২.১৭ জন্মভূমিসন্দর্শন

দ্বিতীয় খণ্ডসপ্তদশ অধ্যায়: জন্মভূমিসন্দর্শন

ভৈরবী ব্রাহ্মণী হৃদয়ের সহিত ঠাকুরের কামারপুকুরে গমন

প্রায় ছয়মাস কাল ভুগিয়া ঠাকুরের শরীর অবশেষে ব্যাধির হস্ত হইতে মুক্ত হইল এবং মন ভাবমুখে দ্বৈতাদ্বৈতভূমিতে অবস্থান করিতে অনেকাংশে অভ্যস্ত হইয়া আসিল। কিন্তু তাঁহার শরীর তখনও পূর্বের ন্যায় সুস্থ ও সবল হয় নাই। সুতরাং বর্ষাগমে গঙ্গার জল লবণাক্ত হইলে বিশুদ্ধ পানীয়ের অভাবে তাঁহার পেটের পীড়া পুনরায় দেখা দিবার সম্ভাবনা ভাবিয়া মথুরবাবু প্রমুখ সকলে স্থির করিলেন, তাঁহার কয়েক মাসের জন্য জন্মভূমি কামারপুকুরে গমন করাই শ্রেয়ঃ। তখন সন ১২৭৪ সালের জ্যৈষ্ঠ মাস হইবে। মথুরপত্নী ভক্তিমতী জগদম্বা দাসী ঠাকুরের কামারপুকুরের সংসার শিবের সংসারের ন্যায় চির-দরিদ্র বলিয়া জানিতেন। অতএব সেখানে যাইয়া ‘বাবা’কে যাহাতে কোন দ্রব্যের অভাবে কষ্ট পাইতে না হয়, এই প্রকারে তন্ন তন্ন করিয়া সকল বিষয় গুছাইয়া তাঁহার সঙ্গে দিবার জন্য আয়োজন করিতে লাগিলেন।1 অনন্তর শুভমুহূর্তের উদয় হইলে, ঠাকুর যাত্রা করিলেন। হৃদয় ও ভৈরবী ব্রাহ্মণী তাঁহার সঙ্গে যাইলেন। তাঁহার বৃদ্ধা জননী কিন্তু গঙ্গাতীরে বাস করিবেন বলিয়া ইতঃপূর্বে যে সঙ্কল্প করিয়াছিলেন, তাহাই স্থির রাখিয়া দক্ষিণেশ্বরে বাস করিতে লাগিলেন।


1. গুরুভাবউত্তরার্ধ, ১ম অধ্যায়।

ঠাকুরকে তাঁহার আত্মীয়বন্ধুগণ যে ভাবে দেখিয়াছিল

ইতঃপূর্বে প্রায় আট বৎসরকাল ঠাকুর কামারপুকুরে আগমন করেন নাই, সুতরাং তাঁহার আত্মীয়বর্গ যে তাঁহাকে দেখিবার জন্য উদ্গ্রীব হইয়াছিলেন, একথা বলা বাহুল্য। কখনও স্ত্রীবেশ ধরিয়া ‘হরি হরি’ করিতেছেন, কখনও সন্ন্যাসী হইয়াছেন, কখনও ‘আল্লা আল্লা’ বলিতেছেন, প্রভৃতি তাঁহার সম্বন্ধে নানা কথা মধ্যে মধ্যে তাঁহাদিগের কর্ণগোচর হওয়ায় ঐরূপ হইবার বিশেষ কারণ যে ছিল, একথা বলিতে হইবে না। কিন্তু ঠাকুর তাঁহাদিগের মধ্যে আসিবামাত্র তাঁহাদিগের চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হইল। তাঁহারা দেখিলেন, তিনি পূর্বে যেমন ছিলেন এখনও তদ্রূপ আছেন। সেই অমায়িকতা, সেই প্রেমপূর্ণ হাস্যপরিহাস, সেই কঠোর সত্যনিষ্ঠা, সেই ধর্মপ্রাণতা, সেই হরিনামে বিহ্বল হইয়া আত্মহারা হওয়া – সেই সকলই তাঁহাতে পূর্বের ন্যায় পূর্ণমাত্রায় রহিয়াছে, কেবল কি একটা অদৃষ্টপূর্ব অনির্বচনীয় দিব্যাবেশ তাঁহার শরীরমনকে সর্বদা এমন সমুদ্ভাসিত করিয়া রাখিয়াছে যে, সহসা তাঁহার সম্মুখীন হইতে এবং তিনি স্বয়ং ঐরূপ না করিলে ক্ষুদ্র সংসারের বিষয় লইয়া তাঁহার সহিত আলাপ-পরিচয় করিতে তাঁহাদিগের অন্তরে বিষম সঙ্কোচ আসিয়া উপস্থিত হয়। তদ্ভিন্ন অন্য এক বিষয় তাঁহারা এখন বিশেষরূপে এই ভাবে লক্ষ্য করিয়াছিলেন। তাঁহারা দেখিয়াছিলেন, তাঁহার নিকটে থাকিলে সংসারের সকল দুর্ভাবনা কোথায় অপসারিত হইয়া তাঁহাদিগের প্রাণে একটি ধীর স্থির আনন্দ ও শান্তির ধারা প্রবাহিত থাকে এবং দূরে যাইলে পুনরায় তাঁহার নিকটে যাইবার জন্য একটা অজ্ঞাত আকর্ষণে তাঁহারা প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়েন।

