২.১৫ ঠাকুরের বেদান্তসাধন

দ্বিতীয় খণ্ডপঞ্চদশ অধ্যায়: ঠাকুরের বেদান্তসাধন

ঠাকুরের এইকালের মানসিক অবস্থার আলোচনা: () কামকাঞ্চনত্যাগে দৃঢ়প্রতিষ্ঠা

মধুরভাবসাধনে সিদ্ধ হইয়া ঠাকুর এখন ভাবসাধনের চরম ভূমিতে উপস্থিত হইলেন। অতএব তাঁহার অপূর্ব সাধনকথা অতঃপর লিপিবদ্ধ করিবার পূর্বে, তাঁহার এই কালের মানসিক অবস্থার কথা একবার আলোচনা করা ভাল।

আমরা দেখিয়াছি, কোনরূপ ভাবসাধনে সিদ্ধ হইতে হইলে সাধকের সংসারের রূপরসাদি ভোগ্যবিষয়সমূহকে দূরে পরিহার করিয়া উহা অনুষ্ঠান করিতে হইবে। সিদ্ধভক্ত তুলসীদাস যে বলিয়াছেন, “যাঁহা রাম তাঁহা কাম1 নেহি”2 – একথা বাস্তবিকই সত্য। ঠাকুরের অদৃষ্টপূর্ব সাধনেতিহাস ঐ বিষয়ে সম্পূর্ণ সাক্ষ্য প্রদান করে। কামকাঞ্চনত্যাগরূপ ভিত্তির উপর দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হইয়াই তিনি ভাবসাধনে অগ্রসর হইয়াছিলেন এবং ঐ ভিত্তি কখনো তিলমাত্র পরিত্যাগ করেন নাই বলিয়া তিনি যখন যে ভাবসাধনে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, অতি স্বল্পকালেই তাহা নিজ জীবনে আয়ত্ত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। অতএব কামকাঞ্চনের প্রলোভন-ভূমির সীমা বহুদূর পশ্চাতে রাখিয়া তাঁহার মন যে এখন নিরন্তর অবস্থান করিত, একথা স্পষ্ট বুঝা যায়।


1. সকাম কর্ম।
2. যাঁহা রাম তাঁহা কাম নেহি,
যাঁহা কাম তাঁহা নেহি রাম।
দুঁহু একসাথ, মিলত নেহি,
রবি রজনী এক ঠাম্॥তুলসীদাসকৃত দোঁহা

() নিত্যানিত্যবস্তুবিবেক ইহামূত্রফলভোগে বিরাগ

বিষয়কামনা ত্যাগপূর্বক নয় বৎসর নিরন্তর ঈশ্বরলাভে সচেষ্ট থাকায় অভ্যাসযোগে তাঁহার মন এখন এমন এক অবস্থায় উপনীত হইয়াছিল যে, ঈশ্বর ভিন্ন অপর কোন বিষয়ের স্মরণ মনন করা উহার নিকট বিষবৎ বলিয়া প্রতীত হইত। কায়মনোবাক্যে ঈশ্বরকেই সারাৎসার পরাৎপর বস্তু বলিয়া সর্বতোভাবে ধারণা করায় উহা ইহকালে বা পরকালে তদতিরিক্ত অপর কোন বস্তুলাভে এককালে উদাসীন ও স্পৃহাশূন্য হইয়াছিল।

() শমদমাদি ষট্ সম্পত্তি মুমুক্ষুত্ব

রূপরসাদি বাহ্যবিষয়সকল এবং শরীরের সুখদুঃখাদি বিস্মৃত হইয়া অভীষ্ট বিষয়ের একাগ্র ধ্যানে তাঁহার মন এখন এতদূর অভ্যস্ত হইয়াছিল যে, সামান্য আয়াসেই উহা সম্পূর্ণরূপে সমাহৃত হইয়া লক্ষ্য বিষয়ে তন্ময় হইয়া আনন্দানুভব করিত। দিন মাস ও বৎসর একে একে অতিক্রান্ত হইলেও উহার ঐ আনন্দের কিছুমাত্র বিরাম হইত না এবং ঈশ্বর ভিন্ন জগতে অপর কোন লব্ধব্য বস্তু আছে বা থাকিতে পারে, এ চিন্তার উদয় উহাতে ক্ষণেকের জন্যও উপস্থিত হইত না।

() ঈশ্বরনির্ভরতা দর্শনজন্য ভয়শূন্যতা

পরিশেষে ঠাকুরের মনে জগৎকারণের প্রতি ‘গতির্ভর্তা প্রভুঃ সাক্ষী নিবাসঃ শরণং সুহৃৎ’ বলিয়া একান্ত অনুরাগ, বিশ্বাস ও নির্ভরতার এখন সীমা ছিল না। উহাদিগের সহায়ে তিনি যে এখন আপনাকে তাঁহার সহিত সপ্রেম সম্বন্ধে কেবলমাত্র নিত্যযুক্ত দেখিতেন তাহা নহে, কিন্তু মাতার প্রতি বালকের ন্যায় ঈশ্বরের প্রতি একান্ত অনুরাগে সাধক যে তাঁহাকে সর্বদা নিজ সকাশে দেখিতে পায়, তাঁহার মধুর বাণী সর্বদা কর্ণগোচর করিয়া কৃতকৃতার্থ হয় এবং তাঁহার প্রবল হস্ত দ্বারা রক্ষিত হইয়া সংসারপথে সতত নির্ভয়ে বিচরণ করিতে সমর্থ হয় – একথার বহুশঃ প্রমাণ পাইয়া তাঁহার মন জীবনের ক্ষুদ্র বৃহৎ সকল কার্য শ্রীশ্রীজগদম্বার আদেশে ও ইঙ্গিতে নির্ভয়ে অনুষ্ঠান করিতে এখন সম্পূর্ণরূপে অভ্যস্ত হইয়াছিল।

ঈশ্বরদর্শনের পরেও ঠাকুর কেন সাধন করিয়াছিলেন, তদ্বিষয়ে তাঁহার কথা

প্রশ্ন উঠিতে পারে – জগৎকারণকে ঐরূপে স্নেহময়ী মাতার ন্যায় সর্বদা নিজ সমীপে পাইয়া ঠাকুর আবার সাধনপথে নিযুক্ত হইয়াছিলেন কেন? যাঁহাকে লাভ করিবার জন্য সাধকের যোগ-তপস্যাদি সাধনের অনুষ্ঠান, তাঁহাকেই যদি পরম আত্মীয়রূপে প্রাপ্ত হইলাম, তবে আবার সাধন কিসের জন্য? ঐ কথার উত্তর আমরা পূর্বে একভাবে করিয়া আসিলেও তৎসম্বন্ধে অন্য একভাবে এখন দুই-চারিটি কথা বলিব। ঠাকুরের শ্রীপদপ্রান্তে বসিয়া তাঁহার সাধনেতিহাস শুনিতে শুনিতে আমাদিগের মনে একদিন ঐরূপ প্রশ্নের উদয় হইয়াছিল এবং উহা প্রকাশ করিতেও সঙ্কুচিত হই নাই। তদুত্তরে তিনি তখন আমাদিগকে যাহা বলিয়াছিলেন, তাহাই এখানে বলিব। ঠাকুর বলিয়াছিলেন, “সমুদ্রের তীরে যে ব্যক্তি সর্বদা বাস করে, তাহার মনে যেমন কখনো কখনো বাসনার উদয় হয় – রত্নাকরের গর্ভে কত প্রকার রত্ন আছে তাহা দেখি, তেমনি মাকে পাইয়া এবং মার কাছে সর্বদা থাকিয়াও আমার তখন মনে হইত, অনন্তভাবময়ী অনন্তরূপিণী তাঁহাকে নানাভাবে ও নানারূপে দেখিব। বিশেষ কোন ভাবে তাঁহাকে দেখিতে ইচ্ছা হইলে উহার জন্য তাঁহাকে ব্যাকুল হইয়া ধরিতাম। কৃপাময়ী মাও তখন তাঁহার ঐ ভাব দেখিতে বা উপলব্ধি করিতে যাহা কিছু প্রয়োজন, তাহা যোগাইয়া এবং আমার দ্বারা করাইয়া লইয়া সেই ভাবে দেখা দিতেন। ঐরূপেই ভিন্ন ভিন্ন মতের সাধন করা হইয়াছিল।”

পূর্বে বলিয়াছি, মধুরভাবে সিদ্ধ হইয়া ঠাকুর ভাবসাধনের চরম ভূমিতে উপনীত হইয়াছিলেন। উহার পরেই ঠাকুরের মনে সর্বভাবাতীত বেদান্তপ্রসিদ্ধ অদ্বৈতভাবসাধনে প্রবল প্রেরণা আসিয়া উপস্থিত হয়। শ্রীশ্রীজগদম্বার ইঙ্গিতে ঐ প্রেরণা তাঁহার জীবনে কিরূপে উপস্থিত হইয়াছিল এবং কিরূপেই বা তিনি এখন শ্রীশ্রীজগন্মাতার নির্গুণ নিরাকার নির্বিকল্প তুরীয় রূপের সাক্ষাৎ উপলব্ধি করিয়াছিলেন, তাহাই এখন আমরা পাঠককে বলিতে প্রবৃত্ত হইব।

ঠাকুরের জননীর গঙ্গাতীরে বাস করিবার সঙ্কল্প এবং দক্ষিণেশ্বরে আগমন

ঠাকুর যখন অদ্বৈতভাবসাধনে প্রবৃত্ত হন, তখন তাঁহার বৃদ্ধা মাতা দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে অবস্থান করিতেছেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র রামকুমারের মৃত্যু হইলে, শোকসন্তপ্তা বৃদ্ধা অপর দুইটি পুত্রের মুখ চাহিয়া কোনরূপে বুক বাঁধিয়া ছিলেন। কিন্তু অনতিকাল পরে তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র গদাধর পাগল হইয়াছে বলিয়া লোকে যখন রটনা করিতে লাগিল, তখন তাঁহার দুঃখের আর অবধি রহিল না। পুত্রকে গৃহে আনাইয়া নানা চিকিৎসা ও শান্তিস্বস্ত্যয়নাদির অনুষ্ঠানে তাঁহার ঐ ভাবের যখন কথঞ্চিৎ উপশম হইল, তখন বৃদ্ধা আবার আশায় বুক বাঁধিয়া তাঁহার বিবাহ দিলেন। কিন্তু বিবাহের পর দক্ষিণেশ্বরে প্রত্যাগমন করিয়া গদাধরের ঐ অবস্থা আবার যখন উপস্থিত হইল, তখন বৃদ্ধা আর আপনাকে সামলাইতে পারিলেন না – পুত্রের আরোগ্যকামনায় হত্যা দিয়া পড়িয়া রহিলেন। পরে মহাদেবের প্রত্যাদেশে পুত্রের দিব্যোন্মাদ হইয়াছে জানিয়া কথঞ্চিৎ আশ্বস্তা হইলেও তিনি উহার অনতিকাল পরে সংসারে বীতরাগ হইয়া দক্ষিণেশ্বরে পুত্রের নিকটে উপস্থিত হইলেন এবং জীবনের অবশিষ্ট কাল ভাগীরথীতীরে যাপন করিবেন বলিয়া দৃঢ়সঙ্কল্প করিলেন। কারণ, যাহাদের জন্য এবং যাহাদের লইয়া তাঁহার সংসার করা, তাহারাই যদি একে একে সংসার ও তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া চলিল, তবে বৃদ্ধ বয়সে তাঁহার আর উহাতে লিপ্ত থাকিবার প্রয়োজন কি? শ্রীযুত মথুরের অন্নমেরু-অনুষ্ঠানের কথা আমরা ইতঃপূর্বে পাঠককে বলিয়াছি। ঠাকুরের মাতা ঐ সময়ে দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে উপস্থিত হইয়াছিলেন এবং এখন হইতে দ্বাদশবৎসরান্তে তাঁহার শরীরত্যাগের কালের মধ্যে তিনি কামারপুকুরে পুনর্বার আগমন করেন নাই। অতএব ঠাকুরের জটাধারী বাবাজীর নিকট হইতে ‘রাম’-মন্ত্রে দীক্ষাগ্রহণ এবং মধুরভাব ও বেদান্তভাব প্রভৃতির সাধন যে তাঁহার মাতার দক্ষিণেশ্বরে অবস্থানকালে হইয়াছিল, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই।

ঠাকুরের জননীর লোভরাহিত্য

ঠাকুরের মাতার উদার হৃদয়ের পরিচায়ক একটি ঘটনা আমরা পাঠককে এখানে বলিতে চাহি। ঘটনাটি তাঁহার দক্ষিণেশ্বরে আগমনের স্বল্পকাল পরেই উপস্থিত হইয়াছিল। পূর্বে বলিয়াছি, ঐ কালে কালীবাটীতে মথুরবাবুর অক্ষুণ্ণ প্রভাব ছিল এবং মুক্তহস্ত হইয়া তিনি নানা সৎকার্যের অনুষ্ঠান ও প্রভূত অন্নদান করিতেছিলেন। ঠাকুরের প্রতি তাঁহার ভালবাসা ও ভক্তির অবধি না থাকায় তিনি ঠাকুরের শারীরিক সেবার যাহাতে কোনকালে ত্রুটি না হয়, তদ্বিষয়ে বন্দোবস্ত করিয়া দিবার জন্য ভিতরে ভিতরে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন; কিন্তু ঠাকুরের কঠোর ত্যাগশীলতা দেখিয়া তাঁহাকে ঐ কথা মুখ ফুটিয়া বলিতে এ পর্যন্ত সাহসী হন নাই। তাঁহার শ্রবণগোচর হয়, এরূপ স্থলে দাঁড়াইয়া তিনি ইতঃপূর্বে একদিন ঠাকুরের নামে একখানি তালুক লেখাপড়া করিয়া দিবার পরামর্শ হৃদয়ের সহিত করিতে যাইয়া বিষম অনর্থে পতিত হইয়াছিলেন। কারণ, ঐ কথা কর্ণগোচর হইবামাত্র ঠাকুর উন্মত্তপ্রায় হইয়া ‘শালা, তুই আমাকে বিষয়ী করতে চাস’ বলিয়া তাঁহাকে প্রহার করিতে ধাবিত হইয়াছিলেন। সুতরাং মনে জাগরূক থাকিলেও মথুর নিজ অভিপ্রায় সম্পাদনের কোনরূপ সুযোগলাভ করেন নাই। ঠাকুরের মাতার আগমনে তিনি এখন সুযোগ বুঝিয়া বৃদ্ধা চন্দ্রাদেবীকে পিতামহী সম্বোধনে আপ্যায়িত করিলেন এবং প্রতিদিন তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহার সহিত নানা কথার আলোচনা করিতে করিতে ক্রমে ক্রমে তাঁহার বিশেষ স্নেহের পাত্র হইয়া উঠিলেন। পরে অবসর বুঝিয়া একদিন তাঁহাকে ধরিয়া বসিলেন – “ঠাকুরমা, তুমি তো আমার নিকট হইতে কখনো কিছু সেবা গ্রহণ করিলে না। তুমি যদি যথার্থই আমাকে আপনার বলিয়া ভাব, তাহা হইলে আমার নিকট হইতে তোমার যাহা ইচ্ছা চাহিয়া লও।” সরলহৃদয়া বৃদ্ধা মথুরের ঐরূপ কথায় বিশেষ বিপন্না হইলেন। কারণ, ভাবিয়া চিন্তিয়া কোন বিষয়ের অভাব অনুভব করিলেন না। সুতরাং কি চাহিয়া লইবেন, তাহা স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। অগত্যা তাঁহাকে বলিতে হইল – “বাবা, তোমার কল্যাণে আমার তো এখন কোন বিষয়ের অভাব নাই, যখন কোন জিনিসের আবশ্যক বুঝিব তখন চাহিয়া লইব।” এই বলিয়া বৃদ্ধা আপনার পেঁটরা খুলিয়া মথুরকে বলিলেন – “দেখিবে, এই দেখ, আমার এত পরিবার কাপড় রহিয়াছে! আর তোমার কল্যাণে এখানে খাবার তো কোন কষ্টই নাই, সকল বন্দোবস্তই তো তুমি করিয়া দিয়াছ ও দিতেছ; তবে আর কি চাহি, বল?” মথুর কিন্তু ছাড়িবার পাত্র নহেন, ‘যাহা ইচ্ছা কিছু লও’ বলিয়া বারংবার অনুরোধ করিতে লাগিলেন। তখন ঠাকুরের জননীর একটি অভাবের কথা মনে পড়িল; তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন – “যদি নেহাত দেবে, তবে আমার এখন মুখে দিবার গুলের অভাব, এক আনার দোক্তা তামাক কিনিয়া দাও।” বিষয়ী মথুরের ঐ কথায় চক্ষে জল আসিল। তিনি তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিলেন – “এমন মা না হইলে কি অমন ত্যাগশীল পুত্র হয়!” এই বলিয়া বৃদ্ধার অভিপ্রায়মতো দোক্তা তামাক আনাইয়া দিলেন।

