2 of 3

২.১৫ There are only three things

There are only three things to be done with a woman.
you can love her, suffer for her, or turn her into literature.

মহারাজ চেয়ারটা আস্তে পেছনে ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন। মুকুর প্রখর বোলচাল স্তম্ভিত। টকটকে গেরুয়া কাপড় ভাজে ভাজে খুলে পায়ের পাতা ঢেকে দিল। মুকু মেঝেতেই বসে রইল থেবড়ে। মহারাজ তাকিয়ে আছেন তার দিকে।

মুকুর মাথায় একটা আঙুল আলতোভাবে স্পর্শ করিয়ে তুলে নিলেন। বললেন, উঠে বোসো চেয়ারে। তোমার এই বীরভাব আমার ভাল লাগছে। তবে কী জানো, তোমার কাণ্ডজ্ঞানের একটু অভাব আছে। আমি সন্ন্যাসী। গাড়িতে বসে আছি। তুমি একবারও খেয়াল করলে না, পাঁচজনে কী ভাববে!

মুকু চেয়ারে বসতে বসতে পটাং করে বলে উঠল, মহারাজ, কাণ্ডজ্ঞানের অভাব নয়, আমার আবেগ। অপরাধীকে আমার চাবকাতে ইচ্ছে করে। আপনি যে গাড়িতে আছেন লক্ষ করিনি। গাড়িতে একটি মেয়ে ছিল আর আপনার এই ছেলে তার কোলের ওপর মেয়েটির হাত নিজের হাতে নিয়ে মহা আরামে বসে ছিল। যে-গাড়িতে আপনি সেই গাড়িতে এমন ঘটনা ঘটে কী করে? ইংরেজিতে একেই বলে কমপ্রোমাইজিং পজিশন।

ও! ও তো সুরঞ্জনা! সুরঞ্জনা ছিল গাড়িতে। সুরঞ্জনা তো একজন মহিলা আর ও তো একটা ছেলে। যে সন্ন্যাসী হবে সে অত ঘন হয়ে বসেছিল কেন? ঠাকুর বলে গেছেন, আগুন আর ঘি পাশাপাশি রাখতে নেই মহারাজ। ঠাকুর কত সাবধান হতে বলেছেন। বলেছেন, সর্বাঙ্গে চাদর মুড়ে মেয়েদের পাশে যেতে হয়, যদি অ্যাট-অল যেতেই হয়। বলেছেন, মেয়েদের ছবি দেখলেও চিত্ত চঞ্চল হতে পারে। যে সন্ন্যাসী হবে তার এইসব অবশ্যই মানা উচিত। এই দু’ নৌকোয় পা দেখে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া তার আগের সারাটা রাত কোথায় ছিল তার কোনও সন্তোষজনক উত্তর নেই। মিথ্যা কথায়

অতিশয় পারদর্শী। গল্প তৈরিতে মহা ওস্তাদ। ওকে দেখার মতো কেউ নেই, তাই আমাকেই কড়া। হাতে শাসনের ভার নিতে হয়েছে। ওর মাথায় সদাসর্বদাই অদ্ভুত সব মতলব খেলা করে।

আমার এইবার আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলা উচিত। যেভাবে চিত্রিত হচ্ছি তাতে প্রায় চরিত্রহীনের পর্যায়ে চলে যাচ্ছি।

মাতাল লম্পটরাই রাতে বাড়ি ফেরে না। মেয়ে দেখলেই ল্যাল ল্যাল করে এগিয়ে যায়। ঘোঁতর ঘেতর করে। ও কি তাই? মহারাজ গাড়িতে আপনি আছেন, আমি একবারও লক্ষ করিনি। আমার চোখ ছিল শুধু ওদের দুজনের দিকে। আমাকে আপনি ক্ষমা করবেন আমার অসভ্যতার জন্যে। মুকু ভাবের আবেগে আমার চরিত্র আরও কিছুটা বিপর্যস্ত করে দিল। মেরামতের বদলে ভেঙে দিল অংশে অংশে, খণ্ডে খণ্ডে।

মিউমিউ করে স্বর বেরোল, যেন ছুঁচো, আমার কিছু বলার ছিল। আমি সুরঞ্জনার দিকে চেপে ছিলুম কোনও বদ মতলবে নয়, মহারাজের কারণে, পাছে মহারাজের গায়ের সঙ্গে আমার গা লেগে যায়! উনি সন্ন্যাসী আমি গৃহী।

মুকু সঙ্গে সঙ্গে বললে, দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না।

আমি হতাশ হয়ে বললুম, দেখছেন মহারাজ? আমার কেস হাজির করার সুযোগই দিচ্ছে না।

শোনো, তোমাকে একটা অপ্রিয় কথা বলি। প্রথমে ইংরেজিতেই বলি। পুস্তু প্রবাদ,

The ungrateful son is a wart on his father’s face;
to leave it is a blemish, to cut it off is pain.

অকৃতজ্ঞ পুত্র হল পিতার মুখে একটা আঁচিলের মতো। রাখাটা কলঙ্কের মতে, কাটা যন্ত্রণাদায়ক। তুমি যদি তোমার আচরণে পিতার মান-সম্মান, পরিবারের আদর্শ ধুলোয় লুটিয়ে দাও, সেটা হবে এমন কলঙ্ক যা স্বীকার করা যাবে না, অস্বীকারও করা যাবে না, কারণ তুমি পুত্র। আমি তো দেখছি এই মেয়েটির যা তেজ, যা বোধ-বুদ্ধি, তোমার তা নেই। রাগ কোরো না, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি তুমি এফিমিনেট, তোমার চরিত্র দুর্বল। আমি তোমার ডান পাশে বসে আছি, আর তুমি তোমার বাঁ পাশে সুরঞ্জনার হাত নিয়ে খেলা করছ? ঠাকুর বলতেন, মেয়েরা যতই ভক্তিমতী হোক, তাদের সংস্পর্শে মন টলে যেতে বাধ্য। যুবতী সম্পর্কে ভয়ংকর সাবধানতার প্রয়োজন। নির্জনে তাদের সঙ্গে ধর্মালোচনাও বিপজ্জনক! তোমার এমন দুঃসাহস, আমার উপস্থিতি সত্ত্বেও তুমি এমন কাজ করতে পারলে? তুমি তো সাংঘাতিক ছেলে!

আমার খুব রাগ হচ্ছিল। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার মতো, চটরপটর এন্তার কথা আমাকে অকারণে দাগরাজি করে দিচ্ছে। আশ্চর্য বরাত আমার! একটু উষ্ণভাবেই বললুম, আমার মনে কোনও পাপ নেই। যে-হাত আমি ধরেছিলুম, সে হাত কোনও মেয়ের নয়, বন্ধুত্বের হাত। সুরঞ্জনার দাদা নিরুদ্দিষ্ট, আমার পিতা নিরুদ্দিষ্ট। দু’জনেরই এক অবস্থা। সেই কথাই হচ্ছিল।

মুকু সঙ্গে সঙ্গে বললে, কথা তো মুখে মুখে হয় মহারাজ। আর হাতে হাতে হয় হাতাহাতি।

আমি বললুম, সুরঞ্জনা আমার কাছে লেখাপড়ায় সাহায্য চেয়েছে। দাদা অঙ্ক দেখিয়ে দিত। আমাকে অনুরোধ করেছে, অঙ্ক বোঝাবার জন্যে।

মুকু বললে, এত শিক্ষক থাকতে তোমাকে কেন? তুমি তো কেমিস্ট্রির লোক। অঙ্কের তুমি কী বোঝো! মেসোমশাই তো তোমাকে উঠতে-বসতে ধমকাতেন। অঙ্কের মাথা তোমার মোটেই ভাল নয়।

মহারাজ বললেন, প্রসঙ্গটা আর এগোতে দেওয়া ঠিক নয়। এটা আশ্রম। তোমাদের ঝগড়া করার প্ল্যাটফর্ম নয়। কী চাও তোমরা? আমার কাজ আছে। নষ্ট করার মতো সময় নেই।

মুকু বললে, আপনি ওকে ভালবাসেন। আমিও ভালবাসি। একটা কথা ওকে আপনি বুঝিয়ে দিন, সংসারই ওর জায়গা, আশ্রম নয়। চাকরিবাকরি ছেড়ে বাড়িতে বসে থাকলে কেউ খাওয়াবে না। সন্ন্যাসী হওয়া অত সহজ নয়!

মহারাজ টেবিলে দেহের ভার রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন এতক্ষণ। এইবার চেয়ারে বসলেন আবার। মুখ থমথমে। মুকুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার পক্ষে সন্ন্যাস ছাড়া অন্য কোনও পরামর্শ দেওয়া সম্ভব নয়। যে-পাখি যে-গান গায়, যে-বাদ্যযন্ত্র যেমন আওয়াজ করে! এই ভোগের পৃথিবীতে আমিও একজন গৃহী হতে পারতুম। এই চেয়ারে গেরুয়া পরে বসে না থেকে কোনও এক বড় কোম্পানির চেয়ারে সুট-বুট-টাই পরে বসে থাকার যোগ্যতা আমার ছিল। আমার যৌবনে আমি এক মহাপুরুষের সংস্পর্শে এসেছিলুম। সে আমার ভাগ্য। তিনি আমাকে প্রথম যে কথা বলেছিলেন, ভারী সুন্দর। বলেছিলেন, পৃথিবীতে একবারই এসেছ, মেয়েদের আঁচল ধরে না ঘুরে, ঈশ্বরের হাত ধরে ঘোরো। হয়তো পাবে না কিছুই, যতই না পাবে, তত পেতে চাবে, ততই বাড়িবে পিপাসা আমার, ওগো ফুরাবে না তুমি, ফুরাব না আমি, তোমাতে আমাতে হব একাকার। তিনি অনন্ত। অনন্ত হয়েছ, ভালই করেছ, থাকো চিরদিন অনন্ত অপার। ধরা যদি দিতে ফুরাইয়া যেতে, তোমারে ধরিতে কে চাহিত আর। ভুলায়েছ যারে তব প্রলোভনে, সে কি ক্ষান্ত হবে তব অন্বেষণে? না পায় না পাবে, যায় প্রাণ যাবে, কভু কি ফুরাবে অন্বেষণ তার? এই অন্বেষণই জীবন। চিদানন্দের চেয়ে বড় আনন্দ পৃথিবীতে আর কি কিছু আছে? কিন্তু? একটা মহা কিন্তু আছে, সংসারদুঃখজলধৌ পতিতস্য/কামক্রোধাদিনক্রমকরৈঃ কবলীকৃতস্য। দুর্বাসনানিগড়ি তস্য নিরাশ্রয়স্য/চৈতন্যচন্দ্র মম। দেহি পদাবলম্বমা। আমি সংসারে দুঃখসমুদ্রে পড়েছি। পড়েছ তো ওঠার চেষ্টা করো। চেষ্টা করব। কী? কাম ক্রোধ প্রভৃতি হাঙর কুমির আমায় গিলে ফেলেছে। তাতে কী হয়েছে, বেঁচে তো আছ, নাড়াচাড়া দাও তা হলেই তো ওরা উগরে দেবে। সে তো জানি, কিন্তু আমি যে নিজের দুর্বাসনায় নিজেকে শৃঙ্খলিত করেছি। অন্যে বাঁধলে নাড়াচাড়া দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করা যেত। এ যে নিজেই নিজেকে জড়ানো। তা হলে অন্য কোথাও যাও। কোথায় যাব? আমি যে নিরাশ্রয়। তুমি ছাড়া আর কোনও আশ্রয়স্থল নেই আমার। বেশ, তা হলে আমার চরণ ধরো! প্রভু! আমি বদ্ধ। আমি যাব কী করে! তুমি এসো। এসে তোমার চরণ-তরী দিয়ে আমায় উদ্ধার করো। শ্রীরামকৃষ্ণ মম দেহি পদাবলম্বম্ ॥ আমি এই জানি। তা তুমি যদি অন্যরকম জানো তো তাই জানো। যার যার জীবন, তার তার জীবন। এখানে তো জোরজবরদস্তির কোনও ব্যাপার নেই। কে তোমাকে সন্ন্যাসী হতে বলেছে! কেনই বা হবে! সৎ গৃহীই হও না। ঠাকুর বলেছেন, গৃহদুর্গে থেকে সাধনভজন, সে তো খুবই ভাল কথা। সকলকেই সন্ন্যাসী হতে হবে এমন তো কোনও কথা নেই। সন্ন্যাসী হতে হলে, তোমাকে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হবে। সবচেয়ে বড় ত্যাগ হল কামিনীকাঞ্চন। মনে মুখে এক হতে হবে। ভীষণ একটা রোখ চাই। আমাকে পেতেই হবে। মিনমিনে ম্যাদামারা হলে হবে না। হাজার বই, হাজার উপদেশেও কিছু হবে না। ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়েও হবে না। নায়মাত্মা বলহীনে ন। লভ্য। কে তোমাকে সন্ন্যাসী হতে বলেছে বাপু!

মুকু বললে, ও চাইছে ওর বাবাকে কপি করতে। ওর কম্পিটিশন তত মেসোমশাইয়ের সঙ্গে। অসম প্রতিযোগিতা! জীবনে যা পারবে না কোনওদিন। শেয়াল কোনওদিন বাঘ হতে পারে, না পারবে?

রাগে আমার গা জ্বালা করছে। মুকু আমাকে একবার করে তুলছে, একবার করে ফেলছে। আছড়ে আছড়ে আমাকে মেরে ফেলতে চায়।

মুকু বলেই চলেছে, ও ভীষণ নিজের প্রশংসা শুনতে ভালবাসে। ও যে একটা কেউকেটা, জগৎকে দেখাতে চায়। আপনার মতো মহারাজ হবে। সবাই শ্রদ্ধা করবে, ঢিপ ঢিপ প্রণাম করবে। কী? না সন্ন্যাসী হয়েছেন!

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম, মুখে আর নয়, এইবার কাজে। এক ঝটকায় নিজেকে বের করে নিয়ে চলে যাব। একজনের পরিবার বললে, অমুক লোকের ভারী বৈরাগ্য হয়েছে, তোমার কিছু হল না! যার বৈরাগ্য হয়েছে, সে লোকটির যোলোজন স্ত্রী, এক-একজন করে তাদের ত্যাগ করছে। স্বামী নাইতে যাচ্ছিল, কাঁধে গামছা, বললে, খেপি! সে তোক ত্যাগ করতে পারবে না, একটু একটু করে কি ত্যাগ হয়? আমি ত্যাগ করতে পারব। এই দেখ, আমি চললুম। সে বাড়ির গোছগাছ না করে, সেই অবস্থায় কাঁধে গামছা, বাড়ি ত্যাগ করে চলে গেল। এরই নাম তীব্র বৈরাগ্য। জ্ঞানই হবে আমার আশ্রয়। আমি যদি জ্ঞানী হতে পারি, আমার আচরণে দুটো লক্ষণ দেখা যাবে। আমার কূটস্থ বুদ্ধি হবে। সে বুদ্ধি আবার কেমন বুদ্ধি, হাজার দুঃখ কষ্ট, বিপদ-বিঘ্ন হোক– নির্বিকার, যেমন কামারশালার লোহা, যার ওপর হাতুড়ি দিয়ে পেটে। আর দ্বিতীয়, পুরুষকার খুব রোখ। কাম-ক্রোধ আমার অনিষ্ট করছে তো একেবারে ত্যাগ! কচ্ছপ যদি হাত-পা ভিতরে সাঁদ করে, চারখানা করে কাটলেও আর বার করবে না।

মহারাজ আমার চিন্তাকে টেনে নিয়ে গেলেন, বললেন, বৈরাগ্য দু’প্রকার। তীব্র বৈরাগ্য আর মন্দা বৈরাগ্য। মন্দা বৈরাগ্য হচ্ছে হবে– ঢিমে তেতালা। তীব্র বৈরাগ্য–শাণিত ক্ষুরের ধার–মায়াপাশ কচকচ করে কেটে দেয়। এইবার নিজের অবস্থা নিজেই বিচার করো। ফেরিঅলার মতো দোরে দোরে ঘুরো না। প্রচারধর্মী হয়ে সন্ন্যাসের আদর্শকে হাস্যকর করে তুলো না। অবিশ্বাসকারীর সংখ্যা কম নয়।

আমি খুব বিনীতভাবে বললুম, মহারাজ, আজ তা হলে আমরা আসি।

এসো। তোমার চেয়ে এই মেয়েটিকে আমার বেশি ভাল লেগেছে। ভেতরে একটা ফায়ার আছে। কী নাম মা তোমার?

আমার ডাক নাম মুকু, মহারাজ।

বাঃ বেশ সুন্দর নাম।

মহারাজ পর মুহূর্তেই লেখায় মুখ নামালেন। আমি অপরাধীর মতো, মুকু বীরের মতো, বেরিয়ে এলুম দু’জনে। মুকু রাস্তায় নেমে বললে, তোমার কেসটা মোটামুটি ড্যামেজ করতে পেরেছি। মেরামতের বাইরেই চলে গেছে ধরে নাও। এবার একা-একা এলে তোমার যা রিসেপশন হবে, ভাবা যায় না। তবে হ্যাঁ, আমি এলে অন্যরকম হবে। বুঝতেই পারছ, এখন থেকে সংসার ত্যাগ করতে হলেও তোমাকে আমার সাহায্য নিতে হবে। রাম লক্ষ্মণ সীতা, দৃশ্যটা একবার কল্পনা করো। যার কাছে এসেছিলে তার কথাতেই বলি। তোমার তো কিছু মনে থাকে না। ভাসাভাসা পড়া। পড়লে আর ভুললে।

আমরা বেড়াতে বেড়াতে হাঁটছি। গঙ্গার দিকে, ট্রাম ডিপো লক্ষ্য করে। সামনেই কালীবাড়ি। বহু প্রাচীন। সেখানে এক জ্যোতিষী মায়ের সামনে বসে এক মহিলার হাত দেখছেন। আমারও ইচ্ছে করছিল হাতটা মেলে ধরি। মুকু ধমকাবে, কুসংস্কার! বলবে, পুরুষকারই ভাগ্য। বলবে, মেসোমশাই বলতেন, রোজ সকালে পরপর সাত দিন দুটো করে হাফবয়েল চালাও, ভাগ্যবিশ্বাস চলে গিয়ে পুরুষকারে বিশ্বাস ফিরে আসবে।

আমরা এক ঝলক গঙ্গাদর্শনের জন্যে জল ঢোকার সুইস গেটের দিকে এগিয়ে গেলুম। মুকু বললে, এসো একটু বসি দু’জনে। ধর্ম আলোচনা করা যাক।

জায়গাটা তেমন পরিষ্কার নয়। একটু ইতস্তত ভাব হচ্ছিল। মুকুর শাড়িটা একেবারে পাটভাঙা। আবার এক দাবড়ানি, অত পিটপিটে স্বভাব হচ্ছে কেন? এই নাও ফুঁ দিয়ে ধুলো উড়িয়ে দিলুম, বোসো।

বসেই পড়লুম, যা থাকে বরাতে! মুকু হাত দুয়েক তফাতে বসল। সূর্য ডুবে গেছে। পশ্চিম আকাশের তলার দিকটা ঘোলাটে। গঙ্গার জলে অন্ধকার গুলছে। নৌকো যাচ্ছে অলস গতিতে, হরি দিন তো গেল র ছন্দে।

মুকু বললে, শোনো, ছোট মুখে বড় কথা শোনো। জীবাত্মা আর পরমাত্মার মধ্যে এক মায়া-আবরণ আছে। এই মায়া-আবরণ সরে না গেলে পরস্পরের সাক্ষাৎ হয় না। পরস্পর মানে জীবাত্মা আর পরমাত্মা। যেমন আগে রাম, মধ্যে সীতা আর পেছনে লক্ষ্মণ। রাম হলেন পরমাত্মা আর লক্ষ্মণ হলেন জীবাত্মা, মধ্যে জানকী মায়া-আবরণ হয়ে রয়েছেন। যতক্ষণ মা জানকী মধ্যে থাকেন, ততক্ষণ লক্ষ্মণ রামকে দেখতে পান না। জানকী একটু সরে পাশ কাটালে তখন লক্ষ্মণ রামকে দেখতে পান। শোনো, আমি হলুম সেই মায়া। তোমার আর তোমার ঈশ্বরের মাঝখানে আমি আঁচল মেলে দাঁড়িয়ে আছি। হয় আমাকে সরতে হবে, না হয়, না হয় কী?

প্রশ্নের উত্তর না-জানা বিব্রত ছাত্রের মতো আমি হা করে তাকিয়ে রইলুম। তা হলে কী?

মুকু অসাধারণ একটা হাসি ছাড়ল। উদাস, মিষ্টি। আমার সতীমা ধ্যান ভেঙে যাবার পর ঠিক এইরকম আধ্যাত্মিক হাসি হাসতেন। মুকু বললে, পারলে না তো সমস্যার সমাধান করতে! বৃথাই হল তোমার পড়া লেখা। খনার মতো তোমাকে আমি সবেতেই হারিয়ে দিচ্ছি। আবার শোনো, ট্র্যান্সফর্মেশন, রূপান্তর, তোমার কেমিস্ট্রিতে আছে। মায়ার দুটো রকম– বিদ্যা আর অবিদ্যা। তার মধ্যে বিদ্যা মায়া আবার দু’প্রকার বিবেক এবং বৈরাগ্য। আর অবিদ্যা মায়া ছ’প্রকার কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। বিদ্যা মায়াকে আশ্রয় করলে তুমি ঈশ্বরের সন্ধান পেলেও পেতে পারো। আর যদি অবিদ্যা মায়াকে আশ্রয় করো তা হলে বুঝতেই পারছ, আমি আর আমার করতে করতেই মরবে। কামের শেষ নেই। সেও এক ভিশিয়াস সার্কল। এক থেকে আর এক। গীতা নিশ্চয় পড়া আছে? দ্বিতীয় অধ্যায়ের বাষট্টিতম শ্লোকটা বলল।

আবার হাঁ করে তাকিয়ে রইলুম, মুখস্থ নেই।

তোমার আর সন্ন্যাসী হয়ে কাজ নেই। ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেযূপজায়তে, মনে পড়ছে?

সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোছভিজায়তে।

এই তো, খোকার আমার মনে পড়েছে। এইবার চেনটা মনে করো। বিষয়ের চিন্তা করতে করতে জন্মায় আসক্তি। আসক্তি থেকে কাম, কাম প্রতিহত হলে ক্রোধ, ক্রোধ থেকে বিবেকাশ, বিবেকনাশ থেকে শাস্ত্রজ্ঞান লোপ, শাস্ত্রস্মৃতি লোপ, স্মৃতিবিভ্রম মানে সদসবিচারবুদ্ধি বিনষ্ট, বিচারবুদ্ধি গেলে রইলটা কী? পুরুষার্থের অযোগ্য। তা হলে? একটাই পথ। আমার হাতে পায়ে ধরো, প্রার্থনা করো। আমি মায়া, কিন্তু আমি যেন তোমার বিদ্যা-মায়া হই। তা হলে যদি কোনও রাস্তা হয়!

আমি কেমন করে করব? ও তো তোমার হওয়ার ব্যাপার। তুমি হবে। তুমি আমাকে বিবেক আর বৈরাগ্য দেবে।

বিবেক তোমাকে আমি অনবরতই দিচ্ছি আর বৈরাগ্যের পথ খুলে দিয়ে গেছেন মেসোমশাই। তুমি তো মহাভাগ্যবান। সংসারে তোমার কেউ নেই। সব ফাঁকা। তোমার সব বাঁধনই তো তিনি কেটে দিয়েছেন। আর আমি? মুকু খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। বাতাসে চুল উড়ল। কাঁধের কাছে। শাড়ির আঁচল কাপল। হাসিতে শান বাঁধানো ব্যঙ্গ।

মুকু বললে, যে করে তোমার আশ তাকে তো তোমার মতোই করে দেবেন ভগবান। তুমি দেবতার মতো পিতা দেখেছ। মহারাজেরও মহারাজ। তুমি সঙ্গমরত পিতা দেখেছ? বয়েসের ভারে স্থবির তবু.. মুকু হঠাৎ গান গেয়ে উঠল সুন্দর গলায়,

এখনও গেল না আঁধার, এখনও রহিল বাধা।
এখনও মরণব্রত জীবনে হল না সাধা ॥
কবে যে দুঃখজ্বালা হবে রে বিজয়মালা।
ঝলিবে অরুণরাগে নিশীথরাতের কাঁদা ॥
এখনও নিজেরই ছায়া রচিছে কত যে মায়া।
এখনও কেন যে মিছে চাহিছে কেবলি পিছে,
চকিতে বিজলি-আলো চোখেতে লাগাল ধাঁদা ॥

গান শেষ করেই মুকু বললে, আই হেট মাই ফাদার। পরিচয় দিতে লজ্জা করে। পরিচয় মুছে ফেলাও যায় না। এক জরদগব গদগদে মহিলাকে আঁকড়ে আঁকড়ে ধরছে। সে দৃশ্য সারা জীবনেও ভোলা যাবে না। প্রেম এক জিনিস, কাম আর এক জিনিস। একটা স্বর্গীয় আর একটা পাশবিক। একটা আলো আর একটা অন্ধকার। তোমার মধ্যে কাম দেখলে আমার পেটাতে ইচ্ছে করে। চলো, এই সংসারে কিছু নেই, বেরিয়ে পড়ি দু’জনে। যথা বালস্য বেতালো মৃত্যুপর্যন্ত দুঃখদঃ। অসদেব সদাকারং তথা মূঢ়মতের্জগৎ ॥ অবশ্যই মানে বুঝলে না। বুঝলে তারিফ করতে। বালকের কল্পনায় আছে ভূত। আমরণ সেই ভূত তাকে ভয় দেখায়। ঠিক সেইরকম অজ্ঞানীর কাছে এই জগৎ এক ভীষণ সত্য। মৃত্যু পর্যন্ত সে এর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে। সোমশর্মার পিতার গল্প জানো? জানো না। কেমিস্ট্রি ছাড়া কিছুই জানেন না। একমুখী জ্ঞান। অতি দরিদ্র কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী। দেশে তখন আকাল, দুর্ভিক্ষ। একমুঠো ছাতু কাপড়ে বাঁধা। কোনওক্রমে সংগ্রহ করেছে। ভীষণ শ্রান্ত। একটা গাছের তলায় এসে বসেছে। ছাতুর পুঁটলিটা খুলে হাতে সব ঢেলেছে। এইবার সেই ছাতুর দিকে তাকিয়ে সে ভাবছে, ছাতুটা সে বিক্রি করবে। যে-পয়সা পাবে সেই পয়সায় সে গোরু কিনবে। ক্রমে গোরুর বংশ বৃদ্ধি হবে। অনেক বলদও হবে। সেই বলদ দিয়ে হবে চাষবাস। ধনে ধানে সে তখন বড়লোক। বিশাল বাড়ি, দাস-দাসী। ঐশ্বর্য দেখে সুন্দরী কন্যার পিতা ছুটে আসবে। বিয়ে হবে। একটি ছেলে হবে। ছেলের নাম রাখব সোমশর্মা। প্রিয়পুত্র। তার অনাদর হলেই বউকে মারব এক চড়। হাতের সব ছাতু মাটিতে পড়ে, বাতাসে উড়ে গেল হুস করে। লোকটি তখন বিলাপ করতে লাগল, হা কষ্ট! আমি কী মন্দভাগ্য। এত কষ্টের সংগ্রহ আমার সব ছাতু কোনও কাজেই লাগল না। তখন শাস্ত্রকার বলছেন, অভুতাভিনিবেশেন স্বাত্মানং বঞ্চয়ত্যয়ম। অসত্যপি দ্বিতীয়েছর্থে সোমশর্মপিতা যথা। যা মিথ্যা, যা কল্পনা, তাতে মশগুল হয়ে গেলে আসল জিনিস হারাতে হয়। সব মিথ্যা। সব ভ্রান্তি। কামুক কী ভাবে জানো, আহা! কী সুন্দর ভুরু, কী সুন্দর নাক, কী সুন্দর মুখ, কী অপূর্ব চোখ, কী মোহিনী হাসি, হচরপাঁচর করে জড়িয়ে ধরলে। আসলে কী, একটা শরীর। তোমার কেমিক্যাল অ্যানালিসিসে কী বেরোবে, হাড়ের খাঁচা, মেদের স্তর, মাংসের প্রলেপ, চামড়ার আস্তরণ, লিভার, পিলে, মল, মূত্র, কফ। অবিদ্যার এই হল প্রভাব। অনিত্যে নিত্যবুদ্ধি, অশুচিতে শুচিবুদ্ধি, অনাত্মাতে আত্মবুদ্ধি, দুঃখে সুখবুদ্ধি করিয়ে ছাড়ে। মানুষকে উট করে দেয়। কাটাগাছ চিবোচ্ছে, রক্ত গড়াচ্ছে দু’কষ বেয়ে। চলো, তোমাকে আজ আকণ্ঠ মদ খাওয়াব।

মদ!

হ্যাঁ মদ। মদ খেলে মানুষের আসল প্রবৃত্তি জেগে ওঠে। আমি পরীক্ষা করে দেখব, তোমার ভেতর ঠিক ঠিক কী আছে? কে আছে?

মুকু ঝেড়েঝুড়ে উঠে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *