২.১১
মা সরাইয়ে ফিরে এলেন। ক্ষুধা নেই, খাবার পড়ে রইলো প্লেটে! কেবল চোখের ওপর নাচতে লাগলো রাইবিনের সেই নির্যাতন।
পরিচারিকাটি এসে বললো বেশ একটু উত্তেজিত স্বরে, উঃ পুলিস সাহেব কী মারটা মারলে! আমি কাছে দাঁড়িয়ে দেখলুম, সবকটা দাঁত ভেঙে গেছে…থুথু ফেললো, পড়লো ভাঙা দাঁত আর রক্তের চাপ। চোখ এতো ফুলে উঠেছে যে, তা দেখা যায় না। ওরা বললো, দলে আরো লোক ছিলএ ছিল নেতা…তিনজনকে ধরেছিল…একজন পালিয়েছে …এরা নাকি ঈশ্বর মানে না। লোকজনকে বলে, গির্জা লুঠ করো…এমনি লোক এবা। অনেকে চোখের জল ফেললো ওদের জন্যে…আবার কোন কোন হতভাগা বলে কিনা, বেশ হয়েছে, বাছাধনের একেবারে ঠাণ্ডা! কী নীচ অন্তকরণ দেখেছেন?–
মা বুঝলেন, টাউনহলের ভিতর নিয়ে গিয়ে রাইবিনকে আরো একচোট মারা হয়েছে। চুপ করে রইলেন তিনি। দরদী শ্রোতা পেয়ে মেয়েটি বলতে লাগলো, বাবা বলেন,… অজন্মার দরুণ এসব হয়! পরপর এই দু’বছর অজন্মা। লোকজন হয়রান হয়ে গেলো।…তাই এসব হাঙ্গামা।… এই তো সেদিন ভসিনকভের যথাসর্বস্ব বিকিয়ে গেলে দেনার দায়ে। মরিয়া হয়ে শেষে বেচারা বেলিফের মুখে লাগালো এক ঘুষি, বললো, এই নাও তোমার পাওনা।…
নীল-চোখ চাষীটি এসে হাজির হলো। মা তার সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথা বলে বুঝেছেন, সেও তাদের দলের লোক; কাজেই তার ওখানে রাত্রিবাস করা স্থির করেন। চাষীটি মেয়েটিকে বললো …ওকে আমাদের ওখানে নিয়ে যেয়ে। তারপর মার ব্যাগটা তুলে নিয়ে মুচকি হেসে বললো, একদম খালি যে…এটা আমি নিয়ে গিয়ে সাবধান করে রাখছি। আপনি ওর সঙ্গে আসুন,”বলে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে গেলো।
খানিক বাদে মাও মেয়েটির সঙ্গে চাষীর বাড়ি গিয়ে হাজির হলেন। ছোট্ট একখানি ঘর, কিন্তু পরিস্কার ঝকঝকে। এক কোনে টেবিলের ওপর একটা ল্যাম্প জ্বলছে। মাকে অভ্যর্থনা করে চাষী বউকে বললো, তেতিয়ান, যাও, শীগগির পিওরকে ডেকে আন।
তেতিয়ান চলে যেতে মা জিগ্যেস করলেন, আমার ব্যাগ।
নিরাপদ জায়গায় আছে।…মেয়েটি সামনে ছিল বলে খালি বলেছিলুম…নইলে ও তো দেখচি বেজায় ভারি।
তাতে কি হল?
তারপর উঠে মার কাছে গিয়ে চাষীটি ফি কি করে বললো, সেই লোকটাকে চেনেন আপনি?
মা একটু চমকে উঠলেন, কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিলেন, হাঁ।
তা-ই আন্দাজ করেছিলুম। তাকেও জিগ্যেস করতে বললো, আরো অনেক আছে আমাদের দলে। বেশ লোক রাইবিন…আচ্ছা আপনার ও ব্যাগে তো বই আর কাগজ আছে, না?
হাঁ, ওদের জন্যই নিয়ে এসেছিলুম।
আমাদের হাতেই বই-কাগজ পড়েছিল…আমরাও ওই চাই।…খাঁটি কথা লিখেছে… আমি নিজে বড় একটা পড়তে পারিনে—আমার এক বন্ধু পারে। তাছাড়া আমার বউও পড়ে শোনায়।… তা, বই-কাগজগুলোর ব্যবস্থা কি করবেন?
আমাদের দিয়ে যাবো।
চাষী শুধু বললো, আমাদের! কিন্তু কোনো রকম আশ্চর্যের ভাৰ দেখালো না!
রাইবিনের কথা ভেবে মার চোখ বারে-বারেই অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠছে। কিন্তু কণ্ঠ তার অকম্পিত, বলেন, মানুষের যথা-সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাব কণ্ঠরোধ করে তাকে পায়ে মাড়িয়ে যায় ঐ ডাকাতের দল! প্রতিবাদ করলে জবাব মেলে প্রহার এবং নির্যাতন।
চাষী বললো, শক্তিশক্তি ওদের বেশি কিনা!
