বিষ
১৯৭১ সালের ঘটনা।
কায়রোর একটি মসজিদ। মসজিদটি বেশী বড়ও নয়, তেমন ছোটও নয়। জুমার জামাত অনুষ্টিত না হলেও পাঞ্জেগানা জামাতে মুসল্লি হয় প্রচুর।
শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত এ মসজিদ-এলাকায় বাস করে মধ্যম ও নিম্নবিত্তের মানুষ। ধর্মের প্রতি এখনো তারা বেশ অনুরাগী। আবেগপূর্ণ আকর্ষণীয় কথায় সঙ্গে সঙ্গে তারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। তবে তারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী মিসর এসে যেসব নতুন সৈন্য সংগ্রহ করেছিলেন, তাতে এই এলাকার লোকেরাই ভর্তি হয়েছিল বেশী। তার কারণ ছিল দুটি। প্রথমতঃ এটি জীবিকা নির্বাহের একটি মাধ্যম। সালাহুদ্দীন আইউবী তার সৈন্যদের আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা ও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতেন। দ্বিতীয়তঃ জিহাদ যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ আমল, তা তাদের ভাল করেই জানা ছিল। ইসলামের জন্য জীবন দিতে তারা প্রস্তুত থাকত সর্বক্ষণ। সে যুগে তাদের মত চেতনাসম্পন্ন মর্দে মুমিনের প্রয়োজন ছিল অপরিসীম। সরকারীভাবে তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছিল, খৃষ্টজগত ইসলামী দুনিয়ার নাম-চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। বীর বিক্রমে তাদের মোকাবেলা করে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে। অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে জিহাদের ময়দানে।
ছয়-সাত মাস হল, অখ্যাত এ মসজিদটির সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিক। এই খ্যাতির কারণ নতুন ইমাম, যিনি প্রতিদিন ঈশার নামাযের পর আকর্ষণীয় দরস প্রদান করছেন।
আগের ইমাম তিনদিন আগে মারা গেছেন। তিনি দুঃসহ পেটব্যাথা আর অস্ত্র জ্বালায় ভুগছিলেন। অভিজ্ঞ ডাক্তার-হেকিম কেউ-ই তার এ রোগের কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেননি। অবশেষে এ রোগেই তিনি মারা যান। তিনি একজন সাধারণ মৌলভী ছিলেন। শুধু পাঞ্জেগানা জামাতের ইমামতি করতেন। এর অতিরিক্ত কোন যোগ্যতা তার ছিল না।
ইমামের মৃত্যুর ঠিক আগের দিন অচেনা এক মৌলভী এসে হাজির হন মসজিদে। লোকটির গৌরবর্ণ চেহারা। সুঠাম দেই। মুখজোড়া ঘন লম্বা দাড়ি। সঙ্গে আপাদমস্তক কালো বোরকায় আবৃতা দুজন মহিলা। সম্পর্কে তার স্ত্রী। দুই স্ত্রী নিয়ে তিনি এতদিন কোন এক ঝুপড়িতে বাস করতেন।
আলাপ-পরিচয়ের পর আগন্তুক অত্র মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব পালন করার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। বেতন-ভাতার প্রয়োজন নেই। মুসল্লিদের খাতির-সমাদরও তার নিষ্প্রয়োজন। কারো হাদিয়া-নজরানাও গ্রহণ করবেন না। প্রয়োজন শুধু মানসম্পন্ন প্রশস্ত একটি বাসস্থান, যেন তিনি সেখানে দুই স্ত্রীসহ সম্মান ও পর্দার সাথে বাস করতে পারেন।
মুসল্লিরা তার প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করে নেয়। তারা মসজিদের সন্নিকটে একাধিক কক্ষবিশিষ্ট একটি বাড়িও তাকে খালি করে দেয়। দুই স্ত্রীকে নিয়ে সেই বাড়িতে এসে উঠেন নতুন ইমাম। স্ত্রী দুজন কালো বোরকায় আবৃতা। হাতে-পায়ে কালো মোটা মোজা। দেহের কোন অংশ পর-পুরুষের চোখে পড়ার জো নেই। এমন পর্দানশীল মহিলা এ যুগে কমই চোখে পড়ে। মুসল্লিরা ঘরের জরুরী আসবাবপত্রের ব্যবস্থাও করে দেয়। বাহ্যিক আচার-আচরণ দেখে তাদের মনে নতুন ইমামের প্রতি বেশ শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হয়। আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে একজন যোগ্য ইমাম পেয়ে গেছি, এই তাদের বিশ্বাস।
প্রথমবারের মত মিনারে দাঁড়িয়ে আযান দেন নতুন ইমাম। সে কি যাদুমাখা সুরেলা কণ্ঠ! যতদূর পর্যন্ত তার আযানের আওয়াজ পৌঁছে, সর্বত্র যেন নেমে আসে এক স্বর্গীয় নিস্তব্ধতা। গোটা প্রকৃতিকে মাতাল করে তুলছে যেন তার আযানের মধুর আওয়াজ। তার যাদুময় আযানের চুম্বকর্ষণে তারাও মসজিদপানে ছুটে আসে, ইতিপূর্বে যারা নামায পড়ত ঘরে, কিংবা আদৌ নামাযে অভ্যস্থ ছিল না।
প্রথম রাতেই তিনি ঈশার নামাযের পর মসজিদে দন্স প্রদান করেন। পরে ঘোষণা দেন যে, এভাবে প্রতি রাতেই তিনি দর্স প্রদান করবেন। নতুন ইমামের বয়ান শুনে মুসল্লিরা বেজায় খুশি।
ছয়-সাত মাস সময়ে নতুন ইমাম মুসল্লিদেরকে তার নিবেদিতপ্রাণ ভক্তে পরিণত করেন। অনেকে তার মুরীদও হয়ে যায়।
কায়রোর সেই মসজিদে এতকাল জুমার নামায অনুষ্ঠিত হত না। নতুন ইমাম এবার জুমার নামাযও চালু করেন।
দূর-দূরান্ত পর্যন্ত সেই অখ্যাত মসজিদ এবং নতুন ইমামের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। শহর থেকেও কিছু লোক ইমামের দরূসে যোগ দিতে শুরু করে।
ইমাম ইসলামের যে দুটি মৌলিক বিষয়ের উপর জোরালো বক্তব্য দিতেন, তাহল, ইবাদত ও সম্প্রীতি। দরসে তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহের বিপক্ষে সবক দিতেন। মানুষের চিন্তা-চেতনায় তিনি এ বিশ্বাস বদ্ধমূল করে দেন যে, মানুষের ভাল-মন্দ সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হাতে। ভাগ্য পরিবর্তনে মানুষের কোন দখলঃনই। মানুষ দুর্বল প্রকৃতির একটি প্রাণী মাত্র।
বড় ক্রিয়াশীল ইমামের বয়ান। তিনি কুরআন হাতে নিয়ে বয়ান করতেন। যে কোন বিষয়ে বয়ান করার সময় কুরআনের কোন না কোন আয়াত বের করে তার আলোকে বিষয়টি বিস্তারিত বুঝিয়ে দিতেন। তিনি সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর ভূয়সী প্রশংসা করতেন। প্রায় সময়ই তিনি বলতেন, মিসরের বড় খোশনসীব যে, সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর মত এক মহান নেতা তার রাজত্ব করছেন।
ইমাম জিহাদের এমন দর্শন ও ব্যাখ্যা প্রদান করেন, যা সেখানকার লোকদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন। তবু বিনা বাক্যব্যয়ে অবলীলায় তারা তার সেই ব্যাখ্যা মেনে নেয়।
.
এক রাতে ইশার নামাযের পর ইমাম দরস দিচ্ছেন। হঠাৎ এক কোণ থেকে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলে উঠল, মুহতারাম! আল্লাহ আপনাকে কবুল করুন। আপনার বিদ্যার আলো জিন-পরী এবং আমরা চোখে দেখি না এমন মাখলুক পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন। আমরা আট বন্ধু বহু দূর থেকে আপনার মূল্যবান বয়ান শুনতে এসেছি। এসেছি আপনার সুনাম-সুখ্যাতি শুনে। যদি গোস্তাখী না হয় এবং যদি আপনি বিরক্তিবোধ না করেন, তাহলে আমাদেরকে জিহাদ সম্পর্কে আরো কিছু বলুন। জিহাদের ব্যাপারে আমরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছি। মানুষ বলছে, জিহাদ সম্পর্কে নাকি আমাদেরকে ভুল ধারণা দেয়া হচ্ছে।
মসজিদের বিভিন্ন স্থান থেকে আরো সাতটি কণ্ঠ সমস্বরে বলে উঠে, আমরা এমন ওয়াজ জীবনে আর কখনো শুনিনি। দয়া করে আপনি আরো বলুন। জিহাদ বিষয়টি আমাদের খোলাসা করে বুঝিয়ে দিন।
মহামান্য ইমাম যা বললেন, তা-ই নির্ভুল এবং সময়োপযোগী বক্তব্য। অন্যরা আমাদেরকে বিকৃত ধারণা দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে। আমরা সঠিক বক্তব্য শুনতে চাই। বলল একজন।
ইমাম বললেন, এটি কুরআনের আওয়াজ। ইনশাআল্লাহ, কেউ একে বিকৃত করতে পারবে না। যা সত্য, যা সঠিক, তা আমি বলব-ই। প্রয়োজনে একই কথা হাজার বার বলতে হলেও আমি তা প্রতিটি মানুষের কানে পৌঁছিয়ে দেব। অন্যের ভূখন্ড দখল করার উদ্দেশ্যে মানুষ খুন করার নাম জিহাদ নয়। জিহাদ অর্থ হত্যা লুঠন বা খুন-খারাবীও নয়।
ইমাম কুরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করে তার এরূপ ব্যাখ্যা প্রদান করেন
আমার নিজের কথা নয়- স্বয়ং আল্লাহই বলেছেন যে, তোমরা পাপাচারের বিরুদ্ধে লড়াই কর। এরই নাম জিহাদ। এই জিহাদ-ই আমাদের সকলের উপর ফরজ। কেন, আপনারা কি শুনেননি যে, ইসলাম তরবারীর জোরে নয়- মমতার জোরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? জিহাদের রূপ বিকৃত হয়েছে পরে। আর তা করেছে রাজা বাদশাহদের তল্পিবাহক আলেমরা। আজ খৃষ্টানরা যেমন অন্যের দেশ দখল করে নিজেদের সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তৃত করার জন্য লড়াই করাকে ক্রুসেড বলছে, তেমনি মুসলমানরাও একই উদ্দেশ্যে হত্যা-লুণ্ঠন করাকে জিহাদ আখ্যা দিচ্ছে। মূলতঃ এ সব ক্ষমতা দখলের একটি কৌশল মাত্র। নিরীহ জনসাধারণকে ধর্মের নামে উত্তেজিত করে যুদ্ধে নামিয়ে রাজা-বাদশাহরা তাদের ক্ষমতার ভিত্তি পাকাঁপোক্ত করছে মাত্র। আমি জাতিকে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে চাই।
তবে কি মিসরের আমীর সালাহুদ্দীন আইয়ুবী আমাদেরকে বিভ্রান্ত করে যুদ্ধে নামিয়েছেন? প্রশ্ন করলেন একজন।
না, সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। বড়রা তাকে যা করতে বলেছে, একজন খাঁটি মুসলমানের ন্যায় সম্পূর্ণ নেক নিয়তে তিনি তার-ই উপর আমল করছেন। তার অন্তরে খৃষ্টানদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করা হয়েছে, তিনি সে আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করছেন। আচ্ছা, খৃষ্টান আর মুসলমানদের মধ্যে পার্থক্য কী? দুজনের নবী তো অভিন্ন! পরে না কিছুটা ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। হযরত ঈসা (আঃ) যেমন ভালবাসা ও শান্তির পয়গাম নিয়ে এসেছিলেন, তেমনি আমাদের রাসূল (সাঃ) ও তো প্রেম-ভালবাসার পয়গাম দিয়ে গেছেন! তাহলে এই তরবারীগুলো আসল কোত্থেকে? আল্লাহ্র এই প্রিয় ভূমিতে- যেখানে একমাত্র তাঁর-ই রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকার কথা সেখানে যারা আপন প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে নিজেদের গোলামে পরিণত করতে চায়, এসব তাদের-ই আবিষ্কার। আমি মিসরের আমীরের দরবারে যাব। তার সামনে জিহাদের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরব। তিনি অবশ্য সঠিক জিহাদের কার্যক্রম শুরু করেও দিয়েছেন। তা হলো, অজ্ঞতার বিরুদ্ধে জিহাদ। জুমার খোতবা থেকে খলীফার নাম তুলে দিয়ে তিনি বিরাট জিহাদ করেছেন। মাদ্রাসা খুলেও তিনি জিহাদ করেছেন। তবে মাদ্রাসাগুলোয় ধর্মশিক্ষার পাশাপাশি সামরিক প্রশিক্ষণ চালু করে তিনি ভাল করেননি। কোমলমতি শিশুদেরকে তিনি আল্লাহর নামে লুটতরাজের সবক দিচ্ছেন। তার মাদ্রাসাগুলোতে অসি চালনা আর তীরন্দাজির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আপনি যদি আপনার সন্তানের হাতে তরবারী আর তীর-ধনুক তুলে দেন, তাহলে তাদেরকে একথাও বলতে হবে যে, এর দ্বারা তুমি অমুককে খুন করে আস। কিছু লোককে দেখিয়ে আপনাকে বলতে হবে, অমুক তোমার দুশমন, তাকে হত্যা কর।
ইমামের কণ্ঠে এত প্রভাব আর প্রমাণ-উপস্থাপনায় এত আকর্ষণ যে, তার বক্তব্য শুনে শ্রোতারা অভিভূত হয়ে পড়ে। তিনি বললেন
আপন সন্তানদেরকে তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর। নতুবা তাদের সঙ্গে তোমাদেরও জাহান্নামে যেতে হবে। কারণ, সন্তানদেরকে ভুল পথে তুলে দেয়ার জন্য তোমরাও দায়ী। তোমাদের রাজা-বাদশাহ আর সেনাপতিরা তোমাদেরকে জান্নাতে নিয়ে যাবে না। নিবেন সেই আলেমে দ্বীন, যার হাতে ধর্ম ও ইলমের প্রদীপ। দুনিয়ার জীবনে যদি তোমরা আলেমের পিছনে চল, তাহলে কিয়ামতের দিন তিনি তোমাদেরকে জান্নাতে নিয়ে যাবেন। কিয়ামতের দিন যার হাত মানুষের রক্তে রঞ্জিত থাকবে, হাজারো নেক আমল এবং নামায-রোযা ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
আরো একটি সূক্ষ্ম কথা বুঝে নাও। তোমরা যাকাত দাও কাকে? বাইতুল মালকে তো? যখন যিনি দেশের শাসক থাকেন, বাইতুল মালের মালিক হন তিনি। আর যাকাত হল গরীব-অসহায়ের হক। শাসক তো গরীব হন না। বাইতুল মালে তোমরা যে যাকাত জমা দাও, তা দ্বারা ঘোড়া আর অস্ত্র ক্রয় করা হয়। অস্ত্রের কাজ হল মানুষ ধ্বংস করা। তার মানে, যে ফরজ আদায় করে তোমরা জান্নাতে যেতে পারতে, সেই ফরজ আদায় করে তোমরা জাহান্নামে ঠিকানা করে নিচ্ছ। তাই বলছি, তোমরা যাকাত আর বাইতুল মালে দিও না।
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ইমাম আরো বললেন
অনেক কথা সাধারণ মানুষের বুঝে আসে না। কেউ তাদেরকে বলেও না। তোমরা কি দেখছ না যে, তোমাদের মধ্যে একটি পশুবৃত্তি আছে? কেন, তোমরা কি নারীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব কর না? এই পশুবৃত্তি-ই কি তোমাদেরকে পাপের অন্ধগলিতে নিয়ে যায় না? মানুষের এই বৃত্তিটা মানুষ সৃষ্টি করেনি- করেছেন স্বয়ং আল্লাহ। তোমরা এই পশুবৃত্তিকে দমন করতে পার। এর-ই জন্যে আল্লাহ তোমাদেরকে একত্রে ঘরে চারটি করে স্ত্রী রাখতে আদেশ করেছেন। অর্থের অভাবে যদি তোমরা একজন স্ত্রী রাখতেও সক্ষম না হও, তাহলে কোন নারীকে পারিশ্রমিক দিয়ে তোমরা এই পশুবৃত্তি নিবারণ করতে পার। আরে! মানুষ তো সেই পশুবৃত্তির-ই এক ফসল। তবু তোমরা পাপ থেকে বেঁচে থাক। ঘরে এক এক, দু দু, তিন তিন ও চার চারজন করে স্ত্রী রাখ। আর স্ত্রী ও কন্যাদেরকে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে রাখ। আমি দেখতে পাচ্ছি যে, আজ যুবতী মেয়েদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। ঘোড়সাওয়ারী ও উটসাওয়ারী শেখান হচ্ছে। মহিলা মাদ্রাসা স্থাপন করে সেখানে মেয়েদেরকে যুদ্ধাহতদের সেবার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। শেখান হচ্ছে, কিভাবে তারা আহত মুজাহিদের জখমে পট্টি বাধবে। এ এক বেদআত কাজ। এই ঘৃণ্য বেদআত থেকে তোমরা তোমাদের বোন-কন্যাদেরকে হেফাজত কর। তোমাদের বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের যারা মসজিদে আসে না, আমার এ কথাগুলো তাদেরও কানে দাও। আল্লাহর বিধানে তোমরা হস্তক্ষেপ কর না। এটি মস্তবড় পাপ।
ইমামের দরস সমাপ্ত হয়। শ্রোতারা উঠে ইমামের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে যেতে শুরু করে। সেদিন বয়ানে এত বিপুলসংখ্যক লোকের সমাগম হয়েছিল যে, মসজিদের ভিতরে জায়গা না পেয়ে বহু লোক বাইরে দাঁড়িয়ে বয়ান শ্রবণ করে।
সুযোগ মত অনেকে ইমামের হাতে চুম্বনও করে। মাথা ঝুঁকিয়ে মোসাফাহা করতে বাদ দেইনি একজনও।
.
একজন একজন করে চলে গেছে সবাই। শুধু দুজন লোক ইমামের সামনে বসা। তাদের একজন সেই ব্যক্তি, যে ইমামের কাছে জিহাদ বিষয়ে বিস্তারিত বক্তব্য শুনতে আবদার করেছিল। গায়ে তার লম্বা জুব্বা। মাথায় ছোট্ট একটি পাগড়ী। পাগড়ীর উপর চওড়া ফুলদার রুমাল। মুখে লম্বা কালো দাড়ি। ঘন গোঁফ। পোশাকে তাকে মধ্যবিত্ত লোক বলে মনে হল। তার একটি চোখের উপর পট্টির মত সবুজ বর্ণের এক চিলতে কাপড়। কাপড় খন্ডটি দুটি সুতা দিয়ে মাথার সঙ্গে বাঁধা।
ইমামের জিজ্ঞাসার জবাবে সে জানাল, তার এ চোখটি নষ্ট।
দ্বিতীয় ব্যক্তির পোশাকও ছিল সাধাসিধে। তারও লম্বা ঘন দাড়ি। তারা দুজন ই এখন মসজিদে ইমামের সামনে বসা। অপর ছয় সঙ্গী- যারা জিহাদের সবক নিতে এসেছিল- মসজিদের বাইরে দন্ডায়মান, যেন তারা সঙ্গীদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
কেন, তোমাদের সন্দেহ এখনো দূর হয়নি? হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন ইমাম।
হ্যাঁ, আমাদের সব সন্দেহ দূর হয়ে গেছে। চোখে পট্টিওয়ালা ব্যক্তি জবাব দেয়।
আমরা বোধ হয় আপনাকেই খুঁজে ফিরছি। আমরা মিসরের অর্ধেকটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে এসেছি। বোধ হয়, আমাদেরকে মসজিদের অবস্থান সম্পর্কে ভুল নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।
কেন, মিসরের অর্ধেকেও আমার চেয়ে ভাল আলেম খুঁজে পাওনি বুঝি?
খুঁজছি যে শুধু আপনাকে-ই। আমরা কি সঠিক জায়গায় এসে পৌঁছিনি? আপনার দস বলছে, আমরা আপনাকেই খোঁজ করছি। জবাব দেয় একজন।
ইমাম বাইরের দিকে তাকালেন এবং নির্লিপ্তর মত বললেন, জানি না, আজকের আবহাওয়া কেমন থাকবে!
বৃষ্টি আসবে। পট্টিওয়ালা জবাব দেয়।
আকাশ তো বিলকুল পরিস্কার। ইমাম বললেন।
আমরা মেঘ নিয়ে আসব। বলেই পট্টিওয়ালা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
ইমাম মুচকি হাসলেন এবং চাপাকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে এসেছ?
এক মাস ইসকান্দারিয়ায় ছিলাম। তার আগে শেবকে। মুসলমান?
ফেদায়ী, তবে এখনো মুসলমান-ই মনে করুন। বলে সঙ্গীর প্রতি কটাক্ষ দৃষ্টিপাত করে বিকট শব্দে হেসে উঠে পট্টিওয়ালা।
আমি আপনাকে ওস্তাদ মানছি। এ-যে আপনি, আমার বিশ্বাস-ই হতে চাচ্ছে না। আপনি ব্যর্থ হতে পারেন না। বলল দ্বিতীয়জন।
তবে সফলতা অত সহজও নয়। সালাহুদ্দীন আইয়ুবীকে হয়ত তোমরা জান না। আমি সর্বস্তরের মানুষের অন্তরে জিহাদ ও যৌনতা সম্পর্কে ইসলামী ধ্যান-ধারণার বিপরীত ধারা ঢুকিয়ে দিয়েছি। কিন্তু সালাহুদ্দীন যে মাদ্রাসা খুলেছে, তা সম্ভবতঃ আমাদের প্রচেষ্টাকে সহজে সফল হতে দিবে না। আচ্ছা, তুমি আমাকে জিহাদ সম্পর্কে বলতে বলেছিলে কেন? ইমাম বললেন।
শোবকে আমাদেরকে বলা হয়েছিল, জিহাদ সম্পৰ্কীয় আলোচনা-ই আপনার সবচে বড় পরিচয়। দরূসে আপনি যা বলেছেন, তা ওখানেই আমাদেরকে শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমাদেরকে আরো বলা হয়েছিল, জিহাদের পর আপনি অবশ্যই যৌনতা নিয়ে আলোচনা করবেন। আপনি আপনার সবক বেশ ভাল করেই রপ্ত করেছেন। বলল পট্টিওয়ালা।
আমার নাম কি? ইমাম জিজ্ঞেস করেন।
আপনি কি আমাদেরকে পরীক্ষা নিতে চাচ্ছেন? আমাদের উপর কি আপনার সন্দেহ হচ্ছে? নাম নয়। আমাদেরকে পরস্পরের সংকেত শেখান হয়। পট্টিওয়ালার জবাব।
তোমরা কী উদ্দেশ্যে এসেছ? জানতে চান ইমাম।
ফেদায়ী কেন আসে? পট্টিওয়ালার পাল্টা প্রশ্ন।
তোমাদেরকে আমার নিকট কেন পাঠান হয়েছে? জিজ্ঞেস করেন ইমাম।
একটি উষ্ট্রীর জন্য। আপনার কাছে দুটি আছে। আমাদেরকে আপনার নিকট পাঠান হত না। কিন্তু আপনি জেনে থাকবেন যে, সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর এক নায়েব সালার রজব সুদানীর সঙ্গে শোবক থেকে তিনটি উন্ত্রী প্রেরণ করা হয়েছিল। তাদের একটি ছিল আমাদের জন্য। কিন্তু কী হয়েছে জানি না, তিনটি-ই মারা গেছে। রজবের বিচ্ছিন্ন মস্তক আর সবচে রূপসী উজ্জ্বীটি সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর নিকটে পৌঁছে গেছে। সেটিও শেষ হয়ে গেছে। বলল একজন।
বেদনার নিঃশ্বাস ছেড়ে ইমাম বললেন, হ্যাঁ, জানি। আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল। আইয়ুবীর এই দক্ষ কমাণ্ডারকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে আমাদের বড় কাজ হত। কিন্তু জল্লাদ তাকে শেষ করে দিল। আচ্ছা, এবার ভিতরে চলুন, এ স্থান নিরাপদ নয়।
দুই আগন্তুক ইমামের সঙ্গে উঠে মসজিদের বাইরে চলে আসেন। বাইরে অপেক্ষমান হয় সঙ্গী অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
***
তারা ইমামের ঘরে প্রবেশ করে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর। একাধিক কক্ষ। দুতিনটি কক্ষ অতিক্রম করে ইমাম তাদের অপর একটি কক্ষের সামনে নিয়ে যান। কক্ষটির অবস্থান মাটির উপরে হলেও দেখতে তা মাটির নীচে বলে মনে হয়। কক্ষের সম্মুখে খড়-কুটো ছড়ানো। দরজা তালাবদ্ধ। বুঝা গেল, কয়েক বছর ধরে তালাটি খোলা-ই হয়নি, খোলা যাবেও না।
কক্ষের এক পার্শ্বে জানালা। জানালায় হাত লাগান ইমাম। খুলে যায় জানালা। ইমাম ভিতরে প্রবেশ করেন। পিছনে তারা দুজন।
ভিতর দিক থেকে কক্ষটি বেশ সাজানো-গোছানো। দেয়ালে ঝুলছে একটি সোনার ক্রুশ। তার একদিকে হাতে আঁকা ঈসা (আঃ)-এর প্রতিকৃতি আর অপরদিকে মা মরিয়মের ছবি। ইমাম বললেন, এটি আমার গীর্জা, আমার আশ্রম।
তা বিপদের মুহূর্তে আপনার আত্মরক্ষার ব্যবস্থা কী? জানতে চায় সবুজ পট্টিওয়ালা। ক্রুশ এবং ছবিগুলো এভাবে চোখের সামনে না রাখা উচিৎ বলেও পরামর্শ দেয় সে।
এ পর্যন্ত কারো আগমনের আশংকা নেই। ইমাম জবাব দেন এবং হেসে বলেন, মুসলমান বড় সরল ও আবেগপ্রবণ জাতি। আবেগঘন জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনেই তারা জীবন দিতে শুরু করে। জৈবিক চাহিদা মানুষের সবচে বড় দুর্বলতা। মুসলমানদের মধ্যে আমি এই দুর্বলতাকে উস্কে দিচ্ছি। তাদের আমি সবক দিচ্ছি যে, এক একজনের চারটি করে বিয়ে করা ফরজ। আমি ধীরে ধীরে তাদেরকে বিপথগামিতার প্রতি আগ্রহী করে তুলছি। ধর্মের নামে মুসলমানদের তোমরা ভালো-মন্দ দু-ই করতে পার। কুরআন হাতে নিয়ে কথা বললে এরা বোকামীসুলভ কথাও মেনে নেয়, মিথ্যাকেও সত্য বলে বিশ্বাস করে ফেলে। আমার পরীক্ষা সফল। এখানে আমি আমার-ই মত এমন একদল লোক তৈরি করে নেব, যারা মসজিদে বসে কুরআন হাতে নিয়ে মুসলমানদের জিহাদী জবা আর নৈতিকতাকে নিঃশেষ করে দেবে। আমি নারী সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিচ্ছি। সালাহুদ্দীন আইয়ুবী নারীদেরকেও সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছে। আমি তাদের বলছি, নারীদেরকে তোমরা ঘরে আবদ্ধ করে রাখ। এ জাতির অর্ধেক জনশক্তিকে আমি বেকার করে ছাড়ব।
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে। সাধারণ মানুষ আর সেনা সদস্যদের এক করে তিনি বড় সাফল্য অর্জন করেছেন। এ মুহূর্তে যদি তিনি জেরুজালেম জয় করার ঘোষণা দেন, তাহলে মিসরের সব মানুষ তার পিছনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। বলল সবুজ পট্টিওয়ালার সঙ্গী।
কিন্তু, এমন ঘোষণা তিনি দেবেন না। তিনি বুদ্ধিমান। আবেগপ্রবণ লোকদের তিনি পছন্দ করেন না। তিনি একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিককে আবেগপ্রবণ অপ্রশিক্ষিত একশত লোকের উপর প্রাধান্য দেন। আইউবী একজন বাস্তববাদী মানুষ। অন্তঃসারশূন্য সস্তা শ্লোগানে তিনি জাতিকে ক্ষেপান না।
আমাদের কাজ, বাস্তবতা ও প্রশিক্ষণ থেকে এ জাতিকে দূরে রাখা এবং আরো আবেগপ্রবণ করে তোলা। হুঁশ বলতে তাদের কিছুই থাকবে না- থাকবে শুধু জোশ। জোশের বশবর্তী হয়ে তারা ভুলে যাবে বাস্তবতা আর বিবেক-বুদ্ধির কথা। দুশমনের প্রথম আঘাতেই তারা দমে যাবে। শুনেছ তো, দসে আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর কেমন প্রশংসা করলাম? এটা আমার কূট-কৌশলের-ই অংশ।
এসব কথা আমরা পরে বলব। আগে আমাদেরকে উন্ত্রী দুটো দেখান এবং বলুন, এখানে কখন কিভাবে আমরা আশ্রয় পেতে পারি, এখানে আপনার অন্য কোন লোক থাকে কি?
না, এখানে আর কেউ থাকে না। বললেন ইমাম।
আগন্তুকদের ব্যাপারে ইমাম এখন সন্দেহমুক্ত। গোপন সাংকেতিক শব্দ দ্বারা তিনি তাদের চিনে ফেলেছেন।
.
ইমাম কক্ষ থেকে বের হয়ে যান। খানিক পরে ফিরে আসেন। সঙ্গে তার চোখ– ঝলসানো দুটি অনুপম রূপসী যুবতী। এরা-ই সেই দু মেয়ে, যাদেরকে তিনি নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। এনেছিলেন আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢেকে। কিন্তু এখন সেই পর্দা নেই। দেহের অর্ধেকটা-ই এখন তাদের অনাবৃত। ইমাম আগন্তুকদের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেন এবং আলমারী থেকে মদের বোতল বের করে আনেন। এক মেয়ে গ্লাস এনে তাতে মদ ঢেলে মেহমানদের সামনে রাখে।
এসব পরে হবে, আগে কাজের কথা বলে নিই। বলল সবুজ পট্টিওয়ালা ব্যক্তি।
আমাদের দু ব্যক্তিকে হত্যা করতে হবে। সালাহুদ্দীন আইউবীকে আর আলী বিন সুফিয়ানকে। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা তাদেরকে চিনি না। আপনি দেখিয়ে দেবেন। আপনি কি ওদের দেখেছেন কখনো? বলল অপরজন।
দেখেছি মানে? এত দেখেছি যে, ঘোর অন্ধকারেও আমি তাদেরকে চিনতে পারব। আমি যে অভিযান শুরু করেছি, তার সাফল্যের জন্য ওদেরকে চিনে রাখা ছিল অপরিহার্য। আলী বিন সুফিয়ান এতই বিচক্ষণ, এত-ই অভিজ্ঞ যে, কোন গোয়েন্দা পাঠিয়ে তিনি নিজেই আমার এখানে চলে আসতে পারেন। তবে আমার সামনে। ছদ্মবেশে এলেও আমি তাকে চিনে ফেলব। বললেন ইমাম।
আর সালাহুদ্দীন আইউবীর ব্যাপারে আপনার ধারণা কী? পট্টিওয়ালা জিজ্ঞেস করে।
তাকেও বেশ ভাল চিনি। বললেন ইমাম।
চোখে সবুজ পট্টিওয়ালা ব্যক্তি তার হাত দুখানা নিজের কান আর মাথার মধ্যখানে নিয়ে আসে। দাড়ি ধরে ঝটকা টান মারে নীচের দিকে। লম্বা কৃত্রিম দাড়ি আর ঘন গোঁফ চেহারা থেকে আলগা হয়ে যায়। চোখের উপর রাখা সবুজ পট্টিও খুলে ছুঁড়ে ফেলে। ফুটে উঠে তার আসল রূপ।
ইমাম যেখানে বসা ছিলেন, সেখানেই মূর্তির মত বসে রইলেন। বিস্ফারিত অপলক নেত্রে মুখ হা করে তাকিয়ে রইলেন মুখোশহীন আগন্তুকের প্রতি। মেয়ে দুটো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারা একবার লোকটির প্রতি, একবার ইমামের প্রতি দৃষ্টিপাত করছে। রক্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ইমামের দেহ। এবার দুনিয়া জোড়া বিস্ময় ও ভয়জড়িত ইমামের কাঁপা কণ্ঠ : সালাহুদ্দীন আইউবী!
হ্যাঁ, দোস্ত! আমি সালাহুদ্দীন আইউবী। সুনাম শুনে আপনার দরূন্স শুনতে এসেছিলাম।
আইউবী এবার তার সঙ্গীর দাড়ি মুঠি করে ধরে ঝটকা এক টান দেন। চেহারা থেকে পৃথক হয়ে আসে দাড়ি। বললেন, একেও বোধ হয় চিনেন?
হ্যাঁ চিনি। আলী বিন সুফিয়ান। ভয়ার্ত কণ্ঠে জবাব দেন ইমাম।
হঠাৎ মেয়ে দুটো এবং ইমাম পিছনে দৌড়ে গিয়ে আলমারী খুলে হাতে তরবারী তুলে নেয়। কিন্তু পিছনে মোড় ঘুরিয়েই তারা থমকে যায়। উদ্যত তরবারীগুলো আপসে অধঃনমিত হয়ে যায় তাদের। কারণ, ইতিমধ্যে আইউবী আর আলী বিন সুফিয়ানের জুব্বার ভিতরে লুকানো তরবারীও তাদের হাতে এসে গেছে। অসি চালনায় প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও দুই পেশাদার যোদ্ধার মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারল না মেয়ে দুটো। ছিনিয়ে নেয়া হল তাদের হাতের অস্ত্র।
আলী বিন সুফিয়ান বাইরে ছুটে যান। খানিক পর বাইরে অপেক্ষমান অপর ছয় সঙ্গীও উদ্যত তরবারী হাতে ভিতরে প্রবেশ করেন।
পরদিন মসজিদের সামনে এলাকাবাসীদের প্রচন্ড ভীড় জমে যায়। কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তা পালাক্রমে তাদের নিয়ে যাচ্ছে ইমামের গোপন কক্ষে। জনতাকে ইমামের ঘর দেখান হল, দেখান হলো দেয়ালে ঝুলান ঈসা ও মরিয়মের প্রতিকৃতি আর সারি সারি সাজানো মদের বোতল। কর্মকর্তাগণ জনতার সামনে তুলে ধরেন ছদ্মবেশী ইমামের আসল রূপ।
***
খৃষ্টানরা সারা দেশে, বিশেষ করে কায়রোতে বিপুলসংখ্যক গুপ্তচর ও সন্ত্রাসী ছড়িয়ে দিয়েছিল। তার মোকাবেলায় সালাহুদ্দীন আইউবীর দিক-নির্দেশনায় আলী বিন সুফিয়ান দেশময় গোয়েন্দার জাল বিছিয়ে দেন। খৃষ্টানদের ইসলামী সভ্যতা ধ্বংসের অভিযান-ই আইউবীকে বেশী অস্থির করে তোলে।
আলী বিন সুফিয়ান যখন তাঁকে অবহিত করেন যে, এক মসজিদের পেশ ইমাম প্রতি রাতে মসজিদে দস দিচ্ছেন এবং ইসলামী চিন্তাধারাকে বিকৃত করছেন, তখন আইউবী সঙ্গে সঙ্গেই তাকে গ্রেফতার করে আনার আদেশ দেননি। রিপোের্ট শুনে তিনি বলেছিলেন, আলী! ধর্ম নিয়ে ফের্কাবাজি শুরু হয়েছে। এই ইমামও কোন এক ফেরকার লোক হবেন হয়ত। এমনও হতে পারে যে, তিনি কুরআনের নিজস্ব ব্যাখ্যা ই পেশ করছেন। ধর্মের ব্যাপারে আমি হস্তক্ষেপ করতে চাই না। আমি শাসক, আলেম নই। লোকটিকে যদি তুমি কুচক্রী মনে কর, তাহলে গ্রেফতার করার আগে উত্তমরূপে যাচাই করে দেখ। একজন ইমামের মর্যাদা আমার চেয়ে অনেক উঁচু।
আলী বিন সুফিয়ান দ শুনতে নিজে সেই মসজিদে যাননি। তার সন্দেহ ছিল যে, যদি এই ইমাম সত্যি-ই দুশমনের নিয়োজিত কুচক্রী-ই হয়ে থাকে, তাহলে সে তাকে চিনে থাকবে নিশ্চয়। তাই তিনি কয়েকজন বিচক্ষণ গুপ্তচরকে মসজিদে প্রেরণ করেন। তারা দশ-বার বার মসজিদে যায় এবং যে দস শোনে, তা আনুপূর্বিক আলী বিন সুফিয়ানকে শোনায়। সর্বশেষ এক রাতে ইমাম জিহাদের উপর এক দর্স প্রদান করেন এবং জিহাদের ভিন্নধর্মী ব্যাখ্যা পেশ করেন। গুপ্তচররা আলী বিন সুফিয়ানের নিকট রিপোর্ট করে। আলী বিন সুফিয়ান রিপোর্টটি আইউবীকে শোনান এবং অভিমত পেশ করেন যে, এই লোকটি যদি ক্রুসেডারদের চর কিংবা সন্ত্রসী না-ও হয়, তবু তাকে গ্রেফতার করা কিংবা নিবৃত্ত করা জরুরী। কারণ, সে জিহাদের এমন দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করছে, যা কেবল সেই ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব, যে হয়ত শত্রুপক্ষের লোক অন্যথায় মাতাল।
সালাহুদ্দীন আইউবী বেশ মনোযোগ সহকারে রিপোর্টটি শ্রবণ করেন এবং বলেন, ঘটনা যা-ই হোক, বিষয়টি বড় স্পর্শকাতর। ধর্ম, মসজিদ ও ইমামের ব্যাপার। আমাদের ভেবে-চিন্তে পা ফেলতে হবে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, আলী বিন সুফিয়ানকে নিয়ে নিজেই ছদ্মবেশে ইমামের দরুস শুনতে যাবেন। জিহাদের সঙ্গে যৌনতার আলোচনার অভিযোগ আইউবীকে বেশী ভাবিয়ে তুলে। আলী বিন সুফিয়ানের সঙ্গে পরামর্শ করেই তিনি একটি ছদ্মবেশ নির্ণয় করেন।
.
গোয়েন্দাবৃত্তি করা এবং গোয়েন্দাবৃত্তি প্রতিরোধে আলী বিন সুফিয়ান একজন ঝানু, লোক। যে খৃষ্টান মেয়েকে দিয়ে তিনি ফয়জুল ফাতেমীকে গ্রেফতার করিয়েছিলেন এবং আহমাদ কামাল নামক এক কমাণ্ডারের হাতে যে মেয়ে মুসলমান হয়ে তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিল, সেই মেয়ে খৃষ্টান গোয়েন্দাদের সাংকেতিক ভাষা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিল আলী বিন সুফিয়ানকে। তারই দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী আলী বেশ কজন মুসলমানকে গ্রেফতারও করেছিলেন, যারা অর্থ আর রূপসী নারীর বিনিময়ে ঈমান বিক্রি করে খৃষ্টানদের পক্ষে গোয়েন্দাবৃত্তিতে লিপ্ত ছিল। ধরা পড়ার পর চাপের মুখে তারাও স্বীকার করেছিল, হ্যাঁ খৃষ্টান গোয়েন্দাদের মধ্যে এসব ভাষা ও সংকেত ব্যবহৃত হয়।
খৃষ্টান গোয়েন্দারা অপরিচিত লোককে নিজের দলের লোক কিনা যাচাই করার জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, জানি না, আজকের আবহাওয়া কেমন থাকবে। কথাটা সে এমন নির্লিপ্তের মত বলবে, যেন এমনিতেই হঠাৎ তার আবহাওয়ার কথা মনে পড়ে গেছে। এখন অপরজন যদি তাদের দলের লোক হয়, তাহলে বলে বৃষ্টি আসবে। তারপর প্রথমজন বলে, আকাশ তো বিলকুল পরিষ্কার। দ্বিতীয়জন বলে, আমরা মেঘ নিয়ে আসব। বলেই সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার তাৎপর্য হলো, যেন পাশের মানুষও শুনতে পায় কিংবা অপর ব্যক্তি গোয়েন্দা না হলে সে বুঝবে যে, এ লোকটি ঠাট্টা করছে।
আলী বিন সুফিয়ানকে এ তথ্যও প্রদান করা হয়েছিল যে, তাদের এই সাংকেতিক সংলাপ যদি কখনো শত্রুদের কাছে ফাঁস হয়ে যায়, তখন-ই কেবল তা পরিবর্তন করা হবে। অন্যথায় এ সংকেত-ই ব্যবহার করা হবে।
আলী বিন সুফিয়ান আরো জানতে পেয়েছিলেন যে, খৃষ্টান গোয়েন্দারা কখনো একে অপরের নাম বলে না। তাদের হেডকোয়ার্টার ফিলিস্তীনের প্রত্যন্ত এক পল্লীতে। নাম তার শোবক। এই শোবক-ই ক্রুসেডারদের চরবৃত্তির প্রাণকেন্দ্র।
এসব তথ্যের উপর ভিত্তি করে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ও আলী বিন সুফিয়ান ছদ্মবেশে কায়রোর সেই মসজিদে গমন করেন। তারা জিহাদ বিষয়ক বয়ানের আবদার জানালে ইমাম তাদের আবদার পূরণ করেন। দরূস শেষে নির্জনে বসে সেই গোপন সাংকেতিক সংলাপের মাধ্যমে ইমামকে কুপোকাত করে ফেলেন তারা। পরে তিনি বলেও ছিলেন যে, আমি অত কাঁচা গোয়েন্দা ছিলাম না যে, অপরিচিত মানুষের সামনে মনের সব গোপন কথা প্রকাশ করব।
আইউবী ও আলী বিন সুফিয়ানের সাংকেতিক সংলাপ-ই তাকে ফাঁদে ফেলেছে। কারণ, সেই সংলাপ ছিল উচ্চ পর্যায়ের গোয়েন্দাদের জন্য নির্দিষ্ট। সাধারণ গোয়েন্দারা তা জানত না। তাছাড়া এই সাংকেতিক সংলাপের শেষে অট্টহাসিতে ফেটে পড়াও ছিল বিশেষ তাৎপর্যবহ। যথাসময়ে এই হাসির অভিনয় করতে না পারলে খৃষ্টান গোয়েন্দারা গোপনীয়তা ফাস করত না অন্যের কাছে। সেজন্যেই সালাহুদ্দীন আইউবী সংলাপ শেষে অট্টহাসির অভিনয় করেছিলেন। সঙ্গে তিনি ছয়জন জানবাজ সৈন্যও নিয়ে গিয়েছিলেন, যাতে সময়ে তারা সাহায্য করতে পারে।
.
তিনজনকে বন্দী করে রেখে তদন্ত শুরু করলেন আলী বিন সুফিয়ান। প্রথমে সেই এলাকায় গিয়ে খোঁজ নিলেন, লোকটি কিভাবে এই মসজিদের দখলদারিত্ব হাতে নিল এবং তার আগে সে যে ঝুপড়িতে বাস করত, তা তাকে কে দিয়েছিল?
স্থানীয় লোকদের বিবরণে আলী জানতে পারলেন যে, দুই স্ত্রীসহ লোকটি এ অঞ্চলে আসে। প্রথমে একজনের ঘরে মেহমান হয়ে থাকে কিছুদিন। ধীরে ধীরে মানুষ যখন বুঝতে পারল যে, লোকটি আসলে বড় একজন আলেম, তখন স্ত্রীদেরসহ বসবাসের জন্য তাকে ঐ ঝুপড়িটি দেয়া হয়। নামায পড়তে আসতেন তিনি এ মসজিদে। আস্তে আস্তে ভাব গড়ে তোলেন মসজিদের ইমামের সঙ্গে।
পনের-ষোলদিন পর মসজিদে নামাযের মধ্যে-ই ইমাম সাহেবের পেটব্যাথা শুরু হয়। ধীরে ধীরে ব্যাথা এত তীব্র আকার ধারণ করে যে, এখন আর মসজিদে আসতেই পারছেন না। ডাক্তাররা ঔষধ দেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। তৃতীয় দিনে প্রচন্ড ব্যাখ্যা নিয়ে-ই ইমাম সাহেব মারা যান।
এ সুযোগে উক্ত আলেম মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব হাতে নেয়। অল্প কদিনের মধ্যে সে সমাজে এমন প্রভাব বিস্তার করে যে, মুসল্লিরা তার ভক্ত হয়ে যায় এবং স্ত্রীদের নিয়ে বাস করার জন্য একটি ঘর দিয়ে দেয়।
আলী বিন সুফিয়ানের প্রশ্নের জবাবে লোকেরা জানায়, তারা একাধিকবার তাকে পুরাতন ইমামের জন্য খাবার নিয়ে যেতে দেখেছে। আলী বিন সুফিয়ান বুঝে ফেললেন, লোকটি ইমাম সাহেবকে বিষ খাইয়েছে এবং পথের কাঁটা সরিয়ে নিজে মসজিদের দখলদারিত্ব হাত করেছে।
গোয়েন্দা ইমামের বাসভবনে তল্লাশী চালান হল। পাওয়া গেল বিপুলসংখ্যক অস্ত্র। অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখা ছিল ভবনের বিভিন্ন জায়গায়। পাওয়া গেল পুটুলীভরা বিষ। বিষগুলো খাওয়ান হল একটি কুকুরকে। বিষ খেয়ে কুকুরটি অস্থির হয়ে পড়ে। উলট পালট করতে থাকে তিনদিন পর্যন্ত। তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় কুকুরটি মারা যায়।
আলী বিন সুফিয়ান তদন্ত রিপোর্ট পেশ করলেন আইউবীর সামনে। রিপোর্ট শুনে আইউবী বললেন
বন্দীদশায় ওদেরকে অস্থির করে তোল, ভীত-সন্ত্রস্ত করে রাখ সারাক্ষণ। কিন্তু আমি ওদেরকে জল্লাদের হাতে দেব না, কয়েদখানায়ও ফেলে রাখব না।
কী করবেন তাহলে? জিজ্ঞেস করলেন আলী।
মুক্তি দিয়ে আমি ওদেরকে সসম্মানে ফেরত পাঠাব। বললেন আইউবী।
আলী বিন সুফিয়ান বিস্ময়ভরা অপলক নেত্রে তাকিয়ে রইলেন আইউবীর প্রতি।
আইউবী বললেন, আমি একটি জুয়া খেলতে চাই, আলী!
এখন আমাকে কিছু জিজ্ঞেস কর না। আমি ভাবছি, এই বাজি লাগাব কি না।
খানিক নীরবতার পর তিনি আবার বললেন, আগামীকাল দুপুরের আহারের পর নায়েব সালার, উপদেষ্টা ও উচ্চ পর্যায়ের কমাণ্ডার এবং প্রশাসনের প্রত্যেক বিভাগীয় কর্মকর্তাদেরকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। তুমিও থাকবে।
***
দিন শেষে রাত এল। আলী বিন সুফিয়ান এই প্রথমবারের মত বন্দী আলেমকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। কিন্তু বুঝা গেল, লোকটি বড় কঠিনপ্রাণ। আলীর এক প্রশ্নের জবাবে আলেম বলল
মনোযোগ সহকারে আমার কথাগুলো শোন আলী বিন সুফিয়ান! আমরা দুজন একই ময়দানের সৈনিক। তুমি যদি আমার দেশে ধরা পড়, তাহলে আমার তো বিশ্বাস, তুমি জীবন দেবে, তবু দেশ ও জাতিকে ধোঁকা দেবে না! আমাকে তুমি একই রকম মনে কর। আমি জানি, আমার পরিণতি কী হবে। আমার কাছে তুমি যা কিছু জানতে চাও, যদি আমি সব বলেও দিই, তবু তোমরা আমাকে ক্ষমা করবে না। জল্লাদের হাতে হোক কিংবা নির্যাতনের শিকার হয়ে হোক এই অন্ধকার কুঠরিতেই আমাকে মরতে হবে। তাহলে বল, জাতির সঙ্গে প্রতারণা কেন করব আমি?
আমার আশা, তুমি তোমার ইচ্ছার পরিবর্তন ঘটাবে। কেন, মেয়ে দুটোর সম্ভ্রম রক্ষার খাতিরেও কি তুমি মুখ খুলবে না?
সম্ভ্রম? ওদের সম্ভ্রম বলতে কিছু নেই। সম-সতীত্বের বিসর্জন দেয়ার প্রশিক্ষণ দিয়ে-ই ওদের মাঠে নামান হয়। আমরা জীবন আর সম্ভ্রম দূরে ছুঁড়ে ফেলে আসি। ওদের আছে শুধু রূপ আর পুরুষের মনকাড়া ছলনা। এ-ই ওদের সম্পদ। এ দিয়েই ওরা পাথরকে মোমে পরিণত করে। ওদের সঙ্গে তোমরা যা ইচ্ছে করতে পার। আমার চোখের সামনে ওদের অপমান করলেও আমি কিছু বলব না। ওরাও আপত্তি করবে না।
গোয়েন্দা মেয়েদেরকে আমরা মৃত্যুদন্ড দিয়ে থাকি- অপমান করি না। আমাদের ধর্ম আমাদেরকে নারী নির্যাতনের অনুমতি দেয় না। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
দোস্ত! মমতার লোভ দেখাও বা নির্যাতনের ভয় দেখাও, কোন অস্ত্র-ই তোমার সফল হবে না। আমাদের কারুর মুখ থেকে আমাদের সে সহকর্মীদের নাম-পরিচয় উদ্ধার করতে তুমি পরবে না, যারা তোমাদের শাসন ক্ষমতার শীর্ষস্থান দখল করে আছে। বন্দী মেয়েদের সঙ্গে তুমি সদ্ব্যবহারের ওয়াদা করেছ। এর বিনিময়ে আমি তোমাকে এতটুকু বলতে পারি যে, এটা তোমার-আমার লড়াই নয়। এ লড়াই ক্রুসেড বনাম চাঁদ-তারার লড়াই। আমি সাধারণ গোয়েন্দা নই যে, এদিকের খবর ওদিকে, ওদিকের খবর এদিকে আদান-প্রদান করব। আমি গোয়েন্দা বিভাগের একজন শীর্ষ অফিসার। আমি আলেম। খৃষ্ট ও ইসলাম উভয় ধর্মে সমান পারদর্শী। ইঞ্জীল ও কুরআন উভয় গ্রন্থের তলা পর্যন্ত হাতড়িয়েছি। আমি স্বীকার করি, তোমাদের ধর্ম শ্রেষ্ঠ ও সরল-সহজ। ইসলাম সব মানুষের ধর্ম। কোন জটিলতা, নেই এতে। আর ইসলামের গ্রহণযোগ্যতার কারণও এটাই। কিন্তু পাশাপাশি তোমাদেরকে আমি এ কথাও বলে দিতে চাই যে, শত্রুরা তোমাদের ধর্মের মৌলিকত্ব নষ্ট করে দিচ্ছে, যাতে এর গ্রহণযোগ্যতা বিনষ্ট হয়। মুসলমান আলেমের বেশ ধারণ করে ইসলামের মধ্যে বহু ভিত্তিহীন বর্ণনা ঢুকিয়ে দিয়েছে তোমাদের শত্রুরা। ইসলাম ছিল কুসংস্কারবিরোধী ধর্ম। কিন্তু এখন সবচেয়ে বেশী কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাতি হল মুসলমান। চন্দ্রগ্রহণ, সূর্য গ্রহণের সময় মুসলমানদের আমি সেজদা করতে দেখেছি। দেখেছি এ সময় নজরানা দিতে। তাছাড়া এমন বহু বেদআত আছে, যাকে মুসলমানরা দ্বীনের অংশ বলে বিশ্বাস করে। বলল, গোয়েন্দা আলেম।
দীর্ঘদিন যাবত আমরা তোমাদের মূল চিন্তাধারাকে ধ্বংস করে আসছি। আমরা জানি, পৃথিবীতে মাত্র দুটি ধর্ম টিকে থাকবে। খৃষ্টবাদ ও ইসলাম। আর দুটির যে কোন একটি খতম না হওয়া পর্যন্ত তাদের পরস্পর লড়াই অব্যাহত থাকবে। আমরা জানি, তীর-তরবারী দ্বারা কোন ধর্মকে-ই বিলুপ্ত করা যায় না। প্রচারণার মাধ্যমেও নয়। এর একটি মাত্র পথ, যা আমরা অবলম্বন করেছি। মনে রেখ, এ অভিযানে আমি একা নই। আমরা বিশাল এক বাহিনী তোমাদের চিন্তাধারার উপর হামলা চালিয়ে আসছি।
আলী বিন সুফিয়ান বন্দী গোয়েন্দার সামনে পায়চারী করছেন। গভীর মনোযোগ সহকারে শুনছেন তার বক্তব্য। বুঝলেন, লোকটি সাধারণ গোয়েন্দাদের চেয়ে ব্যতিক্রম। এর মুখ থেকে তথ্য বের করা কঠিন ব্যাপার। তাই তিনি কৌশল পরিবর্তন করলেন।
.
গোয়েন্দার পায়ে বেড়ী, হাতে হাতকড়া। কয়েদখানার একজন রক্ষীকে ডাকলেন আলী। বন্দী গোয়েন্দার পায়ের বেড়ী আর হাতকড়া খুলে দিতে বললেন। বন্দীর খানাপিনার ব্যবস্থা করার আদেশ দেন।
আমার এই আচরণকে কথা নেয়ার কৌশল মনে কর না। আমরা আলেমদের কদর করি। হোক সে যে কোন ধর্মের। আমি আর কিছুই জানতে চাইব না তোমার কাছে। ইচ্ছে হলে তুমি কিছু বলতে পার। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
আমি তোমাকে ইজ্জত করি আলী! আমি তোমার অনেক প্রশংসা শুনেছি। তুমি যেমন যোগ্য, তেমনি আদর্শবান। এর চেয়ে বড় মর্যাদা আর কী হতে পারে যে, স্বয়ং খৃষ্টান রাজারা তোমাকে খুন করাতে চান? এর মানে তো এই-ই যে, তুমি আইউবী জঙ্গীর সমমর্যাদার লোক! শোন আলী! কোন জাতির ধর্ম আর তাহযীব-তামাদুন ধ্বংস করার জন্য সেনা অভিযান আর যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রয়োজন পড়ে না। যৌনতার আগুন জ্বালিয়েই একটি জাতিকে নিঃশেষ করতে হয় তিলে তিলে। এ আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা। বিশ্বাস যদি না হয়, তাহলে তোমাদের মুসলিম শাসকদের অবস্থাটা একটু দেখে নাও। তোমাদের রাসূল বলে গেছেন, নিজের প্রবৃত্তিকে খুন কর; এটা সব অনিষ্টের মূল। কিন্তু তোমার জাতি কবে পর্যন্ত এর উপর আমল করেছে? রাসূল যে কদিন জীবিত ছিলেন, সে কদিন-ই তো? ইহুদীরা তাদের সুন্দরী মেয়েদের দিয়ে তোমার জাতিকে উত্তেজিত করেছে। তাই তোমার জাতি আজ প্রবৃত্তির দাস। তোমাদের যার হাতে সম্পদ আছে, নারীদের দিয়ে সে হেরেম পূর্ণ করে আগে। কি ধনী, কি গরীব প্রত্যেক মুসলমান ঘরে চারটি করে বউ রাখতে চায়। মাওলানা মৌলভীর রূপ ধরে ইহুদীরা তোমাদের চিন্তা-চেতনায় পাশবিকতা ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, মুসলমানরা যদি তাদের নবীর আদর্শ অনুসরণ করত, তবে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার তিন চতৰ্থাংশ-ই হত মুসলমান। কিন্তু, তা হয়নি। যে কজন আছে, তারাও নামে মাত্র মুসলমান। তোমাদের রাজত্ব দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। আমার মত আলেমরা তোমাদের ধর্ম ও তাহযীব-তামাদুনের উপর যে হামলা চালিয়ে আসছে, এ তারই প্রতিফল।
শোন বন্ধু! এ হামলা কখনো বন্ধ হবে না। আমি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি, একদিন এ পৃথিবীতে ইসলাম থাকবে না। থাকেও যদি, থাকবে পৌরাণিক এক সংস্কার হিসেবে। নারী আর মদে মাতাল হয়ে থাকবে তার অনুসারীরা। যে কেউ তো আর সালাহুদ্দীন আইউবী, নুরুদ্দীন জঙ্গী হতে পারে না! কাল-পরশু তাদেরকে মরতেই হবে। তারপরে যারা আসবে, আমরা তাদেরকে প্রবৃত্তিপূজায় মাতিয়ে তুলব। আমাকে তুমি হত্যা করতে পার আলী! কিন্তু আমার মিশনকে হত্যা করা তোমার সম্ভব নয়। মানুষের মৃত্যুতে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মরে না। তোমার হাতে আমি খুন হলে আমার জায়গায় আরেকজন আসবে। বন্ধু! ইসলামকে বিলুপ্ত করে কিংবা মুসলমানদেরকে আমাদের তাবেদারে পরিণত করেই তবে আমরা ক্ষান্ত হব। আমার আর কিছু বলার নেই। এবার তুমি ইচ্ছে করলে আমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিতে পার।
আলী বিন সুফিয়ান গোয়েন্দাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেননি। তিনি গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। এক অপার্থিক গাম্ভীর্য তার চেহারায়। গোয়েন্দার বক্তব্যে কি এক কঠিন, কত স্পর্শকাতর চিত্র ফুটে উঠেছে তার সামনে। তা-ই বোধ হয় ভাবছিলেন তিনি। কল্পনার পাখায় ভর করে দেশময় ছুটে চললেন আলী। চোখ ঘুরিয়ে নতুন করে দেখে নিলেন দেশের মুসলমানদের বাস্তব চিত্রটা। খৃষ্টান গোয়েন্দার বক্তব্যের সত্যাসত্য যাচাই করলেন বাস্তবতার নিরিখে। না, গোয়েন্দার বক্তব্য একতিলও মিথ্যে নয়। বর্ণে বর্ণে সত্য তার প্রতিটি কথা। মুসলিম জাতির মধ্যে নৈতিক অধঃপতনের জীবাণু আসলেই ঢুকে পড়েছে। আরবের আমীর-উজীরগণ তো পুরোপুরি ধ্বংস হয়েই গেছে। যুদ্ধের ময়দানে খৃষ্টানদের পরাজিত করে ইসলামী সালতানাতকে আরো বিস্তৃত করার স্বপ্ন দেখছেন সালাহুদ্দীন আইউবী। কিন্তু খৃষ্টানরা এমন এক দিক থেকে আক্রমণ করে বসেছে, যা প্রতিরোধ করা সুলতান আইউবীর সাধ্যের অতীত বলে মনে হচ্ছে আমার।
আলেম গোয়েন্দার কুঠরী বন্ধ করিয়ে আলী বিন সুফিয়ান বন্দী মেয়ে দুটোর কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ান। একটি কক্ষের দরজা খুলিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেন তিনি। বিছানায় বসা ছিল মেয়েটি। আলী বিন সুফিয়ানকে দেখে দাঁড়িয়ে যায় সে। আলী চুপচাপ গভীরভাবে দেখে নেন মেয়েটিকে। তারপর কিছুই না বলে নীরবে বেরিয়ে যান কক্ষ থেকে। বন্ধ করে দেয়া হয় কক্ষের দরজা।
.
পরদিন দুপুরের আহারের পর। সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা সালাহুদ্দীন আইউবীর সভাকক্ষে উপস্থিত। দুটি মেয়েসহ এক খৃষ্টান গোয়েন্দার গ্রেফতারীর সংবাদ তারা আগেই জেনেছেন। সভাকক্ষে বসে কানাঘুষা করছে তারা। ইত্যবসরে সালাহুদ্দীন আইউবী কক্ষে প্রবেশ করেন। গভীর দৃষ্টিতে এক নজর দেখে নিলেন গোটা কক্ষটি। যেন কাউকে খুঁজছেন তিনি।
নির্দিষ্ট আসনে বসলেন আইউবী। বললেন
বন্ধুগণ! আপনারা শুনে থাকবেন যে, একটি মসজিদ থেকে আমরা এক খৃষ্টান গুপ্তচরকে গ্রেফতার করেছি। লোকটি সেই মসজিদে নিয়মিত ইমামতি করত।
লোকটাকে কিভাবে ধরা হল, আইউবী তার বিবরণ দেন। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সে আলী বিন সুফিয়ানকে কী বলেছে, তাও বর্ণনা করেন।
সালাহুদ্দীন আইউবী বললেন
আপনারা গুপ্তচর ও সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন, এ উপদেশ দেয়ার জন্য আমি আজ আপনাদেরকে সমবেত করিনি। আজ আমি আপনাদেরকে একথাও বলব না যে, যারা ইসলামের দুশমনদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তারা জাহান্নামে যাবে। শুধু একথাটি বলার জন্য আমি আপনাদের কষ্ট দিয়েছি যে, কাফিরদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে, তাদের জন্য দুনিয়াটাকে আমি জাহান্নামে পরিণত করব। এখন আর কোন গাদ্দারকে আমি মৃত্যুদন্ড দেব না, মৃত্যু তো মুক্তির-ই একটি মাধ্যম। এখন থেকে গাদ্দারের শাস্তি হবে, তাদের গলায় রশি বেঁধে সামনে একটি পিছনে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে প্রতিদিন বাজারে বাজারে ঘুরিয়ে পরে চৌরাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হবে। সাইনবোর্ডে লিখা থাকবে আমি গাদ্দার। এভাবে তাদের প্রত্যহ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চৌরাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হবে। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে ধুকে ধুকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পর তার লাশ নিক্ষেপ করা হবে শহরের বাইরে কোন এক নর্দমায়। কাউকে জানাযা-দাফন করতেও দেয়া হবে না …।
কিন্তু বন্ধুগণ! এতে দুমশনের তেমন কোন ক্ষতি হবে না। তারা নতুন গাদ্দার তৈরি করে নেবে। যতদিন তাদের কাছে রূপসী নারীর অশ্লীলতা, অর্থ-কড়ি, সোনা-দানার প্রাচুর্য আর আমাদের কাছে ঈমানের কমতি থাকবে, ততদিন পর্যন্ত তারা গাদ্দার সৃষ্টি করতেই থাকবে। আপনার দুশমন আপনার মসজিদে বসে, আপনার কুরআন হাতে নিয়ে আপনার নবীর আদর্শকে বিকৃত করছে। একি আপনার আত্মমর্যাদার প্রতি চ্যালেঞ্জ নয়? ক্রুসেডাররা যেসব মেয়েকে গুপ্তচরবৃত্তি আর আমাদের চরিত্র ধ্বংসের জন্য এদেশে পাঠায়, তাদের অনেকে মুসলমানের-ই সন্তান। মা-বাবার কোল থেকে ছিনিয়ে এনে অপকর্মের লজ্জাকর প্রশিক্ষণ দিয়ে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে তাদের। ফিলিস্তীন এখন কাফেরের কজায়। সেখানকার মুসলমানরা চরম নির্যাতনের শিকার। কঠিন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে তারা। তাদের ঘর-বাড়ি লুটে নিচ্ছে ক্রুসেডাররা। প্রতিবাদ করলে তাদের নিক্ষেপ করা হয় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। অপহরণ করা হচ্ছে কিশোরীদের। সুন্দরীদের বেছে বেছে তাদের চিন্তা চেতনা থেকে ইসলাম ও দেশপ্রেম বিলুপ্ত করে অশ্লীলতার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। আঙ্গুলের ইশারায় পুরুষদের নাচাতে শিখে তারা। তারপর গুপ্তচরবৃত্তি আর নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য পাঠান হয় আমাদের দেশে।
ক্রুসেডারদের ফিলিস্তীন কজা করার পর সেখানকার মুসলমানদের জীবন এখন বিপন্ন। বেঁচে থাকার অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। খৃষ্টানরা পাইকারীহারে হত্যা করে মুসলমানদের। লুটে নেয় তাদের সহায়-সম্পদ। মসজিদগুলোকে পরিণত করে গীর্জা আর ঘোড়ার আস্তাবলে। যুবতী মেয়েদেরকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে যারা অধিক রূপসী, নাশকতা আর বেহায়পনার প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের ঢুকিয়ে দেয়া হয় আমাদের আমীর-উজীরদের হেরেমে। তাদের ব্যবহার করা হয় আমাদের বিরুদ্ধে। মুসলিম মেয়েদের গলায় ক্রুশ পর্যন্ত ঝুলিয়ে দেয় তারা। নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে পলায়নপর মুসলিম ভাইদেরকেও হত্যা করে পথে। আমাদের বোন-কন্যাদের ইজ্জত লুণ্ঠন করে।
আমার কালেমায় বিশ্বাসী বন্ধুগণ! সেই ধারা এখনো বন্ধ হয়নি। ফিলিস্তীনে এখনো সমানগতিতে চলছে মুসলিম নির্যাতনের স্টীমরোলার। ক্রুসেডারদের একটি-ই লক্ষ্য মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করা। তারা চায়, মুসলিম মেয়েরা খৃষ্টান সন্তান জন্ম দিক।
কিন্তু আমরা এখনো চুপ করে বসে আছি। ক্রুসেডারদের বর্বরতার শিকার হয়ে। শাহাদাত বরণকারী ভাইদের কথা আমরা ভুলে গেছি। এর চেয়ে বড় পাপ আর কী হতে পারে। কোন আদেশ করার আগে আমি আপনাদের জিজ্ঞেস করতে চাই, এ পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী? আপনাদের মধ্যে অভিজ্ঞ সৈনিক আছেন, আছেন প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দও। বলুন, আমরা কী করতে পারি।
আমীরে মেসের! আপনার আদেশের প্রয়োজন-ই বা কি। এতো আল্লাহর-ই নির্দেশ যে, প্রতিবেশী দেশের মুসলমান নির্যাতনের শিকার হলে তাদের উদ্ধার করার জন্য জালিমের সঙ্গে লড়াই করা ফরজ। কালবিলম্ব না করে এক্ষুণি আমাদের ফিলিস্তীনে অভিযান প্রেরণ করা উচিত। প্রবীণ এক কমাণ্ডার বললেন।
নায়েব সালার পর্যায়ের অপর এক ব্যক্তি উঠে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, কাফিরদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণের আগে আপনি ঐসব মুসলিম শাসক ও আমীরদের শায়েস্তা করুন, যারা নেপথ্যে থেকে কাফিরদের হাত শক্ত করছে। আমাদের জন্য লজ্জাকর বিষয় যে, আমাদের সারিতে গাদ্দারও আছে। ফয়জুল ফাতেমীর মত উচ্চপদের মানুষ যদি গাদ্দার হতে পারে, তাহলে নিমপদের লোকদের উপর ভরসা কি? একটি মুসলিম কিশোরীর শ্লীলতাহানীর প্রতিশোধের জন্য সমগ্র জাতি জীবন বিলিয়ে দেয়া দরকার। অথচ এদেশে আমাদের গোটা জাতির শ্লীলতাহানী চলছে আর আমরা কিনা এখনো ভাবছি, আমাদের কর্তব্য কী? ক্রুসেডাররা আমাদের মেয়েদেরকে অপকর্মের প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের দিয়েই তাদের সঙ্গে কুকর্ম করাচ্ছে। মুহতারাম আমীরে মেসের! আমি যদি আবেগপ্রবণ না হয়ে গিয়ে থাকি, তাহলে আমাকে এ প্রস্তাব পেশ করার অনুমতি দিন যে, ফিলিস্তীন আমাদের উদ্ধার করতেই হবে। ক্রুসেডাররা আমাদের প্রথম কেবলাকে কুকর্মের আস্তানায় পরিণত করেছে, এর চেয়ে যন্ত্রণার বিষয় আর কি হতে পারে!
দাঁড়ালেন আরেকজন। কথা বলতে চাইলেন তিনি। কিন্তু সুলতান আইউবী হাতের ইশারায় তাকে বসিয়ে দিলেন এবং বললেন
আমি এমন কথা-ই শুনতে চেয়েছিলাম। আপানাদের যারা আমার কাছে থাকেন, তারা জানেন যে, আমার প্রথম লক্ষ্য ফিলিস্তীন। মিসরের শাসনক্ষমতা হাতে নেয়ার পর পরই আমি ফিলিস্তীন আক্রমণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দু বছরেরও অধিক সময় কেটে গেছে। বিশ্বাসঘাতকরা আমাকে মিসরে এতই ব্যস্ত রেখেছে, যেন আমি পাকে আটকে গেছি। বিগত দুটি বছরের ঘটনাবলী নিয়ে একটু ভাবুন। সন্ত্রাসী খৃষ্টান ও গাদ্দারদের সঙ্গে আপনারা যুদ্ধ করেছেন। যারা সুদানীদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়েছে, তারা আমাদেরই লোক। সুদানী সৈন্যদের দিয়ে যে ব্যক্তি মিসর আক্রমণ করিয়েছে, সে ছিল আমাদের-ই কমান্ডার। সে সেই জাতীয় কোষাগার থেকে বেতন গ্রহণ করত, যে কোষাগারে জনগণের অর্থ আছে, আছে আল্লাহর নামে প্রদত্ত যাকাতের পয়সা। গুপ্তচর, গুপ্তচরদের আশ্রয় ও সাহায্যদাতা এবং ঈমান বিক্রেতাদের খতম করে ফিলিস্তীন আক্রমণ করব, এ আশায় আমি দুটি বছর কাটিয়েছি। কিন্তু আমার দু বছরের অভিজ্ঞতা, এই নাশকতার ধারা কখনো বন্ধ হবে না। আমরাই আমাদের মধ্যে গাদ্দার সৃষ্টি করার সুযোগ করে দিচ্ছি …।
আজ আমি আপনাদের একথা বলার জন্য একত্রিত করেছি যে, ফিলিস্তীন আক্রমণে আমি আর বেশী বিলম্ব করব না। আপনারা সৈন্যদের সামরিক মহড়া ও প্রশিক্ষণ জোরদার করুন। মুজাহিদদেরকে দীর্ঘ সময়ের অবরোধ পরিচালনার ট্রেনিং দিন। তুর্কী এবং সিরীয় বাহিনীর উপর আমি অধিক আস্থাশীল। মিসরী ও ওফাদার সুদানীদের মধ্যে আরো চেতনা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। প্রয়োজন তাদের আরো দক্ষ করে গড়ে তোলা। তাদের মনে শত্রু-বিরোধী ক্ষোভ সৃষ্টি করুন, আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত করুন। তাদেরকে বুঝিয়ে বলুন যে, যেসব নারী ক্রুসেডারদের হিংস্রতার শিকার হচ্ছে, তারা তোমাদের-ই বোন-কন্যা। মসজিদের ইমামদেরকে বলুন, যেন তারা জনসাধারণের সামনে জিহাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং যুবকদের মধ্যে জিহাদী স্পৃহা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। কোন ইমাম বা খতীব যদি ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে তাকে ইমামতের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিন। আমাদের নীতি-আদর্শ মজবুত থাকলে কোন যাদুমন্ত্র, কোন প্রতারণা আমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। মানুষের মন-মস্তিষ্ককে বেকার থাকতে দেবেন না; তাদেরকে একটা না একটা মহৎ কাজে জড়িয়ে রাখুন। অন্যথায় শত্রুরা তাদেরকে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে। খুব শীঘ্ৰ আপনারা বাকী নির্দেশনা পেয়ে যাবেন। সৈন্যরা কবে রওনা হবে, তাও অচীরে জানাব। আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন।
***
সাতদিন পর।
সুলতান আইউবী আলেম গুপ্তচর এবং মেয়ে দুটোকে তলব করেন। হাজির করা হয় তাদেরকে আইউবীর সামনে। সুলতান তাদেরকে পাশের কক্ষে বসিয়ে রাখতে বললেন। তাদের পায়ে বেড়ী, হাতে শিকল।
সুলতান আইউবীর খাস কামরার পাশের কক্ষে তাদের বসিয়ে রাখা হল। দু কামরার মাঝে একটি দরজা। দরজার একটি কপাট সামান্য খোলা।
কক্ষে পায়চারী করছেন সুলতান আইউবী। মাথা ঝুঁকিয়ে পায়চারী করতে করতে সুলতান বললেন, আমি অতি শীঘ্র কার্ক আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
কার্ক ফিলিস্তীনের দুর্গসম একটি জনপদ। আরেক প্রসিদ্ধ নগরীর নাম শোবক। শোবকও একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ। ফিলিস্তীন দখলের পর শোবক এখন ক্রুসেডারদের প্রাণকেন্দ্র। খৃষ্টান রাজা ও উচ্চপদস্থ কমান্ডাররা শোবকেই একত্রিত হয়। এটাই ক্রুসেডারদের ইন্টেলিজেন্স-এর হেডকোয়ার্টার। গোয়েন্দাদের ট্রেনিংক্যাম্পও এটিই।
সুলতান আইউবী ফিলিস্তীন উদ্ধারের জন্য সর্বপ্রথম শোবক আক্রমণ করবেন, আইউবীর সেনাবাহিনী এবং প্রশাসন কর্মকর্তাদের এটাই ছিল বদ্ধমূল ধারণা। তাদের ধারণায় কৌশলগত দিক থেকে এটাই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। খৃষ্টানদের কোমর ভেঙ্গে দেয়ার জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ শক্ত ঘাঁটিটি ছিনিয়ে আনা-ই যথেষ্ট। কিন্তু সুলতান বলছেন, তিনি কিনা কার্ক আক্রমণ করবেন আগে, অথচ গুরুত্বের দিক থেকে কার্কের অবস্থান দ্বিতীয় পর্যায়ে।
মুখ খুললেন এক নায়েব সালার। বিনীত কণ্ঠে বললেন, মুহতারাম! আপনার আদেশ শিরোধার্য। কিন্তু আমার পরামর্শ, আগে শোবক আক্রমণ করা হোক। শত্রুর কেন্দ্রীয় কমান্ড আগে খতম করা জরুরী। শোবক হাত করার পর কার্ক দখল করা কঠিন হবে না। আমরা যদি সব শক্তি কার্কেই ব্যয় করে ফেলি, তাহলে শোবক দখল করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে।
আলেম গুপ্তচর পাশের কক্ষে উপবিষ্ট। সুলতান আইউবীর কক্ষের সব কথাবার্তা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে গোয়েন্দার কক্ষ থেকে। কান খাড়া হয় গোয়েন্দার। পা টিপে টিপে এগিয়ে এসে দরজা ঘেঁষে বসে সে। সুলতানের পরিষ্কার কণ্ঠ শুনতে পেল গোয়েন্দা
আমি ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে চাই। শোবকের তুলনায় কার্ক সহজ শিকার। কার্ক দখল করে তাকেই আমি কেন্দ্র বানাব। কার্ক আক্রমণে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদেরকে কিছুদিন বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে অতিরিক্ত রিজার্ভ সৈন্য তলব করে পূর্ণ প্রস্তুতির পর আমি শোবক আক্রমণ করব। আমাদের গোয়েন্দাদের রিপোর্ট মোতাবেক শোবকের প্রতিরোধ ব্যবস্থা এত শক্ত যে, দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমাদেরকে তা অবরুদ্ধ করে রাখতে হবে। আমার ধারণা, কার্কে আমাদের বেশী শক্তি ব্যয় হবে না। আগে আমাদের একটি ক্যাম্প প্রয়োজন। প্রয়োজন রসদ মজুদের এমন একটি নিরাপদ জায়গা, যেখান থেকে সময়মত রসদ সগ্রহ করতে আমাদের বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হবে না।
.
দরজা ঘেঁষে বসে সুলতান আইউবীর প্রতিটি শব্দ শুনছে আলেম গোয়েন্দা। মেয়ে দুটোও তার কাছে এসে বসে। সুলতান আইউবীর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পৌঁছে যাচ্ছে শত্রু গোয়েন্দার কানে।
কিন্তু আলী বিন সুফিয়ানের সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। সম্ভবত গোয়েন্দাদের শোবক পর্যন্ত পৌঁছার সম্ভাবনা ক্ষীণ ছিল বলেই আলী বিন সুফিয়ান কোন সাবধানতা অবলম্বন করেননি। যাদের আজীবন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ধুকে ধুকে মরতে হবে কিংবা জল্লাদের হাতে জীবন দিতে হবে, শত্রুর গুপ্তচর হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে গোপন তথ্য জানতে দেয়ায় ক্ষতি কি।
ইস্, কত মূল্যবান তথ্য! আমরা কেউ যদি এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে আইউবীর এ পরিকল্পনার কথা কার্ক ও শোবকে পৌঁছিয়ে দিতে পারতাম!! সংবাদটা আগেভাগেই জানিয়ে দিতে পারলে কার্কের পথেই গতিরোধ করে মুসলিম বাহিনীর শক্তি নিঃশেষ করে দেয়া যেত। কার্ক পৌঁছার আগেই পরাজিত করা যেত তাদের। কানে কানে ফিসৃফিসিয়ে মেয়েদেরকে বলল গোয়েন্দা।
আমাদের পরিপূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। আগেই যদি ক্রুসেডাররা আমাদের আক্রমণের খবর পেয়ে যায়, তাহলে আমরা কার্ক পৌঁছুতে ব্যর্থ হব। পথেই তারা আমাদের গতিরোধ করবে। ক্রুসেডারদের তুলনায় আমাদের সৈন্যসংখ্যা কম। অস্ত্র-ঘোড়ায়ও আমরা তাদের তুলনায় দুর্বল। তাদের আছে লোহার শিরস্ত্রাণ। আছে বর্ম। যার কারণে আমাদের তীরন্দাজ বাহিনী ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে একাধিকবার।
ক্রুসেডারদের অজান্তেই আমরা কার্ক পৌঁছে যেতে চাই, যাতে তারা খোলা ময়দানে আমাদের মুখোমুখি হতে না পারে। যদি তারা খোলা মাঠে আমাদের মোকাবেলায় আসার সুযোগ পায়, তাহলে পিছনে এসে তারা আমাদের রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দিবে। তখন পরাজয়বরণ ছাড়া আমাদের আর উপায় থাকবে না। কার্ক পৌঁছার জন্য আমি জারিরের টিলা হয়ে অতিক্রম করা পথটি অবলম্বন করব। জারির একটি প্রশস্ত এলাকা। আমার ভয় শুধু একটি-ই যে, ক্রুসেডাররা পথে এসে আমাদের প্রতিরোধ করে বসে কিনা। বললেন, সালাহুদ্দীন আইউবী।
এর মোকাবেলায় আমাদের বাহিনীকে আমরা তিন চারটি দলে বিভক্ত করে নেব। পথ চলব শুধু রাতে। দিনের বেলা নড়াচড়া করব না; লুকিয়ে থাকব নিরাপদ স্থানে। পথে অপরিচিত কোন ব্যক্তি বা কাফেলা চোখে পড়লে, আটকে ফেলব এবং কার্ক পৌঁছা পর্যন্ত সঙ্গে রাখব। শত্রুর গোয়েন্দাবৃত্তির বিরুদ্ধে আমাদের এ পদক্ষেপ সুফল বয়ে আনবে বলে আশা করি। বললেন গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান।
.
বন্দী খৃষ্টান গুপ্তচর আর মেয়ে দুটো যখন সুলতান আইউবীর মুখ থেকে অতি স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ এ তথ্যগুলো শুনছিল, ঠিক সে সময়ে চলছিল শোবক দুর্গে খৃষ্টান রাষ্ট্রপ্রধান ও সেনা কমান্ডারদের জরুরী সভা। সভাসদদের সকলের মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। হাতেমুল আকবর নামক এক মিসরী মুসলমানও সভায় উপস্থিত।
সভার কার্যক্রম শুরু হল। বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করছে হাতেম
ক্ষমতাচ্যুতির পর খলীফা আজেদ মারা গেছেন। মিসর এখন বাগদাদের খলীফার অধীনে। খৃষ্টানদের ওফাদার মুসলমান নায়েব সালার রজবও প্রাণ হারিয়েছে রহস্যময়ভাবে। শোবক থেকে রজব যে তিনটি মেয়ে নিয়ে গিয়েছিল, খুন হয়েছে তারাও। খৃষ্টানদের আরেক ওফাদার মুসলিম সেনানায়ক ফয়জুল ফাতেমীও জল্লাদের হাতে মারা পড়েছে। সর্বোপরি দুটি মেয়েসহ যে আলেম গোয়েন্দাকে কায়রো পাঠান হয়েছিল, মেয়েদেরসহ সেও ধরা পড়েছে। তাদের ধরা পড়ার ঘটনা ঠিক এমন সময়ে ঘটল, যখন তাদের মিশন সফল হওয়ার পথে। থামল হাতেম।
সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দা বিভাগ বড় অভিজ্ঞ ও চৌকস। তাদের হাতে বন্দী মেয়েগুলোকে মুক্ত করে আনা অসম্ভব। আমাদের ভাল ভাল মেয়েগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বলল, কনরাড। কনরাড খৃষ্টানদের বিখ্যাত এক রাষ্ট্রনায়ক ও সেনা কমাণ্ডার।
ক্রুশের স্বার্থে এ ত্যাগ আমাদের দিতেই হবে। জীবন দিতে হবে আমাদেরও। আমাদের যারা এ যাবত ধরা পড়েছে, তাদেরকে ভুলে যাও। তাদের স্থলে নতুন লোক পাঠাও। বলল অপর এক খৃষ্টান রাষ্ট্রনায়ক ও সেনা কমাণ্ডার গাই অফ লুজিনান।
আচ্ছা, এই যে মুসলমানদের হাতে দুটি মেয়ে ধরা পড়ল, এরা কারা? আর ঐ রজবের সঙ্গে মারা যাওয়া মেয়ে তিনটি এসেছিল কোথা থেকে? প্রশ্ন করে লুজিনান।
তাদের দুজন ছিল খৃষ্টান। তারা ইটালীর মেয়ে। অপর তিনজন মুসলমান। শৈশবে তাদের অপহরণ করে আনা হয়েছিল। তারা বেশ রূপসী মেয়ে ছিল। তারা যে মুসলিম বাবা-মার সন্তান, তা তারা ভুলেই গিয়েছিল। শিশুকাল থেকেই তাদের গোয়েন্দাবৃত্তির প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল। কাজেই এক সময়ে মুসলমান ছিল বলে তারা আমাদেরকে ধোঁকা দিয়েছে, এমন সন্দেহ করার কোন অবকাশ নেই। গোয়েন্দা প্রধান জবাব দেয়।
ছিল-ই বা মুসলমান, তাতে কি? বলল কনরাড। হাতেমুল আকবরের প্রতি ইঙ্গিত করে কনরাড বলল, এই যে আমাদের প্রিয় বন্ধু হাতেমও তো মুসলমান। নিজ ধর্মের প্রতি অনুরাগ নেই কি তার? তারপরও তো সে আমাদের আপন!
হাতেমের হাতে মদের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে কনরাড আরো বলে, আমাদের হাতেম জানে যে, সালাহুদ্দীন আইউবী মিসরকে দাসত্বের শৃংখলে আটকাতে চায় এবং ইসলামের নামে তামাশা করছে। আমরা মিসরকে স্বাধীন করতে চাই। তার প্রথম পদক্ষেপ হল, আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীকে মিসরে এক মুহূর্তের জন্য সুস্থির হয়ে বসতে দেব না।
মদোন্মত্ত হাতেম মাথা নেড়ে সমর্থন জানায়। বলে, এবার আমি ওখানে এমন ব্যবস্থা নেব যে, আপনার একজন লোকও আর ধরা পড়বে না।
মিসরে যদি আমরা এ অশান্তি সৃষ্টি করে না রাখতাম, তাহলে সালাহুদ্দীন আইউবী বহু আগেই আমাদের উপর হামলা করে বসত। তার শক্তিকে আমরা তারই লোকদের উপর ব্যয় করাচ্ছি, এটা আমাদের কম সাফল্য নয়। বলল এক খৃষ্টান কমান্ডার।
আইউবী ও আলী বিন সুফিয়ানকে দুনিয়া থেকে বিদায় করার কোন ব্যবস্থা : এখনো হয়নি? জানতে চায় কনরাড।
কয়েকবার চেষ্টা করেছি স্যার! কিন্তু কামিয়াব হইনি। ব্যর্থতার কারণ, লোক দুটো পাথরের মত শক্ত। না তারা মদ স্পর্শ করে, না নারীর প্রতি তাদের দুর্বলতা আছে। এ কারণে মদে কিছু মিশিয়েও তাদেরকে হত্যা করা যায় না, নারী দিয়েও কাবু করা যায় না। তবে আমরা নিরাশ নই। ব্যবস্থা একটা করে রেখেছি।
আইউবীর দেহরক্ষীদের মধ্যে চারজন-ই আমাদের ফেদায়ী। বড় বুদ্ধিমত্তার সাথে আমার তাদেরকে ঐ পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়েছে। সুযোগ পেলেই ওরা তাদের দুজনকে, অন্তত একজনকে খতম করে ফেলবে। গোয়েন্দা প্রধান জবাব দেয়।
আচ্ছা, আমাদের এখানেও আইউবীর গোয়েন্দা আছে নাকি? জিজ্ঞেস করে লুজিনান।
অবশ্যই। যখন থেকে আমরা মিসর ও সিরিয়ায় আমাদের গুপ্তচরবৃত্তি এবং নাশকতামূলক কার্যক্রম শুরু করি, তখন-ই আইউবী আমাদের এদিকে চর পাঠিয়ে দিয়েছে। আমাদের হাতে দুজন ধরাও পড়েছে। কিন্তু নির্যাতনের মুখে ওরা জীবন দিয়েছে ঠিক, তৃতীয় কোন সহকর্মীর নাম বলেনি। গোয়েন্দা প্রধান জবাব দেয়।
তাদের সফলতার পরিমাণ কী? জানতে চায় লুজিননি।
স্যার! কার্কে আমাদের গুদামে আগুন লেগে যে অর্ধেক রসদ পুড়ে গিয়েছিল, জীবন্ত জ্বলে গিয়েছিল এগারটি ঘোড়া, তা আইউবীর এই সন্ত্রাসী গুপ্তচরদের-ই কাজ ছিল। আমি আপনাকে আরো জানাতে পারি যে, আমাদের যুদ্ধের ধরন ও কৌশলের পুংখানুপুংখ রিপোর্ট আইউবীর কানে পৌঁছে যায় যথাসময়ে। আমি আইউবীর গুপ্তচরদের প্রশংসা না করে পারছি না যে, ওরা জীবন বাজি রেখে পরম নিষ্ঠা ও আমানতদারীর সাথে দায়িত্ব পালন করে থাকে। জবাব দেয় অপর একজন।
দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত চলে এই সভা। মিসর ও সিরিয়ায় নাশকতামূলক কর্মতৎপরতা কিভাবে আরো জোরদার, আরো ধ্বংসাত্মক করা যায়, সে বিষয়ে চুলচেরা আলোচনা হয়। হাতেমুল আকবর সভাসদদের সামনে সুলতান আইউবীর সরকারের দুর্বলতা সবলতার দিকগুলোর প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে। অবশেষে হাতেমুল আকবরকে আরো কিছু লোক ও দু-তিনটি মেয়ে প্রদান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
***
দু নায়েব এবং আলী বিন সুফিয়ানকে কার্ক আক্রমণের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করছেন সুলতান আইউবী। বিশদিন পর তার বাহিনী রওনা হবে বলে জানালেন। পাশের কক্ষ থেকে আলেম গোয়েন্দা এবং মেয়ে দুটো সব শুনে ফেলে। তারা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে ফেলে। আলেম গোয়েন্দা অনুশোচনা ব্যক্ত করে, এত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, অথচ শোবকে তা পৌঁছাতে পারছে না সে।
আমি সালাহুদ্দীন আইউবীকে বাগে আনার চেষ্টা করব। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও যদি তিনি আমাকে নির্জনে তার সঙ্গে থাকার সুযোগ দেন, তাহলে আমি আমার মুক্তি আদায় করে নিতে পারব। তার বিবেক-বুদ্ধি কজা করতে পারব বলে আমি আশাবাদী। বলল এক মেয়ে।
তিনি আমাদেরকে কেন ডাকলেন, বুঝতে পারছি না। তবে মনে রাখবে, যদি তোমাদেরকে একজন একজন করে হাজির করা হয়, তাহলে তাকে পশুতে পরিণত করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। যদি মদ খাওয়াতে সক্ষম হও, তাহলে অচেতন করতে হলে কি পরিমাণ খাওয়াতে হবে, তা তোমাদের জানা আছে। তারপর পালাবার পদ্ধতিও তোমাদের অজানা নয়। পালিয়ে গিয়ে প্রথমে কার নিকটে পৌঁছতে হবে তা-ও তোমাদের জানা। মনে আছে তো? তার ঘর মসজিদের ঠিক বিপরীতে। বলল গোয়েন্দা।
আমি জানি- মাহদী আবাদান তার নাম। বলল মেয়েদের একজন।
হ্যাঁ, তোমরা যদি মাহদী পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পার, তাহলে তোমাদেরকে শোবকে পৌঁছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব তার। আমার পালাবার প্রশ্নই আসে না। আইউবীর পরিকল্পনা সবই তোমরা শুনেছ। মুসলিম বাহিনীর রওনা হওয়ার তারিখটা মনে রেখ। তারা কোন্ পথে যাবে, তাও ভুলো না। তারা পথ চলবে রাতে। দিনের বেলা তারা নড়াচড়া করবে না। আমি আশা করি, আগেভাগে তথ্যগুলো পৌঁছিয়ে দিতে পারলে আমাদের বাহিনী আইউবীকে পথেই প্রতিরোধ করতে পারবে। আর এটিই আইউবীর একমাত্র ভয়। শোবকে গিয়ে বিশেষভাবে একথাও জানাবে যে, আইউবী মুক্ত মাঠে মুখোমুখি লড়াই করতে ইচ্ছুক নয়। কারণ, তার সৈন্য কম। বলল আলেম গোয়েন্দা।
বৈঠক সমাপ্ত হয়। যার যার মত চলে যান নায়েবগণ। টের পেয়ে দ্রুত আপন আপন জায়গায় গিয়ে বসে তিন গোয়েন্দা। আলেমের পরামর্শে মেয়ে দুটো দুই হাটুর মাঝে মাথা লুকিয়ে বসে থাকে, যেন তারা কিছুই শুনেনি। আশপাশের কোন খবরই তারা রাখে না যেন।
তারা কক্ষে কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়। তবু কেউ মাথা তুলছে না। আলী বিন সুফিয়ান আলেম গোয়েন্দার কাঁধে হাত রাখেন। বললেন, উঠ, আমার সঙ্গে চল।
এবার মাথা তুলে তাকায় গোয়েন্দা। মেয়ে দুটোকেও উঠিয়ে আনেন আলী। নিয়ে যান সুলতানের কক্ষে।
বন্দী গোয়েন্দাদের শৃংখল খুলে দেয়ার আদেশ দেন সুলতান। কর্মকার আনার জন্য আলী বাইরে বেরিয়ে পড়েন। সুলতান বসতে বললেন তিনজনকে। তারপর আলেম গোয়েন্দার উদ্দেশে বললেন
আমি তোমার ইলম ও বিচক্ষণতাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তুমি তোমার বিদ্যাকে শয়তানী কাজে ব্যবহার করছ। এই অপকর্মের স্থলে যদি তুমি এদেশে এসে নিজ ধর্ম প্রচার করতে, তাহলে এই ভেবে আমি মনের গভীর থেকে তোমাকে শ্রদ্ধা করতাম যে, তুমি নিজ ধর্ম ও নবীর খেদমত করছ। বল তো, তোমার ধর্ম কি তোমাকে অন্য ধর্মের ইবাদতখানায় বসে সেই ধর্মে মিথ্যার সংমিশ্রণ ঘটানোর বৈধতা স্বীকার করে? তোমার হৃদয়ে কি তোমার পবিত্র ক্রুশ, নবী ঈসা ও কুমারী মাতা মরিয়মের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধও আছে? যদি থাকে, তাহলে মিথ্যা ও শয়তানী কর্মকান্ডের মত। কবীরা গুনায় লিপ্ত হয়ে তুমি তাদের ইবাদত কর কিভাবে?
এ মিথ্যাচার আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। আমি যা কিছু করেছি, ক্রুশের জন্যই করেছি। বলল গোয়েন্দা।
তোমার দাবী অনুযায়ী তুমি গভীরভাবে ইঞ্জীল ও কুরআন অধ্যয়ন করেছ। বল, এই দুই আসমানী কিতাবের একটিতেও কি এই অনুমতি দেয়া আছে যে, এ রকম উদ্ভিন্ন-যৌবনা যুবতীদেরকে কুকর্মের পথে নিক্ষেপ করবে এবং পর পুরুষের কাছে পাঠিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করবে? ইঞ্জীল কি তোমাদের বলেছে যে, ক্রুশের খাতিরে তোমরা জাতির সুন্দরী মেয়েগুলোর ইজ্জত অন্যের হাতে তুলে দাও? তুমি কি কোন মুসলমান মেয়েকে কুরআন ও ইসলামের নামে নিজের ইজ্জত পরপুরুষের হাতে তুলে দিতে দেখেছ কখনো? বললেন আইউবী।
ইসলামকে আমি খৃষ্টবাদের প্রতিদ্বন্দ্বি মনে করি। যখন-ই যে বিষ হাতে পাব, তা-ই আমি ইসলামের শিরায় শিরায় মিশিয়ে ছাড়ব। বলল গোয়েন্দা।
মধুর বিষ দিয়ে তোমরা গুটিকতক মুসলমানের চরিত্র হনন করতে পারবে জানি; কিন্তু তোমরা ইসলামের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না। শান্ত-সমাহিত কণ্ঠে বললেন আইউবী।
এবার মেয়ে দুটোর প্রতি দৃষ্টিপাত করে সুলতান বললেন
তোমরা কোন্ বংশের মেয়ে জানা আছে তোমাদের? বল, তোমাদের আসল পরিচয় কি?
দুজন-ই নীরব। কারো মুখে রা নেই।
নৈতিক ও চারিত্রিক পবিত্রতা তো সব শেষ করেছ। এখন কোন সম্রাপ্ত পরিবারের কারুর স্ত্রী হয়ে জীবন অতিবাহিত করার ইচ্ছা আছে তোমাদের জিজ্ঞেস করেন আইউবী।
প্রশ্নটা লুফে নেয় এক মেয়ে। আইউবীকে টোপ দেয়ার জন্য এমন একটি মোক্ষম প্রশ্ন-ই দরকার ছিল তার। বলল, আমি সম্মানিত স্ত্রী হয়ে বাকী জীবন কাটাতে চাই। আপনি কি আমায় গ্রহণ করবেন? আপনি যদি গ্রহণ না করেন, তাহলে আমাকে অন্য একজন সম্ভ্রান্ত স্বামীর ব্যবস্থা করে দিন। ইসলাম কবুল করে অতীতের সব পাপ থেকে আমি তাওবা করব।
স্মিত হাসলেন আইউব। তারপর খানিক ভেবে বললেন
আমি চাই না, এ আলেমের ইলম জল্লাদের তরবারীর খুনে ভেসে যাক্। আমি এ ও চাই না যে, তোমাদের দুজনের রূপ-যৌবন আমার বন্দীদশার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে গলে-পঁচে নিঃশেষ হোক। শোন মেয়ে! সত্যিই যদি অতীতের পাপাচার থেকে তাওবা করতে চাও, তাহলে আমি তোমাদের মুক্তি দিয়ে তোমাদের জন্মভূমিতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে মনে রেখ, ঐ দেশ তোমাদের নয়- আমাদের। একদিন না একদিন আমি তোমাদের রাজাদের হাত থেকে আমার দেশকে উদ্ধার করব-ই। যাও; দেশে গিয়ে একজন ভদ্র পুরুষের স্ত্রী হয়ে পবিত্রতার সাথে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দাও। আমি তোমাদের তিনজনকেই মুক্তি দিলাম।
হঠাৎ চমকে উঠে তিন গোয়েন্দা। যেন সুঁই ফুটানো হয়েছে তাদের গায়ে। ইত্যবসরে কক্ষে প্রবেশ করেন আলী বিন সুফিয়ান। সঙ্গে তার এক কর্মকার। শৃংখল খুলে দেয়া হয় তিনজনের। সুলতান বললেন, আলী! আমি এদেরকে মুক্তি দিয়েছি। শুনে আলী জ্ৰপ বিস্মিত হলেন। দীর্ঘক্ষণ অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকেন সুলতানের মুখের দিকে। সুলতান বললেন, এদেরকে তিনটি উটে তুলে দাও। চারজন দক্ষ, বিচক্ষণ ও সাহসী অশ্বারোহী সশস্ত্র রক্ষী সঙ্গে দাও। তারা এদেরকে শোবক দুর্গে রেখে ফিরে আসবে। জরুরী পাথেয়-সামানও সঙ্গে দিয়ে দাও আর আজই এদের বিদায় করে দাও।
আলেম গোয়েন্দার উদ্দেশে সুলতান বললেন
ওখানে গিয়ে এ ভুল প্রচার করো না যে, সালাহুদ্দীন আইয়ুবী গোয়েন্দাদের ক্ষমা করে দেয়। গোয়েন্দাদেরকে চাক্কিতে দানা পেষার মত পিষে পিষে নিঃশেষ করা-ই আমার নিয়ম। তুমি একজন আলেম বলেই আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম। আমি তোমাকে ইলমের আলো ছড়ানোর সুযোগ দিলাম।
***
সূর্য এখনো অস্ত যায়নি। তিনটি উটে সাওয়ার হয়ে চারজন দেহরক্ষীর সঙ্গে রওনা হয় তিন গোয়েন্দা। দেহরক্ষী চারজন মুসলিম সেনাবাহিনীর বাছাইকরা লোক। সুশ্রী, সুঠাম, বলিষ্ঠ, সাহসী ও ব্যক্তিত্ববান সৈনিক তারা। সুলতানের নির্দেশে আলী বিন সুফিয়ান দেখে-শুনেই এদের নির্বাচন করেছেন। তার কারণ দুটি। প্রথমতঃ পথে– তাদের পদে পদে দুস্য-ডাকাতের মোকাবেলা করতে হবে। এর জন্য শক্তি-সামর্থ ও সাহসের প্রয়োজন। দ্বিতীয়তঃ গোয়েন্দাদের পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য তাদের খৃষ্টান সেনাকমান্ডারদের মুখোমুখি হতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। সঙ্গে দেয়া উট-ঘোড়াগুলোও অতি উন্নত।
কিন্তু সুলতান আইউবী এই ব্যতিক্রমী উদারতা কেন দেখালেন, ভেবে সবাই হতবাক্। দুশমনকে ক্ষমা করা তো তার স্বভাব নয়! সবিনয়ে ঘটনার রহস্য জানতে চান আলী বিন সুফিয়ান। জবাবে সুলতান শুধু বললেন
আলী! তোমাকে বলেছিলাম, আমি একটি জুয়া খেলতে চাই। এবার সেই জুয়ার বাজি-ই লাগালাম। বাজিতে যদি হেরে যাই, তাহলে ক্ষতি শুধু এতটুকু-ই হবে যে, তিনজন শত্রু গোয়েন্দা আমার হাতছাড়া হয়ে গেল।
বিস্তারিত জানতে চান আলী। কিন্তু সুলতান এ পর্যন্ত-ই কথার ইতি টেনে বললেন, ধৈর্য ধর আলী! সময়মত সব জানতে পারবে।
মুক্তিপ্রাপ্ত তিন গোয়েন্দা আনন্দচিত্তে এগিয়ে চলছে শোবক অভিমুখে। তাদের এই আনন্দ শুধু মুক্তির আনন্দ নয়। এ মুহূর্তে তাদের আনন্দের মূল কারণ, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য, যা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা শোবকে।
.
কায়রো শহর ত্যাগ করে বহুদূর এগিয়ে গেছে সাতজনের কাফেলা। তিন গোয়েন্দার উট তিনটি পাশাপাশি চলছে। চার দেহরক্ষীর দুজন সামনে আর দুজন পিছনে।
পথ চলতে চলতে আলেম গোয়েন্দা মেয়েদের উদ্দেশে বলে, আমাদের খোদা ঈসা মসীহ মোজেজা দেখালেন। এতে প্রমাণিত হয়, আমাদের তিনি ভালবাসেন এবং আমাদেরকে বিজয় দান করবেন। এটি আমাদের ধর্মের সত্যতার লক্ষণ। খোদা সালাহুদ্দীন আইউবী ও আলী বিন সুফিয়ানের মত বিচক্ষণ লোকের বিবেক অন্ধ করে দিয়েছেন। যার ফলে এত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের কানে দিয়ে তিনি আমাদেরকে মুক্তি দিয়ে দিলেন। এ তথ্য পেলে আমাদের সৈন্যরা আইউবীর বাহিনীকে খোলা মাঠে ঘিরে ফেলেই নিঃশেষ করে দেবে। বেটারা কার্ক পৌঁছার সুযোগই পাবে না। আমার আশা, আমাদের কমাণ্ডার যুদ্ধ আক্রমণ পর্যন্তই সীমিত রাখবেন না- মিসরেও চড়াও হবেন। পতন ঘটবে আইউবীর। অতি অনায়াসে প্রতিষ্ঠিত হবে আমাদের ক্রুশ।
আপনি অভিজ্ঞ আলেম। কিন্তু আপনি যাকে মোজেজা বলছেন, আমার কাছে তা বিপদ বলে মনে হচ্ছে। বিপদ হল এই চার দেহরক্ষী। বিচিত্র কি যে, সামনে কোথাও গিয়ে এরা আমাদেরকে হত্যা করে ফিরে যাবে। এমনও তো হতে পারে যে, আইউবী আমাদের সঙ্গে উপহাস করেছেন। জল্লাদের হাতে অর্পণ না করে তিনি আমাদেরকে তুলে দিয়েছেন এদের হাতে। নিরাপদ কোন স্থানে গিয়ে এরা মনভরে আমাদেরকে উপভোগ করবে। তারপর খুন করে ফিরে যাবে! বলল এক মেয়ে।
আর আমরা তো নিরস্ত্র। তোমার আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কোন রাষ্ট্রনায়ক তার গোয়েন্দাকে এভাবে ক্ষমা করতে পারেন না। তাছাড়া মুসলমান এতই যৌনবিলাসী জাতি যে, তারা তোমাদের মত সুন্দরী মেয়েদের নাগালে পেয়ে হাতছাড়া করতে পারে না। বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল আলেম গোয়েন্দা। যেন সব আনন্দ, সব স্বপ্নসাধ উড়ে গেছে তার মন থেকে। চেহারায় তার নিদারুণ হতাশার ছাপ। মেয়েটির কল্পিত বিপদের আশংকা আচ্ছন্ন করে ফেলেছে তাকেও।
আমাদের চোখ-কান খোলা রেখে সতর্কতার সাথে রাত কাটাতে হবে। রাতে যখন এরা ঘুমিয়ে পড়বে, তখন এদের অস্ত্র দিয়েই এদের খুন করতে হবে। আমাদের প্রয়োজন শুধু একটু সাহস। বলল অপর মেয়ে।
এতটুকু সাহস আমাদের করতেই হবে। কাজটা আজ রাতেই হয়ে গেলে ভাল হয়। সকাল পর্যন্ত আমরা অনেক পথ এগিয়ে যেতে পারব। বলল আলেম।
তিন গোয়েন্দার আগে-পিছে দুজন করে চার দেহরক্ষী গল্প-গুজবের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে। তাদের ভাব-গতিতে মনে হচ্ছিল, দুটি হৃদয়কাড়া রূপসী যুবতী যে তাদের হাতের মুঠোয়, সে খবর-ই তাদের নেই।
.
বেলা শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবি ডুবি করছে। ধীরে ধীরে ঘনিভূত হচ্ছে তিন গোয়েন্দার বিপদ-শংকা। মেয়ে দুটোর একজন আলেমকে বলে, আমরা এখন কোথাও থামব না। রাতের প্রথম প্রহরটি এভাবে অতিক্রম করেই কাটিয়ে দেব।
চলতে থাকে কাফেলা। মরুভূমির রাত আঁধারে ছেয়ে যায়। উট তিনটি কাছাকাছি এনে তিন গোয়েন্দা আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে। তারা দেহরক্ষীদের হত্যা করার পরিকল্পনা আঁটতে শুরু করে।
দীর্ঘক্ষণ পর এক সবুজ-শ্যামল স্থানে এসে পৌঁছে কাফেলা। থেমে যায় দেহরক্ষীগণ। তাবু ফেলে সেখানে। গোয়েন্দাদের আহারের ব্যবস্থা করে। নিজেরাও আহার করে। তারপর শোয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
চার মুসলিম দেহরক্ষীকে হত্যা করার পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে শুয়ে পড়ে তিন গোয়েন্দা। সুযোগের সন্ধান করছে তারা। দৃষ্টি তাদের দেহরক্ষীদের প্রতি নিবদ্ধ।
চার দেহরক্ষীর তিনজন শুয়ে পড়ে। টহল দিচ্ছে একজন। নিজেদের তাঁবুর চারদিকে পায়চারী করছে সে। হঠাৎ কেমন যেন একটা সন্দেহ জাগে তার মনে। দৌড়ে যায় গোয়েন্দাদের তাবুর দিকে। দেখে-শুনে ফিরে আসে আবার।
এভাবে দুঘন্টা কেটে যায়। তারপর সে অপর এক সঙ্গীকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। নিজে শুয়ে পড়ে তার জায়গায়। নতুনজন চারদিক টহল দিতে থাকে। একবার পশুগুলোর কাছে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে, আবার ঘুমন্ত লোকদের কে কি অবস্থায় আছে, লক্ষ্য করে দেখে। এবার আলেম গোয়েন্দা মেয়েদের ফিফিসিয়ে বলে, বোধ হয় আমরা সফল হতে পারব না। বেটারা পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছে। চিন্তা করে লাভ নেই। ঘুমিয়ে পড়; কপালে যা আছে, তা-ই হবে।
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তিন গোয়েন্দা।
রাতের শেষ প্রহর। এখনো আবছা অন্ধকার। তবে ভোর হলো বলে। রক্ষীরা জাগিয়ে তোলে গোয়েন্দাদের। শুরু হয় পুনরায় পথচলা। আগের নিয়মেই রওনা হয়। তারা। তিন গোয়েন্দা পাশাপাশি। রক্ষীদের দুজন সামনে দুজন পিছনে।
সূর্য উদিত হয়। ধীরে ধীরে প্রখর হতে থাকে রোদের কিরণ। কাফেলাও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে গন্তব্যপানে।
উঁচু-নীচু এক পার্বত্য এলাকায় ঢুকে পড়ে কাফেলা। এদিক-সেদিক মাটি আর বালির পাহাড়। দাঁড়িয়ে আছে বাঁকা দেয়ালের মত। দুই পাহাড়ের মধ্যখানে সরু গলিপথ। পথের উপর দুদিকের পাহাড়ের ভূতুড়ে ছায়া। ভয়ে মেয়েদের গা ছমছম্ করে উঠে। ভীতির ছাপ পরিষ্কার ফুটে উঠেছে তাদের চেহারায়। তাদের দৃষ্টিতে কু কর্ম আর খুন করার বড় উপযুক্ত স্থান এটি। ওসরের জন্যই বোধ হয় রক্ষীরা তাদের এ পথে নিয়ে এসেছে।
ওদেরকে আমাদের সাথে কথা বলতে বলুন। ওদের নীরবতা আর সম্পর্কহীনতার কারণে আমার ভয় লাগছে। বলুন, যদি ওরা আমাদেরকে খুন-ই করতে চায়, বিলম্ব না করে করে ফেলুক। মৃত্যুর অপেক্ষা করতে আমার কষ্ট হচ্ছে। বলল এক মেয়ে।
আলেম কথা বলছে না। মেয়েদের কোন সহযোগিতা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তারা তিনজনই এখন মুসলিম রক্ষীদের দয়ার উপর নির্ভরশীল।
বেলা দ্বি-প্রহর। সূর্য এখন মাথার উপর। থেমে যায় কাফেলা। টিলার ছায়ায় অবস্থান নেয় তারা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে খেতে বসে সবাই। আহারের মাঝে এক পর্যায়ে আলেম গোয়েন্দা রক্ষীদের জিজ্ঞেস করে, আমাদের সাথে তোমরা কথা বলছ না কেন?
আমরা কর্তব্যের অতিরিক্ত কথা বলি না। তোমাদের বিশেষ কোন কথা থাকলে বলতে পার, আমরা শুনব, প্রয়োজনে জবাব দেব। বলল রক্ষীদের কমান্ডার।
তোমাদের কি জানা আছে, আমরা কারা? জিজ্ঞেস করে আলেম।
তোমরা তিনজন গুপ্তচর। মেয়ে দুটো কুলটা। যাদেরকে তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাও, এরা তাদের ভোগের সামগ্রী। জানি না, মিসরের আমীর সালাহুদ্দীন আইউবী কেন তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন! তোমাদেরকে শোক দুর্গে পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তোমরা আমাদের আমানত …। কিন্তু একথা জিজ্ঞেস করলে কেন? বলল রক্ষী কমান্ডার।
মন চাইছিল তোমাদের সাথে কথা বলি। আমরা ক্ষণিকের সহযাত্রী ঠিক; কিন্তু আমাদের গন্তব্য এক; তোমাদের গন্তব্য অন্য। দুদিন পর আমরা তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাব। বলল কমান্ডার।
.
রক্ষীর জবাব যেন কানেই গেল না গোয়েন্দার। দূরের কি একটি বস্তু অবলোকন করছে যেন তার দু চোখ। চকিত নয়নে এক নাগাড়ে তাকিয়ে আছে ওদিকে। ধীরে ধীরে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে গোয়েন্দা। চোখে-মুখে তার ভীতির ছাপ। ভয়ংকর কি যেন দেখেছে সে।
রক্ষী কমান্ডারও চোখ তুলে তাকান সেদিকে। শংকিত হয়ে উঠেন তিনিও। বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ।
দুশ গজ দূরে এক স্থানে দাঁড়িয়ে আছে দুটি উট। পিঠে দুজন মানুষ। মাথায় পাগড়ি। মুখমন্ডল কাপড়ে ঢাকা। সওয়ার নির্নিমেষ চক্ষে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রক্ষী ও গোয়েন্দাদের কাফেলার প্রতি। তাদের গতিবিধি আর পোষাক-ই বলে দিচ্ছে, তারা কারা।
জান, ওরা কারা? রক্ষী কমান্ডার প্রশ্ন করে আলেমকে।
মরু ডাকাত। কি জানি, ওরা কজন! জবাব দেয় আলেম।
দেখা যাবে। বলেই রক্ষী কমান্ডার উঠে দাঁড়ান। এক সঙ্গীকে বলেন, আমার সঙ্গে এস।
ঘোড়ায় চড়ে দুই রক্ষী ডাকাতদের দিকে ছুটে যায়। তারা অস্ত্রসজ্জিত। সাথে তরবারী ছাড়াও আছে বর্শা। কাফেলা থেকে দুজন লোক ছুটে আসতে দেখে উষ্ট্ৰারোহীরা টিলার পিছনে অদৃশ্য হয়ে যায়।
বাকী দুই রক্ষী নিকটতম টিলায় উঠে পড়ে। আলেম মেয়েদের উদ্দেশে বলে, বোধ হয় তোমাদের আশংকা-ই সত্যে পরিণত হতে যাচ্ছে। ওরা ডাকাত নয় সালাহুদ্দীন আইউবীর পাঠানো লোক বলেই মনে হয়। না হলে রক্ষী দুজন এত বীরদর্পে তাদের কাছে গেল কেন! তোমাদেরকে চরমভাবে অপদস্ত করতে চায় আইউবী। তোমাদের বড় ভয়ানক শাস্তি ভোগ করতে হবে। আর আমার জন্য মৃত্যু তো অবধারিত।
তার মানে, আসলে আমরা মুক্তি পাইনি। এখনো আমরা আইউবীর কয়েদী। বলল, মেয়েদের একজন।
তা-ই তো মনে হয়। বলল অপরজন।
খানিক পর।
ফিরে আসে দুই মুসলিম রক্ষী। টিলা থেকে নেমে আসে সঙ্গীদ্বয়। তাদের চারপাশে জড়ো হয় সবাই।
রক্ষী কমান্ডারের নাম হাদীদ। হাদীদ জানায়
ওরা মরুদস্যু। আমরা তাদের সাথে দেখা করে এসেছি। সংখ্যায় ওরা কজন, জানতে পারিনি। যে দুজনকে আমরা উটের পিঠে দেখেছিলাম, তারা জানায়, আজ ভোর থেকেই তারা আমাদের পিছু নিয়েছে। তারা আমাকে বলে, তোমরা ফৌজের লোক। মুসলমান বলে মনে হয়। কিন্তু মেয়ে দুটো মুসলমান নয়। মেয়েদেরকে আমাদের হাতে তুলে দাও; তোমাদেরকে বিরক্ত করব না। আমি বললাম, মেয়ে দুটো যে ধর্মের-ই হোক; আমাদের হাতে আমানত। জীবন থাকতে আমরা ওদেরকে তোমাদের হাতে অর্পণ করতে পারব না। আমাকে তারা সাধের জীবনটা না খোয়াবার পরামর্শ নেয়। আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করে। আমি ওদের সাফ বলে এসেছি, আগে আমাদেরকে খুন কর, পরে ওদেরকে নিয়ে নাও।
তোমরা কি অস্ত্র চালাতে জান? গোয়েন্দাদের জিজ্ঞেস করে রক্ষী কমান্ডার।
আমরা মেয়েদেরকে যে কোন অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। তোমাদের কাছে তো বর্শা-তীর-কামান সবই আছে। তার থেকে একটি একটি করে দাও না আমাদের! বলল আলেম।
এখন নয়। সংঘর্ষ শুরু হোক, তখন দেব। বললেন হাদীদ। সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয় গোয়েন্দাদের।
রক্ষী কমান্ডার বললেন, উট-ঘোড়ায় চড়ে লড়াই করার জন্য এ জায়গা উপযোগী নয়। এক্ষুণি আমাদের এ স্থান ত্যাগ করতে হবে। বলেই এক লাফে ঘোড়ায় উঠে রওনা দেয় হাদীদ।
রক্ষীরা তীর-কামান হাতে নেয়। নীরের মুখ খুলে নেয়। ঘোড়ায় চড়ে ছুটে চলে তারাও। মেয়েদের নিয়ে আলেম গোয়েন্দাও এগিয়ে চলে।
এক সঙ্গীসহ হাদীদ সকলের আগে। সঙ্গী তাকে বলে, ওদের হাতে অস্ত্র দেয়া ঠিক হবে না। শত হলেও ওরা আমাদের শত্রু। অস্ত্র পেলে ওরা ডাকাতদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমাদেরকে মেরে ফেলতে পারে।
ওরা আমাদের অস্ত্র দিতে অস্বীকার করল। ওদের মনোভাব ভাল নয়। ডাকাতরা ওদের-ই লোক। তোমাদের দুজনকে ওরা ডাকাতদের হাতে তুলে দেবে আর আমাকে খুন করে ফেলবে। মেয়েদের উদ্দেশে বলল গোয়েন্দা।
মুখোশপরা কাউকে দেখামাত্র তীর ছুঁড়বে। আমার নির্দেশের অপেক্ষা করবে না। যখন হোক, যেখানে হোক, ডাকাতদের সঙ্গে সংঘর্ষ হবেই। রক্ষীদের আগেই বলে দেন হাদীদ।
বিদ্যুৎগতিতে এগিয়ে চলে কাফেলা। মাঝে-মধ্যে থেমে উট-ঘোড়াকে দানা-পানি খাইয়ে নিচ্ছে। তাই পথ চলায় ক্লান্তি নেই ওদের।
উঁচু-নীচু পার্বত্য এলাকা যেন ফুরাতে চায় না। মাঝে-মধ্যে পথের দুধারে উঁচু উঁচু টিলা। হাদীদ ভয় পান টিলার উপর থেকে ডাকাতরা তীর ছোঁড়ে কিনা। সতর্ক করে দেন তিনি সঙ্গীদের। গোয়েন্দাদেরও বলে দেন, যেন তারা উটের গতি বাড়িয়ে ঘোড়ার সমানে চলে আর উপর দিকে লক্ষ্য রাখে।
পার্বত্য এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে আসে কাফেলা। কোন ডাকাত চোখে পড়েনি। পশ্চিম আকাশে সূর্য নীচে নামতে শুরু করে। একবার দূরে ছায়ার মত দুটি উট চোখে পড়ল। কাফেলা যেদিকে যাচ্ছে, উট দুটোও সেদিকে এগুচ্ছে বলে মনে হল। দ্রুত এগিয়ে চলছে কাফেলা।
পথে একস্থানে পানি পাওয়া গেল। থামল কাফেলা। উট-ঘোড়াকে পানি পান করাল। নিজেরাও পান করল। আবার ছুটে চলল।
সূর্য আরো নীচে নেমে আসে। সাঝের আবছা আঁধারে ছেয়ে যায় প্রকৃতি। কাফেলাকে থামান হাদীদ। বলেন, যুদ্ধের জন্য এটি উপযুক্ত জায়গা। এখানে আশে পাশে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই।
হাদীদ ঘোড়াগুলোর জিন খুললেন না, যাতে প্রয়োজনের সময় প্রস্তুত পাওয়া যায়। উটগুলোকে বসিয়ে দেন। আহারাদি সেরে হাদীদ মেয়েগুলোকে এক স্থানে শুইয়ে দেন। সতর্ক থাকতে বলে দেন তাদের। রক্ষীদেরকে তীর-কামান প্রস্তুত রাখতে বলেন। বলেন, চোখ-কান খোলা রেখে শুয়ে থাকতে। হাদীদ নিশ্চিত, রাতে যে কোন সময় আক্রমণ হবেই।
***
মধ্য রাত। শান্ত-নিস্তব্ধ মরুভূমি। হঠাৎ কিসের যেন শব্দ শুনতে পায় কাফেলা। কান খাড়া করে সবাই। চকিতে চোখ তুলে তাকান হাদীদ। ভূত! ভূতের ন্যায় বড় বড় ছায়ামূর্তি দৌড়াচ্ছে কাফেলার চারদিকে। অনেকগুলো উটের পায়ের আওয়াজ স্পষ্ট কানে আসছে। মাটি যেন থর থর করে কাঁপছে। উটের সংখ্যা দশেরও বেশী বলে মনে হল। একটিতে একজন করে আরোহী। কাফেলার মনে আতংক সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে তারা।
তিন চারটি চক্কর দিয়ে নিকটে এসে হাঁক দেয়, মেয়ে দুটোকে আমাদের হাতে তুলে দাও। আমরা তোমাদের আর কিছু চাই না; ওদের নিয়েই ফিরে যাব।
শুয়ে শুয়ে-ই হাদীদ প্রথম তীর ছুঁড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বিকট এক আর্তচীৎকার ভেসে আসে। অন্য রক্ষীরাও শোয়া অবস্থাতেই তীর চালাতে শুরু করে। দুটি উটের গোংগানীর শব্দ শোনা যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দস্যুদলের উট দুটো।
হাদীদ মেয়েদের বলেন, পালাবার চেষ্টা কর না, আমাদের সঙ্গে থাক।
দস্যুদের একজন বলল, আক্রমণ কর, ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়। একজনকেও প্রাণে বাঁচতে দিওনা। মেয়েদের তুলে আন।
জোৎস্না না থাকলেও মরুভূমির রাত বেশ ফর্সা।. অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। উটের পিঠ থেকে নেমে আসে দস্যুদল। তরবারী আর বর্শা হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাফেলার উপর। হাতাহাতি লড়াই শুরু হয়। দু পক্ষের হাঁক-ডাকে নিঝুম রাতের নীরবতা ভেঙ্গে যায়। হাদীদ ও তার সঙ্গীরা নিজেরা ঢাল হয়ে দস্যুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করছে মেয়েদের। অস্ত্র চায় মেয়েরা। নিজের তরবারী দিয়ে দেন হাদীদ। নিজে বর্শা দিয়েই মোকাবেলা করছেন তিনি। হাদীদের তরবারী হাতে নিয়ে এক মেয়ে রক্ষীদের নিরাপদ বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে যায়। আলেম গোয়েন্দার সাড়াশব্দ নেই।
দীর্ঘক্ষণ চলে এ সংঘর্ষ। ধীরে ধীরে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যোদ্ধারা। রক্ষীরা একে অপরকে ডাকতে থাকে। এক সময়ে তাদের ডাক-চীৎকারও বন্ধ হয়ে যায়। রণাঙ্গনের হট্টগোলও কমে আসে।
হাদীদ তার সঙ্গীদের ডাকেন। কিন্তু কোন জবাব পাচ্ছেন না তিনি। একটি মেয়ের কণ্ঠ শুনতে পান হাদীদ। মেয়েটি চীৎকার করে ডাকছে তাকে। সাথে একটি ঘোড়ার তীব্রগতিতে ছুটে চলার শব্দও শোনা গেল। হাদীদ বুঝতে পারেন, কোন ডাকাত এক মেয়েকে উটের পরিবর্তে তাদেরই ঘোড়ায় তুলে নিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত একটি ঘোড়ায় চড়ে বসেন হাদীদ। পলায়নপর ঘোড়ার অনুসরণ করেন তিনি।
বিদ্যুৎগতিতে ছুটে চলছে তার ঘোড়া। সমতল মরুভূমিতে কোন বাঁধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না তাঁর।
কয়েক মাইল পথ অতিক্রম করার পর পলায়নপর ঘোড়ার ছায়া চোখে পড়ে। ধীরে ধীরে দুই ধাবমান ঘোড়ার মধ্যকার দূরত্ব কমতে থাকে। হঠাৎ হাদীদ অনুভব করে, পিছন দিক থেকে আরো একটি ঘোড়া ধেয়ে আসছে। আরোহী তারই সঙ্গী না দস্যু বুঝতে পারছেন না তিনি। পিছন থেকে আসা ঘোড়াটি কাছে এসে গেছে হাদীদের। হাদীদ নিজের ঘোড়ার গতি স্বাভাবিক রেখেই উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করেন, কে? কোন জবাব পান না তিনি। হাদীদ তার অশ্বের গতি আরো তীব্র করার চেষ্টা করেন।
পলায়নপর ঘোড়ার বাগ এখন মেয়ের হাতে। ঘোড়া ডান-বাম করতে শুরু করে। গতিও কমে যায়। কাছে চলে আসেন হাদীদ।
হাদীদের হাতে বর্শা। পলায়নপর ঘোড়ার আরোহীর এক পার্শ্বে গিয়েই বর্শার আঘাত হানেন তিনি। এক দিকে সরে যায় ঘোড়া। আঘাত থেকে রক্ষা পায় আরোহী। বর্শা বিদ্ধ হয় ঘোড়ার গায়ে। ১
ঘোড়া থামিয়ে ঘুরে দাঁড়ান হাদীদ। অপর ঘোড়ার আরোহীও মোড় ঘোরাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সম্মুখে বসা মেয়েটি ঘোড়ার লাগাম এদিক-ওদিক করে স্থির হতে দিচ্ছে না তার ঘোড়াকে।
মেয়েটিকে নিয়ে ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়ে দস্যু। নিজের ঘোড়াকে ঢাল বানিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে সে।
ঘোড়ায় বসেই আঘাত করার চেষ্টা করছেন হাদীদ। কিন্তু যে দিক থেকেই তিনি আঘাত করছেন, দস্যু মেয়েটিকে নিয়ে তার ঘোড়ার আড়াল হয়ে হাদীদের আঘাত থেকে রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে।
এবার ঘোড়া থেকে নেমে আসেন হাদীদ। পিছন থেকে ধেয়ে আসা আরোহীও এসে পড়ে ইতিমধ্যে। হাদীদের সঙ্গী নয় সে, দস্যু। সে-ও নেমে পড়ে ঘোড়া থেকে। যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে গর্জে ওঠেন হাদীদ। বলেন, আমার জীবন থাকতে তোমরা মেয়েটিকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না।
এক দস্যু মেয়েটিকে ঝাঁপটে ধরে রাখে। অপরজন যুদ্ধে লিপ্ত হয় হাদীদের সঙ্গে। মেয়ের কাছে এখন তরবারী নেই। মেয়েকে আটকে রাখা দস্যুও এবার হাদীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছেড়ে দেয় মেয়েটিকে।
হাদীদ মেয়েকে ডেকে বলে, ঘোড়ায় চড়ে তুমি শোবকের দিকে চলে যাও। আমি দস্যুদের তোমাকে ধাওয়া করতে দেব না। কিন্তু মেয়ে এক পা-ও নড়ছে না, ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে।
দু দস্যুর মোকাবেলা করেন হাদীদ। দস্যুদ্বয় বারবার তাকে বলে, একটি মেয়ের জন্য নিজের জীবন বিপন্ন কর না। আমাদের পথ ছেড়ে তুমি জীবন নিয়ে সরে যাও। কিন্তু হাদীদের একই জবাব, আগে আমার জীবন নাও, পরে মেয়েকে নিও। আমার জীবন থাকতে তোমরা ওকে নিতে পারবে না।
হাদীদ মেয়েকে পুনরায় বলে, এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন তুমি? পালাও না কেন এখান থেকে! মেয়ে বলে, তোমাকে ছেড়ে আমি যেতে পারব না। জীবন দিতে হলে তুমি একা কেন, দুজনই দেব। আমার জন্য তুমি তোমার জীবন বিপন্ন করবে, আর আমি তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে যাব, তা হতে পারে না।
.
দস্যুদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন হাদীদ। প্রতিপক্ষের আঘাতে আহত হয়ে পড়েন তিনি। যুদ্ধরত অবস্থায় হাদীদ পুনরায় মেয়েকে বলেন, আমি আহত হয়ে গেছি। আমার মৃত্যুর আগেই তুমি এখান থেকে জীবন-সম্ভ্রম নিয়ে পালিয়ে যাও। অনুরোধ, আর দাঁড়িয়ে থেক না। যাও বলছি, যাও।
মেয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়ায় এক দস্যু। মওকা পেয়ে যান হাদীদ। তার পাজরে বর্শা ঢুকিয়ে দেন তিনি। কিন্তু এ সময়ে অপর দস্যুর তরবারী হাদীদের কাঁধে আঘাত হানে। হাদীদের আঘাত খাওয়া দস্যু লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে তার তরবারীটি নিয়ে নেয় এবং পিছন থেকে এসে এক ঘা মারে দস্যুর পিঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করতে চায় সে। এ সময়ে হাদীদের বর্শা এসে বিদ্ধ হয় তার বুকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দস্যুর অসাড় দেহ। চিরতরে নিস্তব্ধ হয়ে যায় সে-ও।
হাদীদও আহত। ক্ষত তার মারাত্মক। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। পড়ে যাচ্ছেন তিনি। মেয়েটি ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে তাঁকে।
কাঁপা কণ্ঠে হাদীদ মেয়েকে বলে, তুমি আমায় ছেড়ে দাও। ঘোড়ায় চড়ে এক্ষুণি শোবক অভিমুখে রওনা হও। শোবক এখান থেকে বেশী দূরে নয়; তুমি একাই যেতে পারবে। সঙ্গীদের দিকে যেও না। ওখানে বোধ হয় একজনও জীবিত নেই। যাও, আল্লাহ তোমায় নিরাপদে পৌঁছিয়ে দিন।
আপনার জখম কোথায় কোথায়, দেখি? বলল মেয়েটি।
আমায় মরতে দাও মেয়ে! আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে তুমি রওনা হও। আল্লাহর দিকে চেয়ে আমার দায়িত্বটা তুমি নিজেই পালন করে নাও। তোমাকে শোবক পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়া ছিল আমার দায়িত্ব। কিন্তু আমি আর বাঁচব না। অপর কোন দস্যু-তস্কর এদিকে এসে পড়তে পারে। তার আগেই তুমি এ স্থান ত্যাগ কর।
হাদীদের ব্যাপারে মেয়ের মনে এখন আর কোন সন্দেহ নেই। সব সংশয়, ভুল বুঝাবুঝি দূর হয়েছে তার। মেয়েটি বুঝে ফেলেছে, তাদের ব্যাপারে হাদীদ ও তার সঙ্গীদের কোন কুমতলব বা দুরভিসন্ধি ছিল না। তার জীবন ও ইজ্জত রক্ষার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দস্যুদলের মোকাবেলা করেছেন তিনি।
আহত হাদীদকে এই জনমানবহীন মরুভূমিতে একাকী ফেলে যেতে স্পষ্ট অস্বীকার করে মেয়েটি। দৌড়ে গিয়ে ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বাঁধা পানির মশক খুলে নিয়ে এসে হাদীদকে পানি পান করায়, নিজের পরিধানের কাপড় এবং হাদীদের পোষাক ছিঁড়ে কিছু কাপড় নিয়ে জখমে পট্টি বাঁধে। গোয়েন্দা মেয়ের প্রশিক্ষণ আছে এ কাজে।
মেয়েটি হাদীদকে ধরে দাঁড় করিয়ে একটি ঘোড়ার কাছে নিয়ে যায়। বড় কষ্টে তাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে বসিয়ে দিয়ে নিজে অন্য ঘোড়ায় চড়তে যায়। কিন্তু হাদীদ ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, আমি একা ঘোড়ায় বসে থাকতে পারব না। সেই শক্তি আমার নেই।
ঘোড়া ছিল তিনটি। একটি ঘোড়াও যাতে খোয়াতে না হয়, তার জন্য বুদ্ধি করে মেয়েটি দুটি ঘোড়ার বাগ অপর ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বেঁধে নেয়। নিজে হাদীদের পিছনে চড়ে বসে। হাদীদের পিঠ নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে তার মাথা নিজের কাঁধের উপর রেখে রওনার জন্য প্রস্তুতি নেয় সে।
শোবক কোন্ দিকে বলতে পারেন? হাদীদকে জিজ্ঞেস করে মেয়েটি।
হাদীদ মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকান। নক্ষত্র দেখে এবং একদিকে ইংগিত করে বলেন, ওদিকে চল।।
ঘোড়া ছুটায় মেয়ে। ধীর গতিতে এগিয়ে চলছে তিনটি ঘোড়া। খানিক অগ্রসর হওয়ার পর হাদীদ বললেন, আমি বোধ হয় বাঁচব না। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছে। যেখানে আমার মৃত্যু হবে, সেখানেই আমাকে কবর দিও। আমার ব্যাপারে তোমার মনে কোন সন্দেহ থাকলে, তা মন থেকে দূর করে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি আমানতে খেয়ানত করিনি। দুআ করি, আল্লাহ তোমাকে নিরাপদে জীবিত গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দিন।
এগিয়ে চলছে ঘোড়া। কেটে যাচ্ছে রাত।
***
পরদিন ভোর বেলা। মেয়েটির কাঁধে মাথা আর বুকে পিঠ ঠেকিয়ে অর্ধ-অচেতন অবস্থায় বসে আছেন হাদীদ। নিজেকে সচেতন রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন তিনি। তার জখমের রক্তক্ষরণ এখন বন্ধ। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে অসাড় হয়ে পড়েছে তার দেহ।
ছোট্ট একটি খেজুর বাগানে এসে ঘোড়া থামায় মেয়েটি। হাদীদকে আলগোছে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামায়। পানি পান করায়। ঘোড়াগুলোর সঙ্গে বাঁধা ছিল কিছু খাবার। হাদীদকে খাওয়ায় সেগুলো। হাদীদের আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে যায়। মস্তিষ্ক পরিষ্কার হতে শুরু করে। হাদীদ ভাবেন, ছিলাম মেয়েটির রক্ষী, এখন হয়েছি তার বন্দী।
মেয়েটি শুইয়ে দেয় হাদীদকে। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর সুস্থতা অনুভব করে সে। ধীরে ধীরে চাঙ্গা হয়ে উঠে তার দেহ। মেয়েটিকে বলেন, শোবক আর বেশী দূরে নয়। বোধ হয় আর একদিনের পথ হবে। একটি ঘোড়া নিয়ে তুমি চলে যাও, আমি ফিরে যাই।
জীবন নিয়ে তুমি গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে না। এখান থেকেই যদি ফিরে যেতে হয়, তাহলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে চল। তুমি যেমন আমাকে একাকী ফেলে আসনি, আমিও তোমাকে একলা ছেড়ে যাব না। বলল মেয়েটি।
আমি পুরুষ। একজন নারী আমাকে হেফাজত করবে, আমার মন তা মানছে না। তার চেয়ে বরং আমার মরে যাওয়াই শ্রেয়। বললেন হাদীদ।
যারা ঘরের চার দেয়ালে আবদ্ধ থাকে, যারা পুরুষের সহযোগিতা ছাড়া এক পা ও চলতে পারে না, আমি তেমন মেয়ে নই। আমাকে একজন সৈনিক-ই মনে কর। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, আমার অস্ত্র তীর-তরবারী নয়। আমার অস্ত্র হল, আমার রূপ যৌবন, আমার নারীত্ব, আমার বাকপটুতা। তোমার মত আমিও কষ্ট সহ্য করতে অভ্যস্ত। এখান থেকে পায়ে হেঁটে আমি শোবক যেতে পারি। বলল মেয়েটি।
আমি তোমার আবেগের মূল্যায়ন করি। দস্যুরা আমাদের দুজনকে পরস্পর কত কাছে এনে দিয়েছে! অথচ, আমরা একে অপরের দুশমন। তুমি আমার দেশের ভিত উপড়ে ফেলার চেষ্টা করছ, আর আমি একদিন তোমার দেশ আক্রমণের স্বপ্নে বিভোর। বললেন হাদীদ।
কিন্তু এ মুহূর্তে আমার বন্ধুত্ব বরণ করে নাও। দুশমনির কথা তখন ভাববে, যখন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে তুমি নিজের দেশে ফিরে যাবে। বলল মেয়ে।
মেয়েটি হাদীদের বাহু ধরে শোওয়া থেকে উঠিয়ে বসায়। হাদীদ নিজ শক্তিতে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে হেঁটে ঘোড়ার কাছে পৌঁছে সে। মেয়েটি ধরে হাদীদকে ঘোড়ার রেকাবে তুলে দেয়। ঘোড়ার পিঠে উঠিয়ে বসায় তাকে। হাদীদকে বসিয়ে মেয়েটি নিজেও একই ঘোড়ায় চড়তে চায়। বাধা দেন হাদীদ। বলেন, তুমি অন্য ঘোড়ায় উঠ। আমি এখন একাই চলতে পারব।
তবু আমি এ ঘোড়ায়-ই বসব। তোমাকে জড়িয়ে রাখব আমার গায়ের সাথে। দৃঢ়কণ্ঠে বলল মেয়ে।
হাদীদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও মেয়েটি তার ঘোড়ার পিছনে চড়ে বসে। নিজের এক বাহু হাদীদের বুকে রেখে হাদীদকে নিজের গায়ের সাথে জড়িয়ে রাখার চেষ্টা করে। আপত্তি জানায় হাদীদ। বলে, আমাকে একটু নিজের শক্তিতে বসতে দাও।
হাদীদের আপত্তিতে কান দেয় না মেয়ে। জোর করে হাদীদকে নিজের বুকের সঙ্গে লাগিয়ে নেয় সে। নিজের কাঁধের উপর টেনে আনে হাদীদের মাথা। তারপর বলে, আমি জানি, খারাপ মেয়ে মনে করে তুমি আমার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছ।
না, খারাপ মেয়ে মনে করে নয়- শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে আমি তোমার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছি। দুটি রাত নিতান্ত অসহায় অবস্থায় তুমি আমার বন্দীনী ছিলে। ইচ্ছে করলে আমি তোমাকে দাসীর মত ব্যবহার করতে পারতাম। কিন্তু আমি শয়তানকে আমার উপর জয়ী হতে দেইনি। এখন আমার মনে হচ্ছে, যেন আমি আমানতে খেয়ানত করছি। আমার মধ্যে পাপবোধ জাগ্রত হচ্ছে।
তুমি পাথর তো আর নও। আমাকে যখনই যে পুরুষ দেখেছে, কামনার চোখেই দেখেছে। সামান্য মূল্যের বিনিময়ে আমি তোমার জাতির দুজন মুমিনের ঈমান কিনে নিয়ে এসেছি।
কত মূল্য? জিজ্ঞেস করে হাদীদ।
শুধু এতটুকু যে, তাদেরকে আমার কাছে বসতে দিয়েছি, আমার কাঁধে তাদের মাথা রেখেছি। জবাব দেয় মেয়ে।
ঈমান ছিল-ই না তাদের কাছে। বলল হাদীদ।
যতটুকু ছিল, তাই আমি নিয়ে এসেছি। তার স্থলে তাদের অন্তরে স্বজাতির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছি।
তারা কারা? জানতে চায় হাদীদ।
এখন বলব না। তোমার অর্পিত দায়িত্বের প্রতি তুমি যেমন নিষ্ঠাবান, তেমনি আমার কর্তব্যও আমার কাছে ততটুকু প্রিয়। জবাব দেয় মেয়েটি।
কথা বলা বন্ধ করে হাদীদ। যুবতীর দেহের উষ্ণতা, হালকা ঘ্রাণ অনুভব করছে সে। তরুণীর উন্মুক্ত রেশম-কোশল চুল বাতাসে উড়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে হাদীদের গাল-মুখ।
তন্দ্রা পায় হাদীদের। ঝিমিয়ে পড়ে সে। এগিয়ে চলছে ঘোড়া। বেশ কিছু পথ অতিক্রম করার পর চোখ খুলে হাদীদ। সূর্য তখন মাথার উপরে উঠে এসেছে। হাদীদ বলে, ঘোড়ার গতি বাড়াও। আশা করি, সূর্যাস্তের পরপর আমরা শোবক পৌঁছে যেতে পারব।
ঘোড়ার গতি বাড়ায় মেয়ে। তীব্রগতিতে পিছনে সরে যাচ্ছে মরুপ্রান্তর।
***
সূর্য ডুবে গেছে। শোবকের সভাকক্ষে খৃষ্টান সম্রাট ও কমান্ডারগণ উপবিষ্ট। আলেম গোয়েন্দাও তথায় উপস্থিত। কর্মকর্তাদের নিকট রিপোর্ট পেশ করছে সে।
মেয়ে দুটোর পরিণতি কি হয়েছে, তা আমি বলতে পারছি না। ওদের রক্ষা করা তো দূরে থাক, আমি ওদেরকে এক নজর দেখে আসারও চেষ্টা করিনি। কারণ, মিসর থেকে আমি যে তথ্য নিয়ে এসেছি, তা মেয়ে দুটোর চেয়েও বহু বহু মূল্যবান। আপনাদের নিকট সে তথ্য পৌঁছানোর জন্য ডাকাতদের আক্রমণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক সুযোগে ঘোড়ায় চড়ে আমি পালিয়ে এসেছি। আইউবীর বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাওয়া ছিল আমার এক বিস্ময়কর ঘটনা। তাই ডাকাতদের রক্তক্ষয়ী হামলা থেকে আমি নিরাপদে সরে এলাম, কেউ-ই আমাকে ধাওয়া পর্যন্ত করল না।
আমার মনে হয়, ওরা আসলে দস্যু নয়। আইউবী-ই দস্যুবেশে ওদেরকে আমাদের উপর লেলিয়ে দিয়েছেন। ঘটনাটি একটি সাজানো নাটক। সালাহুদ্দীন আইউবী আমাদের তিনজনকে মৃত্যুদন্ড কেন যে দিলেন না, কেন যে মেয়েদের নষ্ট করার জন্য তিনি এই পন্থা অবলম্বন করলেন, আমার তা মাথায় ধরছে না। মেয়েগুলো এখন বোধ হয় ওদের আয়ত্ত্বে চলে গেছে এবং অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করছে! বলল আলেম গোয়েন্দা।
ওদের মুক্তির কথা ভাববার সময় আমাদের নেই। দুটো মেয়ে হারিয়েছি, তাতে তেমন কিছু হয়নি। বৃহত্তর স্বার্থে এরূপ ত্যাগ দিতেই হয়। আমাদের কাছে মেয়ের অভাব নেই। এ পদ্ধতি আমাদের সফল। এই ধারা চালু রাখার জন্য আরো মেয়ে প্রস্তুত কর। সভাসদদের সকলেই এসে গেছেন, এবার বলুন, আপনি কী তথ্য নিয়ে এসেছেন। বলল এক কর্মকর্তা।
কায়রোর এক মসজিদে সালাহুদ্দীন আইউবী ও আলী বিন সুফিয়ানের হাতে কিভাবে বন্দী হল, কয়েদখানায় তার ও মেয়েদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হল এবং সুলতান আইউবী কিভাবে তাদের অপ্রত্যাশিতভাবে মুক্তি দিলেন, আলেম গোয়েন্দা সভাসদদের সামনে সব বিবরণ তুলে ধরে। এ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আইউবী তাকে কিভাবে দিলেন, তাও শোনায়। দিন-তারিখ উল্লেখ করে আলেম গোয়েন্দা জানায়, সালাহুদ্দীন আইউবী এ-দিন কার্ক আক্রমণের জন্য বাহিনী প্রেরণ করবেন। তার এ ঘোষণা শুনে এক সভাসদ বলল, কার্ক নয়- আগে আমাদের শোবক দখল করা প্রয়োজন। কারণ, কার্কের তুলনায় শোবক অধিক শক্তিশালী দুর্গ। কিন্তু আইউবী শোবকে তার শক্তি ব্যয় করতে চাইছেন না। দুর্বল মনে করে তিনি কার্ক দখল করতে চান আগে। তার কথা হল, আগে কার্ক দখল করে তাকে তিনি সৈন্য ও রসদ ইত্যাদির কেন্দ্র বানাবেন। পর্যাপ্ত রসদ সংগ্রহ করে বিশেষ ফোর্স তলব করবেন। তারপর সৈন্যদের কিছুদিন বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে শোবকে হামলা চালাবেন।
তিনি আমাদের অজ্ঞাতে অতর্কিতে আক্রমণ চালাতে চান। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তার সৈন্য কম। পক্ষান্তরে আমাদের সৈন্যও বেশী এবং আমাদের ঘোড়াও তার ঘোড়া অপেক্ষা উন্নত। তাছাড়া আমাদের আছে বর্ম, আছে শিরস্ত্রাণ, যা তার নেই। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, খৃষ্টান সৈন্যরা যদি আমাদেরকে পথেই প্রতিহত করে ফেলে, তাহলে পরাজয় ছাড়া আমাদের উপায় থাকবে না। তিনি খোলা মাঠে যুদ্ধ করতে ভয় পান।
সুলতান আইউবীর মুখ থেকে শোনা সব কথা আনুপুংখ বিবৃত করে আলেম গোয়েন্দা।
এমন মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও তার বিস্তারিত বিবরণ শুনে সবাই ভুলে গেল মেয়েদের কথা। এ বিষয়ে মত বিনিময় শুরু হল। দীর্ঘ আলোচনার পর সভা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, সুলতান আইউবী একজন অসাধারণ বিচক্ষণ যোদ্ধা। কার্ক আক্রমণের যে পরিকল্পনা তিনি প্রস্তুত করেছেন, তাতেই তার সামরিক দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। পথে লড়াই এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্তও তার বিচক্ষণতার এক জ্বলন্ত প্রমাণ। আমাদের প্রতি যীশু খৃষ্টের অপার অনুগ্রহ আছে বলেই আমরা আগেভাগে এ পরিকল্পনার খবর পেয়ে গেছি। অন্যথায় আইউবী শুধু কার্ক-ই নয়- শোবকের মত শক্ত দুর্গের জন্যও আশংকার কারণ হয়ে দেখা দিত।
সালাহুদ্দীন আইউবীর পরিকল্পনা মোতাবেক তখনই তাদের সেনা তৎপরতা ও প্রতিরোধ আয়োজন শুরু হয়ে যায়। পরিকল্পনায় নিম্নরূপ সিদ্ধান্তগুলি গৃহীত হয়
সম্মিলিত খৃষ্টান বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ড থাকবে শোবকে। রসদও থাকবে এখানে। শোবক থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কার্ক দুর্গকে আরো দুর্ভেদ্য করে তোলা হবে। শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য কার্কে আরো কিছু সৈন্য পাঠান হবে।
আইউবীকে কার্ক থেকে দূরে তারই সীমান্তের ভিতরে কোন এক দুর্গম পার্বত্য এলাকায় প্রতিরোধ করা হবে। এ লক্ষ্যে বিপুলসংখ্যক সৈন্য প্রেরণ করা হবে। এই বাহিনীতে বেশী থাকবে অশ্বারোহী ও উজ্জ্বারোহী সৈন্য। আইউবীর বাহিনীকে অবরুদ্ধ করে ফেলার চেষ্টা করতে হবে। পানির ঝর্ণাগুলো কজা করতে হবে আগেই।
পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ শুরু করার নির্দেশ জারী করা হয়। সবাই ভীষণ আনন্দিত। এই প্রথমবার তারা সময়মত সুলতান আইউবীর গোপন পরিকল্পনার কথা জানতে পারল। অন্যথায় সবসময়ই তিনি ক্রুসেডারদের ফাঁকি দিয়ে-ই অভিযান পরিচালনা করে থাকেন।
খৃষ্টান সেনাপতিগণ বিস্ময় প্রকাশ করে বলে যে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ন্যায় দূরদর্শী সিপাহসালারের থেকে এই পদস্খলন ঘটল, যে শত্ৰু গোয়েন্দাদের তিনি মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদেরকে পাশের কক্ষে বসিয়ে উচ্চস্বরে এমন একটি নাজুক বিষয় নিয়ে কথা বললেন! সেনাপ্রধান তার ফ্রান্সের সৈন্যদের কাছেও এ পয়গাম প্রেরণ করে যে, অমুক দিনের আগেই তোমরা এমন জায়গায় পৌঁছে যাবে, যেখানে নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিশেষ বাহিনীকে প্রতিরোধ করা যায়।
এ সময়ে কক্ষে প্রবেশ করে এক খৃষ্টান অফিসার। গোয়েন্দা প্রধানের কানে কানে কি যেন বলে। গোয়েন্দা প্রধান সকলকে জানায়, ডাকাতের হাতে আক্রান্ত মেয়ে– দুটোর একজন এইমাত্র এসে পৌঁছেছে। সাথে তার এক আহত মুসলিম রক্ষীসেনা।
আলেম গোয়েন্দা সকলের আগে কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়ে। তার পিছনে অন্যরাও বাইরে আসে। আহত হাদীদকে বারান্দায় শুইয়ে রেখে তার মাথার কাছে বসে আছে মেয়েটি। দীর্ঘ ভ্রমণের ফলে পট্টি-ব্যান্ডেজ খুলে গিয়ে ক্ষতস্থান থেকে আবার রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে হাদীদের। বিছানায় অচেতন পড়ে আছে সে।
খৃষ্টান সেনাপতিদের কেউ হাদীদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করল না। কারণ, তাদেরকে আগেই বলা হয়েছিল যে, ডাকাতদের আক্রমণ ছিল সাজানো নাটক। আইউবী-ই এ আক্রমণের মূল নায়ক।
আলেম গোয়েন্দা মেয়েটির হাত ধরে তাকে কক্ষের ভিতরে চলে আসতে বলে। খৃষ্টানদের বড় মূল্যবান মেয়ে ও। কিন্তু হাদীদের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ-চিকিৎসা না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে এক চুল নড়বে না বলে জানিয়ে দেয় সে।
গোয়েন্দা প্রধান হরমুন মেয়েটিকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কানে কানে বলে, কোন্ সাপের বাচ্চাকে তুমি ব্যান্ডেজ করাতে চাইছ? ভাগ্য প্রসন্ন ছিল বলেই না তুমি জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছ। অন্যথায় এরা তো তোমাদেরকে ডাকাতরূপী হায়েনাদের হাতে তুলে দিতেই চাইছিল!
এ তথ্য মিথ্যা। প্রথমে আমারও এ সন্দেহ ছিল। এ লোকটি আমার মনের সব সন্দেহ মুছে দিয়েছে। দু ডাকাতকে খুন করে সে আমার জীবন রক্ষা করেছে। কাঁদ কাঁদ কণ্ঠে বলল মেয়েটি।
মেয়েটি হরমুনকে সব ঘটনা খুলে বলে। শেষে একথাও জানায় যে, লোকটি আমাকে বারবার বলছিল, আমাকে এখানে মরতে দাও আর তুমি শোবক চলে যাও।
খৃষ্টানদের চোখে মুসলমান মানেই এক চরম ঘৃণ্য জাতি। মুসলমান হওয়ার কারণে হাদীদও ঘৃণার পাত্র। তাই এতগুলো অফিসার-সেনাপতির মধ্যে একজনও বলল না যে, লোকটির চিকিৎসার ব্যবস্থা কর।
জিদ ধরে বসে আছে মেয়েটি। অবশেষে একজন অফিসার বলল, লোকটিকে কক্ষে নিয়ে গিয়ে ব্যান্ডেজ করার ব্যবস্থা কর।
হাদীদকে তুলে কক্ষে নিয়ে যাওয়া হল। মেয়েটি চাপের মুখে অফিসারদের সঙ্গে চলে গেল।
মেয়েকে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল অফিসাররা। তার জীবিত ফিরে আসার কাহিনী জানতে চায় তারা। সব ঘটনা খুলে বলে সে।
মেয়ের জন্য খাদ্য ও শরাব এসে যায়। আহার সেরে নিতে বলে অফিসাররা।
জখমীকে খাইয়ে থাকলেই তবে আমি খাব। অন্যথায় আমি খাবার স্পর্শ করব না। আমি তাকে একটু দেখে আসি। বলেই মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়।
থাম লুজিনা! এই দ্বিতীয়বার ক্রুশের সামরিক নীতির বিরুদ্ধাচারণ করছ তুমি! প্রথমবার তোমাকে কক্ষে প্রবেশ করতে বলা হয়েছিল আর তুমি সেই নির্দেশ অমান্য করে বলেছিলে, আগে জখমীকে ব্যান্ডেজ করা হোক, তারপর আমি কক্ষে যাব। এবার তুমি বিনা অনুমতিতে অভদ্রের ন্যায় বাইরে যেতে পা বাড়িয়েছ! তোমার সম্মুখে যারা উপবিষ্ট, তারা সবাই খৃষ্টান বাহিনীর পদস্থ অফিসার। দুজন সম্রাটও বসা আছেন এখানে। জান, তোমার এ অপরাধের শাস্তি কি? দশ বছরের কারাদন্ড। আর যেহেতু তুমি এ আইন লংঘন করছ শত্রু বাহিনীর একজন সাধারণ সৈনিকের খাতিরে, তাই আমরা তোমাকে মৃত্যুদন্ডের শাস্তিও দিতে পারি। অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বলল গোয়েন্দা প্রধান হরমুন।
যে লোকটি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একজন অভিজ্ঞ খৃষ্টান গোয়েন্দা মেয়ের জীবন রক্ষা করল, খৃষ্টান সম্রাট ও সেনাপতিগণ কি তাকে এর কোন প্রতিদান দেবেন না? আমি জানি, ও আমাদের শত্রু শিবিরের একজন সেনা কমান্ডার। কিন্তু আমি তাকে দুশমন ভাবব তখন, যখন সে নিজ বাহিনীতে ফিরে যাবে। বলল লুজিনা।
শত্রু সর্বাবস্থায় এবং সব জায়গায়-ই শত্রু। ফিলিস্তীনে কজন মুসলমানকে আমরা জীবিত থাকতে দিয়েছি? কেনই বা আমরা তাদের বংশধারা নিঃশেষ করছি? কারণ, ওরা আমাদের শত্রু, আমাদের ধর্মের দুশমন। ক্রুশ ছাড়া আর কোন প্রতীক আমরা পৃথিবীতে রাখব না। আমাদের কাছে একজন আহত মুসলমানের কোনই মূল্য নেই। বস তুমি! চীৎকার করে বলল এক কমান্ডার।
লুজিনা বসে পড়ে। বেদনার অশ্রুতে দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার।
***
পরদিন সকাল থেকে সোবকে নতুন এক তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। এ তৎপরতা সামরিক। শোবকের বেসামরিক জনগণ আপন আপন কাজে লিপ্ত। এ তৎপরতার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। দুর্গ থেকে সারি সারি সৈন্য বের হচ্ছে। সামান-পত্র এদিক-ওদিক করা হচ্ছে। বহিরাগত সৈন্যদের সাময়িক তাঁবুর জন্য জায়গা খালি করা হচ্ছে। রসদ পরিবহনের জন্য উটের বহর দাঁড়িয়ে আছে। সেনা হেডকোয়ার্টারেও তৎপরতার অন্ত নেই। সালাহুদ্দীন আইউবীর আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে গতরাতে যে পরিকল্পনা ঠিক করা হয়েছিল, তারই অংশ হিসেবে এ ব্যস্ততা। অফিসারদেরও এক দন্ড দাঁড়াবার ফোরসত নেই। উঁচু পর্যায়ের কয়েকজন অফিসার রওনা হয়ে গেছে কার্ক অভিমুখে।
মাত্র একটি মেয়ে এ তৎপরতায় সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত। লুজিনা। যে হাদীদকে সঙ্গে করে শোবকে নিয়ে এসেছিল, সেই মেয়ে।
গত রাতে সভাকক্ষ থেকে যখন সে ছুটি পায়, তখন মধ্য রাত। গোয়েন্দা বিভাগের বিশেষ শাখার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যা বলে পূর্বেকার অভিযানের রিপোর্ট পেশ করতে হয়েছে তাকে রাতভর।
দীর্ঘ পথ অশ্ব চালনার ক্লান্তি ও অনিদ্রায় এখন অসাড় হয়ে পড়েছে তার দেহ। একজন অফিসার তাকে বলেছিল, তোমার আহত মুসলিম ফৌজিকে ডাক্তারের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। ওর জন্য তোমার এত অস্থির হওয়া ঠিক হচ্ছে না। এরূপ আবেগ-প্রবণতা তোমার কর্তব্যের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
গোয়েন্দা প্রধান হরমুন লুজিনাকে বলেছিল, এ রাতে না হলে কনরাড এবং গাই অফ লুজিনান এর মত সম্রাট- যারা কাউকে ক্ষমা করতে জানেন না তোমাকে বন্দীশালায় নিক্ষেপ করতেন। তোমার মুসলিম রক্ষীর যা করার করা হয়েছে। তোমার জন্য নির্দেশ, তার সঙ্গে তুমি সাক্ষাৎ করতে পারবে না।
কেন? আমি কি তার কৃতজ্ঞতাও আদায় করতে পারব না? বিস্ময় ও নিরাশার সুরে বলল লুজিনা।
না। কারণ সে দুশমনের ফৌজি। তুমি যে বিভাগে চাকুরী কর, জান তো তা কি? আমি তোমাকে ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দিতে পারি না। তোমার বিদ্যা ও কর্তব্যের দাবীও তা-ই। আমি এ-ও লক্ষ্য করছি যে, তার প্রতি তুমি আসক্ত হয়ে পড়েছ। এটা ভাল লক্ষণ নয়। শত্রুর সঙ্গে এমন সম্পর্ক স্থাপনের অনুমতি দেয়া যায় না লুজিনা। হরমুনের কণ্ঠে দৃঢ়তা।
আপনি আমাকে শুধু এতটুকু নিশ্চয়তা দিন যে, তার ক্ষতে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে আর নিরাপদে তাকে ফেরত পাঠান হবে। বলল লুজিনা।
লুজিনা! আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, তোমার এ আকাংখা পূরণ করা হবে। আর শোন, তুমি বড় কঠিন ভয়ানক মিশন থেকে ফিরে এসেছ, তোমার সফরও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তোমাকে দশদিনের ছুটি দেয়া হল। পরিপূর্ণ বিশ্রাম নাও। ঝঝ মেশানো কণ্ঠে বলল হরমুন।
.
রাতে এসব কথাবার্তার পর লুজিনা তার কক্ষে চলে যায়। গোয়েন্দা মেয়েদের আবাস হাইকমাণ্ড থেকে অনেক দূরে। কিন্তু লুজিনার মত উচ্চ পর্যায়ের গোয়েন্দা মেয়েরা থাকে বেশ উন্নত কক্ষে, রাজকীয় হালে। রাজকন্যাদের ন্যায় সুযোগ সুবিধা ও বিলাস উপকরণ পায় তারা। দায়িত্ব তাদের যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, সুযোগ সুবিধা তেমনি উন্নত।
কক্ষে গিয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় লুজিনা। মুহূর্ত মধ্যে দু চোখের পাতা বুজে আসে তার। গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে সে।
পরদিন বেশ বেলা হলে চোখ খোলে লুজিনার। কিন্তু বিছানা থেকে শরীর টেনে তুলতে পারছে না সে। ভেঙ্গে আসছে তার সারা শরীর। উঠে বসার শক্তিটুকুও পাচ্ছে না সে।
বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে অবশেষে উঠে দাঁড়ায় লুজিনা। নাস্তা করে বাইরে বের হওয়ার প্রস্তুতি নেয়। ইতিমধ্যে পাশের কক্ষের মেয়েরা এসে কায়রোর কারগুজারী শুনতে চায় তার কাছে। কথা বলতে মন চাচ্ছে না লুজিনার। সংক্ষেপে দু চারটা কথা শুনিয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরে হবে বলে হাসপাতাল অভিমুখে ছুটে যায়।
***
একটু এগুতেই এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হয় লুজিনার। গোয়েন্দা বিভাগেই চাকুরী করে মেয়েটি। লুজিনার সহকর্মী। দুজনের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। নিজের মনের কথা অপরজনের কাছে গোপন রাখে না দুজনের কেউ।
মুখোমুখি হয় দু বান্ধবী। কিছুক্ষণ মুখপানে তাকিয়ে থেকে লুজিনার বান্ধবী জিজ্ঞেস করে, যাচ্ছ কোথায়, লুজি? তোমাকে খুব অস্থির মনে হচ্ছে। কোন অঘটন ঘটেছে, নাকি দীর্ঘ সফরের ক্লান্তির কারণে এমনটি হল? ছুটি পাওনি বুঝি?
ছুটি পেয়েছি বটে, তবে বিশেষ একটি ঘটনা আমাকে অস্থির করে তুলেছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল লুজিনা।
বান্ধবীর হাত ধরে একটি গাছের ছায়ায় গিয়ে বসে লুজিনা। বান্ধবীকে ঘটনা বিস্তারিত শুনিয়ে মনের বোঝা হালকা করার চেষ্টা করে। অফিসাররা তাকে যে ধমক দিয়েছে, বান্ধবীকে তাও শুনিয়ে লুজিনা বলল, আমি হাদীদকে এক নজর দেখতে চাই। আমার আশংকা, ওর কোন চিকিৎসা হয়নি এবং ওকে নির্দয়ভাবে নগর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে কিংবা মৃত্যুর জন্য কোন এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটকে রাখা হয়েছে।
তুমি বললে, তোমাকে না ওর সঙ্গে দেখা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। অফিসারদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এ ঝুঁকি নিওনা বোন! ধরা পড়লে জান তো শাস্তি কি! লুজিনাকে নিরস্ত হওয়ার পরামর্শ দেয় বান্ধবী।
লোকটির জন্য মৃত্যুদন্ডও মাথা পেতে নিতে আমি প্রস্তুত। আমার খাতিরে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেছে সে, তা তোমাকে বলেছি। ডাকাতদের হাতে আমার জীবনের কোন ভয় ছিল না। আমাকে ওরা তুলে নিয়ে যেত। কিছুদিন ভোগ করে নষ্ট করে কোন আমীরের হাতে বিক্রি করে দিত। হাদীদ আমার এই পরিণতির কথা জানত। আমার ইজ্জতের খাতিরে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে ডাকাতদের সঙ্গে লড়াই করেছে। ডাকাতরা তাকে বলেছিল পর্যন্ত, মেয়েটিকে আমাদের হাতে তুলে দাও, আর তুমি নিজে নিরাপদে চলে যাও। হাদীদ এ-ও তো জানত যে, আমি পবিত্র মেয়ে নই। কিন্তু তারপরও তার বিবেচনায় আমি ছিলাম তার আমানত। এ আমানতকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশী মূল্য দিয়েছে সে।
লোকটির জন্য তুমি বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছ লুজি!
হ্যাঁ। হরমুনের সামনে আমি আমার আবেগ প্রকাশ করতে পারিনি। কিন্তু তোমার কাছে তো আমি মনের সব কথা খুলে বলতে পারি। তুমি আমার বান্ধবী। আমার-ই মত একজন নারী। নারীর হৃদয় বহন কর তুমি। আচ্ছা বল তো, আমাদের জীবনটা কি? আমরা সুদর্শন খঞ্জর। মধুর বিষ। আমাদের দেহ ব্যবহৃত হয় পুরুষের বিনোদ সামগ্রী আর প্রতারণার ফাঁদ হিসেবে। এ-ই কি আমাদের জীবনের মূল্য? এমন কথা আমি আগে কখনো ভাবিনি। আমার মধ্যে কোন আবেগ-আসক্তি আছে বলেও মনে করিনি কখনো। কিন্তু এ লোকটির দেহের পরশ আমার ঘুমন্ত সব আবেগ-স্পৃহা জাগিয়ে তুলেছে। আমি এখন নিজেকে যুগপৎ মা-বোন-কন্যা এবং একজন পুরুষপ্রার্থী নারী বলে কল্পনা করছি। আবেগঝরা কণ্ঠে বলল লুজিনা।
এক নাগাড়ে এতগুলো কথা বলার পরও বলা শেষ হয় না লুজিনার। আবার বলতে শুরু করে সে
আমাকে সন্ত্রাসের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আমি নাশকতামূলক কাজে এত দক্ষতা অর্জন করেছি যে, আমি যে কোন স্বৈরশাসককে আঙ্গুলের উপর নাচাতে পারি। কিন্তু ডাকাতরা আমাকে বিক্রয়ের পণ্যে পরিণত করেছে। আমাকে তারা এমন এক স্তরে নামিয়ে এনেছে, যেখানে আমার মত মেয়েরা প্রতি রাতে নিত্য নতুন খদ্দেরের হাতে বিক্রি যায় কিংবা কোন মুসলমান আমীর বা শাসকের হেরেমের দাসীতে পরিণত হয়। হাদীদ আমাকে সেখান থেকে উপরে তুলে এনেছে। ডাকাতদের হাতে পড়ার আগে আমি তার বন্দীনী ছিলাম। ইচ্ছে করলে সে আমাকে তার বিনোদ উপকরণে পরিণত করতে পারত। কিন্তু তা সে করেনি। তারপর যখন লোকটি আমার ইজ্জত রক্ষা করার জন্য নিজের দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করল, তখন আমি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি; জড়িয়ে নিই তাকে নিজের বুকের সঙ্গে।
সালাহুদ্দীন আইউবীর একটি কথা আমার মনে পড়ে যায়। তিনি আমায় বলেছিলেন, তুমি কোন সম্ভ্রান্ত পুরুষের স্ত্রী হয়ে মর্যাদার সাথে জীবন কাটাতে পার না? তখন লোকটিকে আমার কাছে বোকা মনে হয়েছিল। মনে মনে বলেছিলাম, নিতান্ত বেওকুফ ছাড়া এমন কথা বলে নাকি কেউ! কিন্তু এখন অনুভব করছি, তিনি কত মূল্যবান কথা বলেছিলেন।
শোন সখী! আমি তোমায় পরিষ্কার বলে দিচ্ছি, গুপ্তচরবৃত্তি করা আর আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। শৈশব থেকে যে প্রশিক্ষণ আমাকে দেয়া হয়েছিল, তার সব আমি হারিয়ে ফেলেছি। মরুভূমির সেই ভয়ানক রাত, দস্যুর ভয় আর হাদীদের দেহের উষ্ণ পরশ ও তার রক্তের ঘ্রাণ আমার ভিতর থেকে সব বিদ্যা ধুয়ে মুছে ছাফ করে দিয়েছে।
লুজিনার অবলীলায় বলে যাওয়া কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনে তার বান্ধবী। লুজিনা থামলে এবার মুখ খুলে সে। বলে
এতগুলো কথা না বললেও তমার মনের অবস্থা বুঝতে আমার অসুবিধা হত না। কিন্তু বাস্তবকে তো আর অস্বীকার করা যায় না লুজি! যার জন্য তোমার এত ব্যাকুলতা, এখান থেকে একদিন তাকে চলে যেতেই হবে। আর তুমিও পারবে না তার সঙ্গে যেতে। এ সময়ে যদি সে এখানে কষ্টেও থাকে, তবু উপরের নিষেধাজ্ঞার কারণে তুমি তো তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারছ না। চেষ্টা করতে পার, কিন্তু ধরা পড়লে তোমার সঙ্গে তাকেও জীবন হারাতে হবে। অতএব, এসব চিন্তা ত্যাগ করে তুমি শান্ত হও।
তুমি আমাকে একটু সাহায্য কর বোন! এতটুকু খবর নাও যে, লোকটি কোথায় আছে। হাদীদ সুস্থ হয়ে আপন গন্তব্যে চলে গেছে, এটুকু জানতে পারলেই আমার মন শান্তি পাবে। এটুকু উপকার তুমি আমার কর বোন! মিনতির সুরে বলল লুজিনা।
ঠিক আছে, এ কাজ আমি করতে পারব। তুমি শান্ত হও। কক্ষে চলে যাও, আরাম কর। বলল বান্ধবী।
লুজিনা তার কক্ষে চলে যায়। বান্ধবী চলে যায় অন্যদিকে।
***
কায়রোতে চলছে ব্যাপক সেনা তৎপরতা। সৈন্যদের সামরিক মহড়া চলছে। অতর্কিত আক্রমণ, অল্প কজনে দুশমনের বিপুল সৈন্যের উপর হামলা চালিয়ে শত্রুর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে কমান্ডো বাহিনী। আক্রমণ করে চোখের পলকে হাওয়া হয়ে যাওয়ার ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে তাদের। রাতের বেলাও ছাউনিতে অবস্থান নেয়ার সময় পাচ্ছে না তারা; থাকতে হচ্ছে ছাউনির বাইরে।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী নিজে মহড়ার তদারকি করছেন। তিন-চার দিন পরপর তিনি উচ্চপদস্ত অফিসার ও গ্রুপ কমান্ডারদের উদ্দেশে বক্তৃতা করছেন এবং মানচিত্রের সাহায্যে তাদের রণকৌশল শিক্ষা দিচ্ছেন।
তার এ প্রশিক্ষণের মূলনীতি হল, স্বল্পসংখ্যক সৈন্যের পক্ষে দুশমনের ব্যাপক ক্ষতিসাধন, অস্ত্রের চেয়ে বুদ্ধিকে বেশী কাজে লাগান, মুখোমুখি লড়াই এড়িয়ে চলা, সমুখ থেকে হামলা না করা, দিনে একশত সৈন্য মুখোমুখি লড়াই করে দুশমনের যে পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে, রাতে দশ-বারজনের কমান্ডো আক্রমণে তার চেয়ে বেশী সাফল্য অর্জন করা। তাছাড়া দুশমনের দুর্গ কিংবা শহর দীর্ঘ সময় অবরোধ করে রাখার পদ্ধতি এবং দুর্গের প্রাচীর ভাঙ্গার নিয়মও শিক্ষা দেন সুলতান। দুর্বল ও বয়স্ক উট, ঘোড়া ও খচ্চরগুলো আলাদা করে ফেলেন তিনি। আক্রমণের দিন ক্ষণ ঠিক হয়ে আছে আগেই।
.
সুলতান আইউবী ফিলিস্তীন জয়ের যে পরিকল্পনা স্থির করেছেন, তার প্রথম অভিযানে সাফল্যের সঙ্গে ফিলিস্তীন প্রবেশ করার তৎপরতা চলছে জোরেশোরে। অপরদিকে আইউবীকে পথেই প্রতিহত করার আয়োজন করছে খৃষ্টান বাহিনী। প্রস্তুতি দেখে মনে হচ্ছিল, দু পক্ষ-ই একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে চিরদিনের জন্য।
শোবক থেকে কার্ক এবং মিসরের সীমান্ত পর্যন্ত ক্রুসেডারদের আয়োজনের পরিধি। এ অঞ্চলের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছে তারা তাদের সেনাবাহিনী। এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে তারা সুলতান আইউবীর জন্য ফাঁদ হিসেবে গড়ে তুলেছে। এ ফাঁদে একবার আটকা পড়লে জীবনেও উদ্ধার পাবে না আইউবী। সুলতান আইউবীর সে পরিকল্পনার-ই আলোকে চলছে তাদের প্রস্তুতি, যা সময়ের আগেই তাদের গোচরে এসে গেছে। মনে মনে আত্মতৃপ্তিতে বিভোর খৃষ্টান রাষ্ট্রনায়ক ও সেনাপতিগণ।
এই ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতির ফাঁকে শোবকে চলছে অন্য এক গোপন তৎপরতা। তার সম্পর্ক যুদ্ধের সঙ্গে নয়- হৃদয়ের সঙ্গে।
লুজিনা নির্লিপ্ত পড়ে আছে তার কক্ষে। বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে সে হাদীদের জন্য। হাদীদের অমঙ্গল-আশংকায় উথালপাথাল করছে তার মন।
লুজিনার বান্ধবী দুদিন ধরে ঘুরে ফিরছে হাদীদের সন্ধানে। হাদীদ অফিসারদের হাসপাতালে নেই। নেই সাধারণ সৈনিকদের হাসপাতালেও।
পদস্থ গুপ্তচর হওয়ার সুবাদে বড় বড় অফিসারদের কাছে তার অবাধ যাতায়াত। সকলে তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। এ সুযোগকে কাজে লাগায় সে। লুজিনার সঙ্গে যে আহত মুসলিম ফৌজি এসেছিল, এখন সে কোথায়? একে একে ছোট-বড় সব অফিসারকে জিজ্ঞেস করে লুজিনার বান্ধবী। কিন্তু প্রত্যেকের একই জবাব, কই এমন কাউকে তো আমি দেখিনি।
তৃতীয় দিন এক অফিসার তাকে সাবধানতার সাথে জানায়, লুজিনার সঙ্গে আসা আহত মুসলিম ফৌজিকে ব্যান্ডেজ করে মুসলিম ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
.
শোবকের মুসলিম ক্যাম্প এক ভয়ংকর স্থান। মুসলিম যুদ্ধবন্দী আর বিজিত অঞ্চল থেকে ধরে আনা নিরপরাধ বেসামরিক মুসলমানদের রাখা হয় এ ক্যাম্পে। লুণ্ঠিত কাফেলার মুসলমানদের ধরে এনেও এ ক্যাম্পে নিক্ষেপ করে খৃষ্টানরা। বেগার ক্যাম্প নামে পরিচিত এ ক্যাম্প।
এটি কোন কারাগার নয়। এখানে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা নেই। যাদেরকে এখানে রাখা হয়, তাদের নিয়মিত কোন রেকর্ডও রাখা হয় না। পশুর মত আচরণ করা হয় এখানকার অধিবাসীদের সঙ্গে। কোথাও প্রয়োজন হলে এখান থেকে পছন্দমত লোকদের ভেড়া-বকরীর মত হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। গাধার মত খাটান হয় তাদের। খাবার দেয়া হয় সামান্য; বেঁচে থাকতে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু। থাকে তারা তাঁবুতে। যারা সাধারণ রোগে আক্রান্ত হয়, কেবল তাদের-ই চিকিৎসা করা হয়। রোগ বেড়ে গেলে মেরে ফেলা হয় বিষ খাইয়ে। এ অমানুষিক নির্যাতন সেলে নিক্ষিপ্ত বিপুলসংখ্যক মুসলমানের একমাত্র অপরাধ, তারা মুসলমান। গুপ্তচর মারফত সুলতান আইউবী অবহিত ছিলেন সোবকের এই বেগার ক্যাম্প সম্পর্কে।
হাদীদকেও পাঠিয়ে দেয়া হয় এ ক্যাম্পে। বান্ধবীর মুখে এ সংবাদ শুনে শিউরে উঠে লুজিনা। ধক্ করে জ্বলে উঠে তার হৃদয়। বেগার ক্যাম্পের পুরো চিত্র ফুটে উঠে তার চোখের সামনে।
হাদীদের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি নেই লুজিনার। গোয়েন্দা প্রধান হরমুন কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছে তাকে। একজন মুসলিম ফৌজির প্রতি এতটুকু আবেগপ্রবণ হওয়ার শাস্তির কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু সে নিষেধাজ্ঞা মেনে নেয়নি লুজিনা। হাদীদ বেগার ক্যাম্পে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে, বান্ধবীর মুখে এ সংবাদ শুনে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে লুজিনা। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বান্ধবীকে বলে, যে করে হোক, আমি ওকে মুক্ত করব-ই। তুমি আমায় সাহায্য কর বোন! সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয় বান্ধবী। পরিকল্পনা প্রস্তুত করে দুজনে মিলে।
লুজিনা তৎক্ষণাৎ ছুটে যায় শহরে। সাক্ষাৎ করে এক প্রাইভেট ডাক্তারের সঙ্গে। বলে, একজন আহত রোগী আছে, আপনাকে তার চিকিৎসা করতে হবে। কিন্তু বিষয়টা সম্পূর্ণ গোপন রাখতে হবে। এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলা যাবে না।
গোপনীয়তার কারণ জানতে চায় ডাক্তার।
লোকটি একজন গরীব মুসলমান। সে আমার পরিবারের বহু উপকার করেছে। এক জায়গায় ঝগড়া-ঝাটি করে এখন সে আহত। অর্থ-কড়ি নেই বলে কোন ডাক্তার তার চিকিৎসা করছে না। এখানকার সব ডাক্তার-ই যে খৃষ্টান। বিনা পয়সায় একজন মুসলমানের তারা চিকিৎসা করবে-ই বা কেন!
তাছাড়া ঝগড়া-ঝাটি করে একজন মুসলমান আহত হয়েছে, প্রশাসন এ খবর পেলে নিশ্চিত তাকে বেগার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেবে। গোপনীয়তা রক্ষা করার এ-ও এক কারণ। লোকটি আমার পরিবারের যে উপকার করেছে, আমি তার প্রতিদান দিতে চাই। আমি তাকে রাতের বেলা নিয়ে আসব। বলুন, আপনাকে কত দিতে হবে? গোপনীয়তা রক্ষা করার পুরস্কারও আমি আপনাকে দেব। বলল লুজিনা।
ডাক্তারের কাছে নিজেকে এক দ্র পরিবারের মেয়ে বলে পরিচয় দেয় লুজিনা। নিজের আসল পরিচয় গোপন রাখে সে।
কথার ফাঁকে ডাক্তার আপাদমস্তক এক নজর দেখে নেয় লুজিনার। যুবতীর অস্বাভাবিক রূপে বিমোহিত হয়ে পড়ে ডাক্তার। পারিশ্রমিকের কথা মুখে আনার ভাষা, হারিয়ে যায় তার। রূপের চেয়ে বড় মূল্যবান বস্তু আর কি হতে পারে, তা খুঁজে পাচ্ছে না সে।
ডাক্তারের দৃষ্টির অর্থ বুঝে ফেলে লুজিনা। ডাক্তার যে তার রূপের জালে আটকা পড়েছে, তা বুঝতে আর বাকি রইল না তার। লুজিনা এ জগতের অভিজ্ঞ মেয়ে। নিজের যোগ্যতা কাজে লাগায় সে। মোমের মত গলে যায় ডাক্তার।
লুজিনা চারটি স্বর্ণমুদ্রা গুঁজে দেয় ডাক্তারের হাতে। ডাক্তার যুবতীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হাসিমুখে বলে, তোমার চেয়ে মূল্যবান বিনিময় আর হতে পারে না। বিশেষ ভঙ্গিতে স্মিত হাসি বেরিয়ে আসে লুজিনার দু রাঙা ঠোঁটের ফাঁক বেয়ে। বলে, আপনি যা চাইবেন, তা-ই দেব; আগে আমার কাজ করুন।
ডাক্তার বুঝে ফেলল, বিষয়টি বিপজ্জনক ও রহস্যময়। কিন্তু লুজিনার রূপের ফাঁদে আটকে গিয়ে এ বিপদের ঝুঁকি মেনে নেয় সে। বলল, রোগী নিয়ে এস। আজ রাত, কাল রাত যেদিন ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা এস। এসে আমাকে ঘুমে পেলেও জাগিয়ে দিও।
ডাক্তার এক হাতে সোনার মুদ্রা আর অপর হাতে লুজিনার পেলব-কোমল হাতখানা মুঠি করে ধরে অপলক নেত্রে লুজিনার মুখপানে তাকিয়ে থাকে।
***
হাদীদকে ক্যাম্প থেকে বের করে আনাটা-ই এ অভিযানের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও বিপজ্জনক কাজ। রাতে ক্যাম্পে নামমাত্র পাহারা থাকে বটে, কিন্তু ক্যাম্পে এসে হাদীদকে খুঁজে বের করে আনা লুজিনার পক্ষে ষোল আনাই ঝুঁকিপূর্ণ। ধরা পড়লে মৃত্যুদন্ড অনিবার্য।
ক্যাম্প সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে লুজিনার বান্ধবী। যেমন যখমী ও রুগ্ন কয়েদীদের প্রতিদিন অতি সাধারণ একটি ডাক্তারখানায় হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের সঙ্গে থাকে মাত্র একজন প্রহরী।
পরদিন বান্ধবীর সঙ্গে লুজিনা সেই ডাক্তারখানার সামনে এসে দাঁড়ায়। তাদের বেশী অপেক্ষা করতে হল না। পঁচিশ-ত্রিশজন রোগীর একটি দল পা টেনে টেনে অতি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে এদিকে। লাঠি হাতে তাদের পশুপালের ন্যায় হাঁকিয়ে নিয়ে আসছে একজন প্রহরী। যারা দ্রুত হাঁটতে পারছে না, তাদের লাঠির দ্বারা ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসছে সে।
চোখে-মুখে কৌতূহলী ভাব নিয়ে সামনে অগ্রসর হয় মেয়ে দুটো, যেন তারা তামাশা দেখছে। রোগীর দলটি তাদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করতে শুরু করলে লুজিনার সন্ধানী দৃষ্টিতে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করে সবাইকে। দলের মধ্যে হাদীদকে খুঁজছে সে।
হঠাৎ চমকে উঠে লুজিনা। দলের মধ্য থেকে একজন লোক প্রবল ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে তার প্রতি। ভালভাবে হাঁটতে পারছে না সে। লোকটি হাদীদ। পান্ডুর চেহারা। আহত হওয়ার আগে লুজিনা তার চেহারায় যে জৌলুস দেখেছিল, এখন আর তা নেই। পোষাকে শুকিয়ে যাওয়া লাল চটচটে রক্তের দাগ।
দেখে কান্না আসে লুজিনার। ঝর ঝর করে দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে বেদনার অশ্রু। কিন্তু হাদীদের দৃষ্টিতে ঘৃণার ভাব। লুজিনার উপর থেকে চোখ সরিয়ে নেয় সে।
আরো সম্মুখে এগিয়ে যায় রোগীর দলটি। প্রহরীর সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেয় লুজিনা ও তার বান্ধবী। এই মুসলমান রোগীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে তারা। কথার যাদু দিয়ে প্রহরীকে পটিয়ে ফেলে দু যুবতী। বলে, কথা বলে এদের সঙ্গে আমাদের একটু তামাশা করতে মন চাইছে।
ডাক্তারখানায় আগে থেকেই রোগীর প্রচন্ড ভীড়। কয়েদীদের বসিয়ে দেয়া হল একদিকে। লুজিনা তাদের ঘনিষ্ঠ হয়। প্রহরীর সঙ্গে মিষ্টি-মধুর গল্প জুড়ে দেয় বান্ধবী। দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে মেয়েটির সঙ্গে আলাপে মেতে উঠে প্রহরী।
দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে বসে পড়ে হাদীদ। অবস্থা তার ভাল নয়। চোখের ইশারায় তাকে আড়ালে আসতে বলে লুজিনা। লুজিনার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় হাদীদ। লুজিনা ক্ষীণ কণ্ঠে তাকে বলে, আমার প্রতি নির্দেশ, আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারব না। আমি যে এখন তোমার সঙ্গে কথা বলছি, এ কথা কাউকে বুঝতে দেয়া যাবে না।
তোমার উপর আর যারা তোমাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে নিষেধ করেছে, তাদের উপর আল্লাহর লানত। কোন প্রতিদানের লোভে আমি তোমাকে ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করিনি। তোমাকে রক্ষা করে আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি মাত্র। কিন্তু কর্তব্যপরায়ণ লোকদের সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করাই কি তোমাদের চরিত্র? ক্ষীণ অথচ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল হাদীদ।
চুপ কর হাদীদ! এসব কথা পরে হবে। আগে বল রাতে তুমি থাক কোথায়? আজ রাতেই তোমাকে বের করে আনতে হবে। ফিসফিসিয়ে বলল লুজিনা।
হাদীদ লুজিনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল না। লুজিনাকে তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু লুজিনা চোখের অশ্রু দিয়ে মায়াবী কণ্ঠে হাদীদের মনে এ বিশ্বাস জন্মাতে সক্ষম হয় যে, তার সঙ্গে সে প্রতারণা করছে না। সত্যিই সে তাকে উদ্ধার করতে চায়।
আশ্বস্ত হয়ে হাদীদ বলল, রাতে যেখানে থাকি, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হবে না। কিন্তু বেরিয়ে এসে যাব কোথায়? মুহূর্ত মধ্যে পালানোর একটা পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলে দুজনে।
***
বেগার ক্যাম্পে মড়ার মত ঘুমিয়ে আছে কয়েদীরা। প্রহরীও গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। এখান থেকে কেউ পালায়নি কখনো। পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? নরক হলেও এটাই তাদের বাসস্থান। তাছাড়া এক আধজন পালালেও কৈফিয়ত চায় না কেউ। তাই নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারে প্রহরীরা।
রাতের প্রথম প্রহর শেষ প্রায়। পুরনো জীর্ণ এক তাবু থেকে এক ব্যক্তি বেরিয়ে আসে। হামাগুড়ি দিয়ে তাবুর আড়ালে আড়ালে অতি সন্তর্পণে চলে আসে প্রহরীদের আওতার বাইরে। অন্ধকার সত্ত্বেও সম্মুখে চোখে পড়ে একটি খেজুর গাছ। সেখানেই তার পৌঁছানোর কথা। খেজুর তলায় দাঁড়িয়ে আছে আপাদমস্তক মোটা কাপড়ে ঢাকা এক ছায়ামূর্তি। হামাগুড়ি থেকে উঠে দাঁড়ায় লোকটি। পায়ে হেঁটে খেজুর তলায় এসে পৌঁছে সে।
লোকটি হাদীদ। ছায়ামূর্তিটি লুজিনা। হাদীদের অপেক্ষায় পরিকল্পনা মোতাবেক খেজুর তলায় দাঁড়িয়ে আছে সে।
দ্রুত হাঁটতে পারবে? জিজ্ঞেস করে লুজিনা।
চেষ্টা করব। জবাব দেয় হাদীদ।
ক্যাম্প থেকে বেশ দূরে চলে যায় দুজন। সামনে বিস্তীর্ণ অনাবাদী ভূমি। দ্রুত হাঁটতে পারছে না হাদীদ। তাকে ধরে দ্রুত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে লুজিনা। এ ফাঁকে ইতিমধ্যে কি কি ঘটেছে, গোয়েন্দা প্রধান কি বলেছে, হাদীদের ব্যাপারে কি কি নির্দেশ জারী হয়েছে, সব খুলে বলে লুজিনা। মনের সন্দেহ দূর হয়ে যায় হাদীদের। লুজিনার প্রতি আস্থা ফিরে আসে তার।
আরো কিছুদূর অগ্রসর হয়ে তারা শহরের একটি গলিতে ঢুকে পড়ে। এ গলিতেই ডাক্তারের বাড়ি। ডাক্তারের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায় লুজিনা। বাড়ির দরজায় করাঘাত করে তিন-চারবার। দরজা খুলে ডাক্তার দ্রুত ভিতরে নিয়ে যায় দুজনকে।
ডাক্তার হাদীদের জখম খুলে নিরীক্ষা করে দেখে। বলে, রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হতে বিশদিনের মত সময় লাগবে।
শুনে ভাবনায় পড়ে যায় লুজিনা। এ এক নতুন সমস্যা। এতদিন হাদীদকে কোথায় লুকিয়ে রাখবে? বেগার ক্যাম্পে তো আর ফেরত পাঠান যাবে না। চিন্তার সাগরে ডুবে যায় লুজিনা। অবশেষে ভেবে-চিন্তে সমাধান একটা ঠিক করে রাখে মাথায়।
হাদীদের জখমে ব্যান্ডেজ করে ডাক্তার বলে, রোগীকে ভাল ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে।
লুজিনা ডাক্তারকে নিভৃতে নিয়ে যায়। বলে, লোকটি যেখানে থাকে, সেখানে তার পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা হবে না। আমার ঘরেও রাখতে পারছি না। আপনি তাকে এখানেই রেখে দিন। আপনি-ই তার উপযুক্ত খাবার-পথ্যের ব্যবস্থা করুন। খরচ ও পারিশ্রমিক যা চান, দেব।
খরচ-পারিশ্রমিকের পরিমাণ জানায় ডাক্তার। বিশাল অংক। আপত্তি জানায় লুজিনা। কিছু কমাবার অনুরোধ করে। ডাক্তার বলে, আমাকে দিয়ে তুমি ভয়ংকর এক কাজ করাচ্ছ। আমি জানি, এ লোকটিকে বেগার ক্যাম্প থেকে আনা হয়েছে। লোকটি মিসরী ফৌজের সিপাহী। আমি যে অংক চেয়েছি, আপত্তি না করে যদি তা ই প্রদান কর, তাহলে এ তথ্য আমার ঘরের বাইরে যাবে না।
ঠিক আছে, তা-ই দেব। তবে! যদি ঘুণাক্ষরে এ তথ্য ফাঁস হয়ে পড়ে, তবে আপনিও বাঁচবেন না। বলে লুজিনা।
ডাক্তার হাদীদকে একটি কক্ষে শুইয়ে দিয়ে বলে, সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া পর্যন্ত তুমি এখানেই থাকবে। ভিতর থেকে দুধ ও ফল এনে খেতে দেয় হাদীদকে। তারপর লুজিনাকে নিয়ে চলে যায় তার কক্ষে …।
পরদিন লুজিনা ও তার বান্ধবী গোয়েন্দাগিরি করতে যায় ক্যাম্পে। তারা কয়েদী রোগীদের ডাক্তারখানায় প্রহরীদের সঙ্গে গল্প করে। কথার ফাঁকে তারা তথ্য সংগ্রহ করে যে, হাদীদের পালানোর কারণে ক্যাম্পে কোন পরিবর্তন আসেনি। টের পায়নি কেউ এ ঘটনা।
ডাক্তার অতি গোপনীয়তার সাথে হাদীদের চিকিৎসা করছে। পুষ্টিকর খাদ্য খাবারও দিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ডাক্তারের বাসায় আসে লুজিনা। হাদীদের শিয়রে বসে কাটায় কিছু সময়। তারপর ডাক্তারের কক্ষে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে চলে যায়। এভাবে চলে যায় বিশদিন। হাদীদের জখমও শুকিয়ে গেছে। সে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। লুজিনা ডাক্তারকে বলে, কাল রাত এসে আমি হাদীদকে নিয়ে যাব। আপনার পাওনাও তখন পরিশোধ করব।
নিম্নপদের এক অফিসার আসক্ত ছিল লুজিনার বান্ধবীর প্রতি। সময় পেলেই ঘুরঘুর করত সে মেয়েটির পিছনে। এ সুযোগ কাজে লাগায় লুজিনা।
পরদিন প্রেমের প্রলোভন দেখিয়ে লুজিনার বান্ধবী অফিসারকে কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যায়। এ ফাঁকে লুজিনা বাক্স থেকে তার সামরিক উর্দি চুরি করে নিয়ে আসে। ডাক্তারের বাসায় গিয়ে আগে তার পাওনা পরিশোধ করে। তারপর হাদীদকে অফিসারের সামরিক পোষাক পরায়। ঘোড়ার ব্যবস্থাও হয়ে যায় অনায়াসে।
.
নগরীর চারিদিক উঁচু দেয়ালে ঘেরা। চারদিকে চারটি ফটক। ফটকগুলো বন্ধ থাকে দিন-রাত সব সময়। কিন্তু সম্প্রতি সুলতান আইউবীর আক্রমণ প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে যে সামরিক তৎপরতা চলছে, তার কারণে ফটকগুলো দিনের বেলা খোলা থাকছে।
সূর্যাস্তের খানিক আগে এক অশ্বারোহী ছুটে আসে দুর্গের প্রধান ফটকের দিকে। গায়ে খৃষ্টান সেনা অফিসারের সামরিক উর্দি। কোমরে ঝুলছে একটি তরবারী। তরবারীটি মুসলমানদের তরবারীর ন্যায় বাঁকা নয়- সোজা। সব মিলিয়ে তাকে খৃষ্টান সেনা অফিসার মনে না করে উপায় নেই।
ফটক খোলা। বের হচ্ছে রসদ বোঝাই উটের বহর। অশ্বারোহী অফিসার উটের বহরের সঙ্গে যাচ্ছে যেন।
ফটকের নিকটে চলে আসে আরোহী। ঠিক এ সময়ে গোয়েন্দা প্রধান হরমুন ঘোড়ার পিঠে করে প্রবেশ করেন ফটকে। বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরছেন তিনি। অশ্বারোহী অফিসারের প্রতি তার দৃষ্টি পড়ে। তিনি মুচকি হাসেন। কিন্তু হাসি দিয়ে হাসির জবাব দেয় না অফিসার। কয়েক পা ভিতরে ঢুকে ঘোড়া থামান হরমুন। দু তিন শ কদম দূরে দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পায় লুজিনাকে। হরমুনকে দেখেই দ্রুত কেটে পড়ে লুজিনা। চলে যায় নিজ কক্ষে।
আলী বিন সুফিয়ানের ন্যায় হরমুনও অত্যন্ত বিচক্ষণ গুপ্তচর। মনে বড় একটা খটকা জাগে তার। তিনি সন্দেহে পড়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার মোড় ঘুরিয়ে দেন ফটকের দিকে। বিদ্যুতিতে ঘোড়া ছুটান। মনের সন্দেহ দূর করতে চাইছেন তিনি।
অশ্বারোহী অফিসার চলে গেছে বহু দূর। তীরগতিতে এগিয়ে চলছে তার ঘোড়া। চোখের নিমিষে হারিয়ে যায় বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে।
***
কিছুদুর অগ্রসর হয়ে থেমে যান হরমুন। অশ্বারোহী অফিসারের নাগাল পাওয়ার সাধ্য নেই তার। ঘোড়ার মোড় ঘুরিয়ে ফিরে আসেন। ফটক পেরিয়ে দ্রুত ঢুকে পড়েন দুর্গের ভিতরে। ছুটে যান বেগার ক্যাম্পে। হাদীদের লক্ষণ বলে ইনচার্জকে জিজ্ঞেস করেন, লোকটি কোথায়? কিছুই বলতে পারে না ইনজার্চ। হাদীদকে পাওয়া গেল না ক্যাম্পে। যে তাঁবুতে তাকে রাখা হয়েছিল, তার অধিবাসীরা জানায়, লোকটি একদিন সকালে অনুপস্থিত ছিল। আমরা মনে করেছিলাম, আশেপাশে কোথাও আছে; কিন্তু আর ফিরে আসেনি।
হরমুনের সন্দেহ দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়। খৃষ্টান সৈন্যের উর্দি পরিহিত যে লোকটিকে তিনি ঘোড়ায় চড়ে ফটক পেরিয়ে যেতে দেখেছিলেন, সে হাদীদ-ই ছিল। আরো কিছু খোঁজখবর নিয়ে লুজিনার কক্ষে যান হরমুন।
মাথায় হাত চেপে কক্ষে নতমুখে বসে আছে লুজিনা। কোন ভূমিকা ছাড়াই গর্জে উঠেন হরমুন
তুই কি ভাগিয়েছিস্ লোকটাকে মিথ্যা বলে রেহাই পাবি না। তদন্ত করে আমি প্রমাণ করে ছাড়ব যে, তুই ওর পলায়নে সাহায্য করেছি।
ধীরে ধীরে মাথা উঠায় লুজিনা। অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকে হরমুনের প্রতি। হরমুনের দুচোখে আগুন। প্রবল ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তিনিও তাকিয়ে আছেন লুজিনার প্রতি।
মুখ খুলে লুজিনা-
আপনার তদন্তের প্রয়োজন নেই। আমার মিথ্যে বলারও আবশ্যক নেই। আমার জীবনটাই এক রাজকীয় মিথ্যা। আমার অস্তিত্ব চোখ ধাঁধানো এক প্রতারণা। নিজের আত্মার মুক্তির জন্য সত্য বলেই আমি মৃত্যুবরণ করছি।
লুজিনার কণ্ঠস্বরে নেশার ভাব। আস্তে আস্তে বেড়ে চলেছে তা। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। পা দুটো কাঁপছে তার। নিকটে-ই পড়ে আছে একটি গ্লাস। তাতে কয়েক ফোঁটা পানি। কম্পিত হাতে গ্লাসটি তুলে নিয়ে হরমুনের প্রতি এগিয়ে ধরে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে
আমি নিজেই আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি। এ গ্লাসের অবশিষ্ট কয়েক ফোঁটা পানি ই তার সাক্ষী। আমার এই অপবিত্র দেহটাকে মৃত্যুদণ্ড আমি এজন্য দেইনি যে, আমি জাতির সঙ্গে গাদ্দারী করেছি। বরং কারণ হল, আমি সেসব লোকদের ধোকা দিতে গিয়েছিলাম, যারা ধোকা-প্রতারণা বলতে কিছু বুঝে না। তাদের চারটি লোক আমার ইজ্জত রক্ষা করার জন্য- যা লুণ্ঠিত হয়েছে আগেই- দশজন দস্যুর মোকাবেলা করেছে। সবশেষে একজন নিজের দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করে আমাকে ডাকাতদের হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছে। এখন আমি ভাল-মন্দ ও ভালবাসা-ঘৃণার পার্থক্য বুঝি। আমি সত্য কথা বলেই মৃত্যুবরণ করছি। এ এক শান্তিময় মৃত্যু।
দুচোখ অন্ধকার হয়ে আসে লুজিনার। কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যেতে শুরু করে সে। হাত থেকে গ্লাসটা সরিয়ে নিয়ে তাকে ধরে ফেলেন হরমুন। গায়ে বল নেই। তবু এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় হরমুনের বাহুবন্ধন থেকে। মাটিতে পড়ে যায় লুজিনা। শুয়ে শুয়ে অস্ফুট স্বরে বলে জীবনের শেষ কথাগুলো-।
আমাকে ছুঁয়ো না হরমুন। এখন আর আমি তোমাদের কোন কাজে আসব না। আমার মধ্যে সত্যের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে এ বিষ; তোমাদের প্রয়োজন অপবিত্র নারী দেহ। ওকে আমি-ই ভাগিয়েছি। লুকিয়ে রেখেছিলাম বিশ দিন। ফার্নান্ডেজের উর্দি চুরি করে ওকে পরিয়েছি আমি। আমি-ই ওকে ঘোড়া দিয়েছি। আমি ওর সঙ্গে যেতে পারিনি, ওকে ছাড়াও থাকতে পারছিলাম না। তাই বিষপান করেছি। তুমি যদি আমায় না-ও দেখে ফেলতে, তবু এ বিষপান আমি করতাম-ই। সত্য বলে মৃত্যুবরণ করাকে কত যে শান্তি, কত যে আনন্দ, এ মুহূর্তে আমি তা গভীরভাবে উপলব্ধি করছি।
.
ঝিমিয়ে পড়ে লুজিনা। সোজা হয়ে যায় তার বিষাক্ত দেহ। বুজে আসে দুচোখের। পাতা। মৃত্যুর কোলে ঘুমিয়ে পড়ে সে চিরদিনের জন্য।
গোয়েন্দা প্রধান হরমুন হতবুদ্ধির ন্যায় পলকহীন নেত্রে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে লুজিনার মৃত দেহটার প্রতি। বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে তার কানে বাজতে থাকে লুজিনার জীবনের শেষ বাক্যটি
সত্য বলে মৃত্যুবরণ করায় কত যে শান্তি, কত যে আনন্দ, এ মুহূর্তে আমি তা গভীরভাবে উপলব্ধি করছি।
শেষকৃত্য সম্পন্ন হল লুজিনার। আপন বলতে কেউ নেই তার। বাবা-মা, ভাই বোন, আত্মীয় কেউ নয়। ছোটকালে এক কাফেলা থেকে তাকে তুলে আনা হয়েছিল। তখন বয়স তার দশ কি এগার বছর। তাই কাউকে তার মৃত্যু সংবাদ পৌঁছানোর ঝামেলা পোহাতে হল না অফিসারদের।
***
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনী অভিযানে রওনা হয়েছে তিনদিন হল। তাদের প্রতিহত করার জন্য পথে অবস্থান নিয়েছে খৃষ্টান বাহিনী। আইউবীর ঘোষণা অনুযায়ী হামলা হবে কার্কে। তাই শোবকের অধিকাংশ সৈন্য এখন কার্কেই অবস্থান করছে। সিরিয়া অভিমুখেও রওনা হয়ে গেছে একটি বাহিনী। উদ্দেশ্য, নুরুদ্দীন জঙ্গী আইউবীর সাহায্যে এগিয়ে আসলে তাকে প্রতিহত করা।
নিজের বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করে নিয়েছেন আইউবী। পরস্পর দূরত্ব বজায় রেখে অগ্রসর হচ্ছে তার তিন বাহিনী। একস্থানে এসে শিবির স্থাপন করেন সুলতান। অধীন সব কমাণ্ডারকে তলব করেন নিজের তাঁবুতে। বললেন
এবার আমার মনের গোপন কথা প্রকাশ করতে হচ্ছে। আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম, আক্রমণ হবে কার্কে। কিন্তু তোমাদের নিয়ে এসেছি অন্য পথে। বিষয়টা তোমাদের মনে খটকা লাগছে নিশ্চয়। কিন্তু শোন, আমি কার্ক আক্রমণ করব না। লক্ষ্য আমার শোবক দুর্গ।
তিন খৃষ্টান গোয়েন্দাকে আমি কেন মুক্তি দিলাম, রক্ষীর প্রহরায় তাদের শোবক পৌঁছানোর ব্যবস্থা-ই বা কেন করলাম, এ প্রশ্ন তোমাদের ভাবিয়ে তুলেছে জানি। এখন শোন তার রহস্য।
গোয়েন্দাদের পাশের কক্ষে বসিয়ে মাঝের দরজা ঈষৎ ফাঁক করে রেখে আমি উচ্চকণ্ঠে আলী বিন সুফিয়ান ও দু নায়েবকে বলতে শুরু করেছিলাম, অমুক তারিখে আমি কার্ক আক্রমণ করব। আমি জানতাম, আমার কথাগুলো সব গোয়েন্দাদের কানে যাচ্ছে। আমি একথাও তাদের কানে দিয়েছি যে, খৃষ্টানদের সঙ্গে খোলা মাঠে লড়তে আমাদের ভয় হয়।
এসব কথা কানে দিয়ে মুক্ত করে দিয়েছিলাম খৃষ্টান গোয়েন্দাদের। চারজন রক্ষী দিয়ে তাদের নিরাপদে শোবক পৌঁছার ব্যবস্থাও করেছিলাম। সংবাদ পেয়েছি, শোবক যাওয়ার পথে তারা এক দুর্ঘটনার শিকার হয়। কতিপয় ডাকাত আমার তিনজন রক্ষী ও একটি গোয়েন্দা মেয়েকে হত্যা করে ফেলেছে। চতুর্থ রক্ষী গতকাল রাতে শোবক থেকে ফিরে এসেছে। গোয়েন্দা মারফত আমি জানতে পেরেছি যে, আলেম গোয়েন্দা জীবিত শোবক পৌঁছুতে সমর্থ হয়েছে। সে আমার কার্ক আক্রমণের পরিকল্পনার কথা খৃষ্টান কর্মকর্তাদের অবহিত করার কৌশল সফল করেছে। আমি যেভাবে চেয়েছিলাম, খৃষ্টানরা সেভাবেই তাদের বাহিনীকে ছড়িয়ে দিয়েছে। এ মুহূর্তে আমাদের বাহিনীর বাম অংশের অবস্থান খৃষ্টানদের বিশাল এক বাহিনীর বাম দিকে বার মাইল দূরে।
বাহিনীর বাম অংশের কমাণ্ডারকে উদ্দেশ করে সুলতান বললেন, আজ সূর্যাস্তের পরপর তুমি তোমার সকল অশ্বারোহী বাহিনীকে সোজা দু মাইল সম্মুখে নিয়ে যাবে। সেখান থেকে মোড় নেবে বায়ে। যাবে আরো সোজা চার মাইল। তারপর আবার বাঁয়ে মোড়। দুমাইল অগ্রসর হওয়ার পর দেখবে শত্রু বাহিনী আরাম করছে। তীব্র গতিতে কমান্ডো আক্রমণ চালাবে তাদের উপর। অল্প সময়ে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করবে। সামনে যা পাবে, পায়ে পিষে দ্রুত ফিরে আসবে আগের জায়গায়।
বাহিনীর দ্বিতীয় অংশ সোজাসুজি সম্মুখে এগিয়ে যাবে। আট ন মাইল পথ অতিক্রম করবে। শত্রু বাহিনীর রসদ ও কাফেলা চোখে পড়বে। তখন থাকবে তোমরা দুশমনের পিছনে। দিনের বেলা শত্রু বাহিনী তোমাদের বাম অংশকে ধাওয়া করবে। মুখোমুখি সংঘাতে লিপ্ত হবে না। দিনের বেলা সরে আসবে অনেক পিছনে।
আক্রমণ করবে রাতে। আক্রমণের পর থামবে না একদন্ডও, সরে আসবে পিছনে। সম্মুখে অগ্রসর হবে খৃস্টান বাহিনী। তখন মাঝের অংশ পিছন থেকে তাদের উপর আক্রমণ করবে। নিজেদের সামলে নিয়ে তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে।
বাহিনীর তৃতীয় অংশকে নিয়ে আমি আজ রাতেই রওনা হব। আগামীকাল দুপুর পর্যন্ত আমরা শোবক অবরোধ সম্পন্ন করে ফেলব। বাহিনীর অপর দুই অংশ আমার শেখানো নিয়মে শত্রু বাহিনীকে মরুভূমিতে অস্থির করে রাখবে। তাদের কাছে রসদ পৌঁছতে দেবে না। সুযোগমত পানির ঝর্ণাগুলো দখল করে নেবে। আক্রমণ করবে সবসময় শক্রর বাম পার্শ্ব থেকে। আক্রমণের পর লড়াই করার জন্য বিলম্ব করবে না। অতর্কিত কমান্ডো আক্রমণ করেই চোখের পলকে কেটে পড়বে। সুইসাইড স্কোয়াড প্রতিরাতে অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করবে দুশমনের পশুপালের উপর।
.
১৯৭১ সাল। বছরের ঠিক শেষ দিন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর কার্কের লোকেরা জানতে পায় যে, শোবকের মত তাদের শক্ত দুর্গ সুলতান আইউবী অবরোধ করে ফেলেছেন। অথচ, তাদের বেশীর ভাগ সৈন্যকে সমবেত করা হয়েছে কার্কে, পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে মরুভূমিতে। এসে তারা শোবককে সাহায্যও করতে পারছে না। মুসলিম বাহিনী মরুভূমির সৈন্যদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে ফিরছে। সামনে এসে মুখোমুখি লড়াই করছে না মুসলিম বাহিনী। গেরিলা ও কমান্ডো আক্রমণ করে তারা সীমাহীন ক্ষতি করছে খৃষ্টানদের। তারা খৃষ্টানদের রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। পানির ঝর্ণাগুলোও এখন তাদের দখলে।
হারিয়ে গেছে খৃষ্টান বাহিনীর মনোবল। উভয় সংকটে পড়ে গেছে তারা। না পারছে মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে, না পারছে পিছনে সরে গিয়ে শোবক রক্ষা করতে। তারা দু চোখে শোচনীয় পরাজয় ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।
শোবক দুর্গ অবরোধ করেছেন সুলতান আইউবী। দুর্গ ও নগরীর পাঁচিলে দাঁড়িয়ে তীর ও বর্শা ছুঁড়ে মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলা করে স্বল্পসংখ্যক খৃষ্টান সৈন্য। বেশিক্ষণ টিকতে পারে না তারা। দুর্গের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে আইউবীর বাহিনী। প্রায় দেড় মাস অবরোধ করে রাখার পর দুর্গে প্রবেশ করেন সুলতান। সর্বাগ্রে ছুটে যান বেগার ক্যাম্পে। সিজদায় লুটিয়ে পড়ে ক্যাম্পের হাড্ডিসার মুসলিম বন্দীরা।
মরুভূমির খৃষ্টান সৈন্যরা দিশে হারিয়ে পিছনে সরে গিয়ে ঢুকে পড়ে কার্ক দুর্গে। ওখানে বিপুলসংখ্যক সৈন্য বেকার বসে বসে সুলতান আইউবীর আক্রমণের অপেক্ষায় প্রহর গুণছে।