১০
প্রসব-গৃহ থেকে হরিদ্রা-স্নান করে বেরোবার পর মিগারমাতা বিশাখা চলেছে জেতবনে। গৃহে অঙ্কধাত্রী, স্তন্যধাত্রী, মণ্ডনধাত্রী রাখা হয়েছে যথাযথভাবে পরীক্ষা করে। বুদ্ধ-প্রণাম করে আসার অবসর অনেক দিন পরে পাওয়া গেছে। বিশাখার পরনে নববস্ত্র। হলুদে-ছোপানো উত্তরীয় দিয়ে সে আজ মাথা ঢেকে নিয়েছে। প্রসাধনের স্নিগ্ধ সৌরভ তাকে ঘিরে। সঙ্গে বহু দান নিয়ে চলেছে দাস-দাসীরা। ধনপালী ঠিক তার পাশটিতে। তার মুখ বিষণ্ণ। বিশাখার শান্ত, গৌরবমণ্ডিত জননী- শ্রীর পাশে ধনপালীর শুষ্ক, করুণ, আর্ত মুখটি যেন কেমন অসঙ্গত মনে হয়।
শান্ত জেতবনসন্ধ্যা। বসন্তকাল আসতে বিলম্ব নেই। বিহার তাই প্রায় শূন্য। কিন্তু তথাগত আছেন। আর আছেন মাতা মহাপ্রজাবতী। আছেন ভিক্ষু আনন্দ। বহু সাবত্থিবাসী ভগবান তথাগতর এই দুর্লভ অধিষ্ঠানের সুযোগ নিতে দেশনা- স্থলে এসে অপেক্ষা করছেন।
ভিক্ষু আনন্দর প্রতি আদেশ হল দানগুলি গ্রহণ করবার— কার্পাসিক চীবর, কাংস্যের ভিক্ষাপাত্র, ভৈষজ রাখবার মণিময় পাত্র সব, ভোজ্য—যব, গম, মুদগ, তণ্ডুল, বহুপ্রকার ফল, মিষ্টান্ন, পায়স। বিশাখা ভিক্ষু আনন্দর হাতে জল ঢেলে দিল। তিনি দান গ্রহণ করলেন। দেশনা-স্থলে গিয়ে বসল বিশাখা। অল্পক্ষণ দেশনা হল আজ। মহারাজ প্রসেনজিৎ আবারও দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। একই স্বপ্ন। বিকট স্বরে কে বা কারা আর্তনাদ করছে। রাজার পুরোহিতেরা বলেছেন—এরা নরকবাসী। এদের শান্ত করার জন্য যজ্ঞ প্রয়োজন। তথাগত মৃদু হেসে তাঁকে রাত্রে গুরুভোজন করতে নিষেধ করলেন। অতিভোজনেই স্বাস্থ্য মন্দ হয়, অল্পভোজনে নয় মহারাজ। আপনি রাজভোগ ভোজন করছেন, কিন্তু সেই পরিমাণে ব্যায়াম করছেন কী? আপনার মধ্যদেশ তো রীতিমতো স্ফীত হয়ে উঠেছে! কাঁধে মাংস জমেছে। আপনি বীরপুরুষ, বীরের মতো আকৃতি ও অভ্যাস রাখতে সচেষ্ট হবেন, তবেই দুঃস্বপ্নগুলি দূর হয়ে যাবে।
—কোনও পূজা, ব্রত, দান এ সকলের প্রয়োজন নেই বলছেন?
—কিছুরই প্রয়োজন নেই মহারাজ। গুরুভোজনের পর শয্যায় যান। শরীর গরম হয়ে থাকে। খাদ্যগুলি আত্তীকৃত হয় না। তাতেই দুঃস্বপ্ন সৃষ্টি হয়।
এবার বিশাখার দিকে চাইলেন তথাগত।
—আজ শুনলাম বিসাখা সংঘকে বহু দান করেছে? কেন কল্যাণি?
—আমার দুই নবজাত পুত্র ও সাকেতে আমার জননী ও তাঁর নবজাতিকার শুভকামনায়।
কিছুক্ষণ আশীর্বাদের ভঙ্গিতে স্থির রইলেন তথাগত। তারপর বললেন— বিসাখা, তথাগত জন্মের সাত দিন পরেই মাতৃহীন হয়েছিলেন, জানো?
—জানি ভন্তে। কিন্তু তিনি মহাপ্রজাবতীকে মাতৃরূপে পেয়েছিলেন।
—মহাপ্রজাবতী তাঁর পুত্র নন্দকে লাভ করার পরও সমান মমতায় ও যত্নে তথাগতকে লালন করেন। জননীর চেয়ে মহীয়সী আর কে বিসাখা? জন্মদাত্রী জননীর চেয়েও মহীয়সী একমাত্র তিনিই, যিনি অনাথ-অনাথাকেও মাতৃস্নেহে লালন করেন। বিসাখার অনুকম্পা সকল অনাথ-অনাথার প্রতি ধাবিত হোক।
বিশাখা মাথা নত করে তথাগতর আশীর্বাদ গ্রহণ করল।
তথাগত বললেন— জনক-জননীর চেয়ে শ্রদ্ধেয়, আদরণীয়, প্রিয় এ জগতে আর কেউই নেই। কিন্তু পার্থিব নিয়মে জনক-জননী লোকান্তরে যান। তখন সেই শূন্যস্থানে যা থাকে তা সেই কল্যাণময়ী জননীর ভাববলয়। সেই ভাব হৃদয়ে গ্রহণ করতে পারলেই জননীকে অনাদ্যন্ত কালের জন্য নিকটে পাওয়া যায়। লোকান্তরিতার স্থানে উত্থান হয় নতুন জননীর। হে সাবকগণ, তোমরা জানবে সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে স্বার্থহীন, সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় স্নেহ জননীর। হৃদয়ে সেই স্নেহের সমুত্থান ঘটাও, সেই স্নেহ অনুভব কর সর্ব জীবের প্রতি, আশ্রয় দাও অনাথদের। জীবগণকে আশ্বাস দাও। মাতৃস্নেহরসের সুধাধারায় অভিষিঞ্চিত কর সমস্ত মানবের মনোভূমি। সব্বে জীবা সুখিত্তা হোন্তু। সোতাপত্তি ফল লাভ যদি করে থাকো হে সাবক-সাবিকাগণ, তা হলে নিশ্চয় জানো— মৃত্যু, বিচ্ছেদ, বিরহই জীবজগতের নিয়ম। এই জীবচক্রকে অনুভব করলেই অশোক হবে সবাই, নিব্বাণপদের দিকে অগ্রসর হবে। নিব্বাণই পরম সুখ, পরম শান্তি, পরম পদ। বীতশোক হও, পরমপদ লাভ করো।
ধনপালী দেখল তথাগত দেশনাস্থল ত্যাগ করছেন এবং বিসাখা মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছে। মহাপ্রজাবতী পাশেই বসেছিলেন, তিনি তাঁর কোলে বিশাখার মাথাটি তুলে নিলেন। ধনপালী উশীর জল একটু একটু করে ছিটোচ্ছে বিশাখার মাথায়, মুখে। একটু পরে সে চোখ মেলল। থেরী মহাপ্রজাবতীর স্থির দৃষ্টি তার মুখের ওপর। তিনি ধীরে ধীরে বললেন— বিশাখা, কন্যা, গৃহে যাও এবার। তোমার পুত্ররা অপেক্ষা করে আছে।
দাস-দাসীরা মিলে ধরে ধরে তাকে শিবিকায় নিয়ে গিয়ে তুলল। বিশাখা অনেক কষ্টে ধনপালীকে বলল—পালি, অচিরবতীর তীরে চল, আমি সাকেত যাবো।
—কিন্তু প্রভু, প্রভুপত্নীকে সংবাদ দেওয়া নেই যে…
—সংবাদ দিয়ে দে
—শিশুদের কী হবে?
—ধাত্রী আছে পালি, ময়ূরীও রয়েছে, পালি আমার দুধ শুকিয়ে গেছে। দ্যাখ!
—কিছুক্ষণ পূর্বেও দুগ্ধধারায় ভিজে যাচ্ছিল বিশাখার স্তনপট্ট। ধনপালী দেখল, এখন সব শুষ্ক। কৃষ্ণাভ রক্তবর্ণের স্তনবৃন্ত দুটি যেন মুখ লুকিয়ে ফেলেছে। ক্ষীরহীন ক্ষীরভাণ্ড।
অচিরবতী পার হয়ে, সরযূ পার হয়ে অক্লান্ত শিবিকার পথ চলে যখন ধনঞ্জয় বিমানে পৌঁছলো বিশাখা তখন ধীর-প্রত্যূষ হচ্ছে। অরুণ আভায় রঞ্জিত বিমানটি, বহির্বাটির কানন, অন্তঃপুরের কানন। অত্যুচ্চ গাছগুলির ওপরের দিকের শাখা ও পত্রাবলীকে ছুঁয়ে নিচের দিকে সহস্রধারায় ঝরে পড়ছে অরুণ আশীর্বাদ। কিন্তু বিশাখা দেখল সবই যেন একটি বিশাল প্রাণহীন স্বর্ণভাণ্ড। প্রাণহীন। পুরস্ত্রীরা ছুটে এলেন। বিশাখা তোমার নবজাতক?
—রেখে এসেছি।
—কী সর্বনাশ!
বিশাখা বলল— পিতা কোথায়?
এইবারে পুরস্ত্রীদের শোক আর বাধা মানল না। এত সাবধানে যে বিশাখার কাছ থেকে এই বজ্রপাতসম সংবাদ গোপন রাখা হল, বিশাখা কেমন করে তা জেনে গেল? বিশাখা কারও কোনও উত্তরের অপেক্ষা করল না। সেই হাহাকারের মধ্য দিয়ে কক্ষের পর কক্ষ ছুটে বেড়াতে লাগল। যেন কোনও একটি কক্ষে বসে আছেন জননী। ঠিকমতো সন্ধান করলেই পাওয়া যাবে। তার চোখে অশ্রু নেই, মুখে ভাষা নেই। পিতার কক্ষে পিতাকে দেখতে পেল না। পুরস্ত্রীরা বললেন— তিনি গতরাত্রে কর্মকক্ষ থেকে আসেননি।
বৰ্হিবাটিতে ছুটল বিশাখা। কর্মকক্ষর এক প্রান্তে একটি চতুষ্পদিকায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছেন ধনঞ্জয়। পাশে ভোজনথালী অস্পৃষ্ট পড়ে রয়েছে।
পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ধনঞ্জয় মাথা তুলে বললেন— বিশাখা!
—পিতা! বিশাখা রুদ্ধকণ্ঠে বলল।
কখনও ধনঞ্জয়ের কোলে বিশাখার মুখ, কখনও বিশাখার কোলে ধনঞ্জয়ের মুখ— শুধু অশ্রুধারায় ভেসে যায় মুখ, বুক ফুলে ফুলে ওঠে। মুখে কোনও শব্দ নেই।
সেই বিলাপগৃহে অর্ধমূৰ্ছিত পিতা-কন্যাকে ঘিরে ধনপালী ছাড়া আর কেউই ক্রমশ রইল না। সকলেই বলল— এঁদের শোকপ্রকাশের অবকাশ দেওয়া প্রয়োজন। নইলে বুক ফেটে যাবে।
একটি একটি করে ধীরে ধীরে সব শোনা হল। যদিও দেবী সুমনার বয়স হয়েছিল, বৈদ্য এবং ধাত্রী সুপ্রসবই আশা করেছিলেন। কীভাবে দেবী সমস্ত যন্ত্রণা বিনা আর্তনাদে সহ্য করেছিলেন। কীভাবে সন্দংশ দিয়ে শেষ পর্যন্ত শিশুর মাথাটি বলপ্রয়োগ করে টেনে বার করতে হয়, তারপর কীভাবে তাঁর হাত পা শীতল হয়ে যেতে আরম্ভ করে, সর্বাঙ্গে স্বেদবিন্দু ফুটে ওঠে, কী যেন বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। পুরী আঁধার করে মূর্ছার কোলে ঢলে পড়লেন। শত ভৈষজ প্রয়োগেও সে মূর্ছা আর ভাঙল না।
মা, তোমার সামনে কখনও তো আঁধার ছিল না। তোমার দ্যুতিময় অন্তরের আলোকচ্ছটায় কিছুই অস্পষ্ট থাকত না। প্রশান্ত মনীষায় করণীয়গুলি দেখতে পেতে, অনম্য সাহসে বিপদের সামনে দাঁড়াতে, প্রসন্নচিত্তে নিজসংসার ও পরসংসারের দায়গুলি পালন করতে! তুমি ছিলে বলে এই বিশাল ধনঞ্জয়ভূমি যেন তৈলনিষিক্ত যন্ত্রের মতো চলত। তুমি ছিলে বলে বিশাখা জীবনের সংগ্রামটিকে জিগীষু বীরযোদ্ধার মতো নিয়েছিল। জয়লাভ সে করবেই এ সঙ্কল্পের শক্তি কোথা থেকে এসেছিল? মা আছেন, মা দেখছেন। হারবার মানুষ মা নন। তাঁর কন্যা কি কখনও হারতে পারে? এই বোধ থাকত সমস্ত দুঃখের মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে দিতে।
বিশাখা বলল— পিতা, আমি এখনও কেমন হৃদয়ঙ্গম করতে পারছি না, মা নেই। না পিতা, এ হতে পারে না।
ধনঞ্জয় শূন্য চোখে চেয়ে বললেন—না বিশাখা, সত্যই সে নেই। এই দীর্ঘ মাস ভরে প্রতি সকালে আমি দেহলিতে একটি করে পুষ্প রেখে দিয়েছি, আজ সুমনাহীন প্রথম দিন পৃথিবীর, আজ সুমনাহীন দ্বিতীয় দিন… আজ সুমনাহীন তৃতীয় দিন…। বিশাখা, কন্যা আমি সবসময়ে সর্বত্র অনুভব করার চেষ্টা করি সে আছে। কিন্তু দেখো, আমি যন্ত্রণায় শতধা হয়ে যাচ্ছি, সে তো কই কোনও স্পর্শ পাঠায় না, আমি খাদ্য গ্রহণ করি বা না করি, নিদ্রা যাই বা না যাই, কোনও সময়েই কোথাও বিন্দুমাত্রও তার অস্তিত্ব অনুভব করি না এই বস্তু-পৃথিবীতে। মহাত্মা অজিত, মহাত্মা পূরণ কাশ্যপ যা বলেন তাই-ই ঠিক বিশাখা, চতুর্মহাভূতে মিলিয়ে গেছে সুমনা। পৃথিবীর কোন শুভক্ষণে, ধনঞ্জয়ের কোন্ শুভকর্মের ফলে, বিশাখার ভাগ্যফলে, মৃত্তিকা, জল, বায়ু, আকাশ থেকে তিল তিল বস্তু আহরণ করে রচে উঠেছিল সুমনা-শরীর, সুমনা-হৃদয়, আবার জড়-পৃথিবীর নিয়মে সে ফিরে গেছে খণ্ড খণ্ড হয়ে। বিশাখা, ব্রাহ্মণরা ভুল বলেন— আত্মা নেই, নির্গ্রন্থরাও ভুল বলেন— আত্মাও নেই, পুদগলও নেই, বুদ্ধ তথাগত ভুল বলেন—শুভ কর্মফল থেকে, শরীর থেকে শরীরান্তরে প্রয়াণ হয় এ কথা ভুল। সুমনা আর কখনও জন্ম নেবে না, নিতে পারে না। জড় প্রকৃতিতে ওরূপ শুভ আকস্মিকতা একবারই ঘটে। মাত্র একবার।
বিশাখা পিতার হাত ধরে অন্তঃপুরে নিয়ে গেল, তার নিজকক্ষে নিয়ে গিয়ে পেটিকা খুলল। সে দেবী সুমনার চিত্র লিখেছিল। কাষ্ঠফলকে, বসনে। সেইগুলি বার করে সে সযত্নে পল্যঙ্কের ওপর বিছিয়ে রাখল। বলল পিতা—একদিন মায়ের অনুপস্থিতিতে এই চিত্র পাশে নিয়ে যজ্ঞকাজ করেছিলে। এখন মায়ের অবর্তমানেও এই চিত্র নিয়ে যজ্ঞস্বরূপ জীবন অতিবাহিত করো। পিতা হয়ত তুমি ঠিকই বুঝেছ— মায়ের শরীরের জৈব উপাদানগুলি হয়ত তাদের উৎসে ফিরে গেছে। কিন্তু সুমনা-হৃদয়, তাঁর দীর্ঘদিনের শুভকর্ম, শুভচেতনা লয় পেয়ে যাবে, এ কি কখনও হতে পারে!
পিতা সেই নবজাতিকা কোথায়? আমার ভগ্নী?
—জানি না, আমি তাকে দেখিনি বিশাখা। আজও দেখিনি। দেখব না।
—সে কী পিতা!
বিশাখা পিতার হাত ধরে নিয়ে গেল সেই নির্জন, প্রায়ান্ধকার কক্ষে যেখানে ক্ষুদ্র মাথাটির দুধারে দুটি ক্ষুদ্রতর মুঠি রেখে ঘুমিয়ে আছে অবহেলিত শিশুটি। কহ্না শুধু কাছে বসে আছে।
বিশাখা বলল— এ কী? এমন অন্ধকার কেন এ ঘর! বাতায়ন নেই ভালো। বায়ু চলাচল যেন বন্ধ হয়ে আছে! পালি, কহ্না—শীঘ্র সুবাতাস আলোযুক্ত সুন্দর কক্ষের ব্যবস্থা কর। উশীর ছড়িয়ে দিবি চারদিকে। চন্দনের ক্ষুদ্র একটি পালঙ্ক আছে। আমি নিজে তাতে শুতাম। পালঙ্কটি একটি প্রেঙ্খার মতো, তামার দৃঢ় শেকল দিয়ে ছাদের সঙ্গে যুক্ত থাকত। দ্যাখ— অঙ্কমাদের জিজ্ঞেস কর।
শিশু এই সময়ে কেঁদে উঠল। বিশাখা পরমস্নেহে তাকে কোলে তুলে নিল। অমনি তার শুষ্ক স্তনবৃন্ত থেকে দুগ্ধক্ষরণ হতে লাগল। স্তনপট্ট ভিজে যাচ্ছে মাতৃ-স্নেহ-পীযূষধারায়। ধাবিত হচ্ছে ওই মাতৃহীন, অনাথা শিশুর দিকে। সে বলল—পিতা, অশ্ব, শিবিকাসহ ধনপালীকে পাঠাও সাকেতে। হর্য আর মিত্তকে নিয়ে আসুক, সঙ্গে আসবে ওদের ধাত্রীরা। আমি এখন সাকেতেই থাকব।
গভীর রাত্রে সারাদিন পরিশ্রমের পর, তিনটি শিশুকে ঘুম পাড়িয়ে, ধাত্রীদের কাজের ভার দিয়ে বিশাখা অন্তঃপুরের কাননে বকুলমূলে তার প্রিয় বেদিকার ওপর এসে বসল। বহুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল সে। সে ধ্যান করছে। আজ তার কর্মস্থান (ধ্যানের বিষয়) দেবী সুমনা। মায়ের রূপ চোখের সামনে ভাসিত করতে কই বিন্দুমাত্রও বেগ পেতে হল না! ওই তো মা দাঁড়িয়ে আছেন, গাঢ় নীল রঙের উত্তরীয়, দেহের বর্ণ আরও উজ্জ্বল লাগছে। কেশগুলি বেণীবদ্ধ। বেণীতে কুন্দকুসুম। মায়ের ওষ্ঠাধরে মৃদু হাসির রেখা, সেই যে বলেছিলেন শ্রাবস্তীর পথে… ‘ধরো তোমার যশোভাগ আমারও নিতে ইচ্ছা হয়েছিল।’ সেই স্নেহ সেই ব্যাকুলতা অথচ গাঢ় আস্থা! কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সে মায়ের চোখ দুটি দেখতে পেল না। মায়ের সমস্ত অবয়বই প্রিয়, কিন্তু চোখ দিয়ে যে কথা বলা যায়, কথা শোনা যায়! মা, তোমার সেই অনুপম পলাশাক্ষি, স্নেহে, প্রণয়ে গাঢ়, মননে গভীর, চিত্তের অন্তস্তল পর্যন্ত দেখার শক্তিতে মর্মভেদী! সেই চোখ দুটি আমি কেন কিছুতেই ধ্যানে আনতে পারছি না। মৃদুহাসিমণ্ডিত, চক্ষুহীন সেই জননীমূর্তি বিশাখার চোখের সামনে একবার আবির্ভূত হচ্ছে, একবার অন্তর্হিত হচ্ছে। অবশেষে চাঁদ যখন অস্তোন্মুখ কাননভূমির অর্ধেক তমসায় আবৃত তখন বিশাখা সামনের অন্ধকারের দিকে চেয়ে আর্তকণ্ঠে বলল— মা, তুমি আমাকে ত্যাগ করে যেও না। সাকেতের এই ধনঞ্জয়লোক, সাবত্থির মিগারলোক, কত দরিদ্ৰজন, পীড়িত পশুগণ, কত সংসারত্যাগিনী কিংবা বহু দুঃখে দুঃখিনী নারীরা বিসাখার মুখের প্রতি চেয়ে রয়েছেন। তাঁদের সবার জন্য বিসাখা আছে। কিন্তু বিসাখার তুমি ছাড়া কেউ নেই। বিসাখার হৃদয় যে প্রণয় জেনেছে তা অতি অদ্ভুত, অলৌকিক। হর্ষের, রোমাঞ্চের শতধারা তা। কিন্তু তা উদ্দীপন হলেও আশ্রয় নয় মা। তাছাড়া বিশাখা আজও জানে না, তা স্বপ্ন না মায়া, করুণা না ইদ্ধি। মা আমি এও জানি না, সমনের অনুরাগিণী হয়ে আমি তাঁর প্রতি অপরাধিনী কি না, কীভাবে তাঁর ছায়াশরীর বিশাখার কাছে আসে, অথচ তিনি জানতে পারেন না! আমি তো কোনও মন্ত্র প্রয়োগ করিনি মা! আমার চিত্তের শ্রদ্ধা, স্নেহ পূজা তাঁকে নিঃশেষে দিয়েছি। পরিবর্তে পেয়েছি দেহমন দীপ্ত করা এক মধুর আগুন। বড় দুঃখ মা, আবার বড় আনন্দও। বিশাখার গতি কি নিরয়লোকেই হবে? বলো মা, বলো! এ কথা যে ভগবানকেও জিজ্ঞাসা করতে পারি না! এ অলৌকিক মিলন, এ অলৌকিক বিরহের ভার বিশাখা আর কতদিন সইতে পারবে?
সহসা বিশাখার ধ্যানদৃষ্ট জননী প্রতিমার মুখমণ্ডলে চোখ দুটি ফুটে উঠল। ব্যথা না করুণা, ভর্ৎসনা না সান্ত্বনা সে চোখে বিশাখা বুঝতে পারল না। সারারাত্রি কেটে গেলে, মাতৃনয়নের ধ্যানের মধ্য দিয়ে বিশাখা পূর্বনিবাসজ্ঞান লাভ করল। জন্ম জন্মান্তরের স্মৃতিগুলি সব ছায়াচিত্রের মতো তার মনশ্চক্ষের সামনে উদ্ভাসিত আবার লয়প্রাপ্ত হতে লাগল। বিশাখা দেখল জন্মে জন্মে সে এমনি হতভাগিনী নারী ছিল যে সংসার-বৈরাগী উদাসীচিত্ত এক পুরুষকে ভালবেসেছিল, কখনও তাকে পায়নি। কাঁটাগাছের বনের মধ্য দিয়ে, জলাভূমির মধ্য দিয়ে, তপ্ত মরুবালুকার মধ্য দিয়ে বংশ, কুল, সমাজ, মানসম্মান সমস্ত তুচ্ছ জ্ঞান করে জন্মের পর জন্ম সে ছুটে চলেছে দারুণ তৃষ্ণা নিয়ে, ছিন্ন-ভিন্ন, ক্ষত-বিক্ষত হয়ে বারবার সে মরেছে, বারবার জন্মেছে, তবু তার প্রেমতৃষ্ণা মরেনি, চণ্ডালের জন্য ব্রাহ্মণকুল ছেড়ে সে চণ্ডালী হয়েছে, শবরের জন্য শবরী, নিষাদের জন্য নিষাদী, নিদারুণ দারিদ্র্য, নিষ্করুণ কঠোর জীবন সমস্তই সে সহ্য করেছে সেই প্রণয়ের জন্য। সে যদি সীবলিকুমারী তো, তার দয়িত মহাজনক হয়ে সংসার ত্যাগ করে চলে গেছেন, সে যদি মাদ্রী তার প্রেমাস্পদ বিশ্বন্তর হয়ে প্রাণের আবেগে তাকে দান করে দিয়েছেন, সে যদি শ্যামা তো তিনি মহাসত্ত্ব হয়ে তাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছেন, আকণ্ঠ প্রেমতৃষ্ণা নিয়ে সে মরেছে। অবশেষে এখন এই বিশাখা-জন্মে সুমনা-গর্ভ তাকে আশ্রয় দিল। সুমনা-গর্ভ দেহহীন মৃত্যুলোকের ওপার থেকেও তাকে ঘিরে ধরছে, তার অপরিপূর্ণ প্রেম তাকে এই জন্মে এক বজ্রসম গঙ্গাস্রোতসম, বর্ষার বারিগর্ভ বিপুলালকার মেঘসম মহাশক্তি দিয়েছে। দিচ্ছে। সে কোনও গৃহের নয় আর। সমাজের। সমাজের নয় জাতির, জাতির নয় সমগ্র দেশের, সমগ্র বিশ্বের হয়ে যাচ্ছে। হয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের এক আলোকদর্পণ, যাতে মুখ দেখে দূরভবিষ্যতের নারীরা আলোময় হয়ে উঠবে, পুরুষরাও আলোময় হয়ে উঠবে। সে মহোপাসিকা বিশাখা।
ধ্যান ভাঙলে, একাকী রৌদ্রালোকিত কাননভূমি সে দৃঢ় পায়ে পার হল। আচ্ছন্নভাব আর নেই। তার ধ্যানের জগৎ আর বাস্তব ঘটমান জগতের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানটুকুর মধ্যে সেতুবন্ধ হয়ে গেছে। সে বিশাখাই। কিন্তু সে বুঝি সুমনাও। তাঁর সারাজীবনের সাধ ও সাধনা এখন বিশাখার মধ্যে প্রবেশ করেছে।
অন্তঃপুরদ্বারের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে করতে বিশাখা অনুভব করল তার মর্মের মধ্যে জেগে রয়েছে দেবী সুমনার সেই চোখ দুটি। কী যেন উৎসারিত হচ্ছে তার সেই মর্মস্থল থেকে। চারিদিক ঘিরে এক আশ্রয়বলয়, যা কখনওই সরে না, নড়ে না। সে যে পথ দিয়ে গেল সেই সেই পথে সেই আশ্রয়বলয়ের কবোষ্ণ তাপ ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তাই গৃহের অস্বাভাবিক স্তব্ধতা, লোকজনের আসা-যাওয়ার স্বল্পতার কারণ সে বুঝতে পারল না।
আরও ভেতরে ঢুকতে ধনপালী এলো, বলল—সখি, চলো স্নান করে নাও।
—আরেকটু পরে পালি, আগে শিশুগুলিকে দেখে আসি।
—শিশুগুলি এখনও ঘুমোচ্ছে, ভদ্রা।
—পিতা?
—ঘুমোচ্ছেন।
—তা হলে চল্।
স্নান সারা হলে বিশাখা পট্টবস্ত্র পরল, কপালে কুঙ্কুমবিন্দু দিল, গন্ধমাল্য ধারণ করল। ধনপালীর আনা সুমিষ্ট দুধ পান করল। তারপর সংসার-কাজে যাবার সময়ে জিজ্ঞাসা করল—কহ্না কোথায় পালি, কখন উঠবে? ধনপালী বলল— কহ্না আর কোনওদিনই উঠবে না ভদ্রা
—কী বলছিস?
—কহ্না কাল রাতে আত্মঘাতী হয়েছে।
—বলিস কী? কেন?
কহ্নার কক্ষের সামনে থেকে পুরস্ত্রীদের সরিয়ে যখন বিশাখা প্রবেশ করল—কহ্নার নীলবর্ণ মুখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে বৈদ্য ধীরে ধীরে তখন তার হাতটি নামিয়ে রেখে দিচ্ছেন। অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারলাম না কল্যাণি— বৈদ্য ধীরে ধীরে বিষণ্ণমুখে বললেন, তারপর নিজের পেটিকাটি নিয়ে চলে গেলেন।
ধনপালী একটি লিপি দিল বিশাখার হাতে, কহ্না তার নবলব্ধ অক্ষরজ্ঞান, লিপিজ্ঞান ব্যবহার করেছে— বিশাখাভদ্রা, দাস জনক-জননী প্রথমে জন্ম দিয়েছিলেন, তুমি নতুন জন্ম দিলে। নতুন জ্ঞান দিলে। সেই জ্ঞান দিয়ে দেখলাম জগৎ বড় বিষাদময়। ধন, জন, রূপ, মুক্তি কিছুতেই সেই মহাশূন্যতা ভরে না। অপরিপূরিত দরিদ্রই থেকে যায় জীবন। সংসারে নারীর সুখ নেই, সংসার ত্যাগেই বা সুখ কোথায়? কোথাও কোনও পথ পেলাম না। তোমার জন্যই অপেক্ষা করেছিলাম। তুমি এসেছ, তোমার আধার কাঞ্চনময়, তাই ধৈর্যে, দুঃখ-সহনে তুমি আরও দীপ্ত হয়ে ওঠো। দেবী সুমনার শিশুটিকে তোমার হাতে দিয়ে গেলাম। আর আমার এই মৃৎ-ভাণ্ড ভেঙে দিলাম। যা বায়ুর তা বায়ুতে ফিরে যাক, যা জলের তা জলেতে, যা অগ্নির তা অগ্নিতে, এবং যা শূন্যতার তা সেই মহাশূন্যতায়।
১১
পাঞ্চাল তিষ্য উজ্জয়িনীতে দৌত্য শেষ করে বৎস বা বংস রাজ্যের রাজধানী কৌশাম্বীর দিকে একাকী যাত্রা করলেন। সাকেতের রাজন্যকুমার তিষ্য, মগধরাজ বিম্বিসার ও দৈবরাত চণকের আদরের তিষ্যকুমার যে ঠিক কবে থেকে পাঞ্চাল তিষ্য বলে প্রতিষ্ঠা ও সম্মান পেতে আরম্ভ করলেন, বলা কঠিন। সম্ভবত কোশলরাজ পসেনদি তাঁর বংশপরিচয় নিয়ে ঔৎসুক্য প্রকাশ করাতে তিষ্যকুমার উল্লেখ করেন যে তাঁর পিতা নিজেকে পঞ্চাল রাজবংশসম্ভূত বলে মনে করেন।
পসেনদি তখন মহাঔৎসুক্যভরে বলে উঠেছিলেন—ক্ৰৈভ্য, ক্ৰৈভ্য! ঋক্সংহিতায় এই পঞ্চালদের উল্লেখ আছে ক্ৰৈভ্য বলে। বহু প্রাচীন জন।
তখন তিষ্যর মনে পড়ে যায় ঋক্-সংহিতায় নয়, শতপথ ব্রাহ্মণের আলোচনার সময়ে এক বিদথে সে শুনেছিল ক্ৰৈভ্যদের সম্পর্কে বলা হয়েছে এঁরা প্রথমে সিন্ধু ও অসিক্লী নদীবিধৌত অঞ্চলে বাস করতেন। পরে পূর্ব দিকে যমুনার তীরে চলে যান, এবং পঞ্চাল বলে পরিচিত হতে থাকেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কুরু-পঞ্চাল মিত্রতার পরে পঞ্চাল দেশ এবং পঞ্চাল জাতি ক্রমশই গৌরব অর্জন করতে থাকে। আর এখন তো কুরু-পঞ্চাল দেশ বিদগ্ধতম বলে খ্যাতি পেয়েছে। কথা হচ্ছে, তাদের বংশটি পঞ্চাল রাজবংশের মূল ধারা থেকে চ্যুত হল কবে? কেনই বা? এর মধ্যে কোনও অগৌরবের ইতিহাস লুকনো থাকা অসম্ভব নয়। মহারাজ পসেনদি সম্ভবত তাদের কুলের ইতিহাসটি পুঙ্খানুপুঙ্খ উদ্ঘাটিত করতে উৎসুক ছিলেন। পসেনদির প্রকৃতিই এইরূপ। ওঁর নিজের বংশে মাতঙ্গচ্যুতি দোষ আছে। এখন এই দোষ ঠিক কী প্রকৃতির, তা তিষ্য জানে না। জানতে আগ্রহীও নয়। কিন্তু পসেনদি ব্যাপারটি গোপন করতে এবং অন্যান্য খ্যাতিমান বংশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে এই কুলদোষ খণ্ডাতে বড়ই শক্তিক্ষয় করেন। যেমন ভগবান তথাগতর কুল অর্থাৎ শাক্যকুল থেকে কন্যা এনে বিবাহ করেছিলেন। এখন বলতে থাকলেন— ‘ক্ৰৈভ্য, ক্ৰৈভ্য-পঞ্চাল, তিষ্যকুমার তোমার সঙ্গে আমার একটি কন্যার বিবাহ নিশ্চয় দেবো। পঞ্চালবংশের সঙ্গে মিত্রতা হবে আমার।’
তিষ্য কিছু বলতে পারেনি। কেননা রাজাদের মধ্যে মৈত্রী-স্থাপন করবার মানস নিয়েই তো সে বেরিয়েছে! যাতে মৈত্রীর ভিত দৃঢ় হয় তেমন কিছুতে তার আপত্তি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু পসেনদি যদি মহাদেবী মল্লিকার বালিকা কন্যা মল্লিকা, কিংবা মহাদেবী বাসবক্ষত্রিয়ার বালিকা কনা বজিরার সঙ্গে তার বিবাহ দিতে নির্বন্ধ করেন তাহলে অগত্যাই তাকে শ্রাবস্তী ত্যাগ করে এমন স্থানে পালাতে হয়, যেখানে পসেনদির হাত পৌঁছবে না। অবশ্য তিষ্য পালিয়ে যায় নি। শ্রাবস্তীতে তার সবচেয়ে বড় বন্ধু ও হিতাকাঙক্ষী বন্ধুল রয়েছেন। রয়েছেন বন্ধুপত্নী মল্লিকাদেবীও। এঁরা থাকতে বড় কিছু অঘটন ঘটবে না। প্রধানত বন্ধুলের কারণেই তিষ্য শ্রাবস্তীতে তার একটি কর্মকেন্দ্র স্থান করল।
মহারাজ বিম্বিসারের রাজসংঘ স্থাপনের প্রস্তাবের মধ্যে একটি অংশ সে অতিশয় স্পর্শকাতর বলে বুঝেছে। রাজগণের ভেতর বন্ধুতা ও হৃদ্যতা থাকা এক বস্তু, আর সংঘনায়কত্ব একজনকে অর্পণ করা সম্পূর্ণ আর এক বস্তু। বিশেষত এই দিকটি নিয়েই দীর্ঘদিন মহারাজের সঙ্গে তিষ্যর পরামর্শ হয়েছে, স্থির হয়নি কিছু। কতকগুলি সমাধানের কথা আলোচনা হয়েছে মাত্র। বেশ কিছুকাল কোশলরাজের আতিথ্য ভোগ করবার পর তিষ্যকুমার যখন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং নিভৃত আলাপের সুযোগ পেল, সে বন্ধুলকে সঙ্গে রেখেছিল। প্রস্তাবটি নিবেদন করবা মাত্র পসেনদি হা-হা করে হেসে উঠলেন।
—শ্যালকের সঙ্গে আবার মিত্রতা কী? শ্যালক হল চির-শত্রু, কী বলো বন্ধুল! নাও নাও সাকেতকুমার মহামান্য মগধদূত তিষ্য, মৈরেয় নাও, পান করো, পান করো হে!
কেউ তাঁর কথার কোনও উত্তর না দেওয়াতে পসেনদি সম্ভবত বুঝলেন ব্যাপারটি গম্ভীর। তিনি হাসি-হাসি মুখে গোপন ষড়যন্ত্রের ভাব ফুটিয়ে বললেন— সেনিয় কি আমার ভগ্নীর সঙ্গে কলহ টলহ করেছে না কী? কলহের কারণ তো সেই কবে থেকেই ঘটছে! সেনিয়- অম্বপালী প্রণয়-পর্বের কথা তো সারা জম্বুদ্বীপেই বিদিত। সেনিয় কি ভাবে তার অন্তঃপুরই মাত্র এ বিষয়ে অন্ধকারে আছে?
তিষ্যর মুখ আরক্ত হয়ে উঠল। পিতার বয়সী এক মহারাজের সঙ্গে প্রণয়-ব্যাপার নিয়ে রসালাপ করার অভিজ্ঞতা তার স্বভাবতই ছিল না।
—সেনিয়র ভগ্নী, অর্থাৎ আমার প্রথমা পত্নী কিন্তু বুদ্ধিমতী। ক্ষমাশীলাও বটে। তিনি কোনকালে পসেনদির সুমতির আশা ত্যাগ করেছেন। দেবী মল্লিকাকে বিবাহ করবার পর একটু অভিমান রোষ ইত্যাদি দেখিয়েছিলেন, শাক্যকন্যা বাসবীকে বিবাহ করার পর সেই যে নিজের প্রাসাদ আশ্রয় করেছেন, আর বার হতে দেখি না। মাঝে মাঝে যখন সংবাদ নিতে যাই, দেখি তিনি ধর্মকর্মে মন দিয়েছেন।
বন্ধুল বললেন—মহারাজ, নিজের হৃদয়হীনতার কথা আর এই যুবার কাছে প্রকাশ না-ই করলেন!
বন্ধুল-মল্ল ও মহারাজ পসেনদি তক্ষশিলায় সতীর্থ ছিলেন। পসেনদিই বহু অনুরোধ উপরোধ করে বন্ধুলকে কোশলে অমাত্য পদ দিয়ে আনেন। এমনিতেই পসেনদি তরলস্বভাব, বন্ধুলের সঙ্গে একান্তে বসলে তো কথাই নেই! তিনি আবারও হাসিমুখে চোখ দুটি ছোট ছোট করে বললেন— বন্ধুল বড়ই একপত্নীকতার গর্ব করে। আচ্ছা তিষ্য, ওকে জিজ্ঞাসা করো তো আয়ুষ্মতী মল্লিকার যখন সন্তানাদি হচ্ছিল না, তখন ও মল্লিকাকে পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দিয়েছিল কেন।
বন্ধুল রাগ করে বললেন— মহারাজ, তিষ্য আমাদের সন্তানতুল্য। তার সামনে দাম্পত্যকলহ ইত্যাদি ব্যাপারের আলোচনা না করলেই আপনার চলছে না, কেমন!
—আহা হা, তিষ্য সন্তানতুল্য হলেই বা, প্রাপ্তবয়স্ক তো হয়েছে! এখন আর…
—ঠিক আছে প্রাপ্তবয়স্ক ক্ষত্রিয় বীরের সঙ্গে রাজোচিত আলোচনা করুন। যুদ্ধবিগ্রহ, দণ্ডনীতি শাসনকার্য। মূর্খ গ্রাম্যজনের মতো… বন্ধুল থেমে গেলেন।
—হ্যাঁ হ্যাঁ বলে যাও, বলে যাও, থামলে কেন?—এবার দেখা গেল পসেনদি রাগ করেছেন,
—সতীর্থ বলে তুমি মানতেই চাও না যে, পসেনদি একজন রাজা।
—শুধু রাজা নয়, মহারাজা। কোশলাধিপতি। বন্ধুল ঈষৎ হাসি মুখে বললেন, ভুলবো কেন? আপনি না ভুললেই হল।
তিষ্য এতক্ষণে বলল—‘মহারাজ, মগধাধিপ আপনার মিত্ররাজ বলেই তো আমাকে তিনি সর্বপ্রথম শ্রাবস্তীতেই পাঠিয়েছেন। শুধু মৌখিক মিত্রতা নয়, মগধরাজ চাইছেন একটি সংঘ স্থাপন করতে। শ্রেষ্ঠীদের সংঘে যেরূপ বাণিজ্য-বিষয়ে পারস্পরিক মতবিনিময় হয়, নীতি নির্ধারণ হয়, রাজসংঘে রাজাদের মধ্যেও তেমন হবে।
—তাতে লাভ? আমার নীতি আমি নির্ধারণ করবো না তো কি সেনিয় করে দেবে? না কি করবে সেই বাতুল উদয়ন?
—মহারাজ, রাজ্যের ভেতরে যেমন নিজস্ব সমস্যা আছে, তেমনই কতকগুলি সমস্যা আছে যা পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকলে উন্নত হয়। সীমান্তপ্রদেশে উভয় রাজ্যেরই শাসন শিথিল, অধিকার নিয়েও বহু ভুল বোঝাবুঝি হয়। বাণিজ্যশুল্ক নিয়ে বণিকদের মধ্যে অসন্তোষ দিন দিন বাড়ছে। প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে করের সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন। এই সব আন্তঃরাজ্য সমস্যা তো আছেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে বহিঃশত্রু। আপনারা জম্বুদ্বীপের রাজারা যদি নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য একত্র করেন তা হলে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে আমরা আত্মরক্ষা করতে পারবো। —বলতে বলতে তিষ্যর কাঁধের কাছের গুচ্ছ গুচ্ছ কেশ দুলতে লাগল। সেই অভিরাম দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে পসেনদি সামান্য কৌতুকের স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বহিঃশত্ৰু? তুমি কি গান্ধার মদ্র এঁদের কথা বলছো? না কুরু-পঞ্চাল?
—এরাও না মহারাজ। এদেরও রাজসংঘভুক্ত করা প্রয়োজন। এরও বাইরে উত্তরপশ্চিম সীমান্তর ওপার থেকে পার্সরা আসছে। সমুদ্রের ওপার থেকে যবনরা আসতে পারে। পূর্ব প্রান্ত থেকেই আসা অসম্ভব না কি? ওদিকেও আছে সুবর্ণভূমি, উত্তরে হিমবন্তের ওপারে উত্তরকুরু।
—এ সকল কার কল্পনা তিষ্যকুমার? সেনিয় আজকাল আলস্যে আর কল্পকথা রচনায় সময় কাটাচ্ছে না কি?— অর্ধেক স্নেহ অর্ধেক বিদ্রূপভরে তিষ্যর দিকে তাকিয়ে বললেন পসেনদি।
বন্ধুল এই সময়ে বললেন— মহারাজ বিম্বিসার যে দূরদর্শী তাতে সন্দেহ নেই।
—তুমি বলছো, এই সব ভয় কল্পিত নয়?
—মহারাজ, হয়ত আপনার জীবৎকালে কোনও বৈদেশিক আক্রমণ হল না, কিন্তু আপনার পুত্রের সময়ে তো হতে পারে! সামান্য কোশল প্রত্যন্ত নিয়েই আমরা কিরূপ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি দেখেন না? সেক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক সেনা নিয়ে যদি পার্সরা গান্ধার আক্রমণ করে, গান্ধারকে পরাস্ত করে, মদ্র, অবন্তী, মৎস্য, বিদেহ, কুরু-পঞ্চাল, কোশল এইভাবেই তো অগ্রসর হবে তারা! খণ্ড খণ্ড রাজ্য। পরস্পরকে সাহায্য না করলে তৃণখণ্ডের মতো ভেসে যাবে।
পসেনদি উঠে পড়ে পদচারণা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর থেমে বললেন— ওই চণ্ডটার সঙ্গেও প্রণয় করতে হবে না কি?
তিষ্য সসম্ভ্রমে বলল— আপনি কি প্রদ্যোৎ মহাসেনের কথা বলছেন? অবশ্যই! উনিই তো সবচেয়ে অবুঝ, ক্রোধী…,
—আর ওই বাতুলটার সঙ্গে?
—বৎসরাজ উদয়নের কথা বলছেন কি?
—আবার কি!
—হ্যাঁ, সবার সঙ্গেই মিত্রতা ও আদান-প্রদান, পরামর্শ ও শক্তিসংযোগের সম্পর্কে আসতে হবে।
বন্ধুল বললেন— কাউকে চণ্ড, কাউকে বাতুল বলে ত্যাগ করলে নিজেরই সর্বনাশ হবে মহারাজ।
পসেনদি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গর্বভরে বললেন— প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্য প্রয়োজন। একাধিপত্য। বুঝলে? চক্রবর্তী। রাজচক্রবর্তী। একটি মাত্র অশ্বমেধ যজ্ঞ। সমগ্র জম্বুদ্বীপ আমার যজ্ঞভূমিতে সমবেত হবে। … কিন্তু ভগবান তথাগত সম্মত হবেন কী?
