ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন
[কার্ড ক্লোনিং মামলা
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, বড়বাজার থানার ওসি। ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রদত্ত ‘প্রশংসা পদক’-এ সম্মানিত। ২০১৪ সালে পেয়েছেন ভারত সরকারের ‘ইন্ডিয়ান পুলিশ মেডেল’।]
একবার দেখলে আরেকবার তাকাতে ইচ্ছে হয়।
মহিলা সত্যিই চোখ টানার মতো সুন্দরী। দেখে মনে হয় বয়স মাঝতিরিশ। ববকাট চুলে আঙুল চালাচ্ছেন ট্যাক্সি থেকে নেমে। যেটা এসে থেমেছে বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল গেটের ঠিক সামনে।
প্রি-পেইড ট্যাক্সি বুথের বাইরে দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলোচ্ছিলেন সৌম্য। দেখার মতো কিছু থাকে না এয়ারপোর্টে। কী বাইরে, কী ভিতরে। সব শহরেই একই ছবি। একই ধাঁচের বিল্ডিং। একের পর এক গাড়ি এসে থামছে বাইরের রাস্তায়। হয় অ্যারাইভালে, নয় ডিপার্চারে।
যাঁরা উড়ে যাবেন অন্য শহরে, তাঁরা লাগেজ ট্রলি টেনে এনে মালপত্তর রাখছেন। এগোচ্ছেন এন্ট্রি গেটের দিকে। যাঁরা ঝাড়া হাত-পা, তাঁরা গাড়ি থেকে নেমে আরও আগে পৌঁছে যাচ্ছেন গেটে। যন্ত্রও লজ্জা পাবে, এমন মুখ করে টিকিট চেক করছেন বিমানবন্দরের কর্মী। সজাগ দৃষ্টি নিয়ে লক্ষ করছেন পাশে দাঁড়ানো সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী।
যাঁদের উড়ান এই শহরমুখী, বেরনোর গেটে তাঁদের জন্য ভিড়। আত্মীয়স্বজন যত, তার থেকে বেশি জটলা ড্রাইভারদের। একটু পরেই যাঁরা আরোহী হবেন পার্কিংয়ে থাকা গাড়িগুলোর, তাঁদের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে অপেক্ষমাণ। চোখ ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে। যার লেখাগুলো ঘনঘন পালটাচ্ছে। অমুক ফ্লাইট ইজ় ডিলেইড। তমুক ফ্লাইট হ্যাজ় জাস্ট ল্যান্ডেড।
এয়ারপোর্ট বড্ড একঘেয়ে লাগে সৌম্যর। শহরের নামটা শুধু বদলে দিলেই হল। বাকি সব মোটামুটি উনিশ-বিশ। বাইরের ভিড়ের মধ্যেও একটা দমবন্ধ শৃঙ্খলা। চলো নিয়মমতে। এর থেকে স্টেশন ভাল। তুমুল ভিড়ভাট্টা আছে। পারিপাট্যের অভাব আছে। হকারের হইহই আছে। কিন্তু চরিত্র আছে। প্রাণ আছে। এক এক শহরে এক এক রকমের স্থাপত্য। শুধু নাম বদলায় না। বাড়িও বদলে যায়।
এলোমেলো ভাবনায় ছেদ পড়ে সঙ্গী অফিসারের কনুইয়ের গুঁতোয়।
—স্যার… ওই দেখুন.. লিন্ডা!
সতীর্থের দৃষ্টিপথ অনুসরণ করেন সৌম্য। ববকাট চুলের সুন্দরী দাঁড়িয়ে পড়েছেন বেরিয়ে আসার গেটের সামনে। একবার চোখ রাখলেন কবজিতে বাঁধা ঘড়িতে। তাকালেন ডিসপ্লে বোর্ডে।
কোন ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছেন মহিলা, জানা ছিল সৌম্য এবং সঙ্গীদের। দুবাই টু কলকাতা, এমিরেটস-এর উড়ান কলকাতার মাটি ছুঁল আধঘণ্টার মধ্যেই। অন্য অনেকের সঙ্গে বেরিয়ে এলেন এক সুগঠিত চেহারার যুবক। যাঁকে বেরতে দেখেই এগিয়ে গেলেন মহিলা। জড়িয়ে ধরলেন আলতো। এবং আলিঙ্গনপর্ব শেষ হতে না হতেই দেখলেন, দুই মহিলা সহ চারজন ঘিরে ধরেছেন আচমকা। যাঁদের একজন সরাসরি যুবকের হাত চেপে ধরেছেন, কোনও ভূমিকা না করেই অল্প কথায় বলেছেন, যা বলার ছিল।
—ইয়োর গেম ইজ় আপ..
—হোয়াট? হোয়াট গেম আর ইউ টকিং অ্যাবাউট? আই ডোন্ট গেট দিস …
কৌতূহলী ভিড় জমার আগেই পকেট থেকে আই কার্ড বার করেন সৌম্য, মেলে ধরেন দুবাই থেকে সদ্য কলকাতায় আসা যুবকের সামনে। সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট, কলকাতা পুলিশ।
জোঁকের মুখে নুন পড়লে যা অবধারিত, চোখমুখ নিমেষে রক্তশূন্য হয়ে যায় যুবকের। মহিলারও। মিনিটখানেকের মধ্যেই একটা টাটা সুমো এসে থামে গেটের সামনে। যাতে দু’জনকে চাপিয়ে গাড়ি বেরয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে।
গন্তব্য? কোথায় আর? গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার!
.
গোওওওল! বল জড়িয়ে গেছে জালে। তারপর যা হয়, গোলদাতাকে ঘিরে উচ্ছ্বাস এক দলের। গোলকিপারকে নিয়ে হা-হুতাশ বিপক্ষের।
শীতশেষের ফেব্রুয়ারিতে ফুটবলের তেমন চল নেই কলকাতা ময়দানে। ব্যাটে-বলেরই দাপট থাকে ওসময়টা। ময়দানের এই মাঠটায় ছেলেগুলো তবু দিব্যি ফুটবল পেটাচ্ছে। অফ সিজ়ন প্র্যাকটিস?
মাঠের বাইরে একটা চেয়ারে বসে লাল-কালো ট্র্যাকসুট পরিহিত যিনি নজর রাখছেন ছেলেগুলোর উপর, তাঁর দিকে এগিয়ে যান দুই যুবক। নিয়মরক্ষার আলাপ-পরিচয়ের পর সোজাসুজি আর্জি জানান।
—দাদা, আমাদের একটা ভাল স্ট্রাইকার চাই। বলটা যে মোক্ষম সময়ে তিন কাঠির মধ্যে রাখতে পারবে। গোল করার লোক নেই আমাদের টিমে।
লাল-কালো ট্র্যাকসুট চুপ করে শুনলেন। এবং তারও মিনিটখানেক পর সামান্য হাসলেন। সে হাসি দেখে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ মনে পড়ে যায় দুই যুবকের। শুণ্ডির রাজা মেয়ের জন্য পাত্র হিসেবে গুপীকে ভেবে রেখেছেন শুনে বাঘার মাথায় বজ্রাঘাত। উদভ্রান্ত বাঘাকে আশ্বস্ত করে হল্লারাজার টিপ্পনী, ‘রাজকন্যা কি কম পড়িতেছে?’ অবিকল সেই হাসি ভদ্রলোকের মুখে। শুধু ‘রাজকন্যা’-র বদলে ‘ফুটবলার’ বসিয়ে দিতে হবে, এই যা। শেষ দৃশ্য ‘আর কম পড়িতেছে?’—মার্কা হাসি।
—স্ট্রাইকার? পাচ্ছেন না? তা বাজেট কত আপনাদের?
—আপনিই বলুন মিল্টনদা, কত দিতে হবে? আসলে সঞ্জয়ের হঠাৎ চোট হয়ে গেল। সঞ্জয়, আমাদের টপ গোলস্কোরার। লিগামেন্ট টিয়ার, মাঠে ফিরতে ফিরতে বেশ কয়েক মাস তো বটেই। এদিকে পাঁচ দিন পরে ফাইনাল… ভাল স্ট্রাইকার ছাড়া কোনও চান্স নেই আমাদের।
—খেলা কোথায়? কত মিনিটের?
—পাইকপাড়ায়। এই খেপ টুর্নামেন্টটা প্রতি বছর এ সময়েই হয়। সত্তর মিনিট। থার্টিফাইভ – থার্টিফাইভ।
—হুঁ, বিদেশি ছেলে আছে একটা। বেনসন। গত বছর কলকাতা লিগের সেকেন্ড ডিভিশনে খেলেছে। তেরোটা গোল করেছে। দু’পায়েই ভাল শট আছে। হেডটাও ভাল। সিক্স ফিট প্লাস… হাইটটা কাজে লাগাতে জানে।
হাতে যেন চাঁদ পান দুই যুবক।
—ওর কথা আমরাও শুনেছি। ওকে পেলে তো কথাই নেই কোনও… ইন ফ্যাক্ট, ওর জন্যই আসা… দিন আমাদের ছেলেটাকে… প্লিজ় দাদা… আমরা জানি, আপনি যেখানে খেলতে বলেন, সেখানেই খেলে ও।
তৃপ্তির হাসি হাসেন ‘দাদা’। মধ্যপঞ্চাশের মিল্টনদা। ‘প্রাচীন ময়দান প্রবাদ’ অনুযায়ী যিনি এখানে-ওখানে ছোটখাটো ‘খেপ’ টুর্নামেন্টে ফুটবলার সাপ্লাইয়ে ডক্টরেট করে ফেলেছেন।
—ম্যাচ প্রতি পাঁচ হাজার নেয়। পোষাবে?
