তখনও ভালো করে ভোর হয়নি, হঠাৎ বহু মানুষের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল বিনয়, আর শেখরনাথের। বন্ধ দরজার বাইরে থেকে জোরে জোরে ধাক্কাও দিচ্ছে কেউ কেউ।
তারই মধ্যে পরিতোষের গলা শোনা গেল, কাকা, কাকা, তরাতরি দুয়ার খোলেন।
বিনয় এবং শেখরনাথ বিছানা থেকে নেমে পড়েছিলেন। বিনয় লম্বা পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। শেখরনাথও তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বাইরে সারি সারি উদ্বিগ্ন মুখ। পরিতোষ এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে বেশ কিছু উদ্বাস্তুও রয়েছে। তারা সবাই বয়ষ্ক পুরুষ এবং মেয়েমানুষ। তাদের মধ্যে খুলনা জেলার সৃষ্টিধর বারুইকেও দেখা গেল। তার উৎকণ্ঠাই সবচেয়ে বেশি। ভেতরকার চাপা ত্রাসে ঘন ঘন ঢোক গিলছে।
বিনয়রা রীতিমতো অবাক তো হয়েছেই। এই ভোরবেলায় এতগুলো লোক আচমকা চলে এসেছে। তাদের মুখচোখের চেহারা দেখে দুজনের দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।
শেখরনাথ ব্যগ্র স্বরে জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার, কী হয়েছে?
একটি মাঝবয়সি সধবা মেয়েমানুষ, কপালের আধাআধি অবধি ঘোমটা টানা- শেখরনাথকে বলল, ছিষ্টিধরের বউয়ের ব্যথা উঠছে। যন্তরনায় কাতরাইতে আছে। একজন ডাক্তর কি দাই না পাইলে মহা বিপদ অইয়া যাইব। আপনে এট্টা কিছু ব্যাবোস্তা করেন।
সেই পূর্ণগর্ভা বউটির কথা মনে পড়ে গেল বিনয়ের। সেদিন সৃষ্টিধরের সঙ্গে কত কষ্ট করেই না তাদের জমির আগাছা সাফ করছিল। মনে আছে, শেখরনাথ এই সেটেলমেন্টে একজন ডাক্তার পাঠানোর জন্য বিশ্বজিৎকে খবর পাঠিয়েছিলেন। সেই ডাক্তার এখনও এসে পৌঁছায়নি। সরকারি ব্যাপার, অনেকরকম নিয়মকানুন আছে। মুখের কথা খসালেই ব্যবস্থা করা যায় না। এদিকে সৃষ্টিধরের বউটি প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। এই মুহূর্তে কীভাবে নির্বিঘ্নে তার সন্তানটির জন্ম হবে ভেবে পেল না বিনয়। হতবুদ্ধির মতো সে তাকিয়ে রইল।
ওধারে শেখরনাথ চকিতে কিছু ভেবে নিলেন। তারপর পুবদিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, ওই দিকের তিনটে পাহাড়ের ওধারে যে নতুন রিফিউজি সেটেলমেন্ট বসেছে, শুনেছি সেখানে। একজন দাই আছে। চাল ডাল আর অন্য সব মালপত্র নিয়ে সেই যে ট্রাকটা এসেছিল সেটা কি ফিরে গেছে?
পরিতোষ বলল, না কাকা
তাকে রেডি হতে বল, আমাকে নিয়ে ওই সেটেলমেন্টে যাবে। আমি মুখটুখু ধুয়ে বাসি কাপড়চোপড় পালটে নিই।
পরিতোষ নিজেই দৌড়ে চলে গেল।
বিনয় আগেই ওধারের উদ্বাস্তু কলোনি আর ব্রিটিশ আমলের পেনাল সেটেলমেন্টের খবর পেয়েছে। সেখানে যাবার এই সুযোগটা ছাড়তে চাইল না। আগ্রহের সুরে বলল, কাকা, আপনার। সঙ্গে যেতে চাই।
শেখরনাথ একটু হাসলেন।-বুঝেছি। জার্নালিস্ট তো। ওই দিকের সেটেলমেন্ট টেটেলমেন্ট দেখে কাগজে লিখতে চাও। কিন্তু এবার তো তোমার পক্ষে ওখানে থাকা যাবে না। আমি গিয়েই দাইকে নিয়ে ফিরে আসব। খানিক ভেবে বললেন, এত যখন ইচ্ছে, চল। ওখানকার মাতবরদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। পরে গিয়ে বেশ কিছুদিন থেকে ভালো করে ইনফরমেশন। জোগাড় করে লিখো। নাও, এখন চটপট তৈরি হয়ে নাও। পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা মেয়েরা যে ব্যারাকে থাকে তার একধারে বাঁশের বেড়াটেড়া দিয়ে আঁতুড়ঘর করে রাখ। আমরা দুপুরের মধ্যে ফিরে আসব। প্রার্থনা কর, তার ভেতর বাচ্চা যেন না হয়ে যায়।
.
এমনই উৎকণ্ঠা যে বিনয়দের চাটা খাওয়া হল না। ট্রাকে ড্রাইভারের পাশে বসে বেরিয়ে পড়লেন।
পাহাড়ের পর পাহাড়। সেগুলোর কোমর বুক পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কালো মসৃণ পিচের রাস্তা। এই রাস্তা বিনয়ের চেনা। কদিন আগেই এই পথে ব্যাম্বু ফ্ল্যাট থেকে বিশ্বজিৎদের সঙ্গে সে জেফ্রি পয়েন্টে এসেছিল। ট্রাক কখনও চড়াইতে উঠছে, কখনও উতরাইতে নামছে। রাস্তার একধারে গভীর জঙ্গলে ভরা পাহাড়, অন্য দিকে খাদ। খাদের ওধারে আবার পাহাড়।
ঘণ্টাখানেক চলার পর রাস্তাটা দুভাগ হয়ে একটা চলে গেছে সোজা, অন্যটা ডান দিকে। ট্রাকটা ডান পাশের রাস্তাটা ধরল। এদিকটা বিনয়ের পুরোপুরি অচেনা।
খানিকটা যাবার পর দুই পাহাড়ের মাঝখানে অনেকখানি জায়গা মোটামুটি সমতল। তার একধারে টিন কি টালির চাল-দেওয়া কাঠের একতলা কি দোঁতলা। সব মিলিয়ে প্রায় ষাট-সত্তরটা। এই ধরনের বাড়ি বর্মায় দেখা যায়। বিনয় ছবিতে দেখেছে।
বাড়িগুলো পুরানো, কম করে তিরিশ চল্লিশ বছর আগের তৈরি।
শেখরনাথ বললেন, এটা হল পেনাল কলোনি। ব্রিটিশ আমলে গড়ে উঠেছিল। নাম কী জানো?
বিনয় ঘাড় নাড়ল।–না।
ওয়ান্ডুর। বর্মায় ওই নামে একটা ছোট শহর আছে। আন্দামানের কলোনিতে এইরকম নাম দেওয়া হল কেন, ভেবে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছ।
তা হচ্ছি।
নাইনটিন থার্টি ফাইভের আগে বর্মা ছিল ইন্ডিয়ার একটা অংশ বা প্রভিন্স। সেখান থেকে মার্কামারা ডাকাত, খুনিরা আন্দামানে জেল খাটতে আসত। এদের মধ্যে পুরুষও ছিল, মেয়েও ছিল। তারা আর দেশে ফিরে যায়নি। বিয়েটিয়ে করে এখানেই কলোনি বসিয়েছে। কিন্তু জন্মভূমির কথা ভুলতে পারেনি। তাই নিজেদের কলোনির নাম রেখেছে বর্মার কোনও গ্রাম কি শহরের নামে। সাউথ আন্দামানে এরকম আরও সাত-আটটা কলোনি রয়েছে– মেমিও, মৌলমিন, পোগো এমনি নানা নাম। অবশ্য এই ওয়ান্ডুর বর্মিতে বর্মিতেই শুধু বিয়ে হয়নি। অনেক বর্মি মেয়ে ইন্ডিয়ার অন্য প্রভিন্সের লোকজন, যেমন বাঙালি, শিখ, তামিল, মোপলাদের বিয়ে করেছে। বেশকিছু বর্মি পুরুষও তা-ই। তাদের স্ত্রীরা কেউ পাঠান, কেউ মারাঠি, কেউ বিহারি।
যেন আশ্চর্য এক রূপকথা শুনছিল বিনয়। অপার কৌতূহলে জিগ্যেস করে, এদের বিয়ে কী করে হত?
আমি আর কতটুকু বলতে পারব? পরে এসে যখন তুমি কিছুদিন পেনাল কলোনিতে থাকবে, সেই সময় ব্রিটিশ আমলের যে কয়েদিরা বিয়ে করেছে তাদের মুখে ডিটেলে শুনতে পাবে।
বিনয় আর প্রশ্ন করল না। উইন্ড স্ক্রিনের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকাল। পেনাল কলোনি থেকে বেশ খানিকটা দূরে সারি সারি অগুনতি টিন এবং টালির চালের ঘর চোখে পড়ল। অনেকটা পুববাংলার ঘরবাড়ির মতো। সেগুলোর গা ঘেঁষে মাইলখানেক, কি তারও বেশি জায়গা জুড়ে হাল-লাঙল চলছে। বোঝা যায় একসময় ওখানে ঘোর জঙ্গল ছিল; সেসব সাফ করে জমি বার করা হয়েছে। তার ডান পাশে সমুদ্র।
ঘরগুলোর দিকে আঙুল বাড়িয়ে বিনয় জিজ্ঞেস করল, মনে হচ্ছে, ওখানে নতুন একটা সেটেলমেন্ট হয়েছে।
হা ওটা রিফিউজি সেটেলমেন্ট। জেফ্রি পয়েন্টের সেটেলমেন্টের মাস ছয়েক আগে ওটা বসানো হয়েছে। দেখ এর মধ্যে চাষবাসও শুরু হয়ে গেছে। যে দাইয়ের জন্যে এসেছি, সে ওখানে থাকে।
কিন্তু উদ্বাস্তু সেটেলমেন্টে যাওয়া হল না। ট্রাক যখন ওয়ারের কাছাকাছি এসে পড়েছে হঠাৎ পাশের একটা কাঠের বাড়ি থেকে লুঙ্গি কুর্তা পরা একটা মাঝারি হাইটের লোক পেটানো মজবুত চেহারা, তামাটে রং, চুলের বেশির ভাগটাই ধবধবে, বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি হইহই করতে করতে রাস্তার মাঝখানে এসে দুদিকে দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।–রুখখা, রুখো। রুখ যাও
অগত্যা ট্রাকটাকে থামতে হল। রাস্তার লোকটা আরও কাছে এসে হিন্দি-উর্দু মেশানো হিন্দুস্থানিতে শেখরনাথকে বলল, চাচাজি আপ!
বিনয় আগেই জেনেছে শেখরনাথ আন্দামানের সার্বজনীন কাকা বা চাচা। তিনি বললেন, একটা জরুরি কাজে এখানকার রিফিউজি সেটেলমেন্টে যেতে হচ্ছে। তোরা কেমন আছিস, রঘুবীর সিং? মা ফুন ভালো আছে?
লোকটি অর্থাৎ রসুবীর তড়বড় করে বলে, আপনার মেহেরবানিতে ঠিক আছি। কিয়া খুশনসিব ম্যায় নে। কত রোজ বাদে আপনাকে দেখতে পেলাম। আইয়ে আইয়ে– উতারকে আইয়ে–
না রঘুবীর, আজ সময় হবে না। রিফিউজি সেটেলমেন্ট থেকে একজনকে নিয়ে আমাকে দুপুরের মধ্যে জেফ্রি পয়েন্টে ফিরে যেতে হবে। তুই রাস্তা থেকে সর। গাড়ি যেতে পারছে না।
রঘুবীর সরল তো না-ই, সামনের বাড়িটার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে হাঁক পাড়তে লাগল, মা ফুন, এ মা ফুন। জলদি নিকালকে আ
প্রায় দৌড়েই একটি বর্মি মেয়েমানুষ বেরিয়ে এল। তারও যথেষ্ট বয়স হয়েছে, ষাটের কাছাকাছি তো বটেই। চুল কাঁচাপাকা। মঙ্গোলিয়ানদের মতো চেরা চোখ। এই বয়সেও শরীরের বাঁধুনি অটুট। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকালে আঁতকে উঠতে হয়। লম্বা লম্বা কালো দাগ। এলোপাতাড়ি ছুরি চালাবার পর ক্ষত শুকোলে যেমন দেখায় সেইরকম। দেখলে চমকে উঠতে হয়। তার পরনে লুঙ্গি এবং কুর্তা। বর্মি মেয়েদের পোশাক।
রঘুবীর তাকে বলল, এই দ্যাখ, চাচাজি এখানে না নেমে সিধা রিফিউজিদের কলোনিতে চলে যাচ্ছে।
মা ফুন হুলুস্থুল বাধিয়ে দিল।-কভি নেহি, কভি নেহি। এতকাল পর এসেছেন। আমাদের কোঠিতে না গেলে রাস্তা ছাড়ব না।
শেখরনাথ বোঝান, দ্রুত জেফ্রি পয়েন্টে না ফিরলে একজনের মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।
রঘুবীররা এবার একটু থমকে যায়। মা ফুন জিগ্যেস করে, কী হয়েছে?
এখানে আসার উদ্দেশ্যটা জানিয়ে দেন শেখরনাথ।
রঘুবীর বলে, ঠিক হ্যায়। রিফিউজি কলোনির ওই দাইকে আমরা চিনি। বাচ্চা পয়দা করায়। নাম মনসা। আপনারা আমাদের কোঠিতে বসুন। চায়-পানি খান। আপনার নাম করে তোক পাঠিয়ে তাকে ডাকিয়ে আনছি। উতারিয়ে উতারিয়ে
মা ফুনও তার সঙ্গে সুর মেলাল। শেখরনাথকে কিছুতেই ছাড়া হবে না। এতদিন বাদে এই এলাকায় এসে তিনি বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাবেন, তা-ই কখনও হয় নাকি? ট্রাকের সামনে তারা দাঁড়িয়ে থাকবে। শেখরনাথদের যেতে হলে তাদের চাপা দিয়ে যেতে হবে।
শেখরনাথ বিপন্ন মুখে একবার বিয়ের দিকে তাকালেন। তারপর হেসে ফেললেন। এদের হাত থেকে নিস্তার নেই। চল, নেমে পড়া যাক। অবশ্য যে জন্যে এখানে আসা, সেটা হয়ে যাবে। মনসা দাই এলেই তাকে নিয়ে জেফ্রি পয়েন্টে ফিরে যাব।
বিনয় কিছু বলল না। শেখরনাথকে আন্দামানের মানুষজন কতটা ভালোবাসে, কতখানি শ্রদ্ধা করে, তা আরও একবার নিজের চোখেই দেখতে পেল।
রঘুবীররা শেখরনাথ আর বিনয়কে তাদের বাড়ির ভেতর একটা সাজানো গোছানো ঘরে এনে বসাল। সব আসবাব কাঠের আর বেতের। আলমারি, তক্তপোশ, গদিওলা মোড়া, চেয়ার কী নেই নেই! এক দেওয়ালে রেঙ্গুনের সোয়েডামিন প্যাগোডার ফ্রেমে বাঁধানো বিরাট ফটো অন্যদিকে তেমনি ফ্রেমে বাঁধানো শিউশঙ্করজির ছবি। বিনয় আন্দাজ করে নিল ফুন বৌদ্ধ এবং রঘুবীর হিন্দু।
মা ফুন অনর্গল, পরিষ্কার হিন্দুস্থানিতে শেখরনাথকে বলতে লাগল, আপনাকে দেখে কী খুশি যে হয়েছি! এখানে আরাম করে বসুন। চায়-পানি করে আনি।
এদিকে শেখরনাথের নাম করে মনসাকে ধরে আনার জন্য পেনাল কলোনির একটি বর্মি ছেলেকে রিফিউজি সেটেলমেন্টে পাঠিয়ে রঘুবীর বিনয়রা যে ঘরে বসে ছিল সেখানে ফিরে এল। কিন্তু চেয়ার বা মোড়ায় বসল না, নিচে কাঠের মেঝেতে থেবড়ে বসে পড়ল।
শেখরনাথ বললেন, এটা কী হচ্ছে, উঠে একটা মোড়ায় বোস।
জিভ কেটে রঘুবীর যা বলল তা এইরকম। শেখরনাথের মতো একজন সম্মানিত মানুষ, যিনি, দেশের আজাদির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন, তাঁর সামনে উঁচু জায়গায় তার পক্ষে বসা সম্ভব নয়। তার উপযুক্ত জায়গা শেখরনাথের পায়ের তলায়।
শেখরনাথ হাসলেন। এদের নিয়ে পারা যায় না।
রঘুবীর জিগ্যেস করল, আপনার তবিয়ত আচ্ছা হ্যায় তো?
হ্যাঁ। তোরা কেমন আছিস?
আপনার মেহেরবানিতে ঠিক হ্যায়।কথা বলতে বলতে গভীর আগ্রহে রঘুবীর বারবার বিয়ের দিকে তাকাচ্ছিল।
শেখরনাথ বললেন, তোর ছেলেকে তো মাদ্রাজে পাঠিয়েছিলি। সেখানে ঠিকমতো পড়াশোনা করছে?
হ্যাঁ। রঘুবীর প্রাণ খুলে হাসল। ছেলেটা তার মাবাপের মতো বজ্জাত হয়নি। বিলকুল জেন্টলম্যান। পড়াশোনা ছাড়া আউর কুছু বোঝে না। জজ-ম্যাজিস্টর হবে।তারপরেই বিনয়কে দেখিয়ে জিগ্যেস করল, এই বাবুজিকে তো চিনতে পারলাম না চাচাজি।
শেখরনাথ বললেন, ওই দ্যাখ, তোদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে। দিতে ভুল হয়ে গেছে। ওর নাম বিনয় বসু। কলকাতার এক আখবরের পত্রকার? বিনয়কেও রঘুবীরদের সম্বন্ধে জানাল, ওরা একসময় কয়েদি হয়ে আন্দামানে এসেছিল। রঘুবীর ইন্ডিয়ার সেন্ট্রাল প্রভিন্স থেকে, আর মাফুন এসেছিল বর্মার ওয়ান্ডুর থেকে। তারপর ওদের বিয়ে হয়। একটাই ছেলে। মাদ্রাজে হোস্টেলে থেকে বি.এসসি পড়ছে। খুব ভালো ছাত্র।
বিনয় জানত কালাপানি পাড়ি দিয়ে জাহাজ বোঝাই করে শুধু পুরুষ কয়েদিদেরই সেলুলার জেলে নিয়ে আসা হত। মেয়ে কয়েদিদেরও যে একসময় এই দ্বীপে আনা হয়েছে, এটা তার জানা ছিল না। বর্মি মা ফুনের সঙ্গে কী করে সেন্ট্রাল প্রভিন্সের রঘুবীরের বিয়ে হল, তা নিয়ে ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল কিন্তু সেটা প্রকাশ করা অভদ্রতা। সে চুপ করে থাকে।
এদিকে শেখরনাথের সঙ্গে একজন পত্রকার তাদের কোঠিতে এসেছে সেজন্য রঘুবীর খুবই উত্তেজিত। ভেতরের একটা দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, মা ফুন, চাচাজির সঙ্গে একজন আখবরের লোক এসেছে। জলদি ইধর
মা ফুনের গলা ভেসে এল। পন্দ্র মিনট পর যাচ্ছি। চায় হয়ে এসেছে।
রঘুবীর এবার বিনয়ের দিকে তাকায়।জানেন বাবুজি, আমরা গন্ধী আদমি। হত্যারা। রাগের মাথায় তিনটে খুন করে কালাপানি, এসেছিলাম। আমার বিবি হামসে কমতি নেহি। মা ফুন দোঠো খুন করে এসেছে। আমি যখন সেলুলার জেলে আসি তখন এই চাচাজি আজাদির জন্যে আংরেজদের সঙ্গে লড়াই করে কয়েদ খাটছেন। জেলখানার ছোট এক সেলে চাচাজিকে আটকে বাইরে। থেকে তালা দিয়ে রাখা হত। নাহানার (চান) জন্যে একবার আর খাওয়ার জন্যে দুবার বাইরে আনা হত। সেই সময় চাচাজির সঙ্গে আমার জানপয়চান। দেওতা য্যায়সা আদমি (দেবতার মতো মানুষ)।
হাত তুলে রঘুবীরকে থামিয়ে দিলেন শেখরনাথ।আমার কথা অত বলতে হবে না।
এর মধ্যে শেখরনাথের আসার খবরটা পেনাল কলোনিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখানকার বাসিন্দারা একে একে এসে তার সঙ্গে দেখা করে যেতে লাগল। এদের বেশিরভাগই বর্মি। দু-চারজন ভারতের নানা প্রভিন্সের লোক। সেলুলার জেলে। শেখরনাথের সঙ্গে একসময় এরাও কয়েদ খেটেছে। রঘুবীরের। মতোই শেখরনাথের ওপর এদের অফুরান শ্রদ্ধা।
একজন সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামী ভারত এবং বর্মার কত মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন, নিজের চোখে না দেখলে ভাবতে পারত না বিনয়। সে ভেতরে ভেতরে অভিভূত হয়ে যাচ্ছিল।
শেখরনাথ সবাইকে নামে নামে চেনেন। তাদের ছেলেমেয়ে স্ত্রীর খবর রাখেন। যেই আসছে, কে কেমন আছে, কারও কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিচ্ছেন।
এর মধ্যে মা ফুন ভেতর দিক থেকে চলে এল। শুধু চাই না পরোটা এবং সবজিও বানিয়ে এনেছে। চিনামাটির কটা কাপ-প্লেট একটা নিচু টেবলের ওপর রেখে, একটা প্লেট এবং চায়ের কাপ ট্রাকের ড্রাইভারকে দিয়ে ফিরে এসে সে-ও মেঝেতে রঘুবীরের পাশাপাশি বসে পড়ে।
শেখরনাথ বললেন, এত সব করতে গেলি কেন? শুধু চা হলেই তো হত।
মা ফুন হাসল, স্রিফ চা দিলে কী চলে! কত মাহিনা বাদ আপনি এলেন বলুন তো?
শেখরনাথ হেসে বিনয়ের দিকে তাকালেন।-না, এরা কোনও কথা শুনবে। নাও, খেতে শুরু কর। তারপর মা ফুনের সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ সেই কথাটা মনে পড়ে গেল।
শেখরনাথ এবার বললেন, শোন, বিনয় তোদের এই পেনাল কলোনি নিয়ে তাদের আখবরে কিছু লিখতে চায়। তোদের কাছে যদি কিছুদিন এসে থাকে, অসুবিধে হবে না তো?
কীসের অসুবিধে। মা ফুন এবং রঘুবীর হইচই বাধিয়ে দিল, বাবুজি এলে আমরা মাথায় করে রাখব।
আসলে কলোনিতে যারা থাকে, তাদের সবার সঙ্গে বিনয় কথা বলবে। তারা কবে কোন অপরাধে ইন্ডিয়া আর বর্মা থেকে কালাপানিতে সাজা খাটতে এসেছিল, সেলুলার জেলে কীভাবে, কত নির্যাতন সহ্য করে তাদের দিন কেটেছে, মুক্তি পাওয়ার পর কীভাবে এখানে কলোনি বানিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাচ্ছে সব সে জানতে চায়। তারপর ওদের আখবরে সেই লেখা ছাপবে।
রঘুবীর এবং মা ফুন, দুজনেই প্রচণ্ড উত্তেজিত। রঘুবীর জিগ্যেস করল, বাবুজি কবে আসবে?
কিছুদিন পর। আমিই ওকে দিয়ে যাব।
ওঁদের কথাবার্তার মধ্যেই দূর থেকে চেঁচামেচি ভেসে এল। অনেকে একসঙ্গে কথা বললে যেমন শোনায় অনেকটা সেইরকম।
বাইরের দিকের খোলা দরজা দিয়ে দেখা গেল পঞ্চাশ-ষাটজনের একটা দঙ্গল রিফিউজি সেটেলমেন্টের দিক থেকে প্রায় ছুটতে ছুটতেই এগিয়ে আসছে। পাঁচ সাত মিনিটের ভেতর রঘুবীরদের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল। তাদের মধ্যে রয়েছে মাঝবয়সি, ভদ্র চেহারার একটি লোক, মাঝবয়সি, মাঝারি হাইটের মজবুত একটি মেয়েমানুষ। তার হাতে চটের একটা ব্যাগ জিনিসপত্রে বোঝাই। এছাড়া নানা বয়সের ক্ষয়টে চেহারার মানুষজন। দেখামাত্রই টের পাওয়া যায়– উদ্বাস্তু। ছিন্নমূল সর্বস্ব খোয়ানো মানুষগুলোর চোখেমুখে ক্লেশের, উৎকণ্ঠার একটা ছাপ থাকে। সেটাই তাদের নির্ভুল চিনিয়ে দেয়। যে বর্মি যুবকটি দাইয়ের খোঁজে গিয়েছিল, ভিড়ের মধ্যে তাকেও দেখা গেল।
দ্রুত খাওয়া চুকিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন শেখরনাথ। তার পেছন পেছন বিনয়, মা ফুন এবং রঘুবীর।
জনতার ভেতর থেকে সেই মাঝবয়সি লোকটি ক্ষোভের সুরে। বলল, কাকা, এত দূর তরি (পর্যন্ত) আইলেন, কিন্তু আমাগো সেটেলমেন্টে গ্যালেন না? মনসারে ডাকতে লোক পাঠাইলেন। মনে বড় দুঃখু পাইলাম।
এগিয়ে এসে লোকটির কাঁধে হাত রেখে কাঁচুমাচু মুখে বললেন, রাগ করো না বিনোদ। মা ফুনরা কিছুতেই ছাড়ল না। শিগগিরই আবার আসছি। তখন আগে তোমাদের ওখানে যাব।
আইজ একবার পায়ের ধুলা দিবেন না?
উপায় নেই। একটি মেয়ের প্রসব বেদনা উঠেছে। জেফ্রি পয়েন্টে ডাক্তারটাক্তার নেই। তাই দাই নিতে এসেছি। দাই কি এসেছে?
এখানকার রিফিউজি সেটেলমেন্টের সবাই শেখরনাথের মুখচেনা; তবে অনেকের নাম জানেন না।
বিনোদ নামের লোকটি বলল, এসেছে। এই তো সেই মধ্যবয়সিনিকে দেখিয়ে দিল সে।এরই নাম মনসা। আপনি খবর পাঠাইছেন। মনসা এক্কেরে (একেবারে) তৈয়ার অইয়া আইছে।
শেখরনাথ মনসাকে জিগ্যেস করলেন, তোমার কে কে আছে?
মনসা জানায় সে অল্প বয়সেই বিধবা হয়েছে। ছোট ভাই ৮ গোপাল আর তার বউ কমলার কাছে থাকে। তাদের সঙ্গেই আন্দামানে এসেছে। যুবতী বয়স থেকে দাইগিরি করছে।
শেখরনাথ বললেন, আমাদের সঙ্গে গেলে তোমার ভাই আপত্তি করবে না তো?
একটি বছর চল্লিশের ভালোমানুষ ধরনের লোক বলে উঠল, আমি গুপাল। আপনে দিদিরে লইয়া যাইবেন আমি আপত্ত করুম! আমার ঘেটিতে (ঘাড়ে) কয়ডা মাথা?
শেখরনাথ বিনোদের সঙ্গে বিনয়ের আলাপ করিয়ে দিল। বিনোদ বি.এ পাশ। ঢাকায় থাকত। ইচ্ছা করলে পার্টিশনের পর ইন্ডিয়ায় এসে চাকরিবাকরি জুটিয়ে নিতে পারত। নেয়নি। ওর খুব দুঃখের জীবন; বড় আঘাত পেয়েছে। কলকাতায় ভালো লাগছিল না। অন্য উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আন্দামানে চলে এসেছে।
পরিচয় করানো হলে শেখরনাথ বিনোদকে বললেন, কিছুদিন পর যখন আসব, বিনয়কেও সঙ্গে আনব। ওরঘুবীরদের বাড়িতে থাকবে, তোমাদের ওখানেও যাবে। খবরের কাগজে তোমাদের সেটেলমেন্টের কথা লিখবে। বিনয়কে একটু সাহায্য করো।
বিনয় সাংবাদিক শুনে রঘুবীরদের মতো বিনোদও রীতিমতো উত্তেজিত। বলল, নিচ্চয় করুম। উনি আমাগো লইয়া লেখবেন এয়াতো (এ তো) ভাইগ্যের কথা।
শেখরনাথ আর দেরি করলেন না। আজ আমরা চলি বলে বিনয় এবং মনসাকে নিয়ে ট্রাকে উঠলেন।
ড্রাইভার স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।
বেলা যখন সামান্য হেলতে শুরু করেছে সেই সময় জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছে গেলেন শেখরনাথরা।