২.১ কলিযুগ

কলিযুগ

সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে মানো মাজরার দৈনন্দিন জীবনধারায় সময়সূচীর পরিবর্তন দেখা গেল। ট্রেনের যাতায়াত অনিয়মিত হলো, আবার অনেক ট্রেন রাতে যাতায়াত শুরু করল। অনেক সময় মনে হতো ঘড়ির এলার্ম যেন অসময়ে বাজছে! ঘড়িতে চাবি দেয়ার কথাও যেন আর কারও মনে থাকছে না। প্রথমে ডেকে দেয়ার জন্য ইমাম বখশ অপেক্ষা করে থাকেন মিত সিং-এর আহবানের জন্য। আবার ঘুম থেকে ওঠার জন্য মিত সিং অপক্ষো করে থাকেন মুয়াজ্জিনের আজানের অপেক্ষায়। সাধারণ লোকের ঘুম থেকে উঠতেই দেরি হয়ে যায়। তারা বুঝতে পারে না যে, সময়ের পরিবর্তন হয়েছে এবং মেইল ট্রেন হয়ত আর চলবে না। কখন খেতে হবে শিশুরা তা ভুলে গিয়ে যখন তখন খাবার খেতে চাইল। সন্ধ্যার দিকে সবাই সূর্য ডোবার আগে ঘরে ফিরে আসে এবং এক্সপ্রেস ট্রেন, যদি কখনও আসে, আসার আগেই তারা ঘুমিয়ে পড়ে। মাল ট্রেনের যাতায়াত বন্ধ হয়েছে। ফলে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত আর হচ্ছে না। কিন্তু গভীর রাতে বা খুব ভোরে ভূতুড়ে ট্রেনের যাতায়াতে মানো মাজরার লোকের স্বপ্নের ব্যাঘাত ঘটতে শুরু করল।

এখানেই শেষ নয়। গ্রামের জীবনযাত্রায় আরও পরিবর্তন ঘটেছে। এক ইউনিট শিখ সৈন্য রেল স্টেশনের কাছে তাঁবু ফেলেছে। ব্রিজের কাছে সিগন্যাল খুঁটির পাশে তারা বালির ব্যাগ দিয়ে ছয় ফুট উচু নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে চতুর্দিক তাক করে মেশিনগান বসিয়েছে। সশস্ত্ৰ পাহারা বসানো হয়েছে স্টেশনে। গ্রামের লোকদের রেলিং-এর ভিতরে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। দিল্লী থেকে আগত সব ট্রেন এখানে থামে। এসব ট্রেনের চালক ও গার্ড বদল করে ট্রেন পাকিস্তানের দিকে যায়। পাকিস্তান থেকে আগত ট্রেনের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যবস্থা রয়েছে।

একদিন সকালে পাকিস্তান থেকে একটা ট্রেন এসে মানো মাজরা স্টেশনে থামল। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হলো, শান্তির সময় যে ধরনের ট্রেন যাতায়াত করত, এটাও সেই ধরনের ট্রেন। ছাদের ওপর কেউ বসে নেই। দুই বগির মধ্যে ফাঁকা জায়গায় কেউ বসে বা দাঁড়িয়ে নেই। পা-দানিতে দাঁড়িয়ে কেউ ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছে না। কেমন যেন নতুন ধরনের ট্রেন! ট্রেনটা দেখলে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। ভূতের মতো। প্লাটফরমে দাঁড়ানোর পর ট্রেনের শেষ দিক থেকে একজন গার্ড নেমে এসে সোজা স্টেশন মাস্টারের কামরার দিকে গেল। দুজন লোক সৈন্যদের ক্যাম্পে গিয়ে ভারপ্রাপ্ত অফিসারের সাথে কথা বলল। এরপর সৈন্যদের ডাকা হলো এবং স্টেশনের আশপাশে ঘোরাফেরা করছিল এমন লোকদের মানে৷ মাজরায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। একজন লোককে মোটর সাইকেলে করে চন্দননগরে পাঠানো হলো। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে সাব- ইন্সপেক্টর সাহেব পঞ্চাশ জন সশস্ত্ৰ পুলিশ নিয়ে স্টেশনে এলেন। তাদের আসার পর পরই হুকুম চাঁদ তাঁর আমেরিকান গাড়ি নিয়ে স্টেশনে হাজির হলেন।

