মহাস্থবির জাতক – দ্বিতীয় পর্ব
উৎসর্গ
বন্ধু প্রতোষকুমার রায়ের স্মরণে :
দীর্ঘদিন বিচ্ছেদের পর আবার যার
সঙ্গে নতুন করে মিলন হল।
কলিকাতা
১৫ই আগস্ট, ১৯৪৭
.
সংসারে মনুষ্যকুলজাতি–স্ত্রী-পুরুষমাত্রেই স্বপ্ন দেখে। বাস্তবের রূঢ় আলোকে কারুর স্বপ্ন ছুটে যায়, কারুর বা স্বপ্নবিলাসেই জীবন ভোর হয়।
আমিও একদিন স্বপ্ন দেখেছিলুম।
আমি স্বপ্ন দেখেছিলুম, এই ভগ্নসার্থ, মন্দামতি, নির্বীর্য, স্বার্থান্ধ, মুমূর্ষু দেশবাসীকে মৃত্যুশয্যা থেকে ঝুঁটি ধরে তুলে তাদের দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত করেছি। দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা দেবতাজ্ঞানে আমার প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠেছে। আমার সতত-বিষণ্ণ গম্ভীর পিতার মুখমণ্ডল ঘিরে আনন্দের জ্যোতি ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন, তুমি আমাদের কুল পবিত্র করেছ। সংসারভারে জর্জরিতা আমার মার মুখে হাসি ধরে না। আনন্দাশ্রুবিগলিতবয়ানে তিনি আমার মাথায় হাত দিয়ে বলছেন, স্থবির, তোকে গর্ভে ধারণ করে আমি কৃতার্থ হয়েছি।
স্বপ্ন দেখছিলুম, আমার রচিত সাহিত্য ধরণীর ভাবসমুদ্রে নূতন ভাগীরথীধারা যোজনা করেছে। অতি-অবজ্ঞাত পুরাতন প্রাচীনকে যারা এতকাল অজ্ঞতাবশে অপমান করেছিল, তারা চমকে উঠেছে।
স্বপ্ন দেখছিলুম, আমার মানসগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর অলৌকিক স্মিতহাস্যে আমার দিকে চেয়ে আছেন। তাঁর দক্ষিণ হস্ত আমার মাথায় স্পর্শ করে বলছেন, বৎস, তুমি ধন্য, তোমার লেখনী ধন্য হোক।
কিন্তু তবুও সেই সাফল্যের আনন্দলোকের মধ্যেও একটি তীক্ষ্ণ বেদনার তিমিরধারা হিল্লোলিত হচ্ছিল, শীতারম্ভের প্রত্যূষে আলো ও কুয়াশায় যেমন জড়াজড়ি করে থাকে। কোথা থেকে সেই বেদনার ধারা বিচ্ছুরিত হচ্ছে, কোথায় তার উৎস, তাই নিয়ে স্বপ্নেও মনের মধ্যে আলোড়ন চলেছে। হঠাৎ মনে হল, আমি ও আমার মন যেন দুটো পৃথক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছি। দেখতে দেখতে সেই আলো-আঁধারির মধ্যে ফুটে উঠল লতুর বিদায়োন্মুখ অশ্রুসজল মুখখানি। সমস্ত আনন্দ ও সাফল্য তার অশ্রুজলে মুছে নিয়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে রইলুম তার সামনে, কিন্তু আমার অভিমানক্ষুব্ধ মন ছুটে চলল ভারতবাসীর চরম আশ্রয় হিমালয়ের গিরিকন্দরে। এই দুঃখ, এই অন্তর্দাহ থেকে মুক্তি পাবার জন্যে আমি যোগসাধনায় নিমগ্ন হলুম।
আমি স্বপ্ন দেখছিলুম, যোগবলে আমি মানসচারী হয়েছি, যখন যেখানে খুশি ইচ্ছামাত্র সেখানে উপস্থিত হতে পারি। সাধনাবলে আমি কালচক্রকে থামিয়ে দিয়েছি, আমার ইচ্ছাশক্তিতে অতীত ও বর্তমান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। স্বপ্ন দেখছিলুম, আমি ভারতের অতীত ইতিবৃত্তের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমি যেন মহারাজ দক্ষের দরবারে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছি যজ্ঞে যোগ দেবার জন্যে। দেখলুম, বিপুলনিতম্বা পলাশনয়না চন্দ্রের মহিষীরা সব প্রাসাদের কক্ষ, অলিন্দ, উদ্যান কলহাস্যে মুখরিত করে তুলেছে। কিন্তু সেদিকে আমার ভ্রূক্ষেপও নেই; কারণ নারীর দেহ-সৌন্দর্যের প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ নেই, আমি যে যোগী! আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি দক্ষের সেই দুহিতাকে, যে রাজার মেয়ে হয়েও ভিখারিকে স্বামিত্বে বরণ করেছে, প্রেমকে যে, বংশমর্যাদার ওপরে স্থান দিয়েছে। তাঁরই পদধূলি আমি চাই।
আমি নিজের চোখে দেখেছি দেবীকে। তপঃক্লিষ্টা, তন্বী, উৎকণ্ঠায় গৌরবদন পাংশু। পদতলে, নিজেকে লুটিয়ে দিয়ে বললুম, মা গো, সন্তানের প্রণাম নাও। আমি ধন্য! সার্থক হয়েছে আমার তপস্যা।
আমি স্বকর্ণে শুনেছি, গর্বোদ্ধত দক্ষের বদননিঃসৃত সেই শিবনিন্দা–
অপমান কার?
মান আছে যার!
ভিখারীর অপমান কি রে ভিখারিণী!
আমি দেখলুম, সতীর মৃত্যু। দেখেছি, তাঁর অন্তরের ক্ষোভ ব্রহ্মরন্ধ্র ফেটে প্রবাহিত হয়ে চলল দিগ্বিদিকে, ত্রিকাল ব্যেপে।
দেখলুম, মহেশ্বর, এলেন তাঁর দলবল চেলা-চামুণ্ডা নিয়ে। মুখে তাঁর আর ববম্ রব নেই, বুলি পালটে গিয়েছে। চোখ-দুটি বাড়বানলের মতো, তা থেকে একাধারে অশ্রু ও অনলের প্রবাহ ছুটেছে। ছোট ছেলের খেলনা ভেঙে গেলে যেমন বাড়িসুদ্ধ লোকের বিরক্তি উৎপাদন করে চিৎকার করতে থাকে, তেমনই তিনি “সতী দে, সতী দে” চিৎকারে ত্রিলোক ফাটাতে আরম্ভ করলেন।
ছেলেবেলায় আমাদের বাড়িতে একটা দল ছিল। এই দলের পাণ্ডা ছিল সেজদি–আমার পিসিমার মেয়ে। সেজদি, ছোড়দি, আমি আর অস্থির–এই চারজন ছিলুম আমাদের দলে। কখনও কখনও কালেভদ্রে দাদাকে এই দলে নেওয়া হত। সেজদি ছিল দলের নেত্রী আর আমরা কজন ছিলুম তার চেলা। আমরা পাঁচজনে একত্রে জুটলে একেবারে গায়ে গায়ে লেগে থাকতুম। যতক্ষণ আমরা তাদের বাড়িতে থাকতুম, এক মুহূর্তের জন্যেও কেউ ছাড়াছাড়ি হুতুম না–এক পাতে খাওয়া থেকে এক বিছানায় শোয়া পর্যন্ত। সেজদির ডাকনাম ছিল সুখী। বাড়িতে ও পিসিমার বাড়িতে ‘সুখীর দল’ নামে আমাদের অখ্যাতি ছিল। কোনো ঘরে কোনো কাঁচের জিনিস ভাঙা কিংবা কোথাও ঘড়া উল্টে জলে মেঝের বিছানাপত্র ভেসে-যাওয়া ইত্যাদি দেখলেই বাড়ির সবাই তখুনি ধরে নিত, এ সুখীর দলের কাজ।
সেজদি মাঝে মাঝে চড়ুইভাতি করত। দেশলাইয়ের বাক্সের মতো ছোট ছোট কাগজ কেটে সে পাঁচটা নিমন্ত্রণপত্র লিখে আমাদের মধ্যে বিতরণ করত ও নিজে একটা রাখত। ছোট্ট একটি উনুন, তাতে সরু সরু কাঠের আগুন নিয়ে, ছোট্ট কড়া চাপিয়ে নতুন টাকার মতন ঝকঝকে ছোট ছোট লুচি ভাজা হত। সেজদি সে লুচির নাম দিয়েছিল ‘চাঁদির চাক্তি’। ছোট্ট বঁটিতে সরু-সরু আলু কুটে তাই ভেজে চাঁদির চাতি দিয়ে আমাদের ভোজ হত।
রান্না সেজদিই করত, আমরা তিন ভাই আর ছোড়দি যোগান দিতুম মাত্র।
তখন আমরা একটু বড় হয়েছি। দাদা আমাদের দল থেকে বেরিয়ে গেলেও আমাদের চারজনের মধ্যে গোষ্ঠীগত একতার কোনো ব্যতিক্রমই হয়নি। আমার বয়েস আট, সেজদির বয়েস সতেরো, এমনই এক সময়ে চড়কের দিনে সেজদি দুটো বড় পুতুল কিনেছিল। একটা পুলিশ-কনস্টেবল আর একটা কেঁড়ে-কাঁখে গয়লানি। পুতুল-দুটো দেখেই আমি আর অস্থির বায়না ধরলুম, ও দুটো দাও, দিতেই হবে।
সেজদি কিছুতেই দেবে না। আমরাও ছাড়ব না। শেষকালে সে হাসতে হাসতে বললে, দেখ আমি মরে গেলে পুতুল-দুটো দুই ভাইয়ে নিয়ে যাস।
যাক। তবু একটা আশ্বাস পেয়ে সেদিনকার মতো বাড়ি ফিরলুম।
তারপর রোজই উৎসাহ করে পিসিমার বাড়ি যাই। কিন্তু হায়! গিয়ে দেখি, সেজদি তখনও মরেনি। সেজদি মরতে অনেক দেরি করছে দেখে একদিন অস্থির বলে ফেললে সেজদি তুমি কবে মরবে ভাই?
সেজদি হাসতে হাসতে বললে, শিগগিরই মরব, একটু সবুর কর না।
হাসতে হাসতে সে কথাগুলো বলল বটে; কিন্তু দেখলুম সঙ্গে সঙ্গে তার দুই চোখ জলে ভরে উঠল।
সেজদিকে আমি ও অস্থির বড় ভালোবাসতুম। সে একাধারে আমাদের বন্ধু, দিদি ও জননী ছিল। আমরা শুনেছি আমাদের শিশু-অবস্থায়–সে তখন বালিকা মাত্র–নির্বিকারচিত্তে আমাদের মলমূত্র পরিষ্কার করত। সামান্য দুটো পুতুলের জন্যে সেই সেজদির চোখে জল দেখে আমরা কাঁদতে কাঁদতে তাকে জড়িয়ে ধরে বললুম, তুমি মরো না দিদি, পুতুল আমাদের চাই নে। অস্থির উঠে গিয়ে পেছন থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমো খেতে লাগল। আমি আর একখানা বাহু প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে বসে রইলুম।
সেজদি বলতে লাগল, জানিস ভাই, আমি জানতে পেরেছি, মহেশ্বর আমাকে মেরে ফেলবে। এই বলে সে করুণকণ্ঠে কামিনী রায়ের “আছে এ জগৎ-মাঝারে গোপনে এক সে সুন্দর সিদ্ধিস্থান” গানটা গাইতে লাগল।
অতীতের গর্ভ থেকে সেই করুণ কণ্ঠ আজ আমার কানে এসে বাজছে আর ঈশ্বরের করুণাময়ত্ব সম্বন্ধে একেবারে নিঃসংশয় হচ্ছি।
বোধ হয় পনেরো-ষোলো দিন বাদেই একদিন ছোড়দি আমাদের বললে, সেজদির ভয়ানক অসুখ, তাকে মধুপুরে নিয়ে যাওয়া হবে।
সেজদি মধুপুরে চলে গেল, কিন্তু মাস-দুয়েক যেতে-না-যেতেই তাকে ফিরিয়ে আনা হল–অসুখ বেড়েছে।
আমরা রোজই যাই সেজদিকে দেখতে। অসুখ তার বেড়েই চলল। তার বিছানায় উঠে বসলে বাড়ির সবাই তুলে নিয়ে আসে। বলে, রুগির বিছানায় বসতে নেই। তার গায়ে হাত দিলে সবাই হাঁ-হাঁ করে ওঠে। বলে, অসুখ বেড়ে যাবে।
এইরকমই চলছিল। একদিন সন্ধ্যাবেলা ঘরে কেউ নেই দেখে আমরা দু-ভাই টপ করে তার খাটে উঠে দু-পাশে দুজনে বসে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলুম। সেজদির নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছিল, তবুও হাঁপাতে হাঁপাতে সে বললে, আমার জন্যে মহেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবি, আমি যেন শিগগিরই সেরে উঠি।
সেদিন থেকে ঘুমোবার আগে দুই ভাই মিলে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে লাগলুম, হে মহেশ্বর! তুমি সেজদিকে মেরো না। তাকে বাঁচিয়ে দাও, তাকে শিগগির ভালো করে দাও।
আর একদিন। সকালে বাবা আপিসে না গিয়ে গাড়ি করে মাকে নিয়ে চলে গেলেন সেজদিকে দেখতে, তার অসুখ বেড়েছে। সন্ধে হয়ে গেল, তবুও তাঁরা ফিরলেন না। আমরা রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লুম।
গভীর রাতে মা এসে আমাদের ঘুম থেকে তুলে বললেন, চল, তোদের সেজদি ডাকছে। ধড়মড় করে উঠে পড়লুম, দরজায় গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। পিসিমার বাড়িতে গিয়ে দেখি, অত রাত্রেও ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে, অনেক অচেনা লোক এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে, ব্যাপারটা তখনও ভালো করে বুঝতে পারিনি। সেখানে গিয়ে শুনলুম, সেজদি আমাদের দেখতে চাইছে।
আমাদের দুই ভাইকে ধরে সেজদির খাটের সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। দেখলুম, যন্ত্রণায় সে ছটফট করছে। তার কপালে ও মুখময় বিন্দু বিন্দু ঘাম, একটুখানি নিশ্বাস নেবার সে কি প্রাণপণ চেষ্টা! আমরা এসে দাঁড়াতেই সে স্থির হয়ে আমাদের মুখের দিকে চেয়ে রইল, কিন্তু কিছুই বলতে পারলে না। আমি মনে মনে বলতে লাগলুম, মহেশ্বর, দয়া কর, সেজদিকে বাঁচিয়ে দাও, দয়া কর, দয়া কর।
মনে মনে বলতে অস্ফুট আওয়াজ মুখ দিয়ে বেরুতে লাগল। আমার দেখাদেখি অস্থিরও আরম্ভ করলে, মহেশ্বর, দয়া কর, দয়া কর।
খাটের চারদিকে অস্ফুট ক্রন্দনধ্বনি গুমরে উঠছিল। মুখ তুলে দেখি, সবাই কাঁদছে। সেই দৃশ্য দেখে আমাদের চোখও জলে ভরে উঠল। সেই বিশাল অশ্রু-পারাবারের ভেতর দিয়ে অস্পষ্ট আলোকে দেখতে পেলুম, সেজদির চোখ-দুটোও অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
এক মুহূর্ত পরেই সে চোখের দৃষ্টি নিবে গেল।
আমাদের দুজনকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে সেজদির ঘরে গিয়ে দেখি, তার খাটখানা হা-হা করছে। তার ওপরে সেজদিও নেই বিছানাও নেই।
জীবন-যুদ্ধ ঘোষিত হবার বহু পূর্বেই অতর্কিত অস্ত্রাঘাতে আমাকে কাবু করবার সেই যে চেষ্টা, সে-কথা আমি ভুলিনি। তাই সেই মহেশ্বরকে এতদিন পরে এমন প্যাঁচে পড়তে দেখে খুশিতে মন ভরে উঠল। মনে মনে বলতে লাগলুম, বেড়ে হয়েছে, বেড়ে হয়েছে মহেশ্বর। তোমার বাপ নেই, মা নেই, ভাই-বোন বন্ধু কেউ নেই, তুমি বেপরোয়া দুনিয়ার বুকে শোকের আগুন জ্বালিয়ে ঘুরে বেড়াও। প্রিয়বিচ্ছেদের মজা কতখানি, তা একবার নিজেও উপভোগ কর।
বেশ চলছিল, হঠাৎ মহেশ্বরের চেলার দল বেরসিকের মতো সবাই বিকট চিৎকার করতে আরম্ভ করে দিলে। বাপ রে বাপ! সে কি ভীষণ আওয়াজ! তারপরেই শুরু হল দক্ষযজ্ঞ-পণ্ড! মার্-মার্ কাট্-কাট্ শব্দ!
ব্যাপার দেখে তো দক্ষরাজ আত্মরক্ষার জন্যে মারলেন রাম-দৌড়। যজ্ঞের পুরোহিতেরা কাছা আঁটতে-আঁটতে লুকোতে লাগলেন আড়ালে-আবডালে। আগুন ছুটল চারদিকে।
মহেশ্বর চিৎকার করতে লাগলেন, দে সতী, দে সতী, দে সতী। আর ওদিকে ঘুরন্ত লাট্টুর মাথায় জল পড়লে সে-জল যেমন চারদিকে ছিট্কে পড়তে থাকে, দক্ষের চেলারা মহেশ্বরের চেলাদের তাড়নায় তেমনই ছকে পড়তে লাগল।
ওদিকে যক্ষরক্ষদের চিৎকার ও মালসাটের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে ধুলো ও ধোঁয়ায় দেখতে দেখতে চারিদিক অন্ধকার হয়ে উঠল। সেই অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে মহারাজ দক্ষ ছুটলেন প্রাসাদের অন্তঃপুরে আত্মগোপন করতে।
প্রাসাদের মধ্যে দক্ষের বড় জামাই অর্থাৎ মহেশ্বরের ভায়রাভাই লোচ্চাকুলচূড়ামণি শ্রীযুক্ত বিমানবিহারী চন্দ্র আমন্ত্রিতা মেয়েদের মধ্যে জমাট হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন, হঠাৎ শ্বশুরমহাশয়কে ওইরকম মুক্তকচ্ছ হয়ে ছুটতে দেখে বাইরে বেরিয়ে এসে ব্যাপার দেখে চট করে আকাশে চড়ে হাসতে আরম্ভ করে দিলেন হ্যাঁ-হ্যাঁ করে।
অন্ধকারে মাহেশ্বরীদলের গুণ্ডামি একটু মন্দা পড়েছিল। কিন্তু চাঁদ আকাশে উঠতেই চারিদিক আলোয় আলো হয়ে গেল। তারা আবার হৈ-হৈ করে যজ্ঞপণ্ডের কাজ শুরু করে দিলে। তখন–
হাস্যতুণ্ড যজ্ঞকুণ্ড পূরি পূরি মূর্তিছে।
পাদ ঘায় ঠায় ঠায় অশ্ব হস্তি পুঁতিছে।।
চন্দ্রালোকে আবার চারিদিকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল দেখে দক্ষরাজ চন্দ্রের উদ্দেশে চেঁচাতে লাগলেন, ওহে বিমানবিহারী, ওহে বাবাজীবন। ডুবে যাও, ডুবে যাও বাবা। কিন্তু অবাধ্য চন্দ্ৰ সে-কথা না শুনে আরও হাসতে আরম্ভ করে দিলেন। দক্ষ মহারাজ তখন পাগলের মতন এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে করতে একবার জামাই বাবাজীবনের সামনে পড়ায় তাঁর মুণ্ডুটি উড়ে গেল।
আমি একদিকে দাঁড়িয়ে মজা দেখছি, সমস্ত ব্যাপারটা লাগছে মন্দ নয়। এমন সময়-
রাজ্যখণ্ড লণ্ডভণ্ড বিস্ফুলিঙ্গ ছুটিছে।
হূল থূল কূল কূল ব্ৰহ্মডিম্ব ফুটিছে।
ব্যস্! ষোলো আনা পূর্ণ হতে এইটুকুই বাকি ছিল। অধুনা-আবিষ্কৃত অ্যাটমিক বোমার পূর্বপুরুষ সেই ব্রহ্মডিম্ব দুটি ফাটতেই স্রেফ বায়ুর চাপে সারা কখল সমভূমি হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, ইট-পাটকেল, স্থাবর-জঙ্গম সব কিছুর সঙ্গে আমিও উড়তে লাগলুম আকাশে। উড়তে উড়তে একেবারে বুঁদ হয়ে গেলুম। বাপ রে বাপ, কি শীত! ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে আবার বোঁ-বোঁ করে নীচের দিকে নামতে ধড়াস করে এক জায়গায় এসে পড়তেই স্বপ্ন ছুটে গেল। চোখ চেয়ে দেখি, মহেশ্বরের খাস আস্তানা কাশীধামের রাজঘাট ইস্টিশানে পাষাণশয্যায় পড়ে রয়েছি, পাশে বন্ধু পরিতোষ আপাদমস্তক র্যাপার মুড়ি দিয়ে কুকুর-কুণ্ডলী হয়ে শুয়ে আছে। ব্যোম মহাদেব–জয় জয় মহেশ্বর রবে আকাশ-বাতাস পরিপূর্ণ।
শিলাশয্যা থেকে ধড়মড় করে উঠে বসলুম। দেহ অসম্ভব ভারী বলে মনে হতে লাগল। বেশ বুঝতে পারলুম হিম লেগে চোখ-মুখ ফুলে উঠেছে। ভয়ানক দাঁতের যন্ত্রণা হচ্ছিল, দেখলুম, মাড়ি ফুলে উঠেছে আর প্রত্যেকটি দাঁত নড়ছে। পরিতোষকে ঠেলে তুললুম। সে বললে, কানে কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।
একটু ধাতস্থ হয়ে চারিদিকে চেয়ে দেখি, আমাদের চারপাশে গোল হয়ে একদল মোটা-মোটা লোক বসে রয়েছে, দৃষ্টি তাদের আমাদের দিকে স্থির-নিবদ্ধ। সে দৃশ্য দেখে আমার রাজা রবি বর্মার ‘অশোকবনে চেড়ী-পরিবৃতা সীতা’র ছবির কথা মনে পড়তে লাগল।
ট্রেনে আসবার সময় সহযাত্রীদের মুখে কাশীর গুণ্ডা-পাণ্ডাদের অত্যাচার ও অনেকরকম বিভীষিকার কথা শুনে মনে মনে এদের সম্বন্ধে খুবই সাবধান হয়েছিলুম। কাশী পৌঁছবার বোধ হয় পঞ্চাশ মাইল আগে থেকে প্রতি ইস্টিশানেই পাণ্ডাদের আক্রমণ শুরু হয়েছিল। সকলের মুখে একই প্রশ্ন–কাশী যাচ্ছ বাবু, কে তোমাদের পাণ্ডা?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চুপ করে থাকি, কথা বাড়িয়ে লাভ কি? নেহাত বিরক্ত করলে বলে দিই, আমাদের পাণ্ডার নাম রামমোহন রায়, বিবেকানন্দ স্বামী। কোথাও বলি, রবি ঠাকুর। তারা অবাক হয়ে ভাবতে থাকে, ইতিমধ্যে ট্রেন ছেড়ে দেয়।
এমনই করতে করতে কাশী স্টেশনে এসে পৌঁছেছিলুম। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে নিজেদের এই পাণ্ডাব্যূহের মধ্যে অবস্থিতি দেখে এবার দস্তুরমতো ভড়কে গেলুম।
বোধ হয় মিনিট-পাঁচেক পরেই চারিদিক থেকে প্রশ্নবৃষ্টি শুরু হল।
বাবুদের বাড়ি কোথায়?
আকাশের নীচে।
কোথায় থাকা হয়?
রাজঘাট ইস্টিশানের প্ল্যাটফর্মে।
পরিতোষ চুপ করে বসে আছে, কারণ সে কানে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। আমার জীবন ক্রমেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে লাগল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর একজন জিজ্ঞাসা করলে, বাবুদের নাম কি?
