দ্বিতীয় খণ্ড – দশম অধ্যায়: ভৈরবী–ব্রাহ্মণী–সমাগম
রাণী রাসমণির সাংঘাতিক পীড়া
সন ১২৬৭ সালের শেষভাগে, ইংরাজী ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে কামারপুকুর হইতে দক্ষিণেশ্বরে ফিরিবার পরে ঠাকুরের জীবনে দুইটি ঘটনা সমুপস্থিত হয়। ঘটনা দুইটি তাঁহার জীবনে বিশেষ পরিবর্তন উপস্থিত করিয়াছিল। সেজন্য উহাদের কথা আমাদিগের আলোচনা করা আবশ্যক। ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দের প্রারম্ভে রানী রাসমণি গ্রহণীরোগে আক্রান্তা হয়েন। ঠাকুরের নিকটে শুনিয়াছি, রানী ঐ সময়ে একদিন সহসা পড়িয়া যান। উহাতেই জ্বর, গাত্রবেদনা ও অজীর্ণাদি ক্রমে ক্রমে উপস্থিত হইয়া উক্ত রোগের সঞ্চার করে। ব্যাধি স্বল্পকালমধ্যে সাংঘাতিক ভাব ধারণ করিয়াছিল।
রাণীর দিনাজপুরের সম্পত্তি দেবোত্তর করা ও মৃত্যু
আমরা ইতঃপূর্বে বলিয়াছি, সন ১২৬২ সালের ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ইংরাজী ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসের ৩১ তারিখ বৃহস্পতিবার রানী দক্ষিণেশ্বরে দেবী-প্রতিষ্ঠা করেন। ঠাকুরবাটীর ব্যয়নির্বাহের জন্য তিনি ঐ বৎসর ১৪ ভাদ্র, ইংরাজী ২৯ আগস্ট তারিখে দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত তিন লাট জমিদারি দুই লক্ষ ছাব্বিশ সহস্র মুদ্রায় ক্রয় করিয়াছিলেন।1 কিন্তু মনে মনে সঙ্কল্প থাকিলেও এতদিন তিনি ঐ সম্পত্তি দানপত্র করিয়া দেবোত্তরে পরিণত করেন নাই। আসন্নকাল উপস্থিত দেখিয়া উহা করিবার জন্য তিনি এখন ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। রানীর চারি কন্যার মধ্যে মধ্যমা ও তৃতীয়া শ্রীমতী কুমারী ও শ্রীমতী করুণাময়ী দাসীর কালীবাটী-প্রতিষ্ঠার পূর্বেই মৃত্যু হইয়াছিল। সুতরাং তাঁহার মৃত্যুশয্যার পার্শ্বে তাঁহার জ্যেষ্ঠা ও কনিষ্ঠা কন্যাদ্বয় শ্রীমতী পদ্মমণি ও শ্রীমতী জগদম্বা দাসীই উপস্থিত ছিলেন। দানপত্র সম্পন্ন করিবার কালে তিনি ভবিষ্যৎ ভাবিয়া উক্ত সম্পত্তির অযথা নিয়োগের পথ এককালে রুদ্ধ করিবার মানসে নিজ কন্যাদ্বয়কে দেবোত্তর করিবার সম্মতি প্রদানপূর্বক ভিন্ন এক অঙ্গীকারপত্র সহি করিতে বলিয়াছিলেন। শ্রীমতী জগদম্বা উক্ত পত্রে সহি প্রদান করিলেন, কিন্তু জ্যেষ্ঠা কন্যা পদ্মমণি বহু অনুরোধেও উহাতে সহি দিলেন না। সেজন্য মৃত্যুশয্যায় শয়ন করিয়াও রানী শান্তিলাভ করিতে পারেন নাই। অগত্যা, ৺জগদম্বার ইচ্ছায় যাহা হইবার হইবে ভাবিয়া রানী ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে দেবোত্তর-দানপত্রে সহি করিলেন2 এবং ঐ কার্য সমাধা করিবার পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে রাত্রিকালে শরীরত্যাগ করিয়া ৺দেবীলোকে গমন করিলেন।
1.
Plaint in High Court Suit No. 308 of 1872 Puddomoni Dasee vs. Jagadamba Dasee,
recites the following from the Deed of Endowment executed by Rani Rasmani –
“According to my late husband’s desire *** I on 18th Jaistha, 1262 B.S.
(31st May, 1855) established and consecrated the Thakurs ..and
for purpose of carrying on the Sheba purchased three lots of
Zemindaris in District Dinajpur on 14th Bhadra, 1262 B.S. (29 August, 1855) for
Rs. 2,26,000.”
2. The Deed of
Endowment, dated 18 February, 1861 was executed by Rani Rasmani; she
acknowledged her execution of the same before J. F. Watkins, Solicitor,
Calcutta. This dedication was accepted as valid by all parties in Alipore Suit
No. 47 of 1867, Jadu Nath Chowdhury vs. Puddomoni and in the High Court Suit
No. 308 of 1872, Puddomoni vs. Jagadamba and also when that Suit (No. 308) was
revived after contest on 19 July, 1888.
শরীররক্ষা করিবার কালে রাণীর দর্শন
ঠাকুর বলিতেন, শরীরত্যাগের কিছুদিন পূর্বে রানী রাসমণি ৺কালীঘাটে আদিগঙ্গাতীরস্থ বাটীতে আসিয়া বাস করিয়াছিলেন। দেহরক্ষার অব্যবহিত পূর্বে তাঁহাকে গঙ্গাগর্ভে আনয়ন করা হইলে সম্মুখে অনেকগুলি আলোক জ্বালা রহিয়াছে দেখিয়া তিনি সহসা বলিয়া উঠিয়াছিলেন, “সরিয়ে দে, সরিয়ে দে, ও সব রোশনাই আর ভাল লাগছে না, এখন আমার মা (শ্রীশ্রীজগন্মাতা) আসছেন, তাঁর শ্রীঅঙ্গের প্রভায় চারিদিক আলোকময় হয়ে উঠেছে!” (কিছুক্ষণ পরে) “মা, এলে! পদ্ম যে সহি দিলে না – কি হবে, মা?” ঐ কথার উত্তরপ্রদান করিয়াই যেন শিবাকুল ঐ সময়ে চারিদিক হইতে উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়া উঠিল। কথাগুলি বলিয়াই পুণ্যবতী রানী শান্তভাবে মাতৃক্রোড়ে মহাসমাধিতে শয়ন করিলেন। রাত্রি তখন দ্বিতীয় প্রহর উত্তীর্ণ হইয়াছে।
রাণী মৃত্যুকালে যাহা আশঙ্কা করেন তাহাই হইতে বসিয়াছে
কালীবাটীর দেবোত্তর সম্পত্তি লইয়া রানী রাসমণির দৌহিত্রগণের মধ্যে উত্তরকালে যে বহুল বিবাদ-বিসংবাদ ও মকদ্দমা চলিতেছে, তাহা হইতে বুঝিতে পারা যায় – তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্না রানী তাঁহার প্রাণস্বরূপ দেবীসেবার বন্দোবস্ত যথাযথ থাকিবে না বলিয়া কেন এত আশঙ্কা করিয়াছিলেন এবং কেনই বা ব্যাধির যন্ত্রণাপেক্ষা ঐ চিন্তার যন্ত্রণা মৃত্যুকালে তাঁহার নিকট তীব্রতর বলিয়া অনুভূত হইয়াছিল। আদালতের কাগজপত্রে দেখা যায়, ঐসকল মকদ্দমার বহুল ব্যয়ের জন্য ঐ দেবোত্তর সম্পত্তি ঋণগ্রস্ত হইয়া ক্রমশঃ কিঞ্চিন্ন্যূন লক্ষ মুদ্রায় বাঁধা পড়িয়াছে।1 কে বলিবে, রানী রাসমণির অদ্বিতীয় দৈবকীর্তি ঐ বিবাদের ফলে নামমাত্রে পর্যবসিত এবং ক্রমে লুপ্ত হইবে কি না!
1. Debt due on mortgage by the Estate is Rs. 50,000; interest payable quarterly is Rs. 876-0-0; Costs of the Referee already stated amount to Rs. 20,000, as yet untaxed.
মথুরবাবুর সাংসারিক উন্নতি ও দেবসেবার বন্দোবস্ত
রানীর কনিষ্ঠ জামাতা শ্রীযুক্ত মথুরামোহন বিশ্বাস বিষয়সংক্রান্ত সকল কার্যপরিচালনায় তাঁহার দক্ষিণহস্তস্বরূপ হইয়া উঠিয়াছিলেন। প্রতিষ্ঠার কাল হইতে তিনি কালীবাটীর দেবোত্তর সম্পত্তির আয়ব্যয় বুঝিয়া লইয়া রানীর ইচ্ছামত সকল বিষয়ের বন্দোবস্ত করিতেছিলেন। সুতরাং রানীর মৃত্যুর পরে তিনিই দেবসেবা-সংক্রান্ত সকল কার্য পূর্বের ন্যায় পরিচালনা করিতে থাকিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পবিত্র প্রভাবে দেবতাভক্তি মথুরামোহনের অন্তরে বিশেষ অধিকার বিস্তার করায় দক্ষিণেশ্বরের মাতৃসেবা রানীর মৃত্যুতে কোন প্রকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই।
মথুরবাবুর উন্নতি ও আধিপত্য ঠাকুরকে সহায়তা করিবার জন্য
ঠাকুরের সহিত মথুরবাবুর বিচিত্র সম্বন্ধের কথা আমরা ইতঃপূর্বে অনেক স্থলে বলিয়াছি; অতএব এখানে উহার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। এখানে কেবলমাত্র এই কথা বলিলেই চলিবে যে, দীর্ঘকালব্যাপী তন্ত্রোক্ত সাধনসমূহ ঠাকুরের জীবনে অনুষ্ঠিত হইবার পূর্বে রানী রাসমণির স্বর্গারোহণ ও কালীবাটী-সংক্রান্ত সকল বিষয়ে মথুরামোহনের একাধিপত্যলাভরূপ ঘটনা উপস্থিত হওয়ায়, ভক্তিমান মথুর তাঁহাকে ঐ বিষয়ে সহায়তা করিবার বিশেষ অবসর প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। মনে হয়, মথুরের উক্ত আধিপত্যলাভ যেন ঠাকুরকে সহায়তা করিবার জন্যই উপস্থিত হইয়াছিল। কারণ দেখা যায়, দেবতাজ্ঞানে ঠাকুরের সেবা করাই এখন হইতে তাঁহার নিকটে সর্বপ্রধান কার্যরূপে পরিণত হইয়াছিল। দীর্ঘকাল সমভাবে এক বিষয়ে বিশ্বাসী থাকিয়া উচ্চভাবাশ্রয়ে জীবন অতিবাহিত করা একমাত্র ঈশ্বরকৃপাতেই সম্ভবপর হয়। অতএব রানীর বিপুল বিষয়ে একাধিপত্যলাভপূর্বক বিপথগামী না হইয়া মথুরামোহন যে ঠাকুরের প্রতি দিন দিন অধিকতর বিশ্বাসসম্পন্ন হইয়া উঠিয়াছিলেন এবং এখন হইতে দীর্ঘ একাদশ বৎসরকাল তাঁহার সেবায় আপনাকে সমভাবে নিযুক্ত রাখিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, ইহাতে তাঁহার পরম ভাগ্যের কথা বুঝিতে পারা যায়।
ঠাকুরের সম্বন্ধে ইতরসাধারণের ও মথুরের ধারণা
ঈশ্বরসাধক ভিন্ন অন্য কোন ব্যক্তি ঠাকুরের দিব্যোন্মাদ অবস্থার অসাধারণ উচ্চতা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা করিতে পারে নাই। মানবসাধারণ তাঁহাকে বিকৃতমস্তিষ্ক বলিয়া স্থির করিয়াছিল। কারণ, তাহারা দেখিয়াছিল, তিনি সর্বপ্রকার পার্থিব ভোগসুখলাভে পরাঙ্মুখ হইয়া তাহাদিগের বুদ্ধির অগোচর একটা অনির্দিষ্ট ভাবে বিভোর থাকিয়া কখনো ‘হরি’, কখনো ‘রাম’, এবং কখনো বা ‘কালী’, ‘কালী’ বলিয়া দিন কাটাইয়া দেন! আবার রানী রাসমণি ও মথুরবাবুর কৃপাপ্রাপ্ত হইয়া কত লোক ধনী হইয়া যাইল, তিনি কিন্তু ভাগ্যক্রমে তাঁহাদের সুনয়নে পড়িয়াও আপনার সাংসারিক উন্নতির কিছুই করিয়া লইতে পারিলেন না। সুতরাং তিনি হিতাহিত-জ্ঞানশূন্য উন্মাদ ভিন্ন অপর কি হইবেন? একথা কিন্তু সকলে বুঝিয়াছিল যে, সাংসারিক সকল বিষয়ে অকর্মণ্য হইলেও এই উন্মাদের উজ্জ্বল নয়নে, অদৃষ্টপূর্ব চালচলনে, মধুর কণ্ঠস্বরে, সুললিত বাক্যবিন্যাসে এবং অদ্ভুত প্রত্যুত্পন্নমতিত্বে এমন একটা কি আকর্ষণ আছে, যাহাতে তাহারা যে-সকল ধনী মানী পণ্ডিত ব্যক্তির সম্মুখে অগ্রসর হইতেও সঙ্কোচ বোধ করে, সেইসকল লোকের সম্মুখে ইনি কিছুমাত্র সঙ্কুচিত না হইয়া উপস্থিত হন এবং অচিরে তাঁহাদিগের প্রিয় হইয়া উঠেন! ইতরসাধারণ মানব এবং কালীবাটীর কর্মচারীরা ঐরূপ ভাবিলেও, মথুরবাবু কিন্তু এখন অন্যরূপ ভাবিতেন। মথুরামোহন বলিতেন, “শ্রীশ্রীজগদম্বার কৃপা হইয়াছে বলিয়াই উঁহার ঐ প্রকার উন্মত্তবৎ অবস্থা উপস্থিত হইয়াছে।”
ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন
রানী রাসমণির মৃত্যুর স্বল্পকাল পরে ঠাকুরের জীবনে ঐ বৎসর আর একটি বিশেষ ঘটনা সমুপস্থিত হয়। দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীর পশ্চিমভাগে গঙ্গাতীরে সুবৃহৎ পোস্তার উপর এই কালে বিচিত্র পুষ্পকানন ছিল। সযত্ন-রক্ষিত ঐ উদ্যানে নানাজাতীয় পুষ্পসম্ভারে ভূষিত হইয়া বৃক্ষলতাদি তখন বিচিত্র শোভা বিস্তার করিত এবং মধুগন্ধে দিক আমোদিত হইত। শ্রীশ্রীজগদম্বার পূজা না করিলেও ঠাকুর এই সময়ে নিত্য ঐ কাননে পুষ্পচয়ন করিতেন এবং মাল্যরচনা করিয়া শ্রীশ্রীজগদম্বাকে স্বহস্তে সাজাইতেন। ঐ কাননের মধ্যভাগে গঙ্গাগর্ভ হইতে মন্দিরে যাইবার চাঁদনি-শোভিত বিস্তৃত সোপানাবলী এবং উত্তরে পোস্তার শেষে স্ত্রীলোকদিগের ব্যবহারের জন্য একটি বাঁধাঘাট ও নহবতখানা অদ্যাপি বর্তমান। বাঁধাঘাটটির উপরে একটি বৃহৎ বকুল বৃক্ষ বিদ্যমান থাকায় লোকে উহাকে বকুলতলার ঘাট বলিয়া নির্দেশ করিত।
ঠাকুর একদিন প্রাতে পুষ্পচয়ন করিতেছেন, এমন সময়ে একখানি নৌকা বকুলতলার ঘাটে আসিয়া লাগিল এবং গৈরিকবস্ত্রপরিহিতা আলুলায়িত-দীর্ঘকেশা ভৈরবীবেশধারিণী এক সুন্দরী রমণী উহা হইতে অবতরণপূর্বক দক্ষিণেশ্বর ঘাটের চাঁদনির দিকে অগ্রসর হইলেন। প্রৌঢ়া হইলেও যৌবনের সৌন্দর্যাভাস তাঁহার শরীরকে তখনো ত্যাগ করে নাই। ঠাকুরের নিকটে শুনিয়াছি, ভৈরবীর বয়স তখন চল্লিশের কাছাকাছি ছিল। নিকট আত্মীয়কে দেখিলে লোকে যেরূপ বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করিয়া থাকে, ভৈরবীকে দেখিয়া তিনি ঐরূপ অনুভব করিয়াছিলেন এবং গৃহে ফিরিয়া ভাগিনেয় হৃদয়কে চাঁদনি হইতে তাঁহাকে ডাকিয়া আনিতে বলিয়াছিলেন। হৃদয় তাঁহার ঐরূপ আদেশে ইতস্ততঃ করিয়া বলিয়াছিল, “রমণী অপরিচিতা, ডাকিলেই আসিবে কেন?” ঠাকুর তদুত্তরে বলিয়াছিলেন, “আমার নাম করিয়া বলিলেই আসিবে।” হৃদয় বলিত, অপরিচিতা সন্ন্যাসিনীর সহিত আলাপ করিবার জন্য মাতুলের ঐরূপ আগ্রহাতিশয় দেখিয়া সে অবাক হইয়াছিল। কারণ তাঁহাকে ঐরূপ আচরণ করিতে সে ইতঃপূর্বে কখনো দেখে নাই।
উন্মাদ মাতুলের বাক্য অন্যথা করিবার উপায় নাই বুঝিয়া হৃদয় চাঁদনিতে যাইয়া দেখিল ভৈরবী ঐ স্থানেই উপবিষ্টা রহিয়াছেন। সে তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিল, তাহার ঈশ্বরভক্ত মাতুল তাঁহার দর্শনলাভের জন্য প্রার্থনা করিতেছেন। ঐ কথা শুনিয়া ভৈরবী কোনরূপ প্রশ্ন না করিয়া তাহার সহিত আগমনের জন্য উঠিলেন দেখিয়া সে অধিকতর বিস্মিত হইল।
প্রথম দর্শনে ভৈরবী ঠাকুরকে যাহা বলেন
ঠাকুরের ঘরে প্রবেশপূর্বক তাঁহাকে দেখিয়াই ভৈরবী আনন্দে ও বিস্ময়ে অভিভূতা হইলেন এবং সজলনয়নে সহসা বলিয়া উঠিলেন, “বাবা, তুমি এখানে রহিয়াছ! তুমি গঙ্গাতীরে আছ জানিয়া তোমায় খুঁজিয়া বেড়াইতেছিলাম, এতদিনে দেখা পাইলাম!” ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার কথা কেমন করিয়া জানিতে পারিলে, মা?” ভৈরবী বলিলেন, “তোমাদের তিনজনের সঙ্গে দেখা করিতে হইবে, একথা ৺জগদম্বার কৃপায় পূর্বে জানিতে পারিয়াছিলাম। দুই জনের দেখা পূর্ব (বঙ্গ) দেশে পাইয়াছি, আজ এখানে তোমার দেখা পাইলাম।”
ঠাকুর ও ভৈরবীর প্রথমালাপ
ঠাকুর তখন ভৈরবীর নিকটে উপবিষ্ট হইয়া বালক যেমন অন্তরের কথা জননীর নিকটে সানন্দে প্রকাশ করে, সেইরূপ নিজ অলৌকিক দর্শন, ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গে বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হওয়া, গাত্রদাহ, নিদ্রাশূন্যতা, শারীরিক বিকার প্রভৃতি জীবনে নিত্য অনুভূত বিষয়সকল তাঁহাকে বলিতে বলিতে পুনঃপুনঃ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, “হ্যাঁগা, আমার এসকল কি হয়? আমি কি সত্যই পাগল হইলাম? জগদম্বাকে মনে প্রাণে ডাকিয়া সত্যই কি আমার কঠিন ব্যাধি হইল?” ভৈরবী তাঁহার ঐ সকল কথা শুনিতে শুনিতে জননীর ন্যায় কখনো উত্তেজিতা, কখনো উল্লসিতা, এবং কখনো করুণার্দ্রহৃদয় হইয়া তাঁহাকে সান্ত্বনাদানের জন্য বারংবার বলিতে লাগিলেন, “তোমায় কে পাগল বলে, বাবা? তোমার ইহা পাগলামি নয়, তোমার মহাভাব হইয়াছে, সেইজন্যই ঐরূপ অবস্থাসকল হইয়াছে ও হইতেছে। তোমার যে অবস্থা হইয়াছে, তাহা কি কাহারও চিনিবার সাধ্য আছে? সেইজন্য ঐ প্রকার বলে। ঐ প্রকার অবস্থা হইয়াছিল শ্রীমতী রাধারানীর; ঐ প্রকার হইয়াছিল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর! এই কথা ভক্তিশাস্ত্রে আছে। আমার নিকটে যে-সকল পুঁথি আছে, তাহা হইতে আমি পড়িয়া দেখাইব, ঈশ্বরকে যাঁহারা একমনে ডাকিয়াছেন, তাঁহাদের সকলেরই ঐরূপ অবস্থাসকল হইয়াছে ও হয়।” ভৈরবী ব্রাহ্মণী ও নিজ মাতুলকে ঐরূপে পরমাত্মীয়ের ন্যায় বাক্যালাপ করিতে দেখিয়া হৃদয়ের বিস্ময়ের অবধি ছিল না।
অনন্তর কথায় কথায় বেলা অধিক হইয়াছে দেখিয়া ঠাকুর দেবীর প্রসাদী ফলমূল, মাখন, মিছরি প্রভৃতি ভৈরবী ব্রাহ্মণীকে জলযোগ করিতে দিলেন এবং মাতৃভাবে ভাবিতা ব্রাহ্মণী পুত্রস্বরূপে তাঁহাকে পূর্বে না খাওয়াইয়া জলগ্রহণ করিবেন না বুঝিয়া স্বয়ং ঐসকল খাদ্যের কিয়দংশ গ্রহণ করিলেন। দেবদর্শন ও জলযোগ শেষ হইলে ব্রাহ্মণী নিজ কণ্ঠগত রঘুবীরশিলার ভোগের জন্য ঠাকুরবাটীর ভাণ্ডার হইতে আটা, চাল প্রভৃতি ভিক্ষাস্বরূপে গ্রহণ করিয়া পঞ্চবটীতলে রন্ধনাদিতে ব্যাপৃতা হইলেন।
পঞ্চবটীতে ভৈরবীর অপূর্ব দর্শন
রন্ধন শেষ হইলে ৺রঘুবীরের সম্মুখে খাদ্যাদি রাখিয়া ব্রাহ্মণী নিবেদন করিয়া দিলেন এবং ইষ্টদেবকে চিন্তা করিতে করিতে গভীর ধ্যানে নিমগ্না হইয়া অভূতপূর্ব দর্শনলাভে সমাধিস্থা হইলেন। বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হইয়া তাঁহার দুনয়নে প্রেমাশ্রুধারা প্রবাহিত হইতে লাগিল। ঠাকুর ঐ সময়ে প্রাণে প্রাণে আকৃষ্ট হইয়া অর্ধবাহ্য অবস্থায় সহসা তথায় উপস্থিত হইলেন এবং দৈবশক্তিবলে পূর্ণাবিষ্ট হইয়া ব্রাহ্মণী-নিবেদিত খাদ্যসকল ভোজন করিতে লাগিলেন। কতক্ষণ পরে ব্রাহ্মণী সংজ্ঞালাভ করিয়া চক্ষু উন্মীলন করিলেন এবং বাহ্যজ্ঞানবিরহিত ভাবাবিষ্ট ঠাকুরের ঐপ্রকার কার্যকলাপ নিজ দর্শনের সহিত মিলাইয়া পাইয়া আনন্দে কণ্টকিত-কলেবরা হইলেন। কিয়ৎকাল পরে ঠাকুর সাধারণ জ্ঞানভূমিতে অবরোহণ করিলেন এবং নিজকৃত কার্যের জন্য ক্ষুব্ধ হইয়া ব্রাহ্মণীকে বলিতে লাগিলেন, “কে জানে বাপু, আত্মহারা হইয়া কেন এইরূপ কার্যসকল করিয়া বসি!” ব্রাহ্মণী তখন জননীর ন্যায় তাঁহাকে আশ্বাস প্রদানপূর্বক বলিলেন, “বেশ করিয়াছ, বাবা; ঐরূপ কার্য তুমি কর নাই, তোমার ভিতরে যিনি আছেন তিনি করিয়াছেন; ধ্যান করিতে করিতে আমি যাহা দেখিয়াছি, তাহাতে নিশ্চয়ই বুঝিয়াছি, কে ঐরূপ করিয়াছে এবং কেনই বা করিয়াছে; বুঝিয়াছি, আর আমার পূর্বের বাহ্যপূজার আবশ্যকতা নাই, আমার পূজা এতদিনে সার্থক হইয়াছে!” এই বলিয়া ব্রাহ্মণী কিছুমাত্র দ্বিধা না করিয়া দেবপ্রসাদস্বরূপে উক্ত ভোজনাবশিষ্ট গ্রহণ করিলেন এবং ঠাকুরের শরীরমনাশ্রয়ে ৺রঘুবীরের জীবন্ত দর্শনলাভপূর্বক প্রেমগদ্গদচিত্তে বাষ্পবারি মোচন করিতে করিতে বহুকালপূজিত নিজ রঘুবীরশিলাটিকে গঙ্গাগর্ভে বিসর্জন করিলেন।
পঞ্চবটীতে শাস্ত্রপ্রসঙ্গ
প্রথম দর্শনের প্রীতি ও আকর্ষণ ঠাকুর এবং ব্রাহ্মণীর মধ্যে দিন দিন বর্ধিত হইতে লাগিল। ঠাকুরের প্রতি অপত্যপ্রেমে মুগ্ধহৃদয়া সন্ন্যাসিনী দক্ষিণেশ্বরেই রহিয়া গেলেন। আধ্যাত্মিক বাক্যালাপে দিনের পর দিন কোথা দিয়া যাইতে লাগিল, উভয়ের মধ্যে কাহারও তাহা অনুভবে আসিল না! নিজ আধ্যাত্মিক দর্শন ও অবস্থাসম্বন্ধীয় রহস্যকথাসকল অকপটে বলিয়া ঠাকুর নিত্য নানাবিধ প্রশ্ন করিতে লাগিলেন এবং ভৈরবী তন্ত্রশাস্ত্র হইতে ঐসকলের সমাধান করিয়া অথবা ঈশ্বরপ্রেমের প্রবল বেগে অবতারপুরুষদিগের দেহমনে কিরূপ লক্ষণসকল প্রকাশিত হয়, ভক্তিগ্রন্থসমূহ হইতে তদ্বিষয় পাঠ করিয়া ঠাকুরের সংশয়সকল ছিন্ন করিতে লাগিলেন। পঞ্চবটীতে ঐরূপে কয়েক দিবস দিব্যানন্দের প্রবাহ ছুটিয়াছিল।
ভৈরবীর দেবমণ্ডলের ঘাটে অবস্থানের কারণ
ছয়-সাত দিন ঐরূপে কাটিবার পরে ঠাকুরের মনে হইল ব্রাহ্মণীকে এখানে রাখা ভাল হইতেছে না। কামকাঞ্চনাসক্ত সংসারী মানব বুঝিতে না পারিয়া পবিত্রা রমণীর চরিত্র সম্বন্ধে নানা কথা রটনার অবসর পাইবে। ব্রাহ্মণীকে উহা বলিবামাত্র তিনি ঐ বিষয়ের যাথার্থ্য অনুধাবন করিলেন এবং গ্রামমধ্যে নিকটে কোন স্থানে থাকিয়া, প্রতিদিন দিবসে কিছুকালের জন্য আসিয়া ঠাকুরের সহিত দেখা করিয়া যাইবার সঙ্কল্প স্থিরপূর্বক কালীবাটী পরিত্যাগ করিলেন।
কালীবাটীর উত্তরে ভাগীরথীতীরে দক্ষিণেশ্বর-গ্রামস্থ দেবমণ্ডলের ঘাটে আসিয়া ব্রাহ্মণী বাস করিতে লাগিলেন1 এবং গ্রামমধ্যে পরিভ্রমণপূর্বক রমণীগণের সহিত আলাপ করিয়া স্বল্পদিনেই তাহাদিগের শ্রদ্ধার পাত্রী হইয়া উঠিলেন। সুতরাং এখানে তাঁহার বাস ও ভিক্ষা সম্বন্ধে কোনরূপ অসুবিধা রহিল না এবং লোকনিন্দার ভয়ে ঠাকুরের পবিত্র দর্শনলাভে তাঁহাকে একদিনের জন্যও বঞ্চিত হইতে হইল না। তিনি প্রতিদিন কিয়ৎকালের জন্য কালীবাটীতে আসিয়া ঠাকুরের সহিত কথাবার্তায় কাল কাটাইতে লাগিলেন এবং গ্রামস্থ রমণীগণের নিকট হইতে নানাপ্রকার খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহপূর্বক মধ্যে মধ্যে তাঁহাকে ভোজন করাইতে লাগিলেন।2
1.
হৃদয়
বলিত,
দেবমণ্ডলের
ঘাটে
থাকিবার
পরামর্শ
ঠাকুরই
ব্রাহ্মণীকে
প্রদানপূর্বক
মণ্ডলদের
বাটীতে
পাঠাইয়া
দেন।
তথায়
যাইবামাত্র
৺নবীনচন্দ্র
নিয়োগীর
ধর্মপরায়ণা
পত্নী
তাঁহাকে
সাদরে
গ্রহণ
করেন
এবং
ঘাটের
চাঁদনিতে
যতকাল
ইচ্ছা
থাকিবার
অনুমতিসহ
একখানি
তক্তপোশ,
চাল,
ডাল,
ঘি
ও
অন্যান্য
ভোজনসামগ্রী
প্রদান
করিয়াছিলেন।
2. গুরুভাব – পূর্বার্ধ, ৮ম অধ্যায়।
ঠাকুরকে ভৈরবীর অবতার বলিয়া ধারণা কিরূপে হয়
ঠাকুরের কথা শুনিয়া ব্রাহ্মণীর ইতঃপূর্বে মনে হইয়াছিল, অসাধারণ ঈশ্বরপ্রেমেই তাঁহার অলৌকিক দর্শন ও অবস্থাসকল উপস্থিত হইয়াছে। এখন ভগবদালাপে, তাঁহার ভাবসমাধিতে মুহুর্মুহুঃ বাহ্যচৈতন্যলোপ ও কীর্তনে পরমানন্দ দেখিয়া তাঁহার দৃঢ় ধারণা হইল – ইনি কখনই সামান্য সাধক নহেন। চৈতন্যচরিতামৃত ও ভাগবতাদি গ্রন্থের স্থলে স্থলে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের জীবোদ্ধারের নিমিত্ত পুনরায় শরীরধারণপূর্বক আগমনের যে-সকল ইঙ্গিত দেখিতে পাওয়া যায়, ঠাকুরকে দেখিয়া ব্রাহ্মণীর স্মৃতিপথে সেই সকল কথা পুনঃপুনঃ উদিত হইতে লাগিল। বিদুষী ব্রাহ্মণী ঐসকল গ্রন্থে শ্রীচৈতন্য ও শ্রীনিত্যানন্দ সম্বন্ধে যে-সকল কথা লিপিবদ্ধ দেখিয়াছিলেন, সেই সকলের সহিত ঠাকুরের আচার-ব্যবহার ও অলৌকিক প্রত্যক্ষাদি মিলাইয়া সৌসাদৃশ্য দেখিতে পাইলেন। শ্রীচৈতন্যদেবের ন্যায় ভাবাবেশে স্পর্শ করিয়া অপরের মনে ধর্মভাব উদ্দীপিত করিবার শক্তি ঠাকুরে প্রকাশিত দেখিলেন। আবার ঈশ্বর-বিরহ-বিধুর শ্রীচৈতন্যদেবের গাত্রদাহ উপস্থিত হইলে স্রুক্চন্দনাদি যে-সকল পদার্থের ব্যবহারে উহা প্রশমিত হইত বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে, ঠাকুরের গাত্রদাহ প্রশমনের জন্য ঐ-সকলের প্রয়োগ করিয়া তিনি তদ্রূপ ফল পাইলেন।1 সুতরাং তাঁহার মনে এখন হইতে দৃঢ় ধারণা হইল, শ্রীচৈতন্য ও শ্রীনিত্যানন্দ উভয়ে জীবোদ্ধারের নিমিত্ত ঠাকুরের শরীরমনাশ্রয়ে পুনরায় পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইয়াছেন। সিহড় গ্রামে যাইবার কালে ঠাকুর নিজ দেহাভ্যন্তর হইতে কিশোরবয়স্ক দুই জনকে যেরূপ বাহিরে আবির্ভূত হইতে দেখিয়াছিলেন, তাহা আমরা পাঠককে ইতঃপূর্বে বলিয়াছি।2 ব্রাহ্মণী এখন ঐ দর্শনের কথা ঠাকুরের মুখে শ্রবণপূর্বক শ্রীরামকৃষ্ণদেবসম্বন্ধীয় নিজ মীমাংসায় দৃঢ়তর বিশ্বাসবর্তিনী হইয়া বলিলেন, “এবার নিত্যানন্দের খোলে চৈতন্যের আবির্ভাব!”
উদাসিনী ব্রাহ্মণী সংসারে কাহারও নিকট কিছু প্রত্যাশা করিতেন না, প্রাণ যাহা সত্য বলিয়া বুঝিয়াছে তাহা প্রকাশে লোকের নিন্দা বা উপহাসভাগিনী হইতে হইবে, এ আশঙ্কা রাখিতেন না। সুতরাং শ্রীরামকৃষ্ণদেবসম্বন্ধীয় নিজ মীমাংসা তিনি সকলের সম্মুখে বলিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিতা হয়েন নাই। শুনিয়াছি, এই সময়ে একদিন ঠাকুর পঞ্চবটীতলে মথুরবাবুর সহিত বসিয়াছিলেন। হৃদয়ও তাঁহাদের নিকটে ছিল। কথাপ্রসঙ্গে ঠাকুর, ব্রাহ্মণী তাঁহার সম্বন্ধে যে মীমাংসায় উপনীতা হইয়াছেন, তাহা মথুরামোহনকে বলিতে লাগিলেন। বলিলেন, “সে বলে যে, অবতারদিগের যে-সকল লক্ষণ থাকে, তাহা এই শরীর-মনে আছে। তার অনেক শাস্ত্র দেখা আছে, কাছে অনেক পুঁথিও আছে।” মথুর শুনিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “তিনি যাহাই বলুন না, বাবা, অবতার তো আর দশটির অধিক নাই? সুতরাং তাঁহার কথা সত্য হইবে কেমন করিয়া? তবে আপনার উপর মা কালীর কৃপা হইয়াছে, এ কথা সত্য।”
1.
গুরুভাব
– উত্তরার্ধ, ১ম অধ্যায়।
2. ঐ।
মথুরের সম্মুখে ভৈরবীর ঠাকুরকে অবতার বলা
তাঁহারা ঐরূপে কথোপকথন করিতেছেন, এমন সময়ে এক সন্ন্যাসিনী তাঁহাদের অভিমুখে আগমন করিতেছেন দেখিতে পাইলেন এবং মথুর ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “উনিই কি তিনি?” ঠাকুর স্বীকার করিলেন। তাঁহারা দেখিলেন – ব্রাহ্মণী কোথা হইতে এক থালা মিষ্টান্ন সংগ্রহ করিয়া শ্রীবৃন্দাবনে নন্দরানী যশোদা যেভাবে গোপালকে খাওয়াইতে সপ্রেমে অগ্রসর হইতেন, সেইভাবে তন্ময় হইয়া অন্যমনে তাঁহাদিগের দিকে চলিয়া আসিতেছেন। নিকটে আসিয়া মথুরবাবুকে দেখিতে পাইয়া তিনি যত্নপূর্বক আপনাকে সংযতা করিলেন এবং ঠাকুরকে খাওয়াইবার নিমিত্ত হৃদয়ের হস্তে মিষ্টান্নের থালাটি প্রদান করিলেন। তখন মথুরবাবুকে দেখাইয়া ঠাকুর তাঁহাকে বলিলেন, “ওগো! তুমি আমাকে যাহা বল সেই সব কথা আজ ইঁহাকে বলিতেছিলাম, ইনি বলিলেন, ‘অবতার তো দশটি ছাড়া আর নাই’।” মথুরানাথও ইত্যবসরে সন্ন্যাসিনীকে অভিবাদন করিলেন এবং তিনি সত্যই যে ঐরূপ আপত্তি করিতেছিলেন, তদ্বিষয় অঙ্গীকার করিলেন। ব্রাহ্মণী তাঁহাকে আশীর্বাদ করিয়া উত্তর করিলেন, “কেন? শ্রীমদ্ভাগবতে চব্বিশটি অবতারের কথা বলিবার পরে ভগবান ব্যাস শ্রীহরির অসংখ্য বার অবতীর্ণ হইবার কথা বলিয়াছেন তো? বৈষ্ণবদিগের গ্রন্থেও মহাপ্রভুর পুনরাগমনের কথা স্পষ্ট উল্লিখিত আছে। তদ্ভিন্ন শ্রীচৈতন্যের সহিত (শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে দেখাইয়া) ইঁহার শরীর-মনে প্রকাশিত লক্ষণসকলের বিশেষ সৌসাদৃশ্য মিলাইয়া পাওয়া যায়।” ব্রাহ্মণী ঐরূপে নিজপক্ষ সমর্থন করিয়া বলিলেন, শ্রীমদ্ভাগবত ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবাচার্যদিগের গ্রন্থে সুপণ্ডিত ব্যক্তিদিগকে তাঁহার কথা সত্য বলিয়া স্বীকার করিতেই হইবে। ঐরূপ ব্যক্তির নিকটে তিনি নিজপক্ষ সমর্থন করিতে সম্মতা আছেন। ব্রাহ্মণীর ঐ কথার কোন উত্তর দিতে না পারিয়া মথুরামোহন নীরব রহিলেন।
পণ্ডিত বৈষ্ণবচরণের দক্ষিণেশ্বরে আগমনের কারণ
ঠাকুরের সম্বন্ধে ব্রাহ্মণীর অপূর্ব ধারণা ক্রমে কালীবাটীর সকলেই জানিতে পারিল এবং উহা লইয়া একটা বিষম আন্দোলন উপস্থিত হইল। উহার ফলাফল আমরা অন্যত্র বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করিয়াছি।1 ভৈরবী ব্রাহ্মণী ঐরূপে ঠাকুরকে সকলের সমক্ষে সহসা দেবতার সম্মান প্রদান করিলেও তাঁহার মনে কিছুমাত্র বিকার উপস্থিত হয় নাই। কিন্তু উক্ত সিদ্ধান্ত স্মরণ করিয়া শাস্ত্রজ্ঞ পুরুষসকলে কিরূপ মতামত প্রদান করেন, তাহা জানিতে উৎসুক হইয়া তিনি বালকের ন্যায় মথুরামোহনকে ঐ বিষয়ের বন্দোবস্ত করিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। ঐ অনুরোধের ফলেই বৈষ্ণবচরণপ্রমুখ পণ্ডিতসকলের দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে আগমন হইয়াছিল। তাঁহাদিগের নিকটে ব্রাহ্মণী কিরূপে নিজপক্ষ সমর্থন করিয়াছিলেন, তাহা অন্যত্র বলিয়াছি।2
1.
গুরুভাব
– পূর্বার্ধ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ অধ্যায় এবং উত্তরার্ধ, ১ম অধ্যায়।
2. গুরুভাব – উত্তরার্ধ, ১ম অধ্যায়।