মা উত্তেজিত সুরে বললেন, কিন্তু সে শক্তি না পেলে কোত্থেকে?…এই আমাদেরই কাছ থেকে। যা-কিছু তাদের, সব আমাদের কাছ থেকেই পাওয়া।
চাষী বললো, সে কথা ঠিক।…একটা চাকার মতো আর কি।… আমরা চালাই অথচ গুমরাই তাতে কাটা পড়ি।…ঐ আসছে।
কে?
আমাদের দলেরই লোক। ওর কাছেই ব্যাগটা রেখেছি।
বউ এ টি চাষীকে নিয়ে এলো। এই পিওর। পিওরকে বসতে দিয়ে বউ মাকে লক্ষ্য করে স্বামীকে জিগ্যেস করলো, উনি খাবেন না, স্টিপান?
মা বললেন, না, মা।
পিওর একটু বেশি কথা বলে। মার সঙ্গে মিনিটখানেকের মধ্যেই সে দিব্যি গল্প জুড়ে দিলো। রাইবিনের কথা উঠতে প্রশ্ন করলো, সে কি আপনার আত্মীয় কেউ?
আত্মীয় নয়…বহুদিনের পরিচিত…দাদার মতো ভক্তি করি।
অর্থাৎ বন্ধু। চরিত্রবান্ লোক বটে! আর নিজের কদর বোঝে… একটা লোকের মতো লোক, বুঝলে, তেতিয়ান!
তেতিয়ানা জিগ্যেস করলো, বিয়ে করেছে?
মৃত-দার।
তাই এতো সাহস। বিবাহিতেরা এত সাহস দেখাতে পারে না।
পিওর বললো, কেন,–আমি?…
তেতিয়ানা ঠোঁট উলটে বললো, তুমি? কাজ তো করছে ভারি? খালি বকর-বকর আব ঘরের কোনে বসে এক-আধখানা বই পড়ে ফিসফাস।
পিওর আহত হয়ে প্রতিবাদ করলে, কেন, মেলা লোক তো শোনে আমার কথা। এটা বলা তোমার উচিত হলনা, বৌদি।
তেতিয়ানা সে কথা কানে না তুলে বললো, তা ছাড়া, চাষীরা আবার বিয়ে করে কেন? চাকরের একজন চাকবানীর দরকার-তাই! কাজ কি তার? ‘
স্টিপান বললো, সে কি বউ, কাজের কি কোনো কমতি আছে। তোমার?
ছাই কাজ। এ কাজ করে লাভ?…ছেলে-মেয়ে বিয়ানো, অথচ তাদের যত্ন করার ফুরসুং নেই…খাওয়ানোর কড়ি নেই। খালি খেটে মর। আমারও, মা, দুটি ছেলে ছিল…একটি দু’বছর বয়সে ফুটন্ত জলে পড়ে মারা যায়। আর একটি মারা পড়ে, এই পোড়া খাটুনির ফলেই। আমি বলি, চাষীরা যেন বিয়ে না করে, হাত না বাঁধে। তাহলেই তারা সত্যের জন্য খোলাখুলি লড়াই চালাতে পারবে। তাই নয়, মা?
হাঁ।
তারপর মা আবেগের সঙ্গে বিপ্লব কাহিনী, নামজাদা বিপ্লবীদের জীবনী এবং কার্যপ্রণালী ও দেশ-বিদেশের মজুর-প্রগতির কথা চাষীদের কাছে বর্ণনা করে গেলেন।
তেতিয়ানা বললো, তাইতো আমি ওকথা বলি, মা। তারা আর আমরা! আমরা তো জীবন কাটাই ভেড়ার মতো। এইতো ধরুন, আমি লিখতে পড়তে জানি, বই পড়ি আর ভাবি,এমনও অনেকদিন হয় যে ভাবনায় বাতে ঘুম হয় না?…কিন্তু লাভ? না ভাবলে জীবনটা ঠেকে ফাকা, আর ভাবলেও জীবনটাকে ফাকাই ঠেকে। পৃথিবীর কোন কিছুর যেন কোন উদ্দেশ্য নেই। এই যে চাষীরা…দিনরাত খেটে মরে এক টুকরো রুটির জন্য…কিন্তু কি পায়? কিছুই না। তাইতো দুঃখ পায়, রেগে ওঠে, মদ খায়, মারামারি করে, তারপর আবার কাজ করে। কাজ… কাজ… কাজ… কিন্তু কাজ করে লাভ?…বিন্দুমাত্র না।
স্টিপান হঠাৎ বললো, তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আলোটা নিভিয়ে দেওয়া ভাল।
পিওর বললো, হ, সতর্ক থাকবে বৈকি, স্টিপান। কাগজ যখন ছড়িয়ে পড়বে লোকদের মধ্যে তখন…
স্টিপান অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে মার দিকে চেয়ে বললো, কিন্তু আমি আমার কথা বলিনি।…আমার মতো মানুষের দামই বা কি! একশো এক আনা।
মা বললেন, ভুল করছো তুমি। বাইরের লোক তোমায় শশাষণ করায় যার স্বার্থ…সে তোমার যে দাম কষবে তা গ্রাহ্য নয়! তোমার, দাম কষবে তুমি নিজে।
.