হলধারীর কর্মত্যাগ অক্ষয়ের আগমন

ঠাকুরের বেদান্তসাধনে নিযুক্ত হইবার কালে তাঁহার পিতৃব্যপুত্র হলধারী দক্ষিণেশ্বর-দেবালয়ে শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দজীউর সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন বলিয়া এবং ভাগবতাদি গ্রন্থে তাঁহার সামান্য ব্যুৎপত্তি ছিল বলিয়া তিনি অহঙ্কারের বশবর্তী হইয়া কখনো কখনো ঠাকুরকে কিরূপে শ্লেষ করিতেন এবং তাঁহার আধ্যাত্মিক দর্শন ও অবস্থাসমূহকে মস্তিষ্কের বিকারপ্রসূত বলিয়া সিদ্ধান্ত করিতেন এবং ঠাকুর তাহাতে ক্ষুণ্ণ হইয়া শ্রীশ্রীজগদম্বাকে ঐকথা নিবেদন করিয়া কিরূপে বারংবার আশ্বস্ত হইতেন – সে সকল কথা আমরা ইতঃপূর্বে পাঠককে বলিয়াছি। হলধারীর তীব্র শ্লেষপূর্ণ বাক্যে তিনি এক সময়ে বিষণ্ণ হইলে ভাবাবেশে এক সৌম্য মূর্তির দর্শন ও ‘ভাবমুখে থাক’ বলিয়া প্রত্যাদেশ লাভ করিয়াছিলেন। বোধ হয় ঐ দর্শন ঠাকুরের বেদান্তসাধনে নিযুক্ত হইবার কিছু পূর্বে ঘটিয়াছিল এবং মধুরভাবসাধনের সময় তাঁহাকে স্ত্রীবেশ ধারণপূর্বক রমণীর ন্যায় থাকিতে দেখিয়াই হলধারী তাঁহাকে আত্মজ্ঞানবিহীন বলিয়া ভর্ৎসনা করিয়াছিলেন। পরমহংস পরিব্রাজক শ্রীমদাচার্য তোতাপুরীর দক্ষিণেশ্বরে আগমন ও অবস্থানের সময় হলধারী কালীবাটীতে ছিলেন এবং সময়ে সময়ে তাঁহার সহিত একত্রে শাস্ত্রচর্চা করিতেন, একথা আমরা ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়াছি। শ্রীমৎ তোতা ও হলধারীর ঐরূপে অধ্যাত্মরামায়ণ-চর্চাকালে ঠাকুর একদিন জায়া ও অনুজ লক্ষ্মণসহ ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের দিব্যদর্শন লাভ করিয়াছিলেন। শ্রীমৎ তোতা সম্ভবতঃ সন ১২৭১ সালের শেষভাগে দক্ষিণেশ্বরে শুভাগমন করিয়াছিলেন। এ ঘটনার কয়েক মাস পরে শারীরিক অসুস্থতাদি নিবন্ধন হলধারী কালীবাটীর কর্ম হইতে অবসরগ্রহণ করেন এবং ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র অক্ষয় তাঁহার স্থলে নিযুক্ত হয়েন।

ভাবসমাধিতে সিদ্ধ ঠাকুরের অদ্বৈতভাবসাধনে প্রবৃত্ত হইবার কারণ

ভক্তের স্বভাব – তাঁহার সাযুজ্য বা নির্বাণ [তথা] মুক্তিলাভে কখনো প্রয়াসী হন না। শান্তদাস্যাদি ভাববিশেষ অবলম্বনপূর্বক ঈশ্বরের প্রেমের মহিমা ও মাধুর্য সম্ভোগ করিতেই তাঁহারা সর্বদা সচেষ্ট থাকেন। দেবীভক্ত শ্রীরামপ্রসাদের ‘চিনি হওয়া ভাল নয়, মা, চিনি খেতে ভালবাসি’-রূপ কথা ভক্তহৃদয়ের স্বাভাবিক উচ্ছ্বাস বলিয়া সর্বকালপ্রসিদ্ধ আছে। অতএব ভাবসাধনের পরাকাষ্ঠায় উপনীত হইয়া ঠাকুরের ভাবাতীত অদ্বৈতাবস্থালাভের জন্য প্রয়াস অনেকের বিসদৃশ ব্যাপার বলিয়া বোধ হইতে পারে। কিন্তু ঐরূপ ভাবিবার পূর্বে আমাদিগের স্মরণ করা কর্তব্য যে, ঠাকুর স্বপ্রণোদিত হইয়া এখন আর কোন কার্যের অনুষ্ঠান করিতে সমর্থ ছিলেন না। জগদম্বার বালক ঠাকুর এখন তাঁহার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়া তাঁহারই মুখ চাহিয়া সর্বদা অবস্থান করিতেছিলেন এবং তিনি তাঁহাকে যেভাবে যখন ঘুরাইতে ফিরাইতেছিলেন, সেইভাবেই তখন পরমানন্দে অবস্থান করিতেছিলেন। শ্রীশ্রীজগন্মাতাও ঐ কারণে তাঁহার সম্পূর্ণ ভার গ্রহণপূর্বক নিজ উদ্দেশ্যবিশেষ সাধনের জন্য ঠাকুরের অজ্ঞাতসারে তাঁহাকে অদৃষ্টপূর্ব অভিনব আদর্শে গড়িয়া তুলিতেছিলেন। সর্বপ্রকার সাধনের অন্তে ঠাকুর জগদম্বার ঐ উদ্দেশ্য উপলব্ধি করিয়াছিলেন এবং উহা বুঝিয়া জীবনের অবশিষ্ট কাল মাতার সহিত প্রেমে এক হইয়া লোককল্যাণসাধনরূপ তাঁহার সুমহৎ দায়িত্ব আপনার বলিয়া অনুভবপূর্বক সানন্দে বহন করিয়াছিলেন।

ভাবসাধনের চরমে অদ্বৈতভাবলাভের চেষ্টার যুক্তিযুক্ততা

মধুরভাবসাধনের পরে ঠাকুরের অদ্বৈতভাবসাধনের যুক্তিযুক্ততা আর একদিক দিয়া দেখিলে বিশেষরূপে বুঝিতে পারা যায়। ভাব ও ভাবাতীত রাজ্য পরস্পর কার্যকারণ সম্বন্ধে সর্বদা অবস্থিত। কারণ, ভাবাতীত অদ্বৈতরাজ্যের ভূমানন্দই সীমাবদ্ধ হইয়া ভাবরাজ্যের দর্শন-স্পর্শনাদি সম্ভোগানন্দরূপে প্রকাশিত রহিয়াছে। অতএব মধুরভাবে পরাকাষ্ঠালাভে ভাবরাজ্যের চরম ভূমিতে উপনীত হইবার পরে ভাবাতীত অদ্বৈত ভূমি ভিন্ন অন্য কোথায় আর তাঁহার মন অগ্রসর হইবে?

শ্রীমৎ তোতাপুরীর আগমন

শ্রীশ্রীজগদম্বার ইঙ্গিতেই যে ঠাকুর এখন অদ্বৈতভাবসাধনে অগ্রসর হইয়াছিলেন, একথা আমরা নিম্নলিখিত ঘটনায় সম্যক বুঝিতে পারিব – সাগরসঙ্গমে স্নান ও পুরুষোত্তমক্ষেত্রে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের সাক্ষাৎ প্রকাশ দর্শন করিবেন বলিয়া পরিব্রাজকাচার্য শ্রীমৎ তোতা এইকালে মধ্যভারত হইতে যদৃচ্ছা ভ্রমণ করিতে করিতে বঙ্গে আসিয়া উপস্থিত হন। পুণ্যতোয়া নর্মদাতীরে বহুকাল একান্তবাসপূর্বক সাধনভজনে নিমগ্ন থাকিয়া তিনি ইতঃপূর্বে নির্বিকল্পসমাধিপথে ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার করিয়াছিলেন, একথার পরিচয় তথাকার প্রাচীন সাধুরা এখনও প্রদান করিয়া থাকেন। ব্রহ্মজ্ঞ হইবার পরে তাঁহার মনে কিছুকাল যদৃচ্ছা পরিভ্রমণের সঙ্কল্প উদিত হয় এবং উহার প্রেরণায় তিনি পূর্বভারতে আগমনপূর্বক তীর্থ হইতে তীর্থান্তরে ভ্রমণ করিতে থাকেন। আত্মারাম পুরুষদিগের সমাধি-ভিন্ন-কালে বাহ্যজগতের উপলব্ধি হইলেও উহাকে ব্রহ্ম বলিয়া অনুভব হইয়া থাকে। মায়াকল্পিত জগদন্তর্গত বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি, দেশ, কাল ও পদার্থে উচ্চাবচ ব্রহ্মপ্রকাশ উপলব্ধি করিয়া তাঁহারা ঐকালে দেবস্থান, তীর্থ ও সাধুদর্শনে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন। অতএব ব্রহ্মজ্ঞ তোতার তীর্থদর্শনে প্রবৃত্ত হওয়া বিচিত্র নহে। পূর্বোক্ত তীর্থদ্বয়দর্শনান্তে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ফিরিবার কালে তিনি দক্ষিণেশ্বরে আগমন করিয়াছিলেন। তিন দিবসের অধিক কাল এক স্থানে যাপন করা তাঁহার নিয়ম ছিল না। ঐজন্য কালীবাটীতে তিনি দিবসত্রয় মাত্র অতিবাহিত করিবেন স্থির করিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীজগদম্বা তাঁহার জ্ঞানের মাত্রা সম্পূর্ণ করিয়া দিবেন বলিয়া এবং তাঁহার দ্বারা নিজ বালককে বেদান্তসাধন করাইবেন বলিয়া যে তাঁহাকে এখানে আনয়ন করিয়াছেন, একথা তাঁহার তখন হৃদয়ঙ্গম হয় নাই।

ঠাকুর তোতাপুরীর প্রথম সম্ভাষণ এবং ঠাকুরের বেদান্তসাধনবিষয়ে প্রত্যাদেশলাভ

কালীবাটীতে আগমন করিয়া তোতাপুরী প্রথমেই ঘাটের সুবৃহৎ চাঁদনিতে আসিয়া উপস্থিত হন। ঠাকুর তখন তথায় অন্যমনে একপার্শ্বে বসিয়াছিলেন। তাঁহার তপোদীপ্ত ভাবোজ্জ্বল বদনের প্রতি দৃষ্টি পড়িবামাত্র শ্রীমৎ তোতা আকৃষ্ট হইলেন এবং প্রাণে প্রাণে অনুভব করিলেন, ইনি সামান্য পুরুষ নহেন – বেদান্তসাধনের এরূপ উত্তমাধিকারী বিরল দেখিতে পাওয়া যায়। তন্ত্রপ্রাণ বঙ্গে বেদান্তের এরূপ অধিকারী আছে ভাবিয়া তিনি বিস্ময়ে অভিভূত হইলেন এবং ঠাকুরকে বিশেষরূপে নিরীক্ষণপূর্বক স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমাকে উত্তম অধিকারী বলিয়া বোধ হইতেছে, তুমি বেদান্তসাধন করিবে?”

জটাজূটধারী দীর্ঘবপু উলঙ্গ সন্ন্যাসীর ঐ প্রশ্নে ঠাকুর উত্তর করিলেন, “কি করিব না করিব, আমি কিছুই জানি না – আমার মা সব জানেন, তিনি আদেশ করিলে করিব।”

শ্রীমৎ তোতা – “তবে যাও, তোমার মাকে ঐ বিষয় জিজ্ঞাসা করিয়া আইস। কারণ আমি এখানে দীর্ঘকাল থাকিব না।”

ঠাকুর ঐকথায় আর কোন উত্তর না করিয়া ধীরে ধীরে ৺জগদম্বার মন্দিরে উপস্থিত হইলেন এবং ভাবাবিষ্ট হইয়া শ্রীশ্রীজগন্মাতার বাণী শুনিতে পাইলেন – “যাও শিক্ষা কর, তোমাকে শিখাইবার জন্যই সন্ন্যাসীর এখানে আগমন হইয়াছে।”

শ্রীশ্রীজগদম্বা সম্বন্ধে শ্রীমৎ তোতার যেরূপ ধারণা ছিল

অর্ধবাহ্যভাবাবিষ্ট ঠাকুর তখন হর্ষোৎফুল্লবদনে তোতাপুরী গোস্বামীর সমীপে আসিয়া তাঁহার মাতার ঐরূপ প্রত্যাদেশ নিবেদন করিলেন। মন্দিরাভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিতা ৺দেবীকেই ঠাকুর প্রেমে ঐরূপে মাতৃসম্বোধন করিতেছেন বুঝিয়া শ্রীমৎ তোতা তাঁহার বালকের ন্যায় সরলভাবে মুগ্ধ হইলেও তাঁহার ঐ প্রকার আচরণ অজ্ঞতা ও কুসংস্কারনিবন্ধন বলিয়া ধারণা করিলেন। ঐরূপ সিদ্ধান্তে তাঁহার অধরপ্রান্তে করুণা ও ব্যঙ্গমিশ্রিত হাস্যের ঈষৎ রেখা দেখা দিয়াছিল, একথা আমরা অনুমান করিতে পারি। কারণ শ্রীমৎ তোতার তীক্ষ্ণবুদ্ধি বেদান্তোক্ত কর্মফলদাতা ঈশ্বর ভিন্ন অপর কোন দেবদেবীর নিকট মস্তক অবনত করিত না এবং ব্রহ্মধ্যানপরায়ণ সংযত সাধকের ঐরূপ ঈশ্বরের অস্তিত্বমাত্রে শ্রদ্ধাপূর্ণ বিশ্বাস ভিন্ন কৃপাপ্রার্থী হইয়া তাঁহাকে ভক্তি ও উপাসনাদি করিবার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিত না। আর ত্রিগুণময়ী ব্রহ্মশক্তি মায়া? – গোস্বামীজী উহাকে ভ্রমমাত্র বলিয়া ধারণা করিয়া উহার ব্যক্তিগত অস্তিত্ব স্বীকারের বা উহার প্রসন্নতার জন্য উপাসনার কোনরূপ আবশ্যকতা অনুভব করিতেন না। ফলতঃ অজ্ঞানবন্ধন হইতে মুক্তিলাভের জন্য সাধকের পুরুষকার অবলম্বন ভিন্ন ঈশ্বর বা শক্তিসংযুক্ত ব্রহ্মের করুণা ও সহায়তা প্রার্থনার কিঞ্চিন্মাত্র সাফল্য তিনি প্রাণে অনুভব করিতেন না এবং যাহারা ঐরূপ করে, তাহারা ভ্রান্তসংস্কারবশতঃ করিয়া থাকে বলিয়া সিদ্ধান্ত করিতেন।

ঠাকুরের গুপ্তভাবে সন্ন্যাসগ্রহণের অভিপ্রায় উহার কারণ

সে যাহা হউক, তাঁহার নিকটে দীক্ষিত হইয়া জ্ঞানমার্গের সাধনে প্রবৃত্ত হইলে ঠাকুরের মনের পূর্বোক্ত সংস্কার অচিরে দূর হইবে ভাবিয়া তোতা তাঁহাকে ঐ সম্বন্ধে আর কিছু এখন না বলিয়া অন্য কথার অবতারণা করিলেন এবং বলিলেন – বেদান্তসাধনে উপদিষ্ট ও প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে তাঁহাকে শিখাসূত্র পরিত্যাগপূর্বক যথাশাস্ত্র সন্ন্যাসগ্রহণ করিতে হইবে। ঠাকুর উহাতে স্বীকৃত হইতে কিঞ্চিৎ ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন – গোপনে করিলে যদি হয়, তাহা হইলে সন্ন্যাসগ্রহণ করিতে তাঁহার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। কিন্তু প্রকাশ্যে ঐরূপ করিয়া তাঁহার শোকসন্তপ্তা বৃদ্ধা জননীর প্রাণে বিষমাঘাত প্রদান করিতে তিনি কিছুতেই সমর্থ হইবেন না। গোস্বামীজী উহাতে ঠাকুরের ঐরূপ অভিপ্রায়ের কারণ বুঝিতে পারিলেন এবং ‘উত্তম কথা, শুভ মুহূর্ত উপস্থিত হইলে তোমাকে গোপনেই দীক্ষিত করিব’ বলিয়া পঞ্চবটীতলে আগমনপূর্বক আসন বিস্তীর্ণ করিলেন।

ঠাকুরের সন্ন্যাসদীক্ষাগ্রহণের পূর্বকার্যসকল সম্পাদন

অনন্তর শুভদিনের উদয় জানিয়া শ্রীমৎ তোতা ঠাকুরকে পিতৃপুরুষগণের তৃপ্তির জন্য শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া সম্পন্ন করিতে আদেশ করিলেন এবং ঐ কার্য সমাধা হইলে শিষ্যের নিজ আত্মার তৃপ্তির জন্য যথাবিধানে পিণ্ডপ্রদান করাইলেন। কারণ সন্ন্যাস-দীক্ষাগ্রহণের সময় হইতে সাধক ভূরাদি সমস্ত লোকপ্রাপ্তির আশা ও অধিকার নিঃশেষে বর্জন করেন বলিয়া শাস্ত্র তাঁহাকে তৎপূর্বে আপন প্রেত-পিণ্ড আপনি প্রদান করিতে বলিয়াছেন।

ঠাকুর যখন যাঁহাকে গুরুপদে বরণ করিয়াছেন, তখন নিঃসঙ্কোচে তাঁহাতে আত্মসমর্পণপূর্বক তিনি যেরূপ করিতে আদেশ করিয়াছেন, অসীম বিশ্বাসের সহিত তাহা অনুষ্ঠান করিয়াছেন। অতএব শ্রীমৎ তোতা তাঁহাকে এখন যেরূপ করিতে বলিতেছিলেন, তাহাই তিনি বর্ণে বর্ণে অনুষ্ঠান করিতেছিলেন, একথা বলা বাহুল্য। শ্রাদ্ধাদি পূর্বক্রিয়া সমাপন করিয়া তিনি সংযত হইয়া রহিলেন এবং পঞ্চবটীস্থ নিজ সাধনকুটিরে গুরুনির্দিষ্ট দ্রব্যসকল আহরণ করিয়া সানন্দে শুভমুহূর্তের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

অনন্তর রাত্রি-অবসানে শুভ ব্রাহ্মমুহূর্তের উদয় হইলে গুরু ও শিষ্য উভয়ে কুটিরে সমাগত হইলেন। পূর্বকৃত্য সমাপ্ত হইল, হোমাগ্নি প্রজ্বলিত হইল এবং ঈশ্বরার্থে সর্বস্ব-ত্যাগরূপ যে ব্রত সনাতন কাল হইতে গুরুপরম্পরাগত হইয়া ভারতকে এখনও ব্রহ্মজ্ঞপদবীতে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখিয়াছে, সেই ত্যাগব্রতাবলম্বনের পূর্বোচ্চার্য মন্ত্রসকলের পূতগম্ভীর ধ্বনিতে পঞ্চবটী-উপবন মুখরিত হইয়া উঠিল। পুণ্যতোয়া ভাগীরথীর স্নেহসম্পূর্ণ কম্পিতবক্ষে সেই ধ্বনির সুখস্পর্শ যেন নূতন জীবনের সঞ্চার আনয়ন করিল এবং যুগযুগান্তরের অলৌকিক সাধক বহুকাল পরে আবার ভারতের এবং সমগ্র জগতের বহুজনহিতার্থ সর্বস্বত্যাগরূপ ব্রতাবলম্বন করিতেছেন – ঐ সংবাদ জানাইতেই ভাগীরথী যেন আনন্দকলগানে দিগন্তে প্রবাহিত হইতে লাগিলেন।

সন্ন্যাসগ্রহণের পূর্বে প্রার্থনামন্ত্র

গুরু মন্ত্রপাঠে প্রবৃত্ত হইলেন, শিষ্য অবহিতচিত্তে তাঁহাকে অনুসরণপূর্বক সেইসকল কথা উচ্চারণ করিয়া সমিদ্ধ হুতাশনে আহুতিপ্রদানে প্রস্তুত হইলেন। প্রথমে প্রার্থনামন্ত্র উচ্চারিত হইল –

“পরব্রহ্মতত্ত্ব আমাকে প্রাপ্ত হউক। পরমানন্দলক্ষণোপেত বস্তু আমাকে প্রাপ্ত হউক। অখণ্ডৈকরস মধুময় ব্রহ্মবস্তু আমাতে প্রকাশিত হউক। হে ব্রহ্মবিদ্যাসহ নিত্য বর্তমান পরমাত্মন্! দেব-মনুষ্যাদি তোমার সমগ্র সন্তানগণের মধ্যে আমি তোমার বিশেষকরুণাযোগ্য বালক সেবক। হে সংসার-দুঃস্বপ্ন-হারিন্ পরমেশ্বর! দ্বৈতপ্রতিভারূপ আমার যাবতীয় দুঃস্বপ্ন বিনাশ কর। হে পরমাত্মন্! আমার যাবতীয় প্রাণবৃত্তি আমি নিঃশেষে তোমাতে আহুতি প্রদানপূর্বক ইন্দ্রিয়সকলকে নিরুদ্ধ করিয়া তদেকচিত্ত হইতেছি। হে সর্বপ্রেরক দেব! জ্ঞানপ্রতিবন্ধক যাবতীয় মলিনতা আমা হইতে বিদূরিত করিয়া অসম্ভাবনা-বিপরীতভাবনাদিরহিত তত্ত্বজ্ঞান যাহাতে আমাতে উপস্থিত হয়, তাহাই কর। সূর্য, বায়ু, নদীসকলের স্নিগ্ধ নির্মল বারি, ব্রীহিযবাদি শস্য, বনস্পতিসমূহ, জগতের সকল পদার্থ তোমার নির্দেশে অনুকূলপ্রকাশযুক্ত হইয়া আমাকে তত্ত্বজ্ঞানলাভে সহায়তা করুক। হে ব্রহ্মন্! তুমিই জগতে বিশেষশক্তিমান নানারূপে প্রকাশিত হইয়া রহিয়াছ। শরীর-মন-শুদ্ধির দ্বারা তত্ত্বজ্ঞানধারণের যোগ্যতালাভের জন্য আমি অগ্নিস্বরূপ তোমাতে আহুতিপ্রদান করিতেছি – প্রসন্ন হও।”1


1. ত্রিসুপর্ণমন্ত্রের ভাবার্থ।

সন্ন্যাসগ্রহণের পূর্বসম্পাদ্য বিরজাহোমের সংক্ষেপ সারার্থ

অনন্তর বিরজাহোম আরম্ভ হইল – “পৃথ্বী, অপ্, তেজঃ, বায়ু ও আকাশ-রূপে আমাতে অবস্থিত ভূতপঞ্চক শুদ্ধ হউক; আহুতিপ্রভাবে রজোগুণপ্রসূত মলিনতা হইতে বিমুক্ত হইয়া আমি যেন জ্যোতিঃস্বরূপ হই – স্বাহা।

“প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যানাদি আমাতে অবস্থিত বায়ুসকল শুদ্ধ হউক; আহুতিপ্রভাবে রজোগুণপ্রসূত মলিনতা হইতে বিমুক্ত হইয়া আমি যেন জ্যোতিঃস্বরূপ হই – স্বাহা।

“অন্নময়, প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময়, আনন্দময় নামক আমার কোষ-পঞ্চক শুদ্ধ হউক; আহুতিপ্রভাবে রজোগুণপ্রসূত মলিনতা হইতে বিমুক্ত হইয়া আমি যেন জ্যোতিঃস্বরূপ হই – স্বাহা।

“শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ-প্রসূত আমাতে অবস্থিত বিষয়সংস্কারসমূহ শুদ্ধ হউক; আহুতিপ্রভাবে রজোগুণপ্রসূত মলিনতা হইতে বিমুক্ত হইয়া আমি যেন জ্যোতিঃস্বরূপ হই – স্বাহা।

“আমার মন, বাক্য, কায়, কর্মাদি শুদ্ধ হউক; আহুতিপ্রভাবে রজোগুণপ্রসূত মলিনতা হইতে বিমুক্ত হইয়া আমি যেন জ্যোতিঃস্বরূপ হই – স্বাহা।

“হে অগ্নিশরীরে শয়ান! জ্ঞান-প্রতিবন্ধ-হরণ-কুশল, লোহিতাক্ষ পুরুষ, জাগরিত হও। হে অভীষ্টপূরণকারিন্! তত্ত্বজ্ঞানলাভের পথে আমার যত কিছু প্রতিবন্ধক আছে, সেই সকলের নাশ কর এবং চিত্তের সমগ্র সংস্কার সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধ হইয়া যাহাতে গুরুমুখে শ্রুত জ্ঞান আমার অন্তরে সম্যক উদিত হয়, তাহা করিয়া দাও; আহুতি দ্বারা রজোগুণপ্রসূত মলিনতা বিদূরিত হইয়া আমি যেন জ্যোতিঃস্বরূপ হই – স্বাহা।

“চিদাভাস ব্রহ্মস্বরূপ আমি দারা, পুত্র, সম্পদ, লোকমান্য, সুন্দর শরীরাদি লাভের সমস্ত বাসনা অগ্নিতে আহুতিপ্রদানপূর্বক নিঃশেষে ত্যাগ করিতেছি – স্বাহা।”

ঠাকুরের শিখাসূত্রাদি পরিত্যাগপূর্বক সন্ন্যাসগ্রহণ

ঐরূপে বহু আহুতি প্রদত্ত হইবার পর ‘ভূরাদি সকল লোকলাভের প্রত্যাশা আমি এইক্ষণ হইতে ত্যাগ করিলাম’ এবং ‘জগতের সর্বভূতকে অভয়প্রদান করিতেছি’ – বলিয়া হোমপরিসমাপ্তি হইল। অনন্তর শিখা, সূত্র ও যজ্ঞোপবীত যথাবিধানে আহুতি দিয়া আবহমানকাল হইতে সাধকপরম্পরানিষেবিত গুরুপ্রদত্ত কৌপীন, কাষায় ও নামে1 ভূষিত হইয়া ঠাকুর শ্রীমৎ তোতার নিকটে উপদেশ-গ্রহণের জন্য উপবিষ্ট হইলেন।


1. আমাদিগের মধ্যে কেহ কেহ বলেন, সন্ন্যাসদীক্ষাদানের সময় শ্রীমৎ তোতাপুরী গোস্বামী ঠাকুরকেশ্রীরামকৃষ্ণনাম প্রদান করিয়াছিলেন। অন্য কেহ কেহ বলেন, ঠাকুরের পরমভক্ত সেবক শ্রীযুত মথুরামোহনই তাঁহাকে নামে প্রথম অভিহিত করেন। প্রথম মতটিই আমাদিগের নিকট সমীচীন বলিয়া বোধ হয়।

ঠাকুরের ব্রহ্মস্বরূপে অবস্থানের জন্য শ্রীমৎ তোতার প্রেরণা

অনন্তর ব্রহ্মজ্ঞ তোতা ঠাকুরকে এখন বেদান্তপ্রসিদ্ধ ‘নেতি নেতি’ উপায়াবলম্বনপূর্বক ব্রহ্মস্বরূপে অবস্থানের জন্য উৎসাহিত করিতে লাগিলেন। বলিলেন –

নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব, দেশকালাদি দ্বারা সর্বদা অপরিচ্ছিন্ন একমাত্র ব্রহ্মবস্তুই নিত্য সত্য। অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মায়া নিজপ্রভাবে তাঁহাকে নামরূপের দ্বারা খণ্ডিতবৎ প্রতীত করাইলেও তিনি কখনও বাস্তবিক ঐরূপ নহেন। কারণ সমাধিকালে মায়াজনিত দেশকাল বা নামরূপের বিন্দুমাত্র উপলব্ধি হয় না। অতএব নামরূপের সীমার মধ্যে যাহা কিছু অবস্থিত, তাহা কখনও নিত্য বস্তু হইতে পারে না, তাহাকেই দূরে পরিহার কর। নামরূপের দৃঢ় পিঞ্জর সিংহবিক্রমে ভেদ করিয়া নির্গত হও। আপনাতে অবস্থিত আত্মতত্ত্বের অন্বেষণে ডুবিয়া যাও। সমাধিসহায়ে তাঁহাতে অবস্থান কর; দেখিবে, নামরূপাত্মক জগৎ তখন কোথায় লুপ্ত হইবে, ক্ষুদ্র ‘আমি’-জ্ঞান বিরাটে লীন ও স্তব্ধীভূত হইবে এবং অখণ্ড সচ্চিদানন্দকে নিজ স্বরূপ বলিয়া সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করিবে। “যে জ্ঞানাবলম্বনে এক ব্যক্তি অপরকে দেখে, জানে বা অপরের কথা শুনে, তাহা অল্প বা ক্ষুদ্র; যাহা অল্প, তাহা তুচ্ছ – তাহাতে পরমানন্দ নাই; কিন্তু যে জ্ঞানে অবস্থিত হইয়া এক ব্যক্তি অপরকে দেখে না, জানে না বা অপরের বাণী ইন্দ্রিয়গোচর করে না – তাহাই ভূমা বা মহান, তৎসহায়ে পরমানন্দে অবস্থিতি হয়। যিনি সর্বথা সকলের অন্তরে বিজ্ঞাতা হইয়া রহিয়াছেন, কোন্ মনবুদ্ধি তাঁহাকে জানিতে সমর্থ হইবে?”

ঠাকুরের মনকে নির্বিকল্প করিবার চেষ্টা নিষ্ফল হওয়ায় তোতার আচরণ এবং ঠাকুরের নির্বিকল্প সমাধিলাভ

শ্রীমৎ তোতা পূর্বোক্ত প্রকারে নানা যুক্তি ও সিদ্ধান্তবাক্যসহায়ে ঠাকুরকে সেদিন সমাহিত করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। ঠাকুরের মুখে শুনিয়াছি, তিনি যেন তাঁহার আজীবন সাধনালব্ধ উপলব্ধিসমূহ অন্তরে প্রবেশ করাইয়া তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ অদ্বৈতভাবে সমাহিত করিয়া দিবার জন্য বদ্ধপরিকর হইয়াছিলেন। তিনি বলিতেন, “দীক্ষা প্রদান করিয়া ন্যাংটা নানা সিদ্ধান্তবাক্যের উপদেশ করিতে লাগিল এবং মনকে সর্বতোভাবে নির্বিকল্প করিয়া আত্মধ্যানে নিমগ্ন হইয়া যাইতে বলিল। আমার কিন্তু এমনি হইল যে, ধ্যান করিতে বসিয়া চেষ্টা করিয়াও মনকে নির্বিকল্প করিতে বা নামরূপের গণ্ডি ছাড়াইতে পারিলাম না। অন্য সকল বিষয় হইতে মন সহজেই গুটাইয়া আসিতে লাগিল, কিন্তু ঐরূপে গুটাইবামাত্র তাহাতে শ্রীশ্রীজগদম্বার চিরপরিচিত চিদ্ঘনোজ্জ্বল মূর্তি জ্বলন্ত জীবন্তভাবে সমুদিত হইয়া সর্বপ্রকার নামরূপ ত্যাগের কথা এককালে ভুলাইয়া দিতে লাগিল। সিদ্ধান্তবাক্যসকল শ্রবণপূর্বক ধ্যানে বসিয়া যখন উপর্যুপরি তিন দিন ঐরূপ হইতে লাগিল, তখন নির্বিকল্পসমাধিসম্বন্ধে একপ্রকার নিরাশ হইলাম এবং চক্ষুরুন্মীলন করিয়া ন্যাংটাকে বলিলাম, ‘হইল না, মনকে সম্পূর্ণ নির্বিকল্প করিয়া আত্মধ্যানে মগ্ন হইতে পারিলাম না।’ ন্যাংটা তখন বিষম উত্তেজিত হইয়া তীব্র তিরস্কার করিয়া বলিল, ‘কেঁও, হোগা নেহি’ অর্থাৎ – কি! হইবে না, এত বড় কথা! বলিয়া কুটিরের মধ্যে ইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিয়া ভগ্ন কাচখণ্ড দেখিতে পাইয়া উহা গ্রহণ করিল এবং সূচের ন্যায় উহার তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ ভ্রূমধ্যে সজোরে বিদ্ধ করিয়া বলিল, ‘এই বিন্দুতে মনকে গুটাইয়া আন।’ তখন পুনরায় দৃঢ়সঙ্কল্প করিয়া ধ্যানে বসিলাম এবং ৺জগদম্বার শ্রীমূর্তি পূর্বের ন্যায় মনে উদিত হইবামাত্র জ্ঞানকে অসি কল্পনা করিয়া উহা দ্বারা ঐ মূর্তিকে মনে মনে দ্বিখণ্ড করিয়া ফেলিলাম। তখন আর মনে কোনরূপ বিকল্প রহিল না; একেবারে হু হু করিয়া উহা সমগ্র নামরূপরাজ্যের উপরে উঠিয়া গেল এবং সমাধিনিমগ্ন হইলাম।”

ঠাকুর নির্বিকল্প সমাধি যথার্থ লাভ করিয়াছেন কিনা, তদ্বিষয়ে তোতার পরীক্ষা ও বিস্ময়

ঠাকুর পূর্বোক্ত প্রকারে সমাধিস্থ হইলে শ্রীমৎ তোতা অনেকক্ষণ তাঁহার নিকটে উপবিষ্ট রহিলেন। পরে নিঃশব্দে কুটিরের বাহিরে আগমনপূর্বক তাঁহার অজ্ঞাতসারে পাছে কেহ কুটিরে প্রবেশপূর্বক ঠাকুরকে বিরক্ত করে, এজন্য দ্বারে তালা লাগাইয়া দিলেন। অনন্তর কুটিরের অনতিদূরে পঞ্চবটীতলে নিজ আসনে উপবিষ্ট থাকিয়া দ্বার খুলিয়া দিবার জন্য ঠাকুরের আহ্বান প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

দিন যাইল, রাত্রি আসিল। দিনের পর দিন আসিয়া দিবসত্রয় অতিবাহিত হইল। তথাপি ঠাকুর শ্রীমৎ তোতাকে দ্বার খুলিয়া দিবার জন্য আহ্বান করিলেন না। তখন বিস্ময়কৌতূহলে তোতা আপনিই আসন ত্যাগ করিয়া উঠিলেন এবং শিষ্যের অবস্থা পরিজ্ঞাত হইবেন বলিয়া অর্গলমোচন করিয়া কুটিরে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, যেমন বসাইয়া গিয়াছিলেন, ঠাকুর সেইভাবেই বসিয়া আছেন – দেহে প্রাণের প্রকাশমাত্র নাই, কিন্তু মুখ প্রশান্ত, গম্ভীর, জ্যোতিপূর্ণ! বুঝিলেন – বহির্জগৎ সম্বন্ধে শিষ্য এখনও সম্পূর্ণ মৃতকল্প – নিবাত-নিষ্কম্প-প্রদীপবৎ তাঁহার চিত্ত ব্রহ্মে লীন হইয়া অবস্থান করিতেছে!

শ্রীমৎ তোতার ঠাকুরের সমাধিভঙ্গ করিবার চেষ্টা

সমাধিরহস্যজ্ঞ তোতা স্তম্ভিতহৃদয়ে ভাবিতে লাগিলেন – যাহা দেখিতেছি, তাহা কি বাস্তবিক সত্য – চল্লিশ বৎসরব্যাপী কঠোর সাধনায় যাহা জীবনে উপলব্ধি করিতে সক্ষম হইয়াছি, তাহা কি এই মহাপুরুষ সত্য সত্যই তিন দিবসে আয়ত্ত করিলেন! সন্দেহাবেগে তোতা পুনরায় পরীক্ষায় মনোনিবেশ করিলেন, তন্ন তন্ন করিয়া শিষ্যদেহে প্রকাশিত লক্ষণসকল অনুধাবন করিতে লাগিলেন। হৃদয় স্পন্দিত হইতেছে কিনা, নাসিকাদ্বারে বিন্দুমাত্র বায়ু নির্গত হইতেছে কিনা বিশেষ করিয়া পরীক্ষা করিলেন। ধীর স্থির কাষ্ঠখণ্ডের ন্যায় অচলভাবে অবস্থিত শিষ্যশরীর বারংবার স্পর্শ করিলেন। কিছুমাত্র বিকার, বৈলক্ষণ্য বা চেতনার উদয় হইল না! তখন বিস্ময়ানন্দে অভিভূত হইয়া তোতা চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন –

‘য়হ ক্যা দৈবী মায়া’ – সত্য সত্যই সমাধি! বেদান্তোক্ত জ্ঞানমার্গের চরম ফল – নির্বিকল্প সমাধি! তিন দিনে1 হইয়াছে! দেবতার এ কি অত্যদ্ভুত মায়া! অনন্তর সমাধি হইতে শিষ্যকে ব্যুত্থিত করিবেন বলিয়া তোতা প্রক্রিয়া আরম্ভ করিলেন এবং ‘হরি ওম্’-মন্ত্রের সুগভীর আরাবে পঞ্চবটীর স্থল-জল-ব্যোম পূর্ণ হইয়া উঠিল।

শিষ্যপ্রেমে মুগ্ধ হইয়া এবং নির্বিকল্প ভূমিতে তাহাকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত করিবেন বলিয়া শ্রীমৎ তোতা কিরূপে এখানে দিনের পর দিন এবং মাসের পর মাস অতিবাহিত করিতে লাগিলেন এবং ঠাকুরের সহায়ে কিরূপে নিজ আধ্যাত্মিক জীবন সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ করিলেন, সে সকল কথা আমরা অন্যত্র2 সবিস্তারে বলিয়াছি বলিয়া এখানে তাহার পুনরুল্লেখ করিলাম না।

একাদিক্রমে একাদশ মাস দক্ষিণেশ্বরে অবস্থান করিয়া শ্রীমৎ তোতা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রস্থান করিলেন। ঐ ঘটনার অব্যবহিত পরেই ঠাকুরের মনে দৃঢ় সঙ্কল্প উপস্থিত হইল, তিনি এখন হইতে নিরন্তর নির্বিকল্প অদ্বৈতভূমিতে অবস্থান করিবেন। কিরূপে তিনি ঐ সঙ্কল্প কার্যে পরিণত করিয়াছিলেন – জীবকোটি সাধকবর্গের কথা দূরে থাকুক, অবতারপ্রতিম আধিকারিক পুরুষেরাও যে ঘনীভূত অদ্বৈতাবস্থায় বহুকাল অবস্থান করিতে সক্ষম হয়েন না, সেই ভূমিতে কিরূপে তিনি নিরন্তর ছয়মাস কাল অবস্থান করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন এবং ঐকালে কিরূপে জনৈক সাধুপুরুষ কালীবাটীতে আগমনপূর্বক ঠাকুরের দ্বারা পরে লোককল্যাণ বিশেষরূপে সাধিত হইবে, একথা জানিতে পারিয়া ছয়মাস কাল তথায় অবস্থান করিয়া নানা উপায়ে তাঁহার শরীররক্ষা করিয়াছিলেন, সে সকল কথা আমরা পাঠককে অন্যত্র3 বলিয়াছি। অতএব ঠাকুরের সহায়ে এইকালে মথুরবাবুর জীবনে যে বিশেষ ঘটনা উপস্থিত হইয়াছিল, তাহার উল্লেখ করিয়া আমরা এই অধ্যায়ের উপসংহার করিব।


1. গুরুভাবপূর্বার্ধ (৯ম সং), ‘কথামৃত৪র্থ ভাগ (৮ম সং) ৩১০ পৃঃপ্রঃ
2. গুরুভাবপূর্বার্ধ, ৮ম অধ্যায়।
3. গুরুভাবপূর্বার্ধ, ২য় অধ্যায়।

ঠাকুরের জগদম্বা দাসীর কঠিন পীড়া আরোগ্য করা

ঠাকুরের ভিতর নানাপ্রকার দৈবশক্তির দর্শনে শ্রীযুক্ত মথুরামোহনের ভক্তি-বিশ্বাস ইতঃপূর্বেই তাঁহার প্রতি বিশেষভাবে বর্ধিত হইয়াছিল। এই কালের একটি ঘটনায় সেই ভক্তি অধিকতর অচলভাব ধারণপূর্বক চিরকাল তাঁহাকে ঠাকুরের শরণাপন্ন করিয়া রাখিয়াছিল।

মথুরামোহনের দ্বিতীয়া পত্নী শ্রীমতী জগদম্বা দাসী এই কালে গ্রহণীরোগে আক্রান্তা হয়েন। রোগ ক্রমশঃ এত বাড়িয়া উঠে যে, কলিকাতার সুপ্রসিদ্ধ ডাক্তার-বৈদ্যসকল তাঁহার জীবনরক্ষা সম্বন্ধে প্রথমে সংশয়াপন্ন এবং পরে হতাশ হয়েন।

ঠাকুরের নিকট শুনিয়াছি, মথুরামোহন সুপুরুষ ছিলেন, কিন্তু দরিদ্রের ঘরে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। রূপবান দেখিয়াই রাসমণি তাঁহাকে প্রথমে নিজ তৃতীয়া কন্যা শ্রীমতী করুণাময়ীর সহিত এবং ঐ কন্যার মৃত্যু হইলে পুনরায় নিজ কনিষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী জগদম্বা দাসীর সহিত বিবাহ দিয়াছিলেন। অতএব বিবাহের পরেই শ্রীযুক্ত মথুরের অবস্থার পরিবর্তন হয় এবং স্বয়ং বুদ্ধিবলে ও কর্মকুশলতায় ক্রমে তিনি নিজ শ্বশ্রূঠাকুরানীর দক্ষিণহস্তস্বরূপ হইয়া উঠেন। অনন্তর রানী রাসমণির মৃত্যু হইলে কিরূপে তিনি রানীর বিষয়সংক্রান্ত সকল কার্যপরিচালনায় একরূপ একাধিপত্য লাভ করেন, তাহা আমরা পাঠককে জানাইয়াছি।

জগদম্বা দাসীর সাংঘাতিক পীড়ায় মথুরামোহন এখন যে কেবল প্রিয়তমা পত্নীকে হারাইতে বসিয়াছিলেন তাহা নহে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজ শ্বশ্রূঠাকুরানীর বিষয়ের উপর পূর্বোক্ত আধিপত্যও হারাইতে বসিয়াছিলেন। সুতরাং তাঁহার মনের এখনকার অবস্থা সম্বন্ধে অধিক কথা বলা নিষ্প্রয়োজন।

রোগীর অবস্থা দেখিয়া যখন ডাক্তার-বৈদ্যরা জবাব দিয়া গেলেন, মথুর তখন কাতর হইয়া দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং কালীমন্দিরে শ্রীশ্রীজগন্মাতাকে প্রণাম করিয়া ঠাকুরের অনুসন্ধানে পঞ্চবটীতে আসিলেন। তাঁহার ঐপ্রকার উন্মত্তপ্রায় অবস্থা দেখিয়া ঠাকুর তাঁহাকে সযত্নে পার্শ্বে বসাইলেন এবং ঐরূপ হইবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। মথুর তাহাতে তাঁহার পদপ্রান্তে পতিত হইয়া সজলনয়নে গদগদ বাক্যে সকল কথা নিবেদন করিয়া দীনভাবে বারংবার বলিতে লাগিলেন, “আমার যাহা হইবার তাহা তো হইতে চলিল; বাবা, তোমার সেবাধিকার হইতেও এইবার বঞ্চিত হইলাম, তোমার সেবা আর করিতে পাইব না।”

মথুরের ঐরূপ দৈন্য দেখিয়া ঠাকুরের হৃদয় করুণায় পূর্ণ হইল। তিনি ভাবাবিষ্ট হইয়া মথুরকে বলিলেন, “ভয় নাই, তোমার পত্নী আরোগ্যলাভ করিবে।” বিশ্বাসী মথুর ঠাকুরকে সাক্ষাৎ দেবতা বলিয়া জানিতেন; সুতরাং তাঁহার অভয়বাণীতে প্রাণ পাইয়া সেদিন বিদায় গ্রহণ করিলেন। অনন্তর জানবাজারে প্রত্যাগমন করিয়া তিনি দেখিলেন, সহসা জগদম্বা দাসীর সাংঘাতিক অবস্থার পরিবর্তন হইয়াছে। ঠাকুর বলিতেন, “সেইদিন হইতে জগদম্বা দাসী ধীরে ধীরে আরোগ্যলাভ করিতে লাগিল এবং তাহার ঐ রোগটার ভোগ (নিজ শরীর দেখাইয়া) এই শরীরের উপর দিয়া হইতে থাকিল; জগদম্বা দাসীকে ভাল করিয়া ছয়মাস কাল পেটের পীড়া ও অন্যান্য যন্ত্রণায় ভুগিতে হইয়াছিল।”

শ্রীযুক্ত মথুরের ঠাকুরের প্রতি অদ্ভুত প্রেমপূর্ণ সেবার কথা আলোচনা করিবার সময় ঠাকুর একদিন আমাদিগের নিকট পূর্বোক্ত ঘটনার উল্লেখ করিয়া বলিয়াছিলেন, “মথুর যে চৌদ্দ বৎসর সেবা করিয়াছিল, তাহা কি অমনি করিয়াছিল? মা তাহাকে (নিজ শরীর দেখাইয়া) ইহার ভিতর দিয়া নানাপ্রকার অদ্ভুত অদ্ভুত সব দেখাইয়াছিলেন, সেইজন্যই সে অত সেবা করিয়াছিল।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *