২.১১-১৫ ছায়াসঙ্গিনী

২.১১ ছায়াসঙ্গিনী

একা একা, নিঃসঙ্গ, সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। ভবিষ্যতের দিকে যত দূর চায় কোথাও এতটুকু সঙ্গ নেই, আশ্রয় নেই, ছায়াতরুর স্নেহ নেই, গ্রামের আভাস মাত্র নেই। নিঃসঙ্গতা এমন সম্পূর্ণ যে, মন ভীত হয়ে ওঠে, অবশেষে ভীতির চরমে এসে ভয়টাও মিলিয়ে যায়–ঐ ক্ষীণ বনান্তের পাড়খানি যেন কখন অজ্ঞাতসারে দিগন্তে মিলিয়ে গিয়েছে।

রেশমী একাকী বসে বসে ভাবে আর দেখে। কখন যে তার ভাবনা দেখায় পরিণত হয়, আর দেখা যে কখন ভাবনায় রপান্তরিত হয় টের পায় না।

টাঙন নদীর পশ্চিমে রাঙা মাটির রিক্ত ডাঙা জমির নিস্তব্ধ ওঠা-পড়া একখানি নীরব বেহাগ রাগিণীর মত দিগন্তে গিয়ে সমে মিশেছে। ঐ জনপ্রাণী-তরুগুল্মহীন নিঃশব্দে ওঠা-পড়ার মধ্যে রেশমী নিজ জীবনের ছবি যেন দেখতে পায়—তার নির্জন ভবিষ্যৎ যেন রূপ ধরে সম্মুখে উপস্থিত।

বিকালের দিকে সময় পেলে—সময়ের তার অভাব কি-একাকী চলে আসে এখানে। স্বচ্ছ জলে ভরা ছোট একটা বাঁধ সে আবিষ্কার করেছে, তার একদিকে সেই নিঃসঙ্গ কুসুমতরুটি। এখানে এসে বসে রেশমী; ঠিক জলের ধারে একখানি পাথর, বসে সেই পাথরে, পা দুখানি ঈষৎ জলে ডুবিয়ে। কাকচক্ষু জলে ছায়া পড়ে, হোট ঘোট পাথরের টুকরো জলে ফেলে ফেলে ছায়াকে চঞ্চল করে তুলে সে আপনার সঙ্গে আপনি খেলা করে। মানুষ যখন আপনার ছায়ার সঙ্গ কামনা করে, বুঝতে হবে তখন তার অবস্থা কৃপার যোগ্য। আগে অনেকটা সময় তার কাটত গাঁয়ের মধ্যে। কিন্তু তার জীবনবৃত্তান্ত জানায় গ্রাম দ্বার বন্ধ করেছে। এক সঙ্গী ছিল ঐ রহস্যময়ী ফুলকি বলে মেয়েটা। আজ কদিন থেকে সে-ও নিরুদ্দেশ। ভোলা বাগদির বাড়িতে তার রাত্রিযাপন নিয়ে ভোলাদের দুই ভাই-এ মাথা-ফাটাফাটি হয়ে যায়। ভোলা দিয়েছিল তাকে শাড়ি, ভেবেছিল তার ঘরে রাত কাটাবে ফুলকি, কিন্তু ইতিমধ্যে তার কনিষ্ঠ হার তাকে নাকছবি কবুল করে ঘরে নিয়ে যায়। ভোরে হারুর ঘর থেকে ফুলকিকে বেরুতে দেখে দুই ভাই-এ লাঠালাঠি শুরু হয়ে যায়—ফলে দুজনেরই মাথা ফাটে। ফুলকি গিয়েছিল থামাতে, রক্তে তার কাপড় গেল রাঙা হয়ে। এসব কথা ফুলকির মুখেই শোনা। দিব্য অনায়াসে সব বৃত্তান্ত সে বলে গেল-বেহায়া মেয়েটার এতটুকু লজ্জা, এতটুকু আৰু নেই। রেশমী জিজ্ঞাসা করেছিল, এমন করলে কেন ভাই?

ফুলকি বলে, আমার কাছে যে ভোলা সে হারু, তফাত কি বল!

কিন্তু ওরা যে মাথা-ফাটাফাটি করল?

ও ওদের অভ্যাস। মাসের মধ্যে একবার করে ওদের মাথা ফাটে, এবারে না হয় আমাকে নিয়েই ফাটল!

তোমার লজ্জা করে না?

লজ্জারও তো একটা সীমা আছে। যে কথা সবাই জানে, তাকে আর লজ্জার বলি কেন?

না ভাই, এ ভাল নয়।

প্রসঙ্গান্তর করে ফুলকি বলল, তুমি ভাই একটু সাবধানে থেকো।

ভীত রেশমী শুধাল, কেন?

গায়ের দু-চারজন রসিকের চোখ পড়েছে তোমার উপরে।

সে কি ভাই, আমি তো ও-রকম মেয়ে নই।

আরে সেইজন্যই তো পড়েছে চোখ।

কিছু বুঝতে পারে না রেশমী, শুধায়, সে আবার কেমন?

ফুলকি বলে-যতদিন ওরা জানত যে তুমি কুমারী, তোমার দিকে চোখ দেয় নি। কিন্তু পরে যখন জানতে পারল যে, তোমার এ-কুলও গেছে, ও-কুলও নেই, তোমার দিকে ঝুঁকল। পুরুষগুলোর ভাই ওই স্বভাব, বেওয়ারিশ মেয়ে পেলে লোভের অন্ত থাকে না। একটু সাবধানে থেকে তোমার আমার মত মেয়েদের দিকেই ওদের দৃষ্টি।

তোমার আমার কথাটা রেশমীর ভাল লাগল না; যতই কেন না বন্ধুত্ব থাক ফুলকির সঙ্গে, তবু তার সঙ্গে একত্র উল্লেখে তার আপত্তি ছিল।

এই ঘটনার পরে ফুলকির সঙ্গে আর তার দেখা হয় নি; গাঁয়ের মধ্যে গিয়ে সন্ধান করতে সাহস হয় না, ফুলকিও আসে না।

রেশমী ভাবে, ফুলকি তবে কি অন্যত্র চলে গেল? তার কথাগুলো মনে পড়ে। মেঘের মত হাওয়ার টানে এসেছে, আবার একদিন হাওয়ার টানে ভেসে যাবে। তবে কি হাওয়ার টানেই ভেসে গেল! রেশমী বুঝতে পারে না হাওয়ার টানটা কি? ফুলকির প্রতি তার মনোভাব বড় বিচিত্র—একই সঙ্গে ঘৃণা আর ভালবাসা। দুরন্ত কৌতূহল ঘৃণা আর ভালবাসাকে যুক্ত করে রেখেছে তার মনে।

বাঁধের ওপারে নজর পড়তেই চোখে পড়ল কুসুমতরুটা—সরল উন্নত গাছটি আগাগোড়া রক্তিম হয়ে উঠেছে। তা মনে পড়ল কদিন এদিকে আসে নি। এর আগে যেদিন এসেছিল, দেখেছিল উপরের পাতাগুলোয় লালের আভাস-আজ আর কোথাও এতটুকু সবুজের ছোঁয়া নেই। সমস্ত মাঠের মধ্যে ঐ একটিমাত্র গাছ-ঘন রক্তিম। তার মনে হল ঐ একটি রন্ধ্রপথে মাঠের সমস্ত লাল রঙ ঊর্ধ্বে উৎসারিত। ঐ নিঃসঙ্গ দলছাড়া খাপছাড়া তরুটির সঙ্গে কেমন এক আত্মীয়তা অনুভব করে রেশমী; মনে মনে ভাবে, আমাদের দুজনের এক দশা, আমরা না-বাগানের না-বনের।

টুপ, টুপ, টুপ। পাথরের টুকরোয় জলে তার ছায়া চঞ্চল হয়ে ওঠে।

রেশমী মাথা দুলিয়ে শুধায়, কিগো, অমন ছটফট করছ কেন?

ছায়া মাথা দোলায়, উত্তর দেয় না।

রেশমী মুগ্ধ দৃষ্টিতে ছায়াটিকে দেখে মনে মনে ভাবে—আহা, কি সুন্দর! তার মনে হয় বিশ্বের যাবতীয় রূপ যেন শরতের শিশিরকণার মত অশথপাতার শিষটির শেষ প্রান্তে এসে দোদুল্যমান।

ইস্, খুব যে রূপ!

ছায়া হাসে-স্পষ্ট দেখা যায় তার গালের টোল দুটি।

এত রূপ কার জন্যে গো?