সোজাসাপটা কথা। তেল মাখতে গেলে কড়ি ফেলতে হবে। মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন দুই যুগল।
—পাঁচ? একটা ম্যাচের জন্য একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে… কিন্তু আপনি যখন বলছেন গোলটা ভাল চেনে, তখন না হয় পাঁচই দেব। ফাইনালটা জিততেই হবে যে ভাবে হোক। প্রেস্টিজ়ের ব্যাপার..
ফের একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন মিল্টনদা।
—আমি যখন বলছি মানে? না ভাই .. আমি বলছি বলে দিতে হবে না। নিজেরাই দেখে নিতে পারেন। পরশু বেনসন একটা খেপ খেলতে যাবে। ইচ্ছে করলে গিয়ে দেখে নেবেন। টাকাপয়সার কথা না হয় তারপর হবে।
—না… মানে… আমরা ঠিক ওভাবে বলতে চাইনি… আসলে অনেকগুলো টাকা তো… কোথায় খেলা পরশু?
—হাওড়ায়। সাঁতরাগাছি পেরিয়ে। বিকেল তিনটেয়।
হাওড়ার মাঠটা ঠিক কোথায়, মিল্টনের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে হাঁটা দেন ওঁরা দু’জন। যাঁদের একজন প্রশ্ন করেন অন্যকে, ‘সেভেন্টি মিনিটের ম্যাচে পাঁচ হাজারটা একটু বাড়াবাড়ি না!’
উত্তরও আসে চাঁচাছোলা, ‘ওটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। দশ চাইলেও দিতে হত, বিশ চাইলেও দিতে হত, জানিসই তো!’
.
—আমরা জাস্ট ক্লুলেস স্যার… এমন তো কখনও হয়নি আগে!
শুনতে শুনতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে নগরপালের। এটা তো নতুন ধরনের ক্রাইম। এ শহরে অন্তত এর আগে হয়নি। বাকি দেশেও হয়েছে কি? মনে তো হয় না।
আইসিআইসিআই ব্যাংকের RCU (Risk Containment Unit, গ্রাহক এবং ব্যাংক, আদানপ্রদানের প্রক্রিয়া যাতে দুই তরফেই থাকে যথাসম্ভব ঝুঁকিহীন, সেই শাখা)-এর প্রধান রীতিমতো ঘামছিলেন ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে।
—আমরা বুঝতে পারছি না কী করব … ফিনান্সিয়াল লস কুড়ি লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। হেড অফিস থেকে রোজ ফোন, রোজ মেল। পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, টেকনিক্যাল কোনও প্রবলেম, যেটা ইন্টারন্যালি সর্ট আউট হয়ে যাবে। কিন্তু হচ্ছে না… প্লিজ় ডু সামথিং স্যার।
—কী ব্যাপার? কীসের লস?
—সংক্ষেপে, বিভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহকদের এটিএম কার্ডের তথ্য কোনওভাবে জেনে যাচ্ছে জালিয়াতরা। ধরুন, আমেরিকার ব্যাংকে মার্কিন নাগরিক রামের টাকা রাখা আছে। রামের কাছে সেই ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড আছে। সেই কার্ডের যাবতীয় তথ্য চুরি হয়ে ঢুকে যাচ্ছে এদেশের কোনও ব্যাংকের গ্রাহক শ্যামের ক্রেডিট কার্ডে। রামের কার্ডের ব্যালান্স নিয়ে শ্যাম দেদার কেনাকাটা করে চলেছে। এইভাবেই যদুর টাকা নিয়ে মধু।
এবার রাম যখন জানতে পারছে যে তার টাকা অন্য কেউ হাওয়া করে দিয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই দ্বারস্থ হচ্ছে ব্যাংকের। ফেটে পড়ছে ক্ষোভে। ব্যাংকের কাছে দাবি করছে লোপাট হয়ে যাওয়া টাকার ক্ষতিপূরণ। মার্কিন ব্যাংক তখন আর কী করবে? ভারতের যে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে জালিয়াতিটা হয়েছে, তাদের কাছে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ সহ চিঠি পাঠাচ্ছে, ‘আমাদের গ্রাহকের হকের টাকা ফেরত দাও।’ ফেরত না দিয়ে উপায় নেই। দিতে হচ্ছে, এবং ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে চলেছে।
আইসিআইসিআই ব্যাংক শিকার হয়েছে এই জালিয়াতির। যার ব্যাপ্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে ক্রমশ। দশ-বিশ হাজারের ব্যাপার নয়। ক্ষতির অঙ্ক লাখ ছাড়িয়ে কোটি ছুঁয়ে ফেলবে এভাবে চললে।
নগরপাল প্রশ্ন করেন ব্যাংককর্তাকে, ‘আপনাদের ইন্টারন্যাল এনকোয়ারি কী বলছে?’
—সেটা তো চলছেই স্যার। কিন্তু ট্র্যাক পাওয়া যাচ্ছে না কিছু। গত পরশু অবশ্য একটা জিনিস ঘটেছে।
—কী?
—শহরের যেখানে যেখানে আমাদের EDC (Electronic Data Counter) আছে, সবাইকে আমরা অ্যালার্ট করে দিয়েছিলাম। বউবাজারের একটা দোকানে একটা ছেলে গতকাল বেশ দামি একটা সোনার চেন কিনে ক্রেডিট কার্ড দিয়েছিল। কার্ড দেখে দোকানের লোকের একটু সন্দেহ হয়। ছেলেটার কাছে আইডি প্রুফ দেখতে চাওয়া হয়। তখন এটা দিয়েছিল। এই যে…
পকেটে হাত ঢুকিয়ে যে কাগজটা বার করে আনেন ভদ্রলোক, সেটা একটা ড্রাইভিং লাইসেন্সের জেরক্স। মুখের অবয়ব আবছা।
—স্যার, আমরা ভেরিফাই করেছি মোটর ভেহিকলস থেকে। এটা জাল।
নগরপাল চোখ বুলোন জেরক্সটায়। লাইসেন্সে নাম, মহম্মদ সিকন্দর।
—ঠিক আছে। একটা লিখিত অভিযোগ করুন লোকাল থানায়। রেজিস্টার্ড হয়ে যাক কেসটা।
ভদ্রলোক বেরিয়ে যাওয়ার পর ইন্টারকমে ডিসি ডিডি-কে ধরেন সিপি।
—Anti Bank Fraud সেকশনের অফিসারদের নিয়ে বসতে চাই একবার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
.
কার্ড স্কিমিং(Card Skimming)। শব্দ দুটো এখন শুধু পুলিশ নয়, প্রায় সবাই জেনে গেছেন। খবরের কাগজের দৌলতে স্কিমিং নিয়ে একটা প্রাথমিক ধারণাও হয়ে গেছে অনেকেরই। কয়েকমাস আগে এটিএম জালিয়াতি নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল কলকাতায়। বহু মানুষের টাকা লোপাট হয়ে গিয়েছিল। মূল চক্রী ছিল কয়েকজন রোমানিয়ান নাগরিক। খুব দ্রুত যাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধরা গিয়েছিল বলে রক্ষে। না হলে আরও কত মানুষের কষ্টের টাকা যে বেমালুম উধাও হয়ে যেত, ঠিকঠিকানা নেই।
এ কাহিনি আজ থেকে আট বছর আগের। তখন ‘কার্ড স্কিমিং’ ব্যাপারটা যে কী, খায় না মাথায় দেয়, খুব স্পষ্ট ধারণা ছিল না অফিসারদের। শব্দ দুটো শোনা ছিল বড়জোর, এই পর্যন্তই। ‘Anti Bank Fraud’ বিভাগটাই চালু হয়েছিল মাত্র বারো বছর আগে। ২০০৬ সালে।
ব্যাংকের তরফে শেক্সপিয়র সরণি থানায় যে মামলাটা দায়ের করা হল, তার তদন্তভার পড়ল সাব-ইনস্পেকটর সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের (বর্তমানে বড়বাজার থানার ওসি) উপর। সিপি অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বুঝিয়ে বললেন স্কিমিংয়ের ব্যাপারে। এবং স্পষ্ট জানালেন, দ্রুত কিনারা করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে। এই জালিয়াতি চলতে থাকলে একটা সময় ব্যাংকিং ব্যবস্থার কাঠামোটাই নড়বড়ে হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষের টাকা আর নিরাপদ থাকবে না। সুতরাং চাই অঙ্কুরেই বিনাশ।
অঙ্কুরে বিনাশ বললেই তো আর হল না। অপরাধের কী-কেন-কখন জানলে তবেই না অপরাধীর খোঁজ! ইন্টারনেট ঘেঁটে, বইপত্র পড়ে স্কিমিং সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করলেন সৌম্য। যথাসাধ্য বোঝালেন সতীর্থদেরও।
ক্রেডিট কার্ডের পিছনে যে বাদামি রঙের রেখাটা থাকে, তার মধ্যে অদৃশ্যভাবে ঢোকানো থাকে কিছু তথ্য। যা সাধারণ ব্যাংক কর্মচারীদেরও জানার কথা নয়। সেই তথ্য চুরি করল কেউ। এবং প্রযুক্তির সাহায্যে অন্য ক্রেডিট কার্ডের পিছনের বাদামি রেখাটার ভিতর ঢুকিয়ে সেই কার্ড ব্যবহার করল। এটাই ‘স্কিমিং’। কিন্তু চুরিটা হয় কী করে?