পিওর বিদায় নিয়ে চলে গেলো। তেতিয়ানা মাকে বিছানা পেতে দিতে দিতে বললো, আজকাল চাই মানুষের মধ্যে এই বিদ্রোহকে উসকে দেওয়া। ভাবে তো সবাই, কিন্তু গোপনে নিজের মনে। তাতে চলবে না। মানুষকে মুক্তকণ্ঠে জোর গলায় বলতে হবে। আর, একজনকে প্রথম এই কাজে ব্রতী হয়ে পথ দেখাতে হবে। কতকগুলি অসংবদ্ধ ছাড়া-ছাড়া চিন্তায় চলবে না, একটা কর্তব্য স্থির কবে কাজের সূত্রে সেগুলোকে গেঁথে তুলবে হবে।…
বিছানা পাতা হলে মা শুয়ে পড়লেন। তেতিয়ানা বললো, আপনিও প্রার্থনা করেন না?…আমিও মনে করি, ভগবান নেই, মানুষকে বোকা বানাবার জন্য এসবের আমদানি হয়েছিল।
মা বললেন, আমি যীশুতে বিশ্বাস করি। কিন্তু ভগবান? জানিনে! তিনি যদি থাকবেনই তাহলে তার মঙ্গল-শক্তি হ’তে আমরা বঞ্চিত কেন? কেন তিনি মানুষকে দুটো ভাগে বিচ্ছিন্ন হ’তে দিলেন? কেমন করে তাঁর রাজ্যে সম্ভব হয়, মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং উপহাস, অন্যায় ও পাশব আচরণ?
আমার সন্তান দু’টির মৃত্যুর জন্য দায়ি কে…মানুষই হ’ক আর ঈশ্বরই হক—আমি তাকে কখনো ক্ষমা কববো ন…কখখনো না।
মা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, তোমার তত ছেলে হবার বয়স যায়নি, মা!
তেতিয়ানা খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো, তারপর ধীবে ধীরে, বললো, না, মা, ডাক্তার বলেছে, আমার আর ছেলে হবে না।
এই রিক্ত-সন্তান নারীর বুকের ব্যথা বুঝে মা নীৰ হ’য়ে রইলেন।
স্বামী-স্ত্রী মাকে শুইয়ে রেখে নিজেরাও শুয়ে পড়লো।
.
২.১২
শুয়ে শুয়ে মা স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথন শুনতে লাগলেন।
তেতিয়ানা বললে, বুড়িরা পর্যন্ত একাজে ঝাঁপিয়ে পড়লো, আর তুমি!…
স্টিপান বললো, আহা, এসব কাজ এত তাড়াহুড়োয় হয় না। বেশ করে ভেবে-চিন্তে দেখা চাই।
হাঁ, ভাবতে তো তোমায় আগাগোড়াই দেখছি।
স্টিপান বললো, আহা, তুমি বুঝতে পারছে না। কাজ করতে হলে এই রকম করে—প্রথমে যারা অন্যায় সয়েছে, অত্যাচার সয়েছে, তাদের আড়ালে ডেকে নিয়ে দলে ভাগাও। তারপর আমি শহরে যাবো–কাঠ কেটে খরচ চালাবো, আর ওদের খুঁজে নিয়ে ওদের সঙ্গে কাজে যোগ দেবো…খুব সন্তর্পণে চলবে এ ব্যাপার! আর সত্যিই, নিজের দাম নিজে কষবে। ঐতো রাইবিন…পুলিস কমিশনার তো দূরের কথা, স্বয়ং ঈশ্বরের সামনে দাড় করালেও ও দমবেনা। তারপর নিকিতা”হঠাৎ ওর মন বদলে গেলে কি করে? এ কি যাদু?–না। মানুষ যদি বন্ধুভাবে মিলে মিশে কিছু করে, সবার কাছে তাতে সহানুভূতি পায়।
তেতিয়ানা বলে উঠলো, বন্ধুভাবে! চোখের সামনে একটা লোককে মারবে আর আমরা থাকবো হা করে দাঁড়িয়ে!
স্টিপান বললো, সবুর। তার ভগবানকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত যে আমরা নিজেরা তাকে মারিনি। কর্তারা তো আমাদের বাধ্য করেই এমনি করে মারতে…প্রাণ যতই কাঁদুক, ঘুষি তোমায় চালাতেই হবে,…হুকুম না তামিল করো, তোমার মরণ। কর্তাদের নিষেধ – মানুষ হোয়োনা, এ বাদে শেয়াল-কুকুর যা-খুশি হতে পারে। বীর হলে তোমার রক্ষা নেই…ভবসাগর পার করে দেবার জন্য তারা উঠে পড়ে লাগবে, বুঝলে তেতিয়ানা! চাই আজ অত্যাচারিত জনসাধারণের ক্রোধ এবং বিদ্রোহ!…
পরদিন মা শহরে চলে এলেন। এসে দেখেন বাসা সার্চ হয়ে গেছে …সব জিনিস তছনছ। আইভানোভিচ বললো, শাসিয়ে গেছে, মা, আমার কাজ খম হবে। বাঁচা গেলো, মা। চাষীদের কার কি নেই এ হিসেব করে মাইনে গোন দস্তুরমতো হারামি।
তারপর মা রাইবিনের শোচনীয় গ্রেপ্তার-কাহিনীর বর্ণনা করলেন। আইভানোভিচ প্রথমটা উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠলো, তারপর দীপ্ত চোখে কিন্তু সংযতকণ্ঠে বললো, চমৎকার লোক! এমন মহৎ। কিন্তু জেলে থাকা ওর পক্ষে কষ্টকর, ও রকম লোক জেলে গিয়ে সুস্থ থাকে না।…
তারপর তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললো, আর ঐ পুলিস এবং সার্জেন্ট,–ওরা তো শয়তানের হাতের অস্ত্র …পশুকে যেমন পোষ মানায়, ওদেরও তেমনি করে পোষ মানানো হয়েছে। হাঁ, পশু ওরা… আর পশু যখন কামড়ায়, তখন তাকে করতে হয়,…
উত্তেজনায় আইভানোভিচ পাইচারি করতে করতে রাগ-ভরা কণ্ঠে বলতে লাগলো, কী ভয়ানক! মানুষের ওপর অন্যায় কর্তৃত্বমদে মত্ত হয়ে মুষ্টিমেয় পশু মানুষকে মারছে, অত্যাচার করছে, গলা টিপে খুন করছে। বর্বরতার সুর উচু হতে উচুতে উঠছে, নিষ্ঠুরতা হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবনের নীতি। একটা গোটা জাতি আজ অধঃপতিত। একদল করছে অত্যাচার। একদল এই অত্যাচার নীরবে সয়ে মনুষ্যত্ব হারাচ্ছে আর একদল হুংকার করছে–প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ।…
নিষিদ্ধ কাগজ-পত্রে কথা উঠলে মা কেমন করে তা ছড়াবার বন্দোবস্ত করে এসেছেন তা বলেন। আইভানোভিচ আনন্দে বিহবল হয়ে মা মা বলে তাকে জড়িয়ে ধবে বললো, চাষীরাও তাহলে নড়ে উঠেছে!
হাঁ! পেভেল-এণ্ড্রি যদি এখন থাকতো।
আইভানোভিচ বললো, তুমি শুনে হয়তো প্রাণে খুব আঘাত পাবে, মা…কিন্তু পেভেল জেল পালাবে না; সে চায় বিচার। তারপর নির্বাসনদণ্ড হলে সাইবেরিয়া থেকে পালিয়ে আসবে।
মা বললেন, তাই করুক তবে। কিসে ভালো হবে, সে-ই বেশি বোঝ।
আইভানোভিচ বললো, রাইবিনের সম্বন্ধে একটা ইস্তাহার বের করা দরকার।…আমি আজই লিখবো। কিন্তু গ্রামে পাঠাবো কি করে?
কেন, আমি নিয়ে যাব।
না, মা। তোমার আবার যাওয়া ঠিক হবে না। এবার বরং নিকোলাই যাক।
আইভানোভিচ ইস্তাহার লিখে দিলো। মা তা লুকিয়ে রাখলেন গায়ের জামার মধ্যে ফুরসুৎ মতো ছাপাতে দিয়ে আসবেন বলে।
.
২.১৩
পরদিন ভোরে অপ্রত্যাশিতভাবে ইগ্নাতি এসে হাজির হয়। তাদের দলের পাঁচজন ধরা পড়েছিল। বাকি সব কেউ পালিয়েছে, কেউ পুলিসের সন্দেহে পড়েনি।
পুলিসের সাড়া পেয়েই ইগ্নাতি ঘর থেকে লাফ দিয়ে পড়ে ঝোপ এবং বনের আড়ালে আত্মগোপন করে শহরের দিকে ছুটেছে। সাত দিন পরে সে শহরে এসে পৌছুল। হেঁটে হেঁটে পা ধবে গেছে, তবু তার মন খুশি। জুতো খুলে সে একটুকরো কাগজ বের করে মার হাতে দিলো—রাইবিন লিখছে মাকে চিঠি…আমাদের আরো বই চাই, আবো ইস্তাহার চাই। সেই মহিলাটিকে আমাদের জন্য লেখা পাঠাতে বলবেন…
রাইবিনের চিঠি পড়ে মার চোখে জল এলো…তার গ্রেপ্তাবের সেই করুণ কাহিনী ইগ্নাতিকে শোনান তিনি।…
তারপর ইয়াতির ফুলো পায়ের দিকে চেয়ে আইভানোভিচকে তিনি বলেন, ওর পায়ে একটু অ্যালকোহল মালিশ করা দরকার।
আইভানোভিচ, বললো, নিশ্চয়।
সে অ্যালকোহল নিয়ে এলো। মা ইগ্নাতিব পা ধুয়ে অ্যালকোহল মালিশ করে দিলেন।
ভদ্দরলোক আইভানোভিচ যে তার মতো ছোট লোকের ওপর এতোটা দরদ দেখাবে ইয়াতি তা কল্পনাও করতে পারেনি। কাজেই সে অতি মাত্রায় মুগ্ধ এবং অবাক হ’ল। আইভানোভিচ আড়ালে গেলে বললো, আশ্চর্য ব্যাপার।
কি আশ্চর্য ব্যাপার?
এই–একদিকে ওরা মুখে ঘুষি চালায়, আর এক দিকে দেয়ায় পা। মাঝখানে…
মাঝখানে কি?
আইভানোভিচ হঠাৎ দোর গোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললো, মাঝখানে একদল লোক…যারা প্রহারকর্তার হাতে চুমু খায়, আর প্রহৃতের রক্ত শোষণ করে।
ইগ্নাতি সসম্ভ্রমে তার দিকে চেয়ে বললো, তাই ঠিক।
চা খেতে বসে সে বললো, আমার কাজ ছিল, কাগজ বিলি করা হাঁটতে ওস্তাদ ছিলুম কিনা, তাই রাইবিন এই কাজের ভার দিয়েছিল।
আইভানোভিচ জিগ্যেস করলেন, লোকে কি খুব পড়ে?
হাঁ খুব—যারা পারে। এমনকি অনেক ধনীও পড়ে, তবে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে নয়! আমরা এ ছড়াই জানলেই শ্রীঘর–এ যে তাদের মরণ-ফাঁদ।
মরণ-ফাঁদ কেন?
তা ছাড়া কি? চাষীরা এখন আর জমিদারের তোয়াক্কা না বেখে নিজেরাই জমি বিলি-বন্দোবস্ত করতে শুরু করেছে। ধনীরা কি জমি কামড়ে বসে থাকতে পারবে? চাষীরা রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে দেবে ধনীদের…মুনিবও থাকবে না, মজুরও থাকবেনা দুনিয়ায়। এ হাঙ্গামাকে কে ডেকে আনে, বলো?
রাইবিনের গ্রেপ্তার সম্বন্ধে ইস্তাহার-বিলির কথায় ইগ্নাতি সাগ্রহে বলে উঠল, আমায় দিন, আমি যাচ্ছি। বনের মধ্যে একটা জায়গায় রেখে সবাইকে বলব, যাও, ঐখানে গিয়ে নিয়ে এসো। আমিও ধরা পড়বে না, কাজও ফতে হবে।
আইভানোভিচ বললো, না বন্ধু, তুমি না! যাবো আমি, তুমি শুধু আমাকে সব খবরাখবর বাৎলে দেবে।
ইগ্নাতি তাতেই রাজি হ’ল। ফন্দি-ফিকির বাংলে দিতে দিতে বললো, জানলায় চারটে ঘা দেবে। পয়লা তিনটে…তারপর একটু থেমে আর একটা। একজন লাল-চুল চাষী দোর খুলে দিলে তুমি বলবে, ধাই কোথায়, ওদের কাছ থেকে এসেছি”বাস, এইটুকুই বলবে! তাহলেই বুঝবে সব।
আইভানোভিচ চলে গেলো।
.
২.১৪
ফেরারী নিকোলাইর পক্ষে চোরের মতন লুকিয়ে-লুকিয়ে বেড়ানো আর নিষ্কর্মা-জীবন যাপন করা হয়েছিল অসহ্য। কাজেই রাইবিনকে জেল থেকে মুক্ত করার বন্দোবস্তে সেই হ’ল প্রধান উৎসাহী।
পরিচালনার ভার নিলে শশেংকা, আর তাদের সঙ্গে যোগ দিলো গডুন…গডুনের স্বার্থ, তার ভাইপোও এই সঙ্গে মুক্ত হবে। মাও সঙ্গে গেলেন নেহাৎ যেচে…প্রাণের টানে। জেলের সেদিকটা গোরস্থান, নির্জন, অনেকটা ফাকা। সেদিকে চললেন মা। পথে দু’জন সৈনিকের সঙ্গে দেখা-মা অত্যন্ত ব্যস্ততার ভাব দেখিয়ে বললেন, হাগা, আমার ছাগল দু’টি হেথা কোন্দিকে গেল, দেখেছো?
না।
সৈন্যরা চলে গেলে মা নির্ধারিত স্থানটিতে এসে দাঁড়ালেন। নির্দিষ্ট সময় উপস্থিত হ’ল। মা কেঁপে উঠলেন। ঐ আসছে। জেলের দেয়ালের গা ঘিসে একটি ল্যাম্পপোস্ট।
একটি লোক বাতিওয়ালার মতো পা ফেলে ফেলে ল্যাম্পপোস্টের কাছে এলো। তার কাধে একটা দড়ির সি ড়ি। বেশি ব্যস্ততা না দেখিয়ে সে সিঁড়িটা দেয়ালে আটকে অতি সহজভাবে বেয়ে ওপরে উঠে দাঁড়ালো, হাত দুলিয়ে ইঙ্গিত করলো, তারপর তর তর করে নেবে এসে অদৃশ্য হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে জেলের ভেতর থেকে দেয়াল টপকে বাইরে নেবে এলো রাইবিন এবং গড়ুনের ভাইপো। তাদেরও অদৃশ্য হতে বেশি দেরি হল না।
পরক্ষণেই জেলের পাগলা-ঘণ্টা বেজে উঠলো…পুলিস ছুটছে, সৈন্য ছুটছে…মহা হুলস্থুল।
একটা পুলিস ছুটলতে ছুটলতে মাকে এসে প্রশ্ন করলো, এই বুড়ি… একটা লোক…কালো দাড়ি তার…তাকে এখান দিয়ে পালাতে দেখেছিস?
হাঁ, বাবা। উই দিকে গেলো…বলে মা উল্টো দিক দেখিয়ে দিলেন। সে মহোৎসাহে সেদিকে চলে গেলো।
মাও বাড়ি চলে এলেন।
.
হপ্তাখানেক পরে আদালত লোকে লোকারণ্য। আজ মামলা শুরু। আসামীদের আত্মীয়েরা ভিড় কবে এসে বসেছে। মা বসেছেন কম্পান্বিত হৃদয়ে, শিজভের পাশে। বিচার-মঞ্চের পেছনের দুয়ার খুলে বিচারকেরা এলেন। সবাই উঠে দাঁড়ালো। তারপরই এলো অন্য এক দুয়ার দিয়ে রক্ষী-সমেত পেভেল, এণ্ড্রি, মেজিন, গুসেরা বাপ-ছেলে, শ্যাময়ল, বুকিন, শোমোভ এবং আরো পাচজন যুবক মা তাদের নাম জানেন না।
.
২.১৫
মামলা শুরু হলো…বিচাবকদের একজন একট। #গজ নিয়ে পড়তে লাগলেন। উকিলেরা যেন তা শোনার তেমন দরার বোধ না কবে আসামীদেব সঙ্গে কথা বলতে লাগলো।
হঠাৎ পেভেলের তেজোদৃপ্ত কণ্ঠস্বরে সবাই চমকিত হয়ে নির্বাক হয়ে গেলো—এখানে কোন আসামী বা জজ নেই…এখানে আছে শুধু বন্দী এবং বিজেতা।…
জজ যেন উদাসভাবে বললেন, তারপব, এণ্ড্রি, নখোদকা, তুমি কি তোমার অপরাধ স্বীকার করছ?
এণ্ড্রি সটান দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিয়ে চোখের কোণ দিয়ে চেয়ে বললো, আমার অপরাধ? কি করেছি আমি? চুরিও করিনি, খুনও করিনি! আমি শুধু বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি তেমনি জীবন-যাত্রার, যাতে মানুষ বাধ্য হয় পরস্পর হানাহানি এবং রাহাজানি করতে।
জজ বললেন, সংক্ষেপে জবাব দাও, ‘ই’ কি না?
এণ্ড্রি ও সমান স্পর্ধার সঙ্গে কি একটা জবাব দিলো। শ্রোতৃমণ্ডলী তাতে বেশ একটু চঞ্চল হয়ে উঠলো। আসামীদের দিকে সবারই প্রশংসমান দৃষ্টি।
ফেদিয়া মেজিন, তুমি জবাব দাও।
মেজিন একলাফে উঠে দাঁড়ালো…জবাব আমি দেবোনা, দিতে চাইনে। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে আমি অস্বীকৃত।…কোনকিছু বলার ইচ্ছে নেই আমার। তোমাদের আদালতকে আইনসঙ্গত বলে আমি মনে করিনে। কে তোমরা তোমাদের কি এক্তাব আছে আমাদের বিচার করার? সে অধিকার কে দিয়েছে তোমাদের? জন-সাধারণ? আমি তোমাদের চিনিনে।…ব’লে সে টপ করে বসে পড়লো।
এরপর অভিনয়ের অন্যান্য দৃশ্যগুলি পর-পর অভিনীত হতে লাগলো। জজদের মন্তব্য, সরকারি উকিলের আলোচনা, শেখানো-পড়ানো সাক্ষীদের সাক্ষ্য!…কিছুকালের জন্য আদালত ভঙ্গ…তারপর সেসন আরম্ভ।
শুরুতেই সরকারি উকিলের চার্জসীট দাখিল। অভিযুক্ত আসামীরা সদাহাস্য, নির্বিকার, তেজস্বী। জজরা যেন অসীম ঔদাসীন্য এবং নির্বিকারিতার এক-একটি ডিপো। সরকারি উকিলের লম্বা বক্তৃতা শোনার ধৈর্য যেন তাদের ছিল না।
সরকারি উকিলের পর আসামীপক্ষের উকিলের ডাক পড়লো।
একজন উকিল উঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, জীবন্ত শক্তিমান পুরুষ যে, যার অনুভূতি আছে, সাধুতা আছে, সে কখনও যথাশক্তি বিদ্রোহ না করে পারে না, এই প্রাণহীন, প্রবঞ্চনাময়, মিথ্যাভরা জীবনের বিরুদ্ধে, সে কখনও না দেখে পারে না এই জ্বলন্ত বৈষম্য…
সাবধান হয়ে কথা বলুন।
উকিল বিন্দুমাত্র না দমে সমানভাবে বক্তৃতা চালাতে লাগলেন। ফলে সরকারি উকিল বেশ একটু গরম হয়ে উঠলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে মেতে উঠলো আসামীদের প্রতি সহানুভূতি-সম্পন্ন শ্রোতৃদল।
হঠাৎ সব চুপচাপ। পেভেল উঠে দাঁড়িয়েছে। মা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।
পেভেল বলতে লাগলো, দলের লোক হিসেবে আমি মানি একমাত্র আমাদের দলের আদালতরে। এই আদালতে তাই আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করবো না। আমি শুধু আপনাদের বোঝাতে চেষ্টা করবো, যা আপনার বোঝেন না। সরকারি উকিল বলেন, সাম্যবাদের পতাকাতলে আমাদের এ জাগরণ নাকি কর্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। আমরা নাকি জার-দ্রোহী ছাড়া কিছুই নই। আমি আজ আপনাদের কাছে বলতে চাই যে আমাদের দেশের বন্ধন-শৃঙ্খল একমাত্র জার নয়…তবে সর্বপ্রথম এবং সর্বঘনিষ্ট বন্ধন হিসাবে তাকে আমরা সরিয়ে ফেলতে বাধ্য। আমরা সাম্যবাদী অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পত্তি, যার ফলে মানুষে মানুষে বৈষম্য, হানাহানি, স্বার্থের সংঘাত…এবং এই স্বার্থ-সংঘাত মিথ্যা দিয়ে ঢাকার অথবা সমর্থন করার চেষ্টা… অসত্য, শঠতা, ঈর্ষা-দুষ্ট সমাজের আবির্ভাব…আমরা সেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির শত্রু। যে-সমাজ মানুষের দাম কষে শুধু ধনোৎপাদনের যন্ত্র হিসাবে, সে-সমাজকে আমরা বলি অমানুষিক, সে সমাজ আমাদের বিরোধী, এর নীতির সঙ্গে আমরা বনিবনাও করে চলতে পারিনে, এর দু’মুখো মিথ্যাবহুল হৃদয়হীনতা, মানুষের ওপর এর নিষ্ঠুর সম্পর্ক আমাদের কাছে অসহ্য। আমরা যুদ্ধ করতে চাই…যুদ্ধ করব…এ সমাজের প্রত্যেক কায়িক এবং নৈতিক দাসত্বের বিরুদ্ধে; স্বার্থান্বেষীদের বৈষম্যমূলক সমাজ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আমরা মজুরদুনিয়ার সমস্ত কিছু সৃষ্টির মূলে আমাদের শ্রম…বিবাট যন্ত্র থেকে শুরু করে শিশুর হাতের খেলনাটি পর্যন্ত আমাদেরই তৈরি। সেই আমরা মনুষ্যোচিত মর্যাদারক্ষাকল্পে যুদ্ধ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত। সবাই আমাদের খাটিয়ে নিতে চায়, খাটিয়ে নিতে পারে—স্বার্থসিদ্ধিব যন্ত্র-হিসাবে। আজ আমরা চাই সেই সমস্ত বিরুদ্ধ-শক্তিকে জয় করবার মতো স্বাধীনতা। আমাদের মন্ত্র সহজ। মানুষের জন্য সমস্ত শক্তি, মানুষের জন্য সমস্ত উৎপাদন-যন্ত্র, সমস্তের ওপর বাধ্যতামূলক কাজ, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান।… আপনারা দেখতে পাচ্চেন, আমরা আইনদ্রোহী নই।
একজন জজ বললেন, কাজের কথা বল।
পেভেল স্পষ্টস্বরে বলতে লাগলো। আমরা বিদ্রোহী। ততদিন বিদ্রোহী থাকবে, যতদিন ব্যক্তিগত সম্পত্তি আছে,…যতদিন কেউ শুধু হুকুম চালায়, কেউ কেবল তার হুকুমে খাটে। যে-সমাজের স্বার্থবক্ষাকল্পে আপনারা নিযুক্ত, আমরা তার মরণ-শত্রু। আমরা জয়ী না হওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে কোন আপোস আমাদের হতে পারে না। আমরা…মজুররা জয়ী হবোই। সমাজ নিজেকে যতখানি শক্তিমান মনে করে, আদৌ সে ততখানি শক্তিমান নয়। যে সম্পত্তি সৃষ্টি এবং রক্ষাকল্পে লক্ষ লক্ষ লোক আজ দাসত্ব-নিগড়ে আবদ্ধ, যে বলপ্রভাবে সমাজ আজ মানুষের ওপর এতো শক্তিসম্পন্ন, তা-ই শ্রেণীতে শ্রেণীতে আজ জাগিয়ে তুলেছে এতে। সংঘাত, বয়ে আনছে মানুষের কায়িক এবং নৈতিক মৃত্যু। দুনিয়ায় আজ যে এতো শক্তির অপব্যবহার তা শুধু এই ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার দুরূহ চেষ্টার দরুণ। বাস্তবপক্ষে আমাদের চাইতে বড় গোলাম আপনারা–আমাদের বন্ধু দেহ, আর আপনাদের বদ্ধ মন। সংস্কার এবং অভ্যাসের যে জগদ্দল পাথরের তলে পড়ে মন আপনাদের পিষ্ট, তা থেকে মুক্ত হবার সাধ্য আপনাদের নেই। কিন্তু মনকে মুক্ত করার পক্ষে কোনো বাধাই নেই আমাদের। আপনার বিষ ঢেলেছেন আমাদের বাইবে, কিন্তু আমাদের মনে চলেছে তার চেয়েও প্রবলতর এক প্রতিক্রিয়া…তাই-ই আজ ক্রমবর্ধমান অগ্নিশিখায় জ্বলে উঠেছে আমাদের মধ্যে; শুধু তাই নয়, আপনাদের শক্তিও নিচ্ছে শুষে। তার ফলে, মানুষ আদর্শের জন্য যেমনভাবে লড়াই করে, আপনাদের ক্ষমতার জন্য তা আপনারা পারছেন না। ন্যায়দণ্ড থেকে আত্মরক্ষার যত রকম যুক্তি হতে পারে, সব আপনাদের এরি মধ্যে নিঃশেষ হয়ে গেছে। ভাবের জগতে নতুন কোনকিছু আর সৃষ্টি করতে পারেন না আপনারা, ভাবজগতে আপনারা দেউলে। নব-ভাবের ভাবুক আমরা, উত্তরোত্তর দীপ্ত হয়ে উঠছে আমাদের মন, আমাদের উদ্বুদ্ধ করে তুলছে মুক্তি-সংগ্রামে। সুমহান্ পবিত্র ব্রতের কথা স্মরণ করে দুনিয়ার সকল মজুর আজ একপ্রাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিষ্ঠুরতা এবং হৃদয়হীনতা ছাড়া আপনাদের আর কিছু নেই, যা এই নব-জাগ্রত জীবনের পথে তুলে ধরতে পারেন বাধার মতো। কিন্তু আমরা জানি, যে-হাত দিয়ে আজ আপনারা আমাদের কণ্ঠরোধ করতে যাচ্ছেন, তাই-ই কাল এসে মিলবে আমাদের হাতে বন্ধুর মতো। আপনাদের শক্তি স্বর্ণশক্তি, একান্তই প্রাণহীন আপনাদের তা শুধু বিভক্ত কবছে পরস্পর-বিধ্বংসী দলে। আর আমাদের শক্তি জীবন্ত-শক্তি-মজুদের ক্রমবর্ধমান আত্মসংবিতের ওপর তার প্রতিষ্ঠা। আপনারা যা করেন সবই অন্যায়; কারণ সবেরই উদ্দেশ্য মানুষেব চার পাশে দাসত্বের বেড়াজাল সৃষ্টি করা। আমাদের কাজ পৃথিবীকে মুক্ত করবে আপনাদের লোভ এবং বিদ্বেষপ্রসূত ভ্রান্তি ও বিভীষিকা হ’তে। মানুষকে আপনারা টেনে ছিঁড়ে নিয়েছেন তার জীবন থেকে, তাকে আপনারা করেছেন শতধা-বিভক্ত। সাম্যবাদ এই বিছিন্ন জগতকে এক করে জুড়ে এক বিরাট শ্রেণীহীন-সমাজের সৃষ্টি করবে। এ হবে, হবে।…
পেভেল থামলো। জজরা দস্তুরমতো উষ্ণ হয়ে উঠলেন। পেভেলের সঙ্গে বেশ কড়া ভাষায় এবং চড়া সুরে একজন জজ কথা বলায় পেভেল শান্ত কিন্তু শ্লেষ-ভরা কণ্ঠে জবাব দিলো : আমার বক্তব্য শেষ হয়ে এসেছে। আপনাদের ব্যক্তিগত অপমান করা আমার ইচ্ছা ছিল না। সত্য কথা বলতে কি, এই যে রঙ্গাভিনয় …যার নাম আপনারা দিয়েছেন বিচার, তার অনিচ্ছুক দর্শক হিসাবে আপনাদের অবস্থা দেখে আমার কষ্টই হয়। শত হলেও আপনারা মানুষ… আর মানুষ, তা হ’ক না সে আমাদের শত্রু, তাকে পশুবলের কাজে এমন নির্লজ, হীন, আত্মমর্যাদাবোধশূন্য দেখতে প্রাণে লাগে।…
জজের দিকে দৃকপাত না করে সে বসে পড়লো।
এণ্ড্রি এবং অন্যান্য সঙ্গীবা পেভেলকে আনন্দে অভিনন্দিত করলো।