; বুনো পেয়ারার যাগ চলছে, ময়নার ফল আর তাল পাকতে এখনও অনেক দেরি। যখন টোলার উপর কুদৃষ্টি পড়ে তখন এমনি করেই পড়ে। শীত যেমন গায়ে বেঁধে ছেঁড়া কাঁথার মধ্যে দিয়ে। এদিক দিয়ে সামালাতে যাও ওদিক দিয়ে ঢুকবে। পিপিড়ের সার মুখে করে ডিম নিয়ে গেলেও জল হয় না আজকাল।
বৃষ্টি না হলে মন শক শক করে; আবার জল হলে যে কী হবে সে কথা ভাবতেও মন খারাপ হয়ে যায়। বীজের ধনটা পর্যন্ত কারও কাছে ছিল না যে চারা করে! হলেও বিপদ, না হলেও বিপদ। এদিকে বাপে কুত্তা খায়, ওদিকে মায়ের পরান যায়। গল্পটা জানিস তো? বাপ মাংস রাঁধতে বলে গিয়েছে। মা বেঁধে রেখেছে একটা কুকুরের বাচ্চা মেরে। এখন ছেলে যদি বাপকে বলে দেয় একথা তাহলে মায়ের পরাণ যায়, আর না বললে বাপকে কুত্তার মাংস খেতে হয়। এ হয়েছে তাই বুড়হাদাদা!
বুড়হালাদা অন্ধকারের মধ্যে ঠাহর করে দেখতে চেষ্টা করে, বিল্টাটা আবার ঠাট্টা করছে না তো। যা ফাজিল ছোঁড়াটা! মনে তো হচ্ছে না যে ফাজলামি করছে এখন। বুঝলি বিলট! বাবুসাহেবের এ পাপের পয়সা থাকবে না। এই আমি বলে রাখলাম দেখে নিস। না হলে আমার নামে কুকুর পুষিস। যত ওর আগের জন্মের রোজগার করা পুণ্যি থাকুক না কেন।
মনের গহীনের একই দুঃখে, টোলার সব লোকের মন সাড়া দিয়েছে। তাই বিল্টাকে বিলট বলে ডাকছে বুড়হাদাদা।
রামচন্দ্রজীর রাজ্যের নিয়কানুন সব বদলে গেল নাকি?
অউর করই অপরাধ
কোউ আউর পাব ফল ভোগূ। [৪৪৩]
একজন দোষ করে, আর একজন তার ফল পায়। আশ্চর্য!
সেই রাতই বেশ একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। কলিযুগে লোকের মধ্যে পাপ ঢুকছে। তাই জাট-জাট্টিন-এর গানের ফল ধরতে একটু দেরি হয়। বৃষ্টির সময় গাঁ-সুদ্ধ সকলে জেগে উঠেছিল। সব বাড়িতেই মেয়ে পুরুষ সকলে বলাবলি করে যে, এ জল এখুনি থেমে যাবে। এ এক আঁজলা জলে আর কী হবে! কেবল কুশের শিকড়গুলো গুণসুচের মতো ডগা ছাড়বে, হাল চালানোর সময় পায়ে বিধবার জন্য। তবে ধুলোটা মরবে।
আকাশ ভেঙে জল পড়ছে। সকলে দেখছে যে, ছাঁচতলায় নিচে দিয়ে জলের স্রোত বইছে। তবু কেউ নিজের কাছে, নিজের বাড়ির লোকের কাছে, সত্যি কথাটা বলবে না।
বৃষ্টি থামবার পর সবে গাঁ-খানা একটু ঝিমিয়ে এসেছে। এমন সময় হঠাৎ হট্টগোল শোনা যায়। দূরে, পশ্চিমের দিক থেকে।
নিশ্চয়ই চোরটোর কিছু হবে। নিজের ঘরে চুরি হবার মতো কোনো জিনিস না থাকলেও সকলেই ছোটে লাঠি, বাঁশ, সজনের ডাল যার হাতের কাছে যা জোটে তাই নিয়ে। বিসকান্দায় ভাঙা মঠের কল্যাণে ইটপাটকেলের অভাব নেই এ কথা গনৌরীর মনে পড়ে, পায়ে ইটের ঠোকর খেয়ে। কোঁচর ভরে ইট নেয় সে। আওয়াজটা ততক্ষণে বাবুসাহেবের বাড়ির দিকে পৌঁছে গিয়েছে।
রাতে বাবুসাহেবের বাড়ির চারিদিকে গান গেয়ে না হয় বাঁশি বাজাতে বাজাতে পাহারা দেয়, একজন বজ্ৰবাঁটুল সাঁওতাল। তার হাতে থাকে তীরধনুক আর বল্লম! কাছেই সাঁওতালটুলিতে তার বাড়ি। সারাদিন সেখানে ঘুমোয়, তার রাতে বাবুসাহেরে দেওয়া ধেনো খেয়ে ভিউটি দেয়। সেই লোকটা বাবুসাহেবের পশ্চিমের ক্ষেতের দিকে, একটা ছপ ছপ্ শব্দ পেয়ে ভেবেছিল বুনোশুয়ার কি নীলগাইটাই হবে। আলের পাশ দিয়ে সে গুঁড়ি মেরে মেরে এগিয়ে গিয়েছিল। তার পর ভাল করে চোখ মুছে নেয়। নিজের হাতের আঙুল তো ঠিকই গুনতে পারছে! ভাগ্যে সে তীর ছোড়েনি। তারপর সে চীৎকার করে লোক জাগিয়েছিল।
কোয়েরীটোলার দল বাবুসাহেবের বাড়ি পৌঁছে দেখে তাজ্জব ব্যাপার! বাবুসাহেবের ছেলে অনোখীবাবু খড়ম দিয়ে পিটছে বুড়হাদাদাকে। পাশে রাখা রয়েছে এক বোঝা ধানের চারা। বুড়হাদাদা কাঁদছে আর মাথা কুটছে অনোখীবাবুর পায়ে। আর কখনও এ কাজ করব না ছোটামালিক।
সাঁওতালটা বলে, বাঁশি থামলেই উপর থেকে বাবুসাহেব যে চিৎকার করে, আমি ঢুলছি বলে। দেখো, আমি জেগে থাকি কিনা।
তারপরটা সাঁওতালটা এগিয়ে আসে, কোয়েরীটোলার লোকদের কাছে, সারা ব্যাপারটা তাদের বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। বুঝোবার দরকার ছিল না।
সাঁওতালটা হেসেই কুটিকুটি। ছোটা মালিককে নিচে থেকে ডেকেছে, ঘুম ভাঙানোর জন্য। ঘুম কি ভাঙে। ভাং-এর ঘুম। বৃষ্টির পর। ঘুম ভাঙলে পর আমার উপর রেগে টং। আমি যেন কালো গাইটার বাছুর হচ্ছে বলে ডাকছি।
টোলার লোকদের উপর নজর পড়ায়, হঠাৎ বুড়হাদাদার কান্না থেমে যায়। লজ্জায় সে এদিকে তাকাতে পারে না।
অনোখীবাবুর নজর পড়ে এই দিকে। ভাগো ভাগো শালা সব। চোট্টার দল। চোরকে সাহায্য করতে এসেছে। মাঝি [৪৪৪]! এ লোকটাকে ধরে রেখে দাও আজ। সকালে ওটাকে হাজতে পাঠাব।
বুড়হাদাদা আবার হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে।
——
[৪৪১. স্থানীয় প্রথানুযায়ী গাছ থেকে পড়া আম যে পায় তার; গাছের মালিকের নয়। ৪৪২. বৃষ্টি না হলে গ্রামের মেয়েরা মিলে কোনো মাঠে রাত্রে জাটজাট্টিনের পালা অভিনয় করে। পুরুষদের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানের কোনো সম্বন্ধ নেই। গ্রামের পুরুষরা ভাব দেখায় যে তারা এই অভিনয়ের সম্বন্ধে যেন কিছু জানেই না। ৪৪৩. তুলসীদাস থেকে। ৪৪৪. এখানে সাঁওতালদের মাঝি বলে সকলে ডাকে।]
.
মধুবনের শান্তিভঙ্গ
বাবুসাহেবের বাড়ি থেকে, কোয়েরীটোলার সকলে এসে বসে বিল্টার বাড়ির সম্মুখের মাচায়। কাজটা বুড়হাদাদা করেছে অন্যায়। চুরি করা কি ভাল মানুষের কাজ? ছি ছি! এ কি দুর্মতি হয়েছিল বুড়োর। তিনদিন পরে মরবি, এখনও কি পরমাত্মো-কে ভয় করে না? অভাব তোর বুঝলাম। সে তো সবারই আছে। কিন্তু বেশি খিদে পেলে কি লোকে দুহাত দিয়ে ভাত খায় নাকি? অসম্ভব কাণ্ড!
কিন্তু বুড়হদাদার এই বিপদের সময় নিশ্চিত হয়ে ঘুমোন তো যায় না। একটা কিছু করতে হয়। তবু তো এখনও বাবুসাহেব ওঠেননি। রাত থাকতেই ওঠেন বাবুসাহেব। খবর তো রাখিস ছাই। কেবল বাজে ফটফট করিস তুই গনৌরী। এতক্ষণে বারসাহেব উঠে ধ্যানে বসেছে।
লছমনিয়ার নানী বাবুসাহেবের বাড়িতে কাজ করে। সে বলে যে ধিয়ান করবার সময় বাবুসাহেবের ঘরে একেবারে হাওয়াগাড়ির মতো শব্দ হয়। তারপর গলার মধ্যে দিয়ে তিনি দড়ি ঢুকোন পেটে। বাবুসাহেবের ঘরবালী বলেছেন যে, এ করলে জোয়ানী ফিরে আসে; বুড়োরও আবার দাঁত গজায়। তারপর তিনি রাখালদের ডেকে দেন, মোষ চরাতে নিয়ে যাবার জন্য।
অনোখীবাবুই তো খড়মের সঙ্গে বুড়হাদাদার মাথার চুল তুলে নিয়েছে। দেখো আবার বাবুসাহেব কী করে। গুড়ের মাছি না চুষে ফেলে ও চামারটা। লচুয়া চৌকিদারকে ছেড়ে কথা বলে না, ও আবার ছাড়বে বুড়হাদাদাকে! এ কথাটা থানায় গিয়ে বলবার পর্যন্ত হিম্মত হয়নি হাড়ীর বেটার, আর ঘোড়ায় চরবার শখ আছে।
বড় নিরীহ লোকটা বুড়হাদাদা।
হ্যাঁ, তা লচুয়া হাড়ীর কথাই যদি তুললি তবে বলি। তার কাছ থেকেই শুনেছি যে, থানায় আজকাল বাবুসাহেবের টিয়াপাখি কথা বলে না। [৪৪৫] সেই বলেছে যে, দারোগাসাহেব আর বাবুসাহেবের দিকে হতেই পারে না। মোটারকম পান খাওয়ালেও। বাবুসাহেব কাছারীতে মোকদ্দমা লড়ে দারোগা সাহেবের হাত থেকে গরুর গাড়ি ছাড়িয়ে এনেছে।
তাই দারোগাসাহেব বেইজ্জত হয়েছে উপরওয়ালাদের কাছে।
দেখিসনি সেদিন বিল্টা, সেই যে হাকিমের হাওয়াগাড়ি খারাপ হয়েছিল পাক্কীর উপর, গায়ে লোক ডাকতে এল, গিধর মণ্ডলের দাওয়ার উপর খাটিয়াতে বসল; কিন্তু বাবুসাহেবের বাড়ির চৌহদ্দি মাড়াল না। ঠিকই বলে লচুয়া চৌকিদার। কলস্টর হাকিমরা এখন সবাই বাবুসাহেবের বিরুদ্ধে ওর ছেলে লাডলীবাবু মহাৎমাজীতে নাম লিখিয়েছে বলে।
দারোগাসাহেব হাতের লোক না হলে কি কেউ সাধ করে থানার হাতায় ঢোকে। এ দারোগা যতদিন বদলি না হচ্ছে ততদিন বাবুসাহেবেরা থানার পথ মাড়াবে না; এই আমি মাটিতে লোহার দাগ কেটে বলে রাখলাম।
সকলে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচে। যাক, বুড়হাদাদাকে তাহলে সরকারের খিচুড়ি খেতে হবে না। দুচার ঘা মারের উপর দিয়েই যাবে।
এতক্ষণে সবাই অস্পষ্টভাবে বোঝে যে, যদিও তারা এখানে বসেছিল বুড়হাদাদার ব্যাপারটাকে উপলক্ষ করে, মনের তলায় গোপনে আনাগোনা করছিল অন্য জিনিস। মুখে বলেছে বটে, রামচন্দ্রজী বুড়হাদাদাকে ধরা পড়িয়ে আমাদের সাবধান করে দিচ্ছেন বলছেন, ভেবো না যে আমি ঘুমাচ্ছি। অভ্যাসের বশে বলেছে এ কথা, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছে যে, কথাটার মধ্যে কোথাও একটি অসংগতি আছে। মনের মাখন গলানো কথা, আর মনের কথার তফাৎ শুনলেই বোঝা যায়। সেই জন্যই না এক একজনের পণ্ডিতজীর রামায়ণ পাঠ শুনলেই চোখে জল আসে, আর এক-একজনের শুনলে আসে ঢুলুনি।
ভিজে মাটির গন্ধে কারও মনকে সুস্থির হতে দিচ্ছে না। কেউ কথাটা তুললে আর সকলে বাঁচে। সকলেরই মনে পড়ছে নিজের অক্ষমতার কথা, দূরদৃষ্টের কথা। ইচ্ছা করে নিজের জমিটা একবার দেখে আসি এই রাত্রেই। কিন্তু তারপর? বুড়হাদাদার ব্যাপারটার একটা নিস্পত্তি হয়, কিন্তু মনের ভিতরের প্রশ্নের কি কোনো জবাবই নেই? অমন মিষ্টি গন্ধভরা ভিজে ক্ষেত কি অমনিই থেকে যাবে রামচন্দ্রজী? নিজেদের কাছেও যে কথা বলা না যায়, সে কথা বলা যায় তাঁর কাছে।
ভোরের আলোয় দেখা যায় যে এতগুলো চোখের আয়নাতে ভিজে ক্ষেতে ছোপ পড়েছে।
কেশে গলা সাফ করে নেয় ঢোঁড়াই। নিজের কথাগুলোর ওজন বাড়ানোর জন্য উবু হয়ে বসে।
দারোগা, হাকিম, চৌকিদার যখন বাবুসাহেবের খেলাপে, তখন আর ভয়ের কী আছে?
এ আবার কী বলে ঢোঁড়াইটা? ভাবলাম বুঝি কাজের কথা পাড়বে, যে কথাটা মনের মধ্যে কিরকির করছে সকলের, বৃষ্টির পর থেকে। এ বোধ হয় আরম্ভ করল আবার বুড়হাদাদার কথা নতুন করে। বুড়হাদাদা ওকে একটু ভালবাসে কিনা তাই। বুড়হাদাদার একটানা বাজে গল্প, যে বসে শোনে তাকেই বুড়ো ভালবাসে। …না, ঢোঁড়াই টার চোখে মুখে যে একটা হাসির ঝলক দেখছি; দুষ্টুমিভরা হাসির। একটা কিছু মতলব নিয়ে বলেছে নিশ্চয়ই কথা। আরে বলবি তো পরিষ্কার করেই বল না কথাটা। পেয়েছিস দু-দুটো মোসম্মতকে হাতের মধ্যে, নিজের বলতে কিছু নেই এখানে তোর এখন হাসি আসবে না তো কার আসবে? হাজার হলেও পরদেশী। লোক। গাঁয়ের লোকের জন্য মনের ভিতর থেকে দরদ আসবে কেমন করে। মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল বলে এখন। এর মধ্যে আর হাসিমশকরা করিস না রে ঢোঁড়াই। ওসব করিস গিয়ে তোর মলহরিয়াতে, বুঝেছিস ছোঁড়া। সব জিনিসেরই একটা সময় আছে। খিরা, সবেরে হীরা [৪৪৬]। শশাটা পর্যন্ত খাওয়ার সময় আছে।
ঢোঁড়াই চটে যায়, আরে, আরে আমার কথাটা শুনবি তো আগে। তারপর না বলবি। পরদেশী লোকের কথা শুনলেও কি কানে পোকা পড়বে? সবাই মিলে দল বেঁধে চল বাবুসাহেবের ওখানে।
তারপর ঢোঁড়াই পরিষ্কার করে গুছিয়ে নিজের কথাটা বলে সকলের কাছে।
…কেবল মুখের কথায় মালপোয়া ভাজলে কিছু হবে না; এই বলে ঢোঁড়াই নিজের কথা শেষ করে।
দুই-একটা ক্ষীণ প্রতিবাদ শোনা যায়। বন্দুকটাই না হয় সরকার দিনকয়েক আগে কেড়ে নিয়েছে। তাহলেও বাবুসাহেব বাবুসাহেবই। দারোগার হাত থেকে গাড়ি বলদ ছিনিয়ে আনবার হিম্মৎ রাখে এখনও। থাকবে না? অ্যাসেসর যে ও।
রেগে গজগজ করে ঢোঁড়াই; এবার থেকে রোজ জল হবে দেখিস। জলভরা ক্ষেতের ধারে বসে তোরা দাদ চুলকুবি নাকি? আর রামজী এসে তাদের বাল বাচ্চার মুখে দলা গুঁজে দিয়ে যাবেন?
বেঁটে সাঁওতালটা কিন্তু মারকুটে মোষের মতো তাড়া করে আসবে তীরধনুক নিয়ে।
আরে না না, ওটা তো সূয্যি উঠবার সঙ্গে সঙ্গেই ডিউটি সেরে বাড়ি চলে যায়। শেষ পর্যন্ত যেন এই সাঁওতালটার বাড়ি যাওয়ার উপর তাদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নির্ভর করছিল। তবু কি বুকের টিপটিপুনি থামে? বোধ হয় সেটাকে ভুলবার জন্যই সকলে বিল্টার সঙ্গে সুর মিলিয়ে চেঁচায়, রাজরংবলী মহাবীরজী-কি জয়!