এবারে ছায়া নিস্তব্ধ, বোধ করি তার চোখের কোণ জলে ভরে ওঠে, জলে জল এক হয়ে যায়, কিছু বোঝা যায় না।

এবারে রেশমী মাথা নাড়িয়ে বলে, এত রূপ ভাল নয় রে, ভাল নয়!

ছায়া মাথা নাড়িয়ে তাকে সমর্থন করে।

শুনেছিস তো, দু-চারজনের চোখ পড়েছে তোর উপরে?

ছায়া ভয়ে নিস্তব্ধ হয়ে থাকে।

কিছুদিন হল রেশমী বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত উতলা ভাব বোধ করছিল—মনটা কেমন যেন যখন-তখন অকারণে উন্মনা হয়ে যায় তার। খাঁচার পাখী ক্ষণে ক্ষণে উধাও হয়ে যায় আকাশে, দরজা বন্ধ করতে ভুলে যায় মালিক। কেন এই উভ্রান্তি বুঝতে পারে না, বুঝতে না পারলেও উভ্রান্তিটা তো মিথ্যা নয়। তার মনে হয়, মনের মধ্যে কোথাও যেন ফুল ফুটেছে-স্বগীয় তার গন্ধ, দিব্য তার উন্মাদনা। কি ফুল ফুটল, কোথায় ফুটল, ব্যাকুল হয়ে ওঠে সে, খুঁজতে বের হয়। কিন্তু হায়, মনের ফুলের সন্ধান বাইরে পাবে কেমন করে? মনের গহনে কি প্রবেশ করতে পারে সবাই? তাই শুধু সে এখানে ওখানে হাতড়ে বেড়ায়। কমে গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, রেশমীর জীবন দুর্বহ মনে। হয়। কত বাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে দুই হাতে বুক চেপে ধরে কেঁদেছে—চোখের জলে অন্ধকার ধুয়ে ভোর হয়ে গিয়েছে। এই অকারণ আবেগ, অমূলক বেদনা কেন, সে বুঝতে পারে না। যে দুঃখের কারণ স্পষ্ট তার সীমা আহে, অকারণ দুঃখ অনন্ত। সে যখন ধীরভাবে চিন্তা করে, দেখতে পায় যে, দুঃখটাও নিচ্ছিদ্র নীরঞ্জ নয়, তার মধ্যেও আলোকরশ্মি আছে, একরকম আনন্দ আছে, বেশ একটু মজা আছে। তখন সে দুঃখের সঙ্গে খেলা করে, যেমন করে ঐ ছায়াটির সঙ্গে। দুঃখ তার বুকের রক্ত শোষণ করে রস সংগ্রহ করে, সেই রস তার খাদ্য, তার প্রাণ—এটুকু পীড়াদায়ক। কিন্তু মরি মরি, সেই দুঃখের লতায় ফুলের কি অপূর্ব শোভা! মানুষ গাছ, দুঃখ পরগাছা, গাছের ফুলের চেয়ে পরগাছার ফুলের সৌন্দর্য বেশি।

কিন্তু একদিন সে বুঝতে পারল দুঃখের কারণ, বুঝিয়ে ছিল ঐ ছায়সঙ্গিনী। নিজের ছায়া দেখে সে চমকে উঠল—সম্মুখে ও কে? পুরাণে শোনা অঙ্গরীদের কেউ নাকি? এত রূপ তার? রূপ নাকি গৌরব! তার খুশি হওয়া উচিত ছিল, তার বদলে জলের ধারে লুটিয়ে পড়ে সে কাঁদল—সাথে সাথী হায়াও কাঁদল নীরবে। সে ভেবে পায় না, কেন এমন হল? রূপ রমণীর গৌরব, গৌরবে আছে গুরুত্ব, সেই গুরুভারে সে পীড়িত–এ কান্না সেই পীড়নের। ফুলের ভারে গাছ পীড়িত, ফলের ভারে শাখা পীড়িত, তারার ভারে পীড়িত শরতের আকাশ, নীরবতার ভার চরাচরের পীড়া, আর আজ রেশমী পীড়িত রূপের দুর্বহ ভারে।

যে-বন্যা এক রাতের মধ্যে এসে চরাচর ডুবিয়ে দেয় তার সন্ধান আগে পাওয়া যাবে কেমন করে? রেশমীর রূপের আবির্ভাবও যে বন্যার অতর্কিত অভিযান। কাল ছিল সে কিশোরী, এখানে-ওখানে রূপের কুঁড়ি উকি মারছিল, আজ সে পরিপূর্ণ যুবতী। দেহের কানায় কানায় রূপের বান, আর এক অঞ্জলি বেশি হলে পাড় যাবে ছাপিয়ে।

টুপ, টুপ, টুপ।

শোন লো শোন, গায়ে সামলে কাপড় দিস। দেখেছিস তো ফুলকির হেনস্তা।

ছায়া হাসে।

এত হাসির কপাল! তিন কুলে নেই কেউ!

ছায়ার উত্তর কেড়ে নিয়ে নিজেই বলে, ফুলকিরও তো নেই কেউ, তাতে কি তার হাসির অভাব হয়েছে?

তবে কি ফুলকির মত হতে চাস নাকি?

আবার ছায়ার উত্তর নিজে দেয়, ছি ছি, গলায় দড়ি!

এমন সময়ে হাওয়ায় বুকের আঁচল পড়ে খসে। খলিত-অঞ্চল বুকের দিকে তাকিয়ে পলক পড়ে না রেশমীর চোখে।

কায়া আর ছায়া দুজনে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে সৌন্দর্যমেরুর শিখরে।

পুরাণের মতে সৃষ্টির যাবতীয় সুবর্ণ পুঞ্জীভূত হয়েছে মেরুচুড়ায়, এখানেও বুঝি তাই। রেশমী ভাবে, আহা, এক মুহূর্তের জন্য যদি সে পুরুষের চোখ পেত, দেখে নিত ঐ দৃশ্যটি।

হঠাৎ তন্দ্রা ভেঙে সে চমকে ওঠে, জলে আর একটি ছায়া পড়েছে। তাড়াতাড়ি বুকে আঁচল তুলে দেয়।

কে, কায়েৎ দাদা নাকি? কখন এলে?

রাম বসু বলে, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখতে পেলাম তোমাকে। তা এখানে একা বসে কি করছ? সন্ধ্যাবেলা মাঠের মধ্যে একা একা থাকা কিছু নয়।

রেশমীর মনে পড়ল ফুলকির সতর্কবাণী, ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, চোর-ডাকাতের ভয় নাকি?

মাঠের মধ্যে চোর-ডাকাত কি লুট করবে? নেকড়ে বেরুতে পারে।

চল তবে কায়েৎ দাদা কুঠিতে ফিরে যাই, সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে খেয়াল ছিল না।

দুজনে কুঠি বলে রওনা হল।

রাম বসুর ‘হঠাৎ দেখতে পেলাম তোমাকে’ কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। হঠাৎ দেখতে পেয়েছিল সত্য-কিন্তু কিছুক্ষণ রেশমীর অগোচরে দাঁড়িয়ে যে তাকে দেখছিল সে কথাটা বলে নি, এমন ক্ষেত্রে বলা চলে না।

রাম বসু আজ যেন হঠাৎ নূতন করে রেশমীকে আবিষ্কার করল, দেখল সে অপূর্ব সুন্দরী। বাঁধের ওদিকের রক্তিম কুসুমরুটির সঙ্গে রেশমীকে মিলিয়ে দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল, বা বা, এরা দুজনে যেন জুড়ি, যেমন একক তেমনি দলছাড়া, তেমনি রহস্যময় সৌন্দর্যময়! রাম বসুর কেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব।

রেশমী শুধাল, কেরী সাহেব কি মহীপাল দিঘিতে রওনা হয়েছেন?

কেমন করে হবেন, মিসেস কেরী যে আরও বেশি উন্মাদ হয়ে উঠেছেন।

হবেন না! কোলের ছেলেটা হঠাৎ মারা গেল। মিসেস কেরী যে কদিন বাঁচবেন তাই ভাবছি।

সে ভাবনা কর না, সাহেবী প্রাণ খুব শক্ত। বোটা শক্ত হওয়ার আগে জ্যাভেজের মত ঝরে পড়লে এক কথা। কিন্তু একবার বোঁটা শক্ত হয়ে গেলে যমরাজের পাইক-বরকন্দাজের সাধ্যও নেই লাঠির ঘায়ে পাডে। ওদের নিতে হলে স্বয়ং যমরাজকে আসতে হবে।

এইরকম কথাবার্তা বলতে বলতে দুজনে কুঠির কাছে এসে পড়ল, এমন সময়ে নৈশ অন্ধকার বিদীর্ণ করে সঙ্গীত ধ্বনিত হল—‘ভরা নদী ভয় করি নে, ভয় করি সই বানের জল।‘

কে গান করে রে?

