[দশ]
ঝড়ের গতিতে সাজগোজ সারছিল মিতিন। সাধারণ একটা প্রিন্টেড সালোয়ার কামিজ পরেছে আজ, কপালে ছোট্ট টিপ লাগিয়েছে, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। স্নানের সময় চুল ভেজায়নি, খেতে বসার আগে টান টান করে বেঁধে নিয়েছিল, এখন আবার সামনের দিকে চিরুনি বুলিয়ে নিল একবার। হিরো হিরোইন ভিলেন সম্ভাব্য-ভিলেন সকলের ছবিই প্রিন্ট করে এনেছে পার্থ, বেরনোর আগে ছবিগুলো পুরে নিল ঝোলাব্যাগে।
আকাশ আজ একটু মেঘলা মেঘলা। অল্প গুমোট ভাবও আছে, দু চার পশলা বৃষ্টি হওয়া আজ অসম্ভব নয়। ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে মিতিন দেখে নিল ছাতাটা নেওয়া হয়েছে কিনা। নিয়েছে। নিশ্চিন্ত হয়ে মোড়ে এসে ট্যাক্সি ধরল একটা।
রাস্তায় খুচরো জ্যাম। মিতিন অর্চিষ্মানের বারে এসে পৌঁছল প্রায় সাড়ে এগারোটায়। পানশালা এখনও জমেনি, বেশির ভাগ টেবিলই ফাঁকা। অর্চিষ্মান কাউন্টারে ছিল, মিতিনকে দেখে শশব্যস্ত হয়ে উঠে এসেছে,—ম্যাডাম, আপনি?
—একটা দরকার ছিল।…কয়েকটা নাম অ্যাড্রেস চাই।
—কাদের?
—আপনি দোকান থেকে কয়েকজনকে ছাঁটাই করেছিলেন…
—তাদের নাম ঠিকানা নিয়ে আপনি কী করবেন?
—আপনার দোকানের চুরিটার সঙ্গে ওদের কোনও লিঙ্ক আছে কিনা দেখতে চাই।
অর্চিষ্মান বেশ বিরক্ত,—এর সঙ্গে বিদিশার কেসের কী সম্পর্ক?
—আমি চুরিটা ঠিক হজম করতে পারছি না মিস্টার রুদ্র।
—আমিও আপনার কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না। আজ বুধবার, মাঝে মাত্র দুটো দিন, এখন আসল কেস ছেড়ে…টোটালি মিনিংলেস।
মিতিন নীরস মুখে বলল,—আপনার কি দিতে আপত্তি আছে মিস্টার রুদ্র?
অর্চিষ্মান সংযত করেছে নিজেকে। বলল,—নাম তো দিতেই পারি, তবে ঠিকানাগুলো আমার মুখস্থ নেই। নিলামঘর খুলে খাতাপত্র ঘেঁটে দেখতে হবে।
—প্লিজ, যদি একটু দেখেন।
অপ্রসন্ন মুখে বার থেকে বেরিয়ে এল অর্চিষ্মান, পিছন পিছন মিতিনও। নিলামঘরের সামনের দরজায় গেল না অর্চিষ্মান, গলি ঘুরে পিছনের কোলাপসিবল গেট ঝাঁকাচ্ছে।
দারোয়ান উঁকি দিল। মালিককে দেখেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে দরজা খুলেছে।
অফিসঘরের দিকে এগোতে এগোতে অর্চিষ্মান বলল,—আমি কি পাঁচ লাখ টাকাটা রেডি করে রাখব?
মিতিন ঝলক দেখল অর্চিষ্মানকে,—রাখুন।
—টাকাটা তা হলে আমায় দিতেই হচ্ছে?
—আমি তো ফেলও করতে পারি, তার জন্য আপনার প্রস্তুত থাকাই তো উচিত।
—আমিও তাই ভাবছি। আমার স্ত্রীর লাইফের ব্যাপারে আমি কোনও কমপ্রোমাইজ করতে পারব না।
—করা উচিতও নয়। আপনি যখন স্ত্রীকে এত ভালবাসেন…। আপনি খাতাপত্র বার করুন, আমি একটু টয়লেট থেকে আসছি।
বাথরুম অবধি অবশ্য গেল না মিতিন। ছায়ামাখা হলঘরখানার গলিপথ বেয়ে ভাঙা আলমারিটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। টানল পাল্লাটা, বিকট আওয়াজ করে খুলে গেছে। সাধারণ চার থাকের আলমারি, লকারবিহীন। আলমারির গা’টা আস্তে করে ঠুকে দেখল মিতিন, ঠং ঠং আওয়াজ হচ্ছে। জং ধরা তাকে হাত বোলাল, ওপর দিয়ে, নীচ দিয়ে। আবার আঙুল ঠুকছে। নীচের তাকটায় চাড় দিল সামান্য, খুলে গেছে টানা একটা খোপ। হাত চালাল ভেতরে, একখানা আধছেঁড়া কাগজ খাঁজে আটকে আছে। বিবর্ণ। মলিন। হলদেটে। কোনও এক আদিকালের স্ট্যাম্পপেপারের অংশ।
—ওখানে কী খুঁজছেন?
অর্চিষ্মনের ডাক শুনে সচকিত হল মিতিন। কাগজটা বার করে ভরে নিল ঝোলাব্যাগে। দ্রুত অফিসঘরে ফিরল।
মৃদু হেসে বলল, —পুরনো আলমারিটাকে দেখছিলাম। ওটা তো এখনও দিব্যি সারিয়ে নেওয়া যায়।
—ধুস, কী হবে! ভাঙাচোরা জিনিস থাকলে নিলামঘরের একটু শোভা বাড়ে, নইলে কবে টান মেরে ফেলে দিতাম।
—ওটা কি আপনার বাবার আমলের আলমারি?
—তার আগেরও হতে পারে। অর্চিষ্মান তেমন একটা পাত্তা দিল না,—নিন, লিখে নিন।…যজ্ঞেশ্বর হালদার, একুশের দুয়ের সি চন্দ্রনাথ সিমলাই লেন, কলকাতা-দুই। এটা বোধহয় পাইকপাড়ায়, দু নম্বর বাসস্ট্যান্ডের কাছে।…দ্বিতীয়জন, তপন নন্দী, এগারোর তিন রায়বাগান স্ট্রিট, কলকাতা-ছয়। ওই আপনার স্কটিশ চার্চ স্কুলের কাছাকাছি।…তিন, স্বর্ণেন্দু সামন্ত, ছ নম্বর কালী মিত্তির লেন, ক্যালকাটা-ছয়। এই হেদোর কাছে। চতুর্থজ-নও ওই কাছাকাছিই থাকে। হরিপ্রসাদ সাহা, ফাইভ বাই বি গোয়াবাগান রো।
মিতিন ঝটপট লিখে নিচ্ছিল। মুখ তুলে বলল,—সবই তো দেখছি উত্তর কলকাতার?
—বাবার নর্থের মানুষদের ওপর একটু দুর্বলতা ছিল। সেন্টিমেন্ট। আমি অবশ্য এখন বেশি সাউথের লোকই রাখছি।
মিতিন নোটবইয়ে ঝুঁকল আবার,—আচ্ছা, এদের সকলের বয়স কীরকম?
—হরিপ্রসাদবাবু, যজ্ঞেশ্বরবাবু, দুজনেই সেভেনটি আপ। স্বর্ণেন্দু আর তপনের বয়সটা কম। অ্যারাউন্ড থার্টি থার্টিফাইভ, এগজ্যাক্ট বলতে পারব না।
—চারজনের কি একই গ্রাউন্ডে চাকরি গিয়েছিল?
—নাহ্। হরিপ্রসাদবাবু যজ্ঞেশ্বরবাবু ইনএফিশিয়েন্ট হয়ে গিয়েছিলেন। ঠিক মতো কাজটাজ আর পারতেন না, ঘন ঘন কামাই করতেন। বাকি দুটো ছিল চোরেরও বেহদ্দ। নিলামের জন্য সাজিয়ে রাখা মাল হাওয়া করে দিচ্ছে…। নিজেরাই বেনামে লোক দাঁড় করিয়ে জলের দরে দামি জিনিস কিনে নিচ্ছে…। বাবার স্নেহভালবাসা ছিল, বাবা স্ট্যান্ড করতে পারত, আমি স্ট্রেট বার করে দিয়েছি। অর্চিষ্মান ফাইল বন্ধ করল,—কটা বছর কাজ করেছে দুজন? বছর সাত আট! তার মধ্যেই যা বাড় বেড়েছিল…!
—হুম। মিতিন ব্যাগ বন্ধ করল।
—আপনি কি এখন এদের বাড়ি বাড়ি ঘুরবেন?
—দেখি।
—আমার গাড়িটা নিয়ে যেতে পারেন। টেম্পোরারিলি একটা ড্রাইভার অ্যাপয়েন্ট করেছি।…বাই দা বাই, রবির ঠিক কী হল বলুন তো?
—ভাবছি।
—কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম, এই সিম্পল চুরির কেসটা নিয়ে এই মুহূর্তে মাথা ঘামিয়ে কিন্তু সময়ের অপচয় করে ফেলছেন।
মিতিন চোখটাকে সার্চলাইট করে অর্চিষ্মানের দিকে ফেলল,—চুরিটা কি সত্যিই আপনার খুব সিম্পল বলে মনে হয় মিস্টার রুদ্র?
অর্চিষ্মান একটু বুঝি অস্বস্তি বোধ করল। আমতা আমতা করে বলল,—তা নয়, তবে…। যাক গে, আপনি যা ভাল বোঝেন করুন। আমি যে এই মুহূর্তে ভীষণ রকম ওরিড, এটাই আপনাকে বলতে চাইছিলাম।
—আমি জানি। মিতিন উঠে দাঁড়াল।
—গাড়িটা নেবেন না?
—থ্যাঙ্ক ইউ। দরকার নেই।
ট্যাক্সিতে বসে নোটবইয়ে আর একবার চোখ বোলাল মিতিন। স্বর্ণেন্দু সামন্ত! এই নামটার সঙ্গে সোনা নামের যোগ থাকার সম্ভাবনা বেশি। একটা বাজে, এই ভরদুপুরে স্বর্ণেন্দু সামন্তকে কি বাড়িতে পাওয়া যাবে?
তবু মরিয়া হয়ে প্রথমে স্বর্ণেন্দুর বাড়িই গেল। গলির গলি তস্য গলি, তবে বাড়িটা খুব প্রাচীন নয়। একতলার পিছন দিকে ভাড়া থাকে স্বর্ণেন্দু।
কড়া নাড়তেই ক্ষয়াটে চেহারার একটা বউ বেরিয়ে এল। আটপৌরে শাড়ি বেশ মলিন, কপালে সিঁদুর লেপটে আছে।
—কী চাই?
—সোনাবাবু বাড়ি আছেন?
—কে সোনাবাবু?
—স্বর্ণেন্দু সামন্ত এই বাড়িতেই থাকেন তো?
—তা সোনা সোনা করছেন কেন? বউটা প্রায় খেঁকিয়ে উঠল,—আপনার কী দরকার তাকে?
—আমি ইম্পিরিয়াল এক্সচেঞ্জ থেকে আসছি। মানে স্বর্ণেন্দুবাবু যে নিলামঘরে চাকরি করতেন।
—কেন?
—অর্চিষ্মানবাবু ওঁর খোঁজ করতে পাঠিয়েছেন। উনি এখন কী করছেন জানতে চান।
বউটি সন্দিগ্ধ চোখে মিতিনের পা থেকে মাথা অবধি দেখল,—আপনাকে পাঠিয়েছে?
—হ্যাঁ, আমি ওঁর সেক্রেটারি। রুদ্রসাহেব বলেছেন স্বর্ণেন্দুবাবু চাইলে আবার তাকে চাকরিতে ফেরত নিতে পারেন।
—হঠাৎ তাঁর এত দয়া? আমরা এতদিন কী ভাবে বেঁচে আছি, তার খোঁজ নেননি কোনওদিন…। সাহেবকে বলে দেবেন, আমরা গরিব হতে পারি, আমাদের মানসম্মান আছে। যেখান থেকে ওভাবে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়ায়, সেখানে আমার স্বামী আর কখনও থুতু ফেলতেও যায় না। জুতো মেরে গুরুদান, অ্যাঁ?
—কিন্তু উনি এখন করছেনটা কী?
—তা জেনে আপনার কী হবে? মনে করুন চুরিবাটপারি করছে। আপনার সাহেব তো আমার স্বামীকে তাই মনে করেন।
ভেতরে একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল। বউটা যেন ঈষৎ চঞ্চল। একবার ভেতরে তাকিয়ে নিয়ে রূঢ়ভাবে বলল,—আমার স্বামী বলেছিল, দেখো আমাকে তাড়ানোর জন্য মালিককে একদিন পস্তাতে হবে। এবার তা হলে সেইদিন এসেছে!…কিন্তু ও আর ওই দোকানে পা রাখবে না!…আসুন আপনি।
মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে বউটা। অন্দরে শিশুর কান্না জোরদার হয়েছে আরও। মিতিন আর দাঁড়াল না, বেরিয়ে বড়রাস্তায় পড়ল, খুঁজে খুঁজে গোয়াবাগান রো।
হরিপ্রসাদ সাহার বাড়িটি জরাজীর্ণ, পুরনো আমলের। বছর পঁয়ত্রিশের এক মহিলা দোতলার কোনার দিকের এক ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছে মিতিনকে, সম্ভবত মহিলা হরিপ্রসাদবাবুর পুত্রবধূ। ঘরখানা বড়সড়, জানলায় রঙিন কাচ, লাল মেঝেতে ফাটল ধরেছে। আসবাব-ঠাসা ঘরে বসার জায়গা খাওয়ার জায়গা সব এক সঙ্গেই। জানলায় ছিটকাপড়ের পর্দাটি নতুন, ঘরের সঙ্গে বেমানান।
হরিপ্রসাদবাবু ঘুমোচ্ছিলেন বোধহয়, আসতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগল। ফর্সা সৌম্যদর্শন বিরলকেশ বৃদ্ধ, পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি।
মিতিন হাত জোড় করে নমস্কার করল,—আমার নাম প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায়।
আমি আপনার কাছে একটা অপ্রিয় কাজে এসেছি।
—বলুন।
—আপনি যেখানে কাজ করতেন, মানে ইম্পিরয়াল এক্সচেঞ্জ, সেখানে সম্প্রতি একটি চুরি হয়ে গেছে।
বৃদ্ধর কপাল কুঁচকে গেল,—তো?
—আমি চুরিটার তদন্ত করছি, আপনার একটু সাহায্য দরকার।
—আমি! আমি কী করতে পারি?
—অর্চিষ্মান রুদ্রর ধারণা তাঁর কোনও প্রাক্তন কর্মচারী এই চুরির সঙ্গে…
কথা শেষ হল না, হরিপ্রসাদ তীব্র স্বরে বলে উঠলেন,—বাবলু আমায় সন্দেহ করে? ওর জন্মের আগে থেকে আমি দোকানে চাকরি করছি…! কত লাখ লাখ টাকার মাল আমার হাত দিয়ে বেচাকেনা হয়েছে, একদিন একটা ফুটো পয়সার গরমিল হয়নি..!
মিতিন নম্র স্বরে বলল,—আপনি ভুল করছেন। তিনি আপনাকে সন্দেহ করেন না, বরং রেসপেক্টই করেন। আপনি ছাড়াও আরও কয়েকজনকে তো উনি…
—আর কাকে সন্দেহ করে বাবলু? যজ্ঞেশ্বর? হরিপ্রসাদের মুখচোখ লাল হয়ে গেছে,—বাবলুকে বলে দেবেন, যজ্ঞেশ্বর মারা গেছে।
—আহা, আপনি মিছিমিছি রাগ করছেন। আপনাদের সম্পর্কে ওঁর কোনও অভিযোগ নেই। তবে তপন নন্দী বা স্বর্ণেন্দু সামন্ত সম্পর্কে ওঁর রিজার্ভেশান আছে।
—ওঁরাও বাবলুর দোকানে ঢুকে চুরি ডাকাতি করবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। এতক্ষণে বসলেন হরিপ্রসাদ,—তপন তো অত্যন্ত ভদ্র বাড়ির ছেলে। তার বাবা অতি সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। আমি তাঁর আন্ডারে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছি।
—তপনবাবুর বাবাও নিলামঘরে ছিলেন নাকি? মিতিন বেজায় চমকাল।
—হ্যাঁ। ম্যানেজার ছিলেন। বহুকাল আগে।
—তিনি চাকরি ছেড়েছিলেন কেন?
—ছাড়েননি তো। ঊষাপতিবাবু মারা গিয়েছিলেন। সুইসাইড।
—সেকি! কেন?
—ঠিক বলতে পারব না। দিব্যি হাসিখুশি লোক ছিলেন, বড়কর্তার সঙ্গে ভাল বন্ধুত্বও ছিল, দু বাড়িতে যাওয়া আসাও ছিল খুব।…তারপর কী যে মাথার ব্যামো হল, দুম করে অফিসে আসা বন্ধ করে দিলেন, তারপর হঠাৎ শুনি ফ্যান থেকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে…
—এ সব কথা তো অর্চিষ্মানবাবু কিছু বলেননি!
—বাবলু এ সব কতটুকু জানে! সেই কতকাল আগের কথা…। হরিপ্রসাদ মনে করার চেষ্টা করলেন,—তা প্রায় উনত্রিশ তিরিশ বছর তো হবেই।
—তপনবাবুকে ছাড়ালেন কেন মিস্টার রুদ্র? তপন ছেলে কেমন?
—একটু বেশি শৌখিন, তবে নেশা টেশা করত না। দোষের মধ্যে…একটু আধটু হাতটান ছিল। বাবলু ওয়ান পাইস ফাদার মাদার, বড়কর্তার মতো অত উদারতাও নেই, সে ওই স্বভাব সহ্য করবে কেন? আমাদেরই কত তুচ্ছ কারণে বেলপাতা শুঁকিয়ে দিল! বড়কর্তা না থাকলে হয়তো আমাদের বকেয়া পেতেও জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে যেত।
—আপনাদের বড়কর্তা তার মানে লোক ভাল?
—ভাল মানে! মাটির মানুষ। আমাদের সম্পর্কে কত ভাবতেন! আমাদের হয়ে কথা বলতে গিয়েই না বাবলুর চোটপাট শুনলেন। ছি ছি, মানুষটা কিনা লজ্জায় ঘেন্নায় দোকানেই আসা ছেড়ে দিলেন।
মিতিন একটুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল। তারপর বলল,—আর আপনাদের স্বর্ণেন্দু সামন্ত? তিনি কেমন ছিলেন?
—ওটিই হচ্ছে শয়তানের জাশু। সেজে থাকত ভিজে বেড়াল…। কী ভাল একটা ক্যামেরা হাপিস করে দিয়েছিল! তপনও সরাত, তবে অত দামি জিনিস নয়। তপন অন্তত বড়কর্তাকে মানিগন্যি করত, স্বর্ণেন্দু কাউকেই না।
—এখন তপনবাবু স্বর্ণেন্দুবাবুরা কী করেন?
—তপনের অনেকদিন খবর পাই না। শুনেছিলাম কী ব্যবসা ট্যাবসা করছে। স্বর্ণেন্দু একটা লটারির দোকান দিয়েছে, কলেজ স্ট্রিটে। কথায় খুব ওস্তাদ তো, জপিয়ে জাপিয়ে ভালই কামায়। বড়কর্তা শুনেছি ওকে আলাদা করে কিছু টাকা দিয়েছিলেন…গিয়ে নাকি পায়ে টায়ে পড়ছিল…।
স্বর্ণেন্দুর বউয়ের মুখটা পলকের জন্য মনে পড়ল মিতিনের। জিজ্ঞাসা করল,— আচ্ছা, স্বর্ণেন্দুর কি ডাকনাম সোনা?
—না তো। ওকে তো পাড়ায় বোধহয় ছোটকা বলে ডাকে।
আরও দু চারটে কথা বলে মিতিন উঠে পড়ল। এবার তপন। এটাও খুব দূরে নয়, হাঁটাপথে ছ সাত মিনিট। অন্য বাড়ি দুটোর তুলনায় তপনের বাড়ি একটু ছোট বটে, কিন্তু ছিমছাম ধোপদুরস্ত। একতলা বাড়ির প্রবেশপথে একটা টানা লম্বা বারান্দা, দরজায় কলিংবেল আছে।
বাজাতেই পাখির ডাক শোনা গেল। দরজা খুলেছেন এক প্রৌঢ়া। শ্যামলা রং, বেশ অনেকখানি লম্বা, মাথার কাঁচা পাকা চুল এখনও বেশ ঘন। দেখে বোঝা যায় এক সময়ে যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন।
মিতিন সপ্রতিভভাবে বলল,—আমি সেনসাস থেকে আসছিলাম মাসিমা। কয়েকটা প্রশ্ন ছিল।
মহিলা স্মিত মুখে বললেন,—বলো।
—একটু বসে কথা বলতে পারি কি মাসিমা? আমায় কিছু লিখতে হবে।
—এসো, ভেতরে এসো।
সামনেই ছোট্ট বসার ঘর। সযত্নে সাজানো। বেতের সোফা, কাচ বসানো সেন্টার টেবিল, কালার টিভি, শোকেস, স্ট্যান্ড ল্যাম্প, সবই আছে অল্প জায়গাটুকুতে। শোকেসের মাথায় এক যুবকের ছবি। এই তবে তপন? ঘরের কোণে তানপুরা রাখা আছে একটা, কাপড়ে ঢাকা। কে গান গায়? মা, না ছেলে?
মিতিন গুছিয়ে বসল। পেশাদারি ভঙ্গিতে ফাইল কলম বার করেছে।
প্রশ্ন শুরু হল,—আপনারা ফ্যামিলি মেম্বার কজন?
—দুজন। আমি, আর আমার ছেলে।
—আপনার ছেলেই আর্নিংমেম্বার তো?
—হ্যাঁ।
—ইনকাম? পাঁচ হাজারের নীচে? দশ হাজারের নীচে? না তার ওপরে?
মহিলা ঈষৎ ইতস্তত করে বললেন,—ঠিক বলতে পারব না।
—কী করেন আপনার ছেলে? চাকরি, না ব্যবসা?
—ব্যবসা।
আরও বেশ কিছু রুটিন প্রশ্ন করে পেন বন্ধ করল মিতিন। চোখ বোলাচ্ছে ঘরে। আন্তরিক সুরে বলল,—বাড়িটা আপনার কিন্তু ভারী সুন্দর মাসিমা। ঘর কটা?
—গোটা তিনেক।
—কত দিন আগের বাড়ি?
—এই, একুশ বছর।
—মেসোমশায়ের হাতে তৈরি?
মহিলা হাসলেন একটু, এটাও কি তোমার সেনসাসের প্রশ্ন?
নাহ্, মহিলা বেশ বুদ্ধিমতী, এবং অশিক্ষিতও নয়। স্বরেও বেশ একটা আভিজাত্য আছে। কথা বলেন থেমে থেমে, মেপে মেপে। শুনতে বেশ লাগে।
মিতিনও হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল,—সারাদিন ট্যাঙোশ ট্যাঙোশ করে ঘুরি তো, বকবক করতে করতে বেশি কথা বলে ফেলি।
মহিলা আবার হাসলেন,—হুঁ
—উঠি এবার।…এক গ্লাস জল হবে মাসিমা?
জল আনতে গেছেন মহিলা। দ্রুত উঠে গিয়ে তপনের ছবিটাকে দেখছে মিতিন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। হঠাৎই পাশে চোখ আটকে গেল।
কী ওটা? ভাঙা একটা অ্যাম্পিউল না?
[এগারো]
অস্থির পায়ে লনে পায়চারি করছিল বিদিশা। মিতিনকে দেখে দৌড়ে এল গেটে,— দিদি, আপনি এসে গেছেন?
মিতিন চাপা স্বরে বলল,—দিদি নয়, মিতিন। আমি তোমার বন্ধু না?
মুহূর্তের জন্য থমকেছে বিদিশা। সকাল দশটাতেই আশ্বিনের রোদ বেশ চড়া আজ। বিদিশার মুখ লাল হয়ে আছে, ঘামছে অল্প অল্প। করুণ মুখে বলল,—কাল দুপুরে ফোনটা আসার পর থেকে আমার আর মাথার ঠিক নেই। শরীর ছেড়ে যাচ্ছে…
—আহ্, চুপ। মিতিন মৃদু ধমক দিল,—চলো, ওপরে গিয়ে কথা হবে।
বাড়িতে ঢোকার মুখে পদ্মপাণি। জুলজুল চোখে দেখছে মিতিনকে। হাসি হাসি মুখে বলল,—ভাল আছেন দিদি?
—ওই এক রকম। মিতিন হাসল সামান্য,—তোমাদের খবর ভাল তো?
—কই আর! বাড়ির ড্রাইভার কোথায় হাওয়া হয়ে গেল,…কোনও খবর নেই!…বাড়িতেও অসুখ বিসুখ শুরু হয়েছে…
—কার অসুখ করল?
—বাবুর। কাল দুপুরে গা ম্যাজম্যাজ করছিল, কতবার বললাম বেরোবেন না, সেই বেরোলেন…আজ সকাল থেকে তো একেবারে শয্যা নিয়েছেন। বলতে বলতে পদ্মপাণি বিদিশার দিকে তাকাল,—এই তো দেখুন না, বউদিমণিরও শরীর ভাল নয়। খাচ্ছে না দাচ্ছে না, বলছে মুখে রুচি নেই…
—কী রে, তোর আবার কী হল? মিতিন বিদিশাকে চোখ টিপল,—নতুন খবর টবর কিছু আছে নাকি?
—না না, এমনিই। বিদিশা লজ্জা লজ্জা মুখ করল,—আমার বন্ধুকে কিছু খাওয়াবে না পদ্মদা?
মিতিন তাড়াতাড়ি বলে উঠল,—আমি এক্ষুনি কিছু খাব না। এই মাত্র জলখাবার খেয়ে এসেছি।
—তা হলে আমাদের ঘরে চাট্টি ভাত খেয়ে যাবে।
—সে দেখা যাবেখন।
বলতে বলতে বিদিশার সঙ্গে সিঁড়ির দিকে এগোল মিতিন। উঠতে উঠতে জিজ্ঞাসা করল,—কী হয়েছে মেসোমশায়ের?
—মনে হয় ঠাণ্ডা লেগেছে। সিজন চেঞ্জের সময় তো?
—হুম! ডাক্তার দেখেছে?
—এ বেলাটা যাক, তেমন বুঝলে বিকেলে কল দেব।
বিদিশা ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। কুলার চালিয়েছে। ফোনস্ট্যান্ডে রাখা বিদেশি যন্ত্রটার কাছে গেল,—চালাব?
—খুব লো ভল্যুমে চালাও।
একদম কাছে কান নিয়ে গিয়ে রেকর্ড করা গলাটা শুনল মিতিন। একবার দুবার…। উচ্চারণ পরিষ্কার, তবে গলাটা কেমন যেন বিকৃত মনে হয়! যেন অনাবশ্যক রকমের ভারী!
টাকা দেওয়ার নির্দেশ এবার বেশ অভিনব। দমদম থেকে দুটো দশের টালিগঞ্জগামী মেট্রোট্রেনে চড়তে হবে বিদিশাকে, পুরো টাকা কিটসব্যাগে ভরে। পাঁচ লাখের সবটাই পুরনো একশো টাকার বান্ডিলে হওয়া চাই। বিদিশাকে উঠতে হবে সামনের দিক থেকে তৃতীয় কামরায়, কিটসব্যাগ রাখতে হবে সিটের নীচে, এবং সেই অবস্থাতেই রেখে নিঃশব্দে নেমে যেতে হবে পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে। ব্যস, তা হলেই বিদিশার মক্তি।
নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে কড়া সাবধানবাণীও আছে। এবার যদি বিদিশা কোনও রকম চালাকির চেষ্টা করে, যদি গতবারের মতো কোনও সঙ্গী নিয়ে যায়, অথবা পলিশে খবর দেয়, তা হলে তার সুখের জীবন সেদিনই শেষ।
মিতিন ভুরু কুঁচকে তাকাল,—ফোনটা এসেছে কোন নাম্বার থেকে?
—ওই একই। আগের বারের নম্বর।
—হুম!…এই ফোনের কথা মিস্টার রুদ্রকে কখন জানিয়েছ?
—দুপুরে প্রথমে আপনাকেই করেছিলাম। আপনি ছিলেন না…। তারপর ওকে…। ও অবশ্য তখন বারে ছিল না।
—ছিলেন না! কোথায় গেছিলেন?
—অম্বরীশবাবু বললেন, ব্যাঙ্কে গেছে।…এসেই অবশ্য আমাকে ফোন করেছিল। তখনই…
—মিস্টার রুদ্রর শার্টটা কোথায় আছে দেখাও তো।
বিদিশা অ্যান্টিরুমে নিয়ে গেল মিতিনকে। দেরাজ খুলে একটা ঘিয়ে রঙের হাফস্লিভ শার্ট বার করেছে। মিতিন ভাল করে দেখল শার্টটাকে। মামুলি টেরিটের শার্ট, খুব দামি কিছু নয়। সরু কলার, দু ধারে পকেট, ঘাড়ের কাছে লেবেলে ধর্মতলার এক টেলারিং শপের নাম, একটি ছাড়া বাকি সব বোতাম এখনও অটুট।
শার্টটার গন্ধ শুঁকল মিতিন। তারপর বুকের কাছটা চেপে চেপে ঘষছে। আঙুলটা ঠেকাল জিভে।
বিদিশা হাঁ হাঁ করে উঠল,—ও কী করছেন দিদি?
মিতিন হাসল,—ক্রিমিনালদের শার্ট কেমন হয় চেখে দেখছি।
বিদিশার চোখে আতঙ্ক ফিরে এল,—আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না শার্টটা এখানে কী করে এল…!
শার্টের হয়তো ডানা গজিয়েছিল, উড়ে এসে তোমার বরের দেরাজে ঢুকে গেছে। মিতিন শার্টটা মুড়ে হাতে রাখল,—মিস্টার রুদ্রর ওয়ার্ড্রোব কোনটা?
বিদিশা আরও ঘাবড়ে গেল,—কেন দিদি?
—আহা, নার্ভাস হচ্ছ কেন? দেখাও না।
ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখে অর্চিষ্মানের ওয়ার্ড্রোব খুলে দিল বিদিশা। সার সার শার্ট ঝুলছে হ্যাঙারে, এলোমেলো ভাবে কয়েকটা শার্ট বার করল মিতিন, উল্টেপাল্টে নিরীক্ষণ করল কী যেন, আবার রেখে দিল।
বিদিশা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,—কী দেখলেন দিদি? কী বুঝলেন?
—কিছুই বুঝিনি। বোঝার চেষ্টা করছি।
মিতিন ফিরল অ্যান্টিরুম থেকে। শার্টখানা নিজের ব্যাগে পুরল। খাটের এক কোণে বসে ডাকল বিদিশাকে,—এখানে এসো, তোমার সঙ্গে আরও কয়েকটা কথা আছে।
বিদিশা জড়োসড়ো ভাবে বসল। শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।
মিতিন তার শীতল হাতে হাত রাখল,—তোমার বরের বিজনেসটা কি একার?
—মানে?
—বলছি, ওটা তো তোমার শ্বশুরমশায়ের ব্যবসা, ওতে নিশ্চয়ই ননদেরও ভাগ আছে?
—না, নেই। অর্চিষ্মান একাই চালায়।
—সেটা তো জানি। তোমার শ্বশুরমশাই কি ব্যবসাটা তোমার বরের নামেই লিখে দিয়েছেন?
—মোটামুটি। গত বছরই উনি নাকি উইল করেছেন। বিজনেস অর্চিষ্মনের নামে, বাকি সব স্থাবর সম্পত্তি আধাআধি ভাগ।
—উইলের কথা তোমায় কে বলেছেন? শ্বশুরমশাই?
—না, অর্চিষ্মান একদিন বলেছিল। সেই বিয়ের পর পর।
—তোমার ননদ ননদাই উইলের কথা জানেন?
—জানেন বইকী। পূষনদা তো নাকি সাক্ষী ছিল।
—উইলটা কবে নাগাদ হয়েছে জানো?
—ঠিক টাইম বলতে পারব না, তবে গত বছর পুজোর আগে।
—হঠাৎ উইল করে রাখতে গেলেন কেন তোমার শ্বশুরমশাই?
—অর্চিষ্মান আমায় বলেছে, দিদি নাকি খুব জোরাজুরি করছিল।
মিতিন কী যেন ভাবল একটুক্ষণ,—তোমার ননদের সঙ্গে একবার কথা বলা যাবে?
বিদিশা অবাক চোখে তাকাল, তবে আর প্রশ্ন করল না। বলল,—দিদিকে টেলিফোনে ধরে দেব?
—না। আমি সামনাসামনি কথা বলতে চাই। তুমি এখন আমাকে একটু নিয়ে যেতে পারবে?
—এখন? শালকিয়ায়?
—আর তো সময় নেই বিদিশা।
—এখনও যে স্নান হয়নি!
—স্নান নয় ফিরে কোরো। খাওয়া দাওয়াও কোথাও একটা করে নেওয়া যাবে। তুমি নিজে গাড়ি চালিয়ে যেতে পারবে তো? ঘাবড়ে যাবে না?
বিদিশা মিতিনের দিকে একটু তাকিয়ে বলল,—পারব।…আমি তা হলে তৈরি হয়ে নিই?
—হও তৈরি। তার আগে একটা কাজ করো তো।
—কী?
—তোমাদের দিঘা ট্যুরের ছবি আর নেগেটিভগুলো আছে? দাও আমাকে, একটু বসে বসে দেখি।
বিদিশা উঠে দাঁড়িয়েছিল, আবার ধপ করে বসে পড়ল,—নেগেটিভ কেন দেখবেন?
মিতিন নরম হাসল,—সব কথায় এত ভয় পেয়ে যেও না বিদিশা, শক্ত করো নিজেকে।
বিদিশা কী বুঝল কে জানে, কেঁদে ফেলল হঠাৎ। নাক টানতে টানতে বলল,—আমি তো ভাল মেয়ে নই দিদি, তাই সবেতেই ভয় হয়।
মিতিন বিদিশার কাঁধে হাত রাখল,—ভয়ের কিছু নেই, শনিবারের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
—সত্যি বলছেন?
—বলছি।…দাও, ওগুলো বার করে দিয়ে ড্রেস করো।
শুধু দিঘার ছবি আর নেগেটিভ নয়, গোটা চার পাঁচ অ্যালবাম মিতিনকে দিয়ে অ্যান্টিরুমে চলে গেল বিদিশা। নেগেটিভগুলো আলোর সামনে ঝুলিয়ে দেখছে মিতিন, দরজায় করাঘাত।
—কে?
—আমি পদ্মপাণি। সরবত এনেছিলাম।
তাড়াতাড়ি নেগেটিভটা গুটিয়ে ফেলল মিতিন,—এসো, ভেতরে দিয়ে যাও।
পদ্মপাণি ঘরে ঢুকে এদিক ওকে তাকাচ্ছে,—বউদিমণি কোথায়?
—বিদিশা রেডি হচ্ছে। আমরা এখন বেরোব।
—খাওয়া দাওয়া করবেন না?
উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল মিতিন,—তুমি সরবত আনলে কেন গো? তোমাদের সুমতি কোথায়?
—রান্নাঘরে। মানদাকে সাহায্য করছে।
—ও।…আমরা বাইরে খেয়ে নেব পদ্মদা।
—বউদিমণিও বাইরে খাবে? শরীরটা যে ভাল না…দাদা কিন্তু শুনলে রাগ করবে। আমাকে পই পই করে বলে দিয়েছে বউদিকে চোখে চোখে রাখতে। যদি এর মধ্যে ফোন করে, আমাকে কিন্তু খুব বকবে।
মিতিন কিছু বলার আগে বিদিশা বেরিয়ে এসেছে,—তোমার দাদা ফোন করলে বোলো বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়েছে, বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসবে।
অখুশি মুখে বেরিয়ে গেল পদ্মপাণি।
মিতিন অ্যালবাম খুলে ছবি উল্টোচ্ছে। জিজ্ঞাসা করল—লোকটার নাক একটু বেশি লম্বা, তাই না?
—হুঁ, বেশি ওস্তাদ। সব কথায় কথা বলে।
—কার বেশি পেট্? কর্তার, না দাদার?
