২.১০
আগ্রা দুর্গের ছাদে একাকী বেলেপাথরের তৈরি গুলি চালাবার জন্য ফোকর বিশিষ্ট প্রাচীরের কাছে দাঁড়িয়ে সূর্য তাপের মাঝে পুড়তে থাকা দিগন্তের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে রইলেন শাহজাহান। গত কয়েক ঘণ্টা ধরে ঝুলে থাকা ধুলার মেঘ দেখে এটা নিশ্চিত হওয়া গেল যে বার্তাবাহকদের বয়ে আনা দুই সেনাবাহিনীর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার খবর সত্য। যদি তিনি নিজেও থাকতে পারতেন সেখানটায় নাকের নিচে কামানের ধোঁয়ার গন্ধ আর শিরায় বয়ে চলা যুদ্ধের উদ্দামতা নিয়ে। এর পরিবর্তে বয়স আর স্বাস্থ্যের কাছে ন্যূজ হয়ে অথর্বের মত অপেক্ষা করছেন শুভ কিছু ঘটার আশায়। মনে হল তার মনের কথাই সত্যি প্রমাণিত হল, দেখতে পেলেন যমুনার শেষ তীর ধরে এগিয়ে আসছে কয়েকজন অশ্বারোহী। কাছাকাছি হতেই দেখা গেল কয়েকজনের সাথে পিছনে ঘোড়ার পিঠে বসে আছে দ্বিতীয় আরোহী অথবা দেখে মনে হল অত্যন্ত অসুস্থ কাউকে বহন করে আনা হচ্ছে। নদী পার হয়ে দুর্গের কাছে এগিয়ে আসতেই পোশাক দেখে বুঝতে পারলেন এরা দারার সৈন্য। অশ্বারোহীদের ছোট্ট বিন্দু দ্রুত পরিণত হল একটা প্রবাহে। এর অর্থ কী? চিকিৎসকের প্রয়োজনে যুদ্ধ ছেড়ে আসতে হয়েছে, নাকি দারার সৈন্যরা ময়দান ছেড়ে পালিয়ে আসছে?
পাকস্থলীতে মোচড় দিয়ে উঠল শীতল কিছু একটা, উজ্জ্বল দেহবর্ম দেখে বুঝতে পারলেন এ সৈন্যরা রাজকীয় দেহরক্ষীর দল। একে অন্যের কাছাকাছি থেকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে প্রায় দুডজন সৈন্যর একটা দল। এদের মাঝে নিকোলাস ব্যালান্টাইনকেও দেখতে পেলেন, কিন্তু মাঝখানে দারাকে দেখে ভুলে গেলেন বাকি সবকিছু। জিনের সামনের অংশে উপুড় হয়ে পড়ে আছে দারা, লাগাম ধরে আছে পেছনেই থাকা কর্চি। আর অপেক্ষা করতে পারলেন না শাহজাহান। ঘুরে দাঁড়িয়েই ধুলি মাখা অট্টালিকার প্রাচীর ছেড়ে দ্রুত নেমে যেতে লাগলেন তেমন একটা ব্যবহৃত না হওয়া এমন এক পৌচানো সিঁড়ি বেয়ে সোজা প্রধান আঙিনাতে। সংকীর্ণ, তীক্ষ্ণ সিঁড়ির ধাপগুলো বেয়ে নামার সময় একটু পরপর মুখের সামনে থেকে সরিয়ে দিতে হল মাকড়সার জাল। তিনিও আঙিনাতে পৌঁছে গেছেন আর একই সাথে লম্বা, কারুকাজ করা ফটকদ্বার দিয়ে প্রবেশ করল দারা আর তার রক্ষীবাহিনী। পিতাকে দেখে সোজা হয়ে বসে কথা বলার চেষ্টা করে উঠল দারা। কিন্তু এমনভাবে মাথা নেড়ে উঠল যেন কথা বলাটাও ভারী হয়ে যাবে। ক্ষত-বিক্ষত মুখ দেখে মনে হল মাথা ঘুরছে আর ডান কপালের উপর জমাট বেঁধে আছে। রক্ত। ব্ৰস্ত পায়ে সামনে এগিয়ে হাত বাড়িয়ে পুত্রকে ধরলেন শাহজাহান। পরিচারকেরাও এগিয়ে এলো; কিন্তু হাতের ইশারায় সবাইকে তাড়িয়ে দিলেন তিনি। নিজের পুত্রকে তিনিই সাহায্য করবেন। আঙিনাতে হাজারো চোখ চেয়ে আছে তাদের দিকে আর যুদ্ধের ফলাফল আর পুত্রকে নিয়ে উদ্বিগ্নতা যাতে প্রকাশ না হয়ে পড়ে, তাই একজন কর্চিকে আদেশ দিলেন হাকিমকে ডেকে আনতে। এরপর দারার কাঁধে হাত জড়িয়ে ধীরে ধীরে আঙিনা বেয়ে উঠে গেলেন চওড়া, প্রধান সিঁড়ি দিয়ে রাজগৃহের দিকে।
পিতা-পুত্রের প্রবেশ করতেই সংবাদের জন্য অপেক্ষারত জাহানারা দৌড়ে এগিয়ে এলো সামনে। পিতার সাথে মিলে সেও আস্তে আস্তে দারাকে নামিয়ে রাখল তেপায়ার উপর। মুহূর্তখানেকের মাঝেই এসে পড়ল হাকিম। দারার উপর ঝুঁকে পড়ে চোখের দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল শাহজাদার চোখ জোড়া। এরপর গরম পানির পাত্রে কাপড় ভিজিয়ে মুছে দিল জমাট বাধা রক্ত, যেন পরীক্ষা করে দেখতে পারে কপাল। অবশেষে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ক্ষতটা তেমন মারাত্মক নয়, জাহাপনা। শাহজাদার স্থায়ী কোন আঘাত লাগেনি। যদিও মনে হচ্ছে বিপর্যস্ত তিনি। কি হয়েছিল?
সবার সাথে কক্ষে প্রবেশ করা নিকোলাস উত্তর দিল, ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে গেছেন ভীষণভাবে। দারা নিজেও মাথা নেড়ে চাইল উঠে দাঁড়াতে, কিন্তু কাঁধে হাত রেখে নিবৃত্ত করলেন শাহজাহান।
আব্বাজান…আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে… যুদ্ধের মাঝখানে আমাদেরকে ছেড়ে গেছে খলিল উল্লাহ খান। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সৈন্যরা। আমি আমার যুদ্ধহাতি থেকে নেমে এসেছিলাম। কেননা তাদের সাথেই ঘোড়া ছুটিয়ে উৎসাহ দিতে চেয়েছিলাম যেন যুদ্ধে এগিয়ে যায়, কিন্তু ভুল হয়ে গেছে… আমার সৈন্যরা বুঝতেই পারেনি যে আমি কী করছি। যখন তারা দেখতে পেল যে আমি হাওদাতে নেই, ভাবল নিশ্চয় আমি আহত হয়েছি বা মারা গেছি… এমনকি এটাও ভাবল যে হয়ত আমি পালিয়ে গেছি। চারপাশে আতঙ্কিত চিৎকার চেঁচামেচি শুনেছি আমি। চেয়েছি দেখাতে যে আমি তখনো তাদের সাথেই আছি, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল… সবাই ইতিমধ্যে পিছু হটতে শুরু করে দিয়েছে… আর তারপর ঘোড়া থেকে পড়ে গেছি। আব্বাজান, আমি আপনাকে দেয়া কথা রাখতে পারি নি… আওরঙ্গজেব আর মুরাদ আর খুব বেশি দূরে নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। দুহাতে মুখ ঢেকে মনে হল কেঁদে উঠতে চাইছে দারা।
আমাদেরকে একা থাকতে দাও। হাকিমকে আদেশ করলেন শাহজাহান। তোমরাও যাও। পরিচারকদের একই কথা জানালেন। দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই, পুত্রের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে কাঁধে আস্তে আস্তে চাপড় দিলেন। তুমি আমাকে নিরাশ করোনি… কখনোই না। এক মুহূর্ত দারাকে জড়িয়ে ধরে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে নিকোলাসের দিকে তাকালেন। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে যাবে না থাকবে বুঝতে না পেরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে নিকোলাস।
সত্যিকারের কী অবস্থা? যেমনটা আমার পুত্র বিশ্বাস করে, যুদ্ধে কি সত্যিই পরাজিত আমরা?
হা জাহাপনা। সে ভয়ই পাচ্ছি আমি। শাহজাদা যেমনটা বলেছেন সেভাবেই সব ঘটেছে। যখন তাঁকে ময়দান থেকে উঠিয়ে নিচ্ছিলাম আমাদের সৈন্যদের দল যুদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে শত্রুদের হাতে ঘিরে পড়ে মৃত্যুবরণ করতে থাকে। বাকিদের মাঝে বেশিরভাগই মৃত অথবা বলতে কষ্ট হচ্ছে অস্ত্র ফেলে দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পিছিয়ে গেছে। পুরো দল ধরে পিছু হটা আর কিছু না… আমার ইচ্ছে ছিল আপনাকে ভালো কোন সংবাদ মোনানো কিন্তু সত্যিটা আপনার জানা প্রয়োজন। মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল নিকোলাস।
চুপ করে রইলেন শাহজাহান। সাম্রাজ্যের এবং নিজেদের সকলের জন্য অনুভব করলেন তাঁকে শান্ত মাথায় ভেবে দেখতে হবে সবকিছু, তারচেয়েও বড় কথা সকলের সামনে নিজেকে স্থির রাখতে হবে। পরিষ্কার যে আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। কয়েক মুহূর্ত পরে কথা বলে উঠলেন সম্রাট। আওরঙ্গজেব আর মুরাদ আগ্রার দিকে এগিয়ে আসার জন্য আর বেশি দেরি করবে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, দারা তুমি আর তোমার পরিবার এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাও… কোনমতেই তোমাকে বন্দি হতে দেয়া যাবে না।
না! বলে উঠল দারা। আমাদের সৈন্যরা নিশ্চয়ই আগ্রা ফিরে এসে ভাইদের বিরুদ্ধে দুর্গ রক্ষা করতে পারবে। পূর্ব দিক থেকে সুলাইমান আর তার বাহিনী ফিরে না আসা পর্যন্ত নিশ্চয় রুখতে পারব আমরা…
সুলাইমান কোথায় আছে এ ব্যাপারে এখনো কোন সংবাদ পাইনি আমরা আর ঝুঁকিও নিতে চাইনা। যদি তোমার ভাইয়েরা তোমাকে বন্দি করে ফেলে তাদের অবস্থানের নিষ্ঠুরতা নিয়ে আর কোন সন্দেহ রইবে না। তোমার জীবনে দ্বিতীয়বারের মত তোমাকে বন্দি হতে দিতে চাই না আমি…
কিন্তু তোমাকে ছেড়ে আমি যাবো না…
আমি আওরঙ্গজেব আর মুরাদকে ভয় পাই না আমার পুত্র তারা। যাই হোক, তোমাকে বেছে নেয়ার কোন সুযোগ দিচ্ছি না আমি। তোমার সম্রাট আর পিতা হিসেবে যাবার আদেশ করছি। জাহানারার দিকে ফিরলেন শাহজাহান, ভাইয়ের পাশে একেবারে চুপচাপ, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নাদিরা বেগমের কাছে যাও। রোশনারা আর গওহর আরার সাথে আছে। কী হয়েছে জানিয়ে এখনি আগ্রা ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে বলল। সিপিরকে জানাও প্রস্তুত হতে। তাড়াহুড়ো করে কক্ষ ছেড়ে বের হয়ে গেল জাহানারা। পুত্রের দিকে তাকালেন শাহজাহান। আমার নির্দেশ শোন। নিজের যতজন সম্ভব সৈন্য যোগাড় করে দিল্লি চলে যাও। সুলাইমান এখনো অনুপস্থিত, যশয়ন্ত সিংয়ের বাহিনী ছড়িয়ে আছে। উজ্জয়নীতে আর এইমাত্র যে পরাজয় বরণ করলে তুমি আগ্রা অঞ্চল বাঁচাবার মত যথেষ্ঠ সৈন্য নেই আমাদের হাতে। অবশিষ্ট শক্তিটুকু–আর এটাই সংগতিপূর্ণ হবে–পড়ে আছে উত্তর আর উত্তর-পশ্চিমে। তাদেরকে দক্ষতার সাথে একত্রিত করো, জয় আমাদেরই হবে। দিল্লির শাসনকর্তাকে দেয়ার জন্য তোমাকে একটা পত্র দেব আমি, তাতে তাকে এই আদেশ করব যেন তার অধীনে থাকা রাজসৈন্যদেরকে তোমার কাছে হস্তাপণ করে। তাহলে ভাইদের বিরুদ্ধে শহরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে তুমি। আমার মনে হয় না তারা দুজন তোমাকে অনুসরণ করতে খুব বেশি দেরি করবে। এছাড়া রাজকোষ তোমার কাছে খুলে দেবার নির্দেশও দিয়ে দেব, যেন সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় সৈন্য নিয়োগ করতে পারো।
পুত্রের চোখে এখনো সন্দেহের চিহ্ন দেখে দারার মাথা নিজের দুহাতে ধরে তার চোখের দিকে তাকালেন শাহজাহান। আমার কথা শোন, দারা। এখনি তোমাকে আগা ছাড়তে হবে শুধু আমার আদেশ পালন করার জন্যই নয়, বরঞ্চ এটা নিজের আর পরিবারের প্রতি তোমার দায়িত্বও বটে। তুমি সামুগড়ে পরাজিত হয়েছ; কিন্তু এটা শুধুমাত্র এই যুদ্ধের একটি সংঘর্ষ। মনোবল হারাবে না। যুদ্ধের ময়দানে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছি আমি, কিন্তু কখনো এতে নিজেকে ভেঙে পড়তে দিইনি। বস্তুত এতে করে আমার প্রতিজ্ঞা আরো দৃঢ় হয়েছে যে পরের বার বিজয়ী আমি হব-ই। মনে রাখবে, ভাইদের চেয়ে এখনো তুমি এগিয়ে আছ। তোমাকে মোগল সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছি আমি। এর ফলে তুমি এমন এক ক্ষমতা আর আধিপত্য পাচেছা যেটা তাদের নেই। এ ক্ষমতা কাজে লাগাও, এখনো ঘুরে দাঁড়াবার সময় আছে। পুত্রের উপর নেতৃত্বের ভারী একটি বোঝা চাপিয়ে দিলেন তিনি; মনে মনে ভাবলেন শাহজাহান। এতদিন পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে আড়াল দিয়েছিলেন পুত্রকে, কিন্তু এখন আর কোন উপায় রইল না।
জাহাপনা, শাহজাদা অনুমতি দিলে আমি দিল্লি পর্যন্ত তাঁর সাথে যেতে পারি। বলে উঠল নিকোলাস।
বিবর্ণ মুখে হাসল দারা। আমি অসম্ভব খুশি হব তাহলে। আজ এমনিতেই আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। হতে পারে সময় হয়ত আসবে যখন আমি এ পাওনা পরিশোধ করতে পারব… এখন নাদিরার সাথে গিয়ে প্রস্তুত হতে সাহায্য করতে হবে… নিশ্চয়ই বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে আছে।
তোমার সাথে আমিও যাব হারেমে। আবারো দারাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল শাহজাহান, তারপর নিয়ে গেল কক্ষের বাইরে। জাহাপনা আগমন করছেন বলে প্রথাগত নির্দেশ শুনতে পেল নিকোলাস সামনে থেকে। আস্তে আস্তে দূরে সরে গেল আওয়াজ, একের পর এক দরজা পেরিয়ে হারেমের দিকে এগিয়ে চললেন পিতা-পুত্র। কিন্তু শাহজাহান আর কতক্ষণ ম্রাট হিসেবে থাকতে পারবেন, প্রু মুছে ভাবতে লাগল নিকোলাস। এটি অচিন্ত্যনীয় একটি ব্যাপার যে মাত্র একটি যুদ্ধ এসে এরকম শক্তিশালী এক শাসককে সিংহাসনচ্যুত করে দেবে আর কেই বা ভাবতে পেরেছিল যে আওরঙ্গজেব আর মুরাদের বিদ্রোহ এতদূর গড়াবে?
নিকোলাস নিজেও কক্ষ ছেড়ে বের হতে যাবে, নিজের যা কিছু সম্বল জড়ো করে দিল্লি রওনা হবে, এমন সময় তাকে অবাক করে দিয়ে ফিরে এলো জাহানারা। কয়েক মুহূর্ত একে অন্যের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইল দুজনেই। এরপরই চিৎকার করে উঠল জাহানারা, দারা আমাকে জানিয়েছে যে আপনি তার সাথে যাবার প্রস্তাব করেছেন… এত কিছু হয়ে যাবার পরেও কেন এত দয়াশীল হচ্ছেন আমাদের প্রতি?