স্থবির শর্মা, পরিতোষ রায়।
তারপরে সেই এক প্রশ্ন, কে পাণ্ডা? কেন পুজো দেবে না? কাশীতে এসে বাবার পুজো দেবে না, এটা কি ভালো কথা হচ্ছে, ইত্যাদি।
ক্রমে দু-একটি করে লোক উঠতে আরম্ভ করে দিলে। শেষকালে এক ব্যক্তির সঙ্গে ভাব জমে গেল। তাকে আমরা বুঝিয়ে বললুম, দেখ বাপু! বাড়ি থেকে ত্রিশটি টাকা গ্যাঁড়া মেরে বাবার স্থানে এসে আশ্রয় নিয়েছি। তা থেকে রেল-কোম্পানিতে দিতে হয়েছে আট টাকা, পথে পুরি মিঠাই মেরেছি দু-টাকা, আর আছে মোটে কুড়িটি টাকা। এর মধ্যে থেকে বাবার পুজোর জন্যে যদি খরচা করতে হয় তো অদূর ভবিষ্যতেই বাধ্যতামূলক প্রায়োপবেশনের মহড়া শুরু হবে। অতএব দয়া করে আমাদের রেহাই দাও।
কিন্তু কে কার কথা শোনে! লোকটা তবুও ঘ্যানর ঘ্যানর করতে লাগল। বললে, বছর দু-তিন আগে দু’জন বাঙালি ছেলে তোমাদেরই মতন বাড়ি থেকে পালিয়ে আমার আশ্রয়ে এসে পড়েছিল। তারাও তোমাদেরই মতন প্রথমে বলেছিল, কাছে একটি পয়সাও নেই। শেষকালে পুজো-টুজো দেওয়ার পর রাত্রি দ্বিপ্রহরে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললে, দাদা–আমাদের কাছে এই চারশো টাকা আছে, এটা তোমার কাছে রেখে দাও, আমাদের দরকার মতন চেয়ে নোব। তারা তিন মাস আমার কাছে থেকে মৌজ করে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেল। যাবার সময় আমায় একশোটি টাকা দিয়ে বললে তোমার মতন বিশ্বাসী লোক আমরা আর দেখিনি। মনে মনে সেই বাঙালি ছেলেদের মুণ্ডপাত করে তাকে বললুম, আমরা তোমায় পুজোর জন্যে একটি টাকা দিতে পারি, দেখ, এতে যদি তোমার পোষায় তো বল।
লোকটা কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপরে বললে, আচ্ছা, চল, বিশ্বনাথের যা মরজি তাই হবে। জয় বাবা বিশ্বনাথ।
উঠে পড়া গেল। দেহ অসম্ভব ভারী, দাঁতের যন্ত্রণা অনেক কম পড়লেও তখনও বেশ কট্ট্ করছে। পরিতোষের কানটা একটু সাফ হয়েছে বটে, কিন্তু চিৎকার করে না বললে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না, তার দৈহিক অবস্থাও তদ্রূপ। পাণ্ডা একখানা গাড়ি করতে বললে বটে, কিন্তু ট্যাকের অবস্থা বিবেচনা করে হেঁটে যাওয়াই সাব্যস্ত করা গেল।
প্রথমেই বাসস্থান ও আহারের ব্যবস্থা করা চাই, পুজো তার পরে হবে। পাণ্ডা মহারাজ আশ্বাস দিলে, কোনো ভয় নেই, সব ব্যবস্থা বেশ ভালোভাবেই হয়ে যাবে।
তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বাঙালিটোলায় এসে পৌঁছনো গেল। কাশীর যে বাঙালিটোলার কথা শৈশব থেকে শুনে আসছি, সেই বাঙালিটোলা। পাণ্ডা মহারাজ গলি তস্য গলির মধ্যে একটা বাড়িতে আমাদের নিয়ে উপস্থিত হল। বাড়ির মালিক বাঙালি, জাতিতে ব্ৰাহ্মণ, চট্টোপাধ্যায়। পুরো নামটা এতদিন পরে ঠিক মনে হচ্ছে না, বোধ হয় মহেন্দ্রনাথ চাটুজ্জে।
আমরা যখন তার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলুম, তখন সে ছোট কলকেতে বড় তামাক টানছিল। আমাদের দেখে একহাতে কলকেটা নামিয়ে ধরে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে পাণ্ডাকে জিজ্ঞাসা করলে, কি ব্যাপার?
পাণ্ডা আমাদের দেখিয়ে বললে, বাবুরা কলকাতা থেকে এসেছেন বিশ্বনাথ দর্শন করতে। এখানে ঘর-টর খালি আছে?
চাটুজ্জে হাতের কলকেটা তুলে একটি দম লাগিয়ে বললে, ঘর খালি আছে বইকি। ঘরের অভাব কি?
তার পরে আমাদের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে জিজ্ঞাসা করলে, বাবজীদের বাড়ি কি খাস কলকাতায়?
বললুম, হ্যাঁ।
বাপ-মা আছেন?
আছেন।
তা বাপু, বাপ-মাকে কাঁদিয়ে এরকম করে পালিয়ে এসে কি লাভ হয় তোমাদের বলতে পার?
বলতে বলতে কলকে তুলে আর এক টান–বাপ রে বাপ, সে কি টান!
আবার ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমাদের পাণ্ডাকে সম্বোধন করে চাটুজ্জের পো বলতে আরম্ভ করলে, কলকাতার ছেলে, বুঝলে পাণ্ডাজী, সে এক সাংঘাতিক চীজ! মায়ের দুধ ছাড়তে-না-ছাড়তে ব্যাটারা মাল টানতে শুরু করে দেয়।
কলকেটা উলটে ছাইয়ের ভেতর থেকে ঠিকরেটা তুলে নিয়ে আঙুলের মধ্যে ঘোরাতে ঘোরাতে চাটুজ্জে আমাদের জিজ্ঞাসা করলে, বাবাজীরা মাল-টাল টানতে শুরু করেছ তো? আমরা নিরুত্তর। চাটুজ্জে বলে যেতে লাগল, বছর দু-তিন আগে গোটা-তিনেক ছোঁড়া বুঝলে পাণ্ডাজী, বছর তেরো-চোদ্দ বয়েস তাদের, বাড়ি থেকে টাকা ভেঙে এখানে এসে উঠেছিল। ভালো ঘরের ছেলে, দেখতে এক এক ব্যাটা যেন কন্দর্প। সারাদিন কি মিষ্টি কথা, শুনলে কান জুড়িয়ে যায়। কিন্তু সন্ধে হলেই একেবারে অন্য লোক। রোজ সন্ধেবেলায় এক বোতল মাল এনে তিনটেতে মিলে টেনে সে কি হুড়োপাকাটি! দু-দিনে ঘরের মেঝেটাকে একেবারে চষে ফেললে হে! নেহাত অসহ্য হওয়ায় একদিন বললুম, বাবাজীরা, এই কচি বয়েসে এত মাল টেনে কেন মিছে দেহ নষ্ট করছ?
তা একজন জবাব দিলে, কাশীতে সস্তা মাল, তাই খেয়ে নিচ্ছি, চিরকাল তো আর খেতে পাব না।
যাক। ছেলেমানুষ, দু-দিন ফুর্তি করে নিক ভেবে’ আর বেশি কিছু বললুম না।
একদিন, রাত তখন দশটা হবে, শীতকাল, গ্যাস-ট্যাস টেনে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়েছি, হঠাৎ ছোঁড়ারা চিৎকার আরম্ভ করে দিলে, ওহে চাটুজ্জে, ও চাটুজ্জের পো, ঘুমুলে নাকি হে?
ডাকের রকম দেখে তো আমার সর্বাঙ্গ একেবারে জ্বলে উঠল। বোঝ একবার! আমি একটা বুড়ো মিসে, তোদের বাপের বয়েসি, তায় ব্রাহ্মণ, আমাকে কিনা–ওহে চাটুজ্জে, ওহে চাটুজ্জের পো! তোরা নয় মালই টেনেছিস, কিন্তু আমার পেটও গ্যাসে ভর্তি! কি বল গিরিধারী, বল তুমি। পাণ্ডা মহারাজ বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বললে, সো তো ঠিক কথা আছে। মানী ব্যক্তির মান রাখাই চাহিয়ে।
চাটুজ্জে এবারে কলকেটা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রেখে বলতে লাগল, আরে, তোরা নয় কলকাতার ছেলেই আছিস, আমিও বাবা কাশীর ছেলে। আমিও বেরিয়ে এলুম বালাপোশখানা গায়ে দিয়ে। বুঝলে, তখনও ছোঁড়ারা চেঁচাচ্ছে–ওহে চাটুজ্জের পো!
আমি বেরিয়ে শুরু করে দিলুম, হ্যাঁ হে ছোকরারা! ওহে-তোহে করছ কাকে হে? বলি, ওহে মানে কি হে? বলি, ওহের ব্যাটা ওহে, ওহে মানে কি হে? হ্যাঁ হে ওহে ওহে ওহে, বলি ওহে মানে কি হে?
খানিকক্ষণ ওহে-তোহে করতেই, ব্যস্, ছোকরারা একদম চুপ। মুখে আর বাক্যি নেই আমাদের পাণ্ডা জিজ্ঞাসা করলে, এতো রাত্রে হাঙ্গামা কিসের লেগে তা কিছু বললেন তাঁরা?
তা বললেন বইকি, তা আর বলেন নি! কি বললে জান গিরিধারী? সে-কথা শুনলে চমকে উঠবে। তোমার এই কলকাতার যজমানদের ফেলে কাছা আঁটতে আঁটতে মারবে দৌড় বাড়ির দিকে।
আমাদের পাণ্ডা হ্যাঁ-হ্যাঁ করে খানিকটা হেসে বললে, কি কোথা বললেন তাঁরা?
এবার চাটুজ্জে কয়েক পা এগিয়ে এসে একেবারে গিরিধারীর গা ঘেঁষে বলতে লাগল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটা, বুঝলে, গোঁফের রেখা পর্যন্ত দেখা দেয়নি, দুধের ছেলে হে, কি বললে জান? বললে, রাগ করছ কেন ভাই চাটুজ্জে? আজ রাস্তায় ভাগ্যক্রমে একটা বহুৎ আচ্ছা মেয়েমানুষ মিলে গিয়েছে, তাকে ধরে নিয়ে এসেছি, তোমার একটা ঘর খুলে দাও, এক দিনের ভাড়া দিয়ে দোব।
কথাটা শুনে আমাদের পাণ্ডা একেবারে লাফিয়ে উঠে বলতে আরম্ভ করে দিলে, সীতারাম, সিয়ারাম, এ বড় খারাব কাম আছে। তির করতে এসে এসব কাম বড় খারাব আছে, ছি ছি ছি!
চাটুজ্জে বলে যেতে লাগল, আরে সে-ব্যাটারা কি তীরর্থ করতে এসেছিল! অমন সব ছেলে জন্ম দেওয়ার জন্যে তীর্থ করতে আসা উচিত ছিল তাদের বাপ-মায়ের, বুঝলে গিরিধারী?
গিরিধারী গম্ভীরভাবে বললে, এ কোথা ঠিকই বললেন আপনি।
চাটুজ্জে তখন ক্ষিপ্তপ্রায়। উত্তেজিত স্বরে সে বলে যেতে লাগল, কলকাতার লোক দেখে দেখে সব্বাঙ্গের চুল পেকে গেল আমার। সেখানে বড়লোক গরিবলোক সব্বারই মেয়েমানুষ একটা করে রাখা চাই, তা ঘরের বউ পরমাসুন্দরীই হোক আর নাই হোক।
গিরিধারী গম্ভীরভাবে বললে, হাঁ, তা রাজধানীর নাগরিক, সো একটু বিলাসী হোবেই। তবে মায়েরা খুবই ভালো আছেন। কলকাতার হনেক লোক হামার যজমান, হামি জানি। তীরে এলে তাদের মেজাজ একেবারে রাজরানীর মতো হোইয়ে যায়, সে হামি জানি।
চাটুজ্জে হঠাৎ আকাশের দিকে মুখ তুলে দুই হাত যুক্ত করে কপালে ঠেকিয়ে বলতে লাগল, ওরে বাবা! তাঁরা সাক্ষাৎ দেবী। ওরে বাবা, তাঁদের পুণ্যের জোরেই এ ব্যাটাদের এত লপ্চপানি চলে, নইলে কবে বংশলোপ হয়ে যেত সব ব্যাটার।
চাটুজ্জের পো চেঁচিয়েই চলল। এদিকে ক্লান্তি ও ক্ষুধায় আমাদের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়ে চলেছে, আর দাঁড়াতে পারি না এমন অবস্থা। কলকাতার সেই মহাত্মা বালকদের মনে মনে প্রণাম করে চাটুজ্জেকে বলে ফেললুম, তা কলকাতার লোককে ঘর ভাড়া দিতে ইচ্ছে যদি না থাকে তো সোজাসুজি বলেই দিন না, আমরা অন্যত্র চলে যাই।
আমার কথা শুনে চাটুজ্জে এমন শিউরে উঠল যে, মনে হল, তার মারাত্মক ফিক্-বেদনা ধরেছে। সে বললে, সে কি কথা, সে কি কথা বাবাজী! তোমরা খদ্দের, আমার মাথার মণি। তবে বলেছিলুম কি, মাল-টাল খাও তোমরা খাবে, তাতে আমার বলবার কি থাকতে পারে? কি বল গিরিধারী? তবে ঘরটা আমার কিনা! এই মাগি-গণ্ডার দিনে আমার ঘরখানা যদি বাসের অযোগ্য করে ফেল, তাই একটু সাবধান করে দিচ্ছিলুম। তা কিছু মনে কোরো না, বুড়ো মানুষের কথায় রাগ কোরো না বাবা। যাও গিরিধারী তুমি বাবাজীদের ওপরে নিয়ে যাও, আমি চাবি নিয়ে আসছি।
জিজ্ঞাসা করলুম, ঘরের কিরকম ভাড়া লাগবে?
সব জায়গায় যা নেয়, তাই দেবে। আমি কি তোমাদের কাছে বেশি নোব? জন-প্রতি দৈনিক এক পয়সা।
অর্থাৎ দুজনে চোদ্দ আনা মাসে একখানা ঘর-দোতলায়।
আমি ঊনচল্লিশ বছর আগেকার কথা বলছি। এই ঊনচল্লিশ বছরের মধ্যে কাশীর সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধার্মিক ও নৈতিক জীবনে যে পরিবর্তন জোর করে ঘটানো হয়েছে, অতি-প্রগতিশীল না-ইয়র্ক বা লন্ডন নগরীতেও তা হয়নি। শীতকালে তুলোর জামার বদলে জনকয়েক লোকের, অঙ্গে সার্জের জামা চড়েছে বটে, কিন্তু দেশসুদ্ধ লোক বস্ত্রহীন হয়েছে। অর্থনৈতিক জলসায় ঐন্দ্রজালিক কায়দায় বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, দেশের লোকের আর্থিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে, ফলে দেশের চার ভাগের তিন ভাগ লোক আজ দু-বেলা পেট ভরে খেতে পায় না। আমাদের জীবনধর্মের মর্মমূল দংশন করেছে শ্বেত-উপদংশ, বিষ প্রায় মাথায় চড়েছে, এ বিষ ঝাড়তে পারে এমন ওঝা কি দেশে জন্মাবে?
যাক, একপয়সা ঘর ভাড়া থেকে অনেক কথা এসে গেল।
চাটুজ্জে এসে তো ঘর খুলে দিলে। পুরনো দিনের ঘর, অর্থাৎ একেবারে সিন্দুকের মতো ঘরের একটিমাত্র দরজা, একদিকের দেওয়ালের ওপরদিকে একটি বড় ঘুলঘুলি, যার নাম গবাক্ষ দরজা বন্ধ থাকলে ওই ঘুলঘুলি দিয়ে আলো-বাতাস ঘরে ঢোকে। ঘরের মেঝে মাটির, যদিও দোতলায়, তাতে দুটো তিনটে বড় বড় ইঁদুরের গর্ত।
ঠিক হল, এ-বেলায় আমরা চাটুজ্জের ওখানেই আহার করব, খরচ পড়বে জন-প্রতি তিন আনা। দরজায় তালাচাবি লাগিয়ে আমরা পুজো দিতে বেরিয়ে গেলুম।
পাণ্ডার সঙ্গে এক টাকা দর ঠিক হয়েছিল, কিন্তু এখানে দু-আনা ওখানে চার আনা এমনই করে প্রায় আড়াই টাকা গচ্চা দিয়ে বিশ্বনাথের হাত থেকে তখনকার মতন রেহাই পেয়ে বাড়ি ফিরে এলুম। পাণ্ডা তখনও সঙ্গ ছাড়েনি, কারণ তার পাওনা তখনও বাকি। ভদ্রলোক সে, বললে, আপনারা খাওয়া-দাওয়া করিয়ে লিন, হামার পাওনা, সে একসময়ে লিইয়ে লিব, কুছু চিন্তা নেই।
খাবার ডাক পড়ল। গিরিধারীই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল খাবার ঘরে। চাটুজ্জে তখন খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুম দিচ্ছে। লাল চালের আধসেদ্ধ ভাত, থালার এক কোণে ভাতের মধ্যে খোদল করে হাতা-দুয়েক কলায়ের ডাল, আর এক কুচি ধুঁধুল ভাজা,–এই খাদ্য কোনোরকমে দু-চার গ্রাস খেয়ে তো উঠে পড়লুম। পাণ্ডা বললে, এখানে আর খেও না। তিন আনায় কাশীতে রাজভোগ মিলে, লোকটা ঠিক লোক নাহি আছে।
এবার পাণ্ডা বিদায় করার পালা। শঙ্কিতচিত্তে একটি টাকা বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলুম। কোনো আপত্তি না করে প্রশস্ত-হস্তে টাকাটি নিয়ে বললে, কিছু যদি মনে না করিস তো একটা কথা বলছি বাবা।
বল বাবা।
তোমাদের কাছে কত টাকা আছে?
আমাদের তহবিলে তখন আর মাত্র পনেরো-ষোলোটি টাকা অবশিষ্ট ছিল। আমরা সে টাকাগুলি বের করে তার সামনে রেখে দিয়ে বললুম, এই আছে আমাদের কাছে
গিরিধারী বললে, দেখ্, হামি তোদের বড় ভাই আছে। তোদের টাকাকড়ি, কাপড়-চোপড় খাওয়া-দাওয়ার কোনো কষ্ট হলে হামাকে বলবি, হামি সব ব্যবস্থা করিয়ে দেব। তোদের কোনো ভয় নেহি আছে। কাশীধামে মৌজ করিয়ে থাক্ তোরা, হামি আছে।
গিরিধারীর আশ্বাসবাণীর কোনো উত্তর দিতে পারলুম না। কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটাবার পর সে বললে, সঝের সময় কোথাও যাসনি। তোদের মন্দিরে লিয়ে যাব আরতি দেখতে।
আধ-ভিজে ধুতি-দুখানা মাটির মেঝেতে পেতে, দুখানা শুকনো ধুতি পাকিয়ে বালিশ করে আমরা শুয়ে পড়লুম।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলুম জানি না, দরজা-ধাক্কার আওয়াজ পেয়ে উঠে পড়লুম। উঠে দেখি, গিরিধারী দরজা ঠেলছে, তার সঙ্গে একটা লোক, লোকটার কাঁধে একটা শতরঞ্চি, দুটো বালিশ আর দুটো দিশি কালো কম্বল। আমাদের সঙ্গে বিছানাপত্তর নেই দেখে সে নিয়ে এসেছে।
তখন প্রকৃতির চোখে সন্ধ্যার ঘোর লেগেছে, আলোর প্রয়োজন। চাটুজ্জেকে সে-কথা বলতেই সে বললে, দৈনিক একপয়সা দিলে বাতির ব্যবস্থা হতে পারে।
তখুনি রেড়ির তেলের প্রদীপ ও মাটির পিজ এসে গেল। তখনকার মতন বাতি নিবিয়ে আমরা গিরিধারীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লুম মন্দিরের উদ্দেশে। ঘণ্টা-দুয়েক এ-মন্দির সে-মন্দির ঘুরিয়ে গিরিধারী আমাদের নিয়ে গেল তার নিজের বাড়িতে। সেখানে তার বৈঠকখানায় বসিয়ে সে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে, তোরা বাড়ি থেকে কেনো ভাগিয়েছিস?
আমরা বললুম, দাদা, আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই, বাড়ির গলগ্রহ হয়ে থাকতে চাই না। জীবনে উন্নতি করতে চাই। তা ছাড়া বিশ্বনাথ টেনে এনেছেন, এতে আমাদের হাত নেই। গিরিধারী সব শুনে বললে, ঠিক আছে। বিশ্বনাথের আশ্রয়ে যখন এসেছিস, তখন সবই ঠিক হয়ে যাবে।
গিরিধারী আরও আশ্বাস দিলে, আজকাল এখানে অনেকে তেজারতির কারবার লাগিয়েছে, তাদের কারুর না কারুর দপ্তরে তোদের ঠিক বসিয়ে দেব। জয় বাবা বিশ্বনাথ!
ঠিক হল, চাটুজ্জের ওখানে আর আমরা খাব না। সকালবেলা বাজারে কোথাও খেয়ে নোব, আর রাত্রে গিরিধারীর ওখানে খাব।
সে-রাত্রে গিরিধারীর ওখানে আটার লুচি, কুমড়ো আর কাঁচা-তেঁতুলের ছক্কা, করলার আচার আর রাবড়ি ভক্ষণ করে বাসায় ফিরে এসে দু-দিন বাদে গা ঢেলে শুয়ে বাঁচা গেল।
.
মানুষের জীবনে চরম মুহূর্ত আসে মাত্র একবার। কোথাও সে জানান দিয়ে সমারোহের সঙ্গে আসে, কোথাও বা সে আসে চোরের মতন অতর্কিতে। কিন্তু পরম মুহূর্ত–সে বহুবার আসতে পারে এবং যতবার সে আসে ততবারই আসে অতর্কিতে। আমার জীবনে বিশ্বনাথের রাজধানীতে এই পরম মুহূর্ত এসেছিল অতি অতর্কিতে।
আমি ছেলেবেলা থেকেই অত্যন্ত শীতকাতুরে। এক রাত্রি ট্রেনে ও এক রাত্রি প্ল্যাটফর্মে শুয়ে খুবই কষ্ট ভোগ করেছি। আমরা কলকাতার ছেলে, তেমন শীত সহ্য করা কোনোকালেই অভ্যেস নেই। শীত ও হিম লাগার চোটে পরিতোষ বেচারির ডান কানটা একরকম বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। গিরিধারীর দয়ায় শতরঞ্চি, কম্বল ও বালিশ পেয়ে প্রথম রাত্রিটা বেশ আরামেই কাটল; কিন্তু শেষরাত্রির দিকে বারে বারে ঘুম ছুটে যেতে লাগল শীতের চোটে। একবার এইরকম কাঁপতে কাঁপতে ঘুম ভেঙে যেতেই শুনতে পেলুম, আকাশ-বাতাস ভরে উঠেছে কালংড়ার করুণ গুঞ্জনে। বহুদূরে বসে কোনো সুরশিল্পী সানাইয়ের রন্ধ্র দিয়ে ঘোষণা করছে তার হৃদয়ের ব্যথা! বোধ হয় কয়েক মুহূর্ত মাত্র–তার পরেই এল সেই পরম মুহূর্ত, যার বিনিময়ে আমি আমার বাকি জীবনটা দিয়ে দিতে পারি। সে অনুভূতির সঙ্গে ইহলোকের কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। সে একটা আনন্দময় অনুভূতি, সে আনন্দের সঙ্গে পার্থিব কোনো আনন্দেরই তুলনা করা চলে না। মন আছে বটে, কিন্তু সে জ্ঞান নেই–সেই অবস্থার সঙ্গে নিজের অস্তিত্ববোধের একটা সূক্ষ্ম যোগ আছে মাত্র। আমি যে নিজে একটা আনন্দ অনুভব করছি, তারও পূর্ণ চেতনা নেই। শুধু আছে আনন্দ, আর আছে সেই আনন্দের উৎস-কালাংড়ার করুণ কাহিনি।
কতক্ষণ এই অবস্থায় কেটেছিল জানি না। যখন জ্ঞান ফিরে এল, দেখলুম, দেওয়ালের কোণের গবাক্ষ দিয়ে অরুণ তার আলোকলিপি পাঠিয়েছে।
ধড়মড় করে উঠে দেখি, ‘বন্ধু পরিতোষ আসনপিঁড়ি হয়ে বসে, তার যুক্তকর কপালে সংলগ্ন। আমার বাবা কলকাতা ছেড়ে আসামে চাকরি নিয়েছিলেন–বন-বিভাগে। সেখানে একটি শিশুকন্যার মৃত্যু হওয়ায় চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি চলে আসছিলেন কলকাতায়। আসবার সময় ফরিদপুরে এক বন্ধুর বাড়িতে আমন্ত্রিত হয়ে দিনকতক সেখানে বাস করছিলেন, আমি ধরাধামে অবতীর্ণ হবার বোধহয় মাস-দেড়েক আগে। কলকাতা রওনা হবার মুখে সেখানকার এক হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার মাকে দেখে বলে দিলেন যে, এ অবস্থায় নৌকা অথবা রেলে ভ্রমণ তাঁর পক্ষে মারাত্মক হতে পারে। সদ্যসন্তানশোকবিধুর দম্পতি ঠিক করে ফেললেন, আমি ভূমিষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা ফরিদপুরেই বাস করবেন। আমার সতেরো কি আঠারো দিন বয়সে আমি কলকাতা এসে পৌঁছেছিলুম এবং সেই থেকে এই শহরেই মানুষ হয়েছি। এর মধ্যে বাল্যে একবার পল্লীগ্রামে গিয়েছিলুম। আর বার-দুই পিসিমাদের সঙ্গে গিয়েছিলুম দেওঘরে।
কিন্তু কাশীতে এসে আমি ভারতবর্ষকে প্রথম দেখলুম। ভারতের সর্বশেষ নগরের এই নগণ্য বালকের চোখে জগতের প্রাচীনতমা সেই নগরী যে কি অঞ্জন লাগিয়ে দিলে, আজ পাশ্চাত্য ক্ষতে তার সারা অঙ্গ ভরে উঠলেও তারই অঙ্কে মাথা রেখে শেষনিশ্বাস নেবার জন্যে সে উন্মুখ হয়ে আছে।
কাশীতে আমি যেন একটা নতুন জগতে এসে পৌঁছলুম। কলকাতা বা দেওঘর কারুর সঙ্গেই তার তুলনা হয় না। কাশীর রাস্তা, সে কেমন উঁচু-নীচু! রাস্তা দিয়ে কত রকমের লোক চলেছে, তাদের মাথায় কত অদ্ভুত রকমের টুপি, কত রকম-বেরকমের পাগড়ি! চলতে চলতে কোনো জায়গায় মনে হয়, যেন রাজবাড়ির তোরণের সামনে এসে দাঁড়ালুম। কয়েকধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখি, ওমা, এ যে রাস্তা! বৈচিত্র্যহীন সিধে ও সমতল কলকাতার রাজপথের তুলনায় সেখানকার পথ অপূর্ব বলে মনে হতে লাগল।
এক্কা-গাড়ি সেই প্রথম দেখলুম। কেমন ছোট ছোট রথের মতন গাড়ি, তাতে গাধার মতন ছোট ছোট ঘোড়া জোতা, গলায় ঘণ্টা বাঁধা, পিনপিন করে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এঁকে-বেঁকে ছুটে চলেছে! বড় বড় চওড়া রাস্তার গা দিয়ে ছবির মতো সরু সরু গলিপথ–তিনজন লোক পাশাপাশি চলা যায় না। দু-পাশে উঁচু উঁচু বাড়ি–ইট কি পাথরের তৈরি, তা বোঝা মুশকিল। কোথাও বা সেই সরু অপরিসর পথ জুড়ে বিরাট এক গাই শুয়ে আলস্যে চোখ বুজে রোমন্থন করে চলেছে, মানুষ তার কোনো অসুবিধা না করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে।
মুদির দোকানে পাশাপাশি ঝুড়িতে থরে থরে মন্দিরের আকারে পরিপাটি করে সাজানো রয়েছে সোনা-রঙের কাঁচা মুগের ডাল, অড়র ও খেসারির ডাল। দোকানের সামনে খদ্দেরের ভিড়, হঠাৎ সেই ভিড় ঠেলে ঢুকে পড়ল বিরাট এক ষাঁড়। মুখ থেকে একহাতটাক লম্বা জিভ বের করে যাদুকরের তৎপরতায় ডালের চূড়োর ওপর একবার ঘুরিয়ে পোয়াটাক মাল ভেতরে টেনে নিলে। মুদি হৈ-চৈ করে তাড়া দিয়ে উঠল, আর এক-পো ডাল মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল। নন্দীর পো মন্থরগতিতে ডাল চিবুতে চিবুতে একদিকে চলে গেল। মুদি সেই গরুর জিভের লালা-মাখানো ডাল খদ্দেরদের তুলে দিতে লাগল, কোথাও আপত্তির লেশমাত্র নেই।
ময়রার দোকানে খাবার কিনছি, হঠাৎ কে যেন পায়ে হাত দিলে। চমকে নীচের দিকে চেয়ে দেখি, একটা কুকুর তার সামনের দুটি পা জোড় করে পায়ের ওপর রেখে করুণ নয়নে মুখের দিকে চেয়ে আছে।
ময়রা বললে, ও খেতে চাইছে, ওকে একখানা পুরি দাও।
একখানা পুরি কিনে দিতেই সেখানা মুখে করে নিয়ে রাস্তার একপাশে গিয়ে খেয়ে বসে রইল–আবার তারই প্রত্যাশায় যে তার মর্যাদা বুঝবে। সবার কাছে সে চায় না। সে লোক চিনতে পারে, কাশীর আভিজাত্য যে রক্ষা করে না সেখানকার জানোয়ারেরাও তাকে অবহেলা করে।
ছাতের ওপরে বাঁদর ঘুরছে তার হারেম ও পুত্রকন্যার পাল নিয়ে। গেরস্থ একটু অসাবধান হয়েছে কি তার বড়ি আচার লাড্ডু মেরে ভাগছে। একটা তির-ধনুক কিংবা কাপড়ের একটা মানুষ তৈরি করে টাঙিয়ে দাও, তারা বুঝে নেবে, এ গৃহস্থ চায় না যে তাদের জিনিস লুট করে খাই, তারা অন্যত্র চলে যাবে।
সবাই বিশ্বনাথের জীব, সকলেরই বাঁচবার অধিকার আছে। যে লোক তাদের দিতে কৃপণতা করে, বিশ্বনাথ তাদের রক্ষা করুন। জয় বাবা বিশ্বনাথ!
