We’re always too much out or too much in
মুকু বললে, সময় নষ্ট না করে ট্রামে উঠে পড়ো। শ্যামবাজারে নেমে আমরা একটা ভাল দোকান থেকে বোতলটা কিনব। আজ তোমার পরীক্ষা। দেখতে চাই শয়তান বসে আছে, না দেবতা! কে বসে আছে?
আমি প্রতিবাদ না করে পারলুম না, আমাকে কি তুমি মানুষ-গিনিপিগ ভাবলে মুকু? তোমার মাথার সব স্তু ঢিলে হয়ে গেছে। কেউ ওইভাবে মদ খায়! বেশি মদ খেলে মানুষ মাতাল হবেই। জানা কথা। ওটা কোনও পরীক্ষা নয়। পাগলামি। আমার এই দুর্দিনে আমাকে নিয়ে আর খেলা কোরো না। তুমি যেন বেড়াল, আর আমি একটা ইঁদুর। তুমি কেমন করে ভাবলে, তোমার পরীক্ষার জন্যে আমি মদ গিলব। আমার একটা মান-সম্মান নেই!
তোমার উচিত নিজেকে চেনা। নিজেকে নিজে ঠকিয়ো না।
তা বলে আমাকে মদ খেয়ে পরীক্ষা করতে হবে?
মদ খেলে কী হয় জানো? আমি দেখেছি। কেউ ভেউ ভেউ করে কাঁদে। কেউ হোহো করে হাসে। কেউ কঁচা খিস্তি করে। কেউ ভোম মেরে বসে থাকে। কেউ তার ব্যর্থ প্রেমের কথা বলে। কেউ তার দুঃখ ও আশঙ্কার কথা বলে। কেউ পরিবারকে গালাগাল করে। কেউ তার গোপন পাপের কথা বলে গড়গড় করে। কেউ মা মা বলে চিৎকার করে শ্যামাসংগীত গায়। কেউ আবার মেয়েছেলের জন্যে খেপে ওঠে। মানুষের ভেতরটা বেরিয়ে আসে। প্লিনি সেই কোন কালে বলে গেছেন, In vino veritas. Truth is in wine. আমি একবার খুব খেয়েছিলুম। মীরাবাঈ হয়ে। সারারাত সে কী নাচ! ময় সে গরজ নিশাত হৈ কিস রূসিয়াহ কো।/ইক গুনা বেখুদি মুঝে দিন রাত চাহি এ ॥ মজা লুটতে মদ খেয়েছে কোন সে মুখপোড়া? দিবারাত্তির একটু ভুলে থাকার জন্যেই মদ খায় গালিব।
মদ নিয়ে ডিবেটের ফাঁকেই ট্রামটা গড়গড় করে ডিপো ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ট্রামের আর কীসের মাথাব্যথা! পৃথিবীর যাবতীয় মূল্যবান সমস্যার মধ্যে আমাদের এই অদ্ভুত সমস্যা পড়ে না। খাওয়া-পরা আর মাথা গুঁজে বেঁচে থাকার সমস্যা ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনও সমস্যা তেমন পাত্তা পায় না। আত্মার সমস্যা তো শৌখিন সমস্যা! ভরা পেট, নরম বিছানা, গরম ঘর, নিত্যানন্দ সঙ্গী, তখনই ওইসব ভুতুড়ে উপদ্রব শুরু হয়। আত্মানং বিজালিখ। জানলেই বা কী? না জানলেই বা কী! পাঁয়তাড়া কষতে কষতেই জীবন ফৌত। নচিকেতা যদি এই শতাব্দীতে জন্মাতেন, তা হলে কি মৃত্যুমহারাজের সঙ্গে অমন অপার্থিব আলোচনা হত। রাজার ছেলে ক্যাডিলাক চেপে লাসভেগাসে ঘুরে বেড়াতেন। সঙ্গে টমটম। বেলোয়ারি সুন্দরী। মার কাটারি। আত্মা তো আছেই। অবিনশ্বর। পুলিপিঠের মতো। দাঁত বসানো যায় না। পটলের মতো, টর্পেডোর মতো আকৃতি। গেলাও যায় না। যমরাজ বারকতক পাগলে উগরে দেন। অতি অখাদ্য। কনসেন্ট্রেটেড মহাজীবন। আত্মা যে দেহের ক্যাপসুলে বৈঠকখানা করেছে, সেইটাই তো সব। একবারের খেলা। একবারই হরিশঙ্করের পুত্র। একবারই মুকুর সঙ্গে মেলামেশা। কখনও তিরস্কার, কখনও ভালবাসা। সব একবার। অদূরেই কাশীমিত্রের শ্মশান। এই মুহূর্তে সেখানে দাহ হচ্ছে আত্মার খোল। নামরূপ পুড়ছে পড়পড় করে। ছেলে কাঁদছে। মেয়ে কাঁদছে। বউ কাঁদছে। সব একবার। জন্ম একবার। সম্পর্ক একবার। পরের বার যদিও আসি, পিতা হবেন না হরিশঙ্কর। মুকু আসবে না ভালবাসতে। আমি থাকব না, তবে মানুষ থাকবে। অসংখ্য মানুষ। পিতাপুত্রের সম্পর্ক থাকবে। প্রেম থাকবে। প্রেমিকা থাকবে।
ঝটিতি একটা ভাবনার স্রোত বয়ে গেল। আর খাস করে একটা মোটরগাড়ি আমাদের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে থেমে গেল। পেছনের জানলা দিয়ে একটা মুখ বেরিয়ে এল।
সর্বনাশ! সুরঞ্জনা!
নিমেষে দরজা খুলে নেমে এল সুরঞ্জনা। গাড়িটা একটু এগিয়ে গিয়ে রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়াল। খেল দেখাল মুকু। আমি মুকুর ভয়েই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিলুম। মুকু প্রায় ছুটে গিয়ে সুরঞ্জনাকে জড়িয়ে ধরল, সুরঞ্জনা, আমার নাম মুকু। আমিই সেদিন তোমার গাড়িতে হামলা করেছিলুম। আমি একটু পাগলি আছি তো। তুমি কিছু মনে কোরো না।
রাস্তার মাঝখানে সুন্দরী সম্মেলন। আমি বললুম, সরে এসো, গাড়ি চাপা পড়বে।
দু’জনে প্রায় জড়াজড়ি অবস্থায় পাশে সরে এল। ফরফর করে দখিনা বাতাস বইছে। সুরঞ্জনার সিল্কের শাড়ির আঁচল উড়ছে। আজ যেন সেদিনের চেয়ে সুন্দরী দেখাচ্ছে। সুরঞ্জনা মুকুর চেয়ে লম্বা। বিলিতি ফিগার।
সুরঞ্জনা বললে, সেদিন খুব রাগ হয়েছিল। এই মুহূর্তে সব রাগ জল হয়ে গেল। তুমি ওঁর কে হও?
মাসতুতো বোন।
তাই নাকি? সেদিন ভেবেছিলুম অন্যরকম। ইন ফ্যাক্ট ওঁর ওপর আমার একটা খুব খারাপ ধারণা হয়ে গিয়েছিল। কোন অপরাধে তুমি অমন খামচাখামচি করে নামালে?
ওনার মাথায় ঢুকেছে সন্ন্যাসী হবেন। মাঝে মাঝেই বিবাগী হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সাধুসন্ন্যাসীদের আখড়ায় গিয়ে পড়ে থাকে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া হয় না। আর আমরা ভেবে মরি। একে মা-মরা ছেলে, তায় আবার পিতা নিরুদ্দেশ। গত কয়েকদিন বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল। সেদিন পড়বি তো পড় আমার সামনে। পাছে পালায় তাই চেপে ধরেছিলুম। তুমিই বলো, আমি কিছু অন্যায় করেছিলুম?
অবশ্যই না। তুমি যা করেছিলে আমিও তাই করতুম। এত বড় ছেলে, তার কোনও বোধবুদ্ধি থাকবে না?
তুমিই বলো ভাই, আমাকে বিশাল একটা বাড়িতে একা ফেলে রেখে উনি উধাও হয়ে গেলেন। সেই বাড়িতে আবার ভূত আছে।
একদিন আমাকে নিয়ে যাবে তোমাদের বাড়িতে।
আজই চলো।
আমি যে মহারাজের কাছে যাচ্ছি। তোমরা যাবে না?
আমরা তো ঘুরে এলুম। মহারাজ আজ ভীষণ ব্যস্ত লেখা নিয়ে। মুখ তুলে কথা বলার সময় নেই। কারওকে দেখলেই ভীষণ বিরক্ত হচ্ছেন।
তা হলে?
তা হলে আজ আর বিরক্ত না করাই উচিত।
সুরঞ্জনা আমার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ ভাবল। শেষে বললে, তোমরা আমাদের বাড়িতে চলো! আজ বাবা বাড়িতে আছেন, ওঁর পিতার নিরুদ্দেশের ব্যাপারে কথা বলা যাবে। একটা কিছু করা দরকার তো?
মুকু বললে, তিনি কীভাবে সাহায্য করতে পারেন?
তিনি তো পুলিশের বড় অফিসার। আমার দাদাকেও তো পাওয়া যাচ্ছে না।
নিরুদ্দেশের ধুম পড়ে গেছে।
মুকু আমার দিকে তাকিয়ে বললে, কী, যাবে নাকি?
যেতে পারি। আমাদের তো এখন কোনও কাজ নেই।
আমার মতলব অন্য। সুরঞ্জনাদের বাড়িতে গেলে বেশ কিছুটা সময় কেটে যাবে। মুকু যা একগুঁয়ে, আজ রাতে তা না হলে আমাকে মদ খাইয়ে দিদির সামনে একটা কেলেঙ্কারি করিয়ে ছাড়বে।
মুকু বললে, বেশ তা হলে চলো।
সুরঞ্জনা বললে, তা হলে আমি মাকে প্রণাম করে আসি। তোমরা গাড়িতে বোসো।
তুমি এসো না! আমরা এখানেই আছি।
সুরঞ্জনা হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল। গাড়িটা রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে রইল।
মুকু সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললে, ভীষণ স্মার্ট মেয়ে। এর প্রেমে তো তুমি। পড়বেই। চাবুকের মতো চেহারা। হাত কেন, পায়ে ধরতেও তুমি প্রস্তুত, কী বলে?
আমি সহজে অত টলি না, মুকু।
তাই নাকি মহারাজ? গোল্লা গোল্লা চোখে তো তাকিয়ে আছ?
আমার হঠাৎ মনে হল, আসন না করলে এমন স্লিম চেহারা হয় না।
সব জরিপ করা হয়ে গেছে? ভাইট্যাল স্ট্যাটিসটিক্স?
তোমাকে আমি পারব না মুকু। তুমি আমার মনের আয়না। ধরেছ ঠিক। কী করব বলো? আমি। পারি না। বারেবারে হেরে যাই।
এসো আজ আমরা একটা কাজ করি। আমরা গাড়ির ড্রাইভারকে বলে সরে পড়ি। তোমার এই সেতুটাও পুড়ে যাক। মহারাজের কাছে তো তোমার দফারফা করে দিয়ে এসেছি। এটাও শেষ করে দিই। তা না হলে এই আকর্ষণও তোমাকে কিছুদিন ঘুরিয়ে মারবে। এই মেয়েটির নাকে দড়ি দিয়ে । ঘোরাবার ক্ষমতা আছে। এর দেহ-লক্ষণ ভাল নয়।
তোমার ওটাও কি সাবজেক্ট ছিল?
আমার মায়ের কাছে শেখা। হস্তিনী, পদ্মিনী, শঙ্খিনী। এ তোমার শঙ্খিনী। লম্বা, একহারা। পুরুষালি চেহারা। হাত পা লম্বা লম্বা। বুক তেমন উঁচুনয়। সাপের ফণার মতো গলা। ধারালো মুখ। গাদা গাদা ছেলেকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে। বেশ স্বার্থপর। কাজের সময় কাজি, কাজ ফুরোলেই। পাজি। যে-কোনও কাজ আদায়ের জন্যে এর ছলাকলার শেষ থাকবে না। এর পক্ষে পরপর তিন-চারবার বিয়ে করাও অসম্ভব নয়। কোনওদিনই সেই অর্থে সংসারী হবে না। এর খপ্পরে যে পড়বে। হয় তাকে আত্মহত্যা করতে হবে, না হয় সারাজীবন কেঁদে বেড়াতে হবে। ধরবে, সব শুষে নিয়ে ছিবড়ে করে ফেলে দেবে। এর আকর্ষণও হবে ভয়ংকর। ভীষণ রাগী। এখন দেখো কী করবে?
যা মনে এল, জ্যোতিষীর মতো গড়গড় করে বলে গেলে। যার এত ভক্তি, মায়ের সামনে বসে যেভাবে কাঁদে, সে কেমন করে ছেলেধরা হয় মুকু?
তুমি কেমন করে মেয়েধরা হলে প্রভু? নিজেই দেখো। তুমি নিজেই কতরকমের। কত রূপ তোমার? চলো ক্লিন সরে পড়ি।
সেটা খুব খারাপ হবে। প্রচণ্ড অভদ্রতা হবে। অশিক্ষিতের মতো কাজ হবে। তোমাকে আজ আমি এই মন্দিরের সামনে বলছি, মা আমার সাক্ষী, তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো।
ওদের বাড়ি একবার যাওয়া মানে, তুমি বারেবারে যাবে। তোমার ধর্মকর্ম, লেখাপড়া, জীবন যৌবন সব যাবে।
তোমার মাথা!
এখন আমার মাথা তো! কয়েকদিনের মধ্যেই তোমার মাথা হবে, এইটা তুমি লিখে রাখতে পারো। এই মেয়ে তোমাকে ভালবাসবে না, তোমাকে ব্যবহার করবে, জুতোর মতো, তোয়ালের মতো, চিরুনির মতো, হাত ধোয়ার গামলার মতো, গা রগড়াবার ছোবড়ার মতো। এইবার কী করবে দেখো।
আমরা যাব। আমার পিতার শিক্ষা, ডোন্ট বি ইনডিসেন্ট। কথা দিলে কথা রাখবে। হ্যাঁ বলবে তো হ্যাঁ, না বলবে তো না। ভদ্রতা, সভ্যতা তোমার নিজের অলংকার।
তা হলে চলল। দেখা যাক তোমার বরাতে কী আছে! দেখি ইঁদুর শেষপর্যন্ত কলে পড়ে কি না!
আমাদের গবেষণা থামতে-না-থামতেই সুরঞ্জনা ফিরে এল। সামনে থেকে দেখে একবারও মনে হল না, মুকু যা বললে তা সত্যি হতে পারে! সুস্থ, সবল, চোখা একটি মেয়ে। তরোয়ালের মতো এগিয়ে আসছে। ঝকঝকে মুখ, ঝকঝকে শরীর। কবিতার মতো।
আমি বুদ্ধি করে সামনের আসনে গিয়ে বসে পড়লুম। সুরঞ্জনা কয়েকবার বললে, পেছনে আসুন, পেছনে আসুন। তিনজনে একসঙ্গে বসি। এড়িয়ে গেলুম, ও চক্করে আমি নেই। কোথা থেকে কী হয় কে জানে বাবা! দু’জনের গজর গজর লেখাপড়ার আলোচনা চলেছে। মাঝে মাঝে হাসি হচ্ছে। গাড়ি চলছে। আমি কলকাতার চলমান দৃশ্য দেখছি। সন্ধ্যা নেমেছে। পুটপুট আলো জ্বলে উঠছে। একটু পরে আলোর চোখ আরও ফুটবে। অন্ধকার আরও একটু ঘন হোক।
সুরঞ্জনাদের সাবেক বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াল। বিশাল বাড়ি। ফটকে মার্বেল স্ল্যাব। লেখা রয়েছে, শান্তিধাম। বড় বাড়ি দেখলে ভয় করে। ভেতরে কোন অহংকারের পরিবেশে গিয়ে পড়ব কে জানে! পুলিশের বড়কর্তা মানে আই পি এস। সায়েবি মেজাজের মানুষ হওয়াই স্বাভাবিক। ড্রেসিং গাউন। মুখে পাইপ কি চুরুট। চিবিয়ে চিবিয়ে কথা। সেই মানুষের স্ত্রীর ঠাট আর ঠমক কেমন হবে তাও তো জানি না।
ভয়ে ভয়ে প্রবেশ। চকমেলানো বাড়ি। মাঝে বাঁধানো উঠোন। লাল রক। ঘর। ঘরের পর ঘর। সবই বেশ পরিষ্কার। ঝকঝকে তকতকে। কোথাও অর্গান বাজছে। গম্ভীর সুরে। চওড়া সিঁড়ি ধাপে ধাপে দোতলায় উঠছে। লোহার ঢালাই রেলিং। অর্গানের সুর আরও সুস্পষ্ট হল। দোতলার বারান্দা। আমরা এগিয়ে চলেছি। দরজার পর দরজা। সুরঞ্জনা সামনে, পেছনে মুকু, সব পেছনে আমি। বারান্দার বাহার দেখে মুগ্ধ আমি। বড়লোকরা বাঁচতে জানে। বারান্দায় চিক ঝুলছে। গোটানো। প্রয়োজনে নামানো হবে। পেতলের টবে ভাল ভাল গাছ। ফার্ন। পাম। অর্কিডও ঝুলছে ছাড়া ছাড়া। সাদা শ্বেতপাথরের মেঝে। কোথাও এতটুকু দাগ নেই। আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছে। কী কাণ্ড রে ভাই! ক্রমশই আমি যেন ছোট হয়ে যাচ্ছি। নেংটি ইঁদুরের মতো। এই বাড়ির মেয়ে সুরঞ্জনা? আমি তার আঙুল নিয়ে খেলা করেছি! অল্প অল্প ডিগবাজি খাওয়ার ভাবও হয়েছিল। মিথ্যে কথা বলব না। ইংরেজি ফিলমের নায়িকার মতো দেখতে যাকে, সে তো টাল খাওয়াবেই।
আমি পায়ে পায়ে শহরের রাস্তায় গাঁয়ের লোকের মতো লম্বা লম্বা বারান্দা ধরে এগোলেও, মুকু একেবারেই স্বাভাবিক। তরতর করে চলেছে। যেন নিজের বাড়ি। এই বাড়ির সঙ্গে মুকুকে বেশ মানিয়ে গেছে। সুরঞ্জনা আর মুকু দু’জনেই সমানে সমান। হঠাৎ আমার মাথায় আর একটা চিন্তা খেলে গেল। সুরঞ্জনার দাদা যদি ফিরে আসেন তা হলে আমি নিজে সম্বন্ধ করে মুকুকে এই বাড়ির বউ করে দেব। যা মানাবে! সাংঘাতিক!
আমরা অবশেষে একটা বড় ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালুম। সামনের দেয়ালে, একেবারে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত লম্বা বিশাল এক পেন্টিং। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিস্থ। ছবিটি দেখামাত্রই মনে হল নিজের পরিবেশ ফিরে পেলুম। ঘরে খুব কাজ করা পুরু একটা কার্পেট পাতা। কার্পেটে দশ-বারোজন মহিলা বসে আছেন বিভিন্ন বয়সের, ঘর আলো করে। শ্রীরামকৃষ্ণের ছবির একপাশে মা সারদা, অন্যপাশে স্বামী বিবেকানন্দ। সিলিং-এ একটা ঝাড়বাতি। ঠাকুরের পায়ের কাছে একটা পাথরের বেদি। ধূপ জ্বলছে। ঠাকুরের দিকে মুখ করে লম্বা চওড়া এক ভদ্রলোক উপবিষ্ট। সিল্কের ধুতি উত্তরীয়। একপাশে অর্গানে বসেছেন এক মহিলা। ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারা। দেখলেই মনে হয় পাঞ্জাবি। বাঙালির এমন দীর্ঘ ওয়ালনাটের মতো চেহারা কদাচিৎ দেখা যায়। সুরঞ্জনার মুখের সঙ্গে ভীষণ মিল। সুরঞ্জনার মা-ই হবেন। আমরা পা টিপে টিপে প্রায় নিঃশব্দে কার্পেটের একপাশে বসে পড়লুম। আর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল আরত্রিক ভজন, খণ্ডন ভববন্ধন বন্দি তোমায়।/ নিরঞ্জন নররূপধর নিগুণ গুণময় ॥ সাদা মার্বেল পাথরের বেদি। সার সার ফিনফিনে লাল গোলাপ। ধূপের ধোঁয়ার কুণ্ডলী। অর্গানের গম্ভীর সুরেলা আওয়াজ। ইমনে বাঁধা ভজন। দখিনা বাতাস। রমণীয় রমণীকুল। স্বর্গ যেন স্লিপ করে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। আমার একপাশে মুকু, অপর পাশে সুরঞ্জনা। একেবারে সামনে রক্তলাল ব্লাউজ পরা একটি মেয়ে। সামনে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ। জননী সারদা। বিশ্ববিবেক বিবেকানন্দ। মাথার ওপর টিংলিং ঝাড়। বড় নেশা। জীবনের নেশা। বেঁচে থাকার কারিগরি। সবাই গাইছেন। আমি আর স্থির থাকতে পারলুম না। ধরে ফেললুম নিখুঁত সুরে। কোনও জায়গাতেই ছুট হবার সম্ভাবনা নেই। বহুবার গেয়েছি এই আরত্রিক সংগীত। আমার গলা ডি শার্পে খেলে। এঁরা ধরেছেন সি-তে। আমার কাছে মাখন। ভজন একসময় শেষ হল। ভদ্রলোক আরও কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন ধ্যানে। নিশ্চল প্রস্তরমূর্তি। একসময় সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালেন। যেন অ্যাটলাস। অর্ধনিমীলিত চোখে একবার তাকালেন সকলের দিকে। খুব ছোট নিটোল চমচমের মতো প্রসাদ হাতে হাতে আমার হাতেও এল। অপূর্ব স্বাদ। ভুরভুরে গোলাপের গন্ধ।
সুরঞ্জনা ভদ্রলোকের সামনে আমাকে হাজির করল। পরিচয় আর কী দেবে! আমার পরিচয় আর কতটুকু জানে। নিজেকেই নিজের পরিচয় দিতে হল। কী-ই বা আমার পরিচয়। আমার পিতার পরিচয়ই পরিচয়। যেই বললুম আমার পিতার নাম শ্রীহরিশঙ্কর, তার কপালে তিনটে ভাঁজ পড়ল।
হরিশঙ্কর! স্কটিশে পড়তেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ!
তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বিশাল বুকে আমি এক ঘুঘু। আমার মাথাটা তার বুকের কাছে। এত লম্বা তিনি।
আমাকে বুকে চেপে ধরে বললেন, তুমি হরিশঙ্করের ছেলে! হরিশঙ্কর আমার এক বছরের সিনিয়ার। হি নেভার স্টুড সেকেন্ড ইন এনি এগজাম। যেমন অঙ্কে তেমনি ইংরিজিতে। আমি হরিদার কাছে অঙ্ক শিখেছি। হি ওয়াজ মাই টিচার। তুমি আমার গুরুপুত্র।
আমি আর মুকু তাকে প্রণাম করলুম।
মেয়েটি কে?
আমার মাসতুতো বোন।
বেশ দেখতে তো। দেবীর মতো। যোগাসন করো?
আজ্ঞে না।
আসন করবে। অ্যান আউন্স অফ একস্ট্রা ফ্যাট। আমি, সুরঞ্জনা, আমার স্ত্রী, আমরা সবাই আসন করি। একটা দিনও ফেল করি না।
সুরঞ্জনার মা এসে দাঁড়িয়েছেন। আমরা তাকেও প্রণাম করলুম। ঠাকুরঘর ছেড়ে বসার ঘরে এসে বসলুম। দেয়াল দেখা যাচ্ছে না, সবই বই। সুন্দর একটা লাইব্রেরি। ভদ্রলোক ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে এসে বসলেন। মেহগনি কাঠের ঝকঝকে সুন্দর টেবিল। সুন্দর টেবিলে ভীতিপ্রদ একটা জিনিস পড়ে আছে। ভয়ে ভয়ে আমাকে সেদিকে তাকাতে দেখে ভদ্রলোক বললেন, রিভলভার আগে কখনও দেখেনি, তাই না? বড় সুন্দর জিনিস। মসৃণ। শক্তিশালী। ক্লোজ রেঞ্জ থেকে একবার ট্রিগার টিপলেই ভবের খেলা শেষ। আমার দুই সঙ্গী, ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ আর এই মারণাস্ত্র। দুটোই মুক্তির পথ। জীবন্মুক্তি আর দেহমুক্তি। তোমার চোখের সামনে থেকে এটা সরিয়ে রাখব?
মুকু আমার পাশে বসে ছিল, সে বললে, থাক না। বেশ সুন্দর দেখতে। গুলি কি ভরা আছে কাকাবাবু? মুকু সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলল। মুকুর নিমেষে এই আপন হয়ে যাবার ক্ষমতা তুলনাহীন।
হ্যাঁ মা। লোডেড। তবে লক করা আছে। এখন বলল, হরিদার জন্যে কী করা যায়? সুরঞ্জনা আমাকে বলেছিল তোমার কথা। তবে ও তো আমাকে তখন নাম বলতে পারেনি! হরিদার হঠাৎ কী হল! সে তো জীবনকে ভালবাসত। আমাদের বলত, সমুদ্রে নামলে ঢেউ তো খেতেই হবে। যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই তো করতেই হবে। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে আমাদের সঙ্গে ব্যায়াম করত। বলত, নড়বড়ে রুণ শরীর নিয়ে ধর্ম অর্থ মোক্ষ কাম কোনওটাই হয় না। পৃথিবীটা কল্পনার জায়গা নয়, কাজের জায়গা। ঘোড়াকে দেখে শেখো। ঘোড়া কি কবিতা লেখে? অলওয়েজ অন দেয়ার লেগস। ঘোড়ার শোয়া মানেই মৃত্যু। গতি, বীরত্ব, বিশ্বস্ততা এই তিন গুণের চেহারা হল ঘোড়া। আমরা হরিদাকে কখনও বসে থাকতে, গালগল্প করতে দেখিনি। ডে ড্রিমিং-এর ঘোরতর বিরোধী। মহাত্মা গান্ধীর মতো সত্যের পূজারি। বলত, মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ। সেই মানুষের হঠাৎ কী হল!
চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকছে কাজের মহিলা। সুরঞ্জনার মা আমাদের সামনে কাপ রাখতে রাখতে বললেন, শুধুই চা। অন্য কিছু নেই। কারণ যতদিন না আমার ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে ততদিন অতিথি আপ্যায়ন বন্ধ।
মুকু বললে, চায়েরই বা কী প্রয়োজন ছিল কাকিমা?
এইসময় আমরা সবাই চা খাই। এটা আলাদা কিছু নয়।
ভদ্রমহিলাকে যতই দেখছি, ততই মনে হচ্ছে বাঙালি নন। মুখের গড়ন, শরীর, গায়ের রং। যদিও খুব সুন্দর বাংলা বলছেন।
চায়ে চুমুক দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আমার ছেলের জন্যে সারা ভারতে তল্লাসি চালিয়ে কোনও সুরাহা হল না আজও। নিজের ক্ষমতার ওপর অবিশ্বাস এসে যাচ্ছে। সেই ছাত্রজীবনে হরিদা আমাকে একটা কথা বলেছিল, আজও সেই কথার জোরে অচল অটল আছি। বলেছিল, নিজের শক্তিকে একটা ওয়ালনাটের মতো হৃদয়ে ধরে রাখবে। বিক্ষিপ্ত ঘটনা যখন উলটে ফেলে দিতে চাইবে, তখন চোখ বুজিয়ে ভেবে নেবে, একটা শক্তির বেল্ট সাপের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তোমার শরীরের নীচের দিক থেকে ওপরে উঠছে। শরীরের এক ইঞ্চিও ফাঁকা থাকছে না। সোজা ওপরে উঠে গিয়ে পেছন দিক থেকে মাথার ওপর ফণা তুলে দুলছে। কী অপূর্ব! ওই প্রক্রিয়ায় আমি যে কী শক্তি পাই, বলে বোঝাতে পারব না। হি ওয়াজ এ যোগী। সেই আজ আমার গুরু। বলেছিল, মনের টালমাটাল অবস্থায় অঙ্ক নিয়ে বসবে। অঙ্কে আর ধ্যানে মন স্থির হয়। মন যত চঞ্চল হবে পৃথিবীকে ততই চঞ্চল মনে হবে। হরিদা বলত, গণিতের মতো পৃথিবীর সব সমস্যাকে বিচার দিয়ে সহজ করে নেবে। যা আসে তাই যায়। কী সুন্দর কথা! জীবনের সামনে, জীবনের পেছনে মৃত্যু। সত্য একটাই, অনস্তিত্ব। তুমি কেন, কেউই থাকবে না। থাকার একটা নির্ধারিত সময়সীমা আছে।–থাকাটাই অনির্ধারিত আকাশের মতোই অনন্ত। জীবনের হাসা আর কাদা কন্ডিশনাল। না-হাসা না কাঁদাটাই সাধনা। বি নিউট্রাল। হৃদয়বান, হৃদয়হীন, একটা নেগেটিভ, একটা পজেটিভ। হৃদয়টাকে সমর্পণ করে দাও। হিন্দি হাম আর ইংরেজি হিম প্রায় একরকম ধ্বনি। হাম মানে হিম। অ-এ আকার আ মানে আমি। আ থেকে দু’বর্ণ স্বরপার্থক্যে ই বসে আছে। ই দীর্ঘ হলেই ঈ। ঈতে ঈগল। ঈগলও ঈশ্বর। ইঁদুরের মতো জীবের অহংকার ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। হরিদাকে আমি খুঁজে বের করবই। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণকে সেই জন্মযোগী নিজের জীবনে একাকার করে ফেলেছে। তোমার কাছে তার ছোট ছবি আছে?
আমার মাথা নিচু। এর চেয়ে লজ্জার কী আছে? তার একটাও ছবি নেই।
ছবি নেই? ছোটখাটো কোনও ছবি?
আজ্ঞে না। তিনি ছবি তোলাতে দিতেন না।
একটা ছবি রাখোনি? আশ্চর্য। তা হলে অনুসন্ধান হবে কী করে?
আমি ভাবছি নিজেই একবার বেরোব। সব তীর্থস্থান ঘুরে ঘুরে দেখব। আচ্ছা আপনি বলতে পারেন, কোন সে নদী! দু’পাশে পাহাড় শ্রেণি। নদীতে জল নেই। শুধু নুড়ি পাথর। বড় ছোট নানা মাপের। হঠাৎ হুড়হুড় করে জল নামে। কূল ছাপিয়ে যায়। পরক্ষণেই আবার সেই নুড়ি। জায়গাটা খুব শীতল।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, মনে হচ্ছে লিডার। পহেলগাঁওতে ওই নদী। পাহাড়ের ওপরে বৃষ্টি নামলেই জলে ভরে যায়। জল গড়িয়ে নীচের দিকে চলে যাবার পরেই শুকনো। কেন বলো তো?
এমনি। হঠাৎ মনে হল তাই।
হঠাৎ টেলিফোন বাজল। ভদ্রলোক ঝটিতি রিসিভার তুলে বললেন, হ্যাললো।