ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
প্রথমে মাসি-পিসি তারপরে ঘুংরি কাশি
উঠতে বসতে পড়ছে ড্যাঙ্গোস
কাছা ধরে টানাটানি ॥
বেশ রাত। দেয়াল ঘড়ি সময়ের পায়ে টকাস টকাস হাঁটছে। মহাকাল যেন হাইহিল জুতো পরে সানবাঁধানো পৃথিবীতে বেড়াতে বেরিয়েছেন, কিংবা প্রজাদের কাছে খাজনা আদায়ে। খাজনা হল দিন। একটা করে দিন তুলে দিতে হবে তার হাতে। ভাবতে বেশ রোমাঞ্চ হয়, আমি একটা গাছ। অনেক পাতা। রোজ একটা করে পাতা খসে পড়ে যাচ্ছে। একদিন শেষ পাতাটি পড়ে যাবে; তখন আমি বলতে পারব, আমার কথাটি ফুরোল, নটে গাছটি মুড়োল।
পাশের ঘরে মুকু আর দিদি একই বিছানায় পাশাপাশি শুয়েছে। দু’জনে খুব গজর গজর করছে এখনও। মেয়েদের কথা সহজে শেষ হয় না। রাতের রান্না দিদিই করলেন। কথাটা ঠিকই, অসম্ভব ভাল রাঁধেন। প্রথমে ঠিক হয়েছিল, ডিমের কারি আর রুটি হবে। মুকু হঠাৎ বললে, আজ থেকে এ বাড়িতে নিরামিষ হবে। দিদি খাবে না, আমরা মাছমাংস খাব, তা হতে পারে না। অসম্ভব।
দিদি বলেছিলেন, তা কেন? তোমরা মাছমাংস খাও না! আমি আমিষ রান্নাও খুব ভাল পারি। আমার জন্যে তোমরা কেন সব ত্যাগ করবে?
মুকু বলেছিল, তাতে আমাদের খাওয়া হবে, কিন্তু আনন্দটা কমে যাবে। একসঙ্গে বসে খেতে পারব না। পাশাপাশি দুটো আলাদা ব্যবস্থা। হৃদয়হীনতার চূড়ান্ত। একধরনের অসভ্যতাও। ওরকম দুই দুই এ বাড়িতে আমি অ্যালাউ করব না। আমি যা বলব তাই হবে। কোনওরকম তর্ক চলবে না।
দিদি হাঁ হয়ে বসে রইলেন। নীল চৌখুপ্লি শাড়ি পরে মুকু হনহন করে চলে গেল। দিদি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এমন মেয়ে তো দেখিনি। যেমন রূপ, তেমন তেজ। তেমন মন তেমন হৃদয়! এ কে! তামারও তো সেই একই প্রশ্ন, এ কে? এ যে দেখি হরিশঙ্করের নারী সংস্করণ। হরিশঙ্করের গুণাবলির মধ্যে কয়েক পোয়া মমতা মিশিয়ে দিলেই মুকুর অন্তঃকরণ। নিখাদ এমন আবেগ, আবার এমন বিচার ও পরিচ্ছন্নতা সহসা দেখা যায় না। আবার এমন স্বার্থশূন্যতা!
বড় নেশাতে পড়েছি শ্যামের বাঁশিতে। জামা ধরে যখন গাড়ি থেকে টেনে নামিয়েছিল, ভেবেছিলুম মুখদর্শন করব না। নিদারুণ অসভ্যতা। পরে চিন্তা করে দেখলুম, যাকে আমি অসভ্যতা ভাবছি, সেটা আসলে আবেগ। মুকু যা কিছু করে তার মধ্যেই জীবন-মরণ একটা নিষ্ঠা কাজ করে। অদ্ভুত এক আন্তরিকতা। কোনও ফাঁকি নেই। সেইটা ধরতে না পারলেই মনে হবে মেয়েটা বুঝি পাগলি।
সে যাই হোক। ভাবনা তো অনেক হল, আমার কী হবে? ব্রেকডাউন গাড়ির মতো জীবনের একপাশে পড়ে থাকব! ফ্যালফ্যাল করে দেখব, হাই স্পিডে সব বেরিয়ে যাচ্ছে জীবনের রাজপথ ধরে! ঊ্যা করে জন্মে আমি কী পেলাম? সবাই ভাবলে আমি এক রেসের ঘোড়া। শিক্ষার রেসকোর্সে ছেলে আমার ডার্বি নেবে। সেই জোরে জীবিকার বিশাল মাঠে সবাইকে মেরে বেরিয়ে যাবে। সদরে মোটরগাড়ি, লোকজন, দাসদাসী। আজ ভারতে তো কাল বিলেতে! বউটি হবে ডানাকাটা পরি, ইউনিভার্সিটি ব্লু, আধুনিকা, কিন্তু চালচলনে সাবেকি। খোঁপায় তোলা ঘোমটা, বাতাসের স্বরে কথা, তুলোর পায়ে হাঁটা। পাশ ফিরতেও পারমিশন নেবে, হাসবে কিন্তু শব্দ হবে না, সাইলেন্সার লাগিয়ে হাঁচবে। রাগবে না, আবহাওয়া যেমনই হোক, বসন্তের বাতাসের মতো বইবে। এমন ছেলে কই হলাম! উঁ্যা করে জন্মে আমি কী পেলাম! প্রথমে মাসি-পিসি, এ মাসি-পিসি সেই মায়ের বোন মাসি বাপের বোন পিসি নয়, এক ধরনের ফুসকুড়ি। তারপরে ঘুংরি কাশি। স্মৃতি এখনও অমলিন। যে পারে সে পিটিয়ে যায়। সকালে কানটানা। মাস্টারমশাই ভীষণ রাগী। পড়াবেন কী? ধৈর্য নেই। কান টানাই তার মেডইজি। কান ধরে টানলে অঙ্ক বেরোবে। কান ধরে টানলে। ইংরিজি ঝরবে। তিনি ছাড়লে কী হবে! স্কুলে ডাস্টার পেটা। সহপাঠীর ল্যাং। আমি যেন এক বেওয়ারিশ মাল।
পাশের ঘরে মহিলা দু’জন ঘুমিয়ে পড়েছে। দু’জনেরই মন পরিষ্কার। কোনও ঘোরপ্যাঁচ নেই। বিছানায় পড়তে-পড়তেই ঘুমে কাদা হবে না কেন? বাইরের বারান্দায় আজ সেই শব্দ। বহুদিন পরে ফিরে এল। ভয় করে, তবু উন্মুখ হয়ে থাকি। বুঝতে পারি না। সামনাসামনি যাওয়ার সাহসও নেই। শব্দের সঙ্গে শব্দকারীকে যদি দেখে ফেলি! আমার ঘর অন্ধকার। বিছানায় পড়ে আছি মড়ার মতো। ঘুমের পাত্তা নেই। মাথার ভেতর দিয়ে সারা কলকাতা শহর সশব্দে নেচে নেচে চলেছে। বারান্দায় সেই সাবধানী পায়ের শব্দ এ পাশ থেকে ও পাশ, ও পাশ থেকে এ পাশ করছে। বহুকাল কোথাও আবদ্ধ থাকলে, সেই বন্দি মানুষ যেমন নিরুপায় হয়ে এ দেয়াল থেকে ও দেয়াল পায়চারি করে, এ যেন ঠিক সেইরকম। মনে হয় কোনও রমণী। অকালে চলে যাওয়া এ বাড়ির কোনও বধূই হয়তো! দেহ গেছে, আত্মা এখনও যেতে পারেনি মায়ার বাঁধন খুলে। আগেও দেখেছি আজ দেখছি, পদশব্দ যেন এই ঘরেই আসতে চায়। বারেবারে ফিরে এসে এই ঘরের সামনেই থামছে। থেমে থাকছে বেশ কিছুক্ষণ, তারপর ফিরে যাচ্ছে আবার। আমার শরীরের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে উঠছে। বন্ধ দরজার বাইরে তীব্র একটা আলো জ্বলে উঠল। আলোর রেখায় হিলহিল করে উঠল দরজার সমস্ত ফঁকফোকর। আলোটা জ্বলেই মুহূর্তে নিবে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সারাঘর ভরে গেল অপূর্ব সুবাসে। এর একটাই ব্যাখ্যা, শব্দকারী জাগতিক দরজার বাধা পেরিয়ে চলে এসেছে ঘরে। এই সুগন্ধই তার প্রমাণ। ভয়ে আমার কণ্ঠ, তালু শুকিয়ে গেল। ধূপ তো কেউ জ্বালেনি! আলোর উৎসই বা কী? বারান্দার পেছনে শুধুই ঝোঁপঝাড়, বাগান। সব কিছুরই তো একটা কারণ থাকবে। পাশের ঘরের দু’জন অঘোর ঘুমে অচৈতন্য।
