২.১৬ আবার ভাসমান
নৌকা চলেছে টাঙন হযে, মহানন্দা হয়ে ভাগীরথীর দিকে।
রাম বসু ভেবেছিল তাকে একাই যেতে হবে। কিন্তু সে কলকাতা রওনা হয়ে যাচ্ছে শোনবামাত্র তার সঙ্গীরাও জিনিসপত্র বেঁধে প্রস্তুত হল।
রাম বসু শুধাল, কি ন্যাড়া, তুই যাবি নাকি?
ক্ষতি কি? কায়েৎ দিদি আমাকে পাঠিয়েছিল তোমাকে দেখাশোনা করবার জন্যে। তুমি গেলে দেখব কাকে।
পার্বতী ব্রাহ্মণ বলল, যেখানে রাম সেখানে লক্ষ্মণ। তুমি চলে গেলে আমি একাকী এই দণ্ডকারণ্যে থাকতে পারব না।
গোলোক শর্মা এই অঞ্চলের লোক।
রাম বসু বলল, তোমার তো না থেকে উপায় নেই।
পাগল হয়েছ ভায়া! ‘বামুন গেল ঘর, লাঙল তুলে ধর’! তোমরা নৌকোয় উঠবে আমিও চরণ দাড়ির নৌকোয় উঠে পাড়ি দেব গাঁয়ের দিকে।
রাম বসু সঙ্গীদের মনোভাবে বিস্মিত হল, মোটা বেতনের চাকুরি ছেড়ে চলল সবাই তার আকর্ষণে। কিন্তু তার বিস্ময় চরমে উঠল যখন ছোট পুঁটুলিটা নিয়ে রেশমীও এসে নৌকোয় চড়ল।
বিভ্রান্ত রাম বসুর মুখ দিয়ে বের হল, তুই যাবি নাকি?
রেশমী নৌকার গলুই-এ বসে পা ধুতে ধুতে বলল, কি মনে হচ্ছে?
যাবি কেন রে?
কাল সন্ধ্যাবেলা একটা লোককে দেখে সন্দেহ হয়েছে।
কি সন্দেহ হল আবার?
বোধ করি চণ্ডী বক্সীর লোক। কাল সন্ধ্যাবেলা বাগানের কাছে ঘোরাঘুরি করছিল।
সবাই বলল, তাই তো, তাহলে একলা থাকবি কি করে?
রেশমীর কথাটা সত্য নয়। সন্দেহজনক কোন লোক সে দেখে নি। কিন্তু ঐ রকম কিছু একটা না বললে তার যাওয়ার পথ সুগম হয় না, তাই ঐ ছলনাটুকু করতে বাধ্য হল।
নৌকা ছেড়ে দিল।
রাম বসু হঠাৎ কলকাতায় চলে যাচ্ছে শুনে সবাই কারণ শুধালে রাম বসু একটা কাহিনী বানিয়ে বলল। সে বলল, আর বল না ভাই, বেটা টমাসের কাও। সেদিন রাতে তোমরা সবাই যখন যাত্রা গান শুনতে গিয়েছিলে, পাষণ্ডটা এসে রেশমীর দরজায় ধাক্কা মারছিল। আমি দেখতে পেয়ে নিষেধ করতেই লেগে গেল আর কি! তার পরে কেরীকে হাত করে এই কাণ্ডটি ঘটাল। লোকটা ভেবেছিল আমি গেলে রেশমী ওর খপ্পরে পড়বে।
পার্বতী ও গোলোক বলল, তাই বল। আমরা আগেই জানতাম ওর ভাব-গতিক ভাল নয়। এখন সব বোঝা গেল।
রাম বসু বলল, যাক কথাটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি ক’র না, রেশমীর কানে উঠলে লজ্জা পাবে। এমন ভাব দেখিও যেন তোমরা কিছু জান না।
তারা বলল, ছি ছি, এ সব কি ঐ অতটুকু মেয়ের সামনে আলোচনা করা যায়।
নৌকো স্রোতের টানে পূর্ণবেগে ভেসে চলেছে।
.
রাম বসু একা একা শুয়ে বিস্ময়ের অন্ত পায় না; ভাবে, আশ্চর্য এই মেয়েটি রেশমী। এতকাল পর্যন্ত যত মেয়ের সঙ্গ পেয়েছে কারও সঙ্গে তার মিল নেই। না, টুশকির সঙ্গেও নয়। টুশকিতে মায়া-মমতা কিছু বেশি, কিন্তু নারীসুলভ রহস্য যা তা আছে ঐ রেশমীতে, আর কোন মেয়েতে সে এমনটি দেখে নি। সে ভাবে, অধিকাংশ মেয়েকেই দূর থেকে স্ফটিকের দ্বার বলে মনে হয়; মনে হয় অগম্য, কিন্তু কাছে এসে দাঁড়াতেই দেখা যায় প্রশস্ত দ্বার, অনায়াসে গলে যাওয়া যায়। সেই অভিজ্ঞতাতে রেশমীকেও সফটিকের দ্বার বলে মনে হয়েছিল, গলা গলালেই দিব্যি গলে যাওয়া যাবে। কিন্তু সেদিনকার রাত্রের অভিজ্ঞতায় দেখল—না, ফটিকের দেয়াল, দূর থেকে স্বচ্ছতার দরজার বিভ্রান্তি উৎপাদন করেছিল। দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে অবশেষে বুঝতে পারল প্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ।
টমাস ফিরে আসবার আগেই রেশমী বিদায় করে দিয়েছিল রাম বসুকে, বলেছিল, এবারে যাও কায়েৎ দা।
বসুজা বলেছিল, কেন রে, এত তাড়া কিসের? এতক্ষণ পাষণ্ডটার সঙ্গে হাঁকাহাঁকি করলাম, একটু জিরিয়ে নিই।
না, আর দেরি ক’র না। টমাস আবার ফিরে আসবে, হয়তো এবারে কেরীকে সঙ্গে নিয়ে আসবে।
কথাটা রাম বসুর মনে হয় নি। সে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল, জিজ্ঞাসা করল, টমাস এসে ডাকাডাকি করলে কি বলবি?
কিছু বলব না, দরজা খুলে দিয়ে বলব, দেখ কেউ নেই।
দরজা খুলে দিতে ভয় করবে না?
তোমাকেও তো ভয় পাই নি দরজা খুলে দিতে।
রেশমীর কথা বসুর হৃদয়ে গোপন কশাঘাত করল। তবে কি তারা দুজনে সমান রেশমীর চোখে? তখন মনে পড়ল, নিশ্চয়ই সমান নয়, বসুর স্থান আজ অনেক নীচে। এই আত্মদোষ স্বীকারেও সান্ত্বনা পেল না তার মন, গম্বুজের মধ্যেকার প্রতিধ্বনির মত রেশমীর কথাটা মাথা কুটে বেড়াতে লাগল মনের মধ্যে।
দরজার কাছে গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে রাম বসু শুধাল, হাঁরে রেশমী, আজ যে কাণ্ডটা করলাম, কাল বেশ স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারবি আমার সঙ্গে, অপ্রস্তুত হবি নে?
সহজভাবে রেশমী বলল, অপ্রস্তৃত হব কেন?
রাম বসুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, সংস্কার!
চিতার আগুনে আমার সব সংস্কার যে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে।
বলিস কি?
রেশমী পূর্বসূত্র অনুসরণ করে বলে চলল, এখন কোন পুরুষের সাধ্য নেই আমার কাছে আসে, আমাকে ঘিরে জ্বলছে চিতার আগুন।
অপ্রস্তুত হল রাম বসু। সে নীরবে বেরিয়ে এল। বুঝল এ মেয়ে সত্যই অগ্নিসম্ভবা রিরংসার গ্রাস এ নয়।
রাম বসু বেরিয়ে চলে গেলে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে কেঁদে বালিস ভিজিয়ে দিল রেশমী। কেন জানি নে বারংবার তার মনে পড়তে লাগল ফুলকির কথা। সেদিন সন্ধ্যার ঘটনার পরে দারুণ ঘৃণায় ভরে গিয়েছিল তার মন, চরম শত্রু বলে। মনে হয়েছিল ফুলকিকে। তবু আজ এই পরম দুঃখের ক্ষণে ঐ স্বৈরিণী মেয়েটাই থেকে থেকে উদিত হচ্ছে তার মানে। বিষ দিয়ে বিষ নামাতে হয়। যে বিষ এইমাত্র সে পান করেছে তার প্রতিকার কেমন করে জানবে সাধ্বী কুলবালারা! তার প্রতিকার জানে ঐ কুলটা নারী, যে নিজে আকণ্ঠ পান করেছে বিষ। রেশমী ভাবল, হক সে বিষকন্যা, তবু তার কাছে আজ সে-ই হচ্ছে ধন্বন্তরি।
তার মনে পড়ল একদিন ফুলকিকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আচ্ছা সই, ঐ যে গানটা সব সময়ে তোমার মুখে লেগে রয়েছে ‘ভরা নদী ভয় করি নে, ভয় করি সই বানের জল’ ওর মানে কি? ভরা নদীই বা কি, বানের জলই বা কি? ফুলকি বলেছিল, ভরা নদী ভরা যৌবন, তখন ভয় কম; ভয় যখন গাঙে প্রথম বানের জল আসে, তখন কুল ভাসিয়ে দেবার আশঙ্কা। আমি যে ভাই প্রথম বানের জলে কুল থেকে ভেসে গেলাম। তার পর রেশমীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, তোমার গাঙে এখন সই প্রথম বানের জল ঢুকছে, সাবধানে থেকো।
রেশমী বলেছিল, তুমি তো ভাই লেখাপড়া শেখ নি, এত জানলে কি করে?