শ্রীশ্রীমার কামারপুকুরে আগমন

সে যাহা হউক, বহুকাল পরে তাঁহাকে পাইয়া এই দরিদ্র সংসারে এখন আনন্দের হাটবাজার বসিল, এবং নববধূকে আনাইয়া সুখের মাত্রা পূর্ণ করিবার জন্য রমণীগণের নির্দেশে ঠাকুরের শ্বশুরালয় জয়রামবাটী গ্রামে লোক প্রেরিত হইল। ঠাকুর এ বিষয় জানিতে পারিয়া উহাতে বিশেষ সম্মতি বা আপত্তি কিছুই প্রকাশ করিলেন না। বিবাহের পর নববধূর ভাগ্যে একবার মাত্র স্বামিসন্দর্শনলাভ হইয়াছিল। কারণ, তাঁহার সপ্তম বর্ষ বয়সকালে কুলপ্রথানুসারে ঠাকুরকে একদিন জয়রামবাটীতে লইয়া যাওয়া হইয়াছিল। কিন্তু তখন তিনি নিতান্ত বালিকা; সুতরাং ঐ ঘটনা সম্বন্ধে তাঁহার এইটুকুমাত্রই মনে ছিল যে, হৃদয়ের সহিত ঠাকুর তাঁহার পিত্রালয়ে আসিলে বাটীর কোন নিভৃত অংশে তিনি লুকাইয়াও পরিত্রাণ পান নাই। কোথা হইতে অনেকগুলি পদ্মফুল আনিয়া হৃদয় তাঁহাকে খুঁজিয়া বাহির করিয়াছিল এবং লজ্জা ও ভয়ে তিনি নিতান্ত সঙ্কুচিতা হইলেও তাঁহার পাদপদ্ম পূজা করিয়াছিল। ঐ ঘটনার প্রায় ছয় বৎসর পরে তাঁহার ত্রয়োদশ বর্ষ বয়ঃক্রমকালে তাঁহাকে কামারপুকুরে প্রথম লইয়া যাওয়া হয়। সেবার তাঁহাকে তথায় একমাস থাকিতেও হইয়াছিল। কিন্তু ঠাকুর ও ঠাকুরের জননী তখন দক্ষিণেশ্বরে থাকায় উভয়ের কাহাকেও দেখা তাঁহার ভাগ্যে হইয়া উঠে নাই। উহার ছয় মাস আন্দাজ পরে পুনরায় শ্বশুরালয়ে আগমনপূর্বক দেড়মাস কাল থাকিয়াও পূর্বোক্ত কারণে তিনি তাঁহাদের কাহাকেও দেখিতে পান নাই। মাত্র তিন-চারি মাস তাঁহার তথা হইতে পিত্রালয়ে ফিরিবার পরেই এখন সংবাদ আসিল – ঠাকুর আসিয়াছেন, তাঁহাকে কামারপুকুরে যাইতে হইবে। তিনি তখন ছয়-সাত মাস হইল চতুর্দশ বৎসরে পদার্পণ করিয়াছেন। সুতরাং বলিতে গেলে বিবাহের পরে ইহাই তাঁহার প্রথম স্বামিসন্দর্শন।