ফুলকি। চেন না ওকে কায়েৎ দাদা?

দেখেছি বটে মেয়েটাকে।

তুমি যাও কায়েৎ দাদা, আমি ওর সঙ্গে দুটো কথা বলে আসি, দেখি নি অনেক দিন ওকে। ফুলকি, এদিকে আয় ভাই।

.

২.১২ অন্ধকারের ভুল

ফুলকি শুধাল, এত রাতে কোথায় গিয়েছিলে?

রেশমী বলল, এত রাতে কোথায়? কেবল তো সন্ধ্যা!

তা বটে, কলির সন্ধ্যা আর কি! তা সঙ্গে উটি কে ছিল?

চেন না? কায়েৎ দাদা।

তা কায়েৎ দাদার সঙ্গে এত রাতে মাঠের দিকে গিয়েছিলে কেন? বলে ফুলকি মুচকে হাসল।

তার হাসি দেখে রেশমীর গা উঠল জ্বলে, সে বেশ একটু তেতে উঠে বলল, যেখানেই যাই, যার সঙ্গেই যাই, তোমার তাতে কি?

ভাল রে ভাল! আমি তোমার হয়ে লড়াই করে মরছি—আর তুমি করছ রাগ!

রেশমীর রাগ কমে নি, গা তখনও জ্বলছিল, তবু রাগ দমন করে শান্তভাবে শুধাল, আমার হয়ে কার সঙ্গে লড়াই করছিলে?

গোপাল নায়েবের সঙ্গে।

আর লড়াই-এর বিষয়টা কি, শুনি?

তবে শোন, শুনে রাখাই ভাল—এই বলে সে আরম্ভ করল, আজ অনেকদিন থেকে নায়েব বলছে, ওরে ফুলকি, তোর সঙ্গে তো ঐ কুঠির মেয়েটার খুব ভাব-সাব, ওকে যোগাড় করে দে না। আমি বলি, নায়েব মশাই, ও সে-রকম মেয়ে নয়, ওর দিকে নজর দিও না। নায়েব বলে, রাখ রাখ—তিন কলে কেউ নেই, ভরা যৌবন, আবাব সে-রকম মেয়ে নয়। তা ছাড়া, কতদিন ওকে রাতের বেলায় মাঠের দিক থেকে ফিরতে দেখেছি-অত রাতে মাঠের মধ্যে যায় পূজো করতে, না?

ফুলকির কথা শুনে রেশমী স্তম্ভিত হয়ে যায়, সে স্বপ্নেও ভাবে নি তার যাতায়াত কেউ লক্ষ্য করছে–আর তার এমন কদৰ্থ সম্ভব।

রেশমীকে নীরব দেখে ফুলকি বলে চলল, আজ আবার নায়েব ধরেছিল, যা ফুলকি, মেয়েটাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজী করে ফেল, তাকে বালস, গয়নাগাটি দেব—আর তুইও বাদ যাবি নে।

তার পরে একটু থেমে পুনরায় আরম্ভ করল, আসছিলাম তোমাকে সাবধান করে দিতে। কিন্তু এখন দেখছি নায়েবের কথা মিথ্যে নয়—ধরা পড়লে তো একেবারে বামাল ধরা পড়লে, তাও আবার আমার চোখে!

রেশমীর ঝগড়াঝাঁটি করা স্বভাব নয়, জীবনে কখনও ঝগড়া করেছে বলে কেউ জানে না কিন্তু ফুলকির কথায় তার গা এমন জ্বলে উঠল যে ভুলে গেল নিজ স্বভাব।

সে ঝঙ্কার দিয়ে উঠে বলল, আমি যখন যত রাতে খুশি যেদিকে ইচ্ছা যাব, কারও তোয়াক্কা আমি রাখি নে।

ফুলকিও কখনও রাগে না, তবে খোঁচা দিতে পারে বিলক্ষণ, বলল, আর যার সঙ্গে খুশি যাবে, কি বল?

নিশ্চয়।

এবারে ব্যঙ্গ মিশিয়ে বলল, তবে ভাই একবারটি নায়েব মশাই-এর সঙ্গে যাও না। আহা, বুড়ো মানুষ, বেচারার অনেকদিনের শখ! তাছাড়া, দুটো একটা গয়নাগাটি যদি পাই, তোমার ভাগ্যে তো বাজুবন্দ নাচছে!

তবে তাই গড়াতে বলে দাও গে তোমার নায়েব মশাইকে-অসহ্য ক্রোধে কাঁপছিল রেশমী।

রেশমীকে ভাল মেয়ে বলে ধারণা হয়েছিল ফুলকির, তাই সে গায়ে পড়ে এসে মিশত তার সঙ্গে। এখন সেই ধারণা ভেঙে যাওয়ায় ফুলকির মনের মধ্যে চলছিল আলোড়ন। ফুলকির ধারণা ছিল যে, মানুষের ভাল মন্দ সে চেনে, এখন সে ধারণা ভঙ্গ হওয়ায় বোকা বনে গিয়েছে সে। দেখা গেল যে, রেশমী তার চেয়েও চতুর। তাই সে নিজের প্রতি ধিক্কার অনুভব করছিল। চতুর মানুষের বিপদ এই যে, একবার বোকা প্রতিপন্ন হয়ে গেলে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারে না। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য দায়ী করল রেশমীর সূক্ষ্মতর বুদ্ধিকে—তাই গঞ্জনার সুরে বলল, আর কি কি গয়না পছন্দ বলে দাও, একসঙ্গে গড়ালে নায়েব মশাই-এর দু পয়সা সস্তা পড়বে।

খুব যে দরদ নায়েব মশাই-এর জন্য!

হবে বই কি ভাই, আমিও তো কিছু কিছু পেয়েছি কিনা।

তবে তুমিই যাও না, আবার কুটনীগিরি করতে এসেছ কেন?

এসব জাগ্রত দেবতা, নিত্য নূতন ভোগ চাই, নইলে আমার কি অসাধ!

রেশমীর গালাগালির অভিধান খুব বৃহৎ নয়, কোন শব্দ ব্যবহার করবে ভাবছে এমন সময়ে ন্যাড়া এসে উপস্থিতঃ রেশমীদিদি, তুমি এতক্ষণেও ফেরনি দেখে কায়েৎ দাদা চিন্তিত হয়ে উঠেছেন, আমাকে পাঠালেন, শীগগির চল।

রেশমী বুঝল, ঘটনাচক্র আজ তার প্রতিকূল, ফুলকির মনগড়া ধারণাটাই ক্রমে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে, ভয় ছিল ন্যাড়ার সম্মুখে ফুলকি না-জানি কি বলে বসে!

ফুলকি এমন কিছু বলল না যাতে ন্যাড়ার সন্দেহ উদ্রেক করে—অথচ অতি-সাধারণ কথায় এমন একটি সুর মিশিয়ে দিল যাতে রেশমীর বুঝতে ভুল না হয়।

যাও ভাই শীগগির যাও, কায়েৎ দাদার কথা অমান্য করলে তিনি আবার রাগ করবেন!

রেশমীর উত্তর দেওয়ার সাহস ছিল না, পাছে ন্যাড়া সন্দেহ করে, আর উত্তর দেওয়ার ইচ্ছাও ছিল না। সে ন্যাড়াকে অনুসরণ করে হন হন করে প্রস্থান করল। ফুলকির সন্দেহে তার সর্বাঙ্গ জ্বলছিল। মক্ষীয়মাণ গানের সুরে বোঝা যাচ্ছিল যে, ফুলকি ক্রমেই দূর থেকে দূরান্তরে চলে যাচ্ছে–

‘ভরা নদী ভয় করি নে
ভয় করি সই বানের জল।‘

.

২.১৩ রাম বসুর আবিষ্কার

রাম বসু হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলেছে যে, রেশমী অপূর্বসুন্দরী। মহৎ আবিষ্কার মাত্রেই আকস্মিক। দুরন্ত সমুদ্রের বঙ্কিম দিগন্তের ভূতেরণশায়ী নবজগতের সঙ্গে কলম্বাসের যেদিন প্রথম চোখাচোখি হয়েছিল সে কি নিতান্ত আকস্মিক ছিল না? পরিচিত সমুদ্র তাকে বহন করে নিয়ে পৌঁছে দিল একটি মহৎ অপরিচয়ের সম্মুখে। রাম বসুরও ঘটল ঠিক সেইরকম অবস্থা।

রেশমীকে সে দেখছে আজ দু বছরের উপর, তাকে চপল চঞ্চল বালিকা ছাড়া কিছু মনে হয় নি। যখন সে প্রথম ইংরেজি লিখতে পড়তে বলতে শিখল কৌতূহল অনুভব করেছে মুন্সী। ন্যাড়ার সঙ্গে যখন সে ইংরেজিতে কথা বলতে চেষ্টা করেছে আর ন্যাড়া তার উত্তর দিয়েছে ইংরেজি বাংলা হিন্দীর মিশলে, কিছু না বুঝতে পেরে রেশমী জরুরী কাজের অছিলায় পভ দিয়েছে, বিজয়ী ন্যাড়ার হাসিতে সে কৌতুক অনুভব করেছে। ন্যাড়া বলেছে, দেখলে তো কায়েৎ দাদা, কাজের ছুতো করে পালাল রেশমী দিদি! ও পারবে কেন আমার সঙ্গে ইংরেজী বিদ্যায়?

আরও বলেছে, ও শিখেছে ইংরেজী, আমি শিখেছি ইংরজকে। ওদের ভাষার মধ্যে বারো আনা গায়ের জোর, বুঝলে কায়েৎ দাদা, হিন্দী বাংলা মিশিয়ে জোরে গর্জন করে

উঠলেই ইংরেজি হয়।

দূর বোকা, বলে বসুজা।

এতদিন তুমি ইংরেজের সঙ্গে কাটালে, তুমিও কিছু বোঝ না দেখি।

বেশ তো, বুঝিয়ে দে না।

অদম্য ন্যাড়া বলে, তবে শোন। শুয়োর বলে বোঝায় শুয়োর নামে জীবটা। কিন্তু যখন সাহেব গর্জন করে ওঠে—‘ইউ শুয়ার, ইধার আও’ তখন শুয়োরের মানে বদলে যায়।

তখন আবার কি মানে হয়?

তখন মানে হল, খানসামা, বাবুর্চি যেটি ঠিক সেই সময়ে সাহেবের দরকার।

রাম বস হাসে।

ন্যাড়া বলে, তোমার হাসি পেল, কিন্তু ঐ গর্জন শুনে খানসামা বাবুর্চিদের প্রাণ উড়ে যায়, তারা সম্মুখে এসে কাঁপতে থাকে।

তার পরে একটু থেমে বলে, মানি সাহেবের আবার ভাষারও দরকার হত না, হাতের কাছে যা পেত ছুঁড়ে মারত। একদিন পর পর তিনখানা প্লেট আমাকে ছুঁড়ে মারল, আমি পর পর তিনখানা লুফে ফেললাম। তাই না দেখে সাহেব খুশি হয়ে আমার পিঠ চাপড়ে বলে উঠল, ‘ওয়েল ডান, হ্যাটট্রিক! আবার প্লেট ভাঙে নি দেখে মেমসাহেবও আমার উপরে খুব খুশি।

আবার রেশমী যেদিন সায়া-শেমিজ ধরল সেদিন ন্যাড়া বলে উঠল, কে বলবে রেশমী দিদি বাঙালী! খাস মেমসাহেব বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।

রেশমী ঠাট্টা করে বলল, তা হলে এবারে একটা সাহেব বর খুঁজে বার কর।

খুঁজতে হবে কেন, তাদের কাছেই হাজির।

কে রে?

কেন, ঐ আমাদের টমাস্ সাহেব, না হয় নাই থাকল গোটা-পাঁচেক দাঁত।

টমাসের নাম শুনে রেশমী একখানা ঠ্যাঙা নিয়ে তাড়া করে।

দূরে বসে রাম বসু দেখত এসব দৃশ্য, মনটা খুশি হত, ভাবত, আহা যেমন করে হক মেয়েটা দুঃখের কথা ভুলে থাকুক।

রেশমী সহজে সায়া-শেমিজ ধরতে চায় নি। কেরী-দম্পতির বিশেষ পীড়াপীড়িতেই ধরেছিল। তবু একবার জিজ্ঞাসা করেছিল রাম বসুকে।

তুমি কি বল কায়েৎ দাদা?

ক্ষতি কি!

ক্ষতি কি?

সায়া-শেমিজ ধরলে খিরিস্তান হতে আর বাকি থাকল কি?

দূর বোকা! ঐ যে ছিরুর মা সায়া-সেমিজ পরে, ও কি খিরিস্তান? কোন সাহেব যদি ধুতি চাদর ধরে তবেই কি হিন্দু হয়ে গেল?

হিঁদু তো হওয়া যায় না, খিরিস্তান যে হওয়া যায়।

হওয়া যায় বলেই তো হচ্ছিস না।

ওসব পরলে আমাকে যে চেনাই যাবে না।

সে তো ভালই হবে, চণ্ডী বক্সীর লোকে তোকে চিনতে পারবে না, কাছে এসে পড়লেও মেমসাহেব ভেবে পালাবার পথ খুঁজবে।

যুক্তিটা তার মনে ধরল, আর সে ধরল সায়া-শেমিজ। চণ্ডী বক্সীর চোখে ধুলো দেবার উপায় এত সহজ জানত না রেশমী।

এ হেন রেশমীকে হাটে ঘাটে মাঠে ঘরে বাইরে দিনে রাতে সদাসর্বদা রাম বসু দেখেছে কিন্তু সে যে বিশেষ করে সুন্দরী একথা কখনও তার মনে হয় নি।

সেদিন হঠাৎ আবিষ্কার করে বসল তার সৌন্দর্য। সেই গোধূলির আলো-আঁধারি রঙীন প্রচ্ছায়ে, মাঝ-বসন্তের খেয়ালে ভরা এলোমেলো বাতাসের অদৃশ্য চামরব্যজনের ছন্দে, স্বচ্ছ বারিখণ্ডের পটে সন্নিবিষ্ট নিঃসঙ্গ নারীমূর্তি হঠাৎ রহস্যের চমকে উদঘাটিত হল তার চোখে। প্রথম দৃষ্টিতে বুঝতে পারে নি কে এল এখানে! পরমুহূর্তে মন বলল রেশমী। কিন্তু বোঝবার ফলে রহস্য ফিকে না হয়ে গাঢ়তর হল। রেশমী! যাকে আগে সহস্রবার দেখা গিয়েছে, সহস্রাতীত একবারের জন্য এমন বিস্ময় সঞ্চিত ছিল তার মধ্যে? বিস্ময়ের অন্ত পায় না রাম বসু। নিস্তব্ধ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। পা দুখানি জলের দিকে নামিয়ে দিয়ে ঈষৎ ঝুঁকে বাম করতলে চিবুক ন্যস্ত করে তন্ময় হয়ে বসে রয়েছে। নিঃসঙ্গ তরুণী—নির্জনতার প্রশ্রয়ে আঁচল পডেছে খসে, লুটিয়ে আছে ঘাসের উপরে, শুভ্র গ্রীবার উপরে বাতাসে কাঁপছে আলগা চুলের গুচ্ছ, অর্ধাবগুণ্ঠিত পূর্ণিমা চাঁদের আভাস দিচ্ছে অপ্রচ্ছন্ন বাম পরোধর, সুঠাম নিটোল তনুষ্টি, রেখায় রঙে ছায়াতপে তাল মিলিয়ে সৃষ্টি করেছে নেত্রপেয় একখানি রাগিণীর। রাম বসুর চোখের পলক পড়ে না। সে ভাবল, সৌভাগ্য এই যে ওকে মুখোমুখি দেখি নি, তা হলে কি এমন খুঁটিয়ে দেখবার পূর্ণ অবকাশ পেতাম; ভাবে, মুখ দেখলে প্রত্যহের পরিচিত সেই মেয়েটিকে দেখতাম, সংসার যেখানে অঙ্কিত করে দিয়েছে ছোটখাটো সুখদুঃখের চক্রচিহ্ন; ভাবে, কখনও মনে হয় নি প্রত্যহের অতীত কিছু আছে ওর মধ্যে; এখন বুঝল সমগ্রভাবে দেখলেই তবে পাওয়া যায় সৌন্দর্যকে, সত্যকেও সেই সঙ্গে। সে নির্বাক দাঁড়িয়েই থাকে যেমন নির্বাক বসে আছে রেশমী, সৌন্দর্য-সোনার মিনে-করা লোহার হাতুড়ি, অকস্মাৎ বুকের উপরে নিক্ষিপ্ত হয়ে অতর্কিতে হতচৈতন্য করে দেয় দ্রষ্টাকে।

রাম বসু অতিশয় ধূর্ত, অতিশয় ঘোড়েল, অতিশয় প্রাজ্ঞ বাস্তববাদী; ক্ষিপ্র নিপুণ ছিপ নৌকার মত ডাইনে বাঁয়ে সাহেব-সমাজ ও বাঙালী-সমাজের ঢেউ কাটিয়ে ছুটতে সে অভ্যস্ত; পিছে পড়ে থাকে পাণ্ডিত্যের বজরা, ঐশ্বর্যের পালী, বানচাল হয়ে যায় নির্বুদ্ধিতার পালোয়ারী সব নৌকা, সংসার-তরঙ্গতলে নৃত্য করে ছুটে চলে যায় রাম বসুর লঘুভার ছিপ। সারাজীবন ধূর্তপনা করে তার ধারণা হয়েছিল সে নীতির উর্দ্ধে; হিন্দুধর্ম খ্রীষ্টধর্ম দুয়েরই মাথায় নিরপেক্ষভাবে সে কাঁঠাল ভেঙে এসেছে; টাকার দুর্নিবার আকর্ষণেও তাকে অর্থগৃধ করতে পারে নি; জ্ঞানের ক্ষেত্রকে পরিণত করেছে সে সরাইখানায়, আকণ্ঠ পান করেছে সরাব, তার পরে রাত্রিশেষে চলে গিয়েছে নূতন সরাবখানার উদ্দেশে; আর নারীদেহ, তাতে পেয়েছে সে জড়, পায় নি কখনও জাদু, কেবল ঐ টুশকি ছাড়া।

সে কেবল অনুভব করে না, অনুভূতিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে, নিজের অনুভূতিকে বাইরে স্থাপিত করে নিরীক্ষণ করে; একসঙ্গে সে তন্ময় ও মন্ময়; ‘প্রাচীন মানুষ’ হয় শুধু তন্ময়, নয় শুধু মন্ময়; ‘প্রাচীন মানুষ’ হরগৌরী, ‘নব্যমানুষ’ অর্ধনারীশ্বর। রাম বসু প্রাচ্য ভূখণ্ডের প্রথম ‘মর্ডান ম্যান’ বা ‘নব্যমানুষ’। এ বিষয়ে সে রামমোহনের অগ্রজ।

টুশকির প্রসঙ্গে বসুজার মনে নিজের যৌন-জীবনের ইতিহাস জেগে ওঠে। যৌবনের সূচনা থেকে যত নারী তার জীবনে এসেছে-কেউ এক রাত্রির দীপ জ্বালিয়ে, কেউ বা বৎসরকাল মশাল জ্বালিয়ে তাদের সংখ্যা গণনা করতে গেলে স্বয়ং শুভঙ্করকে বা আর্যভট্টকে ডাক দিতে হয়। তার পরে হঠাৎ একদিন এল টুশকি, তখন সে বুঝল জড়ে জীবে প্রভেদ। জীব সত্য, তবু জাদু নয়। টুশকির দেহটার সঙ্গে পেয়েছিল সে স্নেহ, ঐ দাক্ষিণ্যটুকুর জন্যে টুশকি আর সকলের সঙ্গে একাসনে বসে একাকার হয়ে গেল না, স্থান পেল হৃদয়ের কাছে। গৃহের স্বাদ ও স্বস্তি পাওয়ায় যে চিরন্তন আকাক্ষা পুরুষের মনে তারই আভাস পেল টুশকির গৃহে, তখন থেকে সে হল গৃহহীন গৃহী।

কিন্তু আজ, ঐ যে রহস্যময়ী মূর্তি, গোধূলির পড়ন্ত আলোয় আরও অস্পষ্ট হয়ে উঠে অধিকতর মনোজ্ঞ হয়ে উঠেছে, ওতে আর টুশকিতে অনেক প্রভেদ। টুশকি জীব, রেশমী জাদু; জীবে আছে পৃথিবীর প্রাণ, জাদুতে স্বর্গের আভাস; জীবে রুপ, জাদুতে সৌন্দর্য; রূপ রক্তমাংসের সৃষ্টি, সৌন্দর্য সৃষ্টি কল্পনার।

হয়তো বা গাছের পাতার শব্দ হয়ে থাকবে, হয়তো এগোতে গিযে পায়ের শব্দ করে থাকবে রাম বসু, চকিতে মুখ ফিরিয়ে সভয়ে জিজ্ঞাসা করে রেশমী, কে? কে

আমি কায়েৎ দাদা রে!

তাই বল! আশ্বস্ত হয় রেশমী।

এত রাতে এখানে একা বসে থাকা ভাল নয়, বাড়ি চল।

উঠে পড়ে রেশমী, দুজনে অগ্রসর হয় কুঠির দিকে।

স্বভাবতই রাম বসু একটু বেশি কথা, কিন্তু আজ যোগাতে চায় না তার কথা। বসন্তের খেয়ালে-ভরা আকাশ গান-থেমে-যাওয়া বীণার তন্ত্রের মত রী রী করতে থাকে অনুরণনে, আকাশ তারায় তারায় ওঠে মুখর হয়ে। পশ্চিম দিগন্তের মাথা-বরাবর ঝামা আলোটুকু কমে আসে আরও ঝিমিয়ে; আরও ক্ষীণ, আরও ম্লান; এবারে দৃষ্টির সঙ্গে অনুমানকে দোসর না করে নিলে আর দেখবার উপায় নেই।

.

রাত্রে ঘুম এল না রাম বসুর। আহারটাতেও পড়েছে ফাঁক। অনেক রাত পর্যন্ত বিছানায় পড়ে এপাশ ওপাশ করে সে, নূতন অভিজ্ঞতার ধাক্কা তার মনকে করে রাখে চঞ্চল। হঠাৎ কানে গেল বাইরে কে গান করে চলেছে-”রজকিনী-প্রেম নিকষিত হেম, কাম গন্ধ নাহি তায়।” কতবার শুনেছে সে এই পদটি। আজ মনে হল এত বড় মিথ্যা কোন মহাকবির কলমে আর বের হয় নি। তার মনে হল কামের মধ্যে প্রেম না থাকতে পারে কিন্তু প্রেমে কাম থাকবেই; হয়তো অগোচরে থাকে, কি না থেকে যায় না। তার মনে হল কাম ফুল, প্রেম ফল; ফুল ছাড়া ফল সম্ভব নয়। বিষয়টা নিয়ে মনের সঙ্গে সে বিচারে বসল। সে বলল, আজ বিষয়টা নূতন করে বুঝলাম। মন বলল, হঠাৎ আজকে বোঝবার কি কারণ ঘটল? রেশমীর প্রতি তোমার নজরের বদল হয়েছে কি? সে বলল, আরে ছি ছি, সে রকম কিছু নয়, তবু ভুল হলে স্বীকার করব না কেন? মন বলে, বেশ, তাই না হয় হল, কাম ফুল, প্রেম ফল; তবে সৌন্দর্যটা কি?

কেন, সৌন্দর্য তরু!

আর যৌবনটা?

ভূমি।

মন বলে, বাহবা, এখনও তোমার অবস্থা চিকিৎসার অতীত নয়।

রোগটা কি যে চিকিৎসার প্রয়োজন হবে! তবু শুনি আমার অবস্থা বুঝলে কি করে?

এখনও বেশ গুছিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারছ।

না পারবার হেতু কি?

ব্যাধি।

কি ব্যাধি?

মন বলে, যে ব্যাধিতে শীঘ্রই আক্রান্ত হবে।

নাম?

প্রেম।

তার মানে, মূলে কাম আছে?

মন বলে, নিজেই ভেবে দেখ। বলে, রেশমীর সৌন্দর্যে তুমি অভিভূত হয়েছ, ঐ অনুভূতিটুকু কাটলে বুঝতে পারবে প্রকৃত অবস্থা।

বিরক্ত হয়ে রাম বসু বলে, আচ্ছা তখন দেখা যাবে, এখন ঘুমোতে দাও দেখি।

কদিন ধরে চলে রাম বসুর উন্মনা উদভ্রান্ত অবস্থা।

কেরী বলে, মুন্সী, অতিরিক্ত পরিশ্রমে তুমি কাতর হয়ে পড়েছ, বিশ্রাম নাও।

ন্যাড়া বলে, চল কায়েৎ দাদা, কদিন ঘুরে আসি, কাছেই প্রেমতলীর মেলা, খুব জবর মেলা।

রেশমী বলে, কায়েৎ দাদা, ভেবে ভেবে তোমার শরীর যে গেল। শুধায়, কার জন্যে এত ভাব, কায়েৎ বৌদিদির জন্যে নাকি?

রাম বসু কি উত্তর দেবে! সব এড়িয়ে যায়।

.

সেদিন রাতে ন্যাড়া, পার্বতীচরণ, গোলোক শর্মা সবাই গিয়েছে গাঁয়ের মধ্যে যাত্রাগান শুনতে। ডাকাডাকি সত্ত্বেও যায় নি সে, বিছানায় শুয়ে নিজের মনটাকে চিরে চিরে বিশ্লেষণ করে দেখছে ব্যাপারখানা কি ঘটল। তখন বাইরে খেয়ালী বসন্তের মাঝ রাতের এলোমেলো হাওয়া বাগানের আম কাঁঠাল গাছগুলোর মধ্যে যথেচ্ছাচার করছে, বোলের সঙ্গে শূন্যতা উঠেছে ব্যথিয়ে আর ঝাউ গাছ কটা বহুযুগের পুঞ্জিত দীর্ঘনিঃশ্বাসে সমস্ত আকাশটাকে করেছে উন্মনা। এতদিনের বিচার-বিশ্লেষণে যা স্থির করতে পারে নি হঠাৎ এক মুহূর্তে তা স্থির হয়ে গেল। রেশমীকে তার চাই। রাত্রির অন্ধকারে ভাস্বরতর হীরককঠিন রেশমীর যৌবনতি লুব্ধ নাগরাজের মত সবলে করল তাকে আকর্ষণ। ত্বরিতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে সোজা গিয়ে রেশমীর দরজায় ঘা দিল সে।

.

২.১৪ ধর্মস্য তত্ব

রাত অনেক হয়েছে দেখে কেরী বই খাতাপত্র গুছিয়ে রেখে শুতে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে, এতক্ষণ সে পড়বার ঘরে ছিল। এমন সময়ে দরজা খুলে দমকা হাওয়ার মত ঢুকে পড়ে টমাস।

বিস্মিত কেরী বলে ওঠে, এ কি, টমাস যে! হঠাৎ এত রাত্রে?

টমাস হাঁপাচ্ছিল, লক্ষ্য করে কেরী বলল, বস, বস, একেবারে হাঁপিয়ে পড়েই যে!

দম নিয়ে টমাস বলল, হাঁপাব না! ঘোড়া ছুটিয়ে হঠাৎ আসতে হলে না হাঁপিয়ে উপায় কি?

হঠাৎ এমন কি ঘটল যে এত রাত্রে ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে হবে?

টমাস আসন গ্রহণ করে বলে, একটা লোকের ওলাউঠো হয়েছে খবর পেয়ে গিয়েছিলাম পঁচিশ মাইল দূরের রামকানাই বলে একটা গ্রামে। সন্ধ্যাবেলায় মহীপালদিঘিতে ফিরে এসে দেখলাম মিঃ উডনীর লোক অপেক্ষা করছে।

কেরী বলে, তাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বার কি আছে?

আগে সবটা শোন। সেই লোকটি মিঃ উডনীর এজেন্ট রীডারের অগ্রদূত। মিঃ রীডার কাল সকালে এসে পৌঁছবে।

ভাল কথা, অনেক দিন পবে একজন দেশের লোক দেখতে পাওয়া যাবে।

কি মুশকিল! আগে সবটা শুনেই নাও।

দুঃখিত, বল।

মিঃ রীডার বেরিয়েছে উডনীর বিভিন্ন কুঠির তদারকে। কালকে প্রথমে এসেই সে ক্যাশ মিলিয়ে দেখবে।

বেশ তো, ক্যাশ মিলিয়ে দিও।

ক্যাশ যে শর্ট।

বলে টমাস নীরব হল। কেরীও নীরব। দেয়ালের ঘড়িটার টিক টিক ধ্বনি ফুটতর হয়ে উঠল।

নীরবতা ভঙ্গ করে কেরী প্রথমে কথা বলল, আবার তুমি ক্যাশের টাকা ভেঙেছ!

কি করব বল, দুঃস্থ লোক দেখলে আমি স্থির থাকতে পারি না।

দুঃস্থ লোকের সাহায্যের জন্যেও পরের টাকা দান করবার অধিকার তোমার নেই।

তার পরে কিছুক্ষণ নীরব থেকে কেরী বলল, কিন্তু ক্যাশ শর্ট পড়বার আসল কারণ জুয়ো খেলে তুমি টাকা নষ্ট করেছ।

নীরবতার দ্বারা টমাস দোষ স্বীকার করে নিল। অপরাধ করবার চেয়ে অপরাধ স্বীকার করা কঠিন, সেই কঠিন কাজটা করতে হল না, কেরীর মুখে প্রকাশ হয়ে পড়ল, তাতে টমাসের উদ্বেগের প্রধান অংশ দূরীভূত হয়ে গেল। দ্বিতীয় অংশ, আজই টাকা সংগ্রহ। কেরীকে সে বেশ জানত যে, কেঁদে গিয়ে পড়লে টাকা পাওয়া যাবেই। অনেকবার অনেক বিপদ থেকে সে রক্ষা করে দিয়েছে।

টমাস বলে উঠল, এবারের মত আমাকে বাঁচিয়ে দাও ব্রাদার কেরী, ভবিষ্যতে সাবধান হয়ে চলব। আর আমার প্রতিশ্রতিতে যদি বিশ্বাস না কর তবে ভগবানের নাম করে–

কেরী বাধা দিয়ে বলল, থাম থাম, বৃথা ভগবানের নাম উচ্চারণ কর না।

টমাস মাথা হেঁট করে বসে রইল। মনে তার অনুশোচনা হচ্ছিল সত্যি, কিন্তু সেই সঙ্গে উদ্বেগ লাঘব হওয়ায় বেশ একটু স্বস্তিও অনুভব করছিল সে।

কিন্তু বিপদে ফেললে যে! অফিস-ঘরে আছে সিন্দুক, অফিস-ঘরের চাবি থাকে মুন্সীর কাছে। সে হয়তো আর-সকলের সঙ্গে গাঁয়ের মধ্যে গিয়েছে যাত্রাগান শুনতে।

আমি খুঁজে আনছি, বলে টমাস ছুটে বেরিয়ে গেল। টমাসের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় আবার বই খুলে বসল কেরী।

টমাস সোজা গিয়ে উঠল রাম বসুর ঘরের বারান্দায়, দেখল মুন্সীর ঘর বন্ধ। সে জানত পাশের ঘরটায় থাকে পার্বতী ব্রাহ্মণ, দেখল সে ঘরটাও বন্ধ। বুঝল কেরীর অনুমান মিথ্যা নয়—সকলে যাত্রা শুনতে গিয়েছে গাঁয়ের মধ্যে। সে জানত না গাঁয়ের ঠিক কোন্‌খানে গ্লান হচ্ছে, ভাবল, ন্যাড়াকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাক। ন্যাড়ার ঘরটা অন্য দিকে, রেশমীর ঘরের কাছে। সেখানে গিয়ে টমাস দেখল ন্যাড়ার ঘরটাও বন্ধ, বুঝল সবাই একসঙ্গে গিয়েছে। তখন সে নিরুপায় হয়ে স্থির করল রেশমীকে ডেকেই জেনে নেবে যাত্রার আসরের সন্ধান—তাই সে রেশমীর ঘরের কাছে গিয়ে পৌঁছল। রাত্রিবেলা একাকী কোন মহিলার ঘরের দরজায় গিয়ে ডাকাডাকি করা সামাজিক নীতি নয় সত্য, কিন্তু ভোর হওয়া মাত্র যেখানে তহবিল ঘাটতি মিটিয়ে দেওয়া অপরিহার্য, সেখানে ওসব সূক্ষ্ম শিষ্টাচারের বাধা যে কত তুচ্ছ, বিপন্ন ব্যক্তি ছাড়া অপরের পক্ষে সহজবোধ্য নয়।

টমাস দরজায় ঘা দিল।

কেউ সাড়া দিল না বা দরজা খুলল না। কিন্তু দরজা ভিতর থেকে বন্ধ, লোক নিশ্চয় আছে, হয়তো ঘুম ভাঙে নি মনে করে আবার প্রবলতর আঘাত দিল টমাস।

আবার। আবার।

কে এত রাত্রে?

চমকে উঠল টমাস। এ যে মুন্সীর কণ্ঠ।

মুন্সী, তুমি এত রাত্রে এখানে?

রাম বসুর সাড়া দেওয়া উচিত হয় নি, আর কোন উপায়ে দরজায় ঘা পড়ার প্রতিবিধান করা উচিত ছিল তার। কিন্তু সংসারে উচিতমত কাজ কয়টা হয়? সঙ্কটকালে অতিশয় ধৃত ব্যক্তিও অতিশয় ভুল ভুল করে বসে বলেই তো জীবনের রস আজও শুকিয়ে যায় নি। সংসারের জমাখরচের পাকা খাতায় কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম হিসাবের গরমিল থেকে গিয়েছে।

সাড়া দেওয়া মাত্র রাম বসু বুঝল মস্ত ভুল হয়ে গিয়েছে, হয়তো তার জীবনের প্রকাঙতম ভুল। কিন্তু সেই সঙ্গে এই অপ্রত্যাশিত সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, টমাসের কণ্ঠস্বরে বাস্তবের কেন্দ্রে পুনঃসংস্থাপিত হয়ে—এই কদিনের উদ্ভ্রান্তি গেল তার দূর হয়ে, যেমন হঠাৎ উদভ্রান্তি কুয়াশায় ঢুকে পড়েছিল, আবার তেমনি হঠাৎ প্রখর প্রোজ্জ্বল কাণ্ডজ্ঞানের সূর্যালোকে এল ফিরে; লুপ্ত হয়ে গেল ক্ষণিকের প্রেমিক ভাবুক রোমান্টিক সত্তা, উঠল জেগে স্বভাবসিদ্ধ প্রত্যুৎপন্নমতি, শ্লেষরসিক, বাস্তববাদী রামরাম বসু।

মুন্সী, তুমি এত রাত্রে একাকী রেশমী বিবির ঘরে! এ যে দুর্বোধ্য!

ভিতর থেকে অবিচলিত কণ্ঠে রামরাম বসু উত্তর দিল, তার চেয়ে অনেক বেশি দুর্বোধ্য তত্ত্ব নিয়ে পড়েছি।

বুঝতে পারে না টমাস, বিস্মিত হয়ে শুধায়, কি সেই তত্ত্ব?

ভিতর থেকে রাম বসু বলে, ধর্মস্য তত্ত্বম্।

পুনরায় মূঢ়ের মত টমাস শুধায়, তা ওখানে কেন?

ভিতর থেকে উত্তর আসে, সে বস্তু যে নিহিতং গুহায়াম।

ওটা বোধ করি সংস্কৃত ভাষা, বুঝতে পারছি না, বুঝিয়ে বল।

সেটা মন্দ নয়, তবে শোন-The mystery of religion is hidden in the cave.

টমাস শুধায়, রিলিজ্যন তো বুঝলাম, কিন্তু মিষ্ট্রিই বা কি আর কেই বা কি?

আরে সেই তো অনুসন্ধান করছি। আমাদের শাস্ত্রে বলেছে গুহা অর্থাৎ কেভে সশরীরে না ঢুকলে সেই মিষ্ট্রির সাক্ষাৎ পাওয়া সম্ভব নয়।

বাস্তবিক আশ্চর্য তোমাদের শাস্ত্র! কিন্তু এত রাত্রে কেন?

রাত্রি কোথায়? বলে রাম বসু, আর তাছাড়া রাত্রিই তো গুহাবতরণের প্রশস্ত সময়।

শাস্ত্রের অনুশাসন হচ্ছে—”যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগতি সংযমী।”

অনুবাদ করে বোঝাও।

তবে শোন—When it is night to ghosts, সংযমী–কি না people like myself kecp up late.

বিস্ময়-উদ্বেল হয়ে ওঠে টমাসের মন। বলে, আশ্চর্য তোমাদের শাস্ত্র, সব কাজেই সমর্থন আছে!

তার পর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলে টমাস—কিন্তু একাকী রমণীর ঘরে পুরুষের প্রবেশ কি ঠিক?

তোমার এ প্রশ্নের উত্তরটাও শাস্ত্রের বচনে দিই–

এর সমর্থনও শাস্ত্রে আছে নাকি, বাপ রে বাপ—

কথার মাত্রা হিসাবে ‘বাপ রে বাপ’ বলা টমাসের অভ্যাস।

আছে বই কি। শাস্ত্রে বলেছে, “না স রমণ, ন হাম রমণী।” ডাঃ টমাস, পুরুষ রমণী ওসব দৃষ্টির ভ্রম।

তবে আসলে তোমরা কি?

জীবাত্মা আর পরমাত্মা। জীবাত্মা ভোগ করতে উদ্যত—

আর পরমাত্মা কি করছে?

আপাতত নারাজ।

এবারে গম্ভীর ভাবে টমাস বলে, মুন্সী, তোমার উদ্দেশ্য মহৎ আর পথটা না হয় শাস্ত্র-সম্মত কিন্তু যুবতী রমণীর সঙ্গে গভীর রাত্রে নিভৃত কক্ষে অবস্থান, এর মর্ম লোকে ভুল বুঝতেও পারে।

রাম বসু বলে, ডাঃ টমাস, শাস্ত্র মানলে শাস্ত্রের সকল বাক্যই মানতে হয়-যুবতী নারীই এই শ্রেণীর ধর্মসাধনার শ্রেষ্ট সহায়।

কিন্তু রেশমী কি সম্মত আছে?

আরে সেইখানেই তো গোল!

কেন?

কেন আর কি, ছেলেমানুষ! মিষ্ট্রি অব রিলিজ্যন যে হিডন ইন দি কেভ—তা স্বীকার করতেই চায় না।

কেন, ও কি শাস্ত্র জানে না?

জানে কিন্তু না-জানার ভান করছে।

তবে না হয় দরজাটা খুলে দাও, দুজনে মিলে চেষ্টা করি।

কি সর্বনাশ! এসব ক্ষেত্রে দুই গুরু অচল।

তবে তুমি একাই চেষ্টা কর।

তার পরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে, সত্যি মুন্সী, তুমি খুব সৌভাগ্যবান, নতুবা মিস্ত্রি অব রিলিজ্যন বোঝাবার এমন মনোরম সুযোগ পেতে না। আমি কতবার চেষ্টা করেছি, সুযোগ পাই নি।

উপযুক্ত সাধনা চাই, সাহেব, উপযুক্ত সাধনা চাই।

টমাস বলে, মুন্সী, তত্ত্বটা বুঝলে রেশমী বিবি কি খ্রীষ্টান হতে রাজী হবে?

মুন্সী বলে, তখন খ্রীষ্টান হওয়া ছাড়া আর কোন গতি থাকবে ওর!

তবে বোঝাও মুন্সী, ভাল করে বোঝাও, তোমার সমস্ত শক্তি দিয়ে বোঝাও, প্রয়োজন হলে সারারাত ধরে বোঝাও।

তাই তো বোঝাচ্ছিলাম, হঠাৎ তুমি এসে পড়ে রসভঙ্গ করলে।

কিন্তু আমার কত সৌভাগ্য দেখ—এমন যে পবিত্র কর্ম চলছে, হঠাৎ এসে পড়ায় তা জানতে পেলাম।

বেশ তো, এখন সরে পড় না!

সে কথায় কর্ণপাত না করে টমাস শুধায়, আচ্ছা মুন্সী, তুমি কি আগেও ওকে মিস্ট্রি অব রিলিজ্যন বোঝাতে চেষ্টা করেছ?

না সাহেব, এই প্রথম।

আশা করি, এই শেষ নয়!

নিশ্চয়ই নয়, এখন কিছুদিন চলবে।

চলবেই তো, চলবেই তো—উৎসাহে বলে ওঠে টমাস সাহেব, এ সুযোগ পেলে কেউ সহজে ছাড়তে চায় না।

তার পরে শুধায়, কিছু সুবিধা করতে পারলে মুন্সী?

কিছু সুবিধা হবে মনে হচ্ছে।

টমাস ভক্তির আবেগে বলে ওঠে, নিশ্চয় হবে, নিশ্চয় হবে।

তার পরে আবার থেমে বলে, উপর-উপর না বুঝিয়ে একবারে গভীরে প্রবেশ করতে চেষ্টা কর।

তা নইলে আর বুঝিয়ে আনন্দ কি?

মুন্সী, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি ও-বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।

না হয়ে উপায় কি, অনেককাল তোমাদের সঙ্গ করছি।

এবারে টমাস ব্যাকুলভাবে বলে, মুন্সী, দয়া করে একবার দরজাটা খুলে দাও, আমি একবার পরমরমণীয় দৃশ্য দেখে প্রভুর নামকীর্তন কবি!

না না, এখন দরজা খোলা চলবে না, রেশমীর এমনিতেই খুব সঙ্কোচ। স্বীকার করে টমাস। বলে, তা আমি দেখেছি কিনা। বাইবেলের একটা সাধারণ গল্পেই ওর গাল লাল হয়ে ওঠে, আর এ তো গৃঢ়তম রহস্য। সঙ্কোচ হবে বই কি।

একটু থেমে বলে, মুন্সী, আমার যে ভগবানের নাম করতে ইচ্ছা করছে।

তা ঐখানে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নাম কর, আমরা ভিতর থেকে বেশ শুনতে পাব।

না, দাঁডিয়ে নয়, নতজানু হয়ে। মুন্সী, আমি এখানে নাম করি আর তুমি ওখানে ক্রমে গভীরতর অন্তরে প্রবিষ্ট হয়ে নিগৃঢ়তম তত্ত্বটি বুঝিয়ে দাও।

মুন্সী বলে, সাহেব, এখন ঘরে যাও দেখি।

নিশ্চয়ই যাব, আনন্দের সংবাদ বহন করে যাব, কিন্তু তার আগে একবার বল দেখি, ও বুঝেছে কি না?

বিরক্ত হয়ে মুন্সী বলে, বুঝেছে বুঝেছে, তুমি গেলে আরও ভাল করে বুঝবে।

‘জয় হক’ বলে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে টমাস, তার পরে পেয়েছি, পেয়েছি, স্বর্গের চাবি পেয়েছি বলে চীৎকার করতে করতে ছুটে চলে যায় কেরীর ঘরের উদ্দেশে।

২.১৫ স্বর্গের চাবি

টমাসের ফিরতে বিলম্ব দেখে কেরী মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠছি। বেরিয়ে সন্ধান করবে কিনা ভাবছে, এমন সময়ে সশব্দে দরজা খুলে দমকা হাওয়ার মত প্রবেশ করল টমাস।

পেয়েছি পেয়েছি, সোল্লাসে চীৎকার করে উঠল।

টমাসের ভাবালুতার সঙ্গে কেরী পরিচিত কিন্তু আজ কিছু বাড়াবাড়ি মনে হল, তাই কিঞ্চিৎ বিরক্ত ভাবেই বলল, পেয়েছ তো দাও, খামকা অমন চীৎকার করছ কেন?

টমাস বলল, এ দেওয়া যায় না, অনুভব করা যায় মাত্র।

কি সব বাজে কথা বলছ তুমি! সিন্দুক-ঘরের চাবি কই?

সিন্দুক-ঘর! বিস্মিত হয় টমাস।

তুমি কি সিন্দুক-ঘরের চাবি আনতে যাও নি?

এতক্ষণে সব কথা মনে পড়ে টমাসের, বলে ওঠে, তাই গিয়েছিলাম বটে, কিন্তু পেয়েছি তার অনেক বেশি।

কি আর এমন পাবে?

কি আর এমন পাব! বলে বিস্ময়ের সঙ্গে টমাস। তার পরে শুধায়, অনুমান কর তো ব্রাদার কেরী, কি পেতে পারি?

স্পষ্ট বিরক্তির সঙ্গে কেরী বলে ওঠে, দেখ টমাস, এত রাতে তোমার সঙ্গে ছেলেমানুষি করবার সময় আমার নেই। সিন্দুক-ঘরের চাবি পেয়ে থাক তো দাও।

ব্রাদার কেরী, সিন্দুক-ঘরের চাবি খুঁজতে গিয়ে স্বর্গের চাবির সন্ধান পেয়েছি।

কেরী দাঁড়িয়ে উঠে বলল, তবে তুমি স্বর্গে প্রবেশের চেষ্টা কর, আমি শুতে চললাম, বড় ক্লান্তি অনুভব করছি।

ব্রাদার কেরী, স্বর্গে প্রবেশের সুযোগ পেলে কি আর বাইরে থাকি। কিন্তু মুন্সী কিছুতেই রাজী হল না, রেশমীর তাতে নাকি খুব সঙ্কোচ। তার পরে স্বাগত ভাবেই যেন বলে উঠল, মুন্সী এতক্ষণ একাকীই বোধ হয় স্বর্গে প্রবেশ করল। স্বার্থপর!

রাম বসু ও রেশমীর নাম একত্রে শুনে কান খাড়া করল কেরী, গভীরভাবে শুধাল, কি ব্যাপার বল তো?

যথোচিত ভাবানুষঙ্গে আদ্যোপান্ত বর্ণনা করে টমাস বলল, ব্রাদার কেরী, এমন ব্যাপার যে দেখতে হবে, আগে ভাবি নি।

কেরী বলল, আমিও আগে ভাবি নি যে, এমন ব্যাপারে দেখতে হবে।

কিন্তু আমি বাইরে থেকেও যেটুকু আভাস পেয়েছি, তুমি তো সেটুকুও পেলে না। তার পরে বলল—চল না কেন, দেখে আসি। এতক্ষণে নিশ্চয় মিষ্ট্রি অব রিলিজ্যন রেশমীকে বুঝিয়ে সেরেছে—মুন্সী সত্যই একজন জ্ঞানী পুরুষ।

মুন্সী যেমন জ্ঞানী, তুমিও তেমনি ভক্ত! ধিক্কার দিয়ে ওঠে কেরী, তুমি একটি আস্ত গর্দভ!

কেন, এতে নির্বুদ্ধিতার কি দেখলে?

দেখেও যদি না বুঝতে পার তবে আর কেমন করে বোঝাব!

খুলেই না হয় বল না।

গভীর রাত্রে একজন পুরুষ একটি যুবতীর নিভৃত কক্ষে প্রবেশ করেছে, কি উদ্দেশ্যে হতে পারে?

আমিও তো প্রথমে সেই প্রশ্ন করেছিলাম। মুন্সী বলল, মিষ্ট্রি অব রিলিজ্যন বোঝাবার উদ্দেশ্যে।

ও বলল আর তুমি বিশ্বাস করলে?

ক্ষতি কি? তুমি অন্য কিছু সন্দেহ করছ নাকি?

অন্য কিছু তো সন্দেহ করবার নেই—এ রকম ক্ষেত্রে একটিমাত্র ঘটনাই সম্ভব।

কি সেটা?

নাঃ, তোমাকে নিয়ে পারলাম না। বলে ওঠে কেরী।

তার পরে বলে, ঐ মেয়েটাকে নষ্ট করবার উদ্দেশ্যে ঢুকেছে লোকটা। এমন কতদিন ধরে চলছে কে জানে!

ও যে বলল, এই প্রথম।

ও যা বলল তাই বিশ্বাস করলে? ও বলল এই প্রথম, তুমি বিশ্বাস করলে? ও বলল, মিষ্ট্রি অব রিলিজ্যন বোঝাতে এসেছে, তুমি বিশ্বাস করলে?

টমাসের ভক্তির নেশা কাটতে চায় না। বলে, যদি অসদুদ্দেশ্যেই ঢুকে থাকবে, তবে ধর্মতত্ত্বের কথা তুলল কেন?

জানে যে, ভক্তি তোমার ক্রনিক ব্যাধি, তাই সেখানে একটু মোচড় দিয়ে তোমার মনটাকে সন্দেহের পথ থেকে ভক্তির পথে চালিয়ে দিল।

তা দেয় দিক, কিন্তু ধর্ম-প্রসঙ্গ নিয়ে এমন পরিহাস অমার্জনীয়।

ব্যভিচারী ব্যক্তির কাছ থেকে আর কি তুমি আশা করতে পার?

আমি তো মুন্সীকে সৎ ব্যক্তি বলে জানতাম।

আমারও সেইরকম ধারণা ছিল। তা ছাড়া লোকটার অন্য অনেক গুণ; ওর সঙ্গে সমানে সমানে কথা বলা যায়।

এবারে কিছুক্ষণ নীরবে পায়চারি করে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে কেরী-মুন্সী মাস্ট গোর অব কোর্স হি মাস্ট গোয়

গর্জে ওঠে টমাস। কাঁচা ভক্ত ভক্তির উপরে ব্যঙ্গ ছাড়া আর সব সহ্য করতে পারে আর একবার ভক্তিতে উপহসিত হলে মরীয়া হয়ে ওঠে। মরীয়া হয়েই উঠল টমাস। আমার সঙ্গে পরিহাস, দেখে নেব সেই শয়তানটাকে!

সবেগে সে ছুটল রেশমীর ঘরের দিকে।

টমাস, টমাস, হঠাৎ নাটকীয় কিছু করে বোসো না, ফের ফের, ফিরে এস।

কে কার কথা শোনে! ততক্ষণে অন্ধকারের মধ্যে উধাও হয়ে গিয়েছে উন্মত্ত টমাস।

ধর্মশাস্ত্রের অপমানেই টমাসের এই উম্মা মনে করলে ভুল হবে। আরও কিছু গৃঢ় কারণ ছিল। রেশমীর প্রতি লালসার ভাব দেখা দিয়েছিল টমাসের মনে, সেখানে রাম বসুকে সফল প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে দেখে তার মন গিয়েছিল বিষিয়ে। সেই উত্তেজনা তাকে ভিতরে ভিতরে মারছিল ঠেলা। টমাসকে বললে নিশ্চয় সে স্বীকার করত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *