অনেক বক বক করা হল। এবার একটি গল্প দিয়ে শেষ করি। গল্পটি ফজলুল করিম সাহেবের ত্রাণকার্য নামে এক অখ্যাত পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল কারণ বিখ্যাত পত্রিকার কোন সম্পাদক এটা ছাপতে রাজি হননি। কেন রাজি হননি সেই বিবেচনার ভার পাঠকদের উপর ছেড়ে দিচ্ছি।
ফজলুল করিম সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, মাঝে মাঝে বড় ধরনের ক্যালামিটির প্রয়োজন আছে। বন্যার খুব দরকার ছিল। এই বলেই তিনি পানের পিক ফেলে কড়া করে তাকালেন ইয়াজুদ্দিনের দিকে। ইয়াজুদ্দিন ভয়ে কুঁচকে গেল।
পানে কি জর্দা দেয়া ছিল ইয়াজুদ্দিন?
ইয়াজুদ্দিন হ্যাঁ না কিছুই বলল না। ফজলুল করিম সাহেব দ্বিতীয়বার পানের পিক ফেলে বললেন, তোমরা কোন কাজ ঠিকমত করতে পার না। আমি কি জর্দা খাই?
আরেকটা পান নিয়ে আসি স্যার?
ফজলুল করিম জবাব দিলেন না। তার মাথা ঘুরছে। বমি বমি ভাব হচ্ছে। এই সঙ্গে ক্ষীণ সন্দেহও হচ্ছে যে, ইয়াজুদ্দিন নামের বোকা বোকা ধরনের এই লোকটা ইচ্ছে করে তাঁকে জর্দাভর্তি পান দিয়েছে। এরা কেউ তাঁকে সহ্য করতে পারে না। পদে পদে চেষ্টা করে ঝামেলায় ফেলতে। ইয়াজুদ্দিনের উচিত ছিল ছুটে গিয়ে পান নিয়ে অসা। তা না করে সে ক্যাবলার মত জিজ্ঞেস করছে–আরেকটা পান নিয়ে আসি স্যার। হারামজাদা আর কাকে বলে।
তিনি বিরক্ত মুখে বললেন, রিলিফের মালপত্র সব উঠেছে?
রোগা লম্বামত এক ছোকরা বলল, ইয়েস স্যার। ছোকরার চোখে সানগ্লাস। সানগ্লাস চোখে দিয়ে একজন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা চূড়ান্ত অভদ্রতা–এটা কি এই ছোকরা জানে? অবশ্যি পুরোপুরি মন্ত্রী তিনি নন, প্রতিমন্ত্রী। মন্ত্রীদের দুলের হরিজন। তিনি যখন কোথাও যান তাঁর সঙ্গে টিভি ক্যামেরা থাকে না। বক্তৃতা দিলে খবরের কাগজে সবসময় সেটা ছাপাও হয় না। কাজেই এই ছোকরা যে সানগ্লাস পরে তাঁর সঙ্গে কথা বলবে এতে অবাক হবার কিছু নেই। তবু তিনি বললেন,
আপনার চোখে সানগ্লাস কেন?
চোখ উঠেছে স্যার।
ছোকরা সানগ্লাস খুলে ফেলল। তিনি আঁতকে উঠলেন… ভয়াবহ অবস্থা। তাঁর ধারণা ছিল চোখ-উঠা রোগ দেশ থেকে বিদেয় হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে পুরোপুরি বিদেয় হয়নি। এই ছোকরার কাছ থেকে হয়ত তাঁর হবে। এখনি কেমন যেন চোখ কড় কড় করছে। তিনি বিরক্ত মুখে বললেন, আমরা অপেক্ষা করছি কি জন্যে?
সারেং এখনো আসেনি।
আসেনি কেন?
বুঝতে পারছি না স্যার। টার সময় তো আসার কথা।
তিনি ঘড়ি দেখলেন এগারোটা কুড়ি বাজে। তাঁর এগারোটার সময় উপস্থিত হবার কথা ছিল। তিনি কাঁটায় কাঁটায় এগারোটায় এসেছেন। অথচ তাঁর পি.এ এসেছে এগারটী দশে। প্রতিমন্ত্রী হবার এই যন্ত্রণা।
ডেকে চেয়ার আছে স্যার। ডেকে বসে বিশ্রাম করুন। সারেংকে আনতে লোক গেছে।
তিনি অপ্রসন্ন মুখে ডেকে রাখা গদিওয়ালা বেতের চেয়ারে বসলেন। সামনে আরো কিছু খালি চেয়ার আছে কিন্তু তাঁর সঙ্গের কেউ সেই সব চেয়ারে বসল না। তিনি দরাজ গলায় বললেন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। কতক্ষণে লঞ্চ ছাড়বে কোন ঠিক নেই। বাংলাদেশ হচ্ছে এমনই একটা দেশ যে সময়মত কিছু হয় না।
বন্যাটা অবশ্যি স্যার সময়মত আসে।
তিনি অপ্রসন্ন মুখে তাকালেন। কথাটা বলেছে সানগ্লাস পরা ছেকিরা। কথার পিঠে কথা ভালই বলেছে। তিনি নিজে তা পারেন না। চমৎকার কিছু কথা তাঁর মনে আসে ঠিকই কিন্তু তা কথাবার্তা শেষ হবার অনেক পরে। তিনি চশমা পরা ছোকরার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কে? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না।
আমার নাম স্যার জামিল। নিউ ভিডিও লাইফে কাজ করি। আমি স্যার ত্রাণকার্যের ভিডিও করব।
ত্রাণকার্যের ভিডিও করবেন মানে? ত্রাণকার্যের ভিডিও করতে আপনাকে বলেছে কে?
আমাকে স্যার একদিনের জন্যে ভাড়া করা হয়েছে।
আপনি নেমে যান।
জি স্যার।
আপনাকে নেমে যেতে বলছি। ত্রাণকার্যের ভিডিও করার কোন প্রয়োজন নেই।
স্যার হামিদ সাহেব বললেন…
হামিদ সাহেব বললে তো হবে না। আমি কি বলছি সেটা হচ্ছে কথা। যান নেমে যান।
জামিল লঞ্চের ডেক থেকে নীচে নেমে গেল। ফজলুল করিম সাহেব থমথমে গলায় বললেন–জনগণকে সাহায্য করার জন্যে যাচ্ছি। এটা কোন বিয়েবাড়ির দৃশ্য না যে ভিডিও করতে হবে। কি বলেন আপনারা?
একজন বলল–স্যার ঠিকই বলেছেন। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে যাচ্ছে। সাহায্য যা দেয়া হচ্ছে তার চেয়ে ছবি বেশী তোলা হচ্ছে। টিভি খুললেই দেখা যায় …
তিনি তাকে কথা শেষ করতে দিলেন না। কড়া গলায় বললে–লঞ্চের সারেং-এর খোঁজ পাওয়া গেল কি-না দেখেন। অমিরা রওনা হব কখন আর ফিরবই বা কখন? এত মিস ম্যানেজমেন্ট কেন?
দুপুর বারোটা পর্যন্ত লঞ্চের সারেং-এর খোঁজ পাওয়া গেল না। তার বাসা কল্যাণপুরে। পুরো বাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তার পরিবার-পরিজনকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না–এরকম একটা খবর পাওয়া গেল। ফজলুল করিম সাহেবের বিরক্তির সীমা রইল না। এত মিস ম্যানেজমেন্ট। কেউ কোন দায়িত্ব পালন করছে না।
লঞ্চ একটা দশ মিনিটে ছাড়ল। অন্য একজন সারেং জোগাড় করা হয়েছে।
ফজলুল করিম সাহেব বলে দিয়েছেন ইনটেরিয়রের দিকে যেতে হবে। এমন জায়গা যেখানে এখনো সাহায্য পৌঁছেনি। তাঁরা হবে প্রথম ত্রাণদল।
প্রথম দিকে এ রকম হচ্ছে–একই লোক তিন চারবার করে সাহায্য পাচ্ছে, আবার কেউ কেউ এখন পর্যন্ত কিছু পায়নি। তবে অবস্থাটা সাময়িক। কিছুদিনের মধ্যে খুবই প্ল্যানড ওয়েতে ত্রাণকার্য শুরু হবে। আমার সরকারের তাই ইচ্ছ। কি বলেন হামিদ সাহেব?
তা তো ঠিকই স্যার। জার্মানরা যখন প্রথম রাশিয়া আক্রমণ করল তখন কি রকম কনফিউশন ছিল রাশিয়াতে। টোটেল হচপচ। কে কি করবে, কার দায়িত্ব কি–কিছুই জানে না। এখানেও একই অবস্থা।
ফজলুল করিম সাহেব কিছুই বললেন না। তাঁর এই পি.এ-র স্বভাব হচ্ছে বড় বড় কথা বলা। বুঝিয়ে দেয়া যে, সে নিজে প্রচুর পড়াশোনা জানা লোক। সে ছাড়া বাকি সবাই মূর্খ।
স্যার চা খাবেন? ফ্লাক্সে চা এনেছি।
না।
খান স্যার, ভাল লাগবে।
তাঁর চায়ের পিপাসা ছিল কিন্তু তিনি চা খেলেন না। ডেকের খোলা হাওয়ায় আরাম করে চা খেতে খেতে যাওয়ার চিন্তাটাই অস্বস্তিকর। তিনি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, এতো দেখি সমুদ্র।
সমুদ্র তো বটেই স্যার। বাতাস নেই, আরামে যাচ্ছি। বাতাস দিলে–ছয় সাত ফুট ঢেউ হয়।
সেকি!
একটা ব্ৰাণলঞ্চ ডুবে গেল। আর ছোটখাট নৌকা তো কতই ডুবছে।
বলেন কি! নতুন সারেং কেমন?
লঞ্চ ডুবার ভয় নেই স্যার। স্টিল বডি লঞ্চ। নতুন ইঞ্জিন।
আমরা যাচ্ছি কোথায়?
সেটা তো স্যার এখনো ঠিক হয়নি।
কি বলছেন এসব? চোখ বন্ধ করে চলতে থাকবে নাকি?
ব্যাপার অনেকটা তাই স্যার। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সব দিকেই পানি। এখন কম্পাস ছাড়া গতি নেই।
ডেস্টিনেশন তো লাগবে?
অফকোর্স স্যার। আমি সারেংকে বলে দিয়েছি ঘণ্টা খানিক নদী ধরে সোজাসুজি যাবে, তারপর কোন একটা শুকনো জায়গা দেখলে … শুকনো জায়গা মানেই আশ্রয় শিবির।
আগে দেখতে হবে ওরা সাহায্য পেয়েছে কি-না। তেলা মাথায় তেল দেয়ার মানে হয় না।
তা তো বটেই স্যার।
ত্রাণ সামগ্রীর লিস্ট কার কাছে?
আমার কাছে।
কি কি নিয়ে যাচ্ছি আমরা?
হামিদ সাহেব ফাইল খুলে লিস্ট বের করলেন।
বায়ান্নটা তাঁবু…
তাঁবু? তাঁবু কি জন্যে? তবু আপনি কি মনে করে আনলেন? এটা মরুভূমি নাকি?
মরুভূমির দেশ থেকে আসা সাহায্য আমরা স্যার কি করব বলুন। তাঁবু ছাড়াও আরো জিনিস আছে। এক হাজার কৌটা কনসানট্রেটেড টমেটো জুস।
বলেন কি? কনসানট্রেটেড টমেটো জুস দিয়ে ওরা কি করবে?
ইরাকের সাহায্য স্যার। গত বছরে বন্যার জন্যে দিয়েছিল। গুদামে থেকে পচে গেছে বলে মনে হয়। কোটা খুললেই ভক করে একটা গন্ধ আসে।
আর কি আছে?
পাঁচশ বোতল ডিস্টিল ওয়াটার! এক একটা বোতল দুলিটারের।
ডিস্টিল ওয়াটার দিয়ে কি করবে?
বুঝতে পারছি না স্যার। মনে হচ্ছে মেডিক্যাল সাপ্লাই, বরিক কটন আছে দুই পেটি।
এই সব সাহায্য নিয়ে উপস্থিত হলে তো আমার মনে হয় মার খেতে হবে।
তা তো হবেই। বেশ কিছু ত্রাণ পার্টি মার খেয়ে ভূত হয়েছে। কাপড়-চোপড় খুলে নেংটা করে ছেড়ে দিয়েছে।
আপনি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন?
জি না স্যার, সত্যি কথা বলছি। একটা পার্টি খুব সম্ভব শিক্ষক সমিতি–শিশু শিক্ষা বই, খাতা, পেনসিল এইসব নিয়ে গিয়েছিল। তাদের এই অবস্থা হয়েছিল।
ফজলুল করিম সাহেব খুবই গম্ভীর হয়ে গেলেন। হামিদ সাহেব বললেন, আমাদের এই ভয় নেই। রান্না করা খাবারও তো নিয়ে যাচ্ছি।
কি খাবার?
খাবার হচ্ছে খিচুড়ি। প্রায় তিনশ লোকের ব্যবস্থা। তারপর লুঙ্গি, গামছা, শাড়ি এসবও আছে। ক্যাশ টাকা আছে।
ক্যাশ টাকা কত?
প্রায় পাঁচ হাজার।
প্রায়? প্রায় কি জন্যে? এগজেক্ট ফিগার বলুন।
পাঁচ হাজার ছিল, তার মধ্যে কিছু খরচ হয়ে গেল। ভিডিও ক্যামেরা, তারপর আপনার নতুন সারেং নিতে হল। এই খরচা বাদ যাবে।
ভিডিও ক্যামেরা আপনাকে কে নিতে বলল?
এটা তো স্যার বলার অপেক্ষা রাখে না। একটা বেকর্ড থাকতে হবে না?
ফজলুল করিম সাহেব আর কিছু বললেন না। ঝিম মেরে বসে রইলেন। চারিদিকে পানি আর পানি। নদী দিয়ে নৌকা চলছে না সমুদ্র পাড়ি দেয়া হচ্ছে। বোঝার কোন উপায় নেই। আকাশ কেমন ঘোলাটে। অল্প অল্প বাতাস দিচ্ছে। তাতেই বড় বড় ঢেউ তৈরী হচ্ছে। লঞ্চের গায়ে বেশ শব্দ করে ঢেউ ভেঙ্গে পড়ছে। আরো বড় ঢেউ উঠতে শুরু করলে মুশকিল।
দুঘণ্টা চলার পরও কোন শুকনো জায়গা দেখা গেল না। লঞ্চের সারেং চোখ মুখ কুঁচকে জানাল, নদী-বরাবর গেলে শুকনো জায়গা চোখে পড়বে না। আড়াআড়ি যেতে হবে। তবে সে আড়াআড়ি যেতে চায় না। লঞ্চ আটকে যেতে পারে। আড়াআড়ি যেতে হলে নৌকা নিয়ে যাওয়া উচিত।
ফজলুল করিম সাহেবের বিরক্তির সীমা রইল না। তিনি বিড় বিড় করে বললেন–মিস ম্যানেজমেন্ট। বিরাট মিস ম্যানেজমেন্ট। এই ব্যাপারগুলো আগেই দেখা উচিত ছিল।
হামিদ সাহেব হালকা গলায় বললেন, আগে তো স্যার বুঝতে পারিনি। আপনি কিছু মুখে দিন স্যার, সারাদিন খাননি। চা আর নোনতা বিসকিট দেই? কলাও আছে। স্যার দিতে বলি?
আপনারা কিছু খেয়েছেন? চাবটা তো প্রায় বাজে।
খিচুড়ি নিয়ে বসেছিল সবাই। খেতে পারেনি। টক হয়ে গেছে।
টক হয়ে গেছে মানে?
সকাল সাতটার সময় রান্না হয়েছে, এখন বাজছে চারটা–গরমটাও পড়েছে ভ্যাপসা। এই গরমে মানুষ টক হয়ে যায় আর খিচুড়ি।
লঞ্চ মাঝ নদী কিংবা মাঝসমুদ্রে থেমে আছে। ফজলুল করিম সাহেব বিমর্ষ মুখে নোনতা বিসকিট এবং চা খাচ্ছেন। এক ফাঁকে লক্ষ্য করলেন ভিডিওর জামিল ছোকরা লঞ্চেই আছে, নেমে যায়নি। পানির ছবি তুলছে। হারামজাদাকে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিতে পারলে একটু ভাল লাগত, তা সম্ভব না।
নদীতে নৌকা, লঞ্চ একবারেই চলাচল করছে না। দুপুর বেলার দিকে কিছু কিছু ছিল এখন তাও নেই। হামিদ সাহেব শুকনো গলায় বললেন–কি করব স্যার? ফিরে চলে যাব?
ফজলুল করিম সাহেব জবাব দিলেন না। হামিদ সাহেব থেমে থেমে বললেন, সন্ধ্যা পর্যন্ত নদীতে থাকা ঠিক হবে না স্যার, ডাকাতের উপদ্রব। খুবই ডাকাতি হচ্ছে। ফিরে যাওয়াই ভাল। দিনের অবস্থা খারাপ। ভাদ্র মাসে ঝড় বৃষ্টি হয়।
আশ্বিন মাসে ঝড় হয় বলে জানতাম। ভাদ্র মাসের কথা এই প্রথম শুনলাম।
বহাওয়া তো স্যার চেঞ্জ হয়ে গেছে। এখন তাহলে কি রওনা হব?
ফজলুল করিম সাহেব চুপ করে রইলেন। বন্যার পানি দেখতে লাগলেন। হামিদ সাহেব বললেন, খিচুড়ি ফেলে দিতে বলেছি। টক খিচুড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে তো লাভ নেই। যে খাবে তারই পেট নেমে যাবে।
যা ইচ্ছা করুন। কানের কাছে বক বক করবেন না।
পাঁচ হাজার টাকা ক্যাশ আছে বলেছিলাম না, তাও ঠিক না। লঞ্চের তেলের খরচ দিতে হয়েছে। সারেং এবং তার দুই এ্যাসিসটেন্টের বেতন, ভিডিও ভাড়া, চা, নোনতা বিসকিট এবং কলার জন্যে খরচ হল চার হাজার সাতান্ন টাকা তেত্রিশ পয়সা। সঙ্গে এখন স্যার ক্যাশ আছে নয় শ বিয়াল্লিশ টাকা সাতষট্টি পয়সা।
আমার কানের কাছে দয়া করে ভ্যান ভ্যান করবেন না।
লঞ্চ ফিরে চলল। পথে কলাগাছের ভেলায় ভাসমান একটি পরিবারকে পাওয়া গেল। তিন বাচ্চা, বাবা-মা, একটি ছাগল এবং চারটা হাঁস। অনেক ডাকাডাকির পর তারা লঞ্চের পাশে এনে ভেলা ভিড়ল। নয় শ বিয়াল্লিশ টাকা সাতষট্টি পয়সার সবটাই তাদেরকে দেয়া হল। একটা শাড়ি, একটা লুঙ্গি এবং একটা গামছা দেয়া হল। ফজলুল করিম সাহেব দরাজ গলায় বললেন–একটা তাঁবু দিয়ে দিন। হামিদ সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, তাঁবু দিয়ে ওরা কি করবে?
যা ইচ্ছা করুক। আপনাকে দিতে বলছি দিন।
তাঁবুর ভারে ভেলা ডুবে যাবে স্যার।
ডুববে না।
তারা তাঁর নিতে রাজি হল না। তার বদলে ভেলা থেকে লঞ্চে উঠে এল। এগারো-বারো বছরের একটি মেয়ে আছে সঙ্গে। সে সারাদিনের ধকলের কারণেই বোধ হয় লঞ্চে উঠে হড়হড় করে বমি করল। ফজলুল করিম সাহেব আঁৎকে উঠে বললেন, কলেরা না-কি? কি সর্বনাশ। তাঁর মেজাজ খুবই খারাপ হয়ে গেল। তিনি বাকি সময়টা কেবিনে দরজা আটকে বসে রইলেন। তাঁর গায়ের তাপমাত্রা বেড়ে গেল। হড় হড় শব্দে বমি করে ফেললেন।
পরদিনের খবরের কাগজে ফজলুল করিম সাহেবের ত্রাণকার্যের একটি বিবরণ ছাপা হয়–অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থায় জনশক্তি দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী জনাব ফজলুল করিম একটি ত্রাণদল পরিচালনা করে বন্যা মোকাবেলায় বর্তমান সরকারের অঙ্গীকারকেই স্পষ্ট করে তুলেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় পুরো চব্বিশ ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রম করে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন। জনশক্তি মন্ত্রী জনাব এখলাস উদ্দিন হাসপাতালে তাঁকে মাল্যভূষিত করে বলেন–বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের ফজলুল করিম সাহেবের মত মানুষ দরকার। পরের জন্যে যাঁরা নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পিছপা নন। এই প্রসঙ্গে তিনি রবি ঠাকুরের একটি কবিতার চরণও আবেগজড়িত কণ্ঠে আবৃত্তি করেন–কেবা আগে প্রাণ করিবে দান, তার লাগি কাড়াকাড়ি।