বন্ধুল বললেন— ধরুন ভগবান তথাগত সম্মত হলেন। আর না হলেও রাজকৃত্য বলে আপনি যা মনে করবেন তা আপনার করাই উচিত। কিন্তু অশ্বমেধ যজ্ঞ করে সমগ্র জম্বুদ্বীপের রাজচক্রবর্তী হওয়া আর সম্ভব কী?
—পসেনদির ক্ষমতার প্রতি কটাক্ষ করছো নাকি বন্ধুল?
বন্ধুল বললেন— পসেনদির ক্ষমতার অংশ তো বন্ধুলও। নিজের শক্তির প্রতিও সংশয় প্রকাশ করা হচ্ছে তাহলে, তাই নয় কি? মহারাজ, বন্ধুলকে তিরস্কার করতে হলে সোজাসুজি করুন, এভাবে ছল করে রাগ করবেন না। চিন্তা করে দেখুন। কোশল রাজ্যের যেটুকু বিস্তার, জম্বুদ্বীপের আর কোনও রাজ্যেরই সে বিস্তার নেই। কিন্তু সেই কোশলের সীমান্ত রক্ষা করাও সম্ভব হচ্ছে কী? সর্বক্ষণ বিদ্রোহ, সর্বক্ষণ দস্যুতা। সাম্রাজ্যসৃষ্টি করতে পারলেও তা রক্ষা করা যাবে না আর। ঔপরাজ্যে ঔপরাজ্যে বিভক্ত হয়ে যাবে। তারপর সেই ঔপরাজ্য আবার স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে এই কেন্দ্রাতিগ শক্তি আপনি আর অস্বীকার করতে পারেন?
তিষ্য বলল— তা ছাড়া মহারাজ, অশ্বমেধ বা রাজসূয় যজ্ঞ করে পৃথিবীপতি হবার ধারণা প্রাচীন হয়ে গেছে। ও ধারণার আর গুরুত্ব দেয় না কেউ। এখন নতুন ধারণার প্রয়োজন। একাধিপত্য যদি ব্যর্থ হয়ও, যেমন আর্য বন্ধুল বললেন, সখ্য, পারস্পর সাহায্য ও সংঘবদ্ধতা ব্যর্থ হবে না। অন্ততপক্ষে তা অনেক কার্যকর।
মহারাজ পসেনদির আস্থা এবং মোটামুটি সম্মতি অর্জন করতেই তিষ্যকুমারের কত কাল কেটে গেল। একবার ভালোভাবে পরিচয় হবার পর আবার রাজাটি তাকে এতোই ভালোবেসে ফেললেন যে, কিছুতেই ছাড়তে চান না। কোশলরাজের সমর্থন না পেলে আর অগ্রসর হওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। অগত্যা তিষ্য-কোশলরাজের মৃগয়া, দস্যুদমন, ধর্মচর্চা, উৎসব পালন ইত্যাদির সঙ্গী হয়ে থেকে গেল। তিষ্য সময়টির সদ্ব্যবহার করল বন্ধুলের কাছে শস্ত্র চর্চায়।
বর্ষা শেষ হলে আকাশে যখন শারদমেঘের গতায়াত, তিষ্যকুমার তার প্রাসাদশীর্ষে উঠে একদিন দেখল অচিরবতীর জল নেমে গেছে। জলের বর্ণ মুকুরের মতো। একটি বলাক বহুক্ষণ ধৈর্য ধরে নদীতীরে দাঁড়িয়ে আছে। দেখলে মনে হয় বুঝি চিত্র। সুনীল আকাশ, গাঢ় শ্যামবর্ণ বৃক্ষগুল্মাদি, দর্পণসম নদীজলধারা এবং তার তীরে ওই শুভ্র বলাক সবই চিত্র। কেউ লিখেছে চিত্রটি। তার হঠাৎ মনে হল সে নিজেও হয়ত চিত্র। ওপর থেকে, কিংবা নিচ থেকে, কিংবা বাম অথবা দক্ষিণ পার্শ্ব থেকে কেউ, কোনও মহাচিত্রকর তাদের সবাইকে লিখে এখন সাগ্রহে পর্যবেক্ষণ করছেন। বর্ণগুলি সঠিক হয়েছে কিনা, রেখাগুলি কেমন বিন্যস্ত হল দেখছেন। সে নিজের দিকে চাইল। নিম্নাঙ্গে পাটলবর্ণের অধোবাস, উপবীতের একাংশ কৃষ্ণসার চর্মের কটিবন্ধনীর ওপর পড়েছে। তার পদপল্লব দুটি চন্দনকাঠের উপানতের মতো শোভা পাচ্ছে। —ভালো লিখেছেন। সে মনে মনে বলল। বলবার সঙ্গে সঙ্গে তার সর্বাঙ্গে রোমহর্ষ হল। জীবন কি এইরূপ চিত্র? চিত্রের ভেতরে চিত্রের ভেতরে… কে লিখেছেন? বিরাট আকাশ তার ওপরে। অচিরবতী-তীরের এই চিত্রের ওপরে নত হয়ে পড়েছে। দিগন্ত পরিপ্লাবী অপরাহ্ণের আলো। সে নিস্পন্দ হয়ে সেই আলো মেখে রোমহর্ষ গায়ে দাঁড়িয়ে রইল। ঠিক যেন মহাচিত্রকরের তুলিকার একটি নিপুণ টান তার ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, তাকে দৃঢ়বদ্ধ করে রেখেছে আপাতত।
তাহলে কি সবই নির্ভর করছে সেই চিত্রকরের ইচ্ছার ওপর? তিষ্য কি সেই মহাতুলিকার টানে টানেই সাকেত থেকে রাজগৃহ, রাজগৃহ থেকে শ্রাবন্তী ছুটছে? সমস্তই কি পূর্ব থেকেই স্থিরীকৃত নাকি! সে প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজেকে এই চিন্তার বন্ধন থেকে মুক্ত করল। হঠাৎ তার মনটা হু-হু করতে লাগল। সকলেরই কেউ-না-কেউ আছে যার সঙ্গে পরামর্শ করা যায়, ক্লান্তি হলে যার সঙ্গে চিন্তাভার, কর্মভার ভুলে থাকা যায় কিছুক্ষণ। সে নিজের কর্মক্ষে এসে একটি লিপি লিখন—
ভদ্দ লোকপাল,
সাহেট গামের গামভোজকের মতির ওপর সব নির্ভর করছে। আমার বান্ধবই একমাত্র আশা। সাহেট-গামেই ধরুন একটি আপণ আরম্ভ করি। এখানে পণ্য কিছুটা বিকোলে, পরের গাম বেসর। কাছাকাছি গামগুলিতে আপণ না সাজিয়ে দূরান্তরে যাওয়া বিষয়ে আপনি কী বলেন? এত বিলম্ব দেখে ব্যস্ত না হন তাই। আপনাদের সকলের সংবাদ বিষয়ে উদ্বিগ্ন। আপনার সহচর— সাকেতক।
লিপিটি কাঠের দুটি পাতের মধ্যে রেখে সে সূত্রগুচ্ছ দিয়ে সেটিকে বাঁধল। সে এবার চলল জেতবনে। জেতবনপ্রান্তে ঘোড়া বাঁধতে বাঁধতে সে দেখতে পেল বিশাখার শিবিকা আসছে। তিষ্য বড় বড় কয়েকটি পদক্ষেপে সেখান থেকে সরে গেল। একটি বিরাট অশ্বত্থ গাছ। সে তার কাণ্ডে পিঠ রেখে বসে রইল। শিবিকার অভিমুখ থেকে পেছন ফিরে। বসে বসেই সে বুঝতে পারল শুধু শিবিকাই নয়, আরও আসছে গাধার পিঠে, অশ্বতরের পিঠে নানা দ্রব্য। বিশাখা সঙ্ঘকে দান দিচ্ছে। ভালো বিশাখা, দাও। দান করার ভাগ্য নিয়ে জন্মেছ, সেই চিত্রকর তোমায় দাত্রী করেই এঁকেছেন, অতএব দাও। বর্ষান্ত-চীবর দিচ্ছো বোধহয়! পংসুকুল (ধুলোমাখা ফেলে দেওয়া বস্ত্র) থেকে সাধারণত চীবর প্রস্তুত করেন শ্রমণরা। বর্ষায় তা টেকে না। তাই বিশাখা বর্ষার পর নূতন চীবরের জন্য বস্ত্র দান করে। শ্রাবস্তী নগরে মিগারমাতা বিশাখার নাম ছড়িয়ে গেছে। সুন্দরী, করুণাময়ী, দানশীলা, বুদ্ধিমতী ও বীর্যবতী বলে। বিশাখা এমনই এক মণি যার দ্যুতি কখনও কোথাও লুকোনো যাবে না—এ কথা তিষ্য অনেক আগেই বুঝেছিল, সে প্রতিভাময়ী। তিষ্য মিগারমাতাকে কয়েকবার দূর থেকে দেখেছে, কিন্তু মিগারপুত্তকে আজ অবধি এখানে দেখেনি। সম্প্রতি তার কানে এসেছে মিগারপুত্ত পুন্নবর্ধন নাকি বহুদূরে বাণিজ্য করতে গেছেন, এবং এই নিয়ে বণিককুলে হাসাহাসি পড়ে গেছে। কেন না সকলেরই বিশ্বাস সে বাণিজ্যের ছল করে ভিন্ন দেশে সংগীত-বাদ্য এবং গণিকার সন্ধানে গেছে। শুনে তিষ্যর প্রথমটা একটা তিক্ত আত্মপ্রসাদ হয়েছিল। ভালো বিশাখা, ভালো, তিষ্যকে প্রত্যাখ্যান করে নিজ বর্ণের অচেনা অজানা কুলপুত্রকে বরণ করাও শ্রেয় মনে করেছিলে। তোমার অত যে শক্তিধর পিতা, বুদ্ধিমতী মা, তারাও কোনও সংবাদ নেওয়া প্রয়োজন মনে করলেন না। এখন এক অযোগ্য, বারনারীতে আসক্ত, লোকের হাসির পাত্র ধনী যুবককে বিবাহ করে নিশ্চয় শান্তিতে আছো। কিন্তু পরক্ষণেই তিষ্যর মন এক অবর্ণনীয় বিষাদে ভরে গেল। বালিকা বিশাখার নিষ্পাপ মুখটি তার চোখের সামনে। ভদ্দা বলুন তিস্সকুমার, যাদুকরী বিসাখা…। হায় বিসাখা, তুমি কেমন আছো? কেমন আছো তুমি? তোমার ভালোমন্দ দেখবার অধিকার তিষ্যকে দাওনি, কিন্তু ভাববার জন্য অধিকারের প্রয়োজন তো হয় না!
তিষ্য অশ্বত্থতল ছেড়ে জেতবনে প্রবেশ করল। শ্রাবকদের ভিড়ের মধ্যে বসে সে দেখল বিশাখা তার ঘনিষ্ঠ সখীদের নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ওই বসল, শ্রমণাদের পাশে। এখান থেকে তার পার্শ্বমুখ দেখা যাচ্ছে। ভগবান তথাগত আসছেন সবাই উঠে দাঁড়াল। বিশাখা অনিমেষ লোচনে তথাগতর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ভেতরের কুটি থেকে শ্ৰমণ আনন্দ বেরোচ্ছেন। এঁকে তিষ্যর বড় ভালো লাগে। মনে হয় এঁকে সে জেতবনকুটির ভেতর থেকে শক্তিপ্রয়োগ করে বাইরে নিয়ে আসে। এভাবে বাইরে নিয়ে আসতে ইচ্ছা হয় শ্রমণ সুভদ্র, শ্ৰমণ অনঘকেও। মনে হয় বলে—নির্বাণ পরে লাভ করবেন কুমার। এখন এই জম্বুদ্বীপটিকে সুসংহত করুন তো! আপনার মতো, আপনাদের মতো কুমারদের এখন বড় প্রয়োজন। একা চণক, একা তিষ্য, একা বিম্বিসারই বা কী করতে পারেন! কুমার আনন্দ, শ্রমণ বেশ ত্যাগ করুন, আসুন, অনুনয় করছি, আসুন। তার চোখ চলে গেল আনন্দর দিকে। শ্ৰমণ আনন্দর চোখ দুটি সর্বদা যেন প্রীতি স্নেহ করুণায় ভরা। তিনি তাকিয়ে আছেন বিশাখার দিকে! তিষ্য দেখল বিশাখার চোখের পাতাগুলি ধীরে ধীরে বুজে গেল। বিশাখা কি ধ্যান করছে?
সেদিন দেখবার পর সকলে চলে গেলে, বুদ্ধ তখনও আসনে বসে আছেন। মৃদু প্রদীপ জ্বলছে। তিষ্য ধীরে ধীরে বেদীর কাছে গিয়ে বসল। সন্ধ্যার পরিচিত শব্দগুলি ধীরে ধীরে বাড়ছে। পাখিরা সব উড়ে যাচ্ছে, তাদের পাখার শব্দ, ঝিঁঝি ডাকতে আরম্ভ করেছে। নিস্তব্ধ হয়ে আসছে চরাচর। শ্ৰমণ শ্রমণারা বুদ্ধবেদীর কাছে ঘন হয়ে বসছেন। সাধারণের জন্য দেশনার কাল শেষ। এখন ভগবান শ্ৰমণ-শ্রমণাদে সঙ্গে তাদের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবেন। অন্যদের প্রবেশ যে একেবারে নিষিদ্ধ তা নয়, প্রাতিমোক্ষ বা প্রবারণার সময় তো নয়! সুতরাং তিষ্য বসেই রইল।
বুদ্ধ বললেন—সমন অনঘ!
—বলুন ভন্তে!
—তুমি নাকি উৎকণ্ঠিত হয়েছ? গত কয়েকদিন ধ্যানে মন দিতে পারোনি!
—সত্য ভন্তে।
—কারণ কী?
সোজা হয়ে বসে আছেন ভিক্ষু অনঘ। ইনি এবং এঁর সখা সুভদ্রর পূর্বজীবনের কথা দৈবরাত চণকের কাছে শুনেছে তিষ্য। সে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল। ভিক্ষু অনঘ কথা বলছেন না।
—কোনও নারী? বুদ্ধ আবার জিজ্ঞাসা করলেন।
—হ্যাঁ ভন্তে।
—কিন্তু এই নারী তো জন্ম-জন্মান্তরে তোমার তপসা ভঙ্গ করেছে, তোমাকে কুশল কর্ম থেকে নিয়ে গেছে অকুশল কর্মের দিকে। এখনও কি তুমি সতর্ক হবে না?
—কিন্তু ভন্তে এই নারী সংযমী, পুণ্যশীলা, উনি কুশল কর্মের অনুষ্ঠানই করেন, তথাগতর অতিশয় স্নেহভাগিনী
—কার কথা বলছেন সমন অনঘ!
—মিগারমাতা বিশাখা!
সমবেত ভিক্ষুদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য, ধিক্কার। তিষ্য উৎকর্ণ হয়ে রয়েছে।
বুদ্ধ বললেন—বিসাখা তো বিবাহিতা! তাকে কামনা করে তুমি অতি কুৎসিত কর্ম করেছ, তাতে কি আর সন্দেহ আছে সমন!
—ভন্তে, মনের মধ্যে যা ঘটছে তা অকপটে আপনার সামনে, এবং সমনদের সন্নিধানে বলার নির্দেশ পেয়েছি উপসম্পদা নেবার সময়ে। কারও ধিক্কারের ভয় করি না। কিন্তু আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। আমি ভদ্রা বিশাখাকে কামনা করিনি। তাঁকে দেখতে দেখতে, আমার গান্ধারে ফেলে আসা প্রিয়তমার কথা মনে পড়ে গেছে।
—সেই নারীই তাহলে তোমার পতনের কারণ ভিক্ষু অনঘ।
—না ভগবন, সত্য বলতে গেলে বলতে হয়, তিনি আমার অভ্যুদয়েরই কারণ, যদি ধম্মের শরণ নেওয়াকে অভ্যুদয় বলেন। তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বলেই আমি ঐহিক সব ব্যাপারে বীতরাগ হয়ে পড়ি। ভন্তে, আয়ুষ্মতী বিশাখাকে দেখে আমার সেই পূর্বস্মৃতি এমনভাবে জেগে উঠেছে যে, আমি ধ্যানে মন বসাতে পারছি না। আপনি আমায় সংঘ-ত্যাগ করার অনুমতি দিন।
তিষ্য হতবাক হয়ে শুনছিল। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, কে সেই নারী। কার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন অনঘ।
বুদ্ধ বললেন—যাঁর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলে, সমন, এখন কি তাঁর কাছে আদৃত হবে মনে করো?
—না, ভগবন, সে আশা নিয়ে সংঘত্যাগ করতে চাই না।
—তবে?
—ভগবন, আমার বৈরাগ্যের ভিত্তি দৃঢ় ছিল না। আমি তথাগতের অলৌকিক প্রভাবে মুগ্ধ হয়েছিলাম। স্বদেশের প্রতি, আমার পরিচিত-জনের প্রতি আমার কর্তব্যগুলিকে এড়িয়ে এসেছিলাম। সেগুলি করতে চাই। আমি বীরপুরুষ ছিলাম। আবার বীরের পথ গ্রহণ করবো।
—তিষ্য রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে দাঁড়াল।
—কিন্তু সংসার-ত্যাগের মতো বীরত্ব আর কিছুতে তো নেই সমন।
—আমি পলায়ন করেছিলাম তথাগত, আমার প্রব্রজ্যায় কোনও বীরত্ব ছিল না। যেদিন কর্মত্যাগ করবার সত্য প্রেরণা পাবো, আবার সংঘের দুয়ারে আসবো।
—তোমাকে সংঘ-ত্যাগ করার অনুমতি দিলাম অনঘ। তথাগত আসন ত্যাগ করলেন। এতো সহজ? দীর্ঘদিন সংঘজীবন যাপন করে সংসারে ফিরে যেতে চাইছেন একজন চমৎকার ভিক্ষু? তথাগত অনায়াসে সে অনুমতি দিয়ে দিলেন? তবে যে লোকে বলে ইনি বড় শিষ্যলোভী?
সন্ধ্যার অন্ধকারে জেতবনের দ্বার প্রান্তে অপেক্ষা করতে লাগল তিষ্য। সামান্য পরেই দেখল দুই শ্ৰমণ আসছেন। অনঘ ও সুভদ্র। এঁদের উভয়ের কথাই সে চণকের কাছ থেকে শুনেছে। সমগ্র জেতবন বিহারে এই দুই গান্ধার শ্রমণ সবচেয়ে দীর্ঘাকৃতি। এখন, এত বছর চর্চার অভাবেও দেহ পেশীবলশূন্য হয় নি। চোখ মুখ নাসা সবই দীর্ঘ। শ্ৰমণ সুভদ্রর মুখে সামান্য মধ্যদেশীয় পেলবতা থাকলেও শ্রমণ অনঘর মধ্যে এমনই একটা পৌরুষ, বীরতা, যার মধ্যে কোমলতার কোনও স্থান নেই। তাই বলে তিনি ক্রূরদর্শন নন!
অনঘ বললেন—সুভদ্র, বিদায় ভাই।
অনঘ আমার অনুমান… না অনুমানের কথা এখন বলব না। তবে তুমি শীঘ্রই সংঘে ফিরে আসবে।
—কখনও না সুভদ্র। চণক আমাদের কিছু কর্মভার দিয়েছিল। আমরা তা যথাযথ সম্পন্ন করিনি। তোমার কি মনে পড়ে না সুভদ্র, তক্ষশিলায় আমরা তিন বন্ধু কীভাবে দিনের পর দিন জম্বুদ্বীপ সংহত করার কল্পনা নিয়ে, রাজ-চক্রবর্তী সন্ধানের স্বপ্ন নিয়ে কাটিয়েছি! সেই সব কল্পনা, স্বপ্ন সত্য করার জন্য সেদিন আমরা প্রাণ দিতে পারতাম। কিন্তু সুভদ্র প্রাণ তো তুচ্ছ কথা, যে কোনও শস্ত্রবীর প্রাণ দিতে এবং নিতে সবসময়ে প্রস্তুত থাকে। প্রকৃত কথা মন। মন দিয়ে, সমস্ত চিত্ত দিয়ে, মস্তিষ্কের সমস্ত শক্তি দিয়ে, হৃদয়ের সমস্ত সংবেদন দিয়ে এই জম্বুদ্বীপকে তার অপরূপ, মহিমময় সৌন্দর্য সমেত রক্ষা করা, আরও সুষ্ঠু, সুন্দর করা মনুষ্যপ্রবর্তিত নিয়মগুলি, সংস্কারগুলি। এই মহা গম্ভীর কাজ থেকে আমরা অন্যায়ভাবে সরে এসেছিলাম। সুভদ্র, তোমাকে বোঝাতে পারিনি, কেন তা জানি না, কিন্তু আমি আরদ্ধ কাজ আবার কাঁধে তুলে নেবো।
—অনঘ, তুমি আমাকে যা বোঝাবার চেষ্টা করেছ, আমি বুঝেছি। কিন্তু আমার সামনে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ এখন একটি, মাত্র একটিই কালবিন্দু বলে প্রতীয়মান হয়। জন্ম-মরণ, ধ্বংস-নির্মাণ সবই একসঙ্গে ঘটছে বলে দেখতে পাই। আমি কেমন করে তোমাকে বোঝাবো, আমরা রাজ-চক্রবর্তী পেলাম কি পেলাম না, তাতে মহাকালের কিছু যায় আসে না। জম্বুদ্বীপ ধ্বংস হলেই বা কী? না হলেই বা কী! এই ধ্বংস হবেই। আবার নতুন জন্ম, অভ্যুত্থান এ-ও ঘটবেই।
—বলো না। আর বলো না সুভদ্র, আমি তোমাকে আর বোঝাবার চেষ্টা করবো না। আমাদের পথ এতদিনে সত্যই স্বতন্ত্র হয়ে গেল।
অনঘ একবারও পেছন না ফিরে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে আসতে থাকলেন। তিষ্য যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেই বৃক্ষটিও পার হয়ে গেলেন, সুভদ্র বিহারের অভিমুখে ফিরে যাচ্ছেন। তিষ্য এগিয়ে গিয়ে অনঘর কাঁধ স্পর্শ করল।
—কে?