আপনি এটিএম কাউন্টারে গেলেন। কম্পিউটার স্ক্রিনের নীচে যেখানে একটা সবুজ রঙের যন্ত্রে লেখা থাকে, ‘Insert your card here’, সেখানে নিয়মমতো কার্ড ঢোকালেন। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না যে ওই যন্ত্রটির ওপরে লাগানো একটা অন্য যন্ত্রে (স্কিমিং ডিভাইস) মুহূর্তে রেকর্ড হয়ে গেল কার্ডে সঞ্চিত তথ্য। এরপর কি-বোর্ডে টাইপ করলেন গোপন পিন নাম্বার। কিন্তু বুঝতে পারলেন না কি-বোর্ডের উপর নিখুঁত লাগানো আরেকটা কি-বোর্ডের মতোই দেখতে যন্ত্রের মাধ্যমে রেকর্ড হয়ে গেল আপনার পিন নাম্বার।
এটিএম ছেড়ে আপনি বেরিয়ে গেলে বাকিটা ‘এসো ভাই, বোসো ভাই, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’-এর মতো সোজা। জালিয়াতরা কাউন্টারে ঢুকে খুলে নিয়ে গেল সেই স্কিমিং ডিভাইস, যেটা তারা আগে থেকে লাগিয়ে রেখে গিয়েছিল। এবার চুরি করা তথ্যের মাধ্যমে ডামি কার্ড তৈরি করা এবং অন্যের টাকা আত্মসাৎ করা কোনও ব্যাপারই না।
আইসিআইসিআই ব্যাংকের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছিল, নগরপালকে যা সংক্ষেপে বলেছিলেন ব্যাংককর্তা, সেটা আরও বিশদে জানলেন সৌম্য। কী? ধরা যাক, আজকের বাজারে ভারতীয় মুদ্রায় ১ ডলারের বিনিময়মূল্য ৭০ টাকা। এবার ধরুন, কোনও মার্কিন ভদ্রলোকের ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরি করল কেউ। তথ্য চলে এল ভারতে, শাগরেদের কাছে। ভুল ঠিকানা দিয়ে একটা ভারতীয় ক্রেডিট কার্ড যে আগেই তুলে রেখেছিল। যাতে ব্যালান্স ছিল জিরো।
এবার শাগরেদ কী করল, সোনার দোকানে গিয়ে ১০০ ডলার খরচ করে গয়নাগাটি কিনল। মানে, সাত হাজার টাকার গয়না। মার্কিন ভদ্রলোকের কার্ড থেকে ১০০ ডলার লোপাট হয়ে গেল। এবং চোর গয়না নিয়ে চম্পট। দোকানের মালিক জানলেন না, অমুকের কার্ডের তথ্য নিয়ে তমুককে গয়না বেচে দিলেন। বেচার সময় কার্ডটা দোকানে রাখা ছোট্ট মেশিনটায় ঘষে একটা ‘চার্জস্লিপ’ নামের যে চিরকুট বেরল, সেই স্লিপ ব্যাংকে জমা দিয়ে পরের দিন সাত হাজার টাকা তুলেও নিলেন দোকানি।
টনক নড়ল কখন? যখন সেই মার্কিন ভদ্রলোক নিজের ব্যাংকে গিয়ে হইচই করলেন। এটা কী ব্যাপার? আমার কার্ড থেকে সাত হাজার টাকার গয়না কেনাকাটার খরচ দেখানো হয়েছে। তা-ও আবার ভারতে গিয়ে। ইয়ার্কি নাকি? ভারতে যাইই নি কখনও! সত্যিই যাননি, পাসপোর্ট জানান দিচ্ছে স্পষ্ট। আমেরিকার ব্যাংক এবার ভারতীয় ব্যাংকের কাছে ১০০ ডলার চেয়ে পাঠাল অকাট্য তথ্যপ্রমাণ সমেত। ভারতীয় ব্যাংক নিজের কোষাগার থেকে টাকা দিতে বাধ্য হল। অথচ গয়নার দোকানদারকে সেই টাকাটা আগেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে চার্জস্লিপ অনুযায়ী। গয়না কেনার নথি তো কার্ডে ঠিকঠাকই ছিল। দোকানে খোঁজ নেওয়া হল। দোকানি বললেন, কোনও বিদেশি ওই গয়না কেনেনি। তা হলে?
‘তা হলে’-র একটাই উত্তর। বিদেশি ভদ্রলোকের কার্ডের তথ্য চুরি করে ভারতীয় কার্ডে সেই তথ্য ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল। স্কিমিং! যার জেরে আইসিআইসিআই ব্যাংককে লক্ষ লক্ষ টাকা খেসারত দিতে হচ্ছিল।
দেশের কোথাও তখনও, সেই ২০১০ সালে, এমন কোনও ঘটনা লিপিবদ্ধ নয়, যেখানে ‘কার্ড স্কিমিং’ করে লক্ষ লক্ষ টাকা নয়ছয় হয়েছে। সাম্প্রতিক এটিএম জালিয়াতিতে রোমানিয়ার নাগরিকরা জড়িত ছিল। ভারতীয়দের কার্ডের তথ্য চুরি করে দুষ্কর্মটা ভারতীয় ব্যাংকের এটিএম-এই হয়েছিল। কিন্তু দশ বছর আগের এই মামলায় অবশ্য দেখা যাচ্ছিল, বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিদেশে বসবাসকারী নাগরিকের কার্ডের তথ্য চুরি করে ‘স্কিমিং’ করা হয়েছে ভারতে। মানে, চক্র বিস্তৃত আমেরিকা পর্যন্ত!
ঘোর দুশ্চিন্তার কারণ ছিল লালবাজারের। এক তো এ ধরনের অপরাধ ঘটেছে প্রথম। তদন্তের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। দুই, চক্রের একাংশ যদি থাকে বিদেশে, আর বাকিটা এদেশে, একটা আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়ে যায় পুরো ব্যাপারটা। কিন্তু তা বলে তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা চলে না। এই গ্যাংটাকে ধরতে তো হবে।
‘ধরতে হবে’ ভাবা এক, আর ‘ধরা’ আরেক। ‘লাও তো বটে, কিন্তু আনে কে!’ চেনা ছকের বাইরে অপরাধ। কাজে আসবে না সোর্স নেটওয়ার্ক। পুলিশই ভাল করে জানত না, কীভাবে এই জালিয়াতিটা করা যায়। সোর্স কী করে জানবে? অপরাধীদের সম্পর্কে কিছু ‘ক্লু’ পেলে তবেই সোর্সকে কাজে লাগানোর প্রশ্ন। আপাতত হাতে তথ্য কী? শুধু ওই জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সের জেরক্স। আবছা মুখাবয়ব। নাম মহম্মদ সিকন্দর।
শহরের থানাগুলোকে সতর্ক করা হল। খবর পৌঁছে দেওয়া হল এলাকার সেই সমস্ত দোকানগুলোতে, যেখানে কার্ডের মাধ্যমে কেনাকাটার ব্যবস্থা রয়েছে। বলে দেওয়া হল, কেনাবেচার সময় চোখ-কান খোলা রাখতে। কোনও কার্ডের ব্যাপারে ন্যূনতম সন্দেহ হলেই পুলিশকে জানাতে সঙ্গে সঙ্গে। এবং মামলা রুজু হওয়ার দিনদশেক পরে প্রথম খবর এল পার্ক স্ট্রিট থানায়।
‘খবর’ বলতে, একটা ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস-এর দোকানে দু’জন অল্পবয়সি ছেলে এসেছিল ল্যাপটপ কিনতে। সঙ্গে কার্ড। কিন্তু কার্ড ‘সোয়াইপ’ করার পর দেখা যায়, কার্ডের নম্বরের সঙ্গে প্রিন্ট স্লিপের কিছু তফাত আছে। একটি ছেলেকে দোকানে বসিয়ে রাখা হয়েছে। অন্যজন? গেছে অন্য কার্ড আনতে।
থানা থেকে ‘ব্যাংক ফ্রড’ সেকশনে খরব আসতেই সঙ্গী অফিসারদের নিয়ে ছুটলেন সৌম্য। সুরাহা বোধহয় হয়েই গেল তদন্তের। আর সুরাহা! বছর বিশেকের যে ছেলেটি কাঁচুমাচু মুখে দোকানে বসে ছিল, তার নাম অঙ্কুশ তেওয়ারি। কলেজের গণ্ডি সবে ছাড়িয়েছে। বেকার। বাড়ি মানিকতলায়। আটক করা হল। জেরার পর্বটা তুলে রাখা হল লালবাজারে ফেরা পর্যন্ত। যে ছেলেটির অন্য কার্ড নিয়ে ফিরে আসার কথা, তার জন্য অপেক্ষা করা হল অনেকক্ষণ। কিন্তু সেই ছেলেটা সেই যে গেল, গেল তো গেল, আর এল না।
কে ছেলেটি? লালবাজারে রাতভর দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদে অঙ্কুশ জানাল, ছেলেটির সঙ্গে অল্প দিনেরই পরিচয়। নাম, মণিময় আগরওয়াল। আলাপ মিডলটন স্ট্রিটের এক চায়ের দোকানে। ছেলেটি দিনকয়েক আগে অঙ্কুশকে অনুরোধ করে, ‘তুই তো ভাই বেশ টেকস্যাভি, আমি একটা ল্যাপটপ কিনব ঠিক করেছি, দোকানে যাবি আমার সঙ্গে? স্পেসিফিকেশনগুলো জাস্ট বুঝিয়ে দিস কেনার সময়। যাতে ঠকে না যাই।’
—কোথায় থাকে মণিময়?