দিনের বেলায় একটা ভূতুড়ে ট্রেনের আগমনকে কেন্দ্র করে মানো মাজরায় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হলো। গ্রামের লোকেরা তাদের ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করল স্টেশনে কি হচ্ছে। তারা শুধু দেখতে পেল স্টেশনের এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত ভূতুড়ে ট্রেনের ছাদের কালো অংশ। স্টেশন বিল্ডিং ও রেলিং-এর জন্য ট্রেনের কিছু অংশ দেখা গেল না। মাঝে মাঝে দেখা গেল একজন সৈন্য বা পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসছে আবার ভিতরে ঢুকছে।

বিকেলের দিকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে কিছু লোক ঐ ট্রেনটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। তারা সব পিপুল গাছের তলায় জমায়েত হলো এবং একে একে সবাই গুরুদুয়ারায় গিয়ে উপস্থিত হলো। মহিলারা বিভিন্ন বাড়িতে গিয়েছিল কিছু সংবাদ সংগ্রহের আশায়। তারা যে সব কথা শুনেছে সেই সময় তারা তা বলেও এসেছিল। অতঃপর তারা সব জমায়েত হলো গ্রামের সর্দারের বাড়িতে। কিন্তু ট্রেন নিয়ে কোন সঠিক তথ্য জানতে না পেরে তারা যে যার বাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল বাড়ির পুরুষদের আগমন অপেক্ষায়। তাদের কাছ থেকে যদি কিছু জানা যায়, এই আশায়।

মানো মাজরায় কোন অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে এ ধরনের চাঞ্চল্য দেখা যায়। মেয়েরা গিয়েছিল গ্রামের সর্দারের বাড়িতে। আর পুরুষরা গিয়েছিল গুরুদুয়ারায়। গ্রামে কোন স্বীকৃত নেতা ছিল না। গ্রামের সর্দার বানতা সিং ছিলেন একজন রাজস্ব সংগ্ৰাহক-ল্যামবরদার। কয়েক শতাব্দী ধরে এই পদটি তার পরিবারের লোকেরাই পেয়ে আসছে। অন্যের তুলনায় তার বেশি জমিজমাও নেই। অন্য কোন দিক থেকে সে কারও চেয়ে বড়ও নয়। এ পদের জন্য তার কোন গর্বও ছিল না। গ্রামের অন্য চাষীর মতো সে একজন পরিশ্রমী চাষী মাত্র। কিন্তু যেহেতু সরকারী কর্মকর্তা ও পুলিশের লোক যে কোন বিষয়ে তার সাথে আলোচনা করে, সেহেতু তার একটা সরকারী মর্যাদা আছে। এজন্য কেউ তার নাম ধরে ডাকে না। তার পিতা, দাদা, পরদাদা বা তার ওপরের দাদাকে লোকে যেমন লামবারদারা সাহেব বলে ডাকত, তাকে লোকে তেমনি সম্বোধন করে।