ভোরের আলোয় আগুন লেগেছে তখন বিসকান্ধার আকাশে, মাঠের উপরের বটগাছে, ঢোঁড়াইদের চোখে …।
বাবুসাহেব ধানের চারা চুরির ব্যাপারটা রাতেই জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই সময় তাই নিয়ে চেঁচামেচি করেননি। বাড়ির কর্তার কথার ওজন থাকা চাই। সময় নেই অসময় নেই যখন তখন হাঁ-হাঁ করে উঠলে, কিছু মানে লাগায় না [৪৪৭] সে লোকের। ভোরে দাঁতন করবার পর সবে গলার মধ্যে ফিতেটা ঢুকিয়েছেন, হঠাৎ কানে আসে, মহাবীরজী-কি জয়-এর আওয়াজটা। কেমন কেমন যেন লাগল। আজ কোনো পরব তো নেই। মাঠে আবার ব্যাটারা কুস্তির আখড়া খুলল নাকি? ছেলেছোকরারা তো বোঝে না, তর্ক করতে আসে। ইস্কুল আর কুস্তির আখড়া; দুটোই সংস্কার বিগড়োবার যম। তাইতো ছেলেদের বলি যে, ঠেকে শিখবি তোরা। বিনা পূজোয়, মহবীরজীর জয় দেওয়া বড় কুলক্ষণ। চেঁচামেচি এই দিকেই আসছে। মুহূর্তের মধ্যে তিনি বুঝে নেন যে কোয়েরীটোলার লোকেরা, চোট্টাটাকে ছাড়াবার দরবার করতে আসছে। এগুলোকে রামজী সুমতি দেন না কেন? তাঁর রাজ্যে তো চুরি ছিল না। ছেলেগুলো হয়েছে অপদার্থ। একদিন মাত্র বড়টাকে লাঠি তুলতে দেখেছিলাম। তাও দেখি সরু দিকটা নিয়েছে হাতের মুঠোর মধ্যে। এ কি কোদাল পাড়া নাকি? এখনও ঘুম ভাঙেনি। বৃষ্টির পরদিন কোথায় তাড়াতাড়ি উঠে ক্ষেত দেখতে যাবে, ধান রোপার ব্যবস্থা করবে, তা নয় এখনও ঘুমুচ্ছে। দেখি কত ঘুমুতে পারে।… আমি কিছুতেই ডেকে তুলছি না।
বাবুসাহেবের বাড়ির কাছাকাছি এসে ঢোঁড়াইদের দলের উৎসাহ একটু মিইয়ে আসে। দুই-একজনের নিমের দাঁতন পাড়বার কথা মনে পড়ে। যাদের অছিলা জোটে না তারাও পিছনে থাকতে চায়। পরদেশী লোকের কত সুবিধা। না বাবুসাহেবের জমির আধিয়াদারি করে, না কর্জ খায়, না লাঠিযুগের জোয়ান বাবুসাহেবের খবর রাখে। বচ্চন সিং কোথায়? আমরা ভেট করতে চাই তাঁর সঙ্গে।
বাবুসাহেবের সঙ্গে? কেন? দরকার থাকে তো ছোটামালিক এলে তাঁর সঙ্গে মোলাকাত করিস।
আরে বচ্চন সিংই সব- অনোখবাবুকে সামনে রেখে, সেই তো সব কাজ চালায়। বাবুসাহেবের কান খাড়া হয়ে ওঠে। তাঁর দেউড়ীতে দাঁড়িয়ে বলছে বচ্চন সিং। কোনো বুড়ো গলা বলে তো মনে হল না।
তিনি সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ান। তাঁর সম্মুখে কোয়েরীটোলার লোকদের এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবার কথা। ডান-পা দিয়ে বাঁ পায়ের হাঁটুটাকে জড়িয়ে দুহাত জোড় করে দাঁড়ানো জমিদারের সম্মুখে এটা কেবল এ গাঁয়ের রেওয়াজ নয়, এ মুল্লুকের।
অবাক হয়ে যান বাবুসাহেব। আরও অবাক হয়ে যান নিজের সহিষ্ণুতা দেখে।
হুজুর, আমরা এসেছিলাম একটা নিবেদন করতে কোয়েরীটোলা থেকে।
বাবুসাহেবের ইচ্ছে হয় যে বলেন, আমার কাছে আবার কেন? কিন্তু এরা যে জানে, বচ্চন সিং অনোখবাবুকে সম্মুখে রেখে নিজেই কাজ চালায়। তাঁর মনে হয় এ কথাটা খানিক আগে পর্যন্ত এত পরিষ্কার করে জানতেন না। ধরা পড়ে গিয়েছেন তিনি এদের কাছে।
ঢোঁড়াই মনে মনে তৈরি হবার সময় পেয়েছে অনেকক্ষণ। সত্যিই পরদেশী হওয়ার লাভ আছে। হারলে পরোয়া নেই, গাঁ ছেড়ে চলে যেতে হলেও পরোয়া নেই। যেখানে তার শিকড় ছিল, সেখানেই বলে যে, পঞ্চদের সঙ্গে টক্কর দিতে পেছপা হয়নি, তার আবার এখানে সে ভয় পাবে। সেখানে সে হার মেনেছিল জাতের মাথাদের কাছে নয়, সে হার মেনেছিল নিজের মনের একটা দুর্বলতার কাছে। তা নইলে ঢোঁড়াই কখনো কারও কাছে ছোট হয়?
আর যখন সে জানে যে সে রামজীর কাছে কোনো পাপ করছে না, অন্যায় করছে না। দারোগা হাকিমকে সে এখনও ভয় করে। বাবুসাহেব দারোগা, হাকিমের কাছে। আজকাল আর যেতে পারবে না, এটা না জানলে, তার মনের জোর এখন এতটা থাকত কিনা বলা শক্ত।
বাবুসাহেব জিজ্ঞাসা করেন, এই চোট্টাটাকে ছাড়ানোর দরবার করতে এসেছিস নাকি?
না হুজুর, আমরা এসেছি ধান নিতে।
ধান? তুই আবার ধানের বালিস্টর [৪৪৮] হলি কবে থেকে? তুই তো মোসম্মতের ওখানে চাকরি করিস।
ঢোঁড়াই এ কথার কোনো জবাব দিতে পারে না। জবাব দেয় বিলটা। হুজুরই মা বাপ। হুজুরের জুতোর বোঝা মাথায় করে আমাদের দিন চলে। ধান আমাদের আজ চাই-ই ক্ষেতের জন্য।
বাবুসাহেবের মতো লোকও হকচকিয়ে যান, বিলটার গলার স্বরের দৃঢ়তা দেখে। তাতে প্রার্থনার লেশমাত্র নেই। লোক ডাকতে পারেন তিনি এখনই, কিন্তু তাতে কি নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা হবে না। নিজের লোকই বা কজন। সব চলে গিয়েছে। ক্ষেতে। রাখালগুলো এখনও মোষ চরিয়ে ফেরেনি। অনোখীবাবু ঘুমুচ্ছে। তিনি এরকম গলার স্বর কোয়েরীদের মুখ থেকে কখনও শোনেননি। সত্যি করে বুড়ো হয়ে গিয়েছেন তিনি। নইলে এই সামান্য ব্যাপারে কোনো একটা হুকুম দেওয়ার আগে, এত সাত-পাঁচ কথা মনে আসবে কেন?
বাবুসাহেবের কথার জবাবটা সময়মতো মনে জুগোয়নি। নিজের উপর রাগ হয় ঢোঁড়াই য়ের।
ঢোঁড়াইরা গোলার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে আমরা গোলা থেকে মেপে ধান বার করে নিচ্ছি। এক ছটাক ধানও এদিক ওদিক হবে না। সকলের নাম লিখে রাখুন গোমস্তাজী। সকলে টিপসই করে দেবে। ধামা আছে আপনাদের? আপনিই গুনে দেন গোমস্তাজী। এক এক করে। সকলে একসঙ্গে ভিড় কোরো না।
বাবুসাহেবকে আর বেশি ভাববার ফুরসত দেয়নি। রাগে বাবুসাহেবের নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছা করে। হতভাগা লাডলীটা গঞ্জের বাজারে কাপড়ের দোকানের সম্মুখের মহাৎমাজীর হল্লা না করলে আজ এ হতে পারত না। এতক্ষণে এখানে বন্দুক চলে যেত, তারপর ঘোড়াতে চড়ে বাবুসাহেব নিজে যেতেন থানায়। নিজের লাঠির উপর তিনি আর ভরসা পান না। তবু তার একটা সম্ভ্রম আছে গাঁয়ে। ছোট যা হবার তা হয়েছেন।
গোলার টোপরটা খুলে উপর থেকে নে ধান। রাতে জল পড়ছে ধানে, পুরনো টোপরটার মধ্যে দিয়ে। ওটাকে নামিয়ে রাখিস, মেরামত করতে হবে। ধানগুলো একটু রোদবাতাসও পাক।
একটা উদারতার খোলস পরিয়ে বাবুসাহেব নিজের সম্মানটুকু বাঁচিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। তিনি বোঝেন যে কথাগুলোয় কাজ হল না। ব্যাটারা বোঝে সব। থাকে অমনি চুপ করে। তবু মনকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করতে হয়।
চোখের সামনে এই ধান ওজন তিনি আর দেখতে পারেন না।
গোমস্তাজী, তুমি লিখে রাখো সবার নাম। এই বলে বাবুসাহেব গোয়ালঘরের দিকে চলে যান। ধান দেওয়া-নেওয়ার মতো তুচ্ছ মামুলি ব্যাপারে মাথা ঘামানোর তাঁর সময় নেই, এমনি একটা ভাব দেখিয়ে যান।
গোয়ালঘরে গিয়েও নিস্তার নেই। সেখানেও মূর্তিমানরা গিয়ে হাজির। কী আবার? যতদূর সম্ভব কড়াভাবে বাবুসাহেব জিজ্ঞাসা করেন। বলতে চেয়েছিলেন কত জোরে! কী রকম আস্তে হয়ে গেল।
ধানের কিছু চারাও চাই হুজুর সকলের। এবারে ঢোঁড়াই জবাবটা সব ঠিক করে রেখেছে। বলুক আবার বাবুসাহেব বালিস্টার তাকে।
আমার নিজের ক্ষেতে পুঁতবার জন্যও কিছু রাখিস তা বলে। লচুয়া চৌকিদারটাও অন্তত আজ যদি তাঁর মধ্যে থাকত। এ কথাটুকু ভেবেও বাবুসাহেব একটু সান্ত্বনা পান মনে। বার্ধক্যের জন্য তাহলে তাঁর আজকের এই দুর্বলতা নয়; ও একটু ভুল সন্দেহ হয়েছিল তার মনে। রাজপুত কেবল যে লাঠি চালাতে জানে তা নয়। দরকার হলে ভূমিহারী চাল [৪৪৯] সেও দেখাতে পারে। টিপসইগুলো নিল তো গোমস্তাজী ঠিক করে।
পড়া দাঁতের ফাটায় বাবুসাহেবের জিভটা কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে।
———-
[৪৪৫. দিন গিয়েছে। ৪৪৬. শশা সকালে হীরা। ৪৪৭. গ্রাহ্য করে না। ৪৪৮. ব্যারিস্টার। ৪৪৯. ভূমিহার ব্রাহ্মণদের এ অঞ্চলে সর্বাপেক্ষা কুটিল বলে অখ্যাতি আছে। (শব্দার্থ) ভূমিহার ব্রাহ্মণদের কূটনীতি।]
.
বাবুসাহেবের কটক সঞ্চারণ
এর পর থেকে কোয়েরীদের সঙ্গে বাবুসাহেবের লড়াইটা জমল বেশ ভাল করে। এত বড় আস্পর্ধা! রাজপুতদের বাড়ির বাসন মেজে যাদের সাতগুষ্টির জন্ম গেল, তারা শাসায় বাবুসাহেবকে। চুরি করে চোখ রাঙ্গায়। গোমস্তাজীর উপর হুকুম চালায়। এ বরদাস্ত করবার পাত্র বচ্চন সিংকে পাওনি। স্নানের পর বাবুসাহেবের তিলক কাটবার তর সয় না। আঁচানোর পর হাতের উলটো পিঠ দিয়ে সাদা গোঁফ জোড়াকে সাজিয়ে নিতে ভুল হয়ে যায়। সাবেককালের মতো বৈঠকখানার বারান্দায় এসে তিনি আবার বসতে আরম্ভ করেন।
এ হল কী কালে কালে! ইংরাজের রাজত্ব আবার চলে গেল নাকি, মহাৎমাজীর দু ফোঁটা নুনের ছিটেতেই। অনোখীবাবুর ঘুম ভাঙেনি নাকি এখনও?
যা শিগগির ছোট মালিককে ডেকে নিয়ে আয়।
গোমস্তাজী তটস্থ হয়ে ওঠে। বাবুসাহেবের এ চেহারা তার অপরিচিত নয়। এখনই তিনি বার করতে বলবেন, পুরনো আঙুলের ছাপ দেওয়া কাগজগুলো। একটার পর একটা উদ্ভট ফরমাস আরম্ভ হয়ে যাবে। বুড়ো হয়ে মেজাজটা আগের চাইতেও খিটখিটে হয়ে উঠেছে।
পুরনোগুলো নয়। বাবুসাহেব ধানের দরুন নেওয়া আঙুলের ছাপগুলো দেখতে চান। দাগগুলো ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া লাগছে।
গোমস্তাজী, সব কাজে তোমার হড়বড় হড়বড়।
আবার কী হল! গোমস্তাজী মাথা চুলকোয়।
ও! না!
কাগজটা দূরে ধরলে দাগটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কথাটা জোরে বলে তিনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছেন। সুচে সুতো পরাতে তিনি নিশ্চয়ই পারেন এখনও। বহুকাল পরে কাগজে হাত দিয়েছেন কিনা!
গোমস্তাজী, রাখালরা ফিরেছে?
হা হুজুর।
বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে ইশারাই যথেষ্ট। গোমস্তাজী আঙুলের ছাপ দেওয়া কাগজগুলি নিয়ে যায় যেখানে মোষগুলো বাঁধা থাকে খুঁটিতে, অধিকাংশের গায়ের কাদাই এখনও শুকোয়নি। একটা শুকনো গোছের গা দেখে গোমস্তাজী সেইটার উপর ঘষে, একটু ময়লা ময়লা করে নেয় কাগজগুলোকে। বারসাহেবকে আর সে কথা খরচ করবার। তকলিফ দেবে না। কাগজগুলো আর কী লিখবে সেইটা খালি একবার জিজ্ঞাসা করে নেবে। বাস! আর কিছু না। এতদিন ধরে বাবুসাহেবের খিদমৎ করেছে সে। বাকি সব কাজ তার জানা। কাজও তো ভারি! চিনিগোলা জল খানিক খানিক কাগজগুলোর উপর এখানে-সেখানে লাগিয়ে দেওয়া। তারপর পিঁপড়ে গেলে, বাঁশের চোঙার মধ্যে ভরে খুঁজে রেখে দিতে হবে রান্নাঘরের বাতায়। ভূসির মধ্যে রাখার চাইতে এতে জিনিসটা হয় অনেক ভাল।
গোমস্তাজী আবার যখন বৈঠকখানায় ফিরে এল, তখন বাবুসাহেব অনোখীবাবুর সঙ্গে কথা বলছেন। ছোট মালিক আবার দেখছি বাবুসাহেবের সামনে তক্তপোশের উপর বসেছে। বয়স তো হল। চুল পাকবে দুদিন পরে। এখনও বসবে না।
এস গোমস্তাজী, তুমিও শোন।
অনোখীবাবু, আপনি চলে যান জিরানিয়ায়। অনিরুদ্ধ মোক্তারের সঙ্গে সলা করে জোতের কোয়েরী রায়তগুলোর উপর বাকি দররৈয়ত আধিয়াদার। [৪৫০] যেখানে পারেন এইগুলোর জায়গায় সাঁওতালটুলির লোকদের ঢোকান। ঐ যে নতুন লোকটা ঢোঁড়াই না কী নাম, ওটা ফেরারী-টেরারী নয়তো? বাড়ি যাওয়ার নাম করে না এক দিনও। এটাই বোধ হয় উসকারি দিচ্ছে সকলকে। মোসম্মত যে রায়ত রাজপারভাঙার। আমার হলে না হয় একটু চাপ দিলেই লোকটাকে সরিয়ে দিত। এ সম্বন্ধে অনোখীবাবু আপনি একবার রাজপারভাঙার তশীলদারের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। গোমস্তাজী, আপনিও যাবেন। বাবুসাহেব জানেন যে, গোমস্তাজী সঙ্গে না থাকলে, এসব কাজের থই পাবেন না অনোখীবাবু।
এতক্ষণে গোমস্তাজী কথা বলবার সাহস পান। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পাউন্ডকীপার ইনসান আলি হাতের লোক। বাবুসাহেবের টাকা দিয়েই সে খেয়াড় নিয়েছে, নিলামে ডেকেঅ মোসম্মতের ক্ষেতে গরুমোষ রাতে ছাড়লেই তিন দিনের মধ্যে কাবু হয়ে যাবে। হুজুর, ঝোলাগুড় দিয়েই ওঠেন গোমস্তাজীকে। কেবল কথা! যা দরকার বুঝবে করবে। তা নিয়ে এত কথা কিসের?
কোয়েরীরা রাজপুত বচ্চন সিংকে চুনৌতি [৪৫১] দিয়েছে। বড় বাড় বেড়েছে। কোয়েরীগুলোর! গাঁয়ের অন্য রাজপুতরা সকলেই এই ব্যাপারে বাবুসাহেবকে যথাসাধ্য সাহায্য করতে প্রস্তুত আছে। তাই ছোট মালিক পরের দিন থেকে ভাঙের শরবতের ভাঁটি খুলে দিতে আরম্ভ করেন প্রত্যহ সন্ধ্যায়। শরবতের লোটা তাদের দিকে ঠেলে দিয়ে ছোট মালিক তাদের হেসে আপ্যায়িত করেন। জাতবেরাদারদের খোঁজখবর নিয়মিত নেওয়ার ইচ্ছা তাঁর চিরদিনই: রাজপুতই রাজপুতের গতি তা সে চান্দেলাই হোক, আর বুন্দেলাই হোক: আর কিছু না হোক, ভালবাসা বলে একটা জিনিসও তো আছে পৃথিবীতে। হে- হে- হে।
যারা বীরাসন হয়ে বসতে ভুলে গিয়েছিল তারাও ভুলটা শুধরে নেয়।
যবে থেকে পৈতে নিয়ে ছত্রি হয়েছে, তবে থেকে তেল বেড়েছে হারামজাদা কোয়েরীগুলোর।
তেল বলে তেল।
বুঝলেন ছোটামালিক, ছোটলোকদের মাথায় চড়িয়েছে লাডলীবাবুরা। নুনিয়ারা মাথায় টুপি লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভালা আদমীদের [৪৫২] সম্মুখে।
আরে নুনিয়ার কথা ছেড়ে দে গজাধর সিং। জেলে মুচি চামারের ছোঁয়া কি আর খাচ্ছে না লাডলীবাবু।
হ্যাঁ, তোর তো জেলের সব হালতই জানা আছে লছমপৎ সিং।
লছমপৎ সিং একবার ঘোড়া চুরি করে জেলে গিয়েছিল। বাপের বেটা হোস তো চলে আয় বলে লছমপৎ সিং গজাধরের গলায় টুটি চেপে ধরে।
সকলে মিলে তাদের ছাড়িয়ে দিলে দুজনেই বলে যে, বাবুসাহেবের বাড়িতে না হলে আজ একটা কাণ্ড হয়ে যেত এখানে।
আর কিছু না থাকুক মোহব্বত [৪৫৩] বলেও তো একটা জিনিস আছে পৃথিবীতে। কোনার দিককার কার যেন নেশাটা জমে এসেছে। সে বলে, তোরা কি আর পারবি কোয়েরীদের সঙ্গে লড়তে। ওগুলো এঁটো ধোয়ার সেপাই।
এক হাতে থালার ঢাল আর এক হাতে ঝাঁটার তরোয়াল দিয়ে বসিয়ে দেন ওদের একটাকে আপনার বদমাশ ঘোড়াটার পিঠে। তারপর ছোটামালিক চাবুক মারুন ঘোড়াটাকে সপাসপ।
ভাঙের উপর এই সূক্ষ্ম রাজপুতী রসিকতার দমকে ঘরসুদ্ধ সকলে হেসে গড়িয়ে পড়ে।
বুঝলেন, অনোখীবাবু, মেয়েমানুষ বুকে টানে সুখের সময়, আর জাতে বুকে টেনে নেয় বিপদের সময়।
তা তো বটেই! মোহব্বত বলে তো একটা জিনিস আছে পৃথিবীতে।
———
[৪৫০. রায়তের অধীনে ভাগচাষী। জোতদারের অধীনে ভাগচাষী হলে কতকগুলি সুবিধা পাওয়া যায়। ৪৫১. Challenge, যুদ্ধে আহ্বান। ৪৫২. নুনিয়ারা মাটি কাটার কাজ করে। আগে এরা মাটি থেকে সোরা বার করার কাজ করত। গ্রামে ভাল আদমী অর্থাৎ ভালো লোক-এর অর্থে বড়লোক। ৪৫৩. ভালবাসা, টান।
.
ঢোঁড়াইয়ের অমৃত ফল লাভ
কোয়েরীরাও বসে থাকে না। রাজপুতদের মাটিতে কাটা লোহার দাগ মুছে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে লড়াইয়ে। [৪৫৪] কিছুদিনের মধ্যে কী নিয়ে ঝগড়ার আরম্ভ সে কথা সকলে ভুলে যায়। আর কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা জানেন কেবল মহাবীরজী। কিন্তু ঘটনার স্রোতের প্রতিটি ঢেউ নেওয়া চাই কোয়েরীটোলার প্রতিটি লোকের।
বাধা না পেলে ঢোঁড়াইয়ের আসল রূপ খোলে না। তাই কী করে যে সে এর মধ্যে জড়িয়ে পড়ে, তা সে নিজেই বুঝতে পারে না; বুঝতে চেষ্টাও করেনি বোধ হয়। এই টক্কর দেওয়ার সাধ বড় মিঠে। মধুর মতো। মাছি জড়িয়ে পড়বে জেনেও তাতেই বসে।
যে রায়তগুলোর উপর বাকি খাজনার নালিশ করেছে বাবুসাহেব সেগুলো হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ায় এখানে-ওখানে। পাশের গায়ের রামনেওয়াজ মুন্সি জিরানিয়ার কাছারীতে মুহুরিগিরি করে। এক রবিবারে দলের সঙ্গে মুন্সীজীর দুয়োরে ধরনা দেয়। আশপাশের গাঁয়ের বহু লোক তার আগেই সেখানে গিয়ে ভিড় জমিয়েছে।
ভারি চোখা বুদ্ধির লোক মুন্সিজী। বালিস্টরকেও হারিয়ে দেয়; নইলে কি আর চশমা পরবার হক পেয়েছে মাঙনা।
বিল্টা কনুই দিয়ে খোঁচা দেয় ঢোঁড়াইকে ঐ শোন না কী বলছে।
রামনেওয়াজ মুন্সি তামাক টানার ফাঁকে ফাঁকে নির্লিপ্তভাবে বলে চলেছে।–সেবার যুদ্ধের সময় জিরানিয়ায় টুরমনের তামাসা [৪৫৫] হয়েছিল না? সেই সময় অনেক টাকা উঠেছিল। তাই দিয়ে কমিটি কিনেছিল বার-এর কাগজ [৪৫৬]। সেই টাকা সুধে আসলে সাত লাখ হয়েছিল। কলস্টর সাহেব অংরেজের বাচ্চা। বললে যে এই টাকা দিয়ে জিরানিয়া জেলার চাষবাসের উন্নতি করতে হবে ফরাম [৪৫৭] খুলে। জিরানিয়ার পুরুবে ঐ বকরহাট্টার মাঠ আছে না, সেই মাঠ কেনা হয়েছে এ টাকা দিয়ে। তারই খেলাপে বিজনবাবু ওকিল তাৎআটুলির পাবলিকের তরফ থেকে আর্জি লিখে দিয়েছিল। বিজনবাবু বলে যে, এটা পাবলিকের গরু চরাবার জায়গা চিরকাল থেকে। পাবলিক নিমক তৈরি করেছিল মরণাধারের কাছে। অনিরুদ্ধ মোক্তার আর্জি দেখেই তো ঢোক গিলে, টাক চুলকে অস্থির। তখন ডাক পড়ল রামনেওয়াজ মুন্সির। সার্ভে খতিয়ান মক্কেলের দিকে, শিমুলগাছ কাটার সাক্ষী রয়েছে হাতে; দিলাম জবাব হেনে ঠুকে। পাটনার ঢাইকোর্ট পর্যন্ত বাহাল থেকে গেল, আমার লেখা জবাব। এই তো গত হপ্তায় এসেছি পাটনা থেকে। খালি বিজন ওকিল কেন, ঢাইকোর্টের হাসান ইমান বলিস্টর পর্যন্ত পুটুর পুটুর তাকাতে থেকে গিয়েছিল।…
কোয়েরীটোলার দল ভারি দেখে মুন্সিজী চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে নেয়। কান থেকে কলমটা নিয়ে খুশখুশ করে একটা হিসাব লিখে দেয়, বাবুসাহেবের সঙ্গে মোকদ্দমা করবার খরচের। প্রথম দিনই লাগবে ছাব্বিশ টাকা। লম্বা তারিখ চাও তো আরও চার টাকা বেশি। …না না, এক পয়সা কম হবে না। রামনেওয়াজ মুন্সির কাছে দরদস্তুর নেই। ঐ এক কথা। সস্তার কাজ চাও, জেলায় অনেক উকিল মোক্তার আছে। রামনেওয়াজ মুন্সির কাছে কেন? তোমরা খরচ করতে না পার, বাবুসাহেব লুফে নেবে, রামনেওয়াজ মুন্সিকে। তোমরাও যেমন পাবলিক, বাবুসাহেবও সেই রকম পাবলিকের বাইরে নয়।
ঢোঁড়াইয়ের মন চায়, মুন্সিজী বকরহাট্টার মাঠের, তাৎমাটুলির কথা আরও বলুক। কিন্তু আর কি বলবে মুন্সিজী। লোকটা আর একটু কম বুদ্ধিমান হলেই ছিল ভাল। তাহলে হয়তো বিজন ওকিল বকরহাট্টার মাঠটাকে বাঁচিয়ে নিতে পারত ঢাইকোর্টে।….
গাঁয়ে ফিরে এসে টাকার যোগাড় আর হয় না। যাদের নামে মোকদ্দমা নেই তারা কেন পয়সা খরচ করবে। এ কি বিদেশীয়া-র গান না, ছকরবাজি নাচ। এ টোলার পঞ্চায়েতের মোড়ল গিধর মণ্ডল। ঝাড় মার! ঝাড় মার! ও যাবে বাবুসাহেবের বিরুদ্ধে? তাহলে আর আমরা গোড়া ছেড়ে, পাতায় জল দিতে যাই।
কষ্টেসৃষ্টে এক টাকা বারো আনা যোগাড় হয়। ঢোঁড়াইয়ের মনটা খারাপ হয়ে যায়। তারই শলা অনুযায়ী বাবুসাহেবের ধান আনা থেকেই, এই ঝগড়া পর্বের পত্তন। আর সে কিছু সাহায্য করবে না মোকদ্দমার খরচ দিয়ে? তার নিজের বলতে একটা পয়সাও নেই। কোমরের নেংটি, আর মুখে দানা রামজী তার জুটিয়ে দিয়েছেন। ভেবেছিল তার জীবনে পয়সা দরকার হবে না। কিন্তু মহাবীরজী গন্ধমাদন পর্বত মাথায় নিয়েছিলেন, সে কি নিজের খাওয়া-পরা জোটেনি বলে?
ঢোঁড়াই মোসম্মতের কাছে মোকদ্দমার খরচের টাকার কথা তোলে। মোসম্মত চোখ কপালে তুলে চিৎকার করে।
তাদের বাবারা কি বাঁশের কেঁড়েতে করে আমার কাছে টাকা আমানত রেখে গিয়েছিল? ওরে আমার হিতৈষী রে! আমার বরাতে কি সব কটাই এমনে লোকই জোটে।
মরমে মরে যায় ঢোঁড়াই। গিধর মণ্ডল যে চার আনা করে মাইনে ঠিক করে দিয়েছিল অন্তত সেটাও যদি মোসম্মত দিত! কিন্তু একথাটা কি বলা যায় মোসম্মতের কাছে। ঘুম আর আসতে চায় না, সে রাতে ঢোঁড়াইয়ের।
মোসম্মত এমন করে মুখ ঝামটা দেবে, তা ঢোঁড়াই আশা করেনি। যে লোকটা মাইনে নেয়নি একপয়সাও তাকে এমনি করে কথা শোনাতে একটু সংকোচও হল না। সাগিয়াও সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সেও তো মাকে কিছু বলতে পারত। কিন্তু মোসম্মতের কথাটা অন্যায্য নয়। তাই এ নিয়ে রাগ করা চলে না তার উপর।
ঘুম না এলেই মাচার ছারপোকাগুলো জ্বালাতন করে। আজকাল সজাগ হয়ে থাকাই ভাল। এই তো গত হপ্তায় খুঁটি থেকে মোষ খুলে নিয়ে গিয়ে পুরেছে খোঁয়াড়ে। নিশ্চয়ই ইনসান আলি পাউন্ডকীপারের কাণ্ড। নিজে হাতে ঢোঁড়াই বেঁধেছিল। খোয়াড় থেকে ছাড়াতে গিয়ে দেখে বইয়ের পাঁচ দিন আগের পাতায় লেখা আছে। পাঁচ দিনের চার্জ লেগে গেল মিছামিছি। এসব কার কাণ্ড তা কি মোসম্মত বুঝতে পারছে না? তবুও মোকদ্দমার জন্য দুটাকা সাহায্য করল না।
তার উপর উজাড়-এর [৪৫৮] পালা চলছে গাঁয়ে কিছুদিন থেকে। ঘোড়ার খাওয়া দেখলেই চেনা যায়। গড়-মোষের খাওয়া একেবারে আদেখলে হাভাতের সাপটে মুড়িয়ে খাওয়া। আর ঘোড়ায় খায় কে উলটে পালটে; ফররুর করে নিঃশ্বাস ফেলে ধুলো উড়িয়ে পাতার ভগাগুলো খায়। ঠিক যেন কাঁচি দিয়ে হেঁটে দিয়েছে। ঘোড়ার খাওয়া মানেই রাজপুতের কাণ্ড। রাজপুতরা ছাড়া আর ঘোড়ায় চড়ে কে গাঁয়ে। ঐ চড়তে গিয়েছিল একদিন লচুয়া হাড়ী।…
সেই ছোটবেলায় ঘোড়ায় চড়া রাজপুতুর বিজা সিং মেঘের মধ্যে দিয়ে উড়ে চলে যেত… মরনাধারে বেলেমাছের ভুড়ভুড়ি কাটার ঢেউয়ে কোথায় সে ছায়া মিলিয়ে যেত…
মিষ্টি চিন্তার আমেজে ঢোঁড়াইয়ের চোখের পাতা বুজে আসছিল।… হঠাৎ ও কী কাপড়ের খসখসানির শব্দ না। একটা ছায়া নড়ল যেন ঘরে? ইনসান আলীর ভাড়া করা লোক নয়তো? মাচার পাশে রাখা বল্লমখানা শক্ত করে ধরে ঢোঁড়াই।
কে?
হাতভরা গালার চুড়িগুলোর খটখট করে শব্দ করে ওঠে।
আমি, আমি! চুপ!
সাগিয়া।
কেন যেন, ভয়ে ঢোঁড়াই ঘেমে উঠে।
এইটা রাখ ঢোঁড়াই।
অবাক হয়ে যায় ঢোঁড়াই। কী!
টাকাকড়ি তো আমার কাছে থাকে না। সে মা কোথায় বাতায় গুঁজে রাখে, আমাকে জানতেও দেয় না। আমার গহনাগুলো দেওর এ বাড়িতে আনতেই দেয়নি। এইটাই কেবল আমার আছে? মোকদ্দমার খরচ করিস।
জিনিসটা কী ঢোঁড়াই আঙ্গুল দিয়ে ঠাহর করবার চেষ্টা করে।
না, করিস না ঢোঁড়াই
বিরাট গলা খাকার দিয়ে ইঁদারাতলার দিকে থেকে ধ্বনি ওঠে হহা হৈ… ঘরবালা জাগো-ও-ও-ও হৈ।
একেবারে চমকে উঠেছে দুজনে।
লচুয়া চৌকিদার কোয়েরীটোলার দিকে পাহারা দেওয়া বাড়িয়েছে কিছুদিন থেকে। না হলে গরিবমার হয়ে যাবে। একবার ধরতে পারলে ও ঐ মুসলমান পাউন্ডকীপারকে খাট্টা খাইয়ে ছাড়বে!…
বাড়ির ভিতর থেকে মোসম্মত কেশে চৌকিদারকে সাড়া দেয় যে, সে জেগেই আছে।
অন্ধকার ঘরে মায়ের খাটের তলে বেশ একটু শব্দ করেই লোটাকে রাখে সাগিয়া।
———
৪৫৪. লোহার দাগ মোছার অর্থ to accept challenge. ৪৫৫. District Way Tournament ১৯১৭ সালে জিরানিয়ায় হয়েছিল। ৪৫৬. বার-ওয়ার লোন। 8৫৭. Agricultural Demonstration Farm. ৪৫৮. গরু মেষকে নিয়ে অপরের ক্ষেতের ফসল খাইয়ে দেওয়া।]
.
কোয়েরীদের ধর্মাধিকরণে গমন
ঢোঁড়াই সাগিয়ার দেওয়া জিনিসটা প্রাণে ধরে বেচতে পারে না। জিনিসটা পাকানো সুতোর গোছা দিয়ে গাঁথা একটা মালা। ছোট ছেলের গলার। মালা মানে, তাতে রয়েছে দুটো চাঁদির টাকা। একটা রামচন্দ্রজীর টাকা। তীরধনুক কাঁধে দুই ভায়ের ছবি দেওয়া। আর একটা ফারসি লেখা সিক্কা। অতি পরিচিত জিনিস। হিন্দু মুসলমান কোনোরকম ভূত দানো নজর দিতে পারে না, এই মালা ছেলের গলায় থাকলে। যাদের পরমাত্মা দুধ-ঘি খাওয়ার মুখ দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, তাদের ছেলেমেয়েরা এমনি মালা গলায় পরে।
ঢোঁড়াই বোঝে এ জিনিসের দাম কত সাগিয়ার কাছে। কতদিন গল্পে গল্পে ছেলেটার কথা বলে ফেলে সাগিয়ার চোখের পাতা ভিজে উঠেছে। তাকে পরমাত্মা ঐ একটাই দিয়েছিলেন। তিন বছরের দামাল ছেলের চলে যেতে তিন দিনের জ্বরেরও দরকার হল না। জ্বরের সময় মাকে চিনতে পর্যন্ত পারেনি এক পলকে তরে।…
সে সময় ঢোঁড়াই কী বলে সাগিয়াকে সান্ত্বনা দেবে ভেবে পায়নি। ইচ্ছা করেছে তার মাথার চুলের মধ্যে দিয়ে আঙুল চালিয়ে, তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে। ইচ্ছে হয়েছে। বলে, কাঁদিস কেন সাগিয়া? মনে হয়েছে যে, আসল লোকসান সেই ছেলেটার, যেটা চলে গিয়েছে। এমন মা পেয়েছিলি!
আরও কত কী কথা ঢোঁড়াই সে সময় ভেবেছে। কিন্তু বলার সময় আনাড়ীর মতো বলেছে, ছেলে কি কখনও মরে, সোনা কি কখনও জ্বলে ছাই হয়ে যায়? কারও ছেলে মরলে এই বলাই নিয়ম। তবু এর সুরের গভীরতা সাগিয়ার অপ্রত্যাশিত মনে হয়েছে। নিজে এ ব্যথা না বুঝলে এত দরদ কি কারও আসে! ছেলের মা হলেও না হয় কথা ছিল। তার কোল-খালি করা ছেলের জন্য এত ব্যথা এই লোকটার!
হঠাৎ ঢোঁড়াই অনুভব করেছে যে সাগিয়া তার দিকে তাকিয়ে; তার মুখচোখের মধ্যে কী যেন খুঁজছে।
একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে ঢোঁড়াই বলে ফেলেছে, যার জিনিস, তিনিই ফিরিয়ে নিয়েছেন।
সাগিয়া হাতে করে দিল বলেই কি ঢোঁড়াই ঐ মালাটা রাজপুতদের সঙ্গে জেদাজেদিতে খরচ করে দিতে পারে? আবার ফিরিয়ে দিলেও সাগিয়া দুঃখিত হবে। কথা তো বেশি কিছু বলবে না, কিন্তু তার চোখের কোণে জল এসে যাবে, সে কথা ঢোঁড়াই বেশ জানে। তাই মালাটাকে নিজের কাছেই রেখে দেয় ঢোঁড়াই। সে মনে মনে বোঝেছে যে, এটা তার খাতিরেই দিয়েছে সাগিয়া।
গঞ্জের বাজারের নৌরঙ্গীলাল গোলাকার লোক ভাল, কোয়েরীটোলার লোকদের আঙুলের ছাপ নিয়ে সাতটা টাকা দেয়। ছাপ না নিয়ে আর উপায় কী।
সাত টাকায় না-ই রাখতে পারলি রামনেওয়াজ মুন্সিকে। অনিরুদ্ধ মোক্তারও একটা কেউকেটা লোক নয়। জলদি করতে হয়। পরশু আবার বাবুসাহেব গিয়েছে অ্যাসেসরীতে। হাকিমকে দিয়ে কী করাচ্ছে কে জানে।
অগত্যা অনিরুদ্ধ মোক্তারের অনুযায়ীই কোয়েরীরা কাজ করে। তাঁর এক কথা সন কি লুটিস কখনও নিও না। বাস। আর কিছু করতে হবে না।
দুই পক্ষকেই মোকদ্দমার শলা দেয় নিদ্ধ মোক্তার। জিরানিয়ার তনি মোক্তারের শলা নিতে কোয়েরীরা গিয়েছিল কাছারিতে। রামনেওয়াজ মুন্সিই তাদের সঙ্গে যেচে কথা বলে সেখানে।
আরে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন তোরা। বচ্চন সিংও কদিন থেকে আমার বাড়িতে আসে। ও আমার কাছে এসেছে তোদের খেলাপের মোকদ্দমার তৰিরে নয়। ও এসেছে অন্য কাজে। ওর নাম সেসরের ফিরিস্তি [৪৫৯] থেকে কেন যেন হেঁটে দিয়েছে। পেশকারসাহেব অ্যাসেসরিতে ওর নাম আবার ঢুকানোর জন্য চায় দুশ টাকা। কিন্তু বচচন সিংটা এমন হাড়কঞ্জুস যে পেশকার সাহেবকে পঁচিশ টাকার বেশি খুশী করতে রাজী না। আমি বলি যে, ওয়াজিব খরচ করতে পেছপা হলে চলবে কেন। নিজে গাড়োয়ান আর দুটো বলদ, সব মিলিয়ে বোধ হয় পঁচিশ টাকার খেয়েছে। এই কদিনে, তবু ন্যায্য খরচ করবে না। কাজের মধ্যে তো রাতে আমার বাড়িতে ঘুমনো। আর সারাদিন ইরমনের ফারমের [8৬০] মরণাধারে ক্ষেতে জল সেচবার পাম্প বসিয়েছে না, সেখ নে বসে বসে চীনাবাদামের ক্ষেত দেখা। বেশি চালাক কিনা? রাজপুত বুদ্ধি আর কত হবে!
বাবুসাহেব তাহলে বলো আর সেসর নেই? তবে যে সেদিন অংরেজী কুর্তার [৪৬১] উপর পাটকরা ভাগলপুরী চাদর কাঁধে ফেলে শ্যাম্পনিতে এল? কোয়েরীটোলার মধ্যে দিয়ে আসবার সময় চেঁচিয়ে পিছনের হরবংশ সিং সেপাইটাকে বলল যে ছ-সাত দিন লাগবে এ অ্যাসেসরীটায়। এর মধ্যে পচ্ছিমটোলার ক্ষেতটা যেন তোয়ের হয়ে থাকে!
আমি যে বলছি যে, ওর অ্যাসেসরী নেই, সেটা আর কিছু না, ও কী বলল সেইটাই বড় হল? মুন্সিজী চটে ওঠে, এই মুখ গেঁয়েগুলোর উপর।
কারও দেওয়া গালাগালি এর আগে কখনও এত ভাল লাগেনি কোয়েরীদের। এটা বুড়হাদাদার গালাগালির চাইতেও মিষ্টি। ঢোঁড়াই টাও এল না। এলে এখন জমত? তারপর মুন্সিজী কাজের কথা পাড়ে, তোরা হাজির হয়ে যাবি নাকি মোকদ্দমায়? কত টাকার যোগাড় করেছিস? উঠেছিস কোথায়?
এখনও টাকার যোগাড় হয়নি, বলে বিল্টারা কোনোরকমে সেদিনকার মতো কথাটা এড়িয়ে যায়।
তারপর গাঁয়ে ফিরে এসে বিল্টারা গান বাঁধে।…
আজকাল মুন্সিজীর কুঠরীতে জজসাহেবের কাছারি;
নড়বে নাকো বচ্চন সিং মুন্সিজী পা ছাড়ি;
কোথায় গেল কুর্সি এখন, কোথায় গেল সেসরী?…ওরে বিদেশী!
——-
[৪৫৯. জজসাহেবের অফিসের অ্যাসেসরদের নামের তালিকা। 8৬০. Tournament Agricultural Farm। ৪৬১. কোট।]
.
গিধরের সহিত বাবুসাহেবের মিতালি
বাবুসাহেবের সঙ্গে গিধর মণ্ডলের হঠাৎ ইদানীং একটু গলাগলি হবার কারণ ছিল। থানার চৌকিদার কিছুদিন আগে হাটে হাটে ঘণ্টা বাজিয়ে বলেছিল, কবে যেন গঞ্জের বাজারে সভা হবে। কিসের না কিসের সভা হবে, থানা-পুলিশের ব্যাপার। যা দিনকাল! কেউ আর তা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। কেবল খবর রাখত গঞ্জের বাজারের লোকেরা। মুল্লুক জুড়ে আমনসভা [৪৬২] হচ্ছে থানায়। দারোগাসাহেব ভিতরে ভিতরে ঠিক করেছে, এ থানার আমনসভায় সভাপতি করবে রাজপারভাঙার সার্কেল ম্যানেজারকে। তারই মিটিন হবে। থানা আমনসভার নিচে পরে হবে গ্রাম আমনসভা।
মিটিনের সময় নৌরঙ্গীলাল গোলাদারের খাদীপরা ছেলে ভোপতলাল করে বসল এক কাণ্ড! ছোকরা পড়ত ভাগলপুর। সেখান থেকেই মহাৎমাজীর আন্দোলনে তিন সাল হয়ে এসেছ। মিটিনে সে উঠে প্রস্তাব করে যে, যার আয় একশ টাকার উপর সে যেন আমনসভার মেম্বর না হতে পারে। সকলে তো অবাক। বলে কী ছোকরা।
বাইরে বাইরে ইংরাজের দিকে, ভিতরে ভিতরে মহাৎমাজীর দিকে, আর সব সময় নিজের দিকে; এই তো দেখি সবাই। এ ছোকরা দারোগা আর সার্কেল ম্যানেজারের সম্মুখে নিজের দিকের কথাটা একেবারেই ভাবলই না। আলবৎ বুকের পাটা বটে। চেঁচামেচি হৈ-চৈ-এর মধ্যে সেদিনকার সভা ভেঙে যায়।
সেইদিন বাজারের সবাই জানতে পারে যে, থানা আমনসভার সভাপতি, মামুলী অফসর নন। কলস্টার, হাকিম, যিনিই আসুন এদিকে, আগে তাঁরই সঙ্গে এসে ভেট মোলাকাৎ করবেন, তারপর ডেকে পাঠাবেন দারোগা সাহেবকে থানা থেকে। সেখানে এসেও দারোগা সাহেব বসতে পারবে না কুর্সিতে। বসুক তো; অমনি দারোগাগিরি নিলামে চড়বে; সরকারী ডাক এক। সরকারি ডাক দো। সরকারী ডাক তিন। আর দেখতে হচ্ছে না।
তারপর একদিন কী করে যেন, সার্কেল ম্যানেজার থানা আমনসভার সভাপতি হয়ে যান। গিধর মণ্ডল হয় বিসকান্ধা গ্রাম-আমনসভার মুখিয়া। [৪৬৩]
বড় দায়িত্বের কাজ। মহাৎমাজীর চেলারা লেংটাদের [৪৬৪] মাথায় চড়িয়েছে। তারা সাপের পাঁচ পা দেখছে আজকাল। সরকারী কানুন নিয়ে তামাসা। কানুনেরই বাঁধন যদি আলগা করে নেয়, তাহলে জাত-পাত আচার ব্যবহারের বাঁধন থাকবে কোথা থেকে? ভূতের নাচন আরম্ভ হবে দেশে। হবে কি হয়ে গেছে! কাজের খরচা পাবেন কিছু কিছু। আর ভাল কাজ করতে পারলে ইনাম বখশিশের কথাও সরকার মনে রাখবে।…
দারোগা সাহেব আরও কত কী বোঝাল গিধর মণ্ডলকে।
এত বুঝোবার দরকার ছিল না। গিধর ভাল করে জানে যে, বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে লাডলীবাবুটা মহাৎমাজী আর মাস্টার সাহেবের ফাঁদে পা দিয়েছে। নইলে ঐ বচ্চন সিংয়ের গুষ্টি থাকতে, বিসকান্ধার আর কারও অফসর হতে হত না।
বাবুসাহেবও হাড়ে-হাড়ে বোঝেন যে, দারোগা পুলিশ বিরুদ্ধে থাকলে, রাজপুতের লাঠি হয়ে যায় কোটির মতো ফঙ্গবনে; রাজপুতের ঘোড়া হয়ে যায় গাধার শামিল। আরে আহাম্মক লাডলী, বুঝছিল না যে, তোকে ঐ কুচক্করে মাস্টারসাহেবটা তাদের বোঝা বইবার গাধা করেছে, নিয়ে যাচ্ছে ঘাটের দিকে। বংশের ইজ্জতে ঘুণ ধরিয়ে দিলে; আর কি লেংটারা বচ্চন সিংয়ের পরিবারকে মানবে? সেসরীর জানটুকু এখন পর্যন্ত ধুকধুক করছিল রাজপুতী কলজের ভিতর, তাই ঐ শকুনগুলো এখনও ছিঁড়ে খায়নি। এখন আমনসভার মুখিয়াটাকে হাতে রাখতে পারলে সময়ে অসময়ে কাজ দিতে পারে।
তাই জাতের ইজ্জত তুলে গিধর মণ্ডলটার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল [৪৬৫] বচ্চন সিং নিজে উপযাচক হয়ে।
আর গিধর মণ্ডল জানে যে, ঢোঁড়াইটাকে শায়েস্তা করতে হলে, রাজপুতদের সাহায্য বিনা হওয়ার উপায় নেই। তার উপর লচুয়া চৌকিদারটাও একদিন নিরিবিলিতে তার কাছে সাগিয়া আর ঢোঁড়াইয়ের সম্বন্ধে কি সব যেন বলে গিয়েছে। দাঁত বার করে আবার হারাজাদা হাড়ীর বাচ্চাটা যাওয়ার সময় খোঁচা দিয়ে বলে গেল যে, তোমাদের বাড়ির বৌয়ের কথা বলেই তোমার কাছে বললাম মোড়ল। সেইদিন থেকে তার মনটা ঢোঁড়াইয়ের উপর আরও বিগড়েছে।
আর ঐ নচ্ছার কুটনী মোসম্মতটা! এটাই তো যত নষ্টের গোড়া!
——-
[৪৬২. শান্তিসভা। এই সময় গ্রামাঞ্চলের অসন্তোষ ও বিক্ষোভ প্রতিরোধকল্পে গভর্নমেন্ট তার বিশ্বাসী লোকদের সহযোগিতায় সর্বত্র আমনসভা স্থাপিত করে। ৪৬৩. সকৃত শব্দ মুখ্য থেকে। সেক্রেটারি গোছের কাজ। ৪৬৪. ছোটলোকদের। ৪৬৫. বন্ধুত্ব করেছিল।]
.
কোয়েরীটোলার উদ্যোগ
সেই যে রাতে সাগিয়া মায়ের খাটিয়ার নিচে ঠকাস করে লোটাটা রেখেছিল, তার পরদিন থেকে তাদের বাড়ির ভাব হয়ে ওঠে একটু থমথমে মতন। মায়ে বেটিতে রঙ্গরস কমে আসে। যে মোসম্মতের মুখে চব্বিশ ঘণ্টা বাজে কথার খই ফুটত, সে সুদ্ধ হয়ে আসে একটু গম্ভীর। রোদ, বাদল, বলদ, উনুন প্রতিটি জিনিসের উদ্দেশ্যে, হুঁকোর ধোয়ার সঙ্গে সঙ্গে উগলে দেওয়া গালির স্রোতে মন্দা পড়ে। ঢোঁড়াইয়েরও মোসম্মতের সঙ্গে ব্যবহারে অকারণে একটা আড়ষ্টতা এসে যায়।
ঢোঁড়াই সাগিয়াকে ঠিক বুঝতে পারে না। বড় দুঃখ হয়, বড় মায়া হয় তার সাগিয়াকে দেখে। দুনিয়ার দুঃখের বোঝা মনে হয় সাগিয়ার বুকে পাথর হয়ে জমে আছে, কিন্তু তা নিয়ে মুখে রা কাটবার মেয়ে সে নয়। সুয্যিঠাকুরের মতো, ঠিক যে সময় যে কাজটি করা দরকার, মুখ বুজে করে যায়, বাদলে ঢাকা পড়লেও কাজে কামাই নেই। তাকে দেখলেই ঢোঁড়াইয়ের মনে পড়ে, ঢলাকুমারের গানের সেই রাজকন্যের কথা [৪৬৬]। এত ভাল তবু এত পোড়াকপাল নিয়ে জন্মেছে। ডাইনীবুড়ী হিংসে করে তাকে নিমগাছ করে রেখে দিয়েছে। রাজপুত্তুর ঢলাকুমারের কি তাকে চিনতে ভুল হয়? চোখের জলে বুক ভাসে ঢালাকুমারের, শুকনো নিমের গুঁড়ির উপর মাথা কুটবার সময়। অশ্বিনের মরণাধারের মতো কালো চোখদুটির তলায় কী আছে জানতে ইচ্ছা করে। সাগিয়া হাসবার সময়ও তার চোখদুটো ছলছল করছে বলে ভুল হয়। মেয়ে জাতটার অন্যগুলোর মতো নয়; তাই ঠিক বোঝা যায় না তাকে। একেবারে আপন করে টেনে নেবে, আবার দূরে দুরেও রাখবে। মজা নদী মরণাধারের মতো সাগিয়া। বান ডাকে না, পাড় ভাঙে না, আঁধি তুফানেও ঢেউ লাগে না। ঝিরঝির হাওয়ায় উপরটা কাঁপে, নিচের শ্যাওলাটা একটু নড়ে, কেবল দুপুরের রোদ লাগলে তলের বালি চিকচিক করে। রোদ্দুরে যখন ঢোঁড়াই তেতেপুড়ে আসে, তখন চাউনিটা হয়ে যায়, বৌকা বাওয়ার মতো। মুখে কিছু না বললেও দরদের পরশটুকু আদেখলে মনে বড় মিষ্টি লাগে। একে দেখলেই মন ভিজে ওঠে ঠাণ্ডা মিষ্টিরসে। এ কাছাকাছি আছে জানতে পারলেই মনটা ভরপুর হয়ে যায়।
আপনা থেকেই ঢোঁড়াই য়ের মনে আসে আর-একটা আওরতের কথা। পানের পাতার মতো পাতলা ঠোঁট ছিল তার। তাকে দেখলেই দিলের উপর সাপ উল্টান পাল্টানি খেত। দিলের ভিতরটা হয়ে উঠত গরম। গুড়ও মিঠা, চিনিও মিঠা। তবু লোকে চিনিই চায়।
না, না, একটুও মনের উপর লাগাম নেই তার। সেই হারামজাদা আওরতটার উপর এখনও সে মন খরচ করছে। সাগিয়ার সঙ্গে তুলনা করলে রামিয়ার মত মেয়েলোকের দর এক কড়িতে তিনটে। সেই রক্তের দলাটা আজ বোধ হয় তিন বছরের দামাল ছেলে। সে জিরানিয়াতে থাকলে ছেলেটাকে দুলদুল ঘোড়ার মেলা থেকে মাটির ঘোড়া কিনে দিত। এখনও হয়তো একজন দিচ্ছে। আর সেই দুষ্টু ছেলেটা হয়তো একটা মর্কটটার বুকের লাল চুলগুলোর মধ্যে খেলার ঘোড়াটা চরাচ্ছে; খা ঘোড়া লাল ঘাস খা! আর বোধ হয় খিলখিল করে হেসে ফেটে পড়ছে সেই বেজাত আওরতটা, যেটা ঢোঁড়াইয়ের সবুজ দুনিয়াটাকে গরু দিয়ে মুড়িয়ে খাইয়ে দিয়েছে।..
বাইরে কয়েকজন লোকের গলা শোনা যায়। কীরে ঢোঁড়াই, এরই মধ্যে শুয়ে পড়েছিস যে?
আমি ভাবলাম যে আজ আবার তোদের জাতের মিটিন হবে মঠের মাঠে…
তুইও যেমন!
বিল্টা ঢোঁড়াই কে টেনে মাচা থেকে নামায়। অথচ ঢোঁড়াই বাজে কথা বলেনি।
কোয়েরীদের ক্ষেতের ফসল রোজ রাতে রাজপুতদের গরু মোষ ঘোড়ায় খেয়ে যাচ্ছিল। দিন দিন বেড়েই চলছে। একটু-আধটু ফসল খাওয়া না, চিরকাল আছে, সব গাঁয়ে আছে। বুকে হাত দিয়ে বলুক তো দেখি কোনো ভৈসোয়ার [৪৬৭] নিঝুম রাতে কলাই কুথির ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দুচার গাল ফসল তার মোষকে খাওয়ায়নি। হতেই পারে না। মোষের পিঠে চড়লেই মনের ভাব ঐ রকম হয়ে যায়। মোষের গাটা চটক করবে; হাড়-পাঁজরা ঢাকা পড়বে; ফেনায় ভরা কেঁড়েটার মধ্যে ছরর ছরর দু-আঁজলা বেশি দুধ পড়বে, এর লোভ কোনো ভৈসোয়ার সামলাতে পারে না।
কিন্তু এ হচ্ছে জন্য জিনিস। একেবারে যা নয় তাই কাণ্ড। একজন সেপাই খয়নি খাওয়াবার লোভ দেখিয়ে বুড়হাদাদুকে হুউ-উ পাক্কীর দিকে নিয়ে গিয়েছে, আর একজন তার ক্ষেতে একপাল গরু ঢুকিয়েছে সেই ফাঁকে।
বিল্টার ক্ষেতের বেলা কী হল! বাবুসাহেবের রাখালটা একটা উটকা গরুর পিছনে ছুটল আসল গরুর পালটা বিল্টার ক্ষেতের আলের উপর ছেড়ে। সেটা ভাব দেখাল যে, দূরের গরুটা পাছে অন্যর ক্ষেত নষ্ট করে দেয়, সেই জন্য তার ভাবনার অন্ত নেই। সব বুঝি আমরা; ওসব আমাদের মুখস্থ। কিন্তু সবচেয়ে জবর কাণ্ড করেছে। মোসম্মতের যব-মটরের ক্ষেতে। রাতে ক্ষেতের পাহারাদার মাচায় ঘুমাচ্ছিল। মাচার চারিদিকে ফণীমনসার কাঁটা দিয়ে ঘিরে, তারপর মোষ ছেড়ে দিয়েছে ক্ষেতে। সে মোষ খোঁয়াড়ে দিয়েই বা কী। বাবুসাহেবেরই তো খোঁয়াড়, ইনসান আলির নামে নেওয়া। কোয়েরীদের চাইতেও মুসলমান হল আপনার লোক! এ নিয়ে ঢোঁড়াই থানা-পুলিশ করতেও ভয় পায়। দারোগা সাহেব আবার তার ঘরবাড়ি নিয়ে কী সব জিজ্ঞাসা করবে। যদি তাকে জিরানিয়া কাছারিতে যেতে হয়! না না, সে পড়তে চায় না ওসব গোলমালে।
কিন্তু একটা কিছু করতে তো হয়, ক্ষেতের ফসল নষ্ট করার সম্বন্ধে। গিধর মণ্ডলটাও আবার এখন বাবুসাহেবের সঙ্গে মিলে গিয়েছে জাতের লোকের বিরুদ্ধে। জাতের মোড়ল হয়েছেন!
বাবুসাহেবের ধরমপুরিয়া চাল [৪৬৮] দেখেছিস? জাতের মোড়লকে দিয়ে জাতের বরবাদ করাচ্ছে। সত্যিই পাচে, ভূমিহার আর লাল কায়েতের চাইতে কম যায় না রাজপুতরা!
তাই বিল্টা কাল দলবল নিয়ে গিয়েছিল গিধর মণ্ডলের কাছে সে কেন জাতের লোকের বিরুদ্ধে গিয়েছে, তারই জবাবদিহি নিতে। গিধর জিভ কেটে বলে, তা কী হয়? কী যে বলিস তোরা। আমার কি বিয়ে শ্রাদ্ধর ফিকির নেই? আমি যাব জাতের বিরুদ্ধে। জাতের সওয়ালে আমি জাতের দিকেই। আমরণ। তবে কি জানিস, ভদ্রতার জ্ঞানটা তো ধুয়ে পুঁছে ফেলতে পারি না। বাবুসাহেব যেচে আলাপ করতে চায়, আমি কেমন করে না করি! আর জাতের মোড়ল বলে কি আর তোরা আমাকে মানিস! আজকাল জাতের মোড়ল মলহরিয়ার তাৎমা। সে ডাইনে চলতে বললে চলবি ডাইনে। বাঁয়ে চলতে বললে বাঁয়ে। কইরে বিল্টা, মোসম্মতের মানিজর সাহেবকে আনিসনি কেন সাথে? বিল্টা হেসে জবাব দিয়েছিল যে, গিধর গুরুজীর [৪৬৯] সাথে মিতালি করেছে বুড়ো গিধ [৪৭০]। এবার থেকে জ্যান্ত মানুষ খাবে। আর মানিজর এমুখো হয়? লেজ তুলে গাঁ থেকে পালানোর পথ পাবে না।
বড় শয়তান তুই বিল্টা বলে কোয়েরীরা হাসে। গিধর এ হাসিতে যোগ দিতে পারে না। শয়তানটার রসিকতার ইঙ্গিত আবার গড়খোর কথাটার দিকে নয় তো! লেজ তুলে পালালো বুড়ো শকুন।
অপ্রস্তুত হয়ে গিধর মণ্ডল বলেছিল, কাল সাঁঝে সকলে আসিস মঠের মাঠে। জাতিয়ারী কথার বিচার করা যাবে। তোরা আমাকে জাতের বিরুদ্ধে মনে করিস সকলে!
কোয়েরীদের জাতের সভায় ঢোঁড়াই গিয়ে কী করবে? এই জন্যই আজ ঢোঁড়াই সকাল সকাল শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু বিল্টার হাত থেকে কি নিস্তার আছে।
———-
[৪৬৬. প্রচলিত পালাগান। ৪৬৭. মোষ চরাবার রাখাল। ৪৬৮. এ জেলার মধ্যে ধরমপুর পরগণা কুটবুদ্ধিতে সর্বোচ্চ বলে স্বীকৃত। ৪৬৯. শৃগাল পণ্ডিত। ৪৭০- শকুনি।]
.
ঢোঁড়াইয়ের সুমন্ত্রণা প্রদান
টোলার সব লোক জড় হয়েছে মঠের মাঠে। বাইরের লোকের মধ্যে এসেছে লচুয়া হাড়ী। সবচেয়ে শেষে পৌঁছুল গিধর মণ্ডল।
যে জাত জেগে থাকে, সেই জাতই বেঁচে থাকে। বলে গিধর মণ্ডল মধ্যখানটাতে গিয়ে বসে। অনেক ভেবে ভেবে কথাটা তৈরি করে সে এসেছে। এখন এগুলো বুঝলে হয়।
সবাই বলে হাঁ, এ একটা কথার মতো কথা বলছে বটে মোড়ল।
তার মানেই হচ্ছে যে কথাটা বুঝতে পারেনি কেউ। গিধরের মনটা প্রথমেই খারাপ হয়ে যায়।
রাজপুতরা কোয়েরীদের ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে দিচ্ছে। সেই কথাই সকলে উঠোতে চায়। আজ মোসম্মতের হয়েছে, কাল তোর ক্ষেতে হতে পারে। বল মোড়ল, কী করা যায়।
গিধর রাজপুতদের প্রসঙ্গ চাপা দিতে চায়। তাই বলে কি জল কাটবি নাকি ছুরি দিয়ে? কার মোষ তার ঠিকঠিকানা নেই। আগে সেটা ঠিক জানবি, তবে তো ভাবা যাবে তার পরের কথাটা। নীলগাইটাই এসে খেয়ে যাচ্ছে না তো?
সকলে চেচঁমেচি আরম্ভ করে। নীলগাইতে ফণীমনসার কাঁটা দিয়ে গিয়েছে মাচার চারিদিকে? যে মোষটাকে ধরে ইনসান আলির খোঁয়াড়ে দিলাম সেটাও কি কালো রঙের নীলগাই নাকি? কী যে বল মোড়ল। তোমার মতো রামায়ণই না-হয় পড়তে শিখিনি, তাই বলে গাই আর নীলগাইয়ের তফাত বুঝব না।
আরে তা নয়। সাঁওতালরা তীর-ধুনক দিয়ে যে নীলগাই মারল সেদিন ক্ষেতে দেখলি তো? আমি বলছিলাম যে হতেও তো পারে নীলগাই।
গনৌরী বলে, নীলগাইয়ের কথাই যদি তুললি, তবে শোন বলি, আর এক ব্যাপার। নীলগাইয়ের মাংস বিলি হচ্ছিল যখন সাঁওতালটোলায়, তখন পিথো সাঁওতালটা কী বলছিল শুনেছিস? বলছিল তোদের জমি যেগুলো বাবুসাহেব নিলাম করেছিল, সেগুলো আমাদের দেবে বলেছে। আমি বলি নিলাম আবার করাল কবে? অনিরুদ্ধ মোক্তার বলেছে লুটিস না নিলে নিলাম হবে না। তুই বললেই হল।
যে কথাই পাড়ো রাজপুতদের কথা এসে পড়বেই পড়বে। গিধর মণ্ডল বিরক্ত হয়ে ওঠে। ইচ্ছে হয় বলে যে, জাতায় ভুট্টা পিষতে গেলে দানার মধ্যে দু-চারটো ঘুণ পিষে যাবেই। কিন্তু অনর্থক গোলমাল বাড়িয়ে লাভ কী? বলে, অনিরুদ্ধ মোক্তারের চাইতেও পণ্ডিত হয়ে উঠছে সাঁওতালগুলো আজাকাল।
বুড়হাদাদা এই কথায় সায় দেয়।
একটা ছোকরা বলে, বুড়হাদাদা সেই রাতের বাঁধনে কথাটা ভুলতে পারছে না।
ঢোঁড়াই বিল্টাকে খোঁচা দিয়ে মনে করিয়ে দেয় যে আসলে কাজের কথা কিছু হচ্ছে না। এই জিনিসই তো চায় গিধর মণ্ডল।
বাবুসাহেব বোধ হয় সাঁওতালদের কাছ থেকে ধাপ্পা দিয়ে কিছু সেলামি নিতে চায়। বিল্টা আবার বাবুসাহেবের কথা তুলছে। গিধর আর একবার কথার মোড় ঘুরোবার চেষ্টা করে।
জাতের কে কে নীলগাইয়ের মাংস খেয়েছিলি সেদিন?
প্রায় সকলেই দোষী। কেউ জবাব দেয় না।
এ আবার কি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুল!
বিল্টা বলে, আসল কাজের কথায় এস মোড়ল। আমি চাই জাতের তরফ থেকে আমাদের মেয়েদের রাজপুতদের বাড়ি কাজ করা বন্ধ করে দাও। পৈতা নেওয়ার পর থেকে কুশবাহাছত্রি মরদরা রাজপুতদের বাড়ির এঁটোকাটার কাজ বন্ধ করে দিল। তবে মেয়েরা করে কেন সে কাজ এখনও? আমাদের টোলার তিন-তিনটে মেয়ে বিয়ের পরও শ্বশুরবাড়ি যায় না। সেখান থেকে নিতে এলেও তাদের বাপ মা রোকশোদি [৪৭১] করায় না। কেন শুনি? পরগণা সুদু লোক এ কথা জানে। আমার সাফ-সাফ কথা, রাজপুতদের বাড়ি দাইয়ের কাজ করা বন্ধ করে দাও। ঘরের বেড়ায় মেমের ছবি টাঙিয়েছে লছমনিয়া; পেলে কোথা থেকে?
তুলকালাম আরম্ভ হয়ে যায় মঠের মাঠে। বুড়হাদাদু ঠকঠক করে কাঁপে। হল কী কালে কালে! এখনও তবু তার ছেলের বৌটা রাজপুতদের বাড়ি কাজ করে যা হোক দুমুঠো খেতে পাচ্ছে! নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারিস না রে বিল্টা। তবে হ্যাঁ, যে মেয়েদের বয়স কম, তাদের জন্যে একটা নিয়ম করলে হয়।
খেঁকিয়ে ওঠে একসঙ্গে কয়েকজন।
আমার মেয়ে লছমনিয়াকে ঠেস দিয়ে কথা বললি সে বাবুসাহেবের বাড়ি কাজ করে বলে?
তোর ছেলের বৌয়ের বয়স দেড় কুড়ি হয়েছে বলে কি তার চরিত্তিরটা দুধ দিয়ে ধুয়ে পবিত্র করা হয়ে গিয়েছে?
তোর চুরির জন্য আমাদের এই হালত আজ, আর তুই দিস আমার মেয়েকে খোটা? বিল্টার আর ধৈর্য থাকে না। সে কারও কথায় কান না দিয়ে গিধরকে বলে, কী গিধর মণ্ডল। তুমি যে মুখে রা কাটছ না, রাজপুতদের বিরুদ্ধে কথা বলে? পহরে পহরেও তো একবার তোমার বুলি শোনাবে। তুমি একবার জিব নাড়লেই তো রাজপুতী ময়লা সাফ হয়ে যায়। [৪৭২]
রাগে গিধর মণ্ডলের সর্বশরীর জ্বলে ওঠে। তবু মুখে হাসি এনে বলে, এটা কি কুশবাহাছত্রিদের জাতের মিটিন নাকি যে এখানে জাতের তরফ থেকে ফয়সালা হবে কোনো জিনিসের?
সকলে অবাক হয়ে যায়। এটা জাতের মিটিন না। তবে যে কাল বললে সকলকে এখানে জুটতে? সব সময় একই মুখ দিয়ে কথা বল, না আর একটা মুখ আছে তোমার?
এতক্ষণে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ওঠে গিধর মণ্ডল।
জাতের মিটিন হবে, সে আবার আমি বললাম! জাতের মিটিন হলে এর মধ্যে লচুয়া হাড়ী এসেছে কেন? ওই তাৎমাটা এসেছে কেন? তন্ত্রিমাকোয়েরী বলেও কি একটা নতুন জাত সৃষ্টি হয়েছে নাকি আজকাল? না হয়ে থাকলেও হবে। কী বলিস চৌকিদার?
লচুয়া চৌকিদার ছাড়া কথাটার ইঙ্গিত এই উত্তেজনার মধ্যে কেউ খেয়াল করে না। সব জিনিসে কেবল মারামারি, কাটাকাটি এ গাঁয়ে।
গিধর মণ্ডল ধড়মড় করে উঠে পড়ে। এই সব দলাদলির মধ্যে থাকা আমার অভ্যাসও নেই, আর আমনসভায় মুখিয়া হয়ে আমি তা করতেও পারি না।
ঢোঁড়াইয়ের দিকে একটা অগ্নিদৃষ্টি হেনে সে চলে যায়।
ওরে আমার অভ্যাস-না-রাখনেওয়ালা! দেরি হয়ে যাচ্ছে; যা শিগগির কানী মুসহরনীর কাছে অভ্যাস বদলাতে।
এতক্ষণে লচু চৌকিদার বলে যে, গিধর মণ্ডল তাকে আসতে বলেছিল, আমন সভার বৈঠক হচ্ছে বলে।
তাই নাকি। হারামীর বাচ্চা, গরুখোরটা।
আমনসভার মিটিনের রিপোর্ট মাসে একটা না পাঠালে দারোগা সাহেব চটে যে।
অনেক আশা করে আজকে সকলে জাতের সভা করতে এসেছিল, সাঁঝের ভজন বন্ধ করে। যে লোকগুলো সাঁঝের ভজনে আসে, সেগুলোই শাদি আর শ্রাদ্ধের ভোজে যায়, বিষহরির আর রামনবমীর পূজো করে, রামখেলিয়া তার ভমরের গানের আসর পাতে। কিন্তু যেদিনের যে কাজ। আজ কি আর এখন জাতিয়ারী সভার জন্য তৈরি করা মন ভজনে বসে। সে কথা কেউ ভাবতেও পারে না। ওই শালা গিধরটার জন্য কি জাতের কাজ আজ টকরসে জারানো থাকবে? তুই কি বলিস ঢোঁড়াই।
আরে জাতের সওয়াল তো জাতের সওয়াল। তাই বলে কি তুই কিছুই বলবি না?
এখানে না থাকলে কি আর বলতাম তোকে। জাতের ব্যাপারে কি আর আমরা : রামনেওয়াজ মুন্সির কাছে যাই না কেন? আরে তোর গায়ে তো তন্ত্রিমাকোয়েরীর ছাপ দিয়ে দিয়েছে জাতের মোড়ল নিজে।
বুড়হাদাদু বিল্টার শলাতে ভরসা পায় না। ও ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। ধান ভানবার সময় বাড়ি মারতে হয় আস্তে আস্তে সইয়ে সইয়ে। তবে না গোটা চালটা বেরিয়ে আসবে। জোরে বদাম করে মার, একেবারে বরবাদ হয়ে যাবে চাল। এই সোজা কথাটা বিল্টা বোঝে না।
ঢোঁড়াই কেন বিল্টাও বোঝে যে, এই অভাব-অনটনের দিন কোয়েরী মেয়েরা রাজপুতদের বাড়ি কাজ করা বন্ধ করতে পারে না। ঠিক হয় কোয়েরীটোলার মেয়েদের বিয়ের দুবছরের মধ্যে রোকশোদি করাতে হবে। যেমন করে হোক এইসব মেয়েদের নিয়েই জাতের দুর্নাম সবচাইতে বেশি। এতে রাজপুতদের বলার কিছু নেই।
গনৌরী কথা তোলে, কোয়েরীটোলার মেয়েরা বাবুদের বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে বলে কি রাজপুত মরদের কাপড় কাঁচবে নাকি?
সকলেই আশ্চর্য হয়, এত বড় অপমানের কথাটা তাদের এতক্ষণ মনে পড়েনি দেখে। গনৌরীটা কথা বলে কম। কিন্তু বলে বড় সময় মতো কাজের কথা।
সকলেরই মনে মনে গর্ব হয়; যাক! রাজপুতদের বিরুদ্ধে তবু তারা জবর একটা কিছু করতে পেরেছে! কিন্তু মোড়ল যে চলে গেল; ওটা আবার নীলগাইয়ের মাংস খাওয়ার ব্যাপারে নিয়ে গোলমাল-টোলমাল না করে। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওই কথাটাই তুলছিল মোড়ল! পৈতা নেওয়ার পর থেকে নীলগাইয়ের মাংস খাওয়ার সুযোগ কোয়েরীটোলার লোকের এর আগে হয়নি। বিবেকের দংশনটাই বোধ হয় মোড়লের কথা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল। অর্থাৎ আজকের নীলগাইয়ের আপদটা সেকালের সাহেবের মতনই বড় আপদ হয়ে উঠেছে। ঢোঁড়াই সকলকে সাবধান করে দেয়, দেখ আজ থেকে আর কেউ নীলগাই বলবি না। বলবি বনহরণা [৪৭৩] সাঁওতালরা যা বলে। সবাই এই মঠের মাঠে অশত্থ গাছের সমুখে হলপ নে, কেউ কথার খেলাপ করবি না। গিধর মোড়লের বাপ মোড়ল এলেও বনহরণার মাংস খেলে হুক্কাপানি [৪৭৪] বন্ধ করতে পারব না।
বনহরণা! খুব মাথায় খেলেছে যা হোক ঢোঁড়াই তোর। রামনেওয়াজ মুন্সির শাগরেদ হলি না কেন তুই?
বনহরণা! এত বড় একটা প্রশ্নের এত সহজে সমাধান হয়ে যেতে পারে, তা কেউ আগে কল্পনাও করতে পারেনি।
আলবৎ চোখা বুদ্ধি ঢোঁড়াইটার!
বহরণা! বনহরণা!
হঠাৎ হাসির ধুম পড়ে যায় সভায়। বনহরণা!
বুড়হাদাদুর হাসতে হাসতে কাশি এসে যায়। বিল্টার পর্যন্ত হাসতে হাসতে জল এসে গিয়েছে চোখে।
মল বুঝি বুড়োটা এবার!
তন্ত্রিমাকোয়েরী কথাটা ঢোঁড়াইয়ের ভাল লাগে না। গিধরটা তাকে ঠাট্টা করে গেল; আর সে জবাব দিতে পারলে না কথাটার! দিতে পারত সে জবাব ঠিকই। ইচ্ছা করেই সে কিছু বলেনি। একটা কিসের বাধা ছিল, সংকোচ ছিল তার মনে।
না, আর কেউ কথাটা ধরতে পারেনি বোধ হয়।
পরিষ্কার সামনাসামনি দুপক্ষের লড়াই জিনিসটা ঢোঁড়াই ছোটবেলা থেকে বুঝতে পারে। এ কেমন যেন অনেক দলের লড়াই, অনেক লোকের লড়াই, অনেক রকমের ঝগড়ার মুখ জট পাকিয়ে যাচ্ছে। কে কোন দলে, কোন দল কখন কোনদিকে বোঝা যায় না। হরেক ধন সামলাতে লাগে লড়াই, অথচ একা হাতে লড়া যায় না। তাকে একা পেয়েই না তাৎমাটুলির পঞ্চরা তাকে যা করবার নয় তাই করেছিল। এই একা লড়া যায় না বলেই লোকে জাতের দুয়োরে মাথা কোটে। তাই না বচ্চন সিং অন্য রাজপুতদের রোজ সন্ধ্যাবেলায় সিদ্ধির শরবত খাওয়ায়। জাতের বাইরে যে লোকের সাহায্য পাওয়া যায়, তার কাছেই লোক আপনা থেকেই ছুটে যায়। তাই বাবুসাহেব যায় মুসলমান ইনসান আলির কাছে, তাই না বাবুসাহেব টানে লালাকায়েত রামনেওয়াজ মুন্সিকে তার দিকে। তাইজন্যেই না কোয়েরীরা ঢোঁড়াইয়ের মতো রামায়ণ না পড়া লোকেরও সাহায্য চায়। রাজপুতরা তাদের চাইতে বেশি বুদ্ধি রাখে। তারা কোয়েরীদের মোড়লকে দল থেকে ভাঙিয়ে নেয়; নিক তো দেখি কোয়েরীরা একজনও রাজপুতকে, তাদের দল থেকে ভাঙিয়ে। সাঁওতালদেরও কি বাবু সাহেব নিজের দিকে করছে? পিথো খামকা মিথ্যে বলবে কেন!
সাগিয়া গোয়ালঘরে আগুন জ্বালাতে এসেছিল ধোঁয়া করবার জন্য। ঢোঁড়াই ঢুকতেই জিজ্ঞাসা করল, কী সব হল জাতীয়তা সভায়? তামাক খাওয়ার শব্দ শুনে ঢোঁড়াই বুঝতে পারে মোসম্মতও শোয়নি এখনও এই খবর শোনবার জন্য।
নিজে এসে জিজ্ঞাসা করুক, তবে ঢোঁড়াই বলবে তাকে খবর! নইলে দায় পড়েছে ঢোঁড়াইয়ের।
সাগিয়া সব শুনে যাওয়ার সময় বলেছিল, এত পাপও কি ধরতিমাই [৪৭৫] সহ্য করতে পারে!
——–
[৪৭১. দ্বিরাগমন। ৪৭২. দ্ব্যর্থবাচক কথাগুলি। ময়লা কথাটির অপর একটি অর্থ বিষ্ঠা। জিব নাড়ানোর একটি অর্থ কথা বলা। ৪৭৩. বনহরিণ। যথার্থই নীলগাই, এক শ্রেণির হরিণ। ৪৭৪. হুঁকো জল। একঘরে করার অর্থে ব্যবহৃত হয়। ৪৭৫. ধরিত্রী দেবী।]
.
ধরিত্রীদেবীর কোপ
সাগিয়ার কথা বোধ হয় ধরতিমাইয়ের কানে গিয়েছিল।
সে কী ধরতিমাইয়ের সাড়া! [৪৭৬] গম্-গ-গম্ গম! গুড়গুড়গুড়গুড়! এক কুড়ি মেঘের ডাক যেন টগবগ করে ফুটছে তার বুকের ভিতর। হুঙ্কার ছাড়ছেন ধরতিমাই। বুকখানা তাঁর ফেটে যাবে বুঝি এবার! যা ভাবা, তাই কি হল। চড়মড় করে তামাকক্ষেতের মধ্য দিয়ে জমিটা ফেটে গেল। ফোয়ারা দিয়ে বাতাস সমান উঁচু জল আর বালি বেরুল, ফাটলের মধ্য দিয়ে এখানে ওখানে অগুনতি জায়গায়। অগুনতি হাতি শুড় দিয়ে জল ফেলছে পাতাল থেকে। শব্দ থামেই না, শব্দ থামেই না! কুয়োটা গবগব করে জল বমি করছে। চারিদিকে বালির সমুদুর ভুরভুর কাটছে। তামাকক্ষেত তখন ডুবে গিয়েছে জল-বালির মধ্যে, তা ঢোঁড়াই লক্ষ্যও করেনি। ভয়ে কোঁড়াই রামচন্দ্রজীর নাম পর্যন্ত ভুলে যায়। দুনিয়াটা গুঁড়োওঁড়ো হয়ে যাবে এইবার! আর রক্ষে নেই তার। কোথায় তলিয়ে যাবে সে! হঠাৎ কেন যেন আবছাভাবে মনে হয়, একমাত্র ওই দূরের উঁচু পাক্কী সড়কে যেতে পারলে তার প্রাণটা বাঁচতে পারে। ঢোঁড়াই উধ্বশ্বাসে দৌড়োয় পাক্কীর দিকে। দৌড়ান কি যায়। কাদা বালির মধ্যে টলে টলে পড়ছে সে। অসম্ভব! এই তামাক ক্ষেতটুকু পার হতেই তার জন্মযুগ কেটে যাবে। তাৎমাটুলির সেই আওরতটার মুখ হঠাৎ মনে পড়ে… তিন চার বছরের নেংটা ছেলেটা ভয়ে তার বুকে মুখ গুঁজছে…
এগে মাইয়া গে! এ ঢোঁড়াই! জান গেল রে!
সাগিয়ার গলা। ঢোঁড়াই থমকে দাঁড়ায়। এতক্ষণ সাগিয়ার কথা মনেই পড়েনি। তামাক ক্ষেতে তারা কাজ করছিল। ঢোঁড়াই ফিরে দেখে যে, সাগিয়ার কোমর পর্যন্ত ঢুকে গিয়েছে একটা ফাটলের বালির মধ্যে। মায়ে ঝিয়ে পরিত্রাহি চিৎকার করছে। ঢোঁড়াই আর মোসম্মত মিলে ধরাধরি করে সাগিয়াকে টেনে তোলে। মা-বেটিতে ঢোঁড়াইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে বসে। তারা দুজনেই তখনও ঠকঠক করে কাঁপছে ভয়ে। তাদের বুকের ধুকধুকুনিটা পর্যন্ত ঢোঁড়াই শুনতে পাচ্ছে। বেশ নূতন নূতন লাগে ঢোঁড়াইয়ের। বুড়ী কাঁদতে কাঁদতে কত কী বলে যায়।
…বকরির কানদুটো ধরলে ব্যা-ব্যা করে ডাকবার সময় তার চাউনিটা কেমন যেন হয়ে যায় লক্ষ্য করেছিস ঢোঁড়াই? আমার মেয়ের চাউনি হয়ে গিয়েছিল সেই রকম।…সাগিয়া, তোর কোমড়ের মাজায় লাগে-টাগেনি তো? …আমি ভাবলাম, আমার কপাল বুঝি পুড়ল। তুই না থাকলে কি করতাম ঢোঁড়াই, ভাবতে গেলেও বুক শুকিয়ে যায়।…
ঢোঁড়াই সব কথা ভাল করে শুনছেও না। মন চলে গিয়েছে তাৎমাটুলিতে। সেখানে কে কেমন থাকল। ছেলেটা।…আর তার মা-টাও। ছেলের মায়ের অমঙ্গল সে চায় না।
দোষ রামিয়ার নয়, দোষ ঢোঁড়াই য়ের কপালের। পচ্ছিমা আওরতটা, কখনোই ঢোঁড়াইয়ের মায়ের মতো ব্যবহার করবে না তার ছেলের সঙ্গে। সব মা সে-রকম হলে পাপের ভারে রোজ আজকের মতো ভূমিকম্প হত। এই সাগিয়াকেই দেখ না, এখনও মরা ছেলেটার কথা মনে করে চোখের জল ফেলে। ঢোঁড়াইয়ের সংসার যদি হরাভর [৪৭৭] থাকত, তাহলে বাঙালী বাবুভাইয়াদের ছেলের মতো আরামে রাখত সে ছেলেটাকে। মায়ের দুধের উপরও মোষের দুধ কিনে খাওয়াত। ভগবানের সেরা দান ছেলে। তার নিজের জাত-বেরাদারই যখন তার হাত কেটে নিয়েছে, তখন সে দোষ দেবে কাকে। দোষ তার আগের জন্মের কৃতকর্মের। …ছেলেটার চেহারা যদি নেই কটা মর্কটটার মতো হয়। ভয়ে তার বুক কেঁপে ওঠে। এ কথা কত সময় তার মনে হয়েছে। ছেলের কথা মনে হলেই এই কথাই সব চাইতে আগে মনে হয় তার। না, তার মন বলছে যে, তা হতেই পারে না! রামচন্দ্ৰজী আছেন। কখনও হতে পারে না–যত পাপই সে করে থাকুক আগের জন্মে। তার ছেলে পর হয়ে যেতে দিয়েছে সে, কিন্তু মনের এই সান্ত্বনাটুকুকে কেড়ে নিতে দেবে না সে কাউকে, খোদ রামচন্দ্রজীকেও না। তা হলে সে কি নিয়ে থাকবে। …খৃষ্টান হলেই কি রামচন্দ্রজীর রাজ্যের আওতা থেকে বেরিয়ে যেতে হয় নাকি?…দুটোকেই বাঁচিও রামজী, আজকের বিপদ থেকে তারা খৃষ্টান হয়নি। …কার হাতের কাঁপুনি কার কথা মনে করিয়ে দেয়। শিরশির করে মনে-পড়াগুলো উঠছে ঢোঁড়াইয়ের মাথার দিকে।
হঠাৎ নজর পড়ে সাগিয়ার দিকে। একটা কী বুঝবার চেষ্টা করছে। ঢোঁড়াই য়ের চোখ-মুখের উপরের লেখাটার মানে বোধ হয়।
অপ্রস্তুতের ভাবটা কাটাবার জন্যে ঢোঁড়াই সাগিয়াকে ইশারা করে বুঝিয়ে দেয় যাক তোর মার রাগটা পড়েছে, এই হিড়িকে। বাড়ির থমথমানিটা যাওয়া কম লাভ নয়।
মোসম্মতের কান্নার লক্ষ্য ততক্ষণে গিয়ে পড়েছে বালি ভরা তামাক ক্ষেতটার উপর। আপন বলতে ভগবান আর কী রেখেছেন তার, ওই মেয়ে আর জমি ছাড়া। তাতেও কি চোখ টাটাচ্ছে তাঁর।
সাপ দেখলে শালিখ পাখির ঝাঁক যেরকম কিচিরমিচির করে, সেই রকম একটা অবিচ্ছিন্ন হট্টগোল গাঁয়ের আকাশ-বাতাস ভরে গিয়েছে। রাজপুতটোলার দিক থেকেই চেঁচামেচিটা আসছে।
যাস কোথা ঢোঁড়াই?
এ সময় একজন মরদ কেউ কাছে না থাকলে ভয় করে মোসম্মতের আর সাগিয়ার। এই এলাম বলে।
ন্যায়বিচারের হদ্দ করেছ রামচন্দ্রজী। গায়ের যে বাড়ি যত বড়, সে-বাড়ি ভেঙেছে তত বেশি। কোয়েরীটোলার খড়ের বাড়িগুলোর কিছু লোকসান হয়নি। পাকা দালানে ভরা রাজপুতটোলার রূপ হয়েছে শুয়োর চরাবার পর কচুর ক্ষেতের মতো। বাবুসাহেবের বাড়ির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে মাটির ফাটলটা। দালানটাকে একেবারে দু টুকরোয় ভাগ করে দিয়েছে। ছাতের একদিক থেকে আর একদিকে যাওয়া শক্ত।
এর মধ্যেও বিল্টা ফিসফিস করে বলে, একেবারে গঙ্গাজী চলে গিয়েছে ছাদের মধ্যে দিয়ে-
পয়সা, পয়সা!
এক পয়সা।
পয়সা ফেকো!
কালী কলকত্তাবালী পুল!
গঙ্গজীর উপর।
এর মধ্যেও তোর হাসি-মশকারা আসে? মুখে বলে বটে ঢোঁড়াই। কিন্তু বহুকাল পরে রামচন্দ্রজী ভগবান এই অন্ধ দুনিয়াটাকেই দেখিয়েছে তার ন্যায়বিচারের দোর্দণ্ডপ্রতাপ চার কাঙলা, তো এক বাঙলা। [৪৭৮] চারজন গরীব থাকলে তবে একটা পাকা দালান হয়। থাক পাকা দালানে আরাম করে গিধর মণ্ডল। কোয়েরীটোলার মধ্যে ওই একটা বাড়িই গিয়েছে। খড়ের বাড়িগুলোর আর যাবে কী! একটু আধটু বাঁশ খুঁটি নড়েছে কোনো কোনোটার।
কিন্তু এতটা কড়া না হলেও পারতে রামজী, রাজপুতটোলার মেয়ে আর বাচ্চাদের উপর। তারা কি এই শীতের মধ্যে সারারাত বাইরে বসে থাকতে পারে।
সব চাইতে অবাক কাণ্ড হল জল নিয়ে। সেবার কলেরার সময় ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড থেকে টিউবওয়েল বসিয়ে গিয়েছিল মঠের মাঠে। সেটাতে জল ওঠেনি। মিস্ত্রিরা বলে গিয়েছিল যে, সদর থেকে আরও নল এনে পুঁতে দেবে। তাহলেই জল উঠবে। মিস্ত্রিরা সেই যে গিয়েছিল আর ফিরে আসেনি বিসকান্ধায়। সেই কলটাতে ভূমিকম্পে হঠাৎ জল এসে গিয়েছে।
রাজপুতদর্পহারী অবধবিহারী রামচন্দ্রজীর অদ্ভুত লীলা। বিসকান্ধার সব কুয়ো ইঁদারা বালিতে ভরে গিয়েছে। রাজপুতটোলার লোকদের এবার থেকে পায়ের ধুলো দিতে হবে কোয়েরীটোলায়, কল থেকে জল নেওয়ার জন্য। ইঁদারার ফুটানি দেখাত এতদিন!
———–
[৪৭৬. ১৫ই জানুয়ারী, ১৯৩৪; বিহার ভূমিকম্প। ৪৭৭. সবুজ। সোনার সংসার। ৪৭৮. স্থানীয় প্রবাদ শব্দ।]
.
সাগিয়া ঢোঁড়াই সংবাদ
ভূমিকম্পের হৈ-হল্লার মধ্যে গাঁয়ের ঝগড়া-দলাদলির ব্যাপারটা চাপা পড়ে যায়। বাবুসাহেবের ছোট ছেলে লাডলীবাবু ফিরে আসেন গাঁয়ে; সরকার মহাৎমাজীর চেলাদের ছেড়ে দিয়েছে জেল থেকে ভূমিকম্পের জন্যে। মাঠের টিউবওয়েলটাতে চব্বিশ ঘণ্টা মেলা লেগে রয়েছে। দু-কোশ দূরে কুশীতে স্নান করতে যেতে হয় সকলকে। সেখান থেকে মেয়েরা কলসীতে করে জল নিয়ে আসে। নইলে কলতলাতে রাজপুতদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে জল নেওয়া সে কি মোসম্মত ছাড়া যে সে মেয়ের কর্ম। তাছাড়া হাজার হলেও ভাল আদমী ঘি-দই খাওয়ার মুখ দিয়ে ভগবান তাদের পাঠিয়েছেন। [৪৭৯] কোয়েরীরা সামান্য একটু কষ্ট স্বীকার করলেই তারা যদি একটু আরাম পায় তো পাক। এতে কোয়েরীদের পয়সা খরচ নেই। তবে হ্যাঁ, চোখ রাঙিয়ে যদি কলে জল নেওয়ার হক দেখাতে আসত, তাহলে ছিল আলাদা কথা।
দু-ঘড়া জল দু-ক্রোশ বয়ে আনা, এ কি চাট্টিখানি কথা। সাগিয়া দু-ঘড়া জল নদী থেকে এনে রেখে যেন ধুকছে। শক্তি ছিল তাৎমাটুলির সেই পশ্চিমা মেয়েটার। তিনটে জলভরা কলসী একসঙ্গে নিয়ে আসবার সময় এক ফোঁটা জলও ডছলে পড়ত না তার গায়ে। সব সময় ঢোঁড়াই সেইটার সঙ্গে সাগিয়াকে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখে। উঠানের মধ্যে কুয়ো না হলে চলত না সে মেয়েটার। সাগিয়ার কিন্তু কোনো আবদারের বালাই নেই। নিজে দিয়েই খুশি; যা পায় তাতেই খুশি। দাবি কিছুর নেই। সেটা ছিল সোহাগী বিল্লি। যত দাও তত তার চাই; তৃপ্তি তার নেই কিছুতেই। শীতের রাতে কম্বলখানির ভাগ চাই; তবে তিনি আরামের গরর গরর শব্দ করতে করতে ঘুমোবেন। ঘুমের ঘোরে লেজে হাত পড়ে গেলে আঁচড়াতেও কসুর করবেন না।
ভাগ্যে সাগিয়া পচ্ছিমের তরিবত শেখেনি। তাই ঢোঁড়াই এক মুহূর্তের জন্য ভাববার অবকাশ পায়নি যে, সে কোনো বিষয়ে সাগিয়ার চাইতে ছোট।
এ অঞ্চলের কুয়ো খোঁড়ার কাজ করে নুনিয়ারা। তারা মাটি থেকে সোরা আর নুন বার করবার কাজ করত। নিমকের হল্লার সময় এরাই মহাৎমাজীর চেলাদের নিমক তৈরি করতে শেখাত! তাই এদের উপর পুলিশের নজর ছিল তিন-চার বছর থেকে। কলস্টরসাহেবের হুকুমে ভূমিকম্পের পরদিনই দারোগাসাহেব ডাকতে পাঠায় থানায় সব নুনিয়াদের। মুল্লুক জুড়ে কুয়ো পরিষ্কার করবার কাজ করতে হবে বলে। তারা বিশ্বাস করতে পারেনি চৌকিদারের কথা। একবার থানায় গেলে দারোগা জেলের খিচুড়ি খাওয়াবে, সেই ভয়ে সবাই নিজের গাঁ ছেড়ে পালিয়েছিল।
কুয়োর বালি ছাঁকার কাজ তত্তাটুলির লোকের কাছে নূতন নয়। সাগিয়ার বড় কষ্ট হচ্ছে নদী থেকে জল আনতে। ঢোঁড়াইয়ের জীবনের উপর দিয়ে একটা করে বিপদের ঝাঁপটা কেটে যাওয়ার পরই সে দেখেছে যে, কিছুদিনের মধ্যে রামচন্দ্রজীর কৃপা অজস্র ধারায় তার দুনিয়াটুকুর উপর পড়েছে। নতুন করে কাজে উৎসাহ পাচ্ছে সে।
সাগিয়া ঢোঁড়াইকে বারণ করে, না, না, ঢোঁড়াই, তুই নামিস না ইঁদারার মধ্যে। ওই দেখতে মনে হচ্ছে বালিতে ভরে গিয়েছে কুয়োটা, কিন্তু ভিতরে পাতালে কী আছে, কে জানে।
ঢোঁড়াই হেসে বলে, ধরতিমাই সীতাজীকে পাতালে টেনে নিতে চান। আমার মতো অচল টাকাতে তাঁর দরকার নেই।
সাগিয়ার মুখে সলজ্জ হাসির আভাস ফুটে ওঠে। তুই-ই তো টেনে তুলেছিলি।
তুলেছিলাম কি আর সাধে। জান গিয়া রে ঢোঁড়াই বলে কী চিৎকার।
জানের ডর নেই কার? তুই দৌডুচ্ছিলি কেন পাক্কীর দিকে? সে সময় তো আমাদের কথা মনে হয়নি।
কথাটা সত্যি। ঢোঁড়াই লজ্জিত হয়ে যায়। বালি-ভরা বালতিটা সাগিয়ার হাতে দেয়। ঢোঁড়াই বালি তোলে কুয়ো থেকে, সাগিয়া বালতি-ভরা বালি দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসে।
সত্যিই পাক্কীর সঙ্গে তার নাড়ী বাঁধা। লাঙলের ফালের দাগ যেন পাক্কী আর তার দু-পাশের গাছের সার, হলরেখার দু-ধারের উঁচু মাটি। জীবন কেটেছে ওই গাছের আওতায়, গোঁসাই-থানে, শীতের হিমে, বর্ষার জলে, গ্রীষ্মের লু-বাতাসে। পাক্কীর ধারের মাটি-কাটার গর্তগুলো দেখলেই তার মনের মধ্যে ভিড় করে আসে, শনিচরা, বুদ্ধ ঠিকেদারসাহেব, ওরসিয়ারবাবু, আরও কত কে। সবাই তারা ছিল ভাল লোক। সেখানকার সেই ছেলেটা আর তার মা, আর এখানে সাগিয়া, এই দুইয়ের সংযোগের সূত্র পাক্কী। তাই না তার মন ওখান থেকে ছুটে এখানে আসে। সেখানে ঘা খেয়ে, এই পাক্কী ধরে এসেছিল বলেই তো, আজ এখানকার সাগিয়া বিপদে পড়লে জান বাঁচানোর জন্যে তাকেই ডাকে। বর্ষায় দু-ধার জলে ডুবে গেলেও উঁচু করে থাকে রাস্তাটা। পাক্কী ঢোঁড়াইয়ের কাছে নির্বিঘ্নতা, দৃঢ়তা আর বিশালতার প্রতীক! তাই সে ছুটে যাচ্ছিল পাক্কীর দিকে, নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে।
বুঝলি সাগিয়া, এই পাক্কী ধরে এসেছিলাম বলেই তো এখানে পৌঁছেছিলাম।
তবু ভাল। চুপ করে থাকতে দেখে আমি ভাবলাম বুঝি আমার কথায় গোসা হল সাহেবের। দেখেছিস তো পাক্কীর ফাটলগুলো। সেদিন ছুটে মলহরিয়াতে যেতে চাইলেও যেতে হত না।
সাগিয়া ঠাট্টাই করছে, না তার ছুটবার একটা মন গড়া মানে করে নিয়েছে, তা ঢোঁড়াই ঠিক বুঝতে পারে না। গল্পে গল্পে কুয়োর বালি তোলার কাজ চলে। শীতের দিনে সাগিয়ার কপালে ঘাম ঝরছে! দেখতে রোগা না হলেও সাগিয়া বড়ই ক্ষীণজীবী।
আর বেশি পারবি না সাগিয়া। এ কি মেয়েমানুষের কাজ। আমি বরঞ্চ বিল্টাকে ডেকে নিয়ে আসি!
না।
ছোট্ট জবাব। রামিয়া হলে নিশ্চয়ই বলত, হয়েছে, আর মরদগিরি ফলাতে হবে না। ক্ষেতে সাগিয়ার সঙ্গে বহুদিন একসঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু আজকের মত এত তৃপ্তি কোনোদিন হয়নি ঢোঁড়াইয়ের কাজ করে। এক থালায় ভাত খাওয়ার মতো। সেই রকমই আপন-আপন লাগছে।
বিল্টাকে ডেকে আনতে হয় না। খালি বিল্টা কেন, গুটিগুটি পাড়ার সব লোক এসে জোটে, কেবল জোটে না, ঢোঁড়াইকে সাহায্যও করে। কুয়োর বালি তোলার কাজ এত সোজা, তা আগে জানা ছিল না।
সাঁঝের খানিক আগে লাডলীবাবু পর্যন্ত এসে ঢোঁড়াই য়ের পিঠ ঠুকে তারিফ করে যান।
এই তো চাই। নইলে সরকারের ভরসায় বসে থাকলেই হয়েছে। পাক্কীর ফাটল মেরামত হবে, তবে আসবেন হাকিম সাহেবরা হাওয়াগাড়িতে। আলবাত নজীর দেখিয়েছে কোয়েরীটোলা। পথ দেখাতে পারলে কি আর সাথে চলার লোকের অভাব হয়? এবার বিসকান্ধার সব কুয়ো ঢোঁড়াই তোমার দলকে করতে হবে। এই তো কাংগ্রিস আর মহাৎমাজীর হুকুম!
কৃতার্থ হয়ে যায় ঢোঁড়াই। সে অবাক হয় একই মায়ের পেট থেকে লাডলীবাবু আর অনোখীবাবু দুজন দুরকমের লোকের জন্ম হয় কী করে!
ঢোঁড়াই! ঢোঁড়াই!
এর পর চারিদিকে কেবল ঢোঁড়াইয়ের নাম। সকলের ক্ষেত থেকে বালি সরাবার কাজের তদারক করে ঢোঁড়াই, কিন্তু কেন যে সে কুয়োর বালি তোলার কাজ আরম্ভ করেছিল, মনের কোণের সেই গোপন খবরটা সে কাউকে জানতে দেবে না। সেটা ঢোঁড়াইয়ের নিজের জিনিস।
———
[৪৭৯. ভাল লোকের অর্থ বড়লোক, জিরানিয়া জেলাতে।]
.
সাগিয়ার যাঞ্চা
কলির রঘুনাথ মহাৎমাজী। তাঁর চেলাদের বলে কাংগ্রিস। বিলেত থেকে এসেছিল লাল টকটকে সাহেবের দল ভূমিকম্পের লোকসান দেখবার জন্য। কাংগ্রিসের লোকের সঙ্গে গঞ্জের বাজারে যাওয়ার পথে লাডলীসাহেবের বাড়ি হয়ে যায়। অতিথ-অভ্যাগতকে আলবৎ খাতিরদারি (৪৮০) করতে পারে বাবুসাহেবরা। পুরি খেল না। লোটা-ভরা গরমাগরম মোরে দুধের মধ্যে হলে থেকে বার করে চায়ের পাতা দিল। লাডলীবাবু তাড়াতাড়ি নতুন তোয়ের করা খড়ের ঘরটা থেকে একথালা ভুরা এনে দিলেন। হাকিম-দারোগারা ইদানীং বাবুসাহেবের বাড়িতে আসতেন না, তাই চা ছিল না তাঁদের বাড়িতে; নইলে অমন দশটা সাহেবকে মোরে দুধে নাইয়ে দিতে পারে বাবুসাহেব।
এই দলের সঙ্গে লাডলীবাবুও গিয়েছিল গঞ্জের বাজারে। ফিরে এসে খবর দেয়, কাংগ্রিস থেকে সাহায্য করবে লোকদের, বিশেষ করে গরীবদের। নতুন নতুন কুয়ো খুঁড়িয়ে দেবে; মাটির পাট নয়, সিমেন্টের পাট দেওয়া। লাখ লাখ বস্তা সিমেন্ট এসেছে, জিরানিয়াতে মাস্টার সাহেবের আশ্রমে। বাঁশ, খড়, কাঠের তো কথাই নেই। এই সরসৌনী থানায় রিলিফ দেওয়া হবে লাডলীবাবুর রিপোর্ট-এর উপর। তাই জন্যেই সরকার ছেড়ে দিয়েছে কাংগ্রিসের লোকদের জেল থেকে। কোথায় গেল এখন সাহেবি-টুপি-পরা সরকার? কত ধেনো জমি বালি পড়ে উঁচু হয়ে গেল, তার খবর নিয়েছে কি, ওই খাসী খাওয়ার যম দারোগাসাহেব?
বড় সাচ্চা লোক লাডলীব বুটা। সে কাংগ্রিসে বলে দিয়েছে যে, তার নিজের গাঁ বিসকান্দার রিপোর্ট যেন উপর থেকে কাংগ্রিসের লোক এসে নিয়ে যায়। গাঁয়ের সবাই তার পরিচিত। কাকে ছেড়ে সে কাকে দেবে। সত্যি, দৈত্যকুলে এমন প্রহাদ জন্মাল কি করে। যেদিন লাডলীবাবু প্রথম জেল থেকে এল, সেদিন বাবুসাহেব সিধা হুকুম দিয়েছিল যে, এক হপ্তার মধ্যে তাকে কাংগ্রিস ছাড়তে হবে। লাডলীবাবুটাও নাকি রুখে জবাব দিয়েছিল, তোমাকে এক হপ্তার মধ্যে জজসাহেবের সেসরী ছাড়তে হবে। অমনি জোঁকের মুখে নুন, এঁটুলির গায়ে চুন। সবে বলে বাবুসাহেব আড়াইশ টাকা খরচ করে সেসরীতে আবার নাম ঢুকিয়েছে।
লাডলীবাবু আবার বলেছে যে মহাৎমাজী আসবেন জিরানিয়ায়। ভূমিকম্পে মুল্লুকের লোকসান দেখে তাঁর প্রাণ কেঁদেছে। এত বড় সন্ত তিনি যে আঙিনায় কোণের সরষে গাছটা পর্যন্ত ঝটা চাপা পড়লে তার প্রাণ কেঁদে ওঠে। কোথায় থাকেন মহাৎমাজী। পাক্কী যেখানে শেষ হয়েছে তার থেকেও অনেক দূরে, মুঙ্গের তারাপুর, অযোধ্যাজী র চাইতেও দূরে। পুরুবে ধান কাটনীর দেশ, গনৌরীর ভাইটা যেখানে কাজ করে, সেই কলকাতা, জিরানিয়া, তাৎমাটুলি, বিসকান্ধা, শোনপুরের মেলা, কুশীজী পার হয়ে গঙ্গাজী পার হয়ে অনেক গা, আর একটা কী যেন খুব ভাল নাম, ভাগলপুর আর কাটিহার, আরও কী কী যেন…এই মুল্লুকটার ভালমন্দ দেখাশুনার ভার মহাৎমাজীর উপর। আঙুলের ডগা কেটে গেলে মাথা জানতে পারবে না? তার ব্যথা লাগবে না? তাই মহাৎমাজী আসছেন জিরানিয়াতে।
লাডলীবাবুকে নিশ্চয় মহাৎমাজী খুব পেয়ার করেন। ধন্যি জীবন লাডলীবাবুর!
সাগিয়া হুজুগে নেচে উঠবর মেয়ে নয়। তবুও গানহী ভগমানকে দর্শন করবার লোভ সামলাতে পারে না। এক সিরিদাস বাবাজী ছাড়া আর কোনো সন্তের দর্শন তার ভাগ্যে ঘটেনি। না ঢোঁড়াই , আমাদের নিয়ে চল।
মোসম্মতের গম্ভীর ভাবটা আজকাল কেটেছে। সে-ও মেয়ের কথায় সায় দেয়। ঢোঁড়াই নানা রকম ছুতো দেখায়। কিন্তু মোসম্মতের সঙ্গে পেরে ওঠা শক্ত।
বারো কোশ পথ তো কী হল? কত দূর দূর থেকে বলে লোকেরা আসবে। গাঁয়ের অন্য মেয়েরা যাচ্ছে না কে বলল? রাজপুতটোলা থেকে সাতখানা গাড়ি যাবে। গাড়ি নেই বলে কি আমরা যাবো না। না যাক কোয়েরীটোলার আর কেউ, আমরা যাব। পাক্কী দিয়ে হাওয়াগাড়িতে চলে যাবেন মহাৎমাজী। আমাদের টোলার লোকেরা সেই ঝাঁকি দর্শনেই খুশি। আজ আছি, কাল নেই। তীরথ সাধু-সঙ্গ জীবনে হল না। কম্মের মধ্যে সেই মরা লোকটার নামে একটা ইঁদারা করে দিয়েছিলাম। সেটা পর্যন্ত ভূমিকম্পে ফেটে গিয়েছে। কপালই আমার ফাটা রে ঢোঁড়াই। হয়তো দেখবি দর্শনের আগেই আমি খতম হয়ে গিয়েছি। মরা স্বামী জামাইয়ের নাম করে মোসম্মত বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে বসে।
ঢোঁড়াই এর আগে জিরানিয়া যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেনি। কিন্তু সাগিয়াটা তো কখনও কিছু আবদার করে না। তার কথা ঢোঁড়াই ঠেলতে পারে না।
এতদিন সে এই বিষয়ে নিজের মনের উপর কড়া রাশ টেনে রেখেছিল। ঢোঁড়াই নিজের কাছে পর্যন্ত স্বীকার করতে চায় না যে, জিরানিয়ার আকর্ষণ সে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। পাছে আবার কেউ বুঝে ফেলে, তাই ঢোঁড়াই জিরানিয়া ফেরত কোয়েরীটোলার লোকদের নিজে থেকে খুঁচিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করে না। বিল্টা গত বছর মোকদ্দমার তদবির থেকে ফিরে বলেছিল যে, বকরহাট্টার মাঠে ফট ফট ফট ফট করে হওয়াগাড়ি চলে আর বিঘার পর বিঘা জমি চাষ হয়ে যায়। ঐ গাড়ি মেরামতের ঘর করেছে পাক্কীর পীপর গাছের কাছে। দত্যির মতো গাড়িগুলো দেখলেই গা ছমছম করে। এরই মধ্যে একটা লোকের জান নিয়েছে। লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল পিছনে। বলা নেই, কওয়া নেই, উপরের লোকটা দিয়েছে গাড়ি চালিয়ে। আর যাবে কোথায়। পিছনের লোকটা হালের ফালগুলো দিয়ে একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। সরকারি ব্যাপার বলে সাজা হয়নি কারও, না হলে ডেরাইভার সাহেবকে লটকে দিত হাকিমরা। রামনেওয়াজ মুন্সি নিজে বলেছিল।
ঢোঁড়াই সেদিন বিল্টাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ময়নার জঙ্গলগুলোও কেটে দিয়েছে নাকি বকরহাট্টার মাঠের?
বিল্টা একটু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। হালওয়ালা হাওয়াগাড়ির কথা জানতে আগ্রহ লোকটার নেই, জানতে চায় ময়নার জঙ্গলের কথা! ঢোঁড়াইটা কী রকম যেন।
ঢোঁড়াই অপ্রস্তুত হয়ে বলেছিল, ময়নার ডাল দিয়ে কোদালের বাঁট হয় কিনা, তাই মনে এল।
এমন জিরানিয়ার খুচরো খবর আরও দু-একদিন ঢোঁড়াইয়ের কানে এসেছে। কিন্তু অধিকাংশ গাড়োয়ান চোখ বুজে কানে তুলো গুঁজে গাড়ি চালায়। কোনো খবর রাখে না। কেবল জিরানিয়া বাজারের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালানোর কেরামতির বড়াই। কেউ রলেও হয়তো তালে মহলদার কিম্বা অন্য কোনো চেনা লোকের কিছু খবর পাওয়া যেত। দু-বৎসরের কথাটা এক যুগ আগের বলে মনে হয়, আর এক যুগ আগেকার কথাগুলো মনে হয় যেন সেদিনকার। কতদিন মনের কোণে কত ইচ্ছা এসেছে। ছেলেটাকে দেখতে, রামিয়ার কোলে। রাতের বেলায় গিয়ে বলদজোড়াকে একটু আদর করে আসতে। সাহস হয়নি। ঠেলে দূরে করে দিয়েছে এইসব চিন্তাগুলোকে মন থেকে। বিসকান্ধা তো আর খারাপ লাগে না। লোকের কি আর জায়গা ভাল খারাপ লাগে। সেখানকার লোকজনের সঙ্গে সম্বন্ধটাই লাগে ভাল কি বা খারাপ। এখানেও তো ঢোঁড়াইয়ের নতুন মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে কত লোকের সঙ্গে। ছোটবেলার জানাশুনা আর বড় হয়ে পরিচয়ের মধ্যে তফাৎ গরম ভাত আর ঠাণ্ডা ভাতের মধ্যে তফাত। জিরানিয়ায় যেতে ইচ্ছে করলেও সে এতদিন ঠিক করেছিল যে, মরে গেলেও সে ওমুখো হবে না জীবনে! এখন ঠিক করে যে যেতে ইচ্ছে না থাকলেও সে যাবে। নিজের ইচ্ছাটাই জীবনের একমাত্র জিনিস নয়।
অন্যের ইচ্ছাও কত সময় রাখতে হয় দুনিয়ায়। নিজের সঙ্কল্প বজায় চাইতে সাগিয়ার আবদার রাখতে মনে তৃপ্তি পাওয়া যায় বেশি।
অন্ধকার হওয়ায় পর সে সাগিয়াদের নিয়ে জিরানিয়ায় পৌঁছুবে, যাতে তাৎমাটুলির কোনো চেনা লোকের সঙ্গে তার দেখা না হয়ে যায়।
.
পাপ ক্ষয়ের উপায় কথন
জিরানিয়ার সেদিন মোসম্মত আর সাগিয়া প্রাণভরে দর্শন করেছিল। ধন্যি তাদের পুণ্যের বল! ধন্য হো রামচন্দ্রজী! দেখে আর তাদের তৃপ্তি হয় না। সাধুবাবাজী তারা এর আগেও দেখেছে। কিন্তু দেবতার সাক্ষাৎ দর্শন এর আগে হয়নি। চারিদিকের সাদা আলোগুলো, তা শরীরের ঠাণ্ডা জ্যোতির কাছে মিটমিট করছে।
কত কী বললেন মহাৎমাজী! তাঁর কথা নিজে কানে শুনতে পাওয়া কি কম ভাগ্যের কথা।…
পৃথিবীর পাপের বোঝা বেড়েছে। তাই জন্যই দেশে এই ভূমিকম্প হয়েছে।
ঢোঁড়াইয়ের মনে হয় ঠিক বলেছেন মহাৎমাজী। রাজপুতদের পাপ; তাৎমাটুলির মোড়লের পাপ।
অছুৎ হরিজনদের উপর আমরা অন্যায় করি। তাদের মানুষ বলে ভাবি না। ধরতিমাই সে পাপের বোঝা সইতে পারেননি।…
কথাটা ঢোঁড়াই ঠিক বুঝতে পারে না। রাজপুতদের পাপের কথা কি তাহলে ভুল? তাৎমাটুলির মোড়লদের পাপের কি তাহলে কোনো ওজন নেই।
…এই বিপদে কত লোক জেরবার হয়ে গিয়েছে! রামজীর উপর বিশ্বাস রাখবে। সমাজে যে সব চাইতে নিচে আছে, তার সঙ্গেও ভাইয়ের মতো ব্যবহার করবে। তবে না, পৃথিবীতে রামরাজ্য ফিরে আসবে। রামরাজ্যে—
নহিঁ দরিদ্র কোউ দুখী ন দীনা
নহিঁ কোউ অবুধ ন লছানহীনা। [৪৮১]
রামরাজ্যে দরিদ্র, দীনদুঃখী, নির্বোধ বা অলুক্ষণে কেউ থাকবে না। তারই জন্য আমরা চেষ্টা করছি, তারই জন্য তোমাদের মাস্টারসাহেব চেষ্টা করছেন। তাঁর উপরই এ জেলার ভূমিকম্পের রিলিফ সেবার ভার আমরা দিয়েছি। যে মাস্টার সাহাব পৃথিবীতে রামরাজ্য আনবার জন্য নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন আমি জানি তাঁর হাতে গরীবের উপর অবিচার হবে না।..
এতক্ষণে ঢোঁড়াইয়ের নজর পড়ে মাস্টারসাহেবের উপর। আগের চেয়ে একটু বুড়ো বুড়ো লাগছে। তবু একজন চেনা লোকের মুখ সে দেখতে পেয়েছে। এতদূর থেকেও ভারি আপন-আপন লাগে মাস্টরসাহেবকে।
মহাৎমাজীর পা ছোঁয়া কি সোজা ব্যাপার! জিরানিয়া বাজারের সাওজী যেন সকালবেলা দানা ছিটোচ্ছে কবুতরদের। ওখানে পৌঁছানো সাগিয়ার সাধ্যি নাই। এখানে থেকেই ছুঁড়ে দে পয়সা সাগিয়া, মহাৎমাজীর নাম করে। দে আমার কাছে, আমিই ছুঁড়ে দি। তুই কি পারবি অতদূরে ফেলতে?
আবার গায়ে-টায়ে না লাগে! মোসম্মতকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সে প্রণাম করবেই মহাৎমাজীর পা ছুঁয়ে। ভিড়ের চাপে সে এগিয়ে যায়। ঢোঁড়াই সাগিয়াকে আগলাবার জন্য সেখানেই থেকে যায়।
তারপর ঢোঁড়াই আর সাগিয়া বহুক্ষণ অপেক্ষা করে মোসম্মতের জন্য। ভিড় পাতলা হয়ে যাবার পরও মোসম্মতকে খুঁজে পাওয়া যায় না। দুজনেই চিন্তিত হয়ে ওঠে। গেল কোথায়। গাঁয়ের কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়ে থাকবে। হয়তো তাদেরই সঙ্গে চলে গিয়েছে। দেখ দেখি আক্কেলখানা একবার।
জিরানিয়া থেকে বেরিয়ে আকাশ-বাতাসের পরিচিত গন্ধটা হঠাৎ ঢোঁড়াইয়ের নাকে যায়। চোখ বাঁধা থাকলেও সে বুঝতে পারত যে কোথায় এসেছে। শীতের সাঁঝে শহর থেকে বেরিয়ে এখানে এলেই কনকনানিটা একটু বেশি মনে হত। আরম্ভ হয়ে যেত স্বর্ণলতায় ভরা কুলের ঝোঁপ, হরিয়ালের ঝাঁকের অশত্থপাতার সঙ্গে খুনসুটি।
একটা অজ্ঞাত ভয়ে শিহরণে ঢোঁড়াইয়ের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। বুকের টিপটিপুনিটা কমানোর ক্ষমতা মানুষের হাতের মধ্যে থাকলে বেশ হত। কী সব যেন বলছে। চারিদিকে ঢোঁড়াই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। অন্ধকারে বকরহাট্টার মাঠে গাছপালা আছে কিনা কিছুই ঠাহর করা যায় না। শুনেছিল তো চীনাবাদামের চাষ হচ্ছে। তাড়াতাড়ি পার হয়ে যেতে হবে এই জায়গাটুকু। যদি আবার কোনো চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। নিজের দিকটায় তাকাতে ভয় করে। সেই দিকটা ছাড়া, এতক্ষণ ঢোঁড়াই আর সব দিকের জিনিস দেখবার চেষ্টা করেছে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না; কেবল মিটমিটে আলো দুচারটি। যে দিকটা দেখছে না সেটারই ছবি পড়েছে তার মনে, সাড়া জাগিয়েছে তার প্রতিটি রোমকূপে। এ কেবল একটা অহেতুক নয়। এ তার সত্তার অঙ্গ। এড়িয়ে যাবার উপায় নেই।…
..তার বাড়ির বাইরে একটা আলো জ্বলছে। কুপীর আলো বলে বোধ হয় না। নিশ্চয়ই সেই বাওয়ার দেওয়া বিলিতি লণ্ঠনের আলো। যদি সেই ছোটছেলেটা ঐ আলোর পাশে ঘুরঘুর করে বেড়াত এখন। একটা ছায়া নড়তেও যদি দেখা যেত ওখানে। সাগিয়া সঙ্গে না থাকলে আর একটু কাছে যেত সে বাড়িটার। সাগিয়াটা আবার লক্ষ্য করছে না তো। গোঁসাইথানের অশ্বত্থ গাছটার তলাটা ভাঁটের জঙ্গলে ভরে গিয়েছে। এটা গোঁসাইথান সাগিয়া। ভারি জাগ্রত। দুজনে সেখানে প্রণাম করে।
সেইখানেই পিদিম দিয়ে প্রণাম করার সময় আর একজনের চুলের বোঝ ছড়িয়ে পড়েছিল। গলাকাটা সাহেবের হাতার কুলের গাছটা আছে কিনা কে জানে। শুকনো পাতাভরা একটা গতাঁর মধ্যে ঢোঁড়াইয়ের পা পড়ে, হয়তো ভূমিকম্পের সময়ের ফাটল। কিন্তু ঢোঁড়াইয়ের মনে হয় যে এটা নিশ্চয় বাওয়ার উনোনের গর্তটা। কেন যেন সেটাকেও মনে মনে প্রণাম জানায়।
গরুর গাড়ির সার চলেছে রাস্তা দিয়ে। নিশ্চয়ই মহাৎমাজীর সভায় গিয়েছিল এরা সকলে। পাক্কীর ধারে এটা আবার কার বাড়ি? ইয়া উঁচু! নিটের বাড়ি? কয়েকজন হাফপ্যান্ট পরা লোক জটলা করছে। এইটাই তাহলে লাঙলের হাওয়াগাড়ি মেরামতের ঘর, যেটার কথা বিল্টা বলেছিল। লোকগুলোর গল্প কানে ভেসে আসে। এতদিন থেকে এত হই-হই রইরই। লে হালুয়া! তিন মিনিটের মধ্যে মহাৎমাজীর তামাশা শেষ হয়ে গেল। খেল খতম। পয়সা হজম! [৪৮২]
কতদিন পর ঢোঁড়াই লে হালুয়া! খেল খতম পয়সা হজম। কথাগুলো শুনল। বিসকান্ধায় এসব কেউ বলে না। এই কথা কয়টার মধ্য দিয়ে সমস্ত পুরনো তাৎমাটুলিটা মনে হচ্ছে কথা বলছে তার সঙ্গে।
জানা গন্ধটা ফিকে হয়ে আসছে। আর ঢোঁড়াইয়ের তাড়াতাড়ি এ জায়গাটা পার হয়ে যাবার উৎসাহ নেই। শেষ মুহূর্ত সে গন্ধটা উপভোগ করবার চেষ্টা করে।…
এতক্ষণে সাগিয়ার কথা কানে আসে। এখানে খানিক বসে মায়ের জন্য অপেক্ষা করে গেলে কেমন হয়? হয়তো আগেই চলে গিয়েছে।
এই গাড়োয়ান। এই শগগড়! [৪৮৩]…তালে মহলদার ঘুমন্ত গাড়োয়ানদের জাগিয়ে পয়সা আদায় করছে। মহাৎমাজীর কৃপায় আজ হঠাৎ মরসুম পড়েছে তার।
না না, সাগিয়া, আর খানিক আগে গিয়ে বসা যাবে মোসম্মতের জন্য।…
————
[৪৮০. উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন। ৪৮১. তুলসীদাস থেকে। ৪৮২. এ জিরানিয়া শহরের বাক্যরীতি; গ্রামঞ্চলের নয়। হালুয়া-কথাটির অর্থ আশ্চর্য! কোনো পর্ব শেষ হলেই বলে শেষ হল! পয়সা হজম হয়ে গেল। ৪৮৩. গরুর গাড়ি।]
.
মোসম্মতের অভিশাপ
ঢোঁড়াই আর সাগিয়া যখন গিয়ে বিসকান্ধায় পৌঁছুল তখনও সাগিয়ার মা বাড়ি ফেরেনি।
এ দ্যাখ আবার কী কাণ্ড হল। না ঢোঁড়াই, তুমি জিরানিয়াতে একবার খোঁজ-খবর কর মায়ের। তখনি আমি বলেছি। কোথা থেকে কোথায় চলে যাবে। বুড়ো মানুষ।
দেখা যাক না খানিক। কোন দলের সঙ্গে নিশ্চয়ই আসবে। আর পাক্কী ধরে একা আসতে অন্ধতেও পারে।
সাগিয়া বিশেষ আশ্বস্ত হল বলে মনে হল না। ঢোঁড়াই বলদের খাওয়ার জন্য জল আনতে চলে যায় ইঁদারায়। মোসম্মত দশ মরদের সমান? ও হারাবার মেয়ে নয়! অথচ এ কথাটা সাগিয়ার কাছে বলা যায় না।
উৎকণ্ঠায় যখন সাগিয়ার পুণ্য অর্জনের মিষ্টি আমেজটুকু প্রায় উবে গিয়েছে, তখন তার মা এসে বাড়ি পৌঁছুল। সাগিয়া আর ঢোঁড়াই দাওয়ায় বসে। দুশ্চিন্তায় থমথমে মুখ। উনোনে আগুন পড়েনি।
…মহাৎমাজীকে প্রণাম করবার পর মোসম্মত ভিড়ের চাপে কোথায় যেন চলে গিয়েছিল। আঁধারে দিক ঠিক করতে পারেনি। ভীড়ের সঙ্গে এ মুল্লুক ও মুল্লুক ছিষ্টি সাত মুল্লুক ঘুরতে ঘুরতে দেখা গিধর মণ্ডলের সঙ্গে হালুয়াই-এর দোকানের সমুখে। গিধর আবার তাকে নিয়ে যায় সভার মাঠে। সেখানে গিয়ে কত ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি! ও ঢোঁড়াই! ও সাগিয়া! কে শুনছে বুড়ির কথা! তখন কেঁদে বুক চাপড়ে মরে। গিধর বলে, ভাবনা কী; ওরা বাড়ি ফিরবে ঠিকই। ওই হারামজাদাটার সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার মেয়ে সাগিয়া নয়। তবে দিনকাল খারাপ; মন না মতি; ঘি আর আগুন। বাড়ি পৌঁছুবে ওরা ঠিকই। কেবল আগে আর পরে। তুমি কেঁদে আর কী করবে। আমার গাড়িতে করে তোমায় নিয়ে যাব। ভোররাত্রে বেরুনো যাবে? বুড়ো মানুষ; এতটা পথ হেঁটে আসবার দরকার কী ছিল? আমাকে একটা খবর দেওয়াতেও আজকাল অপমান হয় তোমাদের। মহাৎমাজীর আশীর্বাদে।
চোখের জল আর দুলুনির ফাঁকে ফাঁকে মোসম্মত গিধর মণ্ডলকে কত হাবিজাবি মনের কথা বলে। বড় আপনার জন বলে মনে হয় গিধরকে আজ। লোকটা খারাপ নয়। তবে দশে মিলে বিশেষ করে ঢোঁড়াই অহরহ মোসম্মতের কানে মন্তর পড়ে পড়ে বিষ করে তুলেছে লোকটাকে। দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষেছিল না জেনে এতদিন। তোকে দোষ দিই না গিধর। তুই করেছিস আমার খুব। নিজের হাত আমি নিজে কেটেছি।
গল্পে গল্পে এক রাত্রের কথা বেরিয়ে আসে। কথাটা লচুয়া চৌকিদার গিধর মণ্ডলকে বলেছিল। তুমি জান না মোসম্মত, এ নিয়ে কানাকানি হয়েছিল গাঁয়ে। তোমায় আর এ কথা কে বলবে?
মোসম্মতের চোখে ছানি পড়েনি এখনও রামজীর কৃপায়। কানেও সে তুলো খুঁজে থাকে না। ইঙ্গিতে ইশারায় ইঁদারাতলায় এ নিয়ে কেউ ঠেস দিয়ে কথা বলেছে বলে মনে তো পড়ে না তার। আগে সে ভেবেছিল চুপ করে যাওয়াই ভাল। এতক্ষণে জানতে পারে যে, দুনিয়াসুদ্ধ সব লোক তাকে দেখে এসেছে এতদিন। আর আজকের এই কেলেঙ্কারির পর তো গিধর টিক্কিার করে দেবে সারা গাঁয়ে। এর চাইতে সাগিয়াকে রাজপুতদের বাড়ি ঝিয়ের কাজ করতে পাঠালে দুর্নাম কম ছিল।…
গাড়ি থেকে নামতেই ঢোঁড়াই আর সাগিয়া ছুটে আসে, রাজ্যের প্রশ্ন মুখে নিয়ে। একটা কথারও জবাব দেয় না সাগিয়ার মা। সাগিয়া ঢোঁড়াইকে ইশারা করে, খুব চটেছে! ঢোঁড়াইয়ের দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে সাগিয়ার মা বাড়ির ভিতরে ঢোকে।
ঢোঁড়াই অনেকদিন থেকে বলব বলব মনে করছি। তোমাকে রাখা আমার পোষাবে না। মুখে খানিক, আর পেটে খানিক, তেমন কথা নেই আমার কাছে।
গিধর জিজ্ঞাসা করে, মাইনে-টাইনে বাকি নেই তো?
ঢোঁড়াই, সাগিয়া আর মোসম্মত তিনজনের কারও কানে কথাটা গেল কিনা বোঝা যায় না।
.
সাগিয়ার অন্তর্ধান
যখন ঢোঁড়াইয়ের জীবনটা চলনসই গোছের হয়ে আসে, অমনি একটা করে আঁধি উঠে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায়। তার জীবনে বরাবর লক্ষ্য করে আসছে এটা ঢোঁড়াই! মনের রাজ্য চালানোর এই রীতি রামন্দ্রজীর।
সেদিন তখনই সে বিল্টার বাড়িতে চলে এসেছিল। আসবার সময় সাগিয়ার দিকে সংকোচে তাকাতে পারেনি।
চাকরি থেকে জবাব হয়েছে কি রে?-বিল্টা হেসেই বাঁচে না। গিধরটা আছে নাকি এর মধ্যে? সে আমি আগেই বুঝেছি।
টোলার লোকে এ নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না।
জোয়ান মরদ; খেটে খাবে; তার এখানেই বা কী আর ওখানেই বা কী? মাথার ঘায়ে বলে কুকুর পাগল! এখন ঐ ডাইনী মোসম্মতটা রইল কি মরল কে ভেবে মরছে তা নিয়ে। ও বুড়িটার কথা ভাববার ঠিকে দেওয়া আছে, ঐ শালা গরুখোরটার উপর। আমনসভার জুলুস ঘুচেছে গিধরটার গা থেকে। আর এখন সরকারের আমনসভার দরকার নেই। নতুন দারোগা সাহেব এসেছে। তার সঙ্গে লাডলীবাবুর বেশ মাখামাখি হয়েছে, ভূমিকম্পের রিলিফের ব্যাপার নিয়ে। দারোগা হাকিমেরা আবার এস বাবুসাহেবের ভাঙা বৈঠকেই পুরি-হালুয়া উড়োচ্ছে। এখন গিধরকে পোছে কোন রাজপুতটা। বাবুসাহেবের লেজ ধরে যতখানি যাবে, ততখানি ওকে পুছবে ওরা আর দারোগাসাহেব। কষে ধরে থাকিস গিধর! দেখিস, বাবুসাহেবের কাছাটা আবার খুলে না যায়!
এত কথা ঢোঁড়াইয়ের ভাল লাগে না। আর মন টক হয়ে আছে।
কিছুদিন পর বিদেশিয়ার নাচ-এর দল এসেছিল গাঁয়ে। গরম আর বর্ষাটা গায়ে। গাঁয়ে দেখাবে, আর শীতকালে ঘুরবে মেলায়। পচ্ছিম-এর জিনিস; জিনিস ভাল। হাটের চালাটায় উঠেছে বিদেশিয়ার দল। স্থায়ী কুষ্ঠরুগীটা তাদের জন্য খাতির করে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। গাঁয়ের ছেলেবুড়ো ভেঙে পড়েছে সেখানে। সরকার এখন আর বিদেশিয়ার গানের উপর বিরক্ত নয়। কেননা মহাৎমাজীর নিমক তৈরির গান, তালগাছ কাটার গান, চরখার সুদর্শন চক্র দিয়ে দুশমন তাড়ানোর গান উঠে গিয়েছে এরই মধ্যে। তবু লচুয়া চৌকিদারকে এখনও রিপোর্ট দিতে হবে থানায়, বিদেশিয়ার দল কোন গান গাইল।
ঢোঁড়াই দুদিন যায়নি বলে ভাল লাগে না। তৃতীয় দিনে বিল্টা আর গনৌরী জোর করে ধরে নিয়ে যায় ঢোঁড়াইকে। কত বলে নতুন নতুন গান আমদানী করেছে এই দল, লালমুনিয়ার গান, গরুবেচার গান কত কত! শুনলে কান্না আসে। আজকেই শেষ। কাল চলে যাবে এরা ফলাহাটে। কোনো ওজর শোনা হবে না তোর ঢোঁড়াই! বাধ্য হয়ে ঢোঁড়াই যায়। গান তখন চলেছে।
গিয়েছে সে পুরুবে বাঙালা মুলুকে,
আমাকে ছেড়ে গিয়েছে আমার রাজা,
গিয়েছে করতে চাকরি,
নিশ্চয় শুখিয়ে হয়েছে লাকড়ি।
মরি মরি। হাঁটুর উপর রঙিন ধুতি,
কী শোভাই দিছিল! [৪৮৪]।
ভাবলেই মন দিয়ে রস গড়ায়।
ওরে বিদেশী।
জানি তুমি এখন কার কথা শুনছ,
জানি কেন রোজগারের পয়সা গুনছ,
নিশ্চয়ই তার জন্য কিনছ,
আঁটো আঁটো ফাটো ফাটো চোলি। [৪৮৫]
ওরে বিদেশী!
মেয়ে-পুরুষ সকলেই সীতাজীর মতো অত ভাল মেয়েটার দুঃখে হাপুস নয়নে কাঁদছে। বিল্টা যে বিল্টা সে সুদ্ধ নাক ঝাড়বার ছুতো করে লুকিয়ে চোখটা মুছে নিল। কিন্তু ঢোঁড়াই নির্বিকার। সব লাগছে ফিকে, পানসে। কত অঙ্গভঙ্গি করে দেখানো, কত কসরত করে গাওয়া শেষের লাইনটা, ঠিক ঢোঁড়াইয়ের সম্মুখে এসে তারপর তার থুতনিটা ধরে নেড়ে মেয়েটা শেষ করল ওরে বিদেশী। নিশ্চয়ই বিল্টাটার শেখানো। তাই আজ ঢোঁড়াইকে ধরে এনেছে। রাগ হলেও রাগ দেখাতে নেই গানের আসরে। এটা হল ইজ্জতের কথা। ঢোঁড়াই ট্যাকের থেকে এক আনা পয়সা বার করে দেয়। সকলে হেসে বলে, যাক লোকটার দিল আছে!
অথচ ঢোঁড়াইয়ের মনে এ গান একটুও সাড়া জাগায় না। দেখতে হয় দেখছে। শুনতে হয় শুনছে। সে দশটা আঁটো আঁটো ফাটো কাঁচুলি কিনলেও দুনিয়ার কোথাও কেউ কেঁদে মরবে না। দুনিয়াতে তার জন্য কেঁদে মরবার লোক থাকলে আর তার দুঃখ কিসের!
পরের দিন গাঁয়ে দারুণ হট্টগোল। সাগিয়া চলে গিয়েছে বিদেশিয়ার দলটার সঙ্গে।
…ঐ যে দলের কর্তাটাকে দেখিসনি, শিয়ালের লেজের মতো গোঁফ, জবজবে তেল মেখে টেড়ি কাটা, ঐ যেটা হরমুনিয়া বাজায় সেইটার সঙ্গেই ভেগেছে। রাতে নাচ দেখে বাড়িতে ফিরেছিল। তারপর ভোর রাতে উঠে, বাইরে যাবার নাম করে, উড়েছে ফুভূত করে। সকালে গিধর কথাটা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল প্রথমটায়। কিন্তু পারেনি। কে কে যেন যেতে দেখেছে, সাগিয়াকে বিদেশিয়ার দলের গরুর গাড়িতে। বাজে কথা নয়, তারা স্বচক্ষে দেখেছে, মাথায় কাপড়টা পর্যন্ত তুলে দেয়নি বেহায়া মেয়েটা।
সাগিয়া! সাগিয়া পালাবে ঐ লোকটার সঙ্গে! বিশ্বাস হয় না ঢোঁড়াইয়ের। কাপড়টা পর্যন্ত টেনে দেয়নি মাথায় গাঁয়ের লোক দেখেও! সে যে জোরে কথা বলতে জানে না। রাগতে জানে না বলে গিধরকে দেখে চোখ নামিয়ে দেয়। ছেলের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে মরে। মনের মধ্যে ঝড় বইলেও মুখের ভাব বদলায় না। ঠাণ্ডা মিষ্টি কথা ঝরে তার মুখ থেকে, ঠিক যেন মালসা থেকে বোশেখে টুপটুপ করে জল পড়ছে নিচের তুলসী গাছটার উপর। হাঁটুর উপর রঙিন ধুতির গান শুনে, ঘর ছাড়বার মেয়ে তো সে নয়। ঢোঁড়াই বুঝবার চেষ্টা। সে জানে সাগিয়াকে। তার উপর রাগ করা যায় না। আওরত জাতটার উপর ঢোঁড়াইয়ের মনটা আর বিষিয়ে ওঠে না। গিধরের হাত থেকে বেঁচেছে সাগিয়া। সেই বিদেশিয়ার দলের মোচওয়ালা কর্তাটার উপরও তার রাগ হয় না। তার দুঃখ নিজের কপালটাকে নিয়ে। সব জায়গা থেকে তাকে উপড়ে ফেলে দিচ্ছে তার কপাল। রামজীকে পর্যন্ত সে আজ দোষ দেয় না। দুনিয়া চালানোর এই নিয়ম। তাদের নিজেদের দরকারেই তারা রামজীকে ডাকে। দুনিয়ার দরকার আছে রামচন্দ্রজীকে, কিন্তু তার এই দুনিয়াটা না হলেও চলে।
বিল্টা বলে, দলের কর্তাটা আবার কী জাত না কী জাত কে জানে। জাতের মেয়ে নিয়ে গেল আর সকলে তাই পিটপিট করে দেখবে? কত দূরই বা গিয়েছে। কাল থেকে তো ফকাহাটে বিদেশিয়ার গান হবার কথা আছে। শুনে ঢোঁড়াইয়ের মনেও একটু খটকা লাগে। লোকটা মুসলমান নয়তো? যে রকম জুলফির বাহার!
মোসম্মত এসে কেঁদে পড়ে। ঢোঁড়াই, তুই একবার যা ফলাহাটে; তুই বললে ফিরে আসতেও পারে। আমি গিধরের সঙ্গে গিয়েছিলাম, ফিরিয়ে আনতে পারিনি। কোন কথা বলেনি আমার সঙ্গে।
গিধর হন্যে হয়ে উঠেছে। সব গুছিয়ে এনেছিল আগঘাট বেঁধে। কেবল একটা দিক দেখেনি। এখন দেখছে সেই দিকটাই আসল। মোসম্মতকে নিয়ে ফিরবার সময় গিররা রামনেওয়াজ মুন্সির বাড়ি হয়ে এসেছিল। মুন্সিজী বলছে এ নিয়ে মামলা চলবে না। জুলফিওয়ালা দলের পাণ্ডাটাকে আমি জেলের খিচুরি খাইয়ে ছাড়ব; সদরে তিন দফার নালিশ ঠুকব; যতই মুন্সিজী মানা করুক না কেন। আমি ওকে ছাড়ছি না। অনিরুদ্ধ মোক্তারকে দিয়ে আমি এস.ডি.ও. সাহেবের কাছে মামলা দায়ের করব। শালা বলে কিনা, আমি কি ঐ আওরতকে নিয়ে এসেছি? ও নিজে এসেছে। ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পার, নিয়ে যাও। আমি আটকাচ্ছি না ওকে। বিদেশিয়ার গান শুনে হরহামেশা জোয়ান জোয়ান হুঁড়িয়া ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসে। যতদিন ইচ্ছে থাক, যখন খুশি চলে যাও। তাদেরই বলে আটকে রাখি না, তার আবার এই এত বয়সের আওরতকে আটকাব! ও চলে যেতে চায় এই মুহূর্তে চলে যেতে পারে।…ঐ ধড়িবাজটাকে জুলফি আর মোচ দেখেই চিনেছি আমি। কত বলে ভালা আদমীদের [৪৩৭] দেখে নিলাম হরমুনিয়ার বাজনাদার এসেছে আমাকে কানুন দেখাতে। আর বলিহারি ঐ মেয়েটার প্রবৃত্তির! গিধরের সব রাগ গিয়ে পড়ে সাগিয়ার উপর।
মোসম্মত ঢোঁড়াইয়ের পায়ে মাথা কোটে। না করিস না ঢোঁড়াই। কবে তোকে কী বলেছি সে কথাটা মনের মধ্যে গিট দিয়ে বেঁধে রাখিস না। বুড়ো হয়েছি, মুখের বাঁধন নেই। আমার সাতটা পাঁচটা নয়, ঐ একটা মাত্র মেয়ে। ঐ গিধরটার জন্যেই আজ আমার এই হাল। ওকে চুমৌনা করবার জন্য চাপ না দিলে হয়তো সাগিয়া আমার এমন করত না। তুই একবার যা ঢোঁড়াই।
ঢোঁড়াই যখন ফালকাহাটে গিয়ে পৌঁছল তখন রাত হয়েছে। ইটের উনান পেতে সাগিয়া বসেছে রাধতে, দলের লোকের জন্যে। পাড়ার লোকে ভিড় করছে খানিক দূরে গোলার সম্মুখে নিমগাছটার তলায়। সেই জুলফিওয়ালা দলের কর্তাটা তারই মধ্যেখানে বসে কথার তুবড়িতে আসর জমাচ্ছে। দলের অন্য সকলে হাটের এদিক সেদিক ছড়ানো মাচাগুলোর উপর গড়াচ্ছে।
আশ্চর্য লাগে ঢোঁড়াইয়ের। একটুও বৈলক্ষণ্য দেখা গেল না সাগিয়ার মুখে চোখে ব্যবহারে।
কে, ঢোঁড়াই। নিজের বসবার ইটটা এগিয়ে দেয় সাগিয়া। কুপীর আলোয় মুখে খুঁটিনাটি দেখা যায় না। এই আলো-আঁধারির খেলায়, সাগিয়ার নরম মুখটা পাথরের মুরত-এর মতো লাগছে। চোখের জলও কি তার শুকিয়ে গিয়েছে! ঢোঁড়াইকে দেখেও কি তার চোখের কোণে দুফোঁটা জল আসতে নেই। অদ্ভুত মেয়ে। কথা বলে না। একটা কথা বলতেও কি ইচ্ছা করছে না ঢোঁড়াই রে সঙ্গে।
ফিরিয়ে নিয়ে যাবার কথা ঢোঁড়াইয়ের মুখ দিয়ে বার হয় না। দারোগা হাকিমের সম্মুখে গড়গড় করে কথা বলে যায় সে, আর এখানে কী কথা বলবে খুঁজে পাচ্ছে। না। বলে, গিধর মণ্ডল এসেছিল না?
বলেই মনে হয় ঠিক এই গিধরের কথাটাই না তোলা উচিত ছিল এখন।
হ্যাঁ।
আবার কথা ফুরিয়ে যায়। সাগিয়া ভাতের ফেন গালে। ঢোঁড়াই একটা আধপোড়া পাটকাঠি ভেঙে, অন্ধকার মাটিতে কী সব হিজিজিবি কাটে।
মোসম্মত পাঠিয়েছিল।
বলেই, আবার ঢোঁড়াইয়ের মনে হয় যেন ভুল করেছে সে। ঠিক কথাটা বলা হয়নি। সাগিয়া মুখ তুলে তাকায়। কুপীর আলো পড়েছে মুখে। মুখ দেখে তার মনের নাগাল পাওয়া ভার। তবু ঢোঁড়াইয়ের মনে হয় যে, তার চোখদুটো কী যেন জিজ্ঞাসা করতে চায়। যদি এখনই বলে ও! তাই জন্য এলে? কথার সূক্ষ্ম মারর্পেচ ঢোঁড়াই বোঝে না।
যা মনে আসে তাই বলে ফেলে। আজ কী হয়েছে তার। যা বলতে চায় তা বলতে পারছে না কেন। কিছু কি তার বলবার নেই? কত কী ভেবেছে এতদিন। কিছু না বলাই ভাল ছিল। না আসাই ছিল উচিত। যাক, এসেছিল বলে তবু তো দেখা হল।
ঢোঁড়াই উঠে পড়ে।
মাকে দেখো।
ফরুতেও বান ডাকে। চোখের জল লুকোবার জন্য দুজনেই আঁধারের দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
—–
[৪৮৪. হাঁটুর নিচে পুরুষদের কাপড় নামালে এদের খারাপ লাগে। ৪৮৫. স্ত্রীলোকদের খুব ছোট কুর্তা। গানের লাইনটিতে আছে কসমস চোলিয়া। ৪৮৬. ভাল লোকদের অর্থাৎ বড়লোকদের।]