2 of 3

২.১০ I do none of the things I promised I would

I do none of the things I promised I would
I listen to exculpations of every imaginable sort–

একটা মিষ্টি বাতাস বয়ে আসছে গঙ্গার দিক থেকে। ঝঝালো মধুর মতো রোদে ঝলমল করছে দিন। সেগুন কাঠের ঝকঝকে টেবিল। চৌকো একটা কাঁচ পাতা রয়েছে। মহারাজ বসে আছেন। চেয়ারে। চোখের সামনে পরপর তিনটি ছবি। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীশ্রীমা, স্বামীজি। র‍্যাকে আলমারিতে অজস্র বই। বেদান্ত, উপনিষদ, গীতা-ভাষ্য, শ্রীরামকৃষ্ণ সাহিত্য, সংস্কৃত মহাভারত, রামায়ণ, আরও কত কী! মহারাজের উলটো দিকের চেয়ারে আমি বসে আছি। স্নান করলেও একটা অস্বস্তিতে ভুগছি। জামাকাপড় অন্তর্বাস বদলানো হয়নি।

স্বামী নির্মলানন্দজি আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, যাও, নীচে গিয়ে মায়ের মন্দিরে মাকে প্রণাম করে এসো। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসবে। ছটফট করবে না। তারপর চরণামৃত নিয়ে, ওপরে আসবে।

একটা ব্যাপার আমি লক্ষ করেছি, ধর্ম ধর্ম করি বটে, আমার ভক্তিটা কিছু কম। মহারাজের নির্দেশে সিঁড়ি দিয়ে তিনতলা থেকে দোতলায় নামছি বটে, মনে তেমন কোনও উৎসাহ নেই। বরং একটা বিরক্তির ভাব। জোর করে আমাকে লোক-দেখানো বসে থাকতে হবে অন্তত পনেরো মিনিট চোখ উলটে। কতই যেন ধ্যান লেগেছে! সমাধি হল বলে। চোখ বোজাতে আমার ভয় করে। যাকে ভাবব, তিনি আসবেন না। আবোলতাবোল নানা দৃশ্য ভেসে আসবে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব চিন্তা দুধের মতো মনে উথলে উঠবে। অবস্থাটা হবে এইরকম, ঝোলার ভেতর থেকে বেড়ালটা বেরিয়ে আসতে চাইছে, তাকে জোর করে চেপে ধরে আছি। থলেতে জায়গায় জায়গায় ফুলে ফুলে উঠছে। না আসে চোখে জল, না, জাগে মনে পুলক! বড় শুকনো লাগে। মনে হয় বসে আছি ডেন্টিস্টের চেম্বারে দাঁত তোলাবার জন্যে।

শ্বেতপাথরের ঝকঝকে মেঝে। প্রশস্ত ঘর। সামনেই কাঠের বেড়া। বেড়ার ওপাশে সিংহাসন। সিংহাসনে মায়ের বিশাল পট। সামনেই পূজার আয়োজন। ধূপের গন্ধ বাতাসে পাক মারছে। মায়ের মূর্তির দিকে চোখ পড়ার আগেই, চোখের এমনই ট্রেনিং, চলে গেল অন্য দিকে। আটকে গেল আকাশি রঙের পিঠে। চওড়া একটি পিঠ। সামনে ঝুঁকে চরণামৃত নিচ্ছে একটি মেয়ে। মুকুর বয়সি। চোখ কেড়ে নেবার মতোই চেহারা। পরনে আকাশি রঙের ফিনফিনে শাড়ি। জিভ দিয়ে মানুষের লালা পড়ে। যদি চোখ দিয়ে পড়ত, আমার বুক ভিজে যেত। কী ভয়ংকর দুর্বল আমার মন! এই মন নিয়ে তো বেশি দূর যাওয়া যাবে না। মেয়েটি চরণামৃত খেয়ে হাত ধোয়ার জন্যে উঠে গেল। আমার চোখও পায়ে পায়ে চলল লেজ-তোলা বেড়ালের মতো। মনে মনে নিজেকেই নিজে ঠাস করে একটা চড় হাঁকড়ালুম। রাসকেল, চরিত্রহীন!

বসে পড়লুম একপাশে। আবার যে-সে বসা নয় একেবারে পদ্মাসনে। আসলে যার কিছু হবেনা, তার বাড়াবাড়িটা তো খুব হবে। সাধে মুকু বলেছে, আমি একটা ভণ্ড! মায়ের দিকে তাকিয়ে বললুম, মা, আমার মন থেকে পাপটা বের করে দাও মা। ভয়ংকর জ্বালাচ্ছে। দগ্ধে দগ্ধে মারছে। এ এক অদ্ভুত অসুখ মা। এর কোনও ডাক্তার নেই। আমাকে শাসন করার কেউ নেই তো, প্রাণ যা চাইছে তাই করে বেড়াচ্ছি! মা, তুমি আমার হাত ধরো।

কষকষে করে চোখ বুজিয়ে আছি, যাতে খুলে না যায়। গায়ে একটা বাতাস লাগল। নতুন রকমের একটা গন্ধ। চোখ খুলে গেল। সেই মেয়েটি আমাকে আঁচলের বাতাস মেরে, আমারই সামনে গিয়ে বসেছে সোজা হয়ে। চওড়া কাঁধ, চওড়া পিঠ। না, আমি দেখব না। কিছুতেই দেখব না। মেয়েটি যদি ধ্যানে বসতে পারে, আমিও পারি। হেরে আমি যাব না। দাতে দাঁত চেপে আমি আবার চোখ বোজালুম। প্রথমেই লাঠালাঠি বেধে গেল মনে। মাকে কোথায় দেখব? মধ্যে, না হৃদয়ে, না মাথার ওপর সহস্রারে? ঝামেলা কি একটা! নানা মুনির নানা মত। মা আসতে চাইছিলেন, শেষে বসার জায়গা না পেয়ে, আসন না পেয়ে, ধুততেরিকা বলে একেবারেই বেরিয়ে গেলেন। কোনও জায়গাই খালি নেই। হৃদয়! হৃদয়ে বসে আছে মুকু। ভুরুর মাঝখানে আপাতত বসে আছে সদ্য-দেখা মেয়েটি। সেখানে, তিনজনের লাঠালাঠি চলেছে, জিরাবাই বলছে নাচব, লতা বলছে খেলব, নীলবসনা বলছে আমি পিঠ দেখাব, পাশ থেকে আমার ধারালো, একটু পুরুষালি মুখ দেখাব। আয় কে হারে, কে জেতে! একটাকে তাড়াই তো আর একটা এসে ঢোকে। জোর ধ্যান হচ্ছে! আমি হাল ছেড়ে বসে আছি। এ তত ভাল জ্বালা যা হোক! একবার পিটপিট করে তাকালুম। ঘরে আরও কয়েকজন একটি ফুল হাতে নিয়ে সংকল্প করছেন। মেয়েটি আমার চোখের সামনে খাড়া ধ্যানস্থ। একটুও বুঝতে পারছে না, সে একই সঙ্গে ওখানেও আছে, আবার আমার মধ্যেও আছে। এর মাঝে কোথাও হরিশঙ্করকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মহারাজ আমাকে সুন্দর একটা গল্প বলেছিলেন: একজন সাধু, সর্বদা তার জ্ঞানোন্মাদ অবস্থা। কারও সঙ্গেই কথাটথা বলতেন না। লোকেরা বলত, পাগল। একদিন লোকালয়ে এসেছেন। ভিক্ষে করে কিছু খাবারও জুটেছে। একটা গোদা কুকুর শুয়ে ছিল। পাগল বেশ জুত করে সেই কুকুরের ওপর বসে নিজে খাচ্ছেন, কুকুরকেও খাওয়াচ্ছেন। ভিড় জমে গেল। সবাই হাসাহাসি করছে। বলছে, পাগলার কাণ্ড দেখ! সাধু তখন গম্ভীর গলায় একটি মাত্র প্রশ্ন করলেন, বাবা, তোমরা হাসছ কেন? সবাই বললে, হাসব না? হাসছি তোমার কাণ্ড দেখে। সাধু তখন একটি শ্লোক বললেন,

বিষ্ণুপরি স্থিতো বিষ্ণুঃ
বিষ্ণু খাদতি বিষ্ণবে।
কথং হসসি রে বিষ্ণো
সর্বং বিষ্ণুময়ং জগৎ ॥

সেই গল্প আর শ্লোক একসঙ্গে মনে পড়ল, একটু অন্য অর্থে, অন্যভাবে। আমিও এক উন্মাদ। তবে জ্ঞানোন্মাদ নই। জ্ঞানপাগল নই, মেয়েপাগল। আর আমার শ্লোক হল, মুকুপরি স্থিত লতা/জিরা খাদতি লতবে। কথং হসসি রে মনো। সর্বং নারীময়ং জগৎ ।

শাস্ত্র বলছেন, বিচার করবে। রমণী কেন এত রমণীয় ভাবছ? শ্রীরামকৃষ্ণের ধমক ভেসে এল। কানে, লজ্জা হয় না! পশুর মতো ব্যবহার! লাল, রক্ত, মল, মূত্র এসব ঘৃণা করে না! যে ভগবানের পাদপদ্ম চিন্তা করে, তার পরমাসুন্দরী রমণী চিতার ভস্ম বলে বোধ হয়। যে-শরীর থাকবে না, যার ভিতর কৃমি, ক্লেদ, শ্লেষ্ম, যত প্রকার অপবিত্র জিনিস। সেই শরীর নিয়ে আনন্দ! লজ্জা হয় না!

বুকের ভেতরটা চাপা আগ্নেয়গিরির মতো গুমগুম করে উঠল। পিঠ দেখছি পিঠ। পিঠে কী আছে? কিছুই নেই। মন তুমি বিচার করো। পিঠ হল যে-কোনও মানুষের শরীরের একটা অংশ। মেয়েদের পিঠ চওড়া। বেশ একটা ভরভরতি শোভা আছে। এর বেশি তো কিছু নয়। পিঠ তো আর পীঠস্থান নয়। এইবার পিঠের উলটো দিক, মানে পিঠের অপর পিঠ। সেখানে? মন একটু থমকে গেল। বিচার কতক্ষণ চলত কে জানে! আর সেই বিচারে মন কতটা সরে আসত না আরও ঢুকে যেত, তাই বা কে জানে! হঠাৎ একটা চাপা কান্নায় চোখ খুলতে হল। মেয়েটি কাঁদছে। মনে মনে খুব লজ্জা পেলুম। পৃথিবীতে কত মানুষ কত দুঃখ নিয়ে ফিরছে। তার কোনও খবরই আমি রাখি না। আমি কেবল আমার তালেই ঘুরছি। মনে মনে সম্ভোগ করছি। মানুষের মন না দেখে দেহটাই দেখছি। আরে ছিঃ ছিঃ। মাথায় আঙুলের স্পর্শ। মহারাজ আমার পেছনে। ইশারা করলেন, উঠে পড়ার।

মহারাজের ঘরে আর একটা ছোট টেবিলে খাদ্য অপেক্ষা করছে। চা ধোঁয়া ছাড়ছে ফুস ফুস। মহারাজ প্রশ্ন করলেন, ধ্যান তা হলে বেশ ভালই জমেছিল?

ঠোঁটের কোণে যেন সামান্য মুচকি হাসি। ইস্পাতের মতো ধারালো কঠিন চেহারা। অন্তর্ভেদী চোখ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির ফার্স্ট ক্লাস ফাস্ট। সব ছেড়ে সন্ন্যাসী। ধন জন বিত্ত মান। এক মহান সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে জীবন ঘুরে গেল সংসার থেকে সন্ন্যাসে। সর্বশাস্ত্রে পারদর্শী। বিজ্ঞানের মানুষ সংস্কৃতে কেমন করে এমন সুপণ্ডিত হলেন? আসলে ব্রহ্মচারীর পক্ষে সবই সম্ভব। পিতা হরিশঙ্কর বারেবারে আমাকে বলতেন, শিশ্নবান হও। সমস্ত সাফল্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে ওইখানে।

সহসা হ্যাঁ বলতে পারলুম না। আমার সত্য-মিথ্যা জ্ঞান অতিশয় কম। কথায় কথায় মিথ্যা ঢুকিয়ে দিই। একবারও মনে হয় না, ছি ছি, মিথ্যা বললুম। স্বামীজির ক্ষুরধার চোখের দিকে তাকাবার সাহস হচ্ছে না। ধরা পড়ে যাব।