আত্মীয়বর্গ বাল্যবন্ধুগণের সহিত ঠাকুরের এই কালের আচরণ

কামারপুকুরে ঠাকুর এবার ছয়-সাত মাস ছিলেন। তাঁহার বাল্যবন্ধুগণ এবং গ্রামস্থ পরিচিত স্ত্রী-পুরুষ সকলে তাঁহার সহিত পূর্বের ন্যায় মিলিত হইয়া তাঁহার প্রীতিসম্পাদনে সচেষ্ট হইয়াছিলেন। ঠাকুরও বহুকাল পরে তাঁহাদিগকে দেখিয়া পরিতুষ্ট হইয়াছিলেন। দীর্ঘকাল কঠোর পরিশ্রমের পর অবসরলাভে চিন্তাশীল মনীষিগণ বালক-বালিকাদিগের অর্থহীন উদ্দেশ্যরহিত ক্রীড়াদিতে যোগদান করিয়া যেরূপ আনন্দ অনুভব করেন, কামারপুকুরের স্ত্রী-পুরুষ সকলের ক্ষুদ্র সাংসারিক জীবনে যোগদান করিয়া ঠাকুরের বর্তমান আনন্দ তদ্রূপ হইয়াছিল। তবে, ইহজীবনের নশ্বরতা অনুভব করিয়া যাহাতে তাহারা সংসারে থাকিয়াও ধীরে ধীরে সংযত হইতে এবং সকল বিষয়ে ঈশ্বরের উপর নির্ভর করিতে শিক্ষালাভ করে, তদ্বিষয়ে তিনি সর্বদা দৃষ্টি রাখিতেন, একথা নিশ্চয় বলা যায়। ক্রীড়া, কৌতুক, হাস্য-পরিহাসের ভিতর দিয়া তিনি আমাদিগকে নিরন্তর ঐসকল বিষয় যেভাবে শিক্ষা দিতেন, তাহা হইতে আমরা পূর্বোক্ত কথা অনুমান করিতে পারি।

উহাদিগের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তির আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্বন্ধে ঠাকুরের কথা

আবার এই ক্ষুদ্র পল্লীর অন্তর্গত ক্ষুদ্র সংসারে থাকিয়া কেহ কেহ ধর্মজীবনে আশাতীত অগ্রসর হইয়াছে দেখিয়া তিনি ঈশ্বরের অচিন্ত্য মহিমা-ধ্যানে মুগ্ধ হইয়াছিলেন। ঐ বিষয়ক একটি ঘটনার তিনি বহুবার আমাদিগের নিকটে উল্লেখ করিতেন। ঠাকুর বলিতেন – এই সময়ে একদিন তিনি আহারান্তে নিজগৃহে বিশ্রাম করিতেছেন। প্রতিবেশিনী কয়েকটি রমণী তাঁহাকে দর্শন করিতে আসিয়াছিলেন এবং নিকটে উপবিষ্টা থাকিয়া তাঁহার সহিত ধর্মসম্বন্ধীয় নানা প্রশ্নালাপে নিযুক্তা ছিলেন। ঐ সময়ে সহসা তাঁহার ভাবাবেশ হয় এবং অনুভূতি হইতে থাকে তিনি যেন মীনরূপে সচ্চিদানন্দসাগরে পরমানন্দে ভাসিতেছেন, ডুবিতেছেন এবং নানাভাবে সন্তরণক্রীড়া করিতেছেন। কথা কহিতে কহিতে তিনি অনেক সময়ে ঐরূপে ভাবাবেশে মগ্ন হইতেন। সুতরাং রমণীগণ উহাতে কিছুমাত্র মন না দিয়া উপস্থিত বিষয়ে নিজ নিজ মতামত প্রকাশ করিয়া গণ্ডগোল করিতে লাগিলেন। তন্মধ্যে একজন তাঁহাদিগকে ঐরূপ করিতে নিষেধ করিয়া ঠাকুরের ভাবাবেশ যতক্ষণ না ভঙ্গ হয়, ততক্ষণ স্থির হইয়া থাকিতে বলিলেন। বলিলেন, “উনি (ঠাকুর) এখন মীন হইয়া সচ্চিদানন্দসাগরে সন্তরণ দিতেছেন, গোলমাল করিলে উঁহার ঐ আনন্দে ব্যাঘাত হইবে।” রমণীর কথায় অনেকে তখন বিশ্বাস স্থাপন না করিলেও সকলে নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। পরে ভাবভঙ্গে ঠাকুরকে ঐকথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন, “রমণী সত্যই বলিয়াছে। আশ্চর্য, কিরূপে ঐ বিষয় জানিতে পারিল!”

কামারপুকুরবাসীদিগকে ঠাকুরের অপূর্ব নূতনভাবে দেখিবার কারণ

কামারপুকুরপল্লীস্থ নরনারীর দৈনন্দিন জীবন ঠাকুরের নিকটে এখন যে অনেকাংশে নবীন বলিয়া বোধ হইয়াছিল, একথা বুঝিতে পারা যায়। বিদেশ হইতে বহুকাল পরে প্রত্যাগত ব্যক্তির, স্বদেশের প্রত্যেক ব্যক্তি ও বিষয়কে যেমন নূতন বলিয়া বোধ হয়, ঠাকুরের এখন অনেকটা তদ্রূপ হইয়াছিল। কারণ ঐ কেবল আট বৎসরকাল মাত্র জন্মভূমি হইতে দূরে থাকিলেও ঐ কালের মধ্যে ঠাকুরের অন্তরে সাধনার প্রবল ঝটিকা প্রবাহিত হইয়া উহাতে আমূল পরিবর্তন উপস্থিত করিয়াছিল। ঐ সময়ে তিনি আপনাকে ভুলিয়াছিলেন, জগৎ ভুলিয়াছিলেন এবং দূরাৎ সুদূরে দেশকালের সীমার বহির্ভাগে যাইয়া উহার ভিতরে পুনরায় ফিরিবার কালে সর্বভূতে ব্রহ্মদৃষ্টিসম্পন্ন হইয়া আগমনপূর্বক সকল ব্যক্তি ও বিষয়কে অপূর্ব নবীনভাবে দেখিতে পাইয়াছিলেন। চিন্তাশ্রেণীসমূহের পারম্পর্য হইতেই আমাদিগের কালের অনুভূতি এবং উহার দৈর্ঘ্য-স্বল্পতাদি পরিমাণের উপলব্ধি হইয়া থাকে, একথা দর্শনপ্রসিদ্ধ। ঐজন্য স্বল্পকালের মধ্যে প্রভূত চিন্তারাশির অন্তরে উদয় ও লয় হইলে ঐকাল আমাদিগের নিকট সুদীর্ঘ বলিয়া প্রতীত হয়। পূর্বোক্ত আট বৎসরে ঠাকুরের অন্তরে কি বিপুল চিন্তারাশি প্রকটিত হইয়াছিল তাহা ভাবিলে আশ্চর্যান্বিত হইতে হয়! সুতরাং ঐ কালকে তাঁহার যে এক যুগতুল্য বলিয়া অনুভব হইবে, ইহা বিচিত্র নহে।

জন্মভূমির সহিত ঠাকুরের চিরপ্রেমসম্বন্ধ

কামারপুকুরে স্ত্রী-পুরুষ সকলকে ঠাকুর কি অদ্ভুত প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ করিয়াছিলেন, তাহা ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। গ্রামের জমিদার লাহাবাবুদের বাটী হইতে আরম্ভ করিয়া ব্রাহ্মণ, কামার, সূত্রধর, সুবর্ণবণিক প্রভৃতি সকল জাতীয় প্রতিবেশিগণের পরিবারভুক্ত স্ত্রী-পুরুষদিগের সকলেই তাঁহার সহিত শ্রদ্ধাপূর্ণ প্রেমসম্বন্ধে নিয়ন্ত্রিত ছিল। শ্রীযুক্ত ধর্মদাস লাহার সরলহৃদয়া ভক্তিমতী বিধবা কন্যা প্রসন্ন ও ঠাকুরের বাল্যসখা, তৎপুত্র গয়াবিষ্ণু লাহা, সরলবিশ্বাসী শ্রীনিবাস শাঁখারী, পাইনদের বাটীর ভক্তিপরায়ণা রমণীগণ, ঠাকুরের ভিক্ষামাতা কামারকন্যা ধনী প্রভৃতি অনেকের ভক্তি-ভালবাসার কথা ঠাকুর বিশেষ প্রীতির সহিত অনেক সময় আমাদিগকে বলিতেন এবং আমরাও শুনিয়া মুগ্ধ হইতাম। ইঁহারা সকলে প্রায় সর্বক্ষণ তাঁহার নিকটে উপস্থিত থাকিতেন। বিষয় বা গৃহকর্মের অনুরোধে যাঁহারা ঐরূপ করিতে পারিতেন না, তাঁহারা সকাল সন্ধ্যা বা মধ্যাহ্নে অবসর পাইলেই আসিয়া উপস্থিত হইতেন। রমণীগণ তাঁহাকে ভোজন করাইয়া পরম পরিতৃপ্তি লাভ করিতেন, তজ্জন্য নানাবিধ খাদ্যসামগ্রী নিজ সঙ্গে লইয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত হইতেন। গ্রামবাসিগণের ঐসকল মধুর আচরণ এবং আত্মীয়স্বজনের মধ্যে থাকিয়াও ঠাকুর নিরন্তর কিরূপ দিব্য ভাবাবেশে থাকিতেন, সেসকল কথার আভাস আমরা অন্যত্র পাঠককে দিয়াছি,1 সেজন্য পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন।


1. গুরুভাবউত্তরার্ধ, ১ম অধ্যায়।

ঠাকুরের নিজ পত্নীর প্রতি কর্তব্যপালনের আরম্ভ

কামারপুকুরে আসিয়া ঠাকুর এই সময়ে একটি সুমহৎ কর্তব্যপালনে যত্নপরায়ণ হইয়াছিলেন। নিজ পত্নীর তাঁহার নিকটে আসা না আসা সম্বন্ধে উদাসীন থাকিলেও যখন তিনি তাঁহার সেবা করিতে কামারপুকুরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ঠাকুর তখন তাঁহাকে শিক্ষাদীক্ষাদি প্রদানপূর্বক তাঁহার কল্যাণসাধনে তৎপর হইয়াছিলেন। ঠাকুরকে বিবাহিত জানিয়া শ্রীমদাচার্য তোতাপুরী তাঁহাকে এক সময়ে বলিয়াছিলেন, “তাহাতে আসে যায় কি? স্ত্রী নিকটে থাকিলেও যাহার ত্যাগ, বৈরাগ্য, বিবেক, বিজ্ঞান সর্বতোভাবে অক্ষুণ্ণ থাকে, সেই ব্যক্তিই ব্রহ্মে যথার্থ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, স্ত্রী ও পুরুষ উভয়কেই যিনি সমভাবে আত্মা বলিয়া সর্বক্ষণ দৃষ্টি ও তদনুরূপ ব্যবহার করিতে পারেন, তাঁহারই যথার্থ ব্রহ্মবিজ্ঞান লাভ হইয়াছে; স্ত্রী-পুরুষে ভেদদৃষ্টিসম্পন্ন অপর সকলে সাধক হইলেও ব্রহ্মবিজ্ঞান হইতে বহুদূরে রহিয়াছে।” শ্রীমৎ তোতার পূর্বোক্ত কথা ঠাকুরের স্মরণপথে উদিত হইয়া তাঁহাকে বহুকালব্যাপী সাধনলব্ধ নিজ বিজ্ঞানের পরীক্ষায় এবং নিজ পত্নীর কল্যাণসাধনে নিযুক্ত করিয়াছিল।