গ্রামের এই বৈঠকে মুখ খুললেন মসজিদের ইমাম বখশ ও ভাই মিত সিং! ইমাম বখশ একজন তাঁতী। পাঞ্জাবে তাঁতীদের নিয়ে ঠাট্টা করা হয়। তাদের মেয়েলি ও ভীতু স্বভাবের লোক বলে বিবেচনা করা হয় এবং বলা হয় তারা অসতী স্ত্রীর স্বামী। এদের মেয়েরা পরপুরুষের সাথে মেলামেশায় অভ্যস্ত। কিন্তু ইমাম বখাশের বয়স ও ধর্মপরায়ণতার কারণে সবাই তাকে সম্মান করে। তাঁর পরিবারে একাধিক দুঃখজনক ঘটনার কারণে সবাই প্রথমে তাঁকে সমবেদনা জানোত, এখন ভালবাসে। তাঁর স্ত্রী ও পুত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে মারা যায়। তাঁর চোখ কোন সময় ভাল ছিল না। কিন্তু হঠাৎ তা এমনই খারাপ হয়ে যায় যে, সে তাঁত বুনতে অক্ষম হয়ে পড়ে। সে পরিণত হয় ভিক্ষুকে। ছোট মেয়ে নূরানই তাঁকে দেখাশোনা করে। মসজিদেই সে দিনরাত পড়ে থাকে। আর মুসলমান ছেলেমেয়েদের কোরআন পড়া শেখায়। কোরআনের আয়াত লিখে সে গ্রামের লোকদের তাবিজ বানিয়ে দেয়। নানা রোগের জন্য পানিপীড়া দেয়। গ্রামের লোকেরা তাঁকে যে আটা, শাক-সবজি, খাবার, পুরান কাপড় দেয় তাতেই তাঁর ও তাঁর মেয়ের চলে। ইমাম বখশ খুব সুন্দর সুন্দর উপাখ্যান ও প্রবাদ জানেন। গ্রামের চাষীরা এসব তাঁর কাছ থেকে শুনতে খুবই ভালবাসে। তাঁর চেহারা এমন কমনীয় যে, লোকে তাঁকে সম্মান করে। লম্বা পাতলা গড়ন। টাক মাথা। সাদা দাঁড়ি পরিপাটি করে ছাঁটা। মাঝে মাঝে তিনি তাতে মেহেদী রং লাগায়। চোখের ছানিতে একটা রহস্যময় দার্শনিকের অভিব্যক্তি ধরা পড়ে। ষাট বছর বয়স হলেও তাঁকে শক্ত সমর্থ দেখায়। সব কিছু মিলিয়ে তিনি একজন মর্যাদাবান ব্যক্তিত্ব। তাঁর ধাৰ্মিকতার সুনাম সবার কাছেই। গ্রামের লোকদের কাছে তাঁর পরিচিতি ইমাম বখশ বা মসজিদের মোল্লা নয়। চাচা হিসাবেই তিনি সবার কাছে পরিচিত।

মিত সিং-এর প্রতি লোকের অতটা শ্রদ্ধা-ভালবাসা ছিল না। তিনি ছিলেন। একজন কৃষক। কাজ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তিনি ধর্মকে বেছে নিয়েছেন। তার সামান্য কিছু জমি ছিল। তা তিনি বর্গা দেন। জমির সামান্য আয় এবং গুরুদুয়ারায় প্রাপ্ত নৈবদ্য দিয়ে তাঁর আরামেই চলে। তাঁর স্ত্রী বা ছেলেমেয়ে নেই। তিনি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত নন, বা ধর্মালোচনায় তার গভীর পাণ্ডিত্য নেই। তার চেহারাও তাঁর পেশার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বেটে, মোটা ও লোমযুক্ত তাঁর দেহ। তাঁর বয়স ইমাম বখশর মতোই। কিন্তু ইমাম বখশের দাড়িতে যে পবিত্রতার ভাব দেখা যায়, মিত সিং-এর দাড়ি দেখতে তা মনে হয় না। মিত সিং-এর দাড়ি কালো, মাঝে মাঝে পাকা দাড়ি দেখা যায়। অপরিচ্ছন্নভাবেই তিনি থাকেন। তিনি যখন পবিত্র গ্রন্থ পড়েন তখনই মাথায় পাগড়ি বাঁধেন। অন্য সময় তিনি তাঁর লম্বা চুলে গিরে দিয়েই চলাফেরা করেন। তাঁর প্রায় অর্ধেক চুল ঘাড়ের ওপরই পড়ে থাকে। জামা তিনি প্রায় পরেনই না। তাঁর একমাত্র পরিধেয় বস্ত্র হলো এক জোড়া হাফ প্যান্ট, তাও আবার তেল চিটাচিট ময়লা। কিন্তু মিত সিং শান্তিপ্রিয় মানুষ। ইমাম বখশের প্রতি তার যে ভালবাসা আছে তা আমলিন হয়নি কোন কারণে। ইমাম বখশ কোন বিষয়ে কোন প্রস্তাব দিলে তিনি তা নিজের সম্প্রদায়ের লোকদের বলার জন্য ব্যাকুল হন। তাঁদের আলোচনায় বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতার প্রবাহ সৃষ্টি হয়।

গুরুদুয়ারায় অনুষ্ঠিত ঐ বৈঠকের পরিবেশ ছিল হতাশাজনক। সাধারণ লোকের বলার বিশেষ কিছু ছিল না। যারা কিছু বলছিল, তাদের কথার ধরন ছিল ভবিষ্যদ্বক্তার মতো। ইমাম বখশই আলোচনার সূত্রপাত করলেন, আল্লাহ দয়া করুন। আমাদের এখন দুঃসময়।

কয়েকজন লোক দুঃখের নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলল, হ্যাঁ এখন দুঃসময়।

মিত সিং আলোচনায় যোগ দিলেন। হাঁ। চাচা। এটা কলিযুগ, অন্ধকার যুগ।

বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কাটল। অস্বস্তির মধ্যে অনেকে নিজের নিতম্ব চুলকাতে লাগল। কেউ কেউ হাই তুলে মুখ বন্ধ করে খোদার কাছে প্রার্থনা জানাল, ইয়া আল্লাহু, ওয়া গুরু ওয়া গুরু।

সরদার সাহেব, ইমাম বখশ আবার শুরু করলেন, কি ঘটছে। আপনার তো জানা উচিত। ডেপুটি সাহেব আপনাকে ডেকে পাঠালেন না কেন?

আমি কি করে জানব চাচা? তিনি যখন ডাকেন তখনই আমি যাই। তিনি এখন স্টেশনে। সেখানে তো কাউকে যেতে দিচ্ছে না।

একজন যুবক গ্রামবাসী চীৎকার করে উল্লাসের ভঙ্গিতে বলল, আমরা এখনই মরে যাচ্ছি না। কি ঘটছে তা শীগগির আমরা জানতে পারব। এটা একটা ট্রেন ছাড়া তো আর কিছু না। এর মধ্যে হয় সরকারী মাল আর না হয় অস্ত্ৰ আছে। এজন্য তারা পাহারা দিচ্ছে। তোমরা কি শোননি যে, অনেকের সব কিছু লুঠ হয়েছে?

চুপ করা, যুবকটির শাশ্রুমণ্ডিত পিতা ক্রুদ্ধভাবে তাকে তিরস্কার করল। যেখানে প্রবীণরা আছে, সেখানে তোমার কথা বলার প্রয়োজন কি?

আমি শুধু…

বাস্, আর কোন কথা নয়। দৃঢ়ভাবেই যুবকটির পিতা বলল। কিছু সময় আর কেউ কথা বলল না।

ইমাম বখশ দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে ধীর কণ্ঠে বললেন, আমি শুনেছি, ট্রেনে অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে।

উপস্থিত সকলের কাছে দুৰ্ঘটনা শব্দটি উৎকণ্ঠার উদ্রেক করল। হ্যাঁ, অনেক দুৰ্ঘটনার কথা আমিও শুনেছি, মিত সিং তাঁর কথার সমর্থন করলেন।

ইমাম বখশ যে বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন, সেই বিষয়ে আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটানোর উদ্দেশ্যে বললেন, আমরা কেবল খোদার দয়া প্রার্থনা করতে পারি।

খোদার দয়া প্রার্থনায় মিত সিং পিছনে পড়ে রইলেন এমন চিন্তা না করেই তিনি বললেন, ও গুরু, ও গুরু।

তারা সব চুপচাপ বসে রইল। মাঝে মাঝে ইয়া আল্লাহ, ও গুরু শব্দে নীরবতা ভঙ্গ হলো। তাই জমায়েতের বাইরে যে সব লোক ছিল, তারা মেঝের ওপরই ঘুমিয়ে পড়ল।

হঠাৎ একজন পুলিশ গুরুদুয়ারার সামনে এসে উপস্থিত হলো। সরদার ও অন্য চারজন লোক তাকে দেখে দাঁড়াল। যারা ঘুমিয়ে ছিল তাদের খোঁচা দিয়ে ওঠানোর চেষ্টা করা হলো। যারা তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল তারা চোখ মেলে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, কি ব্যাপার? কি হলো? অতঃপর তারা তাড়াতাড়ি মাথায় পাগড়ি বেঁধে নিল।

গ্রামের সর্দার কে?

বানতা সিং দরজার কাছে এলেন। পুলিশ তাঁকে এক পাশে নিয়ে গিয়ে কানে কানে কিছু বলল। বানতা সিং ফিরে আসতেই পুলিশটি জোরে জোরে বলল, তাড়াতাড়ি, আধা ঘন্টার মধ্যেই। স্টেশনের মাঠে দু’টো আর্মি ট্রাক আছে। আমি ওখানেই থাকব।

পুলিশটা বেশ দ্রুততার সঙ্গেই স্থান ত্যাগ করল।

গ্রামের লোকেরা বানতা সিংকে ঘিরে ধরল। গোপন তথ্য জানতে পারায় তাঁকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে হলো। তাঁর কথায় কর্তৃত্বের ভাবও ফুটে উঠল।

তোমাদের ঘরে যে কাঠ ও বাড়তি কেরোসিন তেল আছে তা নিয়ে স্টেশনের কাছে ট্রাকের কাছে যাও। কাঠ ও তেলের জন্য তোমাদের টাকা দেয়া হবে।

গ্রামবাসী অপেক্ষা করে রইল কেন তারা ঐ কাজ করবে তা জানার জন্য। বানতা সিং কড়া সুরেই আদেশ দিলেন, তোমরা কি কালা? আমার কথা তোমরা শোন নি? না তোমরা চাও যে, তোমাদের না যাওয়ার জন্য পুলিশ তোমাদের পাছায় চাবুক মারুক? যাও, তাড়াতাড়ি কর।

গ্রামবাসীরা পরস্পরের সাথে ফিস ফিস করে কথা বলতে বলতে গ্রামের ছোট গলি পথের দিকে চলে গেল। সরদার নিজেও তাঁর বাড়ির দিকে ছুটলেন।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা কাঠের বোঝা ও কেরোসিনের বোতল নিয়ে স্টেশনের পাশে এসে জমায়েত হতে শুরু করল। পাশাপাশি দু’টো বড় সামরিক ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিল। একটা কাঁচা দেয়ালের ধারে লাইন করে পেট্রোলের খালি টিন রাখা ছিল। সেখানে একজন শিখ সৈন্য স্টেনগান হাতে পাহারারত ছিল। অন্য একজন শিখ সামরিক অফিসার একটা ট্রাকের পিছন দিকে বসে পা দোলাচ্ছিলেন। তার দাড়ি পরিপাটি করে পাকানো। অন্য ট্রাকে কাঠ বোঝাই করা তিনি লক্ষ্য করছিলেন। গ্রামবাসীর সম্ভাষণে তিনি মাঝে মাঝে মাথা নত করছিলেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সরদার। তিনি কে কতটা কাঠ এনেছে তা লিখে রাখছিলেন। ট্রাকে কাঠ ও খালি টিনে কেরোসিন তেল ঢালার পর গ্রামবাসীরা ঐ অফিসারের কাছ থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে রইল।

ইমাম বখশ তাঁর মাথায় করে যে কাঠ এনেছিলেন তা ট্রাকে তুলে দিলেন। যে কেরোসিন তেল এনেছিলেন তা সরদারের হাতে দিলেন। মাথার পাগড়ি ঠিক করে বেঁধে নিয়ে তিনি উচ্চ স্বরে বললেন, সালাম সরদার সাহেব।

অফিসারটি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন।

ঈমাম বখশ পুনরায় বললেন, সবকিছু ঠিক আছে তো সরদার সাহেব?

অফিসারটি তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রুক্ষ মেজাজে বললেন, এখন যান। দেখছেন না আমি ব্যস্ত আছি।

ইমাম বখশ তখনও তাঁর পাগড়ি ঠিক করছিলেন। অফিসারের কথা শুনে তিনি মৃদু পায়ে গ্রামবাসীর দলে মিশে গেলেন।

দু’টো ট্রাক ভর্তি হওয়ার পর অফিসারটি বানতা সিংকে পরদিন সকালে টাকা নেয়ার জন্য ক্যাম্পে আসতে বললেন। ট্রাক দু’টো ধুলো উড়িয়ে স্টেশনের দিকে চলে গেল।

আগ্রহী গ্রামবাসীরা সরদারকে ঘিরে ধরল। তিনি অনুভব করলেন যে, ইমাম বখশকে যে অপমান করা হয়েছে তার জন্য তিনি কিছুটা দায়ী। তার নিচুপতার কারণে গ্রামবাসীরা অধৈর্য হয়ে পড়ল।

সরদার সাহেব, আপনি আমাদের কিছু বলছেন না কেন? আপনি কি মনে করেন যে, আপনি বড় একটা কিছু হয়ে গেছেন এবং সেজন্য আমাদের সাথে কথা বলছেন না, মিত সিং রাগের সাথেই বললেন।

না ভাই না। আমি কিছু জানলে তোমাদের কাছে বলব না কেন? তোমরা শিশুর মতো কথা বলছি। সৈন্য ও পুলিশের সাথে আমি কি করে তর্ক করব? তারা আমাকে কিছুই বলেনি। তোমরা দেখলে না, ঐ শুয়োরের বাচ্চাটা কিভাবে চাচার সাথে কথা বলল? প্রত্যেকের সম্মান তার নিজের হাতে। পাগড়ি খুলে দিয়ে আমি কেন নিজেকে অপমানিত করব?

ইমাম বখশ তাঁর বক্তব্যের সমর্থন করলেন, সরদার ঠিকই বলেছে। তোমার কথা বলার সময় কেউ যদি চিৎকার করে তাহলে চুপ থাকাই ভাল। চল বাড়ি ফিরে যাই। তোমাদের বাড়ির ছাদ থেকেই তোমরা দেখতে পাবে তারা কি করছে।

গ্রামবাসীরা তাদের নিজ নিজ ঘরে গিয়ে ছাদের ওপরে উঠে কিছু দেখার চেষ্টা করল। সেখান থেকেই স্টেশনের কাছে ক্যাম্পের ধারে ট্রাক দু’টো দেখা গেল। সেখান থেকে ট্রাক দু’টো রেল লাইনের পাশ দিয়ে পূর্বদিকে গেল। ট্রেনের সিগনাল খুঁটি ছাড়িয়ে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে ট্রাক দু’টো রেল রাস্ত পার হয়ে আবার বাঁদিকে মোড় নিল। অতঃপর স্টেশনের দিকে এসে ট্রাক দু’টো ভূতুড়ে ট্রেনের পাশে হারিয়ে গেল।

সারা বিকাল ধরে গ্রামবাসীরা ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে এ ওকে জিজ্ঞস করল কেউ কিছু দেখতে পেয়েছে কিনা। এই উত্তেজনার মাঝে তারা তাদের দুপুরের খাবার তৈরি করতেও ভুলে গেল। মায়েরা তাদের শিশুদের আগের দিনের বাসি জিনিস খাওয়াল। ঘরের মাঝে অগ্নিকুণ্ড জ্বালাতে মেয়ের ভুলে গেল। পুরুষরা ভুলে গেল তাদের গৃহপালিত পশুকে খাবার দিতে, এমন কি সুন্ধ্যা এগিয়ে এলেও তাদের দুধ দোহনের কথা স্মরণ হলো না। সত্যি সত্যি যখন ব্রিজের খিলানের নিচে সূর্য ডুবে গেল তখনই তাদের দৈনন্দিন কাজ সম্পাদন না করার কথা স্মরণ হলো। অন্ধকার ঘনিয়ে আসলেই শিশুরা খাবার খাওয়ার বায়না ধরবে। কিন্তু স্টেশনের দিকে তখনও দাঁড়িয়ে আছে মহিলারা। যদি কিছু দেখা যায়, এই আশায়। গোয়ালে গরু ও মহিষের ডাক শোনা গেল মাঝে মাঝে। কিন্তু পুরুষরা তখনও ছাদে দাঁড়িয়ে স্টেশনের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই আশা করছিল কিছু একটা ঘটার।

শেষে সূর্য ডুবে গেল ব্রিজের ওপারে। আকাশের সাদা মেঘ তামা, কমলা ও পাটল বর্ণ ধারণ করল। সন্ধ্যা গোধূলি এবং গোধূলি অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার সাথে সাথে আকাশের ঐ সব রং একটা ধূসর আভায় আচ্ছাদিত হলো। স্টেশনকে মনে হলো একটা কালো দেয়াল। ক্লান্ত হয়ে পুরুষ ও মেয়ের ছাদ থেকে ঘরের আঙ্গিনায় নেমে এলো। অন্যকেও তারা ছাদ থেকে নেমে আসার পরামর্শ দিল। নিজে বঞ্চিত থেকে অন্য কেউ কোন ঘটনা প্রত্যক্ষ করুক, এটা কেউ চাইল না।

উত্তর দিকের আকাশে নীলাভ ধূসর আভা ক্রমেই কমলা রং ধারণ করল। ঐ কমলা রঙয়ের আভা প্রথমে তামাটে এবং পরে উজ্জ্বল পাটল বর্ণ ধারণ করল। অন্ধকার আকাশে আগুনের লেলিহান শিখা উর্ধ্বমুখী দেখা গেল। গ্রামের ওপর দিয়ে মৃদু বায়ু বয়ে যেতে লাগল। এই বায়ুতে প্রথম ভেসে এলো কেরোসিন পোড়ার গন্ধ, তারপর কাঠ পোড়ার গন্ধ এবং সব শেষে ভেসে এলো মূৰ্ছা যাওয়ার মতো কটু মানুষ পোড়ার গন্ধ।

সমস্ত গ্রামটা মৃত্যুর নীরবতার মতো যেন নীরব হয়ে গেল। কেউ কাউকে কি ঘটছে তা জিজ্ঞাসা করল না। তারা সবাই বুঝতে পেরেছে। এ ধরনের ঘটনা তাদের কারও অজানা নেই। ট্রেনটা পাকিস্তান থেকে এসেছে, এ কথার মধ্যেই সবার অবগতির গূঢ় অর্থ নিহিত ছিল।

মানো মাজরার ইতিহাসে ঐ সন্ধ্যায় প্রথমবারের মতো খোদার প্রশংসা ধ্বনি ইমাম বখশের কণ্ঠে আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হলো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *