২.১৬
শক্ত, ঠাণ্ডা মেঝেতে জ্ঞান ফিরলো আমার। মাথার পেছনে দপদপ করছে, যেন কেউ ধারালো ছুরির ফলা বিধিয়ে দিয়েছে সেখানে। হাত বুলালাম জায়গাটায়।
“রক্ত বের হয়নি,” একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠলো পাশ থেকে। কিন্তু ফুলে যাবে। মাথা ব্যথাও থাকবে কয়েকদিন।”
উপরে তাকাতেই পল রোজের কৌতূহলী চেহারাটা দেখতে পেলাম। একটা বেজবল ব্যাট হাতে নিয়ে উবু হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বয়সে আমার কাছাকাছি হলেও, অনেক বেশি লম্বা-চওড়া। চেহারাটা অবশ্য কিশোরসুলভ। মাথাভর্তি লাল চুল, অ্যালিসিয়ার মতন। হুইস্কির গন্ধ আসছে লোকটার গা থেকে।
উঠে বসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না।
“কিছুক্ষণ শুয়ে থাকুন।”
“কনকাশন, মানে মাথায় আঘাতের জন্য সাময়িক স্মৃতিবিভ্রমের মতো জটিলতা হতে পারে।”
“হ্যাঁ।”
“আপনার মাথায় সমস্যা নাকি? এভাবে ব্যাট দিয়ে বাড়ি দিলেন কেন?”
“আমি ভেবেছিলাম চুরি করতে এসেছেন।”
“আমি চোর না।”
“সেটা জানি এখন। আপনার ওয়ালেটের পরিচয়পত্র দেখেছি। আপনি একজন সাইকোথেরাপিস্ট।”
পেছনে পকেটে হাত দিয়ে আমার ওয়ালেটটা বের করে আনলো সে। পরক্ষণেই আমার দিকে ছুঁড়ে দিল। বুকের ওপর এসে পড়ে জিনিসটা। দেখে নেই সব ঠিকঠাক আছে কি না।
“আপনি তো গ্রোভে চাকরি করেন।”
সামান্য নড়াচড়াতেই মাথার ভেতরে ব্যথার বিস্ফোরন ঘটলো। “হ্যাঁ।”
“তাহলে নিশ্চয়ই জানেন আমি কে?”
“অ্যালিসিয়ার ফুপাতো ভাই?”
“পল রোজ।” হাত বাড়িয়ে দিল লোকটা। “দেখি, আস্তে আস্তে এবারে ওঠার চেষ্টা করুন।”
পলের হাত ধরে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। গায়ে বেশ শক্তি ধরে সে। দাঁড়িয়ে থাকতে অবশ্য কষ্ট হচ্ছে। আরেকটু হলে মেরেই ফেলতেন আমাকে,” বিড়বিড় করে বললাম।
“যদি আপনার কাছে বন্দুক থাকতো? যা দিনকাল! তাছাড়া বিনা অনুমতিতে ভেতরে ঢুকেছেন আপনি। কি আশা করছিলেন? ফুলের মালা নিয়ে স্বাগত জানাবো?”
“আপনার সাথেই দেখা করতে এসেছিলাম ভাই,” ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে বললাম। “এখন তো মনে হচ্ছে না এলেই ভালো হতো।”
“ভেতরে এসে বসুন।”
এ মুহূর্তে তাকে অনুসরণ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমার কাছে। ব্যথাটা বেড়েই চলেছে। পেছনের দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে পা দিলাম আমরা।
বাইরের মতনই ভেতরের অবস্থাও শোচনীয়। রান্নাঘরের দেয়ালের কমলা জ্যামিতিক নকশা দেখে মনে হচ্ছে কম করে হলেও চল্লিশ বছরের পুরনো। ওয়ালপেপার খুলে খুলে আসছে, কিছু জায়গায় একদম কালো হয়ে গেছে। আনাচে কানাচে ঝুল আর মাকড়সার জাল। মেঝেতে ধূলোর পুরু স্তর দেখে কার্পেট বলে ভুল হতে পারে। আর ঘরময় বিড়ালের প্রস্রাবের গন্ধ। এক রান্নাঘরেই পাঁচটা বিড়াল শুয়ে বসে আছে। বাম দিকের কোণায় অনেকগুলো বিড়ালের খাবারের পুরনো টিন ফেলে রাখা হয়েছে, সেগুলো থেকেও গন্ধ ছুটেছে। ভীষণ অস্বাস্থ্যকর একটা পরিবেশ।
“বসুন, আমি চা বানাচ্ছি,” বলে বেসবল ব্যাটটা দরজার পাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখলো পল। ওটার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছি না। লোকটাকে আশপাশে এখনও নিরাপদ লাগছে না নিজেকে।
কিছুক্ষণ পর এক ভাঙা মগ ভর্তি চা আমার হাতে দিল পল। “খেয়ে ফেলুন।”
“পেইনকিলার হবে কি?”
“অ্যাসপিরিন আছে বোধহয়, খুঁজে দেখি দাঁড়ান। এটা মিশিয়ে দেই,” একটা হুইস্কির বোতল আমাকে দেখালো সে। “চাঙ্গা লাগবে তাহলে।”
আমি কিছু বলার আগেই মগের মধ্যে কিছুটা হুইস্কি ঢেলে দিল পল। চুমুক দিলাম। বেশ কড়া ঠেকছে স্বাদটা, মিষ্টিও পরিমাণমতো। পল নিজেও চায়ের কাপে চুমুক দিল। কিছুক্ষণ কেউ কিছু বললাম না। নীরবে আমাকে দেখছে সে। লোকটার তাকানোর ভঙ্গির সাথে অ্যালিসিয়ার তাকানোর ভঙ্গির মিল আছে।
“কেমন আছে ও?” কিছু সময় পর জিজ্ঞেস করলো পল। “অনেক দিন দেখা হয়নি আমাদের। মা’কে এখানে রেখে বেরুতেই পারি না,” আমি জবাব দেয়ার আগেই বলল।
“ওহ আচ্ছা। অ্যালিসিয়ার সাথে শেষ কবে দেখা হয়েছিল আপনার?”