— ঠিকানা জানা নেই, তবে বলেছিল, আলিপুরের দিকে।
—মোবাইল নম্বর?
— মোবাইল আছে মণিময়ের, কিন্তু নম্বর জানি না।
—নম্বর জানা নেই মানে?
—সত্যি জানি না স্যার! আমার নিজের মোবাইল নেই। ওর মোবাইল নম্বর নেওয়ার দরকার পড়েনি সেভাবে।
উৎসাহিত হওয়ার মতো সূত্র একটাই। ড্রাইভিং লাইসেন্সে যে মহম্মদ সিকন্দরের ছবি ছিল, সেটা অঙ্কুশকে দেখানো হল। এবং অঙ্কুশ জানাল, এই ছবির সঙ্গে মণিময়ের মুখের প্রায় হুবহু মিল।
অঙ্কুশকে পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ ছেড়ে দিলেন গোয়েন্দারা। কুড়ি বছরের ছেলেটি লালবাজারের গেট থেকে বেরিয়ে যখন হাঁটা দিল, জানতেও পারল না, সাদা পোশাকে দু’জন অফিসার নিঃশব্দে অনুসরণ করছেন নিরাপদ দূরত্ব থেকে। যাঁরা অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, মানিকতলার বাসিন্দা অঙ্কুশ দক্ষিণ কলকাতাগামী মিনিবাসে উঠে বসলেন। নিমেষের মধ্যে একই বাসে সহযাত্রী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন দুই অফিসার।
পার্ক সার্কাসের কাছে নামল অঙ্কুশ। কিছুটা হেঁটে গিয়ে ঢুকল Ice Skating Rink–এর উলটোদিকের এক নামকরা কফিশপে। বেরিয়ে এল মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। ফের হাঁটা দিল পার্ক সার্কাসের দিকে। এবং উঠে পড়ল উত্তরমুখী বাসে। কফিশপের সার্ভিস বয়ের সঙ্গে কথা বললেন অফিসাররা। অঙ্কুশ কিছুই অর্ডার করেনি। শুধু বলে গেছে, ‘আমার নাম অঙ্কুশ। আমার এক বন্ধুর একটু পরে এখানে আসার কথা। দু’জনে একসঙ্গে কফি খাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার একটা জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় পুলিশে যেতে হবে। বাড়িতে ক’দিন আগে একটা চুরি হয়ে গেছে। কেস হয়েছে। পুলিশ ডেকেছে লালবাজারে। তাই থাকতে পারছি না। কেউ এসে আমার নাম করে খোঁজ করলে বলে দেবেন, আমি আজ আর আসব না।’
আরও জানা গেল, অঙ্কুশ মাসে এক-দু’বার এখানে আসে কফি খেতে। কখনও একা, কখনও সঙ্গে দু’-তিনজন বন্ধু থাকে। এই বন্ধুদের মধ্যে একজন ছ’ফুটের উপর লম্বা নাইজেরিয়ানও আছে। যাকে ‘বেনসন’ বলে ডাকে অন্যরা। বেশিরভাগ সময় ফুটবলের জার্সি আর শর্টস পরেই আসত বেনসন। সার্ভিস বয় কথায় কথায় জানতে পেরেছিল, বেনসন ফুটবলার। কলকাতা ময়দানে খেলে।
এটুকু বোঝা যাচ্ছিল, অঙ্কুশকে যতটা চালাক ভাবা গিয়েছিল, বাস্তবে তার থেকে একটু বেশিই চতুর। কফির দোকানে যাওয়ার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। তার বন্ধু বা বন্ধুদের কাছে ওই সার্ভিস বয়ের মাধ্যমে খবর পৌঁছনো, পুলিশ ‘ট্র্যাক’ করছে। সাবধান!
যে বন্ধুর সঙ্গে অঙ্কুশের কথা ছিল কফিশপে দেখা করার, সে কে? মণিময় আগরওয়াল, যে কার্ড বদলে আনছি বলে পার্ক স্ট্রিটের দোকান থেকে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল? না কি অন্য কেউ? কেউ আসেনি অঙ্কুশের খোঁজে। কোনওভাবে খবর দিয়ে দিয়েছিল অঙ্কুশ বাড়ি ফেরার পথে? কোন পিসিও বুথ থেকে ফোন করে দিয়েছিল? কী-ই বা এমন কঠিন!
ডিসি ডিডি মিটিংয়ে বসলেন অফিসারদের নিয়ে। যা যা তথ্য হাতের কাছে ছিল, ঝালিয়ে নেওয়া হল।
এক, অঙ্কুশ ছেলেটা গোলমেলে। সেই জিজ্ঞাসাবাদের পরদিন থেকে মানিকতলার বাড়ি আর পাড়ার বাইরে বেরচ্ছেই না প্রায়। মোবাইল নেই বলে আরও মুশকিল। কার সঙ্গে কীভাবে কখন যোগাযোগ করছে, জানার উপায় নেই।
দুই, মণিময় চক্রের সঙ্গে যুক্ত, সন্দেহ নেই। কিন্তু খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ‘মহম্মদ সিকন্দর’-ই যে মণিময়, তা নিয়েও সংশয়ের জায়গা নেই। কফিশপের সার্ভিস বয় ছেলেটি বিহারি। লাইসেন্সের ছবি দেখে চিহ্নিত করেছে মণিময়কে। এবং জানিয়েছে, মণিময় তাকে বলেছিল, মল্লিকবাজারে তার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের কাপড়ের দোকান আছে। ছট পুজোর আগে সস্তায় জামাকাপড় কিনিয়ে দেবে।
সে না হয় হল, কিন্তু মল্লিকবাজারে অসংখ্য কাপড়ের দোকান। কোনটা মণিময়ের আত্মীয়ের, কী করে জানা যাবে? সিদ্ধান্ত হল মল্লিকবাজারে নজরদারির। জাল লাইসেন্সের ছবির প্রিন্টআউট সঙ্গে নিয়ে সোর্সরা মাঠে নামল।
তিন, বেনসন। নাইজেরীয় ফুটবলার। যাকে দ্রুত চিহ্নিত করা দরকার, কোথায় থাকে জানা দরকার। কী করে ফুটবল ছাড়া, জানতে হবে।
—স্যার, অঙ্কুশকে আরেকবার জিজ্ঞাসাবাদ করলে হয় না? সৌম্য প্রশ্ন করেন ডিসি ডিডিকে।
—করাই যায়। কিন্তু লাভ হবে কি কিছু? নতুন কিছু বেরবে? যেটুকু বলেছে, তার বেশি বলবে বলে মনে হয় না। আর যতটা বলেছে, তার থেকে খুব বেশি জানে তারও তো গ্যারান্টি নেই।
—হুঁ…
—একটু তলিয়ে ভাবো… অঙ্কুশ বা মণিময় জালিয়াতি চক্রের অংশ হতেই পারে, কিন্তু এই গ্যাং-এর শিকড় বিদেশে। কলকাতার দুটো ছেলের পক্ষে এই মাপের চক্র চালানো মুশকিল। এরা বড়জোর টিম মেম্বার। আসল পান্ডাদের খুঁজে বার করতে হবে। অঙ্কুশকে আর ডাকার দরকার নেই। ওকে ভাবতে দাও, ব্যাপারটা মিটে গেছে। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা শ্যাডো করো। কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে দেখা করছে, সব…
—আর বেনসন?
—ওটা ইমপরট্যান্ট, ভেরি ইমপরট্যান্ট। ফরেন কানেকশন বলতে আপাতত বেনসনই। ওর সম্পর্কে খোঁজ নাও ডিটেলে। কোথায় থাকে, সেটা জানতে পারলে লোক বসিয়ে দাও বাড়ির সামনে। ওর মুভমেন্টের ব্যাপারেও রাউন্ড-দ্য-ক্লক রিপোর্ট জরুরি।
—ওকে আইডেন্টিফাই করাটা খুব সমস্যা হবে না স্যার। পেয়ে যাব মনে হয়। পেলে তুলে আনব লালবাজারে?
—নো। বাই নো মিনস। আমরা তো এখনও জানিই না ওর কতটা ইনভলমেন্ট। বা আদৌ ইনভলমেন্ট আছে কিনা। কিছু প্রমাণও নেই। কী হবে তুলে এনে? একটা কফিশপে অঙ্কুশ-মণিময়ের সঙ্গে সময় কাটায়। তো? হোয়াট ডাজ় দ্যাট প্রুভ?
—রাইট স্যার…
—জিজ্ঞেস করার মতো কিছু তো নেই এখনও। তারপরও ডাকলে উলটো ফল হবে। আমাদের ছেড়ে দিতে হবে ইন্টারোগেশনের পর। আর যদি সত্যিই ও এই চক্রের সদস্য হয়, তা হলে বেরিয়ে গিয়েই বাকিদের অ্যালার্ট করে দেবে। একটা ফোন, বা একটা ই-মেল, একটা টেক্সট মেসেজ়, ব্যস। আপাতত লোকটাকে ট্র্যাক করে ওর উপর নজরদারি চালানো ছাড়া কিছু করার নেই।
ট্র্যাক করার জন্য যা করণীয় ছিল, করলেন সৌম্য। ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএফএ) অফিসে পরের দিন দুপর নাগাদ ঢুঁ মারলেন। নিজের পরিচয় গোপন রেখে।
নাইজেরিয়ান ফুটবলারদের লিস্ট পাওয়া যাবে? ফার্স্ট ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশনের? চলতি মরশুম এবং তার আগের দু’-তিন বছরের?
আইএফএ-র কর্মকর্তা ভদ্রলোক প্রশ্ন করেন নিস্পৃহ ভঙ্গিতে।
—কী দরকার? খেপ?
সৌম্য হাসেন অপ্রস্তুত।
—হ্যাঁ… মানে… কী করে বুঝলেন?
মধ্যবয়সি কর্মকর্তার ঠোঁটে একটা বিদ্রুপের হাসি খেলে যায়। যেন মাছকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, ভাই সাঁতার শিখলে কী করে?
—ফেব্রুয়ারিতে নাইজেরিয়ান প্লেয়ারের খোঁজ করতে একটা কারণেই লোক আসে।
—দাদা, আমরা আসলে একজন ভাল স্ট্রাইকারের খোঁজ করছিলাম। বেনসন বলে একটা ছেলে শুনেছি ভাল খেলছে ইদানীং। কিন্তু ঠিকানা জানি না। যদি একটু যোগাযোগ করা যায়… সে জন্যই…
—বেনসন? এবার সেকেন্ড ডিভিশনে খেলেছে ছেলেটা। অনেক গোল-টোল করেছে শুনেছি। পরের রার হয়তো ফার্স্ট ডিভিশনে টিম পেয়ে যাবে।
সৌম্য আড্ডা জমানোর চেষ্টা করেন।
—বড় টিম? মানে মোহনবাগান- ইস্টবেঙ্গল?
কর্মকর্তা ফের হাসেন। একটা সিগারেট ধরান।
—দুর মশাই। খেপেছেন? অত সোজা? সবাই কি চিমা ওকোরি বা এমেকা ইউজিগো নাকি? ছোট টিমগুলোও এখন বড় চেহারার বিদেশি খোঁজে। যারা অ্যাটাকিং থার্ডে গুঁতোগুঁতি করে গোলটা করে দেবে ঠিক সময়ে। অ্যাটাকিং থার্ড কাকে বলে জানেন তো?
সৌম্য মৃদু হাসেন। ফুটবল নিয়ে কর্মকর্তার কচকচি অসহ্য ঠেকলেও ধৈর্য হারান না। নিজে ভাল ফুটবল খেলতেন ছোট থেকেই। রাজ্য স্তরের ফুটবলে পুরুলিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। রাত জেগে ফলো করেন লা লিগা, ইপিএল-এর প্রতিটা ম্যাচ। মাঠটার প্রতিটা অর্ধ-কে যে তিনটে ভাগে ভাগ করে নেওয়া হয়, ডিফেন্ডিং থার্ড, মিডল থার্ড আর অ্যাটাকিং থার্ড, এই কর্মকর্তার থেকে জানতে হবে?
—মোটামুটি জানি দাদা। তবে আপনার যা এক্সপিরিয়েন্স, আমরা তো নেহাতই বাচ্চা। বেনসনের একটা ছবি পাওয়া যাবে? মানে রেজিস্ট্রেশনের সময় ছবি তো দিতে হয়, সেখান থেকেই যদি… আর ঠিকানাটা…
—রেজিস্টার থেকে যা ছবি বেরয়, খুবই অস্পষ্ট। মুখাবয়ব পরিষ্কার করে বোঝার উপায় নেই। ঠিকানার জায়গায় লেখা আছে, ওয়াইএমসিএ হস্টেল, ধর্মতলা।
তবে ওই হস্টেলে না-ও পেতে পারেন। এরা কলকাতায় এসে সবাই ওখানেই প্রথমে ওঠে। তারপর একটু পয়সাকড়ি হাতে পেলে হয় একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া করে নেয়। নয়তো ‘পেয়িং গেস্ট’ হয়ে থাকতে শুরু করে কোথাও।
—কিন্তু যোগাযোগ করব কী ভাবে? ধরুন ওয়াইএমসিএ–তে যদি না পাই…
কর্মকর্তা ভদ্রলোক এক মিনিট ভাবেন। সৌম্যর চোখমুখ দেখে বোধহয় একটু মায়াই হয়।
—সেক্ষেত্রে একটাই রাস্তা। মিল্টনদা।
—মিল্টনদা?
—হ্যাঁ, ময়দানের পুরনো লোক। মাঠই ধ্যানজ্ঞান। অফ সিজ়নে খেপ কে কোথায় খেলছে, কে কোথায় খেলবে, পুরোটা জানে। কন্ট্রোল করে। বাটা গ্রাউন্ডে সকাল থেকে পাবেন রোজ।
সঙ্গী অফিসারকে নিয়ে মিল্টনদার কাছে পৌঁছে গেলেন সৌম্য পরদিন সকালে। বেনসনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবেন, আশ্বস্ত করলেন মিল্টন। দরদাম নিয়েও কথা হয়ে গেল।
—আপনি যখন বলছেন গোলটা ভাল চেনে, তখন না হয় পাঁচই দেব। ফাইনালটা জিততেই হবে যেভাবে হোক।
—আমি যখন বলছি মানে? পরশু একটা খেপ খেলতে যাবে। ইচ্ছে করলে গিয়ে দেখে নেবেন।
—কোথায় খেলা পরশু?
—হাওড়ায়। সাঁতরাগাছি পেরিয়ে।
.
সাঁতরাগাছি পেরিয়ে আরও বেশ কিছুটা। জায়গার নাম উনসানি। বেরতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল সৌম্য আর তাঁর সঙ্গীদের। তার উপর একটা গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়ে সাঁতরাগাছি ব্রিজ নট নড়নচড়ন। যখন গাড়ি গিয়ে মাঠের কাছাকাছি পৌঁছল, সেকেন্ড হাফ শেষ হতে বাকি মিনিট দশেক। ১-১। ম্যাচ শেষ হল ৩-১ স্কোরলাইনে। বেনসন দুটো গোল করল একাই। একটা হেডে। একটা গোলার মতো শটে। শেষ মুহূর্তে একটা শট বারে না লাগলে হ্যাটট্রিক হয়ে যায়। মিল্টন ভুল বলেননি। খেপ খেলায় এই বেনসনকে ম্যাচ পিছু পাঁচ হাজার দেওয়াই যায়।
টিমের বেশিরভাগ প্লেয়ার বাসে করে রওনা দিল কলকাতা। বেনসন চড়ে বসল একটা মারুতি ৮০০ গাড়ির পিছনের সিটে। খেপ-তারকার জন্য আলাদা ট্রিটমেন্ট। দ্বিতীয় হুগলি সেতু ধরে ছুটল মারুতি। পিছনে সামান্য দূরত্বে সৌম্যদের সাদা অ্যাম্বাসাডর।
বেনসনের গাড়ি যখন থামল তিলজলা এলাকার একটা একতলা ফ্ল্যাটের সামনে, সন্ধে নেমেছে কলকাতায়। সেই যে ফ্ল্যাটে ঢুকল, পরের দিন দুপুর অবধি বেরলই না বেনসন। নজরদারি চালু হল অষ্টপ্রহর। দেখা গেল রুটিন বলতে একটা মোটরবাইকে করে সকালে ময়দানে প্র্যাকটিসে যাওয়া আর মধ্য কলকাতার সদর স্ট্রিটে একটা ফ্ল্যাটে পেয়িং গেস্ট হিসেবে বসবাস। মাঝেমধ্যে নিশিযাপন তিলজলায় ওই ফ্ল্যাটে।
কার ফ্ল্যাট? লিন্ডা স্যামুয়েলস। মধ্য তিরিশের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান যুবতী। সুন্দরী, বিবাহবিচ্ছিন্না। এক ছেলে, নাম সেবাস্তিয়ান। পড়ে মধ্য কলকাতার এক নামী কনভেন্ট স্কুলে। ক্লাস নাইন। লিন্ডা কাজ করেন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের এক স্টিল কোম্পানির অফিসে। রিসেপশনিস্ট। বেনসন ছাড়াও দু’-একজন নাইজেরিয়ান যুবক মাঝেমাঝে আসে। এক কি দু’দিন থাকে। তারপর চলে যায়। এক মাঝবয়সি নাইজেরীয় অবশ্য মাস দুয়েক অন্তর অন্তর আসেন। আর এলে থাকেন অন্তত দু’সপ্তাহ। এক-দু’দিনের জন্য নয়।
অতঃকিম? বেনসনের খোঁজ পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে হদিশ মিলেছে মণিময়েরও। নজরদারিতে থাকা সোর্স খবর দিয়েছে, মণিময়কে দেখা গেছে মল্লিকবাজারে এক প্রৌঢ়ের দোকানে কিছুক্ষণ কাটাতে। কার দোকান? মহাবীর আগরওয়াল, মণিময়ের বাবা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মহাবীরের দুটো বিয়ে। থাকেন আলিপুরে। মণিময় দ্বিতীয় পক্ষের একমাত্র সন্তান। এবং এলাকায় এই বয়সেই চিটিংবাজ হিসেবে দুর্নাম কুড়িয়েছে। মোবাইল নম্বর? পাওয়া গেল। ফোন বন্ধ। শেষ টাওয়ার লোকেশন হরিদ্বার। বেশ, ঘাপটি মেরে আছে। থাক। আজ নয় কাল, ফিরতে তো হবেই কলকাতায়। যাবে কোথায়?
অঙ্কুশের কী খবর? মানিকতলার বাড়ি থেকে বেরচ্ছেই না প্রায়। লিন্ডার গতিবিধিতেও সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। বেনসনও আছে নিজের মতো।
লিন্ডার বাড়িতে রেইড করে লাভ নেই। একজন প্রাপ্তবয়স্কা মহিলার একাধিক নাইজেরীয় বন্ধু থাকতেই পারে। তারা লিন্ডার ফ্ল্যাটে রাত কাটাতেই পারে। তাতে কী প্রমাণ হল? আসল ব্যাপার তো কার্ড স্কিমিং এবং তার নেপথ্যের চক্র। সেই চক্রের সঙ্গে এই বিদেশিদের জড়িত থাকার সম্ভাবনা আছে। সে থাকতেই পারে। কিন্তু আন্দাজের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেফতার করা যায় না। আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে উলটো ফলই হবে। চক্রের চাঁই যে বা যারা, সে বা তারা সাবধান হয়ে যাবে।
আরেকটা মুশকিল, লিন্ডা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। ২০১০ সালে বেসরকারি সংস্থায় কর্মরতা মহিলার মোবাইল ফোন নেই, ভাবাই যায় না। কেন নেই? মোবাইল না নেওয়ার পিছনে কোনও বিশেষ কারণ? কারণ সে যা-ই হোক, এই বেনসন-টেনসনের মতো নাইজেরীয় বন্ধুরা যোগাযোগ করে কী করে লিন্ডার সঙ্গে? ল্যান্ডফোন? রেকর্ড দেখা হল। সন্দেহজনক কিছু নেই।
একটাই রাস্তা পড়ে থাকে যোগাযোগের। ই-মেল। লিন্ডার অফিস থেকে ই-মেল আইডি জোগাড় করতে অসুবিধে হল না। এবার জানা দরকার কার কার সঙ্গে কী কী মেল চালাচালি হয়। জানার উপায়? হ্যাকিং। তদন্তের প্রয়োজনে ততদিনে ‘ethical hacking’ শুরু হয়ে গিয়েছে কলকাতা সহ দেশের সর্বত্র। কয়েকজন তুখোড় হ্যাকারের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ ছিলই। যাঁদের একজন লিন্ডার পাসওয়ার্ড ক্র্যাক করলেন মাত্র মিনিট পনেরোর মধ্যে।
আজকের দিনে পাসওয়ার্ড সুরক্ষিত রাখার ব্যাপারে আমি-আপনি অনেক সচেতন। সবাই জানি আমরা, অক্ষর-সংখ্যা-গাণিতিক চিহ্ন মিলিয়ে-টিলিয়ে একটা ভজঘট পাসওয়ার্ড তৈরি করা জরুরি। যেটা সহজে ভেদ করা যাবে না। সবাই জানেন, নিয়মিত পাসওয়ার্ড বদলানো দরকার। কিন্তু এ মামলা যখনকার, তখন সাইবার-সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতার মাত্রা ছিল অনেক কম।
লিন্ডাও ওই অসচেতনদের দলে পড়তেন। নিজের জন্মতারিখটা উলটে দিলে যা দাঁড়ায়, সেটা পাসওয়ার্ড হিসেবে রেখেছিলেন। যে তারিখটা লিন্ডার অফিস থেকে জানা হয়ে গিয়েছিল গোয়েন্দাদের। ‘চিচিংফাঁক’ হয়ে গেল লিন্ডার মেল।
গত কয়েক মাসের মেল ঘেঁটে বোঝা গেল, লিন্ডা পুরো ব্যাপারটা না-ই জানতে পারেন, কিন্তু তাঁর ফ্ল্যাটে যারা যাওয়া-আসা করে, তারা ধোয়া তুলসীপাতা নয়। পিটার বলে একজন প্রায়ই লিন্ডাকে নির্দেশ পাঠায় ই-মেলে। অমুক কাল কলকাতায় এক রাতের জন্য থেকে পরের দিন বাংলাদেশ যাবে, তাকে তোমার ফ্ল্যাটে থাকতে দিয়ো। তমুকের দিল্লিতে কিছু পুলিশি সমস্যা হয়েছে, আগামীকাল কলকাতায় যাবে। তোমার ফ্ল্যাটে রাতটা থাকবে। এইসব।
পিটারের মেলগুলোর প্রযুক্তিগত কাটাছেঁড়া করে জানা গেল, পাঠানো হয়েছে বিদেশ থেকে। কোন দেশ? নাইজেরিয়া!
হলই বা নাইজেরিয়া, কিন্তু জালিয়াতিতে জড়িত থাকার প্রমাণ? হয় কিছু প্রমাণ ছাড়া? হতাশ লাগছিল সৌম্যর। তা হলে কি এরা অন্য কোনও ধরনের বেআইনি কাজে যুক্ত? কার্ড স্কিমিং-এ নয়? কিন্তু আপাতত হাতে তো অন্য কোনও লিডও নেই, যে অন্য কোনও গ্যাং-এর খোঁজখবর করা যাবে। এ যা অবস্থা, শুধু পেনাল্টি বক্সের বাইরে পাসের দেওয়া-নেওয়াই চলছে। গোলের মুখ আর খোলা যাচ্ছে কই?
গোলের মুখ খোলার সামান্যতম আভাস মিলল দিনকয়েক পর। রোজই পিটার-লিন্ডার মেল চালাচালিতে চোখ রাখতেন সৌম্য। এক রাতে নিয়মমাফিক ‘হাই-হ্যালো-লাভ ইউ ডিয়ার’-এর পাশাপাশি পিটারের তরফে একটা মেল, ‘Please keep Mr.Stanley Rodrigues safe.’
মানে? Stanley Rodrigues-টা আবার কে? এ তো নতুন মোচড় তদন্তে। যাকে বলে, ‘কাহানি মে টুইস্ট’! কে স্ট্যানলি? সেই মাঝবয়সি, যে দু’মাস অন্তর আসে আর লিন্ডার ফ্ল্যাটে থাকে বেশ কিছুদিন? তা হলে স্ট্যানলিই কি নাটের গুরু? লিন্ডাকে মেল করে স্ট্যানলিকে ‘সেফ’ রাখতে বলছে কেন পিটার? ‘সেফ’ রাখার প্রয়োজন পড়ছে কেন? কী সম্পর্ক স্ট্যানলির সঙ্গে পিটারের? রাখতেই যদি হয়, স্ট্যানলিকে কোথায় ‘সেফ রাখবেন লিন্ডা? এই ফ্ল্যাট ছাড়া অন্য গোপন আস্তানা আছে মহিলার? নজরদারি তো সমানে চলছে। অফিস-বাড়ি আর রোববারে চার্চ, এর বাইরে তো কোথাও যান না মহিলা। বেনসন ছাড়া আর যে নাইজেরীয়রা মাঝেমধ্যে লিন্ডার ফ্ল্যাটে আসে, তাদের মধ্যে কারও কথা বলছে? যদি তা-ই হয়, ঝুঁকি নিয়ে লিন্ডার বাড়িতে রেইড করতে হয়। আর করলেও তখন এই স্ট্যানলি থাকবে, কী গ্যারান্টি? বরং খুঁচিয়ে ঘা করলে হয়তো স্ট্যানলি, যাকে পিটার নিরাপদে রাখার নির্দেশ দিয়েছে লিন্ডাকে, আর এ তল্লাট মাড়ালই না। তখন?
‘তখন’ যে পুরো গ্যাংটাই হাতের বাইরে চলে যেতে পারে, সেটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না গোয়েন্দাদের। আরও একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হচ্ছিল। এসব মামলায় ‘ডিজিটাল এভিডেন্স’ সংগ্রহ না করতে পারলে চার্জশিটটা দাঁড়াবেই না। আর সাইবার-ফুটপ্রিন্টস মুছে ফেলতে আর কতক্ষণ? সাবধানে পা ফেলা ছাড়া উপায় কী?