এটা দয়া নয়। হিন্দুস্তান আমার ভূমি। চলে যেতে মনস্থির করার আগপর্যন্ত তা উপলব্ধি করিনি আমি। আপনি যেটার উল্লেখ করেছেন সেটা ছাড়াও অনেক দয়া দেখিয়েছে আপনার পরিবার আমার প্রতি… মুহূর্তখানেকের জন্য ধরে গেল নিকোলাসের গলা, এরপর আবারো বলে উঠল, দারার জন্য সংগ্রাম করতে পেরে আমি সম্মানীত হব যেমনটা একদা করেছিলাম আপনার পিতার জন্য।
তাহলে পিতা আর দারার হয়ে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু একই সাথে ক্ষমা প্রার্থনাও করছি। কোন রকম ভাবনা-চিন্তা না করেই আমি আপনাকে অনেক বড় বিপদের মাঝে ফেলে দিয়েছিলাম… আমি দুঃখিত … আমি শুধুমাত্র নিজের বিষয়েই চিন্তিত ছিলাম, কখনো ভাবিনি…
দুঃখিত হবার মত কোন কারণ ঘটেনি আপনার, নম্রভাবে জাহানারাকে থামিয়ে দিল নিকোলাস। আপনি সৎ উদ্দেশ্যেই এসব করেছেন।
পাতলা বেগুনি ওড়নার উপর দিয়েই দেখা গেল জাহানারার চোখ ভর্তি জল। আপনি ছাড়া সত্যিকারের আর কোন বন্ধু নেই আমার আর আমি জানি যেভাবে সম্ভব দারাকে সাহায্য করবেন আপনি। আমাদের মহান প্রপিতামহ আকবরের যোগ্য উত্তসূরী সে ধর্মবিশ্বাস যাই হোক না কেন, সবার প্রতি ন্যায়বিচারক। আওরঙ্গজেব শুধু আমাদের জনগণের মাঝে বিভেদই সৃষ্টি করবে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদেরকে দাঁড় করিয়ে দেবে। যদি সে কখনো সম্রাট হয়ে যায় অসহিষ্ণুতা এ ভূমিকে ঠিক সেভাবেই ক্ষত-বিক্ষত করে তুলবে, একদা যেভাবে আগুন করেছিল আমার সাথে। ডান হাত দিয়ে আস্তে করে নিজের ওড়না সরিয়ে গালের উপরে পোড়া চিহ্ন দেখাল জাহানারা। এক মুহূর্তের জন্য দাগটার দিকে তাকিয়ে রইল নিকোলাস, আলতো করে হাত এগিয়ে দিল ছুঁয়ে দেখার জন্য, নীল চোখ মেলে তাকিয়ে রইল জাহানারার অন্তরের গভীরে। কিন্তু ঠিক তখনই দূর থেকে ভেসে এলো বাদ্যের ধ্বনি, নির্ঘাৎ দারার সৈন্যরা প্রস্থানের জন্য জড়ো হয়েছে।
হাত সরিয়ে নিল নিকোলাস। আমাকে যেতে হবে… কিন্তু আমি যা পারি করব, প্রতিজ্ঞা করছি আপনার কাছে। একবারও পিছনে না তাকিয়ে চলে গেল নিকোলাস।
আধা ঘণ্টা পরে, জালি পর্দার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দুর্গ থেকে ছোট্ট একটা দলকে বের হয়ে যেতে দেখল জাহানারা। অশ্বারোহীদের মাঝেই কোথাও আছে তার ভাই আর নিকোলাস। গোধূলী আলোয় সৈন্য সারি অদৃশ্য হয়ে যেতেই মনে হল দারাকে বিদায় জানানো হল না।
*
তিন দিন পরে, নিকোলাসকে পাশে নিয়ে নিজের ঘর্মাক্ত কালো ঘোড়া ছুটিয়ে নিচু একটা পর্বতের কাছে পৌঁছালো দারা। চূড়ায় পৌঁছতেই দেখতে পেল সামনে ছড়িয়ে আছে দিল্লি শহর। মসজিদের দেয়ালের উপর সাদা মার্বেলের গম্বুজ চমকাচ্ছে সূর্যের আলো পড়ে, বেশিরভাগেরই আবৃত হয়ে আছে বেগুনি ছাড়া দিয়ে।
অবশেষে দিল্লি। বলে উঠল দারা। পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে থাকা কোন বিদ্রোহী দলকেও দেখা যাচ্ছে না।
ভাগ্য আবারও আমাদের সহায় হল মাননীয় শাহজাদা, যেমনটা হয়েছিল মথুরাতে।
এছাড়া যত মানুষ আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে, খোলা ময়দানে আমাদের বিরুদ্ধে লাগার জন্য বেশ শক্তিশালী বাহিনী প্রয়োজন হবে এখন।
মাথা নাড়ল নিকোলাস। তাদের পিছনে বিস্তীর্ণ হয়ে আছে প্রায় দশ হাজারের কাছাকাছি এক বহর, গত বাহাত্তর ঘণ্টা ধরে যারা দারার পতাকাতলে যাত্রা করেছে। এদের মাঝে কেউ আছে সামুগড়ে পরাজিত হওয়া রাজসৈন্য, অন্যরা পথিমধ্যে থাকা ছোট ছোট দুর্গের সৈন্যরা আর বাকিরা শাহজাহানের জরুরি আদেশ পেয়ে ছুটে আসা স্থানীয় শাসকদের নিয়োগকৃত সৈন্য।
শহরে প্রবেশ করার জন্য অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত কি আমরা অপেক্ষা করব?
প্রতিপক্ষের কোন দেখা যেহেতু নেই, তাই এরও প্রয়োজন নেই। তাড়াতাড়ি করা যাক, চলুন। শীঘিই হয়ত শাসনকর্তার প্রাসাদে আরাম করার পাশাপাশি ভাইদেরকে পরাজিত করার জন্য যৌথ বাহিনীর পরিকল্পনা করতে পারব। জানিয়ে দিল দারা। হাতের ইশারায় দেহরক্ষীদেরকে অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়ে কালো ঘোড়া ছুটিয়ে দিল পাঁচ মাইল দূরে শহরের উদ্দেশে।
দারার অভিব্যক্তিতে কতটা পরিবর্তন এসেছে, ভাবল নিকোলাস, দারার পিছনে যেতে যেতে। বিপর্যস্ত, মনোবলহীন শাহজাদা, পিছনে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেতেই প্রাণশক্তিতে ভরপর হয়ে উঠেছে। নিজের ঘোড়ার পিঠে বসে শারীরিক আর মানসিকভাবেও হয়ে উঠেছে শক্তিশালী।
পনের মিনিট পরে, সূর্য তাপের বিরুদ্ধে চোখের উপর ছায়া দিয়ে এক মাইল দূরে দিল্লির বিশাল দক্ষিণ ফটকদ্বারের দিকে তাকাল নিকোলাস। ফটকগুলো তো মনে হচ্ছে বন্ধ, তাই না…?
মাননীয় শাহজাদা, ফটকদ্বার বন্ধ।
এরকম সমস্যার সময়ে এক বিজ্ঞ সতর্কতা। উত্তরে জানালো দারা। প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে আমাদের আগমন সংবাদ জানানোর জন্য পাঠানো গুপ্তচর একটু পরেই ফিরে আসবে। আমার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি দূর এগিয়ে গেছে তারা।
ঠিক বলেছে দারা। প্রায় সাথে সাথেই ফটকের পাল্লা দুটো ঠিক ততটাই খুলে গেল যতটা হলে ছোট্ট একটা সৈন্যদল এগিয়ে আসতে পারে। কয়েক মিনিট পরে অশ্বারোহী সৈন্যরা–যেমনটা প্রত্যাশিত ছিল, দারার গুপ্তচরেরা– পিছনে সান্ধ্য বাতাসে সোনালি ধুলার মেঘ ছড়িয়ে এগিয়ে এলো সামনে।
শাসনকর্তা আমার জন্য গৃহ প্রস্তুত করে রেখেছেন? চেহারার চওড়া হাসি ছড়িয়ে জানতে চাইল দারা।
গুপ্তচরদের প্রধান লম্বা দাঁড়িঅলা পাঞ্জাবি সৈন্যের চেহারাতে কিন্তু পাল্টা হাসির প্রত্যুত্তর দেখা গেল না। তারা আপনাকে অনুমতি দিবে না, মাননীয় শাহজাদা। সহজ সুরে জানালো লোকটা।
কী বলতে চাও? পিতার চিঠি দেখাওনি শাসনকর্তাকে…।
দেখিয়েছি, মাননীয় শাহজাদা। প্রহরীদলের নেতা শাসনকর্তার কাছে নিয়ে গেছে পত্রখানা। আধা ঘণ্টা ধরেও সে ফিরে না এলে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। যখন আসল, তখন সাথে শাসনকর্তাও ছিলেন। তিনি আমাদেরকে জানিয়েছে যে, পত্রখানা একটা চক্রান্ত আর আমরা স্বধর্মত্যাগী। এছাড়াও আমরা নাকি ভাগ্যবান যে তিনি আমাদেরকে হত্যার আদেশ দেননি। তারপর আমাদের হাতে এ চিঠি তুলে দেয়া হয়েছে। সবুজ টিউনিকের ভেতর থেকে ভাঁজ করা খাম বের করে দিল পাঞ্জাবী সৈন্যটা।
দারা, চোখে-মুখে অবিশ্বাস নিয়ে ছো মেরে তুলে নিল চিঠিটা। সীলমোহর ভেঙে পড়া শুরু করতেই ক্রোধ ফুটে উঠল চেহারাতে। কতটা নিচে নামতে পারে আমার ভাইয়েরা? সত্য অথবা আমার পিতার প্রতি কি কোন শ্রদ্ধা নেই তাদের? পড়ে দেখুন, নিকোলাস।
‘শাহজাদা দারা, আমাকে পাঠানো আপনার পত্র একটা চক্রান্ত। আপনার ভাইয়েরা আমাকে আগেই সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে যে পিতার সিংহাসন হস্তগত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন যিনি কিনা মানসিকভাবে এতটা অসুস্থ যে শাসন করার অথবা আপনার বিশ্বাসঘাতকতা বুঝতে পারার মত অবস্থায় নেই। আমাকে তারা এও জানিয়েছে যে, বিশ্বস্ত পুত্র হিসেবে যেটি আপনি নন–পিতাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে তারা আর ইতিমধ্যে যুদ্ধে আপনাকে একবার পরাজিত করেছে। আমাকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, অসাধু উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আমার রক্ষীবাহিনী নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সর্পতুল্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠতে পারেন আপনি। আমি তাদেরকে জানিয়েছি যে, একজন বিশ্বস্ত প্রজা হিসেবে আদেশ মান্য করব আমি। তাই চলে যান। শহরের আরেকটু কাছে এগিয়ে আসার চেষ্টা করলে নিঃসন্দেহ থাকতে পারেন যে আমার সৈন্যরা গুলি ছুড়বে আপনার উপর।‘
কতটা সাহস হলে এমন মিথ্যে রটনা ছড়ানো যায় সত্যের ঠিক পুরোপুরি বিপরীত–আর এই শাসনকর্তাই বা কেমন বোকা যে তাদের কথা বিশ্বাস করল?
অথবা ভণিতা করছে। বলে উঠল নিকোলাস। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে সামুগড়ে আপনার পরাজিত হবার সংবাদ জানে সে। আওরঙ্গজেব আর মুরাদের বার্তাবাহকেরা নিশ্চয়ই জানিয়েছে যে আপনি আসতে পারেন আর আমার সন্দেহ নিশ্চয়ই শাসনকর্তাকে মোটা মানের পুরস্কারের লোভ দেখানো হয়েছে যদি তাদের কথা মেনে নিয়ে আপনাকে রুখে দেয় ভাগ্য পরিবর্তনের পথে।
আমি পথে বসব না। তারই দখলকৃত দুর্গের আঙিনাতে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে এ অভদ্রতার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে শাসনকর্তাকে। আক্রমণের পরিকল্পনা করতে এখনি একটি যুদ্ধসভার আহবান করব আমি। তীব্রস্বরে বলে উঠল দারা, জিনের উপর বসে এতজোরে কাঁপতে লাগল ক্রোধে যে পা হড়কে গেল কালো ঘোড়ার।
সম্মানীয় শাহজাদা যুদ্ধসভা ডাকার আগে ভেবে দেখুন সম্ভাবনা আর। বাস্তবতার ব্যাপারগুলো। সেনাপতিদের সামনে সফল হবার বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা তুলে ধরতে হবে আপনাদেরকে, নয়ত ইতিমধ্যে যারা আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে অতি দ্রুত আমাদেরকে ছেড়ে চলেও যাবে। আর যদি আমি খোলামেলাভাবে বলার সুযোগ পাই–পুরোপুরি সম্মুখ আক্রমণ তো দূরের কথা, দিল্লি অবরোধের পদক্ষেপও আমাদের জন্য যৌক্তিক হবে না এখন। আমাদের সৈন্যসংখ্যা পর্যাপ্ত নয় আর দ্রুত ছুটে আসার কারণে কামান নেই। এছাড়া ভালোভাবেই জানি যে আওরঙ্গজেব আর মুরাদের সৈন্যরা হয়ত আর বেশি দূরে নেই। তাদের চেয়ে যে এতটা পথ এগিয়ে আসতে পেরেছি সেটাই আমাদের ভাগ্য। শহরের উপর আমরা যখন আঘাত হানব তখন অনায়াসে পিছন দিকে আক্রমণ করে বসবে তারা। দেয়ালের বাইরে ছিন্নভিন্ন করে দিবে আমাদেরকে।
আশার আলো নিভে যেতে লাগল দারার চোখে, যেমন করে দিনের আলো বিদায় নিচ্ছে এই দিল্লি শহর ছেড়ে। কথা বলার আগে খানিকটা সময় নিল শাহজাদা। হয়ত আপনিই ঠিক বলছেন নিকোলাস… হয়ত নিজের ভাগ্য প্রবাহের গতিপথ পাল্টানোর জন্য আমি আর একটা মাত্রই সুযোগ পাব। তাই তাড়াহুড়া করে কিছু করাটা ঠিক হবে না, বিশেষ করে যখন নাদিরা আর সিপির আছে আমার সাথে। সম্ভবত উত্তর-পশ্চিমে সরে গেলেই ভালো হবে এখন যেখানে আপনার আর অন্যান্য সেনাপতিদের সাথে বসে নিরাপদে পরবর্তী পদক্ষেপের কথা চিন্তা করা যাবে।
*
ঘন আম গাছের নিচে পাতার ছায়ায় ঘোড়া থামিয়ে জটার ঘর্মাক্ত গলায় হাত বুলালো নিকোলাস। পাশেই ছুটে এসেছে দারা। দুজনেই নেমে পড়ল ঘোড়া থেকে। শাখা-প্রশাখার মাঝে দিয়ে চুঁইয়ে আসা আলোতে বিমর্ষ দেখালো শাহজাদার মুখমণ্ডল। দিল্লি থেকে আসার পথে রাস্তায় প্রায় তেমন কোন কথাই বলেনি দারা। নিকোলাস যেমন সন্দেহ করেছিল যুদ্ধ সভা উত্ত-পশ্চিমে লাহারে চলে যেতে যেন কোন সাহায্যের সংস্থান করা যায়। যাই হোক, আর বলার কিই বা আছে? কেই বা ভাবতে পেরেছিল যে দিল্লির শাসনকর্তা শাহজাহানের পত্র থাকা সত্ত্বেও রুদ্ধ করে দিবে শহরের প্রবেশদ্বার? সামুগড়ে দারার পরাজয়ের ফলে ভারসাম্য কতটা দ্রুত পাল্টে গেছে, এটা তারই ইশারা করেছে।
এখন না জানে কী অপেক্ষা করে আছে দারার ভাগ্যে? দিল্লির বিশাল লাল দুর্গের নিরাপত্তার মাঝে দারা হয়ত শক্তিশালী অবস্থানে চলে যেতে পারত। রাজকোষের সম্পদ ব্যবহার করে আরো সৈন্য আর সহায়তা ক্রয় করতে পারত। এর পরিবর্তে এখন কী হল পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া? আরো বেশ কয়েকবারের মত আবারো মনে পড়ে গেল সেসব দিনের কথা মমতাজ আর তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে শাহজাহানের সাথে পালিয়েছেন নিকোলাস। কিন্তু দারার পারিপার্শ্বিক আরো বেশি ভয়ংকর। শাহজাহানের অন্তত কিছু মিত্র ছিল। কিন্তু মনে হচ্ছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দিল্লি ছাড়ার ফলে দারার পক্ষে তেমন কেউ রইল না। যদিও কয়েকজন বার্তাবাহক পাঠানো হয়েছে যাদের বিশ্বস্ততার উপর ভেবেছিল নির্ভর করা যাবে এমন কয়েকজন অভিজাত ব্যক্তির কাছে, কিন্তু একটি কোন আশ্বাসবাণী পায়নি শাহজাদা–শুধুমাত্র বাকসর্বস্ব অজুহাত আর কয়েক ক্ষেত্রে তো সেটাও নয়। অদ্ভুত আর ভাসা ভাসা সব কারণ দেখিয়ে দিনের পর দিন কমে যেতে লাগল দারার সৈন্যসংখ্যা। কয়েকজন নিশ্চয়ই গিয়ে জুটে যাবে তার ভাইদের দলে, অন্যরা ফিরে যাবে নিজেদের গ্রামে অথবা জায়গীর অপেক্ষা করবে হিন্দুস্তানের উপর ভেঙে পড়ার জন্য এগিয়ে আসা নিশ্চিত ঝড়ের জন্য।
আমার স্ত্রীর শরীর এখনো খারাপ। পালকি থেকে নিশ্চয় তার কাশির শব্দ পেয়েছেন আপনি। ছায়ার মাঝে তার জন্য একটি তাঁবু তৈরির নির্দেশ দিয়েছি আমি। তাকে সুস্থ হতে সাহায্য করার জন্য গরম না কমা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করব আমরা সম্ভবত কাল আসা পর্যন্ত তাঁবু নির্মাণ হয়ে যাবে। এই ঘন ঝাড় আর গাছের ভিড়ে যথেষ্ট নিরাপদ আমরা। পানির বোতল খুলে লম্বা চুমুক দিল দারা। আওরঙ্গজেব আর মুরাদ নিশ্চয় জানে যে আমরা দিল্লি থেকে উত্তর-পশ্চিমে গেছি। তাহলে ছড়িয়ে থাকা আমার গুপ্তচররা পিছু ধাওয়াকারীদের হদিস পায়নি কেন? ভাইদের কি ধারণা যে আমার মত অপ্রয়োজনীকে নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই?
হতে পারে তারা প্রথমে দিল্লি আর আগ্রাতে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে চেয়েছে প্রথমে… যুক্তি নিশ্চয়ই আছে।
আমিও সেরকমই আশা করছি। আমার আরো সময় প্রয়োজন। গত রাতে আমার পাশে শুয়ে কাশির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছিল নাদিরা, জেগে থেকে আমি ভাবছিলাম সুলাইমান আর তার সেনাবাহিনীর কথা– সে কি ফিরে আসার জন্য পিতার আদেশ পায়নি নাকি এখনো শাহ সুজার পিছু ধাওয়া করে চলেছে? রাজকীয় বাহিনীর শ্রেষ্ঠ সৈন্যরা গেছে তার সঙ্গে আর তারা থাকলে একটা সুযোগ নিতে পারতাম আমি…আরো চিন্তা হচ্ছে না জানি কি ঘটছে আগ্রাতে আব্বাজান আর বোনের সাথে।
এত সহজে ধরা দেবার পাত্র নন ম্রাট। আমি নিশ্চিত যতক্ষণ সম্ভব দুর্গ আঁকড়ে ধরে রাখবেন তিনি।
মাটির উপর উবু হয়ে বসে একটা কাঠি খুঁজে নিয়ে আঁকিবুকি কাটতে লাগল দারা লাল ভূমির উপর। যদি তাঁর সাথে যোগাযোগ করার কোন পথ খুঁজে পেতাম–জানতে পারতাম এখন আমাকে কী করতে বলতেন তিনি এরকম উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরতে হত না।
মাননীয় শাহজাদা, আমার দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে: যদি ইচ্ছেগুলো ঘোড়া হত, ভিক্ষুকেরাও ছুটে বেড়াত। আমরা সবাই চাই যে ঘটনাগুলো ভিন্নভাবে ঘটতো যদি; কিন্তু সত্যটাকেই মেনে নিতে হবে। ভুলে যাবেন না বাবরের বিরুদ্ধে তাঁর পরিবারও ফারগানার গুহায় থেকে জীবন ধারণ করেছে, তাদের সৈন্যসংখ্যা আপনার চেয়ে কম ছিল। নিজের উপর বিশ্বাস ধরে রাখতে হবে আপনাকে।
আমার দুর্বলতার জন্য ক্ষমা করুন। হঠাৎ করে আমার ভাগ্য পরিবর্তিত হয়ে গেছে। পুনরায় উদ্দীপিত হয়ে ওঠার পরিকল্পনাকে প্রথম ধাপ হিসেবে শেষ বার গণনার সময় কত জন সৈন্য ছিল আমাদের হাতে?
পনেরশ বা এর কাছাকাছি।
এটা কোন সেনাবাহিনীই নয়…আমাকে কেন এত কম সংখ্যক সৈন্য অনুসরণ করেছে? আমি তো পিতার পছন্দের নির্বাচিত উত্তরাধিকারী।
এখনকার মত অনিশ্চিত সময়ে বেশিরভাগই চিন্তা করেছে এড়িয়ে যেতে পারলে আপনার পক্ষ না-ই নিতে। ফলাফল নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত মিত্ৰতা করা ঝুঁকিপূর্ণ।
কিন্তু আমার প্রতি তাদের দায়িত্ব আছে। তাদের সম্মান এর দাবিদার।
জীবন আর সম্পত্তি বিপন্ন হতে বসলে মানুষ প্রায়শই সম্মানের চিন্তা বাদ দেয়। দারাকে বিমর্ষ হয়ে পড়তে দেখল নিকোলাস। মনে মনে ভাবল এতটা কঠোরভাবে না বলতে পারলেই ভালো হত। নিজের সমস্ত বুদ্ধিমত্তা আর পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও দরবারের বাইরের মানুষের উদ্দেশ্য আর সত্যিকারের পৃথিবী সম্পর্কে শাহজাদাকে মাঝে মাঝে অজ্ঞই মনে হয়। কিন্তু তাহলে কতটা যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হবে এর সাথে?
যাই হোক, পরিষ্কার বোঝা গেল যে দারা অন্য কিছু চিন্তা করছে। হঠাৎ করেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল চেহারা আর কাঠিটাকে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে ঝটকা মেরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। আমি একটা বোকা যে আগে কেন এটা মাথায় আসেনি। একজন আছে যার কাছে আমি সাহায্য চাইতে পারব আর জানি সেও আমাকে প্রত্যাখান করবে না।
কে?
মালিক জিউয়ান নামে একজন বালুচি নেতা। কয়েক বছর আগে একজন মোগল কর সংগ্রাহককে হত্যার আদেশ দিয়েছিল। প্রদেশের শাসনকর্তা তাকে শিকলে বেঁধে দিল্লি পাঠিয়ে দিলে পিতা তার শাস্তি হিসেবে নির্ধারণ করে হাতির পায়ের নিচে মৃত্যু। কিন্তু আমার কাছে আবেদন করেছিল মালিক জিউয়ান। দাবি করেছিল যে কর সংগ্রাহক নিজ জায়গীর খুন করেছিল এক কৃষককে, যে কৃষক কিনা ঘুষ দিতে অস্বীকার করে তার সম্রাটের কাছে আর্জি জানাবার হুমকি দেয়। মালিক জিউয়ানের মতে কর সংগ্রাহকের সে মৃত্যু পাওনা ছিল। তাকে বিশ্বাস করে পিতাকে জানিয়েছিলাম মৃত্যুদণ্ড মুলতবী করার জন্য। এ মামলার তদন্ত কাজে পাঠানো কর্মকর্তার মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম যে তার দাবি পুরোপুরি সত্য, তাই পিতাকে অনুনয় করেছি মালিক জিউয়ানকে ক্ষমা করে দিতে, তিনি তাই করেছেন। এছাড়া মালিককে জায়গির হিসেবে সমৃদ্ধ ক্ষতিপূরণও দিয়েছেন যেটা এখান থেকে সম্ভবত পঞ্চাশ বা ষাট মাইল উত্তরদিকে। সাথে একটি দুর্গও ছিল, যেখানে আবাসস্থল তৈরি করেছে মালিক। সে নিশ্চয় আমাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে পারবে। আমরা এখানেই থাকব, গুপ্তচর পাঠিয়ে আমার কাছে ডেকে পাঠাবো মালিককে।
গুপ্তচররা দ্রুত কাজ দেখিয়েছে ভালোই; দুদিন পরে ঠিক সূর্যাস্তের আগে নীল পাগড়ি পরিহিত দেহরক্ষীদের ছোট্ট দল নিয়ে মালিক জিউয়ানকে এগিয়ে আসতে দেখে ভাবলো নিকোলাস। লম্বা, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বছর চল্লিশের লোকটা নেমে এলো মাখনরঙা ঘোটকী থেকে দারাকে দেখতে পেয়ে অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠল আনন্দ আর আন্তরিকতা।
সুস্বাগতম মালিক জিউয়ান।
আপনার সংবাদ পেয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছুটে এসেছি। একদা আমার প্রতি অনেক সদয় আচরণ করেছেন আপনি আর আমি খুশি যে এখন সময় এসেছে তা পরিশোধ করার।
ঠিক তাই। কিন্তু তার আগে আমার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তোমাকে কিছু প্রদান করতে চাই আমি। হাততালি দিয়ে উঠল দারা আর ইশারা পেয়ে বাকি শিবির থেকে পর্দার মাধ্যমে আলাদা করা হারেমের তাঁবু থেকে বের হয়ে এলো অবগুণ্ঠনবিহীন দারার স্ত্রী। নাদিরা পরিষ্কারভাবেই বোঝা গেল যে অসুস্থ, হাতে করে নিয়ে আসছে ছোট্ট একটি রুপার কাপ, একজন পরিচারিকার হাতের উপর শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে হেঁটে আসছে। আরেকজন পরিচারিকার হাতে রুপার পাত্রের অর্ধেক পূর্ণ হয়ে আছে তরলে। ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে নিকোলাসও এগিয়ে এলো খানিকটা। এমনকি এখনকার মত যেনতেন একটি তাঁবুর ক্ষেত্রেও নারীরা হারেম খোপের অন্দরমহলেই থাকে। হিন্দুস্তানে এত বছর ধরে বাস করার পরেও কখনোই দেখেনি যে নাদিরার সমান সামাজিক মর্যাদার কোন নারী–একজন শাহজাদী আর শাহজাদার মাতা–পুরোপুরি অচেনা কারো সামনে এসেছে এভাবে। এমনকি আগন্তুকের জন্য কোন অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দারাও কিছু বলেনি।
আমার স্ত্রী, সম্মানীয়া নাদিরা বেগম। বালুচি প্রধানকে জানালো দারা। বিস্মিত হয়ে মাথা নত করে কুর্নিশ করল মালিক জিউয়ান।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বললেও নাদিরার কণ্ঠস্বর এত ভাঙ্গা ভাঙ্গা শোনা গেল যে নিকোলাস বাঁকা হয়ে গেল এর মর্মোদ্ধার করতে। আমাদের তাঁবুতে আপনি একজন সম্মানিত অতিথি। একজন বালুচি হিসেবে আমার লোকদের প্রাচীন প্রথা সম্পর্কে জানেন না আপনি। দয়া করে আমাকে ব্যাখ্যা করতে দিন। এই পাত্রের পানি দিয়ে আমি আমার স্তন ধৌত করেছি। আমি আপনাকে প্রস্তাব করছি আমার স্বামীর শ্রদ্ধার চিহ্ন হিসেবে এক কাপ পান করতে। এর মাধ্যমে আমার দুধের চিহ্ন হিসেবে আপনি পরিণত হবেন মোগল রাজপরিবারের সদস্য আর আমার স্বামীর আপন ভাইতে। ধীরে ধীরে আর আভিজাত্যের সাথে নাদিরা পরিচারিকার হাতে থাকা পাত্রের মাঝে কাপ ডুবিয়ে বাড়িয়ে ধরল মালিকের দিকে। এক মুহূর্ত দ্বিধার পরে কাপটা হাতে নিয়ে, চুমুক দিয়ে আবার ভদ্রতাসূচকভাবে মাথা নেড়ে ফিরিয়ে দিল মালিক। এরপর ফিরে তাকাল দারার দিকে। আমি বেশ সম্মানিত বোধ করছি, জাহাপনা। বুঝতে পারছি না কী বলব…।
কিছু বলার দরকার নেই। প্রয়োজনের সময় আমার ডাকে সাড়া দিয়ে এসেছেন আপনি, আর তাই কাউকে আমি দিতে পারি এমন শ্রেষ্ঠ উপহারটাই প্রদান করেছি–জীবনের বন্ধন তৈরি করতে পারে এমন কিছু। যখন, আপনার সাহায্য নিয়ে আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে, আমার পিতা, ম্রাট আপনাকে ভরে দেবে সোনা আর রুপার স্তূপ দিয়ে, আমার নতুন ভাই। এখন চলুন একত্রে বসা যাক।
আস্তে আস্তে নিজের তাঁবুর দিকে চলে গেল নাদিরা। গতি ধীর হয়ে গেল কাশির দমকে। মালিক জিউয়ানের কাঁধে হাত দিয়ে কার্পেট আর তাকিয়া পেতে রাখা আসনের দিকে নিয়ে গেল দারা। একটু পরেই ডুবে গেল গভীর আলোচনায়।
পরের দিন সকালবেলা ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনি আর বলকা লাগাম ইত্যাদি সহযোগে জন্তুগুলোকে সাজানোর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল নিকোলাসের। মুহূর্তের মাঝে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে হাতে তুলে নিল তলোয়ার, প্রভাতের স্নান আলোয় পিটপিট করে তাকাল বাইরের দিকে। তাঁবুতে আক্রমণ হয়েছে, এরকম দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে অস্থির নিদ্রাহীন রাত কেটেছে তার। এখনো আধো ঘুম আধো জাগরণে মনে হল সত্যিই তাই ঘটছে নাকি। এরপর ইতিমধ্যেই রান্নার জন্য জ্বালানো আলোতে দেখা গেল দারার দেহরক্ষীরা ঘোড়ায় লাগাম পরানো শুরু করেছে আর মাহুতদেরকে তৈরি করে দিচ্ছে সহিসেরা। অবাক হয়ে চারপাশে তাকাতেই, দারা কাঁধের উপর অশ্বারোহণের উপযোগী ঢাকা কাপড় পরিহিত হয়ে এগিয়ে গেল তার দিকে, চেহারায় দীপ্যমান হয়ে আছে আরো একবার ফিরে পাওয়া আত্মবিশ্বাসের ছাপ।
কী হয়েছে, মাননীয় শাহজাদা? আমরা কি তাঁবু গুটিয়ে নিচ্ছি।
না। সিপির আর দেহরক্ষীদের নিয়ে মালিক জিউয়ানের সাথে তার দুর্গে যাচ্ছি আমি। সেখানে থাকা সৈন্যদল ইতিমধ্যে প্রস্তুত করা শুরু হয়ে গেছে। সৈন্যদের দক্ষতা আর প্রস্তুতি সম্পর্কে নিজের চোখে দেখতে চাই আমি। এছাড়াও মালিকের মতে, যদি আমি আর আমার পুত্র সৈন্যদের সামনে গিয়ে তাদেরকে উৎসাহিত করি, তাহলে অন্যেরাও তার ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসবে। তাঁবুর প্রধান হিসেবে আপনাকে দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি আমি।
কিন্তু মাত্র পঞ্চাশের মত দেহরক্ষী প্রস্তুত হয়েছে আপনার সাথে যাবার জন্য। পুরো বাহিনী নিয়ে গেলেই কি ভালো হত? চারপাশে তাকিয়ে গলার স্বর নিচু করে আবারো বলে উঠল নিকোলাস, যদি মালিক জিউয়ান আপনার সাথে কোন কৌশল খেলতে চায়? আপনি নিশ্চিত যে সে পুরোপুরি বিশ্বস্ত?
গতকাল কী ঘটেছে দেখেছেন আপনি। জানি অনেক বছর ধরেই হিন্দুস্তানে বাস করছেন আপনি; কিন্তু সম্ভবত এখনো আমাদের আচার প্রথায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেননি। মালিক জিউয়ানকে নাদিরা যে সম্মান দিয়েছে তা সচরাচর দেখা যায় না। এখন মালিক আমার সাথে এমন এক বন্ধনে আবদ্ধ যা অবিচ্ছেদ্য। হঠাৎ করে সামনে এগিয়ে এসে নিকোলাসের বাহুতে হাত রাখল দারা। আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করছি না। বস্তুত আমি আপনাকে আরো বড় দায়িত্ব দিতে চাই। আমার স্ত্রীর শরীর ভালো নয়। বলা যায় আরো খারাপের দিকে, ক্ষণে ক্ষণে ঘামছে আর কেঁপে কেঁপে উঠছে। তাই আমি চাই সে এখানেই থেকে বিশ্রাম নিক। আমি কি আপনার ভরসায় তাকে রেখে যেতে পারি? তার নিরাপত্তা রক্ষাই এখন আপনার প্রধান দায়িত্ব। প্রতিজ্ঞা করুন যে তার এবং তার সম্মানের দিকে খেয়াল রাখবেন আপনি।
আমি কথা দিলাম।
পনের মিনিট বাদে সিপির আর মালিক জিউয়ানকে দুপাশে নিয়ে, দেহরক্ষী আর বলুচি নেতার রক্ষী বাহিনী সমভিব্যাহারে তাঁবু ছেড়ে বের হয়ে গেল দারা ঘোড়া ছুটিয়ে। গাছের ঘন ছায়ার নিচে একটু পরেই হারিয়ে গেল দৃষ্টিসীমার বাইরে।
শাহজাদীর জ্বর আরো বেড়ে গেছে। মাটির উপর উপুড় হয়ে বসে নিজের বন্দুকের ব্যারেল পরিষ্কারে ব্যস্ত নিকোলাস চোখ তুলে তাকিয়ে দেখতে পায় নাদিরার একজন পরিচারিকাকে–সেলিমা নামে বয়স্ক এক নারী, যে সিপির ধাত্রীর কাজও করেছিল–দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। সাদা সুতির ওড়না ছাপিয়েও উদ্বিগ্ন চোখ জোড়া দেখা যাচ্ছে।
কতটা খারাপ অবস্থা?
রাতের বেলা কাশি আরো খারাপের দিকে গিয়ে ঝাঁকুনি খেয়ে কাঁদতে শুরু করে দেন। পোশাক আর বিছানাও ভিজে গেছে ঘামে। আমি চেষ্টা করেছি শান্ত করতে কিন্তু কোন লাভ হয়নি, পরের কয়েক ঘণ্টার মাঝে বিকারগ্রস্থের মত হয়ে পড়েন। আমি কে বা কোথায় আছেন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। ভাবতে থাকেন যে আগ্রার হারেমে ফিরে গেছেন। এমন সব জিনিসের কথা বলতে শুরু করেন যেগুলো আমি আনতে পারি নি। বুঝতে পারছি না কী করব…।
উঠে দাঁড়ালো নিকোলাস। কিন্তু সত্যি আসলে, নয়। যখন দারাকে কথা দিয়েছিল যে নাদিরাকে নিরাপত্তা দেবে, সেটা তো কোন আক্রমণের মুখে… অসুস্থতার হাত থেকে নয়। তাদের সাথে কোন হাকিম নেই। যদি শাহজাদী কোন পুরুষ হত, তাহলে অন্তত একবার চোখের দেখা যেত বিভিন্ন অভিযানে নিজের যোদ্ধাদের মাঝে অনেক ধরনের জ্বর দেখেছে সে কিন্তু যদি নাদিরার অবস্থা সত্যিই বেশি খারাপ হয়, পথিমধ্যে ফেলে আসা জন-জীবনের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইতে হবে। এতে সময় লাগবে আর ঝুঁকিও আছে। কিন্তু আর কোন উপায়ও তো নেই। এর মাঝে সাহায্য করার অন্য উপায়ও ভাবতে হবে। সোমরাজ (তিক্ত উদ্ভিদ বিশেষ) গাছের পাতা নাকি জ্বরের জন্য উপকারী বিভিন্ন অভিযানে চিকিৎসকদের দেখেছেন পাতা ছিঁড়ে গরম পানি দিয়ে চা তৈরি করতে। আরো দেখেছেন হাকিমেরা নিমের পাতার পেস্ট বানিয়ে আহতের জিহ্বায় রেখে দিতেন।
তোমার মালিকার কাছে ফিরে যাও। প্রচুর পানি পান করিয়ে বাতাস করতে থাকো। গ্রামের দিক থেকে সাহায্য নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠাচ্ছি আমি, এছাড়া কাজে লাগতে পারে এমন লতাপাতার ব্যবস্থাও করছি। ত্রস্ত পায়ে সেলিমা চলে যেতেই আপন মনে নিকোলাস ভাবল, এখন কি দারার জন্য লোক পাঠানো উচিত হবে কিনা। কিন্তু ইতিমধ্যে তিনদিন পার হয়ে গেছে শাহজাদা গিয়েছেন, নিশ্চয়ই শীঘ্রি ফিরে আসবেন। এছাড়া দারার দেয়া মালিক জিউয়ানের দুর্গের অবস্থানও স্পষ্ট নয়। অনর্থক অন্বেষণে নোক পাঠিয়ে তাঁবুর নিরাপত্তা কমিয়ে দেয়াটা বোধ হয় বোকামি হবে। না, তার চেয়ে মনোযোগ দেয়া উচিত চিকিৎসক খুঁজে বের করার কাজে। নিজের বন্দুক নামিয়ে রেখে এদিক ওদিক তাকিয়ে দুজন গুপ্তচরকে খুঁজল নিকোলাস আমুল আর রাজিক জানে এদের উপর ভরসা করতে পারবে সে।
চার ঘণ্টা পরে, আকাশের গভীরে গেছে সূর্য, তাঁবুতে ফিরে এলো নিকোলাস। নিজের চওড়া-কানাওয়ালা টুপির মাথায় করে নিয়ে এসেছে লম্বা সোমরাজ বৃক্ষের স্থূপীকৃত পাতা। সাবধানে দুই হাত দিয়ে ধরে বহন করে এনেছে এতদূর। জানে না সত্যিই এর চা কাজে দেবে কিনা; কিন্তু চেষ্টা করাটা জরুরি। হিন্দুস্তানে থাকার এত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে জ্বরতপ্ত রোগীর সবচেয়ে বড় ভরসা হল তার নিজের শারীরিক শক্তি। নাদিরা এখনো বেশ তরুণী, আশা করা যায় সেরে উঠবে। নিজের শক্তিই তাকে সারিয়ে তুলবে। একইভাবে নিকোলাসের নিজের মাঝেও স্কৃর্তি ফিরে এলো যখন শিবিরের চৌহদ্দির মাঝে প্রবেশ করার পর দেখতে পেল দুজনে গুপ্তচর একজন লম্বা পাঞ্জাবী, আমুল ফিরে এসে তাঁবুর বাইরে অপেক্ষা করছে তার জন্য।
তো আমুল, ভাগ্য নিশ্চয়ই তোমার সহায় হয়েছে? বলে উঠল নিকোলাস। কিন্তু কাছাকাছি হতেই পাঞ্জাবীর মুখের বিমর্ষ ভাব দেখতে পেল স্পষ্ট। কী হয়েছে? শাহজাদী কেমন আছেন? আরো অবনতি…?
মাথা নাড়ল আমুল। ঐ ব্যাপারে কিছু জানি না আমি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই।
নিজের তাঁবুতে ঢুকে ইশারা করে আমুলকেও ভেতরে ডাকল নিকোলাস। বাইরের আলো দ্রুত নিভে আসায় জ্বালিয়ে নিল তেলের বাতি। তাঁবুর দেয়াল আর ছাদে নাচতে লাগল কালির ছায়া। এরপর বন্ধ করে দিল তাঁবুর প্রবেশদ্বার।
কী হয়েছে আমুল?
কারো চোখে যাতে না পড়ে যাই এমনভাবে গাছের ছায়ার সাথে মিশে অবশেষে এমন এক রাস্তায় পৌঁছেছি, ভেবেছি যেটি কিনা কোন বসতির দিকে নিয়ে যাবে। এখান থেকে হয়ত কয়েক ঘণ্টার পথও যাইনি, দেখতে পেয়েছি ঘোড়ার বিশাল বড় এক যাত্রীদল, সাথে খচ্চর আর উটও ছিল, আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছে পশ্চিম দিকে। এরকম যাত্রী দলের সাথে প্রায়শ হাকিম থাকে, জানা থাকায় ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে গেছি। তৎক্ষণাৎ কাহিনী তৈরি করে বলেছি যে শিকার অভিযানে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছে আমাদের এক সদস্য। কিন্তু আমাদের কথা পুরো শোনার আগেই বয়স্ক, কাফেলার মালিক নিজের কাহিনী শোনাতে আরম্ভ করে দেয়। আগের দিন একদল সৈন্য দুজন বন্দি নিয়ে তার কাফেলার পাশ দিয়ে দিল্লি গেছে। কাফেলা থেকে মাংস আর উটের দুধ কেনার জন্য থেমেছিল সৈন্যরা, একজন গর্ব ভরে কাফেলার মালিককে জানায় যে তাদের কাছে বন্দি দুজন কোন সাধারণ মানুষ নয়। সম্রাটের পুত্র আর দৌহিত্র, আওরঙ্গজেব আর মুরাদের কাছে উপঢৌকন হিসেবে পাঠাচ্ছে মালিক জিউয়ান। কাফেলা মালিক এও জানিয়েছে যে, সে নিজের চোখে হাত পেছনে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পেয়েছে দুই শাহজাদাকে।
রাজিক কোথায়?
ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেছে কাফেলা মালিকের কথা সত্য কিনা যাচাই করে দেখতে। আমি ফিরে এসেছি আপনাকে জানাতে। যদি আমরা এখনি তাঁবু গুটিয়ে নেই তাহলে হয়ত গিয়ে উদ্ধার করে আনতে পারব শাহজাদারকে। কাফেলা মালিকের কথা মত মাত্র শখানেকের মত সৈন্য আছে সে দলে।
আমরা তা পারব না। শাহজাদাকে কথা দিয়েছে আমি যে তার স্ত্রীর দিকে খেয়াল রাখব। অবস্থা ভালো না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে আমাদেরকে। আমাদের ছোট্ট বাহিনীকে বিভক্ত করতে পারব না। এখানেই থাকো… তাঁবু থেকে বের হয়ে গেল নিকোলাস। দারাকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিল সে… আরো বেশি জোর করা উচিত ছিল। সেলিমাকে ডেকে আনো আমার কাছে। একজন কর্চিকে আদেশ দিল নিকোলাস। অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল বৃদ্ধার জন্য। কাছে আসতেই দেখা গেল পরিচারিকার চেহারা উদভ্রান্ত হয়ে আছে।
তোমার মালিকা কেমন আছেন?
খুব খারাপ। ওড়না সরিয়ে নিল সেলিমা। বলিরেখাময় চেহারা বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রুজল। এখনো আমাকে চিনতে পারছেন না, কাশির দমকে কেঁপে উঠছে শরীর, আগুনের মত গরম চামড়া আর নাড়ীর গতিও হালকা, দপদপ করছে।
সোমরাজ পাতার কথা মনে পড়ে গেল নিকোলাসের, নিচু হয়ে টুপি থেকে তুলে নিল এক মুঠ। তাঁবুর বাইরে পড়েছিল এতক্ষণ।
এগুলো দিয়ে চা বানিয়ে দাও শাহজাদীকে। কাজে লাগতে পারে। মোলায়েম স্বরে জানালো নিকোলাস। কিন্তু সেলিমার মুখে ভেসে উঠল অসম্ভষ্টি।
কোন হাকিম পাওয়া যায়নি।
না। যদি অবস্থার আরো অবনতি হয়, আমাকে জানাবে।
এমনভাবে তাকাল সেলিমা যে স্পষ্ট পড়া গেল তার ভাষা। কেন জানাবো? কোন সাহায্য করেছেন আপনি? প্রাচীন পা দুটো টেনে শক্ত হয়ে চলে গেল সেলিমা। মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে ইতিমধ্যেই নরম হতে থাকা সোমরাজ পাতা। নাদিরার যাই ঘটুক না কেন, মৃত্যু অথবা সুস্থতা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক, প্রার্থনা করতে লাগল নিকোলাস। এছাড়া আর কিইবা আশা আছে দারাকে মুক্ত করে আনার?
*
কঠিন নীলরঙা মেঘহীন আকাশের নিচে একাকী ঘোড়া ছুটিয়ে গ্রেট ট্রাঙ্ক রোড ধরে দিল্লির দিকে চলেছে নিকোলাস। এড়িয়ে চলেছে পথের উপর চড়ে বেড়ানো গরু, নগ্ন ধুলাবালিতে খেলায় ব্যস্ত ছেলে-মেয়ে, কাঁধে কাস্তে নিয়ে মাঠের দিকে যেতে উদ্যত কৃষক আর মাঝে মাঝে ব্যবসায়ীদের গরুর গাড়ি অথবা উট। এই গ্রাম্য ভারতই তার পছন্দ; কিন্তু এখন হাতে সময় নেই এ আনন্দ উপভোগ করার। ছয় দিন আগে ঘোড়ায় চড়ে বসার আগেই নাদিরার সাধারণ সমাধিতে ফেলা হয়ে গেছে শেষ মুঠো মাটি, শেষ বারের মত পড়া হয়েছে প্রার্থনা দরুদ। যদিও তৃতীয় আরেকজন গুপ্তচর গিয়ে জোগাড় করে এনেছিল এক হাকিমকে নাদিরার জন্য কিছুই করতে পারেনি লোকটা। শাহজাদীর বিকারগ্রস্থ আচরণ শেষ কয়েক ঘণ্টায় আরো বেড়ে গিয়েছিল। হারেমের তাঁবুর চারপাশে ঘিরে থাকা পর্দার বাইরে অসহায়ের মত শুনতে হয়েছে ফুসফুস ফেটে যাবার মত দমকা কাশির শব্দ আর দারার জন্য শাহজাদীর উন্মাদের মত চিৎকার। অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না নিকোলাসের। এখন শান্তি পেয়েছে নাদিরা। দারা আর সিপিরের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা দেখার জন্য মুক্তি পেয়েছে নিকোলাস।
একজন ইউরোপীয়ানের কাছে যতই অদ্ভুত দেখাক না কেন স্তন ধোয়া জলের মত মহৎ আর সম্মানজনক উপহার পেয়েও কেন বিশ্বাসঘাতকতা করল মালিক জিউয়ান? মরিয়া এই উপহার পেয়ে মালিক কি ইশারা পেয়েছে যে তার জয়ীদের দলেই যোগ দেয়া উচিত? সম্ভবত দারাকে অনুসরণ করে আসা কম সংখ্যক সৈন্যও এতে ভূমিকা রেখেছে। নাকি ইতিমধ্যেই আওরঙ্গজেব আর মুরাদের সাগরেদ হয়ে গেছে সে?
শাহজাহানের ক্ষমতা আর দারার প্রত্যাশার আলো এত দ্রুত নিভে গেছে যে পরিষ্কার হয়ে গেছে এসব একদিনে হয়নি। আগ্রাতে থেকে আর দারাকে নিজের পাশেই রেখে প্রাদেশিক সেনাপ্রধানদের কাছ থেকে ক্রমান্বয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন শাহজাহান। কিন্তু অন্য পুত্রদেরকে সুযোগ দিয়েছেন বিশ্বাসঘাতকতার বীজ বপন করার। আগ্রা আসা-যাওয়ার পথে পুরষ্কারের লোভ দেখিয়ে নিজেদের মিত্র তৈরি করে রেখেছে তারা। দারার চেয়ে, যে কিনা পিতার পছন্দনীয় হওয়ায় নিজের সফলতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ ছিল, তার অন্য ভাইয়েরা উপলব্ধি করেছিল যে নিজেদের উচ্চাকাঙ্খ পূরণ করতে হলে পদক্ষেপ নিতে হবে। যাই ঘটে থাকুক না কেন, হয়ত দারাকে সাহায্য করার আর কোন উপায় নেই নিকোলাসের… তাঁবুর মাঝে শাহজাদার বন্দি হবার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সৈন্যরা সব চলে যেতে শুরু করে। প্রথম প্রথম একজন দুজন করে নিঃশব্দে সরে পড়তে শুরু করে আর তারপর দলে দলে চলে যায় সবাই। শেষতক এত কম সংখ্যক সৈন্য টিকে ছিল যে দিল্লিতে একাকীই আসার সিদ্ধান্ত নেয় নিকোলাস। অন্তত এভাবে তাকে কেউ ততটা খেয়াল করবে না।
অবশেষে দিগন্তের কাছে শহরের বালি-পাথরের দেয়াল চোখে পড়তেই, ঘোড়া থেকে নেমে গেল নিকোলাস, ভাবতে চেষ্টা করল কী ঘটছে এখন সেখানে। আওরঙ্গজেব আর মুরাদ কি সত্যিই ক্ষতি করবে তাদের জ্যেষ্ঠ ভাইয়ের? সত্য আবিষ্কারের আগে নিজের ছদ্মবেশ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সচরাচর যে ধরনের পাজামা আর চামড়ার ফতুয়া পরে থাকে সেটি বদলে ইতিমধ্যেই গায়ে চাপিয়েছে পিঙ্গলবর্ণের সুতীর প্যান্টালুন আর লম্বা টিউনিক। সাথে চওড়া বেগুনি কোমরবন্ধনী, এটার মাঝে খুঁজে রেখেছে পিস্তল আর ছুরি। এবার মাথায় পরে নিল আমুলের দেয়া গোলাকার পশমী টুপি, চুলগুলো ভেতরে ঢুকিয়ে ধুলিমাখা সুতির গলার মাফলার একটু উপরে তুলে দিতেই ঢাকা পড়ে গেল মুখের নিচের অংশ।
দুই ঘণ্টা পরে, নিজের ক্লান্ত ঘোড়াটাকে শহরের ঠিক বাইরেই একটা সরাইখানায় রেখে সচরাচর চোখে পড়ে না এত বড় একটা ভিড়ের সাথে মিশে ঢুকে গেল মূল ফটকদ্বার দিয়ে। ফটকদ্বার আর পার্শ্ববর্তী দেয়াল সর্বত্র উড়ছে মোগল সবুজরঙা সিল্কের পতাকা সাধারণ সময়ে এর মানে সম্রাট বাস করছেন এ শহরে, কিন্তু আজ তারা কাকে সম্মান দেখাচ্ছে? ম্রাটের বিশ্বাসঘাতক পুত্রদ্বয়কে? ফটকের ভেতরে কয়েক শখানেক গজ গিয়ে বাঁক নিয়ে চওড়া উত্তরের প্রধান রাস্তা ধরে দিল্লির নতুন লাল দুর্গে হাঁটা ধরল নিকোলাস। সবাই মনে হচ্ছে এখন এদিকেই যাচ্ছে। একে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে নিজেরা আগে পৌঁছাতে চাইছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা মিস হয়ে যাবে সে চিন্তায় উদ্বিগ্ন। হতে পারে আজ কোন উৎসবের দিন। ভিড়ের সাথে মিশে নিকোলাস নিজেও হেঁটে এসে অবশেষে থামল দুর্গের সামনে চৌকোনা জায়গাটাতে, যেটির বিশাল বেলে-পাথরের তৈরি দেয়াল অপর পাশে চলে গেছে দুইশ গজ পর্যন্ত। হাজারো মাথার উপর দিয়ে নিকোলাসের চোখে পড়ল কোনমতে জড়ো করা এক্যুপ কাঠের উপর তৈরি করা হয়েছে একটি মঞ্চ। ঠিক দুর্গের দেয়াল থেকে উদগত হওয়া খোদাই করা সুদৃশ্য বারান্দার নিচে শহরে আসলে এ স্থান থেকেই জনগণের উদ্দেশে বক্তৃতা দিতেন শাহাজাহান। মঞ্চটার চারপাশ ঘিরে রেখেছে সৈন্যরা।
সামনের দিকে যেতে চেষ্টা করল নিকোলাস, যেন স্পষ্ট দেখা যায় সবকিছু। ভিড়ের শব্দ ছাপিয়ে মনে হল বাদ্যের তালে তালে বাজনা শোনা যাচ্ছে। অন্যরাও শুনতে পেয়েছে আর তাদের টুকরো টুকরো সংলাপ কানে এলো। তারা আসছে… বলে উঠল এক বৃদ্ধ, নিজের শুকনো গলা বাড়িয়ে, আর বেশি দেরি নেই। কে আসছে? আর কেন? হতে পারে আওরঙ্গজেব আর মুরাদ বিজয়ীর বেশে দখলকৃত শহরে ঘুরে বেড়াতে চায়? এখন বোঝা গেল ফটক দ্বারে পতাকার অর্থ। বাদ্যের বাজনা আরো তীব্র হয়ে উঠল, এরপরই নিকোলাসের চোখে পড়ল পদাতিক সৈন্যদের সারি, হাতে হাত ধরে দুর্গের বাম পাশের রাস্তা থেকে প্রবেশ করল চৌকোনা জায়গায়। ভিড়ের মাঝে দিয়ে নিজেদেরকে দাঁড় করিয়ে পথ করে নিল মঞ্চ পর্যন্ত। অত্যন্ত কর্কশ আচরণ করতে লাগল, ফলে হাতাহাতি-মারামারি বেঁধে গেল কয়েক জায়গায়। কিন্তু শীঘ্রি দেখা গেল পাঁচ থেকে ছয় গজ চওড়া একটা রাস্তা তৈরি হয়ে গেল, দুপাশে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে গেল সৈন্যরা।
ভিড়ের জনতা উৎসাহী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল যে পথ দিয়ে এইমাত্র সৈন্যরা প্রবেশ করেছে সেদিকে। সমান্তরালভাবে দুই সারি অশ্বারোহী সৈন্যের একটি দল প্রবেশ করতেই চারপাশে শুরু হয়ে গেল হট্টগোল। একেবারে প্রথমে থাকা দুজন সৈন্যের লাগামের সাথে লাগান আছে ড্রাম, একের পর এক বাজিয়ে চলেছে দুজনে : প্রথমে একজন, পরে আরেকজন, তারপর দুজন একসাথে। যাই ঘটতে চলুক না কেন ভিড়ের জনতার সহ্য শক্তির যেন বাঁধ ভেঙে পড়তে চাইছে। পেছন থেকে সবাই মিলে আবারো ধাক্কা দিল নিকোলাসকে। কেউ একজন পড়ে গেল, শব্দ পেল নিকোলাস, সাথে সাথে মাড়িয়ে দিল পেছনের লোকেরা, অবাধ্য স্রোতের মত মানুষের ঢেউ ক্রমাগত ধাক্কা দিচ্ছে সামনের দিকে।
এরপর যেমন হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল তেমনিভাবে থেমে গেল সবকিছু। হতাশাবোধক অদ্ভুত একটা শব্দ শোনা গেল, যেন সবাই মিলে একসাথে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছে। নিকোলাস দেখতে পেল এর কারণ…. একটা মাত্র হাতি এগিয়ে আসছে চৌকোনা জায়গাটার দিকে। রাজকীয় হাতি মহলের কোন জমকালোভাবে সজ্জিত জন্তু নয়, মুক্তাখচিত শিরস্ত্রাণ অথবা স্বর্ণমণ্ডিত গজদন্তও নেই–বয়সের ভারে ন্যুজ, ক্ষত-চিহ্ন আর ঝোলানো কানওয়ালা জন্তুটাকে পথ দেখাচ্ছে সাধারণ ধূতি পরিহিত লম্বা চুলের এক লোক। কিন্তু অন্য সকলের মত নিকোলাসও তাকিয়ে আছে হাতির দিকে নয়, বরঞ্চ হাতির পিঠে অমসৃণ কাঠ দিয়ে কোনমতে তৈরি হাওদার উপর বসে থাকা কৃশকায় চেহারা দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে দারা আর সিপির, ন্যাকড়া ধরনের ছেঁড়া কাপড় গায়ে, পচা ফুলের মালা জড়ানো গলায়। ঋজু হয়ে বসে আছে দারা, ডান বা বাম কোন পাশেই তাকাচ্ছে না, কিন্তু তার পুত্র ঝুঁকে আছে সামনে দিকে।
আতঙ্কিত হয়ে উঠল নিকোলাস। অবচেতনেই চেষ্টা করল সবাইকে ধাক্কা দিয়ে বন্দিদের কাছে ছুটে যেতে; কিন্তু তার সামনে মানুষের ঘন দেয়াল আর ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা লাল পাগড়ি পরিহিত এক লোক ঘুরে তাকিয়ে গালি দিয়ে উঠল নিকোলাসকে। কিন্তু থু থু মিশ্রিত অশ্রাব্য ভাষা পাত্তা দিল না নিকোলাস। মাথা জুড়ে শুধু একটাই চিন্তা যে দিল্লির রাস্তা ধরে ভাই আর ভ্রাতুস্পুত্রকে সাধারণ অপরাধীর মত করে প্যারেড করাচ্ছে আওরঙ্গজেব আর মুরাদ। কিন্তু এরপর ভিন্ন কিছু উপলব্ধি করল নিকোলাস। বিশ্বাসঘাতকেরা যদি ভেবে থাকে যে এ ধরনের প্রদর্শনীতে তাদের জনপ্রিয়তা বাড়বে তাহলে ভুল ভেবেছে। চারপাশ থেকে অসন্তুষ্ট হয়ে চিৎকার করে উঠল সকলে আর কয়েকজন তো পাথর, গোবরের স্তূপ তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারতে লাগল সৈন্যদিগের দিকে। কাঠের মঞ্চের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে অবশেষে থামল হাতি।
ঠিক সেই মুহূর্তে থেমে গেল বাজনা আর উপরের বারান্দাতে দেখা গেল চওড়া কাঁধ আর লম্বাদেহী একজনকে। তৎক্ষণাৎ আওরঙ্গজেবকে দেখতে পেল নিকোলাস। হঠাৎ করেই চিৎকার থামিয়ে সবাই ঘুরে তাকাল তার দিকে। কী করতে যাচ্ছে সে? বক্তৃতা দেবে? দারাকে প্রকাশ্যে নিন্দা করবে? কিন্তু মনে হল এরকম কোন অভিপ্রায় নেই আওরঙ্গজেবের। হাত তুলতেই তার মাথার উপরে থাকা গুলি ছোঁড়ার ফোকর প্রাচীর থেকে তিনবার বাদ্য বেজে উঠল ত্বারস্বরে। ইশারা পেয়ে মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন সৈন্য সামনে এগিয়ে এসে দারাকে টেনে-হিঁচড়ে নামালো হাওদা থেকে। দারা মাটিতে পড়ে যেতেই বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল ভিড়ের জনতা। এক মুহূর্তের জন্য নিকোলাসের সামনে থেকে মুছে গেল দারার দৃশ্য, তারপর আবারো তাকাতেই দেখতে পেল বহুকণ্ঠে হাত বাঁধা অবস্থায় উঠে দাঁড়াল দারা। সৈন্য দুজন আবারো ধরে ফেলল তাকে, এইবার ধাক্কা দিল মঞ্চে ওঠার তিন ধাপ কাঠের সিঁড়ির উপর।
মুখ ঘুরিয়ে সৈন্যদের হাতের গণ্ডি পার হবার জন্য উন্মত্ত জনতার দিকে তাকাল দারা। এত দূর থেকেও দেখা গেল শাহজাদার উস্কুখুস্কু, আলুলায়িত চুল কাঁধের উপর পড়ে আছে ইঁদুরের লেজের মত। তারপরেও দেহভঙ্গিমায় ফুটে উঠল আভিজাত্য আর আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ। ভাইয়েরা একজন শাহজাদার সমস্ত বাহ্যিক চিহ্ন কেড়ে নিলেও হরণ করতে পারেনি তার আত্মসম্মান, আপন মনে ভাবল নিকোলাস। ধীরে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে আওরঙ্গজেবের দিকে সোজাসুজি তাকাল দারা। উপরের বারান্দায় প্রস্তরবৎ মূর্তি হয়ে তাকিয়ে আছে আওরঙ্গজেব। নিকোলাস শুনতে পেল কিছু একটা বলে উঠল দারা, কিন্তু বুঝতে পারল না শব্দগুলো। যদিও আওরঙ্গজেব স্পষ্ট শুনেছে। সাথে সাথে দারার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন সৈন্যকে ইশারা করতেই তারা দারাকে ধরে জনতার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বাধ্য করল হাঁটু ভেঙে বসে পড়তে।
এরপর মঞ্চের ডানপাশে দুর্গের দেয়ালে থাকা ফটক দিয়ে বের হয়ে এলো শক্তিশালী এক লোক। প্রায় মাটিতে লুটাচ্ছে এরকম এক চামড়ার অ্যাপ্রন পরিহিত লোকটার হাতে চমকাচ্ছে চওড়া ফলার ভোজালি। চিৎকরে করে উঠল নিকোলাস, না!…না! লোকটা মঞ্চে উঠে আসতেই উন্মাদের মত ছাড়া পেতে চেষ্টা শুরু করল দারা। মুক্তি পেতেই লাফ দিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে হাতির দিকে দৌড়ে সিপিরের পাশে গেল। পুত্রকে ছোঁয়ার চেষ্টা করল; কিন্তু আওরঙ্গজেবের সৈন্যরা তাকে আবারো ধরে ফেলে ছুঁড়ে দিল মঞ্চের দিকে। সেখানে আগের সৈন্য দুজন আবারো ধরে ফেলল দারাকে। আবারো হাঁটু ভেঙে বসতে বাধ্য হল দারা; প্রত্যেকে শাহজাদার একটি করে বাহু পেছনে টেনে ধরতেই দারার মাথা চলে এলো সামনের দিকে। আওরঙ্গজেবের দিকে তাকাল জল্লাদ, মাথা নাড়ল বিশ্বাসঘাতক ভাই। ভয়ংকর শব্দে আর্তচিৎকার করে উঠল ভিড়ের জনতা, জল্লাদ মাথার উপরে ভোজালি তুলেই নামিয়ে আনল নিচে। একটা মাত্র কোপে সাঙ্গ হল হত্যা। রক্তাক্ত হয়ে দারার শরীর ছিটকে পড়ল সামনের দিকে। কিন্তু মাথা গড়িয়ে গেল মঞ্চের সামনের দিকে, পড়ে গেল মাটিতে। একজন সৈন্য তাড়াতাড়ি কুড়িয়ে নিল সেটা।
আরো ভালোভাবে দেখার জন্য পেছন থেকে সকলে ধাক্কা দিতে আরম্ভ করায় মুখ তুলে বারান্দার দিকে তাকাল নিকোলাস। চলে গেছে আওরঙ্গজেব। হাঁটুতে মাথা গুঁজে কাঁদতে লাগল সিপির। হাতি আবার চলতে শুরু করল দুর্গের দিকে, তাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে খুনী চাচার বরাদ্দ করে রাখা ভবিষ্যতের দিকে।
.
২.১১
এখনো কি কোন খারাপ সংবাদ পাওয়া গেছে, আব্বাজান? কথা বলতে বলতেই বহুদূরে বুম করে আওয়াজ শুনতে পেল জাহানারা। এতক্ষণে তো দুর্গের প্রাত্যহিক বোমাবাজি বন্ধ হয়ে যাবার কথা। রাত নেমে এসেছে আর গাছের ফাঁক দিয়ে আধা মাইল দূরে যমুনার তীরে বিদ্রোহীদের তাঁবুতে রান্নার চুলার আগুনের আভা দেখা যাচ্ছে। অবরোধ শুরু হবার পর থেকে শাহজাহানের অভ্যাস হয়ে গেছে সন্ধ্যা বেলা দুর্গের গুলি করার ফোকর বিশিষ্ট প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে বিদ্রোহী আর তার নিজের দলের পাল্টাপাল্টি বোমা বিনিময়ের দৃশ্য দেখা। পিতাকে এখানেই পাওয়া যাবে অনুমান করতে পেরে হারেম থেকে মাত্রই এসে যোগ দিয়েছে জাহানারা।
মাথা নাড়লেন শাহাজাহান, না। তারা এখনো ছোট কামান ব্যবহার করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়ছে, আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের উপর। শুধুমাত্র তাদের সবচেয়ে বড় কামান দিয়ে একটানা গুলিবর্ষণ করলেই সম্ভব হবে জোড়া দেয়ালে ফাটল ধরানো। আমার মনে আছে দুর্গ পুনর্নির্মাণের সময় এর নকশা আমাকে দেখিয়েছিলেন দাদাজান। দেয়ালের মজবুত নির্মাণ আর উচ্চতা নিয়ে গর্বিত ছিলেন তিনি। আমার মনে হয় না কখনো স্বপ্নেও ভেবেছিলেন যে একদিন তাঁরই পরিবারের এক সদস্য এদের উপর হামলা চালাবে। একইভাবে আমিও কখনো ভাবিনি যে নিজ পুত্ৰই আক্রমণ করে বসবে….
মুরাদ কেন তার ভারী অস্ত্র নিয়ে আসছে না? প্রায় একমাস হতে চলল অবরোধের কিন্তু কতটা উন্নতি করেছে সে? একটুও না!
আমিও একমত এ ব্যাপারে। যদি মুরাদ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হত তাহলে পুরো সামর্থ্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিন্তু সম্ভবত এমন করবে না। হয়ত দুর্গে ঢোকার আসলেই কোন ইচ্ছে নেই তার।
তাহলে আমাদের উপর বোমাবর্ষণই বা করছে কেন?
আমার ধারণা নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে সতর্ক করে দিতে চায় যেন দুর্গ থেকে তাদের উপর আক্রমণের চেষ্টা না করা হয়। জানে যে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারলে বিদ্রোহীদের সত্যিকারের রূপ প্রকাশ করে সমর্থক জোগাড় করতে পারব না আমরা। একই সাথে অবশিষ্ট বিশ্বস্ত সৈন্যদেরকেও ব্যবহার করতে পারব না। প্রদেশ জুড়ে শুধু তাদের অংশই প্রচারিত হবে আর কর্মচারিরা যদি তাদের কথা বিশ্বাসও করে, দোষ দেব না আমি–অন্তত এ ব্যাপারে কিছু জানতেও চাইব না। কেননা যুদ্ধের ফলাফল যেখানে এখনো অনিশ্চিত।
হতে পারে দুর্গের সৈন্যদের মনোবল ভেঙে দিয়ে আমাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করতে চায়।
হতে, কিন্তু যাই হোক না কেন আমি পরোয়া করি না। আমাদের কাছে যথেষ্ট খাবার, পানি আর সৈন্য, গোলাবারুদও আছে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা ছাড়াও শত্রুর উপর আঘাত হানতে পারব আমি। নিজের সৈন্যদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি প্রতি একটি বিদ্রোহী কামান নিপ করার । জন্য পাঁচশ রুপি করে উপহার পাবে।
হয়ত তুমি যা ভাবছ মুরাদের লক্ষ্য সেটা না। হতে পারে যা কিছু ঘটে গেছে তার জন্য অনুতপ্ত হয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। তোমার যেন কোন ক্ষতি না হয়ে যায়… অথবা ওর বোনেদের। হয়ত সে নিজেও সমঝোতার কথা চিন্তা করছে…
মুরাদ অবশ্যই জানে যে সে এতটা এগিয়ে গেছে যে চাইলেও আর আমার ক্ষমা লাভ করতে পারবে না। সে আর আওরঙ্গজেব মিলে ময়দানে আমার সৈন্যদেরকে হত্যা করেছে, বাধ্য করেছে আমার নির্বাচিত উত্তরাধিকারী, তাদের নিজ ভাইকে পালিয়ে যেতে। দারার নাম শুনতেই জাহানারার বিমর্ষভাব খেয়াল করলেন শাহজাহান।
আমি জানি তোমার জন্য কতটা কঠিন এটা। আরো একটু মোলায়েম স্বরে বলে উঠলেন, গত কয়েক সপ্তাহ আমাদের সকলের জন্যই কঠিন সময় যাচ্ছে। প্রতিটি দিনই, তোমার মত আমিও আশা করছি যে দারার সংবাদ পাব।
কিছু জানতে না পারাটাই বেশি কঠিন। এই দুর্গের মাঝে বন্দি হয়ে বাইরের পৃথিবীতে কী ঘটছে কিছুই জানতে পারছি না আমরা। আর একমাত্র যে সংবাদ পেয়েছি সেটাও দুঃসংবাদ…
শাহজাহান ভালো করেই জানেন কী বলতে চাইছে জাহানারা দিল্লির সুবাদারের কাছ থেকে বার্তাবাহকের নিয়ে আসা পত্র, তিন সপ্তাহ আগে যাকে আসতে অনুমতি দিয়েছিল মুরাদ, যেটিতে দারাকে শহরে প্রবেশ করতে দিতে সুবাদারের অস্বীকৃতি লেখা ছিল। সুবাদারের দাবি ছিল, আওরঙ্গজেব তাকে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে সম্রাট এতটাই অসুস্থ; ফলে শহর আর এর রাজকোষ দারার হাতে তুলে দেবার মত কোন পত্র লেখারও ক্ষমতা নেই…
‘শাহজাদা আওরঙ্গজেব আমাকে জানিয়েছে যে শাহজাদা দারা সিংহাসন দখলের জন্য নিজের কার্য সিদ্ধি করার উদ্দেশ্যে জাহাপনার কাছ থেকে যে নির্দেশপত্র এনেছে তা সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্র। আর তাই তাকে অস্বীকার করে সাম্রাজ্য আর সম্রাটের প্রতি আমার দায়িত্ব পালন করেছি আমি। এর পরিবর্তে দিল্লির তত্ত্বাবধানের ভার তুলে দিচ্ছি শাহজাদা আওরঙ্গজেবের উপর। যে কিনা আমার মতে একজন অনুগত পুত্র হিসেবে মহান জাহাপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। পরম করুনাময় আল্লাহ দ্রুত আপনার আরোগ্য লাভে সহায়তা করুন।‘
আশা করি কোন একদিন দারা আর আমি একসাথে হয়ে সুবাদারকে তার প্রতারণা আর ভণ্ডামির জন্য শাস্তি প্রদান করতে পারব। জল্লাদের হাতের নিচে দিতে পারলেই বেশি খুশি হব। একটা প্রতিউত্তরও পাঠাতে পরিনি তাকে অভিযুক্ত করে। সাম্রাজ্যের উপর আমার ইচ্ছে চাপিয়ে দেয়ার পক্ষে আমি এতটাই অলস হয়ে পড়েছি।
তোমার কি মনে হয় আওরঙ্গজেব এখনো দারার পিছু নিচ্ছে?
হ্যাঁ। দারাই তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। আমার মনে হয় না আগ্রা আর দিল্লি থেকে দারাকে বহুদূরে না পাঠিয়ে দেয়া পর্যন্ত সুস্থির হবে আওরঙ্গজেব। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি পারে এখানেও ফিরে আসতে চাইবে সে। বেশি সময়ের জন্য মুরাদের হাতে পুরো দায়িত্ব ছেড়ে রাখারও ঝুঁকি নিতে চাইবে না। নিশ্চয় গোপনে তার মনে এ ভয়ও থাকবে যে যদি মুরাদ একাকী পুরো সাম্রাজ্য দখল করে নিতে চায়–যেমনটা সে নিজে করেছে। আশা করছি যে শীঘি তাদের দুজনের মাঝেই ঝগড়া বেধে যাবে। যদি এমনটা হয় তাহলে দারা আরেকটা সুযোগ পেয়ে যাবে। বিশেষ করে যদি পূর্বদিক থেকে সৈন্য নিয়ে ফিরে আসতে পারে সুলাইমান। এই যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি…
খানিকক্ষণের জন্য চুপচাপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পিতা-কন্যা। গত কয়েকটা দিন ধরেই প্রায় এরকম ঘটছে, ভাবল জাহানারা। বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় কথা বলার আর কিইবা আছে?
সারাক্ষণ বিভিন্ন কিছু কল্পনা করা বেদনাদায়ক। নিত্য নতুন দুশ্চিন্তা এসে যন্ত্রণা আরো বাড়িয়ে দেয়। প্রতিটি দিন অনুভব করছে নিজের ভেতরে আরো বেশি করে ডুবে যাচ্ছেন পিতা, যেমনটা সে নিজে। মাঝে মাঝে মনে হয় নিকোলাসের কথা। তার চারপাশের দুনিয়া–একদা পূর্ণ ছিল নিশ্চয়তায় হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। জানে যে নিকোলাসের উপর এখনো বিশ্বাস করতে পারে সে ভুলে যায়নি বিক্ষত মুখে নিকোলাসের নম্র ছোঁয়া। সেই মুহূর্তে কী মনে হয়েছিল তার? বিস্ময় বা চমক নয়, কিন্তু… খানিকটা সময় লেগেছে এটা উপলব্ধি করতে.. এরকম দুঃসময়ে কৃতজ্ঞতা। যদি রোশনারা এটা দেখতে পেত, কোন সন্দেহ নেই যে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিত পুরো ব্যাপারটার।
রোশনারার কথা মনে হতেই স্মরণ হল সান্ধ্য খাবারের জন্য হারেমে ফিরে যাওয়া উচিত। অবরোধের শুরু থেকেই ভগিনীদ্বয়ের সাথেই খাবার গ্রহণ করে সে। রোশনারার সাথে তার সম্পর্ক এখনো বেশ শীতল, পারতপক্ষে একে অন্যের সাথে তেমন কথা বলে না। কিন্তু জানে কামানের গর্জন ভীত করে তোলে গওহর আরাকে। যদিও এখন আর সে কোন শিশু নয়, পূর্ণবয়স্ক নারী, তার কনিষ্ঠ ভগিনী খেতে পারছে না তেমন, ঘুমাচ্ছেও অল্প। প্রতি সন্ধ্যায় জাহানারা চেষ্টা করে গওহর আরার মনোযোগ আনন্দে ভুলিয়ে রাখতে।
আব্বাজান, তোমার অনুমতি নিয়ে হারেমে ফিরে যেতে চাই আমি। মাথা নাড়লেও কিছু বললেন না শাহজাহান। শান্তিকালীন সময়ের মতই প্রাত্যহিক সান্ধ্য মশাল জ্বলে উঠল হারেমের প্রধান আঙিনায় যাবার ফটকের উভয় পার্শ্বে, পা বাড়াল জাহানারা।
তুর্কি নারী সৈন্যরা তার জন্য দরজা মেলে ধরতেই হাসির আওয়াজ শুনতে পেল জাহানারা। আঙিনার মাঝখানে ঝরনার ধারে মার্বেলের উপর বসে আছে তিন নারী। এক মুহূর্তের জন্য তাদের হাস্যরসের শব্দে ভান করল যেন কিছুই অনর্থ হচ্ছে না চারপাশে। এরপর নিজের আর বোনদের জন্য সান্ধ্য খাবার আয়োজনের নির্দেশ দিল; কিন্তু তার আগে রোশনারার কাছে গিয়ে দুর্গের প্রতিরক্ষা সম্পর্কে পিতার ভাষ্য জানাতে হবে।
কিন্তু আঙিনার দূরতম কোণে রোশনারার গৃহে প্রবেশ করতেই দেখতে পেল বোন সেখানে নেই। এমনকি তার পরিচারিকারাও নেই। হতে পারে স্নানঘরে গেছে? চলে যেতে উদ্যত হতেই বোনের জমকালো কারুকাজ করা গহনার বাক্সের উপরে ভাঁজ করা একটা কাগজ পড়ে আছে দেখতে পেল জাহানারা। কৌতূহলী হয়ে তুলে নিয়ে খুলতেই দেখতে পেল রোশনারা পরিষ্কার অক্ষরে সম্বোধন করেছে পিতাকে, বোনের ময়ুরের সীলমোহরও নজরে পড়ল। কেমন বেখাপ্পা দেখাল পুরো ব্যাপারটা। পত্র লেখার কী দরকার যখন চাইলেই পিতার সাথে দেখা করতে পারে সে… জাহানারা পত্রখানা ফিরিয়ে রাখতে গিয়েই দেখতে পেল আরেকটা জিনিস–বাক্সের রুপার ঢাকনা খোলা, অথচ নিজের শ্রেষ্ঠ আর সুন্দর রুবি, খোদাই করা পান্না আর তাদের গ্রেট দাদীজান হামিদা বানুর নেকলেসও ওখানেই রাখে রোশনারা। তার পরিচারিকারা কেমন করে এতটা ভুলো মন হতে পারে? ঢাকনা তুলে ভেতরে তাকাল জাহানারা। বাক্স খালি, শুধু কয়েকটা রুপার চুড়ি পড়ে আছে। ভারী ঢাকনাটা আবার জায়গা মত রেখে পুরো কক্ষের দিকে নজর বুলালো জাহানারা। যেমনটা সবসময় থাকে তেমন পরিষ্কার নয়। ড্রয়ার থেকে ঝুলে আছে একটা কাশ্মিরি শাল, মেঝেতে গড়াচ্ছে সোনার পাড়ওয়ালা সিল্কের স্কার্ট। ডাকাতি হয়েছে নাকি? এত সুরক্ষিত হারেমে তো সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু এরপরই মনে হলো আরেকটা কথা–চমকে গিয়ে… কি করছে ভাবার আগেই পত্রের সীলমোহর খুলে পড়ে ফেলল বোনের লেখা, কার্পেটের উপর ঝরে পড়ল সবুজ মোমের গুঁড়া।
‘প্রিয় পিতা, আপনি এই চিঠি পড়তে পড়তে দুর্গ ছেড়ে ভাইদের কাছে বেরিয়ে পড়েছি আমি। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আপনি যাদেরকে ভুল বুঝেছেন তাদের প্রতি বিশ্বস্ত আমি, যাদের হৃদয়ে সাম্রাজ্যের জন্য সৎ অভিপ্রায় ছাড়া আর কিছু নেই, আমার বিবেকের কথা মান্য করতে হবে আমাকে। হয়ত আবারো আনন্দময় সময়ে আমাদের দেখা হবে।‘
কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হল যেন জমে গেল জাহানারা, হাতে ধরা পত্রখানার লাইনগুলোর অর্থই যেন বোধগম্য হল না। এরপর ধাতস্থ হতেই চিঠিটা ভাঁজ করে দরজার কাছে গিয়ে ডেকে পাঠালো পরিচারিকাকে।
এখনি খাজাসারাকে ডেকে পাঠাও। বলো যে এটা অত্যন্ত জরুরি।
দুই মিনিটেরও কম সময়ের মাঝে এসে হাজির হল হারেমের তত্ত্বাবধায়ক। সদা প্রশান্ত আর অভিজাত চেহারাতে উদ্বিগ্নতার ছাপ। মাননীয় শাহজাদী?
আমি যখন বোনের সাথে দেখা করতে এসেছি, সে এখানে ছিল না। পরিবর্তে এই চিঠিটা পেয়েছি যাতে লেখা যে দুর্গ ছেড়ে চলে গেছে সে।
কিন্তু এটা তো অসম্ভব… একেবারে, কিছুতেই সম্ভব নয়।
আমার মনে হয় ভুল বলছ তুমি, শেষবার কখন দেখেছ তাকে?
দ্বিধায় পড়ে গেল খাজাসারা। সম্ভবত আজ সকালবেলা কথা হয়েছিল… হারেমের একটা ব্যাপারে…
কোন ব্যাপারে?
আমি ভাবিনি যে এটা নিয়ে আপনাকে বিরক্ত করা উচিত। গতকাল সন্ধ্যায় হারেমের এক ভৃত্য, বয়স্ক, শৌচাগার পরিষ্কারক মারা গেছে। শহর থেকে আসা হিন্দু ছিল বৃদ্ধা আর তার শেষ ইচ্ছে ছিল শহরে চিতায় পোড়ানোনার জন্য যেন তার মৃতদেহ আত্মীয়দের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। শেষ মুহূর্তে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল বেচারা আর আমিও কথা দিয়েছি যে সাধ্যমত সব করব, যদিও বিশ্বাস করুন বুঝতে পারছিলাম না যে কীভাবে সম্ভব। কোন একভাবে শাহজাদী রোশনারা মৃতের কথা জানতে পেরে আমাকে ডেকে পাঠান। বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কর্মচারিদের প্রতি সচরাচর কোন আগ্রহ দেখান না তিনি। সহৃদয়ভাবে আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করার পর জানান যে, মৃতা নারীর অনুরোধ রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। আজ সকালে প্রথম আলো ফোঁটার সাথে সাথে দুর্গের সেনাপ্রধানের কাছে বার্তা পাঠান যেন শাহজাদা মুরাদের শিবিরে বার্তাবাহক ও যুদ্ধবিরতীর পতাকা পাঠিয়ে দেয়া হয় দিনের বোমা বর্ষণ শুরুর আগেই। বার্তাবাহকের কাছে ইতিমধ্যেই স্বহস্তে লিখে রাখা পত্র ছিল। সীল করা চিঠিতে দুর্গ থেকে মৃতদেহ বের করে নেবার আকুতি লেখা ছিল… অন্তত তিনি তাই দাবি করেছেন…; গলা কেঁপে গেল খাজাসারার।
মাননীয়া আমি…
বলে যাও।
গোধূলি বেলায় বার্তাবাহক ফিরে এসে জানায় যে দুর্গ থেকে নিরাপদে মৃত নারীর দেহ বের করে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে আমাদেরকে। আমরা সবকিছু প্রস্তুত করে রেখেছিলাম আর আপনি মহান জাহাপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে যাবার পরপরই চারজন সাদা পোশাকধারী হারেমের পরিচারক দুর্গ থেকে মৃতদেহ বাইরে নিয়ে গেছে…; মুখের উপর হাত চাপা দিল খাজাসারা। নিশ্চয় এভাবেই ঘটেছে পুরো কাণ্ডটা। আপনার ভগিনী কোন এক নারীর ছদ্মবেশ নিয়েছে নিশ্চয়। তাদের সবারই মুখ ঢাকা ছিল ওড়নায় আর তাদেরকে চেক করে দেখার কথা আমার মাথাতেই আসেনি…
কোন ফটক ব্যবহার করেছে তারা?
বার্তাবাহকের ব্যবহার করা পাশের ফটক শহরের দিকে মুখ করে থাকা ছোট ফটকটা।
তো এই কারণেই সে আর পিতা যমুনার দিকে তাকিয়ে থাকলেও কিছুই দেখতে পায়নি, ভাবল জাহানারা। যখন তারা দাঁড়িয়ে কথা বলছি, রোশনারা পালিয়ে গেছে… কীভাবে করল এমন একটা কাজ? আর কত বড় সাহস বিবেকের কথা লিখেছে যখন আসলে তার কোনই বিবেক নাই? কিন্তু এরপরই নতুন চিন্তা এলো মাথায়।
শাহজাদী গওহর আরার কী খবর? তাকে শেষবার কখন দেখেছ তুমি?
সারাদিন মাথা ব্যথায় নিজের ঘরেই শুয়েছিলেন তিনি। এটাই জানিয়েছে তাঁর পরিচারিকা আর তাদেরকে অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই আমার… আমি শপথ করে বলছি দায়িত্বের ব্যাপারে আমি সবসময় সচেতন।
কিন্তু শুনছিল না জাহানারা। শশব্যস্ত পায়ে আঙিনার ওপাশে ছোট বোনের কক্ষের দিকে চলল, সাথে পিছনেই খাজাসারা। গওহর আরাও নিশ্চয়ই পিতাকে ছেড়ে যায়নি, নাকি? আইভরি রঙা দরজাগুলো বন্ধ, ঠিক যেমন রোশনারার গৃহের দরজা বন্ধ ছিল। দুরুদুরু বক্ষে খুলে ফেলল, জাহানারা। গরাদের উপর পর্দা নামানো আর অল্প কয়েকটা বাতি জ্বলছে। কোন একটা লতা জাতীয় গন্ধে–সম্ভবত কোন সুগন্ধি ফুল– ভরে আছে বাতাস–অন্ধকারে চোখ সইয়ে আসতেই ডিভানের উপর শুয়ে থাকা একটা দেহ নজরে এলো জাহানারার এরপর শুনতে পেল জড়ানো কণ্ঠস্বর। কে? আমার মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে?
গলার স্বরে মনে হল গওহর আরাই, তারপরেও নিশ্চিত হতে হবে যে এটা কোন কৌশল নয়। কুলুঙ্গি থেকে তেলের বাতি নিয়ে কাছে এগিয়ে গেল জাহানারা। শিখার আভায় দেখা গেল বোনের পাতলা মুখমণ্ডল… অসংখ্য ধন্যবাদ আল্লাহ।
ওহ, তুমি, জাহানারা। আমি ভেবেছি বোধ হয় সাত্তি আল-নিসা। সারাদিন তাকে ডেকেছি। একমাত্র সে-ই জানে কীভাবে এই ব্যথা দূর করতে হয়, কিন্তু কাছাকাছি নেই সে।
শাহজাদী আজ সকালের পর থেকে সাত্তি-আল-নিসাকে দেখিনি আমি। জাহানারার পিছুপিছু রুমে আসা খাজাসারা বলে উঠল।
কাঁধের উপর দিয়ে ইশারা দিল জাহানারা যেন আর কিছু না বলে ফেলে। এখনি গওহর আরাকে রোশনারার পালিয়ে যাওয়া সম্পর্কে কিছু বলে লাভ নেই। বোনের দিকে ফিরে তাকাল। আমার খারাপ লাগছে যে তোমার শরীর ভালো না। আমি দেখছি তোমার জন্য সাত্তি আল-নিসাকে খুঁজে পাই কিনা।
আবারো খাজাসারাকে সাথে নিয়ে জাহানারা গেল মোটা কার্পেট পাতা দেয়ালে সিল্ক ঝোলানো করিডোরের শেষ মাথায় প্রায় তিন দশক ধরে বরাদ্দকৃত সাত্তি আল-নিসার কক্ষে–যখন থেকে সে মমতাজের বিশ্বস্ত পরিচারকের কাজ পেয়েছে। একমাত্র সাত্তি আল-নিসাকেই সে নির্ভয়ে বলতে পারবে যে কী ঘটছে, যদিও এখন পর্যন্ত রোশনারার পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু টের পায়নি সে। তার বোন কি হঠাৎ ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার সুযোগ নিয়েছে নাকি বহু আগে থেকেই এটির পরিকল্পনা করছিল?
পর্দা সরিয়ে কক্ষের মাঝে প্রবেশ করার সাথে সাথে বোঝা গেল যে কোথাও কোন সমস্যা হয়েছে। মেঝেতে বড় একটা সিল্কের পাশ বালিশের উপর উপুড় হয়ে আছে সাত্তি আল-নিসা, চারপাশে ছড়িয়ে আছে রুপালি ধূসর কেশরাজি। সে কি মূৰ্ছা গিয়েছে? এখনো এত পরিশ্রমী যে বয়সের কথা মনেই হত না। সাত্তি আল-নিসার পাশে হাঁটু গেড়ে তার হাত নিজের হাতে তুলে নিল জাহানারা। ঠাণ্ডা হাত, তালু ঘষার পরেও কোন প্রতিক্রিয়া নেই… এমনকি বুকেও ওঠা-নামার কোন চিহ্ন নেই। না, এটা হতে পারে না… সাত্তি আল-নিসার কাছে মুখ নামিয়ে নিতেই জাহানারার চোখ ভরে গেল জলে। এরপরই অনুভব করল অথবা তার মনে হল–নিজের ত্বকের গায়ে অত্যন্ত হালকা নিঃশ্বাসের উষ্ণতা। আস্তে করে সাত্তি আল-নিসার হাত নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালো জাহানারা। বেশ অসুস্থ হলেও আমার ধারণা এখনো বেঁচে আছে… দ্রুত সাহায্য করার জন্য কাউকে নিয়ে এসো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা খাজাসারাকে চিৎকার করে আদেশ দিল জাহানারা।
কয়েক মিনিটের মাঝেই বেগুনি আলখাল্লা পরিহিত সঙ্গীকে নিয়ে এলো খাজাসারা, যার কপালে অদ্ভুত ট্যাটু আঁকা।
এই হল ইয়াসমীন। আরব থেকে এসেছে। হাকিম পিতার কাছ থেকে এ বিদ্যার কিছু দক্ষতা শিখেছে সে।
এক পাশে সরে গিয়ে ইয়াসমীনকে জায়গা দিল জাহানারা, সাত্তি আল-নিসার উপর ঝুঁকে নাড়ি পরীক্ষা করে এক চোখের পাতা তুলতেই দেখা গেল ঘন, প্রশ্বস্ত মণি।
কী হয়েছে তার? জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে? জিজ্ঞেস করল জাহানারা।
না, মাননীয়। আমার ধারণা আফিম খেয়ে গভীর ঘুমে মত্ত হয়ে আছে।
আফিম? তুমি নিশ্চিত? কখনো তার এই অভ্যাসের কথা শুনিনি আমি।
ঘুরে তাকিয়ে, নিচু মার্বেলের সাদা টেবিলের উপর রুপালি কাপ দেখতে পেয়ে নিজের ডান হাতের তর্জনী চুবিয়ে দিয়ে চুষে দেখল, কোন সন্দেহ নেই, পপি ফুলের কটু স্বাদ, এমনকি গোলাপের সুগন্ধি মেশানো শরবতে মেশানো হলেও, যায়নি।
কেউ একজন ইচ্ছেকৃতভাবে তাকে নেশা করিয়েছে। এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা। জাহানারা ভালোভাবেই অনুমান করতে পারল যে কে এই ব্যক্তি। রোশনারা কোন সুযোগ রেখে যেতে চায়নি আর তাই বৃদ্ধা এই নারীকে নেশা করিয়েছে যে কিনা প্রায় তার সারা জীবন দেখভাল করেছে। তুমি একেবারে নিশ্চিত যে ভয়ের কোন কারণ নেই?
দীর্ঘস্থায়ী কোন ক্ষতি হবার কথা না। কয়েক ঘণ্টার মাঝেই চেতনা ফিরে পাবে, কিন্তু মাথাব্যথা থাকবে আর দুর্বল ও অসুস্থও বোধ করবে।
এখানেই থাকো। জেগে ওঠার সাথে সাথে আমাকে খবর পাঠাবে। এই কথা বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে কক্ষ ছেড়ে এলো জাহানারা। কেমন করে পিতাকে জানাবে এসব খবর? তারপরেও জানাতে হবে আর যত দ্রুত সম্ভব…
কয়েক মিনিট পরে, হাঁপাতে হাঁপাতে পিতার কাছে গেল জাহানারা।
কী হয়েছে? এত শীগ্রি ফিরে এলে কেন?
দ্বিধায় পড়ে গেল জাহানারা, কিন্তু সত্য লুকানোর আর কোন পথ নেই যে আবারো নিজের রক্ত-মাংস দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার। হয়েছেন পিতা। রোশনারা দুর্গ ছেড়ে মুরাদের কাছে চলে গেছে। এই চিঠি লিখে গেছে… ক্ষমা চাইছি। কী ঘটেছে তাড়াতাড়ি জানার জন্য খুলে সেলেছি আমি।
শাহজাহান রোশনারার চিঠি হাতে নিয়ে পড়ে দেখলেন সংক্ষিপ্ত বার্তাটা। তারপর দলামোচড়া করে মাটিতে ফেলে দিলেন কাগজটা।
মনে হচ্ছে মৃত হিন্দু নারীর দেহ বহনকারীদের দলে লুকিয়ে দুর্গ ছেড়ে গেছে সে। আর…।
হাত তুললেন শাহজাহান। কীভাবে সে এটা করেছে তা কোন বিষয় নয়। আস্তে করে বলে উঠলেন শাহজাহান। গওহর আরার কি খবর?
এখনো এখানেই আছে।
খুশি হয়েছি আমি। আর কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন কন্যার কাছ থেকে যেন তার চেহারা না দেখা যায়। ভেবেছিল রেগে উঠবেন তিনি; কিন্তু তার বদলে অনুভব করল পিতার গভীর বিমর্ষতা। ভালোই বুঝতে পারল জাহানারা। কেননা সে নিজেও ঠিক একই জিনিস অনুভব করছে। কেমন করে এতটা বিভেদ তৈরি হয়ে গেল তাদের পরিবারে? কোন পরিবারে এহেন বিচ্ছেদ–বিশেষ করে একটি রাজপরিবারে কখনো সত্যিকারে সারবে? হয়ত না।
*
আমার শিবিরে স্বাগতম। তুমি আর আমি একত্রে মিলেমিশে এখন এই আনন্দ উদ্যাপন করতে পারব যে আমি আগ্রাতে ফিরে এসেছি। মুরাদের পিঠে চাপড় মেরে বলে উঠল আওরঙ্গজেব।
তোমার রক্ষীবাহিনীকে আলাদাভাবে খাবার পরিবেশন করার আয়োজন করেছি আমি। কিন্তু আমরা দুজনে একসাথে আহার করব। আমার তাঁবুতে।
তোমার আমন্ত্রণ পাবার সাথে সাথে ছুটে এসেছি আমি। রোশনারাও অভিনন্দন পাঠিয়েছে। ভালোই হয়েছে তাই না, সে দুর্গ থেকে বের হবার পথ করে নিয়ে আমার সাথে এসে যোগ দিয়েছে।
আমার শুধু মনে হচ্ছে জাহানারাও যদি থাকত, কিন্তু তুমি তো জানো তার ধরন। সাম্রাজ্যের কিসে ভালো হবে তার চেয়েও উপরে পিতার প্রতি বিশ্বস্ততাকে স্থান দিয়েছে সে… নিজের তাঁবুর দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল আওরঙ্গজেব, যেখানে শতরঞ্জি দিয়ে ঢাকা মেঝের উপর পেতে দেয়া হয়েছে সিল্কের কুশন আর খাবার পরিবেশনের জন্য নিচু একটা টেবিলের উপর ইতিমধ্যেই পেতে দেয়া হয়েছে কাপড়।
মুরাদ বসে কয়েকটা তাকিয়ার গায়ে হেলান দিতেই একজন পরিচারক পিতলের পাত্রে পানি ঢেলে দিল হাত খোবার জন্য। এরপর আরেকজন নিয়ে এলো মদ। আমি ভেবেছিলাম তুমি মাদক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছ আওরঙ্গজেব?
হেসে ফেলল আওরঙ্গজেব, তাই করেছি, কেননা ধর্মীয় সব নীতিতে বিশ্বাসী আমি। কিন্তু জানি তুমি নও। আর যেমনটা বলেছি, এখন সময় হয়েছে ভোজনরসিক আর হৃদয় খুলে দেবার, কঠোরতার নয়… আমি পান করব না; কিন্তু উদ্যাপনের নিমিত্তে তুমি যত চাও পান করতে পারো।
তোমার কি সত্যিই মনে হয় আমরা জিতে গেছি?
হ্যাঁ, ভেবে দেখ তুমি, দারা মৃত। আর কে আছে আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার? নিশ্চিতভাবে এটাই ভাবছে গুরুত্বপূর্ণ সব অভিজাত আর প্রজাবর্গ… এমনকি যারা দারার হয়ে যুদ্ধ করেছে তারাও এখন তাড়াহুড়া করে নিজেদেরকে আমাদের সমর্থক হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যস্ত। প্রায় প্রতিদিনই এ জাতীয় বার্তা পাচ্ছি আমি, তুমিও নিশ্চয়।
মাথা নেড়ে মুরাদ বলে উঠল, কিন্তু পিতা আর দুর্গের অবশিষ্ট সৈন্যরা? হাল ছেড়ে দেবার কোন চিহ্নই নেই এখনো।
আগেকার মত নেই আর পিতা। খুব বেশি সময় লাগবে না যুক্তি দিয়ে বুঝতে বিশেষ করে যখন শুনবেন যে সেনাবাহিনী নিয়ে আগ্রাতে ফিরে এসেছি আমি। আর যদি তা নাও হয় তাহলে কোন না কোন রাস্তা ঠিকই বের করে ফেলব বন্দি হতে বাধ্য করাতে।
কাপ থেকে লম্বা চুমুক দিয়ে গলায় মদ ঢালল মুরাদ, হাসতে হাসতে, পিছনে হেলান দিল। তাহলে তুমিই ঠিক বলেছিলে… আমার অবিশ্বাস সত্ত্বেও সবসময় বলতে যে আমরাই জিতব–এমনকি সামুগড়ের পরেও। যদিও দারার পেছনে ছিল পিতা আর রাজকীয় সেনাবাহিনীর বেশির ভাগ অংশ…
হ্যাঁ, কিন্তু নিজের সুযোগগুলো হেলায় হারিয়েছে সে, বিশেষ করে যখন অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল। খলিল উল্লাহ খানের মত শক্তিশালী সমর্থককেও পরোয়া করার প্রয়োজন মনে করেনি–ধরেই নিয়েছিল যে সবাই তাকে অনুসরণ করবে। কিন্তু উত্তরে অভিযানের সময় থেকে খলিল উল্লাহ খানকে চিনি আমি, আর তাই জানতাম যে, কী বলা যায় উৎসাহী ছিল আমাদের সাথে যোগ দেবার প্রতি…
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দারার কথা অনেক ভেবেছি আমি… তার মৃত্যু সত্যিই কী প্রয়োজনীয় ছিল কিনা। আমাদের ভাই ছিল সে। অন্য কোন পথ নিশ্চয়ই ছিল… দেশান্তরী বা মক্কায় তীর্থযাত্রী হিসেবে পাঠিয়ে দেয়া?
সবসময় একটা শিশুর মত ভাবো তুমি। ব্যাপারটা ছিল সে অথবা আমরা। যদি তাকে বেচে থাকার সুযোগ দিতাম, আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করত সে। পুরো সংঘর্ষ আবারো দানা বেঁধে উঠে, আরো কতকগুলো জীবন ধ্বংস হত।
মনে হয় তুমি ঠিকই বলছ।
আমি জানি আমি তাই। যাই হোক, হয়ে গেছে সবকিছু। এখন তোমার মাথা থেকে তাড়িয়ে দাও এসব। সিদ্ধান্ত আমি একাই নিয়েছি, জবাবও আমিই দেব।
ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত, তাই না? পিতা আমাদের দুজনকেই ভর্ৎসনা করেছিলেন উত্তরের অভিযানে ব্যর্থতা নিয়ে অথচ শেষতক আমরাই বিজয়ী হলাম। হতে পারে এখন পিতা পস্তাবেন এতটা রূঢ় হবার জন্য। আরো একবার চুমুক দিয়ে বলে চলল মুরাদ, পরিতাপের বিষয় যে শাহ সুজা আমাদের সাথে নেই। এটা তো তারও বিজয় আর আমাদের সাথে উদযাপনও করতে পারত। হতে পারে এর ফলে মেরুদণ্ডে বল ফিরে পাবে সুলাইমানের সাথে যুদ্ধ করার জন্য।
মেরুদণ্ডে বল?
হ্যাঁ। সুলাইমানকে তাকে পরাজিত করার সুযোগ দিয়ে আর পালিয়ে গিয়ে আমাদের কাছে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে সে।
কিন্তু এক অর্থে এতে আমাদের সুবিধা হয়েছে। শাহ সুজা আগ্রায় আসার পরিবর্তে পূর্বদিকেই আটকে রেখেছে সুলাইমানকে। যদি সুলাইমান তার পিতার সাথে সামুগড়ে যোগ দিত, ফলাফলও ভিন্ন হত হয়ত।
হতে পারে… যদিও চূড়ান্ত রূপ পেত না। সুলাইমানের নিজের কিছু ভুল ছিল যেমনটা ছিল তার পিতার… অসহিষ্ণু, অতি আত্মবিশ্বাসী আর চিন্তার কোন ধার ধারত না।
তো সে কোন হুমকি নয়?
বেশি গুরুত্ব দেবার মত নয়। একবার দারার মৃত্যুসংবাদ সুলাইমানের শিবিরে পৌঁছালেই, আমার ধারণা তার কিছু সৈন্য চলে যাবে আর বাকিরা মনোবল হারিয়ে ফেলবে। ভালো হয় যদি এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে শাহ সুজা তাকে পরাজিত করে। কিন্তু যদি শাহ সুজার মনে হয় যে তার জনবল কমে গেছে তাহলে আমি বলব যেন নিজের সৈন্য নিয়ে সোজা আগ্রাতে চলে আসে। এখন সময় হয়েছে আমাদের তিনজনের একত্রিত হবার। যেন একসাথে সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলো কীভাবে নিজেদের মাঝে ভাগ করে নেব। কিন্তু অনেক গুরুগম্ভীর কথা হয়েছে… চলো, খাবার গ্রহণ করা যাক।
মুরাদ পরিচারকের কাছে পেয়ালা বাড়িয়ে দিল পূর্ণ করে দেয়ার জন্য। অন্য পরিচারকেরা একে একে ভেড়ার রোস্ট, কিসমিস দেয়া কোয়েল, কেশরের সুগন্ধিলা পাখির মাংস আর শুকনো চেরি ও অ্যাপ্রিকট ছড়িয়ে দেয়া পোলাওয়ের ডিশগুলো নিয়ে আসতে লাগল। খানিকক্ষণের জন্য চুপচাপ খেয়ে চলল দুই ভাই। মুরাদ খেল ক্ষুধার্তের মত, পরিমাণেও বেশি। অন্যদিকে আওরঙ্গজেব খেল অল্প একটু। তাঁবুর আধ খোলা ফটক দিয়ে দেখা গেল তারা ভরা আকাশ, অর্ধচন্দ্রাকৃতি চাঁদও উঠে গেছে, তৃপ্তির ঢেকুর তুলে পিছনে হেলান দিল মুরাদ, মদের পেয়ালা থেকে আরেক চুমুক মুখে দিয়ে বলে উঠল, তোমার মনে আছে আমার পছন্দের খাবারগুলো কী। আমি খুব খুশি হয়েছি…
অবশ্যই, আনন্দ পিয়াসী ভাই আমার। আর তুমি পছন্দ কর এরকম আরেকটা জিনিসেরও ব্যবস্থা করেছি আমি। আওরঙ্গজেব হাততালি দিয়ে উঠতেই তাঁবুর ভেতরে প্রবেশ করল মুখমণ্ডল সহ সারা শরীর ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখা, বুকের উপর হাত জড়ো করা এক নারী। তোমাকে একা রেখে যাচ্ছি আমার উপহার উপভোগ করার জন্য। আমি জানি তার এমন সব দক্ষতা আছে যে খুশি হবে তুমি। যদি চাও তোমার সেবা করতে নিয়ে যেতে পারো তাকে। অনেক রাত হয়ে গেছে। এখানেই রাত কাটাও না কেন যেন সকালবেলা আবার কথা বলতে পারি?
আওরঙ্গজেব চলে যেতেই, তাঁবুর পর্দা নেমে প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে গেল। ইশারা করে আগন্তুক নারীকে কাছে ডাকল মুরাদ, তোমার চেহারা দেখাও আমাকে। ওড়না সরিয়ে নিতেই বাদামি চোখ জোড়া তার দিকে চেয়ে আছে দেখতে পেল মুরাদ। আর কোন আদেশের অপেক্ষা না করেই মাথার কাপড় ফেলে দিতেই ঘন এলো চুল বেরিয়ে পড়ল।
চওড়া হল মুরাদের হাসি। সুন্দরী নারী ভালোবাসে সে, ভালোভাবেই জানে তার ভাই… আওরঙ্গজেব সত্যিই তার কৃপাদৃষ্টি বর্ষণ করেছে মুরাদের উপর।
নাম কী তোমার?
জয়নাব।
তো জয়নাব, দেখা যাক আমার ভাইয়ের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে পারো কিনা তুমি…
মদের প্রভাবে খানিক টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল মুরাদ, খুলে দিল জয়নাবের কাপড়ের একটামাত্র হুক। মেঝেতে পোশাক লুটিয়ে পড়তেই বেরিয়ে পড়ল নগ্ন শরীর, মার্বেলের মত উজ্জ্বল দেহত্বক আর সোনালি উন্নত বক্ষ। কাছে এগিয়ে কৃশকায় কোমর, নরম নিতম্ব সহ শরীরের প্রতিটি বাঁকে ঘুরে বেড়াতে লাগল মুরাদের হাত, কেশগুচ্ছে মুখ ডুবিয়ে দিতেই নাকে লাগল জেসমিনের সুগন্ধ। একেবারে পরিপূর্ণ এই নারী… ডান নিতম্বে এক হাত রেখে, অন্য হাত পৌঁছে গেল দুপায়ের ফাঁকে।
অপেক্ষা করুন, শাহজাদা আগে আপনাকে মালিশ করতে দিন। এতে আনন্দ বেড়ে যাবে বহুগুণ, কথা দিচ্ছি। আপনার ভাই তো জানিয়েছেন যে আমার বিশেষ দক্ষতা আছে… তিনি চান যেন সেসব প্রয়োগ করে আপনাকে সন্তুষ্ট করি আমি… তাকে মনোকষ্ট পেতে দেবেন না।
কৌতূহলী হয়ে জয়নাবকে ছেড়ে দিয়ে মাথা নাড়ল মুরাদ। ভালো। দুঃখ পাবেন না আপনি। প্রথমে, আপনার পোশাক খুলতে দিন। দ্রুত হাতে মুরাদের পোশাক খুলে নিয়ে সপ্রশংস দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলল জয়নাব। আপনার সাথে রাত কাটাতে পেরে ধন্য হবে যে কোন নারী… আসুন, কুশনের মাঝে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে পড়ুন।
মুরাদ কথামত কাজ করতেই অনুভব করল তার দুই পা ফাঁক করে দিল জয়নাব। এরপর নিজের বুক দিয়ে মসৃণভাবে চাপ দিতে লাগল মুরাদের কাঁধে, দেহত্বকে ঘসতে লাগল স্তনবৃন্ত। একই সাথে নিজের কোমর আর শরীরের সবচেয়ে নাজুক অংশ দিয়ে ঘষতে লাগল মুরাদের নিতম্ব। উচ্চ স্বরে চিৎকার করে উঠল মুরাদ। দেখেছেন, আমি বলেছি না এটা কত ভালো হবে? একটু পরে আপনার পালা আসবে আমাকে তৃপ্ত করা, শাহজাদা, তবে এত শীঘ্রি না… সামনের দিকে ঝুঁকে পড়তেই জয়নাবের চুল মুরাদের উপর ছড়িয়ে পড়ল সুগন্ধি কার্পেটের মত। তাঁবুর বাইরে কোথাও থেকে ভেসে এলো হাতির ঢাকের বাজনা; কিন্তু কোন দিকে হুঁশ নেই মুরাদের। শুধু অনুভব করছে জয়নাবের মাংসল দেহ, নিজেকে তার হাতে সঁপে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল মুরাদ।
মদ আর লীলাখেলায় মত্ত সুখে খানিক সময় লাগল বুঝতে যে জয়নাব উঠে গেছে তার উপর থেকে, হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে সে। এখন কী? এখন কি আনন্দ বাড়িয়ে দেবার জন্য অন্য কোন খেলা খেলবে জয়নাব নাকি চূড়ান্ত মুহূর্ত এসে গেছে? ঘুরে গিয়ে তাকাতেই দেখতে পেল কোন বড় বড় নারী চক্ষু নয়, সরু, কালো আর পুরুষালী এক জোড়া চোখ। কী…?
আর কিছু বলার আগেই, তাঁবুর প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে কোন একটা কণ্ঠ বলে উঠল, বেঁধে ফেল! বিপদের গন্ধ বহু দেরিতে পাওয়ায় উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই কালো চোখের সৈন্যটা নিজের ছুরির ফলা ধরল মুরাদের গলায় আর ছায়া থেকে বের হয়ে এসে অন্য দুজন বেঁধে ফেলল তার হাত। দেহরক্ষীদের ডাকার জন্য মুখ খুলল, আশা করল হয়ত কেউ থাকবে কাছাকাছি; কিন্তু ছুরি দিয়ে চামড়ায় খোঁচা দিল লোকটা, রক্ত বের হয়ে আসল, তার উপর নিচু হয়ে চিৎকার করে উঠল।
একটুও নড়বে না!
কত বড় সাহস! এখানে কীভাবে ঢুকলে তুমি? আমার ভাই কোথায়?
তিনি তোমার মুখ দেখতে চান না। আমরা তাঁরই লোক। তিনি চলে গেছেন তোমার শিবিরের দায়িত্ব নিতে। আর তুমিও ভ্রমণে বের হবে– দীর্ঘ ভ্রমণ। এরপর তাড়াতাড়ি নিজের লোকদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল মুরাদকে নিচে চেপে ধরে আছে, বলে উঠল, তাড়াতাড়ি দাঁড় করাও।
মানুষ দুটো অবষন্ন আর প্রতিরোধবিহীন মুরাদকে তুলে ধরতেই কাপড় দিয়ে জড়িয়ে দেয়া হল। আধো চেতনে মুরাদ বুঝতে পারল এগুলো তার কাপড় নয়, কোন প্রহরীর পোশাক। ছুরি দিয়ে তাঁবুর পর্দা একটু উঁচিয়ে ধরে কালো তে-কোনা রাতের আকাশের দিকে তাকাল লোকটা। আস্তে করে উঁকি দিয়ে চারপাশ দেখে নিল দ্রুত।
ভালো। মাথা নেড়ে দুই প্রহরীকে জানালো, বাইরে নিয়ে এসো। হাতিরা অপেক্ষা করছে। তোমরা জানো কী করতে হবে।
*
আমার তলোয়ার নিয়ে এসো, আলমগীর! বিস্মিত কর্চিকে আদেশ দিতেই এস্তভাবে ব্যক্তিগত কামরা ছেড়ে চলে গেল পরিচারক। যদি এর আগে শাহজাহান ভেবেছিলেন মোগলদের পারিবারিক, প্রাচীন তলোয়ার–হিন্দুস্তানে এই অস্ত্র প্রথম নিয়ে এসেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ বাবর–দারাকে দেবেন; কিন্তু তিনি এখনো ময়ূর সিংহাসনে আসীন, এই অবস্থায় এটিকে কাছছাড়া করাটা অমঙ্গল হতে পারে ভেবে, থেমে যান আবার।
কয়েক মিনিট পরে নিজের হাতে আবারো তলোয়ার নিয়ে অনুভব করলেন এটির সুদৃশ্য ঈগলের হাতল–যতটা শক্ত, ততটাই সুন্দর, পাখিটার লাল রুবির চোখ দেখেই সপ্রশংস দৃষ্টিতে খুশি হয়ে উঠলেন। আগামীকাল আলমগীরের সাথে, কোমরে তলোয়ারের রত্নখচিত খাপ আর আঙ্গুলে তৈমুরের ভারী সোনার আংটি পরে যুদ্ধে যাবেন তিনি হয়ত শেষ বারের মত। যাই ঘটুক না কেন তাঁর–এমনকি মৃত্যু হলেও–আরো একবার একজন পুরুষ আর যোদ্ধা হতে পেরে, এই সুনিপুণ অস্ত্র নিয়ে খেলতে পারার অনুভূতি মন্দ হবে না। আগেও বহুবার কোন এক সংঘর্ষের শুরুতে যেমন করতেন ঠিক সেভাবে ইস্পাতের ফলার একপাশে আঙুল বুলাতে লাগলেন। যদি চামড়া কেটে যায় বুঝতে পারবেন এখনো ধার আছে। ডান তর্জনী দিয়ে চাপ দিলেন কিন্তু কোন রক্তের কুড়ি দেখা গেল না। আমার অস্ত্র নির্মাতার কাছে পাঠিয়ে দাও তীক্ষ্ণ করে তোলার জন্য। কর্চিকে আদেশ দিলেন শাহজাহান।
তরুণটা গেছে বেশিক্ষণ হয়নি, আবারো দরজা খুলে গেল জাহানারার জন্য। মেয়েটার কী প্রতিক্রিয়া হবে তার পরিকল্পনা শোনার পর বেশ ভালোই বুঝতে পারছেন শাহজাহান; কিন্তু কিছুতেই দমে যাবেন তিনি। হতে পারে তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন কিন্তু এখনো একজন সম্রাট আর যোদ্ধা হিসেবে নিজের বিদ্রোহী সন্তানদের দেখিয়ে দিতে পারেন–পুত্র আর কন্যা উভয়কেই সত্যিকারে এর অর্থ কী।
এটা কি সত্যি যে আওরঙ্গজেব অবশেষে চিঠি লিখেছে? শোনার সাথে সাথে হারেম থেকে এখানে এসেছি আমি।
মাথা নাড়লেন শাহাজাহান। এক সপ্তাহ আগে আগ্রাতে ফিরে এসেছে আওরঙ্গজেব-পুত্রের গর্বিত আগমন, উড়ন্ত ব্যানার, ঢাকের বাজনা সবই নিজের চোখে দেখেছেন তিনি গুলি করার জন্য প্রাচীরের ফোকার দিয়ে কিন্তু এতদিন লেগে গেল যোগাযোগের ক্ষেত্র স্থাপনে।
কী বলেছে সে? সেই কি কামান দাগা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে?
হ্যাঁ। লিখেছে আমার মত এত বৃদ্ধ আর অথর্ব এক লোক বাস করছে এমন দুর্গে বোমাবর্ষণ শুরু করাটাই উচিত হয়নি মুরাদের। যাই হোক, এর মানে এই না যে সে আমাদের ভালো চায়। তার দাবি এটা তার দায়িত্ব, আমার প্রতি–যে কিনা শাসন করার বা দুর্গ নিয়ন্ত্রণ করার উপযুক্ত নই আর–আর সাম্রাজ্যের প্রতি, আমাকে বাধ্য করা যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আত্মসমর্পণ করে ফেলি, তাহলে পুনরায় শৃংখলা স্থাপন করতে পারবে সে। এছাড়াও, সে দাবি করছে যে উপায়ও সে খুঁজে পেয়েছে তা করার।
কীভাবে?
দুর্গের পানির প্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে। এক বিদ্রোহী দুর্গের পানির বাঁধ খুলে দিয়েছে, ফলে যমুনার পানি ঢুকে পড়াতে আর বিশুদ্ধ পানি পাবো না আমরা। বাকি আছে আমাদের জন্য বহুদিনের অব্যবহৃত অল্প কয়েকটা কুয়া… সে আশা করছে এই গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে মনোবল হারাবে আমার সৈন্যরা।
আমি বুঝতে পারছি না… আশা করেছিলাম এতদূর এসেও হয়ত পিছু হটে যাবে তারা দুজন…।
লজ্জাবোধ বা অপরাধের কোন অনুভূতিই নেই তাদের।
দারা সম্পর্কে কিছু বলেছে আওরঙ্গজেব?
না। আশা করছি যে আওরঙ্গজেব আগ্রাতে ফিরে এসেছে কারণ দারা তাকে কৌশলে এড়িয়ে যেতে পেরেছে।
আমি চিঠি লিখব ভাইদের কাছে… যুক্তি দিয়ে বোঝাব আওরঙ্গজেব আর মুরাদকে।
তারা শুনবে না আর বিশ্বাসঘাতকদের কাছে অনুনয় করে নিজেকে ছোট করতে তোমাকে দেব না আমি।
আমি অনুনয় করব না…আমিও তাদের সমকক্ষ… ।
তার পরেও আমি মানা করব। আমিই এখনো সম্রাট। মেরুদণ্ডহীনের মত দুর্গে বসে পুত্রদের জন্য অপেক্ষা করব না আমি যে তারা পরবর্তী কোন পদক্ষেপ নেবে আমার জন্য। দুনিয়ার কাছে প্রচার করেছে আমি এতটাই বৃদ্ধ আর অসুস্থ যে শাসন করার উপযুক্ত নই, কিন্তু তাদেরকে আর আমার প্রজাদেরকে এর বিপরীত চিত্র দেখাবো আমি।
কী করতে চান আপনি?
সৈন্যদের প্রধান হয়ে তাদের সাথে লড়াই করতে যাব। দুর্গের সৈন্যরা এখনো বিশ্বস্ত আর আমাকে অনুসরণ করবে আমি নিশ্চিত। কথা বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ালেন শাহজাহান। বহুদিন ধরে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে আছি। দারাকে ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে না পাঠিয়ে উচিত ছিল আমার যাওয়া। বুঝতে পারত তারা যে আমি আমার শক্তি হারাইনি, তবে এখনো তত বেশি দেরি হয়ে যায়নি। আর যদি আমি মারাও যাই, আত্ম গরিমা ফিরে পাবো আমি আর এরই মাঝে দারা আর সুলাইমান ফিরে এসে আমাকে হত্যার প্রতিশোধ নেবে।
আব্বাজান, অনুগ্রহ করে আপনি এমনটা করবেন না…
এটাই এখন একমাত্র পথ। আমি আমার কর্মচারীর কাছে আওরঙ্গজেব আর মুরাদকে দেয়ার জন্য একটা চিঠি রেখে দিয়েছি, লেখা আছে আমার শেষ ইচ্ছে তারা যেন তোমার সাথে সম্মান আর শ্রদ্ধামূলক আচরণ করে। যা কিছু ঘটে গেছে আর আমার প্রতি তারা যতই বিরাগ থাকুক না কেন, আমার বিশ্বাস এ দায়িত্ব তারা পালন করবে। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
আমি ভয় পাচ্ছি না–অন্তত নিজের জন্য তো নয়ই, কিন্তু আপনার কথা ভেবে সাড়া হচ্ছি… আওরঙ্গজেব জানে আপনার প্রকৃতি। সে জেনে বুঝেই আপনাকে প্ররোচিত করতে চেয়েছে। ক্ষমা চাইছি, কিন্তু একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করছেন, আব্বাজান।
হতে পারে, কিন্তু অন্তত কর্মক্ষম তো হয়ে উঠেছি। হয়ত যোদ্ধা সুলভ স্বাস্থ্য নেই, কিন্তু উদ্দীপনা ঠিকই আছে।
এক মুহূর্তের জন্য পত্নীর অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানা ভেসে উঠল চোখের সামনে। অসংখ্য বার পত্নীকে রেখে যুদ্ধে গিয়েছেন, আবার তার কাছে ফিরেও এসেছেন। কখনোই মনে হয়নি মমতাজই মৃত্যুবরণ করে তাকে ছেড়ে চলে যাবে… কিন্তু এসবই বহুদিন আগের কথা আর সম্ভবত শীঘ্রিই স্বর্গে দেখা হবে দুজনের।
দরজায় করাঘাতের শব্দ পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন শাহাজান, ওড়না টেনে নিল জাহানারা। কর্চি কি তলোয়ার নিয়ে ফিরে এসেছে? যদি তাই হয়, তাহলে দ্রুত কাজ করেছে এই তরুণ। কিন্তু দরজা খুলে যেতেই দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে দুর্গের সেনাপতি।
জাহাপনা, যুদ্ধ বিরতীর পতাকাতলে আরো একজন বার্তাবাহক এসে পৌঁছেছে আপনার পুত্রদ্বয়ের কাছ থেকে। জোর দিয়েছে যেন আপনি একাকী এটি দেখেন। বার্তাবাহকের দাবি, শাহজাদা আওরঙ্গজেব কিছু পাঠিয়েছে আপনার জন্য।
কী? আরেকটা পত্র?
না, জাহাপনা। মনে হচ্ছে কোন পার্সেল। পরীক্ষা করে দেখার জন্য আমার লোকদেরকে আদেশ দিলে বাধা দিয়েছে বার্তাবাহক। বলছে এটা শুধুমাত্র আপনার হাতে দিতে আর কাউকে দিতে চাইছে না সে। যদি আপনি চান, জাহাপনা, আমি আমার সৈন্যদেরকে আদেশ দেব তার কাছ থেকে নিয়ে নিতে।
না। অস্ত্র আছে কিনা তার সাথে খোঁজ করে, প্রহরী দিয়ে আমার কাছে নিয়ে এসো।
শাহজাহান আর জাহানারা একে অন্যের দিকে তাকালেও কিছু না বলে চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলেন। কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এলো সেনাপতি, পেছনে এসেছে পরিষ্কার কালো পাগড়ি আর কর্মকর্তাদের সাধারণ আলখাল্লা পরিহিত, দাড়িঅলা আর লম্বা একজনকে নিয়ে আটজন প্রহরী। বিশাল বড় এক রেশমি থলে, সিল্কের রশি দিয়ে আটকানো কিছু একটা ধরে আছে লোকটা।
আমি বুঝতে পেরেছি আমার জন্য কিছু একটা নিয়ে এসেছ তুমি। কী, জিজ্ঞেস করলেন শাহজাহান।
আমার প্রভু আমাকে জানাননি শুধু এটুকুই যে যেন আপনার হাতেই দেই, অন্য কারো হাতে নয়।
খুব ভালো। তোমার সামনে কার্পেটের উপর রেখে পিছিয়ে যাও। প্রহরী, চোখ রাখবে তার উপর। লোক পিছিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন শাহজাহান, এরপর প্রহরীরা চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলল বার্তাবাহক লোকটাকে। সাবধানে রেশমের থলেটার কাছে গিয়ে তুলে নিলেন। বিশাল চেহারা সত্ত্বেও তেমন একটা ভারী নয়। কার্পেটের উপর রেখে দিয়ে ঝুঁকে সিল্কের রশিটা খুলে ফেলেলেন শাহজাহান। ভেতরে পাওয়া গেল আরেকটা থলে। তবে নিকৃষ্টমানের, গোলাকার মুখের কাছে পাতর রশি দিয়ে বাঁধা। সাবধানে এটাও তুলে নিলেন শাহাজাহান। রশির সাথে ভাঁজ করা এক টুকরো কাগজ। তুলে নিয়ে খুলে ফেললেন শাহজাহান : ধর্মদ্রোহীতার একমাত্র শাস্তি মৃত্যু। আল্লাহর ইচ্ছাই পূর্ণ হয়েছে আর বেহেশতের উদ্যানে সকলেই আনন্দে মেতেছে।
কাগজটাকে একপাশে রেখে ব্যাগ খুলে ফেললেন শাহজাহান। সাথে সাথে নাকে এসে লাগল অস্বস্তিকর মিষ্টি গন্ধ–একবার এ গন্ধ পেয়েছেন তিনি, মৃত্যুর গন্ধ তাই ভুলে যাননি–বমি ঠেলে এলো মুখে। ব্যাগের ভিতরে পাওয়া গেল আরো একটা ব্যাগ। এবার কালো সিল্ক দিয়ে মোড়ানো। কাঁপা কাঁপা হাতে সিল্ক খুলে ফেললেন। আর অবশেষে কিছু একটা বের হয়ে গড়িয়ে পড়ল কার্পেটের উপর : দারার খণ্ডিত মস্তক, কুৎসিত, মৃত চোখ জোড়ার চারপাশে নড়ছে ক্রিম রঙা পোকা, মুখ আর রক্তাক্ত নাকের ভেতরে বাইরে যাওয়া-আসা করছে কীটগুলো।
বহুদূর থেকে মনে হল ভেসে এলো জাহানারার আর্তচিৎকার, বেশ কিছু সময় ধরে গলিত কাঠামোটার দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলেন শাহজাহান। প্রায় না শোনার মত করে বলে উঠলেন, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। শেষ হোক এবার। দরজাগুলো খুলে দাও…