সুবালা তার ভাঙা দাঁতের হাসি হেসে অভ্যস্ত ভঙ্গীতে সকৌতুকে বলে, বল শুনি কেমন লাগলো?
অম্বিকা অবাক হয়।
অম্বিকা যেন আর এক জগৎ থেকে এসে পড়ে।
পারু মানে? পারু কে?
পারু কে কিগো? মেজদার মেয়ে না? এই সুবালাসুন্দরীর ভাইঝি। তোমার সামনে বেরোয় নি বুঝি? না বেরোনোই সম্ভব, বড় হয়েছে তো! তা মেজবৌ কিছু বললো?
অম্বিকা বিচিত্র একটু হেসে বলে, বললেন।
সুবালা আশ্বস্ত গলায় বলে, যাক, তাহলে সেজদা আমার চিঠিটার মান রেখেছে মেজদার নতুন বাড়ির ঠিকানাটা ঠিক জানি না তো, কি জানি পৌঁছায় না-পৌঁছয়, তাই সেজদার কেয়ার অফে মেজদাকে একটা চিঠি দিয়েছিলাম তোমার কথা উল্লেখ করে। তা এখন বল বাপু শুনি, কি সব কথা-টথা হলো? আমার তো ইচ্ছে–এ মাসেই লাগিয়ে দিই।
অম্বিকা যেন একটু গম্ভীর হয়।
বলে ওঠে, কী মুশকিল! আপনি এসব কী যা-তা আরম্ভ করলেন!। এ রকম চালালে। কিন্তু ফের পালাবো!
বলে ওঠে, কী মুশকিল! আপনি এসব কী যা-তা আরম্ভ করলেন!। এ রকম চালালে। কিন্তু ফের পালাবো।
সুবালা শঙ্কিত হয়।
সুবালা বোঝে অবস্থাটা আশাপ্ৰদ নয়। মেজবৌ বোধ হয় তেমন আগ্রহ দেখায় নি। তা হতে পারে, মানুষটা তো আছে একটু উল্টো-পাল্টা! অম্বিকাকে যতই ভালবাসুক, মেয়ের সঙ্গে বয়সের তফাৎটা মনে গেথে রেখেছে। ঠাকুরপোর একটু অপমান বোধ হয়েছে তা হলে। বলতে কি একটু আশায় আশায়ই তো গেল তাড়াতাড়ি! বিয়ের মন হয়েছে, সেটা বুঝতে পারছে সুবালা। ভাবে, যাকগে–পারু না হোক গে, আমি তোড়জোড় করছি। কনের আবার অভাব? আবার ভাবে, তবে অত বয়সের মেয়ে সহসা পাওয়া যাবে না। মেজবৌ ডাকাবুকো, তাই মেয়েকে অতখানি বড় করছে। বসে বসে।
কিন্তু সুবালা চট করে কিছু বলে না, আস্তে দ্যাওরের মন-মেজাজ বুঝতে বলে, শোনো কথা, আমি আবার কী চালালাম?
এইসব বাজে বাজে কথা? বিয়ে-টিয়ের কথা শুরু করলেই কিন্তু জেনে রাখবেন আমি হাওয়া!
সুবালা ভয়ে ভয়ে বলে, মেজদা— বুঝি-
দোহাই বৌদি, আপনার ওই মেজদটির নাম আমার সামনে করবেন না। বসেছিল, উঠে পড়লো। পায়চারি করতে করতে বললো, আপনার ওই মেজদা আর মেজবোঁদিকে পাশাপাশি দেখলেই মনে হয় যেন বিধাতার একটু নিষ্ঠুর বঙ্গের জ্বলন্ত নমুনা!
সুবালা অবাক গলায় বলে, কিসের নমুনা?
যাক গে, ও আপনাকে বোঝানো যাবে না। তবে আপনার পূজনীয় মেজদার বাড়িতে ঢোকবার সৌভাগ্য আমার হয়নি, এইটাই জেনে রাখুন।
সুবালা হতভম্ব গলায় বলে, তবে যে বললে মেজবৌ কথা বলেছে—
হ্যাঁ, বলেছেন, অম্বিকা একটা জ্বালোভরা গলায় বলে, রাস্তায় বেরিয়ে এসে বলেছেন। আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আমায় বৌদি!
তার মানে, মেজদা তোমায় অপমান করেছে! জেলখাটা আসামী বলে বাড়ি ঢুকতে দেয় নি। আস্তে বলে সুবালা, বুঝতে পারছি আসল কথা—
অম্বিকা সহসা স্থির হয়। সামনে সরে আসে। বলে, আসল কথা বোঝাবার ক্ষমতা আপনার ইহজীবনেও হবে না বৌদি। আপনি এতই ভালো যে, এসব কথা আপনার মাথাতেই ঢুকবে না। শুধু বলে রাখি, যদি হঠাৎ কোনোদিন শোনেন আপনার মেজবৌদি। পাগল হয়ে গেছেন, অবাক হবেন না। হয়তো শীগগীিরই শুনতে হবে। … আশ্চর্য, আপনার ওই মেজদার মত একটি শয়তানের কোনো শাস্তি হয় না। না দেয় সমাজ, না দেন। আপনাদের ওই ভগবান।… কিছু মনে করবেন না বৌদি, না বলে পারলাম না। বড় যন্ত্রণা হলো দেখে। ছেলেও তো দেখলাম ঠিক বাপের মতন!
সরে গেল সামনে থেকে, পায়চারি করতে লাগলো। একটা জ্বালোভরা গলার আক্ষেপ শোনা গেল, এইভাবে জীবনের অপচয় ঘটে, এইভাবে এই হতভাগা দেশের কত মহৎ বস্তু ধ্বংস হয়! এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে একদিন সমাজকে।
না, অম্বিকাকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করবার সাধ আর মিটলো না সুবালার। অম্বিকা পায়ে হেঁটে ভারত ভ্ৰমণ করতে বেরোলো। সুবালা বুঝতে পারছে, মুখে ও যতই বলুক, এই ভারতবর্ষটাকে একবার দেখতে চাই, দেখতে চাই বাংলা দেশের মত হতভাগা দেশ আর কোথাও আছে কিনা, তবু বুঝতে পারছে সুবালা, সেসব দেখেশুনে ফিরে আর আসছে না। ছন্নছাড়া ভবঘুরেই হয়ে যাবে!
ওর মা-বাপ থাকলে জীবনটাকে নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলতে পারতো না ও।
অমূল্যের চোখটাও লালচে হয়ে উঠেছিল।
ভারী ভারী গলায় বলেছিল, ওটা তোমার ভুল ধারণা! ওর মা থাকলে যে তোমার থেকে বেশি ভালবাসতে পারতো, একথা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু তা তো নয়, মায়ার বাঁধন সবাইকে বাধতে পারে না! বুদ্ধদেবের কি মা-বাপ ছিল না? নদীয়ার নিমাইয়ের ছিল না। মা, বৌ? আসলে এই জগতের অবিচার-অত্যাচার দুঃখ-দুৰ্দশা দেখে যাদের প্রাণ কাদে, তারা পাঁচজনের মতন খেয়ে শুয়ে দিন কাটাতে পারে না। ঘরে তিষ্ঠোনো দায় হয় তাদের। মা-বাপও বেঁধে রাখতে পারে না, স্ত্রী-পুত্ৰও বেঁধে রাখতে পারে না। তবু ভালই হল যে একটা পরের মেয়ে গলায় গেথে দেওয়া হয় নি। ওর!
দেশ দেশ, স্বাধীন পরাধীন, এই সব করেই একটি হলো ওর— সুবালা চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, এই গায়েই জন্মালো, এই তোমাদের বংশেই বড় হলো, কোথা থেকে যে ওসব চিন্তা মাথায় ঢুকলো, ভগবান জানেন।
তাছাড়া আর কি বলবে সুবালা?
মানুষের জানার সীমানা ছাড়ালেই বলে ভগবান জানেন। একা সুবালা কেন, সবাই বলে। আর খুব যখন কষ্ট হয়, তখন ভগবানের বিচারের দোষ দেয়। সুবালাও দিল।
আর তার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ মুছতে মুছতে ওই ছন্নছাড়ার যাত্রাকালে জোর করে সঙ্গে দিয়ে দিল একগাদা চিড়ের নাড়ু, তিলপাটালী-নারকেলের গজা! যা সব একদা অম্বিকার বড় প্রিয় ছিল।
অম্বিকা মুখে খুব উৎসাহ দেখায়। বলে, বাঃ বাঃ! চমৎকার! পথে পথে ঘুরবো, কোথায় কি জুটবে কে জানে, যেদিন কোথাও কিছু না জুটবে ওইগুলি বার করবো, আর আপনার জয়গান করতে করতে খাবো!
থাক, আর আমার জয়গান করতে হবে না। আমার ওপর যে তোমার কত মায়া আছে তা বোঝাই গেছে।
বুঝে ফেলেছেন তো? বাঁচা গেল! অম্বিকা হাসে। তারপর বলে, রামকৃষ্ণ পরমহংসের সবচেয়ে বড় ভক্ত বিবেকানন্দের নাম শুনেছেন? এক সময় তিনি ঘুরছিলেন পথে পথে, হাতে এক কপর্দকও নেই, মনের জোর করে বললেন, দেখি আমার চেষ্টা ছাড়াই খাদ্য আসে। কিনা! এসে গেল। আশ্চর্য উপায়ে এসে গেল! একটা মিষ্টির দোকানের দোকানী স্বপ্ন দেখলো অমুক জায়গায় এক উপবাসী সাধু এসে বসে আছেন, খাওয়াগে যা তাকে চৰ্য্যচোষ্য লেহ্য পেয়। কাজেই ঠিক করেছি, তেমন অসুবিধেয় পড়লে সাধু বনে যাব!
জোর করে টেনে টেনে হাসে।
সুবালা রেগে উঠে বলে, আহা, সাধু বনে যাবে! তুমিই না বল দেশের ওই গেরুয়াধারীরাই হচ্ছে সর্বনামের গোড়া। ওরাই জগৎ মিথ্যে না কি বলে বলে দেশের লোকগুলোকে কুড়ের বাদশা করে রেখে দিয়েছে! সবাই পরকালের চিন্তাতেই ব্যস্ত, ইহকালের কথা ভাবে না!
বলি, বলবোও। তবে এক-একজনকে দেখলে ধারণা পালটে যায়। যাক আপনি মন খারাপ করবেন না। আমাদের ধর্মের দেশে হরিবোল বললেই অন্ন মেলে!
তাই তো, ভিক্ষে মেগেই যে খাবে তুমি, সুবালা রেগে বলে, তাই ভিটে জমি সর্বস্ব বিক্কিরী করে দিলে!
ওই, ওটাই হচ্ছে সব চেয়ে দুশ্চিন্তার। যে মানুষ ভিটেমাটি বেচে চলে যায় সে কি আবার ফিরে আসে?
অথচ কটা টাকাই বা পেলো?
সুবালার যদি টাকা থাকতো, নিশ্চয় দিয়ে দিতো। বলতো, দেশ বেড়াবার জন্যে ভিটে বেচবে তুমি, আর তাই আমি দেখবো বসে বসে?… কিন্তু ভগবান মেরেছেন সুবালাকে!
অমূল্য সঙ্গে গেল খানিকটা এগিয়ে দিতে।
সুবালাও এলো গরুর গাড়ির সঙ্গে যতটা যাওয়া যায়। তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে দেখতে লাগলো যতদূর পর্যন্ত দেখা যায়।
অনেকক্ষণ পরে যখন উড়ন্ত ধুলোও নিথর হয়ে গেল তখন ফিরে এল, একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আপনমনে বললো, বেটা ছেলে, কোনো বন্ধন নেই, বিয়ে করবো না তো করবো না। ঘর ছেড়ে চলে যাবো তো চলে যাবো! ব্যস! নিন্দের কিছু নেই। পোড়া মেয়েমানুষের সকল পথ বন্ধ! আমাদের মেজবেঁটা যদি বেটা ছেলে হতো, সেও বোধ হয় এই রকম হতো। বিয়ে করতো না সংসারে থাকতো না। মেয়েমানুষ, বন্দীজাত, খাঁচার মধ্যে ঝটপাটানি সার!