স্ট্যানলির খোঁজে ফের যাওয়া হল আইএফএ অফিসে। এই নামে কোনও নাইজেরীয় ফুটবলার আছে? নেই। নাইজেরীয় দূতাবাসে নেওয়া হল খোঁজখবর। এই নামের কেউ ভারতে এসেছেন সম্প্রতি? কোনও রেকর্ড আছে? পাওয়া গেল না। শহরের যেখানে যেখানে নাইজেরীয়দের বেশি দেখা যায়, সোর্স লাগানো হল সেখানে। স্ট্যানলি নামের কারও খোঁজ পেলেই যেন খবর পাওয়া যায়। সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, খবর এল না কিছু।
কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এবং ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির আরও টুকটাক অভিযোগ জমা পড়ছে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই। অথচ তদন্তে যা যা করার, সবই তো করা হচ্ছে। মার্চের মাঝামাঝি একদিন কাজ সেরে অফিস থেকে যখন বেরচ্ছেন হতোদ্যম সৌম্য, রাতের লালবাজার শুনশান। বোসপুকুরে নিজের ফ্ল্যাটে পৌঁছতে পৌঁছতে মাঝরাত হয়ে গেল সৌম্যর। ড্রয়িংরুমের সেন্টারটেবিলে ‘ফেলুদাসমগ্র’ রাখা। একমাত্র কন্যা ক্লাস সিক্সে পড়ে। গোয়েন্দাগল্পের পোকা। ফেলুদা বলতে অজ্ঞান। অবশ্য কে নয়? সময়-সুযোগ পেলে সৌম্য নিজেই পঞ্চাশবার পড়া ফেলুদা-কাহিনি আবার নিয়ে বসে যান পাতা উলটোতে। বইটায় বুকমার্ক দিয়ে শুতে গেছে মেয়ে। সৌম্য হাতে তুলে নেন। শোবার আগে ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’ পড়ছিল। গল্পটার নাম শুনলেই অবধারিত মনে পড়ে যায় কালীকিঙ্করবাবুর সেই টিয়ার কথা, ‘ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন একটু জিরো’। সিন্দুকের কম্বিনেশন লকের কোড। ফেলুদার মগজাস্ত্র যে কোডের রহস্যভেদ করেছিল, ‘থ্রি নাইন জিরো থ্রি নাইন এইট টু জিরো!’
ঘুম আসতে দেরি হবে আজ। মাথায় ঘুরছে Mr Stanley Rodriges। ফেলুদার বই রেখে দিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলেন সৌম্য। মগজাস্ত্রের প্রয়োগ যদি করা যেত ফেলু মিত্তিরের মতো! বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে একসময় উঠে পড়েন। কম্পিউটার খুলে বসেন। শূন্য থেকে শুরু করা যাক। কার্ড স্কিমিং-এর জালিয়াতি বিশ্বের কোথায় কোথায় কীভাবে হয়েছে, কীভাবে সমাধান হয়েছে, লিঙ্কগুলো আবার দেখা যাক। যদি দিশা পাওয়া যায় কিছু।
গুগল নিমেষে লিঙ্ক ভাসিয়ে দিল অসংখ্য। সৌম্য চোখ বোলাচ্ছিলেন। একটার হেডিং, ‘All you need to know about MSR’। এটা আগেও পড়েছিলেন। MSR, অর্থাৎ ‘Magnetic Stripe Readers’। দেখতে থাকেন সাব-হেডিং, “how to keep your card safe from MSR”.. ‘Magnetic Stripe Reader, a device used to read magnetic stripe cards such as credit cards.’
একবার পড়েন, দু’বার পড়েন। বারবার তিনবার পড়েন। তৃতীয় বারের পড়ায় শুধু দুটো শব্দে চোখ চুম্বকের মতো আটকে যায়। ‘Safe’ আর ‘MSR’। কেন চোখ সরছে না? কেন স্নায়ু আচমকাই চঞ্চল হয়ে উঠছে? কেন মস্তিষ্কে উত্তেজক তরঙ্গ টের পাচ্ছেন হঠাৎ?
সংকেত? কোড? ‘ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন’ -এর মতো? M ফর Mr, S ফর Stanley, R ফর Rodrigues? MSR? যাকে ‘safe’ রাখতে সাংকেতিক নির্দেশ পাঠিয়েছে পিটার? হতেই হবে.. এটা কোডই … কোড না হয়ে যায় না… Magnetic Stripe Reader? এ ছাড়া আর কোনও সম্ভাবনা পড়ে থাকে না। সৌম্য বুঝতে পারেন, রাতে ঘুম আসবেই না আর। ফোনে ধরেন ওসি ব্যাংক ফ্রড-কে, ‘স্যার, Mr. Stanley Rodrigues…!’
.
লিন্ডার বাড়িতে এখন ‘রেইড’ করাটা মূর্খামি হবে, সিদ্ধান্ত হল সর্বসম্মত। MSR পাওয়া গেলেও পিটারকে আর পাওয়া যাবে না। দিন পনেরোর মধ্যেই যে কলকাতায় আসবে বলে লিন্ডাকে জানিয়েছে মেলে। ঘটনার বিশ্লেষণ করে যা বোঝা যাচ্ছে, পিটার অন্যতম নাটের গুরু। এখন আছে নাইজেরিয়ায়। লিন্ডার ভাড়ার ফ্ল্যাটটা তার কলকাতার আস্তানা। বেনসন-মণিময়-অঙ্কুশরা, যেমন ভাবা গিয়েছিল, স্রেফ চুনোপুঁটি স্তরের শাগরেদ।
অপেক্ষা করা শুরু হল পিটারের শহরে আসার। বেনসনের খেলাধুলো আর লিন্ডার বাড়ি আসা-যাওয়া স্বাভাবিকভাবেই চলছে। অঙ্কুশও আর আগের মতো ঘরবন্দি থাকছে না। এবং যেমন ভাবা হয়েছিল, পুলিশি খোঁজখবর একটু থিতিয়ে যেতেই কলকাতায় ফিরে এসেছে মণিময়। মেট্রোপ্লাজার একতলার একটা রেডিমেড কাপড়ের দোকানে বসছে নিয়মিত। এদের ধরা তো জলভাত। ঠিক সময়ে তুলে নেওয়া যাবে।
অবশেষে লিন্ডার ইনবক্সে ঢুকল কাঙ্ক্ষিত বার্তা। ‘Sweetheart, arriving tomorrow…’। লাগোস থেকে দুবাই হয়ে কলকাতায় আসছে পিটার। এমিরেটস-এর ফ্লাইটে।
তিনটে টিম করা হল। একটা যাবে এয়ারপোর্টে, পিটারকে ধরতে। একটা কিড স্ট্রিটের ডেরা থেকে বেনসনকে তুলবে। আর তৃতীয় দলের দায়িত্ব থাকবে অঙ্কুশ-মণিময়কে তুলে আনার।
এর পরের ঘটনাপ্রবাহ শুরুর অনুচ্ছেদে লিখেছি। এয়ারপোর্ট থেকে বেরনোর পর লিন্ডা পিটারকে জড়িয়ে ধরা মাত্র ঘিরে ধরলেন অফিসাররা।
—ইয়োর গেম ইজ় আপ…
—হোয়াট? হোয়াট গেম আর ইউ টকিং অ্যাবাউট? আই ডোন্ট গেট দিস…
.
স্বীকারোক্তি আদায়ে বিশেষ অসুবিধে হল না। লিন্ডা আর পিটারকে একসঙ্গে বসিয়ে মেল চালাচালির প্রিন্ট আউটগুলো মেলে ধরা হল সামনে। তার আগেই পিটারের ব্যাগ থেকে উদ্ধার হয়েছে বিভিন্ন নামের গোছা গোছা কার্ড। পিটার-লিন্ডা কবুল করলেন দ্রুত, হ্যাঁ, Mr. Stanley Rodrigues আসলে ‘Magnetic Stripe Reader’–এর সংকেতই। লিন্ডার বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল টিম, আলমারির মধ্যে থেকে উদ্ধার হল MSR 205 মেশিনটি। যা দিয়ে তৈরি করা হত জাল কার্ড।
বেনসনের কাছ থেকেও পাওয়া গেল বেশ কয়েক গোছা জাল কার্ড। এবং তার পাসপোর্টটা ভাল করে দেখার পর বোঝা গেল, ভারতে থাকার ভিসার কাগজটাও জাল।
পিটারের ব্যাগ থেকে একটা ল্যাপটপ পাওয়া গেল। সেটা বাজেয়াপ্ত করার আগে ডেটা কপি করে নেওয়া হল একটা হার্ড ডিস্কে। ডিস্কটার আদ্যোপান্ত ঘেঁটে দেখা গেল, পিটার মার্কিন নাগরিকদের কার্ডের তথ্য পেত একটা মেল আইডি থেকে। [email protected]। কথাবার্তা হত yahoo messenger-এ।
কে এই man-t-2? পিটার জানাল, man-t-2-র নাম জেমস। নাইজেরীয়, ভারতেই থাকে। একসময় আমেরিকাতে ছিল। মার্কিন বন্ধুবান্ধব আছে বেশ কিছু। তা হলে আসল লোক পিটার নয়, জেমস?
Yahoo Messenger-এর লগ ডিটেলস নিয়ে বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করে বোঝা গেল, জেমসের বর্তমান অবস্থান পুনেতে। ভোঁসারি থানার অন্তর্গত গণেশওয়াড়ি নামের এক জায়গায়। অতএব চলো পুনে।
.
গণেশওয়াড়ি। মহল্লার আয়তন ছোট নয় খুব একটা। দিনভর এলাকা চষে ফেললেন সৌম্য এবং সহযোগী অফিসাররা। দোকানে-পাড়ায়-রকের আড্ডায় স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে জানার চেষ্টা করলেন, কালো চামড়ার লোক থাকে নাকি আশেপাশে? সন্ধের দিকে এক চায়ের দোকানের মালিকের কাছে হদিশ মিলল।
—আপনারা কি কালো ইংরেজদের কথা জিজ্ঞেস করছেন।
—হ্যাঁ হ্যাঁ, গায়ের চামড়া কালো, কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলে? জানেন?
—হ্যাঁ, কালো ইংরেজ থাকে একটা বাড়িতে। এই রাস্তাটা ধরে সোজা গিয়ে একটা মোড় পড়বে, সেখান থেকে বাঁ দিকে…
—একটু দেখিয়ে দিন না প্লিজ়… সেই কলকাতা থেকে এসেছি।
দেখিয়ে দিলেন চা-দোকানি। সঙ্গে সঙ্গে সৌম্য যোগাযোগ করলেন ভোঁসারি থানায়। ‘রেইড’ করা হল প্রায় মাঝরাতে। বেল বাজানোর পর দরজা খুললেন স্কার্ট-টপ পরিহিতা এক তরুণী। ভারতীয়। যিনি কিছু বোঝার আগেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল পুলিশ। এবং দু’কামরার ছিমছাম ফ্ল্যাটের শোওয়ার ঘরে আবিষ্কার করল এক নাইজেরীয় তরুণকে। টি-শার্ট আর শর্টস পরে একমনে ঝুঁকে ল্যাপটপের স্ক্রিনে।
পিঠে হাত পড়তে মুখ তুলে তাকালেন তরুণ। সৌম্য সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেন, ‘How is life James?’
—I am not James. Myself Christopher.
—And who is she?
—She’s Noa. Lives in Chennai. We are going to be married soon and shall leave for Dubai.
পাসপোর্ট দেখালেন যুবক। নাম সত্যিই ক্রিস্টোফার। নোয়া নামক তরুণীকে বিয়ে করে পাড়ি দেওয়ার কথা দুবাই। ভিসাও হয়ে গেছে। কাগজপত্র দেখা হল। মিথ্যে নয়। পাসপোর্ট-ভিসায় গরমিল নেই কোনও। তা হলে?
‘জেমস’ শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যে নোয়ার মুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল আচমকা, লক্ষ করেছিলেন এক অফিসার। কেন, সেটা বোঝা গেল বসার ঘরে পড়ে থাকা একটা চামড়ার ব্যাগ তল্লাশি করার পরেই। যাতে পাওয়া গেল বেশ কিছু জামাকাপড় আর কিছু ফটো। ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক মাঝবয়সি নাইজেরীয়কে। এই ক্রিস্টোফারের সঙ্গে কোনও মিল নেই ছবির।
—ফটোর লোকটা কে? এক মহিলা অফিসারের ধমকে নোয়া ভেঙে পড়লেন।
—জেমস। তোমরা যাকে খুঁজছ। Egbe Dakun James Taino। এই ফ্ল্যাটটা ওর ভাড়া করা। ক্রিস্টোফার ওর বন্ধু। ক্রিস্টোফার আর আমাকে এখানে থাকতে দিয়েছে জেমস। আজ বিকেলের ফ্লাইটে মুম্বই হয়ে দিল্লি গেছে। তবে কয়েকদিন পরই ফিরবে। আমরা এর বেশি কিছু জানি না স্যার।
শর্ত দিলেন সৌম্য। দুবাইও যাওয়া হবে, আর বিয়েও ভণ্ডুল হয়ে যাবে না, যদি জেমস এই ফ্ল্যাটে ফেরার পর ওঁরা ফোন করে জানিয়ে দেন কলকাতায়। আপাতত ওঁদের পাসপোর্টগুলো জমা রইল পুলিশের কাছে। জেমসের খবর পেলে পুলিশ আবার আসবে। তখনই ফেরত দেওয়া হবে পাসপোর্ট।
প্রস্তাবে রাজি না হয়ে উপায় ছিল না ওঁদের। সৌম্যরা ফিরে এলেন কলকাতায়। ভোঁসারি থানার অফিসাররা নজরদারির ব্যবস্থা করলেন ফ্ল্যাটে।
বহুপ্রতীক্ষিত ফোন এল দিনদশেক পরে। সাতসকালে সৌম্যর মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠল, ‘Noa Calling’।
—স্যার, জেমস গত কাল রাতে এসেছে। ঘুমচ্ছে এখন। কাল সকালের ফ্লাইটে আবার মুম্বই চলে যাবে।
মানে দাঁড়াচ্ছে, আজই পৌঁছতে হবে, যে ভাবেই হোক। তদন্তে এমন হয় কখনও কখনও, এক সেকেন্ডও দেরি করা চলে না। যেটা করতে হবে, সেটা তখনই করতে হবে।
করা হল। গোয়েন্দাপ্রধানকে জানানো হল। যাঁর নির্দেশে দুপুরের ফ্লাইটে মুম্বই রওনা দিলেন অফিসারেরা। মুম্বই-পুনে হাইওয়ে ধরে রওনা দিলেন সড়কপথে। যখন গণেশওয়াড়ি পৌঁছনো গেল, ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটা ছাড়িয়ে ন’টার পথে রওনা দিয়েছে।
মাঝবয়সি নাইজেরীয়, James Taino, Yahoo messenger-এ চ্যাট করছিলেন ফ্ল্যাটে বসে। আইডি? man-t-2।
ল্যাপটপের দু’-একটা ফোল্ডার এলোমেলো চেক করতেই বেরিয়ে পড়ল অজস্র কার্ডের ডিটেলস। Track-1 এবং Track-2, যেগুলো থাকে কার্ডের পিছনের ম্যাগনেটিক স্ট্রিপের মধ্যে। খালি চোখে যা দেখতে পাওয়ার কথাই নয়। ডেটা বোঝাই হয়ে আছে ল্যাপটপে। যা দিয়ে চলছিল লক্ষ লক্ষ টাকার জালিয়াতি, ‘ইধার কা মাল উধার’।
পরের দিন জেমসকে স্থানীয় কোর্টে হাজির করে ‘Transit Remand’ নিয়ে ফের রওনা দেওয়া। সড়কপথে ফের মুম্বই। সেখান থেকে কলকাতার উড়ান।
.
অঙ্কুশ-মণিময়-লিন্ডা রাজসাক্ষী হয়েছিলেন। পুরো ঘটনা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছিলেন বিচারকের সামনে। জানিয়েছিলেন, তাঁরা স্রেফ বোড়ে ছিলেন, জানতেন না কিস্তিমাতের আসল ছক। লিন্ডা অকপটে বলেছিলেন আদালতে, জেমসের সঙ্গে আলাপ মধ্য কলকাতার এক চার্চে। জড়িয়ে পড়েছিলেন গভীর সম্পর্কে। যা বলতেন জেমস, অন্ধের মতো মেনে চলতেন।
জেমসের থেকে পাওয়া গেল আমেরিকা-প্রবাসী দুই নাইজেরীয় বন্ধুর খুঁটিনাটি। যারা সরবরাহ করত কার্ডের তথ্য। এবং জেমস ভারতে বসে লোপাট করে দিত লক্ষ লক্ষ টাকা। ভাগবাঁটোয়ারা হত অনলাইনে। FBI (ফেডারাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন)-এ বিস্তারিত জানিয়ে মেল করে দেওয়া হল লালবাজারের তরফে।
তিন বছর লেগেছিল বিচারপর্ব শেষ হতে। রাজসাক্ষী লিন্ডা-অঙ্কুশ-মণিময়কে সাজা দেননি আদালত। দশ বছরের কারাদণ্ড বরাদ্দ হয়েছিল তিন চক্রীর জন্য। বেনসন-জেমস-পিটার।
শাস্তি যেদিন ঘোষণা হয়েছিল, আদালত থেকে বেরনো মাত্রই ফোনে মেসেজ এসেছিল সৌম্যর। ডিসি ডিডি লিখেছিলেন, ‘Well done. The reward of a good job done is to have done it.’
সেই মেসেজ আজও যত্ন করে রেখে দিয়েছেন সৌম্য। ভাল কাজের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার কী হতে পারে? ভাল কাজটাই তো!
পুনশ্চ: লিন্ডা, অঙ্কুশ এবং মণিময়, তিনটি নাম পরিবর্তিত ওঁদের সামাজিক বিড়ম্বনা এড়াতে।