২.১২ শাহজাহান অবাক হয়ে গেলেন

২.১২

শাহজাহান অবাক হয়ে গেলেন যখন আওরঙ্গজেবের পক্ষ থেকে আগ্রা দুর্গের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা নিজে এলো তার কাছে। তিনি ইতিমধ্যেই শুনেছেন যে লোকটা উজবেক খলিল উল্লাহ খানের সৈন্য, যে কিনা সেনাপতির সাথে সামুগড়ের যুদ্ধে দারাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এখন তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে মাখদুমী খান। লম্বা, মাখদুমী খানের ডান ভ্রর নিচে সাম্প্রতিক সময়ে কেটে যাবার গোলাপি দাগের চিহ্ন ধূসর দাড়ি। অভিবাদন জানানোর কোন চেষ্টা করল না লোকটা আবার একই সাথে শাহজাহানের স্থির দৃষ্টির দিকে তাকাতেও পারল না। অন্য পাশে সরিয়ে রেখেছে চোখ জোড়া।

আমার পাঠানো বার্তা কেন অগ্রাহ্য করেছ? উত্তর দাও! আমার কন্যারা কোথায়? জানতে চাইলেন শাহজাহান।

শাহজাদী গওহর আরা নিজ ইচ্ছেতেই যমুনার তীরে প্রাসাদে অবস্থানরত শাহজাদী রোশনারার কাছে চলে গেছেন। আপনার অন্য কন্যা রাজকীয় হারেমে অবরুদ্ধ অবস্থায় আছেন।

যত শীঘ্রি সম্ভব শাহজাদী জাহানারার সাথে দেখা করতে চাই আমি। আমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে তার পদমর্যাদা অনুযায়ী আচরণ করা হচ্ছে। তার সাথে।

আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে আপনার কন্যা ভালো আছেন আর তার সাথে কোন দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে না। এটা আমার বলার কথা নয় যে কখন আপনারা একে অন্যের সাথে দেখা করতে পারবেন। আপনার পুত্র আওরঙ্গজেব আপনাকে যা জানাতে বলেছেন দয়া করে তা শুনুন। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে আপনি এখানেই আপনার গৃহে অবরুদ্ধ থাকবেন। আরো নির্দেশ দিয়েছেন যেন আপনার নিরাপত্তার জন্য বাইরে দিন-রাত প্রহরী নিযুক্ত থাকে।

আমার দরজায় সর্বদাই প্রহরী থাকে নিরাপত্তা রক্ষার জন্য। আমার ধারণা, আমাকে কোথাও যেতে বাধা দেবার জন্যই এমনটা করা হচ্ছে?

কিছুই বলল না মাখদুমী খান।

আর আমার পরিচালক আর কর্চিদেরকেই বা কেন পরিবর্তন করা হয়েছে? আমি চিনি না বা বিশ্বাস করি না এমন আগন্তুক আমার সেবা করুক চাই না আমি।

এসব জাহাপনারই আদেশ…।

 জাহাপনা বলতে কাকে বোঝাতে চাও? কার কথা বলছ?

সম্রাট আওরঙ্গজেব।

এরকম তো কেউ নেই। আমি শাহজাহান, হিন্দুস্তানের সম্রাট, আর কেউ নয়।

আমি শুধুমাত্র জাহাপনা, সম্রাট আওরঙ্গজেবের বার্তা বহনকারী। আমি আপনার সাথে তর্ক করব না। কর্কশভাবে বলে উঠল মাখদুমী খান।

অসম্ভব ইচ্ছেশক্তির জোরে এখন পর্যন্ত শান্তভাবে ধীরে ধীরে কথা বলছেন শাহজাহান। নিজের অন্তরের বিষাদকে ঢেকে রেখেছেন। প্রায় তিন সপ্তাহের কাছাকাছি হয়ে গেল দেখেছেন দারার গলিত মস্তক আর জেনেছেন ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের বাস্তবতা। দুর্গের আত্মসমর্পণের আদেশ দেয়ার পরপরই নিজ কক্ষে ফিরে এসেছেন। ভেবেছেন নিজের জীবন শেষ করে দেবেন। কিন্তু শুধুমাত্র জাহানারার চিন্তা, যে কিনা তিনি জানেন তাঁর মতই মর্মবেদনায় ভুগছে আর যাকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারেন না তিনি, তার জন্যই থেমে গেল হাত। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল, অগ্রাহ্য করার দৃঢ় মনোভাব–আর চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা–তার কুচক্রী পুত্রদ্বয়কে, শক্তি সঞ্চয় করতে লাগলেন শাহজাহান-। ধীরে ধীরে অধৈর্য হয়ে উঠতে থাকলেও অপেক্ষা করছেন আওরঙ্গজেব আর মুরাদকে সামনা-সামনি দেখতে পাবার মুহূর্তটুকুর জন্য। বারেবারে অনুশীলন করছেন তাদেরকে কী বলবেন। কিন্তু একজনও আসছে না তার কাছে। এর পরিবর্তে যেমন বিশ্বাসঘাতক তেমনি কাপুরুষ, পুত্রদ্বয় শুধুমাত্র সৈন্য পাঠিয়ে দখল করে নিয়েছে দুর্গ।

হঠাৎ করেই সেনাপতির শব্দের কোন একটা অংশ আঘাত করল শাহজাহানকে। অন্তত এটা বলল, কেন শুধুমাত্র আওরঙ্গজেবের কথা বললে তুমি? বিদ্রোহে তার মিত্র, আমার পুত্র মুরাদের কী খবর?

অবাক হয়ে গেল মাখদুমী খান। আপনি জানেন না?

কীভাবে কিছু জানবো এরকম বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বাস করলে?

আমি ভেবেছি হয়ত কোন পরিচারক আপনাকে জানিয়েছে… আগ্রাতে ফিরে আসার খানিক পরেই আওরঙ্গজেব শাহজাদা মুরাদকে বন্দি করার আদেশ দিয়েছে।

কোন অভিযোগে?

গুজরাটে আপনার সুবেদার থাকাকালীন অর্থমন্ত্রী আলী নাকীকে হত্যা করেছিলেন তিনি। আওরঙ্গজেবের মতে, এটি মানুষ এবং আল্লাহ উভয়ের চোখেই অপরাধ, আর নিজ ভাই হওয়া সত্ত্বেও এমন অপরাধের শাস্তি না দিয়ে পারেন না তিনি।

প্রায় হেসেই ফেলছিলেন শাহজাহান। তিনি ভেবে ভেবে সারা হচ্ছিলেন যে প্রতিদ্বন্দ্বীকে কীভাবে সড়াবে আওরঙ্গজেব তার কপটতা শ্বাসরুদ্ধকর আওরঙ্গজেব নিজে দারার হত্যাকাণ্ডের আদেশ দেয়ার পর ভণিতা করছে ভাইয়ের হাতে একজন কর্মকর্তা খুন হওয়ায় বিস্মিত সে। মুরাদ বাধা দেয়নি?

তিনি বুঝতেই পারেননি যে কী ঘটছে, যখন বুঝেছেন বহু দেরি হয়ে গেছে। আওরঙ্গজেব তাকে তার নিজের তাঁবু থেকে এক মাইল বা সেরকম দূরত্বে নিমন্ত্রণ করেছিলেন একত্রে আনন্দ উদযাপনের জন্য। নিজে কোন রকম পানাহারের বিরুদ্ধে কঠোর হলেও ভাইকে নির্দেশ দিয়েছেন ইচ্ছেমত পান করতে। এরপর এক দেহপসারিণীকে ডেকে পাঠিয়েছেন ভাইকে মালিশ করে দেহসুখ দিতে। নগ্ন অবস্থায় প্রহরী বিহীন ভাইয়ের শিবিরে থাকাকালীন আওরঙ্গজেবের প্রহরীরা এসে বন্দি করেছে শাহজাদা মুরাদকে।

একা, নির্বোধের মত দারার ভূগর্ভস্থ কক্ষে যেতে ভয় পেয়েছিল আওরঙ্গজেব। একইভাবে মুরাদও কেন সাবধান হল না একাকী আওরঙ্গজেবের তাঁবুতে যেতে, এটা জানার পরেও যে বড় ভাইকে খুন করেছে আওরঙ্গজেব, আপন মনে ভাবলেন শাহজাহান। মুরাদের নিজের সৈন্যরা নিশ্চয় কী ঘটেছে জানার পর তাকে বাঁচাতে চেয়েছিল?

এক্ষেত্রে মহান জাহাপনা অসম্ভব চতুরতার পরিচয় দিয়েছেন। উজবেক লোকটার চেহারায় এমন এক হাসি দেখা গেল বোঝা গেল যে আওরঙ্গজেবের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করছে সে। শাহজাদা জানতেন যে সকাল হবার আগপর্যন্ত তার ভাইকে খোঁজ করা হবে না। আর আগেই নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যেন একই রকম দেখতে চারটি হাতি প্রস্তুত করে রাখা হয় ও পর্দা দিয়ে ঘিরে রাখা হবে হাওদাগুলো। বেশিরভাগ তাঁবুতে সবাই ঘুমিয়ে আছে, এমন সময় তিনি শাহজাদা মুরাদকে মদের ঘোরে আচ্ছন্ন করে বসিয়ে দেন একটা হাওদাতে। এরপর আওরঙ্গজেব ভাইদের যেসব সৈন্যদেরকে অর্থ ও উন্নতির লোভ দেখিয়েও নিজের দলে টানতে পারেনি তারা যেন মুরাদকে অনুসরণ করতে না পারে এই উদ্দেশে অন্ধকার থাকতেই প্রতিটি হাতিকে কম্পাস ধরে ভিন্ন ভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দেয়া হয় প্রহরী সহ। বস্তুত পক্ষে, মুরাদকে বহনকারী হাতি চলে যায় দক্ষিণ দিকে, গোয়ালিওর দুর্গে। যতক্ষণে তার বিশ্বস্ত কয়েকজন প্রকৃত ঘটনা জানতে পারে ততক্ষণে পিছু নেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে আর তারা তাই সহজেই স্বীকার করে নেয় পরাজয়।

গোয়ালিওর… চূড়ার উপরে থাকা বিশাল দুর্গ, উজ্জ্বল রঙের দেয়াল আর অসংখ্য কামান রাখার গম্বুজ সমেত একটা দুর্ভেদ্য জেলখানা। মোগলদের অনেক শক্রই এর গভীর নালাগুলোতে উধাও হয়ে গেছে, আর কখনো দিনের আলো দেখার সুযোগ পায়নি।

আমি শুনেছি যে তিনি আপনার দৌহিত্র সিপিরের কাছের একটা কামরাতে বন্দি। বলে চলল সুবাদার।

সিপির? দারার কনিষ্ঠ পুত্র তাহলে এখনো বেঁচে আছে… আপন মনেই আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালেন শাহজাহান।

হ্যাঁ, আওরঙ্গজেব এখনো তার ভাগ্য নির্ধারণ করেননি।

মুরাদ? তাকে নিয়ে কী করবে?

জাহাপনা জানিয়েছেন, যে ভাই তার সাথে ধর্মদ্রোহী দারার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তার রক্ত দেখতে চান না তিনি। তাই, হত্যা করা হবে না। এর পরিবর্তে প্রতিদিন তাকে পোস্ত খাওয়ানো হবে।

একদৃষ্টে উজবেক লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন শাহজাহান। দুজনেই জানেন এর মানে কী। পপি থেকে তৈরি আফিমের এক ধরনের দুধময় রস এই পোস্ত, যাকে এটি খাওয়ানো হয় সেই ব্যক্তি প্রথমে তোতলা, নির্বোধ হয়ে তারপর ধীরে ধীরে এতে বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে মৃত্যুবরণ করে। এটা এত ভয়ংকর একটা পরিসমাপ্তি এর চেয়ে যুদ্ধের ময়দানে ধ্বংস হয়ে যাওয়াও ভালো ছিল।

এক মুহূর্তের জন্য ছেলেবেলার মুরাদের কথা মনে পড়ে গেল শাহজাহানের–অসম্ভব সুদর্শন, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর আর দুঃসাহসী যে কোন পুরুষ গর্বিত হবেন এমন পুত্র পেয়ে। তারপরেও এটাই তার ভাগ্যলিপি প্রথমে আপন পিতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, এরপর আপন ভাই কর্তৃক চক্রান্তের শিকার হয়ে ধীর মৃত্যু, যেটি কিনা শরীর আর চেতনা উভয়কে ধ্বংস করে ফেলবে। মুরাদের দুর্দশা আর পুত্রকে সাহায্য করতে না পারার নিজের অক্ষমতার কথা মনে হতেই এমন একভাবের উদয় হলো শাহজাহানের মনে, যা ক্রোধের সাথে কোনভাবেই খাপ খায় না। হতে পারে এক পুত্রের প্রতি পিতার অনুভূতির প্রমাণ এটি, বিশেষ করে যাই ঘটুক না কেন, সন্তানকে রক্ষা করার প্রবণতা… সন্তান যতই অধঃপতনে চলে যাক না কেন। সম্ভবত নিজ মনে তাঁর পিতা জাহাঙ্গীরও একই রকমটাই অনুভব করেছিলেন তাকে নিয়ে।

সম্রাটের কাছ থেকে আরো কয়েকটা আদেশ নিয়ে এসেছি আমি। শাহজাহানের চিন্তায় বাধা দিল মাখদুমী খান। আপনার কর্মচারীরা ইতিমধ্যেই রাজকোষের চাবি দিয়ে দিয়েছে; কিন্তু আপনার, ব্যক্তিগত রত্ন আমাকে দিয়ে দিতে হবে যেহেতু এরকম অবসর জীবনে আর এগুলো প্রয়োজন হবে না আপনার। বিশেষ করে, মহান তৈমুরের সোনার আংটি আছে আপনার কাছে। আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন আপনার সব রত্নের মাঝে আংটিটি আছে কিনা, তা যাচাই করে নেয়া হয়।

না! আমি কিছুই দেব না–এমনকি ছোট্ট একটা হীরা বা মুক্তাও না। আর যদি আমার পুত্র তৈমুরের আংটি চায় তাহলে তাকে নিজে এসে আমার আঙুল থেকে কেটে নিতে হবে! আত্মপ্রত্যয়ে জ্বলে উঠল শাহজাহানের চোখ জোড়া, ডান হাতের মাঝখানের আঙ্গুলের উপর চেপে ধরলেন বাম হাত, মধ্যমাতে পরে আছে গর্জে ওঠা বাঘ খোদাইকৃত ভারী আংটিটা। আমার পুত্রকে জানিয়ে দিও যে আইনগত সম্রাটের কাছ থেকে এমন চুরি করাতে সে মামুলি একটা চোর বৈকি আর কিছু নয়। আর নিজেকে যতটা সৎ মুসলিম হিসেবে দাবি করে তার নিশ্চয়ই জানা আছে যে এ জীবনে না হলেও পরবর্তী জীবনে এর ন্যায্য পাওনা পাবে সে।

আমি আপনার প্রত্যাখানের কথা আপনার পুত্রকে জানিয়ে দিয়ে পরবর্তী নির্দেশও জেনে নেব।

তাঁর প্রতি উজবেক সেনার অভিব্যক্তিতে আলোচনা শুরু হবার পূর্বের তুলনায় একটু বেশিই শ্রদ্ধার ভাব লক্ষ্য করলেন শাহজাহান। উঠে দাঁড়ালেন, সচেতন আছেন যে বন্দি হওয়া সত্ত্বেও রাজকীয় ক্ষমতার শৌর্য এখনো বহন করছেন তিনি, যা পিতামহ আকবর বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন টিকিয়ে রাখতে।

একটু দ্বিধা করলেও, মোলায়েম স্বরে বলে উঠল সুবাদার, আপনি ভাবছেন আপনি এখনো সম্রাট কিন্তু আজ সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের দিকে যদি নিজের ছাদ থেকে তাকিয়ে দেখেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে সময় আর ঘটনা প্রবাহ কাউকে ছাড় দেয় না।

তুমি কী বুঝাতে চাইছ?

কিন্তু পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল যে যা বলার ছিল বলে ফেলেছে মাখদুমী খান। কক্ষ ছেড়ে বের হয়ে যাবার আগে প্রায় না দেখার মত করেই মাথা নত করে কুর্নিশ করল উজবেক সেনাপ্রধান।

পুরো দুপুর ধরে অসম্ভব হট্টগোল হল শাহজাহানের আবাসস্থলের ওপারে যমুনার তীরে। প্রথম দিকে কোন মনোযোগ দিলেন না তিনি। সমস্ত চিন্তা জুড়ে রইল মৃত পুত্রের কথা, আর জীবিত দৌহিত্র আর পুত্র যারা বেঁচে থাকলেও গোয়ালিওরে অন্তরীণ। সিপিরকেও কি পোস্ত খাওয়াবার আদেশ দিয়েছে আওরঙ্গজেব? মনে হল এ সময় জাহানারা সাথে থাকলে ভালো হত… মেয়েটার সদুপদেশ আর সহজাত বোধের বড় বেশি প্রয়োজন এসময়, যখন অন্ধকার এসে ঢেকে ফেলেছে পুরো পরিবারকে। এমন একটা কারণে সবকিছু বিষবাষ্পে দূষিত করে ফেলেছে যা তিনি এখনো ভাবতে পারছেন না। উচ্চাকাঙ্খ অন্য জিনিস–এর ফলেই মোগলরা প্ররোচিত হয়েছিল মহান আর ভয়ানক সব কাণ্ড ঘটাতে কিন্তু আক্রোশ আর প্রতিহিংসাপরায়ণতা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।

দারার দ্বিখণ্ডিত গলিত মস্তক পাঠানো ইচ্ছেকৃত দ্বেষ। কেন আওরঙ্গজেব তাঁকে এতটা ঘৃণা করে আর এসবের সূচনাই বা কবে থেকে? যখন দারার ভূগর্ভস্থ কক্ষ দেখতে যাবার তাঁর আদেশ অমান্য করেছিল তখন কি ইতিমধ্যেই পিতার প্রতি এত বিষিয়ে উঠেছিল তার মন? সে সময় তিনি এতটাই ক্রোধান্বিত ছিলেন যে পুত্রের অদ্ভুত আচরণের পিছনের কারণ সম্পর্কেও ভেবে দেখেননি… সে কি সত্যিই ভেবেছিল যে দারা তাকে খুন করতে চাইছে আর তার পিতাও এতে সায় দিচ্ছে। নিশ্চয় না। কিন্তু আওরঙ্গজেবের সন্দেহ আর নিরাপত্তার অভাব বোধ দিনে দিনে আরো ঘনীভূত হয়েছে যা শাহজাহান কখনো চিন্তাই করেননি। দারার প্রতি দুর্ব্যবহার আর তাকে হত্যা করাটা ছিল আওরঙ্গজেবের বহুদিনের হিসেব। ঠাণ্ডা মাথায়, শীতল হৃদয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে পিতা আর ভাইয়ের প্রতি যাকে সে অবজ্ঞা আর ঘৃণা করত। এটি ইশারা করছে যে তার পথে হুমকী হয়ে ওঠা সকলকে খতম করে ফেলবে আওরঙ্গজেব। প্রথম দারা, তারপর মুরাদ। এরপরে কার পালা? হয়ত শাহ সুজা–যেখানেই সে থাকুক না কেন–আর তার দৌহিত্র সুলাইমান। সামুগড়ের যুদ্ধের পর দারা আগ্রা ছেড়ে চলে যাবার পর সুলাইমানকে নিয়ে অনেকটা আশা করেছিলেন শাহজাহান। অপেক্ষা করেছেন শুনতে পাবেন যে সেনাবাহিনী নিয়ে আগ্রাতে ফিরে এসেছে সে কিন্তু কিছুই হয়নি। দারাকে হত্যা করার মাধ্যমে আওরঙ্গজেব একটুও দ্বিধা করেনি তার জ্যৈষ্ঠ পুত্র, সিংহাসনের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীকে শেষ করে দিতে। তাই পরিষ্কারভাবে যুদ্ধের ময়দানে হোক অথবা ভাড়াটে গুপ্তঘাতক দিয়েই হোক, সুলাইমানের তাঁবুতে আঘাত করতে পিছপা হবে না সে। একভাবে না একভাবে নিজের পথ ঠিকই করে নেবে আওরঙ্গজেব।

গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে রইলেন শাহজাহানপুরোটাই তিক্ত আর অন্ধকার–শেষপর্যন্ত বাইরের চেঁচামেচি আর হট্টগোল এতটাই বেড়ে গেল যে অবহেলা করার উপায় রইল না। ছাদে যাবার কোন ইচ্ছেই নেই তাঁর যেখান থেকে তাঁকে হয়ত দেখা যাবে। কিন্তু খোদাই করা জালি পর্দার ফাঁক দিয়ে কী ঘটছে বেশ ভালোই দেখতে পাবেন। প্রায় দুইশ ফুট দূরে যমুনার অপর দিকে সৈন্যরা বড়সড় সবুজ রঙের সিল্কের একটি মঞ্চের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে, কিনার পুরো সোনালি। মঞ্চটা দাঁড়িয়ে আছে সবুজ আর সোনালি ডোরা কাটা, চিকন কয়েকটা থামের সাহায্যে। প্রতিটি কোনাতে কাপড়কে টানটান করে বেঁধে রাখার জন্য যে সোনালি দড়ি ব্যবহার করা হয়েছে তাতে সেলাই করে দেয়া হয়েছে উজ্জ্বল রত্ন। শামিয়ানার নিচের ভূমিতে সৈন্যরা পেতে দিয়েছে। বহুমূল্যবান কার্পেট; এছাড়া নদী আর মঞ্চে মাঝামাঝি রাস্তার উপর সারিবদ্ধভাবে আরো কার্পেট পেতে দেয়া হয়েছে যেন মসজিদে জায়নামাজ পাতা হয়েছে। মঞ্চের উভয় পাশে হামাগুড়ি দিয়ে বসে থাকা বাঘের আকৃতির আর প্রায় সেই সাইজেরই ধূপদান জ্বালানো হয়েছে। বাঘগুলোর ভোলা মুখের চোয়াল থেকে এরই মাঝে বের হতে শুরু করেছে সাদা ধোঁয়ার চিকন একটি রেখা। ভেতরে নিশ্চয়ই সুগন্ধি স্ফটিক জ্বালানো হয়েছে।

ইতিমধ্যেই জড়ো হতে শুরু করেছে কৌতূহলী জনতার ভিড়। কী ঘটছে দেখার হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও শামিয়ানার একপাশ থেকে শুরু করে অন্যপাশে গোলাকার বৃত্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যের দল তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে উত্তেজিত চিৎকার চেঁচামেচি। বহুদিন আগেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে–এমনকি তার হত্যাকাণ্ডের আগেই কতটা খামখেয়ালী হতে পারে জনগণ, কতটা অস্থির তাদের স্মৃতি আর বিশ্বস্ততা। অসংখ্যবার ঘোড়া ছুটিয়ে সৈন্যপ্রধান হিসেবে আগ্রা দুর্গে এসেছেন তিনি আর তাঁর পরিচারকেরা উল্লসিত জনতার উপর গইনার টুকরো স্বর্ণ ছুঁড়ে দিয়েছে, শাসকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রজারা। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসাহী মুখগুলোর মাঝে একজনও কি ভাবছে যে তাদের সত্যিকারের সম্রাট বিশ্বাসঘাকতার স্বীকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক ওপারে? হয়ত না। আনন্দ আর স্বল্প মূল্যের মণি প্রিয় শিশুদের মত, কোথা থেকে আসছে সে পরোয়া না করে সবাই নিমগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে অনাগত প্রদর্শনী আর সম্ভবত আওরঙ্গজেবের অকাতরে দান করা অর্থের জন্য।

কোন পরিকল্পনা আঁটছে আওরঙ্গজেবে? খুব বেশি সময় লাগল না উত্তর পেতে। নিম্ন অববাহিকা থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো বিশাল বড় একটা, সমান্তরাল তলা বিশিষ্ট বজরা; এমন নকশা আর কখনো দেখেননি শাহজাহান। যে ডজনখানেক মাঝি বজরার দাঁড় বাইছে, তাদেরকেও চিনতে পারলেন শাহজাহান। সাধারণত দুর্গের দেয়ালের মাঝে সম্রাটের ব্যবহারের জন্য নোঙ্গর করে রাখা নৌকার মাঝি ছিল এরা। পড়ন্ত দিনের সূর্যের আলোয় চকচক করছে শূন্য পিঠ। বহুকষ্টে দাঁড় বাইছে লোকগুলো, শুধুমাত্র যে ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করতে হচ্ছে তা নয়, নৌকার ঠিক মাঝখানে লম্বা, ভারি কিছু একটা ঢেকে রাখা হয়েছে অয়েল ক্লথে মুড়ে। এতটাই ভারী যে পানির মাঝে অনেকটাই ডুবে গেছে নৌকাটা। তীর থেকে বেশ দূরে থাকতেই সৈন্যরা দৌড়ে গিয়ে মাঝির ছুঁড়ে দেয়া রশি ধরে ফেলে নৌকাটাকে টেনে তুলে আনল কর্দমাক্ত তীরে।

এবার অন্য সৈন্যরাও উঠে গেল নৌকাতে। একজন ছুরি বের করে ভারী জিনিসটাকে জায়গা মত আটকে রাখা মোটা দড়ি কাটতে শুরু করে দিল। কয়েক মিনিট লাগল দড়িটা কাটা শেষ হতে আর অন্যরা সবাই মিলে অবশেষে অয়েল ক্লথটাকে সরিয়ে ফেলল। এতক্ষণ কি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল দেখতে পেয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল শাহজাহানের। বারোটি পান্না খচিত পিলার ধরে রাখা গম্বুজঅলা ছাদের সবুজ রঙ জ্বলতে লাগল সূর্যের আলোয়। রত্মখচিত ময়ূর আর পিলারের উপরকার রুবি, হীরা, পান্না আর মুক্তাখচিত গাছগুলো দেখাচ্ছে অবিশ্বস্য রকমের উজ্জ্বল।

এক মুহূর্তের জন্য গর্বিত হয়ে উঠে শাহজাহান ভুলে গেলেন নিজের সব সমস্যা। তিনি, আর তিনি একাই সৃষ্টি করেছেন এই অনিন্দ্য সৌন্দর্য, সাম্রাজ্যের সম্পদ থেকে নিজে পছন্দ করে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ সব রত্ন। রাজা সলোমানের পর থেকে আর কোন শাসকের কাছে এমন একটি সিংহাসন নেই…নিজের রাজত্বের শুরুতে প্রথম যখন চিন্তাটা এসেছিল মাথায়, তখনো তিনি বেশ তরুণ ছিলেন আর অন্তর ছিল আশায় পরিপূর্ণ। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন আবার ফিরে গেলেন সেসব দিনে, যেন সামনে এখনো বাকি আছে গৌরবময় দিনগুলো, পাশে আছে তাঁর পরিবার, কিন্তু তারপরই ঝাপসা হয়ে গেল সব অনুভূতি। ভেঙে পড়েছে পরিবার। এই সিংহাসন আর তাঁর নয়। এই কুচক্রী পুত্র চুরি করে নিয়েছে তার কাছ থেকে। তাকিয়ে দেখলেন দুজন দাঁড়ী মিলে নিচু করে ধরল বজরার সামনের অংশটা। নিশ্চয় এই উদ্দেশ্যেই বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে নৌকাটা। সিংহাসনের পেছনে একদল সৈন্য দাঁড়িয়ে ধাক্কা দেয়া শুরু করল। অতিধীরে আর বহুকষ্টে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এটি সামনে এগোতে লাগল। অবশেষে নৌকা থেকে তীরের কাছাকাছি আসার পর সিংহাসনটাকে দুপাশে রোলার লাগান কাঠের মঞ্চে রাখা হলো দেখতে পেলেন শাহজাহান। এরপর বিশ মিনিট ধাক্কা দেবার পর অবশেষে শামিয়ানার নিচে এনে রাখা হল সিংহাসন, এটির চকচকে, উজ্জ্বল, সম্মুখভাগ রাখা হয়েছে সরাসরি দুর্গের দিকে মুখ করে।

সূর্যাস্তের দিকে, মাখদুমী খান যেমনটা বলেছিল… দিগন্তের দিকে তাকিয়ে শাহজাহান দেখতে পেলেন আর খুব বেশি দেরি নেই সূর্যি মামার পাটে যেত। মনে হল তার মনের কথা বুঝতে পেরেই মুহূর্তখানেক পরে একসাথে বেজে উঠল বাদ্যের বাজনা, মনে হল দুর্গের কাছাকাছি কোন প্রাচীর থেকে। এরপর বিশাল রুপার দাঁড়ের রাজকীয় বজরা–তাঁর নিজের বজরা–ঠিক সেই দিক থেকে উদয় হল যেখান থেকে এসেছিল সিংহাসন বহনকারী বজরাটা। পুনরায় রং করে কারুকাজ করা হয়েছে, সামনে আর পেছনে উড়ছে মোগলদের সবুজ ব্যানার আর ডেকের উপর ছড়িয়ে রাখা হয়েছে গোলাপের পাপড়ি, মৃদু বাতাসে উড়তে লাগল গোলাপি তুষার কণার ন্যায়। জলযানের ঠিক মাঝখানে বড়সড় একটা সবুজ ছাতার নিচে সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে দাঁড়িয়ে আছে আওরঙ্গজেব। পরনে ক্রিম রঙা আলখাল্লা আর গলায় মুক্তার লম্বা মতো। মাথার উপরে সাদা বকের পালকওয়ালা রাজকীয় পাগড়ি আর আঙ্গুলে চমকাচ্ছে মণি-রত্ন। নিজেকে যেভাবে স্থির আর অচঞ্চল রেখেছেন, উন্নত শিরদাঁড়া থেকে শুরু করে উদ্ধত চিবুক সবকিছুতেই প্রকাশ পাচ্ছে গর্বিত আর ক্ষমতার আভা।

পিছনে অনুসরণ করে আসছে আর দুটি নৌকা। ত্রিশ জনের প্রায় প্রত্যেকে, জমকালো পোশাক পরিহিত সভাসদকে চিনতে পারলেন শাহজাহান। কয়েকজন আরঙ্গজেবের সেনাপতি আর অনুসরণকারী অভিজাত বর্গ; কিন্তু তাদের মাঝে এমন কয়েকজন আছে যাদেরকে তিনি তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত ভাবতেন। এমনকি কয়েকজন তো অবরোধের মুখেও দুর্গের প্রতিরক্ষা কাজে সাহায্য করেছিল। আওরঙ্গজেব তাদের সবাইকে কিনে নিয়েছে…নাকি তারা সাধারণভাবেই নিয়তির কাছে মাথা নত করে ফেলেছে?

দৃশ্যটা দেখে দুঃখিত শাহজাহান জালি পর্দা ছেড়ে চলে এলেন কক্ষের মাঝে, নিজের ছোট্ট শিকারি চিতাটা যেমন করে অশান্তভাবে খাঁচার ভেতরে আস্ফালন করে ঠিক তেমন বোধ করছেন এমন–পার্থক্য শুধু এই যে চিতাটা মাঝে মাঝে মুক্ত হয়ে দৌড়ে বেড়াবার স্বাধীনতা পায়। হয়ত আর কখনো মুক্তি পাবেন না তিনি…কিন্তু জানেন যে যা দেখবেন বেদনা শুধু বাড়বে। আবারো ঢাকের বাড়ি আর দামামার ধুমধুম আওয়াজে ফিরে গেলেন জালি পর্দার কাছে।

নৌকা থেকে নেমে রুপার দেহবর্ম পরিহিত আওরঙ্গজেব উত্তর পার্শ্বে বারো জন দেহরক্ষী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সিংহাসনের দিকে। সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করে চলেছে সভাসদদের দল। সিংহাসনের কাছে পৌঁছে, মুহূর্তের জন্য থেমে গেল আওরঙ্গজেব, মুখ তুলে তাকাল আত্যজ্বল শামিয়ানের দিকে। এরপর সোনালি সিঁড়িতে পা দিয়ে উঠে ঘুরে তাকাল, বসল। সভাসদেরাও সার বেঁধে দাঁড়াল তার সামনে। তারপর একটামাত্র ঢাকের বাড়ির সাথে সভাসদবৃন্দ ভূমি শয়ান হয়ে হাত দুপাশে ছড়িয়ে, মাটিতে মুখ ডুবিয়ে প্রাচীন প্রথানুযায়ী কুর্নিশ করল। আবারো বাজনার শব্দে উঠে দাঁড়াল তারা। এরপর আগে খেয়াল করেননি শাহজাহান এরকম এক দাঁড়িঅলা লোক এগিয়ে এলেন সামনে। সাদা আলখাল্লা আর কালো পাগড়ি পরিহিত লোকটাকে দেখে মনে হল মোল্লা। আওরঙ্গজেবের এক ইশরাতে সভাসদদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে আবৃত্তি করতে লাগলেন। শাহজাহান সাথে সাথে বুঝতে পারলেন নতুন মোগল সম্রাটের রাজত্বকালের ঘোষণা স্বরূপ প্রার্থনা দোয়া তেলোয়াত করছেন মোল্লা:

আল্লাহর আর্শিবাদ ধন্য হয়ে এবং অসীম শক্তিশালী চেঙ্গিস খান ও তৈমুর, মহান বাবর এবং হুমায়ুন, আকবর এবং জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের উত্তরাধিকারী হিসেবে…।

নিজের নাম শোনার সাথে সাথে ক্ষণিকের জন্যে দুচোখের পাতা শক্তভাবে বন্ধ করে রইলেন শাহজাহান।

…আমি ঘোষণা করছি যে, আওরঙ্গজেব হলেন হিন্দুস্তানের নতুন সম্রাট। তাঁর গৌরবোজ্জ্বল রাজত্বকালের আলোক শিখা ছড়িয়ে পড়ক জনতার উপর যেন তারা এবং তাদের উত্তরসূরীরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাঁর নামে জয়ধ্বনি করবে আর সূর্যের আলোর মত তাঁর স্মৃতি পৃথিবী থেকে দূর করে দেবে সকল অন্ধকার। দীর্ঘজীবী হোক মহান শাসক।

মোল্লার সুমধুর কণ্ঠে নিজের ঘোষণা শেষ হতেই ডান হাত তুলল আওরজেব। সিংহাসনের পেছন থেকে এগিয়ে আসতে লাগল কর্চিদের সারি। সকলের হাতের ট্রে উপচে পড়ছে। চকচকে ভাব দেখে শাহজাহান অনুমান করে নিলেন যে তারা কী বহন করছে সোনার রুপী, জনতার উদ্দেশে নতুন সম্রাটের পক্ষ থেকে ঐতিহ্যবাহী উপহার। আওরঙ্গজেব মাথা নাড়াতেই, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কর্চিরা। অর্ধেক এগিয়ে গেল ডান দিকে, আরেক দল বাম দিকে অপেক্ষারত দর্শনার্থীদের দিকে। সৈন্যদের কর্ডনের কাছে পৌঁছে বাতাসে ছুঁড়ে মারল ট্রে-র জিনিসগুলোকে, ফলে উপস্থিত জনতার উপর শুরু হল মুদ্রাবৃষ্টি, বন্য হুংকারে ছোটাছুটি শুরু করে দিল মানুষ, নতুন সম্রাটেরা দেয়া উপহার সুলভ মুদ্রার ভাগ পাবার জন্য। এরই মাঝে আরো কর্চিরা এসে পৌঁছল, সাথে নিয়ে এলো সিল্কের আলখাল্লা, সাধারণত সম্মান দেখানোর উদ্দেশ্যে যা কাউকে দান করা হয় আর ছোট ছোট থলে, কোন সন্দেহ নেই এগুলো ভর্তি অর্থ আর রত্নপাথর। একের পর এক সিংহাসনের সামনে এসে সম্রাটের সামনে হাঁটু গেড়ে বসা অভিজাতদের হাতে একেকটা করে থলে তুলে দিতে লাগল আওরঙ্গজেব। শাহজাহান চোখ সরু করে তাকিয়ে রইলেন লম্বাদেহী খলিলউল্লাহ খানকে এগিয়ে যেতে দেখে। আওরঙ্গজেব তাকে উপহার হিসেবে দিল একটি তলোয়ার, শেষ বেলার সূর্যের আলোতে চকচক করতে লাগল মণি-মুক্তি খচিত খাপ। ষড়যন্ত্রে অংশ নেবার পুরস্কার।

আওরঙ্গজেবের কাজ শেষ হতে কমে যেতে লাগল দিনের আলো। নদীর তীরে একটু পর পর জ্বলন্ত মশাল জ্বালানোর জন্য ছোটাছুটি শুরু করে দিল পরিচারকেরা। দুর্গের প্রাচীরের গুলি করার ফোকর থেকে পাওয়া গেল আতশবাজি পোড়ানোর হুশহুম শব্দ। আওরঙ্গজেবের মাথায় উপরের আকাশে জ্বলে উঠল সবুজ আর সোনালি তারা। অদেখা ঢাক বা বাদ বেজে উঠল। হাতে লণ্ঠন নিয়ে ভৃত্যের দল অপেক্ষা করতে লাগল সম্রাট ও তার সভাসদদের নৌকায় তুলে নেয়ার জন্য। রাজকীয় বজরাতে এত আলো জ্বলে উঠল যে চারপাশে যমুনার কালো পানি সোনালি আভা ছড়াতে লাগল।

বিস্মিত শাহজাহান ভাবতে লাগলেন যে এতসব আয়োজনের আসল মানেটা কী। দুর্গের ভেতরে ব্যক্তিগত দর্শনার্থীদের হল ছেড়ে নদীর তীরকে কেন আওরঙ্গজেব বেছে নিল নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করার মঞ্চ হিসেবে? এর এককটাই মাত্র উত্তর…আওরঙ্গজেব এমন একটা স্থান বেছে নিয়েছে যা দুর্গে তার পিতার আবাসস্থলের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত, কেননা সে চেয়েছে, যেমনটা মাখদুমী খান ইঙ্গিত করেছিল, পিতাকে দেখাতে যে সত্যিকারের সম্রাট এখন কে। জালির মাঝে দিয়ে শেষবারের মত তাকিয়ে শাহজাহান দেখতে পেলেন তাঁর পুত্র এখনো স্থির আর খাড়া হয়ে বসে আছে সিংহাসনে, তাকিয়ে আছে সরাসরি তাঁর দিকে, যেন সে জানেই যে পিতা তাকিয়ে আছেন আর অবশেষে এত বছর পরে পিতার পূর্ণ মনোযোগ পেয়েছে সে।

.

২.১৩

আগ্রাতে আমার সাথে দেখা করতে আসতে প্রত্যাখান করেছে সে। দেখ কী লিখেছে…আমি একজন পিতা সুলভ সমস্ত অধিকার হারিয়ে ফেলেছি… জাহানারার সামনে আওরঙ্গজেবের চিঠি বাড়িয়ে ধরলেন শাহজাহান। মাখদুমী খান এখন প্রতিদিন পিতা-কন্যার সাক্ষাতের অনুমতি দিয়েছে।

তাদের কারাদণ্ড শুরু হবার পর থেকে গত ছয় মাস ধরে বহুবার আওরঙ্গজেবকে অনুনয় করে পত্র লিখেছে জাহানারা, যেন পিতার সাথে দেখা করতে আসে সে। যা যা ভাবতে পেরেছে সমস্ত যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে–শাহজাহানের বয়স আর অসুস্থতা, পিতার প্রতি একজন পুত্রের দায়িত্ব, এমনকি একদা তার প্রতি আওরঙ্গজেবের ভালোবাসার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে কেমন করে আগুনে পুড়ে গিয়ে প্রায় মৃত্যুমুখে পতিত হবার পর বোনের শয্যাপাশে থাকার জন্য ছুটে এসেছিল সে। আওরঙ্গজেবের উত্তরগুলো বেশ নস্ত্র কিন্তু শীতল। স্পষ্টতাই বুঝিয়ে দিয়েছে যে পিতার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে আওরঙ্গজেবের স্নেহ ও মনোযোগ পাবার সমস্ত অধিকার হারিয়েছে সে। কিন্তু শাহজাহানকে লেখা আওরঙ্গজেবের নিষ্ঠুর শব্দগুলো পড়ে দম বন্ধ হয়ে এলো জাহানারার।

‘আপনি আমাকে আপনার কাছে আসতে বলেছেন। কিন্তু কেন আসব আমি? এতে আমাদের দুজনের কী-ই বা লাভ হবে? জানতে চেয়েছেন আমার পিতা হওয়াতে আপনার সাথে আমি এমন আচরণ কীভাবে করেছি। কিন্তু আমার কাছে কখনোই একজন পিতা ছিলেন না আপনি; তাই আমার উপর কোন দাবিও করতে পারেন না। আমাকে কখনোই ভালোবাসেননি। অন্য সন্তানদের সুবিধাতে অবহেলা করেছেন মায়ের মৃত্যুর পর থেকে আরো বেশি। উপহাস করেছেন যখন আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম যে, নিজ জীবনে আর সাম্রাজের ক্ষেত্রেও আমাদের ধর্মীয় শিক্ষাগুলোকে আরো কাছ থেকে অনুসরণ করুন।

 ধর্মদ্রোহী দারা আর খুনী মুরাদের প্রতি আমার আচরণকে তিরষ্কার করেছেন আপনি–যেন ব্যাপারটা এরকম যে আমার ভাই হওয়াতে তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া উচিত ছিল আমার। নিজেদের ভাগ্যেরই উপযুক্ত তারা আর আইনের মাঝে থেকেই তাদেরকে শাস্তি দিয়েছি আমি। বস্তুত এমনটা না করলে আমিই নিন্দনীয় হতাম। এর চেয়েও বড় কথা আপনার প্রতিবাদ বিশুদ্ধ কপটতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনি ভুলে যাবার ভান করছেন যে আপনি আমাদের চাচা খসরু আর শাহরিয়ারকে হত্যা করেছেন অন্য কোন কারণে নয়, এই কারণে যে তারা আপনার আর আপনার উচ্চাকাঙ্খর মাঝে বাধা ছিল। অথচ আমাদের লোকদের প্রথানুযায়ী সিংহাসনের উপরে তাদের দাবি আপনার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আপনি, আমি নই, হত্যাকারী–সত্যিকারের অপরাধী।‘

এক কি দুই মিনিটের মত চুপচাপ বসে রইল পিতা আর কন্যা। এরপর শাহজাহান বলে উঠলেন সে যা লিখেছে তাতে খানিকটা সত্যিও আছে। আমার সত্তাইদের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। কিন্তু তোমাদের নিরাপত্তার জন্যেই তারা মারা গিয়েছে–আমার সন্তানদের নিরাপত্তা–আর রাজপরিবারের। তাই মারা গেছে যেন আমার পুত্রেরা, আপন ভাই হিসেবে কখনো এমন বিপদের মুখোমুখি না হতে যা আমার ক্ষেত্রে হয়েছিল। নিজের কাছেও তাদের মৃত্যু নিয়ে সহজ হতে পারি নি কখনো। এখন মনে হচ্ছে অনর্থক হয়েছে সবকিছু…রক্তের প্রাচীন চক্র, পিতার বিরুদ্ধে পুত্র, ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই আবারো শুরু হয়েছে। আমি নিজেকেই দোষ দিচ্ছি। আমি আত্মপ্রসন্নতায় ডুবে ছিলাম যখন আমার উচিত ছিল কঠোর আর উদ্যমী হবার। বিশ্বাস করেছিলাম প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে যে শত্রুতা মোগলদেরকে চুরমার করে দিয়েছে তা কখনো আমার পরিবারে ঘটবে না।

আওরঙ্গজেবের আচরণ এমন হবে তুমি তো জানতে না।

 তুমি বুঝতে পেরেছিলে–তার সম্পর্কে সতর্ক করতে চেয়েছিলে!

না। আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম যে আপনারা দুজন একে অপরের কাছ থেকে দূর সরে যাচ্ছেন। কিন্তু কখনোই ভাবিনি যে অতৃপ্তির বশে আপনার বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ করবে বা দারাকে হত্যা করবে… কেঁপে উঠল জাহানারার কণ্ঠস্বর। নিজেকের শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে পড়তে লাগল আওরঙ্গজেবের পত্রের বাকি অংশটুকু।

‘কিন্তু এখন বাস্তব ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলতে হবে আমাকে। আমি দয়ালু হয়ে নতুন অবস্থার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্যে আপনাকে সময় দিতে চাই। আপনার দুর্ব্যবহার আর অভিযোগ ভরা পত্রগুলোকে মেনে নিয়েছি এমন এক বৃদ্ধের প্রলাপ হিসেবে যার শারীরিক আর মানসিক শক্তি নিঃশেষের দোরগোড়ায় আর যে কিনা মেনে নিতে পারছে না যে সময় বয়ে চলেছে, তিনি আর সম্রাট নন। গত কয়েক মাস ধরে আপনার রাজকীয় মণি-মুক্তা দিয়ে দিতে ক্রমাগত প্রত্যাখান শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। কিন্তু আমার ধৈৰ্য্যও শেষ হবার পথে। হয় আমি যা চেয়েছি তা পাঠিয়ে দেবেন–তৈমুরের আংটি সহ অথবা আপনার কাছে থেকে নিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করব আমি। আশা করছি মর্যাদা বজায় রেখে পদক্ষেপ নেবেন, বাকি আপনার মর্জি।‘

 নড়াচড়ার শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকাল জাহানারা। নিজের সব দামি আর মূল্যবান সম্পদ রাখা চামড়ায় মোড়ানো সিন্দুকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন পিতা। গলায় পেঁচানো পাতলা স্বর্ণের চেন থেকে একটা চাবি নিয়ে খুলে ফেললেন সিন্দুক, ভেতরে হাত ঢুকিয়ে ছড়িয়ে ফেলতে লাগলেন ভেতরের জিনিস–মিনা করা চেন, রুবির হার, পান্না আর হীরা, সোনার ভারী কঙ্কন। কার্পেটের উপর ছড়িয়ে পড়ে আলো ছড়াতে লাগল সবকিছু।

পিতা, কী করছেন আপনি?

সে আমার সিংহাসন চুরি করেছে; কিন্তু কিছু জিনিস কখনোই তার হবে না…যেমন তৈমুরের আংটি, সেটি আমার সাথে কবরে যাবে–অথবা এটি!

বলার সাথে সাথে বের করে আনলেন যেটি খুঁজছিলেন, গাঢ় সবুজের ভেলভেটের একটা রোল। খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে কার্পেটের উপর উপুড় করে দিলেন, বের হয়ে পড়ল একটা লম্বা, তিন প্রস্থ সুনিপুণ, দীপ্তিমান আর মসৃণ মুক্তার মালা। আমার পিতা এটা আমাকে দিয়েছিলেন যখন আমি আমার প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলাম। কোন এক সময় এটি ছিল পিতামহ আকবরের।

খানিকটা কষ্ট করে দাঁড়িয়ে, ডান হাতে মুক্তার মালাটা ঝুলন্ত অবস্থায় কক্ষের কোণার দিকে হেঁটে গেলেন শাহজাহান। তারপর আবার হাঁটু গেড়ে বসলেন; এবার বড়সড় একটা খোদাই করা কার্পেটের বাটখারার পাশে। নিজের সামনে মুক্তগুলো ছড়িয়ে দিয়ে, দুহাতে তুলে নিলেন বাটখারা, সজোরে নামিয়ে এনে গুঁড়ো করতে লাগলেন মুক্তাগুলোকে। কয়েকটা চূর্ণ হয়ে গুঁড়ো হয়ে গেল বাকিগুলো গুঁড়ো একত্রে বেঁধে রাখা সিল্কের দড়ি থেকে মুক্ত হয়ে মেঝেতে গড়িয়ে গেল।

আব্বাজান আব্বাজান, দয়া করে থামুন! কিন্তু জাহানারার দিকে কোন মনোযোগ নেই শাহজাহানের। ভয়ংকর মনে হল এই শীতল অভিব্যক্তি। মনোযোগ দিয়ে একের পর এক মুক্তা গুঁড়ো করে সূক্ষ্ম সাদা ধুলার মেঘ বানিয়ে চললেন শাহজাহান। শেষ করে চোখ তুলে তাকালেন মেয়ের দিকে। কঠিন পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছেন, বুকের ওঠানামার সাথে দেখা গেল চিকচিক অশ্রুবিন্দু।

*

জাহানারার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল রোশনারা। তৈমুরের আংটি খুঁজে পেতেই হবে।

ঘণ্টাখানেক আগে বাদ্যের আওয়াজে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল জাহানারা। শশব্যস্ত হয়ে বাইরে এসে দেখে একদা তার থাকা রঙিন হাতিটা বন্ধ রুপালি হাউদাতে করে বোনকে নিয়ে আস্তে আস্তে প্রবেশ করছে হারেমের আঙিনাতে। রোশনারার পরনে জমকালো সোনালি অ্যামব্রয়ডারী করা মেরুন সিল্কের পোশাক। আঙ্গুলে চমকাচ্ছে রত্নপাথর আর গলাতেও একই। হেনায় রাঙানো চুলে জড়ানো হয়েছে রুবি বসানো সোনার সেট। অথচ রং না লাগান হলে চুলগুলো একেবারে জাহানারারই মতন ধূসর। এখন জাহানারা জানে যে এত মাস পরে আগ্রা দুর্গে রোশনারা কেন এসেছে।

ইতিমধ্যেই তোমাকে জানিয়েছি যে আমি জানি না আব্বাজান এটি কী করেছেন। নিজের বাকি সব রত্ন তো দিয়ে দিয়েছেন..যথেষ্ট হয়নি?

না। তৈমুরের আংটিই হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় পারিবারিক নিদর্শন। আওরঙ্গজেব জানিয়েছে যে আব্বাজানকে অবশ্যই মনে করাতে হবে।

এ কারণেই মাখদুমী খানকে সরিয়ে তার প্রধান নপুংসককে সুবাদার বানিয়েছে?

হ্যাঁ। আওরঙ্গজেবের ধারণা মাখদুমী খান পিতার প্রতি একটু বেশিই প্রশ্রয়শীল ছিল। পিতার জেদ আর একগুয়েমিতাকেও বাহবা দিয়েছে। কিন্তু ইতিবার খান নিজের দায়িত্ব ঠিকই আরো ভালো করে বুঝবে।

আব্বাজানকে আবাসকক্ষ ছেড়ে বাগানে হাঁটতেও প্রত্যাখানের মাধ্যমে? পিতার পরিচালকদের সংখ্যা আরো কমিয়ে দেয়ার মাধ্যমে? তাঁর সাথে দেখা করার জন্য আমার উপর বাধা আরোপের মাধ্যমে?

হ্যাঁ, সবকিছুই হয়েছে আওরঙ্গজেবের আদেশে।

এটা তো একজন বৃদ্ধ মানুষের প্রতি আক্রোশ আর প্রতিহিংসা ছাড়া আর কিছুই নয়–তার আপন পিতা।

আংটি না পাওয়া পর্যন্ত সুস্থির হবে না আওরঙ্গজেব। তুমি জানো সে কতটা অবাধ্য হতে পারে।

পিতাও একইভাবে একগুয়ে। আর এর কারণও আছে। তুমি আর আওরঙ্গজেব জানো না যে এই আংটির কী মানে তার কাছে? আওরঙ্গজেব তো বাকি সব জিনিস নিয়েই নিয়েছে–দিল্লিতে লাল দুর্গে যে ময়ূর সিংহাসনে বসে আছে সে এখন, রাজকোষ, মোগলদের সব প্রাসাদ আর জায়গীর সমূহ। এখনো কি তার তৃপ্তি হয়নি? নিজেকে একজন সম্রাট মনে করে সে কিন্তু আচরণ করছে দুর্বলের উপর ডাকাতির মত।

এই ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না আমি। দুর্গে তোমার সাথে দেখা করিতে এসেছি, কারণ আওরঙ্গজেবই এমনটা বলেছে। তার বিশ্বাস তুমি চাইলেই আব্বাজানকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারো। যদি তুমি এ কাজে সাহায্য কর তাহলে তোমার জন্য আরো আয়েশের ব্যবস্থা করে দেবে সে। আর যদি তুমি প্রত্যাখান কর…

আওরঙ্গজেবকে বলল যে আমি আব্বাজানকে বোঝাতে চেষ্টা করব যেন আংটিটা দিয়ে দেয়, কিন্তু কোন পুরস্কারের আশায় বা হুমকির ভয়ে নয়। পিতার জন্যই এটা করব আমি। যতবার আওরঙ্গজেব আংটি চায়, আব্বাজান এত উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে আমি ভয় পেয়ে যাই। আমি চাই তাঁর জীবনের বাকি দিনগুলি যেন শান্তিতে আর নিরুপদ্রবে কাটাতে পারেন তিনি–তোমারও ঠিক তাই করা উচিত।

কিছুই বলল না রোশনারা।

এতগুলো মাস ধরে তোমার কাছ থেকে কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা। করেছি আমি। বলে চলল জাহানারা, ভেতরে উথলে উঠছে আবেগ। যদি তুমি আমাদেরকে দেখতে নাও আসতে পারো আমাকে অথবা আব্বাজানকে কয়েকটা শব্দ লিখে পাঠাতে কি খুব বেশি কষ্ট হত? তোমার নিশ্চয় জানা ছিল যে দারার মৃত্যুতে কেমন অনুভূতি হবে পিতার? তুমি কি জানতে যে আওরাঙ্গজেব দারার খণ্ডিত মস্তক পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে? কল্পনা করে দেখো থলে থেকে বের করে এটা দেখে কেমন লেগেছে তাঁর…এমন নিষ্ঠুর আচরণ করতে আওরঙ্গজেবকে থামাতে পারোনি তুমি? নাকি এতে কিছুই যায় আসে না তোমার?

আমি জানতাম না আওরাঙ্গজেব কী করতে যাচ্ছিল। আস্তে করে বলে উঠল রোশনারা। বিশ্বাস করো যদি আমি জানতাম, চেষ্টা করতাম তাকে রুখতে। কিন্তু দারার জন্যে খুব বেশি দুঃখিত হতে বলো না আমায়। আওরাঙ্গজেব যা করেছে সাম্রাজ্যের জন্যেই করেছে।

আওরঙ্গজেব সবসময়কার মত শুধু নিজের ভালোটাই দেখেছে যেমন তুমি সবসময় তাই করেছ যা তোমার জন্য ভালো। সিল্ক আর মণি-মুক্তা জড়িয়ে কেন এসেছ? যেন আমি ঈর্ষিত হয়ে উঠি। তোমার কি ধারণা ভাইয়ের রক্ত হাতে মেখে তুমি সাম্রাজ্যের প্রধান রমণী হয়ে উঠলেই আমি হিংসা করব তোমাকে? আমি শুধু আশ্চর্য হয়ে ভাবছি যে কেমন ধরনের নারী হলে তুমি কোন দয়া নেই, সহানুভূতি নেই, সচেতনতা নেই ঠিক তোমার আঙ্গুলের হীরেগুলোর মতই–শক্ত।

লজ্জিত হবার মত কিছু করিনি আমি। আমার উপস্থিত যদি তোমার জন্য পীড়াদায়ক হয়ে উঠে, চলে যাবো আমি। যদিও তোমার জন্য কয়েকটা সংবাদ নিয়ে এসেছিলাম।

কী সংবাদ?

 ভ্রাতুস্পুত্র সুলাইমানকে বন্দি করা হয়েছে।

তৎক্ষণাৎ শাহজাহানের কথা মনে পড়ে গেল জাহানারার। দুঃখে জর্জরিত হয়ে যাবেন তিনি এ কথা শুনলে। কীভাবে কী হয়েছিল?

দারাকে বন্দি করার পর সুলাইমানের বাহিনী তাকে ছেড়ে যায়। সে নিজেও তখন উত্তরে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ধরা পড়ে যায় আওরঙ্গজেবের এক সেনাপতির হাতে। শিকল দিয়ে বেঁধে দিল্লিতে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে। দর্শনার্থীদের কক্ষে ভাইয়ের সামনে হাজির করা হয়। নারীদের অংশ থেকে সব দেখেছি আমি।

কী শাস্তি ঘোষণা করেছে আওরঙ্গজেব? প্রায় ফিসফিস করে জানতে চাইল জাহানারা।

দয়া দেখিয়েছে। গোয়ালিওয়র দুর্গে পাঠিয়ে দেবার আদেশ দিয়েছে।

মুরাদের মত পোস্ত খেতে?

প্রথমে উত্তর দিল না রোশনারা। এরপর আস্তে করে বলে উঠল, আরো একটা ব্যাপার আছে যা তোমার জানা দরকার। মুরাদ মারা গেছে।

আফিমের প্রভাবে?

না। মুরাদ যে কর্মচারীকে খুন করেছিল, আলী নাকীর ভাইয়ের হাতে। লোকটা আওরঙ্গজেবের কাছে দরখাস্ত দিয়ে জানায় রক্ত অথবা অর্থের মাধ্যমে মৃতের রায় পাবার অধিকার আছে তাদের। ন্যায়বিচার করতে চেয়েছে আওঙ্গজেব। স্বর্ণ দেবার প্রস্তাব করা হয়েছে লোকটাকে। কিন্তু প্রত্যাখান করে জানের বদলে জান চেয়েছে। আলী নাকীর ভাই।

আর আওরঙ্গজেবও রাজি হয়েছে নিশ্চয়। বলে উঠল জাহানারা। আইনের নামে প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দেয়াটা কত সহজ। হয়ত আওরঙ্গজেব নিজেই লোকটিকে এগিয়ে আসতে উৎসাহ দিয়েছে…

আর কোন উপায় ছিল না আওরঙ্গজেবের। লোকটাকে বলেছিল মুরাদকে ক্ষমা করে দিতে। ভাইসুলভ মনোভাব নিয়ে দায়িত্ব এড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু জনসমক্ষে মুরাদের হত্যার আদেশ দিতে হয়েছে। পরবর্তীতের ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকায় লোকটাকে পুরস্কৃতও করেছে আওরঙ্গজেব। কেননা বিক্রি হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে লোকটা। যেমনটা মুরাদ বলেছে, স্বর্ণ দেখে অনেকেই লোভ সামলাতে পারে না।

বাকরুদ্ধ হয়ে গেল জাহানারা। যেন বহুদূর থেকে ভেসে এলো রোশনারার কণ্ঠস্বর, কিন্তু এখন যেতে হবে আমাকে। আংটি সম্পর্কে খবর পাঠিয়ে দিও। সিল্কের মর্মর-ধ্বনি তুলে চলে গেল তার বোন।

তো মুরদাও মারা গেছে…অন্তত পোস্ত খাবার হাত থেকে তো বেঁচে গেছে। কিন্তু বন্দি সুলাইমানের কী হবে, হয়ত এতদিনে পপি খেতে খেতে চলে গেছে অনেক দূর, ধ্বংসের কাছাকাছি… পরিষ্কার হয়ে এলো জাহানারার ভাবনা। মুরাদের জন্য কিছুই করা যায়নি, কিন্তু ভ্রাতুস্পুত্রকে এখনো সাহায্য করতে পারবে সে। তৈমুরের আংটির বিনিময়ে আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে কথা নিতে হবে সুলাইমানের কোন ক্ষতি হবে না। পিতাকে যতটা জানে সে, নিশ্চিত মানা করবেন না তিনি।

.

২.১৪

আগ্রা দুর্গ, জানুয়ারি ১৬৬৬

আওরঙ্গজেব আমাকে প্রত্যাখান করেছে। আমি ভেবেছিলাম যে মেনে নেবে। লিখেছে যে দক্ষিণে তার অভিযানে অনেক খরচ হয়ে গেছে। তাই বহুমূল্যবান কোন দালান নির্মাণ করতে পারবে না। একজন বৃদ্ধের অতি কল্পনা হিসেবে খারিজ করে দিয়েছে আমার পরিকল্পনা, বলেছে এই ব্যাপারে আর কোন প্রশ্ন না তুলতে…

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল জাহানারা। হৃদয়ের গভীরে জানতে পেরেছিল এটা ঘটার কোন সম্ভাবনাই নেই, তারপরেও আশা করেছিল হয়ত মেনে নেবে আওরঙ্গজেব। বহুদিন ধরেই পিতার স্বপ্ন ছিল নিজের সমাধি হিসেবে তাজের মত কালো মার্বেলের ইমারত তৈরি করা যমুনার ওপাড়ে।

দুঃখ পেয়ো না। অন্তত আজকে নিজের জন্মদিনের দিন। নিজের শ্রেষ্ঠ সিল্ক আর মণিমুক্তি দিয়ে বেশ পরিধান করেছে সাবধানী জাহানারা। রান্নাঘরে বিশেষভাবে নির্দেশ পাঠিয়েছে যেন পিতার পছন্দের পদগুলো তৈরি করা হয়, যদিও জানে তিনি বেশি খান না। খাবারের আগ্রহ দিনেকে দিন কমেই যাচ্ছে। যদিও মন ভরল না শাহজাহানের।

আওরঙ্গজেব ঠিক কথাই বলেছে। আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমার মত এত বয়স পর্যন্ত আর কোন মোগল সম্রাটই বেঁচে থাকেননি। সবচেয়ে দীর্ঘজীবী আকবরও মৃত্যুবরণ করার সময়ে আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট ছিলেন।

চুয়াত্তর বছর বয়স এত বেশি কিছু নয়, পিতা… কিন্তু বলতে গিয়েও জাহানারা খেয়াল করল শাহজাহানকে কতটা দুর্বল আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে। জন্মদিন যতই এগিয়ে আসছিল ততই দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন শাহজাহান। আর অতি ধীরে হলেও গভীরভাবে বোঝা যাচ্ছে বয়সের ছাপ। গত কয়েক সপ্তাহে তো নিজের আরামদায়ক আবাসকক্ষ ছেড়ে বাইরে যাননি বলা চলে, দুর্গের নিচে যমুনার ডান দিকে বাঁকের কাছে তাজমহলের দিকেও তাকাননি।

একদা সৈন্য প্রধান হিসেবে ঘোড়া ছুটিয়ে চলার সময় কত সুদর্শন আর শক্তিশালী দেখাত তার পিতাকে; কিন্তু এখন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে সেই পেশীবহুল যোদ্ধার কাঠামো। সময় বড় বেশি কঠিন আচরণ করছে তার সাথে, হয়ত বেশিরভাগ মানুষের সাথেই এমন হয়, কিন্তু তাঁর মত নিষ্ঠুর নয় নিশ্চয়ই আপন রক্ত আর মাংস। শাহজাহানের কারাবাসের সাত বছরের মধ্যে আওরঙ্গজেব একবারও তাকে দেখতে আসেনি অথবা স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটা চিঠি লিখেনি। যে কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর শোনা যেত রোশনারার মাধ্যমে…বোনের কাছ থেকেই জাহানারা আর তার পিতা অবশেষে জানতে পেরেছিল যে সাম্রাজের পূর্বাংশের কোথাও হারিয়ে গেছে শাহ সুজা। সুলাইমানের সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে বন্য আরাকানীয় জলদস্যুদের ভূমিতে চলে যায় শাহজাদা আর কখানোই দেখা যায়নি তাকে। একদা একে অন্যের কাছাকাছি থাকা চার ভাইয়ের মাঝে একজনেই শেষপর্যন্ত জীবিত থাকে…আওরঙ্গজেব।

তুলা রাশির জাতক হিসেবে আমার জন্ম হয়েছিল…বলে চললেন শাহজাহান। জাহানারা অনুমান করতে পারলো এরপরে কী বলবেন তিনি। আগেও বহুবার এ কথা শুনেছে সে। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান আমার জন্ম মুহূর্তে ঠিক সে রকম ছিল যেমন ছিল তৈমুরের বেলায়। পিতামহ আমার নাম রেখেছিলেন খুররম হাসিখুশি। তিনি বলেছিলেন আমি নাকি ছিলাম রাজকীয়তার টুপির উপরে একটি রেশমী ফিতা আর সূর্যের চেয়েও বেশি জ্যোতিষ্মন। ডিভান থেকে চোখ তুলে কন্যার দিকে তাকালেন শাহজাহান আর চেহারায় এমন এক হাসি ফুটিয়ে তুললেন দেখে মনে হল জরা চলে গিয়ে উঁকি দিয়ে গেল সেই আগেকার মানুষটা। জাহানারা খুশি হয়ে উঠল যে অতীত তাকে এতটা খুশি করে দেখে। বর্তমান তো অন্ধকারে ভরা, যদিও আওরঙ্গজেব তাদের কারাবাসে আরাম আয়েশের উন্নতি ঘটিয়েছে। আবাসস্থল আসবাবপত্র আর যথেষ্ট সংখ্যক ভৃত্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা হারিয়ে এসবে কিই বা লাভ হল? প্রায়ই তাকিয়ে দেখে পিতা চেয়ে আছেন যমুনা তীরে তাজমহলের দিকে। তার একান্ত বাসনা ছিল তাজমহলে গিয়ে নিজের হাতে গড়া উদ্যানে ঘুরে বেড়াবেন। কিন্তু প্রতিবারই আওরঙ্গজেব প্রত্যাখান করেছে। দুর্গ ত্যাগের অনুমতি দিতে।

পিতা, আমাকে সেই গল্পটা আরেকবার বলল–কীভাবে আমার দাদাজানের বাবা আগ্রার রাস্তা দিয়ে ছোট্ট বাচচা হাতির পিঠে চড়িয়ে তোমাকে রাজকীয় মসজিদের বিদ্যালয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন লেখাপড়া শুরু করার উদ্দেশ্যে। এটা শুনতে আমার বেশ ভালো লাগে…

এটা মিথ্যে কথা নয়। জাহানারা পিতার শৈশবের কথা শুনতে সত্যিই মজা পায়, কিন্তু তার চেয়েও শাহজাহান বেশি খুশি হয় সেসব দিনের কথা বর্ণনা করতে। এখন পিতার মোলায়েম নিচু স্বর শুনতে গিয়ে নিজের সামনে ঠিক যেন দেখতে পেল সেই ছোট্ট ছেলেটাকে পুরোপুরি চার বছর, চার মাস আর চার দিন বয়সে যেমনটা ছিল ঐতিহ্য–জমকালো সাজে সজ্জিত আকবরের হাতির ঠিক পাশেই, উত্তেজিত হয়ে চারপাশের উল্লসিত আর গোলাপের পাপড়ি ছুঁড়তে থাকা জনতার দিকে তাকিয়ে…জাহানারার চোখের সামনে ভেসে উঠল, পাগড়ি পরে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা হিন্দুর পাশপাশি মুসলমান পণ্ডিতদের দৃশ্য, বিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখে অপেক্ষা করছে শিশুটিকে ভেতরে নিয়ে যাবার জন্য যেন নিজের শিক্ষা জীবন শুরু করতে পারে শাহজাদা।

কিন্তু শাহজাহান তার গল্পের মাত্র মাঝামাঝি পর্যায়ে আসতেই জাহানারা দেখতে পেল চোখ বন্ধ করে ফেললেন তিনি, মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে নড়তে লাগল। গত কয়েকদিন ধরে একটু বেশিই ঘুমাচ্ছেন তিনি। বিরক্ত যাতে না হন তাই নিঃশব্দে নিজের আসন ছেড়ে উঠে গরাদবিহীন জানালার কাছে গেল জাহানারা। প্রথম দিকে নিজের পা জোড়াও মনে হল ভারী, কিন্তু তারপর মনে পড়ল তার নিজেরও বয়স হচ্ছে–এপ্রিল মাসে বয়স হয়ে যাবে বাহান্ন। চুলগুলো, যদিও এখনো বেশ ঘন, বহুবছর ধরে না দেখা কাশ্মিরের তুষারের ন্যায় সাদা হতে শুরু করেছে। যাই হোক, তাকে কেমন দেখাচ্ছে তাতে আর কিই বা যায়। আসে? তাকে দেখার জন্য বেশি কেউ নেই এখন…

জানালা দিয়ে দেখা গেল এক তরুণ উট নিয়ে যমুনা নদীতে নেমে গেছে পানি খাওয়ানোর জন্য, নদীর তীরে ছেলেমেয়েরা ছুটছে, চিৎকার করছে। খুশি হয়ে উঠল জাহানারার মন। তার পরেও বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যথা করে উঠল ছেলেমেয়েদের উদ্দামতা আর সহজ-সরল আনন্দ দেখে। সেই তুলনায় তার নিজের অস্তিত্ব কতটা আবদ্ধ আর সংকীর্ণ। তারপরেও বলতে হবে তরুণ বয়সে তার জীবনও পূর্ণ ছিল প্রাণ প্রাচুর্য আর জনগণে–মা, ছয় ভাই-বোন, দরবারের অন্তহীন হৈ-চৈ আর কার্যক্রম, তাদের বিভিন্ন ভ্রমণ, বিভিন্ন পরিচারিকা যারা অবশেষে তার বন্ধু হয়ে গেছে, যেমন সাত্তি আল-নিসা, তাজমহলের মাটিতে এখন নিজের সমাধিতে চির নিদ্রায় শুয়ে আছে… আর অবশ্যই ছিল নিকোলাস ব্যালান্টাইন।

মৃত্যুর কয়েক মাস পূর্ব সাত্তি আল নিসা দুর্গে আসা নিকোলাসের একটা চিঠি চুরি করে এনেছিল। ইংল্যান্ড থেকে এসেছে ভ্রমণের তারিখ ছিল আরো এক বছর আগেকার। সহজভাবেই লেখা ছিল যে নিকোলাস দেশে পৌঁছে বাস করছে ভাইয়ের জমিদারিতে কিন্তু হিন্দুস্তানের গরম আর রং এর পাশাপাশি দরবারে তার বন্ধুদেরকেও অনেক হারানোর বেদনা অনুভব করছে।

চিঠিটা পড়তে গিয়ে অশ্রুতে ভরে গিয়েছিল জাহানারার চোখ। স্বস্তি পেয়েছে এই ভেবে যে, যাক অবশেষে নিজের ঠাণ্ডা, বৃষ্টিস্নাত দ্বীপে ফিরে যেতে পেরেছে নিকোলাস, কিন্তু প্রায়ই অবাক হয়ে ভাবে যে লোকটা কি সত্যিই সুখী সেখানে গিয়ে? বিমর্ষতা আর অপূর্ণ আশা তো জীবনেরই অংশ, যেই হোক না কেন শাহজাদী অথবা নিকোলাসের মত অভিযাত্রী অথবা একেবারে নগণ্য গ্রামবাসী সবার বেলাতেই একই কথা খাটে।

*

হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গেল জাহানারার। শেষ দিকের শীতের প্রভাতের হালকা আলো এসে পড়েছে ঘরের মাঝে, গরাদের চারপাশে জটিল খোদাইকৃত কারুকাজের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে, হেঁটে হেঁটে জানালার কাছে গেল জাহানারা, তাকাল বাইরের কুয়াশার দিকে, বছরের এই সময় যমুনা প্রায়ই এভাবে ঢেকে থাকে। হঠাৎ করেই একটু কেঁপে উঠল মন, ঠাণ্ডাতে নয়, যদিও সকালটা বেশ ঠাণ্ডাই, কিন্তু কি যেন মনে হলো। এখনি পিতার কাছে যাওয়া দরকার, দুসপ্তাহ আগে জন্মদিনের পর থেকে শাহজাহানের শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। কেন এরকম বোধ হচ্ছে সে কথা না ভেবেই পরিচারিকাকে ডেকে দ্রুত পোশাক পরে নিল জাহানারা।

এক ঘণ্টার চার ভাগের এক ভাগেরও কম সময়ের মাঝে গরম পোশাক পরে আর ওড়নার বদলে চেহারার উপর নরম কাশ্মিরি শাল জড়িয়ে ত্রস্তপায়ে পিতার কক্ষের দিকে ছুটল শাহজাদী। পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল দুজন হারেমের নপুংসক আর অনুসরণ করল তার নিজের দুজন নারী ভৃত্য। গজদন্ত দিয়ে তৈরি দরজার কাছে পৌঁছে নপুংসকদ্বয় করাঘাত করল হাতে থাকা লাঠি দিয়ে, ভেতর থেকে দরজা খুলে যেতেই সরে দাঁড়াল জাহানারাকে প্রবেশ করতে দেবার জন্য।

আব্বাজান এখনো উঠেননি? রুপালি চুলের পাঠান, শাহজাহানের বয়স্ক প্রধান ভৃত্যের কাছে জানতে চাইল জাহানারা।

হ্যাঁ, মাননীয় শাহজাদী। বলতে শুরু করল লোকটা আর স্বস্তি ফিরে পেল জাহানারা। প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে জেগে গেছেন তিনি যখন আমরা নিত্যকার মত দেখতে এসেছিলাম তাঁকে। জানিয়েছেন যে তিনি উঠতে চান না, কিন্তু ঠিক তার কক্ষের বাইরে গম্বুজাকৃতি মঞ্চে নিচে বিছানা প্রস্তুত করে দিতে যেন বেশি সময় বিশ্রাম নিতে পারেন তিনি।

এখনো কি মঞ্চে আছেন?

হ্যাঁ মাননীয় শাজহাদী। শয্যা প্রস্তুত করতে খুব বেশি সময় লাগেনি আমাদের। দশ মিনিট আগেও আমি আসার সময় আধো জাগরণে ছিলেন তিনি।

আমি তাঁর কাছে যাচ্ছি।

এখানো মনের মাঝে অদ্ভুত এক অস্বস্তি নিয়ে দামি কার্পেটে মোড়া কক্ষ পার হয়ে বাইরের দিকের দরজা দিয়ে বারান্দার মত জায়টাতে গেল জাহানারা। রেশমের কুশন আর কোলবালিশে হেলান দিয়ে ডিভানে শুয়ে আছেন শাহজাহান। ভোরের ঠাণ্ডার হাত থেকে রেহাই পেতে গায়ে জড়িয়েছেন শাল আর নরম উলের কম্বল। হালকা একটু বাতাস এসে মাথা ঢেকে রাখা নানা বর্ণের ছাপঅলা শালের নিচ থেকে বের করে দিল একগুচ্ছ রুপালি চুল, নিচু হয়ে আবারো শালের মাঝে কেশগুচ্ছকে ফেরৎ পাঠালো জাহানারা। প্রথমে মনে হল চোখ আধবোজা অবস্থায় জাহানারার স্পর্শ বা উপস্থিতি কিছুই টের পেলেন না শাহজাহান। কিন্তু ধীরে ধীরে চোখ জোড়া একটু একটু করে খুলে গিয়ে নিবদ্ধ হল দৃষ্টি।

জাহানারা তুমি?

জ্বি, আব্বাজান, পিতার হাত ধরল জাহানারা। কত নরম মনে হল দেহত্বক। হাতের তালু আর লম্বা আঙুল মাংস প্রায় নেই বললেই চলে।

ভালো। আমি খুশি হয়েছি।

এক বা দুই মুহূর্তের জন্য দুজনের কেউই কিছু বলল না। শাহজাহানের হালকা আর দ্রুত নিঃশ্বাস দেখে জাহানারা উপলব্ধি করল যে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ভুল বলেনি। পিতার সাথে শেষ দেখা হবার পর গত কয়েক ঘণ্টাতে তার শরীর আরে ভেঙে পড়েছে। এরপরই কন্যার মনের ভয়কে শব্দে পরিণত করলেন শাহজাহান। মনে হচ্ছে জীবন যেন ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে আমার কাছ থেকে। জাহানারার চোখে অশ্রু দেখে বলে চললেন, কেঁদো না। প্রত্যেক মানুষের জন্যেই মৃত্যুর সময় নির্দিষ্ট আছে আর মাঝে মাঝে তো আমার মনে হয় যে আমি বোধ হয় আমার সময় পার হয়ে চলে এসেছি। কোন ব্যথা নেই। শুধু জীবনীশক্তি নিঃশেষ। এরপর শক্ত হয়ে গেল শাহজাহানের কণ্ঠস্বর। যাবার আগে পাশবালিশের সাথে ভর দিয়ে আমাকে উঁচু করে ধর, যেন তোমার মায়ের সমাধি দেখতে পাই।

নিজের চোখের অশ্রুর সাথে যুদ্ধ করতে করতে জাহানারা পাশপালিশের সাথে হেলান দিয়ে তুলে ধরল পিতার কৃশকায় শরীর পিছনে গুঁজে দিল আরো কয়েকটি তাকিয়া।

ধন্যবাদ। এখন আবার তোমার হাত দাও। কিছু কথা অবশ্যই বলতে হবে।

আরো একবার পিতার হাত নিজের হাতে নিয়ে জাহানারা বুঝতে পারল যে তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে লুকোবার কিছু নেই, তাই শুধু মাথা নেড়ে বলল, বলেন। আমি শুনছি।

হয়ত এটা তার কাছে কোন ব্যাপারই না, তবু আওরঙ্গজেবকে বলল যে আমি তাকে ক্ষমা করেছি…সবচেয়ে বড় কথা অনুনয় করবে যেন তার ও তার পুত্রদের মাঝে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য যা যা সম্ভব করে সে। হিন্দুস্তানে প্রথম আসার পর থেকে এহেন বিদ্বেষ প্লেগের মত ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের রাজবংশে! আমি চেয়েছিলাম এর সমাপ্তি টানেত…কিন্তু অনুতাপের সাথে বলতে হচ্ছে আমি পারিনি।

আমি তাঁকে জানাবো, আব্বাজান। নরম স্বরে বলে উঠল জাহানারা।

আশা করি আমি খুব বেশি বড় কোন পাপ করিনি। আমি জানি যে অনেক ভুল কাজ করেছি আর অন্য অনেকর চেয়ে বেশিবার করেছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস যে এগুলোর কারণ আমার উচ্চাকাঙ্খ আর অবস্থান অনেকের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা দিয়েছে। এমন নয় যে অন্তরের দিক থেকে বেশি পাপাচারী ছিলাম। যা করেছি তা করেছি আমার স্ত্রী, সন্তান আর রাজপরিবারের প্রতি ভালোবাসার জন্য।

আমাদের কেউই আপনার ভালোবাসা নিয়ে সন্দিহান নয়, আব্বাজান। আল্লাহ আপনাকে সকল পাপের জন্য ক্ষমা করবেন। এখানে পৃথিবীতে আমাদের মায়ের জন্য যে সমাধি নির্মাণ করেছেন আপনি, তা আপনার মহৎ ভালোবাসার অতুলনীয় উদাহরণ হিসেবে অন্য সব স্মৃতিকে ছাপিয়ে বেশি দিন টিকে থাকবে। জাহানারা শুনতে পেল অনিয়মিত হয়ে পড়ল পিতার হৃদস্পন্দন। আরো শক্ত করে ধরল পিতার হাত, বাতাসের জন্যে হাঁসফাঁস করতে লাগলেন শাহজাহান। শীঘি বেহেশতের উদ্যানে মায়ের সাথে মিলিত হবেন আপনি।

আমি দেখতে পাচ্ছি তাকে। যমুনার কুয়াশা ভেদ করে গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা তাজমহলের উপর দৃষ্টি স্থির করে বলে উঠলেন শাহজাহান। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গেল নাড়ীর গতি। বুঝতে পেরেই পিতার উপর ভেঙে পড়ল জ্যেষ্ঠ কন্যা জাহানারা। উষ্ণ অশ্রুতে পিতাকে ভরিয়ে দিয়ে কাঁদতে লাগল তাঁর স্ত্রী, জীবিত আর মৃত ছেলেমেয়ে– এমনকি তার নিজের জন্যও।

এক কি দুই মিনিট পরে পিতার মৃতদেহ আস্তে করে ডিভানে শুইয়ে দিল জাহানারা। উঠে দাঁড়াল, নিজেকে শান্ত করে, শিরদাঁড়া খাড়া করলেন। নিজেকে মনে করিয়ে দিলেন যে সে একজন মোগল। পিতার জন্য তাঁর প্রাপ্য সমাধির আয়োজন করতে হবে। যদি তিনি নিজের জন্য কালো মার্বেলের সমাধি নাও পেয়ে থাকেন স্ত্রীর সাথে সেই অত্যুজ্জ্বল শুভ্রতায় একত্রিত হতে পারবেন, যে স্তম্ভ তিনি নির্মাণ করেছেন। স্ত্রীর জন্য, তাদের ভালোবাসার জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *