মেয়েদের ব্যারাকের সামনে বিরাট ভিড়। নানা বয়সের মেয়েরা রয়েছে সামনের দিকে। পুরুষেরা একটু দুরে। তাদের মধ্যে পরিতোষ, লা ডিন এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা এসে জড়ো হয়েছে। সারি সারি উদ্বিগ্ন মুখ।
নিজেদের মধ্যে সবাই বলাবলি করছিল, সৃষ্টিধরের বউরে আর বুঝিন বাঁচান গেল না। হেই সকাল থিকা যায় কাতরাইতে আছে। অহনও কাকায় দাই লইয়া ফিরল না। খালাস না অইলে মায় (মা) আর প্যাটের বাচ্চা-দুইটারই মরণ।
কী যে অইব, ভগমানই জানে।
এই সময় ট্রাকের আওয়াজে সবাই ঘুরে তাকায়। উতরাইয়ের ঢাল বেয়ে বিশাল গাড়িটা নেমে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে তুমুল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে উদ্বাস্তুদের মধ্যে।
আইয়া গ্যাছে, আইয়া গ্যাছে
আর চিন্তা নাই।
মা কালী বউডারে রক্ষা কর।
শেখরনাথদের ট্রাক মেয়েদের ব্যারাকটার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। মনসা আর বিনয়কে নিয়ে শেখরনাথ নেমে পড়লেন। জনতার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, কী হয়েছে, তোমরা সবাই এখানে? তার কণ্ঠস্বরে রীতিমতো উৎকণ্ঠা। সকালে সৃষ্টিধরের বউয়ের যে হাল দেখে গিয়েছিলেন তাতে খারাপ কিছু হয়ে গেল নাকি, এটাই তার ভয়।
মেয়েরা ভিড় করার কারণটা জানিয়ে দিল। পরিতোষ জানাল, শেখরনাথরা চলে যাবার পর পুরুষরা জমি সাফ করতে গিয়েছিল। সূর্য মাথার ওপর উঠে এলে চান-খাওয়া সারতে ক্যাম্পে এসে সব শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
শেখরনাথ জানতে চাইলেন, সৃষ্টিধরের বউ এখন কোথায়?
পরিতোষ বলল, ভিতরে। আশুচ (আঁতুড়) ঘরে।
শেখরনাথ দাই আনতে যাবার সময় ব্যারাকের এক কোণে চেরা বাঁশ দিয়ে এক ফালি জায়গা ঘিরে সন্তান জন্মের ব্যবস্থা করে রাখতে বলেছিলেন। পরিতোষের কথায় জানা গেল সেটি এর মধ্যেই করে ফেলা হয়েছে। এবং সৃষ্টিধরের বউকে সেখানে রাখা হয়েছে। কয়েকজন বয়স্কা উদ্বাস্তু মেয়েমানুষ তার কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করছে।
যে শঙ্কাটা হঠাৎ পাষাণভারের মতো শেখরনাথের মাথায় চেপে বসেছিল সেটা আপাতত নেমে গেছে। না, মেয়েটা বেঁচেই আছে। তিনি ব্যস্তভাবে মনসাকে দেখিয়ে জমায়েতটাকে বললেন, এই যে দাইকে নিয়ে এসেছি। আর চিন্তা নেই। তোমরা সরে সরে পথ করে দাও। ও আঁতুড়ঘরে যাক।
মনসা ব্যারাকের ভেতর ঢুকে গেল।
কিন্তু বাইরের ভিড়টা অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। এতগুলো মানুষ খিদে-তেষ্টার কথা বোধহয় ভুলেই গেছে। এমনকী শেখরনাথ বিনয়কে নিয়ে একধারে অপেক্ষা করতে থাকেন।
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর ভেতর থেকে অনেকগুলো মেয়ে-গলার কলকলানি ভেসে আসে। –খালাস অইয়া গ্যাছে, খালাস অইয়া গ্যাছে। মা কালী গো, তুমার দয়া
তারপরেই পরিষ্কার ন্যাকড়া জড়ানো একটি মানবশিশুকে কোলে করে মনসা ব্যারাকের সামনে এসে দাঁড়ায়। মাখনের দলার মতো বাচ্চাটা কুঁই কুঁই, ক্ষীণ আওয়াজ করছিল। পৃথিবীর প্রথম আলো এসে পড়েছে তার চোখে। পিট পিট করে তাকাচ্ছিল সে।
বাইরে তুমুল শোরগোল শুরু হয়ে গেল। এতক্ষণের উৎকণ্ঠা কেটে গেছে সবার। হুড়মুড় করে তারা মনসার কাছে ছুটে আসে।
কী অইচে, কী অইচে? পোলা, না মাইয়া? প্রতিটি উদ্বাস্তু জানার জন্য উদগ্রীব।
মনসা হেসে হেসে বলল, একহান সোনার চান্দ (চাঁদ) অইচে। পোলা–পোলা–
মেয়েদের ভেতর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, তরা খাড়ইয়া রইছস ক্যান? জোকার (উলু দে। শাখ বাজা
মুহূর্তে উলুধনি এবং শাঁখের আওয়াজে জেফ্রি পয়েন্টের ছিন্নমূল মানুষের উপনিবেশ সরগরম হয়ে ওঠে।
দক্ষিণ আন্দামানের এই সৃষ্টিছাড়া জঙ্গল-ঘেরা এই ভূখণ্ডে এই প্রথম একটি মানুষের জন্ম হল। আজকের দিনটা নিয়ে সবাই যেন অফুরান উৎসবে মেতে ওঠে।
মনসা বলে, বাইরে রইদের (রোদের) জবর ত্যাজ (তেজ)। বাচ্চাটার কষ্ট অইতে আছে। ভিতরে যাই। সে ব্যারাকে ঢুকে গেল।
এদিকে উদ্বাস্তুরা ঘিরে ধরে সৃষ্টিধরকে।–মিঠাই খাওয়াইতে অইব তুমারে
সৃষ্টিধরের চোখেমুখে লাজুক হাসি। সেটা সুখের এবং গর্বের। কঁচুমাচু মুখে বলে, আমার কি ট্যাকাপয়সা আছে যে খাওয়াতি পারি। খুলনে জিলায় আমাগের গেরামি থাকলি প্যাট ভইরে মোন্ডা মেঠাই খাওয়ায়ে দেতাম। শেখরনাথ হাসিমুখে সব শুনছিলেন। বললেন, সৃষ্টিধর কোত্থেকে খাওয়াবে? ওকে তোমরা ছেড়ে দাও। বলে পরিতোষের দিকে তাকালেন। –তুমিই তো এই সেটেলমেন্টের কর্তা। তোমার হাতে টাকাপয়সা থাকে। সকলকে মিষ্টিমুখ করিয়ে দাও
পরিতোষ বলল, এইটা কি কইলকাতার শহর! সন্দেশ রসগুল্লা পামু কই?
একটু ভেবে শেখরনাথ বললেন, সেটা অবশ্য ঠিক। এবার মালপত্রের সঙ্গে কয়েক টিন আমেরিকার মিষ্টি বিস্কুট এসেছে না?
হ, কাকা।
সবাইকে দুটো করে তা-ই খাইয়ে দে।
বিস্কুট বিলি করা হল। তারপর সমুদ্রে চান করে এসে ভাত খেতে খেতে বিকেল পেরিয়ে গেল। আজ আর কেউ এ বেলা জমিতে গেল না। মাঝরাত অবধি হইহই করে গানটান গেয়ে কেটে গেল।