—কারুরই না। যে যখন সামনে থাকে তার। এখন অবশ্য দাদাকে খুব জপানোর চেষ্টা করছে ছেলেকে দেশ থেকে এনে দোকানে যদি লাগানো যায়…। বিদিশা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে থমকে দাঁড়াল,—আচ্ছা দিদি, পদ্মপাণি শার্টটা ওখানে রেখে দেয়নি তো?
—হতেও পারে। কিন্তু মোটিভটা জানা দরকার। দুনিয়ার কিছুই অকারণে ঘটে না।
—আমার মনে হচ্ছে এটা পদ্মপাণিরই কাজ। ওকে ডেকে ভাল করে ক্রস করুন না। দেশে জমি কিনেছে, বাড়ি করেছে…নিশ্চয়ই ক্রিমিনালের সঙ্গে যোগ আছে।
—থাকতে পারে। তবে তোমার পঞ্চাশ হাজার টাকা থেকে ভাগ নিয়ে জমি বাড়ি করেনি, এটা তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। মিতিন আরও কয়েক মিনিট অর্চিষ্মানের পারিবারিক ছবিগুলো দেখল। তারপর উঠে দাঁড়িয়েছে,—চলো, তোমার আসল গার্জেনের পারমিশান নিয়ে বেরোই।
দিননাথ দেওয়ালের দিকে ফিরে শুয়ে ছিলেন। বিদিশার ডাকে ফিরলেন। সত্যিই বেশ অসুস্থ দেখাচ্ছে মানুষটাকে। মুখ শুকনো শুকনো, চোখ ভেতরে ঢোকা, চেহারায় কেমন ছন্নছাড়া ভাব।
মিতিনকে দেখে উঠে বসলেন, একটু যেন কষ্ট করেই। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,— তুমি কতক্ষণ এসেছ?
—এই তো, আধঘণ্টাটাক আগে। মিতিন বসল কারুকাজ করা পালঙ্কের এক ধারে,—কী করে বাধালেন?
—এই বয়সে কী আর বাধাতে হয়? বেধে যায়।
—বাজে কথা একদম বোলো না। বিদিশা চোখ পাকাল,—পরশু অত রাত অব্দি ফাংশান শুনে এলে…তারপর কাল আর তোমার বেরনোর কী দরকার ছিল শুনি? পরশুই তোমার হিম লেগে গেছে, আমি জানি।
—কোথায় ফাংশান শুনতে গিয়েছিলেন মেসোমশাই?
—ওই তো…সাউথে…নজরুল মঞ্চ।
—যেখানে আমজাদ আলি খাঁর প্রোগ্রাম ছিল?
—হ্যাঁ হ্যাঁ। তুমিও গিয়েছিলে নাকি?
—না, কাগজে দেখছিলাম। মিতিন ঘড়ি দেখল। সামান্য আবদারের সুরে বলল, —আমি আর বিদিশা একটু বেরোচ্ছি মেসোমশাই।
—কোথায়?
—পুজোর বাজার। বিদিশাও বলছিল ওর নাকি কোনও মার্কেটিংই হয়নি…। বেশি দূর যাব না, এই হাতিবাগান শ্যামবাজার…
বিদিশা চটপট বলে উঠল,—তুমি কিন্তু আজ আর চান কোরো না বাবা। সুমতিকে বলো, গরম জল দেবে, মাথা ধুয়ে ভাল করে গা স্পঞ্জ করে নিও।
কেমন যেন বিহ্বল চোখে বিদিশার দিকে তাকিয়ে আছেন দিননাথ। অস্ফুটে বললেন,—তাড়াতাড়ি ফিরিস। দেরি হলে কিন্তু আমি চিন্তা করব।
—জানি তো। চারটের মধ্যেই ফিরব।
—অতক্ষণ লাগবে? তা হলে খাওয়া দাওয়া করে যা।
মিতিন চুপ করে শ্বশুর-পুত্রবধূর ভালবাসা বিনিময় দেখছিল। মুচকি হেসে বলল,— আজ আমরা একটু মুখ বদলাব মেসোমশাই। রেস্টুরেন্টে খাব। আপনার বেটির জিভে স্বাদ নেই। রুচি ফেরানো দরকার।
আরও কী যেন একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন দিননাথ। মিতিন আর বিদিশা বেরিয়ে এল।
রোদের তাপ প্রখর হয়েছে আরও। থোকা থোকা সাবানের ফেনায় ভরে আছে আকাশ, হাওয়ার স্রোতে ছুটছে অবিরাম। রাস্তার ধারে ফুটে থাকা কাশফুলের গায়েও সেই হাওয়ার ছোঁয়া। চারদিকে ঘন সবুজ হয়ে আছে গাছগাছালি।
গাড়িতে যেতে যেতে মিতিন বলল,—তোমার শ্বশুরমশাই দেখছি তোমাকে চোখে হারান!
—ওটাই তো আমায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়। গিয়ার বদলে গাড়ির গতি একটু কমাল বিদিশা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,—উনি যদি আমার পাস্ট জানতে পারেন, আমি শিওর উনি বাঁচবেন না। আমিই এখন ওঁর একমাত্র অবলম্বন।
—এমন শ্বশুর অনেক ভাগ্য করলে জোটে! মিতিন একটুক্ষণ নীরব থেকে বলল,— তোমার শ্বশুরের অত গানবাজনার নেশা, নিজে গান জানেন?
—শুনিনি। মাঝে মধ্যে একটু আধটু গুনগুন করেন…
—তোমার বর ননদ, এদের গলা কেমন?
—আমার বর তো অ-সুর। তার একটাই গান আছে, শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর…। ননদও গান টান জানে বলে মনে হয় না।
—মিস্টার রুদ্রর মামার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক কেমন?
—তারা তো খুব একটা আসে না। ওই বউভাতের সময়ে এক দুজনকে দেখেছিলাম…
—তাদের অবস্থা কেমন?
—বিশাল বড়লোক। ব্যবসা আছে নানা রকম, প্রচুর বাড়ি আছে কলকাতায়…
—কোথায় থাকেন তাঁরা?
—বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে। মেফেয়ার রোড। আমি অবশ্য সেখানে একদিনও যাইনি।
—কেন?
—অর্চিষ্মানের সময় কোথায় নিয়ে যাওয়ার! তা ছাড়া রিলেটিভ টিলেটিভদের ওপর ওদের টান একটু কমই।
—ও। মিতিন দুম করে প্রসঙ্গ বদলাল, —তোমার শ্বশুরমশায়ের দাবার নেশা কত দিন?
—এই তো চার ছ মাস। ওই কর্নেল লাহিড়িই ধরিয়েছেন।
—কে কর্নেল লাহিড়ি?
বিদিশা স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে একটা গাড়িকে পাশ কাটাল,—বলিনি আপনাকে? বাবার বন্ধু। ওই মর্নিংওয়াক করতে করতে আলাপ। স্টেডিয়ামের দিকে থাকেন।
মিতিন হেসে ফেলল। বিদিশা জেরার উত্তর দিতে দিতে বেশ পোক্ত হয়ে গেছে, দিব্যি জবাব দিচ্ছে গুছিয়ে।
হাসি হাসি মুখে প্রশ্ন করল,—রোজই কি উনি দাবা খেলতে যান?
—প্রায় রোজই। কী যেন মনে পড়েছে বিদিশার, হাসছে মিটিমিটি,—একটা ভারী মজার ব্যাপার হয়, জানেন! জিতলে বাবার বেশি মন খারাপ হয়। হারার থেকেও।
—তাই?
—হুঁ। বলেন, পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখ দেখে ওঁর নাকি জেতার আনন্দ উবে যায়।…অর্চিষ্মান একেবারে উল্টো।
—কী রকম? জেতা হারা স্পোর্টিংলি নিতে পারে না?
—খেলার কথা অবশ্য জানি না। ব্যবসার কথা বলতে পারি। অন্য নিলামঘরে সত্যিকারের কোনও রেয়ার পিস এসে গেলে ওর মুখ হাঁড়ি হয়ে যায়। পার্ক স্ট্রিটের কোন বারে কী রকম বিজনেস চলছে, তাই নিয়েও খুব টেনশানে থাকে।
—তোমাকে গল্প করে বুঝি?
—উহুঁ। মোবাইলে রাতে কথা বলে তো, কানে আসে।
—ও।
কথা বলতে বলতে বিবেকানন্দ রোডে এসে পড়েছে গাড়ি। জ্যামে পড়ে ঘন ঘন ক্লাচ ব্রেক চাপছে বিদিশা, মুখে চোখে এখন তার টানটান ভাব। পোস্তা পেরিয়ে হাওড়া ব্রিজ, সেখান থেকে শালকিয়া, এ যেন এক দুর্গম অভিযান। মিতিনও আর কথা বলছিল না, আপন মনে মাথা দোলাচ্ছিল মাঝে মাঝে।
পূষনদের বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে দেড়টা বেজে গেল।
অসময়ে বিদিশাকে দেখে খুবই অবাক হয়েছে অর্চনা,—কী রে, হঠাৎ কোনও খবর না দিয়ে?
বিদিশা বিনা ভূমিকায় মিতিনের শেখানো কথা উগরে দিল,—দিদি, এ আমার বন্ধু, প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি। তোমার সঙ্গে কীসব কথা বলতে চায়।
অর্চনা আরও অবাক,—আমার সঙ্গে? কী কথা ভাই?
মিতিন নরম সুরে বলল,—দিদি, কথাটা একটু প্রাইভেট। আমরা একটু অন্য কোথাও বসতে পারি?
অৰ্চনা চোখের পাতা ফেলতেও ভুলে গেছে,—আমরা মানে? বিদিশাও থাকবে না?
—বললাম না দিদি, প্রাইভেট। বিটুইন ইউ অ্যান্ড মি।
বিদিশা বলল,—আমি মাসিমার সঙ্গে দেখা করে আসছি, তোমরা কাজ সেরে নাও।
হতভম্ব মুখে মিতিনকে শোওয়ার ঘরে নিয়ে এল অর্চনা। আধঘণ্টা পর যখন বেরোল, তখন মিতিনের মুখ গম্ভীর, অর্চনার মুখ ছাইয়ের মতো সাদা।
বাইরে বেরিয়ে বিদিশা জিজ্ঞাসা করল, —কী হয়েছে দিদি? আমার ননদ অত কাঁপছিল কেন?
কথাটার উত্তর দিল না মিতিন। বলল,—পূষনবাবুর ফ্যাক্টরিটা কোথায় তুমি জানো?
—হ্যাঁ, এই তো কাছেই। বেলগাছিয়ায়। কিউ রোড, না এম রোড…গেছি একবার। বিদিশা অস্ফুটে প্রশ্ন করল,—এখন ওখানে যাবেন?
একটু ভেবে নিয়ে দু দিকে মাথা নাড়ল মিতিন,—থাক।…চলো, এবার আমরা কোথাও বসে কিছু একটা খেয়ে নিই।
[বারো]
শুক্রবার সারাটা দিন ছোটাছুটিতেই কাটল মিতিনের। যাকে বলে টালা থেকে টালিগঞ্জ করা, তাই। একবার লালবাজার দৌড়োয়, তো একবার শ্যামবাজার, সেখান থেকে থেকে যদুবাজার…। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরল একেবারে ঝোড়ো কাক হয়ে। এসেও বসল না, বুমবুমকে নিয়ে সোজা চলে গেছে ক্যারাটে ক্লাব। এ সপ্তাহে ক্লাস নিতে আসা হয়নি, আজ মন দিয়ে বাচ্চাদের শরীরচর্চা শেখাল অনেকক্ষণ। বুমবুমও লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছে, হাত পা ছুঁড়ছে, আর হুহ্ হাহ্ করছে। ওদের সঙ্গে ঝাঁপাঝাঁপি করে মিতিনের শরীরও বেশ টনকা হয়ে গেল। সুস্থ সতেজ দেহ স্বচ্ছ চিন্তাশীল মস্তিষ্কের আধার, কথাটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে মিতিন।
আটটা নাগাদ বাড়ি ঢুকে মিতিন টিভি চালিয়ে দিল। ডিসকভারি চ্যানেল। সমুদ্রের অতলে অজস্র রঙিন মাছ খেলা করছে, বুমবুমকে পাশে নিয়ে দেখছে বসে বসে।
এমত সময়ে অর্চিষ্মানের আবির্ভাব। পরনে মাখনরঙ্ সাফারি স্যুট, হাতে একটা নতুন কিটসব্যাগ, মুখে ভাদ্রের গুমোট।
মিনি কিছু প্রশ্ন করার আগেই অর্চিষ্মান বলে উঠল,—টাকাটা আপনাকে দিতে এলাম। যেমন বলেছেন, তেমনই আছে। পঞ্চাশটা বাণ্ডিল। পুরনো একশো টাকার।
মিতিন হেসে ফেলল,—আমি তো কিছুই বলিনি! বলেছে তো আপনার স্ত্রীর ব্ল্যাকমেলার!
অর্চিষ্মান আরও গোমড়া হয়ে গেল,—এই সময়েও আপনি ঠাট্টারসিকতা করতে পারছেন প্রজ্ঞাপারমিতা দেবী? কাজের কাজ কিছু হল না, এখনও লোকটার হদিশ করতে পারলেন না…।
—সময় তো এখনও পেরোয়নি মিস্টার রুদ্র! মিতিনের মুখে হাসিটা ধরাই আছে,— আপনি যেন টাকাটা দেওয়ার জন্য একটু বেশি উদগ্রীব?
—এ ছাড়া আর উপায় কি? অর্চিষ্মান প্রায় খিঁচিয়ে উঠল,—আমার স্ত্রীকে তো আমি বিপন্ন হতে দিতে পারি না!
—কিন্তু বিপদের ঝুঁকি যে তাকেই নিতে হবে মিস্টার রুদ্র। ব্ল্যাকমেলার টাকাটা তাকেই ক্যারি করতে বলেছে।
—আপনি থাকছেন না?
—থাকাটা কি উচিত হবে? যদি গুলিগোলা চালিয়ে দ্যায়!
—আপনি…আপনি…!
—উত্তেজিত হবেন না। বসুন। রিল্যাক্স। কফি খাবেন?
—নো, থ্যাঙ্কস। অর্চিষ্মান ধপ করে সোফায় বসল,—আপনি কাল তা হলে সত্যিই বিদিশার সঙ্গে থাকছেন না?
মিতিন উত্তর না দিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল। পালটা প্রশ্ন জুড়ল,—আপনি কাল দুপুরে কোথায় থাকছেন?
—আমি আর কোথায় থাকব, দোকানেই আছি।…একবার হয়তো ব্যাঙ্কেও যেতে পারি। কাল বারোটায় র্যাঙ্কিং আওয়ার শেষ হওয়ার পর ম্যানেজারের সঙ্গে আমার একটা জরুরি মিটিং আছে। হয়তো সেখানে…
—কাল আপনার স্ত্রীর অত বড় একটা ক্রাইসিস, আর আপনি নিশ্চিন্ত মনে মিটিং করবেন?
—কাজের মধ্যে থাকলে টেনশানটা কম হয়।…অবশ্য আপনি যদি আমাকে বিদিশার সঙ্গে থাকতে বলেন…
—না না, তার দরকার হবে না।
—ঠিকই তো। বিদিশা যাবে, আমার হার্ডআর্নড মানি একটা লোকের হাতে তুলে দিয়ে আসবে…সেখানে আমার আর কী রোল আছে! অর্চিষ্মানের স্বর তেতো। উঠে দাঁড়িয়েছে অকস্মাৎ,—তা হলে টাকা আপনি রাখছেন না?
—না। ওটা আপনি বিদিশাকেই দিয়ে দিন। সব বলা আছে, ও জানে ও কী করবে।
—ও।…তা হলে চলি।
জুতো মশমশ করে বেরিয়ে গেল অর্চিষ্মান।
মিতিনের মুখ থেকে হাসি মুছে গেছে। ভাবছিল।
পার্থ ফিরল অনেক রাতে। বুমবুম ঘুমিয়ে পড়েছে, বিমলাও শুয়ে পড়েছে বিছানা করে। মিতিন অপেক্ষা করছিল পার্থর জন্য, এক সঙ্গে খেতে বসল দুজনে। ব্যারাকপুরে আজ কল শো ছিল পার্থর। প্রতিটি কল শোতেই কিছু না কিছু কমিক ঘটনা ঘটে, এবারের ব্যারাকপুরের শোও তার ব্যতিক্রম নয়। আজ মঞ্চে পার্থর এক সহঅভিনেতার গোঁফ খুলে গিয়েছিল, পার্থর সঙ্গেই অভিনয়ের সময়ে। দৃশ্যটা খুব সিরিয়াস ছিল। তবু হাসি চাপতে পারছিল না পার্থ। শেষমেষ দর্শকদের দিকে ফিরে করজোড়ে বলেছে, দয়া করে আমাদের পাঁচটা মিনিট সময় দিন, একটি ঝুলন্ত গোঁফ কিছুতেই আমাদের স্বাভাবিক অভিনয় করতে দিচ্ছে না! শুনে নাকি দর্শরা খুব একচোট হেসেছিল, তারপর তারাও ব্যাপারটাকে স্পোর্টিংলি নিয়েছে, এবং নাটকটা নাকি পরে দারুণ জমেওছিল!
একাই বকে যাচ্ছে পার্থ, মাঝে মাঝে শুধু হুঁ হ্যাঁ করছে মিতিন। একটু পরে পার্থ নজর করল তাকে।
চোখ ঘুরিয়ে বলল,—কী ব্যাপার, আজ ম্যাডামের কোনও কমেন্ট নেই যে?
মিতিন কাঁচালঙ্কায় ছোট্ট কামড় দিল,—শুনছি তো।
—উহুঁ, তোমার মন নেই। বলতে বলতে হঠাৎ খেয়াল হয়েছে পার্থর,—ওহ, হো কালই তো তোমার ডি-ডে!
মিতিন ঘাড় দোলাল,—হুঁ।
—অপারেশন-প্রস্তুতি শেষ?
—মোটামুটি।
—অনিশ্চয়বাবুর সঙ্গে কথা হয়েছে আর?
—হয়েছে। কাল সঙ্গে দুজন এ এস আই দিয়ে দেবেন। প্লেন ড্রেসে থাকবে।
—মাত্র দুজন? লোকটার কাছে যদি আর্মস থাকে? বা সঙ্গে আরও কেউ থাকে?
—তার জন্যই তো ওই ব্যবস্থা। নইলে তো আমি একাই ট্যাকল্ করতে পারতাম।
—এবার থেকে তুমি একটা রিভলবার রাখার বন্দোবস্ত করো।
—হুঁ, অনিশ্চয়বাবুও তাই বলছিলেন। মিতিন পার্থর প্লেটে ডিমের কারি তুলে দিল। নিজের পাতে স্যালাড নিতে নিতে বলল—তবে এই কেসে মনে হয় লাগবে না। ইনফ্যাক্ট, পুলিশ না হলেও বোধহয় চলত।
পার্থর চোখ সরু হল,—কোন যুক্তিতে বলছ এ কথা?
—যুক্তি নয়, আমার হিসেব বলছে।
—কী হিসেব?
—জানবে জানবে, তাড়া কীসের?
—মানে, হিসেবটা যদি ভুল হয়, সেইজন্যই কিছু বলবে না। তাই তো?
ইচ্ছে করে পার্থ খোঁচাচ্ছে। কৌতূহল। বুঝতে পারছিল মিতিন। একটুও উত্তেজিত না হয়ে হেসে উড়িয়ে দিল কথাটা, জবাব দিল না।
পার্থ ফের বলল,—মনে রেখো, ওই ব্ল্যাকমেলারটাই কিন্তু অর্ককে খুন করেছিল।
—অর্কর কেসটা আলাদা। লোকটা অর্ককে গ্রিপে পেয়ে গিয়েছিল, এবং ওই মুহূর্তে অর্ককে না সরিয়ে তার কোনও উপায়ও ছিল না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হবে না।
—কেন?
—লোকটার বিষদাঁত ভেঙে গেছে। অন্তত আমার হিসেব তাই বলছে।
—তোমার হিসেব আর কী কী বলছে ম্যাডাম? পার্থ নিরীহ মুখ করে মিতিনের দিকে তাকাল,—কালপ্রিটের নামটা বলতে পারছে?
মিতিন কচকচ শশা চিবোচ্ছে। খানিকটা আত্মগত ভাবে বলল,—একটা কথাই বলতে পারি। কালপ্রিট একজন সূর্যদেব।
—সূর্যদেব! ডিমের কুসুম হাতেই ধরা রইল পার্থর,—সে আবার কে?
—বারে, লক্ষ করোনি, বিদিশার আকাশে শুধুই সূর্যের ছড়াছড়ি?
—হেঁয়ালি করছ কেন? যা বলার স্পষ্টাস্পষ্টি বলো।
—বিদিশার প্রেমিকদের নাম কী? অরুণ মিহির ভাস্কর অর্ক। প্রতিটিই সূর্যের নাম, ঠিক কি না? তারপর পর ধরো ওর বরের নাম অর্চিষ্মান, শ্বশুরের নাম দিননাথ। দুটো নামই সূর্যর। ওর দাদা চিত্রভানু, সেও সূর্য। বাবা প্রভাকর, সেও সুর্য। চাকর পদ্মপাণিও সূর্য, ড্রাইভার রবিও সূর্য, অর্চিষ্মানের বারের ম্যানেজার অম্বরীশও সূর্য, এমন কী যিনি ওর লাইফ ইনশিওর করিয়েছেন, সেই সবিতাবাবুও সূর্য ছাড়া অন্য কিছু নন। বিদিশার ননদাই পূষন, সেও তো সূর্যই।
—আইব্বাস, শুনেই আমার সানস্ট্রোক হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা তুমি কবে আবিষ্কার করলে গো?
—অনেকদিনই করেছি। তোমার শব্দজব্দ করা মাথায় এসেছে কিনা দেখছিলাম।
—মাইরি, এই জন্যই তুমি টিকটিকি।
—এবং তুমি আরশোলা। উচ্চিংড়েও বলা যায়। মিতিন অনেকক্ষণ পর অনাবিল হাসল। ভুরু নাচিয়ে বলল,—কী গো, যাবে নাকি কাল সঙ্গে? অবশ্য প্রেসে যদি চাপ থাকে তবে বাদ দাও…
—না না, কাল তো শনিবার, দেড়টায় ছুটি। আমি বারোটায় বেরিয়ে পড়তে পারি।
—তোমার রিহার্সাল নেই?
—যাব না। নাটক করি বলে কি অমলদার চাকর বনে গেছি না কি? আজ ওই ক্রিটিকাল শোটাকে পার করে দিলাম, তার একটা মাসুল নেই?
—ঠিক আছে। তুমি প্রেসেই থেকো, আমি তুলে নেব।
খাওয়া শেষ করে বেসিনে আঁচাতে গেল মিতিন। পার্থ বসে বসে মাথা চুলকোচ্ছে। এক সময়ে সেও উঠল। মুখ ধুয়ে বসেছে সোফায়। আয়েশ করে সিগারেট ধরাল।
মিতিন টুক করে ঢুকে গেল স্টাডিরুমে। আধঘণ্টাটাক পর বেরিয়ে দেখল, পার্থ শুয়ে পড়েছে। নাকও ডাকছে ফুরুর ফুরুর।
আলো নিবিয়ে বিছানায় এল মিতিন। মাঝখানে বুমবুম, তাকে পেরিয়ে হাত রেখেছে পার্থর মাথায়। ফিসফিস করে ডাকল,—অ্যাই উচ্চিংড়ে, শুনছ?
পার্থর নাকডাকা থেমেছে। পাশ ফিরল,—উম?
—একটা কথা ছিল।
পার্থ জড়ানো স্বরে বলল,—বলে ফ্যালো।
—কদিন কোথাও থেকে একটা ঘুরে এলে হয় না? এই ধরো, পুজোর পর?
—এসব কি হুট বললে হয় না কি? বাঙালিরা সারা বছর ছারপোকার মতো ডেরায় সেঁধিয়ে থাকে, পুজোর সময়ে কিলবিল করে গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। এখন তুমি হারগিস কোনও জায়গার টিকিট পাবে না।
—কাছেপিঠে কোথাও চলো। মাথাটা একদম জ্যাম হয়ে গেছে, ছাড়ানো দরকার।…তোমার কোন এক বন্ধু আছে না, ট্র্যাভেল এজেন্ট?
—কোথায় যাবে? পার্থ লম্বা হাই তুলল।
—সূর্যদেবের দেশেই যাই চলো। মিতিন অন্ধকারে মুচকি হাসল,—কোনার্ক, পুরী…
—দেখছি। পার্থর নিশ্বাস প্রলম্বিত হচ্ছে,—এক্সপেনসেজ কিন্তু তোমার…
—তাই হবে গো কিপটেরাম।
মিতিন চোখ বুজল। বাতাসে বেশ হিম হিম ভাব, পাখার হাওয়ায় শীত করছে অল্প। পায়ের কাছে পাতলা চাদর ভাঁজ করা আচ্ছে, টেনে ছেলের গায়ে ভাল করে ছড়িয়ে দিল।
পার্থ গভীর ঘুমে চলে গেছে। ছেলের গায়ে আলগা হাত রেখে পাশ ফিরে শুয়েছে মিতিন। ঘুমোতে চাইছে, ঘুম আসছে না। মনে মনে আবার কাহিনীটাকে সাজাতে শুরু করল মিতিন। বন্ধ চোখের পাতায় একের পর কল্পদৃশ্য ভেসে উঠছে। তবু এখনও যেন ফাঁক থেকে যাচ্ছে কোথাও!
অন্ধকারে অদৃশ্য গ্রন্থিটাকে খুঁজছে মিতিন।
[তেরো]
ঠিক দুটো সাতাশে সেন্ট্রাল স্টেশনে ইন করল মেট্রোট্রেন। মিতিন পার্থ প্রস্তুতই ছিল, উঠেছে একেবারে প্রথম কামরায়। সরকারি অফিস সব ছুটি আজ, ট্রেনে তেমন ভিড় নেই, তবে একদম ফাঁকাও নয়। বসার সিট ভর্তি, দু পাঁচ দশজন দাঁড়িয়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। চাঁদনি থেকে বেশ কিছু লোক উঠল, মিতিনরা দ্রুত পিছিয়ে এল দ্বিতীয় কামরায়। এসপ্ল্যানেডে পৌঁছে ট্রেন প্রায় পূর্ণ হয়ে গেছে। মিতিনরাও ওমনি সরে এসেছে তৃতীয় কামরায়।
মিতিনের চোখে সানগ্লাস, মণি ঘুরছে আনাচে কানাচে। বিদিশা বসে আছে দরজার পাশে, হাতলে হাত, মাথা নিচু, শালোয়ার পরা দু পায়ের মাঝখানে কালো কিটসব্যাগ। চোখ তুলে কী যেন খুঁজল একবার, মিতিনকে দেখেই দৃষ্টি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। মিতিন সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
সুড়ঙ্গপথে ছুটছে ট্রেন। প্রচণ্ড আওয়াজ, গাড়ির সর্বাঙ্গ ঝনঝন করছে, কানে তালা লেগে যায়। তারই মধ্যে পার্থ কানের কাছে গুনগুন করে উঠল,—তোমার পুলিশ অফিসাররা কোথায় গো?
—আছে। আগে থেকেই উঠেছে।
—বিদিশার পাশের সর্দারজিটাই বুঝি সেই লোক?
—না। আছে ঠিক জায়গায়। তুমি চুপ করে দাঁড়াও তো।
পার্ক স্ট্রিট এসে গেল। জড়োসড়ো পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে বিদিশা, দরজা খুলে যেতেই নেমে গেল, মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে উঠেছে আরও এক ঝাঁক মেট্রোযাত্রী। দরজা বন্ধ হয়ে গেল, উদ্বিগ্ন বিদিশার মুখ মিলিয়ে গেল স্টেশনে।
কামরায় এখন ঠাসাঠাসি ভিড়। মিতিন ঠেলেঠুলে বিদিশার ফেলে যাওয়া সিটের দিকে এগোল কিছুটা। সেখানে এখন সরে বসেছে সর্দারজি, আর সর্দারজির জায়গায় রোগা চেহারা এক যুবক, ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে যুবকটি, যেন কোথাও জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে তার।
পার্থ পাশে এসে গেছে। কানে কানে বলল,—ওই কি কালপ্রিট?
—আহ্, থামবে?
পার্থকে মৃদু ধমক দিয়ে আর একটু এগোল মিতিন। দরজার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।
পর পর স্টেশন চলে যাচ্ছে। ময়দান রবীন্দ্রসদন নেতাজিভবন…। এখন লোকজনের ওঠা নেই বিশেষ, তবে নামছে অনেকে। এক দল তরুণ তরুণী উচ্চৈঃস্বরে গল্প করছে, হি হি হাসছে, যাত্রীরা ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে তাদের দিকে। ছেলেমেয়েগুলো বেশভূষায় যথেষ্ট আধুনিক। হয়তো সেই আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতেই অনর্গল ইংরিজি বুলি ফুটছে তাদের মুখে। মাঝে মধ্যে এক আধটা খাঁটি দেশজ বাংলা শব্দ শুনে সন্দেহ হয় এরা বোধহয় বাঙালি পিতামাতারই সন্তান। পার্থর এ ধরনের ট্যাঁশপনা ঘোরতর অপছন্দ, মাঝে মাঝেই কটমট চোখে ছেলেগুলোকে দেখছে সে, আর বিড়বিড় করছে—এদের সিটিজেনশিপ কেড়ে নেওয়া উচিত…
মিতিন শুনেও শুনছিল না তার চোখ কান মস্তিষ্ক সবই এখন ওই কালো ব্যাগে স্থির। নামার আগে ব্যাগ সামান্য একটু ভেতর দিকে ঠেলে দিয়ে গেছে বিদিশা, হ্যান্ডেলটা সর্দারজির পায়ের কাছে লটপট করছে।
যতীনদাস পার্ক চলে গেল। মিতিন বুকের মধ্যে চাপা উত্তেজনা টের পাচ্ছিল। ট্রেন তো এর পর বেশ ফাঁকা হয়ে যাবে, এখনও ব্যাগটাকে তুলছে না কালপ্রিট?
কালীঘাট স্টেশন। প্রচুর লোক নামছে এ স্টেশনে। সেই ছেলেমেয়েগুলোও নেমে গেল। এখনও ব্যাগ অনড়।
তখনই ঘটল ঘটনাটা। স্বয়ংক্রিয় দরজা বন্ধ হচ্ছিল, হঠাৎই বিদ্যুৎবেগে ব্যাগটা তুলে নিয়ে দরজা গলে নেমে গেল সর্দারজি। মিতিন হতচকিত হয়ে গিয়েছিল, মুহূর্তের মধ্যে ইতিকর্তব্য স্থির করে বন্ধ হয়ে আসা গেটের সরু ফাঁকে গলিয়ে দিয়েছে পা। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল।
মিতিন পার্থ দৌড়ে নেমেছে। সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ পোশাকের দুই পুলিশও। মিতিনের ইশারায় তির বেগে ছুটল তারা।
সর্দারজি হনহনিয়ে হাঁটছিল, কিছু একটা আঁচ করে দৌড়তে শুরু করেছে। এসকালেটারে গাদাগাদি ভিড়, লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভাঙছে লোকটা। একদম ওপরের ধাপ পর্যন্ত পৌঁছতে পারল না, তার আগেই পুলিশের লোক চেপে ধরেছে তার কলার।
মিতিন চেঁচিয়ে উঠল,—তপন, একদম নড়বেন না।
ঘাড় ঘুরিয়ে মিতিনকে এক ঝলক দেখেই নিজেকে ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিয়েছে লোকটা। ধেয়ে আসা পুলিশের একজনকে ব্যাগ ঘুরিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল। ছিটকে পড়ে গেছে পুলিশটা, আশপাশের ভিড়ের প্রায় ছত্রভঙ্গ দশা। তারই সুযোগ নিয়ে গেটে পৌঁছে গিয়েছিল সর্দারজিবেশী তপন, গেট পার হতে পারল না, অন্য পুলিশটা ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে মিতিনই পৌঁছে গেছে। মিতিনের ডান হাত শূন্যে উঠল একবার, নেমে এল তপনের কাঁধে।
যন্ত্রণায় কুঁকড়ে বসে পড়েছে তপন। বিস্ফারিত চোখে দেখছে মিতিনকে। মিতিন গর্জে উঠল,—আপনার খেলা শেষ তপন। একটু নড়ার চেষ্টা করলে আপনার হাড় আমি গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেব।
তপন দরদরিয়ে ঘামছে। চারপাশে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে, সকলে ড্যাবড্যাব চোখে গিলছে দৃশ্যটা। মিতিন টান মেরে তপনের দাড়িটা খুলে নিল, পাগড়িটাও। বেরিয়ে পড়েছে এক সাধামাঠা মুখ। একজন পুলিশ হাতকড়া বার করল, টেনে ওঠানোর চেষ্টা করছে তপনকে, পারল না। কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে গেছে তপনের মুখ, চোখ উল্টে গড়িয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
পুলিশ দুজন নিচু হয়ে ঝাঁকাচ্ছে, নড়ছে না তপন। একজন পুলিশ তপনের হাতটা ওঠাল, বডি তো বেশ ঠাণ্ডা ম্যাডাম! পালস পাচ্ছি না…!
পার্থ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নার্ভাস গলায় বলে উঠল, স্ট্রোক ফোক হল নাকি?
মিতিন ঝুঁকল,—কিচ্ছু হয়নি। নাথিং টু ওরি।
বলেই মিতিন হাত ঢুকিয়েছে তপনের বুকপকেটে। ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বার করে আনল। চেপে চোয়াল ফাঁক করে প্যাকেটটা উপুড় করে দিল তপনের মুখে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভোজভাজি! তপনের চোখ খুলে গেছে, পিটপিট তাকাচ্ছে চারদিকে।
মিতিন মৃদু হাসল,—কী সোনাদা, শরীর ঠিক হয়ে গেছে তো? এবার তা হলে উঠে পড়ুন। এখন যে আপনাকে শ্রীঘর যেতে হবে।
পলকে তপনের মুখচোখ আবার হিংস্র। ফুসে উঠেছে,—দেখে নেব, সব্বাইকে দেখে নেব। সব ফাঁস করে দেব। আমায় ধরিয়ে দেওয়া, অ্যাঁ?
মিতিন তপনের দিকে তাকালই না। কেজো সুরে পুলিশদের বলল,—একে তবে এখন লালবাজারে নিয়ে যান। মিস্টার তালুকদারকে গিয়ে বলবেন আমি ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই আসছি।
—আপনি আমাদের সঙ্গে যাবেন না ম্যাডাম?
মিতিন দু দিকে মাথা নাড়ল, —না ভাই,—আমার এখনও কিছু কাজ বাকি।
তরতর পায়ে পার্থকে নিয়ে ভূতলে উঠে এল মিতিন। কিটসব্যাগটা হাতে চেপে খোলা জায়গায় এসে বড় করে নিশ্বাস নিল একটা। পার্থকে বলল,—এক্ষুনি একটা ট্যাক্সি ধরো। শিগগিরই।
পার্থ কিছুই বুঝতে পারছে না। ফ্যালফ্যাল তাকাচ্ছে,—কোথায় যাবে এখন?
—আহ্, দেরি কোরো না। বিদিশা পার্কস্ট্রিট স্টেশনের গেটে অপেক্ষা করছে। ওকে নিয়ে এক্ষুনি ইম্পিরিয়াল এক্সচেঞ্জে যেতে হবে।
—নিলামঘরে? এক্ষুনি? কেন?
মিতিনের ঠোঁটে বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল। বলল,—তুমি কি ভাবছ তপন একাই কালপ্রিট? মোটেই না।
[চোদ্দ]
পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে ফুটপাথে অপেক্ষা করছিল বিদিশা। অপেক্ষা না বলে ছটফট বলাই ভাল, উদ্বিগ্ন মুখে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক, ঘন ঘন কবজি উল্টোচ্ছে, তার ত্রস্ত চোখ পিছলে পিছলে যাচ্ছে প্রতিটি চলমান গাড়িতে। মিতিনদের ট্যাক্সির দর্শন পেয়েই সে প্রায় ঝাপটে এল।
বিদিশা কোনও প্রশ্ন করার আগে মিতিন ট্যাক্সির দরজা খুলে ডাকল,—উঠে পড়ো।
সুস্থিত হয়ে বসতে পারল না বিদিশা, তার নজর আটকেছে মিতিনের কোলে। অস্ফুটে বলল,—লোকটা টাকা নেয়নি?
—চেষ্টা করেছিল, হজম করতে পারেনি। মিতিন কিটসব্যাগটা নাড়াল,—সে এখন পুলিশের জিম্মায়।
—কককে সে? বিদিশার গলা কাঁপছে, —চেনা কেউ?
—হয়তো চেনো। সিগনাল সবুজ হতেই নড়ে উঠেছে ট্যাক্সি, মিতিন বিদিশার দিকে ফিরল,—লোকটার নাম তপন। তপন নন্দী।
পার্থ পাশ থেকে ফুট কেটে উঠল,—ব্যাটা আপনার স্বামীর দোকানে চাকরি করত। ছাঁটাই হয়েছিল।
বিদিশার চোখের মণি স্থির, কী যেন মনে করার চেষ্টা করছে। বিড়বিড় করে বলল,— তপন? হ্যাঁ, লোকটাকে একদিন দেখেছিলাম বটে। আমাদের বাড়িতে…। কিন্তু সে কেন হঠাৎ…? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
—সম্ভবত তোমার স্বামীর ওপর আক্রোশেই তোমার ওপর এই আক্রমণ।
—শুধু ছাঁটাই হওয়ার জন্য কেউ এমন…?
—অন্য কারণ থাকলে পুলিশ টেনে বার করবে। বিদিশার জিজ্ঞাসা মাঝপথে থামিয়ে দিল মিতিন,—লোকটা তোমার দাদার বন্ধুও ছিল। তোমার পাস্ট সে জেনেছে তোমার দাদার কাছ থেকেই। চিত্রভানুবাবু অবশ্য এই ব্ল্যাকমেলিং-এর বিন্দুবিসর্গও জানেন না। তিনি শুধু নির্বোধের মতো খবর সাপ্লাই করেছেন, ব্যস। একটু বেশি বকবক করা স্বভাব কিনা।
বিদিশা স্তম্ভিত মুখে বলল,—তাই কি সেদিন লোকটাকে চেনা চেনা লেগেছিল? দাদার সঙ্গেই কি দেখেছি কোনও দিন?
—হতে পারে। মিতিন বিদিশার পিঠে হাত রাখল,—যাক গে, আজ থেকে তোমার দুঃস্বপ্নের দিন শেষ। এবার থেকে লক্ষ্মী বউ হয়ে সুখে শান্তিতে ঘরকন্না করো। নতুন কোনও লোভের ফাঁদে পোড়ো না, আর কোনও ভাস্কর মিহির অরুণ অর্ক জুটিও না। বুঝেছ? মনে রেখো, তোমার স্বামী তোমার একটা অপরাধ হয়তো ক্ষমা করে নেবেন, কিন্তু…। তা ছাড়া তোমারই জন্য অর্কর মতো একটা নিরীহ ছেলেকে মরতেও হয়েছে।
বিদিশা মাথা নামিয়ে নিল। টপটপ জল পড়ছে চোখ বেয়ে। কান্নাটা বোধহয় কৃত্রিম নয়, মনে হল মিতিনের।
ইম্পিরিয়াল এক্সচেঞ্জের সামনে ট্যাক্সি থামিয়েছে পার্থ। মিতিন বলল, —তুমি এই ট্যাক্সিতেই বাড়ি চলে যাও বিদিশা, আমরা একটু মিস্টার রুদ্রর সঙ্গে কথা বলব।
—আমি থাকব না?
—তুমি থেকে কী করবে? হয়তো এক্ষুনি আমাদের মিস্টার রুদ্রকে নিয়ে লালবাজারে ছুটতে হবে। সেখানে কতক্ষণ লাগবে, না লাগবে…। তোমার শ্বশুরমশায়ের শরীরটা ভাল না, তুমি বরং তার কাছেই এখন…। ট্যাক্সি থেকে নেমে মিতিন কী যেন ভাবল একটু। তারপর ট্যাক্সির জানলায় মুখ এনে বলল,—টেনশান কোরো না। আমার স্মরণে আছে, ভাস্কর মিহিরদের কথা তোমার স্বামীকে বলব না। তুমিও এই ব্ল্যাকমেলিং-এর আতঙ্ক মন থেকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলো, কেমন?
ট্যাক্সি মিলিয়ে যেতে পার্থ বলল,—কেসটা কী বলো তো? মেয়েটাকে ভাগালে কেন?
মিতিন মুচকি হাসল, রহু ধৈর্যং, রহু ধৈর্যং। নাটক তো ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছেই গেছে, আর একটু সবুর করোই না।
নিলামঘরে ঢুকতেই দূরে কাচের ওপার থেকে মিতিনদের দেখতে পেয়েছে অর্চিষ্মান। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছে। হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
মিতিন কিটসব্যাগটা অৰ্চিষ্মানের দিকে বাড়িয়ে দিল। নীরস গলায় বলল,—দেখে নিন। পুরো পাঁচ লাখই আছে।
অৰ্চিষ্মানের তবু যেন বিশ্বাস হচ্ছে না,—লোকটা…?
—ধরা পড়েছে। সে এখন শ্রীঘরে।
—রিয়েলি? রিয়েলি? হারামজাদাটা কে?
—বলছি বলছি, তাড়া কীসের! চলুন গিয়ে ঠাণ্ডাঘরে বসি, একটু কফিটকি খাই। মিতিন ফিক করে হাসল,—আমার স্বামী খুব ভোজনরসিক মানুষ, ওকে একটু ভাল করে আপ্যায়ন-টাপ্যায়ন করুন।
মিতিনের আকস্মিক লঘু আচরণে কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল অর্চিষ্মান। পলকে অবশ্য সামলেও নিয়েছে নিজেকে। দারুণ শশব্যস্ত ভঙ্গিতে দুজনকে এনে বসাল নিজস্ব ঘেরাটোপে, বেয়ারাকে ডেকে কফি স্ন্যাকসের অর্ডার দিল, এসিও বাড়িয়ে দিল দু পয়েন্ট। চেয়ারে বসে টেবিলের পেপার ওয়েট নিয়ে নাড়াচাড়া করল একটুক্ষণ। তারপর গলা ঝেড়ে বলল,—ওয়েল ম্যাডাম, এবার সব খুলে বলুন।…বাই দা বাই, আমার ওয়াইফ কোথায়?
—এতক্ষণে তার কথা মনে পড়ল? মিতিনের ঠোঁটে আবার আলগা হাসি,—ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। বেচারার ওপর আজ খুবই মেন্টাল স্ট্রেন গেছে, ওর এখন বিশ্রাম দরকার। তা ছাড়া এই মুহূর্তে ওর বাড়িতে থাকাটা খুব জরুরি। টু অ্যাভয়েভ ফারদার মিসহ্যাপ ইন ইওর ফ্যামিলি।
অর্চিষ্মান ফ্যালফ্যাল চোখে তাকাল।
অচিষ্মানের ধন্দ মাখা মুখখানা দেখতে দেখতে হাসি মুছে ফেলল মিতিন। সংক্ষেপে আজকের অভিযানের বিবরণ দিল। শুনতে শুনতে অর্চিষ্মানের চোয়াল শক্ত হচ্ছে ক্রমশ। তপনের নাম শুনে প্রায় ছিটকে লাফিয়ে উঠল। চিৎকার করছে,—আ’ইল কিল দ্যাট সোয়াইন,…দা সান অফ আ বিচ। ব্যাটা চোরস্য চোর, তার অত বড় সাহস…! বলতে বলতে ভুরু কুঁচকে তাকাল,—কিন্তু ওই হারামজাদা বিদিশার এত খবর জানল কোত্থেকে?
—বলছি, সব বলছি। উত্তেজিত না হয়ে স্থির হয়ে বসুন।
বসবে কি, ক্রোধে ফুঁসছে অর্চিষ্মান। ঝপাং করে চেয়ারে ছেড়ে দিল শরীর, হাতের মুঠো পাকাচ্ছে।
মিতিন হিমশীতল গলায় বলল,—এবার মন দিয়ে আমার কথাটা শুনুন। তপন একা কালপ্রিট নয়। একজনের প্রত্যক্ষ যোগসাজশে ঘটনাটা ঘটেছে। বলতে পারেন, তাঁর অপরিণামদর্শিতা এবং দুর্বলচিত্ত আচরণই এই ব্ল্যাকমেলিং-এর মূল কারণ।
অর্চিষ্মানের চোখ সরু হল,—কে সে?
—আপনার বাবা। শ্রীদিননাথ রুদ্র স্বয়ং। তিনি পর্দার আড়ালে আসল ট্র্যাজিক হিরো। ভিলেনও বলতে পারেন।
ঘরে এই মুহূর্তে অ্যাটম বোমা পড়লেও বুঝি এতটা চমকাত না অর্চিষ্মান। বাক্যস্ফূর্তি হচ্ছে না তার। কোনও মতে বলল,—কী আবোল তাবোল বকছেন?
—আমি সত্যি কথাই বলছি। মিতিনের মুখ ভাবলেশহীন,—এও শুনে রাখুন, আপনি এতক্ষণ ধরে যাকে গালিগালাজ করলেন, সেই হারামজাদা তপন নন্দী আপনার বাবারই ছেলে। অর্থাৎ আপনার ভাই।
অর্চিষ্মানের মুখ লাল হয়ে গেছে। ফ্যাসফেসে গলায় বলল,—অ্যাবসার্ড। ইম্পসিবল। হতেই পারে না। তপন নন্দী আমাদের এক্স ম্যানেজার ঊষাপতি নন্দীর ছেলে।
—হ্যাঁ, এইটাই তার অফিসিয়াল পরিচয় বটে, কিন্তু আদতে সে ঊষাপতিবাবুর সন্তান নয়। মিতিন গুছিয়ে বসল। অর্চিষ্মানের চোখে চোখ রেখে বলল,—আমার বলতে খুব খারাপ লাগছে মিস্টার রুদ্র, ঊষাপতিবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে আপনার বাবার অবৈধ প্রণয় ছিল। ওই সম্পর্কেই বিষাক্ত ফল এই তপন নন্দী। দিননাথবাবুর সঙ্গে স্ত্রীর এই সম্পর্কের কথা জানতে পেরে ঊষাপতিবাবু প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। এবং তপনের জন্মের পর পরই তিনি আত্মহত্যা করেন।
—নো। আই কান্ট বিলিভ ইট। অর্চিষ্মান দু দিকে মাথা ঝাঁকাচ্ছে।
—তবু এটাই ফ্যাক্ট। বিশ্বাস না হয়, আপনার দিদিকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। আপনার বাবার ঘটনাটা মোটামুটি জানেন।
অর্চিষ্মানের চোখে এখনও তীব্র অবিশ্বাস।
মিতিন গলা ঝেড়ে বলল,—রিল্যাক্স মিস্টার রুদ্র। আপনার বাবা তো একজন মানুষ, আর মানুষ মাত্রেরই পদস্খলন ঘটতে পারে। ইন ফ্যাক্ট, দিননাথবাবুর এই পদস্খলনের যথেষ্ট কারণও ছিল। আপনার মা ছিলেন নিতান্ত সাদাসিধে মানুষ যাকে বলে ঘরোয়া, সলজ, হাঁড়িহেঁশেলে ডুবে থাকা আপাদমস্তক গৃহবধূ। তুলনায় ঊষাপতিবাবুর স্ত্রী অনেক স্মার্ট, রূপসী বলিয়ে কইয়ে। সব থেকে বড় কথা, তিনি খুব ভাল গান জানেন। হয়তো এই সব কারণেই তিনি বন্ধুর স্ত্রীর প্রতি…। সে যাই হোক, আপনার বাবা কিন্তু মানুষ খারাপ নন। ঊষাপতিবাবুর মৃত্যুর পর তপন বা তপনের মার দায়িত্ব তাই তিনি ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। বরং তাদের সংসারটা তিনিই টেনে এসেছেন এতকাল। ওদের একটা বাড়ি কিনে দিয়েছেন, তপনকে ভাল ভাবে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন, মা ছেলেকে যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে রেখেছেন…। এটাকে আপনি তাঁর চারিত্রিক দুর্বলতাও বলতে পারেন, আবার মহানুভবতাও বলতে পারেন। বাট দি আয়রনি ইজ দিস, তাঁর কৃতকর্ম তাঁকে একটা দিনের জন্যও শান্তি দেয়নি।
বেয়ারা কফি এনেছে, সঙ্গে গরম গরম চিকেন পকোড়া। পার্থ পকোড়ার প্লেটের দিকে হাত বাড়াচ্ছে না, মুগ্ধ চোখে শুনছে স্ত্রীর কথা। অর্চিষ্মানের চোখ মিতিনে স্থির।
মিতিন ধূমায়িত কাপে চুমুক দিল,—অশান্তি আর বদনামের ভয়ে দিননাথবাবু দর্জিপাড়া থেকে সরে এসে সল্টলেকে বাড়ি করলেন, তবু শেষ রক্ষা হল না। ওই তপন সারাটা জীবন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে তাঁকে। সম্ভবত সে ছোটবেলাতেই টের পেয়ে গিয়েছিল, দিননাথ রুদ্র যতই নিজেকে বাবার বন্ধু বলে পরিচয় দিন, আসলে তিনিই তার জন্মদাদা। এসব ব্যাপারে বাচ্চাদের সিক্সথ্ সেন্স খুব কাজ করে। চিরকাল সে দিননাথবাবুকে দু হাতে দোহন করার চেষ্টা করে গেছে। লেখাপড়া তো শিখলই না, উল্টে কুসঙ্গে পড়ে জুয়া খেলে টাকা উড়িয়ে গেছে ক্রমাগত। আর আপনার বাবা অপরাধবোধের ভারে জর্জরিত হয়ে একটি কথাও বলতে পারেননি, নীরবে শুধু তাকে টাকা জুগিয়ে গেছেন। ছেলেকে শোধরানোর শেষ একটা চেষ্টা তিনি করেছিলেন, এই ইম্পিরিয়াল এক্সচেঞ্জে চাকরি দিয়ে। ভেবেছিলেন, রোজগারপাতির মধ্যে থাকলে হয়তো তপনের মতি ফিরবে। আর আপনার সঙ্গে যদি তার হৃদ্যতা হয়ে যায়, তা হলেও তো তার আখেরে লাভই। কিন্তু সেই চেষ্টাও ফেল করে গেল। চুরিচামারি করে তপন চাকরিটাও খোয়াল, মাঝখান থেকে দিননাথবাবুর সঙ্গে কুরুক্ষেত্র বেধে গেল আপনার। তখন থেকেই তো দিননাথবাবুর দোকানে আসা বন্ধ হয়েছিল। নয় কি?
—হ্যাঁ মানে…বাবা…তপনের মতো স্কাউন্ড্রেলের জন্য এমন ওকালতি করছিলেন…। অর্চিষ্মান প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলে উঠল।
—না করে তাঁর যে কোনও উপায়ও ছিল না। যতই হোক, নিজেরই ছেলে যে। মিতিন মাথা দোলাল,—তখন থেকে আবার অন্য একটা বিপদ শুরু হল। টাকাপয়সার ওপর থেকে দিননাথবাবুর কন্ট্রোল চলে গেছে, তপনদের সংসারে আর ইচ্ছে মতো টাকা দিতে পারছেন না, তপনও ক্রমাগত তাঁকে চাপ দিয়ে চলেছে, তার মাও তাকে থামিয়ে রাখতে পারেন না…। ইতিমধ্যে আপনার দিদিও কিছু আন্দাজ করে থাকবেন। ভবিষ্যতে তপনকে যাতে সম্পত্তির ভাগ না দিতে হয়, সেই জন্য তিনি বাবাকে উইল করার জন্য চাপ দিতে শুরু করে দিলেন। দিননাথবাবু বরাবরই দুর্বলচিত্তের মানুষ, মেয়ের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে গত বছর পুজোর আগে উইলটা করে ফেলতে বাধ্য হন। ছেলে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, বিবেকের এই তাড়নায় কথাটা বোধহয় বলেও ফেলেছিলেন তপনের মাকে, তার পর থেকে প্রতিহিংসার নেশায় পাগল হয়ে উঠল তপন। ইন্সিডেন্টালি, অর অ্যাক্সিডেন্টালি, এর কিছুদিন আগে চিত্রভানুর সঙ্গে তপনের পরিচয় হয়। চিত্রভানু তাকে বিদিশার প্রেমের গল্প শুনিয়েছিল, এক আধ বার সে বোধহয় দেখেওছিল বিদিশাকে, ব্যস ওমনি তার মাথায় শয়তানি বুদ্ধিটা খেলে যায়। দিননাথকে সে প্রেসার করা শুরু করে, ওই বিদিশার সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে অর্চিষ্মানের, এবং তারপর বিদিশাকে ব্ল্যাকমেল করে সে নিয়মিত টাকা নিয়ে যাবে। অদৃষ্টের এমনই পরিহাস, স্নেহে অন্ধ হয়ে এমন একটা কুপ্রস্তাবে রাজিও হয়ে গেলেন দিননাথ। আসলে বোধহয় সব বাবার মধ্যেই একজন ধৃতরাষ্ট্র লুকিয়ে থাকে। আপনি তাঁকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে দিয়েছিলেন বলে তাঁর মনে বোধহয় একটা অভিমানও ছিল। আর সেটাকেই উসকে দিয়েছিল তপন।
অর্চিষ্মান বলে উঠল,—কিন্তু আমিও তো তাঁর ছেলে!
—বিদিশার মাধ্যমে টাকাই তো শুধু নিচ্ছে তপন, আপনার তো কোনও ক্ষতি করছে না! অন্তত দিননাথবাবু এরকমই ভেবেছিলেন হয়তো। পরে, বিদিশা আপনাদের বাড়ির বউ হয়ে আসার পর, গোটা পরিকল্পনাটাই ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়। আবার দুর্বল মনের শিকার হলেন আপনার বাবা। বিদিশাকে সত্যি সত্যি ভালবেসে ফেললেন। একেবারে নিজের মেয়ের মতো। কিংবা তার চেয়েও বেশি। তপন ঘন ঘন তাড়া লাগাচ্ছে। কাজ শুরু করবে বলে, কিন্তু তিনি আর কিছুতেই এগোতে রাজি হচ্ছিলেন না। তখনই তপন মাস্টার স্ট্রোকটা দিল।
—মাস্টার স্ট্রোক? পার্থ চিকেন পকোড়ার দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও থমকে গেল,—কীরকম?
—নিলামঘরের চুরি। কাজটি তপনের। ইম্পিরিয়াল এক্সচেঞ্জের কোনও দারোয়ানকে হাত করেছিল তপন। নিলামঘরে হানা দিয়ে সে একটা মোক্ষম জিনিস হাতিয়ে নিয়ে চলে যায়।
—কী জিনিস? অর্চিষ্মানের মুখ থেকে প্রশ্ন ছিটকে এল।
—একটা উইল। দিননাথবাবুর। অনেক দিন আগে করেছিলেন। উইলটিতে তপনকে আপনার সম্পত্তির অংশীদার করা হয়েছিল।
—কিন্তু সেকেন্ড উইল করার পর সে তো অটোমেটিকালি নাল অ্যান্ড ভয়েড! পার্থ চোখ পিটপিট করল,—এই উইলের আর কী মূল্য?
—আছে। তপন যে দিননাথবাবুর ছেলে, সেই প্রমাণটা তো ওই উইলের সুবাদে তপনের হাতে রয়ে গেল। অর্চিষ্মানের দিকে ফিরল মিতিন,—আপনাদের বাতিল আলমারিটা থেকে ওই উইলেরই ছেঁড়া অংশ আমি পেয়েছি। দিননাথবাবু ওটা বাড়িতে রাখার সাহস পাননি, দোকান থেকে নিয়েও যেতে পারেননি। তপন সম্ভবত তার মার কাছ থেকে জেনেছিল ওটা কোথায় আছে।
অর্চিষ্মান দু আঙুলে রগ টিপে ধরেছে,—আমি ভাবতে পারছি না, ভাবতে পারছি না…
—বাট দিস ইজ অলসো ফ্যাক্ট। এমনটাই হয়েছে। ওই উইল হাতে পেয়েই লম্ফঝম্ফ বেড়ে যায় তপনের। অগত্যা নিরুপায় হয়ে দিননাথবাবুকে সম্মতি দিতে হয়েছিল খেলাটায়। মনে রাখবেন, চুরির পরদিনই দুপুরে প্রথম ফোনটা আসে। এরপর থেকে তপনের প্রতিটি কাজে তিনি সহায়তা করেছেন। বিদিশার প্রতিটি গতিবিধির ওপর তিনি নজর রেখেছেন, টাইম টু টাইম তপনকে জানিয়েও গেছেন। রবি ছিল দিননাথবাবু লোক, সেই মেনলি বিদিশার ওপর নজরদারিটা…। বিদিশা যখন নার্ভাস হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে, তখনই তার গয়নার বাক্সটা চুরি হয়। আমি নিশ্চিত, এর পিছনে দিননাথবাবুর ইন্সস্ট্রাকশন ছিল। অবশ্য বাক্সে যে লাভলেটার আছে, এটা রবি বা দিননাথবাবুর কেউ ভাবতে পারেননি। ওটা একটা ম্যাটার অফ কোন্সিডেন্স। অবশ্য রবি বক্স খুলে চিঠির তাড়া দেখেও থাকতে পারে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, রবি এখন বহাল তবিয়তে তার দেশের বাড়িতে হাওয়া খাচ্ছে। আপনি যা জানেন না তা আপনাকে বলি, তপন যে শার্ট পরে প্রথম দিন টাকা নিতে যায়, তার একটি বোতাম অর্ক ছিঁড়ে নিয়েছিল। শার্টটা আপনার পুরনো জামাকাপড়ের ড্রয়ারে পরে পাওয়া গেছে।
—ইজ ইট? কিন্তু কী করে?
—দিননাথবাবুরই কাজ। জাস্ট টু মেক বিদিশা মোর নার্ভাস। এই কাজটাই বড় কাঁচা হয়ে গিয়েছিল। আপনি ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটি দোকান থেকে শার্ট বানান, কিন্তু ওই শার্ট অন্য টেলারের। মেটিরিয়ালও অনেক সস্তা দামের। দিননাথবাবু ব্যাপারটা খেয়ালই করেননি। অর্কর মৃত্যুর পর থেকে তিনি বেজায় নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলেন। প্রাণপণে তপনকে রুখবারও চেষ্টা করেছেন। বাট ইট ওয়াজ টু লেট। তপন আপনার বাবার সঙ্গে শেষে রফা করেছিল একটা মোটা টাকা পেলে সে আপাতত চুপ করে যাবে। তাই লাস্টে টাকার অ্যামাউন্টও বেড়ে গেল। দু লাখ থেকে পাঁচ লাখ।
অর্চিষ্মান খানিকক্ষণ চুপ। মাথা নিচু করে বসে আছে। তারপর টেরচা চোখে মিতিনের দিকে তাকাল,—আপনি যে আমার বাবার বিরুদ্ধে এতগুলো সিরিয়াস অ্যালিগেশন আনলেন, প্রমাণ আছে কিছু?
—প্রমাণ তো ওই তপনই। সে এখন ডিসি ডি ডির হেপাজতে আছে। পুলিশি জেরার সামনে সে বেশিক্ষণ মুখ বন্ধ করে থাকতে পারবে না। মিতিন বড় করে শ্বাস নিল,— শুনুন মিস্টার রুদ্র, আপনার বাবার অ্যাফেয়ারের ব্যাপারটা আপনার দিদির কাছ থেকে আমি ভেরিফাই করে এসেছি। ইচ্ছে হলে ফোন করে দেখতে পারেন। চাইলে দিননাথবাবুকেও এক্ষুনি ফোন করুন। জানিয়ে দিন, তপন অ্যারেস্ট হয়েছে। তারপর দেখুন কী রিঅ্যাকশন হয়। দিননাথবাবুর মতো দুর্বল মানুষ আর কিছুই অস্বীকার করতে পারবেন না।
অর্চিষ্মান আবার চুপ।
মিতিন নিচু গলায় বলল,—আমার কাজ কিন্তু শেষ মিস্টার রুদ্র। এবার আপনি ঠিক করুন কী করবেন।
অর্চিষ্মানের গাম্ভীর্যের আবরণ খসে গেছে। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,—কী করি বলুন তো?