অতি প্রত্যূষে, ভোর হবার বোধ হয় দু-ঘণ্টা আগে সানাইয়ের তানে ঘুম ভেঙে যায়। কোথায় শুরু হয়েছে কালাংড়া, তার মধ্যে কোথা থেকে ললিতের তান এসে ঢুকে পড়ল। শুঁয়োপোকার চলনের মতন অতর্কিতে এসে গেল জৌনপুরীর আবেদন, সবাইকে ডুবিয়ে দিয়ে ভয়রোঁ ছড়িয়ে দিলে করুণ-গম্ভীর আকুতি–জাগো জাগো পুরবাসী! অন্ধকার অবসান হল।–বলতে বলতে উদাসী ভৈরবী এসে গেল।
ব্রাহ্মমুহূর্তের আগেই ভক্তরা সব সেই শীতে বেরিয়ে পড়েছে গঙ্গাস্নান করতে। ‘জয় জয় বাবা বিশ্বনাথ’ রবে আকাশ ভরে উঠেছে। ওঠ, জাগো, ভোর হল, ভোর হল!
দশাশ্বমেধ ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখ, খৃষ্টগাত্রী বাঙালি তরুণী বিধবার দল। সমাজ তাদের সিঁথের সিঁদুর মুছে দিলেও বালার্ক প্রতি প্রত্যূষেই তাদের সীমন্তে মুঠো মুঠো সোহাগ-সিঁদুর ছড়িয়ে দিচ্ছে। সংসারের সমস্ত ‘বন্ধন ছিন্ন করে বাসনা-কামনা-শূন্য হয়ে কাশীতে এসে প্রতি প্রভাতে তারা কাকে প্রণাম করে? কি উদ্দেশ্যে?
স্নানান্তে স্ত্রীপুরুষ সব ঘরে ফিরে চলেছে, কিন্তু কোনো তাড়া নেই–চলেছে তো চলেইছে। এখানে জল ঢালছে, ওখানে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। দশটায় ট্রাম ধরবার তাড়া নেই, অধিকাংশেরই এক-বেলা আহার, একসময়ে গিয়ে চড়িয়ে দিলেই হবে। অদ্ভুত হালচাল সব; সাত্ত্বিকতা ও তামসিকতা জড়াজড়ি করে যেন বিশ্বনাথের পায়ে লুটিয়ে পড়েছে। জয় বাবা বিশ্বনাথ!
দিনশেষে আবার ছুটবে সুরের প্রস্রবণ। বয়স্কেরা তখন ঘাটে এসে স্থির হয়ে বসে যায় গঙ্গামুখী হয়ে। শুঁয়োপোকা গুটি বাঁধবার আগে যেমন স্থির হয়ে গাছের ডালে আটকে যায় জীবনবিহঙ্গ পক্ষ বিস্তার করবার আগে তারা যেন তেমনই স্থাণু হয়ে গিয়েছে। কাশীর সব ভালো, সব ভালো–এই তাদের বুলি। কাশী ছেড়ে কোথাও নড়ব না, এখানেই মরতে হবে, এখানে মরলে আর জন্মাতে হবে না, এখানে মরলে শিব হয়, এখানে শব নেই, সব শিব।
কাশী বাবা-বিশ্বনাথের স্থান, তিনি এখানে কারুকেই অভুক্ত রাখেন না। মানুষ তো দূরের কথা, পশুপক্ষীও কেউ অভুক্ত থাকে না। রাস্তায় রাস্তায় ছত্র, সেখানে ঠিক সময়ে উপস্থিত হলে পেট পুরে খেতে পাওয়া যাবে। যদিও সেদিন আর নেই, কিন্তু বেশিদিনের কথা নয়, আমি যেদিন কাশীকে প্রথম দেখেছিলুম সেদিন এমনই ছিল।
দিন-চারেক এমনই কাটল, কিন্তু চাকরি-বাকরির কিছুই ঠিক হল না। গিরিধারীকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলে, কিছু ভাবনা নেই, এখন মৌজ কর, সব ঠিক হোইয়ে যাবে।
মৌজের অপর্যাপ্ত উপাদান চারিদিকে ছড়িয়ে আছে স্বীকার করলেও মাথার ওপরে ওই দুর্ভাবনার বোঝা নিয়ে যে মৌজ করা সম্ভব নয় সে-কথা গিরিধারী কিছুতেই বোঝে না। সকালবেলা বাজার থেকে পুরি-মিঠাই কিনে খাই, রাত্রে গিরিধারীর ওখানে মাগনায় রাজভোগ জোটে। এদিকে ট্যাকের অবস্থা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে, ভেবে-চিন্তে কিছুই ঠিক করতে পারি না। শেষকালে গিরিধারীর সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করা হল যে, চাটুজ্জের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আমরা আপাতত একটা ধর্মশালায় গিয়ে থাকব। গিরিধারীই সেখানকার একটা ভালো ঘর ঠিক করে দিলে। ঠিক হল, সকালবেলা এখানে সেখানে খেয়ে রাত্রে তার ওখানেই খাব। কাজকর্ম ঠিক হয়ে গেলে, তখন তিন-চার টাকা দিয়ে একটা বাড়ি ভাড়া আর টাকা-পাঁচেক দিলেই একজন বাঙালি বিধবা পাওয়া যাবে, তিনি আমাদের রান্নাবান্না ও সংসারের সমস্ত ব্যাপারই তদারক করবেন। গিরিধারী আরও আশ্বাস দিলে যে, মুন্সী মাধোলালের (পরে রাজ) দপ্তরে আমাদের এক-একটা কাজের ব্যবস্থাও সে করে ফেলেছে–মাসে কুড়ি টাকা মাইনে আর ইংরিজিতে চিঠিপত্র লিখতে পারলে দেখ দেখ করে মাইনে বেড়ে যাবে। জয় বাবা বিশ্বনাথ! চাটুজ্জের সঙ্গে হিসেবকিনেশ শুরু হল–চার দিনের ঘরভাড়া দু’জনের দু-আনা, চার দিনের প্রদীপ-ভাড়া এক আনা হবে।
চাটুজ্জে বললে, চার দিনের চার পয়সা চৌকিদার আর চার পয়সা পায়খানার ভাড়া দিতে
আমরা বললুম, শহরে আবার চৌকিদার কি?
সে বললে, শহরের নয়, বাড়ির চৌকিদার।
শেষদিনে আমরা পায়খানা ব্যবহার করিনি, কিন্তু চাটুজ্জে বললে, বাড়িতে থাকলেই পায়খানার ভাড়া দিতে হবে।
গিরিধারী বললে, লোকটা চামার আছে।
বিদায়ের সময় চাটুজ্জে গদগদ হয়ে বললে, যাও বাবা, ঘরের ছেলে ঘুরে ফিরে যাও বাপ-মার কোলে। বিয়ের পর বউমাকে নিয়ে যখন বিশ্বনাথ দর্শন করতে আসবে–আসতেই হবে–তখন এখানেই এসে উঠো। বুড়ো চাটুজ্জেকে ভুলো না বাবা।
বুড়ো চাটুজ্জেকে ভুলিনি। চৌকিদার আর পায়খানার জন্যে সেদিন অসহায় ছেলেমানুষ পেয়ে এই যে কটা পয়সা জোর করে সে আদায় করেছিল, তার প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছে মনের মধ্যে জাগ্রতই ছিল। তাই বিয়ের বোধ হয় বছরখানেক পরেই গুরুদেবীকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলুম, সেখানে, কিন্তু তার বরাত ছিল ভালো, গিয়ে শুনলুম, কয়েক বছর আগেই সে কাশীপ্রাপ্ত হয়েছে।
চাটুজ্জের হিসেব চুকিয়ে বালিশ, কম্বল ও শতরঞ্চি গিরিধারীর বাড়িতে জমা দিলুম, রাত্রে খেয়ে-দেয়ে যখন ধর্মশালায় যাব তখন নিয়ে যাব।
রাস্তায় তো বেরিয়ে পড়া গেল। ধর্মশালায় বিনা পয়সায় থাকতে পাব, একবেলা বিনা পয়সায় আহার, মন অনেক নিশ্চিন্ত। ঠিক করা গেল, আজ আর পয়সা খরচ করে খাব না। লোকে বলে, বিশ্বনাথ কারুকে অভুক্ত রাখেন না–এই বাক্য প্রমাণ করবার একটা সুযোগ বিশ্বনাথকে দেওয়াই যাক। সন্ধ্যাবেলা গিরিধারীর ওখানে খাবার তো ঠিকই আছে।
রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলুম। একবার দূরে একজন মুখচেনা লোক দেখতে পেয়ে টপ করে একটা গলিতে ঢুকে পড়া গেল। লোকটা কিন্তু সেই গলিতেই ঢুকে বনবন করে আমাদের পেরিয়ে চলে গেল, আমাদের দিকে ফিরেও তাকালে না।
জয় বাবা বিশ্বনাথ! –বলে হাঁপ ছেড়ে আবার বড় রাস্তায় বেরিয়ে পড়া গেল। কিন্তু কাশী এক বিচিত্র দেশ বাবা! ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যে কত চেনা মুখ চোখে পড়ল তার ঠিক নেই। এরকম পথে পথে ঘুরলে হয়তো ধরাই পড়ে যাব। ওদিকে দিনের আলো থাকতে থাকতে ধর্মশালায় যেতে পারি না, কারণ সেখানে হরদম বাঙালি যাত্রী আসছে যাচ্ছে। কোথা দিয়ে কোন চেনা লোকের সামনে পড়ে গেলে কেলেঙ্কারির অন্ত থাকবে না–এইসব ভেবে গলির গলি তস্য গলির মধ্যে নির্জন জায়গা দেখে একটা বাড়ির রকে গিয়ে দুজনে বসে রইলুম।
খিদেয় পেটের মধ্যে পাক দিচ্ছে; কিন্তু সংকল্প করেছি, কিছুতেই পয়সা খরচ করে খাব না। বিড়ি ফুঁকছি আর দুজনে পরামর্শ করে আকাশে প্রাসাদ তৈরি করছি। নির্জন রাস্তা, তবু মাঝে মাঝে এক-আধজন স্ত্রীপুরুষ যাচ্ছে, যাবার সময় অবাক হয়ে আমাদের দেখছে, আর আমরা মনে মনে শঙ্কিত হচ্ছি। সেখান থেকে উঠে অন্য কোথাও গিয়ে বসব বলে মনে করছি, এমন সময় গৈরিক-বস্ত্রধারিণী এক সন্ন্যাসিনী ধীরপদক্ষেপে আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেলেন। সন্ন্যাসিনী গৌরী–শুধু গৌরী নয়, অপূর্ব সুন্দরী। এ শ্রেণীর সৌন্দর্য ইতিপূর্বে আমি আর দেখিনি। বয়স মনে হল তিরিশের কাছাকাছি হবে; কিন্তু পরে শুনেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি। একখানা লালপেড়ে গেরুয়া রঙের শাড়ি পরা, গায়ে একখানা বাসন্তী রঙের রেশমের নামাবলী, চুল ঝুলছে প্রায় হাঁটু ছাড়িয়ে, ডান হাতে ঝোলানো একটা ঝকঝকে তামার কমণ্ডলু। কি অসীম মমতা তাঁর চাহনির মধ্যে স্তব্ধ, দেখলেই মনের মধ্যে আশ্বাস জেগে ওঠে। ওষ্ঠাধরের এমন গঠন যে, মনে হয়, হাসছেন। সন্ন্যাসনী আমার দিকে এমনভাবে চাইতে চাইতে এগিয়ে গেলেন যে, মনে হল, আমাদের যেন চিনতে পারছেন। তিনি কিছুদূর এগিয়ে যেতেই পরিতোষ বললে, কি রে, চেনা নাকি?
কি জানি ভাই, ঠিক বুঝতে পারছি না।
নিশ্চয় চেনা, না হলে তোকে দেখে অমন হাসতে হাসতে গেল কেন?
তা হলে চল, এখান থেকে সরে পড়া যাক।
একখানা ধুতি পেতে দুজনে জমাট হয়ে বসা গিয়েছিল। তড়াক করে উঠে উলটো দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ধুতিখানা গুটোচ্ছি, এমন সময় কানের মধ্যে মধু বর্ষিত হল, গোপাল!
দেখি সন্ন্যাসিনী ফিরে এসে প্রায় আমাদের কাছেই দাঁড়িয়েছেন। পরিতোষ বললে, বোধ হয় তোকে ভুল করেছে।
আবার মধু বর্ষিত হল, গোপাল!
জিজ্ঞাসা করলুম, আমাকে ডাকছেন?
সন্ন্যাসিনী একবার সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বলেন, এখানে দাঁড়িয়ে কেন গোপাল?
আমরা তো একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলুম। সামান্য সেই দুটি কথায় কি মমতা, কি আকর্ষণ! জয় বাবা বিশ্বনাথ!
সন্ন্যাসিনী ধীরপদক্ষেপে একেবারে আমার সামনে এলে স্থির দৃষ্টিতে হাসাহাসি মুখে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। তাঁর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেবার চেষ্টা করেও পারলুম না, একটা সুখদায়ক শৈথিল্যে আমার সর্বাঙ্গ যেন ভরে আসতে লাগল।
সন্ন্যাসিনী আর এক পা এগিয়ে এসে বললেন, ছি গোপাল, বেলা গড়িয়ে গেল, সারাদিন না খেয়ে এখানে বসে থাকবে! চল।
সন্ন্যাসিনী এগিয়ে চললেন, আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাঁকে অনুসরণ করতে লাগলুম। বন্ধু পরিতোষ যে পেছনে দাঁড়িয়ে, সে খেয়ালও রইল না।
কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর হঠাৎ দাঁড়িয়ে আমার দিকে ফিরে সন্ন্যাসিনী জিজ্ঞাসা করলেন, কই, বন্ধু এল না?
ততক্ষণে আমার সংবিৎ ফিরে এসেছে; কিন্তু আমি পরিতোষকে ডাকবার আগেই তিনি দ্রুত- পদবিক্ষেপে তার কাছে গিয়ে থুতনিতে হাত দিয়ে আদর করে বললেন, দাঁড়িয়ে কেন বন্ধু? চল।
পরিতোষ গুটিগুটি তাঁর পেছনে চলতে আরম্ভ করলে।
প্রায় দশ-বারো মিনিট এ-গলি সে-গলি ঘুরে সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে আমরা একটা বাড়ির মধ্যে ঢুকলুম। তিনতলা বাড়ি, একতলাটি ঝকঝক করছে পরিষ্কার। কাশীর গলির হিসাবে বেশ বড় বাড়িই বলা যেতে পারে। দরজা দিয়ে একটা সরু গলি-পথ। সেটুকু পেরিয়ে মাঝারি-গোছের একটা উঠোন, লাল বেলে-পাথর দিয়ে বাঁধানো। উঠোনের এক কোণে ছোট্ট একটি বাঁধানো কুয়ো। কুয়োর পাড়ে সোনার মতো ঝকঝক করছে একটা লোটা, তার গলায় সাদা ধবধবে সুতোর দড়ি বাঁধা। পাশাপাশি চার-পাঁচটা ঘরে তালা লাগানো। সন্ন্যাসিনী পাশাপাশি তিনটে ঘরের তালা পটপট করে খুলে ফেলে আমাকে বললেন, গোপাল, এই একতলাটা তোমার। দোতলা-তেতলায় সব ভাড়াটে থাকে
আমি একেবারে বাক্যহীন। পরিতোষ বেচারি একে ভালোমানুষ, তার ওপরে কাশীতে পদার্পণ করার পর থেকেই একটা কান তার প্রায় বন্ধ, ব্যাপার-স্যাপার দেখে সে তো একেবারে হতভম্ব। ট্রেনে কাশীর গুণ্ডা, পাণ্ডা, কাশীর জোচ্চোর ইত্যাদির অনেক আজগুবি গল্প শুনেছিলুম বটে, কিন্তু এরকম ব্যাপার তাদের অভিজ্ঞতা বা আমাদের কল্পনা কোথাওই ছিল না।
একটা মাঝারি-গোছের ঘর। একধারে বড় একটা তক্তপোশ, তার ওপরে ধবধবে সাদা উঁচু বিছানা পাতা। ঘরের আর-একদিকে একটা বেঁটে যণ্ডা-গোছের চৌকির ওপরে পাহাড়ের মতন বালিশ, লেপ, তোশক সাজানো। মেঝের একদিকে একটি সুদৃশ্য ছোট্ট জলচৌকির ওপর একটা ঝকঝকে পেতলের পিলসুজ, তার মাথায় পেতলেরই একটা প্রদীপ। এই ঘরের মধ্যে আমাদের নিয়ে এসে সন্ন্যাসিনী পরিতোষকে বললেন, বন্ধু, এইটে তোমার ঘর। তারপর নিজের হাতে আমাদের গা থেকে শার্ট খুলে হিন্দি সুরে কোকিলকণ্ঠে তান ছাড়লেন, রসিয়াকি মায়ি!
রসিয়াকি মায়ি বোধ হয় কাছাকাছি কোথাও ঘুম লাগাচ্ছিল, ডাক শোনামাত্র ‘আয়ি’ বলেই এসে দাঁড়াল।
সন্ন্যাসিনী বললেন, কুয়ো থেকে জল তুলে এদের স্নান করিয়ে দাও।
আমরা কুয়োতলায় গিয়ে দাঁড়ালুম। রসিয়াকি মায়ি একটা তোলা উনুনে আগুন দিয়ে সেটাকে উঠোনের এক কোণে রেখে বালতি করে জল তুলে আমাদের স্নান করাতে লাগল। এতক্ষণে একটু ফাঁকা পেয়ে পরিতোষকে বললুম, ব্যাপার কি রে?
পরিতোষ আস্তে আস্তে বললে, আমাদের বরাত ভালোই বলতে হবে।
এমন সময় সন্ন্যাসিনী দুখানা কাপড় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। একখানা সাদা থান পরিতোষকে দিয়ে বললেন বন্ধু, তুমি এইটে পর।
আর একখানা, সেখানা গেরুয়া রঙে ছোপানো লালপেড়ে শাড়ি, আমাকে দিয়ে বললেন, গোপাল তুমি এখানা পর, দিব্যি মানাবে।
স্নান সেরে হি-হি করতে করতে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি, মেঝেতে দুখানা কার্পেটের আসন পাতা, তার সামনে দুটি থালায় মিষ্টি সাজানো। আমরা জামা পরছি, এমন সময় সন্ন্যাসিনী ঘরের মধ্যে ঢুকে বললেন, গোপাল, বন্ধু, তোমরা একটু জল খেয়ে আরাম কর, ভাত হয়ে গেলেই ডাকব, বুঝলে?
এই বলে পরিতোষকে খানিকটা আদর করে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
খাওয়া শেষ-হওয়া-মাত্র রসিয়াকি মায়ি এসে থালা- দুখানা তুলে নিয়ে গেল। দরজাটা ভেজিয়ে আমরা বিছানায় লুটিয়ে পড়লুম।
বোধ হয় সাতদিন বাদে বিছানা পেয়ে তো পরিতোষ মহাখুশি। সে ছিল একাধারে শয়ন ও নিদ্রাবিলাসী। পায়ের কাছ থেকে লেপটা তুলে নিয়ে একটা প্রকাণ্ড পাশ-বালিশ জড়িয়ে পাশ ফিরে সে ঘুমের আয়োজন শুরু করে দিলে। আমার কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা বিশেষ ভালো লাগছিল না। মনে হচ্ছিল, সন্ন্যাসিনী যেন পরিতোষকেই বেশি খাতির-যত্ন করছে। তার ওপরে ‘গোপাল’ ভাকে আমার আত্মাভিমানে একটু আঘাতও যে না লাগছিল তা নয়। সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে একটা রহস্য বলে মনে হচ্ছিল, খালি মনে হতে লাগল, এর কিছু একটা মতলব আছে।
আমার বাবার নিকট-সম্পর্কীয়া এক জ্যাঠাইমা কাশীবাস করতেন। দু-চার বছর অন্তর তিনি কলকাতায় এসে দু-তিন মাস করে আমাদের বাড়িতে থেকে যেতেন। তিনিও এই সন্ন্যাসিনীর মতন গেরুয়া পরতেন। তবে তিনি ছিলেন বিধবা, তাই সাদা থান গেরুয়া রঙে ছুপিয়ে ব্যবহার করতেন। আমার কিরকম সন্দেহ হতে লাগল যে, বাবা আমার পলায়ন-সংবাদ ঠাকুমাকে পাঠিয়েছেন এবং সন্ন্যাসিনী ঠাকুমারই চর। আমাদের দেখেই ব্যাপার বুঝতে পেরে বাড়িতে এনে যত্ন করে খাইয়ে-দাইয়ে আটকে রাখবে, তারপর ঠাকুমা এসে গ্রেপ্তার করে আমাদের কলকাতায় চালান করে দেবে। এ-সম্বন্ধে পরিতোষের সঙ্গে যে একটু পরামর্শ করব তার উপায় নেই। কাশীতে পদার্পণ করা অবধি ছোটোখাটো কথা সে কানেই তুলছে না। ঠাকুরমার হাতে ধরা পড়বার যে উদ্বেগ আমাকে অস্থির করে তুলছিল, সে-কথা তাকে জানাতে গেলে এখন বাড়িসুদ্ধ লোক হয়তো শুনে ফেলবে। পাশের ঘরেই সন্ন্যাসিনী রান্না করছেন, তার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আর দেরি করা উচিত হবে না মনে করে পরিতোষকে ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে দিলুম। ধড়মড় করে উঠে সে বলল, কি রে?
ঠিক সেই সময়ে হেঁড়ে গলায় বাইরে কে হাঁক দিলে, গুরুমায়ি! হে গুরুমায়ি!
তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে দরজাটা একটু ফাঁক করে দেখলুম, একবালতি দুধ নিয়ে এসে গয়লা দাঁড়িয়ে আছে, লোকটা বোধহয় সাড়ে ছ’ফুট লম্বা হবে, তার ওপরে মাথায় একথান ময়লা কাপড়ের পাগড়ি
গুরুমা রান্নাঘর থেকে একটা কাঁসার বাটলোই-গোছের বাসন নিয়ে বেরিয়ে এসে তার সামনে ঠন করে রেখে বললেন, স্বরূপ, আজ থেকে দুসের দুধ চাই, আমার গোপাল এসেছে।
আচ্ছা মায়ি।–বলে সে আট পাত্র দুধ মেপে ঢেলে দিয়ে চলে গেল।
আমি তখনও দরজার ধারে দাঁড়িয়ে আছি, পাত্রটা নিয়ে গুরুমা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ঘুমোওনি গোপাল?
ঘাড় নেড়ে জানালুম, না।
বন্ধু ঘুমিয়েছে?
খাটের দিকে চেয়ে দেখি, ওরই মধ্যে পরিতোষ রাস্কেল আপাদমস্তক লেপমুড়ি দিয়ে আবার শুয়ে পড়েছে। বললুম, হ্যাঁ, ও ঘুমিয়েছে।
তাহলে চলে এস, গল্প করি।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখলুম, একটা ছোট্ট পেতলের হাঁড়িতে ভাত নামানো রয়েছে। একটা পেতলের কড়ায় ডাল ফুটছে। একখানা পাথরের থালার ওপরে কতকগুলো তরকারি কোটা রয়েছে। গুরুমা দুধটা রাখতে রাখতে বললেন, ডালটা নামলেই তরকারি চড়িয়ে দোব, এক্ষুনি হয়ে যাবে। বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে বুঝি?
বললুম, না, এই তো খেলুম।
আমার এই উত্তরের মধ্যে কি ছিল জানি না, গুরুমা খিলখিল করে হেসে উঠলেন। তাঁর কাছ থেকে এমন হাসি আশা করিনি।
গুরুমা রাঁধতে রাঁধতে প্রশ্ন করতে লাগলেন, নাম কি? বন্ধুর নাম কি? বাড়িতে কে আছে, কেন পালিয়েছ, কি করবার মতলব আছে, ইত্যাদি।
সব কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বার করে তিনি বললেন, তোমরা এইখানেই থেকে যাও। ব্যবসা করতে চাও তো? আমি তোমায় ভালো ব্যবসা করে দোব। বন্ধুকে বুঝিয়ে বলো, কোনো ভয় নেই তার। তোমার কিছু ভালো হলে তারও ভালো হবে। কিন্তু তোমরা তো এখনও ছেলেমানুষ, একটু বড় হও, তারপরে ব্যবসা কোরো।
ডাল নামিয়ে তরকারি চাপিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে কড়ার ওপরে একটা পেতলের সরা উপুড় করে বসিয়ে দিয়ে গুরুমা আমার সামনে এসে বসে আমার মুখের দিকে চেয়ে এমনভাবে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন যে, কি জানি, আমার লজ্জা করতে লাগল। গুরুমা আমার মুখখানা তাঁর দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, জান গোপাল, তুমি যে আসছ, তা আমি আগেই জানতে পেরেছিলুম।
আমার চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক্, মন ও বুদ্ধির অগোচরে যে আরও একটা রহস্যলোক আছে, সেখানকার ইঙ্গিত এই প্রথম এল আমার জীবনে। তারপরে সারাজীবন ধরে আভাসে ইঙ্গিতে সেখানকার কত বার্তাই আমার কাছে এসে পৌঁছল, কিন্তু সে-লোকে প্রবেশ করবার হদিশ আজও পেলুম না। জীবনের এই অভিজ্ঞতা প্রকাশ করবার জন্যেই এই জাতকের অবতারণা, এই অভিজ্ঞতার জন্যেই আমি মহাস্থবির।
গুরুমার কথা শুনে চমকে উঠলুম। বললুম সত্যি! কি করে জানতে পারলেন গুরুমা?
গুরুমা হাসি-হাসি মুখে বলে যেতে লাগলেন, আমি জানি, আমার গোপাল দুঃখ পেয়েছে। জানি যে, তার সখীকে অন্য লোক কেড়ে নিয়ে গিয়েছে।
আমি একেবারে স্তব্ধ, বাক্যহারা!
গুরুমা বলতে লাগলেন, আচ্ছা গোপাল, একবার উঁচু ছাত থেকে পড়ে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
আচ্ছা, একবার জলে ডুবে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
আচ্ছা, শিশু অবস্থায় একবার খাট থেকে পড়ে মাথার বাঁ দিকটা কেটে গিয়েছিল?
এ খবরটা আমার জানা ছিল না। বললুম, না।
গুরুমা ঘাড় নেড়ে ‘দেখি’ বলে আমার সেই চিরুনি-বসে-না এমন ঘন কোঁকড়া চুল ফাঁক করে করে দাগ খুঁজতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর বললেন, এই তো দাগ রয়েছে।
তারপর আয়না এনে মাথার বাঁ দিকে প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা একটা দাগ দেখিয়ে হেসে বললেন, এটা কি?
এই দাগের অস্তিত্ব আমার কাছে অজ্ঞাত ছিল। বাড়িতে কারুর কাছে শুনিনি, চুল আঁচড়াবার সময়ও কখনও চোখে পড়েনি।
বিস্ময়সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলুম, হঠাৎ গুরুমার দিকে চেয়ে দেখি যে, কড়ার ওপর থেকে উপুড়-করা সরাটা নামিয়ে হাতা দিয়ে তিনি তরকারিটা নাড়াচাড়া করেছেন, আর তাঁর চোখ-মুখ ঘিরে একটা দুষ্টু-হাসি জ্বলজ্বল করছে।
আশ্চর্য মানুষের মন! সে হাসি দেখেই আমার মনে কিরকম একটা সন্দেহ উঁকি মারতে আরম্ভ করে দিলে। মনে হতে লাগল, হয়তো বাবা আমার জীবনের সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন অথবা ঠাকুমার মুখে সব শুনে আমিই সেই লোক কি না প্রশ্ন করে করে গুরুমা ফাঁকি দিয়ে সব জেনে নিলেন। নিশ্চয়ই তাই, তা না হলে আমার জীবনের এত কথা তিনি জানবেন কি করে? বুকের মধ্যে হা-হা করে উঠল। চোখের সামনে দেখতে লাগলুম, আবার সেই কলকাতার বাড়ি, ইস্কুল, ইকোয়েশন আর কম্পাউন্ড প্র্যাকটিস-এর ছক ও অক্ষরগুলো চোখের সামনে যেন ভেংচে ভেংচে নাচতে আরম্ভ করে দিলে–সে জীবন কল্পনা করতে ভয় লাগে।
এদিকে এই ষড়যন্ত্র চলেছে আর পরিতোষটা কিনা ও-ঘরে নিশ্চিন্ত আরামে পাহাড়ের মতন গিদ্দে জাপটে লেপ-মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছে! আর নয়, মনে মনে ঠিক করে ফেললুম, এই মুহূর্তেই পরিতোষকে তুলে নিয়ে গুটিগুটি সরে পড়ব।
সঙ্কল্প স্থির করে আস্তে আস্তে উঠে দরজার দিকে অগ্রসর হচ্ছি, এমন সময় গুরুমা রান্না ফেলে একরকম ছুটে এসে আমার সামনে দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে বললেন, কোথায় যাচ্ছ?
ও-ঘরে!
ছি গোপাল, আমাকে অবিশ্বাস! ছি ছি ছি!
কথাগুলো আন্তরিকতায় ভরা হলেও আমার মনের সন্দেহ তখনও সম্পূর্ণ রূপে কাটেনি। গুরুমা আমার কাঁধে একটা হাত রেখে আর একটা হাত থুতনিতে দিয়ে মুখখানা উঁচু করে ধরলেন। ততক্ষণে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। চোখের ওপরে কিছুক্ষণ দৃষ্টি স্থির রেখে বললেন, গোপালের চোখে জল?
কথাটা শেষ হতে-না-হতে গুরুমা দুহাত বাড়িয়ে আমাকে কাছে টেনে এনে দুই বাহু দিয়ে জোর করে আমার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরলেন। সামান্য একটু অস্বস্তি বোধ করলেও সে-আলিঙ্গনের মধ্যে এমন একটা আশ্বাসময় ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন ছিল যে, আমার মনে হতে লাগল, এই সঙ্কটময় ভবার্ণবে একমাত্র আশ্রয়ের অঙ্কে আমি যেন শুয়ে আছি, মাথার মধ্যে ঝাঁ-ঝাঁ করে আওয়াজ হতে লাগল, ওদিকে উনুনের ওপরকার তরকারির সেই ঝাঁ-ঝাঁ–এই দুইয়ে মিলে সংবিৎহারা হয়ে প্রাণপণে সেই আধারকে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে কঠিন ধরণী ভেদ করে আমি যেন বোঁ বোঁ করে নীচে নেমে যেতে লাগলুম।
মিনিট দুই-তিন পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে আমিই প্রথম ছেড়ে দিলুম। গুরুমা আমার হাত ধরে নিয়ে এসে আবার সেই জায়গায় বসিয়ে দিলেন।
গুরুমা রাঁধতে লাগলেন। আমি বসে বসে কখনও মেঝের দিকে চেয়ে কখনও হাতের দিকে চেয়ে, সময় কাটাতে লাগলুম। মুখ তুলে তাঁর দিকে চাইতে, কি জানি, লজ্জা হচ্ছিল। তবুও মনে হতে লাগল, তিনি যেন আমার কতদিনের পরিচিত! খানিকটা মান-অভিমানের ঝগড়া তাঁর সঙ্গে হয়ে গেল। দোষ আমারই, শুধু বয়সে ছোট বলে কেঁদে জিতে গেলুম।
কিছুক্ষণ খুন্তি দিয়ে কড়ার তরকারি নাড়াচাড়া করে গুরুমা বললেন, আচ্ছা গোপাল, একটা কথা ঠিক বলবি?
এতক্ষণ তিনি আমাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করছিলেন, এই প্রথম ‘তুই’ বললেন।
বললুম, হ্যাঁ বলব।
আচ্ছা, এর আগে আমাকে কখনও দেখেছিলি?
আমার জীবনে বার বার উপলব্ধি করেছি, নারীজাতির মনোরঞ্জন করবার সহজাত শক্তি নিয়ে যে জন্মায়, যে-কোনো বয়সের যে-কোনো শ্রেণীর নারী দেখবামাত্র তাকে চিনতে পারে, অর্ধনারীদের কথা স্বতন্ত্র। এই দুর্লভ শক্তিও নারীজাতির সহজাত। গুরুমার এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে ভাবতে হল না। মুখ দিয়ে আপনিই বেরিয়ে গেল, হ্যাঁ দেখেছি। ওঃ কতবার তার আর ঠিকানা নেই!
আমার কথা শুনে গুরুমা ফিক করে হেসেই মুখখানা নীচু করে ডান হাতের কবজির উলটো-পিঠ দিয়ে মাথার চুল সরাতে লাগলেন, যেন হাসিটা আমার চোখে না পড়ে। একটু পরে মুখ তুলে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কি রকম? কোথায় দেখেছিস? রবীন্দ্রনাথের কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ বার পঞ্চাশেক পড়া ছিল। এত শিগগিরই যে সেটা কাজে লাগবে, তার কোনো ধারণাই আমার ছিল না। তাঁর অলৌকিক কাব্যরসকে কতবার যে আমি লৌকিক কার্যোদ্ধারের জন্যে প্রয়োগ করে সাফল্য লাভ করেছি, সে-কথা তাঁকে কখনও জানাইনি, তার কারণ আমি মহাস্থবিরত্ব লাভ করার সঙ্গে-সঙ্গেই তিনি মহাপ্রয়াণ করেছেন।
আমি শুরু করে দিলুম, জানেন গুরুমা, কাশীতে আসবার বোধ হয় বছরখানেক আগে থেকেই প্রায় প্রতি রাত্রেই স্বপ্নে একজন আমাকে দেখা দিত। আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকত আর বলত, গোপাল, তুই আমার কাছে চলে আয়।
গুরুমা দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। কিন্তু তখন আমার কল্পনার গ্রামোফোন খুলে গিয়েছে।
আমি বলে চললুম, কিন্তু তার মুখে থাকত ঘোমটা, মুখখানা দেখতে পেতুম না। আমি রোজই বলতুম, কে তুমি রহস্যময়ী, একবার অবগুণ্ঠন খোল, দেখি তোমায়। তখুনি সে মূর্তি মিলিয়ে যেত, সঙ্গে সঙ্গে আমারও ঘুম ভেঙে যেত।
এমনি রোজই চলছিল। একদিন সে এসে যেমন আমাকে হাতছানি দেওয়া, আর কোনো কথা না বলে টপ করে তার অবগুণ্ঠন খুলেই দেখি, সে আপনি।
অ্যাঁ!–বলে গুরুমা একেবারে চমকে উঠলেন। তারপরে অত্যন্ত শান্তস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, তার পর?
তারপর আর আপনার দেখা পেলুম না। তবে আমি জানতুম, কাশীতে আপনার দেখা পাবই। তাই এত জায়গা থাকতে তো কাশীতে এসেছি।
সত্যি বলছিস?
সত্যি।
বন্ধু জানে এ-কথা?
না।
তা হলে ওকে আর কিছু বলিসনি।
এই কথা বলেই গুরুমা উঠে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আমার কাছে ফিরে এলেন। আমি দাঁড়িয়ে ছিলুম, তিনি আমার দুই কাঁধে হাত দিয়ে ঠেলে নিয়ে গিয়ে তাঁর খাটে বসিয়ে দিয়ে বললেন, দেখ্ গোপাল, এ ঘরে যতক্ষণ থাকবি, ততক্ষণ আমাকে ‘আপনি’ না বলে ‘তুমি’ বলবি, বুঝলি?
আচ্ছা, গুরুমা।
এ ঘরে যতক্ষণ থাকবি, ততক্ষণ আমাকে ‘গুরুমা’ বলিসনি।
কি বলব?
একটু চোখ বুজে কি ভেবে তিনি বললেন, আমাকে ‘রাজকুমারী’ বলে ডাকবি, বুঝলি?
তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ থেকে তখনও পর্যন্ত বোধ হয় চার ঘণ্টা কাটেনি।
যাক, বেলা প্রায় দুটোর সময় আমাদের খাওয়া-দাওয়া তো সমাধা হল। অতি সুন্দর সুগন্ধ আলোচালের ভাত, তার ওপরে যতখানি ইচ্ছে গব্যঘৃত। চমৎকার মুগের ডাল, তাতে বড় বড় বাঁধাকপির পাতা। আলু ও উচ্ছে ভাতে একসঙ্গে মাথা। ফুলকপি ও আলুর একটা শুকনো-শুকনো, ভাজাও নয় চচ্চড়িও নয় গোছের তরকারি।
কদিন থেকে দু’বেলা পুরি-কচুরি খেয়ে খেয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল। গুরুমার ওখানে খেয়ে যে কি তৃপ্তি পেলুম, তা কি বলব!
গুরুমা বললেন, ভালো লাগল না, বুঝতে পারছি। নিরামিষ খাওয়ার অভ্যেস তো নেই।
বললুম, না আমাদের নিরামিষ খাওয়ারই অভ্যেস, মাছ-মাংস কালে-ভদ্রে খাই।
আমার হেঁসেলে তো মাছ-মাংস হয় না, জন্মে কখনও খাইনি তাই হয় না, রাঁধতেও জানি না। যেদিন মাছ-মাংস খাওয়ার ইচ্ছে হবে বলো, ভাড়াটেদের ঘরে তৈরি করিয়ে নোব।
এই আশ্বাসবাণী শুনে পরিতোষের মুখ খুশিতে একেবারে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বললে, আপনাকে কি বলে যে হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা জানাব, তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
গুরুমা একটু হেসে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন, আর খুশিতে সে একেবারে গলে পড়তে লাগল।
একটু পরে গুরুমা বললেন, আচ্ছা, এবার তোমরা আরাম কর, আমি খেয়ে নিই।
হ্যাঁ, নিশ্চয়। আমাদের জন্যে আপনারও দেরি হয়ে গেল।
একটু হেসে দরজার দিকে অগ্রসর হতে হতে গুরুমা আমায় বললেন, গোপাল, ঘুমিও না। আমার খাওয়া হলে ডাকব, গল্প করতে হবে।
গুরুমা আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এসে পরিতোষকে এই তিন ঘণ্টার অভিজ্ঞতার কথা ফিসফিস করে বলতে লাগলুম। সে কিছু শুনতে পেলে, কিছু না-শুনেই ইশারায় আন্দাজে বুঝে নিল। তার পরে পায়ের কাছ থেকে লেপটা তুলে নিয়ে গায়ে দিতে দিতে আমায় ফিসফিস করে বললে, ও-বেলা সব শোনা যাবে।
মিনিট-পাঁচেকের মধ্যেই পরিতোষ গভীর নিদ্রায় অভিভূত হয়ে পড়ল। অনেকদিন পরে অমন সুখাদ্য আর অমন নরম বিছানা ও লেপ পেয়ে ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসতে লাগল। জোর করে জেগে পড়ে রইলুম। ও-ঘরে গুরুমা খাচ্ছেন; রসিয়াকি মায়ি বাসন মাজছে, জল তুলছে; ওপর থেকে সিঁড়ি বেয়ে খটখট করে ভাড়াটেরা উঠছে নামছে; সবই শুনতে পাচ্ছিলুম। তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়লুম, জানতেও পারিনি।
একবার একটা ঠান্ডা হাত মুখের ওপর পড়তেই ঘুমটা ছুটে গেল। দেখি, গুরুমা আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে হাসছেন, পাশেই পরিতোষ আপাদমস্তক লেপ-মুড়ি দিয়ে শুয়ে।
গুরুমা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। আমাদের ঘর আর তাঁর ঘর ছিল পাশাপাশি–দুই ঘরে আসা-যাওয়ার জন্যে মাঝের দেওয়ালে একটা দরজা ছিল বটে, কিন্তু এসে অবধি সেটাকে বন্ধই দেখেছি, এতক্ষণ দরজা দিয়েই উভয়পক্ষের যাওয়া-আসা চলছিল। খাট থেকে নেমে তিনি এই মাঝের দরজাটা খুলে এ-ঘরে এসেছেন। আমি খাট থেকে নামতেই গুরুমা আমাকে একরকম টেনে নিয়ে গেলেন তাঁর ঘরে সেই দরজা দিয়ে। তার পরে দরজাটায় খিল লাগিয়ে দিয়ে ক্রোধের ভান করে আমার দিকে কটমট করে চেয়ে বললেন, ঘুমুতে বারণ করেছিলুম না দুষ্টু ছেলে!
আমার চোখ থেকে তখনও ঘুম ছোটেনি। দিবানিদ্রাটি পুরো না হওয়ার দরুণ আলস্য ও অবসাদে দেহ-মন ভরে রয়েছে, চোখ দুটো এমনিতেই বুজে আসছিল, কিন্তু গুরুমার চোখে চোখ পড়তেই সে-দৃষ্টির সঙ্গে যেন আমার দৃষ্টি বাঁধা পড়ে গেল। সে এক অদ্ভুত চাহনি! চোখদুটো উজ্জ্বল, স্থির, পলকবিহীন অথচ তার মধ্যে কাঠিন্য কিছুই নেই, সমস্ত মুখখানা ঘিরে একটা রহস্যময় হাসি ঢলঢল করছে। ঠিক এরই একটু সামান্য নমুনা তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকালে পেয়েছিলুম। আমি বেশ বুঝতে পারলুম, আমি যেন সম্মোহিত হয়ে পড়ছি।
ছেলেবেলায় একবার অজ্ঞান করে আমার পায়ের তলা থেকে ট্যাংরামাছের কাঁটা বের করা হয়েছিল। ক্লোরোফরমের মাঝের অবস্থার মতন বেশ একটা সুখদায়ক নেশায় মাথাটা রিমঝিম করতে আরম্ভ করে দিলে। আমি অনুভব করতে লাগলুম, রাজকুমারীর নাক দিয়ে ভকভক করে একটা সুগন্ধ গরম হাওয়া আমার মুখের ওপরে এসে পড়ছে। কিছুক্ষণ–কতক্ষণ, সে সময়ের হিসাব দিতে পারব না, তার পরে আর কিছু মনে নেই।
ঘুমের মধ্যে মনে হতে লাগল, কে যেন আমার ডান হাতখানা ধরে মোচড় দিচ্ছে। যন্ত্রণা বাড়তে বাড়তে ঘুমটা ছুটে গেল। মনে হতে লাগল, দেহের ওপর যেন দশ মণের একটা তুলোর বস্তা চাপানো। চোখ চেয়ে দেখি, ঘরটা আধা-অন্ধকার, দূরে জানলার একটা পাল্লা খোলা রয়েছে, রাজকুমারীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে আদুড় গায়ে ঘর্মাক্ত কলেবরে আমি পড়ে রয়েছি, আমার ডান হাতখানা তার গলার নীচে, আর তার একটা হাত আমার গলার ওপরে আড়াআড়িভাবে পড়ে রয়েছে। অনেক কায়দা-কসরৎ করে তার গলার তলা থেকে হাতখানা বের করে নিতেই তার ঘুম ভেঙে গেল।
তাড়াতাড়ি পায়ের তলা থেকে লেপটা টেনে নিয়ে উভয়কে চাপা দিয়ে তন্দ্রাজড়িত কণ্ঠে রাজকুমারী বললে, গোপাল, ঘুম ভাঙল?
আমি বললুম, হ্যাঁ সন্ধে হয়ে গিয়েছে।
রাজকুমারী উঠে পড়ল। আমিও উঠে নিজের ঘরের মধ্যে গিয়ে দেখি, পরিতোষ তখনও এপাশ-ওপাশ করছে।
দরজাটি ‘ভেজিয়ে দিয়ে পরিতোষের সঙ্গে আমার অভিনব অভিজ্ঞতার কথা আলোচনা করছি, এমন সময় ‘গোপাল’ বলে রাজকুমারী ঘরে এসে ঢুকল। তাকে দেখেই মনে হল, সে স্নানে চলেছে। বগলে একটা পুঁটুলি ও হাতে সেই কমণ্ডলু। বললে, চল গোপাল, স্নান করে আসি।
প্রস্তাবটা শুনে তো আমার পায়ের নখ থেকে আরম্ভ করে মাথার চুল অবধি শিউরে উঠল। কি সর্বনাশ! এখন স্নান! মনে মনে জপ শুরু করে দিলুম, জয় জয় বিশ্বনাথ! দেখো বাবা, শেষ অবধি রক্ষে করো।
আমতা-আমতা করে বললুম, নাঃ, সন্ধের সময় স্নান করা আমার অভ্যেস নেই, অসুখ হয়ে যাবে।
গুরুমা সে-কথা একেবারে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, না না, কিছু হবে না, গঙ্গা নাইলে কখনো অসুখ করে! নাও নাও উঠে পড়।
পরিতোষ বললে, বেশ তো, চ’ না, গঙ্গা নেয়ে আসা যাক।
গুরুমা বললেন, না বন্ধু, তুমি বাড়ি থাক। চল গোপাল, ছেলেমানুষি করে না, ওঠ।
পরিতোষ গুরুমার সঙ্গে আমড়াগাছি জুড়ে দিলে, যা না, যা না, কি হয়েছে? গুরুমা যখন বলছেন, তখন কিছু হবে না।
হায় রে আমার বরাত! মাঘ মাসের প্রথম সপ্তাহে সন্ধ্যাবেলায় গঙ্গাস্নান! হোক না সে কাশীধামের গঙ্গা! বিশ্বনাথ, এবার তোমার ওপরেই যে ভক্তি ছুটে যায় বাবা!
চোখে জল এসে গিয়েছিল। গুরুমা চোখে জল দেখে এগিয়ে এসে আমাকে আদর করে বলতে আরম্ভ করলেন, গোপাল আমার সত্যিকারের গোপাল। শীতকালের চানের নাম শুনে চোখে জল এসে গিয়েছে! কিছু ভয় নেই, আমি তোমার গায়ে হাত বুলিয়ে দোব, কিছু শীত লাগবে না। এই দেখ, তোমার কাপড় নিয়েছি।
দেখলাম, গুরুমার বগলদাবায় আমার ধুতিখানাও পাট করা রয়েছে, যেখানা সকালে স্নান করে ছেড়ে দিয়েছিলুম।
গুরুমা আমাকে এমন আদর করতে লাগলেন যে, আমার লজ্জা করতে লাগল।
শেষকালে উঠতেই হল। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। দুপুরে ঘেমেছি, সন্ধ্যায় গঙ্গাস্নান করে ঠান্ডা হতে হবে, উপায় নেই। র্যাপারখানা গায়ে দিয়ে তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লুম।
বাড়ির খুব কাছেই গঙ্গা। দু-চারটে গলি পার হয়ে এসেই একটা বড় অজানা ঘাটে এসে উপস্থিত হলুম। ঘাটে নরনারীর অন্ত নেই, কিন্তু আশ্চর্য রকমের নিস্তব্ধ। অনেকে ঘাটের চাতালে বসে আছে, কেউ নিঃশব্দে মালা জপছে। দু-একজন স্ত্রীলোক আমাকে দেখিয়ে গুরুমাকে জিজ্ঞাসা করলে, ছেলেটি কে?
গুরুমা জবাব দিলেন, এ একটি ছেলে, আমার আপনার লোক।
যাই হোক, বলিদানের পাঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে ঘাটের দীর্ঘ সোপানাবলী অতিক্রম. করে তো উত্তরবাহিনীর সম্মুখীন হওয়া গেল। অন্ধকার বেশ ঘোর হয়ে আসা সত্ত্বেও পুণ্যকামী ও কামিনীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। গুরুমা ‘এস গোপাল’ বলে জলে নেমে পড়লেন। আমি মরিয়া হয়ে জামা ও র্যাপারখানা সিঁড়িতে ছেড়ে তাঁর পিছু পিছু জলে নেমে উপরি উপরি তিন-চারটে ডুব মেরে কাঁপতে কাঁপতে ঘাটে গিয়ে উঠলুম। সিঁড়িতে গুরুমার গামছা ছিল, তাই দিয়ে বেশ করে মাথা গা হাত পা মুছে কাপড় ছেড়ে জামা গায়ে দিয়ে র্যাপার জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। সে-সময় স্নান-করাটাকে যতখানি সাংঘাতিক মনে করেছিলুম, দেখলুম, ব্যাপারটা ততখানি সাংঘাতিক নয়। বরঞ্চ বেশ ভালোই লাগতে লাগল। গুরুমা ধীরে-সুস্থে স্নান সেরে আমার হাত থেকে গামছা নিয়ে জলে দাঁড়িয়েই মাথা মুছলেন, তার পরে ঘাটে উঠে আমার ছাড়া কাপড়খানা কেচে নিংড়ে আমার হাতে দিলেন, তার পরে শাড়ি ছেড়ে নতুন শাড়ি পরে শাড়িখানা কেচে আমার হাতে দিয়ে এক কমণ্ডলু জল ভরে নামাবলিখানা গায়ে দিয়ে আমাকে বললেন, চল।
চলতে চলতে এক জায়গায় এসে বললেন, গোপাল, তুই বাড়ি যা, আমার কয়েক জায়গায় জল দিতে হবে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমি আসছি।
বাড়িতে ফিরে দেখি, পরিতোষ রসিয়ার মায়ের সঙ্গে সশব্দে গল্প জুড়ে দিয়েছে, উভয়ের উচ্চহাস্যে বাড়ি একেবারে জমজমাট।
শুনলুম বাজার থেকে তিন পয়সার ভাং আনিয়ে দু’জনে খেয়েছে, বেশ ফুর্তিতেই তাদের সন্ধ্যাটি কাটছে।
আমি আসবার কিছুক্ষণ পরে রসিয়ার মা উঠে গিয়ে কাপড়গুলো শুকোতে দিলে। তারপরে উনুনে আগুন দিয়ে ময়দা মাখতে বসে গেল।
পরিতোষের সঙ্গে বসে বসে আকাশে প্রাসাদ তৈরি করছি, এমন সময় গুরুমা বাড়ি ফিরলেন। আমরা ঘরে বসে শুনলুম, তিনি রসিয়ার মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার গোপাল ফিরেছে? রসিয়ার মা কি বিড়বিড় করে বললে, শুনতে পেলুম না। তার পরে ও-ঘরে রান্নার আওয়াজ হতে লাগল।
ঘণ্টা-দুয়েক পরে খাবার ডাক পড়ল। গুরুমার ঘরে গিয়ে দেখলুম, একখানা আসনে তিনি বসেছেন আর দু-খানা আসন খালি। আমরা ঢুকতেই তিনি বললেন, বন্ধু বসে পড়, আর রাত করে কি হবে? গোপাল, তুমি এখানে বস। এই বলে তাঁর পাশের আসনটি আমাকে দেখিয়ে দিলেন।
খাওয়া শেষ হতে সাড়ে ন’টা বেজে গেল। রাজকুমারীর ঘরে একটা বড় ঘড়ি ছিল, সেটা আধ ঘণ্টা অন্তর বলেই চলতে লাগল, চলেছে দিন, চলেছে রাত।
মুখ-টুখ ধুয়ে নিজের ঘরে এসে ঘুম লাগাবার ব্যবস্থা করছি, এমন সময় মাঝের দরজা খুলে নিজের ঘর থেকেই রাজকুমারী ডাক দিলে, গোপাল! ·
যাই।–বলে তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে তার ঘরে ঢুকতেই মাঝের দরজায় সে হুড়কো দিয়ে দিলে।
দেখলুম, রসিয়ার মা এঁটো বাসন তুলে ঘর নিকিয়ে দিয়ে গিয়েছে। নিবন্ত উনুনে একটা বড় ডেক্চি চড়ানো, তাতে জল সোঁ-সোঁ করছে। আমাকে খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসতে বলে সে উনুন থেকে গরম জল নামিয়ে ঘরের কোণ থেকে একটা আধ-ভরা বালতি এনে ঠান্ডা জলে গরম জল মিশিয়ে আমার পা ধুতে আরম্ভ করে দিলে। আমি হাঁ-হাঁ করে আপত্তি করতেই আমার পায়ে ছোট্ট একটি চাপড় মেরে বললে, চুপ কর।
পা মুছিয়ে দেওয়ার পর বললে, এবার পা তুলে বিছানায় উঠে ভালো করে বস্। আমি বিছানায় উঠে বসতেই রাজকুমারী দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে নিজে পা ধুতে বসল। প্রায় সাড়ে দশটা অবধি বেশ করে হাঁটু অবধি ধুয়ে পা মুছে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল, আমি পায়ের কাছে বসে রইলুম।
রাজকুমারী গল্প করতে লাগল, গোপাল, খেয়ে পেট ভরেছে তো? রাত্রিবেলা বাড়িতে কি খেতে? কে রান্না করত? এখানে কেমন লাগছে? বন্ধুর কেমন লাগছে? বন্ধুর কথা শুনে আমায় ফেলে পালিও না যেন। এমন সময় রসিয়াকি মায়ি কি বলতে বলতে দরজাটা ফাঁক করতেই রাজকুমারী হাঁ-হাঁ করে চিৎকার করতে করতে বিছানায় উঠে বসে তাকে বললে, যা যা, ঘরে ঢুকিস নে যেন, ঘরে গোপাল রয়েছে, জানিস না?
রসিয়ার মা তাড়াতাড়ি দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়েই বললে, গা টেপাবে না? রাজকুমারী ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, না না, তুই খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়গে যা।
এই কথাগুলো বলেই সে দুই হাতে মাথা মুখ ঢেকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। রসিয়ার মায়ি কি বলে চলে গেল, রাজকুমারী কোনো জবাবই দিলে না।
কিন্তু একটু পরেই ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি এগারোটা বাজল; কিন্তু মনে হতে লাগল, যেন রাত্রি দুটো বাজল। চারিদিক থমথম করছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু ঘরের ঘড়িটা একটানা টকটক আওয়াজ করে চলেছে। ঘরের এক কোণে পিলসুজের ওপর রেড়ির তেলের প্রদীপ মেঝের খানিকটা আলোকিত করেছে, কিন্তু খাটের ওপর আলো-আঁধারে মেশা স্নিগ্ধ বিভা। বই পড়া যায় না বটে, কিন্তু সব কিছুই দেখা যায়। চারিদিকের সমস্ত বস্তুই ধীর স্থির, মধ্যে মধ্যে দীপশিখাটাও নিষ্কম্প হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, শুধু আমার মগজের মধ্যে একটার পর একটা চিন্তার কম্পন ঢেউ খেলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, কাল রাত্রে ভবিষ্যতের চিন্তায় দুই বন্ধুতে আকুল হয়ে উঠেছিলুম। কোথায় থাকব, কোথায় শোব, কোথায় খাব–এই ভাবনায় সারারাত্রি ঘুমুতে পারি নি; কিন্তু আমাদের অগোচরে বিশ্বনাথ কি মনোরম ব্যবস্থাই করে রেখেছিলেন। ভাবতে ভাবতে মন দিশাহারা হয়ে যেতে লাগল। কে এ রাজকুমারী! এর কোনো পরিচয়ই আমার জানা নেই, অথচ আমার সমস্তই সে জানে। আজ সকাল পর্যন্ত যার অস্তিত্ব আমার কাছে অজ্ঞাত ছিল, এই মুহূর্তে সে-ই আমার পরম বন্ধু। এর চেয়ে বড় বিস্ময় আমার জীবনে ইতিপূর্বে আর আসেনি।
চোখ বুজে বিশ্বনাথকে অজস্র ধন্যবাদ জানাতে লাগলুম। কৃতজ্ঞতায় মাথা একেবারে নুয়ে পড়ল নীচের দিকে। চোখ চেয়েই দেখি, রাজকুমারীর ধবধবে সুডৌল পা-দুখানি নিস্পন্দ হয়ে পড়ে আছে সামনে।
বিশ্বনাথের চরণতল থেকে একেবারে রাজকুমারীর পদতলে উন্নীত হয়েই মনটা এক অভিনব আনন্দরসে আপ্লুত হয়ে গেল। পা–যাকে মানবদেহের একটা অতি তুচ্ছ অঙ্গ বলে এতদিন মনে করেছি, তারই আকর্ষণে আমি যেন অভিভূত হয়ে পড়তে লাগলুম। পদসেবা করবার একটা দারুণ বাসনার সঙ্গে আমার মজ্জাগত ভদ্রতা ও সামাজিকতার লড়াই শুরু হয়ে গেল বুকের মধ্যে। শেষকালে আমার সমস্ত মনোবৃত্তিকে হারিয়ে দিয়ে পদসেবাই জয়যুক্ত হল। কাঁপতে কাঁপতে একখানা হাত তার পায়ের ওপরে রাখলুম।
রাজকুমারী যেন এতক্ষণ এরই প্রতীক্ষা করছিল। পায়ে হাত পড়া মাত্র শতদলের মতন পা-দুখানি আমার কোলের ওপর তুলে দিয়ে মৃদু পদসংজ্ঞায় ইঙ্গিত করলেন, নির্ভয়ে চরণসেবায় মন দিতে পার।
রাত্রি প্রায় বারোটার সময় ছুটি পেয়ে নিজেদের ঘরে এসে শুয়ে পড়লুম। রাজকুমারী মাঝের দরজাটা বন্ধ করে দিলে।
অকস্মাৎ এই আশাতীত ভাগ্য-পরিবর্তনে আমরা অভিভূত হয়ে পড়েছিলুম বটে, কিন্তু দিন-দুয়েকের মধ্যেই আমাদের এই অদ্ভুত জীবনযাত্রা সরল ও স্বাভাবিক হয়ে উঠল। তার কারণ রাজকুমারীর ব্যবহারের মধ্যে এমন একটা অমায়িকতা, আপনার করে নেবার এমন একটা মিষ্টি কৌশল ছিল যে, দিন দুই যেতে-না-যেতেই মনে হতে লাগল যে, এ আমাদের অতি আপনার জন। এতদিন যেন বিদেশে কোথায় পড়েছিলুম, এবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছি। বর্তমানকে এমন মধুময় ও ভবিষ্যৎকে সে এমন রঙিন করে তুলত যে, আর কি বলব! শুধু তাই নয়, সংসারের সমস্ত কাজে, এমনকি দেনা-পাওনার কাজে পর্যন্ত সে আমাদের এমন কর্তৃত্ব দিত যে, মধ্যে মধ্যে আত্মহারা হয়ে মনে হত, সে-ই বুঝি আমাদের আশ্রিতা।
একদিন রাজকুমারী পরিতোষকে বললে, বন্ধু, তোমার তেতলার ভাড়াটে যে আজ তিন মাস ভাড়া দিচ্ছে না, আসছে মাসে যে টেক্স দিতে হবে, কোথা থেকে দেবে শুনি?
তেতলার যে ভাড়াটেকে রাজকুমারী তগাদা দিতে বললে, এখানে এসে অবধি তাকে দেখছি। বিধবা সে, ঘাড় অবধি কোঁকড়া-কোঁকড়া চুল, রঙ উজ্জ্বল শ্যাম, দীর্ঘ দেহ, মুখে সর্বদা প্ৰসন্নতা বিরাজ করছে। একটি সাত-আট বছরের মেয়ে আছে তার। অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে কাশীবাস করতে এসেছে, এখন বয়স তার ত্রিশ হবে। বাড়ির অবস্থা খারাপ নয়। সেখানে বড় বড় ভাশুরপোরা আছে, তাদের বিবিধ অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে কাশীতে এসে বিশ্বনাথের চরণে আত্মসমর্পণ করেছে। ভাশুরপোদের মধ্যে যে সবচেয়ে ছোট, সে প্রায় তারই সমবয়সি; সে-ই মাসে মাসে নিয়মিত টাকা পাঠায়। মাঝে মাঝে দু-তিন-চার মাস কিছুই আসে না, তারপরে একেবারে তিন-চার-শো টাকা এসে উপস্থিত হয়। অবস্থা তার ভালোই, তবুও মাঝে মাঝে ভাড়া ফেলে রাখে, নইলে লোকটি বড় ভালো। তার নাম হচ্ছে জয়া। ভাড়াটে হলেও রাজকুমারীর সঙ্গে তার বড় ভাব, ঠাট্টাঠুট্টিও চলে; রাজকুমারী তাকে ‘জয়ি’ বলে ডাকে। পরিতোষ বললে, চ তো স্থবরে, আমার সঙ্গে তেতলায়, কেমন ভাড়া দিচ্ছে না একবার দেখি!
রাজকুমারী বাধা দিয়ে বললে, না না, গোপালকে নিয়ে যেও না, তুমিই যাও।
পরিতোষ তিন লাফে তেতলায় চলে গেল।
ঘণ্টাখানেক বাদে নীচে নেমে এসে বললে, ও-বেলা সব ভাড়া ঢুকিয়ে দেবে বলেছে।
সেদিন দুপুরবেলাতেই আবার পরিতোষ তাগাদায় উপরে উঠল, সন্ধেবেলা আমার স্নান করতে যাবার কিছু আগে সে নেমে এল।
স্নান করে ফিরে এসে রসিয়ার মার মুখে শুনলুম, ভাং-টাং টেনে সে আবার তাগাদায় গিয়েছে।
রাত্রিবেলা রাজকুমারী বাড়ি ফেরবার পর সে নেমে এসে বললে, আজ আর ভাড়া দিতে পারলে না। কোনো ভয় নেই; ও ঠিক দিয়ে, দেবে, বেশ ভালো লোক।
আমি একটু ঠাট্টা করতেই রাজকুমারী বললে, না না বন্ধু, গোপালের কথা শুনো না। দিনরাত লেগে থাকো, মাগি ভারি বজ্জাত, ওর মুখের মিষ্টি কথায় ভুলো না, পয়সার আণ্ডিল মাগি, কিন্তু কিছুতেই বের করতে চায় না।
রাজকুমারীর নির্দেশ পরিতোষ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করতে আরম্ভ করলে। অর্থাৎ দিনরাত্রি জয়া-গিন্নিকে তাগাদা দিতে লাগল। অচিরেই বিশ্বনাথ তার এই বিপুল অধ্যবসায়ের ফল হাতে হাতে দিয়ে দিলেন; কারণ দিন-তিনেক বাদেই একদিন রাত-দুপুরে ঘরে শুতে এসে দেখি, পরিতোষ বিছানায় নেই। বাইরে গিয়েছে মনে করে তার অপেক্ষা করতে লাগলুম, কিন্তু রাত্রি দেড়টার পরও সে ফিরল না দেখে বুঝে নিলুম, তাগাদার ফল ফলেছে।
দিনগুলি বেড়ে কাটতে লাগল। সত্যি কথা বলতে কি, এমন নিরঙ্কুশ শান্তিময় দিন আমার জীবনে আর আসেনি। ইস্কুলের তাড়া নেই, বাবার ভয় নেই, পরীক্ষার বিভীষিকা নেই, অথচ ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। শুধু দুটো বছর কোনো রকমে কাটাতে পারলে হয়। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মুখ-টুখ ধুয়ে রাজকুমারীর সঙ্গে দু’জনে মিলে দশাশ্বমেধ ঘাটে যাই। পরিতোষ ও রাজকুমারী স্নান করে, আমি স্নান করি না, কারণ সন্ধ্যাস্নান আমার বাধ্যতামূলক। রাজকুমারী তার ভিজে শাড়ি ও গামছা আমাদের হাতে দিয়ে চলে যায় মন্দিরে। আমরা দশাশ্বমেধ ঘাটের বাজার থেকে তরি-তরকারি ও যেদিন যা প্রয়োজন, তা কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে রসিয়ার মা’র হাতে সেগুলো জিম্মে করে দিয়ে রাত্রের বাসি লুচি, তরকারি ও ক্ষীর দিয়ে জলযোগ করি। জলযোগান্তে পরিতোষ ওপরে চলে যায় ভাড়ার তাগাদায়, কারণ ভাড়া তখনও আদায় হয়নি। আমি শুয়ে-শুয়ে বিছানা মাপতে থাকি। রাজকুমারী ফিরে এলে গল্প করে তার রান্নায় সাহায্য করি। খাবার একটু আগেই পরিতোষ নেমে আসে। আহারান্তে পান-টান না খেয়েই আবার সে চলে যায় তাগাদা করতে, আর আমি কোনোদিন সম্মোহিত আর কোনোদিন-বা মোহিত হয়ে রাজকুমারীর কুসুমপেলব আলিঙ্গনের মধ্যে আত্মহারা হয়ে ভাসতে ভাসতে চলে যাই ভাব-যমুনার তরঙ্গ বেয়ে।
সন্ধের সময় রাজকুমারীর সঙ্গে গঙ্গাস্নান করে একলা বাড়ি চলে আসি, রাজকুমারী চলে যায় শিবের মাথায় জল ঢালতে। ফিরে এসে দেখি, পরিতোষ আর রসিয়ার মায়ি ভাঁড়ে করে ভাঙের শরবত খাচ্ছে, ইশারা-ইঙ্গিতে বুঝতে পারি জয়া-গিন্নির কাছেও একটি বড় ভাঁড় পৌঁছে গেছে। ভাং খেয়েই সে তাগাদায় চলে যায় তেতলায়, রাজকুমারী বাড়ি ফেরবার আগেই নেমে আসে। রাত্রে আহারাদির পর পরিতোষ চলে যায় জয়া-গিন্নির কাছে, বলে, তার মেয়েকে এ-বি-সি-ডি শিখিয়ে সেখানেই শুয়ে পড়ি।
আর আমি? আমি রাত্রি বারোটা অবধি রাজকুমারীর অঙ্গসংবাহন করি। প্রতি রাত্রেই নতুন অভিজ্ঞতা! কোনো রাত্রে মনে হয়, দু’হাতে চামেলীফুল দলন করছি; আবার কোনো রাত্রে মনে হয়, যেন কেতকীকুসুম চয়ন করছি। কোনোদিন সে কাঁদতে থাকে,–কি আকুলতা সে ক্রন্দনে, অতি করুণ সে কান্না! কোনোদিন-বা দমকা চাপা হাসির আওয়াজে চমকে উঠি। কোনোদিন সে ভাঙা গলায় ‘গোপাল’ নাম জপ করতে থাকে। কখনও-বা ঘামতে ঘামতে দেহ পাথরের মতো ঠান্ডা ও নিস্পন্দ হয়ে যায়, ভয় হতে থাকে; মনে হয়, দেহে বুঝি প্রাণ নেই। ধাক্কা দিয়ে দিয়ে সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনি। বিচিত্র সে অভিজ্ঞতা!
মানুষ মাত্রেই, সে নারী হোক বা পুরুষই হোক, ভালোবাসার শক্তি তার সহজাত; কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশ করবার শক্তি, সে দেবদুর্লভ। ঠিক রসিক ও কবিতে যে পার্থক্য।
সে এক অভিনব শক্তি, যার আকর্ষণের আবর্তে পড়লে প্রতি প্রভাত, দ্বিপ্রহর, সন্ধ্যা, রাত্রি, জীবনের প্রতি মুহূর্ত মনে হতে থাকবে, এত সুখ, এত আনন্দ এর আগে আর কখনও পাইনি। আকাশ ও ধরণীতল, পশু-পক্ষী বৃক্ষ লতা কীট ও নরনারী, চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা–প্রকৃতির যেখানে যা কিছু আছে, তারা যে কত সুন্দর, তারা যে কত আপনার, সকলের সঙ্গে একত্ববোধে যে কি আনন্দ, কোনো ভাষাতেই সে অনুভূতির বর্ণনা করা যায় না।
সে এক অদ্ভুত শক্তি, যার স্পর্শে মন থেকে বয়সের তারতম্য ঘুচে যায়, সুন্দর-কুৎসিতের ভেদাভেদ মুছে যায়। আঁখি মেলে যখনই তাকে দেখি, মনে হয় এই ভগবানের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। যতক্ষণ সে কাছে থাকে, ততক্ষণ মনে হয়, আমি যেন তার মধ্যে ওতপ্রোত হয়ে আছি; যতক্ষণ সে কাছে থাকে না, ততক্ষণ তারই চিন্তায় নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে আত্মহারা হই; আবার তারই আলিঙ্গনে বদ্ধ হয়ে নিজের অস্তিত্ববোধ ফিরে আসে–সন্তানের আবির্ভাবে নারীর অন্তরে যেমন জননীত্বের বোধ জাগে।
সে যেন নিত্যই নতুন, প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তনশীলা। কখনও মমতাময়ী কখনও কঠিনা, কখনও মোহিনী-কখনও জননী, কখনও রূপসী কখনও প্রেয়সী, কখনও দাসী কখনও মহীয়সী — নিত্য নতুন, প্রতি মুহূর্তেই নতুন। মাধুর্যের বিশাল মহাসাগারের তরঙ্গাঘাতে মুহূর্তে মুহূর্তে নব নব ফেনপুঞ্জ উঠছে, আবার সেই সাগরের জলেই তা মিলিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত সে অভিজ্ঞতা!
রাজকুমারী ছিল সেই নারী, ভালোবাসা প্রকাশ করবার গুপ্তবিদ্যায় যে ছিল ওস্তাদ। সে ছিল সেই কবি, পূর্বজন্মের পুণ্যফল ব্যতিরেকে যার কাব্য উপভোগ করা যায় না।
দিনগুলি যে কিরকম কাটছিল বোধ হয় তার আর বিশদ বর্ণনা করতে হবে না। এরই মধ্যে দুই বন্ধুতে মিলে মাঝে মাঝে এদিক সেদিক–একেবারে চৌক অবধি ঘুরে আসি। পরামর্শ করে ঠিক করা গেছে, কাপড়ের ব্যবসা করাই ঠিক হবে। দু’বছর পরে হলেও দোকানটা কোথায় ফাঁদা যেতে পারে, এখন থেকেই তার স্থান ঠিক করে রাখি। বড় দোকান ফাঁদতে হবে। নানা জায়গায় ব্র্যাঞ্চ খুলতে হবে। রাজকুমারী বলেছে, যত টাকা লাগে দেবে। পরিতোষ একদিন অত্যন্ত সহজভাবে স্বীকার করলে, জয়া-গিন্নিও তাকে ওইরকমই একটা আশ্বাস দিয়েছে। অস্থিরকেও আনিয়ে নিতে হবে। আমি, পরিতোষ ও অস্থির–এই তিনজনে সমান অংশীদার হব, হৈ-হৈ করে আমাদের ব্যবসা চলবে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে। এইসব কথা জানিয়ে অস্থিরকে একখানা চিঠি লিখব-লিখব করছিলুম, কিন্তু পরিতোষ বাধা দিয়ে বললে, এখন দিনকতক যাক।
আমি ঠিক করলুম, একদিন রাজকুমারীর সঙ্গে পরামর্শ করে তারপরে অস্থিরকে চলে আসতে লেখা যাবে, এখন তাড়াতাড়ি করবার কোনো দরকার নেই।
বাদশা হারুন-অল-রশিদ আবুল হাসানকে একদিনের জন্যে রাজত্ব দিয়ে কেড়ে নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু রাজত্বের বিনিময়ে আবুল হাসান পেয়েছিল রওশন আরাকে, সেও এক রাজ্য! আমার বাদশা এ-জীবনে আমাকে বহুবার রাজত্ব দান করেছেন; অকৃতজ্ঞতা করব না, সঙ্গে সঙ্গে ভালো ভালো রাজকুমারীও পেয়েছিলুম। কিন্তু রাজত্ব কেড়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবারই তিনি রাজকুমারীকেও কেড়ে নিয়েছেন।
জয়া-গিন্নির সঙ্গে পরিতোষের পরিচয় হবার বোধ হয় দিন পনেরোর মধ্যেই একদিন সকালবেলা তার ছোট ভাশুরপো হৈ-হৈ করে এসে হাজির হল, সঙ্গে আট-দশটি মোক্ষকামী বিধবা। তাঁরা তীর্থ করতে বেরিয়েছেন, চার ধাম তীর্থ করবেন–অর্থাৎ উত্তরে কেদার বদরী, দক্ষিণে কন্যাকুমারী ও রামেশ্বর, পূর্বে কামাখ্যা, পশ্চিমে দ্বারকা শেষ করে পুরুষোত্তমে গিয়ে মাথা মুড়িয়ে যে যার আস্তানায় ফিরে যাবেন। এত বড় পুণ্যকার্যে বিধবা ছোটকাকিকে বাদ দিতে তার মন চায় না বলেই তাকে নিতে আসা হয়েছে।
সংবাদটি শুনে তো পরিতোষ বেচারি একেবারে দমে গেল। জয়া-গিন্নী গুরুমার অবর্তমানে একবার আমাদের ঘরে এসে কত আদর করে তাকে বুঝিয়ে গেল, মাস ছয়েকের মধ্যেই সে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে, ছ’মাস দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
বোধ হয় দিন-দুই পরে তারা চলে গেল। যাবার সময় বাকি ঘরভাড়া ও আগাম ছ’মাসের ভাড়া দিয়ে নিজের ঘর-দুখানি বাঙাল-মার জিম্মেতে রেখে গেল।
জয়া-গিন্নি চলে যাবার বোধহয় দিন-দশেক পরে একদিন সকালবেলা স্নান সেরে রাজকুমারী বললে, গোপাল, আজ আমার ফিরতে একটু দেরি হবে। রসিয়ার মায়িকে বোলো, ঘণ্টাখানেক পরে যেন উনুনে আগুন দেয়।
রাজকুমারী চলে গেল মন্দিরের দিকে, আমরা বাড়িমুখে রওনা হলুম। পথের মাঝে প্রতিদিনই একটা উঁচু রোয়াকে জনকয়েক লোককে বসে আড্ডা দিতে দেখতুম। রাজকুমারী প্রতিদিনই আমাদের সেই রাস্তাটুকু পার করে দিয়ে একটা গলি দিয়ে অন্য পথে চলে যেত, আর আমরা বাড়ির দিকে চলে যেতুম। এই রোয়াকটার সামনে দিয়ে যখন আমরা যেতুম, তখন সেই লোকগুলো হুমড়ি খেয়ে আমাদের দেখতে থাকত আর নিজেদের মধ্যে কি সব বলাবলি করে চেঁচিয়ে অর্থাৎ আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে হাসতে আরম্ভ করে দিত।
সেদিন এই রোয়াকটা পার হয়ে বোধ হয় দশ পা-ও অগ্রসর হইনি, এমন সময় পেছন থেকে ভাঙা গলায় কে যেন ডাকলে, ওহে ছোক্বারা!
আমরা ফিরে দাঁড়াতেই দেখি, একটা ঝাঁকড়া-চুলওয়ালা লোক, বোধহয় মাসখানেক দাড়ি কামানো হয়নি, লিকলিকে রোগা, আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
লোকটাকে রোজই দেখি, তাদের হাসি প্রতিদিনই পিঠে এসে বিঁধতে থাকে, সুযোগ পেলে ওই হাসিকে একদিন কান্নায় বিগলিত করবার একটা প্রবল বাসনাও মনের মধ্যে উদ্যত হয়ে আছে; তার ওপরে কলকাতায় ভদ্রসমাজে ‘ছোক্রা’ কথাটা সে-সময় ছিল অত্যন্ত অভদ্র উক্তি। ‘ওহে ছোক্রা’ বলে আমাদের কেউ ডাকলে নির্ঘাত সেখানে মারামারি বেধে যেত।
একে সেই ‘ছোকরা’ ডাক, তার ওপরে আহ্বানকারীর সেই অপরূপ চেহারা, তার ওপরে প্রতিদিনকার সেই হ্যাঁ-হ্যাঁ হাসির ইতিহাস–এইসব মিলিয়ে মনের মধ্যে হাঙ্গামা বাধাবার একটা দুর্দমনীয় ইচ্ছা লাফালাফি করতে শুরু করে দিলে।
ফিরে দাঁড়িয়েই আমি বললুম, কি বলছ?
লোকটা ধমকের সুরে বললে, বলি এসই না এদিকে।
পরিতোষ বললে, দরকার থাকে তো এখানে এসেই বল না। তোমার চাকর নাকি যে, ডাকলেই যেতে হবে?
পরিতোষকে চিরকাল ভয়তরাসে বলেই জানতুম। দেখলুম জয়া-গিন্নি ক’দিনেই তাকে মানুষ করে তুলেছে। আমাদের তরফ থেকে উত্তরের সুর শুনে, তারা দু-তিনজন টপটপ করে, রোয়াক থেকে নেমে আমাদের কাছে এগিয়ে এল।
ঝাঁকড়া-চুলো জিজ্ঞাসা করলে, তোমাদের বাড়ি কোথায় হে?
লোকগুলো কাছে আসতেই ভভক্ করে গাঁজার গন্ধ বেরুতে লাগল।
জিজ্ঞাসা করলুম, কেন বল দিকিন?
দরকার আছে।
আমাদের বাড়ি কলকাতায়। তোমার বাড়ি কোথায় বল তো?-
লোকটা সে-কথার উত্তর না দিয়ে বললে, লক্ষ্মীমণি কে হয় তোমাদের? কে লক্ষ্মীমণি?
দু’বেলা দেখছি, তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছ, আর লক্ষ্মীমণিকে চেনো না যাদু।
গুরুমার কথা বলছ?
হ্যাঁ হ্যাঁ।
উনি আমাদের গুরুমা হন।
কথাটা শুনেই লোকগুলো হো-হো করে হেসে উঠল। আবার খানিকটা গাঁজার গন্ধ পেলুম। হাসি থামিয়ে একজন আর-একজনকে বললে, ওহে বদ্যিনাথকে খবর দাও, তার মাসি এবার জোড়া-ছোঁড়া পাকড়াও করেছে।
একজন লোক রোয়াক থেকে লাফিয়ে পড়ে ছুটল বদ্যিনাথকে খবর দিতে।
সরু গলি হলেও ইতিমধ্যে কয়েকজন বাঙালি বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মজা দেখতে। দেখলুম একজন বিরাটদেহ ফোঁটা-তিলকধারী পাণ্ডাগোছের লোকও দাঁড়িয়ে শুনছে আমাদের বাগযুদ্ধ
ইতিমধ্যে ঝাঁকড়া-চুলো একেবারে আমার ঘাড়ের ওপর পড়ে শাসাতে লাগল, দেখ যাদু, তোমাদের ও-কলকাতার চালাকি এখানে চলবে না, বুঝলে? এ কাশী, এখানে চালাকি করলে-
এই বলে অশ্লীল ভাষায় একটা গালাগালি দিলে।
তখন রাস্তায় বেশ লোক দাঁড়িয়ে গেছে।
অনেকদিন একাধারে মাধুর্যরসের চর্চা করে মন থেকে হাঙ্গামা-হুঁজ্জতের প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণটা আমার একরকম মুছেই গিয়েছিল। এতদিন পরে আকস্মিক এই আহ্বানে মঙ্গল-দেবতা একেবারে মাথায় চড়ে বসলেন। বিদেশ-বিভুঁই, বন্ধুবান্ধব কেউ নেই, একটা হাঙ্গামা হলে বাঁচাবে এইসব ভেবে এতক্ষণ সংযমই অভ্যাস করছিলুম। কিন্তু ঝাঁকড়া-চুলোর মুখে ওই গালাগালি শুনে একেবারে জ্ঞান হারিয়ে ফেললুম। আমার হাতে রাজকুমারীর ভিজে শাড়িখানা ছিল, আমি চিৎকার করে উঠলুম, পরিতোষ ধর তো এটা।
আমার কথা শেষ হবার আগেই পরিতোষ ঝাঁকড়া চুলোর কানপাট্টায় এমন একটি চপেটাঘাত ঝাড়লে যে, লোকটা ঘুরতে ঘুরতে একটা বাড়ির দেওয়ালে গিয়ে দড়াম করে পড়ে গেল।
একটা হৈ-হৈ ব্যাপার শুরু হয়ে গেল। ঝাঁকড়া-চুলোর বন্ধুরা টপাটপ রক থেকে লাফিয়ে পড়ে মারমুখো হয়ে আমাদের দিকে তেড়ে এল। আমরাও তৈরি। দু-এক হাত ঘুষোঘুষিও হয়ে গেল, এমন সময় সেই পাণ্ডাগোছের ষণ্ডা লোকটি মাঝে পড়ে আমাদের তারিফ করতে লাগল, সাবাস বেটা–সাবাস! তার পরে অপরপক্ষকে ধিক্কার দিয়ে বললে, লজ্জা করে না এইটুকু বাচ্চা ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করতে।
রাস্তায় স্ত্রীপুরুষ যারা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল, তারা সকলেই ওদের ধিক্কার দিতে আরম্ভ করে দিলে। এমন সময় যে লোকটা বদ্যিনাথকে খবর দিতে গিয়েছিল, সে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এসে বললে, বদ্যিনাথ বাড়িতে নেই।
বললুম, বদ্যিনাথ এলে পাঠিয়ে দিও, আমাদের মাথা একেবারে কেটে নিয়ে যাবে ‘খন।
বাড়িতে এসে রসিয়ার মায়িকে রাজকুমারীর শাড়ি ও গামছা দিয়ে নিজেদের ঘরে গিয়ে খাটের ওপরে বসেছি, এমন সময় বাঙাল মা-উঁকি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কি দাদু, লোকগুলোর সঙ্গে কি হাঙ্গামা লাগিয়েছিলে?
রাজকুমারীর বাড়িতে দোতলা ও তেতলা মিলিয়ে আট-দশ ঘর ভাড়াটে থাকত, সকলেই বিধবা। শুধু সে-বাড়ি কেন, আশপাশের প্রায় সব বাড়িতেই দেখতুম, প্রায় ঘরে-ঘরেই বিধবা ভাড়াটে। সকলেই তারা বাংলার ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে কাশীবাস করতে এসেছে–কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ-বা বাধ্য হয়ে। এদের মধ্যে অনেকেরই দেশে খেয়ে পরে স্বচ্ছন্দে থাকবার মতন সঙ্গতি ছিল, কিন্তু আত্মীয়দের ভাঁওতায় তারা জেনেছে, তাদের কিছুই নেই। এরা কাশীতে এসেছে জীবনটুকু কোনোরকমে কাটিয়ে দিয়ে এইখানেই মরবে এই আশায়। পূর্বজন্মের অনেক পাপের ফলে এ-জন্মে বৈধব্য ভোগ করতে হল, আর যেন জন্ম না হয়, আর যেন বিধবা হতে না হয়।
আহার্য তাদের নামমাত্র। বেলা তৃতীয় প্রহরে ভাতের সঙ্গে ডাল, কুমড়ো-বেগুন সেদ্ধ; কারুর ভাগ্যে খই-বাতাসা; কারুর ভাগ্যে কিছুই নেই। এদের মধ্যে কেউ কেউ ভাগ্যবতী, কারণ তাদের বাড়ি থেকে তিন টাকা, পাঁচ টাকা, কারুর বা দশ টাকা আসে; প্রথম প্রথম মাসে-মাসেই আসত, এখন কখনও কখনও আসে। সে-টাকা কেউ-বা দয়াপরবশ হয়ে পাঠায়, কেউ-বা তাদেরই সম্পত্তির অংশ থেকে পাঠায়, কিন্তু প্রতিবারই তাদের টাকা পাঠাবার সময় মনে হয়, মাগি আর কতকাল বাঁচবে, কতকাল আর এইভাবে টাকা পাঠাতে পারা যায়!
এদের মধ্যে অনেকেই, কেউ-বা কোনো তীর্থযাত্রী পরিবারে দু-বেলা রেঁধে, কেউ-বা কাঁথা সেলাই করে, কেউ-বা বড়ি দিয়ে মাঝে মাঝে কিছু রোজগার করে। বছরে দু-খানা কি তিনখানা থান, মাসে আট আনা এক টাকা থেকে তিন টাকা ঘর ভাড়া জোগাড় করতেই হবে। মধ্যে মধ্যে নানা প্রদেশের রাজা-মহারাজা এসে বিধবাদের কম্বল বিতরণ করে, তারই কখনও একখানা পাওয়া যায়, তাই দিয়ে কাশীর দুর্জয় শীত নিবারিত হয়। র্যাপার কিংবা শাল যার আছে, সে ভাগ্যবতী।
সংসারে তাদের আপনার কেউ নেই, তারাও কারুর নয়। বাইরের ঘটনাবলি, সে যতই উত্তেজক বা চাঞ্চল্যকর হোক না, এদের জীবনে তা কোনো রেখাপাতই করে না। জীবন-মৃত্যু কিছুর প্রতিই তাদের বিরাগও নেই, কোনো আকর্ষণও নেই। বৈচিত্র্যহীন তরঙ্গহীন জীবনপ্রবাহ স্থিরভাবে বয়ে চলেছে মরণসাগরের পানে।
ধর্মকর্মের কোনো স্পষ্ট ধারণা তাদের নেই (কারই বা আছে!)–অথচ প্রায় প্রত্যেকেই একটা-না একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের পদ্ধতি অবলম্বন করে চলে। ধর্মের নামে যে-কোনো লোক যা বলে, তাই তাদের কাছে সাময়িক সত্যরূপে প্রতিভাত হয়। বিচার করবার শিক্ষা, শক্তি বা ধৈর্যও তাদের নেই।
এরা কাশীতে এসেছে মরবে বলে, কারণ এখানে মরলে আর জন্মাতে হবে না; কিন্তু নিত্য শত শিবের মাথায় জল ঢালে, শিবের মতো স্বামী পাবে বলে। কোনো ঘটনাই তাদের মনে চাঞ্চল্য জাগায় না; কারণ তারা জানে, এমন কোনো ঘটনাই ঘটতে পারে না, যার দ্বারা তাদের অবস্থার পরিবর্তন হবে। এই সত্যই তাদের কাছে একমাত্র সত্য। এরই পায়ে আত্মসমর্পণ করে তারা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। যত দেরিই হোক, একদিন-না-একদিন বিশ্বনাথ দেখা দেবেনই মহেশ্বরের রূপ ধরে। অতি করুণ সে আত্মসমর্পণ! মৃত্যুদণ্ড-প্রাপ্ত ব্যক্তি ফাঁসির দড়ির কাছে যেমন করে আত্মসমর্পণ করে।
এদের মধ্যে কেউ-বা কখনও হয়তো পাথেয়স্বরূপ কারুকে পায় সঙ্গীরূপে। কিন্তু হায়! নারীর সাহচর্যে এলেই অধিকাংশ সুবোধ পুরুষের মন থেকে ভদ্রতার খোলস ঝরে পড়ে যায়। আবার এক অভিনব দুর্বিপাকের আবর্তে তাকে ফেলে দিয়ে সে-ব্যক্তি সরে পড়ে। অথবা কোনোও সত্যিকারের ভদ্রলোক আমরণ একত্রেই জীবন কাটিয়ে দেয়, সকলের কাছে ঘৃণ্য হয়েও সে-নারী নিজে ধন্য হয়। সবাই তাকে গালাগালি দেয়, ঈর্ষার মেঘ থেকে নিন্দার বজ্র বর্ষিত হয়।
আগে যে বাঙাল-মা’র কথা উল্লেখ করেছি, তিনি এই বাড়িরই তেতলায় বাস করতেন। বয়স আশি পার হয়ে গেলেও বেশ শক্ত-সমর্থ ছিলেন। পূর্ববঙ্গের কোনো-এক পল্লীগ্রামে ছিল তাঁর পিত্রালয়, শৈশবেই পিতৃহীন হয়েছিলেন। বাপের কথা মনে নেই, বিধবা মার একমাত্র সন্তান, আদরেই মানুষ হচ্ছিলেন। এর বেশি বাপের বাড়ির কথা আর স্মরণ নেই।
বাঙাল-মা’র জীবন-কথা তাঁর নিজের জবানিতেই বলি :
ছ’-সাত বছর বয়সে বিয়ে হয়ে মাকে ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলুম। সেখানে তারা অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। বড় দালান-বাড়ি তিনমহলা, জমি-জমা, চাকর-দাসী জনমজুর — জমজমে সংসার। গোলা-ভরা ধান, গোয়াল-ভরা গাই-বলদ। সংসারে শ্বশুর নেই, চারটি ভাই একেবারে রাম-লক্ষ্মণ, আমি হচ্ছি, ছোট বউ। শাশুড়ি বুকে তুলে নিয়ে নিজের সন্তানের মতন মানুষ করতে লাগলেন। কোনো কষ্ট নেই, দুঃখ নেই, শুধু মধ্যে মধ্যে মার জন্যে মনকেমন করতে থাকে, তাই কান্নাকাটি করি। শাশুড়ি মাঝে মাঝে মাকে আনিয়ে বাড়িতে রাখেন, আনন্দে দিন কাটে।
তারপর এল যৌবন। সিঞ্চলে সূর্যোদয়ের মতন মর্মাচলের শিখরে শিখরে অনুরাগের ছোপ একটু একটু করে লাগতে আরম্ভ করেছে মাত্র, এমনই একদিন মা এসে তাঁর জামাইকে ধরলেন, বাবা, আমার তো ছেলে নেই; তুমিই আমার ছেলে, আমাকে কাশী পাঠিয়ে দাও, ছেলের কাজ কর। একটা বিধবার সেখানে থাকতে কতই-বা খরচ হবে! মাসে তিনটে টাকা হলেই আমার চলে যাবে।
মা ছিলেন ভালো মানুষ। এজন্যে আমার শ্বশুরবাড়ির সকলেই, ভাশুরেরা পর্যন্ত তাঁকে পছন্দ করতেন। মা’র ছিল অল্প বয়েস, আমার বড় ননদ মা’র চেয়ে বয়েসে বড় ছিল। শাশুড়ি মাকে মেয়ের মতন যত্ন করতেন, এলে ছাড়তে চাইতেন না।
ভাশুরেরা সব ভাইয়ে মিলে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, সরকারি তহবিলে থেকে মাসে পাঁচ টাকা করে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, আর আমার স্বামী গিয়ে তাঁকে কাশীতে পৌঁছে দিয়ে আসবেন।
তখন নৌকো চড়ে কাশী যাওয়া হত।
ভাশুরেরা তাঁদের মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে এলেন, মার অনুমতি বিনা কিছুই হবার জো নেই। শাশুড়ি ছেলেদের মুখে সব শুনে বললেন, আমিও কাশীবাসী হব।
বাড়িতে হৈ-হৈ পড়ে গেল। মা’র কাশী যাওয়া সে তো চাট্টিখানি কথা নয়! সবাই তাঁকে মানা করতে লাগল, ভাশুরেরা আমার স্বামীর নাম করে বলতে লাগলেন, ওর ছেলেপিলের মুখ দেখে তার পরে যেও। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা, কাশীবাসী হবেনই।
অগত্যা বন্দোবস্ত শুরু হল। ঠিক হল, আমার বড় ও মেজো ভাশুর, আমার বড় জা, শাশুড়ি ও মা যাবেন। মাকে ও শাশুড়িকে সেখানে স্থিতি করিয়ে দিয়ে দুই ভাশুরে ফিরে আসবেন বড় জাকে নিয়ে, সে প্রায় ছ’মাসের ধাক্কা
বাইরে সব বন্দোবস্ত চলেছে। শুভযাত্রার বোধহয় আর মাসখানেক দেরি আছে। শাশুড়ি প্রতিদিনই সন্ধের সময়, কোনোদিন কোনো বউকে, কোনোদিন কোনো ছেলেকে ডেকে উপদেশ দেন। আমাকে দিনরাত বলেন, মা লক্ষ্মী, তুমি এ সংসারে সবার শেষে এসেছ, শেষ অবধি দেখো, যেন আমার শ্বশুরের সংসার না ভেঙে যায়! আমার স্বামীকে কোনো উপদেশ দিতে গেলে তিনি কোনো কথা কানে না তুলে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন।
এমনই দিন চলেছে, এমন সময় চৈত্র মাসের প্রথমেই ওলাউঠা হয়ে তিনদিনের দিন আমার স্বামী মারা গেলেন।
তারপর একদিন সন্ধ্যাবেলা কালবৈশাখীর ঝড় বুকে ভরে নিয়ে আমাদের নৌকো তিনটি বিধবাকে নিয়ে কাশীর দিকে ভেসে চলল, সঙ্গে রইলেন মেজো ভাশুর।
কাশীতে এসে পৌঁছেছিলুম ষাট-পঁয়ষট্টি বছর আগে (অর্থাৎ আজ থেকে এক শতাব্দীরও পূর্বে) মা, শাশুড়ি ও আমি–তিনটি বিধবা, তখনকার দিনে মাসে দু’টাকায় একজন বিধবার রানীর হালে চলে যেত। আর আজ পাঁচ টাকাতেও চলে না।
এখানে এসে কত ত্রৈলঙ্গস্বামী, ভাস্করানন্দ স্বামীই দেখলুম, সে সবার ইতিহাস বলতে গেলে এখন একটা মহাভারত হয়ে যাবে।
বাড়ি থেকে মাসে মাসে নিয়মিত টাকা আসতে লাগল। আমাদের তিনটি বিধবার কোনো কষ্টই ছিল না। বছর-দশেক এইভাবে স্বচ্ছন্দে কাটবার পর আমার শাশুড়ি মাস ছয়েক আমাশায় ভুগে ভুগে কাশীতে দেহরক্ষা করলেন, আমার বয়েস তখন ছাব্বিশ, মার বয়েস বেয়াল্লিশ।
তখন আমার বড় মেজো দুই ভাশুর গত হয়েছেন, একমাত্র ছোট ভাশুর জীবিত। শাশুড়ির অসুখ করা থেকে আরম্ভ করে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা নিয়মিত বাড়িতে খবর পাঠিয়েছিলুম, মাঝে মাঝে ছোট ভাশুর জবাবও দিতেন; কিন্তু সেখান থেকে মাকে কেউ দেখতে আসেনি। শাশুড়ির শ্রাদ্ধ-শান্তি হয়ে যাবার পর মেজো ভাশুরের এক ছেলে আমাকে ও মাকে গালাগালি দিয়ে এক দীর্ঘ পত্র লিখে জানালে যে, আমরা তার পিতমহীকে বিনা চিকিৎসায় মেরে ফেলেছি।
মা ওদের চিঠি পড়েই বললেন, ব্যস, আর ওরা খরচপত্র পাঠাবে না বলে মনে হচ্ছে, এবার তাহলে কাজকর্মের জোগাড় করতে হয়।
মার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। সেই থেকে তারা আর আমাদের কোনো খোঁজই নেয়নি, টাকাকড়িও আর পাঠায়নি। অনেক চিঠি লিখেছিলুম, কিন্তু তার কোনো জবাবই পাইনি।
সেই থেকে দুই মা-বেটীতে কখনও লোকের বাড়িতে রান্নার কাজ করে, জাঁতা ভেঙে, কাঁথা সেলাই করে, বড়ি দিয়ে দুজনের পেট সুখে-দুঃখে চালিয়ে নিতে লাগলুম। দেখতে দেখতে কাশীর কত পরিবর্তনই হল, কত লোক এল গেল, আমরা দুটি বিধবা অখণ্ড পরমায়ু নিয়ে মৃত্যুকে তুচ্ছ করে চললুম। একমাত্র ভাবনা, আমাদের মধ্যে কে আগে যায়, কে পড়ে থাকে! যে আগে যাবে, সেই-ই বেঁচে যাবে। শেষকালে মা-ই আগে চলে গেল, সেও আজ পঁচিশ-তিরিশ বছর হবে।
বাঙাল-মা এই বাড়িরই তেতলায় বাস করতেন। কাশীর ছোট-বড় সব বাঙালিমাত্রেই বাঙাল-মাকে চিনত, তিনিও প্রায় সকলেরই নাড়ীনক্ষত্র অবধি জানতেন। জয়া-গিন্নির ঘর দু-খানার পাশে তেতলায় ছোট্ট একখানা ঘর ছিল, তার পাশেই ছাত। এই ঘরখানা রাজকুমারী বাঙাল-মাকে বিনা ভাড়ায় থাকতে দিয়েছিল। জয়া-গিন্নি তাঁকে খেতে পরতে দিত, তার বদলে তিনি তাদের রান্না করতেন, তার মেয়ের তদারক করতেন, মোট কথা, তার সমস্ত সংসারটাই তিনি দেখতেন। কোন রাত থাকতে উঠে একটা বড় বালতি নিয়ে তিনি গোবর সংগ্রহ করতে বেরুতেন।’ বেলা দশটার মধ্যে প্রায় মাইল পাঁচ-সাত ঘুরে তিন বালতি গোবর এনে উঠোনের এক কোণে জমা করতেন। দু-তিন দিন পরে পরে সেই গোবর ছাতে তুলে নিয়ে গিয়ে ঘুঁটে দিতেন। জয়া-গিন্নির ইন্ধনের খরচ লাগত না। আমরা দেখতুম, বাড়িসুদ্ধ লোক যখন যার প্রয়োজন, তাল-তাল গোবর নিয়ে গিয়ে ব্যবহার করছে, কিন্তু কোনোদিন বাঙাল-মার মুখে এজন্যে একটু ক্ষীণ আপত্তিও শুনিনি। জয়া-গিন্নি তীর্থে যাবার আগে ঘর-দোর দেখবার ভার তাঁরই ওপর দিয়ে গিয়েছিল। এই ক’মাসের খরচও দিয়ে যেতে সে ভোলেনি।
বাঙাল-মা আমাদের ওপরে ডেকে নিয়ে গিয়ে জয়া-গিন্নির ঘরে বসিয়ে বলতে লাগলেন, ও লোকগুলো ভালো নয়, সব নেশাখোর। আর ওই যে বদ্যিনাথ, যাকে ওরা ডাকতে গিয়েছিল, সে একটা সাংঘাতিক লোক। কত বউ-ঝির সর্বনাশ যে সে করেছে, কত যে মানুষ হত্যা করেছে, তার আর ঠিক-ঠিকানা নেই। সে-লোকটা লক্ষ্মীমণির বোনপো হয়।
তার সঙ্গে ঝগড়া করতে বাঙাল-মা আমাদের পই-পই করে বারণ করে দিলেন।
আমরা নীচে নেমে এসে পরামর্শ করতে লাগলুম, কি করা যায়! কোথা থেকে যে কি হল কিছুই বুঝতে পারছিলুম না। কে বদ্যিনাথ? কোনো জন্মে তাকে চোখে পর্যন্ত দেখিনি, সে কেন আমাদের এত বড় শত্রু হয়ে দাঁড়াল? হায় ভগবান! দু’দিনের জন্যেও কি তুমি শান্তি দেবে না? কল্পনায় এতদিন ধরে যে মনোরম ভবিষ্যতের ছবি তৈরি করেছিলুম, মনের মধ্যে তা মিলিয়ে যেতে লাগল। অত্যন্ত ক্ষুণ্নমনে কালকের বাসি লুচি তরকারি ও ক্ষীর নিয়ে খেতে বসা গেল।
খাওয়া চলছে, এমন সময় পরিতোষ দপ করে জ্বলে ওঠার মতো আসন-পিঁড়িতে হঠাৎ উবু হয়ে বসে বললে, দেখ স্থবরে, ওই বদ্যিনাথ না ফদ্যিনাথ সে এসে যদি কিছু বলে কিংবা মারধর করে, তাহলে সহজে ছাড়া হবে না কিন্তু, আমরা যে কলকাতার ছেলে সে-কথা ব্যাটাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে।
পরিতোষের কথায় হাঁ দিয়ে আর একখানা লুচি ক্ষীরে সাপ্টে মুখে তুলেছি, এমন সময় বাজখাঁই গলায় উঠোনে কে যেন হুঙ্কার ছাড়লে, মাসি আছ, মাসি?
আমরা দুজনে মুখ-চাওয়াচাওয়ি করছি, বাক্য নেই, কারণ মুখগহ্বর লুচি ও গব্যে একেবারে নিরেট ঠাসা। এমন সময় আবার হুঙ্কার উঠল, এই যে, মাসির দরজা খোলা রয়েছে–
‘মাসি’ বলে যে লোকটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল, ছ’-ফুটেরও ওপর সে লম্বা আর সেই অনুপাতে চওড়া, দেখলেই মনে হয় খুনে।
আত্মরক্ষার সংস্কারবশত তখুনি বুঝে নিলুম, এই লোকটাই বদ্যিনাথ। শুধু তাই নয়, তার চেহারার সঙ্গে আমাদের কাশীপ্রাপ্তির একটা নিয়ত সম্ভাবনায় আমার বুকের মধ্যে মহাপ্রাণী বার-দুয়েক ডানা-ঝাঁপটা দিয়ে উঠল।
লোকটা চৌকাঠের ওপারে দাঁড়িয়ে কঠিন দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়ে রইল। তার চোখদুটো জবাফুলের মতো লাল, বোধ হয় তক্ষুনি গাঁজা-টাজা টেনে এসেছে। গায়ে একটা লম্বা হাতা কোমর অবধি ঝোলা পিরান, তার ওপরে কালো গরম কাপড়ের ওয়েস্ট-কোটের মতন একটা কোর্তা, আজকের দিনে হলে সেটাকে জওহর কোট বলা চলতে পারত। এক কাঁধে একখানা আলোয়ান বেশ পরিপাটি করে পাট করা, কোঁচা ঝুলিয়ে ধুতি পরা।
পরিতোষের দিকে ফিরে দেখলুম, সে নিশ্চিন্তমনে লুচির পর লুচি মুখের মধ্যে পুরে চলেছে।
লোকটা কিছুক্ষণ আমার দিকে কট্ট্ করে চেয়ে থেকে আবার হুঙ্কার ছাড়লে, ওহে ছোক্বা, একবার এদিকে এস তো।
লোকটাকে সেখান থেকেই আর একবার বেশ করে দেখে নিলুম, সে আমার বাবার চাইতে যণ্ডা কি না!
দেখলুম, বাবার চাইতে সে লম্বা বটে, কিন্তু চওড়ায় কিছু কম। মনে মনে পিতৃনাম স্মরণ করে উঠে পড়া গেল। তার পর বেশ ধীরে-সুস্থে, হেলে-দুলে চৌকাঠের কাছে গিয়ে আঙুল চাটতে চাটতে জিজ্ঞাসা করলুম, কি বলছ?
বলছি, তোমরা কারা?
আমি বললুম, আমরা? আমরা-আমরা।
বদ্যিনাথ এবার সিংহের মতন গর্জে উঠে বললে, তা জানি। জিজ্ঞাসা করছি, তোমাদের বাড়ি কোথায়? এখানে এসে জুটলে কি করে?
আমাদের বাড়ি কলকাতায়, গুরুমা আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন।
বদ্যিনাথের হুঙ্কার শুনে তেতলা থেকে বাঙাল-মা, দোতলায় দু-তিন ঘর থেকে ভাড়াটেরা রসিয়ার মায়ি ইত্যাদি সব ইতিমধ্যে নীচে এসে জমা হয়েছিল। তারা সকলেই তাকে চেনে সবাই তাকে নিরস্ত হবার জন্যে অনুনয় করতে আরম্ভ করে দিলে। সবাই মনে করতে লাগল ছেলে-দুটোর অকালমৃত্যু অনিবার্য।
কিন্তু সকলের অনুরোধ উপেক্ষা করে বদ্যিনাথ আবার হুঙ্কার ছাড়লে, তোমার বাবাকেলে গুরুমা, শালা! দেখ, অনেক শালা কলকাতার লোক এখানে ঠান্ডা হয়ে গেছে। ভালো চাও তো এক্ষুনি বেরোও এখান থেকে, নইলে—
বদ্যিনাথের গালাগালি শুনেই পরিতোষ যে কাঁসিটায় খাচ্ছিল, তার কানা ধরে উঠে এসে দাঁড়াল আমার পাশে; ভরসায় বুক ভরে উঠল।
বললুম, দেখ চাঁদ, যা বলবার বল, গালাগালি করলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।
‘তবে রে শালা’ বলে বদ্যিনাথ সেইখান থেকেই তার ডান হাতখানা বাড়িয়ে একটি ঝঙ্কায় আমার দেহটাকে ফাত্নার মতন বাইরে টেনে নিয়ে গিয়েই মারলে এক চড়। আমি বাঁ হাত দিয়ে চড়ের বেগ কিছু আটকালুম বটে, কিছু যেটুকু এসে মাথায় লাগল, তাতেই ভবিষ্যৎদৃষ্টি খুলে গেল।
কেউ হাত চেপে ধরলে তার বুড়ো আঙুলটা মুচড়ে দিতে পারলে, সে যত বড় পালোয়ানই হোক, তাকে হাত ছাড়তেই হবে। আমি এক হাত দিয়ে বদ্যিনাথের বুড়ো আঙুলটা মুচড়ে দেবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলুম। কিন্তু সে ছিল শক্তিশালী, আমি এক হাত দিয়ে তার আঙুলটা নাড়াতেও পারলুম না। শেষকালে উপায়ান্তর না দেখে তার বুড়ো আঙুলটা কামড়ে ধরলুম। সে অন্য হাত দিয়ে আমার মুখে ঘুষো মারতে আরম্ভ করে দিলে, আমার নাক দিয়ে দরদর করে রক্ত ছুটতে লাগল। বাঙাল-মা ও রসিয়ার মা তারস্বরে চিৎকার করতে আরম্ভ করলে। আমি প্রাণপণ করে আঙুল কামড়িয়েছি। তার মাংস কেটে দাঁত বসে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। সঙ্কল্প যে, হাত না ছাড়লে ব্যাটাকে নির্ঘাত একলব্য করে ছাড়ব, এমন সময় পরিতোষ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তার কোঁচাটা ধরে ফর্ করে টেনে ধুতিখানা খুলে নিলে।
আচমকা অধমাঙ্গ বস্ত্রশূন্য হওয়ায় বদ্যিনাথ মুহূর্তের জন্যে হচকিয়ে গেল। চারদিকে মেয়েছেলে দাঁড়িয়ে, তারা সবাই তাকে সাক্ষাৎ যমের মতন ভয় করে, তাদের সামনে এতবড় বেইজ্জত! সে চট করে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে কাঁধ থেকে পাট-করা র্যাপারটা টেনে নিয়ে যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি পাট খুলে পরবার চেষ্টা করতে লাগল। আমি আর কালবিলম্ব না করে তার তলপেটে মারলুম এক লাথি। ‘উ’ ‘উ’ আওয়াজ করে একবার ঘুরপাক খেয়ে সে মাটিতে বসে পড়ল। আমি দৌড়ে গিয়ে কুয়োর ধারের লোটাখানা তুলে নিয়ে তার মাথা টিপ করছি, এমন সময় তড়াক করে উঠে সে আমার দিকে দৌড়ে আসতে লাগল। লোটাটা ছুঁড়ি আর কি, ঠিক সেইসময় একটা বড় গোবরের তাল তার মুখের ওপর এসে পড়ল।
বদ্যিনাথ যেভাবে দুই চোখ পাকিয়ে হিংস্র জানোয়ারের মতো মুখ হাঁ করে দাঁত বের করে আমার দিকে তেড়ে আসছিল, তাকে দেখে মনে হয়েছিল যে, লোটার আঘাতে যদি তাকে সাংঘাতিকভাবে কাবু না করতে পারি, তাহলে আমার মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু জয় বাবা বিশ্বনাথ–যাঁর দয়ায় মূক বাঁচাল হয়, পঙ্গু গিরি লঙ্ঘন করে, অতি দুঃখের দিনেও সাড়ে তিন টাকা খরচ করে সেদিন যাঁর পুজো দিয়েছি, তিনি যে বাঙাল-মা’র গোবর্ধনগিরির মধ্যে ইন্দ্রজিতের শক্তিশেল লুকিয়ে রেখেছিলেন, কে তা জানত! আর অব্যর্থ বন্ধু পরিতোষের সন্ধান!–বদ্যিনাথের চক্ষু ও মুখগহ্বর পবিত্রতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল।
গোবরের তালটা পড়তেই বদ্যিনাথ চোখের যন্ত্রণায় চিৎকার করে দুই হাত চোখে দিয়ে বোঁ-বোঁ করে ঘুরতে আরম্ভ করে দিলে। পরিতোষ সেই তালে একলাফে এগিয়ে গিয়ে তার কোমর থেকে র্যাপারটা টেনে নিয়ে একেবারে কুয়োর মধ্যে ফেলে দিলে।
রসিয়ার মা, বাঙাল-মা ও বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটেরা আর্তনাদ করতে লাগল। ইতিমধ্যে আমি একতাল গোবর বদ্যিনাথের মুখে মারতেই সে চোখের যন্ত্রণায় ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে কবন্ধের মতন উঠোনময় দুই হাতে শূন্য আলিঙ্গন করে ছুটোছুটি আরম্ভ করে দিলে। রসিয়ার মায়ি কোথা থেকে একখানা গামছা এনে বদ্যিনাথের হাতে দিতেই সে সেখানা কোমরে জড়িয়ে মাটিতে বসে পড়ল। ঠিক সেইসময় কমণ্ডলু-হস্তে রণক্ষেত্রে গুরুমা’র আবির্ভাব।
তখন উঠোনময় গোবরের ছড়াছড়ি, বদ্যিনাথ চলতি বাংলায় চিৎকার করে জানাচ্ছে যে, অচিরভবিষ্যতেই আমাদের স্থানবিশেষে আশ্রয় নিতে হবে। রসিয়ার মা, বাঙাল-মা ও বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটের দল সকলেই সশব্দে এই গজ-কচ্ছপের যুদ্ধ সম্বন্ধে মন্তব্য করছে, আমার নাক দিয়ে তখনও টপটপ করে রক্ত পড়ছে।
গুরুমা শান্ত দৃষ্টিতে চারদিক দেখে কঠোর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, এ কি ব্যাপার বদ্যিনাথ?
বদ্যিনাথ কোমরে গামছা জড়াতে জড়াতে দাঁড়িয়ে উঠে জিজ্ঞাসা করলে, এ ছোঁড়া-দুটো কে জিজ্ঞাসা করি?
গুরুমা তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, গোপাল, একি, তোমায় মেরেছে?
তারপর বদ্যিনাথের দিকে ফিরে বললেন, কেন মেরেছ তুমি একে? তোমার কি ক্ষতি করেছে এ?
বদ্যিনাথ এ-কথার কোনো উত্তর না দিয়ে গুরুমাকে বলতে লাগল, তুমি কোথা থেকে এ ছোঁড়া-দুটোকে নিয়ে এসে বাড়িতে রেখেছ, নিন্দেয় আমার পথ চলা দায় হয়েছে-
বদ্যিনাথ আরও কি বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু গুরুমা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললে, আমি ছোঁড়া ধরি কি বুড়ো ধরি, তাতে তোমারই বা কি আর তোমার বাবারই বা কি? আমার যা খুশি তাই করব, সেজন্য কি তোমার কাছে জবাবদিহি হতে হবে?
আমাকে তো সমাজে বাস করতেই হয়!
কে তোমাকে সমাজে বাস করতে বারণ করেছে? আমার সঙ্গে তোমাদের সম্পর্ক কিসের? আমার মাকে তো তোমরা বেশ্যা বল, তার পয়সা আর তার বাড়ি ছেড়ে দাও তাহলে। বেশ্যার অন্ন খেয়ে. সমাজে বাস করছ’ কি করে জিজ্ঞাসা করি।
বদ্যিনাথ একেবারে চুপ।
গুরুমা বললেন, যাও, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। গুণ্ডামি করো কাশীর রাস্তায়, এদের সঙ্গে গুণ্ডামি করতে এসে মজা বুঝতে পেরেছ তো? এরা জাত-সাপের বাচ্চা।
বদ্যিনাথ সাপের মতন নিশ্বাস ছেড়ে বললে, আচ্ছা, কেমন জাত-সাপের বাচ্চা আমিও বুঝে নোব–আমার নাম বদ্যিনাথ।
গুরুমা বললেন, যা বোঝবার এ-বাড়ির বাইরে বুঝো, এখানে ঢুকে ফের যদি হাঙ্গামা কর তো বাপের বিয়ে দেখিয়ে দোব। জান তো আমাকে, আমার নাম লক্ষ্মীমণি।
গুরুমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে গামছার এক খুঁট দিয়ে চোখ-মুখের গোবর পরিষ্কার করতে করতে বদ্যিনাথ বললে, আমার ধুতি র্যাপার কোথায়?
রসিয়ার মা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে, কুয়োর মধ্যে।
বদ্যিনাথ বোধহয় সাংঘাতিক একটা কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় রসিয়ার মা বললে, তুমি বাড়ি যাও, আমি তোমার ধুতি, গায়ের চাদর পৌঁছে দিয়ে আসব।
বদ্যিনাথ আর কোনো কথা না বলে দরজার দিকে অগ্রসর হল। দু-কদম গিয়ে আবার ফিরে এসে আমাদের বললে, রাস্তায় বেড়িও।
লোকটা চলে গেল। গুরুমা একবার চারিদিক দেখে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন, আমাদের সঙ্গে কোনো কথা বললেন না। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে দেখলুম, কমণ্ডলুটা যথাস্থানে রেখে নামাবলিখানা গা থেকে খুলে বিছানার ওপরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, তারপর দরজাটা বন্ধ করে সশব্দে খিল লাগিয়ে দিলেন।
বাঙাল-মা ও বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটেরা যে-যার ঘরে ফিরে গেল। রসিয়ার মা উঠোন মুক্ত করে কাঁটাওয়ালা ডেকে নিয়ে এসে বদ্যিনাথের ধুতি ও র্যাপার তুলে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে চলে গেল। আমরা স্নান করে গোবর-মুক্ত হয়ে ঘরে এসে বসলুম। রসিয়ার মা বদ্যিনাথের বাড়ি থেকে ফিরে এসে উনুনে আগুন দিয়ে গুরুমার দোরগোড়ায় উনুন রেখে বাড়িতে নাইতে-খেতে চলে গেল।
আমার নাক দিয়ে রক্ত-পড়া বন্ধ হয়ে গেল বটে, কিন্তু দেখতে দেখতে নাকটা ফুলে ঢোল হয়ে উঠল। বাড়িটা সেদিন অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতায় থমথম করতে লাগল। ভাড়াটেরা যে-যার রান্না- খাওয়া শেষ করে ফেললে। উঠোনে আমাদের তোলা উনুন জ্বলে জ্বলে নিবে গেল। আমরা দুজনে পাশাপাশি শুয়ে, কিন্তু ক্লান্তিতে অবসন্ন। অবশেষে দুজনেই পাশবালিশ জড়িয়ে শুয়ে পড়লুম।
রসিয়ার মা’র গলার আওয়াজে যখন ঘুম ভাঙল, তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। ঘুম ভাঙতেই মনে হতে লাগল, যেন ভোর হয়ে গিয়েছে।
গুরুমা তখনও দরজা খোলেননি। ঘণ্টাখানেক ধরে ডাকাডাকি করে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আমরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম।
চৌকে গিয়ে দুজনে দুভাড় সিদ্ধি খাওয়া গেল। সারাদিন পেটে ভাত পড়েনি। একটা খাবারের দোকান থেকে পুরি-কচৌড়ি খেয়ে বিশ্বনাথ দর্শন করে ঘণ্টা-দুয়েক রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে অবসাদটা কাটিয়ে যখন বাড়ি ফিরলুম, তখন আটটা বেজে গিয়েছে।
গুরুমা তখনও দরজা খোলেননি। দরজায় দমাদ্দম ধাক্কা মারতে শুরু করে দিলুম। চেঁচিয়ে বললুম, দরজা না খুললে কোতোয়ালকে খবর দেব, তারা এসে দরজা ভেঙে ফেলবে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দই পেলুম না, আমরা নিজেদের ঘরে গিয়ে অন্ধকারে বসে রইলুম, কারণ গুরুমার ঘরে তেল থাকে, তাই আমাদের ঘরে প্রদীপ জ্বলেনি।
রাত্রি ভোর হল। রসিয়ার মা’র কাছে শুনলুম, গুরুমা নাকি শেষরাত্রির দিকে একবার মিনিট-পাঁচেকের জন্যে দরজা খুলে বেরিয়েছিলেন। আমরা মুখ-টুখ ধুয়ে খানিকক্ষণ দরজা-ধাক্কাধাক্কি করলুম, কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াই পেলুম না।
ব্যাপারটা ক্রমেই গুরুতর হয়ে দাঁড়াতে লাগল। কাল সারাদিন গুরুমা জলগ্রহণ করেননি, আজও সারাদিন তেমনই কাটল। সমস্ত দিন ধরে দরজা ধাক্কাধাক্কি করে কোনো সাড়া না পেয়ে সন্ধের পর বেরিয়ে গিয়ে আমরা বাজার থেকে খাবার খেয়ে এলুম। সেদিন পরিতোষ বললে, যাবার সময় জয়া-গিন্নি তাকে কুড়িটা টাকা দিয়ে গিয়েছে।
বাড়িতে ফিরে এসে বিছানার ওপরে দুজনে মুখোমুখি হয়ে বসে রইলুম। কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারলুম না। ঘণ্টাখানেক এইভাবে কাটাবার পর বাঙাল-মা উঁকি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি দাদারা, অন্ধকারে বসে কি করছ? চল, ওপরে গিয়ে বসি। বাঙাল-মা’র সঙ্গে ওপরে উঠে গেলুম। প্রদীপ জ্বালিয়ে আমাদের দুজনকে তাঁর দু’পাশে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?
বললুম, বাজার থেকে কিছু খাবার কিনে খেয়েছি।
বাঙাল-মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফিসফিস করে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ছেনাল মাগি দরজা খুলেছিল?
ঘাড় নেড়ে জানালুম, না।
বাঙাল-মা বললেন, তোরা বাড়ি থেকে না গেলে ও দরজা খুলবে না।
বাঙাল-মা অতি মৃদুস্বরে বললেন বটে, কিন্তু কথাগুলোর গুরুত্ব এত বেশি যে, পরিতোষ–যে কানে শুনতে পায় না–সেও চমকে উঠে বললে, সে কি!
বাঙাল-মা দয়ার্দ্র-কণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ দাদু, তাই তো মনে হচ্ছে। তোমরা তো আর প্রথম নও, এই কাণ্ডই তো দেখে আসছি বরাবর।
আমরা আর কথা কইতে পারলুম না। বাঙাল-মা গোটা দুই-তিন মোটা কাঁথা এনে আমাদের দুজনের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে নিজে মাঝখানে বসলেন। সেই দয়াবতী নারী–সারাজীবন দুঃখের সঙ্গে সংগ্রাম করতেই যাঁর জীবন কেটেছে–আমাদের মনে যে কি ঝড় উঠেছে, তা বুঝতে পেরে আশ্বাস দিতে লাগলেন। তিনি বলতে লাগলেন, কোনো ভয় নেই দাদু, ভগবান আছেন, তিনি তোদের রক্ষা করবেন। একবার ভেবে দেখ, সহায়সম্পদহীনা বিধবা আমি এই নির্বান্ধব দেশে সারা জীবন তো কাটিয়ে দিলুম, সুখে-দুঃখে কেটে তো গেল।
পরিতোষ বললে, বোধহয় ওর বোনপোকে আমরা মেরেছি বলে চটে গিয়েছে।
বাঙাল-মা একটা ঘৃণার ‘হেঁ” উচ্চারণ করে বললেন, ওর চোদ্দপুরুষের বোনপো! না না, ও-মাগির চিরকেলে স্বভাবই ওইরকম। আমি তো ওকে আজ নতুন দেখছি না!
বাঙাল-মা রাজকুমারীর ইতিহাস বলতে লাগলেন–
অনেক–অনেক দিন আগে এই বাড়িতে শাহুমশায় নামে এক ভদ্রলোক বাস করতেন। ঢাকা অঞ্চলে বাড়ি ছিল, নিজের বড় কারবারও ছিল। ছেলে ছিল না, একমাত্র মেয়ে, সেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঘরজামাই রেখেছিলেন। সেই সময় ঢাকার দিকে প্রতিবৎসরই কলেরায় মড়ক লাগত। একবার ওই ব্যামোয় স্ত্রী ও জামাই মারা যাওয়ায় শাহুমশায় ব্যবসাপত্র তুলে সব বেচে পুঁজিপাটা ও মেয়ে নিয়ে এলেন কাশীবাস করবেন বলে। এখানে এসে খান-তিনেক বাড়ি কিনে ভাড়াটে বসিয়ে নিজে এই বাড়িটাতে বাস করতে লাগলেন। শাহুমশায় জাতিতে গন্ধবণিক। তাঁর মতন সচ্চরিত্র লোক এখানে বাঙালিদের মধ্যে খুব কমই ছিল। কত ব্রাহ্মণের ছেলে তাঁর পায়ের ধুলো নিত, তার ঠিকানা নেই।
স্বামীজী অর্থাৎ ত্রৈলঙ্গস্বামী তখনও বেঁচে। শাহুমশায় গিয়ে তাঁর শিষ্য হলেন। মেয়ের নাম ছিল তরঙ্গিণী। কিছুদিন যেতে-না-যেতে শাহুমশায় তরঙ্গিণীকে নিয়ে স্বামীজীর কাছে যেতে আরম্ভ করলেন। মাসকয়েক বাদেই শুনলুম তরঙ্গিণীও তাঁর শিষ্যা হয়েছে, অথচ কাশীতে এসে অবধি আমরা শুনতুম স্বামীজী কারুকেই শিষ্য কিংবা শিষ্যা করেন না।
বাপ-বেটীতে গেরুয়া পরে সাধন-ভজন আরম্ভ করে দিলে। একদিন দু’দিন অন্তর খায়, সারা দিনরাত দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে সাধন-ভজন করে।
তরঙ্গিণীর নানারকম বিভূতি দেখা দিতে লাগল। যাকে যা বলে, তাই ফলে যায়। কাশীসুদ্ধ মেয়েমদ্দ সেই গন্ধবণিকের মেয়ের পায়ে লুটিয়ে পড়তে লাগল। ইতিমধ্যে রটে গেল, স্বামীজী নাকি বলে দিয়েছেন–তরঙ্গিণী এই জন্মেই সিদ্ধিলাভ করবে। সেইসঙ্গে এ-কথাও রটে গেল যে–শাহুমশায়ের সিদ্ধিলাভ হবে, তবে এখনও দেরি আছে। তার নাকি এ-জন্ম ছাড়া আরও দুবার জন্মাতে হবে, তবে মুক্তিলাভ হবে।
তরঙ্গিণীর অনেকরকম বিভূতি থাকা সত্ত্বেও অনেক লোক মনে মনে তার বাবা শাহুমশায়কেই ভক্তিশ্রদ্ধা করত বেশি। তারা মনে করত যে, তিনি মেয়ের চাইতে অনেক উঁচুতে উঠে গেছেন বলেই বিভূতি-টিভূতিগুলো চেপে রেখে দিয়েছেন; কিন্তু মুক্তি পেতে দেরি আছে শুনেই তাঁর প্রতি ভক্তির মাত্রা লোকের মনে একেবারে কমে গেল, রাজ্যসুদ্ধ লোক এসে পড়ল তরঙ্গিণীর পায়ে।
যশের মজাই এমন, তরঙ্গিণীও মনে করতে লাগল যে, সে তার বাপের চাইতে অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। তারা যখন প্রথমে কাশীতে আসে, তখন শাহুমশায় বলতেন যে, তাঁর মেয়ে সতেরো বছর বয়সে বিধবা হয়েছিল। কিন্তু তরঙ্গিণী এখন বলতে লাগল যে, স্বামী যখন মারা যায় তখন তার মাত্র আট বছর বয়স ছিল, অর্থাৎ সে আজন্ম ব্রহ্মচারিণী।
মেয়ের হালচাল দেখে বাপের মনেও প্রতিযোগিতার ঈর্ষা অঙ্কুরিত হতে লাগল। তিনি দিনরাত সাধন-ভজনের দিকে মন দিলেন। এক-একবার এমনও হয়েছে যে, সাত দিন তিনি দরজা বন্ধ করে থেকেছেন। তিন জন্মের কর্মফল এক জন্মে কাটিয়ে উঠতে পারা যায় কি না তারই মহলা চলতে লাগল।
তারপর একদিন, ওই লক্ষ্মীমণি এখন যে ঘরে থাকে, সেই ঘরের দরজা ভেঙে দেখা গেল, মাথার শিরা ছিঁড়ে শাহুমশায়ের মৃত্যু হয়েছে।
শহরময় বাঙালিদের মধ্যে হৈ-হৈ পড়ে গেল। তরঙ্গিণী চন্দনকাঠ দিয়ে বাপের শব দাহ করলে।
বাপের শ্রাদ্ধশান্তি সমারোহের সঙ্গে হয়ে যাবার পর তরঙ্গিণী একদিন তার শিষ্য-টিষ্য নিয়ে স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করতে গেল। কিন্তু মহাপুরুষদের চেনা মুশকিল। সেদিন সকলের সামনেই তিনি তরঙ্গিণীকে বলে দিলেন, কে তুই? তোকে তো চিনতে পারছি না!
তরঙ্গিণী কাঁদতে কাঁদতে বললে, আমার বাবা মারা গিয়েছেন–
কিন্তু স্বামীজী তাকে গ্রাহ্যই করলেন না।
শিষ্য-শিষ্যা ও অনুগতদের সামনে এইভাবে অপমানিত হয়ে তরঙ্গিণী গেল মহা চটে। সেও সকলের সামনেই স্বামীজীকে যাচ্ছেতাই করে গালাগালি দিতে দিতে সেখান থেকে চলে এল। সেদিন স্বামীজীকে তাঁর এক ভক্ত খাওয়াচ্ছিল। তিনি তরঙ্গিণীর কথার কোনো জবাব না দিয়ে নিজের মনে খেয়ে যেতে লাগলেন।
তরঙ্গিণী তো রেগে-মেগে সেখান থেকে চলে গেল। তার সাধন-ভজন চুলোয় গেল, বাড়িতে লোক এলেই সবার কাছে স্বামীজীকে গালাগালি দেওয়াই হল তার একমাত্র কর্ম।
কিছুদিন এমনই চলল। তারপর একদিন আপনা থেকেই তার বাড়িতে এক সন্ন্যাসী এসে হাজির হলেন। অদ্ভুত ছিলেন এই সন্ন্যাসী, আর অদ্ভুত ছিল তাঁর শক্তি! তিনি ছিলেন বাঙালি; কিন্তু কোথায় বাড়ি, কার শিষ্য, তা আমরা কেউ জানতে পারিনি। হঠাৎ কোথা থেকে একদিন তরঙ্গিণীর বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়ে বললেন, বেটী, আমি তোকে দীক্ষা দেব।
তরঙ্গিণী ছিল অতিশয় দাম্ভিকা, কিন্তু সন্ন্যাসীর কথা শুনে সে তখুনি একেবারে তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে বললে, বাবা আমায় রক্ষে কর।
এই সন্ন্যাসী তরঙ্গিণীকে নতুন করে দীক্ষা দিলেন। সারারাত্রি সন্ন্যাসী একটা ঘর বন্ধ করে তরঙ্গিণীকে কি-সব শেখাতেন। অনেকে ওঁদের নামে অপবাদ রটাতে লাগল; কিন্তু সত্যিকথা বলতে কি, এই সন্ন্যাসীর আওতায় আসার পর তরঙ্গিণীর শক্তি দশগুণ বেড়ে গেল।
বাঙাল-মা বলে চললেন, এই সন্ন্যাসীকে আমি দেখেছি, আমায় তিনি বড় স্নেহ করতেন। আমায় বলতেন, তুইও যোগিনী, তবে নিজেকে চিনতে পারিসনি।
আমার মা কিন্তু মুখে কিছু না বললেও বেশ বুঝতে পারতুম, তাঁর কাছে যাওয়া-আসা করাটা বিশেষ পছন্দ করতেন না।
এই সন্ন্যাসী ছিলেন তান্ত্রিক। তিনি কখনও থাকতেন কামাখ্যায়, কখনও বা হাজারিবাগের জঙ্গলে ছিন্নমস্তার মন্দিরে, কখনও কাশীতে, কখনও বা চলে যেতেন হিমালয়ে, যেখানে তাঁর গুরু থাকতেন। কখনও রেলে চড়তেন না, যেখানে যাবার দরকার হাওয়ায় উড়ে চলে যেতেন!
এতক্ষণ চলছিল মন্দ নয়। কিন্তু বাতাসে চড়ে ঘোরাফেরার কথা শুনে আমাদের হাসি পেল; কারণ কোনো অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত ঘটনাতে যথোচিত লবণসহযোগে গ্রহণ করাই আমাদের সংস্কারের মধ্যে দাঁড়িয়ে দিয়েছিল। তার ওপরে আমাদের গোষ্ঠীপতি মহাত্মা রামমোহন প্ৰকাশ করে গিয়েছিলেন যে, দুর্বলাধিকারিগণের পক্ষে মূর্তিপূজাই প্রশস্ত; এ স্বতঃসিদ্ধ অনুসারেই মূর্তিপূজকদের আমরা দুর্বলাধিকারী বলেই জ্ঞান করতুম এবং সেইসঙ্গে নরাকার সগুণ ব্রহ্মোপসাকদের বংশধর হওয়ার ফলে নিজেরাও যে এক-একটি সবল-অধিকারী–এ জ্ঞানও ছিল টনটনে। এহেন সবল অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও চলতে-ফিরতে রাহাখরচ দিতে দিতে আমাদের প্রাণান্ত হতে হয়, আর কোথাকার কে একজন মূর্তিপূজক, তান্ত্রিক, দুর্বলাধিকারী–সে কিনা হাওয়ায় চড়ে বিনা পয়সায় ঘোরাফেরা করে, এতবড় গুলটি গিলতে গলায় বেধে গেল। একটু শ্লেষের সঙ্গে হেসে জিজ্ঞাসা করলুম, খুব গাঁজা-টাজা টানতেন বুঝি?
বাঙাল-মা বললে, গাঁজা খেতে তো কখনও দেখিনি, তবে দিনরাত কারণ চলত।
তাহলে সাঁতার কেটে যাতায়াত করতেন বলুন।
এতক্ষণে বাঙাল-মা আমাদের রসিকতা বুঝতে পেরে জিভ কেটে বললেন, দাদু, মহাপুরুষদের নিয়ে অমন ঠাট্টা করতে নেই, অমঙ্গল হয়। আমার কথা বিশ্বাস না হয় তো ওই রসিয়ার মাকে জিজ্ঞাসা করিস। ও সেই তরঙ্গিণীর আমলের ঝি, ওর চোখের সামনেই সেসব ঘটনা ঘটেছে।
একদিন, শীতকাল, রাত্রি বারোটা অবধি সন্ন্যাসীর কাছে বসে আছি, তিনি আমাদের উপদেশ দিচ্ছেন আর মড়ার খুলিতে কারণ ঢেলে ঢেলে খাচ্ছেন, এমন সময় আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বলে উঠলেন, কি হয়েছে? অ্যাঁ, অসুখ? বাঁচবে না? আচ্ছা, আমি যাচ্ছি, কোনো ভয় নেই।
সেদিন রাত্রি গম্ভীর হয়ে পড়ায় তরঙ্গিণী আমাদের বাড়ি যেতে দিলে না। আমরা সন্ন্যাসীর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সারারাত্রি সবাই মিলে বাকি রাতটুকু জেগে-জেগেই কাটিয়ে দিলুম। সন্ন্যাসী দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বাতি নিবিয়ে দিলেন। অতি প্রত্যূষে তিনি ও তরঙ্গিণী গঙ্গা নাইতে যেতেন। সেদিন আমরা ঠিক করলুম, তাঁদের সঙ্গে গঙ্গাস্নান করে যে-যার বাড়ি চলে যাব কিন্তু কি আশ্চর্য! সকালবেলা উঠে দেখা গেল, ঘরের মধ্যে সন্ন্যাসী নেই। প্রায় তিন মাস বাদে একদিন ‘কালী’ ‘কালী’ বলে চিৎকার করতে করতে কোথা থেকে সন্ন্যাসী এসে হাজির হলেন।
আর একবার, আমার মা মারা যাবার অনেক পরে, একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলুম, বাবা, আমার শ্বশুরবাড়ির খবরাখবর জানতে ইচ্ছে করে, অনেককাল সেখানকার কোনো সংবাদ পাইনি।
তিনি বললেন, আচ্ছা, কাল আসিস, বলে দেব।
পরদিন সকালবেলা তাঁর কাছে যাওয়া মাত্র তিনি বললেন, ওরে, তোর ছোটভাশুরের যক্ষ্মা হয়েছে, সে আর বাঁচবে না, মাসখানেকের মধ্যেই মারা যাবে।
পরে জানতে পেরেছিলুম, তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য।
সন্ন্যাসীর সব ভালো ছিল, কিন্তু ত্রৈলঙ্গস্বামীকে সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর নাম শুনলেই বলতেন, ও ব্যাটার পেটসর্বস্ব! কিছু বিভূতি-টিভূতি আছে এই যা–না হলে ও কিছুই নয়। বেশ চলছিল, এমন সময় এক ব্রাহ্মণ এসে তরঙ্গিণীর দোতলায় একখানা ঘর ভাড়া করলে। ব্রাহ্মণের কোনো কুলে কেউ ছিল না, স্ত্রী কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছে, সঙ্গে একটি বছর আষ্টেকের মেয়ে।
সন্ন্যাসী তখন এখানে ছিলেন না। মাস কয়েকের মধ্যেই ফিরে আসব বলে কোথায় চলে গিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণের নাম ছিল যদু মুকুটী। অতি সাত্ত্বিক লোক, দু-বেলা গঙ্গাস্নান, পূজা-অর্চনাতেই দিন কাটে–ব্রাহ্মণ হয়েও তিনি তরঙ্গিণীর পাদোদক খেতেন। শুধু তাই নয়, চাকরের মতন তার সেবা করতেন।
বছর-দুয়েক এইভাবে কাটল, কিন্তু সন্ন্যাসীর দর্শন নেই। তরঙ্গিণীই যোগাড়যন্ত্র করে নিজের টাকা খরচ করে মুকুটীমশায়ের মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলে। সেই মেয়েরই ছেলে ওই বদ্যিনাথ, যে আজ সকালে তোদের সঙ্গে মারামারি করতে এসেছিল।
আরও প্রায় বছর দুই এইভাবে চলল, তখনও সন্ন্যাসীর দেখা নেই। তরঙ্গিণী কিন্তু বলত, গুরুদেব নিশ্চয়ই আসবেন, মরবার আগে তাঁর সঙ্গে আর একবার দেখা হবেই। তার যশ দিনে দিনে বেড়েই চলল, এমন সময় শোনা গেল যে, সে মৌনব্রত অবলম্বন করেছে, কারুর সঙ্গে দেখা করবে না, কিছুকাল নির্জন সাধনা করবে। একেবারে সিদ্ধ না হলে আর লোকালয়ে মুখ দেখাবে না।
তরঙ্গিণী আর কারুর সঙ্গে দেখা করে না। তার ঘরে কারুর ঢোকবার হুকুম নেই, যদু ঠাকুর ছাড়া। আমরা রোজই আসি আর নীচে থেকেই তার সংবাদ নিয়ে চলে যাই। তার ওপরে আমাদের শ্রদ্ধার মাত্রা দিনে দিনে বেড়েই চলল। তারপর গ্রীষ্মের এক রাত্রিশেষে ছাদের ওপরে সারারাত এপাশ-ওপাশ করে প্রতিবেশীদের চোখে সবে একটু তন্দ্রার ঘোর লেগেছে মাত্র, এমন সময় সদ্যোজাত শিশুকণ্ঠের চিৎকারে তরঙ্গিণীর সিদ্ধাই-লাভের সংবাদ মহল্লাময় ঘোষিত হতে লাগল। কৌতূহলী প্রতিবেশিনীরা চমকে বিছানায় উঠে বসল, তারপর সবাই ছুটল তার বাড়ির দিকে। সবাই এসে দেখলে তরঙ্গিণীর ঘরের দরজার চৌকাঠে মুকুটীমশায় গালে হাত দিয়ে উদাসভাবে বসে আছেন। ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখা গেল মেনকার পাশে শকুন্তলার মতন তরঙ্গিণীর পাশে একটি শিশুকন্যা পড়ে আছে একরাশ জুঁইফুলের মতন।
সকাল হতে-না-হতে কাশীময় টি-টি পড়ে গেল–সকলের মুখেই ছি-ছি! সবাই বলতে লাগল, সন্ন্যাসিনীর এমন পতনের নজির নাকি মহাভারতেও নেই, মুকুটীর মতন পাষণ্ড সংসারে দুর্লভ।
আমরা তিন-চারটি বিধবা ছাড়া আর সকলেই তরঙ্গিণীকে পরিত্যাগ করলে। সে আমার গুরু হলেও ছিল আমার বন্ধু। এতখানি বয়স হল আমার, কিন্তু তার মতো মেয়ে আমি আর দুটি দেখিনি।
তরঙ্গিণী কিন্তু বিছানা থেকে উঠল না। সন্তান হবার আগে থাকতেই তার অসুখ করেছিল, সন্তান জন্মাবার পর সে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। পুরো একটা বছর ভুগে ভুগে অস্থিচর্মসার হয়ে যায় যায় এমন অবস্থা, সেই সময় হঠাৎ একদিন ‘কালী’ ‘কালী’ চিৎকার করতে করতে সন্ন্যাসী কোথা থেকে এসে হাজির হলেন। আমাদের মুখে সব বৃত্তান্ত শুনে তিনি বললেন, বেশ হয়েছে, এই তো চাই।–বলে তার ঘরে ঢুকলেন।
তরঙ্গিণী পাশ ফিরতে পারত না, সে তবুও উঠে গুরুদেবের পায়ের ধুলো নিয়ে একেবারে এলিয়ে পড়ল। সন্ন্যাসী তার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, কিছু ভয় নেই মা, নির্ভয়ে চলে যা।
তরঙ্গিণী আবার উঠে মেয়েটিকে সন্ন্যাসীর কোলে তুলে দিয়ে লুটিয়ে পড়ল বিছানায়-আর তার জ্ঞান হল না। চব্বিশ ঘণ্টা অজ্ঞান হয়ে থেকে সে চলে গেল।
.
তরঙ্গিণীর মৃত্যুর পর সন্ন্যাসী তার মেয়েটিকে কোলে করে নীচে নেমে গিয়ে ওই ঘরটিতে আশ্রয় নিলে, যেখানে আজ লক্ষ্মীমণি থাকে। সন্ন্যাসীই ওর নাম দিয়েছিলেন লক্ষ্মীমণি। সন্ন্যাসী ওকে মানুষ করতে লাগলেন, আর যদু মুকুটী দিনরাত, যে ঘরে তরঙ্গিণী মারা গিয়েছিল, সেই ঘরের দরজা বন্ধ করে সাধনা আরম্ভ করে দিলেন। লোকে বলতে লাগল, তরঙ্গিণী অদ্ভুত স্ত্রীলোক ছিল, সন্ন্যাসীকে করে গেলে গৃহী আর গৃহস্থকে করে গেল সন্ন্যাসী।
সেই থেকে সন্ন্যাসী এখানেই থেকে গেলেন। তিনি লক্ষ্মীমণিকে লেখাপড়া শেখাতে লাগলেন। মেয়েটার ছিল অদ্ভুত বুদ্ধি, পাঁচবছর বয়সেই বাংলা লিখতে-পড়তে শুরু করে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, তখনই অনেক সংস্কৃত কবিতা মুখস্থ বলতে পারত–সন্ন্যাসীই ওকে শিখিয়েছিলেন।
লক্ষ্মীমণির যখন আট বছর বয়েস, তখন সন্ন্যাসী খুব ধুমধাম করে তাকে দীক্ষা দিলেন –সে তো সেদিনকার কথা। তারপর কিছুদিন যেতে-না-যেতেই ওর মধ্যে অদ্ভুত সব বিভূতি প্রকাশ পেতে লাগল। লোক দেখলেই ও বলে দিতে পারত, কি তার নাম, কোথা থেকে সে আসছে, কোথায় তার বাড়ি, তার সারা-জীবনের ইতিহাস গড়গড় করে বলতে থাকল। পুরনো দিনের অনেকেই তখন মরে গিয়েছে, নতুন লোকের ভিড়ে আবার বাড়ির উঠোন দিনরাত ভর্তি হয়ে উঠতে লাগল–সকলেই নিজের ভবিষ্যৎ জানতে চায়। বারো বছরের মেয়ে লক্ষ্মামণির পায়ে কাশীসুদ্ধ লোক লুটিয়ে পড়তে আরম্ভ করলে।
এই সময় একদিন সন্ন্যাসী যদু মুকুটীকে ডেকে বললেন, আমি চললুম, আর আমি আসব না। লক্ষ্মীকে মানুষ করে দিয়ে গেলুম–ওর বিয়ে দিসনি।
সন্ন্যাসী চলে গেলেন। মুকুটীমশায় আবার ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। সেই থেকে ওই বারো বছরের মেয়ে ভাড়াটেদের তদারক, বাপের সেবা, সংসারের সব কিছু দেখতে আরম্ভ করে দিলে। মাঝে মাঝে মুকুটীমশায়ের মেয়ে অর্থাৎ ওই বদ্যিনাথের মা, এখানে সব তদারক করতে আসত বটে, কিন্তু লক্ষ্মীমণি তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত। সেই বয়স থেকেই ওর এমন একটা ভারিক্কি চাল ছিল যে, বুড়োরা পর্যন্ত ওর কাছে ঘেঁষতে পারত না।
লক্ষ্মীমণির যখন প্রায় আঠারো বছর বয়েস, তখন ওর বাপ মুকুটীমশায় মারা গেলেন। তরঙ্গিণী যাবার আগে কাশীর তিনখানা বাড়ি, আর কেউ-বা বলে লাখ কেউ-বা বলে পঁচাত্তর হাজার টাকার কোম্পানির কাগজ মুকুটীমশায়কে লিখে দিয়ে গিয়েছিল। মুকুটীমশায় একখানা বাড়ি বদ্যিনাথের মাকে দিয়ে বাকি সমস্ত বিষয় লক্ষ্মীমণিকে দিয়ে গেলেন। সেই থেকে ও নিজের সমস্ত বিষয়-আশয় দেখছে ও আপন-মনে সাধন-ভজন করে চলেছে। ওর সব ভালো, কিন্তু ঐ এক দোষ–ঐ এক দোষেই ও সর্বনাশ করেছে। মাঝে মাঝে দেহজ্বরে ওকে বড় কাবু করে ফেলে। সেইসময় রাস্তা থেকে এই তোদের মতন ছোট ছোট ছেলে ধরে নিয়ে এসে ওষুধস্বরূপ তাদের ব্যবহার করে নইলে ওর মতন মেয়ে পৃথিবীতে দুটো মেলে না। এইজন্যে কাশীসুদ্ধ লোক ওর ওপরে চটা। তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর মন্ত্রশিষ্যার এহেন বৈষ্ণবজনোচিত ব্যবহার লোকের সহ্য হয় না।
প্রায় এক-নাগাড়ে ঘণ্টা-দেড়েক বকবক করে বাঙাল-মা এবার চুপ করলেন। শীতের রাত্রি, কাশীর গলি একেবারে নিস্তব্ধ–মাঝে মাঝে কাছে দূরে প্যাচার কর্কশ চিৎকার শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের মুখে কোনো কথা নেই, মাঝে মাঝে পরিতোষ করুণ চোখে আমার ও বাঙাল-মার মুখের দিকে চাইছে। বাঙাল-মা এতক্ষণ ধরে যা বললেন, তা সবই সত্যি, আমাদের কাছে মিথ্যে বলবার ‘তাঁর কি প্রয়োজন! কিন্তু তবুও, কি জানি কেন, আমার মনে হতে লাগল–এতদিন যা হয়েছে তা হয়েছে, আমার সঙ্গে রাজকুমারী সেরকম ব্যবহার কখনও করবে না। যক্ষ্মারোগে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী-এ কথা সর্বজনবিদিত। তবু যারই যক্ষ্মা হয়, এমনকি চিকিৎসকেরও যক্ষ্মা হলে, সে মনে করে, অন্য সবার বেলা যাই হয়ে থাক না কেন, সে বেঁচে যাবে। সে রোগের লক্ষণই তাই।
অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকবার পর আমি বাঙাল-মাকে বললুম, গুরুমা আমাদের বলেছে যে, তোরা আমার কাছ থেকে যেতে পাবি না। আমি তোদের ব্যবসা করে দেব, তোরা এইখানেই থাক্, আমি তোদের ছাড়ব না।
আমার কথা শুনে বাঙাল-মা খানিকটা হি-হি করে হেসে নিয়ে বললেন, দাদু, জ্বর যত বেশি হয়, রুগি তত বেশি ভুল বকে। বিকারের ঘোরে মুখ দিয়ে যত কথা বেরোয়, তা কি বিশ্বাস করতে আছে?
রাত্রি প্রায় দশটার সময় তেতলা থেকে নীচে নেমে এলুম। নিজেদের ঘরে ঢুকে দেখি, প্রদীপ জ্বলছে আর রসিয়ার মা আমাদের খাটের কাছে বসে ঢুলছে। আমরা ঘরে ঢুকতেই রসিয়ার মা চমকে উঠল, তারপর একটু আড়মোড়া ভেঙে আমাদের কাছে এসে নিম্নস্বরে বললে, তোমরা কাল চলে যাচ্ছ তো?
পরিতোষ জিজ্ঞাসা করলে, কেন?
তোমরা না গেলে তো ও দরজাও খুলবে না, খাবেও না। লোকটা কি শেষে মরে যাবে? পরিতোষ কি বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে, রাজকুমারী যাতে শুনতে পায় এমন উচ্চকণ্ঠে বললুম, হ্যাঁ, আমরা কাল সকালে চলে যাব। তোমার মনিবকে বোলো যে, আমরা ভিখিরি নই। সে-ই আমাদের পথ থেকে সেধে ডেকে নিয়ে এসেছিল। ভদ্রলোকের ছেলেদের ডেকে নিয়ে এসে চাকর দিয়ে এমন করে অপমান করে তাড়িয়ে দেবার কোনো দরকার ছিল না, আমাদের বললেই আমরা চলে যেতুম।
রসিয়ার মা জবাব দেবার আর কোনো কথা না পেয়ে গজগজ করে কি বকতে বকতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমরা খাটের ওপরে উবু হয়ে বসে ভাবতে লাগলুম। পরিতোষ কি ভাবছিল জানি না, আমার মনের মধ্যে পুঞ্জ পুঞ্জ অভিমানের মেঘ ঘনিয়ে উঠতে লাগল। রাজকুমারীর প্রতিটি কথা, তার প্রতি অঙ্গভঙ্গি, এতদিন ধরে এত প্রতিজ্ঞা ও আশ্বাস, থাকবার জন্য এত অনুনয় ও অনুরোধ এত ভালোবাসা–এ কি সব অভিনয়! তবু, কেন জানি না, মনে হতে লাগল, এ কখনও হতে পারে না, এ হবে না। এখুনি রাজকুমারী মাঝের দরজা খুলে ঘরের মধ্যে এসে আমাকে বলবে, গোপাল, এ ক’দিন বড় কষ্ট হয়েছে, না? কিন্তু আমার সমস্ত অনুমান ব্যর্থ করে ও-ঘরের ঘড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেজে যেতে লাগল। শেষকালে পরিতোষ আমাকে ধাক্কা দিয়ে বললে, শুয়ে পড়, মিছে রাত জেগে কি হবে?
পরিতোষ শুয়ে পড়ল। আমিও খাট থেকে নেমে প্রদীপটা নিবিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লুম। শুয়ে পড়লুম বটে, কিন্তু ঘুম কোথায়! অভিমানক্ষুব্ধ হৃদয় নিঙড়ে নিঙড়ে অশ্রুধারা গলে পড়তে লাগল বালিশের ওপর। তবু, আশ্চর্য মানুষের মন! ওরই মধ্যে আশা-কুহকিনী সান্ত্বনা দিতে আরম্ভ করলে–কোনো ভয় নেই, এত বড় বিশাল পৃথিবীর মধ্যে কোথাও কোনো-না-কোনো জায়গায় একদিন-না-একদিন বন্ধুর দেখা পাবেই পাবে, এই ক্ষতবিক্ষত অন্তরের সমস্ত সত্তাপ সে জুড়িয়ে দেবে।
হায়! তার দেখা কি কখনও পাব?
কাঁদতে কাঁদতে কোন সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম তা জানতেও পারিনি। ভোর হতে-না-হতে পরিতোষ ঠেলে তুলে দিলে। মুখ ধুয়ে আমরা নিজেদের কাপড়-চোপড়গুলো পুঁটলি করে বেঁধে নিলুম। রাজকুমারী আমাদের একজোড়া করে ধুতি আর একখানা করে টুইলের শার্ট কিনে দিয়েছিল। সেগুলোকে বিছানার ওপর রেখে দিয়ে আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লুম।
তখন ভাড়াটেরা অথবা রসিয়ার মা কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। আমরা সোজা চলে যাচ্ছিলুম সদর-দরজার দিকে। যেতে যেতে দেখলুম, রাজকুমারীর দরজা তেমনি বন্ধ রয়েছে। চলতে-চলতে হঠাৎ পরিতোষ ফিরে গিয়ে রাজকুমারীর দরজার চৌকাঠে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে আমাকে বললে, যাবার আগে একটা প্রণাম করে চল।
আমি আর আপত্তি না করে হাঁটু গেড়ে রাজকুমারীর ঘরের চৌকাঠে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলুম। আমার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল ঝরঝর করে সেই চৌকাঠের ওপর ঝরে পড়ল। তার পর উঠে নিঃশব্দে সদর-দরজা খুলে দুই বন্ধুতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম।
আজও কতদিন স্বপ্নে দেখি, রাজকুমারীর দরজা তেমনই বন্ধ রয়েছে আর তার চৌকাঠের ওপর আমার সেই অশ্রুজল টলটল করছে।
রাস্তায় বেরিয়ে পড়া গেল, কিন্তু যাই কোথায়? এতদিন পরে অতি দুঃখের দিনের বন্ধু গিরিধারীর কথা মনে পড়ল। দু-তিন ঘণ্টা এদিক-সেদিক ঘুরে বেলা দশটা নাগাদ গিরিধারীর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলুম। শুনলুম, সে বাড়িতে নেই, কে একজন ধনী মক্কেলকে আনতে ভোরবেলাতেই মোগলকা-সরাই চলে গিয়েছে, ফিরতে তিনটে-চারটে বেজে যাবে।
.