স্বামীজি বললেন, নাও, জলখাবার খেয়ে নাও। চা ঠান্ডা হয়ে যাবে। চা অবশ্য বেশি গরম খাওয়া উচিত নয়।

ভীষণ লজ্জা করছে। অপরিসীম একটা অস্বস্তি। আমার জন্যে কেউ কিছু করলে, খাতির করলে, ভীষণ কুঁকড়ে যাই। দুঃখ, বঞ্চনা, তিরস্কার, অপমান এইসবই আমার খাদ্য। পেটে সয় ভাল। আমার জন্যে কেউ কিছু করবে কেন? মাথা নিচু করে, যেভাবে মেয়েরা অনেকের সামনে খায়, আমি সেইভাবে খেতে শুরু করলুম।

স্বামীজি তখন অন্য প্রসঙ্গে। বলছেন, ধ্যানে বসলেই মন ছটফট করবে। মনের ধর্মই সেটা। ধ্যানে বসলে মনে যেসব নিচু চিন্তা ঠেলে ঠেলে ওঠে, সে সবই হল আমাদের পূর্বজন্মের সংস্কার। মনের সঙ্গে লড়াই করে লাভ নেই। আলগা ছেড়ে দাও। দেখো কী করে! একটা চিন্তা এল। অনুসরণ করো। দেখো কোথায় যায়। কত দূর যায়। তারপরেই ফুটবলের মতো লাথি মেরে পাঠিয়ে দাও মাঠের বাইরে। আবার একটা চিন্তা আসবে, কারণ মন কখনও খালি থাকে না। সেটাকে ওইভাবে লাথি মেরে বের করে দাও। এইভাবে একদিন তোমার চিন্তাশূন্য অবস্থা আসবে। জানো তো, যোগ দুরকমের- কর্মযোগ আর মনোযোগ। যাক, সেসব কথা পরে। অযাচিত কারওকে জ্ঞান দিতে নেই। জ্ঞানের মূল্য কমে যায়। একমাত্র প্রার্থীকেই দিতে হয়। তোমার চোখ বলছে, তোমার মনের অবস্থা ভাল নয়। তোমার এই বয়সটা বড় সাংঘাতিক! আবার কোন বয়সটাই বা সাংঘাতিক নয়? আবার সাংঘাতিকের সংজ্ঞাটাই বা কী? যে যার জীবন বেছে নেয়। যে যার ঘর বেছে নেয়।

আমার খাওয়া শেষ। প্লেট কাপ ডিশ নিয়ে বিব্রত। এমনি রাখব, না ধুয়ে রাখতে হবে! এখানে নিয়মকানুন খুব সাংঘাতিক।

আমার বিব্রত অবস্থা দেখে স্বামীজি বললেন, যাও, ছাদের একপাশে রেখে দাও। হাত ধুয়ে এসো।

ধুয়ে রাখব না?

তোমাকে ওসব কিছুই করতে হবে না। নিজেকে অত অচ্ছুৎ ভাবছ কেন? তোমার মধ্যে বিশ্রী একটা মেয়েলি ভাব আছে। ওটাকে চেষ্টা করে তাড়াও তো! এফিমিনেসি।

অভিমানে বড় লাগল। ভাল ভেবে যা করতে যাই, সঙ্গে সঙ্গে একটা ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসি। এই আমার বরাত। যেখানে যা কিছু করতে যাব। পিতা হরিশঙ্করকে ভাল ভেবেই সাবধান করতে গেলুম, একজন পরস্ত্রী, সদ্য বিধবা, যুবতী, একই বাড়িতে একসঙ্গে থাকলে আপনারই নিন্দা হবে। হবে কেন, হয়ে বসে আছে। আমার নিজের কত বড় একটা ত্যাগ। মহিলার সঙ্গে কাকিমা সম্পর্কের আড়ালে আমারই আর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পিতা ভুল বুঝলেন। রেগে নিরুদ্দেশ। পৃথিবী জুড়ে উলটো বুঝলি রামেদের রাজত্ব।

ছাতের একপাশে একটা কল। কলের তলায় সব রেখে চলে এলুম। মহারাজ বললেন, এইবার বললো তোমার কী সমস্যা হয়েছে?

কয়েকদিন আগে বলা নেই কওয়া নেই আমার বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন শেষরাতে।

কোথায় গেছেন বা যেতে পারেন বলে তোমার অনুমান?

আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে। আমাদের আত্মীয়স্বজন এমন কেউ নেই যেখানে তিনি যেতে পারেন। বন্ধুবান্ধব দু-একজন থাকলেও তিনি যাবেন না, কারণ তার নেচারটাই একটু অন্য ধরনের।

তোমার মুখেই শুনেছি, ভেরি আপরাইট। তেজস্বী পুরুষ। তুমি কী অ্যাকশন নিয়েছ?

আমি শুধু ভাবছি।

বাঃ বাঃ, আর পথে পথে ঘুরছ, আর মানুষের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছ! বাঃ! শাবাশ বাঙালি!

আমি কী করব বলুন? থানায় ডায়েরি করলে তাকে ছোট করা হয়।

মহারাজ টেবিলের দিকে তাকিয়ে সামান্য সময় ভাবলেন। মুখ তুলে বললেন, কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ। একজন শিক্ষিত, বিচারশীল, বিবেকসম্পন্ন মানুষ যা করেন, ভেবেচিন্তে পূর্বপরিকল্পনা মতোই করেন। এ তো খেয়ালের ঘর ছাড়া নয়। এ একধরনের বানপ্রস্থ।

মহারাজের কথা বন্ধ হয়ে গেল। ঘরে সেই মেয়েটি ঢুকছে। নীচে মায়ের ঘরে যার দিকে তাকিয়ে আমার ধ্যান মাথায় উঠেছিল। চোখদুটো ছলছলে হয়ে আছে। ইরানি ছুরির মতো চোখ। ভীষণ ধার। এইরকম একটা পূত সংস্পর্শে বসেও মন প্রজাপতি হয়ে গেল। এ একেবারে অন্য রকমের, অন্য ধারার মেয়ে। লম্বা ছিপছিপে, চাবুকের মতো চেহারা। কাধ, বুক, পিঠ পুরুষের মতো চওড়া। অ্যাথলিটদের এইরকম চেহারা হয়। চলনে বলনে কোনও জড়তা নেই। আমার লজ্জা, আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

মহারাজ বললেন, এসো, এসো সুরঞ্জনা এসো। কেমন আছ তোমরা?

মেয়েটি নিচু হয়ে প্রণাম করল। প্রণাম করতে করতেই বললে, ভাল আছি মহারাজ।

কোনও খবর পেলে?

নাঃ, কোনও খবর নেই।

আশ্চর্য ব্যাপার। একটা জলজ্যান্ত ছেলে স্রেফ উবে গেল!

সবাই বলছে খুন করে ফেলে দিয়েছে। মেয়েটির চোখে জল এসে গেল। কান্নার কোনও শব্দ নেই। কুলকুল করে জল গড়িয়ে চলেছে দু’গাল বেয়ে।

মহারাজ বললেন, একেবারে একফ্রিমটা ভাবছ কেন? হঠাৎ খুনই বা করতে যাবে কে!

আপনি তো জানেন, আমার বাবার অনেক শত্রু আছে। তাদেরই কেউ চরম প্রতিশোধটা নিয়ে নিলে। পুলিশ তো তিন মাস ধরে হন্যে হয়ে খুঁজেও কিছু করতে পারলে না।

মেয়েটি একেবারে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমার অস্তিত্বটাই যেন সে ভুলে গেছে। শাড়ির আঁচল কখনও আমার মুখে, কখনও মাথায়। শরীরের উত্তাপ, ঘ্রাণ সবই আমার অনুভূতিতে। মুঠোয় ধরা যায় এমন কোমর ঠিক আমার ডান কনুইয়ের পাশে। একবার আড়চোখে তাকিয়েছিলুম, দৃষ্টি সোজা গিয়ে ঠেকল নাভিতে। একে আমি পেটরোগা প্রেমিক। যাকে দেখছি তারই প্রেমে পড়ে যাচ্ছি, তারই বরাতে এই গেরো! উঠে যেতেও পারছি না। মহারাজ ভাবকেন, মনে পাপ পুষছে বাইরে পুণ্যের ভেক। আমার তো স্ত্রী-পুরুষ জ্ঞান থাকা উচিত নয়। আমি তো ভাল ছেলে! ধর্মে মতি, দ্বিজে ভক্তি, মহা গুণবান।

মহারাজই বাঁচালেন। বললেন, বোসো মা সুরঞ্জনা!

আমি আমার বাঁ পাশের চেয়ারে নিজেকে তুলে বসালুম। সুরঞ্জনা আমার চেয়ারে বসল। গা থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। শাড়িটা সিল্কের। হাতে একটা সোনার বালা ঝিলিক মারছে। বিশাল বড়লোকের মেয়ে। কোনও সন্দেহ নেই। চেহারায় একশো ভাগ আর্য।

মহারাজ আমাকে বললেন, বুঝলে পলাশ, অনেকটা তোমার মতোই কেস। তোমার বাবা, এর দাদা। বোম্বাইতে ট্রেনে চেপেছিল এইটুকু নিশ্চিত খবর, তারপর সবই অনিশ্চিত।

সুরঞ্জনা যেন ব্যথার ব্যথী পেল। আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললে, আপনার বাবা!

মুখটাকে করুণ থেকে করুণতম করে বললুম, কয়েকদিন হল আমার বাবা হারিয়ে গেছেন।

মহারাজ বললেন, হারিয়ে গেছেন বোলো না, বলো নিরুদ্দেশ হয়েছেন।

সুরঞ্জনা বললে, আপনি কী করছেন?

মহারাজ উত্তর দিলেন, কিছুই তেমন করা যাচ্ছে না। তিনি একজন নামী মানুষ, পণ্ডিত মানুষ, বিচক্ষণ মানুষ, স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগ করেছেন, অনেকটা হঠাৎ বানপ্রস্থের মতে, এ-ক্ষেত্রে থানা-পুলিশ, কাগজে বিজ্ঞাপন করা মানেই তাকে হেয় করা। ঘটনাটা মেনে নিতে হবে। সইয়ে নিতে হবে। এইরকম হয়। হঠাৎ বৈরাগ্য এসে যায়। অনেকে পরবর্তীকালে এইভাবেই মহাপুরুষ হয়েছেন। আমাদের হিমালয় এক বিস্ময়কর মায়াবী স্থান। মানুষকে ঘর থেকে ঘুম ভাঙিয়ে তুলে নিয়ে যায়। এইজন্যেই ভারত এক মহাপীঠস্থান, পুণ্যভূমি, পরমযোগের স্থান।

সুরঞ্জনার বা কনুইটা আমার ডান কনুইয়ে ঠেকে আছে। পুলক, শিহরন সবই চলেছে যুগপৎ। আমি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছি। মনে হচ্ছে খুব কারেন্ট আছে। অনেকের শরীরে এইরকম থাকে। শুদ্ধ সত্তা হলে এমন হয়। আমি শুনেছি, আজ অভিজ্ঞতা হল।

সুরঞ্জনা আবার আমার দিকে তাকাল। মনে হয় আমার করুণ মুখ দেখে তার করুণা হয়েছে। তার মুখও খুব করুণ গম্ভীর। এত কাছ থেকে এমন একটা ধারালো মুখ দেখলে শরীর কেমন করে। মনে নেমে আসে আরব্য রজনীর রাত। বাগদাদের বাজারে ঘুরছি। দেয়ালে দেয়ালে মশাল জ্বলছে। ছোট ছোট কুপিতে আলো। থরেথরে সাজানো বেদানা, আঙুর, খেজুর, কিসমিস, আখরোট, খরমুজ, খুবানি। হঠাৎ সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে বোরখা-পরা সুন্দরী। আমি তার পায়ের গোড়ালি দেখতে পাচ্ছি। বোরখার ঝালর তুলে এক নজর যেই তাকাল, মনে হল ছুরি চালিয়ে দিলে বুকে আমার। মনে হয় শীতের রাতে একই আলোয়ানের তলায় আমরা দুজনে। আমি আর সে। বসে আছি যমুনার তীরে। শীত-শীত পূর্ণিমা রাত। দূর থেকে ভেসে আসছে ঠুংরির চরণ। এইসব মনে হয় আমার। এ একটা অসুখ। দুরারোগ্য ব্যাধি। মাঝে মাঝে মনে হয় কোনও এক জন্মে আমি নবাব ছিলুম। এই অসুখের মনে হয় একটাই ওষুধ, বেধড়ক ধোলাই।

সুরঞ্জনা বললে, আপনি আমার বাবাকে একবার বলে দেখতে পারেন। উনি তো ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার। ভেতরে ভেতরে অনুসন্ধান চালিয়ে একটা কিছু করতে পারেন, যা আপনার বাবার পক্ষে অসম্মানজনক হবে না।

আমি একটু কুঁচকে গেলুম। পুলিশ অফিসারের মেয়ে! কোনও চালাকি চলবে না। আমি হ্যাঁ না কিছুই না বলে একটু সরে বসলুম। গায়ে গা না লেগে যায়! সুরঞ্জনা মহারাজকে বললে, অনুগ্রহ করে আমাদের বাড়িতে আজ একবার যাবেন? বাবা বিশেষ করে অনুরোধ করেছেন। আপনি না গেলে আমার মাকে সামলানো যাচ্ছে না। আমি গাড়ি এনেছি।

মহারাজ কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, তোমার বাবা আমার সহপাঠী ছিলেন। বন্ধুর অনুরোধ তো রাখতেই হবে। পলাশ, তুমিও চলো আমার সঙ্গে। কোনও কাজ নেই তো?

আজ্ঞে না।

তোমার অফিস?

সেখানেও গোলমাল মহারাজ।

তোমার গ্রহ খুব বেঁকেছে পলাশ।

আজ্ঞে হ্যাঁ। বিদিগিচ্ছিরি সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি।

ঠাকুরকে ডাকো। জীবনের কাছ থেকে বাঁচার শিক্ষা নাও। আচ্ছা, তোমরা দু’জনে ছাদে যাও। আমি তৈরি হয়ে নিই।

ছাদের আলসের ধারে গিয়ে দাঁড়ালুম দু’জনে। চারপাশে গিজিগিজি বাড়ি। বাগবাজার যে কত ঘিঞ্জি এই ছাদে দাঁড়ালেই জানা যায়। আমার থেকে হাত দুয়েক দূরে দাঁড়িয়ে আছে সুরঞ্জনা। একটু পুরুষালি চেহারা, কিন্তু কী ভয়ংকর আকর্ষণ! ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে, ঈশ্বরলাভের সাধনা না করে এই মেয়েটিকে জীবনে পাওয়ার সাধনাই তো ভাল। কোনও পাহাড়ে, নিরালা কোনও নদীর ধারে, ঢেউ-ভাঙা সমুদ্রের কিনারায় দু’জনে পাশাপাশি বসে থাকা। গিরিশ গেয়েছিলেন, ‘জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই। কোথা হতে আসি কোথা ভেসে যাই’। যেখান থেকে আসি আর যেখানেই ভেসে যাই, এসেছি, এইটাই বড় কথা। এমন সুন্দর পৃথিবী! নদী, পর্বত, সমুদ্র, বনানী, সুন্দরী রমণী, ঘুরন্ত ঘাগরা, দুরন্ত নিতম্ব, চপল চরণ। গঙ্গার মৃদু বাতাসে সুরঞ্জনার দু’-এক গুছি চুল কপালে এসে কাঁপছে। সুরঞ্জনার কণ্ঠস্বর অনেকটা বেগম আখতারের মতো। একটু ঘষাঘষা। তার ফলে আরও আকর্ষণীয়।

সুরঞ্জনা প্রশ্ন করলে, আপনি কি ছাত্র?

না, আমি একজন কেমিস্ট।

বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন কোন কলেজে?

স্কটিশে। আপনি?

আমি এখনও ছাত্রী। বিজ্ঞানেরই। এবছর আমার ফাঁইনাল। পড়াশোনা তেমন কিছুই হচ্ছে না।

এই ঘটনাটার জন্যে?

হ্যাঁ। দাদার কী যে হল! অমন একটা ছেলে! গতবছর শিবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেরোল। সাংঘাতিক ভাল ছাত্র। তেমনি খেলাধুলোয়। দাদাই তো আমাকে পড়াত। আমার চেয়ে ঠিক দু বছরের বড় ছিল। একেবারে বন্ধুর মতো। বড় একা হয়ে গেছি। বাড়িতে যতক্ষণ থাকি কেবল দাদার কথা মনে পড়ে। সব জায়গায় দাদার স্মৃতি। জানেন তো, আমার গভীর বিশ্বাস, এর পেছনে বাজে একটা মেয়ে আছে। ফেরোশাস। একই সঙ্গে গোটাদশেক ছেলেকে খেলাচ্ছে। এই নিয়ে এক বছর বাড়িতে খুব অশান্তি হচ্ছিল। দাদাও একটু অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিল। মা আর বাবাকে চড়া চড়া কথা শোনাত। আপনিও আমার দাদার বয়সি। আপনার সঙ্গে আমার দাদার চেহারার ভীষণ মিল। ঠাকুরঘরে আপনাকে দেখে চমকে উঠেছিলুম। আপনাদের এই বয়েসটা খুব সাংঘাতিক।

মনে মনে ভাবলুম, সে আর বলতে!

সুরঞ্জনা বলতে লাগল, আমরা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত। দাদাকে কত চেষ্টা করেছি এই পথে আনতে হেসে উড়িয়ে দিত। বলত ওসব বুড়ো বয়সে হবে, যখন শরীর ঝুলে যাবে, দাঁত পড়ে যাবে। মহারাজের কাছে একবার এনে ফেলতে পারলে, এই অবস্থা হত না।

মনে মনে ভাবলুম, কিছুই কি হত! আমার কি কিছু হয়েছে! ভেতরে ঠিকই সে নড়ছে। সে আমার প্রবৃত্তি। যে-প্রবৃত্তিতে সুরঞ্জনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকাটা স্বর্গসুখের মতো মনে হচ্ছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তদের একদিন কথায় কথায় বলছিলেন, মনে করলেই ত্যাগ করা যায় না। প্রারব্ধ, সংস্কার- এসব আবার আছে। একজন রাজাকে একজন যোগী বললে, তুমি আমার কাছে বসে থেকে ভগবানের চিন্তা করো। রাজা বললে, সে বড় হবে না; আমি থাকতে পারি, কিন্তু আমার এখনও ভোগ আছে। এ বনে যদি থাকি, হয়তো বনেতে একটা রাজ্য হয়ে যাবে। আমার এখনও ভোগ আছে।

সেই ভোগ আমারও মনে হয় আছে। আমার এই ভোগের প্রবৃত্তি কোথা থেকে এল? উড়ে তো আর আসেনি। এসেছে জন্মসূত্রে। কার রক্তের ধারায় প্রচ্ছন্ন ছিল এই প্রবৃত্তি? পিতার? মাতামহের? একটু সত্য কথা, একটু মনের কথা সাহস করে কেউ বলবেন কি? একটা স্বীকারোক্তি! পিতা কেন। বারেবারে সাবধান করতেন, দেখো, তোমার মাতুল বংশের দিকে যেয়ো না। অনেক ভাইস।

মহারাজ বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। অপূর্ব দেখাচ্ছে। নিপাট টকটকে গেরুয়া। কাঁধে ভাজ করা চাদর। মাথায় গেরুয়া টুপি, চোখে সোনার চশমা। বেরিয়ে এসেই বললেন, চলো চলো। সময় খুব কম।

সাদা রঙের গাড়ি। মহারাজই ঠিক করে দিলেন, কীভাবে বসা হবে। পেছনের আসনে একধারে মহারাজ, আর একধারে সুরঞ্জনা। মাঝখানে আমি। কামিনীর স্পর্শ থেকে সন্ন্যাসীকে দূরে রাখার দায়িত্ব আমার। আমার বাঁ দিকে, আমারই পা ছুঁয়ে সিল্ক-ঢাকা মসৃণ জঙ্ঘা। তার ওপর লম্বা লম্বা আঙুল। অনামিকায় জ্বলজ্বল করছে আংটির বেদানার দানার মতো পাথর। মসৃণ কাঁধে ছুঁয়ে আছে। আমার কাধ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *