কয়েক দিন পর।
হাঁসুলী বাঁকে পৃথিবীর সঙ্গেই যথানিয়মে রাত্রি প্রভাত হয়। সেখানে ব্যতিক্রম নেই। গাছে গাছে পাখি ডাকে, ঘাসের মাথায় রাত্রের শিশিরবিন্দু ছোট ছোট মুক্তার দানার মত টলমল করে। বাঁশবনের মাথা থেকে, বনশিরীষ নিম আম জাম কঁঠাল শিরীষ বট পাকুড়ের মাথা থেকে টুপটাপ করে শিশিরবিন্দু ঝরে পড়ে মাটির বুকে। যে ঋতুতে যে ফুল ফোটার কথা সেই ফুলই ফোটে। পূর্ব দিকে নদীর ধার পর্যন্ত অবারিত মাঠের ওপারে—কোপাইয়ের ওপারের গ্রামে গোপগ্রামের চারিপাশে গাছপালার মাথায় সূর্য ওঠে। কিন্তু কাহারেরা জাগে সূর্য ওঠার অনেক আগে। পূর্বের আকাশে তখন শুধু আলোর আমেজ লাগে মাত্র, পূর্ব-দক্ষিণ কোণে শুকতারা জ্বলজ্বল করে। কাহাররা ওঠে সেই সকালে। আপন আপন প্রাতঃকৃত্য সমাধা করে মেয়েরা ঘরে-দোরে জল দেয়, মাজুলি দেয়, সামান্য যে বাসন কয়েকখানি রাত্রে উচ্ছিষ্ট হয়ে থাকে সেগুলি মাজে। গরু ছাগল বার করে তাদের জায়গায় বাধে। হাঁসগুলিকে ছেড়ে দেয়, কলরব করে তারা ছুটে গিয়ে নামে নীলের বাঁধের জলে, নেমেই ছুটে আসে ঘাটে, এঁটো বাসনের খাদ্যকণাগুলো মুখ ড়ুবিয়ে খুঁজে খুঁজে খায়। মুরগিগুলোকে ছেড়ে দেয়, তারা ছুটে যায় আঁস্তাকুড়ে, সারের গাদায়। পুরুষেরা প্রাতঃকৃত্য সেরে এই সকালেই ঘরে দোরে যে মাটির কাজগুলি থাকে, কোদাল নিয়ে সেই কাজগুলি সেরে ফেলে। পাষাণের মত মাটি-মেয়ে-পুরুষে আগের দিন সন্ধ্যায় কলসিতে ভরে জল তুলে ভিজিয়ে রাখে, সকালে কাহার মুনিষ তার উপর কোদাল চালায়। মাটির কাজ কিছু-না-কিছু থাকেই। পুরনো দেওয়াল মেরামত চলতে থাকে ধীরে সুস্থে। নূতন ঘর যদি কেউ করে, তার কাজ চলে দীর্ঘদিন ধরে। কিছু না থাকলে বাড়ির ধারে শাক-পাতার ছোট ছোট ক্ষেত কোপায় তারা। বাড়ির গাছা পেটের বাছার মতই গেরস্থের সহায়। গোটা শীতকালে এই ধারা।
এইসব সেরে তারপর কাহারেরা কাজে বার হয়।
সুচাঁদ ভোরে ওঠে। বঁটা দিয়ে উঠোন পরিষ্কার করতে করতে তারস্বরে গাল দিচ্ছে। আজ আর তার ভাষা অশ্লীল নয়—মর্মান্তিক অভিশাপ-তীক্ষ্ণ, এবং সে অভিশাপের মধ্যে দুঃখ লাঞ্ছনা, নিয়তির নিপুণ বিধানের মত স্তরে স্তরে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে সাজানো।
—যে ‘অক্তের’ ‘ত্যাজে’ এমন বড় হয়েছে, সে অক্ত জল হয়ে যাবেন তোমার। ‘গিহিনী ‘ওগ’ হবে, ‘ছেরউগী’ হয়ে পড়ে থাকবে, ওই পাথরের মত ছাতি ধসে যাবে, হাড় পাজর ঝুরঝুর করবে। যে গলার ত্যাজে হাঁকিয়ে পেঁচিয়ে ফিরছ, সেই গলা তোমার নাকী হয়ে পাখির গলার মত চি-চি করবে। যে হাতে তুমি আমাকে ব্যাঙ দিয়েছ, যে হাতে তুমি বাঁশবনে আগুন লাগিয়ে মা-মনসার বিটীকে পুড়িয়ে মেরেছ, সেই হাতদুটি তোমার পড়ে যাবে, কাঠের মত শুকিয়ে যাবে। দ্যাবতাকে যদি আমি পুজো করে থাকি, অতিথকে যদি আমি সেবা করে থাকি, তবে আমার কথা ফলবে—ফলবে ফলবে। হে বাবা কত্তা, হে মা-মনসা, হে বাবা জাঙলের ‘কলারুদ্দু’, হে মা চন্ননপুরের চণ্ডী, হে মা বাকুলের বুড়িকালী, হে বাবা বেলের ধম্মরাজ, তোমরা এর বিচার কোরো–বিচার কোরো।
বোধ করি হঠাৎ সুচাঁদের মনে পড়ে গেল চোখের কথা—চোখ নিয়ে তো কোনো অভিশাপ দেওয়া হয় নাই! সঙ্গে সঙ্গে চোখ নিয়ে অভিশাপ দিতে আরম্ভ করলে। ওই যে তোমার ড্যাবা চোখ, ওই চোখ তুমি হারিও। দিন ‘আত’ জল ঝরে ঝরে ছানি পড়ুক। কানা হয়ো তুমি—কানা হয়ো তুমি—কানা হয়। ওই ড্যাবা চোখ তোমার ‘আঙা’ ‘অক্তের’ ডেলার মতন কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে এসে ‘বিভীকার হয়ে যায় যেন।
এটি একটি বিশেষত্ব হাঁসুলী বাঁকের কাহারপাড়ার। ঝগড়া হলে সে ঝগড়া এক দিনে মেটে না। দিনের পর দিন তার জের চলতে থাকে এবং প্রাতঃকালে উঠেই এই গালিগালাজের জেরটি টেনে তারা শুরু করে রাখে। কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে থামে। আবার জিরিয়ে নিয়ে অবসর সময়ে নিজের ঘরের সীমানায় দাঁড়িয়ে বিপক্ষ পক্ষের বাড়ির দিকে মুখ করে এক-এক দফা গালিগালাজ করে। এবং কাহারদের ঝগড়ায় এই গালিগালাজের এই বাধুনিটি পুরুষানুক্ৰমে চলে আসছে, একে কলহ-সংস্কৃতি বলা চলে। তবে সাধকভেদে মন্ত্রের সিদ্ধি—এই সত্য অনুযায়ী সুচাঁদ এই বৃদ্ধ বয়সেও সর্বশ্রেষ্ঠা। ওদিকে আরও একজন গাল দিচ্ছে করালীকে—সে হল নয়ানের মা। সে গাল দিচ্ছে করালীকে একা নয়, পাখীকেও শাপ-শাপান্ত করছে।
হাঁপানির রোগী নয়ন উঠে বসে কাশছে আর হাঁপাচ্ছে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বুকের উপর ধর্মরাজের এক মোটা মাদুলি হাঁপানির আক্ষেপে চামড়া-ঢাকা পাজরার সঙ্গে সঙ্গে উঠছে আর নামছে। তার বাড়ির সামনেই একই উঠানের ওদিকে রতনের বাড়ি। রতন কোদাল চালানো শেষ করে বসে হুঁকো টানছিল আর গালাগালি শুনছিল।
হাঁপানিটা একটু থামতেই নয়ান দাওয়ার বাঁশের খুঁটিটা ধরে দাঁড়াল। চোখের দৃষ্টিতে তার অমানুষিক প্রখরতা ফুটে বেরুচ্ছে। এইসব দীর্ঘদিনের রোগীর চোখের রঙ বোধহয় একটু বেশি সাদা হয়। নয়ত জীর্ণ দেহ এবং কালো রঙের জন্যই নয়ানের চোখ দুটো বেশি সাদা দেখাচ্ছে।
রতন বললে—উঠলি যে?
–হুঁ।
—কোথায় যাবি?
—যাব একবার মুরব্বির কাছে।
—যেতে হবে না। বস।
না। এর একটা হেস্তনেস্ত–
—মুরুব্বি বেরিয়ে যেয়েছে।
–বেরিয়ে যেয়েছে! তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে রতনের দিকে, যেন অপরাধটা রতনের। নয়ান আবার প্রশ্ন করলে—এই ‘সমকালে গেল কোন ভাগাড়ে? কেউ তো এখনও যায় নাই?
রতন বললে–মাইটে ঘোষ এই সকালের ‘ট্যানেই’ কোথায় যাবে; ঘোষেদের চাকর এয়েছিল, ভারী মোট আছে—নিয়ে যেতে হবে চন্ননপুরের ইস্টিশান।
—তা হলে? হতাশ হয়ে পড়ল এবার নয়ান।
—তা হলে আর কি করব? বাড়িতে বসে আগে জল গরম করে আরসোলা সিজিয়ে খা। হাঁপটা নরম পড়ক। হাজার হলেও রতনের বয়স হয়েছে, মাতব্বরের বয়সী, বন্ধুলোক; খোদ মাতব্বর না হলেও প্রবীণ। স্নেহবশেই সে উপদেশ দিলে। নয়ানের মা বাসন মাজতে মাজতে গাল পাড়ছিল, সে হঠাৎ ছাইমাখা হাতে এগিয়ে এসে হাত দুটো রতনের মুখের কাছে নেড়ে বললে—তুমি তো মাতব্বরের ডান হাত। সলা-শুলুক-গুজগুজ তো খুব! বলি, মাতব্বরের এ কোন দিশী বিচার, এ কোন ঢঙের মাতব্বরি, শুনি! এ অন্যায়ে একটি কথাও বললে না তোমার মাতব্বর? বিচার করবার ভয়ে সকালে উঠে পালাল?
রতন বললে–তা আমি কি বলব? তোমরাই তাকে বোলো।
—বলব বৈকি, একশোবার বলব। ছাড়ব আমি? জমিদারের কাছে যাব, থানা পুলিশ করব।
—তা যা খুশি তুমি করতে পার। তবে সকালে উঠে বিচারের লেগে মাতব্বর বসে থাকবে—এ তোমাদের ভাল ‘নেকরা’ বটে।
নয়ানের মা বললমাতব্বর তোমার খুব ‘আঁতের’ নোক-তুমি বল কেনে, শুনি।
বিরক্ত হয়ে রতন হুঁকাটি রেখে গামছাখানা টেনে গায়ে চাদরের মত ফেলে বেরিয়ে পড়ল। সূর্য উঠে পড়ছে গোপগ্রামের গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে। রোদ এসে বাঁশবাঁদির ঘরগুলির চালের উপর পড়েছে; বনওয়ারীর সদ্য-ছাওয়া চালের নতুন খড়ের উপর যেন সোনা ঢেলে দিয়েছে।
একা রতন নয়, গ্রামের পুরুষেরা সকলেই বেরিয়েছে নীলের বধের উত্তর পাড় থেকে সরু আঁকাবাকা পথ বেয়ে নামছে জাঙলে যাবার মাঠে পথে।
মেয়েরাও সব এরপর বার হবে। সাতটার ট্রেন তাদের নিশানা।
হাঁসুলী বাঁকের এই জীবনই স্বাভাবিক জীবন। মন্থর গতিতে, পায়ে হাঁটা আলপথে। পদাতিকের জীবন তাদের। কথাটার মধ্যে একবিন্দু অতিরঞ্জন নাই। হাঁসুলী বাঁকে গরুর গাড়ির পথ পর্যন্ত নাই। জাঙল গ্রাম পর্যন্ত গরুর গাড়ির পথ এসে শেষ হয়েছে। বহু আগে এগুলি ছিল চারণভূমিতে গরু নিয়ে আসবার পথ। ‘নিয়ে আসবার বলছি এই জন্য যে, বহু প্রাচীন ভদ্র মহাশয়দের গ্রামওই চন্দনপুর থেকে সেকালে গরু চরতে আসত এই হাঁসুলী বাঁকের চরে। জাঙল পর্যন্ত ছিল রাস্তা গো-পথ, তারপরই ছিল হাঁসুলীর ঘেরের মধ্যে গোল তক্তির মত চারণভূমি। তারপর নীলকুঠির সাহেবেরা এসে ডাঙায় কুঠি কাঁদলে, গোচরভূমি ভেঙে জমি করে সেচের পুকুর কাটিয়ে বাঁশবাঁদির মাঠে নীল চাষ ও ধান চাষের পত্তন করলে, এই পুকুরপাড়ে কাহারবসতি বসালে। যে পথে চন্দনপুরের গরুর পাল আসত, সে পথে গরু আসা বন্ধ হল। ওই পথকে মেরামত করে তার উপর চলতে লাগল নীল কুঠির মালের গাড়ি এবং সাহেবদের। পালকি ও ঘোড়া। চন্দনপুরের ভদ্র মহাশয়দের জাঙলের মাঠে জমিজেরাত আছে চিরকাল, তাদের গরুর পালের সঙ্গে গাড়ি যাতায়াত করত এই পথে মাঠের ধান ঘরে নিয়ে যেত, সেই গরুর গাড়ির যাতায়াত বজায় রইল শুধু। আজও সে পথে তাদের ধান-কলাই-গুড় বোঝাই গাড়ি চলে। বাঁশবাঁদির কাহারদের পায়ে-চলা-পথের চেয়ে ভাল পথের দরকারও ছিল না। কোনো কালেই। তারা পায়ে হেঁটেই চলে, সে হিসাবে পদাতিক, কিন্তু সেকালে তারা পদাতিক ছাড়া আরও কিছু ছিল; পেশা হিসাবে ছিল বাহক, কাধে পালকি নিয়ে সাহেব-মেমদের বইত, বর-কনে বইত। কখনও কখনও জ্ঞানগঙ্গা নিয়ে যাবার জন্য বায়না আসত। সকলের আগে যে। বেহারা থাকত, সে সুর করে বলত সওয়ারীর ছড়া, অন্য সকলে সমস্বরে হাঁকত–প্লো-হিঁ প্লে-হি–প্লো-হিঁ। চারিদিক সরগরম করে তারা চলত দ্রুতবেগে। আজকাল তাদের এ পেশাটা গৌণ হয়েছে। বিয়ে ছাড়া ওদের আর ডাক পড়ে না এই কর্মের জন্য। তবে বহনের কাজটা বজায় আছে, পালকি-বহা কাধে ভার বয়। সে দেড় মন বোঝা নিয়ে যায় দশ ক্রোশ পর্যন্ত। বিশ ক্রোশও যায়, তবে পথে এক রাত্রি বিশ্রাম করতে হয়। মাথায় বোঝা বইতে হয় আজকাল বেশি। বাহকত্ব ছাড়া চালকত্ব গৌরবও আছে; হালের বলদ চালায়, গরুর গাড়িও চালায়। সুতরাং সে গতি আরও মন্থর, তাই পায়ে-চলাপথ ছাড়া অন্য পথের অভাব তারা অনুভব করে না।
পথ চলতে চলতে হুঁকো টানে, মধ্যে মধ্যে হাত বদল করে গল্প হয়। এই মন্থর জীবনের গতানুগতিক কথাই হয় পরস্পরের মধ্যে। রোমন্থন বলা যায়। আজ কিন্তু সকলেই একটু উত্তেজিত। আজ কথা চলছে গত কয়েক দিনের ঘটনার আলোচনা। তার মধ্যে বনওয়ারীর ব্যবহারের সমালোচনাই বেশি। বনওয়ারীর অন্যায় হয়েছে—এ কথা সকলেই একবাক্যে বলছে। নিমতেলে পানু বেশ গুছিয়ে এবং চিবিয়ে কথা বলতে পারে। সে-ই বলছিল মাতব্বর যদি শাসন করতে ‘তরাস’ করে, তবে দুষ্ট নোকে ‘অল্যায়’ করলে তার শাসন হবে কি করে? ‘আজা’ হীনবল হলে ‘আজ্য’ লষ্ট। এতবড় ‘অল্যায়ে’ মুরুদ্ধি বাক্যিটি বার ক বলে না মুখ থেকে।
—‘নিচ্চয়’। তবে চলুক এই করণ কাণ্ড; তোমার পরিজনকে’ আমি টেনে নিয়ে যাই। আমার পরিজন গিয়ে উঠুক ‘অতনার’ ঘরে।—কথাটা বললে প্ৰহাদ।
রতন পিছন থেকে প্রতিবাদ করে উঠল—আমার নাম মাইদি কোরো না বলছি। আমি কাল। ‘সব্বাগ্যে’ মাতব্বরকে বলেছিলাম, এ ‘অল্যায়’ হচ্ছে মাতব্বর। তবে নিজের নিজের বউ বিটী নিজে নিজে না সামলালে মাতব্বরই বা করবে কি? মাতব্বর পাহারা দিয়ে বসে থাকবে?
প্রহ্লাদ চিৎকার করে উঠল—বলি হা শাপলা, মাতব্বর করালীকে শাসন করতে পারত।
সকলের পিছনে নীলের বাঁধের ঘাটের উপর থেকে চিৎকার করে কেউ বললে—কার দশ হাত ল্যাজ গজালছে রে শুনি, করালীকে শাসন করবে, তার নাম কি?
শব্দ লক্ষ্য করে সকলে চকিত হয়ে তাকিয়ে দেখলে, বক্তা করালী নিজে।
নীলের বাঁধের উত্তর-পূর্ব কোণের পথটা বেয়ে ঘাটে করালী উঠছে। চন্দনপুর থেকে আসছে নিশ্চয়। সেই সেদিন রাত্রে পালিয়েছে পাখীকে নিয়ে, ফিরছে আজ সকালে। সম্ভবত কোনো জিনিসপত্র নিতে এসেছে। দাঁড়িয়ে আসছে। সঙ্গে তার পাখী ও নসুদিদি।
রতন প্রহ্লাদ পানু এবং অন্য সকলেই করালীর কথায় ফিরে দাঁড়াল।
তবু তাচ্ছিল্যভরে হাসছে করালী। পানু অন্য সকলকে বললে—দেখ সব, একবার ভাল করে দেখ। পিতিকার করতে না পার, তোমরা গলায় দড়ি দাও গা।
চিৎকার করে উঠল প্ৰহ্লাদ-কিলিয়ে তোমার দাঁত ভেঙে দেব গা।
করালী হা-হা করে হেসে বললে—এস কেনে একা একা, কেমন মরদ দেখি!
পাড়ের উপর থেকে পাণুদের দলের অনুসরণ করে নেমে এল মাথলা এবং নটবর। ওদেরও গন্তব্যস্থল জাঙল, ওরাও সেখানে কৃষাণি করে।
রতন বললে–চল চল। এখন আর পথের মাঝে দাঁড়িয়ে গায়ের ‘খিটকাল’ করতে হবে না।
সে ব্যাপারটাকে চাপা দিতে চায়। করালীর দলে রতনের ছেলেও রয়েছে যে।
করালী কিন্তু অকুতোভয়, কারও ভয়ে সে চাপা দিয়ে রাখতে চায় না। সে চেঁচিয়েই বলে দিল—তোমাদের মাতব্বরকে দেখেছি সেদিন। তোমরাও দেখতে চাও তো এস।
ঘাড় নেড়ে ভুরু নাচিয়ে সে বললে—সেদিন একহাত মুরুক্মির সঙ্গে হয়ে যেয়েছে।
সকলের কাছে এ উক্তিটা একটা অসম্ভব সংবাদের মত। বনওয়ারী কোশকেঁধেদের বংশের ছেলে, পাকা বাঁশের মত শক্ত মোটা হাড়ের কাঠামো তার। কাহারপাড়ায় কেন, কাহারপাড়া, আটপৌরেপাড়া, জাঙল তিন জায়গায় তার মত জোরালো মুনিষ নাই; বনওয়ারী শক্ত মুঠোয় লাঙল কষে টিপে ধরলে টানতে মাঝারি বলদের পিঠ ধনুকের মত বেঁকে যায়, ঘাড় লম্বা হয়ে যায়। তার সঙ্গে একহাত হয়ে গিয়েছে কালীর? বলে কি শয়তান ডাকাত? শুধু তাই নয়, শয়তানের কথার ভঙ্গির তাচ্ছিল্যের মধ্যে যে ফলাফলের ইঙ্গিত রয়েছে, সে কি কখনও হতে পারে—না হয়। কিন্তু সকলের মধ্যে মুখের সামনে জোরগলায় যে একটা স্পষ্ট সত্যের ঘোষণা রয়েছে তাও তো মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে না। সকলে অবাক হয়ে এ ওর মুখের দিকে চাইলে।
করালীকিঙ্কর এতেও ক্ষান্ত হল না; সে আরও একদফা হেসে নিয়ে বললে—তোদের মাতব্বর তো মাতব্বর, তাদের কত্তার বাহনকেই দেখেলিলাম
সঙ্গে সঙ্গে তার পিঠে একটা ধাক্কা দিয়ে শাসন করে পাখী বললে—আবার! আবার! আবার!
হি-হি করে হাসতে লাগল করালী। নদিদি তো হেসে উল্টে পড়ল। পাখীকে সে বললে— দে বুন, দে, আরও ঘা কতক দে। আমি লারলাম ওকে বাগ মানাতে—আমি লারলাম। তু দেখ। বুন এইবার। গদাগ কিল মারবি, আমি বলে দিলাম।
করালীর এই চরম স্পধিত উক্তিটি প্রত্যক্ষ সত্য। কত্তার বাহন অর্থাৎ ওই চন্দ্রবোড়া। সাপটাকে মারার কথা তো সকলে চোখে দেখেছে। কিন্তু সে কথাটাকে এমন স্পৰ্ধায় শাণিত করে বলায় সকলে আশ্চর্য রকম সঙ্কুচিত হয়ে গেল।
করালী পাখী নস্যু কিন্তু উল্লাস করতে করতেই চলে গেল। কোনো কথা না বলে মাথলা। নটবরও মাঠে নেমে পাশ কাটিয়ে তাদের অতিক্রম করে চলে গেল। ওরা নীরবেই গেল—নটবর হুঁকোটা টানছিল, বাপকে দেখে একটু খাতিরই দেখালে, কাছ বরাবর এসে নামালে হুঁকোটা একবার। ওরা চলে যেতেই রতনের দলের চমক ভাঙল। সে-ই ছিল সর্বাগ্রেসে চলতে আরম্ভ। করলে সকলেরই পা চলল সঙ্গে সঙ্গে। চলল কিন্তু নীরবে। খবরটা শুনে যেন সকলের কথা শেষ। হয়ে গিয়েছে।
হঠাৎ একটা ডাক এল সামনে থেকে। জাঙলের আমবাগান পড়ে সর্বাগ্রে। ওই বাগানের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ। পথের উপর দাঁড়িয়ে হেদো মোড়ল তার খুব মোটা গলায় ডাকছে— অ্যাই! অ্যাই বেটা রতনা! হারামজাদা! ওরে গুখোর বেটা!
রতন জোরে হাঁটতে শুরু করল। প্রহ্লাদ বললে ওরে বাবা রে, মোড়ল ‘এগে’ যেয়েছে। লাগছে!
রতন বললে—সঁচিল দেবার ‘জাওন’ খারাপ হয়ে যেছে, কাল দিন যেয়েছে পাচিল দেবার।
পানু বলে উঠল—আমার মুনিব মশায় আবার কি করলে কে জানে? আলু তুলতে হবে; পরশুই লাগবার কথা। কত্তার পুজোর ‘পাট’ পড়ে গেল। বললাম তো বলে দিয়েছে-উ সব আমি জানি না। আলু খারাপ হলে আমি নগদা মুনিষ লাগাব। তোমার ভাগ থেকে কাটব।
প্ৰহ্লাদ পানুকে বললেহা রে পানা, তোর মুনিবের পাল-বাছুরটার ক দাঁত হল রে?
—দু দাত।
এবারে জোয়াল গতাবে?
–তা খানিক-আধেক করে না গতিয়ে রাখলে, চার দত হলে তখন কি আর উ জোয়াল লেবে ঘাড়ে?
—ত্যাজ কেমন হবে বুঝছি?
—ওঃ, বেপৰ্য্যয় ত্যাজ! ‘লেঙুড়ে হাত দেয় কার সাধ্যি। পাচন পিঠে ঠেকলে চার পায়ে লাফিয়ে ঝাপিয়ে ঘুরবে। ওকে বেচে মুনিব পিটবে একহাত।
প্ৰহ্লাদ বললে—আমার মুনিবকে আমি বলছিলাম বাছুরটার কথা।
—লতুন গরু কিনবে নাকি তার মুনিব?
–হ্যাঁ। এবারে কিনবে। তিন বছর বলে বলে এ বছর ‘আজি’ করালছি।
–অ্যানেক টাকা লেবে আমার মুনিব। মাটি থেকে তুলতে হবে টাকা তোর মুনিবকে।
–ওরে না। আমার মুনিব মাটিতে পুঁতলে আর তোলে না, আধ ‘বাখার’ ধান ছেড়ে দেবে। ধানও ছাড়তে হবে না, আলুর টাকাতেই হয়ে যাবে, লাগবে না। তিন বিঘে আলু রে! সোজা কথা! কাঠা-ভূঁই দু পসুরি খোল দিয়েছে, ‘সালপেট আলুমিনি’ দিয়েছে। কাঠাতে ফলন দু মন, তা হেসে খেলে—হ্যাঁ, তা খুব।
ওরা অ্যামোনিয়াকে বলে ‘আলুমিনি’, অ্যালুমিনিয়মকে বলে—‘এনামিলি’।
—অতনকাকার মুনিবের আলু কেমন গো? গাছ তো হলছিল বাহারের!
রতনের উত্তর দেবার অবসর নাই। খুব দ্রুতপদেই সে হেঁটে চলেছে। ইচ্ছে হচ্ছে এক লাফ দিয়ে মনিবের সামনে হাজির হয়। সত্যিই তার মনিবের ক্ষতি হয়েছে। মাটির ‘ক’ ভারি হিসাবের জিনিস। তা ছাড়া পরিশ্রমই কি কম? গোটা একদিন মাটি কেটে, তাতে জল দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া হয়েছে, পরের দিন ফের দুপুর কি তিন প্রহরের সময় আবার একদফা জল ঢালা হয়েছে, পরের দিন ফের কাটা, জল দেওয়া এবং খুব করে ছাঁটা হয়েছে তার উপর আবার জল ঢেলে দেওয়া হয়েছে। সেই জল শুষে সেই জলে ভিজে মাটি তৈরি হয়। বেশি নরম থাকলে চলে না, বেশি শুকিয়ে গেলে তো ‘কাজ খারাবি’ই হয়ে গেল। সেই আবার নতুন করে পাট করতে হবে। নিজের হয় তো সে কথা আলাদা, এ হল মনিবের কাজ। খারাপ হলে মানবে কেন মনিব? তার উপর তার মনিব যে লোক! একবারে মোষের ‘কোধ’। রাগ হলে আর নিজেকে সামলাতে পারে না। প্রকাণ্ড পাথুরে গড়নের ভারী চেহারা, মোটা গলা, থ্যাবড়া নাক, কোঁকড়া চুল, আমড়ার আঁটির মত চোখতাও আবার ‘লালব’, মোটা বেঁটে আঙুল, বাঘের মত থাবা, বুনো দাঁতাল শুয়োরের মত গোঁ। রাগ হলেই গাঁ-গাঁ শব্দে চিৎকার করে দমাদম কিল মারতে আরম্ভ করবে। ঠিক যেন মা-দুর্গার অসুর।
রতনও বেশ মজবুত মুনিষ। লম্বা চেহারা লম্বা ঢঙের ইস্পাতে গড়া মানুষ। বয়স কম হয় নাই, দু কুড়ি পার হয়ে গিয়েছে—আড়াই কুড়ি হবে কি হয়ে গিয়েছে। তবু এখনও পর্যন্ত গায়ের চামড়া কেউ চিমটি কেটেও ধরতে পারে না। সকাল থেকে হালের মুঠো ধরে, দুপুরবেলা হাল ছেড়ে কোদাল ধরে—সাড়ে তিনটের ট্রেন কোপাইয়ের পুলে উঠলে তবে কাজ ছাড়ে। ধান রোয়ার সময় হলে কোদাল ছেড়ে তখন নামে বীজের জমিতে। সন্ধে পর্যন্ত বীজ মেরে তবে ওঠে। দেড় মন বোঝা ভার চাপিয়ে বেশ সোজা হয়েই কাঁধ দুলিয়ে দোলনের তালে তালে একটানা চলে যায় ক্রোশখানেক রাস্তা। এই রতনও মনিবের কিলকে ভয় করে। মনিব রাগে। চিৎকার করে আর কিল মারে। চিৎকার করে যতক্ষণ কাশি না পায়, গলা না ভাঙে, সে ততক্ষণ এই কিল চালায়। সে কিল আস্বাদন করা আছে রতনের, একটি কিলেই পিঠখানি বেঁকে যায়, দম আটকে যায়। এর ওষুধও কিন্তু ওই দম বন্ধ করে থাকা আর চুপ করে থাকা। কিল খাবার আগে থেকেই দমটি বন্ধ করে রাখতে হয়। তাহলে আর কিল খেলে দম আটকায় না এবং লাগেও কম। ঘোষ মহাশয়ের ছেলেদের একটা ‘বল’ আছে, পিতলের পিচকারি দিয়ে বাতাস ভরে দেয়, ইটের মত শক্ত হয়ে ওঠে বলটা, তাতে কিল মারলে যেমন বলটার কিছু হয় না, লাফিয়ে ওঠে—তেমনি হয় আর কি! আর কিল খেয়ে যত চুপ করে থাকবে, মনিব তত চিৎকার করবে রাগে। তাতে সহজেই গলা ভাঙে, কাশি পায় মনিবের। কাশি পেলেই মনিব ছেড়ে দিয়ে নিজের গলায় হাত দিয়ে কাশতে শুরু করবে।
রতন কাছে আসতেই মনিব হেদো মণ্ডল মহাশয় বললেনওরে বেটা গুয়োটা কাহার, বেলা কত হয়েছে রে বেটা? কত্তার পুজো দিয়ে মদ মেরে তুই হারামজাদারা ‘কেডামাতন করবি-—আর আমার ‘জাওন’ শুকিয়ে কাঠ হবে নাকি?
রতন ঘাড় হেঁট করে কান টানতে লাগল। এটা কাহারদের সবিনয় অপরাধ স্বীকারের ভঙ্গি। এর সঙ্গে, মুখে একটু হাসিও থাকা চাই—নিঃশব্দ দন্তবিকাশ। তা অবশ্যই ছিল রতনের মুখে। ওই হাসিটুকুর অর্থ হল এই যে, মনিবের তিরস্কারের অন্তর্নিহিত সদুপদেশ এবং স্নেহ সে অনুভব করতে পারছে।
তা মনিব মহাশয়েরা ‘স্ন্যাহ’ করেন বৈকি। তা করেন। বিপদে আপদে মনিবেরা অনেক করেন। কাহারেরা স্বীকার করে মুক্তকণ্ঠে-অ্যানেক, অ্যানেক করেন। অসুখবিসুখে খোজ করেন, কিছু হলে দেখতে পর্যন্ত আসেন, পয়সা-কড়ি ধার দেন, পথ্যের জন্য পুরনো মিহি চাল, আমসত্ত্ব, আমচুর এমনিই দেন; বিঘটন কিছু ঘটলেও তত্ত্বতল্লাশ করতে আসেন। রতনদের দুঃখে নিজেও হেদো মণ্ডল মহাশয়েরা কাদেন, আপ্তবাক্য বলেন, মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দেন, তাতে সত্যই অন্তর জুড়িয়ে যায় রতনদের। আবার অন্য কোনো ভদ্র মহাশয় যদি কোনো কারণে অকারণে রতনদের উপর জুলুমবাজি করতে উদ্যত হন, তাতেও মনিব মহাশয়েরা আপন আপন। কৃষাণদের পক্ষ নিয়ে তাদের রক্ষা করেন, প্রতিপক্ষের সঙ্গে দরকার হলে ঝগড়াও করেন, প্রতিপক্ষ তেমন বড় কঠিন লোক হলে অর্থাৎ চন্দনপুরের বাবুরা হলে তখন মনিবেরা রতনদের পিছনে নিয়ে বাবুদের কাছে গিয়ে মিটিয়ে দেন হাঙ্গামাটা। ভদ্র মহাশয়দের বলেন, আপনার মত লোকের ওই ঘাসের উপর রাগ করা সাজে? ঘাসও যা, ও-বেটাও তাই।
কখনও বলেন–পিঁপড়ে। ও তো মরেই আছে। মড়ার ওপর খাড়ার ঘা কি আপনার সাজে?
তারপর রতনদের ধমক দিয়ে বলেন—নে বেটা উল্লুক কাহার কঁহাকা, নে ধ, পায়ে ধ। বেটা বোকা বদমাশ হারামজাদা!
পায়ে ধরিয়ে বলেন—নে, কান মল, নাকে খত দে।
তাতেও যদি না মানেন-বড় কঠিন লোক বাবু মহাশয়, তবে মনিব নিজেই হাত জোড় করে বলেন-আমি জোড়হাত করছি আপনার কাছে। আমার খাতিরে ওকে ক্ষমা ঘেন্না করতেই হবে এবার। ‘না’ বললে শুনব না। মোটকথা, যেমন করে তোক রক্ষা করেন রতনদের।
সেই মনিব মহাশয় ‘আগ করেছেন। আজ রাগ খুব বেশি। হবারই কথা। দুদিন কামাই, তার উপর মাটি খারাপ হয়ে গিয়েছে; আজও দেরি হয়েছে খানিকটা। রতন খুব দ্রুতপদেই চলল। মাঠ পার হয়েই কুঠির সাহেবদের আমবাগান—সেই পুরনো কালের আমবাগানের মধ্য দিয়ে জাঙলে ঢুকতে হয়। বাগানের ভিতরে ঢুকতেই মাথার উপরে আমগাছের পাতার মধ্য থেকে অজস্ৰ পোকা উড়ে মাথায় মুখে লাগল। এবার আমগাছের মুকুলও বেশি। মধুর গন্ধে চারিদিক ভুরভুর করছে, পোকাও হয়েছে অসম্ভব রকমের বেশি।
হেদো মোড়ল চিৎকার করতে করতেই চলল-হারামজাদা, নেমকহারাম ছোটলোক জাতেরই দোষ—তোর আর দোষ কি?
পানু বললে প্ৰদকে খুব বেঁচে গেলছে অতনকাকা, আমি বলি-লাগালে বুঝি ‘আষিঢ়ে কিল গদাম করে!
প্ৰহ্লাদ বললে—কিল খেয়ে অতনার অভ্যেস হয়ে যেয়েছে। মারলেও কিছু হত না।
আমবাগান পার হয়ে অপর প্রান্তে জাঙলের বসতি আরম্ভ হয়েছে। বালিপ্ৰধান একটা পথ। বর্ষায় হুড়হুড় করে জল যায় রাস্তাটা বেয়ে, তখন এটা নালা। জল চলে যায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যে, তখন এটা পথ। পথটা এসেছে উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের কুঠিডাঙা থেকে। থমকে দাঁড়াল প্রহ্লাদ। পানু বললে দাঁড়ালে যে গো!
প্ৰহ্লাদ বললে—উটো কে রে? পরমের পারা লাগছে না?
দূরে সায়েবডাঙার উপরে দুটি লোক ঘুরছে প্রহ্লাদ দেখালে।
—তেমুনি তো লাগছে।
–সাথে কে বল দি-নি?
–বড়বাবুদের সেই মোচাল চাষবাবু লয়? সেই যে গো, চুল কোঁকড়া-মিচ্ছি মাশায়। প্ৰহ্লাদ বললে—পরমা আমাদের তত্ত্বে তর্কেই আছে। কোথা জমি, কোথা পয়সা–
—জমি?
—সেদিন মাতব্বরের কাছে শুনিস নাই। চন্ননপুরের বড়বাবুরা কুঠিডাঙা কিনেছে, জমি করবে। বন্দোবস্ত করবে খানিক। পরম সেই তত্ত্বে ঘুরছে।
পানু হেসে বেশ বসিয়ে বললে—ঘুরুক শাললা তর্কে তক্কে পরের দুয়ারে, উদিকে শালোর ঘরে কুত্তা ঢুকে
হাসতে লাগল পান, যে হাসির অনেক অর্থ এবং সে অর্থ কাহারেরা ‘বেদের সাপের হাঁচি চেনা’র মতই চেনে।
–কে? বাবুদের চাপরাসী মাশায় এসেছিল? তা, ও তো জানা কথা।
পানু ঘাড় নেড়ে বললে—সিংয়ের কথা বলছি না। সে পুরনো কথা। সে আর কে না জানে? ভূপ সিং মাশায় ছত্তিরি বেরান, সে কি আর কুত্তা হয়? সে হল বাঘা। বাঘে ধান খেলে তাড়ায় কে? হুঁ-হুঁ, অন্য লোক। কাল সনজেবেলাতে–। সে এক মজার কথা।
সে হাসতে লাগল।
ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করলে প্রহ্লাদকে? কে? কে রে?
খুব হাসতে লাগল পানু।
—কে রে?
–সে বলব মাইরিউ বেলাতে। অ্যানেক সময় নাগবে। গতকাল সন্ধ্যায় আটপৌরেপাড়ার বটগাছের তলায় সেই অন্ধকারের মধ্যেও পানু আবিষ্কার করেছে মাতব্বর এবং কালোবউকে একসঙ্গে। সেও ঠিক সেই সময় ওইদিকে গিয়েছিল আটপৌরে-পাড়ায় তার এক ভালবাসার লোকের সন্ধানে।
বাঁশবাঁদির বাঁশবনে আজও জমে আছে আদিম কালের অন্ধকার। সে অন্ধকার রাত্রে এগিয়ে এসে বাঁশবাঁদির কাহারপাড়াকে আচ্ছন্ন করে। সেই অন্ধকারের মধ্যেও কাহারদের দৃষ্টি কিন্তু ঠিক চলে, ওদের চোখেও তখন জেগে ওঠে সেই আদিম যুগের অর্থাৎ অগ্নি-আবিষ্কারের পূর্বযুগের। মানুষের চোখের অন্ধকারভেদী আরণ্যজন্তুর দৃষ্টি!
মাতব্বরের রঙের খেলা দেখে পানু অত্যন্ত কৌতুক অনুভব করেছে। কৌতুকেরও বেশি একটু কিছু আছে। অন্য লোক হলে ওই কৌতুকের বেশি কিছু হত না। কিন্তু বনওয়ারী মাতব্বর, তা ছাড়া মানুষটাও যেন একটু অন্য ধরনের। কৌতুকের সঙ্গে জেগেছিল বিস্ময়। তাই সে কথাটা গোপন করে রেখেছিল। প্রকাশ করতে সাহস পায় নাই। এবং গতকাল হঠাৎ পাখী ও কালীর কাণ্ডটা ঘটায় এ কাণ্ডটার কথাটা মনেই ছিল না বলতে গেলে। হঠাৎ পরমকে দেখে মনে পড়ে গেল তার আজ। আজও তার বলতে গিয়েও বলতে সাহস হল না। তা ছাড়া কথাটা বলবে কি না তাও পানু ভাবছে মাঝে মাঝে। ওটাকে নিজস্ব করে রাখলে ভাঙিয়ে কিছু কিছু আদায় করতে পারবে মাতব্বরের কাছে।
পানু দল ছেড়ে গলিপথে ঢুকল। গলির ও মাথায় তার মুনিববাড়ি।
প্ৰহ্লাদ প্রমুখ কজন কিন্তু মনে মনে উদগ্রীব হয়ে রইল।
কি মজার কথা! কি মজার কথা! পরমের ঘরে কে ছিল?
কথাটার কল্পনাতে সারাটা দিনের কাজ হালকা হয়ে গেল কাহারদের।
প্ৰহ্লাদ, ভূততা প্রভৃতি এরা কজন গম ঝাড়াই করলে, শিষ পিটিয়ে ক্রুপ করে তুললে। জলখাবার নিয়ে আসবে মেয়েরা, কুলো দিয়ে পাছড়ে খোসা ঝেড়ে গম বার করবে।
জলখাবার-অন্তত দু সের মুড়ি, খানিকটা গুড়, পেঁয়াজ, লঙ্কা আর এক ঘটি জল।
পানা তুললে আলু। খুব মোটা আলু হয়েছে পানার মনিবের। পানার স্ত্রী জলখাবার নিয়ে। আসবে, সেও আলু তুলবে। চারটে মোটা আলু পানী খোড়া মাটি চাপা দিয়ে একটা চিহ্ন দিয়ে। রেখে দিলে। পরিবারকে বলবে, পেঁট-আঁচলে পুরে নিয়ে যাবে। মোটা আলু বেছে মনিবই নিয়ে থাকে। মোটা আলুও খাওয়া হবে ভাত দিয়ে, নিজের ভাগে বেশি কিছু পাওয়া হবে। এই বেশি পাওয়ার আনন্দটাই এক্ষেত্রে বেশি। আর প্রহ্লাদকে দেখাতে হবে। প্রহ্লাদ বলে, বিঘে ভূঁই দুপসুরি খোল, আর ‘আলুমিনি সার দিয়েছে ওর মনিব, আলু ইয়া মোটা হয়েছে। গল্প করা প্রহ্লাদের স্বভাব। পানুর মনিবের বাছুরটা কিনবে নাকি প্রহাদের মনিব। আলুর টাকা থেকেই নাকি তার টাকা হয়ে যাবে। তাই দেখাবে ওকে ওর কৃষাণির জমির আলু-মনিবের সম্পদ।
নিজের মনিবকে বললে পানু—মুনিব মাশায়, পল্লাদে আজ আমাদের পাল বাছুরটার কথা শুধাচ্ছিল। বলে—কত দাম? ওর মুনিব এবার গরু কিনবে।
পানুর মনিব লগ অর্থাৎ নগেন্দ্ৰ মণ্ডল মহাশয় বিচক্ষণ হিসাবি লোক, নাক মুখ চোখ বেশ পাতলা পাতলা চোখা গড়নের, মানুষটিও পাতলা ছিপছিপে; বেশ বাবু-মহাশয়ী ছাপ আছে। মনিব। মহাশয় কিন্তু পানার কথার জবাব না দিয়ে উঠে এলেন জমিতে। যেখানটায় পানা আলুগুলি মাটি চাপা দিয়েছিল, সেখানকার মাটি খুঁড়ে আলু চারটে তুলে গামছায় বেঁধে বললেন—ভাল করে দেখে খোড় রে বেটা, দেখে খোড়, বাদ দিয়ে চললি যে, তাতে তোরই লোকসান। আমার আলু তো আমার জমিতেই থাকবে, সে তো আমি মাটি সরালেই পাব। হ্যাঁ, এ আলু কটির ভাগ তুই পাবি না বুঝলি? তোর নজরের দোষের জরিমানাবলে জমি থেকে উঠে আলের ওপর বসে আবার হুঁকো টানতে লাগলেন নিশ্চিন্ত হয়ে। ভাবটা যেন কিছুই হয় নাই। পানার বুকটা গুরগুর করে উঠল। তেষ্টা পেয়ে গেল।
ওই জলখাবার আসছে। কোপাইয়ের পুলের ওপর দশটার ট্রেন শব্দ করে পার হয়ে গেল। বেশ শব্দ। ঝমর-ঝম, ঝম্-ঝম্!
ইচ্ছে ছিল জলখাবার নিয়ে গাঁয়ের বাইরে আমবাগানে সকলে বসে জমিয়ে গল্প করবে। বনওয়ারী-কালোশশীর কথাটা সকলে শোনবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছে। তারও ইচ্ছে খুব। কিন্তু মনিবের কাছে ধরা পড়ে পানুর সব উৎসাহ নিবে গেল। মাঠে বসেই জল খেতে লাগল সে। হঠাৎ বউটার উপর পড়ল তার রাগ। পানুর সন্দেহ হয়, বউটা করালীর দিকে তাকিয়ে থাকে ঘোমটার মধ্যে দিয়ে। সে তাকে রূঢ় ভাষায় গাল দিতে লাগল।