ফুলকি হেসে বলেছিল, পাঠশালায় গিয়ে আর কতটুকু শেখা যায়।
তার পরে বলেছিল সে, পাঠশালায় দশ বছরে যা শেখা যায় মেয়েরা শেখে তা এক রাত্রের পুরুষ-সংসর্গে—ঐ হল তার আগুন ছোঁয়া।
কথাগুলো সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে নি রেশমী, কিন্তু তখনও যে-ফুলকির ভাষায়–সে আগুন হেয় নি।
তার পর সে-রাত্রে আগুনের মশাল নিয়ে এল রাম বসু, রেশমী আগুন ছুঁল না বটে, কিন্তু তাত লাগল গায়ে; সেই তাপ ভিতরে বাইরে হঠাৎ উঠল বেড়ে। সেই তাপের মরীচিকায় তার কামনার দিগন্তরে ছুটল স্বপ্নের সওয়ার; ঝলমলিয়ে উঠল তার বুকের গজমোতির মালা, বক্ষের কবচ, মাথার উষ্ণীষ। রেশমী বুঝল সে সওয়ার আর যেই হক রাম বসু নয়—বড়জোর রাম বসু তার নকীব। নকীবের অভ্যর্থনায় সে ত্রুটি করে নি।
রাম বসু দরজায় ধাক্কা দিয়ে পরিচয় দিতেই বিনা প্রশ্নে সে দরজা খুলে দিয়েছিল, ভেবেছিল হঠাৎ কোন প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু রাম বসু যখন বিনা ভূমিকায় বিছানায় এসে বসল, তার চোখের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তে সব বুঝল রেশমী। ফুলকির গানটা মনে পড়ল, বুঝল, প্রথম বানের দুর্বার গতি নিয়ে এসেছে প্রথম পুরুষ তার জীবনে। কয়েক মুহূর্ত দুজনেই নীরব। নরনারীর যৌন সম্পর্কের এই শেষ বাধাটিই দুর্লঙ্ঘ্যতম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে বাঁধ ভাঙে না, দুজনে দুদিকে আঘাত করে ফিরে যায়। নির্জন রাত্রে নিভৃত কক্ষে একক পুরুষের সঙ্গ তার শরীরে মনে দাবাগ্নি জ্বেলে দিল, সে উঠে গিয়ে দরজা এঁটে দিয়ে ফিরে এসে বসল। আবার দুজনে মূঢ়ের মত নির্বাক। অত্যন্ত চতুর পুরুষ, অত্যন্ত প্রগলভা নারীও যে এ সময়ে নির্বাক হয়, মৃঢ়বৎ হয়, তার কারণ সেই আদিম পরিবেশ ওঠে জেগে ভাষা যখন সৃষ্টি হয় নি, সামাজিক চাতুরী যখন ছিল ভবিষ্যতের গর্ভে। এমন কতক্ষণ চলত বলা যায় না এমন সময়ে আবার দরজায় ঘা পড়ল। এবারে টমাস সাহেব।
টমাসের কণ্ঠস্বরে একমুহূর্তে একশ’ জন্মান্তর পেরিয়ে রাম বসু ফিরে এল স্বকালে, আর চালাল কৌশলী উত্তর-প্রত্যুত্তর। রেশমীও ফিরে পেল সম্বিৎ। সে বালিসে মুখ খুঁজে হাসি চাপা দিয়ে ফুলে ফুলে উঠতে লাগল।
.
কই গো, তোমরা সব খেতে এস, পাত পড়েছে।
পার্বতী ব্রাহ্মণ রাঁধে, সবাই খায়। অন্য কেউ রাঁধলে সে খাবে না, তাই এই ব্যবস্থা।
ন্যাড়া শুধায়, আচ্ছা পার্বতী দাদা, এক পাটাতনের উপরে বসে যে খাচ্ছ, জাত যায় না?
পার্বতী বলে, বৃহৎ কাষ্ঠে দোষ নেই রে।
আচ্ছা পিড়িখানা যদি বড় করে নেওয়া যায়, তবে দোষ হয় কি না?
সে কথার উত্তর না দিয়ে পার্বতী বলে, তার উপর স্বয়ং মা গঙ্গার বুকের উপরে।
দুবেলা রান্না খাওয়া ছাড়া আর কাজ নেই। রেশমী আর ন্যাড়া দুজনে নৌকোয় ছইয়ের উপরে বসে গল্প করে, উজান-ভাটিতে নৌকা যাতায়াত দেখে, সন্ধ্যাবেলায় আকাশের তারা আর গাঁয়ের প্রদীপ গোনে। সময়ের স্রোত নদীর স্রোতের মত দুজনের কৃচি মনের উপর দিয়ে অবাধে মসৃণভাবে গড়িয়ে চলে যায়, এতটুকু বাধা পায় না।
একদিন রাম বসুকে গম্ভীর দেখে পার্বতী শুধাল, গম্ভীর হয়ে কি ভাবছ ভায়া?
ভাবছি রেশমী তো সঙ্গে চলল, কিন্তু কলকাতায় নিয়ে ওকে রাখি কোথায়?
পার্বতী বলে ফেলল, কেন, তোমার বাড়িতে। তার পরে প্রস্তাবের অসম্ভাব্যতা বুঝে বলল, না না, তা চলে না।
তার পরে বলল, টুশকির বাড়িতে রাখা চলে না?
বসু বলল, সে কি কথা, ও সব জায়গায় কি ঐ কচি মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়া যায়?
কেন, টুশকি তো মন্দ নয়।
মন্দর ভাল, বলল রাম বস, তবে কিনা জায়গা তো ভাল নয়।
তা হলে তো দেখছি মুশকিল। তা ছাড়া রাখতে হবে সাবধানে, চণ্ডী বজীর হাজার জোড়া চোখ—বলেছিল তিনু চক্রবর্তী।
রাম বসু নিশ্বাস ফেলে বলল, দেখা যাক কি হয়, আগে তো গিয়ে পৌঁছই। চল এখন শুতে যাই।
রাম বসুর ঘুম আসে না। সেদিন তার মনে হয়েছিল যে চণ্ডীদাসের ‘রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম, কাম-গন্ধ নাহি তায়’ পদটা মিথ্যা। এখন মনে হল, না, মিথ্যা নয়। তবে কিনা সত্য ও মিথ্যার মাঝখানে আর কয়েকটা অবস্থা আছে, স্কুল বিচারের সময়ে সেগুলো বাদ পড়ে যায়। তার মনে হল ‘নিকষিত হেম’ মিথ্যা নয়, কিন্তু খাঁটি সোনায় সংসারের কাজ চলে না, সংসারের উপযোগী করতে হলে একটু খাদ মেশানো চাই। তার মনে হল ঐ খাদ মেশানোর পরিমাণ-নৈপুণ্যের উপরেই স্যাকরার ওস্তাদি। যে তিনটি মেয়েকে খুব কাছে থেকে সে দেখেছে তাদের কথা মনে পড়ল। টুশকিতে খাদে সোনায় ঠিকটি মিলছে তাই সে সর্বকর্মক্ষম। অন্নদায় খাদের ভাগ কিছু বেশি, নিজের সংসারের বাইরে সে অচল। আর এই রেশমী খাঁটি সোনা–সংসার এখনও খাদ মেশাবার সুযোগ পায় নি তার মনে।
.
২.১৭ তিনু চক্রবর্তীর কর্তব্যপালন
সন্ধ্যাবেলায় মাঝিরা বলল, কর্তা, এখানেই নৌকা বাঁধি?
রাম বসু বলল, কেন রে?
সামনের পথটা ভাল নয়, একা রাত-বিরেতে যাওয়া কিছু নয়, বোম্বটের ভয় আছে।
তবে এখানেই আজ রাতের মত নৌকা বাঁধ।
গাঁয়ের নাম কিরে? শুধায় পার্বতী।
আজ্ঞে, জোড়ামাউ।
জোড়ামউ! সবাই চমকে ওঠে।
রেশমীকে ডেকে রাম বসু সাবধান করে দিল, ভিতরে চুপটি করে বসে থাক, বাইরে বের হস না। চণ্ডী বক্সীর এলাকায় এসে পড়েছে জেনে রেশমী নৌকার মধ্যে গিয়ে আত্মগোপন করল। কিন্তু তবু তার মনের মধ্যে কৌতূহল ও করুণা একযোগে আলোড়ন শুরু করে দিল। এই তার গাঁ! আহা, একবার দিদিমার সঙ্গে দেখা করা যায় না? না, তা অসম্ভব। আহা, কোন রকমে যদি তিনুদাদার সঙ্গে একবার দেখা হয়ে যেত, গাঁয়ের খবরাখবর পায় নি। না, তা-ও সম্ভব নয়। তাই সে একা শুয়ে শুয়ে গাঁয়ের কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল।
মাঝিরা চাল ডাল পান তামাক কেনবার জন্যে বাজারের দিকে গেল।
তাদের সাবধান করে দিতে, নৌকোর আরোহীদের পরিচয় জ্ঞাপনে নিষেধ করতে সবাই ভুলে গেল। আর না ভুললেও সতর্ক করা সহজ নয়, হয়তো তাতেই গোল বাধবার। আশঙ্কা ছিল বেশি।
মাঝিরা বাজারে গিয়ে কথাবার্তার সূত্রে কোথা থেকে আসছে, কোথায় যাবে, নৌকোর যাত্রীদের বিবরণ প্রকাশ করল। তারা তো জানে না লুকোবার কিছু আছে। সেখানে চণ্ডী বক্সীর এক চেলা উপস্থিত, খবরটা চণ্ডীকে পৌঁছে দেবার জন্যে সে উঠে গেল।
চণ্ডী সব শুনে বলল, জয় মা কালী, তোমার ইচ্ছায় বলি একেবারে ঘাটে এসে উপস্থিত! তার পরে দলের আর পাঁচজনের দিকে তাকিয়ে বলল, হবে না? শাস্ত্র তো মিথ্যা হবার নয়?