হঠাৎ মনে হল, আমার এত ভয় কেন! কীসের ভয়! কাকে ভয়! ভয় পেয়েছি ঠিকই। দেহ অসাড় কিন্তু যুক্তি কাজ করছে। ভয় মৃত্যুকে। মরে যাওয়ার ভয়। এতদিন তা হলে বৃথাই গুনগুন করেছি, ‘আমি ভয় করবনা ভয় করব না। দু’বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরবনা।।’ এই তো সেই পরীক্ষার সময়। আমি তো মরতেই চাই। আর একবার ভাল করে জন্মাতে চাই। এবারের সব ভুল-ত্রুটি শুধরে নিয়ে উজ্জ্বল, প্রোজ্জ্বল এক জীবনের প্রত্যাশী। যে-জীবনে কাম বলে কোনও আকাঙ্ক্ষা থাকবে না। রমণীর জন্যে থাকবে না কোনও ব্যাকুলতা। ওইটাই তো এইবারের জীবনে কাল হয়ে উঠেছে।
ঝেড়েঝুড়ে উঠে বসলাম বিছানায়। দেখি ধ্যান লাগাই। চেষ্টা করি আলো আর সুগন্ধের উৎসটাকে ধরার। মনে হয় আমার মা এসেছেন। এসেছেন আমার পিতার খবর নিতে। শুনেছি, তিনি অতিশয় প্রেমিকা ছিলেন। জীবনকে ভয়ংকর ভালবাসতেন বলেই পঁচিশের আগে মৃত্যু নিয়ে গেল হাত ধরে। তিনি এসেছেন ফেলে যাওয়া লন্ডভন্ড এই সংসার দেখতে নিতান্তই এক পর্যবেক্ষকের মতো। ছেলেটা কত বড় হল! পিতা হরিশঙ্কর উপস্থিত থাকলে জিজ্ঞেস করতেন মন দিয়ে মনে, এখনও তোমার শেষ হল না কর্তব্য! জীবননদীর ওপারে আর কতকাল আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখবে একা? চলে এসো। চলে এসো। তুমি বৃদ্ধ হয়েছ, নিঃসঙ্গ সংগ্রামী। রাখো তোমার ধনুর্বাণ। জীবনেরে কে রাখিতে পারে?/আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে। চলে এসো মহাসিন্ধুর এপারে। সমুদ্রস্তনিত পৃথী, হে বিরাট, তোমারে ভরিতে। নাহি পারে। তাই এ ধরারে। জীবন-উৎসব-শেষে দুই পায়ে ঠেলে। মৃৎপাত্রের মতো যাও ফেলে ।
মনে মনে বিছানাটাকে মন্ত্র দিয়ে ঘিরলুম। এখন আমি গণ্ডির ভেতরে। এইবার মন স্থির করে দেখি কী হয়! কী পাই! কে আসেন! আজ এসপার ওসপার। স্থির হয়ে বসলুম। ছেলেবেলার সেই। মন্ত্রটাও আওড়ে নিলাম, অধিকন্তু ন দোষায়, বুকে আছে রামলক্ষ্মণ ভয়টা আমার কী! এই হল। মানুষ। আমার মা যদি এসেই থাকেন আমি তার ছেলে, ভূত ভেবে ভয় পাচ্ছি কেন? মানুষ মারা গেলে জীবিতের পৃথিবীতে তাঁর ফিরে আসার অধিকার নেই! ধীরে ধীরে আমার চোখ বুজে এল। তীব্র হল ঘুরে ঘুরে বেড়ানো সুগন্ধ। বুদ্ধি স্তব্ধ। ব্যাখ্যা অপহৃত। There are more things in heav en and earth Haratio/ Than are dreamt of in your philosophy.
ভয়ের ভাবটা ধীরে কেটে আসছে। শরীর শিথিল হচ্ছে। ভারী হচ্ছে ক্রমশ। যেন দেবে বসে যাচ্ছে বিছানার গদিতে, শ্বাসপ্রশ্বাস ক্ষীণ হয়ে আসছে। শরীরের উত্তাপ কমছে। হৃদস্পন্দন মৃদু থেকে মৃদুতর। ধ্যান জমছে। সমস্ত লক্ষণ সুস্পষ্ট। বেশ ভাল লাগছে। কিছুই যে পারে না, সে একটা অতিশয় কঠিন জিনিস পারছে। যে পারায় ধন-জন-বিত্ত-অর্থ কোনও কিছুই লাভ হবে না। শুধু একটা আত্মতৃপ্তি, ভিন্নতর একটা জগতের উপলব্ধি হবে। মনটাকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে দিয়েছি। তুলোর মতো ভেসে যাক। যেখানে যেতে চায়, যাক চলে। দেহ কোনও বাধা হবে না। দৃষ্টিকে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছি জমধ্যে। সেইখানেই আছে আমার তৃতীয় নয়ন। তৃতীয় নয়নেই দেখা যায় হৃদয়-আকাশ। সেই আকাশের বর্ণ আর আলো সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।
আমার দেহের নিম্নভাগ থেকে একে একে সব অদৃশ্য হতে লাগল। পা গেল, উদর গেল, বুক গেল, হাতদুটো গেল। নেই। কোনও অনুভূতিই আর রইল না। শুধু আমার মুণ্ডটা ভাসতে লাগল। অন্য ধরনের একটা ভয় এল। মরে যাব না তো! একটা মাথার অনুভূতি ছাড়া আর কিছু রইল না। ভীষণ একটা শৈত্যের বোধ। কপালের সামনে শিশিরে বোনা একটা পরদা দুলছে। মা বলে চিৎকার করতে ইচ্ছে করল। নড়ে বসতে চাইছি। ঝাড়া দিয়ে উঠতে চাইছি। পারছি না। আমি আর আমার হাতে নেই। মুণ্ডটা বেলুনের মতো দুলছে। হঠাৎ দৃষ্টি-পরদায় একটা চিড় ধরল। শিশিরের দানা ঝরে পড়ল ঝরঝর করে। জ্বলজ্বল করে উঠল একটা দৃশ্য:
একটা শুকনো নদী। জল নেই। শুধু নুড়ি-পাথর। কিছু দুধের মতো সাদা, কিছু শ্যাওলা সবুজ, কিছু নীল। অজস্র উপলখণ্ড, এ পাশ থেকে ও পাশে চলে গেছে। পরপারে পাহাড়। পাহাড় শুধু পাহাড়। স্পষ্ট দেখছি, একটি শিলাখণ্ডে নিবিষ্ট মনে উপবিষ্ট হরিশঙ্কর। আমি তার মুখের একটা পাশ দেখতে পাচ্ছি। চোখে সেই সোনালি চশমা। শুভ্র বাস। দু’হাতে হাঁটুদুটি ধরে বসে আছেন। আমি তার পায়ের কাছে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলুম, সঙ্গে সঙ্গে তিনি সরে গেলেন অসীম দূরত্বে। আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমি টাল খেয়ে বিছানার ওপর পড়ে গেলুম। সংবিৎ ফিরে এল। ভোর হচ্ছে। একটা পাখিই কোনওক্রমে বাসা ছেড়েছে। মৃদু মৃদু ডাকছে। পাশের ঘরে মৃদু স্বরে গান ধরেছেন দিদি। হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ। একেবারে বাঁশির মতো গলা।
কোনওক্রমে উঠে বসলুম। আর একটু হলেই খাট থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতুম। সামনের দাঁতদুটো অবশ্যই ভাঙত। হা হয়ে গেলুম, একী! ঘরের দরজাটা হাট খোলা। আমার বেশ মনে আছে, দরজা আমি ভেতর থেকে বন্ধ করে শুতে গিয়েছিলুম। কোনও কারণই খুঁজে পেলুম না। হয়তো ভুল হয়েছিল। বাতাসে খুলে গেছে। ছিটকিনি হয়তো সত্যই দিইনি। খাট থেকে মেঝেতে নেমে এলুম। ছোট্ট পাখির ডিমের মতো জিনিস ভেঙে কুচোকুচো হয়ে পড়ে আছে। ভোরের আলোয় তার অপ্রাকৃত চেকনাই। সবকিছুই আমার কাছে অপ্রাকৃত মনে হচ্ছে আজ। এই লৌকিক জগৎ আর পারলৌকিক জগতের মধ্যে মাকড়সার জালের মতো যে সূক্ষ্ম ব্যবধান, সেই ব্যবধানে আমি একটু ছুঁচ ফোঁটাতে পেরেছি অন্তত। সামান্য এক ছিদ্র। সেই ছিদ্রপথে আমি দেখেছি, আলোর কী নীলিম ঔজ্জ্বল্য, বাতাসের কী সূক্ষ্মতা, বস্তুর কী ভারহীনতা!
এটা টিকটিকির ডিমের চূর্ণ আবরণ না অন্য কিছু, মুক্তোও তো হতে পারে! অ্যানালিসিস হবে পরে, আপাতত তুলে রাখি সাবধানে। পাশের ঘরে দুই মহিলাই কীর্তন শুরু করেছে। ওদের মধ্যে কে একজন টিংটিং করে কী একটা বাজাচ্ছে। সম্ভবত কাসার গেলাসের গায়ে হাতের বালা ঠুকে শব্দটা তুলছে। বেশ ভালই লাগছে। মনে হচ্ছে কোনও এক আশ্রমে ঘুম ভাঙল।
বারান্দায় বেরিয়ে এসে চক্ষু স্থির। খুব মিহি, ধূসর কিছু ছাই পড়ে আছে। বাতাসে ঘুরপাক খেয়ে তালগোল পাকিয়ে লম্বা লম্বা সাপের মতো, কিছু এখানে কিছু ওখানে, কিছু যেন ছাড়া ছাড়া শুয়ো পোকা। ঠিক আমার ঘরের দরজার বাইরে। বুকটা হুঁত করে উঠল। ব্যাপারটা কী!
যার সাহায্যের কথা প্রথমেই মনে এল, সে মুকু। বেশ জোর গলায় ডাকতে হল। ওরা গান গাইছে গেলাস বাজিয়ে। মুকু আর দিদি দু’জনেই বেরিয়ে এল। মুকুর পোশাক দেখে অবাক। একটা সাদা চাদর দু’বগলের তলা দিয়ে ঘুরিয়ে সামনে এনে আড়াআড়ি বুকের ওপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘাড়ের পেছনে একটা গাঁট বাঁধা। বাউলের মতো দেখাচ্ছে মুকুকে। অদ্ভুত এক মজার মেয়ে। একদিনেই দিদিকে অনেক তাজা দেখাচ্ছে। অনিশ্চয়তা কেটেছে আপাতত। একটা নির্ভরতার ভাব এসেছে।
মুকু মেঝের দিকে তাকিয়ে বললে, এসব কী?
সেইজন্যেই তো তোমাদের ডেকেছি। মনে হচ্ছে কোনও কিছুর পোড়া ছাই। বললুম না কাল রাতের দেখা তীব্র আলোর কথা।
মুকু উবু হয়ে বসে বললে, দাঁড়াও, গোয়েন্দাগিরি করি। আঙুল দিয়ে একটা ছাইয়ের নুড়ি নাড়াচাড়া করে বললে, এ তো মনে হচ্ছে ন্যাকড়াপোড়া ছাই। কে কী পোড়াল? কালও তো কিছু ছিল না শুতে যাবার সময়।
হঠাৎ দিদি লাফিয়ে উঠলেন, আরে, আমার থান ধুতিটা কী হল। কাল যে শুতে যাবার সময় এইখানে ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছিলুম।
মুকু উঠে দাঁড়াল, সেকী? সে আবার কী! ধুতিতে আপনা-আপনি আগুন ধরে গেল!
আমি চুপ মেরে গেলুম। অতীত ইতিহাস মনে পড়ল। সেই প্রথম ঘটনা। দেখিনি। শুনেছি। আমার মায়ের শাড়ি এইভাবেই জ্বলে গিয়েছিল। আমার মা তারপরে মাত্র তিনমাস বেঁচে ছিলেন। এরই নাম ‘ইল ওমেন। মেনে নিতে ইচ্ছে করে না। যুক্তিবাদী মন ভৌতিক ক্রিয়াকলাপে বিশ্বাসী নয়। কিন্তু এই তো আর একবার ঘটল সেই একই ঘটনা। এদের সামনে অতীত প্রসঙ্গ তুলে মনোবল ভেঙে দিতে চাই না।
মুকু নাছোড়বান্দা। অনুসন্ধানের উৎসাহে নীচে নেমে গেল। তার ধারণা, চোর এসেছিল। চুরির আগে চোর অনেক খেলা দেখায়। নানারকম তুকতাক করে। আমারও ডাক পড়ল পরক্ষণেই। মুকুর পক্ষে একলা কিছু করা সম্ভব নয়। সঙ্গে একজন অ্যাসিসটেন্ট চাই। তাকে বকবে, ধমকাবে। তবেই কাজ এগোবে। গলায় ওইভাবে চাদর বাঁধা। চুড়ো করা চুল। একেবারে অন্যরকম দেখাচ্ছে। চোর ধরব, না মুকুকে ধরব!
বললুম,তোমার এই অদ্ভুত সাজ কেন?
লাজুক লাজুক হেসে বললে, কীর্তন করছিলুম যে। মুকুরও লজ্জা আছে। কীরকম দেখাচ্ছে?
ফ্যান্টাসটিক।
একটা একতারা কিনে দেবে। রোজ সকালে দিদি আর আমি গান গাইব। লাগ গুমগুম। দিদির গলা যেমন সুন্দর, সেইরকম গানের স্টকও অনেক। সকালটা খুব জমে যাবে। আমার গলাটা কেমন?
বেশ ভাল। গানের চর্চা করো না। বাড়িতে সবই রয়েছে, হারমোনিয়ম, তানপুরা, এসরাজ, তবলা।
তাই তো করব। মেসোমশাই বলতেন, যার যা গুণ আছে, সব ফুটিয়ে তোলো। এমন মানব-জনম আর কি হবে। মন যা করো ত্বরায় করো এইভাবে ॥ কত ভাগ্যের ফলে না জানি। মন রে পেয়েছ এই মানব-তরণী ॥
মুকু সুরেই বলছে। গলা সাবলীল, হঠাৎ থেমে গেল, এই জায়গায় মন রে, বলে বিশাল একটা টান আছে, ওইটা আমি পারব না। দোতলার বারান্দার দিকে তাকাল। উদাসী ভৈরবীর মতো সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন দিদি। মুকু বললে, আপনি পারবেন দিদি?
পারব, তবে আমার এখন সুর কেটে গেছে। বড় খারাপ লক্ষণ, এই কাপড় পুড়ে যাওয়া। আমি আর বেশিদিন নেই।
মুকু বললে, কুসংস্কার ছাড়ুন তো। যত বাজে ধারণা। এই দেখুন না, কারণ আমি খুঁজে পেয়েছি। লেডি শার্লক হোমস।
মুকু নিচু হয়ে দুটো পোড়া দেশলাই কাঠি তুলে আমার চোখের সামনে ধরল, দেখেছ! যা বলেছিলুম তাই। কাল রাতে চোর এসেছিল।
ওটা কোনও প্রমাণ নয়। চোর এসে মশাল জ্বেলে জানান দেবে না, আমি এসেছি, আমি এসেছি বঁধুয়া। তারা নিঃশব্দে আসবে, নিঃশব্দে কাজ সেরে পালাবে।
কেন? তুমি শোনোনি চোর এসে আগে বড় বাইরে করে। নিশ্চয় কোথাও করেছে। খোঁজো। আমি স্যানিটরি ইন্সপেক্টর নই মুকু। চোরের বড়বাইরে খুঁজব!
এটা ইনভেস্টিগেশন। সন্দেহের শেষ রাখতে নেই। দেখছ না! দিদি কীরকম ভয় পেয়ে গেছেন। মুকু হঠাৎ নিচু হয়ে কী একটা তুলল। উৎসাহ দেখে মনে হল মানিক পেয়েছে। আমার চোখের সামনে দু’আঙুলে তুলে ধরে বললে, হোয়াট ইজ দিস?
একটা আধপোড়া বিড়ি। মুকু বললে, তুমি বিড়ি খাও। আমরা শুয়ে পড়ার পর কাল তুমি চুপকে চুপকে বিড়ি খেয়েছিলে?
না, আমার কোনও নেশা নেই।
আমি খেয়েছিলুম? দিদি?
না।
তা হলে এই বস্তুটি এমন জায়গায় এল কী করে? উত্তর দাও।
কেউ ফেলেছে।
বেশ, তা হলে একটা কারক আছে। কারক ছাড়া কার্য হয় না। ব্যাকরণের সাধারণ নিয়ম। কর্তা, কর্ম, করণ, সম্প্রদান, অপাদান, অধিকরণ।
একেবারে হরিশঙ্কর কেটে বসানো। পৃথিবীর যা কিছু তুচ্ছ, অতি তুচ্ছ, গুরু অথবা লঘু, ঘুরে যাবে শিক্ষার দিকে। দুটো গিয়ারে পৃথিবী ঘুরছে। গ্রামার আর ম্যাথেমেটিক্স। মানুষের দেহটা তো পারফেক্ট জিওমেট্রি, ইলিস, স্ফিয়ার, ট্রাঙ্গল, রেকট্যাঙ্গল, অ্যাকসিস, ফালক্রাম। পৃথিবীটা পিয়োর ম্যাথেমেটিক্স, মানুষ হল গ্রামার। একগাদা কারক একে আর-একের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মার্চ করছে।
মুকু বললে, কী হল? বোবা মেরে গেলে কেন? কর্তা ছাড়া কর্ম হয়!
কেউ বাইরে থেকে ছুঁড়ে মেরেছে।
বাইরে থেকে এত দূর ছোঁড়া যায়, একমাত্র আধলা ইট ছাড়া?
তা হলে কাকে এনেছে মুখে করে।
তোমার মুন্ডু! এখানে কাল রাতে কোনও এক ব্যাটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি ধরিয়েছিল। অন্ধকারে আন্দাজ করতে পারেনি। দপ করে ঝোলা কাপড়ে আগুন ধরে গেছে। মেরেছে চম্পট। কেস ডিটেক্টেড। এইবার চা।
মুকু তরতরিয়ে উঠে গেল ওপরে। এইবার তার কাজ শুরু হবে ঝড়ের বেগে। কোনও থামাথামি নেই। কাজের বুলডোজার চালিয়ে দেবে। দিদি উনুন ধরাবেন। নীচে এসেছেন কয়লার খোঁজে। ভাঙা একটা ড্রামে কয়লা। মুকু যতই কর্তা আর কর্ম দেখাক, আমার মনে ঘুরছে সেই এক কুসংস্কার। দিদির একটা কিছু হবেই। তারই বার্তা এসেছে ওই কাপড়ে আগুন ধরে যাওয়ার ইঙ্গিতে। দিদির দিকে তাকিয়ে মনে হল, একটা জাওলা মাছ দেখছি। যে-কোনওদিন ছাই মাখিয়ে আঁশ বঁটিতে কুটবে সে। সে কে? জানি না। মহামান্য, মহাপ্রতাপশালী তিনি। মানুষ পেছন ফিরে থাকলেও অনুভব করতে পারে। জাল ফেলে জলে বসে আছে জেলে।
দিদি টিনের দিকে হাত বাড়াতেই বলে ফেললুম, আপনি না আপনি না। আমি বার করে দিচ্ছি।
দিদি থতমত হয়ে বললেন, কেন ভাই!
আপনার হাত কেটে যেতে পারে।
হাত কাটবে কেন?
যদি যায়।
দিদি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন। সুন্দর মুখটা। অনেকটা কৃষ্ণের মতো। ভীষণ ধারালো। এমন যার টিকোলো নাক, তার নাকে রসকলি কেমন মানাবে। দিদির ঠোঁটদুটো থিরথির করে কাপল কয়েকবার। অতি কষ্টে বললেন, শেষকালে এত ভালবাসা! ঈশ্বর এতদিন যেমন কৃপণ ছিলেন, এবারে একেবারে মুক্তহস্ত। ভাই, একটু-আধটু কেটেকুটে গেলে কী-ই বা হবে! জীবনে কত চোট পেয়েছি!
আপনি জানেন না, মরচে-ধরা টিন কী সাংঘাতিক!
আমি ধুমধাম কয়েক ঢেলা কয়লা বের করে দিলাম। আমার ভয়, টিনের কাটা মানেই টিটেনাস। আর কাটবেই। একটা কিছু হবেই। স্বামী নির্মলানন্দজি আমাকে বারেবারে সাবধান করে দিয়েছেন, নেগেটিভ চিন্তা করবে না। থিঙ্ক গুড অ্যান্ড ইউ গেট পজিটিভ রেজাল্ট কোথায় কী? আমার মন মানে না। লখীন্দরকে যেমন লোহার বাসরঘরে রাখা হয়েছিল, দিদিকেও সেইরকম রাখতে পারলে কিছুটা শান্তি পাওয়া যেত। সে আর হয় কী করে! ঈগলের দৃষ্টি পড়েছে। মানুষ-ইঁদুরটিকে ছো মারবেই।
দিদি কয়লা ভাঙছেন। মনকে বোঝালুম, ও কাজটা তেমন বিপজ্জনক নয়। দিদির পক্ষে ভয়ের হবে আগুন, বারান্দা কি ছাদের আলসে ভেঙে পতন, ভাঙা টিনের খোঁচা, খাবারে বিষক্রিয়া। এই ক’টা থেকে যতদূর সম্ভব সাবধানে রাখতে হবে দিদিকে। একদিনেই ভীষণ মায়া পড়ে গেছে। ভদ্রমহিলার মধ্যে অদ্ভুত একটা মায়া আছে। ভোরের আকাশের মতো। আমার মনে হল, এমন একজন মানুষকে এইভাবে সাতসকালে কয়লা ভাঙতে দেওয়া উচিত নয়। হাত থেকে হাতুড়িটা কেড়ে নিলুম।
উঠুন আপনি। এ কাজ আপনার নয়। হয় মুকু করবে, না হয় আমাদের বাড়ি যে কাজ করে সে ভাঙবে।
কেন ভাই? আমার ঠিক হচ্ছে না বুঝি!
কেন হবে না! আমার এই দৃশ্য সহ্য হচ্ছে না।
তুমি কি জানো ভাই, কিছুকাল আমি বাড়ি বাড়ি রান্না করেছি?
সে যখন করেছেন তখন করেছেন, এখন আপনি আমার দিদি। আমাদের মাথার ওপর থাকবেন, আমাদের আদেশ করবেন। উঠুন আপনি।
হাত ধরে তুলে দিলুম। একটু যত্ন করলে চেহারাটা সুন্দর হবে। তখন আভিজাত্য একেবারে ফেটে পড়বে। একদিকে মুকু, একদিকে দিদি। আবার আমাদের সংসারে পুরনো দিন ফিরে আসবে। শুনেছি, আমাদের বাড়ির দুই বউ খুব বিদূষী ছিলেন। দুই সখীর মতো। নীল সোয়েটার আর ডোরাকাটা পাম শু পরে শীতকালের রোদে বেড়াতে বেরোতেন। সঙ্গে থাকত লোমঅলা সাদা কুকুর। পিতাকে যদি ভারত ছুঁড়ে একবার ধরে আনতে পারি তা হলে তো কোনও কথাই নেই। সুখের বন্যা বইবে।
দিদি ছলছলে চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
কাঁদছেন কেন?
কাঁদিনি ভাই। মন দেখছি মন। এ জল আনন্দের। কানের কাছে যেন দৈববাণী হল, ঠিক করেছ।
ওপর দিকে তাকিয়ে দেখি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মুকু। হাসছে। বেশ পালটে গেছে। সেই চাদর জড়ানো বৈরাগীর বেশ আর নেই।
মুকু একটা ব্যাগ দোলাতে দোলাতে বললে, বাজারের ব্যবস্থা করো। দিদির আজ জন্মদিন।
ওমা সেকী? আমার জন্মদিন! তুমি কী করে জানলে! আমার জন্মদিন তো আমিই জানি না।
আমার মন বলছে, আমার দিদির আজ জন্মদিন। এখন দয়া করে দু’জনে ওই ঢ্যাবট্যাবে জায়গা ছেড়ে ওপরে উঠে এসো। আমার চা হয়ে গেছে।
দিদি আমাকে বললেন, তোমাদের নীচে একটা বাথরুম রয়েছে না? আমি বরং সেটাই ব্যবহার করি।
দিদি, আবার শুরু করলেন! ওটায় খুব বিপদে না পড়লে আমরা যাই না। তাও যাই ভয়ে ভয়ে। ওখানে অন্য অনেক প্রাণীর বসবাস। সাপও আছে। ওদের সুখের সংসারে না-ই বা হামলা করলেন। ওপরে চলুন।
সারা বাড়িটা আমার একবার ঘুরে দেখা উচিত। এই বাড়িরই কোনও একটা ঘরে আমি জন্মেছিলুম।
বাড়ি তো আপনার! সময়মতো ঘুরে দেখবেন। একটাই কথা। ছাতের আলসেতে ভর দিয়ে দাঁড়াবেন না। বাড়ি পুরনো হয়েছে। তেমন আর জোর নেই।
বারান্দায় সবাই মিলে বসা হল চা নিয়ে। আমরা তিনজন কিন্তু চার কাপ। সুদৃশ্য একটা কাপ-ডিশে আলাদা করে রাখা, যেন একটু পরেই কেউ আসবেন। বড় একটা বাটিতে শুকনো মুড়ি। তুলে তুলে নাও আর খাও। খালি পেটে চা চলবে না। মুকুর কড়া নির্দেশ। বিস্কুট চলবে না। বিস্কুট হল বিলাসিতা।
জিজ্ঞেস করলুম, ওই চা কার? আমরা তো তিনজন।
কপাল থেকে বাঁ হাতে চুল সরাতে সরাতে মুকু বললে, বুঝতে পারলে না? তোমার এত বুদ্ধি! ওটা মেসোমশাইয়ের। এই সুন্দর সকালে সুন্দর বারান্দায় বসে আমরা চুমুকে চুমুকে সুগন্ধী দার্জিলিং চা খাব, আর তিনি? তাকে কে চা করে দেবে? জানো, তিনি চা কত ভালবাসতেন! দিনে সাত-আটবার চা খেতেন। আমি তার ছায়ায় আছি। চিরকাল তার ছায়াতেই বাস করতে চাই। আমি ভগবান জানি না। তিনিই আমার ভগবান! আজ হতে মোর ঘরের দুয়ার। রাখব খুলে রাতে। প্রদীপখানি রইবে জ্বালা। বাহির-জানালাতে । মুকু কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল স্বপ্নে-দেখা সেই নদী। উপলখণ্ডের বিস্তার। জল নেই। শিলাখণ্ডে মুখ ফিরিয়ে বসে আছেন তিনি। সেই অভিমানী।