—আমি সাকেতক তিষ্য, এখানে সকলে আমাকে পাঞ্চাল বলে জানে। আমি মহারাজ বিম্বিসারের প্রতিনিধি, কাত্যায়ন দৈবরাতের স্নেহভাজন বন্ধু।
—বিপুল বিস্ময়ভরে অনঘ থমকে দাঁড়ালেন— আপনি…আপনি চণক— চণককে চেনেন? সে এখন কোথায়?
—আগে বন্ধুত্বের অঙ্গীকার করুন ভদ্র অনঘ।
—নিশ্চয়! চণকের স্নেহভাজন যে, সে অনঘরও স্নেহভাজন। আপনি আমার বন্ধু। অনঘ তিষ্যকে আলিঙ্গন করলেন। চণক কোথায়?
—সম্ভবত পূর্বদেশে। মাঝে মাঝে সংবাদ দেবার জন্য রাজগৃহে আসারও কথা।
—কী ব্যাপার বলুন তো? কিসের সংবাদ?
তিষ্য বলল, আপনি আমার গৃহে চলুন, সব বলবো।
অর্ধরাত্র পর্যন্ত দুজনের মধ্যে নানা কথা হল। তিষ্য বলল শুধু চণকের সংকল্পের কথা, মহারাজ বিম্বিসারের আদর্শের কথা। অন্য কথাগুলি সাবধানে গোপন রাখল। অনঘ শুনতে শুনতে মাথা নাড়তে লাগলেন। অবশেষে বললেন—আমি আপনার কথামতো রাজগৃহে যাবো, কিন্তু চণকের সঙ্গে যদি দেখা না হয়, ফিরে যাবো গান্ধারে। পাঞ্চাল তিষ্য আপনি কি গান্ধারের সাম্প্রতিক সংবাদ জানেন?
—না। শুনিনি কিছু।
—শ্রেষ্ঠী মিগারের পুত্র সার্থ নিয়ে পশ্চিমে গিয়েছিলেন। তিনি সংবাদ এনেছেন তক্ষশিলার পথে পথে নাকি পার্স বীরপুরুষদের ঘুরে ফিরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। তিষ্যকুমার, এই সংবাদের গুরুত্ব কেউ বোঝে না। আক্রান্ত হলে প্রথম আক্রান্ত হবে গান্ধার, আমার মাতৃভূমি। আপনি যদি পারেন, আপনাদের কল্পনার এই রাজসংঘকে সত্বর কার্যকর করে তুলুন। যাতে জম্বুদ্বীপের রাজগণ গান্ধারের পেছনে একটি দুর্ভেদ্য সৈন্যপ্রাচীর নির্মাণ করতে পারেন। আমি কাল প্রত্যূষেই রাজগৃহ যাত্রা করবো।
তিষ্য তার লিপিটি অনঘকে দিল। দিল আরও একটি পরিচয়পত্র মহারাজ বিম্বিসারের কাছে। মগধরাজ্যের পক্ষ থেকে ভদ্র অনঘকে প্রাথমিক বেশ-বাস, শস্ত্র, যান ইত্যাদিও দিল সে। পরদিন আলো ফোটবার আগেই অনঘ দ্রুতগামী অশ্বে রাজগৃহের দিকে যাত্রা করলেন।
আচিরবতীর তীর থেকে সোজা উত্তরপথের দিকে চলে গেলেন অনঘ! তিষ্য দাঁড়িয়ে রইল। নদীজলে তার অস্পষ্ট ছায়া পড়েছে। তিষ্যর মনে হল, সে-ই একটি বলাক। দীর্ঘদিন ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার সংকল্প সিদ্ধ হবে কী, হলে তা কবে? আর কত দিন?
১২
রাজগৃহে ফিরে একটি অপ্রত্যাশিত সংবাদ শুনলেন চণক। তখনও তিনি নগরে প্রবেশ করেননি। সবে পূর্ব তোরণের প্রান্তে এসে পৌঁছেছেন। বহুক্ষণ একটানা ছুটে এসে চিত্তক ক্লান্ত। তিনি তাকে ইতস্তত চরতে দিয়ে তোরণের কাছে যে প্রপাটি ছিল, সেখানে আকণ্ঠ জল পান করলেন। রাজগৃহের নাগর-চরিত্র এখনই স্ফুট হতে আরম্ভ করেছে। বহুবর্ণ বেশবাস পরে কিছু কুলপুত্র ঘোড়া ছুটিয়ে তোরণের মধ্য দিয়ে চলে গেলেন। একটি রথ গেল, দু-তিন-জন রমণী হেসে কিছু বলতে বলতে পার হয়ে গেলেন। রথটি মোটেই প্রতিচ্ছন্ন নয়। সূর্য প্রায় মধ্যগগন পার হয়ে গেছে। কিন্তু রথচক্রের ঘর্ঘর শব্দ মাঝে মাঝেই কানে আসছে। দুজন আপণিক প্রপায় জল পান করার জন্য থেমেছে।
প্রথম জন বলল—দ্বিগুণ তৈল দিয়ে গুড়ের মূল্ল দিতে চাইলাম, তা কস্সক কিছুতেই তা বিকোল না। বলে কহাপন দাও। এক দ্রোণ গুড়ের জন্য সাতাশটি কহাপন চায়। এখন কহাপণ ঠিক সাতাশটিই হবে তার চেয়ে অল্প বা অধিক হবে না তাই বা কে তাকে ঠিক করে দিলে বলো তো?
দ্বিতীয় আপণিক বলল—তা শেষ পর্যন্ত কী হল? দিলে?
—না দিয়ে করি কী বলো? ঘরের জন্যেই গুড়ের প্রয়োজন ছিল। তিন চার প্রকার চিহ্ন রয়েছে কহাপনগুলিতে। দেখো তো ভালো করে।
কটিবন্ধের তলা থেকে একটি ছোট স্থবিকা বার করে লোকটি কহাপনগুলি অন্য আপণিকটির হাতে ঢেলে দিল।
চণক তোরণের দিকে যেতে যেতে শুনলেন, আপণিকরা বলাবলি করছে—কহাপনগুলি এমন চতুষ্কোণ করে যে কেন! গোলাকার করলে অনেক ভালো হত …
একটি প্রহরী অপরদের বলছিল—গতকাল ঋতু-উৎসবে গিয়েছিলে?
—না ভাই। ছুটির দিন। ভালো করে নিদ্রা দিয়ে নিলাম।
—নতুন একজন নটী অভিষিক্ত হলেন।
—তাই নাকি? কেন সালবতী কি বৃদ্ধা হয়ে গেলেন না কি? তাঁর কন্যা শ্রীমতী বুঝি নগর-নটী পদ পেলেন না!
—না ভাই, ব্যাপার-স্যাপার একটু অন্য প্রকার। এই নটী গান্ধারের। বহু দেশের নৃত্য ও সঙ্গীতকলা জানেন নাকি! ঋতু-উৎসবে এঁর নৃত্য যা দেখলাম—ওরূপ পূর্বে কখনও দেখিনি। নৃত্য না মলয় সমীরের দীর্ঘশ্বাস! বুঝলাম না। এমন পাক দিচ্ছিলেন, অঙ্গের শ্বেত বসন ও উত্তরীয়গুলি বাতাসে বিভিন্ন আকার নিচ্ছিল, অতি দ্রুত। মানুষটিকে অলঙ্কারের ঝিকিমিকি, আর গাত্রবর্ণের ঝিলিক ছাড়া ভালো করে দেখাই গেল না। বংশীধ্বনি আর নূপুরের নিক্কণ ছিল সঙ্গে। সে-ও যেন কেমন রহস্যমন্থর, কখনও শোনা যায়, কখনও শোনা যায় না, যেন কতদূর থেকে ভেসে আসছে … অতি অদ্ভুত। এই দ্যাখো আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে।
চণক দ্রুত ঘোড়া ছোটালেন। পরিচিত প্রিয় পথগুলি। মনে হচ্ছে এই পথধূলির প্রতি রেণুতে তার অস্তিত্ব মিশে আছে। দু’ধারে বৈভার ও বৈপুল্ল। বৈভারের অনুদেশে আজীবিক তীর্থিকদের ভিড়। শিবিকা চড়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কয়েকজন ওপরে ওঠার উপক্রম করছেন। সম্ভবত রোগী। তপোদারামগুলিতে যাচ্ছেন। ক্রমেই পথের দুধারে জাম গাছ বেড়ে উঠছে। ঘন ছায়াময় গাছগুলি। গান্ধারভবনের কাননটি দেখা যাচ্ছে। চণকের ভেতরে একটা উচ্ছ্বাস-উল্লাস ফেটে বেরোতে চাইছে। তক্ষশিলার কুটিরের থেকেও এই গান্ধার-ভবন যে কী করে তার জীবনে আরও প্রিয় আরও অন্তরঙ্গ, আপন হয়ে উঠল— চণক জানেন না।
অশ্বরক্ষক ছুটে এসে চিত্তককে ধরল। চণক নামতে নামতে জিজ্ঞাসা করলেন—তোমাদের সব কুশল তো?
বিনা বাক্যে ঘাড় নাড়ল লোকটি।
দাসী দ্বার খুলে দিল। দাসেরা পা ধোয়ার জল নিয়ে এলো। কারও হাতে উত্তরীয়, কারও হাতে পেটিকাগুলি সমর্পণ করলেন চণক, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন—সোমা, সোমা কোথায়?
উত্তর না দিয়ে মুখ নিচু করল দাসীরা।
—সোমা কোথায়?
—তিনি এখানে থাকেন না অজ্জ…
—কোথায় থাকেন?
—সপ্পসণ্ডিক পভারের কাছে নূতন ভবন হয়েছে। পুষ্পলাবী। সেইখানে।
চণক কটিবন্ধ দাসীর হাত থেকে নিয়ে নিলেন। উত্তরীয় বেঁধে নিলেন আবার। অশ্বরক্ষককে বিস্মিত করে চিত্তকের পিঠে চড়ে বসলেন, তারপর দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেলেন।
সবে রাজসভা ভঙ্গ হয়েছে। বেরিয়ে আসছেন অমাত্যরা, নগর শ্রেষ্ঠী অহিপারক, রাজসচিব বর্ষকার, মহামাত্য সুনীথ …। চণককে দেখে অবাক হয়ে থেমে গেলেন বর্ষকার—মহামান্য আচারিয়পুত্ত যে! কবে ফিরলেন!
—আজই, এখনই ভদ্র।
সুনীথকে হাতের ইঙ্গিতে ডাকলেন বর্ষকার—আচারিয়পুত্ত দৈবরাত চণকের সঙ্গে পরিচিত হও সুনীথ। দৈবরাত, এই অমাত্য সুনীথ ক্রমশই ক্ষুদ্রতর পদ থেকে উচ্চতর পদ পাচ্ছেন নিজ প্রতিভাবলে।
চণক নমস্কার জানালেন। তখনও সভাকক্ষ থেকে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসছেন কুমার অভয়, বিমল কৌণ্ডিন্য ….
চণককে এক পাশে সরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বর্ষকার বললেন— আপনি নিশ্চয়ই রাজদর্শন করতে উৎসুক রয়েছেন। কিন্তু মহারাজ এইমাত্র অন্তঃপুরে গেলেন, এখন হয়ত স্নানকক্ষে ঢুকেছেন, দেখা পেতে বিলম্ব হবে। ততক্ষণ আমরা অতিথিশালার ভক্তগৃহে একটু বসি না!
চণক ভেতরে ভেতরে অধীর হয়েছিলেন। তাঁর এখন মনে পড়ল গান্ধারভবনের শূন্য কক্ষগুলি, দাস-দাসী-অশ্বরক্ষক-গোপাল-সূত—সবাই আছে। তাঁর যত্নের অভাব হবে না। নিজের নিভৃত কক্ষে বহুকাল পরে বিলাস শয়নে শুতে পারবেন। হয়ত নিদ্রা আসবে। যেন নিদ্রা একমাত্র নিজগৃহে নিজশয্যাতেই আসে। কিন্তু অঙ্গহীন মনুষ্যদেহের মতো সোমাহীন গান্ধারভবন কেমন কুশ্রী। যে শান্তির আশ্বাস নিয়ে তিনি ওই ভবনে প্রবেশ করছিলেন, তা কি পাবেন? তাঁর দারুণ ক্রোধ আসছে। মহারাজের ওপর, সোমার ওপর, তিষ্যকুমারের ওপর, সব শেষে নিজের ওপর। এখনই ভেঙে দিতে ইচ্ছে করছে এই বৃহৎ অলিন্দের স্তম্ভগুলি। কাননটি ছিন্নভিন্ন করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু না, তিনি বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করতে লাগলেন। তিক্ত ভৈষজ খাওয়ার মতো গিলে নিলেন ক্রোধ, তবু চোখদুটি ঈষৎ আরক্ত হয়ে রইল। কপালে ভ্রূকুটি। দেহের বর্ণ সামান্য পাণ্ডুর। বর্ষকার বললেন—দৈবরাত কি একটু অসুস্থ?
চণক প্রথমে উত্তর দিলেন না। একটু পরে বললেন—বহু দূর থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছি। গত পনের যোজনের মধ্যে বিশ্রাম নিইনি।
—ও তাই। আপনি কি সোজা রাজপুরীতেই আসছেন?
—হ্যাঁ।
—এত তাড়া করছিলেন… কোনও বিশেষ কাজ…
—মহামান্য বর্ষকার, আপনি কি কখনও দূরদেশে গেছেন? গেলে জানতেন নিজদেশ যতই কাছে এগিয়ে আসে, অধৈর্য ততই বেড়ে যায়!
—ও, কিন্তু দৈবরাত, রাজগৃহ তো আপনার স্বদেশ নয়? আপনি তো তক্ষশি …
বর্ষকারের কথা শেষ হল না। চণক বললেন—সমগ্র জম্বুদ্বীপই আমার স্বদেশ, স্বভূমি। তবে রাজগৃহের স্থান স্বতন্ত্র। তক্ষশিলা যদি আমার প্রথম গৃহ হয়, দ্বিতীয় গৃহ তবে এই নগরী। আপনার তাতে আপত্তি আছে, সচিববর?
বর্ষকার হেসে ফেললেন—না, না, বিন্দুমাত্র না। রাজগৃহকে অনেকেই বিশেষ ভালোবাসে। কিন্তু আপনার তো এখানে তেমন কোনও স্বজন …
বর্ষকার কথা শেষ করলেন না। এই অমাত্য ভালো করে হাসতে পারেন না। এবং কথা শেষ না করার একটি অস্বস্তিকর মুদ্রাদোষ এঁর। কিন্তু চণক এঁর প্রশ্নের উত্তর দেবার কোনও চেষ্টাই করলেন না।
ভক্তগৃহে পোঁছে বর্ষকার সবার হাত মুখ ধোয়ার জল দিতে আদেশ করলেন। রাজ-অতিথি এখন বিশেষ কেউ নেই তাই ভক্তগৃহটি প্রায় শূন্যই ছিল। এঁরা যেতে দাস-দাসীদের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে গেল। বিশেষ করে চণককে এরা অনেকেই চেনে, ভালবাসে, বহুদিন পর তাঁকে দেখে তাদের মুখে ঔৎসুক্য, আনন্দ, আগ্রহ ফুটে উঠতে লাগল। রাজ-অমাত্যদের উপস্থিতির জন্য কেউ তেমন কিছু বলতে পারল না। কিন্তু তাদের হাসি-হাসি চোখগুলি চণককে অনেক কিছু বলতে লাগল যেন। তাঁকে ঘিরে একটি উচ্ছল আনন্দের বলয় প্রস্তুত হয়েছে। ধীরে ধীরে চণকের ভেতরের অস্বস্তি চলে যাচ্ছে। তার কপালে ভ্রূকুটি মিলিয়ে গেল। তিনি বললেন—মহামাত্য সুনীথ কী কাজের ভার পেয়েছেন?
সুনীথ বললেন—সহসচিব। বৈদেশিক ব্যাপারের উপদেষ্টা।
দাস-দাসীরা ভোজ্যবস্তু সামনে এনে রাখতে লাগল। বৰ্ষকার বললেন—মহামান্য দৈবরাত, শুধু মহারাজ বিম্বিসার নয়, তাঁর অমাত্যরাও গুণের আদর করতে জানে। আমার মতে, সুনীথ যে পদ পেয়েছেন, সুনীথ কিছু মনে করবেন না, আচারিয়পুত্ত সেই পদ গ্রহণ করলে তার চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারত না। তিনি বহুভ্ৰমী, বহুদর্শী মানুষ, এই বয়সেই সমগ্র উদীচী-প্রতীচী তাঁর ঘোরা, এখন আবার প্রাচী থেকে ঘুরে এলেন। আমরা এখনও মহারাজকে অনুরোধ করে মহামান্য চণকের জন্য উপযুক্ত অমাত্য-পদের ব্যবস্থা করতে পারি। তিনি যখন রাজগৃহকে নিজভৃমি বলে মনে করেন, তখন তিনি আমাদের নিজেদের লোক।
চণকের মনে হল এই অমাত্য তাঁর ভেতর থেকে কথা বার করে নিতে চাইছেন। তিনি এখনও এঁদের কাছে রহস্যবিশেষ। রাজনীতির লোকেরা রহস্য ভালোবাসে না। অন্য সময় হলে তিনি এঁদের সঙ্গে বুদ্ধির খেলা, কথার খেলায় মাততেন, কিংবা সোজাসুজি নিজের সংকল্পের কথা বলতেন। কিছুটা কার্যসিদ্ধি হয়ে যাবার পর এখন আর অত গোপনতায় কাজ কী: কিন্তু আজ মন বিকল হয়ে রয়েছে।
সুনীথ বললেন—আপনার সম্মানে আজ আমরা অতিথিশালার অন্নগ্রহণ করছি। বিশেষ কিছু খাবেন, বলুন?
সুরাপাত্র এসে গিয়েছিল। তুলে নিতে নিতে চণক বললেন—না। তার চোখ অন্যমনস্ক। বর্ষকার এবং সুনীথ দৃষ্টি বিনিময় করলেন।
হঠাৎ বর্ষকার বললেন—শুনেছি আপনি রাজনীতির ওপর একখানি শাস্ত্র লিখছেন!
—হ্যাঁ, আমার পিতা আরম্ভ করে গিয়েছিলেন।
—কিন্তু যে ধর্মসূত্রগুলি প্রচলিত আছে, তার ওপর …
—হ্যাঁ, মানব, বাশিষ্ঠ ধর্মসূত্র রয়েছে। কিন্তু এগুলি প্রধানত নীতিশাস্ত্র। তাছাড়া মহামাত্র, জগৎ, সমাজ সর্বদাই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। কোনও শাস্ত্রই কি সর্বকালের সমস্যার কথা বলতে পারে?
—আপনাদের শাস্ত্রও তা পারবে না।
—পারবে না। কিন্তু মহামাত্র, এতকাল, আমাদের প্রাচীন শাস্ত্র নিয়ে চলেছে। এখন সর্ব বিষয়ে একটা বিপুল পরিবর্তন আসছে। ভাবতে পারেন বেদকথিত আচার-আচরণও পুরনো ও বর্জনীয় হয়ে যাচ্ছে? এ-কথা কি কিছুকাল আগেও ভাবতে পারা গেছে? গৌতম বুদ্ধ বা জিন নাতপুত্র এঁদের যে মতবাদ তা কি একেবারেই নতুন, বৈপ্লবিক নয়?
সুনীথ বললেন—কিসে নতুন; শুধু যজ্ঞটুকুই মানছেন না। ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব মানছেন না। বা ব্রাহ্মণের সংজ্ঞা নির্ণয় করছেন গুণকর্ম বিচার করে।
—যজ্ঞ না মানাই তো অনেক, সমাজের ভিত্তিটাই তো পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। ধরুন অত যে ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক সবই তো যজ্ঞ না থাকলে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
—দৈবরাত কি বুদ্ধমার্গ নিয়েছেন না কী?
—না, চণক বললেন।
—কী জানি! এ কথা সত্য কি না! আমাদের মহারাজকে জিজ্ঞাসা করলেও বলেন— না। কিন্তু কার্যকালে দেখি বুদ্ধনীতি অনুসৃত হচ্ছে।
—যেমন?—চণক চোখ তুলে বললেন।
—এই কঠোর দণ্ড দিতে মহারাজ ইতস্তত করছেন। ব্রাহ্মণরা যজ্ঞ করলে অসন্তুষ্ট হচ্ছেন। সর্বোপরি … বর্ষকার থেমে গেলেন।
চণক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। কিন্তু বর্ষকার কথা ঘুরিয়ে ফেললেন। মিষ্টান্নের পাত্র বাঁ হাত দিয়ে সামান্য সরিয়ে রেখে চণক বললেন—অমাত্যবর, কথা যখন আরম্ভ করবেন তখন তা শেষও করবেন, নইলে শ্রোতার মনে হতে পারে, আপনি তাকে সংশয়ের চোখে দেখছেন। নিজেকে কারও অবিশ্বাসের পাত্র মনে করতে কারই বা ভালো লাগে!
বর্ষকার ধূর্ত চোখে তার দিকে চেয়ে হাসলেন, বললেন—রাজনীতিতে সংশয় ক্ষমার্হ। আপনার শাস্ত্র এ বিষয়ে কী বলে?
—আমি রাজশাস্ত্রের প্রণেতা হতে পারি, কিন্তু তা ছাড়াও আমি চণক নামে একজন যুবা, সাধারণ আলাপেও আগ্রহী। আর আপনি অমাত্য—কিন্তু শয়নে, স্বপনে জাগরণে সব সময়েই যদি অমাত্য থাকেন, তাহলে আপনাকে করুণা করা ছাড়া উপায় কী?—বলে চণক ভালো করে ওষ্ঠাধর বিস্তৃত করে হাসলেন যাতে তার কথার রূঢ়তাটুকু তরল হয়ে যায়।
পশ্চিম বনশ্রেণীর ওপারে সূর্য অস্তোন্মুখ। বনভূমিতে, পাহাড়গুলির শীর্ষে শীর্ষে আরক্তিম আলো ছড়িয়ে পড়ছে। সেই আলো প্রবেশ করছে নগরনটী জিতসোমার প্রাসাদ ‘পুষ্পলাবী’র পশ্চিম গবাক্ষ দিয়েও। এটিই জিতসোমার প্রসাধনকক্ষ। সে ওই গোধূলির আলোর দিকে তাকিয়ে বলল—এই আলোর মতো ত্বকের বর্ণ করে দে আমার শকুলা! অতি শুভ্রতা যেন বোঝা না যায়। শুধু মুখটি বাদ দিবি। নিত্য নতুন নৃত্যের পরিকল্পনা করছে সে। প্রতি নাচের জন্য স্বতন্ত্র সাজও।
দ্বারের কাছে দাসী এসে বলল—মহারাজ এসেছেন।
হাত থেকে মুকুর ভুমিতে রেখে উঠে দাঁড়াল জিতসোমা। নৃত্যগীত সভা আরম্ভ হবার কিছু আগে মহারাজ আসলে বুঝতে হবে কোনও বিশেষ সংবাদ আছে। তার নিজেরও কিছু কথা সঞ্চয় হয়েছে। তার বেশ এখন অম্পূর্ণ, প্রসাধনও অসমাপ্ত। দেহের ত্বক গোধূলির বর্ণ পেয়েছে। কিন্তু মুখসমেত কণ্ঠটি এখনও কেতকী পাম্পের মতো শুভ্র। লোধ্ররেণুতে ভ্রূ চোখের পাতা ঢেকে আছে। সেগুলি তুলিকা দিয়ে পরিষ্কার করে নিল সে। পাটল বর্ণের উত্তরীয় দিয়ে গলা কান, মাথা ঢেকে নিল। তারপর সভাকক্ষের পাশে বিশ্রাম কক্ষের দিকে চলে গেল।
ঢুকেই চিত্রার্পিত হয়ে গেল জিতসোমা। মহারাজ বিম্বিসারের পাশে চণক। সে তখুনি বেরিয়ে আসছিল, বিম্বিসার গম্ভীর স্বরে ডাকলেন—যেও না জিতসোমা, দাঁড়াও।
জিতসোমা পেছন ফিরেই বলল—মহারাজ, আপনি চুক্তিভঙ্গ করেছেন। আপনার সঙ্গে আমার কোনও গোপনতার সম্পর্ক থাকবে না এমনই কথা ছিল। আপনি যে আজ একা আসেননি একথা না জানালে চুক্তিভঙ্গ দোষ হয়।
—ঠিক আছে। মেনে নিলাম। এই যুবাকে তুমি শুধু বুঝিয়ে বলো তুমি যা করছো তা প্রকৃত পক্ষে কী? কেন? এবং তা তোমার স্বাধীন ইচ্ছার ফল কিনা। নইলে এ যুবক হয়ত আমায় বা হত্যাই করে?
—মহারাজ কবে থেকে শাস্ত্রবিৎ পণ্ডিতের বীরত্বকে ভয় পেতে আরম্ভ করলেন?
এই যুবা শুধু বীর নয়, কুশলীও। তার ওপর আবার সখা। হৃদ্যতাটুকু ফিরিয়ে নেবে ভয় দেখাচ্ছে। মহারাজ ঈষৎ তরল কন্ঠে বললেন।
—আজ নৃত্য-সভার পর যা বলবার বলবেন। এখন আমি ব্যস্ত আছি। —সোমা একবারও দুই অতিথির মুখোমুখি হল না,—চলে গেল।
বিম্বিসার বললেন—শান্ত হও। শান্ত হও চণক। কোনও নগরনটী কি এইভাবে রাজাজ্ঞা উপেক্ষা করতে পারে? দেখো, বোঝো, চণক।
—কোনও অমাত্যই কি তা পারে মহারাজ?
—না তা অবশ্য পারে না। কিন্তু সে অমাত্য যদি হয় রাজার অতি প্রিয় …
—প্রণয়ভাগিনী?
—ধিক্—চণক, আমি কনিষ্ঠা ভগ্নী অথবা কন্যার কথা ভাবছিলাম।
জিতসোমা নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। চণক, চণক, জেট্ঠ চণক! কত কাল ধরে সে এই দিনটির, এই মুহূর্তটির প্রতীক্ষা করছে! জেট্ঠ বহুদিন বোধহয় ক্ষৌরকার্য করেননি। মুখময় অযত্নবর্ধিত শ্মশ্রু, পোশাকও ধূলিমলিন। সে তার কার্যনির্বাহক প্রধান দাস ধ্রুবকে ডেকে বলল—নহাপিত ডাকো। অতিথি কক্ষে মহারাজের সঙ্গে যে ব্যক্তি বসে আছেন তাকে স্নানাগারে নিয়ে পরিচ্ছন্ন করে দাও। সোনার কাজ করা একজোড়া বস্ত্র বার করে দিল সে—এইগুলি পরাবে। গন্ধ, মাল্য কিছুর যেন ত্রুটি না হয়।
—কর্ত্রী আপনাকে অন্তঃপুরে ডাকছেন—
মহারাজ বললেন—যাও দৈবরাত, তোমার প্রশ্নের উত্তর হয়ত এখনই মিলবে। কিন্তু চণকের প্রশ্নের উত্তর তখনই মিলল না। স্নানাগারের সম্মুখে একটি গজদণ্ডের পীঠে বসিয়ে নহাপিত তার ক্ষৌরকর্ম করে দিল। দু’জন দাস তাকে বেত্র-শয্যায় শুইয়ে আপাদ-মস্তক—তৈলসংবাহন করে দিল। চণক আপত্তি করতে তারা শুধু বলল—এ গৃহের এরূপই নিয়ম। স্নানের পর, বহুমূল্য বসন পরতে চণক অতিশয় বিরক্ত হলেন। কিন্তু কোনও ফল হল না। দাসগুলি অম্লানমুখে বলল—এ প্রকার বসন ছাড়া কর্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা অসম্ভব!
মাল্য ধারণ করে শ্বেত উত্তরীয়ের প্রান্ত ডান হাতের ওপর গুচ্ছ করে বিন্যস্ত করে দিয়ে সুন্দর সুসজ্জিত সভাস্থলে নিয়ে গেল দাসরা। বলল—এখানেই কর্ত্রীর সঙ্গে দেখা হবে।
স্নান করে এবং অবলেপ্য মেখে চণকের শরীর স্নিগ্ধ হয়েছিল। তার ওপর বহুক্ষণ পরিশ্রমের পর এমন সেবা পেয়ে তাঁর ঘুম-ঘুম পাচ্ছিল। কিন্তু তিনি সভাগৃহের একপ্রান্তে মহারাজকে বসে থাকতে দেখলেন। পাশেই একটি আসনে চণককে আহ্বান করে বিম্বিসার বললেন—দেখা হল?
—না।
তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে মহারাজ বললেন—ভালো হয়েছে।
চণক তাঁর দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন, কিন্তু মহারাজ অন্য দিকে চেয়ে আছেন। চোখে চোখ মিলল না। একটু পরে তিনি বললেন—দৈবরাত, এই গৃহ কে পরিকল্পনা করেছেন, জানো?
চণক উত্তর দিলেন না।
—এই অপূর্ব স্থাপত্যের জন্যও আমি তোমার কাছে ঋণী। মহাগোবিন্দ-তনয়া দেবী সুমেধা এই প্রাসাদ পরিকল্পনা করেছেন।
চণকের হঠাৎ সব মনে পড়ে গেল। সে চতুর্দিকে তাকাতে লাগল। পাথরের কক্ষটি। অপূর্ব সজ্জিত। ভিত্তিচিত্রগুলি যেন এইমাত্র কেউ শেষ করে গেছে। বিম্বিসার তাঁর চোখ অনুসরণ করে বললেন—এই সব চিত্রের জন্য পশ্চিমদেশীয় সার্থদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে নানা বর্ণের রত্ন কিনেছি। চণক, দেবী সুমেধার পুত্র বোধিকুমার এই সব চিত্র লিখেছে।
চণক আর উদাসীন হয়ে বসে থাকতে পারলেন না। কী অসাধারণ ভিত্তিচিত্রগুলি। চারদিকে গজ, পদ্ম বা হরিণ দিয়ে পট্টিকা করা। মাঝখানে মৃত্তিকা মিশ্রিত চুনমের লেপন দিয়ে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে অঙ্কিত হয়েছে চিত্রগুলি। প্রথম চিত্রটিতেই গৌতম বুদ্ধ অম্ববৃক্ষতলে দেশনায় মগ্ন, সামনে রাজা রাজন্য শ্রেষ্ঠ যুবা বৃদ্ধ শ্রমণ ও শ্রমণারা। তিনি মহারাজের দিকে ফিরে বললেন—শুনেছিলাম গৌতম নিজের মূর্তি বা প্রতিকৃতি করতে অনুমতি দেন না!
বিম্বিসার বললেন—সম্প্রতি বংসরাজ উদয়ন নাকি রক্ত চন্দন কাঠ দিয়ে তাঁর একটি মৃর্তি করিয়েছেন। কোসলরাজও গোপনে চন্দনের মূর্তি করিয়েছেন। এ সকল শুনে আমিও তথাগতকে ধরে পড়ি আমাকেও অনুমতি দিতে। অনুমতি দিলেন। কিন্তু চোখ আঁকতে নিষেধ করলেন। বোধিকুমার সে নির্দেশ পালন করেছে। প্রকৃতপক্ষে চণক, তথাগত চান না তাঁর মূর্তি কেউ পূজা করে। তবে ভিত্তিচিত্র তো আর পূজার জন্য নয়!
চণক অন্যমনস্কভাবে বলে উঠলেন—তবু এঁর চিত্র, মূর্তি নির্মিত হবে। পূজা হবে। মহারাজ আমাদের জীবিতকালে দেখে যেতে পারব কি না জানি না, কিন্তু ইন্দ্র মূর্তি যেমন বর্ষায় পূজিত হয়, বুদ্ধও তেমনি পূজিত হবেন। তবে সর্ব ঋতুতে। দেখবেন, শীঘ্রই ইনি দেবত্ব পাবেন!
সহসা সভাকক্ষের মধ্যে সহস্র প্রদীপ জ্বলে উঠল। পাথরের মসৃণ প্রাচীরে ছাদে প্রতিফলিত হয়ে সেই সহস্র প্রদীপ যেন দুই সহস্র হয়ে গেল।
বিম্বিসার বললেন—চলো চণক, বসি। ওই যে নৃত্য-গীতের জন্য পীঠ দেখছ, ওইখানে দাঁড়িয়ে গাইলে এই বিশাল কক্ষের সর্বত্র শোনা যায় গীত। মহাগোবিন্দ-কন্যার এমনি কুশলতা।
—বলেন কী? চণক অবাক হয়ে রইলেন।
কক্ষের বারোটি প্রবেশপথ দিয়ে বহু দর্শক-শ্রোতা প্রবেশ করতে লাগলেন। পুষ্পসৌরভে ঘর ভরে গেল। ছাদের ওপর থেকে পুষ্প, সুগন্ধী জলচূর্ণ এসে পড়তে লাগল সমবেত শ্রোতাদের ওপর। চণক ওপর দিকে চেয়ে দেখলেন—ছাদের গায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্রের মতো গবাক্ষ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
গম্ভীর বজ্রনাদের মতো তিনটি ধমৎকার শোনা গেল মৃদঙ্গে। চণক মুখ ফিরিয়ে দেখলেন নৃত্য-পীঠের ওপর একটি প্রস্ফুটিত কেতকী বসে আছে। তার দীর্ঘ শ্বেত পাপড়িগুলি সম্ভবত শ্বেত দুকূল দিয়ে প্রস্তুত হয়েছে। প্রসারিত দলগুলির মধ্যে মৃদু হরিদ্রাভ বর্ণের কেশর নটীর শরীরটি। তার ওপরে একটি শুভ্র মুখ ফুটে আছে। দূরে দূরে বীণা হাতে বাদিকারা বসে আছে। একত্রে সকলে বাজাতে আরম্ভ করল। তাল-বাদ্য বাজাতে বাজাতে বাদক মাথা নাড়তে লাগল। নিস্পন্দ কেতকী যে গাইছে তা বোঝা গেল যখন একটি একটি করে বীণার ধ্বনি থেমে যেতে লাগল। চারটি বীণার স্বরের মধ্যে পঞ্চম বীণার মতো লুকিয়ে ছিল গায়িকার স্বর। ক্রমশই তা স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। ভাষা নেই, থাকলেও তা এত অল্প শব্দের যে, ভালোভাবে বোঝাই যায় না। শুধু সুর। অপূর্ব মূৰ্ছনায় তা ওপরে উঠে যায়, তারপর ঝরনার মতো ঝরঝরিয়ে পড়ে। আবার পার্বতী নদীস্রোতের মতো এঁকেবেঁকে চলে। বাষ্পের মতো হতাশ্বাসের ধ্বনিতে আবারও ওপরে উঠে যায়, ধিমিধিমি মৃদঙ্গের সঙ্গে মেঘে পরিণত হয় তারপর মুষলধারার মতো সুরধারায় নেমে আসে। কোন ঊর্ধ্বলোক থেকে যেন এই সুরবারিধারা নেমে আসছে। সমস্ত শ্রোতারা নিস্পন্দ। স্নান করছে। এই সংগীতের মধ্যে কোনও ব্যাকুলতা, আর্তি, প্রার্থনা নেই। অভিযোগ নেই, দ্রোহ নেই, অনঙ্গতাপ নেই। ঝরনার উৎপত্তি, তার জলে ক্ষুদ্র নদীস্রোতের সৃষ্টি, রৌদ্রকর থেকে মহামেঘ এবং সেই মহামেঘ থেকে তাপহরণ বারিধারা, যার ফলে একটি অপরূপ কেতকীর জন্ম হয় শুধু সুর দিয়ে গায়িকা এই প্রাকৃতিক ঘটনার সুররূপ তো দিলেনই, এই ঘটনার অসামান্য সৌন্দর্য, ব্যঞ্জনা, সমারোহময় বিস্ময় এই প্রথম যেন শ্রোতাদের ইন্দ্রিয়গ্রামে অনুভূত হল।
মৃদঙ্গ বাজছে। কেতকী কখন অদৃশ্য হয়েছে। বীণাবাদিকদের স্থানে আরও মৃদঙ্গবাদক এসে বসেছে। প্রায় বাকশক্তিহীন চণককে বিম্বিসার মৃদুস্বরে বললেন—দৈবরাত! কখনও এমন শুনেছো?
চরক নীরবে মাথা নাড়ল অল্প—না। সে শোনেনি।
বিম্বিসার বললেন—কুশলতায় এর দ্বিতীয় আমি শুনেছিলাম বহু বৎসর আগে, বৈশালীতে। কিন্তু এ গীত অন্য জাতের।
কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। শ্রেণিবদ্ধ দাসীরা সমবেত শ্রোতাদের স্ফটিক পাত্রে মৃদু সুরা দিয়ে গেল।
কোথায় একজন মৃদুস্বরে বললেন—এ কি দেবসভা!
আর-একজন অনুরূপ স্বরে বললেন—সংসারবিরাগীরা বেলুবনে না গিয়ে এখানে আসতে পারেন। দুঃখ, বিরক্তি, বৈরাগ, হিংসা, দ্বেষ, দুর্ভাবনা সবই তো এখানে দূরে চলে যায় দেখি।
কতক্ষণ এভাবে আবিষ্ট কেটেছে চণক জানে না। হঠাৎ ভেরীঘোষ হল। মৃদঙ্গগুলি একের পর এক জটিল তাল বাজাতে লাগল। তারপর সেই তালে তাল মিলিয়ে অন্তরাল থেকে লম্ফ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন এক অদ্ভুত পুরুষ। চুলগুলি চুড়া করে বাঁধা। আকৰ্ণবিস্তৃত নয়ন, কাজল দিয়ে, নীল, লোহিত বর্ণ দিয়ে স্বাভাবিক চোখগুলিকে তিনগুণ করা হয়েছে। তুলনায় ক্ষুদ্র, রক্তবর্ণ ওষ্ঠাধর। কপালে তিলক, কণ্ঠে কম্বুচিহ্ন, উদরে ত্রিবলী। গৈরিক উত্তরীয়টি যজ্ঞোপবীতের মতো ডান কাঁধ থেকে বাম-কটিতে এসে গ্রন্থিবদ্ধ হয়েছে। দুটি পা জড়িয়ে রয়েছে রক্তকাষায়। পীঠের মাঝখানে এসে এক পা তুলে তরোয়ালের মতো বাঁকিয়ে অপর পায়ের ওপর স্থাপন করে, দুই হাতে অদ্ভুত মুদ্রা করে দাঁড়ালেন পুরুষ। চোখ দুটি জ্বলছে। জ্বলছে।
মৃদঙ্গগুলি বলতে লাগল:
জ্বলজ্বলদ্ ধ্বকধ্বকদ্ ধমদ্ ধা
রুদ্রায় বসুভ্য বৌষট্ টা
অহং রুদ্রহ্হ্ রুদ্ৰো হং রৌদ্র রৌদ্র
ধ্বংসিত্বা জাগর্মি জাড্যং জাগ্রতু জাগ্রতু জাগ্র জাগর্
কেলিকলাপকুঞ্জঃ নহি ত্তা ত্তা
তুঙ্গ মৈনাকং তুণ্ডেন বিধ্যতি বিধ্যতু বিধ্যেৎ
পিনাকেন মৈনাকং
বিধ্যেৎ বিধ্যেৎ বিধ্যেৎ।
পুরুষ সর্বদিকে, সর্বকোণে, নিজের শরীরটিকে বেঁকিয়ে, ভঙ্গ করে, ত্রিভঙ্গে, দ্বিভঙ্গে, চতুর্ভঙ্গে অদ্ভুত সব হাতের আঙুলের মুদ্রার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মধ্যমাকার, কখনও বড় বড় লম্ফ দিয়ে নাচতে লাগলেন। পায়ের তলা থেকে পাটলবর্ণ, রক্তবর্ণ চূর্ণ সব নাচের তালে তালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে লাগল।
নৃত্যপীঠের প্রদীপগুলি কাদের ফুৎকারে নিবে গেল, জ্বলতে লাগল দুটি উল্কার লেলিহ আগুন। আর সেই আগুনকে পটে রেখে কৃষ্ণবর্ণ ছায়ামূর্তির অলৌকিক নাচ। স্পষ্ট কৃষ্ণরেখায় ফুটে উঠল মৃদঙ্গবাদকরা তাদের মন্ত্র ও অঙ্গভঙ্গিসমেত। উল্কাগুলি পেছন থেকে সামনে চলে এলো, দর্শক শ্রোতাদের চোখ ঝলসে দিয়ে অন্তর্হিত হল। নৃত্যপীঠ অন্ধকার, শূন্য।
দর্শক-শ্রোতারা বহুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে থেকে কখন ধীরে ধীরে চলে গেছেন, সভাগৃহ শূন্য। এখানে ওখানে এক-একটি প্রদীপ জ্বলছে শুধু। চণক বাক্যহীন, স্তব্ধ। পাশে বিম্বিসার। অনেক পরে একজন দাস এসে বিনম্র কণ্ঠে জানাল—কর্ত্রী ডাকছেন।
১৩
ভন্তে, আমি সমনাদের সবাইকে উদকসাটিকা (স্নান-বস্ত্র) দিতে চাই, ভন্তে। প্রতি বৎসর।
—কেন বিসাখা! সমনাদের সম্পৎ থাকা উচিত নয়।
—ভন্তে, অচিরবতীর জলে সমনারা নগ্ন স্নান করেন, নগরের রূপাজীবারাও তাই করে। তারা সমনাদের বিদ্রূপ করে বলে—কীই বা পার্থক্য আমাদের মধ্যে? তোমরাও নগ্নিকা, আমরাও নগ্নিকা। এসো না আমাদের আলয়ে। ভালো ভালো বসন, অলঙ্কার, ভোজ্য পাবে…ভগবন, সমনারা মুখ নিচু করে এই বিদ্রূপ সহ্য করেন। অল্পবয়স্কারা সইতে পারেন না, কেঁদে ফেলেন। আমার বড় কষ্ট হয়। নারীর জন্য সামান্য অধিক প্রয়োজন হয় প্রভু, দিতে অনুমতি করুন।
—তাই হবে বিসাখা..
এ ছাড়াও বর্ষার প্রারম্ভে বর্ষা-চীবর, অন্তে বর্ষান্ত-চীবর এবং সারা বছর আবসথ চীবর প্রদান করতে দিন ভগবন।
—তাই হবে বিসাখা।
—সমনাদের জন্য নগর প্রাচীরের কাছে নবকম্ম কুটির নিম্মান করে দেবার অনুমতি দিন ভন্তে।
বুদ্ধ মৃদু হেসে বললেন—তাই হোক বিসাখা।
নতমুখে বিশাখা জেতবনবিহার থেকে ফিরে চলেছে। তথাগত লক্ষ করেছেন অশ্রু-ছলোছল তার চোখ দুটি। একবার মাত্র বিশেষ দানের কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তারপর বিশাখা যা যা প্রার্থনা করেছে সবেতেই সম্মতি দিয়েছেন।
চলতে চলতে বিশাখার কানে এলো কিছু যুবক শ্ৰমণ আলোচনা করছেন—উপাসিকা বিসাখার করুণা বড়ই পাত্রনির্ভর। নারীদের তিনি যেরূপ করুণা করেন, সবদিক থেকে রক্ষা করেন, ভিক্ষুদের তো তেমন করেন না!
—কেন, ভিক্ষুদের জন্য ভোজের নিমন্ত্রণ তো আছে! বিসাখার আবার সন্তান জন্মালে আবার চীবর, ভৈষজ, পাত্র সব পাওয়া যাবে। শ্রমণের কণ্ঠে ক্ষুব্ধ বিদ্রূপ।
—ততদিন পংসুকুলই পরিষ্কার করো আর ব্যাধি হলে কষ্ট সহ্য করো। মরবার হলে মরে যাও। আমরা তো আর সমনা নই!
উপাসিকা বিশাখা শুনেছেন, কিন্তু অন্য মনে। চলেছেন। পাশে ধনপালী। ময়ূরী সম্প্রতি এক আপণিককে বিবাহ করেছে। তার ক্রমশই শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু তার আপণ ও ধনসম্পদ যত্ন করে দেখাশোনা করার তেমন কেউ নেই। ময়ূরীকেই সে সব করতে হয়। ময়ূরী অত্যন্ত ব্যস্ত। কহ্না, বিসাখার পিয় সহি, শ্লোকরচয়িত্রী কহ্না স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করল। মা নেই। বিসাখার অন্তরের ভেতরটা মাঝে মাঝেই একেবারে শূন্য হয়ে যায়। শিশু-ভগ্নীটির কথা মনে পড়লে তার এমন উৎকণ্ঠা হয় যে মনে হয় এখনি ছুটে সাকেত চলে যায়। সে শিশুটিকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে চেয়েছিল কিন্তু ধনঞ্জয় সম্মত হননি। এখন সেই শিশু সুজাতা গুচ্ছ গুচ্ছ চুল দুলিয়ে গাল ভরে অবোধ হাসি হাসে। পিতার ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটি মুখে পুরে সশব্দে চুষতে চুষতে ঘুমোয়। পিতার দিবারাত্রের একমাত্র সান্ত্বনা, একমাত্র আনন্দ, বেঁচে থাকার অর্থ ওই শিশু সুজাতা। তিনি কী করে সম্মত হবেন? অথচ বিশাখাকে শ্রাবস্তীতে ফিরতেই হবে। সে তো চিরকাল সাকেতে থাকতে পারে না! মিগারের ঘর-সংসার আছে, তার নিজস্ব কর্মান্ত আছে, শ্রাবস্তীতে বহু প্রকার লোককল্যাণের সঙ্গে সে জড়িত। আছে সংঘ। পশুগুলি সব উন্মুখ হয়ে তার পথ চেয়ে থাকে। বৃদ্ধ এবং রুগ্ণ পশুদের জন্য সে যে পশুচিকিৎসাভবন করেছে সেখানে পর্যন্ত বৃদ্ধ কুকুর, বৃদ্ধা গাভী বা ছাগলগুলি, রুগ্ণ অশ্ব সব বিশাখাকে না দেখতে পেলে আহার ত্যাগ করে। দিনের মধ্যে একবার অন্তত তাদের দেখা দিতে হয়। আদর করতে হয়।
প্রবেশদ্বারের কাছে শ্ৰমণ আনন্দ। তিনি আজকাল তথাগতর উপস্থায়ক হয়েছেন। তথাগতর যাবতীয় পরিচর্যার ভার তাঁরই ওপর। অনেক কাল আগে এক সময়ে গৃধ্রকূটে তিনি কিছুদিন নির্জনবাস ও ধ্যান করার অবসর পেয়েছিলেন। তারপর থেকে আনন্দ সব সময়ে তথাগতর পাশে পাশে। তথাগতর প্রতিনিধি হয়ে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন, উপদেশ দেন, দান নেন। স্নেহকরুণ নয়নে বিশাখার দিকে চাইলেন আনন্দ—
—কল্যাণি, আজ এ দীন বেশ কেন?
—সর্বত্যাগী ভিক্ষু আপনি। দীন বেশই তো আপনার মনোমত হওয়ার কথা সমন।
দীন বেশ প্রব্রাজকের। কিন্তু উপাসিকা বিসাখার যে ঐশ্বর্যশ্রী! তোমার মহালতা পসাদন কোথায় গেল কল্যাণি! মহালতা ধারণ করলে বিসাখা যে হয়ে যায় আনন্দ-ময়ূরী। এই পার্থিব প্রকৃতির অন্তরের সৌন্দর্য ও আনন্দের উৎসার শতধারায় উৎক্ষিপ্ত হতে দেখি। শতধারায়…দুই হাতের আঙুল দিয়ে শতধারায় উৎসারিত হবার প্রক্রিয়াটি করে দেখালেন শ্ৰমণ আনন্দ। তারপর কী যেন ভাবতে ভাবতে ভেতরে চলে গেলেন। সরল, পবিত্র, সহাস্য মুখটি আনন্দর। কোনও ব্যক্তিগত দুঃখ নেই, কিন্তু সবার জন্য করুণা অনুভব করেন। কোমল-হৃদয় বৎসল স্বভাবের শ্রমণ আনন্দ তাই নারীদের প্রিয়। বালকদেরও প্রিয়। আনন্দর অনুরোধেই নারীরা প্রব্রজ্যার অধিকার সংঘের অধিকার পেয়েছে। আনন্দর মধ্যস্থতাতেই ভিক্ষুদের স্থান ও ঋতুবিশেষে দুই তিন তলিকা পর্যন্ত পাদুকা পরার অনুমতি মিলেছে। ভৈষজ বলে মধু, ঘৃত, ইত্যাদি ব্যবহার করবার অনুমতি মিলেছে। আনন্দ তদগত চিত্তে তথাগতর সেবা করেন, নিজের অর্হত্ত্বর কথা চিন্তাও করেন না।
মধ্যাহ্নের খর রোদে তপ্ত নগরীর পথ। কিন্তু বিশাখা ধীর পদক্ষেপে চলেছে। ধনপালী শুধু একবার তাকাল, কিছু বলল না। সে-ও চলেছে। শিবিকা পেছন পেছন আসছে। নগরোপান্তে ভিক্ষুণী উপসয়। এখন প্রায় সকলেই ভিক্ষার্থে নগরে। শূন্য ভিক্ষুণী উপসয়ে বিশাখা কেন চলেছে ধনপালী জানে না।
উৎপলবর্ণার ঘটনা ঘটবার পর বিশাখার অনুরোধে গৌতম বুদ্ধর সম্মতিক্রমে এই উপাশ্রয় নির্মাণ করিয়ে দিয়েছেন মহারাজ প্রসেনজিৎ। জেতবনের প্রকাণ্ড দ্বারকোষ্ঠক দেখলে যেমন প্রথমেই ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে যায় চিত্ত, এই উপায়ের অনাড়ম্বর অতি সাধারণ আকৃতি দেখে তেমনি একটা হেলাফেলার ভাব আসে। এখন এখানেই অবস্থান করছেন দেবী রাহুলমাতা। কয়েকদিন রক্তাতিসারে ভোগবার পর এখনও তিনি অসুস্থ। বিশাখা জানে তিনি ভিক্ষার্থে বার হবেন না।
মৃৎবেদীতে মৃৎ-উপাধানে সংঘাটি বিছিয়ে শোন এঁরা। রাহুলমাতা বা মহাপ্রজাবতীদের মতো থেরীদের একেক সময় একেক জন সার্ধবিহারিকা বা অন্তেবাসিনী থাকে। তারা থেরীর দন্তকাষ্ঠ, মুখ ধোবার জল এনে দেওয়া থেকে ভিক্ষান্ন আনা, প্রয়োজনমতো চীবর পরিষ্কার করা ইত্যাদি সবই করে। আজ রাহুলমাতার সঙ্গিনী ভিক্ষার্থে বেরিয়েছে।
নিজের বেদীতে ধ্যানাসনে বসেছিলেন রাহুলমাতা। বিশাখা ধনপালীর সঙ্গে তাঁর সামনে গিয়ে বসতে চোখ মেললেন।
দেবি, আপনার পথ্য এনেছি। —বিশাখা তার উত্তরীয়ের আড়াল থেকে পাত্র বার করল। —গ্রহণ করুন।
—পুরাতন শালিধানের অন্ন আর রসভক্ত (মাংসের ঝোল)। সেইসঙ্গে বিশাখা ভৈষজও বার করল।
রাহুলমাতা মৃদুস্বরে বললেন—কল্যাণ, তুমি কোথা থেকে জানলে…
—শ্ৰমণ আনন্দর কাছ থেকে। গতকাল তিনি আমার গৃহ থেকে আপনার জন্য রসভক্ত নিয়ে এসেছিলেন। একেক দিন একেক জনের গৃহে যান। আমি নিষেধ করলাম। আমিই আসব নিত্য।
ধনপালী তাঁকে মুখ প্রক্ষালনের জল দিল। একটি বড় ঘর আছে, যেখানে সমবেত হয়ে ভিক্ষুণীরা নিজেদের সংগৃহীত ভিক্ষান্ন গ্রহণ করেন। অনেক কষ্টে সেই ঘরে গিয়ে বিশাখার আনা পথ্য ও ভৈষজ গ্রহণ করলেন দেবী। তারপর আবার তাদের সাহায্যেই ধীরে ধীরে এসে নিজের বেদীতে শুয়ে পড়লেন।
বিশাখা ধীরে ধীরে তাঁর চরণ সংবাহন করতে লাগল। ধনপালী মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
রাহুলমাতা দুর্বল কণ্ঠে বললেন—বিসাখা, ক্ষান্ত হও।
বিশাখা বলল—দেবি, রক্তাতিসারে সারা শরীরে বড় যন্ত্রণা হয়। আমি জানি। ভগবান তো কৃচ্ছ্র করতে বলেন না কাউকে!
রাহুলমাতা একটু হাসলেন, বললেন—যখন দীর্ঘ সাত বছর কী শীত, কী গ্রীষ্ম মৃত্তিকায় শয়ন করতাম, কেশ বাঁধতাম না, ছিন্ন চীর ব্যতীত অন্য বস্ত্র পরতাম না, দিনে একবার সামান্য আহার করতাম, তখন তা কি কৃচ্ছ্র ছিল না? কেউ কি নিষেধ করেছিল?
বিশাখা নীরব রইল।
—কল্যাণি, কপিলবস্তু থেকে মল্লভূমি পার হয়ে বজ্জিভূমি বৈশালীতে যখন পৌঁছলাম তখন চরণ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। জটাবদ্ধ কেশ নিজ হাতে কেটে ফেলেছিলাম। অনভ্যস্ত পথ হাঁটায় সমস্ত শরীরে যেন স্ফোটকের যন্ত্রণা, সংঘে প্রবেশ করবার অনুমতি পাবার আগে তিন দিন মুক্ত আকাশের তলায় পড়েছিলাম, কেউ কি নিষেধ করেছিল?
বিশাখা সসম্ভ্রমে বলল—দেবি, শুনেছি সাক্করা, কোলিয়রা আপনাকে তখন বহু উপহার দেয়। সাক্করা নিজেদের রাজ্ঞী বলে স্বীকার করে নেয়, আপনি বৈশালী যাবেন বলে সজ্জিত রথ নিয়ে আসে, আপনি কিছুই গ্রহণ করেননি।
—আমার কৃচ্ছ্র স্বেচ্ছাবৃত এই কথাই বলছ তো বিসাখা?
—তাই। আপনি কেন?…
প্রথমে কোনও উত্তর দিলেন না, অনেকক্ষণ পরে তিনি বললেন—কল্যাণি, আমার নাম জানো?
—জানি। দেবী যশোধরা।
—সমনরা কখনও সে নাম ব্যবহার করেন না। রাহুলমাতাও বলেন অতি সাবধানে, পাছে ভগবানের সঙ্গে অতীত-সম্পর্কের স্মৃতি কোথাও থেকে যায়। যেখানে উনি থাকেন, সেখানে আমার থাকার অনুমতি মেলে না। আমি তো বৈশালীতেই অধিক থাকি।…
অনেকক্ষণ পরে তিনি ধীরে ধীরে বললেন—কৃচ্ছ্র করবো না তো কী!
দেবী যশোধরা পাশ ফিরে শুলেন। ধনপালী ও বিশাখা পরস্পরের দিকে তাকাল। দেবী কি ঘুমিয়ে পড়লেন?… পা দুটি, মাথাটি কি সামান্য তপ্ত?
…আমি জানতাম উনি প্রজ্ঞার সন্ধানে যাবেন। আমি জানতাম। মাতা মহাপ্রজাবতী জানতেন। পিতা শুদ্ধোদন জানতেন।…কতদিন দুজনে এ বিষয়ে কত কথা বলাবলি করেছি… রোহিণী নদীর জল নিয়ে কথায় কথায় সাক্ক ও কোলিয়দের মধ্যে রক্তপাত! আমাদের ভালো লাগত না। একেকটি গৃহের অন্তঃপুর বহু দাস, বহু নটীতে পূর্ণ, অতিরিক্ত ভোগ, অতি বিলাসের জীবনযাপন—কত অনর্থক…জীবন মহৎ কোনও কাজের জন্য নির্দিষ্ট আছে…জীবন কী? কেন?… এই পৃথিবীই বা কেন? সবই ভাবতাম যুগ্মভাবে…সিদ্ধার্থ কেন একা গেলেন? এখনও কেন তিনি একা যাচ্ছেন? সুভগে বিসাখা— যশোধরা তো এখন ভিক্ষুণী, থেরী, যৌবন অতিক্রান্ত, থের সারিপুত্ত সঙ্গে যান, থের মোগ্গল্লান সঙ্গে যান, ভগু, কিম্বিল এরা সঙ্গে থাকে, আনন্দ সর্বত্র সঙ্গে যায়—শুধু ভিক্ষুণী। যশোধরার থেকে এত দূরত্ব রাখবেন কেন মুক্তপুরুষ?
বিশাখা দেখল দেবী যশোধরার শরীর ক্রমশই তপ্ত হয়ে উঠছে। জ্বর আসছে। সে ধনপালীকে বৈদ্য ডাকতে পাঠাল। ক্রমশই জ্ঞান হারাচ্ছেন দেবী। শরীরের বর্ণ হয়েছে রক্তিম। —রাহুল, রাহুল তুমি সঙ্গে যাও। হ্যাঁ পিতার সঙ্গে। না বচ্চ, মা যায় না। মাকে যেতে নেই। মা-ই পালন করে, পত্নী-ই বহন করে কিন্তু পত্নীই সর্বাপেক্ষা বর্জনীয়া। সর্বাপেক্ষা…। অস্ফুট স্বরে কথাগুলি বলছেন, বিশাখা অতি নিকটে বসে আছে বলে শুনতে পাচ্ছে। বৈদ্য বললেন—এই ভৈষজ খাইয়ে দাও কল্যাণি, জ্বর নেমে যাবে। বিকারের অবস্থা কেটে যাবে।
আনন্দ আসছেন ক্ষিপ্র পায়ে। —জল, জল পান করান দেবীকে, বৈদ্যবর, ভগবান বলছেন—প্রচুর জল, একটু একটু করে মিষ্ট জল খাওয়াতে হবে। জলই প্রাণ।
বিশাখা ধীরে ধীরে উঠে এলো। কোন প্রাণ? কোন প্রাণকে জল দিয়ে বাঁচাতে হবে?
সত্যকে পেতে হলে কত ত্যাগ করতে হয় ভগবন! ধনে-জনে-প্রণয়ে পরিপূর্ণ জীবনের মাঝখানে আপনাকে বিষাদে পেলো কেন? যদি মনে হয়েছিল সে জীবন সংকীর্ণ, আত্মসুখী, বৃহৎ সংসার হতে বিমুখ-বিযুক্ত তাহলে হলেন না কেন দৈবজ্ঞের গণনাফল সফল করে মহারাজাধিরাজ! সমগ্র জম্বুদ্বীপে এমন একজনও নেই যে আপনার নায়কত্ব অস্বীকার করত। তখন ওই প্রজ্ঞাবতী উদারহৃদয় ভার্যার সঙ্গে আলোচনা করে সমগ্র দেশের রাজনীতিক্ষেত্রে, সামাজিক নিয়ম-নীতির ক্ষেত্রে আনতে পারতেন অভাবিতপূর্ব পরিবর্তনসকল। আজ রাজশক্তিকে প্রভাবিত করে যেটুকু পারছেন তখন প্রত্যক্ষভাবে পারতেন তার শত গুণ। আজ ধনী শ্রেষ্ঠীদের আশ্রয় করেছেন। তখন তারাই আপনার আশ্রয় নিত। রাজাকে তো আমরা ভক্তি, সম্মান, বিশ্বাস করতেই চাই, চাই আজ্ঞাপালন করতে। কোথায় তেমন প্রজানিষ্ঠ, নির্লোভ, বুদ্ধিমান, বীর্যবান রাজা? হে ভগবন তথাগত, আপনার অলোকসামান্য শক্তি দিয়ে শুধু ভিক্ষাজীবী সৃষ্টি করে গেলেন! যা পূর্ণ ছিল তা শূন্য হয়ে যাচ্ছে। যা শূন্য আছে তা হচ্ছে শূন্যতর। বিপুল এক বিনাশ—এই-ই কি সত্য?
—ভন্তে, বিসাখাকে আমরণ সংঘে অষ্টবিধ দান দেবার অনুমতি দিন।
—সে কি বিসাখা, এই তো ক দিন আগেই ভিক্ষুণীদের জন্য কত কী দানের ব্যবস্থা করে গেলে! আবার কী? কী কী অষ্টবিধ দান শুনি?
—আমরণ পঞ্চশত ভিক্ষুর আহার দেবে বিসাখা। দেবে পীড়িত ভিক্ষুদের ঔষধ, শুশ্রূষাকারীদের পোষণ করবে, সে যে খাদ্য দেবে ভগবান তথাগত তার অংশ গ্রহণ করবেন, প্রতি বৎসর পঞ্চশত ভিক্ষুকে বর্ষাকালীন বস্ত্র ও কণ্ডুপ্রতিচ্ছাদন বস্ত্র দান করবে, সংঘে যা যা ঔষধ লাগে সবই দেবে উপরন্তু।
—বিসাখা, সংঘের সেবা সবাই করতে চান, সে ক্ষেত্রে যদি একা কাউকে এত ভার দেওয়া হয় তাহলে অন্যদের মনে ব্যথা লাগতে পারে। এত দান করতে কেন চাও বিসাখা। যশস্বিনী হবে?
—ইহলোকে যশের প্রত্যাশী নই প্রভু, পরলোকে সুখস্থিতির জন্যও উদ্বিগ্ন নই।
—তবে?
—ভগবন, বিশাখা প্রব্রজ্যা নিতে পারেনি, প্রব্রজিতের সেবা করে প্রব্রজ্যার আনন্দের অংশ পেতে চায়।
—আর?
—ভগবন, নির্বাণপদ লাভ করবার জন্য কত দেশ, কত ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার ভিন্ন বয়সের মানুষ সংঘে আশ্রয় নিচ্ছেন। সারাদিন যদি আহারের জন্য উদ্বেগে কাটে তাঁরা ধ্যান করবেন কখন? সদালোচনা করবার সময়ে, উপদেশ শোনবার সময়ে পিণ্ডপাত্রে মন পড়ে থাকবে। শ্রাবস্তীতে থাকা-কালীন তাঁদের কষ্ট এইটুকু লাঘব করতে চাই।
গৌতম হাসলেন, বললেন— তথাগত এক দিক থেকে তাদের গৃহসীমার থেকে বাইরে বার করছেন, মিগারমাতা কি আরেক দিক থেকে তাদের অন্যতর গৃহে প্রবিষ্ট করাবেন?
—ভগবন মায়ের কাজই তো তাই। তা ছাড়া আপনিই তো কৃচ্ছ্র নিষেধ করেন। দূর দেশ থেকে কত ভিক্ষু-ভিক্ষুণী সাবত্থিতে আসবেন। কিছু জানেন না, চেনেনও না। বিসাখার গৃহে তাঁদের জন্য নিশ্চিন্ত অন্ন থাকবে, থাকবে নিশিন্ত ঔষধ।
—আর?
—ভন্তে দূরদেশে কোনও ভিক্ষু মারা গেছেন সংবাদ পেলে তথাগত তাঁর প্রসঙ্গে সকৃদাগামি ফল, অনাগামি ফল ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেন। তখন বিসাখা জিজ্ঞাসা করবে ওই ভিক্ষু কখনও সাবত্থিতে এসেছিলেন কি না। যদি শোনে এসেছিলেন, তাহলে সে বুঝবে তার দেওয়া বসন তিনি পরেছিলেন, তার অন্ন তিনি গ্রহণ করেছিলেন—জানতে পারলে বিসাখার ভালো লাগবে। বড় ভালো লাগবে।
তথাগত স্মিত মুখে বললেল— তবে তাই হোক।
বৈশাখী পূর্ণিমা। বিশাখার জন্মদিন। সে চন্দন জলে স্নান করে চন্দন বর্ণের বসন পরল। তারপর পরল মহালতাপসাদন। এই অলঙ্কার আজকাল বিশাখা সব সময়ে পরে না। পরে বিশেষ কোনও উৎসব থাকলে বা রাজপ্রাসাদে গেলে! তার সব সময়ে ব্যবহারের জন্য মিগার অন্য একটি অলংকার করিয়ে দিয়েছেন। ঘনমট্ঠক। সেটিই পরে সে। আজ মহালতা পরবামাত্র তার সর্বাঙ্গ ঝলমলিয়ে উঠল। ধনপালী মাথার ওপর ময়ূরমুখটি ভালো করে বসিয়ে দিয়ে বলল- অনেকদিন পরে তোমাকে বিসাখাভদ্রা বলে চেনা যাচ্ছে। প্রসাধনকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতে হর্ষ ও মিত্র ছুটে এলো। তারা ময়ূরের পালকগুলি টানাটানি করছে। বিশাখা ভূষণ বাঁচিয়ে দুই কোলে দুজনকে তুলে নিল।
ধনপালী হাত বাড়িয়ে বলল— মা সংঘে যাচ্ছেন। তোমরাও বুঝি যাবে?
তৎক্ষণাৎ কোল ছেড়ে নেমে এলো দুজনে— না, না, আমরা খেলা করবো।
—ভালো, ছোট্ট ভগ্নীটিকেও খেলতে নিও।
হর্ষ বলল— ও খেলা জানে না।
মিত্র বলল— শুধু কাঁদে।
—হাসে না? —বিশাখা জিজ্ঞেস করলো।
—ও আমাদের কন্দুক, পুত্তুল সব নিয়ে নিতে চায় মা, না দিলে কাঁদে।
মিত্র বলল— প্রহারও করে। মা, ও আমার হাতে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল।
—কই দেখি? ধনপালী মিত্রর হাত পরীক্ষা করে বলল— জানো তো বচ্চ, শিশুতে হাত কামড়ালে হাত শক্ত হয়!
—তাহলে মা ওই তীর-ধনুক ছুঁড়তে পারবো?
মিত্রর ছোট্ট আঙুল অনুসরণ করে বিশাখা দেখতে পেলো প্রাচীরের নাগদন্ত থেকে ঝুলছে তার সেই বিবাহের উপহার সোনার তীর-ধনুক। অনেক দিন থেকে এর ওপর লোভ বালক দুটির। সে হঠাৎ মনস্থির করে ফেলল। নাগদন্ত থেকে তীর-ধনুকটি তুলে নিয়ে বলল— বচ্চ, এই তীর-ধনু নিলে কিন্তু বীর হতে হয়।
—হবো মা, আমরা বীর হবো।
—ন্যায়নিষ্ঠ হতে হয়।
—হবো, আমরা ন্যয়নিট্ঠ হবো।
—তাহলে নাও— সে তীর-ধনুকটি মিত্রর হাতে দিয়ে বলল— দুজনেই অভ্যাস করবে।
বিশাখা সংঘে চলে গেল। দেশনা-স্থলে যাবার আগে সে সযত্নে মহালতাটি খুলে রাখল। প্রশস্ত আলিন্দ আছে বিহারে, অনেকেই সেখানে অস্ত্র, উপানৎ, ভূষণ, বর্ম খুলে রেখে যান।
দেশনা-অন্তে সে দ্রুত অলিন্দ পার হয়ে শিবিকায় উঠল। ধনপালী একবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে কী বলতে গেল, বিশাখা তার হাত দুটি চেপে ধরল শক্ত করে। কিছুক্ষণ পর পেছন থেকে একটি অল্পবয়স্ক সার্ধবিহারিক ছুটতে ছুটতে আসছে দেখা গেল।
—শিবিকা থামান, শিবিকা থামান।
শিবিকা থামলে বালকটি বলল— ভদ্রে, আপনার অলঙ্কার ফেলে এসেছেন যে। মহামূল্য বস্তু তাই আমার আচারিয় সমন আনন্দ তুলে রেখেছিলেন।
বিশাখা মুখ বাড়িয়ে বলল— বচ্চ, সমনকে বলো, তিনি একবার যা গ্রহণ করেছেন বিশাখা কি আর তা ফিরিয়ে নিতে পারে?
বালকটি বিপন্ন মুখে বলল— না আপনি চলুন ভদ্রে, আমি তিরস্কৃত হবো। সমনরা বলবেন— এ একেবারে শিশু, কোনও কাজই সম্পন্ন করতে পারে না।
বিশাখা হেসে বলল— বচ্চ তুমি তো শিশুই। তুমি বুঝি ভেবেছো এখনই একেবারে স্থবির হয়ে গেছো? ফিরে যাও, বলবে আগামীকাল বিশাখা এসে সব সমাধান করে দেবে।
বালকটি ছুটতে ছুটতে ফিরে গেল।
দেশনা-স্থলের মাঝখানে মহালতাটি রাখা। বুদ্ধ বসে আছেন তাঁর বেদীতে। পাশে অপরাধীর মতো মুখ করে শ্রমণ আনন্দ। বিশাখা দেখল বিহারের সব শ্রমণই প্রায় সমবেত হয়েছেন প্রাঙ্গণে।
সে বুদ্ধ তথাগতকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই তিনি বললেন— বিসাখা, সমন আনন্দকে বিপন্ন করছো কেন কল্যাণি, তোমার অলঙ্কার ফিরিয়ে নাও।
বিশাখা সকৌতুকে বলল— সামান্য অলংকারের জন্য শুধু সমন আনন্দ কেন, স্বয়ং তথাগতও তো বিপন্ন হয়ে পড়েছেন দেখছি। কিন্তু প্রব্রজিত ভিক্ষুর স্পর্শ পড়েছে যাতে সেই অলংকার গৃহে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে আমার যে দত্তাপহরণের অপরাধ হয়!
আনন্দ বললেন— কিন্তু আমি তো ও অলংকার গ্রহণ করিনি কল্যাণি।
—আপনারা কি দান স্পর্শ করেই গ্রহণের সম্মতি জানান না?
—এ তো দান নয়?
বুদ্ধ বললেন— স্বর্ণ-রৌপ্য এ সব গ্রহণ করার অনুমতিও নেই কোনও সমনের।
—সমন না নেন, সংঘ নিন।
—সংঘই বা নেবে কেন?
—তাহলে অনুমতি করুন ওই অলংকার আমি বিক্রয় করি। যা অর্থ পাওয়া যাবে তাই দিয়ে একটি বিহার হবে।
—সাবত্থিতে জেতবনই তো যথেষ্ট প্রশস্ত বিহার।
—ভন্তে, বিশাখা নম্রস্বরে বলল— ভিক্ষুণীদের জন্য তো তেমন কোনও বিহার নেই… আপনি যে নিয়ম করেছেন ভিক্ষুণীরা ভিক্ষুসংঘের আশ্রয়ে থাকবেন অথচ একত্র থাকবেন না, তেমনই ব্যবস্থা থাকবে নতুন বিহারে। থেরীরা থাকবেন তাঁদের সার্ধবিহারিকাদের নিয়ে। থেরী খেমা, থেরী মহাপ্রজাবতী, সমনা উপ্পলবন্না, সমনা ভদ্দা, সমনা মিত্তা থেরী যশোধরা… আর…
…ভন্তে যেমন জেতবনে অবস্থান করে অজজ সুদত্তকে ধন্য করেছেন তেমন মিগার মাতার বিহারে অবস্থান করেও…
—সম্মতি দিন ভগবন— সারিপুত্ত মৃদুকণ্ঠে বললেন, না হলে এই চতুরা কন্যা আপনাকে ছাড়বে না।
তথাগত প্রশান্ত নয়নে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন বিশাখার দিকে। কিন্তু বিশাখা চোখ নিচু করে আছে। তখন তিনি চোখ নিমীলিত করে বললেন— তবে তাই হোক।
মহালতা ক্রয় করবার মানুষ পাওয়া গেল না সমগ্র শ্রাবস্তীতে। যাঁরা বিপুল মূল্য দিয়ে কিনতে পারতেন তাঁরাও কেউ কন্যা বিশাখার অলঙ্কার নিতে চাইলেন না। তখন বিশাখা নিজেই নবতি কোটি সুবর্ণ দিয়ে সেই অলঙ্কার ক্রয় করে নিল। শ্রাবস্তী নগরীর পূর্ব দিকে বিস্তৃত ভূখণ্ডের ওপর অনুপম বিহার উঠতে লাগল। সমগ্র অঙ্গ-মগধ-কোশল থেকে শিল্পীরা আসতে লাগল দলে দলে। বিশাখার সুখী সুপ্রিয়া, অনোপমা, সুভদ্রা— এঁরা প্রার্থনা করলেন কেউ সোপান দেবেন, কেউ অলিন্দ দেবেন, কেউ গন্ধকুটির সম্মুখস্থ চত্বালের প্রস্তর দেবেন। বিশাখা সব স্বীকার করে নিলেন। কারণ আত্মযশবিস্তার তো ওই বিহার নির্মাণের কারণ ছিল না!
এইভাবেই গড়ে উঠল অনুপম প্রাসাদোপম পূর্বারাম মহাবিহার, যাকে শ্ৰমণ-শ্রমণারা আদর করে বলতেন মিগার মাতু প্রাসাদ, সন্তানের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধানের সময়ে মায়ের যেমন কিছুই দৃষ্টি এড়ায় না, এই প্রাসাদের পরিকল্পনাতেও তেমনি। তাই পূৰ্বারাম মাতার প্রাসাদ। মাতার প্রসাদ।
১৪
দাস জহ্নু এসে জানাল – দুজন মান্য অতিথি এসেছেন। তিষ্য লিখতে ব্যস্ত ছিল। সে তার অভিজ্ঞতাগুলি লিখে রাখে। স্থান কালের উল্লেখ করে না, পাত্রও ছদ্মবেশে থাকে। সে লেখে কতকটা প্রবচনের আকারে। মহারাজ পসেনদির সান্নিধ্যে এসে তার বহু শিক্ষা হল। এই রাজা অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত, জন্মসূত্রে পেয়েছেন এক বিরাট রাজ্য। স্বভাবে সন্ধিৎসু। কিন্তু এঁর চিত্তে কেমন একটা বিভ্রান্তি। ইনি নিজেও তার সংবাদ জানেন না। রাজার চেতনার দুটি দিক থাকা উচিত: অধিকার ও কর্তব্য। এঁর যে সে চেতনা নেই তা নয় কিন্তু দুটিতে কেমন স্থানবদল হয়ে যায়। অধিকার গুলিকে ইনি অনেক সময়ে কর্তব্য মনে করেন এবং কর্তব্যগুলিকে অধিকার। সন্ততি নামে এক সৈনিক না ছোট অমাত্য দস্যুদমন করে এসেছে, ইনি রাজদণ্ডটি সাতদিনের জন্য তার হাতে তুলে দিলেন। এই নাকি তার পুরস্কার, এটাই রাজার কর্তব্য। কেউ কখনও এমন কথা শুনেছেন? সে কী অবস্থা! অমাত্যরা সব ফুঁসছেন। রাজ্যে অরাজক অবস্থা। মহারাজ পসেনদি অদর্শন। গোপনে কোথায় চলে গেছেন কেউ জানে না। ওদিকে আবার তাঁর এমন অদ্ভুত লোভ যে সুন্দরী নারী, সুন্দর বস্তু, ধন ইত্যাদি, সে রাজ্যের যেখানেই থাকুক যারই থাকুক, যদি মনে করেন চাই, অমনি রাজার অধিকার প্রয়োগ করে নেবেনই তা। এক বৃদ্ধ শ্ৰেষ্ঠী মারা গেলেন। তাঁর পুত্র সমুদ্র বাণিজ্যে গেছে। পাঁচ বৎসর হল তার কোনও সংবাদ নেই। পসেনদি সেই শ্ৰেষ্ঠীর সব ধনই রাজকোষে পুরলেন। শ্রেষ্ঠীর যুবতী পুত্রবধূটিকেও। মহারানী মল্লিকার সঙ্গে প্রচণ্ড কলহ হল। শ্ৰেষ্ঠীর পুত্রবধূকে দেবী মল্লিকা পট্টমহিষী মগধকুমারীর প্রাসাদে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ষষ্ঠ বৎসরে শ্ৰেষ্ঠীপুত্র এসে উপস্থিত। পসেনদি কিছুতেই তার পিতৃধন দেবেন না। অবশেষে গৌতম বুদ্ধর মধ্যস্থতায় শ্রেষ্ঠীপুত্র তার ধন এবং বধূ পেলো।
রাজার অধিকার ও কর্তব্য বিষয়েই সে কতকগুলি প্রবচন লিখে রাখছে এখন। তক্ষশিলা বা বারাণসীর শিক্ষাই স-ব নয়। অথচ একসময়ে সে ভেবে ছিল এই শিক্ষা এক সামগ্রিক শিক্ষা। তার নিজের ক্ষেত্রে যে এই শিক্ষা কত কাজে লেগেছে! কিন্তু পসেনদির ক্ষেত্রে তো তা কই লোভ অসংযমের বীজটি নির্মূল করতে পারেনি!
হঠাৎ তার দুই কানে শঙ্খের ধ্বনি হল। তিষ্য চমকে একেবারে লাফিয়ে উঠেছিল। সামনে দুটি বালিকা হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বজিরা ও মল্লিকা। বা বজ্জি ও মল্লি।
তিষ্যকুমার চোখ পাকিয়ে বলল- রাজকুমারীদের এ কী ব্যবহার? বজ্জির বয়স বছর আটেক হবে মল্লি একটু বড়।
দুজনে তিষ্যর কোলের কাছে এলো। মল্লি বলল – রাজকুমারীদের বুঝি কেউ চোখ পাকিয়ে ভয় দেখায়!
—শিক্ষা দেবার জন্য প্রয়োজন হয়!
বজ্জি বলল —আমাকে কাঁধে তুলে, তোমার গেহের ছাদে নিয়ে চলো না পাঞ্চাল। আমি নদী দেখব।
—ওই তো গবাক্ষ আছে। যাও গিয়ে দেখো।
—ওখান থেকে নয়, অনেক উচ্চ স্থান থেকে দেখব।
—তাহলে তো বৃক্ষশাখায় উঠতে হয় বজ্জি। বাঃ বেশ ভালোই লাগবে দৃশ্যটি।
—কেন? এ কথা বললে কেন?
তিষ্য বলল— চেয়ে দেখো অদূরে ওই বটবৃক্ষটির দিকে।
বটগাছটির শাখায় কতকগুলি বানর নিশ্চিন্তমনে বসেছিল। শ্রাবস্তী, সাকেত, অযোধ্যা, সমগ্র কোশলদেশই বানর ও হনুমানের জন্য বিখ্যাত।
বানরগুলির দিকে চেয়েই মল্লি বলল— ও আমাদের বানরী বললে? দেখাচ্ছি তোমাকে দাঁড়াও।
দুই ভগ্নী দুদিক থেকে তিষ্যর ওপর নানা প্রকারের প্রহার বর্ষণ করতে লাগল। তিষ্য হাসিমুখে প্রহারগুলি সহ্য করতে লাগল।
একটু পরে থেমে গিয়ে মল্লি বলল— এই নাকি তুমি বীরপুরুষ! এই নাকি তুমি মল্লবিদ্যা জানো। কিচ্ছু জানো না।
—কী করে বুঝলে?
—আমরা এতো প্রহার করলাম কিছু করতে পারলে?
—নাঃ। অতি বীর যোদ্ধা যোদ্ধ্রীদের কাছে তিষ্য আগে থেকেই পরাজয় স্বীকার করে নেয়।
তখন দুজনেই রণে নিরুসাহ হয়ে পড়ল। তবে তাদের সঙ্গে নিয়ে তিষ্যকে প্রাসাদচূড়ায় উঠতেই হল।
—পাঞ্চাল, —বজ্জি বলল —তুমি নাকি বেসালি যাবে?
—যাবো।
—আমাকে নিয়ে যাবে?
—কেন?
—আমি মাতুলগেহে যাবো। কপিলবত্থু। মল্লি যখন মাতুলগেহে যায়, ওর অজ্জা-মা, অজ্জ-পিতা, মাতুল সব কত আদর করেন। আমি কপিলবত্থু যাবো…
—সে যে অনেক দূর বজ্জি!
বেসালি তো আরও দুর। তুমি যাবার পথে কপিলবত্থুর তোরণে দাঁড়িয়ে বলবে— অজ্জ মহানামা, অজ্জ মহানামা— আপনার দৌহিত্রী এসেছে দেখে যান। তখন সাক্কারা সবাই গিয়ে সংবাদ দেবে অজ্জপিতা ছুটতে ছুটতে আসবেন। মল্লির মাতামহর মতো দুহাত বাড়িয়ে।
তিনি আমাকে কোলে নিলেই তুমি তাঁকে অভিবাদন করে বেসালি চলে যাবে।
মল্লি বলল— বা, তুই বুঝি পাঞ্চালকে একটা দিনের জন্যও কপিলবত্থুর মাতুলগেহে থাকতে বলবি না। তোর মাতামহ বুঝি বলবেন না! কপিলবত্থু থেকে বেসালি কত দূর জানিস’ পাঞ্চালের দেহ ধূলিধূসর হয়ে যাবে, ঘোড়াগুলোর মুখ দিয়ে ফেনা উঠবে, তাদের বুঝি বিশ্রামের প্রয়োজন নেই? শুধু নিজের কথাই ভাবছিস?
ছোট্ট বজ্জি লজ্জা পেয়ে বলল— না তা বলিনি। মাতামহ তো পাঞ্চালকে আতিথ্য নিতে বলবেনই। কত শঙ্খ বাজবে। মাতুলানীরা সব আসবেন, কিন্তু তখন কি আর পাঞ্চালের দাঁড়াবার সময় আছে? তাই ভাবছি।
মল্লি বলল— ওই দ্যাখ, দ্যাখ— বীরিয় যাচ্ছে। পাঞ্চাল, বীরিয়কে ডাকো না।
তিষ্য দেখল কিশোর রাজকুমার বীরিয় অচিরবতীর তীরে দাঁড়িয়ে আরও দুতিন জন কিশোরের সঙ্গে কথা বলছে। এদের মধ্যে মহামাত্র উগ্রর পৌত্র সুষেণকে সে চিনতে পারল। অন্যগুলি অচেনা। ভারি চমৎকার এই বীরিয় কুমারটি। শীল কাকে বলে একে দেখে শিখতে হয়। আকৃতিও শাক্যদের মতো। কাঞ্চনগৌর, সুমসৃণ ত্বক। অতি সামান্য গুম্ফরেখা দেখা দিয়েছে। মনে হয় বীরিয় শ্রমণ আনন্দর মতো সুন্দর পুরুষ হবে। তবে নিয়মিত ব্যায়ামে, অস্ত্র চালনায় তার দেহ ব্যায়ামপুষ্ট, গৌতম বুদ্ধর মতো সে সিংহকটি। পিতা পসেনদির সঙ্গে তার কোনও সাদৃশ্যই নেই। বীরিয় সবে তক্ষশিলা থেকে এসেছে। এখনও তিষ্যর সঙ্গে ভালো পরিচয় হয় নি। কিন্তু দূর থেকে বীরিয়কে দেখে শুনে তিষ্য আকৃষ্ট হয়েছে। মল্লি ইতিমধ্যে একটি শঙ্খ এনে বাজাতে আরম্ভ করেছে।
শঙ্খধ্বনিতে আকৃষ্ট হয়ে বীরিয় এবং তার সঙ্গীরা মুখ তুলতেই দুই বালিকা ভগ্নী তাকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকতে লাগল। তিষ্য তৎক্ষণাৎ নিচে নেমে গেল, রাজকুমারকে তো শুধু আসতে বললেই হয় না। তাকে প্রতুদ্গমন করে নিয়ে আসতে হয়। বীরিয় তার সঙ্গীদের কী যেন বলে তিষ্যর গৃহের দিকে ফিরল, দেখল তিষ্য স্বয়ং দাঁড়িয়ে রয়েছে, পেছনে তার দ্বাররক্ষী।
—আপনি পাঞ্চাল তিষ্য, নয়? রাজকুমারের কণ্ঠস্বরটি ঈষৎ ভাঙা ভাঙা। চোখদুটি অনাবিল। তিষ্য হাসিমুখে ঘাড় নাড়ল।
—বানরীদুটি এখানে কী করছে?
পেছন থেকে কলকল ধ্বনি উঠল। তুমিও, তুমিও তাহলে বানর বীরিয়, তারা বীরিয়কে প্রহার করতে উদ্যত হয়েছিল, বীরিয়ও আস্ফালন করছিল। কিন্তু তিষ্য মধ্যস্থতা করে থামিয়ে দিল।
—একদিনে একজন বীরপুরুষকে পরাস্ত করাই যথেষ্ট বজ্জি।
বজ্জি বলল— তোমার ওইসব চতুর সুহৃৎদের সঙ্গে কী এতো কথা বলছিলে বীরিয়?
তিষ্য বলল কুমারকে ভেতরে আসতে দাও আগে।
আসনশালায় বসে বীরিয় বলল— পাঞ্চাল, আমি মনস্থ করেছি কপিলবস্তু যাবো। পিতা শীঘ্রই আমাকে নানারূপ দায়িত্ব দেবেন। শস্ত্রশিক্ষাও পূর্ণ হয়নি। তার আগে কপিলবস্তু ঘুরে আসব। আর্য বন্ধুল বলছিলেন অসিচালনায় আপনার কাছে শিক্ষা নিতে। আপনি আজকাল নিয়মিত মল্লভূমিতে যান না?
—কিছুদিন ব্যস্ত আছি। আমাকে বিশেষ কাজে বৈশালী যেতে হবে কুমার। তারই আয়োজনে একটু ব্যস্ত আছি।
—বৈশালী যাবেন? তাহলে তো যাত্রাপথ একই। হে পাঞ্চাল, আমরা দুজনে একত্রেই যাত্রা করতে পারি। আপনি আরও পূর্বে এগিয়ে যাবেন, আমি শাক্য ভূমিতে প্রবেশ করবো।
বজিরা উৎসাহে লাফাতে লাফাতে বলল— আমি যাবো, আমি যাবো বীরিয়।
—দাঁড়াও আগে থেকেই লাফালাফি করো না। পিতা মাতা এঁরা কী বলেন, পুরোহিতরা কী বলেন দেখতে হবে না! কিন্তু পাঞ্চাল আমি কয়েকদিন আপনার সঙ্গে অসিক্রীড়া করব অনুমতি দিন। আর্য দীঘকারায়ণের সঙ্গে মুষল যুদ্ধ আছে আমার কাল, দেখবেন না কি?
—নিশ্চয়। কিন্তু কুমার, মাতুলালয়ে যাবার সঙ্গে এগুলির সম্পর্ক কী?
বীরিয় ঈষৎ লজ্জিত, ঈষৎ গর্বিত মুখে বলল— শাক্যরা বীরপুরুষ। শুনেছি গৌতম তথাগতকেও কয়েকবার শস্ত্ৰপরীক্ষা দিতে হয়েছে। ভাগিনেয়র জন্যও যদি শাক্যরা অনুরূপ পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন তাহলে তাঁদের এবং কোশলের গৌরব রক্ষা করতে হবে তো!
অতএব কয়েকমাস ধরে পাঞ্চালের কাছে কুমারের শিক্ষা ও অনুশীলন পর্ব চলে। তার পর পাঞ্চাল তিষ্য বৈশালী যায়। যায় কোশলকুমার বিরূঢ়কের সুনির্বাচিত, সুসজ্জিত সেনাদলের সঙ্গে। সে নিজে একাই যাচ্ছে। সমরসাজ নেই। মর্যাদাসাজ নেই। একমাত্র সঙ্গী বর্মের সঙ্গে লগ্ন মহারাজ বিম্বিসারের রাজনিদর্শন, মহারাজ পসেনদির রাজনিদর্শন, এবং মহারাজার কাছেও পত্র। সাকেতকুমার তিষ্য যেমন, মহানামা শাক্যও তেমন কোশলের প্রজা, কিন্তু কোশলপতি শাক্যদের রাজমর্যাদাই দ্যান। এইসব প্রায়-স্বাধীন জনপদাধিপতির নিষ্ঠ সমর্থন না থাকলে মহারাজ বিম্বিসারের স্বপ্ন সফল হবে কী? দৈবাত চণকের মতো তিষ্যও বিশ্বাস করে মুষ্টিমেয় রাজার প্রচেষ্টায় জম্বুদ্বীপে কোনও সংঘশক্তির উত্থান হতে পারে না। তাই পাঞ্চাল তিষ্য কপিলবস্তু যাচ্ছে।
শাক্যভূমিতে পা রেখে ঘোড়াগুলির পিপাসা পায়। অশ্বারোহীদের বিশ্রাম নিতে ইচ্ছা করে। বীরিয় এসে বলে— পাঞ্চাল, আমি কোন ধূসর হয়ে গেছি দেখুন! কী ধূলি। আচ্ছা, এখনই কি বেশ পরিবর্তন করে নেবো? আচ্ছা পাঞ্চাল, শাক্য কন্যারাও তো শুনেছি অতি সুন্দরী।
তিষ্য হেসে বলে— আমি দেবী যশোধরাকে দেখি নি। তবে বীরিয়, শ্রমণ আনন্দ, থের নন্দ এঁদের দেখলে মনে হয় বটে এঁদের কুলের কন্যারাও অনুরূপ। গৌতম বুদ্ধর কথা না হয় মহাপুরুষ বলে ছেড়েই দিলাম। তা তুমি কি শাক্যকন্যা লাভের গোপন উদ্দেশ্য নিয়েই কপিলবস্তু যাচ্ছো?
বীরিয় লজ্জা পেয়ে যায়, বলে, কী যে বলেন পাঞ্চাল! মাতুলগৃহে যাচ্ছি, অপরিচিত নারীকুল। তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে তো! তা ছাড়া আমি তো ভাগিনেয় আমার কি শাক্যকন্যা লাভের উপায় আছে?
তিষ্য বলল— নেই কেন? গৌতম নিজেই তো বিবাহ করেছিলেন তাঁর মাতুল কন্যাকে। অন্তর্বিবাহ তো শাক্য লিচ্ছবি এঁদের মধ্যে যথেষ্ট চলে। তা ছাড়া শাক্যকন্যারা সকলেই নিশ্চয় তোমার মাতুলকন্যা নয়।
—তাহলে মা কেন আসার সময়ে আমাকে বারবার সতর্ক করে দিলেন? বীরিয় অন্যমনা হয়ে বলে।
—কী বলেছেন দেবী? —তিষ্য সন্তর্পণে অধিক কৌতূহল প্রকাশ না করে বলে।
—মা তো আমাকে আসতে দিতেই চাইছিলেন না বজ্জিকে তো একেবারেই অনুমতি দিলেন না ভগবান তথাগতর আশীর্বাদ নিতে গিয়েছিলাম, মা বললেন ভন্তে বীরিয়কে একটু বলুন তো ও যেন আবার ওর পিতার মতো শাক্যকন্যা বিবাহ করবার জন্য পীড়াপীড়ি না করে। ভগবান স্মিতমুখে নীরবে ছিলেন। মা আবার বললেন
—তুমি রাজকুমার, ভবিষ্যতে শাক্যদেরও অধিপতি হবে, শাক্যকন্যাদের দিকে দৃষ্টি দিলে, ভবিষ্যৎ- রাজার সম্পর্কে তাঁদের ধারণা ভালো হবে না বীরিয়। মা এমন করে বললেন আমি যেন একটি নারী লোলুপ মর্কট!
বীরিয়র মুখ অভিমানে থমথম করছে।
কপিলবস্তুর প্রান্তীয় গ্রামটিতে যখন শিবির সংস্থাপন করা হল তখন আকাশে সূর্যের অস্তশ্রী। যোজনের পর যোজন চোখের সামনে বিস্তৃত হয়ে রয়েছে। ধান্যের ক্ষেতগুলি শস্যভারে নুয়ে পড়েছে। শ্যামবর্ণ শিষগুলিতে কাঁচা সোনার বর্ণ লাগতে আরম্ভ করেছে। একদল চিত্রল হরিণকে কৰ্ষকরা তাড়া দিয়ে ক্ষেত থেকে বার করছে। হরিণগুলি বাছুরের ভঙ্গিতে ক্ষেতের আলগুলি ডিঙিয়ে উঁচু ভূমিতে উঠল, তারপর তীব্র বেগে ধুলো উড়িয়ে কোশলকুমারের শিবিরের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। পলায়নরত শেষ হরিণদুটিকে তীরবিদ্ধ করল বিরূঢ়কের সঙ্গী সেনারা।
কৰ্ষকগুলি শিবির, লোকজন দেখে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে আসছে।
—সার্থ না কি?
—না, সাবত্থির কুমার যান।
—কোথায় যান ভাই? যুদ্ধযাত্রা মনে হয়! দস্যু দমন না কী?
—না হে। কুমার মাতুলগেহে যান। কপিলবত্থুতে। কেন এদিকে দস্যুর উপদ্রব হচ্ছে না কি?
—আপাতত দস্যু এই হরিণের দল। ক্ষেত্রের মধ্যে মঞ্চ বেঁধে সারা রাত পাহারা দিই তাতেও কখন যে দল বেঁধে ঢুকে পড়ে চোরের দল! মার মার… লাঠি হাতে গ্রামজনেরা আবার তাড়া করে যায়। একটি হরিণ কোথায় লুকিয়ে ছিল, মুখ ভর্তি ধানের শিষ— পালিয়ে যাচ্ছে নিঃ সাড়ে।
কুমারের সঙ্গী সেনাদের শিবির সংস্থাপন হয়ে গেছে। তিনটি শিবির মোট।
একটিতে দুই কুমার থাকবেন। আর দুটিতে সঙ্গীসাথীরা সব। পাক-সাক হবে খোলা আকাশের তলায়। পাথরের টুকরো সন্ধান করছে কেউ কেউ উনান হবে। হরিণ দুটিকে পরিষ্কার করছে কয়েকজনে। ঝলসানো হবে। অগ্নিকুণ্ডর জন্য কাঠ সংগ্রহ হচ্ছে।
—শাক্যদের ভাগিনেয় কোনটি ভাই?
—ওই যে কৃষ্ণায়সের বর্ম পরা, কটিতে হাত রেখে শিবিরের দুয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন?
—ও যে কাকপক্ষধর কিশোর গো! দুধের দাগ মুখ থেকে মোছে নি।
—যেমন তেমন নাকি? তক্ষশিলা থেকে ফিরেছেন। পেটে বিদ্যে গজগজ করছে। লক্ষ্যভেদে নিপুণ একেবারে।
—আমরা ভেবেছিলাম ওই দীর্ঘ আকৃতির মানুষটিই রাজকুমার। তো উনি কে?
—উনিও রাজার কুমার তবে সামত্থির নয় সাকেতের। পাঞ্চাল তিষ্য। তোমাদের এখানে যদি কোনও কিছুর উপদ্রব থাকে তো ওঁকে ওঁদের বলতে পারো। ঈষৎ গর্বভরে বলল সৈনিক।
লোকগুলি পরস্পরের সঙ্গে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। বলল— বলব?
—বলো না! উনি অতি সদাশয় লোক।
—কিন্তু কেমন গম্ভীর। সম্ভ্রম হয়। যদি রাগ করেন!
—বলেই দেখো না।
—সৈনিক গ্রামজনেদের নিয়ে যায়। তিষ্য তখন দূরবিসর্পী ধান্যে ধান্যে টই টম্বুর শ্যামল ক্ষেত্রের ধারে দাঁড়িয়ে অস্তশ্রী দেখছিল।
—হে মহামান্য পাঞ্চাল—
—কে? ও চিত্র? কী ব্যাপার?
—এই গ্রামজনেদের আপনার কাছে কিছু নিবেদন আছে।
—নিবেদন? বলো, তিষ্য তার দিবাস্বপ্ন ভেঙে বেরিয়ে আসতে আসতে বলে।
—আমাদের এখন ধান পাকবার সময়। বন্য পশুরা বড়ই ক্ষতি করে ক্ষেতেরর। হরিণ গুলিকে আমরা তাড়াই সারা রাত পাহারা দিয়ে। কিন্তু কিছু বরাহ আছে। দাঁতাল— হাতি আছে। এদের বড় ভয় করি।
—হাতির দল নেমেছে নাকি?
—না, এখনও নামে নি। অতি চতুর। ধান আরও পাকলে নামবে।
—আর বরাহ?
—বরা দুটো প্রত্যহই ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে, রক্তচক্ষু একখানি দাঁত, কিছু করতে পারি না কুমার।
তিষ্য এখন ধানক্ষেত এবং সূর্যের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পায়ের তলায় ভূমি সামান্য উন্নত। তার বক্ষে চর্মের বর্ম। পায়ে উৎকৃষ্ট অজচর্মের উপানত। কটি থেকে লম্বমান কোষবদ্ধ তরোয়াল। সামনে নগ্নগাত্র লোকগুলি। মুখভাবে অনাবিল সরলতা ও সম্ভ্রম। সেইসঙ্গে আর্তি।
তার মনের মধ্যে বিচিত্র একটি ভাব হল। যেন সে-ই রাজার কুমার। উপরাজ আপাততঃ। রাজ্য-পরিদর্শনে বেরিয়েছে। প্রজাদের অভাব অভিযোগের কথা শুনছে।
চিত্র নামে এই সৈনিক জানে—কুমার বিরূঢ়ক, সে নয়। তাদের নেতৃত্ব কোশলকুমারের, পাঞ্চাল তিষ্যর নয়। কিন্তু প্রথম প্রয়োজনেই তারা তিষ্যর কাছে এসেছে। লোকগুলির চোখে স্পষ্ট প্রশংসার দৃষ্টি। তার মনে হল কে ওই কোশলকুমার? কেনই বা ও কোশলের মতো বৃহৎ রাজ্যের রাজা হতে চলেছে? ওর প্রজারা তো ওর মধ্যে তাদের স্বাভাবিক আশ্রয় দেখতে পায় না? তাহলে? উত্তরাধিকার? একটি চতুর নির্বোধ, অসংযমী কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাজার উত্তরাধিকার? যদি কোশলরাজের স্থানে থাকত সে, তিষ্যকুমার, যাকে আজকাল সবাই পাঞ্চাল তিষ্য বলছে, তাহলে কোশল হত না কি একটি জাগ্রত রাজ্য? পসেনদিকে বাহুবলে সিংহাসনচ্যুত করা তার পক্ষে এমন কিছু কঠিন কাজ নয়, যদি বন্ধুল ও দীঘকারায়ণ বাধ্য না দ্যান।
এ কী ভাবছে সে? শরীরটি আপাদমস্তক ঝাঁকিয়ে এই ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্ত করল তিষ্য। মুখের দু পাশে হাত রেখে সিংহনাদ করল। চমকে উঠল সবাই। তিষ্যর বুকের মধ্যে সন্তোষ, তৃপ্তি। চমকে ফিরে তাকাল বীরিয়। দ্রুত আসতে লাগল এদিকে। দেখল ক্ষুদ্র জনসমাবেশ।
—কী হয়েছে পাঞ্চাল?
এই কিশোরটি কেন কে জানে মাতুলালয়ের স্বপ্নে বিভোর। বংশ, কুল। এই কুল বস্তুটাকে এরা বড়ই গুরুত্ব দেয়। কী ভাবে একটি কুল প্রস্তুত হয়। যে ভাবে অন্য কুল গুলি হয়েছে সে ভাবেই তো? এক কুলের মানুষরা কিছু গৌরবের কাজ করলে তখন কুলের খ্যাতি হয়। এইটুকু সে বুঝতে পাবে। শাক্যকুমার সিদ্ধার্থ মৌলিক মত প্রচার করে কুলগৌরব বৃদ্ধি করেছেন। সত্য। কিন্তু আর কী আছে এই কুলের, যার জন্য এদের এতো দম্ভ এবং অন্যদের এমন সম্ভ্রম? সিদ্ধার্থর আগেই বা কে কী করেছিল? বীরিয়র মতো একটি তক্ষশিলক কেন নতুন চিন্তা করতে পারে না?
—কী হয়েছে পাঞ্চাল?
তিষ্য সামনের লোকগুলিকে দেখিয়ে বলল— এদের ক্ষেত্ররক্ষা করতে বরাহ মারতে হবে।
—আপনি যে ভাবে সিংহনাদ করলেন, তাতে বরাহরা আজ আর এদিকে ঘেঁষবে বলে মনে হয় না— বীরিয় হাসতে হাসতে বলল।
—হ্যাঁ বরাহগুলির আসবার সময় হলে যদি আরও দু একটি নাদ করি, কয়েকদিনের মতো নিশ্চিন্ত থাকা যেতে পারে। কিন্তু তারপর?
—তারপর ওরা আবার আসবে —লোকগুলি বলল।
—অতএব বীরিয় তোমার ধনু নাও— পাঞ্চাল তিষ্য দ্রুত পদক্ষেপে শিবিরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। একটু পরে পিঠে তূণ, হাতে বিশাল ধনু নিয়ে বার হয়ে এলেন।
সৈনিকরা পিছু পিছু আসছিল। তাদের নিষেধ করলেন পাঞ্চাল তিষ্য। হরধনু হাতে রামের মতো প্রবেশ করলেন মহাবনে। পেছনে লক্ষ্মণের মতো কুমার বিরূঢ়ক।
—সেই আশ্চর্য রাতটির কথা জীবনে কখনও ভুলবেন না তিষ্যকুমার। যেমন সুন্দর, পরিষ্কার, তেমনই উজ্জ্বল, নীলাভ সেই রাত। রক্তের মধ্যে কেমন একটা ঝিনিঝিনি উন্মাদনা। কেউ নেই নির্দেশ দেবার। দৈবরাত নেই, মহারাজ বিম্বিসার নেই, নেই বন্ধুল। সে-ই দলপতি। কোশলকুমার কিশোর বীরিয় তার আজ্ঞাবাহী। গভীর রাতে মহাবন থেকে বেরোবার মুখে যখন বিকট চিৎকার করে ভূপতিত হল দাঁতাল বরা, তার সঙ্গিনীকে আর একটি ছুটন্ত তীরে বধ করল তিষ্য; তখনই দেখা গেল বনের গায়ে জমাট অন্ধকারের মতো সারে সারে দাঁড়িয়ে আছে হাতি। নড়ছে না শব্দ নেই, শুধু ধূম্র কুণ্ডলীর মতো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। তারার আলোয় তাদের পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এক, দুই, তিন চার, বারোটির থেকে অল্প নয় কখনোই। দীনবসন কর্ষকগুলি ভয়ে স্তম্ভিত। সেনাগুলির শরীর শক্ত হয়ে গেছে। নগর-সেনা সব, এমন বিপাকে আগে পড়েনি। বিরূঢ়ক বিভ্রান্ত। কী করবে বুঝতে পারছে না।
ভীষণ সিংহনাদ বেরিয়ে এলো পাঞ্চাল তিষ্যর কণ্ঠ থেকে। সেই বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মধ্যে দূরে দূরান্তরে ছড়িয়ে যেতে লাগল উপর্যুপরি সিংহনাদ। কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল হাতির দল। তারপর হঠাৎ দেখা গেল ধূম্রকুণ্ডলী সরে গেছে, দেখা যাচ্ছে উন্নতশির বৃক্ষগুলির শীর্ষ। স্তব্ধ রাত সহসা বানরের চিৎকারে ভরে গেল। চিচ্চিট সব থেমে গেছে। খালি জোনাকিগুলি জ্বলছে, নিবছে।
তিষ্য দেখল সে শূন্যে। তার দেহ সাপের মতো জড়িয়ে ধরেছে কিছু। পেছন থেকে একটি হাতি এসে তাকে কুম্ভে তুলে নিয়েছে। মাথার ওপর জাজ্বল্যমান জ্যোতিষ্কগুলি ছাড়া তিষ্য কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। এক নিমেষের জন্য সে কিংকর্তব্য ভুলে গিয়েছিল। তারপর অতি দ্রুত তার মনে হল দুটি উপায় আছে, হাত দুটি মুক্ত। কিন্তু কটি পেঁচিয়ে ধরেছে হস্তিকুম্ভ। মুক্ত হাত দিয়ে সে তূণ থেকে লৌহমুখ তীর বার করে বিঁধিয়ে দিতে পারে এই হাতির মাথায় চোখে, তাতেও বাঁচবে কি না সন্দেহ। আর একটি উপায়….? সে কোনক্রমে ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা দিয়ে কুম্ভের একটি বিশেষ স্থানে নিবিড় চাপ দিল। কাজ হয়েছে, স্খলিত হয়ে যাচ্ছে কুম্ভ? তিষ্যর মুখ দিয়ে নির্গত হয়ে আসছে এক শিসের মতো সুর, অবিকল যা শ্রাবস্তীর পথে দেবী সুমনা ও তাঁর কন্যা বিশাখার মুখে শোনা গিয়েছিল। তীব্র মাদক সন্মোহনে কপিলবস্তুর প্রান্তিক অরণ্যানী জানু মুড়ে বসে পড়ছে। হতচকিত সৈন্যদল। কুম্ভ বেয়ে ধীরে ধীরে বিশাল হাতিটির পিঠে উঠে পড়ল তিষ্য। সে শুয়ে পড়েছে পিঠের ওপর। ঘুরে ফিরে শিসের শব্দ হাতিটির কানে আসছে। হাতিটি প্রায় শক্তিহীন। সৈনিকেরা দু পাশ থেকে ছুটে এলো, দলের অন্য হাতিদের চালিয়ে নিয়ে আসবে। বন্য হাতিটির পায়ের চার পাশে খোঁটা পোতা, পায়ে লৌহ শৃঙ্খল পরানো, সবই যখন সম্পন্ন হল, তখন শেষ রাত। মহা সমারোহে ঝলসানো হচ্ছে বরা দুটি। গ্রামজনেরা কদলী গাছ সতূপীকৃত করে রেখেছে হাতিটির সামনে। কদলীর মধ্যে মেশানো আছে তীব্র নিদ্রাকর্ষক ভৈষজ।
শেষ রাতে নিভন্ত অগ্নিকুণ্ডের ধারে বসে সেই ঝলসানো মৃগমাংস, শূকর মাংসের ভোজ, সেনাদের সঙ্গে, শাক্য কৰ্ষকদের সঙ্গে, কিশোর বীরিয়কে পাশে নিয়ে, অতগুলি কণ্ঠে সম্মিলিত জয়ধ্বনি, পাঞ্চাল তিষ্যকে লক্ষ্য করে, তীক্ষ্ণ সুরা ভাগ করে নেওয়া। তারপর পান ভোজনে তৃপ্ত সেই গ্রামবাসী সেই সৈনিকদের ঈষৎ উন্মত্ত ঘোষণা আপনিই রাজা। আমাদের রাজা। যাঁকে দেখিনি, তিনি না, তিনি আমাদের দুঃখের নিরসন করতে এগিয়ে আসেন না। তেমন রাজা নিয়ে কী কাজ! হে পাঞ্চাল তিষ্য আমরা সাক্ক জানি না, মল্ল জানি না কোসল জানি না। আমরা আপনাকে জানি….আপনি আমাদের রক্ষা করুন।
একদিকে গভীর অরণ্য আর একদিকে বিশাল শস্যক্ষেত্র। অসংখ্য জ্যোতিষ্কের আলোয় স্নান করতে করতে এই প্রকারই হল পাঞ্চাল তিষ্যর রাজ্যাভিষেক। হৃদয়ের ছিন্ন ভিন্ন সূত্রগুলি জুড়ে যেতে থাকে। ভেতরে একটা গরিমাবোধ। বিপুল হর্ষ। যাদের প্রকৃত অধিকার সেই সামান্যজন তাঁকে রাজা নির্বাচন করেছে। তিনি যেন ফিরে গেছেন বহু শতক আগে যখন মহারাজ মহাসম্মত নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাজতন্ত্রের সেই আরম্ভ। শুধু প্রভুত্বের জন্য রাজা নয়। বিলাস, আত্মসুখ চরিতার্থ করার নাম রাজত্ব করা নয়। বহুজনকে নেতৃত্ব দিয়ে ভয়মুক্ত করে তাদের আনুগত্য শ্রদ্ধা ভালোবাসা নিজের কৃতি নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে আকর্ষণ করে তবেই রাজপদবী পেতে হয়। এবং সেই শ্রদ্ধা আনুগত্য ভালোবাসা রক্ষা করে যেতে হয় সদা জাগ্রত থেকে। কুল দিয়ে কী হবে? কুল বংশমর্যাদা এসব কুসংস্কার। আর ব্যক্তিমায়া? পাঞ্চালের কি ব্যক্তিমায় অর্জন হয়েছে? এতদিনে? তাঁর মধ্যে কতকগুলি দৃঢ় সংকল্প জন্ম নিচ্ছে। এই মুহূর্তে।
বন্য হাতিটিকে পুরোপুরি বশ করতে ছয় সাত দিন লেগে গেল। তার পিঠে রুপোর সাজ। সামনের দুই পায়ে লৌহ শৃঙ্খল। কুম্ভে চন্দনের পত্রলেখা। পাশে দলের সবচেয়ে সুন্দরী হস্তিনী। তাকে দেখাচ্ছে হাতি নয় যেন রাজা। রাজার চরণেও তো শৃঙ্খল থাকে, থাকে না?
প্রত্যুষ। শিবির তোলা হচ্ছে। চার দিকে সাজসাজ রব। কুমার বিরূঢ়কে নীলবর্ণ বসন পরেছে, উত্তরীয় টিতে গোরোচনা দিয়ে বলাক মালা আঁকা। কেশগুলি সযত্ন চর্চিত হয়ে কাঁধের ওপর পড়েছে। কানে কুণ্ডল, বাহুতে অঙ্গদ, কণ্ঠে মুক্তামালা। বুক চিতিয়ে সে সৈন্যদের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হ্যাঁ রাজ কুমার বটে। রাজার কুঙার। তিষ্যকে এগোতে দেখে গ্রীবা সামান্য বাঁকিয়ে বিরূঢ়ক বলল—পাঞ্চাল, মনে হচ্ছে এখানে যেমন, সাক্কনগরীতেও তেমনই আপনিই হবেন মুখ্য। কুমার বিরূঢ়কের মুখে কেমন এক প্রকার অপ্রতিভ হাসি।
তিষ্য মৃদু হেসে বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে বলল— তা কী করে হবে বীরিয়। তুমিই হলে তাঁদের ভাগিনেয়। তা ছাড়া আমি তো কপিলবস্তু যাচ্ছি না!
—সে কী! আপনি যে বললেন রাজকার্য….
—এখানে হাতিটির জন্য কত বিলম্ব হয়ে গেল বীরিয়, বৈশালীতে সেনাপতি সীহ আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তুমি ওই নতুন হস্তী নীলাগ্রের পিঠে চড়ে যখন কপিলবস্তু প্রবেশ করবে, সিদ্ধার্থ গৌতমের চেয়েও অধিক অভ্যর্থনা পাবে। দেখো!
নীলাগ্রকে আপনি জীবন বিপন্ন করে জয় করেছেন। হে পাঞ্চাল নীলাগ্র আপনার।
—যদি আমার হয়ে তবে ওই হস্তিরাজকে আমি আমার প্রথম উপঢৌকন দিচ্ছি কোশলের ভবিষ্যৎ রাজা কুমার বিরূঢ়ক কে।
সেনারা জয়কার দিয়ে উঠল। চোখে বিস্মিত সম্ভ্রমের দৃষ্টি অদূরে কর্ষকগুলি তাদের সামান্য কটিবাস পরে এ ওর গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে হতাশা, সামান্য তিক্ততাও বুঝি! তিষ্যকুমার। তিষ্যকুমার আপনি নীলাগ্রকে নিন। এই অরণ্য নিন। নিন এই বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রগুলির ভার। আমরা আপনাকে কর দেবো।
তারা মুখে না বললেও মনে মনে এই কথাগুলি বলছে, কী এক সহজ বুদ্ধিতে সমস্ত বুঝতে পারছিলেন পাঞ্চাল। হয়তো পারছিল কোশলকুমার বিরূঢ়কও।