এ কথাগুলি শিবরামের নয়। এ কথা পিঙলা অর্থাৎ পিঙ্গলার; পিঙলাই হল শবলার পরে সাঁতালী গাঁয়ের বেদেকুলের নতুন নাগিনী কন্যা। এই পিঙলাই শিবরামকে শবলার এই কাহিনী বলেছিল।
বলতে বলতেই পিঙলা বলে–মায়ের লীলা। বেদেকুলের মা বলতে বিষহরি, বেদেদের অন্য মা নাই। কালী না, দুর্গা না—কেউ না। বেদেদের বাপ বলতে শিব। শিবের মানস থেকে মা-বিষহরির জনম গ। পদ্মবনের মধ্যে শিবের মনের থেকে জন্ম নিয়া পদ্মপাতের মধ্যে ধীরে ধীরে মা বড় হয়্যা উঠলেন। মায়ের আমার পদ্মবনে বাস-অঙ্গের বরন পদ্মফুলের মত। শিবঠাকুরের মধুপান কর্যা নেশা হয় না, তাই শিবের কন্যা পদ্মবনে পদ্মমধু পান করলেন, সেই কন্যের কণ্ঠে–অমৃতের থেকা মধু হইল; তখন সেই মধু খাইলেন শিব। সেই মধুতে তার কণ্ঠ। হল নীল বরন, মধুর পিপাসা মিট্যা গেল চিরদিনের তরে; চক্ষু দুটি আনন্দে হল ঢুলুঢুলু! শিবের কন্যে পদ্মাবতী পদ্মের মত দেহের বরন, তেমনি তার অঙ্গের সৌরভ, মা হলেন চিরযুবতী।
এই মায়ের পূজার ভার যার উপরে, তার কি বুড়ো হইবার উপায় আছে গ? যুবতী মায়ের পূজা করবে যুবতী কন্যে। তবে সে কালনাগিনী বলে তার অঙ্গের বরন হবে কালো। চিকন চিকচিকে কালো মনোহরণ করা কালোবরন। সেই কারণে এক নাগিনী কন্যে বর্তমানেই নতুন নাগিনী কন্যের আবির্ভাব হয়। সেই আবির্ভাব শিরবেদের চক্ষে ধরা পড়ে। কন্যে অনাচার করে, কন্যে বুড়ি হয়—কত কারণ ঘটে; তখন শিরবেদে মনে মনে মায়েরে ডাকে। অ্যাঁধার বর্ষার রাত্রে কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথিতে আকাশে ঘনঘটা করে মেঘ ওঠে; থমথম করে চারিদিক, শিরবেদে আকাশপানে তাকায়। মিলিয়ে নেয় যে রাত্রে বেদেদের সর্বনাশ হয়েছিল সেই রাত্রির সঙ্গে। ওগো, যে রাত্রে লোহার বাসর ঘরে লখিন্দরকে কালনাগিনী দংশন করেছিল—সেই রাত্রের সঙ্গে গ! মেঘের ঘনঘটার মধ্যে মা-বিষহরির দরবার বসে। সামনে আসছে বর্ষা; পঞ্চমীতে পঞ্চমীতে নাগজননীর পূজা; মা দরবার করে খবর নেন—নতুন কালের পৃথিবীতে কে আছে চাঁদ সদাগরের মত অবিশ্বাসী! কোথায় কোন ভক্তিমতী বেনেবেটির হল আবির্ভাব। তেমনি কৃষ্ণাপঞ্চমীর রাত্রি পেলে শিরবেদে বসবে মায়ের পূজায়। ঘরে কপাট দিয়ে পূজায় বসবে! মাকে ডাকবে মামা-মা-মা! প্ৰদীপ জ্বালবে, ধূপ পুড়াবে, ধূপের ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার হয়ে যাবে। ধারালো ছুরি দিয়ে বুকের চামড়া চিরে রক্ত নিয়ে সেই রক্ত নিবেদন করবে মাকে। তখন মেঘলোকে মাবিষহরির আটন একটু টলে উঠবে মায়ের মুকুটের রাজগোখুরা ফণা দুলায়ে হিসহিস করবে। মা বলবেন তার সহচরীকে দেখ তো বহিন নেতা, আসন কেন টলে, মুকুট কেন নড়ে? নেতা খড়ি পাতবে, গুনে দেখবে, দেখে বলবে—সাঁতালী গাঁয়ে শিরবেদে তোমাকে পূজা দিতেছে, স্মরণ করতেছে; তার হয়েছে সংকট; নাগিনী কন্যে অবিশ্বাসিনী হয়েছে। হয়ত বলবেকন্যের চুলে ধরেছে পাক, দত হয়েছে নডোেবড়ো, এখন নতুন কন্যে চাই। মা তখন বলবেন ভয় নাই। অভয় দিবেন, সঙ্গে সঙ্গে নাগিনী কন্যের নাগমাহাত্ম্য হরণ করে লিবেন আর ওদিকে নতুন কন্যের মধ্যে সঞ্চার করে দিবেন সেই মাহাত্ম্য। কন্যের অন্তরে অঙ্গে সেই মাহাত্ম্য ফুটে উঠবে।
পিঙলা বলে—সেবার শহরে কন্যে শবলা বললে, মা-বিষহরি সূক্ষ্ম বিচার করবে। কন্যের উপর ভর হল মায়ের।
মহাদেব শিরবেদে কুকুরের কামড় খেলে। সবার সামনে তার মাথা হেঁট হল। কথা বলতে পারলে না।
শবলা বললে চল, এই ভোরেই ভাসায় দে লায়েব সারি। কুকুর দুটার খোঁজে এসে যদি বাবুরা বুঝতে পারে কি, এটা বেদেদের কারুর কাম, তবে আর কারুর রক্ষে থাকবে না। মা-গঙ্গার স্রোতের টানে নৌকা ছেড়ে দে, তার সঙ্গে ধর দাড়, পাঁচদিনের পথ একদিনের পায়ে যাবি।
মহাদেব নায়ের ভিতর পাথর হয়ে পড়ে রইল।
মনে মনে কইলে–মাগো! শ্যাষে অপরাধ হইল আমার? আমি শিরবেদে—তুর চরণের দাস, আমি যে তুর চরণ ছাড়া ভজি নাই, তিন সন্ধ্যা তুকে ডাকতে কোনো দিন ভুলি নাই আমার দোষ নিলি মা-জনুনী?
****
শেষত্রে অন্ধকারের মধ্যে বড়নগরের রানীভবানীর বাড়ি-মন্দির পড়ে রইল পিছনে নৌকা বালুচর আজিমগঞ্জের শেঠদের সোনার নগর ছাড়িয়ে গেল, তারপর নসীপুরে ভাঙা জগৎশেঠের বাড়ি। সে সব পার হয়ে লালবাগের নবাবমহল। ওপারে খোশবাগ। হিরাঝিলের জঙ্গল। ওই—এইখানেই রাজগোখুরা ধরেছিল শবলার ভালবাসার মানুষ।
পিঙলা বলে—যাই বলা থাকুক শবলা, সে তার ভালবাসার মানুষই ছিল গ কবিরাজ মশাই। ভালবাসার মানুষ, পরানের বঁধু। তোক নাগিনী কন্যে, তবু তো দেহটা মনটা তার মানুষের কন্যের! মানুষের কন্যে ছেলেবয়সে ভালবাসে তার বাপকে মাকে। লাগিনীর সন্তান হয়, ডিম ফোটে, ভেঁকা বার হয়, পুরাণে আছে প্রবাদে আছে-লাগিনী আপন সন্তানের যতটারে পায় মুখের কাছে—খেয়ে ফেলায়। বড় সাপে ঘোট সাপ খায়—দেখেছ কি না জানি না, আমরা দেখেছি খায়। লাগিনী সেখানে নিজের সন্তান খাবে তার আর আশ্চর্য কি গ! সেই লাগিনী মানুষের গভ্যে জনম নেয়—মনুষ্য-ধরম নিয়া, সেই ধরম সে পালন করে। মা-বাপেরে ভালবাসে তাদের না-হলে তার চলে না। তাপরেতে কেরুমে কেরমে বড় হয়, দেহে যৌবন। আসে তখন পরান চায় ভালবাসার মানুষ। লাগিনীর নারী ধরমের কাল আসে তার অঙ্গ থেকে কাঁঠালীচাপার বাস বাহির হয়, সেই বাস ছড়ায়ে পড়ে চারিপাশে। লাগ সেই গন্ধের টানে এসে হাজির হয়। দুজনে মিলন হয়, খেলা হয়, জীবধরমের অভিলাষ মেটে। লগ-লাগিনী অভিলাষ মিটায়ে চলে যায় আপন আপন স্থানে। ভালবাসা তো নাই সেখানে। কিন্তু নাগিনী কন্যে যখন মানুষের রূপ ধরে, মানুষের মন পায়—তখন দেহের অভিলাষ মিটলেই মনের তিয়াস মিটে না, মন চায় ভালবাসা। সে তো ভাল না বেসে পারে না। সেই ভালবাসাই সে বেসেছিল ওই জোয়ানটাকে। তারে চুঁতে সে পারে নাই, ভয় তার তখনও ভাঙে নাই, ভাঙলে পরে সে কিছু মানত না, গাঙের ধারে রাতের অ্যাঁধারে সস্নিয়ে গিয়ে ঝাপায়ে পড়ত তার বুকে, গলাটা ধরত জড়ায়ে, লাগিনী যেমন লাগেরে পাকে পাকে জড়ায় তেমনি করা জড়ায়ে লেগে যেত তার অঙ্গে অঙ্গে।
হিরাঝিলের ধারে এস্যা শবলা আপন লায়ে মায়ের ছামনে আবার আছড়ে পড়ল। কি করলি মা গ! তোর শাসনই যদি নিয়া এসেছিল রাজগোখুরা, তবে আমার বুকে কেনে ছোবল দিলে না?
****
নাগিনীর মতই গর্জন করে ওঠে পিঙলা। সে বলে—শবলা আমাকে বলেছিল। বলেছিল পিঙলা, বহিন, চিরজনমটা বুকের কথা মুখে আনতে পারলাম না, বুকটা আমার জ্বল্যা পুড়া শাক হয়ে গেল। দোষ দিব কারে? কারেও দিব না দোষ। অদেষ্ট না, ললাট না, বিষহরিকে না, দোষ ওই বুড়ার, আর দোষ আমার। মুই নিজেকে নিজে ছলনা করলাম চিরজীবন। পরান ভালবাসলে, মোর সকল অঙ্গ ভালবাসলে, আমার মন বললে—নানা-না, ও-কথা বলতে নাই। ও পাপ–মহাপাপ। মুছে ফেল্ মুছে ফেল, বিষহরির কন্যে, ও অভিলাষ তু মন থেক্য মুছে ফেল।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রাঙা চোখ দুটো মেলে কালো কেশের মত অ্যাঁধার রাতের দিকে চেয়ে থাকত আর ওই কথা বলত। শবলার অঙ্গে অঙ্গে তখন যেন কালো রূপের বান ডেকেছে। সে যেন তখন বান-থইথই কালিন্দী নদীর কলাদহের মত পাথার হয়ে উঠেছে। কদমতলায় কানাই। নাই, তবু সেথায় ঢেউয়ে ঢেউয়ে উথালপাতাল করে আছাড় খেয়ে পড়ছে। কন্যে যদি সত্যিই নাগিনী হয়, তবে অঙ্গে ফোটে চাপার সুবাস। শবলার অঙ্গ ভরে তখন চাপার সুবাস ফুটেছে।
****
শিবরাম সেবার গুরুর আশ্রম থেকে শিক্ষা শেষ করে বিদায় নিয়েছিলেন, সেইবার পিঙলা ওই কথাগুলি বলেছিল। তখন পিঙলার সর্বাঙ্গ ভরে যৌবন দেখা দিয়েছে। প্রথম যেবার শবলার অন্তর্ধানের পর সে এসেছিল, তখন সে ছিল সবুজ-ডাঁটা একটি কচি লতার মত। অল্প বাতাসে দোলে, অল্প উত্তাপে ম্লান হয়, বর্ষণের স্বল্প প্রাবল্যেই তার ডাঁটা পাতা মাটির বুকে কাদায় বসে যায়। এখন সে পূৰ্ণ যুবতী, সবল সতেজ লতার ঝাড়। যেন উদ্যত ফণা নাগ-নাগিনীর মত নিজের কমনীয় প্রান্তভাগগুলি শূন্যলোকে বিস্তার করে রয়েছে, ঝড় বর্ষণ তাকে আর ধুলায় লুটিয়ে দিতে পারে না, বৈশাখী দ্বিপ্রহরে তার পল্লবগুলি ম্লান হয় না। শান্ত স্বল্পভাষিণী কিশোরী মেয়েটি তখন মুখরা যুবতী। সে সলজ্জা নয় আর, এখন সে দৃপ্তা।
শবলা শিবরামের নামকরণ করেছিল—কচি-ধন্বন্তরি। বর্বরা উল্লাসিনী বেদের মেয়েরা তাকে সেই নামেই ডাকত। তারা যেন তঁকে বেশ একটি প্রীতির চোখেই দেখত। শবলাকে জেনে, চিনে, তার অন্তরের পরিচয় পেয়ে শিবরামও এদের স্নেহ করতেন। কিন্তু কিশোরী পিঙলার সঙ্গে পরিচয় নিবিড় হয়ে ওঠে নি এতদিন।
এবার গুরু সুযোগ করে দিলেন। বললেন—আমার শিষ্য শিবরাম এবার থেকে স্বাধীনভাবে কবিরাজি করবেন। এঁকে তোমাদের যজমান করে নাও।
শিরবেদে, নাগিনী কন্যা নূতন যজমানকে বরণ করে। প্রণাম করে হাত জোড় করে বলে–কখনও তোমাকে প্রতারণা করব না। যে গরল অমৃত হয় শোধনে, সেই গরল ছাড়া অন্য গরল দেব না। মা-বিষহরির শপথ। হে যজমান, তুমি আমাকে দেবে ন্যায্য মূল্য, আর সে মুদ্ৰা যেন মেকি না হয়।
সেইদিন অপরাত্নে পিঙলা এল একাকিনী। বললে—তুমার কাছে এলম কচি-ধন্বন্তরি। আজ চার বছর একটা কথা বলবার তরে শপথে বাধা আছি। কিন্তুক বুলতে লেরেছি। আজ বুলতে এসেছি। শবলাদিদির কাছে শপথ করেছিলাম মায়ের নাম নিয়া।
শিবরাম তার মুখের দিকে চাইলেন। এ মেয়ে আর এক জাতের। শব ছিল উচ্ছলা, সে যেন ছিল মেঘলা আকাশ-ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎচকিত হত, ঝলকে উঠত বজ্ৰবহি; আবার পর মুহূর্তেই বৰ্ষণ ও উতলা বায়ুর চপল কৌতুকে লুটোপুটি খেত। আর এ মেয়ে যেন বৈশাখের দ্বিপ্রহর। যেন অহরহ জ্বলছে।
সমস্ত কথাগুলি বলে সে বললে—শবলাদিদি আমার কাছে লুকায় নাই। তার অঙ্গে চাপার বাস ফুটল, পাপ তার হল। মনের বাসনারে যদি লাগিনী কন্যে আপন বিষে জরায়ে দিতে না পারে, তবে সে বাসনা চাপার ফুল হয়্যা পরান-বক্ষে ফুটা উঠা বাস ছড়ায়। তখন হয় কন্যের পাপ। মা-বিষহরি হরণ করেন তার লাগিনীমাহাত্ম্য। অন্য কন্যেকে দান করেন। শবলার মাহাত্মি হরণ করে মা আমারে দিলেন মাহাত্মি। তাতে শবলা রাগলে না। আমার উপর আক্রোশ। হল না।
শিবরামের মুখের দিকে চেয়ে তার মনের প্রশ্ন অনুমান করেই সে বললে—বুঝল না? নাগিনী কন্যের দুর্ভাগ্য যত, ভাগ্যি যে তার থেক্যা অনেক বেশি গ। সি যি সাক্ষাৎ দেবতা। শিরবেদের চেয়ে তো কম লয়। তাতেই লতুন লাগিনী কন্যে যখন দেখা দেয়তখুন পুরনো লাগিনী কন্যে উঠে ক্ষেপে। তারে পরানে সে মেরে ফেলতে চায়। কিন্তু শবলা তা করে নাই। আমায় সে ভালবেসেছিল—আপন বহিনের মত। বুলেছিল—দোষ আমার আর শিরবেদের; তুর দোষ নাই। সে আমাকে সব শিখায়ে গিয়েছে। লাগিনী কন্যের সব মাহাত্মি—সব বিদ্যা দিয়েছে। মনের কথা বুলেছে। শুধু বুলে নাই যি, মহাদেব শিবেদের ধরম নিয়া জীবন নিয়া, অকূলে সে ঝাঁপ খাবে।
বেদেরা এখুন ধরম বাঁচাবার লেগ্যা বলে শবলার মাথা খারাপ হছিল। মিছা কথা। এখুন আমি সব বুঝছি। আমার লেগা গঙ্গারাম শিরবেদে এখুন কি বুলে জান? বুলে—তুরও মগজটা শবলার মত বিগড়াবে দেখছি।
পিঙলা গঙ্গারাম শিরবেদেকে মুখের উপর বলেছিল—আমার মাথা খারাপ হবে না, সে তুকে বল্য রাখলাম, সে তু শুন্যা রাখ। পিঙলা কন্যে শবলা নয়। শবলা আমাকে বলে গিয়েছে–পিঙলা, বহিন, এই কালে কালে হয়্যা আসছে লাগিনী কন্যের কপালে; মুই তুরে সকল কথা খুল্যা বলে গেলম; তু যেন আমাদের মত পড়া পড়া মার খাস না; শিরবেদেকে ডরাস না। মুই তুকে ডরাব না।
নতুন নাগিনী কন্যা পিঙলা আর শিরবেদে গঙ্গারামের মধ্যে চিরকালের বিবাদ ঘনিয়ে উঠেছে। যা হয়েছিল শবলা আর মহাদেবের মধ্যে, তাই। মহাদেব মরেছে আজ সাত বছরের ওপর। পিঙলা নাগিনী কন্যা হয়েছিল যখন, তখন তার বয়স পনের পার হয়েছে, ষোল পূর্ণ হয় নাই। পিঙলা এখন পূৰ্ণ যুবতী। কালো মেয়ে পিঙলার চোখ দুটো পিঙ্গলাভ; সে চোখের দৃষ্টি আশ্চর্য রকমের স্থির। মানুষের দিকে সে নিম্পলক হয়ে তাকিয়ে থাকে, পলক ফেলে না; মনে হয় একেবারে ভিতরের ভিতরে থাকে যে আঙুল-প্রমাণ আত্মা, সে-ই যেন চোখ দুটার দুয়ার খুলে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তার তো ভয় নাই, ডরও নাই। তা ছাড়া, পিঙলার ওই চোখ দুটা অন্ধকারের মধ্যে বনবিড়ালের চোখের মত জ্বলে। যে অন্ধকারে অন্য মানুষের দৃষ্টি চলে না, পিঙলা সেই অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে পায়। পিঙলার চোখের দিকে চাইলেও ভয় পায় সকলে। গঙ্গারাম যে গঙ্গারাম, সেও ভয় পায়। যখন এমনি স্থিরদৃষ্টিতে সে তাকায়, গঙ্গারাম তখন দুপা। পিছন হটে দাঁড়ায়। পিঙলা তাতে কৌতুক বোধ করে না, তার ঠোঁট দুটো বেঁকে যায়, সে বাঁকের এক দিকে ঝরে পড়ে আক্রোশ, অন্য দিকে ঝরে ঘৃণা।
গঙ্গারামও ভীষণ।
মহাদেবের মত সে ভয়ঙ্কর নয়, কিন্তু সে ভীষণ। পাথরের পুরনো মন্দিরের মত কঠিন নয়, কিন্তু সে কুটিল। সমস্ত সাঁতালীর বেদেরা তাকে ভয় করে ডোমন-করেতের মত। মহাদেব ছিল শঙ্খচূড়—সে তেড়ে এসে ছোবলে ছোবলে ক্ষতবিক্ষত করে দিত, প্রাণটা চলে যেত সঙ্গে সঙ্গে। হার মেনে অঙ্গের বেশবাস ফেলে দিয়ে পাশ কাটিয়ে পালালে সে সেই বেশবাসকে ছিঁড়েখুঁড়ে আক্রোশ মিটিয়ে নিরস্ত হত। ডোমন-করেতের কাছে সে নিস্তারও নাই। সে অন্ধকার রাত্রের সঙ্গে তার নীলচে দেহটা মিশিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে তোমার অনুসরণ করে লুকিয়ে থাকবে। দিনের। আলোতে অনুসরণ করতে যদি না-ই পারে, তবে আক্রোশ পোষণ করে অপেক্ষা করে থাকবে। আসবে সে ঠিক খুঁজে খুঁজে। তারপর করবে দংশন। সে দংশনে নিস্তার নাই। ব্রাহ্মণেরা বলে–খেলে ডোমনা, ডাক বানা। অর্থাৎ ডোমন-করেতের দংশন যখন, তখন বিষবৈদ্য ডেক না, মিথ্যা চিকিৎসা করতে যেয়ো না-শ্মশানে শব নিয়ে যাবার জন্য ব্রাহ্মণ ডাক। সৎকারের আয়োজন কর।
ডোমন-করেতের মতই বাইরে দেখতে ধীর আর নিরীহ গঙ্গারাম। দেহের শক্তি তার অনেকের চেয়ে কম, কিন্তু সে কামরূপের বিদ্যা জানে, জাদুবিদ্যা জানে। তিরিশ বছর আগে ওই শহরে থেকেই সে মহাদেবের সঙ্গে ঝগড়া করে, নিরুদ্দেশ হয়েছিল; দোষ মহাদেবের ছিল না, দোষ ছিল গঙ্গারামের। জোয়ান হয়ে উঠবার সঙ্গে সঙ্গেই তার মতিগতি অতি মাত্রায় খারাপ হয়েছিল। শহরে এসে সে একা একা ঘুরে বেড়াত। মদ খেয়ে রাস্তায় লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে ফিরত। গলায় একটা গোখুরা সাপ জড়িয়ে বেড়াত রাস্তায় রাস্তায়। গোখুরাটাকে সে খুব বশ করেছিল। গলায় জড়ালে সেটা মালার মতই ঝুলত, মুখটা নিয়ে কখনও কাঁধে, কখনও কানের কাছে, কখনও বুকের উপর অল্প ঘুরত। এর জন্যে লোক তাকে ভয় করত। গায়ে হাত তুলতে সাহস করত না। একদিন কিন্তু ভিড়ের মধ্যে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। ভিড়ের মধ্যে একজন। হঠাৎ তার ঠিক সামনেই গঙ্গারামের গলায় সাপটাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করে গঙ্গারামকে ঠেলে দিতে গিয়েছিল, ভয় পেয়ে সাপটাও তাকে কামড়ে দিয়েছিল। একেবারে ঠিক বুকের মাঝখানে খানিকটা মাংস খাবলে তুলে নিয়েছিল। তারপর সে এক ভীষণ কাণ্ড। যত নির্যাতন গঙ্গারামের তত লাঞ্ছনা সমস্ত বেদেকুলের। পুলিশ এসে বেদেদের নৌকা আটক করেছিল। মহাদেবকে থানায় নিয়ে গিয়েছিল।
গঙ্গারাম অনেক বলেছিল—কিছু হবে না হুজুর, মুই বিষহরির কিরা খায়্যা বলছি, উয়ার বিষ নাই। উয়ার দাঁত, বিষের থলি—সব মুই কেটে তুলে দিছি। মানুষটার যদি কিছু হয়, তবে দিবেন–দিবেন আমাকে ফাঁসি।
সে গোখুরার মুখটাকে নিজের মুখের মধ্যে পুরে চকচক শব্দ তুলে চুষে দেখিয়েছিল—বিষ নাই। মুখ থেকে সাপটাকে বের করার পর সেটা গঙ্গারামকেও কয়েকটা কামড় দিয়েছিল।
মহাদেব শপথ করে গঙ্গারামের কথা সমর্থন করেছিল। কিন্তু তবু এ লাঞ্ছনা-অপমান থেকে পরিত্রাণ পায় নাই। প্ৰায় চব্বিশ ঘণ্টা আটক রেখেছিল। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেও যখন লোকটির দেহে কোন বিষক্রিয়া হল না, যখন ডাক্তারেরা বললেন না, আর কোনো ভয় নাই, তখন পরিত্রাণ পেয়েছিল তারা। সেই নিয়ে বিবাদ হল মহাদেবের সঙ্গে। একা মহাদেব কেন, বেদেদের সকলের সঙ্গেই ঝগড়া হয়েছিল গঙ্গারামের। দারুণ প্রহার করেছিল মহাদেব। দুদিন পরে গঙ্গারাম একটু সুস্থ হয়ে উঠেই দল ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল।
মহাদেব বলেছিল—যাক, পাপ গেছে, মঙ্গল হল্ছে। যাক।
গঙ্গারাম গেলে মঙ্গল হবে—এ কথায় কারুর সংশয় ছিল না, কিন্তু মহাদেবের পরে শিরবেদে হবে কে?
মহাদেব বলেছিল—মুই পুষ্যি লিব।
হঠাৎ দীর্ঘ তের চোদ্দ বৎসর পর গঙ্গারাম এসে হাজির হল। সে বললেকঁউর-কামিক্ষে থেকে কত দ্যাশে দ্যাশে ঘুরলম, জেহেলেও ছিলম বছর চারেক। তাপরেতে এলম, বলি, দেখ্যা। আসি, সাঁতালীর খবরটা নিয়া আসি।
বেদেদের আসরে সে তার জাদুবিদ্যা দেখালে।
কত খেলা, বিচিত্র খেলা! জিভ কেটে জোড়া দেয়। কাঠের পাখি হুকুম শোনে, জলে। ডোবে, ওঠে। পাথরের গুলি থেকে পাখি বের হয়; সে পাখিকে ঢাকা দেয়, পাখি উড়ে যায়; বাতাস থেকে মুঠো বেঁধে এনে মুঠো খোলে টাকা বের হয়। আরও কত!
বেদেরা সম্মোহিত হয়ে গেল। সন্ধ্যায় বসে সে গল্প করত দেশ-দেশান্তরের। তারপর কিছুদিনের মধ্যেই শবলা আর মহাদেবের মধ্যে বিবাদের মীমাংসা হয়ে গেল। মহাদেবের বুকে বিষকাটা বসিয়ে দিয়ে শবলা ভেসে গেল গঙ্গার বানে। গঙ্গারাম হল শিরবেদে।
পিঙলা বলে—পাপী–উ লোকটা মহাপাপী।
আবার তখনই হেসে বলে—উয়ার দোষ কি? পুরুষ জাতটাই এমুনি। ভোলা মহেশ্বরের কন্যে হলেন মা-বিষহরি। ভোলা ভাঙড় চণ্ডীরে ঘুম পাড়ায়ে এলেন মত্ত্যধামে। বিষহরিরে দেখ্যা কামের পীড়াতে লাজ হারালেন, বললেন—কন্যে, আমার বাসনা পূর্ণ কর। মা-বিষহরি তখন রোষ করে বিষদৃষ্টিতে তাকালেন পিতার পানে, শিব ঢলে পড়লেন। দোষ শুধু লাগিনী কন্যেরই নাই। শাবলার নামে দোষটা দিলি কি—সে শিরবেদের ধরম নিয়া, কাটা বুকে বিঁধে দিয়া পালালছে; কিন্তু দোষটা শিরবেদেরও আছে। ওই গঙ্গারাম শিরবেদেকে দেখ।
নেশায় চক্ষু লাল করে গঙ্গারাম ঘুরে বেড়ায় সাঁতালীর বাড়ি বাড়ি। রসিকতা করে বেদেনীদের সঙ্গে। কিন্তু কেউ কিছু বলতে সাহস করে না। গঙ্গারাম ডাকিনী বিদ্যা জানে। মানুষকে সে বাণ মেরে খোঁড়া করে রেখে দেয়; শুধু তাই নয়, প্রাণেও মেরে ফেলতে পারে গঙ্গারাম। ডাকিনী-সিদ্ধ গঙ্গারামের ধর্ম নাই, অধর্ম নাই। কিছু মানে না সে।
গঙ্গারাম ভয় করে শুধু পিঙলাকে।
পিঙলাও ভয় করে, কিন্তু মধ্যে মধ্যে সে যেন ক্ষেপে ওঠে।
ফাল্গুনের তখন শেষ। ফাল্গুনেও গঙ্গাতীরে ঘাসবনের ভিতর পলিমাটিতে বর্ষার জলের ভিজে আমেজ থাকে। পাকা ঘাস শুকিয়ে যায়, কাশঝাড় আগেই কেটে নিয়েছে বেদেরা। এই সময় একদিন ঘাসবন ধোঁয়াতে শুরু করে। শুকনো ঘাসে আগুন দেয় বেদেরা। শুকনো ঘাস পুড়ে যাবে, তলার মাটি আগুনের অ্যাঁচ পাবে, তারপর পাবে সূর্যের তাপ, সাঁতালীর বসুন্ধরা নব কলেবর ধরবেন। চৈত্রের পর বৈশাখে আসবে কালবৈশাখী ঝড় জল হবে, সেই জলে মাটি ভিজবে, সঙ্গে সঙ্গে ওই পুড়িয়ে দেওয়া ঘাসের মুড়ো অর্থাৎ মূল থেকে আবার সবুজ ঘাস বের হতে আরম্ভ হবে। বর্ষা আসতে আসতে একটা ঘন চাপ-বধা সবুজ বন হয়ে উঠবে। গঙ্গার জলকে রুখবে। সাঁতালী গাঁয়ের বেদেদের বাঁশ আর কাশের ঘরগুলি ছাওয়ার কাশের সংস্থান হবে।
এদিকে পৌষ মাস পর্যন্ত সফর সেরে সাঁতালীতে ফিরবার পথে শীতে জরজর-অঙ্গ নাগ-নাগিনীদের মুক্তি দিয়ে এসেছে; বিষহরির পুত্র-কন্যা সব, বেদের ঝাঁপিতে তাদের মৃত্যু হলে বেদের জীবনে পাপ অৰ্ণাবে। মাঘ থেকে ফাল্গুন-চৈত্র পর্যন্ত বেদেদের ঝাপিতে সাপ নাই। সতেজ নাগ, শীতে যাকে কাবু করতে পারবে না—তেমনি দুটো-একটা থাকে। ফারুনের শেষে ঘাস পুড়িয়ে দিলে আগুনের অ্যাঁচে, রোদের তাপে মাটি শুকালে, নাগেরা মাটির নিচে তাপের স্পর্শে শীতের ঘুম থেকে জেগে উঠবে। আশ্বিনের শেষ থেকে কার্তিকের শেষ পর্যন্ত নাগেরা রাত্রে ভোলা মাঠে নিথর হয়ে পড়ে থাকে, বেদেরা বলে—শিশির নেয় অঙ্গে। ওই শিশির অঙ্গে নিয়ে শীত শুরু হতেই তারা মাটির নিচে কালঘুমে ঢলে পড়ে। লোকে বলে সাপেরা মুদ নেয়। এই কালঘুমই বল, আর মুদই বল, এ ভাঙে ফাল্গুন-চৈত্রে। বেদে যেখানে নাই, সেখানে ঘুম ভাঙায় কাল। যেখানে বেদে আছে, সেখানে এ ঘুম ভাঙানোর ভার বেদেদের। ঘুম ভাঙানোর পর শুরু হবে নতুন করে নাগ ঘরে আনার পালা।
এই আগুন দেওয়ার ক্ষণ ঘোষণা করে হিজল বিলের পাখিরা। সাপদের মুদ নেবার কাল হলেই পাখিরা কোন দেশান্তর থেকে আকাশ ছেয়ে কলকল শব্দ তুলে এসে হাজির হয় হিজল বিলে। সকলের আগে গগনভেরী পাখি। আকাশে যেন নাকাড়া বাজে।
গরুড় পাখির বংশধর। নাগকুলের জননী আর গরুড় পক্ষীর জননী-দুই সতীন। সভাইদের বংশে বংশে কালশত্ৰুতা সেই আদিকাল থেকে চলে আসছে। সৃষ্টির শেষদিন পর্যন্ত চলবে। তাই এ মীমাংসা হয়ত দেবকুলের করে দেওয়া মীমাংসা। শীতের কয়েক মাস পৃথিবীতে অধিকার গরুড়-বংশের। তারা আকাশ ছেয়ে ভেরী বাজিয়ে এসে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে–বিলে নদীতে পুকুরে; ধানভরা মাঠে ধান খাবে। তারপর ফাল্গুন যাবে, চৈত্রের প্রথমে গরমের আমেজ-ভরা বাতাস আসবে দক্ষিণ দিক থেকে; মাঠের ফসল শেষ হবে; তখন তারা আবার উড়বে—গগনভেরী পাখিরা নাকাড়া বাজিয়ে চলবে আগে আগে! তখন আবার পড়বে নাগেদের কাল।
যে দিন ওই গগনভেরীরা উড়বে, উড়ে গিয়ে আর ফিরবে না, সে দিন থেকে তিন দিন পরে এই আগুন লাগানো হবে ঘাসবনে।
***
সাঁতালীর চরে ঘাসবনে সেই আগুন লাগানো হয়েছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে আকাশে। ঘাসের উঁটা আগুনের অ্যাঁচে পটপট শব্দে ফাটছে, আকাশে উঠছে কাকফিঙের দল। ঝাঁকে ঝাঁকে পোকা মাকড় উড়ে পালাচ্ছে। পালম্বা গঙ্গাফড়িঙের দল লাফিয়ে উঠছে। আগুন চলছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। দনে বাতাস বইতে শুরু করেছে। বইবেই তো, গগনভেরী পাখিরা গুরুড়ের বংশধর, তারা দক্ষিণ থেকে উত্তর দেশে চলেছে—তাদের পাখসাটে পবনদেবকেও মুখ ফেরাতে হয়েছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে।
বিলের ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল পিঙলা। দেহ-মন তার ভাল নাই। দুনিয়া যেন বিষ হয়ে উঠেছে। সাঁতালী, বিষহরি, বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড—সব বিষ হয়ে গিয়েছে। সে নাগিনী কন্যে—তাই বোধ হয় এত বিষ তার সহ্য হয়, অন্য কেউ হলে পাথরে মাথা ঠুকে মরত, গলায় দড়ি দিত, নয়ত কাপড়ে আগুন লাগাত।
বিলের দক্ষিণ দিকে সদ্য-জল-থেকে-ওঠা জমিতে চাষীরা চাষ করছে। এর পর লাগাবে বোরো ধান। তার উপরে তিল-ফসলে বেগুনে রঙের ফুল দেখা দিয়েছে। বড় বড় শিমুলগাছগুলোয় রাঙা শিমুল ফুল ফুটেছে। ওই ওদিকে এসেছে ঘোষেরা। মাঠান দেশে ঘাসের অভাব হয়েছে। সামনে আসছে গ্রীষ্মকাল, তারা তাদের গরু মহিষ নিয়ে এসেছে হিজলের কূলে। হিজলের কূলে ঘাসের অভাব নাই। তা ছাড়া আছে হাজারে হাজারে বাবলা গাছ। বাবলার শুটি, বাবলার পাতা খাওয়াবে।
কিছুদিন পরেই আসবে দুঃসাহসী একদল জেলে। মাছ ধরবে হিজল বিলে। বর্ষার একটা হিজল বিল এখন শুকিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। আরও যাবে। তখন এই মাছ ধরার পালা। মূল পদ্মার বিল অর্থাৎ মা-মনসার আইন মাঝের বিল বাদ দিয়ে বাকি সব বিলে মাছ ধরবে।
অকস্মাৎ একটা বন্য জন্তুর চিৎকারে পিঙলা চমকে উঠল।
ওদিকে হইহই শব্দ করে উঠল বেদেরা। গুলবাঘা-গুলবাঘা!
আগুনের আঁচে, ধোঁয়ায়, গাছপা-পোড়ার গন্ধে, কোথায় কোন ঝোপে ছিল বাঘা সে বেরিয়ে পড়েছে। কালো ছাপওয়ালা হলদে জানোয়ারটা ছুটছে। কাউকে বোধ হয় জখম করেছে। কিন্তু বাঘা আজ মরবে। সে যাবে কোথায়? পুবে গঙ্গা, উত্তরে বেদেরা, তারা ছুটে আসছে পিছনে পিছনে, দক্ষিণে মহিষের পাল নিয়ে রয়েছে ঘোষেরা। সেখানে মহিষের শিঙ, ঘোষেদের লাঠি। পশ্চিমে হিজলের জল, যাবার পথ নাই। বাঘা আজ মরবে।
পিঙলার মনের অবসাদ কেটে গেল এই উত্তেজনায়। সে হিজলের ঘাট থেকেই মাথা তুলে। দেখতে লাগল। কিন্তু কই? কোথায় গেল বাঘা? এদিকের ঘাসের বন আড়াল দিয়ে গঙ্গার গর্ভে নামল নাকি? পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে মাথা তুললে সে। ওই ছুটেছে বেদেরাওই! হইগই শব্দ করছে। উল্লাসে যেন ফেটে পড়ছে। পিঙলার ইচ্ছে হল ছুটে যায়। কিন্তু উপায় নাই। তাকে থাকতে হবে এই হিজল বিলের বিষহরির ঘাটে। ওদিকে বনে আগুন লাগানো হয়েছে। নাগিনী কন্যা এসে বসে আছে বিষহরির ঘাটে। তাকে ধ্যান করতে হবে মায়ের। মায়ের ঘুম ভাঙাতে হবে, বলতে হবে–মা গো, নাগকুলের জ্ঞাতিশত্রু–গরুড় পক্ষীর বংশের গগনভেরীরা নাকাড়া বাজিয়ে উত্তরে চলে গেল; নাগেদের দখলে কাল এল। উত্তরে দক্ষিণ-মুখো বাতাস–দক্ষিণ থেকে উত্তরমুখী হয়েছে; নাগ-চাপার গাছে কলি ধরেছে। তুমি এইবার নয়ন মেল; মা গো, তুমি জাগ।
ওদিকে বন পোড়ানো শেষ করে বেদেরা আসবে; শিরবেদে থাকবে সর্বাগ্রে; এসে ঘাটের অদূরে হাত জোড় করে দাঁড়াবে। শিরবেদে ডাকবে-কন্যে গ, কন্যে!
হাঁটু গেড়ে হাত জোড় করে কন্যে বসে থাকবে ধ্যানে। উত্তর দেবে না। আবার ডাকবে শিরবেদে। বার বার তিনবার। তারপর কন্যে সাড়া দেবো–হাঁ গ!
–মা জাগল? ঘুম ভাঙিছে জননীর?
–হাঁ, জাগিছে মা-জননী।
তখন নাকাড়া বেজে উঠবে, জয়ধ্বনি দেবে বেদেরা। পূজা হবে। হাঁস বলি হবে, বন-পায়রা বলি হবে। তারপর তারা গ্রামে ফিরবে। ফিরবার আগে চর খুঁজে বিলের কূল খুঁজে একটিও অন্তত নাগ ধরতে হবে।
বিলের ঘাটে সেই জন্যই একা এসেছে সে। কিন্তু এসে অবধি কোনো প্রার্থনা, কোনো ধ্যানই করে নাই। চুপচাপ পাঁড়িয়ে ছিল। ইচ্ছা হয় নাই, দেহও যেন ভাল মনে হচ্ছিল না। যেন ঘুম আসছিল। হঠাৎ উত্তেজনায় সে চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু উপায় নাই। যাবার তার উপায় নাই। সে উদ্গ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। বাঘা মরবে। আঃ, বাঘা তুই যদি গঙ্গারাম শিরবেদেকে জখম করে মরিস, তবে পিঙলা তোকে প্রাণ খুলে আশীৰ্বাদ করবে। তোর মরণে বুক ভাসিয়ে কাঁদবে। তোর নখ পিতল দিয়ে বাঁধিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখবে। তোর পাঁজরার ছোট হাড়খানি নিয়ে সে সযত্নে রেখে দেবে, সৌভাগ্যের সম্পদ হবে সেখানি।
ওই থমকে দাঁড়িয়েছে বেদের দল। কোন দিকে বাঘা গিয়েছেঠাওর পাচ্ছে না। পরমুহূর্তেই তার সর্বাঙ্গে একটা বিদ্যুৎ শিরেন বয়ে গেল। সামনে হাত-পনের দূরে ঘাসের জঙ্গল ঠেলে বেরিয়েছে একটা হলুদ রঙের গোল হাঁড়ির মত মুখ, তাতে দুটো নিষ্পক গোল চোখ লম্বা দুটো কালো রেখার মত তারা দুটো যেন ঝলসে উঠছে। চোখে চোখ পড়তেই দাঁত বের করে ফাঁস শব্দ করে উঠল; গুঁড়ি মেরে দেহটাকে যথাসাধ্য খাটো করে সে আত্মগোপন করে এইদিকে চলে এসেছে।
সাঁতালী গাঁয়ের চারিপাশে ঘাসবনের ফালিপথ বেয়ে বেড়ায় যে বেদের কন্যে, যার গায়ের গন্ধে ঘাসের বনে মুখ লুকিয়ে কুণ্ডলী পাকায় বিষধর সাপ, সেই কন্যে পিঙলা। যে কন্যেরা জীবনে দু-চার বার বঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে নিরাপদে গ্রামে ফিরেছে, সেই কন্যের কন্যে পিঙলা। কুমিরখালার খালেকুমিরের মুখে প্রতি বছরই যে বেদের মেয়েদের দু-একজন যায়—সেই বেদের মেয়ে পিঙলা। পিঙলার পিসির একটা পা নাই। কুমিরে ধরেছিল। পিঙলার পিসি গাছের ডাল অ্যাঁকড়ে ধরে চিৎকার করছিল। বেদেরা ছুটে এসে খোঁচা মেরে, বাঁশ মেরে কুমিরটাকে ভাগিয়েছিল। কুমিরটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল, কিন্তু একখানা পায়ের নিচের দিকটা রাখে নি। খোঁড়া। পিসি তার আজও বেঁচে আছে। পিঙলার সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎশিহরন খেলে গেল, কিন্তু সে বিবশ হয়ে গেল না।
ওরে বাঘা! ওরে চতুর। ওরে শঠ শয়তান। ওরে গঙ্গারাম।
এক পা, দু পা, তিন পা, চার পা পিছন হটে সে অকস্মাৎ ঘুরে দাঁড়িয়েই ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। হিজলের বিলে।–জয় বিষহরি!
ঘাটে লম্বা দড়িতে বাঁধা তালগাছের ডোঙাটা ভাসছে খানিকটা দূরে। সাঁতরে গিয়ে সেটার উপর উঠে বসল সে। বাঘাটা উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেজ আছড়াচ্ছে। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে পিঙলার দিকে।
পিঙলার মুখে দাঁতগুলি ঝলসে উঠল। ইশারা করে সে ডাকলে বাঘাকে আয়। আয়। আয়। সাঁতার তো জানিস। আয় না রে!
বাঘাটা এবার বেরিয়ে এল ঘাসবন থেকে। ঘাটের মাথায় এসে দাঁড়াল। কোলাহল ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে, চতুর বাঘা সেটুকু বুঝে নিরাপদ আশ্রয় এবং আহারের প্রত্যাশায় ভেঁকে দাঁড়িয়েছে ঘাটের মাথায়। ওরে মুখপোড়া, তুই মা-বিষহরির জামাই হবার সাধ করেছিস নাকি? কন্যাকে নিয়ে যাবি মুখে তুলে, বনের ভিতর ঘর-সংসার পিতবি? বাঘিনীর দলে লাগিনী কন্যে? আয় না ভাই, আয় না; গলায় তের মালা দিব, গলা জড়ায়ে চুমা খাব আয় না; বিলের জলের তলে মা-বিষহরির সাতমহলা পুরী–মোর মায়ের বাড়ি—আয় শাশুড়ির বাড়ি যাবি। আয়।
কথাগুলি পিঙলা বাঘটিকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলেছিল। একেবারে কথা কয়েছিল। বাঘটা দাঁত বের করে ফাঁসফাঁস করছে। হঠাৎ সেটা উপরের দিকে মুখ তুলে ডাক দিয়ে উঠল—আঁ–উ। লেজটা আছড়ালে মাটির উপর।
এবার খিলখিল করে হেসে উঠল পিঙলা।
হিজল বিলের চারিপাশে ছড়িয়ে পড়ল সে হাসি।
ওদিকে বাঘার পিছনে—ঘাসবন পুড়িয়ে আগুন এগিয়ে আসছে। বাঘা এমন নিরস্ত্র নিরীহ শিকারের সুযোগ কিছুতে পরিত্যাগ করতে পারছে না। নইলে সে পালাত। পালাত দক্ষিণ মুখে, যেদিকে ওই চাষীরা চাষ করছে, ঘোষেরা গরু মহিষের বাথান দিয়ে বসে আছে। মহিষের শিঙে, ঘোষদের লাঠিতে, দাওয়ের কোপে বাঘা মরত।
সরস কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল পিঙলা। ডোঙার উপর বসে সে মৃদুস্বরে গান ধরে দিলে—ঠিক যেন বাঘটার সঙ্গে প্ৰেমালাপ করছে গান গেয়ে।
বঁধু তুমি, আইলা যোগীর ব্যাশে।
হায়–অবশ্যাষে!
মরণ আমার হায় গ—মরণ
লয়ন-জলে থোয়াই চরণ
সযতনে মুছায়ে দি আমার কালো ক্যাশে।
যদি আইলা অবশ্যাষে—হে!
হায়-হায় গ! আইলা যোগীর ব্যাশে।
চাচর চুলে জট বাছি লয়ানে নেই কাজল–
অধরে নাই হাসির ছটা–চক্ষে ঝরে বাদল!
গানের সুর তার উত্তেজনায় উঁচু হয়ে উঠল। বাতাসে জোর ধরেছে। আগুন দ্রুত এগিয়ে আসছে। কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া এই দিকে আসছে এবার; বাতাস ঘুরছে। আগুনের সঙ্গে বাতাসের বড় ভাব। ইনি এলেই—উনি একেবারে ধেয়ে আসবেন। বাঘা পড়ল ফাঁদে। হায় রে বন্ধু। আমার, হায় রে! এইবার ফঁদে পড়লা! গান থামিয়ে আবার সে খিলখিল করে হেসে উঠল।
বন্ধু এবার বুঝেছে।
একেবারে রাগে আগুন হয়্যা আয়ান ঘোষ আসছে হে! এইবারে ঠেলা সামলাও! বাঘা এবার ফিরল, আগুন দেখে সচকিত হয়ে দ্রুত চলতে শুরু করল দক্ষিণ মুখে। ও-দিক ছাড়া পথ নাই। কিন্তু ওই পথেও তোমার কাটা বন্ধু! হায় বন্ধু!
চেঁচিয়েই কথাগুলি বলছিল পিঙলা। তার আজ মাতন লেগেছে। সেও হাতে জল কেটে ডোঙাটাকে দক্ষিণ দিকে নিয়ে চলেছিল। কিন্তু হঠাৎ কি হল? বাঘটা একটা প্রচণ্ড হুঙ্কার ছেড়ে থমকে দাঁড়াল; দু পা পিছিয়ে এল। সেই প্রচণ্ড চিৎকারে পিঙলার হাত থেমে গেল, মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেল। বাঘের হুঙ্কার সমস্ত চরটাকেই যেন চকিত করে দিলে।
আহায় হায় হায়! উল্লাসে উত্তেজনায় যেন থরোথরো কাপন বয়ে গেল পিঙলার সর্বদেহ-মনে। সে চিৎকার করে উঠল—আ!
বাঘার সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে—মস্ত এক পদ্মনাগ।
আ—! হায়—হায়–হায়, মরি—মরি—মরি রে!
ওদিকে আগুনের অ্যাঁচ পেয়ে বেরিয়েছে পদ্মনাগ। সেও পালাচ্ছিল, এও পালাচ্ছিল, হঠাৎ দুজনে পড়েছে সামনাসামনি। নাগে বাঘে লাগল লড়াই-হায় হায় হায়!
সে ডোঙাটাকে নিয়ে চলল তীরের দিকে। ভাল করে দেখতে হবে। মরি মরি মরি, কি বাহারের খেলা রে! সোজা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে দুলছে পদ্মনাগ। চোখে তার স্থিরদৃষ্টি। কালো দুটি মটরের মত চোখ। তাতে কোনো ভাব নাই, কিন্তু বিষমাখা তীরের মত তীক্ষ্ণ এবং সোজা। বাঘা যে দিকে ফিরবে, সে চোখও সেই দিকে ঘুরবে তার ফণার সঙ্গে। মরি-মরি-মরি! পদ্মফুলের মত চক্রটির কি বাহার! লিকলিক করে চেরা জিভ মুহুর্মুহুঃ বের হচ্ছে আগুনের শিখার মত। বাঘাও হয়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর। চোখ দুটো যেন জ্বলছে—লম্বা কালো কাঠির মত তারা দুটো চওড়া হয়ে উঠেছে। গোঁফগুলো হয়ে উঠেছে খাড়া সোজা; হিংস্র দুপাটি দাঁত বের করে সে গর্জাচ্ছে; গায়ের ব্লোয়া যেন ফুলছে—লেজটা আছড়ে আছড়ে পড়ছে মাটির উপর। কিন্তু তার নড়বার উপায় নাই। নড়লেই ছোবল মারবে পদ্মনাগ! নাগও নড়ছে না, সুযোগ পেলেই বাঘা মারবে তার থাবা নাগের মাথার উপর। বাঘা মধ্যে মধ্যে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে—সঙ্গে সঙ্গে সভয়ে পিছিয়ে আসছে। মাটির উপর ছোবল পড়েছে নাগের। বাঘা সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে পড়তে চায়নাগের উপর; কিন্তু তা পারছে না; লাফ দেবার উদ্যোগ করতে করতে নাগ যেন বিদ্যুতের মত উঠে দাঁড়াচ্ছে। তখন যদি বাঘা লাফ দেয়, তবে রক্ষা থাকবে না-একেবারে ললাটে দংশন করবে না। সেটা বুঝেছে বাঘা। তাই লাফ না দিয়ে ব্যর্থ ক্রোধে উঁচু দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে উঠছে।
ডোঙার উপর উঠে দাঁড়াল পিঙলা।
আ—! আ—মরি মরি রে! আ—
চারিদিকের এক দিকে গঙ্গা–এক দিকে বিল। আর দুদিক থেকে ছুটে এল বেদেরা, ঘোসেরা, চাষীরা। বিলের দিকে ডোঙার উপর দাঁড়িয়ে নাগিনী কন্যা পিঙলা।
গঙ্গারাম দাঁড়িয়েছে বাঘটার ঠিক ওদিকে। তারও চোখ জ্বলছে। তার হাতে সড়কি দুলছে। সে মারবে বাঘটাকে।
–না। চিৎকার করে উঠল পিঙলা।
থমকে গেল গঙ্গারাম। সে তাকালে পিঙলার দিকে। বাঘটার মতই দাঁত বার করে বললে লাগ মরবে বাঘার হাতে।
—কে কার হাতে মরে দেখ ক্যানে!
–তা’পরেতে? লাগ যদি মরে—
–বাঘাকে রেখ্যা যাবে না!
—না। বিষহরির দাস আমরা। বলতে বলতে হাতের সড়কিটা দুলে উঠল। পিঙলা মুহূর্তে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল জলে। সড়কিটা সঁ করে ডোঙাটির উপরের শূন্যলোক দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে পড়ল বিলের জলে। পিঙলার বুঝতে ভুল হয় নাই। বাঘাকে বিধবে তো পিঙলার চোখে চোখ কেন গঙ্গারামের? পরমুহূর্তেই আর একটা সড়কি বিধল বাঘটাকে। গর্জন করে লাফিয়ে উঠল। বাঘটা। যে মুহূর্তে সে পড়ল মাটিতে, সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে এসে পদ্মনাগ তাকে মারলে ছোবল। আহত বাঘটা থাবা তুলতে তুলতে সে এঁকেবেঁকে তীব্র গতিতে গিয়ে পড়ল বিলের জলে। মুখ ড়ুবিয়ে এখন সে চলেছে সোজা তীরের মত, তার নিশ্বাসে পিচকারির ধারার মত জল উৎক্ষিপ্ত করে চলেছে। কিন্তু জলে রয়েছে নাগিনী কন্যা। এক বুক জলে দাঁড়িয়ে সে লক্ষ্য করছিল। ডোঙার উপর উঠে বসল সে। খপ করে চেপে ধরল নাগের মাথায়। অন্য হাত লেজে। নাগ বন্দি হল।
বেদেরা ধ্বনি দিয়ে উঠল।
গঙ্গারাম ঘাটে এসে দাঁড়াল। ডোঙাটা ঘাটে এসে লাগতেই সে বললে–ঘাটে ধেয়ান না কর্যা তু ডোঙায় বস্যা থাকলি? খ্যানত কলি?
পিঙলা হেসে বললে–ইটা লাগিনী গ বাবা। বাঘটা লাগিনীর হাতে মরিছে।
চিৎকার করে উঠল গঙ্গারাম—খ্যানত ক্যানে করলি? ঘাটে বস্যা ধেয়ান না কর্যা ইটা কি হইল?
পিঙলা স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল। এ তার বিচিত্র দৃষ্টি। মনে হয় ওর প্রাণটাই যেন আগুনে জ্বলতে জ্বলতে চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে।
ভাদু এবার এগিয়ে এসে বললে–ইটা তুই কি কইছিল গঙ্গারাম? বাঘের মুখে পরানটা যেত না?
পিঙলা হেসে বললে—সে ভালই হইত রে ভাদু মামা। লাগিনীর হাত হইতে বাঘটা কেঁচা যেত।
তারপর বললে—লে, নাকাড়া বাজা, পূজা আন। মা তো জাগিছেন রে। চাক্ষুষ পেমাণ তো মোর হাতেই রইছে। পদ্মলাগিনী। অরে হাবু, লে তো–সড়কিটা জলে পড়িছে—তুল্যা আন তো। দে, শিরবেদেকে ফিরায়ে দে। আঃ, কি রকম সড়কি ছুড়িস তু শিরবেদে হয়্যা–ছি-ছি-ছি! ভাম হয়ে দাঁড়ায়ে ক্যানে গ? লে লে, পূজা আন্। বাঘাটার চামড়াটা ছাড়ায়ে লিবি তোলে। আর দাঁড়ায়ে থাকিস না। বেলা দুপহর চলে গেল তিন পহর হয়-হয়। জমুনীর ঘুম ভাঙিছে, খিদা লাগে না। বাজা গ, তুরা বাজা।
বাজতে লাগল নাকাড়া।
গঙ্গারাম যাই বলুক, বেদেপাড়ার লোক এবার খুব খুশি! এবার শিকার হয়েছে প্রচুর। খরগোশ, সজারু, তিতির অনেক পাওয়া গিয়েছে। তার উপর হাঁস বলি হবে। হিজল বিলের ধারে সাতালী গ্রাম, সেখানে মাংস দুর্লভ নয়। ফাঁদ পাতলেই সরালি হাস, জলমুরগি পাওয়া যায়; কাদাখোঁচা, হাঁড়িচাচা, শামকল দল বেঁধে বিলের ধারে ধারে লম্বা পা ফেলে ঘুরছে। বাঁটুল মেরে তীর ছুঁড়ে তাও মারা যায় অনায়াসে। কিন্তু তা বলে আজকের খাওয়ার সঙ্গে সে খাওয়ার তুলনা হয়! আজিকার এই দিনটির জন্য আজ দু-তিন মাস ধরে আয়োজন করছে, সংগ্রহ করছে। কার্তিক মাসে হিজল বিলের পশ্চিমের মাঠ রবি-ফসলে সবুজ হয়ে ওঠে। গম, যব, ছোলা, মসুরি, আলু, পেঁয়াজ, রসুন—হরেক রকম ফসল। ফসল পাকলে বেদেরা সেই ফসল কুড়িয়ে সংগ্রহ করে, চুরি করে সংগ্রহ করে। পেঁয়াজ, রসুন, মসুরি তারা সযত্নে রেখে দেয় এই দিনটির জন্যে। পেঁয়াজ রসুন লঙ্কা মরিচ দিয়ে পরিপাটি করে রান্না করবে মাংস; আজ খাবে পেট ভরে; কালপরশুর জন্য বাসি করে রেখে দেবে। বাসি মাংস রাঁধবে মসুরি কলাই মিশিয়ে। এমন অপরূপ খাদ্য কি হয়! কাজেই আজ শিকার বেশি হওয়ায় সকলেই খুশি। তার উপর মা-বিষহরির মহিমায় নাগ মেরেছে। বাঘ। বাঘের চামড়াটা ছাড়ানো হচ্ছে। ওটাকে নুন মাখিয়ে শুকিয়ে নিয়ে মায়ের খানের আসন হবে। জয় জয় বিষহরি! পদ্মাবতী! জয় জয় বেদেকুলের জনী!
জয় বিষহরি গ! জয় বিষহরি গ!
সকল দুস্ক হইতে মোরা তুমার কৃপায় তরি গ!
অ–গ।
উৎসব আরম্ভ হয়ে গেল। বাজতে লাগল নাকাড়া, বিষম্যাকি। বাজতে লাগল তুমড়ী বশি, চিমটের কড়া। পিঙলা বসেছে মাঝখানে—ছেড়ে দিয়েছে সদ্য-ধরা পদ্মনাগিনীকে। অবশ্য এরই মধ্যে তার বিষদাঁত ভেঙে তাকে কামিয়ে নিয়েছে। সদ্য-ধরা নাগিনী, বন্দিনীদশার ক্ষোভে, মুখের ক্ষতের যন্ত্রণায় অধীর হয়ে মাথা তুলে ক্রমাগত ছোবল মারছে। পিঙলা হাতের মুঠা ঘুরিয়ে, হাঁটু দুলিয়ে, তাকে বলছে—নে, দংশা, দংশা না দেখি! ঠিক ছোবলের সময় হাঁটু বা হাত এমনভাবে সরে যাচ্ছে যে, নাগিনী মুখ আছড়ে পড়ছে মাটিতে। পিঙলা গাইছে–
নাগিনী তুই ফুঁসিস না।
ও কালামুখী নাগিনী লো—এমন করা যুঁসিস না।
ও দেখলে তারে পাগল হবিতাও কি লো তুই বুঝিস না!
এমন কর্যা ফুঁসিস না।
ওদিকে গঙ্গারাম বসেছে মদের আসর পেতে। চোখ দুটো রাঙা কুঁচের মত লাল হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে আজ গম্ভীর। অন্য কেউ লক্ষ্য না করলেও ভাদু সেটা লক্ষ্য করেছে। গঙ্গারামকে ভাদু ভাল চোখে দেখে না। ভাদু বেদের দেহখানা যেমন প্ৰকাণ্ড, সাহসও তেমনি প্রচণ্ড। সাপ ধরতে, সাপ চিনতেও সে তেমনি ওস্তাদ। গঙ্গারাম ডাকিনী-সিদ্ধ; হোক ডাকিনীসিদ্ধ, কিন্তু বিষবিদ্যায় ভাদুর কাছে সে লাগে না। মহাদেবের কাছে সে বিদ্যাগুলি শিখে নিয়েছে। পিঙলার মামা ভাদু। মা-বাপ-মরা কন্যেটিকে সে-ই মানুষ করেছিল। তাকে নাগিনী-কন্যারূপে আবিষ্কার প্রকৃতপক্ষে করেছিল ভাদু। শবলার সঙ্গে যখন মহাদেবের বিবাদ চরমে উঠেছিল, যখন মহাদেব মা-বিষহরিকে ডাকছিলমা গগা, জননী গো নতুন কন্যে পাঠাও। বেদেকুলের জাতধরম বাঁচাও। পুরনো কন্যের মতি মলিন হল মা, সর্বনাশীর পরানে। সর্বনাশের তুফান উঠিছে। সৰ্বনাশ হবে। তুমি বাঁচাও। নতুন কন্যে পাঠাও। তখন দুই বলেছিল-পিঙলার পানে তাকায়ে দেখিছ ওস্তাদ? দেখো দেখি ভাল করে! কেমন-কেমন লাগে যেন আমার।
—কেমন লাগে?
–ললাটে লাগচক্ক দেখবার দিষ্টি মুই কোথা পাব? তবে ইদিকের লক্ষণ দেখা যেন মনে লাগে—লতুন কন্যে আসিছে, ফুটিছে কন্যেটির অঙ্গের লক্ষণে।
এই জাগরণের দিনে—এই আগুনের অ্যাঁচে যেদিন নাগরা ঘুম থেকে জাগে, এই দিনের উৎসবেই ভাদু পিঙলার হাত ধরে মহাদেবের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলেছিল—দেখ দেখি ভাল কর্যা।
–হঁ!হঁ!হঁ!
চিৎকার করে উঠেছিল মহাদেব–জয় মা-বিষহরি। লাগচক্ক! লাগচক্ক! কন্যের ললাটে লাগচক্ক! এলেন—এলেন। লতুন কন্যে এলেন।
পিঙলা হল নতুন নাগিনী কন্যা। ভাদু হল মহাদেবের ডান হাত। শবলা পিঙলাকে বলেছিল—তুর ভয় নাই পিঙলা! তুর অনিষ্ট মুই করব না। তুরে মুই সব শিখিয়ে যাব, বল্যা যাব গোপন কথা। ভাদুকে কিন্তু সাবধান। তুর মামা হলি কি হয়,–শিরবেদের মন রেখে তুরে নাগিনী কন্যে করে দিলে। শিরবেদের পরে উই হবে শিরবেদে। উকে সাবধান। নাগিনী কন্যে আর শিরবেদে–সাপ আর নেউল। ই বিবাদ চিরদিনের। উরে সাবধান!
গঙ্গারাম ফিরে না এলে ভাদুই হতে শিরবেদে। ভাদুর মন্দকপালের জন্যই গঙ্গারাম ফিরল। প্রথম প্রথম গঙ্গারাম ভাদুর কথা শুনেই চলত। কিন্তু ডাকিনী-সিদ্ধ গঙ্গারাম কিছুদিনের মধ্যেই ভাদুকে ঝেড়ে ফেলে দিলে। ভাদুও বিষবিদ্যা ওস্তাদ, সেও তো সামান্য জন নয়, ঝেড়ে ফেলতে গেলেই কি ফেলা যায়? সে-বিদ্যার জোরে নিজের আসন রেখেছে, সেই আসনে বসে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে গঙ্গারামের উপর।
গঙ্গারাম আজ গম্ভীর, সেটা ভাদু লক্ষ্য করেছে। সে জিজ্ঞাসা করলে—কি ভাবিছ গ শিরবেদে?
—অ্যাঁ? কি ভাবিব?
–তবে? আনন্দ কর–আনন্দের দিন। দিন গেল্যা—তো চলাই গেল। হাস খানিক।
–হাসিব কি? তু কইলি—খ্যানত হয় নাই। কিন্তু আমার মনে তা লিছে না। কন্যাটা খ্যানত করিছে। উটা হইছে সাক্ষাৎ পাপ।
—তবে মায়েরে ডাক। লতুন কন্যে দিবেন জনী। পাপ বিদায় হবে। লয় তো–। হাসলে ভাদু।
–হাসিলি যে? লয় তো কি, না বলা চুপ করলি? বল, কথাটা শ্যাম কর।
কথা শেষ হবার অবকাশ হল না। এসে দাঁড়াল দুজন বেদে।–লোক আসিছে গ!
—লোক?
–হঁ। লোক আসিছে ডাক নিয়া।
–ডাক নিয়া?
অর্থাৎ আহ্বান এসেছে বিষবৈদ্যের। কোথাও নাগ-আক্রমণ হয়েছে। মানুষ শরণ মেগেছে। বিষহরির সন্তানদের সঙ্গে সঙ্গে যেতে হবে–এই নিয়ম।
দংশন হয়েছে বড় জমিদার-বাড়িতে। সাঁতালী থেকে ক্রোশ তিনেক পশ্চিমে; পুরনো জমিদার-বাড়িতে গত বৎসর থেকেই নাগের উপদ্রব হয়েছে। গত বৎসর বর্ষায় সাতাশটা গোখুরার বাচ্চা বেরিয়েছিল। বাড়ির দরজায় উঠানে, আশপাশে ঘরের মেঝেতে পর্যন্ত। বাবুরা ডেকেছিলেন—মেটেল বেদেদের। ওখানে ক্ৰোশখানেকের মধ্যেই আছে মেটেল বেদে। মেটেল বেদেরা বিষহরির সন্তান নয়। ওরা সাধারণ বেদে। ওরা জলকে এড়িয়ে চলে। মাটিতে কারবার। হাঁটা-পথে ওরা ঘুরে বেড়ায়। ওরা সাপ বিক্রি করে। ওরা চাষ করে, লাঙল ধরে। সাঁতালীর বিষবেদেদের সঙ্গে ওদের অনেক তফাত।
ওরা অবশ্য বলে—তফাত আবার কিসের?
সাঁতালীর বেদেরা হাসে। তফাত কি? নিয়ে এস মাটির সরায় জীবের তাজা রক্ত। ফেলে দাও গোখুর কি কালনাগিনীর এক ফোঁটা বিষ। কি হবে? বিষের ফোঁটা পড়বামাত্র রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠবে, আগুনের অ্যাঁচে ফুটন্ত জলের মত। তারপর খানা খানা হয়ে ছানার মত কেটে যাবে। খানিকটা জল টলটল করবে তার উপর ভাসবে জলের উপর তেলের মত নাগ-গরল! তারপর? আয় রে মেটেল বেদে! নিয়ে আয় রে জড়িবুটি-শিকড়-পাথর-মন্ত্ৰ-তন্ত্র। নে, ওই জমাটবাঁধা রক্তকে কর আবার তাজা রক্ত। নাই, নাই সে বিদ্যে তোদের নাই। সে বিদ্যা আছে সাঁতালীর বিষবেদেদের। তারা পারে—তারা পারে। তাদের সাঁতালীতে এখনও আছে। সাঁতালী পাহাড় থেকে আনা এক টুকরা মূল্যের লতা। সেই লতার রস, তাজা লতার রস ফেলে দেবে সেই জমাটবাঁধা রক্তে; হকবেমা-বিষহরিকে স্মরণ করে তাদের মন্ত্র। দেখবি, তেলের মত সাপের বিষ মিলিয়ে যেতে থাকবে, জমাটবাঁধা রক্তের ঢেলা আর জল মিশে যাবে। মনে হবে, গলে গেল আগুনের অ্যাঁচে ননীর মত।
ঝাঁপান খেলা দেখে যাস সাঁতালীর বিষবেদেদের। তাদের সঙ্গে তোদর তুলনা! হা-হা করে হাসে বিষবেদেরা।
গত বছর সেই মেটেল বেদেদের ডাক দিয়েছিলেন বাবুরা। তারা এসে হাত চালিয়ে গুনে বলেছিল—এ উপদ্রব ঘরের নয়, বাইরের। বাড়ির বাইরে কোথাও নাগের বংশবৃদ্ধি হয়েছে; সেই। বংশের কাচ্চাবাচ্চারা বড় বাড়ির শুকনো ভকতকে মেঝেতে ঘর খুঁজতে এসেছে। তারা জড়ি দিয়ে, বিষহরির পুষ্প দিয়ে, মন্ত্ৰ পড়ে বাড়ির চারিপাশে গণ্ডি টেনে দিয়েছিল, গৃহবন্ধন করে দিয়েছিল; বাবুরাও বিলাতি ওষুধ ব্যবহার করেছিলেন। ওদিকে আশ্বিন শেষ হতেই কার্তিকে নাগেরা কালঘুমে মুদ নিয়েছিল। এবার এই ফাল্গুন মাসেই নাগ দেখা দিয়েছেন তিন দিন। বাড়ির পুরনো মহলে রান্নাবাড়ি ভাড়ার ঘর; সেই ভঁড়ারে গিনি দুদিন দেখেছেন নাগকে। প্ৰকাণ্ড গোখুরা। ভোররাত্রে পাঁচক ব্রাহ্মণ উঠেছিল বাইরে; ঘর থেকে বাইরে দু পা দিতেই তাকে দংশন করেছে। মেটেল বেদেদের ডাকা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বিষবেদেদের কাছেও লোক এসেছে। যেতে হবে।
ভাদু উঠে দাঁড়াল। কানে নাকে হাত দিয়ে মাকে স্মরণ করে বললে–গঙ্গারাম!
–হাঁ।
গঙ্গারাম জননীকে স্মরণ করে উঠেই চলে গেল নাচ-গানের আসরে।
আজিকার দিন, কন্যাকেও সঙ্গে যেতে হবে। কন্যা নইলে মা-বিষহরির পুষ্প দিয়ে গৃহবন্ধন করবে কে?
সাঁতালী গ্রামের বেদে-বেদেনীরা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। এমন শুভ লক্ষণ পঞ্চাশ বছরে হয়। নাই। জাগরণের দিনে এসেছে এমন বড় একটা ডাক।
নিয়ে আয় কাঁপিবুলি, তাগা, শিকড়, বিশল্যকরণী, ঈশের মূল, সাঁতালী পাহাড়ের সেই লতার পাতা, পাতা যদি না দেখা দিয়ে থাকে তবে এক টুকরো মূল। মূল খুঁজে না পাস, নিয়ে আয় ওখানকার খানিকটা মাটি। বিষহরির পুষ্প সঙ্গে নে, আর নে বিষপাথর। ঝাঁপি নে খালি কাঁপি, আর খন্তা নিয়ে চল।
সাঁতালী পাহাড়ের মূল থেকে পাতা আজও গজায় নাই। নতুন বছরের জল না পেলে গজায় না। মূলও তার পুরনো হয়েছে। তার উপর কেটে কেটে মূলও হয়ে পড়েছে দুর্লভ।
ভাদু বললেওতেই হবে। মানুষটা বাঁচবে বলে মনে লাগছে না। ভোররাত্রের কামড় সাক্ষাৎ কালের কামড়। ওতে বাঁচে না। যদি পরানটা থাকেও এতক্ষণ, তবুও ফিরবে না। তবে জমিদার-বাড়ির লাগ-বন্দি করলে শিরোপা মিলবে।
পিঙলা বললে তুরা যা, মই যাব না।
–ক্যানে?
–না। অধরমের শিরোপা নিয়া মোর কাজ নাই।
–কন্যে! গম্ভীর স্বরে শাসন করে উঠল গঙ্গারাম।
সঙ্গে সঙ্গে ভাদুও যোগ দিলে—পিঙলা!
পিঙলা হাসলে বিচিত্ৰ হাসি। বাবুদের বাড়ির তোক দুটি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, তারা বললে—গিনি-মা বারবার করে বলে দিয়েছেন, ওদের কন্যেকে আসতে বলবি। বিষহরির পূজা করাব।
কি বলবে পিঙলা এদের সামনে? কি করে বলবে?
ভাদু বললেহোথাকে বিষ লহমায় এক যোজন ছুটছে কন্যে—নরের রক্তে নাগের বিষ পাথার হত্যা উঠছে। সে পাথারে পরান-পুতুল ড়ুব্যা গেলে আর শিবের সাধ্যি হবে নাই। চল্—চল্। দেরি করলে অধরম হবে।
–অধরম? হাসলে পিঙলা।—মুই অধরম করছি?
–হাঁ, করছিল।
—তবে চল্। তোর ধরম তোর ঠাঁই। তোর ললাটও তোর ঠাঁই। মই কিন্তুক সাবধান করা দিছি তুকে। তু সাবধান হয়্যা লাগ-বন্দি করিস।
তির্যক দৃষ্টিতে চাইলে তার দিকে–ভাদু গঙ্গারাম দুজনেই।
তাতেও ভয় পেল না পিঙলা। বললে—মহিষের শিঙ দুটা বাঁকা, ইটা ইদিকে যায় তো উটা উদিকে যায়। কিন্তু কাজের বেলায়—যুঁজবার বেলা দুটার মুখই এক দিকে!
গঙ্গারাম উত্তর দিলে না। ভাদু হাসলে। বললে—কন্যের আমাদের বড় খর দিষ্টি গ। দিষ্টিতে এড়ায় না কিছু।
গামছাটা কোমরে ভাল করা জড়ায়ে লে গ।
গঙ্গারাম চমকে উঠল।
ভাদু বললে অঃ, খুব বলেছিস গ কন্যে। বেঁচ্যা থাক্ গ বিটি। বেঁচ্যা থাক্।
ললাট করবার লেগ্যা? তা মুই বাঁচিব অনেক কাল। বুঝলা না মামা, বাঁচিব মুই অনেক কাল। আজ যখন সড়কিটা বাঘ না বিঁধ্যা, বাতাস বিঁধ্যা জলে পড়িছে, তখুন বাঁচিব মুই অনেক কাল।
হেসে উঠল সে।
গঙ্গারাম পিছিয়ে পড়েছিল। সে কাপড় সেঁটে, গামছা কোমরে ভাল করে বেঁধে নিচ্ছিল। এগিয়ে এসে সঙ্গ নিয়ে সে বললে—কি? হাসিটা কিসের গ?
সড়কির কথা বুলছে কন্যে।
হুঁ–।
মুইও বুঝতে পারি কি করে ফসকায়ে গেল।
–কাকে রে? বাঘটাকে না পাপিনীটাকে?
–কি বুলছিস ত গ?
—বুলছি, চাল সিদ্ধ করলি পর ভাত হয়। এমুন আশ্চয্য কথা শুনেছিস কখুনও? সে আবার হেসে উঠল।