“বেশ কয়েক বছর আগে। আসলে কোন যোগাযোগই নেই আমাদের। ওর বিয়েতে গিয়েছিলাম, এর পরে বড়জোর এক কি দু’বার দেখা হয়েছে। গ্যাব্রিয়েল আসলে পছন্দ করতো না ব্যাপারটা। অ্যালিসিয়াও বিয়ের পর থেকে ফোন দেয়া কমিয়ে দেয়, কখনো দেখা করতে আসতো না। সত্যি বলতে মা অনেক কষ্ট পেয়েছে তার এই আচরণে।”
আমি কিছু বললাম না। মাথার প্রচণ্ড ব্যথার কারণে ঠিকমতো কিছু ভাবতেই পারছি না। তবে টের পাচ্ছি যে আমাকে খেয়াল করছে সে।
“আমার সাথে দেখা করতে আসলেন যে?”।
“কিছু প্রশ্ন ছিল অ্যালিসিয়ার ব্যাপারে…মানে তার শৈশব নিয়ে।”
মাথা নেড়ে মগে কিছু হুইস্কি ঢেলে নিল পল। চেহারায় আর আগের বিচলতা নেই; আমি নিজেও হুইস্কির প্রভাব টের পাচ্ছি। ব্যথার তীব্রতা কমে গেছে অনেকাংশে, বোধশক্তিও ফিরে আসছে। যা করতে এসেছো করো, নিজেকে বোঝালাম। এরপর যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে যাও এখান থেকে।
“আপনারা তো একসাথে বড় হয়েছেন?”
মাথা নেড়ে সায় দিল পল। “বাবা মারা যাবার পর এখানে এসে উঠেছিলাম আমি আর মা। তখন আট কি নয় বছর বয়স ছিল আমার। প্রথমে ভেবেছিলাম কয়েকদিন থেকেই চলে যাবো। কিন্তু কিছুদিন পরই অ্যালিসিয়ার মা মারা যায় দুর্ঘটনায়। তাই মা থেকে যায় অ্যালিসিয়া আর ভার্নন মামার দেখভাল করার জন্যে।”
“ভার্নন বোজ-অ্যালিসিয়ার বাবা?”
“হ্যাঁ।”
“মি. ভার্নন এখানেই কয়েক বছর আগে মারা গেছেন?”
“হ্যাঁ,” ভ্রূ কুঁচকে গেল পলের। “আত্মহত্যা করেছিলেন আসলে। ওপরতলার চিলেকোঠায়। আমিই প্রথম দেখতে পাই লাশটা।”
“দুঃখজনক।”
“হ্যাঁ। অ্যালিসিয়া পুরো ভেঙে পড়েছিল। সেবারই ওর সাথে শেষ দেখা হয় আমার। ভার্নন মামর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে। খুব খারাপ অবস্থা ছিল বেচারির।” উঠে দাঁড়ায় পল। “আরেকটু হুইস্কি নিবেন নাকি?”
আমি মানা করার আগেই কথা বলতে বলতে মগে হুইস্কি ঢেলে দিল সে। “আমার কিন্তু কখনো বিশ্বাস হয়নি যে গ্যাব্রিয়েলকে অ্যালিসিয়া খুন করেছে। এরকমটা হবার কোন কারণই নেই।”
“কেন?”
“কারণ অ্যালিসিয়ার স্বভাবের সাথে ব্যাপারটা যায় না। একটা পোকার গায়েও হাত তোলেনি ও কখনো।”
কিন্তু এখন সে বদলে গেছে, মনে মনে ভাবলেও মুখে কিছু বললাম না।
হুইস্কিতে চুমুক দিল পল। “এখনও মুখ খোলেনি ও?”
“না”
“এই ব্যাপারটাও আমার মাথায় ঢোকেনা, বুঝলেন। আমার তো মনে হয়-”
সে কথা শেষ করার আগেই ওপরতলা থেকে একটা অস্ফুট শব্দ ভেসে এলো। চাপা গলায় কেউ কথা বলছে, আমি বুঝতে পারলাম না কিছুই।
লাফিয়ে উঠে পড়লো পল। “এক সেকেন্ড,” বলে দ্রুত সিঁড়ির নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। “সব ঠিক আছে তো, মা?”
আবারো দুর্বোধ্য কিছু কথা ভেসে এলো ওপর থেকে।
“কি? ওহ আচ্ছা। এক-এক মিনিট।” পলের গলায় অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট।
হলওয়ের অপর পাশ থেকে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো সে। “মা আপনার সাথে দেখা করতে চাইছে।”
.
২.১৭
কাঁপা কাঁপা পদক্ষেপে পলকে অনুসরণ করে ধুলোমাখা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম।
সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল লিডিয়া রোজ। জানালায় কিছুক্ষণ আগে তার মুখই দেখেছিলাম। মাথার লম্বা সাদা চুলগুলো দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন চিরুনির স্পর্শ পায়নি। মাত্রাতিরিক্ত ওজনের কারণে নড়তে চড়তে কষ্ট হয়। হাত-পাগুলো গাছের গুঁড়ির মতন পুরু, কাঁধ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি চওড়া। এ মুহূর্তে একটা হাঁটার লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার ওজনের ভারে প্রায় বেঁকে গিয়েছে জিনিসটা, যে কোন সময় ভেঙে যেতে পারে।
“কে এই ছোকরা? কে?”
ক্ষনক্ষনে গলায় প্রশ্নটা পলের উদ্দেশ্যে করলেও তার দৃষ্টি আমার দিকে। এক মুহূর্তের জন্যে চোখ সরাচ্ছে না। আবারো অ্যালিসিয়ার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সাথে তার দৃষ্টির মিল খুঁজে পেলাম আমি।
“উত্তেজিত হবার কিছু নেই, মা,” নিচু গলার বলল পল। “ইনি অ্যালিসিয়ার থেরাপিস্ট। হাসপাতাল থেকে এসেছে আমার সাথে কথা বলতে।”
“তোর সাথে? তোর সাথে কেন কথা বলতে চায়? কি করেছিস তুই
“অ্যালিসিয়ার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন।”
“তোর মাথায় কি ঘিলু নেই? একটা সাংবাদিককে ঘরে ঢুকতে দিলি?” এখন প্রায় চিৎকার করছে লিডিয়া। “এখনই ঘাড় ধরে বের করে দে।”
“আরে সাংবাদিক না, বললাম তো। আইডি দেখেছি আমি। এখন। কোন হৈচৈ কোরো না। চলো, ভেতরে চলো। শুয়ে থাকো।”
গজগজ করতে করতে বেডরুমে ফিরে গেল মিসেস রোজ। ইশারায় আমাকে অনুসরণ করতে বলল পল।
কারো বিছানায় উঠতে এতটা শব্দ হতে পারে, এটা আগে ভাবিনি। ওজনের ভারে দেবে গেছে ম্যাট্রেস। পল তার বালিশগুলো ঠিক করে দিল। একটা বয়স্ক বিড়াল গা এলিয়ে শুয়ে আছে লিডিয়ার পায়ের কাছে। এরকম কুৎসিত বিড়াল আগে দেখিনি। পুরো শরীর জুড়ে নানারকম ক্ষত, কিছু জায়গায় লোম উঠে গেছে, এক কান নেই। ঘুমের ভেতরেও গড়গড় করছে।
রুমটায় নজর বুলালাম একবার। পরননা, বাতিল জিনিসপত্রে ঠাসা। হলুদ হয়ে আসা খবরের কাগজ, পুরনো কাপড়ের টিবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঘরময়। একটা অক্সিজেন ক্যানিস্টার ঠেস দিয়ে রাখা দেয়ালের সাথে। বেডসাইড টেবিলের ওপর নানারকম ঔষধ ভর্তি বড়সড় ডিব্বা।
গোটা সময় লিডিয়ার অগ্নিদৃষ্টি অনুসরণ করলো আমাকে। অবশ্য অগ্নিদৃষ্টি না বলে উন্মাদ দৃষ্টিও বলা যায়।
“কি চায় এই ছোকরা?” আমাকে আবারো আপাদমস্তক দেখলো সে। “কে ও?”
“কেবলই তো বললাম, মা। অ্যালিসিয়ার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছে। ওর চিকিৎসার জন্যে জরুরি ব্যাপারটা। থিও একজন সাইকোথেরাপিস্ট।”
‘সাইকোথেরাপিস্ট’ শব্দটা যে লিডিয়ার বিশেষ পছন্দ নয়, সেটা কাউকে বলে দিতে হলো না। গলা খাকারি দিয়ে ঠিক আমার পায়ের সামনে একদলা থুতু ফেললো সে।
“মা, প্লিজ-” গুঙিয়ে উঠলো পল।
“তুই চোপ!” বলে আমার দিকে চোখ গরম করে তাকালো লিডিয়া। “অ্যালিসিয়া হাসপাতালে কেন?”
“হাসপাতালে থাকবে না তো কোথায় থাকবে?”
“কোথায় আবার? জেলে,” লিডিয়ার ক্রুব্ধ দৃষ্টির তেজ একটুও ম্লান হয় না। “অ্যালিসিয়ার ব্যাপারে জানতে চাও? বলছি আমি। আস্ত হারামী একটা মেয়ে। ছোট থেকেই স্বভাব-চরিত্র খারাপ।”
চুপচাপ শুনছি। মাথাব্যথাটা এখনও কমেনি। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে লিডিয়ার রাগ বেড়েই চলেছে।
“আমার ভাই, ভার্নন বেচারা ইভার মৃত্যুর ধাক্কা কাটিয়েই উঠতে পারেনি। ওর দেখাশোনা করতাম আমি। অ্যালিসিয়ারও খেয়াল রাখতাম। সেজন্যে কি কৃতজ্ঞ হারামিটা?”
এবারেও কিছু বললাম না। আসলে জবাবে আমার কাছ থেকে কিছু শোনার আশাও করছে না লিডিয়া।
“তুমি জানো অ্যালিসিয়া কিভাবে এসবের প্রতিদান দিয়েছে? জানো আমার সাথে কি করেছে?”
“মা, প্লিজ।”
“একদম চুপ!” পলকে ধমকে আবারো আমার দিকে ফিরলো লিডিয়া। এতটা রেগে উঠবে আগে বুঝিনি। “কুত্তিটা আমার ছবি এঁকেছে। কোনরকমের অনুমতির তোয়াক্কা করেনি। আমিও ভালোমানুষের মতো প্রদর্শনীতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি গ্যালারি জুড়ে আমার কুৎসিত, জঘন্য পেইন্টিং। আমাকে নিয়ে তামাশা করেছে ও! তামাশা!”
রাগের দমকে কাঁপছে লিডিয়া। পলের চেহারায় দুশ্চিন্তা। “আপনি আসুন নাহয়। মা’র উত্তেজিত হওয়াটা স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো না।”
মাথা নাড়লাম। লিডিয়া রোজের অবস্থা যে আসলেও ভালো না, এটা নিয়ে কোন সংশয় নেই আমার মধ্যে। কেটে পড়তে পারলেই বাঁচি।
বাড়িটা থেকে বের হয়ে ট্রেন স্টেশনের দিকে হাঁটা দিলাম। মাথায় আঘাতের জায়গাট ফুলে উঠেছে, যন্ত্রনা কমার কোন লক্ষণ নেই। সময় নষ্ট হলো এখানে এসে, কিছুই জানতে পারিনি। তবে এটা পরিস্কার যে কেন সুযোগ পাওয়া মাত্র এই বাড়িটা থেকে পালিয়েছে অ্যালিসিয়া। আঠারো বছর বয়সে আমিও ঠিক এভাবেই পালিয়েছিলাম বাবার কাছ থেকে। আর অ্যালিসিয়ার দুরে সরে যাবার কারণ ওর আপন ফুপি-লিডিয়া রোজ।
লিডিয়ার কেমন ছবি এঁকেছিল অ্যালিসিয়া সেটা নিয়ে ভাবলাম। আসলেও তামাশা করেছে কি না কে জানে। অ্যালিসিয়ার গ্যালারিতে গেলেই উত্তরটা পেয়ে যাবো।
ক্যামব্রিজ ছেড়ে আসার মুহূর্তে পলের কথা মনে হয়ে খারাপই লাগলো। এরকম একজন মানুষের সাথে একা একা থাকা…দুঃখজনক। তার নিশ্চয়ই বন্ধুবান্ধবও নেই খুব একটা বা কারো সাথে কখনো সম্পর্কেও জড়ায়নি। তার মানসিক বিকাশ একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে গিয়েছে।
হঠাই লিডিয়ার প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণায় ছেয়ে উঠলো মন। তাকে দেখে বাবার কথা মনে পড়ে গেছে, এটাই বোধহয় মূল কারণ। যদি আমিও সারের সেই বাসাটায় থেকে যেতাম, তাহলে আমার অবস্থাও পলের মতনই হতো নিশ্চিত।
লন্ডনের ফেরার পুরোটা পথ বড় বিষণ্ণ কাটলো। সেই সাথে যোগ হয়েছে ক্লান্তি আর মাথাব্যথা। তবে কষ্টের অনুভূতিগুলো কি পলের জন্যে নাকি আমার-সেটা বলতে পারবো না।
.
২.১৮
বাসায় ফিরে ক্যাথিকে পেলাম না।
সাথে সাথে ল্যাপটপ খুলে ওর ইমেইলগুলো দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আজকে ভাগ্য খারাপ, লগ আউট করে গিয়েছে।
আমাকে মেনে নিতে হবে যে এই ভুলটা দ্বিতীয়বার আর করবে না সে। এভাবে কতদিন আর ওর ইমেইল অ্যাকাউন্টে ঢোকার চেষ্টা করে যাবো? এরকম চলতে থাকলে ব্যাপারটা অসুস্থ একটা অভ্যাসে পরিণত হবে একসময়। আমি জানি এখন আমাকে কেমন মনে হচ্ছে আপনাদের। গল্প উপন্যাসের সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত কোন স্বামী। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখুন, ক্যাথি ওথেলোতে ডেসডেমোনা চরিত্রে অভিনয় করছে! যার ওপরে কোন ভরসাই নেই তার স্বামী ওথেলোর।
সেদিনই উচিৎ ছিল ইমেইলগুলো আমাকে ফরওয়ার্ড করে দেয়া। তাহলে অন্তত কিছু প্রমাণ থাকতো আমার কাছে। ভুল হয়ে গেছে। এখন তো প্রায়শই সন্দেহ হয় যে ঠিক দেখেছিলাম কি না সেরাতে। ক্যাথিকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যে অদ্ভুত সব ভাবনার উদয় হয় আমার মাথায়। মাঝে মাঝে ভাবি, ভুল বুঝিনি তো? হয়তো গোটাটাই ওর অনুশীলনের অংশ। এর আগে একবার ‘অল মাই সন্স’ নাটকের প্রস্তুতি হিসেবে টানা ছয় সপ্তাহ আমেরিকান টানে কথা বলেছিল সে। তবে ইমেইলগুলোর প্রেরকের স্থানে ক্যাথির নাম লেখা, ডেসডেমোনা না।
পুরোটা যদি কল্পনা হতো, তাহলে ভুলে যেতে পারতাম। যেভাবে ঘুম থেকে জাগামাত্র স্বপ্ন ভুলে যাই আমরা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বরং এটা বলা যায় একটা দুঃস্বপ্নের জালে আটকা পড়েছি। যেখানে আমার সঙ্গি সন্দেহ, অবিশ্বাস আর সংশয়। অবশ্য ক্যাথিকে কিছু বুঝতে দেইনি। এখনও প্রতি রবিবার একসাথে হাঁটতে যাই আমরা। অন্যান্য দম্পতিদের মতন হাত ধরে হেঁটে বেড়াই পার্কে। অবশ্য নীরবতার পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে, কিন্তু সেগুলো অসহনীয় পর্যায়ে যায়নি এখনও। তবে নীরবতার আড়ালে আমার মাথায় কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খায় অবিরাম। কেন এমনটা করলে সে? কিভাবে পারলো করতে? আমাকে ভালোবেসে, বিয়ে করে অন্য একজনের সাথে বিছানায় উঠলে কি করে? গোটাটাই তাহলে অভিনয়? সম্পর্কটা কতদিন ধরে চলছে? এই লোকটাকে কি ভালোবাসে ও? আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তার কাছে?
ক্যাথি গোসলে ঢুকলে কয়েকবার ফোন ঘাটাঘাটি করেছি। কিন্তু ওরকম কোন মেসেজ খুঁজে পাইনি। নিশ্চয়ই ডিলিট করে দিয়েছে। আর যা-ই হোক, বোকা নয় ও। সেদিন বেখেয়ালে ল্যাপটপ খুলে রেখে গিয়েছিল।
এমনটাও হতে পারতো যে সত্যটা হয়তো কখনোই জানতেই পারতাম না আমি।
সেরকমটা হলেই ভালো হতো।
পার্ক থেকে ফেরার পর সোফায় বসে উব্দিগ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় ক্যাথি। “তুমি ঠিক আছে?”
“মানে?”
“না, কেমন যেন চুপচাপ লাগছে তোমাকে।”
“আজকে?”
“গত কয়েকদিন ধরেই।”
দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম। “আর বোলো না, কাজের অনেক চাপ। নতুন রোগিটা সুবিধার না।”
মাথা নাড়লো ক্যাথি। সহানুভূতির ভঙ্গিতে হাতে আলতো চাপ দিল। একবার। ভালো অভিনেত্রী ও, এখন আসলেও মনে হচ্ছে যে আমাকে নিয়ে
“রিহার্সাল কেমন যাচ্ছে?”
“আগের তুলনায় ভালো। দারুণ কিছু বুদ্ধি দিয়েছে টনি। আগামী সপ্তাহটা সেগুলো নিয়েই কাজ করবো। বাসায় ফিরতে দেরি হবে, আগেই বলে দিচ্ছি।”
“ঠিক আছে।”
এখন আর ওকে একটুও বিশ্বাস করি না আমি। সাধারণ কথাগুলো নিয়েও বারবার ভাবি। প্রতিটা বাক্যের প্রচ্ছন্ন কোন অর্থ আছে কি না সেটা বোঝার চেষ্টা করি।
“টনি কেমন আছে?”
“ভালোই,” বলে কাঁধ ঝাঁকালো ক্যাথি, যেন টনির ভালো বা খারাপ থাকাতে কিছু যায় আসেনা ওর। পুরোটাই অভিনয়। টনিকে গুরু মানে সে, একসময় সারাদিন তাকে নিয়ে কথা বলতো। ইদানীং অবশ্য বলে না।
ফোনে নাটক, অভিনয় আর থিয়েটার নিয়ে আলাপ করে ওরা-যে জগতটা নিয়ে আমার কোন ধারণাই নেই। টনির ব্যাপারে অনেক শুনলেও তার সাথে খুব কমই দেখা হয়েছে। একবার রিহার্সালের পরে ক্যাথিকে আনতে গিয়ে দেখেছিলাম। তার সাথে কিন্তু আমার পরিচয় করিয়ে দেয়নি ক্যাথি, ব্যাপারটা অবাক করেছিল আমাকে। টনি বিবাহিত, তার স্ত্রীও অভিনয় করে। আমার কেন যেন মনে হয়েছিল টনির সাথে ক্যাথির ঘেঁষাঘেঁষি ঠিক পছন্দ নয় মহিলার। এ দিক দিয়ে আমার সাথে মিল আছে তার। আমি বুদ্ধি দিয়েছিলাম কোন এক সন্ধ্যায় চারজন একসাথে ঘুরতে বের হবো। কিন্তু ক্যাথিকে খুব একটা আগ্রহী মনে হয়নি প্রস্তাবে। হয়তো ইচ্ছে করেই আমার থেকে টনিকে দূরে রাখতে চেয়েছিল সে।
ক্যাথিকে ল্যাপটপ খুলতে দেখলাম। স্ক্রিনটা এমনভাবে ঘুরিয়ে রেখেছে। যাতে আমি দেখতে না পারি। ওর টাইপ করার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কাকে মেইল পাঠাচ্ছে? টনি?
“কি করো?” হাই তুলে জিজ্ঞেস করলাম।
“আমার খালাতো বোনকে ইমেইল করছি। এখন সিডনিতে আছে ও।”
“তাই? আমার তরফ থেকেও হ্যালো বোলো।”
“ঠিক আছে।”
আরো কিছুক্ষণ টাইপ করে ল্যাপটপটা নামিয়ে রাখলো ক্যাথি। “গোসলে যাবো আমি।”
“ঠিক আছে,” মাথা নেড়ে বললাম।
মুচকি হেসে আমার দিকে তাকালো ক্যাথি। “মুখ এরকম গোমড়া করে রেখো না তো, আমার ভালো লাগে না। আসলেও ঠিক আছে?”
হেসে মাথা নাড়লাম। উঠে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ও। বাথরুমের দরজা পুরোপুরি বন্ধ হওয়া অবধি অপেক্ষা করলাম। পানির শব্দ ভেসে এলো কিছুক্ষণ পরই। এতক্ষণ ক্যাথি যেখানে বসে ছিল, সেখানটায় গিয়ে বসলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে খুললাম ল্যাপটপটা। ব্রাউজার ওপেন করে ওর ইমেইলের পেজটায় ক্লিক করলাম।
লগ আউট করে দিয়েছে।
বিরক্তির সাথে আবারো জায়গামত রেখে দিলাম ল্যাপটপটা। এটা বন্ধ করতে হবে, ভাবলাম। পাগল হয়ে যাবো নাহলে। নাকি ইতোমধ্যেই পাগল হয়ে গেছি?
আমি বিছানায় উঠে চাদর ঠিকঠাক করছি এমন সময় দাঁত ব্রাশ করতে করতে বেডরুমে ঢুকলো ক্যাথি।
“তোমাকে তো বলতে ভুলেই গেছি। সামনের সপ্তাহে লন্ডন থেকে ফিরবে নিকোল।”
“নিকোল?”
“ভুলে গেছো? নিউ ইয়র্কে যাওয়ার আগে পার্টি দিয়েছিল আমার যে বান্ধবীটা।”
“ওহ হ্যাঁ। আমি তো ভেবেছিলাম একেবারে চলে গিয়েছে।”
“গিয়েছিল, কিন্তু এখন আবার ফিরে আসবে,” বলে ক্ষণিকের জন্যে থামলো ক্যাথি। “আমার সাথে বৃহস্পতিবার দেখা করতে চায় ও…রিহার্সালের পর।”
সাধারণ এই কথাটা কেন সন্দেহের উদ্রেক ঘটালো আমার মনে তা বলতে পারবো না। ক্যাথি অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে রেখেছে, এজন্যে? মনে হচ্ছে যেন মিথ্যে বলেছে। আমি আর কিছু বললাম না। সে-ও কথা বাড়ালো না। বের হয়ে গেল ঘর থেকে। বাথরুম থেকে ওর কুলি করার আওয়াজ ভেসে এল কিছুক্ষণ পর।
হয়তো আমার সন্দেহের পুরোটাই অমূলক। আসলেও নিকোলের সাথে দেখা করবে সে বৃহস্পতিবার রাতে।
হয়তো অন্য কোথাও যাবে।
নিশ্চিত হবার একটাই উপায় আছে।
.
২.১৯
এবারে আর কোন ভিড় দেখলাম না অ্যালিসিয়ার গ্যালারির সামনে। কে বলবে যে, ঠিক এখানটাই লোকে লোকারণ্য ছিল ছ’বছর আগে? সবার সাথে দলবেঁধে আমিও অ্যালসেস্টিস ছবিটা দেখতে এসেছিলাম। এখন জানালা থেকে নতুন এক শিল্পীর ছবি ঝুলছি, তবে তার আঁকার হাত ভালো হলেও অ্যালিসিয়ার মত গ্যালারিতে দর্শক টেনে আনতে পারেনি।
গ্যালারিতে পা দেয়া মাত্র কেঁপে উঠলাম। ভেতরের তাপমাত্রা বাইরের তুলনায় কম। পরিবেশটাও কেমন যেন শীতল। বোঝাতে পারছি? কিছু জায়গায় গেলে একটু অন্য রকম লাগে না? সেরকম। চারদিকে থকথক করছে শূন্যতা।
ডেস্কের পেছনে নির্ধারিত সিটে বসে ছিল গ্যালারিস্ট। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো সে।
জিন-ফিলিক্স মার্টিনের বয়স চল্লিশের কোঠায়। সুদর্শনই বলা চলে। সুঠাম দেহ, কালো চুল। খলির নকশা আঁকা একটা আঁটসাঁট টিশার্ট পরনে। কেন এসেছি সে ব্যাপারে কোন রাখঢাক করলাম না। অ্যালিসিয়ার ব্যাপারে কথা বলতে আগ্রহীই মনে হলো তাকে, একটু অবাক হলাম ব্যাপারটায়। ফিলিক্সের কথার টান শুনে জিজ্ঞেস করলাম সে ফরাসি কি না।
“আমার জন্য প্যারিসে। কিন্তু গত বিশ বছর ধরে এখানেই আছি। এখন তো নিজেকে ব্রিটিশই মনে হয়,” হেসে পেছনের রুমটার দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “চলুন, কফি খাওয়া যাক।”
“ধন্যবাদ।”
যে ঘরটাতে প্রবেশ করলাম সেটা অফিসের পাশাপাশি স্টোররুম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। একগাদা পেইন্টিং ফেলে রাখা একপাশে।
“অ্যালিসিয়া কেমন আছে?” কফি মেশিনের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে। “এখনও মৌনব্রত পালন করছে?”
“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে বললাম।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। “খুব খারাপ লাগে ওর জন্যে। আপনি বসুন, প্লিজ। কি জানতে এসেছেন? আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ঠিকঠাক জবাব দেয়ার।”একটা শুকনো হাসি ফুটলো জিন-ফিলিক্সের মুখে। “তবে আমার কাছে কেন এসেছেন সেটা বুঝতে পারছি না।”
“আপনি আর অ্যালিসিয়া তো ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাই না? মানে পেশাদার সম্পর্কের বাইরেও
“কার কাছে শুনেছেন একথা?”
“গ্যাব্রিয়েলের ভাই, ম্যাক্স বেরেনসন। তিনিই বললেন আপনার সাথে কথা বলে দেখতে।”
নামটা শুনেই চোখ বাঁকালো জিন-ফিলিক্স। “ওহ, ম্যাক্সের সাথেও দেখা করেছেন আপনি? বিরক্তিকর একটা লোক।”
এমন সুরে কথাটা বলল যে না হেসে পারলাম না। “আপনি ম্যাক্স বেরেনসনকে চেনেন?”
“চিনি না মানে? ভালো করেই চিনি।” আমার হাতে কফির একটা ছোট কাপ তুলে দিল সে। “অ্যালিসিয়া আমার কাছ থেকে কিছু লুকোতো না। ওকে চিনি অনেক বছর হয়ে গেল, তখনও গ্যাব্রিয়েলের সাথে পরিচয় হয়নি ওর।”
“এটা জানতাম না।”
“আর্ট স্কুলে একসাথেই ভর্তি হয়েছিলাম দু’জনে। পাশ করার পর একসাথে পেইন্টিংও করি।”
“মানে দুজনে মিলে আঁকতেন?”
“আসলে তা না।” হেসে ওঠে জিন-ফিলিক্স। একসাথে দেয়াল রঙ করতাম। হাউজ পেইন্টার ছিলাম আমরা।”
আমিও হাসলাম। “ওহ, আচ্ছা।”
“শেষে দেখা যায় যে ক্যানভাসের চেয়ে দেয়াল রঙের ক্ষেত্রেই আমার প্রতিভা বেশি। তাই আঁকাআঁকি একরকম ছেড়েই দেই। ওদিকে অ্যালিসিয়ার হাত থেকে তখন সবে জাদু ঝরতে শুরু করেছে। কিছুদিন পর যখন এই গ্যালারিটার তদারকি শুরু করলাম, ওকে বললাম এখানেই প্রদর্শনী করতে। সবকিছু খাপে খাপে মিলে গিয়েছিল বলা যায়।”
“তাই তো মনে হচ্ছে। আর গ্যাব্রিয়েল?”
“গ্যাব্রিয়েল?”
জিন-ফিলিক্সের কণ্ঠস্বরে রূঢ়তা টের পেলাম। গ্যাব্রিয়েলকে নিয়ে আরো কথা বলতে হবে তাহলে। “মানে জানতে চাচ্ছিলাম সে বিষয়টা কিভাবে নিয়েছিল। তাকেও নিশ্চয়ই ভালো করেই চেনেন আপনি?”
“নাহ্।”
“চেনেন না?”
“না,” দ্বিধা ভর করলো জিন-ফিলিক্সের কণ্ঠে। “গ্যাব্রিয়েল আসলে আমাকে ঠিকমতো চেনার চেষ্টাও করেনি কখনো। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতো সে।”
“মনে হচ্ছে তাকে খুব একটা পছন্দ নয় আপনার।”
“অস্বীকার করবো না। তাছাড়া আমারও মনে হতো যে সে আমাকে পছন্দ করে না। আসলেই করতো না।”
“সেটা কেন?”
“জানি না আমি।”
“কি মনে হয়? অ্যালিসিয়ার সাথে আপনার মেলামেশা ভালো চোখে দেখতো না?”
কফিতে চুমুক দিয়ে মাথা নাড়লো জিন-ফিলিক্স। “হ্যাঁ, এটা হতে পারে।”
“আপনাকে ওদের সম্পর্কের জন্যে হুমকি ভাবত, নাকি?”
“আপনিই বলুন। মনে হচ্ছে সব জবাব ইতোমধ্যে আছে আপনার কাছে।”
এ বিষয়ে আর কথা বাড়ালে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই অন্য পন্থায় এগোলাম। “গ্যাব্রিয়েল খুন হবার কিছুদিন আগে অ্যালিসিয়ার সাথে দেখা করেন আপনি, তাই তো?”
“হ্যাঁ, ওর বাসায় গিয়েছিলাম খোঁজখবর নিতে।”
“এ বিষয়ে একটু বিস্তারিত বলা যাবে?”
“কিছুদিনের মধ্যে বড় একটা প্রদর্শনী আয়োজন করার কথা ছিল আমাদের, কিন্তু কাজে পিছিয়ে পড়েছিল ও। সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল।”
“তার নতুন কাজগুলো দেখেছিলেন?”
“নাহ। বারবার সময় পেছাচ্ছিল। অগত্যা কিছু না বলেই সেদিন চলে যাই আমি। ভেবেছিলাম বাগানের স্টুডিওতে থাকবে হয়তো। কিন্তু সেখানে খুঁজে পাইনি অ্যালিসিয়াকে।”
“ওহ”
“বাসার ভেতরে ছিল।”
“আপনি ভেতরে ঢুকলেন কী করে?”
প্রশ্নটা শুনে অবাক মনে হলো জিন-ফিলিক্সকে। “মানে?” চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে মাথায় হিসেব মিলিয়ে নিচ্ছে। “ওহ আচ্ছা, বুঝেছি। বাগানের পেছন দিক দিয়ে ভেতরে ঢোকার একটা দরজা আছে। সাধারণত খোলাই থাকতো ওটা। সেদিক দিয়েই রান্নাঘরে ঢুকেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে যে একজন গোয়েন্দার সাথে কথা বলছি, সাইকিয়াট্রিস্ট নয়।”
“আমি একজন সাইকোথেরাপিস্ট।”
“কোন পার্থক্য আছে দুটোর?”
এড়িয়ে গেলাম প্রশ্নটা। “আমি আসলে ঐ মুহূর্তে অ্যালিসিয়ার মানসিক অবস্থা কেমন ছিল, সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি। আপনার কি মনে হয়েছিল? মন-মেজাজ কেমন ছিল তার?”
জবাবে কাঁধ ঝাঁকালো জিন-ফিলিক্স। “স্বাভাবিক। কাজ নিয়ে একটু চিন্তিত ছিল, এই যা।”
“আর কিছু?”
“তাকে দেখে অন্তত এটা মনে হয়নি যে কয়েকদিনের মধ্যে স্বামীর মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করবে। সবকিছু ঠিকঠাকই লেগেছিল আমার কাছে।” কফিতে চুমুক দেয়ার সময় হঠাৎ চোখ বড় হয়ে যায় তার। কিছু একটা নিয়ে দোটানায় ভুগছে। “ওর পেইন্টিংগুলো দেখবেন?” বলে আমার জবাবের অপেক্ষা না করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল জিন-ফিলিক্স। ইশারায় অনুসরণ করতে বলল আমাকে।
“আসুন আমার সাথে।”
.
২.২০
জিন-ফিলিক্সের পিছু পিছু স্টোররুমে চলে এলাম। একটা বড় কেসের সামনে দাঁড়িয়ে তাক থেকে কাপড়ে মোড়ানো তিনটা পেইন্টিং বের করে আনলো সে, সাবধানে কাপড়গুলো সরালে। এরপর হাসিমুখে প্রথম পেইন্টিংটা মেলে ধরলো আমার সামনে।
“এই দেখুন।”
মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম ছবিটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে অ্যালিসিয়ার আঁকা। দূর থেকে মনে হতে পারে ক্যামেরায় তোলা ছবি বড় করে ফেমে বাঁধানো হয়েছে। ছবিটায় অ্যালিসিয়ার মা’র গাড়ি দুর্ঘটনার দৃশ্যটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গাড়ির ধ্বংসস্তূপের মাঝে স্টিয়ারিং হুইল ধরে নিশ্চল বসে আছে এক মহিলা, মৃত। আর গাড়ির ঠিক ওপরে তার আত্মাটা দেহ থেকে বেরিয়ে স্বর্গের পানে ছুটে যাচ্ছে। পিঠের সাথে দুটো পাখাও জুড়ে দিয়েছে অ্যালিসিয়া।
“চমৎকার না ছবিটা?” সমীহ মাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো জিন ফিলিক্স। “এই হলুদ, লাল আর সবুজের মাঝে হারিয়ে যাই মাঝে মাঝে। ইচ্ছে হলেই বের করে দেখি। অসাধারণ একটা দৃশ্য।”
দৃশ্যটা আর যা-ই হোক অসাধারণ নয়, আমার তো অস্বস্তিবোধ হচ্ছে।
পরবর্তী ছবিটা আমাকে দেখালো জিন-ফিলিক্স। ক্রসবিদ্ধ জিশুর একটা পেইন্টিং। জিশু নাকি…?
“এটা গ্যাব্রিয়েল,” আমার অব্যক্ত প্রশ্নটার জবাব দিয়ে দিল গ্যালারিস্ট।
আসলেও জিশুর বেশে গ্যাব্রিয়েলের ছবি এঁকেছে অ্যালিসিয়া। ক্ষতস্থান থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছে। মাথায় কাঁটার মুকুট। তবে একটাই পার্থক্য, ছবিতে মাথা নিচু করে নেই গ্যাব্রিয়েল। বরং তার চোখের দৃষ্টিতে খেলা করছে ঔদ্ধত্য। ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। সামনে এগিয়ে আরো ভালো করে খেয়াল করলাম ছবিটা। গ্যাব্রিয়েলের কাঁধ থেকে কি যেন ঝুলছে! একটা রাইফেল।
“এই বন্দুকের গুলিতেই তো মারা গেছে সে?”
মাথা নাড়লো জিন-ফিলিক্স। “হ্যাঁ, খুব সম্ভবত তারই বন্দুকটা।”
“ছবিটা হত্যাকাণ্ডের আগে আঁকা হয়েছে না?”
একমাস আগে। অ্যালিসিয়ার মনে কি চলছিল সেটা বোঝা যাচ্ছে, তাই না?” বলে তৃতীয় ছবিটা বের করতে লাগলো সে। এটার ক্যানভাস আগের দুটোর চেয়ে বড়। আমার সবচেয়ে পছন্দের ছবি। একটু পিছিয়ে ভালো করে দেখুন।”
তার কথামত পিছিয়ে গেলাম কয়েক কদম। ছবিটা দেখার সাথে সাথে একটা হাসি ফুটলো মুখে।
অ্যালিসিয়ার ফুপি, লিডিয়া রোজের পেইন্টিং এটা! কেন রাগ করেছিল সে, এটা পরিস্কার বুঝতে পারছি এখন। ছবিটায় নগ্ন দেহে ছোট্ট একটা বিছানায় শুয়ে আছে সে। তার ভারে বেঁকে গিয়েছে পায়াগুলো। অস্বাভাবিক মোটা করে আঁকা হয়েছে তাকে, মনের সব ক্ষোভ ঢেলে। চামড়ার ভাঁজ বিছানা ছেড়ে মেঝে ছুঁইছুঁই করছে।
“ঈশ্বর! এটা কি করেছে!”
“আমার কাছে তো চমৎকার লেগেছে।” চোখে আগ্রহ নিয়ে আমাকে দেখছে জিন-ফিলিক্স। “লিডিয়াকে চেনেন আপনি?”
“হ্যাঁ, দেখা করতে গিয়েছিলাম তার সাথে।”
“আচ্ছা।” মুখে হাসি ফুটলো গ্যালারিস্টের। “বেশ ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন তাহলে গত কয়েকদিন। আমি অবশ্য কখনো লিডিয়াকে দেখিনি। অ্যালিসিয়া সহ্য করতে পারতো না মহিলাকে।”
“হ্যাঁ,” ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললাম। “সেটা দেখতেই পাচ্ছি।”
ছবিগুলো কাপড়ে মুড়িয়ে আগের জায়গায় রেখে দিল জিন-ফিলিক্স।
“আর অ্যালসেস্টিস?” বললাম। “ওটা দেখাবেন না?”
“অবশ্যই, আসুন।”
সরু হলওয়ে ধরে হেঁটে গ্যালারির শেষমাথায় চলে এলাম আমরা। এখানে একটা দেয়াল শুধু অ্যালসেস্টিসের জন্যেই বরাদ্দ। আগেরবারের মতনই আমাকে মুগ্ধ করলো পেইন্টিংটা। আগাগোড়া শিল্প আর রহস্যে মোড়া। স্টুডিওতে ইজেলের সামনে নগ্ন দেহে দাঁড়িয়ে আছে অ্যালিসিয়া, পেইন্ট ব্রাশ থেকে টপটপ করে ঝরছে রক্ত। তবে এবারেও তার চেহারার অভিব্যক্তিটা ধরতে পারলাম না। ভ্রু কুঁচকে গেল আপনা থেকেই।
“তার মনে কি চলছে সেটা বোঝা যায় না ছবিটা দেখে।”
“পেইন্টিংটার উদ্দেশ্য তো সেটাই-অ্যালিসিয়া চাচ্ছে না কেউ তাকে বুঝুক। এক অর্থে তার মৌনতাই ফুটে উঠেছে চেহারার শূন্য অভিব্যক্তির মাধ্যমে।”
“বুঝলাম না।”
“সব শিল্পের কেন্দ্রেই একটা রহস্য থাকে। অ্যালিসিয়ার নীরবতাই হচ্ছে তার সেই রহস্য। সেজন্যেই তো ছবিটার নাম দিয়েছে অ্যালসেস্টিস। ইউরিপিডেসের লেখাটা পড়েছেন নাকি?” কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো জিন-ফিলিক্স। “না পড়লে পড়ে ফেলুন। তাহলে আরো ভালো করে বুঝতে পারবেন।”
মাথা নাড়লাম। তবে এবারে ছবিটায় নতুন একটা জিনিস চোখে পড়লো যেটা গতবার খেয়াল করিনি। ইজেলের পেছনে টেবিলের ওপরে একটা ফলের বাটি রাখা-কিছু আপেল আর নাশপাতি শোভা পাচ্ছে সেখানে। তবে লাল আপেলগুলোর গায়ে সাদা সাদা কী যেন কিলবিল করছে।
“এগুলো কি?”
“পোকা?” মাথা নাড়লো জিন-ফেলিক্স। “হা।”
“বাহ, এগুলো এখানে আঁকার নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।”
“এই পেইন্টিংটা একটা মাস্টারপিস। তারিফ করলেও কম হয়ে যাবে।”দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছবিটার দিকে হাত দিয়ে দেখালো জিন-ফিলিক্স। “ওকে যদি তখন চিনতেন আপনি! একদম অন্যরকম একটা মেয়ে। চিন্তাধারাও ভিন্ন। অন্যেরা যেখানে জীবনে পৌনঃপুনিকতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেখানে ওর মাথায় নিত্যনতুন আইডিয়া খেলা করতে সবসময়। প্রকৃত অর্থে বেঁচে থাকা যাকে বলে।” তার চোখ এখন অ্যালিসিয়ার নগ্ন দেহের দিকে। “এত সুন্দর।”
আমিও তাকালাম তার দৃষ্টি অনুসরণ করে। কিন্তু সে যেখানে সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছে, আমার চোখে ধরা পড়ছে বেদনা। আর সেগুলোর জন্যে অ্যালিসিয়া নিজেই দায়ি।
“ও কি কখনো আত্মহত্যার চেষ্টার ব্যাপারটা নিয়ে আপনার সাথে কথা বলেছে?”
টোপটা গিলল জিন-ফিলিক্স। “ওহ, এটার ব্যাপারেও জানেন আপনি? হ্যাঁ, বলবে না কেন।”
“তার বাবার মৃত্যুর পর?”
“একদম ভেঙে পড়েছিল বেচারি,” মাথা নাড়লো জিন-ফিলিক্স। “সত্যটা অস্বীকার করে লাভ নাই, অ্যালিসিয়ার মানসিক অবস্থা কখনোই অতটা ভালো ছিল না। একটুতেই ভেঙে পড়তো। ওর বাবা যখন আত্মহত্যা করলো, আর সহ্য করতে পারেনি।”
“খুব বেশি ভালোবাসতো নিশ্চয়ই তাকে।”
কাষ্ঠ হাসি ফুটলো জিন-ফিলিক্সের মুখে। এমন ভঙ্গিতে তাকালো আমার দিকে যেন পাগলের প্রলাপ বকছি। “কী বলছেন এসব?”
“মানে?”
“অ্যালিসিয়া তাকে ভালোবাসতো না, ঘৃণা করতো। প্রচণ্ড ঘৃণা।”
এরকম কিছু শুনবো একদমই আশা করিনি। “অ্যালিসিয়া এমনটা বলেছিল আপনাকে?”
“হ্যা! ওর মা মারা যাবার পর থেকেই বাবার সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে ওর।”
“তাহলে তার মৃত্যুর পর আত্মহত্যার চেষ্টা করলো কেন? যদি তার জন্যে খারাপই না লেগে থাকে, কষ্ট না পায়…”
কাঁধ ঝাঁকালো জিন-ফিলিক্স। “অনুশোচনা থেকে করতে পারে। কে জানে কেন?”
কিছু একটা লুকোচ্ছে সে। হিসেব মিলছে না।
এসময় ফোন বেজে উঠলো। “এক মিনিট,” বলে ফোনটা বের করে কানে চাপালো গ্যালারিস্ট। ওপাশ থেকে একটা মহিলাকণ্ঠ শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণ কথা বলে দেখা করার জন্যে সময় ঠিক করলো দু’জনে। “আমি ওখানে গিয়ে ফোন দেব তাহলে, ডার্লিং,” ফোন কেটে দিল জিন-ফিলিক্স। “দুঃখিত,” পরমুহূর্তে আমার দিকে তাকিয়ে বলল।
“সমস্যা নেই। আপনার গার্লফ্রেন্ড?”
“না,” হাসি ফুটলো তার মুখে। “বন্ধু…অনেক বন্ধু আছে আমার।”
তা তো থাকবেই, মনে মনে বললাম। কেন যেন এখন আর তাকে আমার পছন্দ হচ্ছে না।
বিদায় নেয়ার আগ মুহূর্তে শেষ প্রশ্নটা করলাম। “আরেকটা ব্যাপার, অ্যালিসিয়া কি কখনো কোন ডাক্তারকে নিয়ে কিছু বলেছিল আপনাকে?”
“ডাক্তার?”
“আত্মহত্যার চেষ্টা করার পর একজন ডাক্তার দেখায় সে। তার খোঁজ বের করার চেষ্টা করছি।”
“হুম,” ভ্রু কুঁচকে বলে জিন-ফিলিক্স। “কার কথা যেন শুনেছিলাম…”
“নামটা মনে আছে?”
এক মুহূর্ত ভেবে মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিল সে। “দুঃখিত, মনে পড়ছে না।”
“ঠিক আছে। যদি মনে পড়ে, তাহলে আমাকে দয়া করা জানাবেন।”
“নিশ্চয়ই, তবে সে আশা কম।” দ্বিধা ফুটলো জিন-ফিলিক্সের চেহারায়। যেন কিছু একটা বলবে কি না ভাবছে। “আপনাকে একটা পরামর্শ দেই?”
“নিশ্চয়ই।”
“যদি অ্যালিসিয়াকে কথা বলাতে চান…তাহলে তার হাতে তুলি আর রঙ তুলে দিন। ছবি আঁকতে দিবেন ওকে। এভাবেই ও কথা বলবে আপনাদের সাথে। ছবির মাধ্যমে।”
“চমৎকার একটা বুদ্ধি দিয়েছেন…অনেক সাহায্য করলেন আজকে, ধন্যবাদ মি. মার্টিন।”
“জিন-ফিলিক্স বলে ডাকবেন আমাকে। আর অ্যালিসিয়ার সাথে দেখা হলে তাকে আমার তরফ থেকে হ্যালো বলবেন।”
হাসলো লোকটা, সেই বিতৃষ্ণার অনুভূতিটা ফিরে এসেছে আবারও। এটা নিশ্চিত যে অ্যালিসিয়ার ঘনিষ্ঠ ছিল সে, লম্বা একটা সময় ধরে একে অপরকে চিনতো।
জিন-ফিলিক্স কি আসলে অ্যালিসিয়াকে গোপনে ভালোবাসে?
এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। অ্যালসেস্টিস ছবিটার দিকে যখন তাকিয়ে ছিল, তখন চোখে ভালোবাসার খেলা করতে দেখেছি। কিন্তু সেই ভালোবাসাটা পেইন্টিংয়ের জন্যে, শিল্পীর জন্যে নয়। জিন-ফিলিক্স একজন প্রকৃত শিল্পপ্রেমী। যদি অ্যালিসিয়াকে আসলেও ভালোবাসতো, তাহলে কখনো না কখনো গ্রোভে আসতোই।
অ্যালিসিয়ার মত কাউকে ভালোবাসলে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।
.