বিষয়ে ঠাকুর কতদূর সুসিদ্ধ হইয়াছিলেন

কর্তব্য বলিয়া বিবেচিত হইলে ঠাকুর কখনও কোন কার্য উপেক্ষা বা অর্ধসম্পন্ন করিয়া ফেলিয়া রাখিতে পারিতেন না; বর্তমান বিষয়েও তদ্রূপ হইয়াছিল। ঐহিক, পারত্রিক সকল বিষয়ে সর্বতোভাবে তাঁহার মুখাপেক্ষী বালিকা-পত্নীকে শিক্ষাপ্রদান করিতে অগ্রসর হইয়া তিনি ঐ বিষয়ে অর্ধনিষ্পন্ন করিয়া ক্ষান্ত হন নাই। দেবতা, গুরু ও অতিথি প্রভৃতির সেবা এবং গৃহকর্মে যাহাতে তিনি কুশলা হয়েন, টাকার সদ্ব্যবহার করিতে পারেন এবং সর্বোপরি ঈশ্বরে সর্বস্ব সমর্পণ করিয়া দেশকালপাত্রভেদে সকলের সহিত ব্যবহার করিতে নিপুণা হইয়া উঠেন,1 তদ্বিষয়ে এখন হইতে তিনি বিশেষ লক্ষ্য রাখিয়াছিলেন। অখণ্ডব্রহ্মচর্যসম্পন্ন নিজ আদর্শ জীবন সম্মুখে রাখিয়া পূর্বোক্তরূপ শিক্ষাপ্রদানের ফল কতদূর কিরূপ হইয়াছিল, তদ্বিষয়ের আমরা অন্যত্র আভাস প্রদান করিয়াছি। অতএব এখানে সংক্ষেপে ইহাই বলিলে চলিবে যে, শ্রীমতী মাতাঠাকুরানী ঠাকুরের কামগন্ধরহিত বিশুদ্ধ প্রেমলাভে সর্বতোভাবে পরিতৃপ্তা হইয়া সাক্ষাৎ ইষ্টদেবতাজ্ঞানে ঠাকুরকে আজীবন পূজা করিতে এবং তাঁহার শ্রীপদানুসারিণী হইয়া নিজ জীবন গড়িয়া তুলিতে সমর্থা হইয়াছিলেন।


1. গুরুভাবপূর্বার্ধ, ২য় অধ্যায় এবং ৪র্থ অধ্যায়।

পত্নীর প্রতি ঠাকুরের ঐরূপ আচরণদর্শনে ব্রাহ্মণীর আশঙ্কা ভাবান্তর

পত্নীর প্রতি কর্তব্যপালনে অগ্রসর ঠাকুরকে ভৈরবী ব্রাহ্মণী এখন অনেক সময় বুঝিতে পারেন নাই। শ্রীমৎ তোতার সহিত মিলিত হইয়া ঠাকুরের সন্ন্যাসগ্রহণ করিবার কালে তিনি তাঁহাকে ঐ কর্ম হইতে বিরত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন।1 তাঁহার মনে হইয়াছিল, সন্ন্যাসী হইয়া অদ্বৈততত্ত্বের সাধনে অগ্রসর হইলে ঠাকুরের হৃদয় হইতে ঈশ্বরপ্রেমের এককালে উচ্ছেদ হইয়া যাইবে। ঐরূপ কোন আশঙ্কাই এই সময়ে তাঁহার হৃদয় অধিকার করিয়াছিল। বোধ হয় তিনি ভাবিয়াছিলেন, ঠাকুর নিজ পত্নীর সহিত ঐরূপ ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হইলে তাঁহার ব্রহ্মচর্যের হানি হইবে। ঠাকুর কিন্তু পূর্ববারের ন্যায় এবারেও ব্রাহ্মণীর উপদেশ রক্ষা করিয়া চলিতে পারেন নাই। ব্রাহ্মণী যে উহাতে নিতান্ত ক্ষুণ্ণা হইয়াছিলেন, একথা বুঝিতে পারা যায়। কিন্তু ঐরূপেই এই বিষয়ের পরিসমাপ্তি হয় নাই। ঐ ঘটনায় তাঁহার অভিমান প্রতিহত হইয়া ক্রমে অহঙ্কারে পরিণত হইয়াছিল এবং কিছুকালের জন্য উহা তাঁহাকে ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধাবিহীনা করিয়াছিল। হৃদয়ের নিকটে শুনিয়াছি, সময়ে সময়ে তিনি ঐ বিষয়ের প্রকাশ্য পরিচয় পর্যন্ত প্রদান করিয়া বসিতেন। যথা – আধ্যাত্মিক বিষয়ে কোন প্রশ্ন তাঁহার সমীপে উত্থাপন করিয়া যদি কেহ বলিত, শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে ঐকথা জিজ্ঞাসা করিয়া তাঁহার মতামত গ্রহণ করিবে, তাহা হইলে ব্রাহ্মণী ক্রুদ্ধা হইয়া বলিয়া বসিতেন, “সে আবার বলিবে কি? তাহার চক্ষুদান তো আমিই করিয়াছি!” অথবা সামান্য কারণে এবং সময়ে সময়ে বিনা কারণে বাটীর স্ত্রীলোকদিগের উপরে অসন্তুষ্ট হইয়া তিরস্কার করিয়া বসিতেন। ঠাকুর কিন্তু তাঁহার ঐরূপ কথা বা অন্যায় অত্যাচারে অবিচলিত থাকিয়া তাঁহাকে পূর্বের ন্যায় ভক্তিশ্রদ্ধা করিতে বিরত হয়েন নাই। তাঁহার নির্দেশে শ্রীমতী মাতাঠাকুরানী শ্বশ্রূতুল্যা জানিয়া ভক্তিপ্রীতির সহিত সর্বদা ব্রাহ্মণীর সেবাদিতে নিযুক্তা থাকিতেন এবং তাঁহার কোন কথা বা কার্যের কখনও প্রতিবাদ করিতেন না।


1. গুরুভাবপূর্বার্ধ, ২য় অধ্যায়।

অভিমানঅহঙ্কারের বৃদ্ধিতে ব্রাহ্মণীর বুদ্ধিনাশ

অভিমান, অহঙ্কার বৃদ্ধি পাইলে বুদ্ধিমান মনুষ্যেরও মতিভ্রম উপস্থিত হয়। অতএব ঐরূপ অহঙ্কার পদে পদে প্রতিহত হইতে দেখিয়াই মানব উহার বিপরীত ফল অবশ্যম্ভাবী বলিয়া জানিতে পারে এবং উহাকে পরিত্যাগপূর্বক নিজ কল্যাণসাধনের অবসর লাভ করে। বিদুষী সাধিকা ব্রাহ্মণীরও এখন ঐরূপ হইয়াছিল। অহঙ্কারের বশবর্তিনী হইয়া তিনি ‘যেখানে যেমন, সেখানে তেমন’ ব্যবহার করিতে না পারিয়া এই সময়ে একদিন বিষম অনর্থ উপস্থিত করিয়াছিলেন।

বিষয়ক ঘটনা

শ্রীনিবাস শাঁখারীর কথা আমরা ইতঃপূর্বে উল্লেখ করিয়াছি। উচ্চ জাতিতে জন্মপরিগ্রহ না করিলেও শ্রীনিবাস ভগবদ্ভক্তিতে অনেক ব্রাহ্মণের অপেক্ষা বড় ছিলেন। শ্রীশ্রীরঘুবীরের প্রসাদ পাইবার জন্য ইনি একদিন এই সময়ে ঠাকুরের সমীপে আগমন করেন। ভক্ত শ্রীনিবাসকে পাইয়া ঠাকুর এবং তাঁহার পরিবারবর্গের সকলে সেদিন বিশেষ আনন্দিত হইয়াছিলেন। ভক্তিমতী ব্রাহ্মণীও শ্রীনিবাসের বিশ্বাসভক্তি দর্শনে পরিতুষ্টা হইয়াছিলেন। মধ্যাহ্নকাল পর্যন্ত নানা ভক্তিপ্রসঙ্গে অতিবাহিত হইল এবং শ্রীশ্রীরঘুবীরের ভোগরাগাদি সম্পূর্ণ হইলে শ্রীনিবাস প্রসাদ পাইতে বসিলেন। ভোজনান্তে প্রচলিত প্রথামত তিনি আপন উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করিতে প্রবৃত্ত হইলে ব্রাহ্মণী তাঁহাকে নিষেধ করিলেন এবং বলিলেন, “আমরাই উহা করিব এখন।” ব্রাহ্মণী বারংবার ঐরূপ বলায় শ্রীনিবাস অগত্যা নিরস্ত হইয়া নিজ বাটীতে গমন করিলেন।

ব্রাহ্মণীর সহিত হৃদয়ের কলহ

সমাজ-প্রবল পল্লীগ্রামে সামান্য সামাজিক নিয়মভঙ্গ লইয়া অনেক সময় বিষম গণ্ডগোল এবং দলাদলির সৃষ্টি হইয়া থাকে। এখনও ঐরূপ হইবার উপক্রম হইল। কারণ, ব্রাহ্মণকন্যা ভৈরবী শ্রীনিবাসের উচ্ছিষ্ট মোচন করিবেন, এই বিষয় লইয়া ঠাকুরকে দর্শন করিতে সমাগতা পল্লীবাসিনী ব্রাহ্মণকন্যাগণ বিশেষ আপত্তি করিতে লাগিলেন। ভৈরবী ব্রাহ্মণী তাঁহাদের ঐরূপ আপত্তি স্বীকার করিতে সম্মতা হইলেন না। ক্রমে গণ্ডগোল বাড়িয়া উঠিল এবং ঠাকুরের ভাগিনেয় হৃদয় ঐকথা শুনিতে পাইল। সামান্য বিষয় লইয়া বিষম গোল বাধিবার সম্ভাবনা দেখিয়া হৃদয় ব্রাহ্মণীকে ঐ কার্যে বিরত হইতে বলিলেও তিনি তাহার কথা গ্রহণ করিলেন না। তখন ব্রাহ্মণী ও হৃদয়ের মধ্যে তুমুল বিবাদ উপস্থিত হইল। হৃদয় উত্তেজিত হইয়া বলিল, “ঐরূপ করিলে তোমাকে ঘরে থাকিতে স্থান দিব না।” ব্রাহ্মণীও ছাড়িবার পাত্রী নহেন, বলিলেন – “না দিলে ক্ষতি কি? শীতলার ঘরে1 মনসা2 শোবে এখন!” তখন বাটীর অন্য সকলে মধ্যস্থ হইয়া নানা অনুনয়-বিনয়ে ব্রাহ্মণীকে ঐ কার্য হইতে নিরস্ত করিয়া বিবাদশান্তি করিলেন।


1. অর্থাৎ দেবমন্দিরে।
2. ব্রাহ্মণী ঐরূপে ক্রুদ্ধ সর্পের সহিত আপনাকে সমতুল্য করেন।

ব্রাহ্মণীর নিজ ভ্রম বুঝিতে পারিয়া অপরাধের আশঙ্কা, অনুতাপ ক্ষমা চাহিয়া কাশীগমন

অভিমানিনী ব্রাহ্মণী সেদিন নিরস্তা হইলেও অন্তরে বিষম আঘাত পাইয়াছিলেন। ক্রোধের উপশম হইলে তিনি শান্তভাবে চিন্তা করিয়া আপন ভ্রম বুঝিতে পারিলেন এবং ভাবিলেন, এখানে যখন ঐরূপ মতিভ্রম উপস্থিত হইতেছে, তখন অতঃপর এইখানে তাঁহার আর অবস্থান করা শ্রেয়ঃ নহে। সদসদ্বিচারসম্পন্ন বিবেকী সাধক যখন অন্তরদর্শনে নিযুক্ত হয়েন, চিত্তের কোন মলিন ভাবই তখন তাঁহার নিকট আত্মগোপন করিতে পারে না – ব্রাহ্মণীরও এখন তদ্রূপ হইয়াছিল। ঠাকুরের প্রতি তাঁহার ভাবপরিবর্তনের আলোচনা করিয়া তিনি উহারও মূলে আত্মদোষ দেখিতে পাইলেন এবং মনে মনে সাতিশয় অনুতপ্তা হইলেন। অনন্তর কয়েক দিন গত হইলে এক দিবস তিনি ভক্তিসহকারে বিবিধ পুষ্পমাল্য স্বহস্তে রচনা ও চন্দনচর্চিত করিয়া শ্রীগৌরাঙ্গজ্ঞানে ঠাকুরকে মনোহর বেশে ভূষিত করিলেন এবং সর্বান্তঃকরণে ক্ষমাপ্রার্থনা করিলেন। পরে সংযতা হইয়া মনপ্রাণ ঈশ্বরে অর্পণপূর্বক কামারপুকুর পশ্চাতে রাখিয়া কাশীধামের পথ অবলম্বন করিলেন। কিঞ্চিদধিক ছয় বৎসর কাল ঠাকুরের সঙ্গে নিরন্তর থাকিবার পরে ব্রাহ্মণী তাঁহার নিকট বিদায়গ্রহণ করিয়াছিলেন।

ঠাকুরের কলিকাতায় প্রত্যাগমন

ঐরূপে প্রায় সাতমাসকাল নানাভাবে কামারপুকুরে অতিবাহিত করিয়া সম্ভবতঃ সন ১২৭৪ সালের অগ্রহায়ণ মাসে ঠাকুর পুনরায় দক্ষিণেশ্বরে প্রত্যাগমন করিলেন। তাঁহার শরীর তখন পূর্বের ন্যায় সুস্থ ও সবল হইয়াছিল। এখানে ফিরিবার স্বল্পকাল পরে তাঁহার জীবনে একটি বিশেষ ঘটনা উপস্থিত হইয়াছিল। উহার কথা আমরা এখন পাঠককে বলিব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *