চিতেন
রেল-বাজার থেকে নবাবগঞ্জ পাঁচ ক্রোশ রাস্তা। পাঁচ ক্রোশ রাস্তা হলে কী হবে ওটুকু পথ লোকে হেঁটেই মেরে দেয়। এখন অবশ্য বাস হয়েছে। কুড়িটা নয়া দিলে একেবারে নবাবগঞ্জের আগের গ্রামে পৌঁছে যাবে। সেখান থেকে ওই দেড় মাইলটাক রাস্তা হেঁটে চলে যাও একেবারে সোজা নবাবগঞ্জে পৌঁছে যাবে।
তা সেই রেলবাজারের ইস্টিশানে ট্রেন থেকে একদিন একজন ভদ্রলোক নামলো। বেশ ধোপ-দুরস্ত চেহারা। হাতে একটা ছোট সুটকেসের গায়ে সাদা রং দিয়ে ইংরিজি অক্ষরে লেখা রয়েছে–পি সি রায়। ট্রেনটা চলে যাবার পর ভদ্রলোক কোনও দিকে দৃকপাত না করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা বাজারের রাস্তায় পড়লো। তারপর বাঁয়ে ঘুরে একটা মিষ্টির দোকানে। দোকানী এগিয়ে এল।
–কী দেব বলুন?
ভদ্রলোক বললে–সন্দেশ কত করে?
–সাড়ে সাত টাকা।
–ওরে বাবাঃ, একেবারে সাড়ে সাত টাকা! গলাকাটা দর করে দিলেন যে। আগে আপনাদের দোকানে কত সন্দেশ-রসগোল্লা-রাজভোগ খেয়েছি, তখন তো আড়াই টাকা করে সের ছিল।
দোকানদার সবিনয়ে বললে–সে-সব দিনের কথা এখন ভুলে যান। তখন সাত টাকা মণ দুধ পাওয়া যেত।
ভদ্রলোকের এ-সব কথা ভালো লাগলো না। বললে–না মশাই, এ একেবারে গলাকাটা দর করে দিয়েছেন। তা সিঙ্গাড়া কত করে?
–তিন আনা পিস্—
ভদ্রলোক বলে উঠলো–তা সিঙ্গাড়া তো আর দুধের খাবার নয় মশাই, সিঙ্গাড়ার এত দাম করেছেন কেন? আমি কি ভেবেছেন নতুন এসেছি এখেনে–আজ কুড়ি-তিরিশ বছর ধরে আসছি। এককালে আপনাদের দোকানে আমি এক টাকা সের সন্দেশ খেয়েছি, তাও আমার মনে আছে–
এতক্ষণে দোকানদারের যেন মন ভিজলো। জিজ্ঞেস করলে আপনার দেশ কি এখেনে?
ভদ্রলোক বললে–আমার নিজের দেশ নয়, আমার জামাইবাবু নবাবগঞ্জের জমিদার–
নবাবগঞ্জের জমিদার?
–আরে হ্যাঁ মশাই, ছোটবেলা থেকে দিদির বাড়ি আসতুম, আর এইখান থেকে কাঁচাগোল্লা কিনে নিয়ে যেতুম। এককালে এখানে রোজ আসতুম।
–আপনার দেশ?
–ভাগলপুর। এখানে নবাবগঞ্জে আমার ভগ্নীপতির বাড়ি। জমিদার হরনারায়ণ চৌধুরীর নাম শুনেছেন? তিনিই ছিলেন আমার ভগ্নীপতি।
–তা তিনি তো নবাবগঞ্জ থেকে জমিজমা বেচে চলে গিয়েছেন। ভাগলপুরে আছেন এখন–
ভদ্রলোক বললে–তাহলে তো সবই জানেন দেখছি। সেই ভগ্নীপতিই এখন মারা গেছেন।
–মারা গেছেন!
ভদ্রলোক বললে–হ্যাঁ, সে এক ভীষণ কাণ্ড! সেই ব্যাপারেই আমরা সব বিব্রত। এখন যাচ্ছি নবাবগঞ্জে আমার ভাগ্নের খবর নিতে–
–ভাগ্নে মানে? সেই সদা! সদানন্দ!
–হ্যাঁ, সদানন্দকে এদিকে দেখেছে নাকি? তাঁকে খুঁজতেই তো যাচ্ছি। যাহোক, তাহলে মশাই আপনার সন্দেশ আর খাওয়া হলো না। সাড়ে সাত টাকা সেরের সন্দেশ খাবার ক্ষমতা নেই আমার–
দোকানদার বললে–তাহলে সিঙ্গাড়া খান, তিন আনার চেয়ে সস্তা দেওয়া যায় না, আলুর যা দাম বাড়ছে–
–তা দু’আনা করে হোক না—
দোকানদারের কী মনে হলো। বললে–ঠিক আছে, আপনি চা খাবেন তো? দু’আনায় এক কাপ চা। চা খেলে একখানা সিঙ্গাড়া দু’আনায় দিতে পারি। আপনি আমাদের পুরোন লোক-দেশের লোক, এতদিন পরে এসেছেন। ওরে, বাবুকে এক কাপ চা আর একটা গরম সিঙ্গাড়া দে–
তা তাই-ই সই। বেশী দরাদরি করা ঠিক নয়। সন্দেশটা সস্তা করে দিলেই ভালো হতো অবশ্য শেষ পর্যন্ত একখানা সিঙ্গারা দিয়ে এক কাপ চা-ই নিলে ভদ্রলোক। বললে–তাহলে চা’য়ে একটু বেশি করে চিনি দেবেন মশাই, আমি আবার চিনি একটু বেশী খাই–
চা আর সিঙ্গাড়া খেয়ে দাম চুকিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক উঠলো। ভোরবেলা ট্রেন থেকে নেমেছে। এবার একটু রোদ উঠেছে। এখনও পাঁচ ক্রোশ রাস্তা ঠেঙ্গাতে হবে। রেলবাজারের রাস্তায় তখন মানুষের রীতিমত আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে–
তারপর রাস্তায় নামবার আগে দোকানদারকে লক্ষ্য করে বললে–ফেরবার সময় আবার আসছি, তখন কিন্তু একটু কন্শেসন করতে হবে, বুঝলেন–
তা এই হলো প্রকাশ রায়। সদানন্দ চৌধুরীর প্রকাশ মামা। আপন মামা ঠিক নয়। তা হোক, আপন মামার চাইতেও বড়। মার এক মামার ছেলে। ছোট বেলা থেকে নবাবগঞ্জে আনাগোনা করতো। বড়লোক ভগ্নীপতি। দূর সম্পর্কের ভগ্নীপতি হলেও ভগ্নীপতি তো! একটা সম্পর্ক তো আছে, তা সে যত ক্ষীণ সম্পর্কই হোক। সেই ক্ষীণ সম্পর্কটাকে ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ আসা-যাওয়া দিয়ে সে রীতিমত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে পরিণত করে তুলেছিল। বলা-নেই কওয়া-নেই হঠাৎ-হঠাৎ এসে উদয় হতো প্রকাশ। বড়লোক দিদি। থাকা-খাওয়ার এলাহি ব্যবস্থা। প্রকাশ এলেই নবাবগঞ্জের লোকেরা বলতো–ওই চৌধুরী মশাই-এর শালা এসেছে–
অনেকে আবার আদর করে শালাবাবুও বলতো।
শালাবাবু এলে নবাবগঞ্জের লোক ধরে বসতো–শালাবাবু, আমাদের বারোয়ারিতলায় যাত্রা হবে, চাঁদা দিন—
তা চাঁদা দিতে কখনও কার্পণ্য করে নি শালাবাবু। বলতো–বেশ তো, কত চাঁদা দিতে হবে আমাকে, বলো–
দশ টাকা চাই আপনার কাছে
তা দশ টাকা দিতেও আপত্তি করত না শালাবাবু। নবাবগঞ্জের জমিদারের শালা, সুতরাং সারা গ্রামের লোকেরই শালা। তার মতন লোকের কাছে দশ টাকা চাঁদা চাইবার হক আছে বইকি গ্রামের লোকের। শালাবাবুর ফিনফিনে পাঞ্জাবি, কোঁচানো ধুতি, আর ঢেউ খেলানো তেড়ি, এ-সব দেখে যে-কোনও লোকই বুঝতে পারতো শালাবাবু পয়সাওয়ালা লোক। আসলে কিন্তু এ পয়সা যোগান দিত দিদি। শালাবাবু এসেই বলতো দিদি, এবার আর তোমার ইজ্জৎ থাকবে না–
দিদি বুঝতে পারতো না। বলতো–কেন রে, কী হলো?
নবাবগঞ্জের ক্লাবের ছেলেরা আবার চাঁদা চাইছে। একেবারে দশ টাকা চাঁদা ধরেছে আমার নামে।
দিদি বলতো–কেন, আবার চাঁদা কীসের? এই তো সেদিন যাত্রার জন্যে তুই দশটা টাকা চেয়ে নিয়ে গেলি। এরই মধ্যে আবার চাঁদা কিসের?
শালাবাবু বললে–আমিও তো তাই জিজ্ঞেস করলুম, আবার চাঁদা কীসের? তা ওরা বললে–এবার বারোয়ারিতলায় কবির গান লাগাবে–
–কবির গান? ওদের বুঝি কাজকম্ম কিছু নেই, কেবল যাত্রা থিয়েটার আর গান!
শালাবাবু বললে–দিয়ে দাও দশটা টাকা। দশটা টাকা তোমার কাছে কিছু না, কিন্তু ওরা আমাকে শালাবাবু বলে এখনও মান্যগণ্য করে তো, টাকা না দিলে সেটাও আর করবে না, তখন তোমারও ইজ্জৎ নষ্ট, বলবে চৌধুরীমশাই কিটে লোক–চৌধুরীমশাই-এর বউও কিপটে, তার শালাটাও কিপটে।
দিদি ভাই-এর কথায় হেসে ফেলতো। বলতো–তোর বুদ্ধি তো খুব প্রকাশ–
প্রকাশ দিদির কাছে তারিফ পেয়ে অহঙ্কারে আরো ফুলে উঠতো। বলতো–তুমি আর আমার বুদ্ধির কতটুকু দেখলে দিদি। জানো, এই যে এতবার ভাগলপুর থেকে এখানে আসি, তুমি কি ভেবেছো আমি রেলের টিকিট কাটি নাকি?
–টিকিট কাটিস না!
প্রকাশ গর্বে বুক ফুলিয়ে দিদির দিকে চেয়ে বলে–না। টিকিট কাটতে যাবো কোন্ দুঃখে বল তো! আমি গাড়িতে চড়লেও রেল চলবে, না-চড়লেও চলবে। আমি চড়ি বলে কি আর রেলের ইঞ্জিনের কয়লা বেশি পোড়ে?
দিদি অবাক। বলে–তাহলে তুই যে আমার কাছ থেকে টিকিটের টাকা নিস?
প্রকাশ বলে–তোমার দেখছি বুদ্ধিসুদ্ধি কিছু নেই দিদি। তোমার কাছ থেকে টিকিটের টাকা নিই বলে সত্যি সত্যি রেলের টিকিট কাটতে হবে? তুমি বলছো কী? ওই রকম বোকা হলেই হয়েছে আর কী! পৃথিবীতে লোকের সঙ্গে একটু ভালোমানুষি করেছ কি সবাই তোমায় পিষে গুঁড়িয়ে চেপটে মেরে ফেলে দেবে। তুমি তো দেশের মানুষগুলোকে এখনও চিনলে না, তাই ওই কথা বলছো! খবরদার খবরদার, ওই বোকামিটি কখখনো কোর না দিদি, রেলে চড়লে কখনো টিকিট কাটবে না। রেলগাড়ি মানে কী জানো তো?
–কী?
–জোচ্চোরের বাড়ির ফলার। পেলে ছাড়তে নেই।
–তা তুই সে টাকাগুলো নিয়ে কী করিস?
প্রকাশ বলে—খাওয়াই–
–খাওয়াই মানে? কাকে খাওয়াস?
প্রকাশ বলে–ওই টিকিট চেকারদের। এক-একদিন যখন ধরে ফেলে তখন চা-সিগ্রেট খাওয়াতে হবে না? সবাই তো আর আমার বউ-এর ভাই নয় যে আমার মুখ দেখে ছেড়ে দেবে! দু’একটা আবার ধর্মপুত্তুর যুধিষ্টির আছে, জানো, তারা মিষ্টি কথাতেও ভুলবে না, চা-সিগ্রেটও খাবে না, আবার ঘুষও নেবে না। সেই সব বেয়াড়া লোকগুলোকে নিয়েই হয় মুশকিল।
–তখন কী করিস?
–তখন কী আর করবো? গাঁট-গচ্চা দিতে হয়—
কথাগুলো বলবার সময় দিদিও যত হাসে, প্রকাশও তত হাসে। ভাইএর বাহাদুরিতে দিদি অবাকও হয়ে যায়। যখন প্রকাশ নবাবগঞ্জে আসে তখন অনেক সময় রেলবাজারের মিষ্টির দোকান থেকে এক হাঁড়ি কাঁচাগোল্লা নিয়ে আসে। দিদি বলে–এ কী রে, তুই আবার কুটুম লোকের মত মিষ্টি নিয়ে আসিস কেন? তুই কি কুটুমবাড়ি আসছিস নাকি?
প্রকাশ বলতো–না দিদি, তুমি কাঁচাগোল্লা খেতে ভালবাসো তাই আনলুম। তিন টাকা সের, বেটারা গলা কাটা দাম রেখেছে–
দিদি সন্দেশটা নেয় বটে, কিন্তু ভাই-এর দেওয়া জিনিসের দামও সঙ্গে সঙ্গে শোধ করে দেয়। আর তা ছাড়া প্রকাশ টাকা পাবেই বা কোথায়? তার তো আর ভগ্নীপতির মত নিজের ঢালাও জমিদারি নেই যে দিদিকে রোজ-রোজ এক সের করে কাঁচাগোল্লা খাওয়াবে! আর প্রকাশও জানতো যে সেই কাঁচাগোল্লা দিদি নিজে যতখানি খাবে, তার চেয়ে বেশি খাবে প্রকাশ নিজে।
ওই সদা যখন হলো তখন ওর ভাতের সময় করা-কর্মা যা কিছু সবই করেছিল ওই প্রকাশ। অবশ্য তখন প্রকাশ নিজেও ছোট। সদানন্দর সেই ছোটবেলা থেকে তার বিয়ে দেওয়া পর্যন্ত সব কাজেই প্রকাশ। জমিদারবাড়ির একমাত্র ছেলে। আদর করবার লোকেরও অভাব যেমন নেই, ছেলের সাধ-আহ্লাদ-শখ মেটাবার জন্যে টাকারও তেমনি অভাব নেই। যত ইচ্ছে খরচ করো না তুমি, ছেলে যদি তাতে সুখী হয় তো আমার কোনও আপত্তি নেই। আরো টাকা নাও নবাবগঞ্জের চৌধুরী বংশের কুল-তিলক সদানন্দ, তার জন্যে নরনারায়ণ চৌধুরীর কোনও কার্পণ্য নেই।
যেদিন সদানন্দ জন্মালো নরনারায়ণ চৌধুরী তখন রাণাঘাটের সদরে মামলার তদ্বির করতে গেছেন। সদরে তার নিজের বাড়ি ছিল। মামলা-মকর্দমার জন্যে তাকে যেতেই হতো। ওখানে গেলে কিছুদিন ওই বাড়িতেই কাটাতেন। লোকজন ছিল তাঁর। কাছারি বাড়ির কাজ হতো ওইখানে। তার জন্যে লোক-লস্কর সব কিছুর ব্যবস্থা ছিল।
সেদিন উকিল-মুহুরি নিয়ে কাছারি-ঘরে তিনি খুবই ব্যতিব্যস্ত। নব্বই হাজার টাকার একটা বিলের মামলার ডিক্রী হয়েছে। তাই নিয়ে সাক্ষী-সাবুদের ঝামেলায় একেবারে নাজেহাল, তখন হঠাৎ নবাবগঞ্জ থেকে দীনু দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে খবর দিলে–বউমার ছেলে হয়েছে–
প্রথমটায় যেন মনে হলো ভুল শুনছেন। তারপর উকিল-মুহুরির দিক থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন–কী বললি?
–আজ্ঞে বউমার ছেলে হয়েছে।
তবু যেন কর্তামশাইএর বিশ্বাস হলো না। বললেন–ছেলে, না মেয়ে?
–আজ্ঞে ছেলে।
–তুই ঠিক জানিস–ছেলে?
দীনু বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ, মঙ্গলা দাই নিজে আমাকে বলেছে। ছোট-মশাই তাই আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিলে।
কথাটা শুনে কর্তামশাই প্রথমে কী করবেন বুঝতে পারলেন না। তারপর কৈলাসকে ডাকলেন। কৈলাস গোমস্তা যে তার পাশেই বসে আছে, উত্তেজনায় সে-খেয়ালও তার ছিল না। আবার ডাকলেন–কৈলাস, কৈলাসের টিকি দেখতে পাচ্ছি নে কেন, সে যায় কোথায়?
পাশ থেকে কৈলাস বলে উঠলো–আজ্ঞে এই তো আমি।
–ও তুমি পাশেই রয়েছ, তা আমি যে এত চেঁচিয়ে মরছি তুমি রা কাড়ছো না কেন? তোমরা কি সব কানে তুলে দিয়ে রেখেছ? তোমাদের কি সব সময় কেবল ফাঁকি! ফাঁকি দেওয়া তোমাদের স্বভাব হয়ে গিয়েছে–
একগাদা নথিপত্র নিয়ে কৈলাস তখন হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল। তিন দিন তিন রাত ধরে সেই সব নথিপত্র নিয়েই কেটেছে সকলের। একবার কাছারি আর একবার কোর্ট করেছে। জমিদারী-সেরেস্তার কাজে তার মত বিশ্বস্ত লোক পাওয়াও কর্তামশাই-এর একটা ভাগ্য। কিন্তু তবু তার বকুনি খাওয়ার কপাল।
কর্তামশাই বললেন–ওসব নথিপত্র এখন রাখো,–
কৈলাস গোমস্তা বললে–আজ্ঞে, কাল যে মুনসিফের কোর্টে এ-মামলার শুনানী আছে– কর্তামশাই বললেন–রাখো তোমার শুনানী। জীবনে অনেক মামলা করেছি, তুমি আমাকে আর কোর্ট দেখিও না। আমি কি কোর্ট-এর নাম শুনলে ভয় পাবো? না-হয় ও বিল্টা যাবে। জীবনে অনেক বিল্ দেখেছি, আবার অনেক সম্পত্তি চলেও গিয়েছে আমার। আর আমি যদি বেঁচে থাকি অমন বিল্ আমি আরো দশটা নীলামে ডেকে নেব। এখন ও সব থাক্, শুনছো নাতি হয়েছে আমার, তুমি এখন আমাকে কোর্ট শোনাচ্ছো। যাও, ও সব রাখো। আমি আজকেই নবাবগঞ্জে ফিরে যাবো, তার ব্যবস্থা করো–
–এখুনি যাবেন?
–এখুনি যাবো না তো কি একদিন পরে যাবো? পরে গেলে দেরি হবে না? এ কি দেরি করার কাজ? যাও, গাড়ির বন্দোবস্ত করো, আর আমার বাক্স-বিছানা সব দীনুকে দিয়ে গুছিয়ে ফেল। রজব আলীকে ডেকে গাড়িতে গরু জুততে বলো–
এর ওপর আর কথা বলা চলে না। কৈলাস গোমস্তা বাইরে যাচ্ছিল সব বন্দোবস্ত করতে।
কর্তামশাই আবার ডাকলেন–হ্যাঁ, ভালো কথা, তার আগে আর একটা কাজ করো দিকিনি। বাজারের সনাতন স্যাকরাকে চেনো তো, তাকে গিয়ে বলো দশ ভরির সোনার হার যদি একটা তৈরি থাকে তো সেটা নিয়ে যেন এখুনি একবার আমার কাছে আসে–
তা সেইদিনই কর্তামশাই সেই দশভরি সোনার হার নিয়ে রজব আলীর গাড়িতে চড়ে গ্রামের দিকে রওনা দিয়েছিলেন। খাওয়া-ঘুমনো মামলা সব কিছু মাথায় রইলো। সব কিছু ফেলে কর্তামশাই নবাবগঞ্জে এসে ওই দশ ভরির সোনার হার দিয়ে নাতির মুখ দেখেছিলেন। এ নাতি যে তার কত আদিখ্যেতার নাতি তা আর কেউ না জানুক, কর্তামশাইএর অজানা ছিল না। ছেলের বিয়ে তিনি অল্প বয়েসেই দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল তার বাড়ি নাতি নাতনীতে ভরে যাবে। তার সংসার বিলাস-বৈভবে ঐশ্বর্যে জাঁক-জমকে জমাট হয়ে উঠবে। কিন্তু তা হয় নি। তিনি অনেক খুঁজে-পেতে সুলতানপুরের জমিদার কীর্তিপদ মুখুজ্যের একমাত্র সন্তানকে নিজের ছেলের পাত্রী হিসেবে পছন্দ করে বউ করে নিজের বাড়িতে এনেছিলেন।
কিন্তু বিয়ের পর বহুদিন কেটে গেল, তবু সন্তানাদি কিছু হলো না দেখে বড় মুষড়ে পড়েছিলেন।
এই প্রকাশ তখন সবে হয়েছে। বাপ-মা মারা যাবার পর পিসীমার কাছেই থাকতো। পিসেমশাই কীর্তিপদ মুখুজ্জের ছেলে ছিল না বলে আদর-যত্ন পেত ছেলের মত। তারপর যখন প্রীতিলতার বিয়ে হয়ে সে নবাবগঞ্জে চলে গেল তখন ছোট ছেলের মত প্রকাশও দিদির সঙ্গে দিদির শ্বশুরবাড়িতে এল।
কিন্তু এ-সব জটিলকুটিল বংশতালিকার শুকনো বর্ণনা না দেওয়াই ভালো। তাতে গল্প দানা বাঁধতে পারে না। গল্প আত্মীয়স্বজনের ডালপালার ঘা লেগে হোঁচট খেয়ে খুঁড়িয়ে চলে। তার চেয়ে প্রকাশের যে পরিচয় দিচ্ছিলাম তাই দেওয়াই ভালো। কারণ এ উপন্যাস যাঁরা পড়ছেন তাদের এখন থেকেই জানিয়ে দেওয়া ভালো যে প্রকাশ রায় ভবিষ্যতে এ উপন্যাসে আরো অনেকবার উদয় হবে। পাঠক-পাঠিকারা এই চরিত্রটির সম্বন্ধে যেন একটু বিশেষ অবহিত থাকেন।
এদিকে সদানন্দ যখন বড় হলো তখন প্রকাশ রায় এ বাড়িতে রীতিমত আসর জমিয়ে বসেছে। এখানে একবার আসে একমাস দুমাস থাকে, আর দিদির কাছ থেকে কিছু টাকা হাতিয়ে নিয়ে আবার কিছুদিনের জন্যে অদৃশ্য হয়ে যায়।
যখন নবাবগঞ্জে থাকে তখন সদানন্দকে নিয়ে ঘোরে। কোথায় যাত্রা হচ্ছে, কোথায় কবির লড়াই হচ্ছে, পাঁচালী হচ্ছে, সেখানে ভাগ্নেকে সঙ্গে করে তার নিয়ে যাওয়া চাই।
নরনারায়ণ চৌধুরী হাজার কাজের মধ্যেও নাতির খবর নেন। বলেন–খোকা কোথায় গেল, খোকা? খোকাকে দেখছি নে যে?
কৈলাস গোমস্তা বলে–আজ্ঞে, খোকাবাবু শালাবাবুর সঙ্গে বেরিয়েছে–
জিনিসটা কর্তামশাইএর পছন্দ হয় না। কিন্তু কিছু বলতেও পারেন না। বউমার ভাই। কুটুম সম্পর্ক। শুধু বলেন–তোমাদের শালাবাবু লোকটা সুবিধের নয়, সিগ্রেট-টিগ্রেট খেতে দেখেছি–
কিন্তু প্রকাশের সে-দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। স্টেশন থেকে সোজা এসেই একেবারে কর্তামশাইএর পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকায়।
কর্তামশাই প্রত্যেকবারই হচকিয়ে যান।
বলেন–কে?
–আজ্ঞে আমি প্রকাশ।
–প্রকাশ! নামটা যেন অনেকক্ষণ চিনতে পারেন না। তারপর একেবারে না চিনলে খারাপ দেখায় তাই বলেন–বেয়াই মশাই কেমন আছেন? বেয়ান? সবাই ভালো আছেন তো?
তারপরে আর কর্তামশাইএর সঙ্গে দেখা করা দরকার মনে করে না সে। সোজা চলে যায় দিদির কাছে। একেবারে অন্দর মহলে গিয়ে বলে–দিদি এলুম—
এক একদিন হাসতে হাসতে ঢোকে দিদির ঘরে। বলে–জানো দিদি, তোমার ছেলে খুব ইনটেলিজেন্ট হয়েছে—
দিদি বলে–কি রকম?
প্রকাশ বলে–ওকেই জিজ্ঞেস করো না—
দিদি খোকার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে খোকন?
খোকন বলে–আমি গান শিখেছি মা–
–ওমা তাই নাকি? কই গাও দিকি?
প্রকাশও উৎসাহ দিলে ভাগ্নেকে। বললে–গাও গাও, গেয়ে শোনাও মাকে, শোনাও–
খোকন দু’হাত তুলে এঁকে-বেঁকে নাচতে শুরু করে দিলে। তারপর গান গাইতে আরম্ভ করলে–
আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম
শ্যামের পীরিত গরল মিশ্রিত
করো মুখে যদি শুনিতাম
কুলবতী বালা হইয়া সরলা
তবে কি ও বিষ ভখিতাম।।
গান শুনে ভেতরবাড়ি থেকে আরো অনেকে দৌড়ে এসেছিল। গৌরী পিসী ছেলের বুদ্ধি দেখে আর থাকতে পারলে না। একেবারে দুই হাতে খোকনকে কোলে তুলে মুখময় চুমু খেতে লাগলো। বললে–ওমা, কী চমৎকার গলা খোকন-মণির, বড় হলে খোকন আমাদের বড় গাইয়ে হবে বউদি–
আরো যারা দেখছিল তারাও সবাই একবাক্যে ধন্য-ধন্য করতে লাগলো!
অহঙ্কারে তখন শালাবাবুর বুক দশ হাত হয়ে গেছে। বললে–এবার সেই গানখানা গাওতো খোকন, সেই যেখানা আমি শিখিয়েছি।
–কোন্ গানটা?
–সেই যে–আর নারীরে করিনে প্রত্যয়—
খোকন গাইতে লাগল–
আর নারীরে করিনে প্রত্যয়
নারীর নাইকো কিছু ধর্মভয়
নারী মিলতে যেমন ভুলতে তেমন
দুই দিকে তৎপর
মজিয়ে পরে চায় না ফিরে
আপনি হয় অন্তর—
শালাবাবু নিজেই গানের তারিফ করতে লাগলো। বললে—বাঃ বাঃ বাঃ—
কিন্তু হঠাৎ হরনারায়ণ ঘরে ঢুকলেন। বললেন–কে গান গাইছিল, খোকা না?
শালাবাবু বললে–হ্যাঁ জামাইবাবু,আপনি আর একবার শুনবেন গানটা?
হরনারায়ণ বললেন–না, ও সব গান ওকে কে শিখিয়েছে?
শালাবাবু বললে–কবির গান শুনতে নিয়ে গিয়েছিলুম, সেখানে শিখেছে। কী ইটেলিজেন্ট হয়েছে খোকন দেখেছেন! একবার মাত্তোর গানটা শুনেছে, আর সঙ্গে সঙ্গে সুরটা মুখস্থ করে ফেলেছে। আমি তো জামাইবাবু আমার বাপের জন্মে এমন ইনটেলিজেন্ট ছেলে দেখি নি, ভেরি ভেরি ইনটেলিজেন্ট বয়–
প্রকাশের সামনে হরনারায়ণ কিছু বললেন না বটে, কিন্তু রাত্রে শোবার ঘরে এসে স্ত্রীর কাছে মুখ খুললেন। বললেন–খোকনকে কি তুমি প্রকাশের সঙ্গে কবির লড়াই শুনতে পাঠিয়েছিলে?
প্রীতিলতা প্রশ্নটা শুনে একটু অবাক হয়ে গেল। বললে–কেন বলো তো?
–না, তাই জিজ্ঞেস করছি। যে-সব গানগুলো খোকন গাইছিল, এগুলো তো খুব ভালো গান নয়। বাবা শুনলে রাগ করবেন। খোকনকে আর যার-তার সঙ্গে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে দেওয়া ঠিক নয়। অভ্যেস খারাপ হয়ে যাবে–
প্রীতিলতা বললে–কীসের অভ্যেস?
–ওই সব বাজে গান গাওয়ার অভ্যেস।
প্রীতিলতা বললে–ছেলেমানুষ গান শুনেছে আর শিখে ফেলেছে, এতে অভ্যেস খারাপ হবার কী আছে? তোমার সবতাতেই বাড়াবাড়ি। ছেলেমানুষ একটু গান গাইলেই দোষ?
হরনারায়ণ এর পরে আর ও-বিষয়ে কোনও কথা বললেন না। আর তা ছাড়া এ নিয়ে মাথা ঘামানোর মত বেশি সময়ও ছিল না তার। কিন্তু মনে মনে কেমন যেন, চিন্তিত হলেন।
সেদিন খোকনের আর একটা বুদ্ধির অকাট্য প্রমাণ দিলে প্রকাশ। দিদির কাছে খোকনকে নিয়ে এসে বললে–উঃ, তোমায় কী বলবো দিদি! খোকন একটা জিনিয়াস হবে নির্ঘাত, দেখে নিও–
দিদি বুঝতে পারলে না। বললে–জিনিয়াস! তার মানে?
–মানে একটা ধুরন্ধর প্রতিভা।
–কেন, আবার কী করেছে?
–আরে কৈলাস গোমস্তার হুঁকোটো ছিল চণ্ডীমণ্ডপে, কলকেতে তখনও আগুন জ্বলছে। ও একটানে হুঁকো থেকে ধোঁয়া টেনে নাক দিয়ে বার করে ছেড়েছে—
দিদিও অবাক ছেলের বুদ্ধির বহর দেখে। বললে–তাই নাকি?
–হ্যাঁ দিদি, আমি কাণ্ড দেখে তো অবাক। আমি এই বলে দিচ্ছি দিদি, এ ছেলে তোমার বংশের নাম রাখবে, এমন বুদ্ধি আমি বাপের জন্মে কারো দেখি নি, সত্যি–
দিদি খোকনের দিকে চেয়ে বললে–হ্যাঁ রে খোকন, তোর কাশি হলো না?
খোকন ঘাড় নাড়লে। বললে—না–
বলিস কী? একটুও কাশি হলো না?
খোকন গর্বের সঙ্গে ঘাড় নেড়ে আবার বললে—না–
গৌরী পিসীও এসে দাঁড়িয়েছিল। সেও শুনে বললে–না বউদি, আমি তোমাকে বলেছিলুম এ ছেলে তোমার একটা কেষ্ট-বিষ্টু না হয়ে যায় না
রাত্রে হরনারায়ণ ঘরে আসতেই প্রীতি বললে–ওগো, খোকনের কী বুদ্ধি জানো?
হরনারায়ণ বললেন–কী?
–আজকে গোমস্তা মশাইএর হুঁকো টেনে খোকন নাক দিয়ে গল্-গল্ করে ধোঁয়া ছেড়েছে, একটুও কাশে নি!
খোকন পাশেই ছিল। সেও বাবার দিকে চেয়ে বললে–হ্যাঁ বাবা, আমি একটুও কাশি নি–
হরনারায়ণ কথাটা শুনে কিন্তু হাসতে পারলেন না। আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। স্ত্রীর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন–কে ওকে হুঁকোয় মুখ দিতে বলেছিল?
স্ত্রী বললে–কে আবার বলবে, ও নিজেই মুখ দিয়েছে।
–কিন্তু ওর সঙ্গে কেউ ছিল?
স্ত্রী বললে–হ্যাঁ, প্রকাশ সঙ্গে ছিল, সে সাক্ষী আছে, সে নিজের চোখে দেখেছে–
হরনারায়ণ এ-কথার কোনও উত্তর দেওয়া দরকার মনে করলেন না। তবে আরো যেন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পরের দিনই কেষ্টগঞ্জের স্কুলের হেডমাস্টার মশাইকে বাড়িতে ডেকে পাঠালেন।
এই সেই প্রকাশ রায়। এককালে এই প্রকাশ রায় যখন-তখন হুট করে এই নবাবগঞ্জে আসতো। আসতো আর নবাবগঞ্জের মানুষজনদের কাছে রাজা-উজির মারতো। ভাগ্নেকে নিয়ে যাত্রা শুনতে যেত, কবির গান শুনে তারিফ করতো। ভাগ্নেকে গান শেখাতো, তামাক খেতে তালিম দিত। তা সে-সব অনেক দিন আগেকার কথা। তারপর সেই নরনারায়ণ চৌধুরী মারা গেলেন, সেই দিদিও আর নেই। আর সেই ভাগ্নে সদানন্দও তখন নেই। ছিল মাত্র এক জামাইবাবু, এবার সেই জামাইবাবুও চলে গেল। প্রকাশ রায়ের সময় এখন খারাপ পড়েছে। সেই খারাপ-সময়ের সুরাহা করতেই প্রকাশ রায় আবার এসেছে রেলবাজারে।
সামনেই বাস দাঁড়িয়ে ছিল। আগে এই রাস্তাটুকু বরাবর হেঁটেই মেরে দিয়েছে সে। কিন্তু এখন বয়স হয়েছে। এখন গতরও আগের চেয়ে অনেক ভারি হয়েছে। সোজা বাসের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন–নবাবগঞ্জে যাবে ভাই, নবাবগঞ্জে?
নবাবগঞ্জে যাবে না। মুবারকপুর থেকে হাঁসখালি চলে যাবে—
–মবারকপুর কত ভাড়া?
–কুড়ি পয়সা।
–কুড়ি পয়সা! কুড়ি পয়সায় এক কাপ চা, আর দুটো সিগারেটও হয়ে যেত। যা গে, কপালে পয়সা নষ্ট আছে, কে খণ্ডাবে? ঠিক আছে, মবারকপুরেই নেমে যাবে সে। প্রকাশ রায় সুটকেসটা নিয়ে বাসে উঠে পড়লো।
মবারকপুরে বাস থেকে নেমে প্রকাশ রায় যখন নবাবগঞ্জে এল তখন আরো বেলা বেড়েছে। নবাবগঞ্জে সেদিন হাটবার। কিন্তু হাট বসতে বসতে সেই যার নাম বেলা দেড়টা। সকাল বেলার দিকে তেমন লোকজন থাকে না। কিন্তু যত বেলা বাড়ে তত চারিদিকের গ্রাম গঞ্জ থেকে ব্যাপারী-চাষা-খদ্দের এসে জোটে। আর আসে ভেনডাররা। কলকাতার কোলে-মার্কেট থেকে সোজা চলে আসে কেষ্টগঞ্জে। কেউ-কেউ নামে মদনপুরে, কেউ আড়ংঘাটায়, আবার কেউ বগুলায়। বেগুন, মূলো, পটল, কপি, কিম্বা আম-কাঁঠাল কিনে ঝুড়ি ভর্তি করে ট্রেনে চাপিয়ে সোজা শেয়ালদা। সেখান থেকে কোলে-মার্কেট।
তখন হাটে আসে ডাক-পিওন। আসে মবারকপুরের ডাক্তার কার্তিকবাবু। আসে কেষ্টগঞ্জ ইস্কুলের হেডমাস্টার। কেউ আসে সাইকেলে চড়ে, কেউ চলে আসে হেঁটে, আবার কেউ বা বাসে চড়ে। এক হপ্তার বাজারটা হয়ে যায় নবাবগঞ্জের হাট থেকে।
–সপ্তাহের ওই দিনটা শুধু হাট করার দিন নয়, পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ করবার দিনও বটে। এ সেই নরনারায়ণ চৌধুরীর আদি আমল থেকেই এমনি চলে আসছিল। বলতে গেলে তিনিই এই হাট বসান এখানে। আগে নবাবগঞ্জের লোকজন বড়-হাট করতে যেত সেই রেলবাজারে আর নয়তো বাজিতপুরে। অবশ্য হাট করার রেওয়াজ তখন এত ছিল না। আলুটা রেলবাজার থেকে নিয়ে এলেই হতো। আলু আর কেরাসিন। বাকি শাক-পাতা-মাছ ওই নবাবগঞ্জের ঘরে বসেই মিলতো সকলের। মালোপাড়া থেকে আসতো মাছ বিক্রি করতে। আর যার যার বাড়ির উঠোনে গজাতে শাক পাতা-কলা-মুলো। তখন কর্তাবাবু নতুন করে বাড়ি করেছেন। পাকা দোতলা বাড়ি। কৃষাণ খাতক ব্যাপারী মহাজন দর্শনার্থী প্রার্থী নানা লোকের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। নবাবগঞ্জের নামধাম হয়েছে এ দিগরে। তিনি বললেন,–এ কী কথা, নবাবগঞ্জে হাট নেই, এটা তো ভালো কথা নয়! দশটা গ্রামে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে জানান দিয়ে দিলেন যে, এবার থেকে প্রত্যেক শনি-মঙ্গলবারে নবাবগঞ্জের বারোয়ারি-তলায় হাট বসবে। ব্যাপারীরা যারা হাটে বেচা-কেনা করতে আসবে, জমিদার তাদের কাছ থেকে কোনও তোলা নেবেন না, ব্যাপারীদের কাজ-কারবারে সব রকমের সুবিধে দেওয়া হবে।
যতদিন কর্তাবাবু ছিলেন ততদিন তিনি দেখে গেছেন নবাবগঞ্জের শনি-মঙ্গলবারের হাট বেশ জমজমাট হয়ে চলছে। তারপর কর্তাবাবুর ছেলে হরনারায়ণের আমলেও হাট রমারম হয়ে উঠেছে। হাটে আরো ব্যাপারী আরো খদ্দের আরো দূর-দূর দেশ থেকে এসে জড়ো হয়েছে। সেই কর্তাবাবু আজ নেই, সেই কর্তাবাবুর ছেলে হরনারায়ণ চৌধুরীও আজ আর নেই। এমন কি হরনারায়ণ চৌধুরীর অত যে আদরের ছেলে, সেও আর নবাবগঞ্জে নেই। ওই হাটের দিন সদানন্দ আসতো দীনুর সঙ্গে, কৈলাস গোমস্তাও আসতো এক-একদিন। কৈলাস গোমস্তা আসা মানেই স্বয়ং হরনারায়ণ চৌধুরীর আসা। কৈলাস গোমস্তা হাটে এলে কারো কোনও জিনিসের জন্যে দরদস্তুরের প্রয়োজন হতো না। অনেক সময় সঙ্গে কর্তাবাবুর নাতি সদানন্দ আবদার ধরতো–কৈলাস কাকা, আমি বেলুন নেব–
রেলবাজার থেকে রবারের বেলুন নিয়ে এসে বেচছিল কপিল পায়রাপোড়া। আবদারের কথা শুনেই সে বললে–এই ন্যান্ গোমস্তা মশাই, খোকাবাবুর জন্যে বেলুন ন্যান্–
কৈলাস গোমস্তা বেলুন নিলে।
জিজ্ঞেস করলে–কত দাম রে কপিল?
কপিল পায়রাপোড়া বললে–দামের কথা বলে লজ্জা দেবেন না গোমস্তা মশাই, আমি খোকাবাবুকে এমনই খেলতে দিলুম–
–খেলতে দিলুম মানে? খোকাবাবু তোর কাছে ভিক্ষে নেবে নাকি? খোকাবাবুর পয়সার অভাব?
কপিল পায়রাপোড়া বললে–আজ্ঞে, বাবুদের খেয়ে পরেই তো আমরা বেঁচে আছি, খোকাবাবু খেলতে চেয়েছেন তাই দিলুম ওনাকে—
বেলুন পেয়ে মহাখুশী সে। দীনুমামা আর কৈলাস কাকার সঙ্গে সারা হাট ঘুরতে লাগলো বেলুন নিয়ে। সদানন্দ যেখানে যায়, তার সঙ্গে সঙ্গে বেলুনও মাথার ওপর চলতে থাকে। সেই বেলুন নিয়েই কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল। বাড়ির ভেতর মাকে গিয়ে বেলুন দেখালে, চণ্ডীমণ্ডপে বাবাকে গিয়ে দেখালে। কাছারি বাড়িতে কর্তাবাবুকে গিয়ে দেখালে। যেন এক মহা সম্পত্তি পেয়েছে সে। বাড়িময় তার বেলুন নিয়ে খেলা। কিন্তু পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখলে সেটা চুপসে গেছে। তখন শুরু হলো নাতির কান্না।
কর্তাবাবুর কানে কান্না যেতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন–খোকা কাঁদে কেন রে? কী হয়েছে? মেরেছে নাকি কেউ?
দীনু বললে–আজ্ঞে, খোকাবাবুর বেলুন চুপসে গেছে…
শেষ জীবনে কর্তাবাবু নাতি-অন্ত প্রাণ হয়ে গিয়েছিলেন। যে বায়না ধরতো তাই-ই যোগান দিতেন। কখনও বেলুন, কখনও পাখি, কখনও ঘুড়ি, কখনও সাইকেল। সুদখোর মানুষ কারো সুদের একটা পয়সা ছাড়তেন না। কিন্তু নাতির জন্যে যত টাকাই হোক তার খরচ হওয়াটাকে খরচ বলে কখনও মনে করতেন না।
বলতেন–আহা, ছোটো ছেলে, আবদার ধরেছে, দাও না ওকে কিনে—
বাবা বলতো–আদর দিয়ে দিয়ে কর্তাবাবুই খোকার সর্বনাশ করবেন দেখছি–
তা কান্নাকাটির কারণ শুনে কর্তাবাবু তখনই লোক পাঠালেন রেলবাজারে। দীনু গেল সেখানে। নাতির আবদার রাখবার জন্যে একটা লোক পাঁচ ক্রোশ হেঁটে দু-পয়সার একটা বেলুন কিনে নিয়ে এল। তখন নাতি ঠাণ্ডা। তখন আবার তার মুখ দিয়ে হাসি বেরোল। তখন আবার সেই বেলুন নিয়ে সারা বাড়িময় মাতামাতি চললো।
কর্তাবাবুর কাছে দীনু আসতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন–এনেছিস, বেলুন এনেছিস?
দীনু বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ–
–খোকাকে দিয়েছিস?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, দিইছি–
–কত দাম নিলে?
–আজ্ঞে দু’পয়সা।
দু’পয়সা! দু’পয়সা দাম শুনেই চমকে উঠলেন কর্তাবাবু। বললেন–সেদিন কপিল পায়রাপোড়া যে কৈলাসের কাছে চার পয়সা নিয়েছিল!
তবু সন্দেহ হলো। হিসেবের খাতাটা বার করে দেখে নিলেন। হাটে যা কিছু কেনা কাটা হতো তার হিসেব দিতে হতো কর্তাবাবুর কাছে। তিনি সেগুলো নিজের হাতে লিখে সিন্দুকের মধ্যে খাতাটা রেখে দিতেন। হিসেবের খাতায় স্পষ্ট লেখা হয়েছে কপিল পায়রাপোড়ার কাছে চার পয়সা দিয়ে খোকার জন্যে বেলুন কেনা হয়েছে। ডাকলেন– কৈলাস? কৈলাস কোথায় গেল?
কৈলাস গোমস্তা এল। কর্তাবাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন–কৈলাস সেদিন কপিল পায়রাপোড়ার কাছে তুমি বেলুন কিনেছিলে ক’পয়সা দিয়ে?
–আজ্ঞে, আপনাকে তো আমি খরচের হিসেব দিয়েছি।
কর্তাবাবু বললেন–তুমি বলেছ চার পয়সা। আমার খাতাতেও তাই-ই লেখা রয়েছে। কিন্তু আজ দীনু রেলবাজার থেকে খোকার জন্যে আর একটা বেলুন কিনে এনেছে–সেটা দু’পয়সা নিয়েছে। কপিল পায়রাপোড়া লোকটা তো দেখছি চোর। আমাকে দু’পয়সা ঠকিয়ে নিয়েছে। এ কি মগের মুলুক পেয়েছে। আমার পয়সা কি সস্তা ভেবেছে সে!
কৈলাস গোমস্তা সবিনয়ে বললে–আজ্ঞে হুজুর, কী আর বলবো, আজকাল পৃথিবীতে কাউকে বিশ্বাস নেই, সব বেটা চোর।
কর্তাবাবু বললেন–তা চোর বললে তো আমি শুনবো না, চুরি করতে হয় অন্য কারো বাড়িতে সিঁধ কাটো, তা বলে আমার বাড়িতে? সে পেয়েছে কী? ভেবেছে আমি ধরতে পারবো না? আমি বোকা? আর আমার পয়সা বুঝি পয়সা নয়? আমাকে বুঝি মুখে রক্ত উঠিয়ে টাকা উপায় করতে হয় নি?
তারপর একটু থেমে বললেন–ওর কাছে জমি-জমা কী আছে আমার?
কৈলাসের হিসেব সবই মুখস্থ থাকে। বললে–বিলের ধারে এক লপ্তে তিন বিঘে ওর ভাগে আছে, আর ওর কাকার ভাগে বাকি সাত বিঘে–
–ওর আর কী কী সম্পত্তি আছে?
–সম্পত্তি বলতে ওই আমাদের তিন বিঘে জমিই ওর ভরসা। ওতে ওর সারা বছর চলে না। মা-ষষ্ঠীর কৃপায় আবার ওর সংসারও অনেক বড়। একটা বউ মরে যাবার পর আবার নতুন করে একটা বিয়েও করেছে। ও-পক্ষের তেরটা আণ্ডা-গ্যাণ্ডা, তার ওপর এ পক্ষেরও একটা মেয়ে হয়েছে সম্প্রতি–
কর্তাবাবু বললেন– তাহলে তো খুব কষ্টেসৃষ্টে চালায়। খাজনা ঠিক সনসন দিয়ে যাচ্ছে তো?
–আজ্ঞে, দিতে পারবে কী করে? দু’এক সন মাঝে-মাঝে বাকি পড়েও যায়। খুব ধমক টমক দিলে তখন গরু বাছুর বেচে জমিদারের পাওনা-শোধ করে কোনও রকমে। সেইজন্যেই তো হাটবারে কখনও বেলুন কখনও বিস্কুট-ল্যাবেনচুষ নিয়ে বসে, তাতে যা দু’পয়সা হয়–
কর্তাবাবু বললেন–তা বলে আমাকে ঠকাবে? আমারই খাবে পরবে আবার আমাকেই ঠকাবে? এ তো ভালো কথা নয়। তুমি ওর জমি খাস করে নাও–
–খাস করে নেব?
–হ্যাঁ হ্যাঁ, খাস করে নেবে! আমি অত দয়ার অবতার হতে পারবো না। আমার অত পয়সা নেই। আজই খাস করে নেবে–বুঝলে?
তা সেইদিনই খবর গেল কপিল পায়রাপোড়ার কাছে। সে তখন সারা দিনের খাটুনির পর তার বাড়ির চাতরায় ভাত খেতে বসেছে। খবরটা শুনেই খাওয়া তার মাথায় উঠলো। খাওয়া ফেলে তখনই ছুটলো কাছারিতে। কৈলাস গোমস্তা তাকে বললে–তা আমি কী করবো বাপু, আমার কি জমি? যাঁর জমি তিনি যদি হুকুম করেন তো আমি কী করতে পারি? তুই কর্তাবাবুর কাছে গিয়ে তোর আর্জি পেশ কর গে–
কপিলের তখন মাথায় বজ্রাঘাত। বললে–আপনিই সব গোমস্তা মশাই, আপনি বললে–কর্তাবাবু জমি ফিরিয়ে দেবেন। ওই জমিটুকু চলে গেলে আমি কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে খাবো কী? আমার সংসার চলবে কী করে?
একটা পাঁচ ফুট লম্বা পুরুষ-মানুষ যে অত গলা ফাটিয়ে হাউ হাউ করে কান্নাকাটি করতে পারে না দেখলে সদানন্দ কল্পনাও করতে পারতো না। বাড়িসুদ্ধ লোক সবাই জানতে পারলো কপিল পায়রাপোড়ার জমি কর্তাবাবু খাস করে নিচ্ছেন। কিন্তু কেন খাস করে নিচ্ছেন তা কেউ জিজ্ঞেস করলে না। সবার কাছেই যেন জিনিসটা স্বাভাবিক। এ তো হবারই কথা। জমিদারের হক আছে জমি খাস করে নেবার। তা সে অন্যায় করুক আর না করুক। খাজনা দিক আর না দিক। আমার মর্জি হয়েছিল তাই তোমায় জমি চাষ করতে দিয়েছিলুম। আবার এখন মর্জি হয়েছে, এখন তোমার কাছ থেকে জমি কেড়ে নেব। জমির মালিক তুমি, না আমি?
সদানন্দ দীনুমামার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে–দীনুমামা, কপিলকে মারছে কেন দাদু?
দীনুমামা বললে–মারবে না? কপিল যে কর্তাবাবুকে ঠকিয়েছে!
–ঠকিয়েছে? কী করে ঠকালো?
–দু’পয়সার বেলুন কেন চার পয়সায় সে বিক্রি করেছে? সেই একই বেলুন আমি রেলবাজার থেকে যে দু’পয়সায় কিনে এনেছি–
সদানন্দ অবাক হয়ে গেল। বললে–কই, বেলুন তো কপিল বেচে নি। আমি বেলুন নেব বলে আবদার ধরেছিলুম বলে ও তো মাগনা দিয়ে দিলে। পয়সা তো নেয় নি ও। আমি নিজের চোখে যে দেখেছি, আমি তো তখন হাটে ছিলুম–
কিন্তু দীনুর কাছ থেকে কোনও প্রতিকার পাবে না জেনে আর সেখানে অপেক্ষা করলে না। একেবারে সোজা দাদুর ঘরে গিয়ে পৌঁছোল। সেখানে তখন বীভৎস কাণ্ড চলছে। ঘরের মধ্যে দাদু নিজের লোহার সিন্দুকটার পাশে বসে আছে, আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে কৈলাস কাকা। আর তাদের সামনে বংশী ঢালী কপিল পায়রাপোড়ার মাথার চুলের ঝুঁটি ধরে আছে আর বলছে–বল, কর্তাবাবুকে কেন ঠকালি বল–
কিন্তু কপিল বলবে কী? তাকে কথা বলবার ফুরসৎই দিচ্ছে না বংশী ঢালী। এক হাতে চুলের ঝুঁটি ধরে অন্য হাতে পটাপট মুখে ঘুষি মেরে চলেছে। আর দাদু বংশীকে উৎসাহ দিয়ে চলেছে–মার মার বেটাকে, মেরে ফেল, আমার সঙ্গে শয়তানি, আরো মার–
সদানন্দ আর থাকতে পারলে না। একেবারে ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়লো দাদুর সামনে। বললে–দাদু, ওকে মারছো কেন? ও তো বেলুনের দাম নেয় নি, অমনি দিয়েছে। ওই তো কৈলাস কাকা জানে, কৈলাস কাকাকে জিজ্ঞেস করো না–ও কৈলাস কাকা, তুমি বলছো না কেন, ও কৈলাস কাকা–
কিন্তু কর্তাবাবু বিরক্ত হয়ে উঠলেন নাতির কথায়। প্রথমটায় তিনি যেন একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলে উঠলেন–আরে, এখানে তুই এলি কেন? ও দীনু, দীনু কোথায় গেলি? ও দীনু, খোকাকে এখানে আসতে দিলি কেন, ওরে দীনু ওকে নিয়ে যা এখেন থেকে–
সদানন্দ নাছোড়বান্দা। বললে–আমি যাবো না এখান থেকে, আগে তুমি আমার কথার জবাব দাও
সদানন্দও যাবে না, কর্তাবাবুও ছাড়বে না। ততক্ষণে দীনু এসে গেছে। এসে জোর করে হাত ধরে টানতে টানতে চ্যাংদোলা করে সদানন্দকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল। কিন্তু তখনও ঘরের ভেতর থেকে কপিলের কান্নার আওয়াজ তার কানে আসছিল।
.
এ-সব কতকালকার আগেকার কথা। তবু সদানন্দর যেমন মনে আছে, নবাবগঞ্জের সেকালের যারা আজো বেঁচে আছে তাদেরও মনে আছে। মনে আছে শেষকালে ছেলে মেয়ে-বউকে খেতে না দিতে পেরে সেই কপিল পায়রাপোড়া একদিন নবাবগঞ্জ থেকে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল কেউ টের পেলে না। কপিল পায়রাপোড়ার কাকা প্রথমে কিছুদিন তার ছেলে-মেয়েদের দেখেছিল। তারপর দেখা গেল একদিন ওই বারোয়ারি-তলার বটগাছের ডালে কপিলের ধড়টা ঝুলছে। একটা গরু বাঁধা দড়ি দিয়ে গলাটা বেঁধে কখন হয়ত ঝুলে পড়েছিল কেউ দেখতে পায় নি।
তারপর পুলিস-থানা-দারোগা-কোর্ট-কাছারি অনেক কিছু হলো তাই নিয়ে। আবার সে ঘটনার ঢেউ একদিন থেমেও গেল। কিন্তু সদানন্দর মন থেকে তা আর মুছলো না।
এ-সব ছোটখাটো ঘটনা। কিন্তু ছোটখাটো ঘটনাগুলোই সদানন্দর মনের ভেতরে জমে জমে পাহাড় হয়ে উঠতে লাগলো। প্রকাশ মামা জিজ্ঞেস করতো–হা রে, তুই কী ভাবিস রে এত?
তখন সদানন্দ একটু বড় হয়েছে। বলতো–আচ্ছা মামা, তোমার এই সব ভালো লাগে?
প্রকাশ মামা তো অবাক। সে শুধু জানে ফুর্তি করা আর খাওয়া-দাওয়া হই-হুল্লোড় করে কাটিয়ে দেওয়া। ভালো খাও, ভালো পরো, দু’হাতে টাকা উপায় করো আবার দুই হাতে সেই টাকা খরচ করো। ভাগ্নের কথা শুনে বললে–কী ভালো লাগে?
সদানন্দ বললে–এই তুমি যা করো সারাদিন?
–আমি সারাদিন কী করি?
–এই আরাম করে খাও, বারোয়ারিতলায় গিয়ে আড্ডা দাও, তাস খেলো, তারপর গাণ্ডে-পিণ্ডে খাও। খেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোও, তারপরে ঘুম থেকে উঠে সন্ধ্যেবেলা এ-গাঁ ও-গাঁ করে বেড়াও; আর তারপর রাত্তিরে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়ো।
প্রকাশ মামা বললে–আমি যা করি এ তো সবাই করে রে। কেন, এতে দোষটা কী? আমি চুরিও করছি না কারো, বাটপাড়িও করছি না। আমার বাপ-কাকা-জ্যাঠা চোদ্দ পুরুষ চিরকাল এই জিনিসই করে এসেছে, আবার আমিও তাই করবো। আবার তুইও যখন বড় হবি তখন তুইও তাই করবি। এই-ই তো নিয়ম রে–
সদানন্দ বললে–কিন্তু আমার যে ও-সব করতে ভালো লাগে না মামা। জানো, কপিল পায়রাপোড়াকে তুমি চিনতে?
–কপিলকে? সেই শয়তানটাকে? চিনবো না? ব্যাটা এক নম্বরের আহাম্মক ছিল একটা। শেষকালে তাই অপঘাতে মরতে হলো। যেমন কম্ম তেমনি ফল!
সদানন্দ বললে–-দেখ প্রকাশ মামা, আজকাল সবাই তার কথা ভুলে গেছে। আমার বাবা-মা কারোরই হয়ত মনে নেই। আমার দাদুরও হয়ত মনে নেই তার কথা। ওই বারোয়ারীতলায় যখন সে আত্মঘাতী হলো সবাই-ই তা দেখেছে। দেখে সবাই-ই শিউরে উঠেছে। কিন্তু আজকে আর কারো সে-কথা মনে নেই, জানো–
প্রকাশ মামা হো হো করে হেসে উঠলো। বললে–তুই তো দেখছি একটা আস্ত পাগল রে, অত কথা মনে রাখতে গেলে মানুষের চলে! সংসারে একদিন তো সবাই মরবে। সকলেরই বাবা মরবে, ঠাকুর্দাদা মরবে, মা মরবে। প্রথম প্রথম লোকে সেজন্যে একদিন কাঁদবে। কিন্তু তারপর? তারপর বেশি কান্নাকাটি চালিয়ে গেলে সংসার চলে? আমার তো বাবা-মা যাবার পর খুব কেঁদেছিলাম, তা এখন কি আর কাঁদছি? আমায় কাঁদতে দেখেছিস কখনও সেজন্যে? তুই যে আমাকে অবাক করলি সদা!
সদানন্দ বললে–কিন্তু মামা, আমি কেন কিছুই ভুলতে পারি না। আমার কেন সব মনে থাকে? কপিল পায়রাপোড়ার কথা আমার সব সময়ে যে মনে পড়ে। রাত্তিরে শুয়ে-শুয়ে ভাবি, দিনের বেলা ইস্কুলে পড়তে পড়তে ভাবি, ভাত খেতে খেতে ভাবি…
প্রকাশ মামা ভাগ্নের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। বললে–এই রে খেয়েছে…
সদানন্দ বললে––কেন? কী করলুম আমি?
–তোর তো দেখছি মাথা খারাপের লক্ষণ! এ তো ভালো কথা নয়! ডাক্তার দেখাতে হয়–
সদানন্দ বললে–কিন্তু সে তো কোনও দোষ করে নি মামা। তাকে যে দাদু মিছিমিছি মারলে। বংশী ঢালীকে দিয়ে বেকসুর অপমান করলে। সে তো কিছু করে নি
প্রকাশ মামা যেন সব ভেবে-চিন্তে একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে এসেছে। বললে–নাঃ, এবার জামাইবাবুকে তোর বিয়ের কথা বলতে হবে দেখছি।
–বিয়ে? বিয়ে আমি করবো না মামা।
–সে কী রে? তুই ঠাকুর্দার সবেধন নাতি, বাপের চোখের মণি একমাত্র ছেলে। বিয়ে করবি না? তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? জানিস তোর মতন পাত্তোর পেলে মেয়ের বাপরা লুফে নেবে?
সদানন্দর ও-সব কথা ভালো লাগতো না। বিকেল বেলা যখন ইস্কুল থেকে হেঁটে-হেঁটে আসতো, এক-একদিন শীতের দিনে বাড়ি আসতে আসতে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসতো। তখন মনে হতো কে যেন তার পেছনে-পেছনে আসছে। শুকনো পাতার ওপর হাঁটতে যেমন মড়মড় শব্দ হয় তেমনি শব্দ করতে করতে তার পিছু পিছু আসছে কেউ। অনেক দিন মনে হয়েছে গাঁয়েরই কোনও লোক ক্ষেত-খামার থেকে ফিরছে। কিংবা কোনও বাড়ির বউ গাঙ থেকে জল নিয়ে ফিরছে। না, তা নয়, অনেক সময় রাস্তার আশেপাশে-সামনে-পেছনে কাছে-দূরে কেউ-ই থাকে না, অথচ কে যেন তার পেছনে-পেছনে হাঁটে।
একদিন ধরে ফেলেছিল। লোকটা একেবারে আসতে আসতে তার গায়ে এসে পড়েছিল। সদানন্দ চমকে উঠেই চেঁচিয়ে উঠেছে–কে?
–আমি!
‘আমি’ কথাটা কেউ বললে কিনা বুঝতে পারলে না সে। কিংবা হয়ত তার নিজের মনের আতঙ্কটাই শব্দ হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সে এক মুহূর্ত। এক মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে দিয়ে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু সেই অদৃশ্য হওয়ার আগেই যেটুকু দেখতে পেলে তাতে মনে হলো সে আর কেউ নয়, সে হলো কপিল পায়রাপোড়া।
ঘটনাটা প্রকাশ মামাকে বলতেই প্রকাশ মামা আর দেরি করলে না। সোজা জামাইবাবুর কাছে চণ্ডীমণ্ডপে চলে গেল। বললে–জামাইবাবু, সদার বিয়ে দিতে হবে–
–বিয়ে! জামাইবাবু কথাটা শুনে প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিল। দিদিও তেমনি। বিয়ে তো সদার দিতেই হবে। তা বলে এখনি? এত তাড়াতাড়ি?
প্রকাশ বললে–বিয়ে না দিলে তোমার ছেলে শেষকালে সন্নিসী হয়ে বনে চলে যাবে, তখন ঠ্যালা বুঝবে–
তা প্রকাশের কথায় কেউ কান দেয় নি। গরীবের কথায় প্রথমে কেউ কান দেয়ও না তেমন। তাই কথায় আছে গরীবের কথা বাসি হলে তবে লোকে তার দাম দেয়। শেষকালে কর্তাবাবু যখন কথাটা তুললেন তখন সকলের টনক নড়লো। আর কর্তাবাবুর তখন দুটো পা-ই পড়ে গেছে। একেবারে পঙ্গু। সিন্দুকটার কাছে শুয়ে শুয়েই দৈনন্দিন কাজকর্ম চালান। তার ইচ্ছে চোখ বোজবার আগে তিনি নাতির ছেলের মুখ দেখে যেতে চান। দেখে যেতে চান যে তার বংশের ধারা অক্ষয় হয়ে রইল।
কথাটা শালাবাবুর কানে যেতেই সে লাফিয়ে উঠেছে। দিদির টাকায় সে বসে বসে খায় আর তার বদলে একটু কিছু উপকারও করতে পারবে না? দিদির উপকার করবার সুযোগ পেয়ে সে যেন বেঁচে গেল।
বললে–কুছ পরোয়া নেই, কী রকম পাত্রী চাই সেইটে শুধু আমায় বলে দাও–
কর্তাবাবুর হুকুম পাত্রী হবে ডানা কাটা পরী। ডানা কাটা পরী মানে পরীর মতন দেখতে শুনতে বলতে কইতে হওয়া চাই, শুধু পরীদের যে ডানা থাকে সেটা থাকবে না।
–আর?
–আর পরীর মতন উড়লে চলবে না।
প্রকাশ বললে–তা ডানাই যদি না থাকে তো উড়বে কেমন করে? আর যদি উড়তে চায় তো তুমি না হয় তার পায়ে শেকল লাগিয়ে দিও।
দিদি হাসতে লাগলো। বললে–আজকালকার মেয়ে কি শেকল মানবে ভাই?
হয়ত শ্বশুর-শাশুড়ীকেই মানতে চাইবে না। এ তো আর আমাদের কাল নয়। আমাদের দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, তখন কোমর থেকে কাপড়ের কষি খুলে যেত, শাশুড়ী তাই শেষকালে গেরো দিয়ে বেঁধে দিত তবে লজ্জা রক্ষে হতো–
প্রকাশ বললে–তাহলে সেই রকম দশ বছরের মেয়েই এনে দেব–তুমি যেমন অর্ডার দেবে, তেমনি বউ পাবে–
দিদি বললে–তাই দে ভাই, নইলে কর্তাবাবু আবার কবে আছেন কবে নেই, একটু শিগগির শিগগির কর তুই–
তা শেষ পর্যন্ত সেই রকম মেয়েই পাওয়া গেল। বয়েসও কম, দেখতেও ডানাকাটা পরী। আরও একটু বয়েস কম হলে অবশ্য ভালো হতো। কিন্তু ঠিক তোমার অর্ডার মাফিক পাত্রী কোথায় পাবো? তাহলে তো কুমোরকে ডেকে ফরমায়েশ করতে হয়। কৃষ্ণনগরের কাছে বাড়ি। বাপ পণ্ডিত। সংস্কৃত শাস্ত্র জানা মানুষ। স্বামী আর স্ত্রী, আর সংসার বলতে ওই একটি মেয়ে। সেকালে পূর্বপুরুষকে দেওয়া রাজাদের দু’শো বিঘের মত জমি-জমা আছে। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার। নগদ কিছু দিতে পারবো না। যদি মেয়ে পছন্দ হয় তো রাঙা সুতো হাতে দিয়ে নিয়ে যান। তারপর মেয়ের ভাগ্য আর ঈশ্বরের ইচ্ছে।
এই-ই হলো নয়নতারা। এ গল্পের আসামী সদানন্দ চৌধুরীর স্ত্রী। আমাদের নায়িকা।
প্রকাশ রায় এই নতুন বিয়ের কনে নয়নতারাকে নিয়ে এই রাস্তা দিয়েই একদিন নবাবগঞ্জে এসেছিল। নবাবগঞ্জের জমিদার নরনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ি যেতে গেলে এই বারোয়ারিতলার হাটের মধ্যে দিয়েই যেতে হয়। এই রাস্তা দিয়েই একদিন নয়নতারা চৌধুরীবাড়ির বউ হয়ে এসেছিল, আবার ঠিক সেই বধূ বেশেই এই রাস্তা দিয়েই চলে গিয়েছিল। এই রাস্তা দিয়েই একদিন সেকালের এক সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামী পরিবারে চূড়ান্ত সমৃদ্ধি এসে উদয় হয়েছিল, আবার নয়নতারার সঙ্গে সঙ্গে এই রাস্তা দিয়েই তা অস্ত গিয়েছিল চিরকালের মত। এই-ই সেই চিরকালের উদয়-অস্তের শাশ্বত পথ, সেই রেলবাজার থেকে নবাবগঞ্জের বারোয়ারিতলার হাট পর্যন্ত। এবার সেই ঘটনার কতকাল পরে প্রকাশ রায় আবার উদয় হলো এই নবাবগঞ্জে। মোবারকপুরে বাস থেকে নেমে পায়ে হাঁটা পথে। এখন আর আগেকার সেই মোবারকপুর নেই। সেই মোবারকপুর কেন, সেই নবাবগঞ্জও নেই। নবাবগঞ্জে চৌধুরীদের সেই বাড়িটাও আর চৌধুরীদের নেই। নরনারায়ণ, হরনারায়ণ, চৌধুরীবাড়ির গিন্নি, প্রকাশ রায়ের দিদি, তারাও কেউ নেই। একদিন রেলবাজারের পাটের আড়তদার প্রাণকৃষ্ণ শা’ মশাই জলের দরে অত বড় তিনমহলা বাড়িটা কিনে নিলে। কিন্তু প্রাণকৃষ্ণ শা’ও তা রাখতে পারলে না। ব্রাহ্মণের সম্পত্তি, বিশেষ করে বসতবাড়ি কিনতে নেই। এমন কি জলের দরে পেলেও না। কিন্তু প্রাণকৃষ্ণ শা’ মশাই সে-কথা শুনলে না। ভাবলে ভারি লাভ করলুম! কিন্তু এখন? সেই প্রাণকৃষ্ণ শা’ও একদিন জন্মাষ্টমীর দিন সাপের কামড়ে অপঘাতে মরলো। তার পর থেকে সেই চৌধুরীবাড়ি এখন ভুতের বাড়ি হয়ে খাঁ খাঁ করছে। দিনের বেলাতেও লোকে সেদিকে মাড়াতে ভয় পায়। বলে–ওবাড়িতে ব্রহ্মদত্যির অভিশাপ আছে, ওদিক মাড়িও না–
পাশের দোকানঘর থেকে কে একজন চেঁচিয়ে উঠলো–মশাই-এর কোত্থেকে আসা হচ্ছে?
প্রকাশ রায় সুটকেসটা নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। বললে–আমি আসছি ভাগলপুর থেকে। এই নবাবগঞ্জ এসেছি একটা কাজে–
–এখানে কার বাড়িতে যাওয়া হবে?
প্রকাশ রায় বললে–কারো বাড়িতে যাবো না, আমি এসেছি সদানন্দর খোঁজে, সদানন্দ চৌধুরী–
সদানন্দ চৌধুরীর নামটা উচ্চারণ করতেই দোকানের আশেপাশে যারা ছিল তারা কাছ ঘেঁষে এসে দাঁড়ালো। এ কোথাকার লোক! কী এর পরিচয়। সদানন্দ চৌধুরীর খোঁজ করে, এ তো সাধারণ লোক নয় হে!
চৌধুরী-মশাই চলে যাবার পর নবাবগঞ্জে কেউ তো সদানন্দ বেঁচে আছে কিনা, খেতে পাচ্ছে কিনা সে-খোঁজও কখনও নেয় নি।
–তা আপনি এতদিন পরে সদার খোঁজ করছেন কেন?
–জিজ্ঞেস করতে এসেছি সে কোথায় আছে আপনারা জানেন কিনা। আমাকে তার সন্ধান দিতে পারেন কিনা। তাকে আমার বড় দরকার–
পরমেশ মৌলিক এতক্ষণ একমনে হুঁকো টানছিলেন। এবার তিনি মুখ খুললেন। বললেন–আপনার নিবাস?
প্রকাশ বললে–ভাগলপুর। আমি হচ্ছি সদানন্দর মামা–
–প্রকাশ মামা? শালাবাবু? তাই বলুন, এতক্ষণ বলেন নি কেন? বসুন বসুন, তা এ কী চেহারা হয়েছে আপনার? চুল পেকে গেছে। ওঃ কতকাল পরে দেখা হলো। তা চৌধুরী-কর্তা কেমন আছেন?
চৌধুরীমশাই মানে হরনারায়ণ চৌধুরী। প্রকাশ রায় বললে–জামাইবাবু গেল হপ্তায় মারা গেছেন।
মারা যাওয়ার খবর শুনেই সবাই যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। বললে–মারা গেছেন?
পরমেশ মৌলিক হরনারায়ণ চৌধুরীর কাছারিতেও কিছুদিন কাজ করেছিলেন। খবরটা শুনে তিনি সকলের চেয়ে বেশি চমকে উঠলেন। বললেন–সে কী? মারা গিয়েছেন? শেষকালে কী হয়েছিল?
প্রকাশ রায় বললে–তেমন কিছুই হয় নি, বেশ ভালোই ছিলেন। কদিন ধরে দেখছিলুম তিনি বাইরে বেরোচ্ছিলেন না, একদিন ঘরের দরজা খুলে দেখি তিনি মরে পড়ে আছেন। কেউ জানতেও পারি নি আমরা…
নতুন লোকের আমদানি দেখে ততক্ষণে আরো কিছু লোক এসে জড়ো হয়েছিল। হরনারায়ণ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর শুনে অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেললে। অনেকেই তাকে দেখেছে। যারা দেখে নি তারা নাম শুনেছে। চৌধুরী বংশের কাহিনী শুনেছে। সেই হরনারায়ণ চৌধুরীর মর্মান্তিক পরিণতির বর্ণনা শুনে সবার মুখ দিয়েই অজান্তে একটা ‘আহা’ শব্দ বেরিয়ে এল। এমনিই হয় গো। যত বড়লোকই হও, সকলের পরিণতি ওই মৃত্যুতে। ওর থেকে কারোর মুক্তি নেই। এই পুরোন কথাটাই যেন আবার সকলের নতুন করে মনে পড়ে গেল।
প্রকাশ রায় বললে–তা এখন সে যা হবার হয়ে গেছে, এখন আমি এসেছি সদাকে খুঁজতে। কোথায় গেলে তাকে পাই বলতে পারেন? কলকাতায় গিয়েছিলাম, সেখানে তারাও তার কোনও সন্ধান জানে না, তাই নবাবগঞ্জে এলাম, এখন এর পর কোথায় গেলে তাকে পাবো তাও বুঝতে পারছি না
পরমেশ মৌলিক বললেন–সদা কি আর বেঁচে আছে? আমার তো বিশ্বাস হয় না। শেষকালের দিকে তার অবস্থা বড় খারাপ হয়েছিল। একদিন মাত্র এসেছিল এ-গাঁয়ে–তাও সে অনেক কাল হলো–
–কেন?
নিতাই হালদার পাশেই দাঁড়িয়ে শুনছিল। সে আর থাকতে পারলে না। বললে–কেন ভালো থাকবে? আপনারা কি তার কোনও খোঁজখবর নিয়েছিলেন? নিজের বাপ যাকে দেখতো না, সে কী করে ভালো থাকবে? তাকে কি কেউ খেতে পরতে দিত? এখন তার বাপ মারা গেছে, তাই সম্পত্তির লোভে তার খোঁজখবর নিতে এসেছেন আপনারা। কিন্তু তখন কোথায় ছিলেন?
পরমেশ মৌলিকও তাই বললেন–হ্যাঁ শালাবাবু, শেষকালের দিকে সদার বড় কষ্টে দিন কেটেছে–অত বড় বংশের ছেলে, তার কিনা এই দশা। শেষকালে একটা যাত্রার দল এসেছিল গাঁয়ে, তাদের পেছন পেছন সে চলে গেল–
প্রকাশ রায় যেন এতক্ষণে খানিকটা সুরাহা পেলে। বললে–যাত্রার দলের সঙ্গে? কোথায় গেল তাদের সঙ্গে?
–তা কি ছাই দেখেছি? যাত্রার দল কি আর এক জায়গায় বসে থাকে শালাবাবু? তারা তো ঘুরে বেড়ায় চারদিকে। আজ আছে হুগলী, কালই হয়ত আবার চলে গেল আসামের দিকে
–তবু একটা আপিস তো আছে তাদের কোথাও। যাত্রাদলের নামটা জানতে পারলেও হয় তাদের হেড-অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতে পারি–
পরমেশ মৌলিক বললেন–কত যাত্রার দলই তো আসে! ও যাদের সঙ্গে গিয়েছিল তাদের নামটা ঠিক মনে ঠিক মনে পড়ছে না।
তারপর অন্য যারা আশেপাশে ছিল তাদের দিকে ফিরে বললেন–তোমরা জানো নাকি হে কেউ নামটা?
নিতাই হালদার পাশেই ছিল। সে আর থাকতে পারলে না। বললে–তা এতদিন কোথায় ছিলেন আপনারা শালাবাবু? এতদিন তো আপনারা একবারও তার খোঁজ নিতে আসেন নি? এখন চৌধুরী মশাই মারা গেছেন তাই তাঁর অগাধ টাকার ওয়ারিশানকে খুঁজে বার করতে এসেছে। আমরা সব বুঝতে পেরেছি–
প্রকাশ রায় কথাগুলো শুনে যেন কেমন চুপসে গেল।
নিতাই হালদার তবু থামলো না। বলতে লাগলো–চৌধুরী মশাই-এর লাখ লাখ টাকা এখন সবই তো পাবে সদানন্দ, তাই তার জন্যে এখন আপনাদের যত দরদ উথলে উঠেছে, না? তাই এখন খোঁজ পড়েছে তার। ভেবেছেন পাগল ভাগ্নেকে সামনে খাড়া করে টাকাগুলো নিজেদের পেটে পুরবেন। তা মতলোব আপনাদের খুবই ভালো শালাবাবু। কিন্তু একটা কথা বলে রাখছি, সদানন্দর যা হয় হোক, এতে আপনাদেরও কিন্তু কিছু ভালো হবে না। আপনাদের এ টাকা ভোগে আসবে না। কারণ এখনও আকাশে চন্দ্র-সূর্য ওঠে, ভুলে যাবেন না মাথার ওপর ভগবান বলে এখনও একজন আছেন–
পরমেশ মৌলিক নিতাই হালদারকে থামিয়ে দিলেন। বললেন–নিতাই তুই থাম—
নিতাই মুখফোঁড় ছেলে বরাবর। বললে–কেন থামবো খুড়োমশাই? আমি কি কিছু অন্যায় কথা বলেছি? এখানে তো আরো দশজন গায়ের লোক আছে। সদানন্দকে কে না দেখেছে? সবাই জানে কত নাকাল হয়েছে আত্মীয়স্বজনের কাছে। নিজের বাপ যখন তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, এক মুঠো ভাত দিয়ে ছেলেকে বাঁচায় নি, তখন এই মামা তো এসে তাকে নিজের বাড়িতে ঠাঁই দেন নি। যতদিন দিদি ছিল, যতদিন টাকা যুগিয়েছে, ততদিন খুব খাতির, ততদিন শালাবাবু ঘরের লোক, আর যেই দিদি মারা গেল আর উধাও–
প্রকাশ রায়ের কথাগুলো ভালো লাগলো না। সুটকেসটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বললে–আমি তাহলে উঠি–
নিতাই হালদার বললে–আমাদের কথাগুলো শুনতে ভাল লাগছে না কিনা তাই উঠে যাচ্ছেন। কড়া কথা কারই বা শুনতে ভালো লাগে, বলুন?
প্রকাশ রায় আমতা আমতা করে বলতে লাগলো–না, মানে সদানন্দকে খুঁজতেই তো আমি এখানে এসেছিলাম, তা সে যখন এখানে নেই তখন অন্য কোথাও চেষ্টা করে দেখি গে–
নিতাই বললে–হ্যাঁ, অন্য কোথাও গিয়ে খুঁজে বার করবার চেষ্টা করুন, খুঁজে বার করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলুন, তুলে জামাই-আদরে রেখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে দিয়ে একটা যা-তা কাগজে সই করিয়ে নিন, তারপর তাকে লাথি-ঝাঁটা মেরে দূর করে দিন গে, কেউ কিছু জানতে পারবে না, মাঝখান থেকে জামাইবাবুর লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি আপনাদের হাতে এসে যাবে–
সেদিন গ্রামের লোক যে কথাগুলো বললে–তার একটাও কিন্তু মিথ্যে নয়। সবাই জানতো হরনারায়ণ চৌধুরী শ্বশুরেরও অনেক টাকা পেয়েছিলেন। নবাবগঞ্জের অত সম্পত্তি সব কিছু বিক্রি করে যা পেয়েছিলেন সব নিয়ে গিয়ে তিনি ভাগলপুরে উঠেছিলেন। সদানন্দর ঠাকুর্দা মা, সবাই তখন মারা গেছে। নয়নতারাও শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে তখন কেষ্টনগরে তার বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। সমস্ত বাড়িটা যেন তখন রাতারাতি শ্মশান হয়ে গেছে। চৌধুরী মশাই এই নবাবগঞ্জে তখন সারা বাড়িতে একলাই কাটাতেন। আর সদানন্দ তখন কোথায় থাকতো কে জানে! কেউ তার কোনও খোঁজও রাখতো না।
ওই পরমেশ মৌলিক যেখানে বসে আছেন, এই বারোয়ারিতলার মাচার ওপর সদানন্দ অনেক দিন অনেক রাত কাটিয়েছে।
নিতাই হালদার জিজ্ঞেস করতো–ছোটবাবু, আপনি বাড়ি যাবেন না? রাত যে অনেক হলো?
তখন হরনারায়ণ চৌধুরী মশাই মস্ত বাড়িটাতে একলা থাকতেন। নবাবগঞ্জের বারোয়ারিতলা থেকে দেখা যেত চৌধুরীদের বাড়িটা। সারা বাড়িতে অসংখ্য ঘর। চারমহলা বাড়ি। দক্ষিণ দিকে সেই পুকুরটা। একেবারে বাড়ির লাগোয়া। পুকুর থেকে উঠতেই পাড়ের ওপর সার সার ধান চাল ডালের মরাই। পুকুর আর মরাই-র মাঝখানে অনেকখানি লম্বা জায়গা জুড়ে শাক-সজির বাগান। লাউ-কুমড়ো-উচ্ছের মাচা। কয়েকটা পেঁপে গাছ, বেগুনের ক্ষেত। যখন চৌধুরী বাড়ি জমজমাট ছিল তখন ওইখানে বাড়ির মেয়েদের শাড়ি শুকোতো সার সার। শুকোবার পর গৌরী পিসী এসে আবার বিকেলের দিকে সেগুলো তুলে নিয়ে গিয়ে ভেতর বাড়িতে যার যার ঘরে সাজিয়ে রেখে দিত। যখন রাত হতো তখন ও জায়গাটায় আর যেতে পারা যেত না। ভয় করতো। কিন্তু তার পাশেই ছিল গোয়ালঘর। সেই রাতির বেলা অনেকদিন সদানন্দ ওই পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটের ওপর চুপ করে বসে থাকতো। তার মনে হতো পুকুরের জলের মধ্যে থেকে যেন কারা দল বেঁধে উঠে আসছে তার দিকে। মানুষের মত চেহারা তাদের, কিন্তু ঠিক যেন আবার মানুষও নয়।
কাছে আসতেই সদানন্দ ভয় পেয়ে যেত। চেঁচিয়ে বলে উঠতোকে তোমরা? তোমরা কারা?
লোকগুলো হাসতো। বলতো–আমাদের তোমরা চিনতে পারবে না গো, আমাদের চিনবে না তুমি–
সদানন্দ বলতো কিন্তু তোমরা এখানে কী করতে এসেছো? বাড়ির ভেতরে যাবে নাকি?
লোকগুলো আরো হেসে উঠতো। বলতো–আমরা সব জায়গায় যেতে পারি–
–কিন্তু তোমরা এখানে কী করতে এসেছ?
–দেখতে।
–কী দেখতে?
–দেখতে এসেছি তোমরা কেমন আছো! দেখতে এসেছি নবাবগঞ্জের সব মানুষ কেমন আছে।
–তোমাদের বাড়ি কোথায়?
–এই নবাবগঞ্জেই আমাদের বাড়ি ছিল একদিন। কিন্তু এখানে আর আমাদের কোনও বাড়ি নেই। এখন সব জায়গাতেই আমাদের বাড়ি, এখন আমরা সব জায়গাতেই যেতে পারি।
–তবে কি তোমরা ভূত?
লোকগুলো সদানন্দর প্রশ্ন শুনে হেসে উঠতো। বলতে–ভয় পাচ্ছো বুঝি? ভয় পেয়ো না। আমরা রোজ রোজ এখানে আসি, আমরা রোজ রোজ এখানে আসবো। আমাদের কেউ আটকাতে পারবে না। এখানে আগে তো আসতে পারতুম না। আমরা চৌধুরী মশাই-এর কাছারিবাড়িতে এসে এককালে তার সামনে হাতজোড় করে বসে থাকতুম। খাজনা মকুব করতে বলতুম। আগে আমরা ছিলুম কালীগঞ্জের জমিদারবাবুর প্রজা, পরে আমরা হলুম চৌধুরী মশাই-এর প্রজা। আমরা খরার সময় খাজনা দিতে পারি নি। যেবার ঝড়ে আমাদের বাড়ি পড়ে গিয়েছিল, আমরা চৌধুরী মশাই-এর ঝাড় থেকে বাঁশ কেটেছিলুম, তার জন্যে আমাদের নামে সদরের কাছারিতে ফৌজদুরি মামলা হয়েছিল।
–তারপর?
–তারপর আমাদের জমি খাস হয়ে গিয়েছে, আমাদের ভিটে-মাটি উচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। এই দেখ, এর দিকে চেয়ে দেখ, এর গলায় কীসের দাগ দেখছো?
–কীসের দাগ?
সদানন্দ সেই অন্ধকারের মধ্যেই লোকটার গলার কাছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখলে। অস্পষ্ট ছায়া সব। তবু মনে হলো সেখানকার ছায়াটা যেন আরো ঘন, আরো গম্ভীর হয়ে উঠেছে।
–এ গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল।
কথাটা শুনেই সদানন্দ আঁতকে উঠলো। গলায় দড়ি দিয়েছিল?
–হ্যাঁ, বারোয়ারিতলার বটগাছের ডালে গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়েছিল।
–এর নাম কী?
–কপিল পায়রাপোড়া।
নামটা কানে যেতেই সদানন্দ একটা আর্তনাদ করে সেই ইট বাঁধানো পৈঁঠের ওপরেই অজ্ঞান হয়ে পড়লো। কিন্তু কেউ তা টের পেলে না। সন্ধ্যেবেলা যখন হরিহরবাবু ছাত্রকে পড়াতে এসেছেন তখন খোঁজ পড়লো–খোকাবাবু নেই। খুঁজে বার করো সদানন্দকে। হরিহরবাবু সেই তিন ক্রোশ দূর থেকে সাইকেল ঠেঙিয়ে রোজ নবাবগঞ্জে পড়াতে আসেন। সকলেরই সে কথা জানা। বাড়িময় খোঁজ পড়লো। বড় অন্যমনস্ক ছেলে। খেয়ালী রকমের মানুষ। অনেক সময় ইস্কুল থেকে আসতে আসতেই কারো বাড়িতে ঢুকে পড়ে তাদের ঘানি গাছে চড়ে বসতো। তখন আর বাড়ির কথা ক্ষিধের কথা মনে পড়তো না। সেদিন সব জায়গায় খোঁজা হলো। চণ্ডীমণ্ডপে চৌধুরীমশাই প্রজা পাঠকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনি বললেন–কই, আমি তো দেখি নি তাকে। আমার কাছে তো কই আসে নি সে। তবে সে ইস্কুল থেকে এসেছিল তো? গৌরী পিসী নিজের হাতে তাকে মুড়িবাতাসা আর সন্দেশ খেতে দিয়েছে। তাহলে সে যাবে কোথায়? দীনুও ছুটলো বারোয়ারিতলায়, সেখানেও নেই। প্রকাশ মামা দিদির কাছে এসেছিল। বাইরে কোথায় ঘুরছিল। বাড়িতে এসেই শুনলো ভাগ্নেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার দৌড়ো বাইরে। যাবে কোথায় সে? উড়ে তো যেতে পারে না। দিদিকে বললে–কিছু টাকা দাও–
দিদি বললে–টাকা কী হবে রে?
প্রকাশ বললে–নানান জায়গায় যেতে হবে, টাকা হাতে থাকা ভালো, বুঝলে? সব সময় কিছু টাকা হাতে রেখে দিও, দেখবে সঙ্গে সঙ্গে সব সুরাহা হয়ে গেছে।
টাকা নিয়ে প্রকাশ রায় বেরোল। কিন্তু আসলে খুঁজে বার করলে গৌরী পিসী। গৌরী পিসী গোয়ালঘরের দিকে যাচ্ছিল ছুঁটে আনতে। হঠাৎ চাঁদের আলোয় দেখতে পেলে কে যেন ঘাটের পৈঁঠের ওপর চিৎপাত হয়ে শুয়ে গোঙাচ্ছে। একবার যেন কীরকম সন্দেহ হলো। তারপর বললে–কে রে? কে রে ওখানে শুয়ে আছিস? কে তুই?
উত্তর না পেয়ে পায়ে-পায়ে কাছে গিয়ে দেখে খোকা। খোকাকে ওই অবস্থায় দেখে আর সেখানে দাঁড়ালো না। দৌড়তে দৌড়তে বাড়ির মধ্যে এসে খবর দিতেই সবাই দৌড়ে গেছে। চৌধুরী মশাইও চণ্ডীমণ্ডপ ছেড়ে এলেন। প্রজা পাঠক যারা ছিল তারাও এলো। সবাই ধরাধরি করে নিয়ে এসে তুললো ভেতর বাড়িতে। তারপর ডাক্তারবদ্যি আসার পর যখন তার জ্ঞান হলো সবাই জিজ্ঞেস করলে কী হয়েছিল তোর? সন্ধ্যেবেলা ওখানে গিয়েছিলি কী করতে? ভয় পেয়েছিলি?
–হ্যাঁ।
–কে ভয় দেখিয়েছিল?
সদানন্দ বললে–কপিল পায়রাপোড়া।
.
এ-সব সদানন্দর জীবনের ছোটবেলাকার ঘটনা। প্রকাশ মামা যখন কেষ্টনগরে সদানন্দের পাত্রী দেখতে গিয়েছিল তখন এইসব কথাই উঠেছিল। বেয়াই মশাই সরল সাদাসিধে মানুষ। নবাবগঞ্জের চৌধুরী বাড়ির একমাত্র ছেলের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে হবে শুনে তিনি খুব খুশী হয়েছিলেন। সারা জীবন ইস্কুলে ছাত্রদের সংস্কৃত শিখিয়েছেন। কাকে বলে ধাতুরূপ তা জানেন। কাকে বলে ব্যাকরণ আর কাকে বলে অলঙ্কার তাও জানেন। খাওয়া-পরার কিছু ভাবনা যেমন ছিল না, তেমনি অভাবও ছিল না কিছু। তিনি বলতেন–অভাব বললেই অভাব। নইলে কোনও অভাব নেই আমার। আমি যদি কিছু না চাই তো আমার অভাব থাকবে কী করে? আমার তো ওই একটা মেয়ে নয়নতারা। নয়নতারাকে যে দেখবে তারই পছন্দ হবে। নয়নতারার বিয়ের জন্যে তোমাদের কাউকে ভাবতে হবে না।
গৃহিণী বলতেন–কিন্তু তা বলে বিয়ের চেষ্টা তো করতে হবে–
ব্যকরণতীর্থ পণ্ডিত মানুষ ওই কালীকান্ত ভট্টাচার্য। তিনি বলতেন–চেষ্টা করবার আমি কে বলো তো? যিনি সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক তার যা মনোবাঞ্ছা তাই-ই হবে।
প্রকাশ মামা যখন নিজে সম্বন্ধটা নিয়ে গিয়েছিল তখন কালীকান্ত ভট্টাচার্য তাকেও সেই কথাই বলেছিলেন। বলেছিলেন–আমি কে বলুন? আর আপনিই বা কে? আমরা কেউ-ই কিছু নই। নিমিত্ত মাত্র। নয়নতারার মা আমাকে তাগিদ দেন। বলেন–মেয়ের বিয়ের জন্যে তুমি কিছু ভাবছো না। আমি বলি–মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে আমি ভাববার কে? যিনি ওঁকে আমার সংসারে পাঠিয়েছেন তিনিই ভাবছেন। তা দেখুন, কোথায় ছিলেন আপনি আর আমি কোথায় ছিলাম, হঠাৎ আপনি নয়নতারার সম্বন্ধ নিয়ে এলেন–আর এমন পাত্র পাওয়া তো আমার পক্ষে ভাগ্যের কথা রায় মশাই–
তারপর থেমে আবার জিজ্ঞেস করলেন–তা আপনি হলেন পাত্রের কে?
–মামা!
–হরনারায়ণ চৌধুরী মশাই-এর শ্যালক আপনি?
–আজ্ঞে না। আমি হলাম চৌধুরী মশাই-এর গৃহিণীর মামার ছেলে। অর্থাৎ মামাতো ভাই। তবে আসলে বলতে গেলে নিজের ভাই-এর মতই। ছোটবেলা থেকে চৌধুরী মশাই এর শ্বশুর কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায়ের কোনও পুত্রসন্তান না থাকায় আমি তার বাড়িতে ছেলের মতই মানুষ হয়েছি। তাই জন্যেই এত ঘনিষ্ঠতা। দিদি আমাকে বলে দিয়েছিল আমার ভাগ্নের জন্যে একজন ডানা কাটা-পরীর মত পাত্রী চাই। তা অনেক খুঁজেছি। প্রায় শ’খানেক মেয়ে দেখেছি এ পর্যন্ত। আমার ভগ্নীপতির তো টাকার প্রয়োজন নেই, টাকা তার অনেক আছে, কিন্তু তার একমাত্র বাসনা পুত্রবধূটি যেন ডানা কাটা-পরী হয়, আর কিছু নয়–
কালীকান্ত ভট্টাচার্য জিজ্ঞেস করলেন–তা আমার মেয়েকে কেমন দেখলেন?
প্রকাশ মামা বললে–ওই যে এককথায় বললাম ডানা-কাটা-পরী–
–আপনার পছন্দ হয়েছে?
প্রকাশ বললে–আপনার মেয়েকে যার অপছন্দ হবে সে হয় কানা আর নয় তো মিথ্যেবাদী।
কালীকান্ত ভট্টাচার্যের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইল। তিনি কী করবেন বুঝতে না পেরে বলে উঠলেন–আপনি আর দু’টো সরভাজা নিন্ বেয়াই মশাই–
–তা দিন। খেতে আমার কোনও কালেই আপত্তি নেই। একবার সম্বন্ধটা হয়ে যাক তখন দেখবো আপনি আমাকে কত সরপুরিয়া সরভাজা খাওয়াতে পারেন–
কথাটা বলে প্রকাশও যত হাসতে লাগলো ভট্টাচার্য মশাইও তত। সঙ্গে সঙ্গে আরো সরপুরিয়া এলো, আরো সরভাজা। আরো কথা হলো, আরো হাসি। প্রথম দিনেই প্রকাশ মামা হাসিতে গল্পে পাত্রীর বাবার মন ভিজিয়ে দিলে। সেখান থেকে বেরিয়েই সোজা ট্রেনে উঠে একেবারে রেল বাজারে নামলো। বারোয়ারিতলায় আসতেই লোকজন ধরলে। কী শালাবাবু, কোত্থেকে আসা হচ্ছে?
শালাবাবু বললে–ওহে, তোমাদের সব বলে রাখি, আসছে অঘ্রাণে সদার বিয়ে, এই পাত্রী পছন্দ করে এলুম। তোমরা সব যাবে, তোমাদের সব নেমন্তন্ন রইলো–
কথা শুনে সবাই অবাক। সদানন্দর বিয়ে। চৌধুরী মশাই-এর একমাত্র ছেলের বিয়ে।
–নেমন্তন্ন হবে সকলের, যাওয়া চাই কিন্তু—
কোথায় বিয়ে, কবে কোন্ তারিখে বিয়ে, তার ঠিক নেই, শুধু পাত্রী দেখলুম আর বিয়ে হয়ে গেল! বিয়ে কি অত সহজে হয়? আর তা ছাড়া যার বিয়ে সেই চৌধুরী-মশাই-এর ছেলেই তো বলে বিয়ে করবে না সে। রাস্তায় ঘাটে কত লোক সদানন্দকে দেখেছে। সকলের সঙ্গে নদীতে চান করবার সময়ও অনেকে জিজ্ঞেস করেছে–কীরে সদা, কাল কোথায় ছিলি তুই? সবাই যে তোর খোঁজাখুঁজি করছিল? কোথায় গিয়েছিলি?
সদানন্দ বলেছে—কালীগঞ্জে–
–কালীগঞ্জে? কালীগঞ্জে কী করতে?
–বেড়াতে।
কালীগঞ্জে বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে যায়। আর বেড়াবার জায়গা পেলে না সদানন্দ, বেড়াতে গেল কি না কালীগঞ্জে! তার চেয়ে বারোয়ারি-তলায় নিতাই হালদারের দোকানের সামনে মাচায় তাস খেলতে এলেই হয়। কিম্বা নল-দময়ন্তী থিয়েটার করছে ক্লাবের ছেলেরা সেখানে গিয়ে মহড়া শুনলেই হয়। তা নয়, একলা-একলা ক্ষেতে খামারে ঘুরে বেড়ানো!
একজন বললে–এবার চৌধুরী মশাইকে বলবো তোর একটা বিয়ে দিয়ে দিতে, তখন বাড়িতে মন বসবে তোর
সদানন্দ বলেছে–আমি বিয়ে করবো না
–বিয়ে করবি না তো এই এত জমি-জমা, এত টাকা কড়ি কে খাবে?
–আমার দাদু খাবে, আমার বাবা খাবে।
–কিন্তু যখন তোর ঠাকুর্দা থাকবে না, তোর বাবা-মা কেউ থাকবে না, যখন তুইও থাকবি না, তখন কে খাবে?
সদানন্দ বলতো–তাহলে তোমরা আছো কী করতে? তোমরা খাবে!
–আমরা? আমরা খাবো? আমাদের কি অমন কপাল? অমন কপাল হলে তো আমরা বড়লোকের বাড়িতেই জন্মাতুম রে!
লোক হাসতো। চৌধুরী মশাই-এর ছেলের কাণ্ড দেখে সবাই হাসত। বলতো–ছোটবেলায় অমন সবাই বলে হে! তারপর দেখবে যখন বড় হবে, বিয়ে হবে, সংসার হবে তখন ওর বাপ-ঠাকুর্দার মত বাকি খাজনার দায়ে আমাদের নামে আবার কাছারিতে গিয়ে নালিশ ঠুকে দেবে। ওরকম অনেক দেখা আছে হে। অনেক দেখা আছে–
কিন্তু ক্রমে সেই সদানন্দর বয়েস হয়েছে, যাকে বলে সাবালক তাই-ই হয়েছে, স্কুল থেকে পাস করে কলেজে পড়তে গেছে, কিন্তু তখনও সেই একই রকম। আগেও যা ছিল পরেও তাই। তা সেই সদার এখন বিয়ে। বারোয়ারীতলার আড্ডায় রীতিমত সোরগোল পড়ে গেল। হরনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ির বিয়ে নয় তো যেন নবাবগঞ্জের সমস্ত লোকেরই বাড়ির বিয়ে। গ্রামসুদ্ধ লোকই কোমর বেঁধে লেগে গেল আলোচনা করতে। কোথা থেকে মিষ্টি আসছে, কোন্ গয়লাবাড়িতে দই-এর বরাত গেছে, কোন্ কুমোরবাড়িতে হাঁড়িকলসী-জালার বায়না গেছে, কোন্ সদর থেকে গোরাবাজনার দল আসছে সব খবর মুখে মুখে ফিরতে লাগলো। তাক্ লেগে গেল শালাবাবুর গরম মেজাজ দেখে। পাত্রী পছন্দ করানো থেকে শুরু করে নুনকলাপাতাটুকু পর্যন্ত সবই যেন তার দায়। নরনারায়ণ চৌধুরী ভেতরে দোতলায় বসে বসে হুকুমজারি করেই খালাস। নাতির বিয়ে হবে, সে-বিয়ে তিনি দেখে যেতে পারবেন, তার কাছে তার চেয়ে বেশি আনন্দ আর কিছু নেই। ছেলে হরনারায়ণ নিজে গিয়ে কন্যাকে হীরের মুকুট দিয়ে আশীর্বাদ করে এসেছে। ওদিক থেকে কালীকান্ত ভট্টাচার্য মশাইও নিজের সাধ্যমত একটা সোনার বোতামের সেট দিয়ে পাত্রকে আশীর্বাদ করে গেছেন। তার নিজের অবস্থার চেয়ে হাজার গুণ বড় অবস্থার বংশের সঙ্গে কুটুম্বিতে করছেন সেটা তার পক্ষেও মহা আনন্দের ঘটনা। দুপক্ষই খুশী। আর দুপক্ষের মাঝখানে যোগসূত্রের মত প্রকাশ মামা একবার কেষ্টনগর আর একবার নবাবগঞ্জ করছে। ছেলে-মেয়ে-বউ সবাইকে নিয়ে এসে তুলেছে এখানে। নরনারায়ণ চৌধুরীর বেয়াই কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায়ও সুলতানপুর থেকে অসুস্থ শরীর নিয়ে এসে হাজির হয়েছেন। কিন্তু সব কিছুর দায়িত্ব বলতে গেলে যেন শালাবাবুরই একলার। একবার ভাড়ার ঘরে গিয়ে হাজির হয় আর একবার দিদির কাছে। বলে–শ’পাঁচেক টাকা দাও তো দিদি
দিদি টাকা দিতে দিতে শুধু মাত্র জিজ্ঞেস করে–আবার পাঁচশো টাকা কী হবে? তোর জামাইবাবুর কাছেই চাইলে পারতিস–
টাকাগুলো পকেটে পুরতে পুরতে প্রকাশ বলে–জামাইবাবুকে এখন কোথায় খুঁজে পাই বলো দিকিনি–! আমারই বা অত সময় কোথায়? শেষকালে সব হিসেব দিলেই তো হলো–
বলে হন-হন করে যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনি হঠাৎই কোথায় উধাও হয়ে যায়। নাইবার খাবারও সময় নেই তার। নরনারায়ণ চৌধুরী এক-একবার জিজ্ঞেস করেন–কৈলাস, সব কাজকর্ম ওদিকে ঠিক চলছে তো?
কৈলাস গোমস্তা বলে–আজ্ঞে হা কর্তাবাবু, প্রকাশ মামা আছেন, তিনি সব করছেন–
নরনারায়ণ চৌধুরী চিনতে পারেন না। জিজ্ঞেস করেন–প্রকাশ মামা? সে আবার কে?
–আজ্ঞে আমাদের বৌমার ভাই।
–বৌমার ভাই মানে? নারায়ণের শালা?
–আজ্ঞে হ্যাঁ—
–তা বেয়াই মশাই-এর তো পুত্রসন্তান ছিল না। শালা কোত্থেকে এল?
–আজ্ঞে বৌমার মামাতো ভাই, আমাদের বেয়াই মশাই-এর কাছেই মানুষ, ছেলেবেলাতেই বাবা-মা মারা গিয়েছিল কিনা–
–ও–বলে তিনি চুপ করলেন। অনেকবার শুনেছেন তিনি কথাটা, তবু শেষের দিকে অনেক কিছুই তিনি ভুলে যেতেন।
যখন বিয়ে বাড়ি এমনি জম-জমাট, চৌধুরী বাড়িতে লোকজন গম গম করছে, তখন গ্রামের লোকের কানে গেল শাঁখ বাজার শব্দ। লোকজন সবাই ভিড় করে এল। গায়ে হলুদ এসেছে। গায়ে-হলুদ এসেছে। শাঁখ বাজাও, শাঁখ বাজাও! গায়ে-হলুদের দলের সঙ্গে এসেছে অনেক লোক। এসেছে সকাল আটটার আগেই। পুরুতমশাই পাঁজি দেখে সময় বলে দিয়েছেন। সেই সময়ের মধ্যে ছেলের গায়ে-হলুদ না হলে ওদিকে মেয়ের গায়ে-হলুদও হবে না। এদিকে টাইম দেওয়া হয়েছে সকাল আটটা, আর ওদিকে সেই হিসেব করে মেয়ের গায়ে-হলুদ হবে সকাল ন’টার সময়। হিন্দুর বিয়ে বলে কথা। এর নড়চড় হবার উপায় নেই। হলে অকল্যাণ হবে। অকল্যাণ হবে বর কনের। অকল্যাণ হবে চৌধুরী বংশের, অকল্যাণ হবে ব্যাকরণতীর্থ কালীকান্ত ভট্টাচার্যের বংশেরও।
কৃষ্ণনগর থেকে নবাবগঞ্জ। মাঝখানে রাণাঘাটে একবার ট্রেন বদল করতে হয়। সময়ও লাগে অনেক। তারপর আছে রেলবাজার থেকে এতখানি রাস্তা।
গায়ে-হলুদের দল যখন কেষ্টনগরে ফিরলো তখন বিকেল পুইয়ে গেছে। সামনের রাস্তার দিকে হা-পিত্যেশ করে চেয়ে ছিলেন ভট্টাচার্যি মশাই। বাড়ির ভেতরেও সকলের উদ্বেগ ছিল। কুটুমবাড়ি থেকে ঘুরে আসছে, ওদের মুখ থেকে অনেক খবর শোনা যাবে।
–কি গো বিপিন, গায়ে-হলুদ হলো? কী রকম খাতির করলেন বেয়াই মশাইরা?
বিপিনের মুখটা যেন কেমন গম্ভীর-গম্ভীর।
–কই, কথা বলছ না যে কিছু?
বিপিন বললে–আজ্ঞে পণ্ডিত মশাই, খাতির খুব ভালোই পেয়েছি, পেটভরে খেয়েছি। সবাই আমরা, কিন্তু…
কী বলতে গিয়ে যেন বিপিন থেমে গেল।
পণ্ডিত মশাই বুঝতে পারলেন না। বললেন–কিন্তু কী…
–আজ্ঞে গায়ে-হলুদ হয়নি।
–গায়ে-হলুদ হয়নি মানে? এদিকে নয়নতারার যে গায়ে-হলুদ হয়ে গেল সকাল ন’টার সময়। ওদিকে আটটার সময় ছেলের গায়ে-হলুদ হবার কথা, সেই হিসেব করে আমরাও যে মেয়ের গায়ে-হলুদ দিয়ে দিয়েছি। সেই রকম ব্যবস্থাই তো করা ছিল–
বিপিন মুখ কাচুমাচু করে বললে–আজ্ঞে, বরবাবাজীকে পাওয়া গেল না–
–পাওয়া গেল না মানে?
বিপিন বললে–আগের রাত্তির থেকেই বরবাবাজী কোথায় বেরিয়ে গেছে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না–
–শেষ পর্যন্ত? শেষ পর্যন্ত কী হলো আগে তাই বলো! শেষ পর্যন্ত বরকে পাওয়া গেল?
–আজ্ঞে না, পাওয়া গেল না। আমরা আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো, তাই আমরা চলে এলুম–
খবরটা কানে যেতেই ভট্টাচার্য-গৃহিণীও ছুটে বাইরে এলেন। বললেন–কী হলো গো? গায়ে-হলুদ হয়নি? এদিকে যে নয়নতারার গায়ে-হলুদ হয়ে গেছে। তাহলে কি বর আসবে না নাকি?
বলে বিপিনের দিকে চাইলেন তিনি।
ভেতরের একটা ঘরে নয়নতারা তখন চুপ করে বসেছিল। তার কানেও গেল কথাটা। কানে যেতেই সমস্ত শরীরটা অবশ হয়ে এল। বর আসবে না!
কিন্তু না, বোধ হয় পণ্ডিত কালীকান্ত ভট্টাচার্যের পূর্ব-পুরুষের বহু পুণ্যফল ছিল, তাই তার কন্যার বিয়েতে কোনও বিপর্যয় ঘটলো না। কিংবা বিপর্যয়টা সাময়িকভাবে না ঘটলেও হয়ত অদূর ভবিষ্যতের জন্যে মুলতুবী রইল। জীবনে দুর্যোগ যখন আসে তখন আপাতত তার আসার রকমটা দেখে অনেক সময় মনে হয় সেটা বুঝি হঠাৎই উদয় হলো। কিন্তু ঝড় আসবার অনেক আগে থাকে ঝড়ের সঙ্কেত। ঘরের চালে যখন আগুন লাগে, সে আগুনের উদ্ভব যে তার কত আগে কারো তামাক-খাওয়ার নেশার তাগিদে, আমরা তার খোঁজ রাখি না।
কালীকান্ত ভট্টাচার্য মশাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলেন। একেবারে শেষ ট্রেনটাতে বর এসে পৌঁছুলো। বিপিন দৌড়ে এসে খবর দিয়ে গেল পণ্ডিত মশাইকে। পণ্ডিত মশাই আবার খবর দিলেন বাড়ির ভেতরে। বিয়ে বাড়িতে তখন চাপা কান্নার রোল উঠেছিল। সুখবর পেয়ে সেই বাড়িই আবার গমগম করে উঠলো। আবার হাসি ফুটে উঠলো সবার মুখে। কে যেন বলে উঠলো–ওরে শাঁখ বাজা, শাঁখ বাজা, উলু দে,–উলু দে–বর এসেছে–
হ্যাঁ, কালীকান্ত ভট্টাচার্যির বাড়িতে বর এসেছে, নয়নতারার বর এসেছে—
.
স্টেশনের প্ল্যাটফরমে প্রকাশ মামা তখন সদানন্দকে আগলে আগলে আসছে। ভাগ্নে আবার না পালায়! পাশে হরনারায়ণ চৌধুরী ছিলেন। তিনিই বরকর্তা। পেছনে পেছনে নাপিত।
প্রকাশ মামা বললে–আপনি কিছু ভাববেন না জামাইবাবু, আমি সদাকে আগলে আছি–
প্ল্যাটফরমে কিছু লোক বর দেখতে ভিড় করেছিল। প্রকাশ মামা তাদের দিকে চেয়ে তেড়ে গেল। বললে–আপনারা কী দেখছেন মশাই? আপনারা কি বর দেখেন নি কখনও? একটু রাস্তা দিন, রাস্তা দিন আমাদের–সরুন–
কিন্তু সদানন্দর তখন অন্য চিন্তা। প্রকাশ মামা তার দিকে চেয়ে বললে–কিচ্ছু ভাবিস নি তুই। বিয়ে করতে ভয় কীসের? আমি তো আছি। এই দ্যাখ না, বিয়ে কে না করেছে। আমি বিয়ে করেছি, তোর বাবা বিয়ে করেছে, তোর ঠাকুর্দা বিয়ে করেছে, তোর ঠাকুরদার বাবাও একদিন বিয়ে করেছিল। বিয়ে করতে ভয়ের কিচ্ছু নেই। এই আমার কথাই ধর না, আমি তো একবার বিয়ে করেছি, এর পর যদি দরকার হয় আরো দশবার বিয়ে করবার হিম্মত রাখি, আমি কি কাউকে পরোয়া করি?
সেদিন প্রকাশ মামার কথায় মনে মনে হেসেছিল সদানন্দ। প্রকাশ মামাও তো একজন মানুষ। কেউ তাকে মানুষ ছাড়া জানোয়ার বলবে না। মানুষের মত দুটো হাত, পা, চোখ, কান। মানুষেরই মতন মুখের ভাষা। সংসার ওরকম লোককে সবাই মানুষ বলেই জানে। অথচ প্রকাশ মামা কি সত্যিই মানুষ! কতদিন সদানন্দকে সিগারেট খাইয়েছে, তামাক খাইয়েছে, বিড়ি খাইয়েছে। যাত্রা থিয়েটার শুনতে কত দূর দূর গ্রামে নিয়ে গিয়েছে। তারপর অন্য গ্রামে রাত কাটিয়ে সকাল বেলা বাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছে। বাড়ি আসবার আগে ভাগ্নেকে সাবধান করে দিয়েছে। বলেছে–খবরদার, কাউকে যেন বলিস নি এসব কথা–
সদানন্দ তখন ছোট। মামার কথা ঠিক বুঝতে পারতো না। জিজ্ঞেস করতো–কী সব কথা?
প্রকাশ মামা বলতো–এই কার ঘরে রাত কাটিয়েছিস—
সদানন্দ জিজ্ঞেস করত–কেন? বললে–কী হয়েছে?
প্রকাশ মামা বকতো। বলতো–দূর হাঁদা। মেয়েমানুষের ঘরে রাত কাটালে কাউকে বলতে নেই–
–কেন? মেয়েমানুষের ঘরে রাত কাটালে দোষ কী? ও মেয়েমানুষটা কে?
প্রকাশ মামা বলতো–দূর, তুই দেখছি সত্যিই একটা হাঁদা-গঙ্গারাম। দেখলি না ওটা একটা বাজারের মেয়েমানুষ!
–বাজারের মেয়েমানুষ মানে?
প্রকাশ মামা অধৈর্য হয়ে উঠতো। বলতো–আরে, তোকে নিয়ে দেখছি মহা মুশকিলে পড়া গেল। বাজারের মেয়েমানুষ কাকে বলে তাও এত বড় ছেলেকে বুঝিয়ে বলতে হবে। দেখলি নে মাগীর কী রকম ঠাঁট?
–ঠাঁট মানে?
প্রকাশ মামা বলতো–নাঃ, তোকে দেখছি আর মানুষ করতে পারলুম না। তুই বড় হয়ে যে কী করবি তা বুঝতে পারছি না। শেষকালে তুই কেলেঙ্কারি না বাধিয়ে বসিস। যখন তোর বাবা মারা যাবার পর লাখ লাখ টাকার সম্পত্তির মালিক হবি, তখন দেখছি সবাই তোকে সব ঠকিয়ে নেবে–
সদানন্দ ছোটবেলায় প্রকাশ মামার কথা শুনে অনেক জিনিস জানতে পারতো। সে জানতে পারতো যে, তাদের অনেক টাকা। তার ঠাকুরদা আর তার বাবা মারা যাবার পরই সে নাকি লাখ লাখ টাকার মালিক হয়ে যাবে! আর শুধু যে তার বাবার টাকা তাই-ই নয়, তার দাদামশাই-এর নাকি অনেক টাকা। দাদামশাই-এর মৃত্যুর পর সে-টাকাও নাকি সদানন্দ একলাই সব পাবে। তখন তার বয়েস পনেরো কি ষোল, সেই সময়েই সে এই সব কথা শুনলো। রানাঘাটের বাজারের একটা বাড়িতে তখন তাকে নিয়ে গেছে প্রকাশ মামা। সারা রাত যাত্রা শুনেছে মামার সঙ্গে। যাত্রা যখন শেষ হয়েছে তখন মাঝরাত। ঘড়িতে বোধ হয় রাত তখন দুটো। সেই অত রাত্রে সদানন্দর খুব ঘুম পেয়েছে। প্রকাশ মামা জিজ্ঞেস করলে–কী রে, খুব ঘুম পেয়েছে?
সদানন্দ বললে–হ্যাঁ।
–তা হলে আয় তোকে বিছানায় শুইয়ে দিই গে। আয় আমার সঙ্গে—
বলে বাজারের গলির ভেতরে একটা বাড়ির সামনে গিয়ে ডাকলে রাধা, রাধা, ও রাধা–
অনেক ডাকাডাকির পর একজন মেয়েমানুষ চোখ রগড়াতে রগড়াতে এসে দরজা খুলে দিলে। জিজ্ঞেস করলে–এ কী, এত রাত্তিরে? এ কে?
প্রকাশ মামার হাব-ভাব দেখে মনে হলো যেন মেয়েমানুষটা তার খুব চেনা। কথা বলতে বলতে একেবারে তার বিছানায় গিয়ে বসে পড়লো। সদানন্দ তখনও মেয়ে-মানুষটার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে। যাত্রা শুনতে শুনতে তখন যে তার অত ঘুম পাচ্ছিল, সেখানে সেই মেয়েমানুষটার বাড়িতে গিয়ে কিন্তু সে-সব যেন কোথায় হাওয়ায় উড়ে গেল।
–কী রে, রাধার দিকে চেয়ে অমন করে কী দেখছিস?
প্রকাশ মামা হাসতে হাসতে সদানন্দকে কথাটা বলতেই সে মাথা নিচু করে নিয়েছিল। তার সেই ওই অল্প বয়সেই মনে হয়েছিল যে, অমন করে কোনও অচেনা মেয়েমানুষের দিকে চেয়ে থাকতে নেই।
তারপর প্রকাশ মামার কথাতেই তার যেন আবার জ্ঞান ফিরে এলো। প্রকাশ মামা তখন মেয়েমানুষটার দিকে চেয়ে বলে চলেছে সদানন্দর কথা। লাখ লাখ টাকার জমিদার এর বাবা। বাবার এক ছেলে, বুঝলে? বাপ মারা গেলে এই ছেলেই সেই অত টাকার সম্পত্তির একচ্ছত্র মালিক হবে।
–তা ওকে নিয়ে আমার এখানে কেন এসেছ? ওর বাবা-মা জানতে পারলে কিছু বলবে না?
প্রকাশ মামা হেসে উঠলো। বললে–কেন, তোমাদের এখেনে আসা কি খারাপ?
রাধা বললে–না, তোমার কথা বলছি নে। তুমি তো এ-লাইনে পাকা ঘুঘু। শেষকালে ভাগ্নেকেও এ-লাইনে নিয়ে এলে, তাই বলছি–
প্রকাশ মামা সদানন্দর দিকে চাইলে। বললে–এ-লাইনে এলে ক্ষতি কী! তোমারও লাভ, আমারও লাভ–
–তোমার কিসের লাভ?
–লাভ নয়? এত টাকা এ একলা খেতে পারবে? পরের গলায় গামছা দিয়ে টাকা করেছে এর ঠাকুর্দা। কালীগঞ্জে এর ঠাকুর্দা পনেরো টাকা মাইনেতে গোমস্তার চাকরি করতো। মাত্তোর পনেরো টাকা। গোমস্তা বললে–খারাপ শোনাতো বলে সবাই এর ঠাকুর্দাকে নায়েবমশাই বলে ডাকতো। সেই পনেরো টাকায় শুরু করে আজ পনেরো লাখ টাকার জমিদারির মালিক তিনি। আর এই নাতিই হলো তার সেই সমস্ত সম্পত্তির একমাত্তোর ওয়ারিশন্।
খবরটা যেমন রাধার কাছে বিস্ময়কর, তখন সেই ছোটবেলায় সদানন্দর কাছেও তেমনি। প্রকাশ মামার সেই সেদিনকার কথাতেই সে প্রথম জানতে পারলো যে, তাদের কত টাকা। সে কত বড়লোক।
রাধা বললে–কিন্তু তুমি এই বয়সেই ওকে এই লাইনে নিয়ে এলে! ও তো বয়স হলে সব ওড়াবে–
–সে গুড়ে বালি। বুঝলে গো, টাকা ওদের বংশে কারোর হাত দিয়ে গলে না।
রাধা বললে–তাই নাকি?
–হ্যাঁ, তাই তো আমি আমার দিদির কাছ থেকে যা পারি হাতিয়ে নিই। এর বাবা, আমার জামাইবাবু এক-পয়সার ফাদার-মাদার। সেই জন্যেই তো এই ভাগ্নেটাকে এ লাইনে এনে একটু মানুষ করার চেষ্টা করছি। দেখি, এখন আমার হাতযশ আর এর কপাল–
সদানন্দ তখনও রাধার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। তার মনে হলো মেয়েমানুষটার মধ্যে কিছু যেন অস্বাভাবিকতা রয়েছে একটা। তাদের নবাবগঞ্জের অন্য মেয়েমানুষদের মত নয় যেন। শেষ পর্যন্ত সেদিন আর ঘুমনোই হয়নি সদানন্দর। ওই রকম জায়গায় কারো ঘুম হয় নাকি?
মনে আছে বাড়িতে ফিরে আসতেই মা জিজ্ঞেস করলে কীরে, সমস্ত রাত কোথায় ছিলি? কোথায় ঘুমোলি?
প্রকাশ মামা বললে–ঘুম হবে কী করে? সাধুদের আশ্রমে কি ঘুম হয় কারো? সবাই কেবল খোলকর্তাল বাজাচ্ছিল–
–সাধুদের আশ্রমে? সাধুদের আশ্রমে মানে?
প্রকাশ মামা বললে–যাত্রা তো শেষ হয়ে গেল রাত দুটোর সময়, তখন কোথায় যাই? সদা বললে–ওর ঘুম পেয়েছে। তাই ওকে নিয়ে রাণাঘাটের একটা সাধুদের আশ্রমে গেলুম। কিন্তু সেখানে সবাই এমন হেঁড়ে গলায় ‘রাধাকৃষ্ণ রাধাকৃষ্ণ’ করতে লাগলো যে, বাপ-বাপ বলে আমাদের ঘুম পালিয়ে গিয়ে বাঁচলো–
দিদি হাসতে লাগলো। বললে–তা আমাদের সদরের উকিলবাবুর বাড়ি থাকতে সাধুদের আশ্রমে তোরা গেলিই বা কেন?
প্রকাশ মামা বললে–গেলুম সদাকে দেখাতে। যখন বড় হয়ে হাতে ওর অনেক টাকা আসবে তখন যাতে না ঠকে তাই এখন থেকে জোচ্চোরদের চিনিয়ে রাখলুম–
কথাটা শুনে দিদিও হাসতে লাগলো, প্রকাশ মামা নিজেও হাসতে লাগলো। কিন্তু সদানন্দ সেদিন হাসতে পারেনি প্রকাশ মামার কথা শুনে। তখনও সেই রাণাঘাটের বাজারের মেয়েমানুষটার কথা মনে পড়ছিল তার।
হঠাৎ প্রকাশ মামা জিজ্ঞেস করলে–জামাইবাবুকে তুমি যাত্রা শুনতে যাওয়ার কথা বলোনি তো?
সত্যিই তখনকার দিনে কেউ-ই জানতো না প্রকাশ মামার সঙ্গে বাড়ির বাইরে সে কোথায় কোথায় যেত। চৌধুরী বংশের কুলতিলকের পক্ষে যেখানে যাওয়া নিষিদ্ধ সেখানেও যে সেই বয়েসেই গিয়ে সে সব-কিছু বিধি-নিষেধ অমান্য করে বসে আছে–এ-কথা গুরুজনদের কারোরই তখন গোচরে আসেনি। জীবন দেখা কি এতই সোজা! প্রকাশ মামা না হলে কি জীবনের উল্টো-পিঠটা সে দেখতে পেত? একদিকে নরনারায়ণ চৌধুরীর অর্থ লালসা, আর তার বাবার বৈষয়িক কূট-কৌশলী বুদ্ধি, আর অন্যদিকে প্রকাশ মামার বেপরোয়া জীবনভোগ। একদিকে কালীগঞ্জের বৌ এসে পালকি থেকে নামতো আর দাদুর কাছে গিয়ে টাকা চাইতো, আর একদিকে সেই টাকাই প্রকাশ মামার হাতের ফুটো দিয়ে রাণাঘাটের বাজারের চালাঘরে গিয়ে নিঃশেষ হতো। মানুষের জীবনের এই অঙ্কটা সে কিছুতেই কষতে পারতো না।
এক-একদিন মা’কে জিজ্ঞেস করতো–মা, ও বউটা কে পালকি করে আসে আমাদের বাড়িতে? কেবল দাদুর কাছে টাকা চায় কেন?
মা বলতো–ও কালীগঞ্জের বউ।
–কালীগঞ্জের বউ কালীগঞ্জে থাকে না কেন? আমাদের নবাবগঞ্জে কেন জ্বালাতে আসে?
মা তাড়াতাড়ি ছেলেকে চুপ করিয়ে দিত। বলতো–চুপ, চুপ, ওকথা বলতে নেই, কর্তাবাবু শুনতে পেলে রাগ করবেন।
সদানন্দ বলতো–তা কালীগঞ্জের বৌ-এর পাওনা টাকা দিয়ে দিলেই হয়। যখনই কালীগঞ্জের বউ টাকা চায় তখনই দাদু বলে টাকা নেই। দাদু কেন মিথ্যে কথা বলে? দাদুর তো অনেক টাকা আছে, আমি দেখেছি–
এ-সব কথার কোনও উত্তর তার মা দিতে পারেনি।
প্রকাশ মামাকেও সে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে–তুমি কেন ওখানে যাও মামা?
প্রকাশ মামা ভাগ্নের কাছে এমন প্রশ্নের আশা করতো না। বলতো–তুই কী বুঝবি কেন যাই! তুই যখন বড় হবি তখন তুইও যাবি–
সেই ছোটবেলায় যখন রাধার বাড়িতে প্রথম গিয়েছিল সে তখন সেই গানটা শুনিয়েছিল। সেই গানটা–আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম।
আসবার সময় রাস্তায় প্রকাশ মামা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল–কী রে, কীরকম গান শুনলি?
সদানন্দ বলেছিল—ভালো–
–ভালো তো বুঝলুম, কিন্তু, কী রকম ভালো তাই বল না—
সদানন্দ বলেছিল–খুব ভালো–
প্রকাশ মামা বলেছিল–তা দ্যাখ, দিদি যদি তোকে জিজ্ঞেস করে কোথায় রাত কাটিয়েছিলি তাহলে কিন্তু রাধার কথা বলিসনি, বুঝলি? তোর বাবাকেও বলবি না, তোর দাদুকেও বলবি না।
সদানন্দ আবার জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু তাহলে তুমি কেন ওখানে যাও মামা?
প্রকাশ মামা বলেছিল–জীবনটাকে ভোগ করতে।
–ভোগ করতে মানে?
প্রকাশ মামা বলেছিল–ওই তো তোর বড় দোষ! বলছি তুই বড় হলে সব বুঝতে পারবি! তবু বারবার সেই এক কথা। তোর ভালোর জন্যেই তোকে এসব শেখাচ্ছি। নইলে তোর হাতে যখন টাকা আসবে তখন তুই খরচ করবি কী করে?
সদানন্দ জিজ্ঞেস করেছিল–কেন? টাকা খরচ করা কি শক্ত?
প্রকাশ মামা বলেছিল–নিশ্চয়ই, টাকা খরচ করা কি সোজা নাকি! তোর দাদুর তো অত টাকা, তাহলে কালীগঞ্জের বৌকে তার পাওনা টাকা দেয় না কেন বল?
সদানন্দ বলেছিল–সত্যিই বলো তো, কালীগঞ্জের বৌকে দাদু টাকা দেয় না কেন?
একটা হাসির শব্দে হঠাৎ যেন সদানন্দর সম্বিৎ ফিরে এলো। চারিদিকে অনেক লোক, অনেক আলো। অনেক বাজনা। ঢোলকাঁসির আওয়াজে জায়গাটা তখন সরগরম হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গে আছে শাঁখ আর উলুর শব্দ।
–বেয়াই মশাই, আমি তো খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম—
প্রকাশ মামা এগিয়ে এল ভট্টাচার্যি মশাই-এর দিকে। বললে–কেন, ভয় পেয়েছিলেন কেন?
ভট্টাচার্যি মশাই বললেন–আমাদের বিপিন গিয়েছিল, তার মুখেই শুনলাম বাবাজীকে নাকি পাওয়া যাচ্ছিল না সকাল থেকে।
কথাটা শুনে হো-হো করে হেসে উড়িয়ে দিল প্রকাশ মামা। জামাইবাবুর দিকে চেয়ে বললে–শুনুন জামাইবাবু, বেয়াই মশাই-এর কথা শুনুন, বরকে যদি পাওয়াই না যাবে তাহলে এখন বর এল কী করে?
কালীকান্ত ভট্টাচার্য মশাই বললেন বুঝতেই তো পারছেন, আমি হলুম মেয়ের বাপ, আমার তো একটা দুশ্চিন্তা থাকে–তা গায়ে-হলুদ নির্বিঘ্নেই হয়েছিল তো শেষ পর্যন্ত?
বরকর্তা চৌধুরী মশাই সাধারণত বেশি কথা বলেন না। গায়ে-হলুদের কথা শুনে মুখ খুললেন। বললেন–গায়ে-হলুদ না হলে বিয়ে হবে কী করে বেয়াই মশাই? অশাস্ত্রীয় ব্যাপার তো আমাদের বংশে চলবে না।
নিরঞ্জন পরামাণিক বরের সঙ্গে গিয়েছিল। কনের বাড়ির পরামাণিক বিপিন এসে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলে–শুনছিলাম কী নাকি হয়েছিল আপনাদের ওখানে–?
–কীসের কী?
–আমি তো গায়ে-হলুদ নিয়ে গিয়েছিলুম নবাবগঞ্জে তখন তো বরকে পাওয়া যাচ্ছিল না, তারপর কখন পাওয়া গেল?
নিরঞ্জন বললে–আরে খোকাবাবু তো খেয়ালী মানুষ, হঠাৎ কালীগঞ্জে চলে গিয়েছিল–
–কালীগঞ্জে? তা বিয়ের দিন বরবাবাজী কালীগঞ্জে চলে গিয়েছিলই বা কেন?
কেন যে সদানন্দ সেদিন কালীগঞ্জে চলে গিয়েছিল তা কি সদানন্দ নিজেই জানতো? এ এক বিচিত্র মানসিকতা। আগের দিনও সে জানতো না যে, সে কালীগঞ্জে যাবে। প্রকাশ মামা তাকে সব জায়গাতেই সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকে সে মামার সঙ্গে কত জায়গাতেই তো গেছে। কালীগঞ্জেও গেছে। রেলবাজার থেকে নবাবগঞ্জে এসে আরো কয়েক ক্রোশ দক্ষিণে যাও তবে কালীগঞ্জ পড়বে। কালীগঞ্জে পোস্টাফিস আছে, থানা আছে, বাঁধা বাজার আছে। বলতে গেলে নবাবগঞ্জের চেয়ে কালীগঞ্জ আরো বর্ধিষ্ণু গ্রাম। সদানন্দ জানতো ওইখান থেকেই কালীগঞ্জের বউ তার দাদুর কাছে আসতো। জানতো দাদুর কাছে এসে কালীগঞ্জের বউ টাকা চাইতো, আর যতবার টাকা চাইতো ততবার দাদু বলতো টাকা নেই। কেন যে বউ টাকা চাইতো আর কীসের টাকা, তা সদানন্দ জানতো না। কাউকে জিজ্ঞেস করলেও কেউ স্পষ্ট জবাব দিত না।
বিয়েবাড়িতে তখন লোকজনের ভিড় হয়েছে খুব। ভাগলপুর থেকে দাদামশাই এসেছে। তার নাতির বিয়ে। বুড়ো মানুষ। বেশি নড়া-চড়া করতে পারেন না। তিনি বললেন কই, খোকাকে তো দেখতে পাচ্ছিনে–
দীনু ডেকে নিয়ে এল খোকাকে। দাদু শুয়ে ছিলেন সামনে। বললেন–দাদুকে প্রণাম করো–
–থাক থাক–বলে কীর্তিপদবাবু পা-জোড়া সামনের দিকে একটু এগিয়ে দিলেন। তারপর বললেন–বেঁচে থাকো বাবা, আশীর্বাদ করি সুখী হও–
সদানন্দ তখনও সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। কীর্তিপদবাবু আবার বলতে লাগলেন–এসে পর্যন্ত তোমাকে দেখতেই পাইনি মোটে, খুবই ব্যস্ত বুঝি–
নরনারায়ণ চৌধুরী বললেন–না, ও আবার ব্যস্ত কীসের! ও তো বরাবরই ওই রকম। আমিই বলে আজকাল দেখতে পাইনে ওকে, অথচ একই বাড়ির মধ্যে থাকি। ওকে কেউই দেখতে পায় না–
কীর্তিপদবাবু বললেন–তা তো পাবেই না, এখন ওদের বয়েস হয়েছে, বুড়োদের সঙ্গে থাকতে ওদের আর ভালো লাগবেই বা কেন? যাও, যাও, তোমার নিজের কাজে যাও বাবা, কাল তোমার বিয়ে, আর কোথাও বেরিও না–
সদানন্দ ছাড়া পেয়ে বেঁচে গেল যেন। সে চলে যাবার পর কীর্তিপদবাবু বললেন অনেকদিন পরে দেখলাম খোকাকে, খুব বড় হয়ে গেছে–আর চেনা যায় না–
নরনারায়ণ চৌধুরী বললেন বড় হলে কী হবে, বৈষয়িক বুদ্ধি-টুদ্ধি তেমন হয়নি
কীর্তিপদবাবু বললেন–এইবার বিয়ে হচ্ছে, কাঁধে জোয়াল চাপলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, ছোট বয়সে সবাই ওরকম একটু হয়েই থাকে–পরে দেখবেন তখন ও-ই আপনাকে শেখাবে। আমি যখন ছোট ছিলুম তখন আমিই কি জমিদারির কিছু বুঝতুম–
দুই বেয়াই-এর বহুদিন পরে দেখা। দুজনেরই অনেক সম্পত্তি। একদিন এই দুজনের সব সম্পত্তিরই মালিক হয়ে বসবে সদানন্দ। কীর্তিপদবাবুর একমাত্র সন্তান এই সদানন্দর মা। আর নরনারায়ণ চৌধুরীরও একমাত্র সন্তান এই সদানন্দর বাবা। সদানন্দ নিজেও হরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র সন্তান। সুতরাং দুই বেয়াই-এরই একমাত্র ভরসা এই সদানন্দ। তাই দুজনেরই এক কামনা। দুজনেরই কামনা সদানন্দ দীর্ঘজীবী হোক, সদানন্দ সুখী হোক, সদানন্দ সংসারী হোক, সদানন্দ বৈষয়িক হোক।
কিন্তু হায় রে মানুষের জীবন আর হায় রে মানুষের জীবনের ইতিহাস! নইলে সেদিন নবাবগঞ্জ আর ভাগলপুরের সেই দুই দুর্ধর্ষ জমিদার-পুঙ্গব কি কল্পনা করতেই পেরেছিলেন যে তাদের একমাত্র উত্তরাধিকারী শ্ৰীমান সদানন্দ চৌধুরী লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক হওয়া সত্ত্বেও কপর্দকশূন্য অবস্থায় এক অখ্যাত চৌবেড়িয়া গ্রামের রসিক পালের অতিথিশালায় অন্নদাস হিসেবে শেষ জীবনটা কাটাবে! নইলে ঠিক বিয়ের আগের দিনই কেউ নিজের বাড়ি ছেড়ে পালায়, না নরনারায়ণ চৌধুরীর শেষ জীবনের চরম শত্রু কালীগঞ্জের বৌ-এর কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়!