তখন দলবল জুটিয়ে নিয়ে সে পরামর্শ করল। স্থির হল অনেক রাতে সকলে মিলে গিয়ে পড়বে নৌকাখানার উপরে আর তার পরে রেশমীকে টেনে তুলে রাতেই কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে। শাস্ত্রজ্ঞ চণ্ডী বক্সী জানিয়ে দিল যে চিতাপলায়িতাকে চিতায় অর্পণ করাই শাস্ত্রের বিধান।
একজন বলল, দেখো দাদা, শেষে বিপদে না পড়ি!
আরে বিপদ বাধাবে কে? সাহেব তো নেই?
নৌকোয় সাহেব নেই মাঝিরা বলেছিল।
অন্ধকারে আবার নৌকা ভুল করে ব’স না—বললে আর একজন।
পাগল নাকি! চণ্ডী বক্সীর চোখ পেঁচার চোখ, অন্ধকারেই খোলে ভাল। ঘাটে আর ক-খানা নৌকা! সাহেবের নৌকা যখন, অবশ্যই বজরা হবে। চিনতে ভুল হবে না।
চণ্ডী বক্সীর অভিপ্রায়ের সংবাদ গড়াতে গড়াতে তিনু চক্রবর্তীর কানে গিয়ে পৌঁছল। জেলেদের উপরে তিনুর অপ্রতিহত প্রভাব, সে রসিক জেলেকে ডেকে বলল, তোরা জন কতক ঠিক থাকিস, সময়মত আমি খবর দেব।
গভীর রাত্রে কোলাহল ও বন্দুকের আওয়াজে রাম বসুদের নৌকায় নিদ্রাভঙ্গ হল। সকলে ব্যস্তভাবে জেগে বাইরে এসে ঘটনা কি জানবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠল। সকলেরই মুখে এক প্রশ্ন—কি হল? ওরা কারা? কাকে আক্রমণ করল? নিদ্রার ঘোর। কাটলে সকলে দেখতে পেল অদূরে অবস্থিত একখানা বজরার হাদে অনেক লোক চড়বার চেষ্টা করছে, সেই অন্ধকারেও চোখে পড়ল বজরার ছাদে জন-দুয়েক লোক দণ্ডায়মান, খুব সম্ভব তারাই বন্দুকের আওয়াজ করে আক্রমণকারীদের তাড়াবার চেষ্টা করছে।
রাম বসু পরামর্শ দিল যে আর এখানে থাকা নয়, আস্তে-সুস্থে নৌকা খুলে দিয়ে এগনো যাক। এখন ওরা বজরাখানা লুট করছে, এর পরে হয়তো আমাদের পালা আসবে।
সেই পরামর্শ সকলের মনঃপূত হল, মাঝিরা সন্তর্পণে নৌকা খুলে দিয়ে মাঝগাঙে গিয়ে নৌকা স্রোতের মুখে ছেড়ে দিল। মাঝিরা নিজেদের মধ্যে বলা-কওয়া করছিল, ও ভাই, বোম্বেটের ভয়ে গাঁয়ে আশ্রয় নিলাম, এখন দেখছি গাঁয়েই ছিল বোম্বটের দল। মাঝিদের কথাবার্তায় আকৃষ্ট হয়ে পার্বতী ও রাম বসু তাদের কাছে গেল। অনেকক্ষণ তাদের জেরা করে বুঝল যে বাজারে গিয়ে কথাপ্রসঙ্গে নৌকার আরোহীদের পরিচয়, কোথা থেকে আসছে কোথায় যাবে প্রভৃতি মাবিয়া সবই প্রকাশ করে দিয়েছে।
তখন রাম বসু পার্বতীকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, দেখ ভাই, এবারে ব্যাপারটা যেন বুঝতে পারছি। এ সেই চণ্ডী বক্সীর কাজ। মাঝিদের কথায় চণ্ডী বী আমাদের পরিচয় পেয়ে আমাদের আক্রমণ করবে ভেবেছিল, ভুলক্রমে বজরাখানা আক্রমণ করেছে।
পার্বতী শুধাল, কিন্তু বজরায় ছিল কারা?
রাম বসু বলল, যারাই থাক, ভীরু নয়, বন্দুক চালিয়েছে তারাই মনে হচ্ছে।
নৌকা গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরে এসেছে, ইতিমধ্যে রাতও ফরসা হয়ে এসেছে, তারা দেখতে পেল একখানা বজরা পিছু পিছু আসছে।
পার্বতী বলে উঠল, পিছু নিল নাকি?
রাম বসু ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, এ সেই বজরা। তবু সাবধানের মার নেই। ও মাঝি, পাল তুলে দেওয়া যায় না?
মাঝিরাও বজরাখানা দেখেছিল, পাল খাটাবার কথা ভেবেছিল। এখন রাম বসুর কথা শুনে বলল, না কর্তা, পাল চলবে না, হাওয়া উত্তরে।
বেশ ফরসা হয়ে এসেছে, বজরাখানাও কাছে এসে পড়েছে, বজরার হাদের লোক চিনতে পারা যায়, জন-তিনেক লোক বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে।
রাম বসু তাদের ঠাহর করে দেখে বলল, পার্বতী ভায়া, চেনা লোক যেন!
সাহেব যে!
জন স্মিথ বলে মনে হচ্ছে—আর ও দুজনকেও তাদের বাড়িতে দেখেছি মনে হয়।
তারা বুঝল যে বজরা থেকে ভয়ের কারণ নেই, তখন নৌকার গতি ধীর করে দেওয়া হল।
রাম বসু বলল, একবার ওদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনে নেওয়া যাক কাল কি ঘটেছিল।
রাম বসু হেঁকে ইংরেজিতে বলল—মিঃ স্মিথ নাকি?
জন তাকে চিনতে পেরে বলল—আশ্চর্য, মুন্সী যে, তোমরা কোথা থেকে?
মদনাবাটি থেকে আসছি।
মিঃ কেরী কোথায়?
তিনি আসেন নি, আমরাই কয়েকজন আসছি।
তবে নৌকা ভেড়াও, অনেক কথা আছে।
তখন নৌকা দুখানা এক জায়গায় বাঁধা হলে পার্বতী ও রাম বসু বজরায় গিয়ে উঠল।
রাম বসু বলল, মিঃ স্মিথ, আমার এই বন্ধুকে নিশ্চয় মনে আছে–পার্বতী ব্রাহ্মণ!
অবশ্য মনে আছে। এবারে আমার বন্ধুদের সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। মিঃ রিংলার ও মিঃ মেরিডিথ—আমাদের বাড়িতে দেখেছ নিশ্চয়।
খুব দেখেছি, বেশ মনে আছে।
জন বন্ধুদের উদ্দেশে বলল, ইনি রাম বসু, পণ্ডিত ব্যক্তি, মিঃ কেরীর মুণী, আর ইনি রাম বসুর বন্ধু, ইনিও খুব শান্ত ব্যক্তি।
রাম বসু শুধাল, কাল কি হয়েছিল বল ত?
জন বলল, কিছুই জানি নে। আমরা শিকার করবার উদ্দেশ্যে কদিন আগে বেরিয়ে কাল সন্ধ্যায় এই গাঁয়ে নৌকা ভিড়িয়েছিলাম। হঠাৎ রাত্রে বোম্বেটেদের দল আক্রমণ করে বসল—আর কিছুই জানি নে।
রাম বসু বলল, আমি জানি বলে মনে হচ্ছে।
তুমি জানবে কি করে?
ওদের লক্ষ্য ছিল আমাদের নৌকা, ভুলক্রমে তোমাদের নৌকাখানা আক্রমণ করে বসেছিল।
কিন্তু তোমাদেরই বা আক্রমণ করতে যাবে কেন?
সে অনেক কথা। বলে রাম বসু রেশমী-সংক্রান্ত যাবতীয় বৃত্তান্ত বলল, মদনাবাটির দু বছরের জীবন-বৃত্তান্ত দিল, কেবল হঠাৎ মদনাবাটি পরিত্যাগের প্রকৃত কাহিনীটি চেপে গিয়ে বলল, অনেক দিন হয়ে গেল, একবার নিজেদের আত্মীয়স্বজন স্ত্রীপুত্রদের দেখবার আশায় চলেছি কলকাতায়। যাক, তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে খুব আনন্দ পেলাম।
জন বলল, মেয়েটিকে তো সঙ্গে নিয়ে এলে, কলকাতায় রাখবে কোথায়? শত্রুপক্ষ খুব দুঃসাহসী বলে মনে হচ্ছে, লুট করে নিয়ে না যায়।
সেই তো পড়েছি দুশ্চিন্তায়।
জন বলল, মেয়েটির যদি আপত্তি না থাকে তবে খুব এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে থাকবার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। সেখানে যম ছাড়া আর কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
কি রকম পরিবার শুনি।
আমাদের পাড়ায় থাকে জন রাসেল, সুপ্রীম কোর্টের জজ। কিছুদিন আগে তার শ্যালীকন্যা এসে পৌঁছেছে। মেয়েটির অল্প বয়স, তার কাজে-কর্মে সাহায্য করবার জন্য একটি দেশী মেয়ের আবশ্যক।
কি কাজ করতে হবে?
কাজ আর কি—তাদের কি কাজের লোকের অভাব আছে। ইংরেজিতে যাকে Maid of honour বলে সেইভাবে থাকবে। চুলটা বেঁধে দেবে, আয়নাটা হাতের কাছে এগিয়ে দেবে, বেড়াবার সময়ে সঙ্গে যাবে, দুটো গল্পগুজব করবে—এই আর কি!
রাম বসু বলে, সে রকম কাজের জন্য এর চেয়ে ভাল মেয়ে সহসা পাবে না। এ বেশ ইংরেজি বলতে কইতে লিখতে পড়তে পারে, ইংরেজী সমাজের কায়দা-কানুনও শিখেছে, সচ্চরিত্র ও মধুরভাষী। তা ছাড়া বয়সও অল্প।
জন উল্লসিত হয়ে বলে ওঠে, বেশ মিলবে রোজ এলমারের সঙ্গে। আমি অনেক জায়গায় সন্ধান করেছি, পাই নি। তা হলে কথা পাকা, কি বল মুন্সী?
নিশ্চয় পাকা।
অপ্রত্যাশিতভাবে রেশমীর নিরাপদ আশ্রয় জুটে যাওয়ায় রাম বসু ও পার্বতী স্বস্তি অনুভব করল।
এমন সময়ে রাম বসুদের নৌকো থেকে কান্নার শব্দ উঠল রেশমী কাঁদছে।
ন্যাড়া, রেশমী কাঁদে কেন রে?
ঐ দেখ না কেন কাঁদে, আমারও কান্না পাচ্ছে।
ন্যাড়ার নির্দেশে নদীর দিকে তাকিয়ে তারা দেখল অদূরে একটি সদ্যোমৃত নরদেহ। রাম বসু ও পার্বতীর চিনতে বিলম্ব হল না—তিনু চক্রবর্তীর মৃতদেহ।
জন বলে উঠল—এটা ডাকুদের কারও দেহ হবে। কাল গুলি চালিয়েছিলাম, অন্ধকারে বুঝতে পারি নি যে কেউ মারা গিয়েছে। রাম বসু বলে উঠল, মিঃ স্মিথ, এ লোক ডাকু নয়, এই গাঁয়ে আমাদের যে একমাত্র বন্ধু তারই মৃতদেহ।
তবে ও ডাকাতদের সঙ্গে এসেছিল কেন?
সঙ্গে এসেছিল কিন্তু এক উদ্দেশ্যে আসে নি, ও নিশ্চয় এসেছিল তার দলবল নিয়ে আমাদের সাহায্য করতে।
জন সত্যকার দুঃখিত হয়ে বলল, আর শেষে কিনা মারা পড়তে সেই লোকটাই মারা পড়ল! এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কিছুই হতে পারে না।
তখন পার্বতী, রাম বসু, ন্যাড়া মিলে মৃতদেহ জল থেকে তুলে কাঠ সংগ্রহ করে মৃতদেহের সৎকার করল। যতক্ষণ মৃতদেহ পুডে নিঃশেষ না হয়ে গেল রেশমী তার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে কাঁদল। ঐ মৃতদেহের সঙ্গে তার গ্রামজীবনের শেষ চিহ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেল। তিনু চক্রবর্তী মৃত্যুর পরেও তার কর্তব্য ভোলে নি, রেশমীর পিছু পিছু ভেসে এসে অভয়পূর্ণ আশীর্বাদ জানিয়ে গেল।
.
২.১৮ আর একটি অবান্তর অধ্যায়
রাম বসু প্রভৃতির প্রস্থানের পরে কেরীর সমস্যা ও সঙ্কট ঘনীভূত হয়ে এল। একটার পরে একটা। প্রথমেই বাংলা পাঠশালাটি ভেঙে গেল; ছাত্ররা আগেই পালিয়েছিল, এবারে গুরুমশায় সরে পড়ল। তার পরে জ্যাভেজের মৃত্যুর কিছুদিন পমেশিটায় হঠাৎ মারা গেল। কেরী যখন শোকে আচ্ছন্ন, ছিরুর মা কতক তৈজসপত্র নিয়ে সরে পড়ল। বিপদের এখানেই শেষ নয়। কুঠির কাজে ক্রমাগত ক্ষতি হচ্ছে দেখে উডনী পত্ৰযোগে জানাল তার পক্ষে আর অধিক দিন ক্ষতি বহন করা সম্ভব নয়শীঘ্রই কুঠির কাজ গুটিয়ে ফেলতে মনস্থ করেছে সে। ওদিকে ভবঘুরে টমাসের পালে আবার লেগেছে দমকা হাওয়া, সে নিরুদ্দেশ হয়ে চলে গেল, কোথায় কেউ নিশ্চয় করে বলতে পারে না; কেউ বলে রাজমহলে কেউ বলে বীরভূমে।
এ-হেন অবস্থাতেও কেরীর আদর্শবাদ অটল, লক্ষ্য স্থির। যেন সমকাই আগের মত নিয়মিত চলছে এইভাবে সকালবেলা সে সংস্কৃত ব্যাকরণ খুলে কেবল বসেছে এমন সময়ে মিসেস কেরী ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে বলল, কাউকে যে দেখছি নে। সব বাঘে নিয়েছে, তুমি এখনও একা বসে? পালাও, পালাও, শীঘ্ন পালাও, এবার তোমার পালা।
এই বলে ছুটে মারল দৌড় বাইরের দিকে।
কেরী ছুটল পিছু-পিছু, দাঁড়াও ডরোথি, দাঁড়াও, কোন ভয় নেই।
এমন আজকাল প্রায়শ হচ্ছে। জ্যাভেজ ও পিটারের পর পর মৃত্যুতে ডরোথির মাথা সম্পূর্ণ খারাপ হয়ে গিয়েছে। উন্মাদ পত্নী ও কঠিন সংস্কৃত ব্যাকরণ এই দুয়ের চর্চায় কেরীর দিবারাত্রি এখন বিভক্ত। একজন স্থানীয় লোকের সাহায্যে ফেলি যথাসাধ্য গৃহকর্মাদি করে।
রাম বসু থাকতেই কেরী সংস্কৃত সাহিত্যের বিপুল ভাণ্ডার আবিষ্কার করেছিল। পাণ্ডিত্য ও কাণ্ডজ্ঞানের বলে সে বুঝেছিল-রাম বসুর ফারসীও নয়, ন্যাড়ার লোক মুখের ভাষাও নয়—সংস্কৃত ভাষার মধ্যেই ভারতীয় যাবতীয় ভাষার প্রাণ-রহস্য নিহিত। রাম বসু ও পার্বতী ব্রাহ্মণ একবাক্যে কেরীকে সমর্থন করল—সংশয়ের আর কিছু রইল না। কেরী সবেগে নিজেকে নিক্ষেপ করল সংস্কৃতভাষা-সমুদ্রে। সংস্কৃত ভাষার প্রেরণায় সে বুঝতে পারল যে এই আদর্শে গড়ে তুলতে হবে বাংলা গদ্য-রীতি। তখন সে সংস্কৃত ব্যাকরণের মডেলে বাংলা ব্যাকরণ এবং সংস্কৃত অভিধানের মডেলে বাংলা অভিধান সঙ্কলন শুরু করে দিল। অন্যদিকে চলল বাইবেল তর্জমার কাজ। বাইবেলের সেন্ট ম্যাথিউ লিখিত সুসমাচারের অনুবাদ রাম বসুর সহযোগিতায় শেষ হয়েছিল, এবারে নবার্জিত সংস্কৃত-জ্ঞানের সাহায্যে তার সংশোধন চলল।
কেরী ভাবল, অনুবাদ তো চলছে, ক্রমে আরও জমে উঠবে, কিন্তু ছাপবার উপায় কি? এমন সময়ে সে খবর পেল কলকাতায় একটি ছাপাখানা নামমাত্র মূল্যে বিক্রয় হচ্ছে। কেরী অবিলম্বে কলকাতায় গিয়ে ছাপাখানাটি কিনে মদনাবাটিতে ফিরে এল। ফিরে এসে দেখল যে, উডনীর একখানা চিঠি অপেক্ষা করছে। কুঠি উঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে উড়নী। তখন কেরী নিকটবর্তী খিদিরপুর গ্রামে এক নীলকুঠি ক্রয় করে সপরিবারে সেখানে উঠে চলে গেল।
টমাস চলে গেলে কিছুদিন পরে ফাউন্টেন নামে ধর্মোৎসাহী এক যুবক তার কাজে এসে যোগ দিয়েছিল—তারই সাহায্যে কোন রকমে কাজ চলল। কিন্তু মনের মধ্যে সে অনুক্ষণ অনুভব করত রাম বসুর অভাব। রাম বসুর উৎসাহ, বিচক্ষণতা, ভাষাজ্ঞান, ও সাহিত্যপ্রীতির অভাব সে পদে পদে অনুভব করতে লাগল। এক-একবার মনে হত মুন্সীকে আনবার জন্যে ফাউন্টেনকে পাঠিয়ে দিই, আবার তখনই মনে হত, না থাক, লোকটা ঘোরতর দুশ্চরিত্র। এই রকম দোটানার মধ্যে কোন রকমে গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে লাগল কেরীর কর্মজীবন।