২.০৯ বিশ্বাসই বিশ্বাসঘাতক

বিশ্বাসই বিশ্বাসঘাতক
[মঞ্জু ঘোষাল হত্যা
মলয় দত্ত, সাব-ইনস্পেকটর, গোয়েন্দাবিভাগ। ২০১৬ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রদত্ত ‘সেবা পদক’।]

দরজাটা বন্ধ কেন? মঞ্জুদির তো খুলে বেরিয়ে আসার কথা, বেরিয়ে দাঁড়ানোর কথা দরজার মুখে। এমনটাই তো হয়ে আসছে এতদিন ধরে। আজ অন্যথা কেন? কেউ আছে ভিতরে? সামান্য থমকান ডলি। একটু ইতস্তত করেন। বেল বাজান। উত্তর নেই কোনও। সামান্য জোরেই ডাক দেন এবার।

—মঞ্জুদি?

সেকেন্ড পাঁচেক পরেও যখন আওয়াজ নেই কোনও ঘরের ভিতর থেকে, গলা আর একটু চড়ান ডলি।

— মঞ্জুদি.. আমি ডলি। মঞ্জুদি…?

কী হল? এমন তো হওয়ার কথা নয়। মঞ্জুদি সাড়া দিচ্ছে না কেন? শরীরটা ইদানীং ভাল যাচ্ছিল না। মাথা-টাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে গেল? নাকি পেনশন তুলতে বেরিয়েছে? কিন্তু সে তো দিনচারেক আগেই তুলে এনেছে ব্যাংক থেকে। তা ছাড়া বেরলে তো দরজায় তালা দেওয়া থাকবে। নেই তো! উদ্বিগ্ন ডলির কী মনে হয়, দরজায় সামান্য চাপ দিয়ে দেখেন। এবং খুলে যায় অর্ধেকটা, ওই সামান্য চাপেই। দরজাটা খোলাই ছিল, ভেজানো। ডলি দ্বিধা কাটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েন।

ফ্ল্যাটে ঢুকেই সামান্য একচিলতে জায়গা। পেরিয়ে বাঁ দিকে একটা শোওয়ার ঘর। খোলা। কেউ নেই ভিতরে। বিছানাটা ওলটপালট অবস্থায়। জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ভয় পেয়ে যান ডলি। মঞ্জুদি কোথায়?

এ ফ্ল্যাটে সে-অর্থে ড্রয়িংরুমের কোনও বালাই নেই। ডানদিকে একটা ছোট প্যাসেজ। বাথরুম-রান্নাঘর ছাড়া আরেকটা শোওয়ার ঘর। যার দরজাটা একটু খোলা। ডলি ঠেলে খুললেন। এবং খুলেই দাঁড়িয়ে পড়লেন স্থাণুবৎ।

‘মঞ্জুদি’ পড়ে আছেন বিছানায়। উপুড় হয়ে। লাল-সাদা রংয়ের যে নাইটিটা পরে ছিলেন, ভেসে যাচ্ছে রক্তে। শরীরের উপরিভাগ খাটের উপর। হাঁটু থেকে নিম্নাংশ খাটের নীচে। ঝুলছে। ঘর লন্ডভন্ড।

ডলি কাঁপতে থাকেন। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে কোনওমতে উঠে আসেন তিনতলায়, নিজের ফ্ল্যাটে। হাত চেপে ধরেন স্বামী শেখরের, ‘নীচে চলো… মঞ্জুদি…!’

সত্তর ছুঁইছুঁই শেখর দু’তলায় নামেন যত দ্রুত সম্ভব। দেখেন, এবং বোঝেন, প্রতিবেশীদের বা মৃতা মঞ্জুর আত্মীয়দের খবর দেওয়ার আগেও জরুরি পুলিশকে জানানো। থামান কাঁদতে থাকা ডলিকে।

—ওঁর মেয়েকে ফোন করো। আমি ততক্ষণ থানায় জানাচ্ছি।

সকাল সোয়া এগারোটায় ফোন বাজল কালীঘাট থানায়। ডিউটি অফিসার ধরলেন, শুনলেন, জানালেন ওসি-কে। দুটো ফোন করলেন ওসি। একটা ডিসি সাউথ-কে, আরেকটা ডিসি ডিডি-কে। তারপর গাড়িতে উঠে বসলেন, ড্রাইভারের প্রতি নির্দেশ এল ঝটিতি।

‌—নেপাল ভট্‌চাজ স্ট্রিট, তাড়াতাড়ি।

ডিসি সাউথও পার্ক স্ট্রিটের অফিস থেকে রওনা দিলেন। যার কিছু পরেই লালবাজার থেকে স্টার্ট নিল ডিসি ডিডি-র গাড়ি।

গন্তব্য? কোথায় আর, কালীঘাট।

.

ন’বছর আগের মামলা। মঞ্জু ঘোষাল হত্যারহস্য। কালীঘাট থানা, কেস নম্বর ১৮৬, তারিখ ৬ নভেম্বর, ২০০৯। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪/৩৯৪ ধারায়। খুন, একই অপরাধের উদ্দেশ্যে একাধিকের সম্মিলিত পরিকল্পনা এবং লুঠের উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত আঘাত।

১, নেপাল ভট্টাচার্য স্ট্রিট। কালীঘাট থানা থেকে গাড়িতে মিনিট দুই-তিনের দূরত্বে। রাসবিহারী মোড় থেকে পশ্চিমদিকে কিছুটা এগিয়েই ডান হাতে পড়বে সদানন্দ রোড। সেই রাস্তা ধরে সামান্য এগিয়েই বাঁ দিকে পাবেন নেপাল ভট্টাচার্য স্ট্রিট। বাদামতলা আষাঢ় সংঘের পুজোটা যে জায়গায় হয়, তার দশ-বিশ মিটারের মধ্যেই অকুস্থল।

একই ঠিকানাতে দুটো বাড়ি পাশাপাশি। দুটোই চারতলা। বাড়ি দুটোতে ভাড়াটিয়া হিসেবে ৩২টি পরিবারের বাস। একটাই বড় গেট ঢোকার।

মঞ্জু ঘোষাল যে ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন, সেটা দোতলায়। মঞ্জু এবং তাঁর স্বামী নারায়ণচন্দ্র ঘোষাল, দু’জনেই ডাক ও তার বিভাগের কর্মচারী ছিলেন। নারায়ণবাবু আটের দশকের শেষাশেষি চাকরি থেকে অবসর নেন। মঞ্জুও শারীরিক অসুস্থতার কারণে স্বেচ্ছাবসর নিয়েছিলেন ২০০৫ সালে।

ঘোষাল দম্পতির একমাত্র সন্তান, মানসী। ডাক নাম বুলা। সম্বন্ধ করে মানসীর বিয়ে হয়েছিল ১৯৯৯-তে। সিঁথির বাসিন্দা দীপঙ্কর মিত্রের সঙ্গে। মানসী-দীপঙ্করের বিয়ের মাস দেড়েকের মধ্যেই মৃত্যু হয় নারায়ণবাবুর। সেই থেকে মঞ্জু একাই থাকতেন দোতলার ওই ফ্ল্যাটে। যেখানে দিনদুপুরে কে বা কারা এসে কুপিয়ে খুন করে গেল ষাট বছরের প্রৌঢ়াকে।

কৌতূহলী প্রতিবেশীদের ভিড় সরিয়ে ফ্ল্যাট সম্পূর্ণ খালি করে দিয়ে যা যা নজরে এল পুলিশের, জানানো যাক। মঞ্জু রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলেন উপুড় হয়ে। চিত করে দিয়ে দেখা গেল, গালে ছড়ে যাওয়ার দাগ। শরীরের দু’জায়গায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত। গলার নলি কাটা। রক্ত ঝরেছে প্রচুর। দ্বিতীয় ক্ষতচিহ্ন পেটে। ছুরি হোক বা ধারালো অন্য কিছু, আততায়ী বা আততায়ীরা সোজা ঢুকিয়ে দিয়েছিল পেটে। নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এসেছে। লাল-সাদা নাইটিটা রক্তধারায় প্রায় পুরোটাই লাল। সাদা রং খুঁজতে দূরবিন লাগবে।

মেঝেতে পড়ে প্লাস্টিকের চপ্পল একজোড়া, দৃশ্যতই মঞ্জুর রোজকার ব্যবহারের। চশমাটা পড়ে বিছানায়, বালিশের পাশে। বাড়ির ল্যান্ডফোনের রিসিভারটা মাটিতে পড়ে, তার ছেঁড়া। দুটো শোওয়ার ঘরই তছনছ অবস্থায়। বালিশ-বিছানা, আলনায় রাখা কাপড়চোপড়, প্লাস্টিকের ছোটখাটো ব্যাগ, কিছুই বাদ দেয়নি খুনি বা খুনিরা। হাতড়েছে সব।

যে বিছানায় মঞ্জুদেবীর মৃতদেহ পড়ে ছিল, তার পাশে স্টিলের আলমারি একটা। বন্ধ, কিন্তু চাবি ঘোরানোর জায়গায় একাধিক ‘টুলমার্ক’। চাবি না পেয়ে কোনও যন্ত্রপাতি দিয়ে খোলার চেষ্টা করলে যেমন দাগ হয়। খুনের পর যে ফ্ল্যাটের যেখানে যা টাকাপয়সা-গয়নাগাটি আছে, হাতানোর মরিয়া চেষ্টা হয়েছিল, বুঝতে ফেলুদা বা ব্যোমকেশ হওয়ার দরকার নেই। ঝলকের দেখাই যথেষ্ট।

মঞ্জুর মৃতদেহ উদ্ধার হল যে ঘরে, সে ঘরেই একটা মাঝারি সাইজ়ের ডাইনিং টেবিল। যার উপর দুটো চায়ের কাপ। একটা স্টিলের, আরেকটা পোর্সেলিনের। চায়ের তলানি পড়ে আছে দুটো কাপেই। আর একটা বড় চায়ের কাপ পড়ে আছে মেঝেতে। হ্যান্ডলটা ভেঙে গেছে, পড়ে আছে কাপের পাশে। একটা নিশ্চয়ই মঞ্জুর, অন্য দুটো? খুনি এক নয়, দু’জন?

বাথরুমের ভিতরটা দেখা হল। অস্বাভাবিক কিছু নেই। দেখা হল রান্নাঘরও। সিঙ্কে কিছু থালাবাসন পড়ে আছে। কাপ-প্লেট-বাটি-চামচ-বয়াম রাখা আছে কিচেনের তাকে, যেমন থাকে যে-কোনও মধ্যবিত্ত বাড়িতে। সবজি পড়ে আছে ঝুড়িভরতি।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা ঘুরে দেখলেন ফ্ল্যাটের প্রতিটি ইঞ্চি-সেন্টিমিটার-মিলিমিটার। আঙুলের ছাপ পাওয়া গেল দুটো জায়গায়। স্টিলের আলমারিতে, আর ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা দুটো চায়ের কাপে। তৈরি হল ‘seizure list’, বাজেয়াপ্ত করা জিনিসের তালিকায় থাকল মঞ্জুদেবীর বিছানায় লাগা রক্তের ছোপের নমুনা, রক্তমাখা বিছানার চাদর ও বালিশের কভার, নীল রংয়ের একটা ক্যারিব্যাগ রক্তমাখা, আঙুলের ছাপ সহ দুটো চায়ের কাপ, মাটিতে পড়ে থাকা কাপ এবং তার ভাঙা হ্যান্ডল।

ততক্ষণে এসে পৌঁছেছে গোয়েন্দাবিভাগের CD Van (Corpse Disposal), বিশেষ শববাহী গাড়ি। ময়নাতদন্তে পাঠানোর জন্য যখন নীচে নামানো হচ্ছে মঞ্জুদেবীর নিথর দেহ, স্থানীয় মানুষের ভিড়ে থিকথিক নেপাল ভট্টাচার্য স্ট্রিট। গাড়িতে তুলে ‘বডি’ বার করতেই কালঘাম ছুটে গেল পুলিশের। ডিসি সাউথ আর ডিসি ডিডি নীচে নামতেই ধেয়ে এল ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কয়েক ডজন বুম।

—খুনের কারণ কিছু জানা গেল?

—আপনারা কি পরিচিত কাউকে সন্দেহ করছেন?

—সকালবেলা এভাবে একজন বয়স্ক মহিলা খুন হয়ে গেলেন, এটা কি শহরে নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষায় কলকাতা পুলিশের ব্যর্থতা নয়?

—ফরেনসিক এক্সপার্টরা কী বললেন?

—সিপি কি স্পট ভিজিটে আসবেন?

প্রশ্ন ঝাঁকে ঝাঁকে। একে অন্যকে শেষ করার সুযোগ না দিয়েই। ডিসি ডিডি শান্ত ভাবে বললেন, ‘তদন্ত সবে শুরু হয়েছে। খুনের কিনারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করার চেষ্টা করব আমরা। সমস্ত সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখা হবে।’

ডিসি সাউথ যোগ করলেন, ‘একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে শহরের নাগরিকদের নিরাপত্তায় কলকাতা পুলিশ ব্যর্থ, এই ধারণা করা অতি সরলীকরণ হবে বলে আমাদের মনে হয়।’

এটুকুই যথেষ্ট ছিল। শুরু হয়ে যায় ‘লাইভ’ সম্প্রচার, কালীঘাট থেকে অমুকের সঙ্গে ক্যামেরায় তমুক।

‘আপনারা শুনলেন, কালীঘাটে প্রৌঢ়ার নৃশংস খুনকে স্রেফ ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে দায় এড়ালেন ডিসি সাউথ। কিন্তু স্থানীয় মানুষ এই ঘটনায় চূড়ান্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন শহরের বয়স্কদের নিরাপত্তা নিয়ে। থানার এত কাছে দিনদুপুরে ঘটে যাওয়া এই খুনে প্রশ্ন উঠছে কালীঘাট থানার ভূমিকা নিয়েও। আমরা এখন শুনে নেব, স্থানীয় বাসিন্দারা ঠিক কতটা আতঙ্কগ্রস্ত… আচ্ছা…আপনি তো এখানেই থাকেন… এভাবে দিনের বেলায় এই নৃশংস খুন…’

মিডিয়া মিডিয়ার কাজ করছিল। পুলিশ পুলিশের। যখন ফ্ল্যাটের ভিতরটা সরেজমিনে দেখছিলেন পুলিশকর্তারা-ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা, প্রাথমিক বিবরণ ফোনে শুনে নিয়েই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন নগরপাল। কেসটা ডিডি করবে। তদন্তের দায়িত্ব পড়েছিল হোমিসাইড শাখার তরুণ সাব-ইনস্পেকটর মলয়কুমার দত্তর উপর।

.

তথ্যসংগ্রহের প্রাথমিক কাজকর্ম সেরে মলয় যখন বেরলেন বাড়ি ফেরার জন্য, রাত সাড়ে ন’টা বেজে গেছে প্রায়। তিন-চারটে তো নয়, ৩২টা ফ্ল্যাট। সব মিলিয়ে একশোর উপর বাসিন্দা। প্রত্যেকের ঠিকুজিকুষ্ঠি জোগাড় করতেই তো ঘণ্টা তিনেক চলে গেল। তা-ও শেষ হয়নি পুরোটা। বাকি আছে আরও। কে কী করেন, ঘটনার সময় কোথায় ছিলেন, কার মোবাইল নম্বর কত, খুঁটিয়ে জানতে আরও একটা দিন লাগবে।

তবে দিন একেবারে নিষ্ফলাও যায়নি। খুনটা যে পরিচিত বা পরিচিতরাই করেছে, এবং উদ্দেশ্য যে ছিল টাকাপয়সা-গয়নাগাটি লুঠপাট, সেটা মোটামুটি ধরা যেতেই পারে। এখনও ‘মোটামুটি’, কারণ এক শতাংশ সম্ভাবনা এসব ক্ষেত্রে থাকেই, খুনটা হল সম্পূর্ণ অন্য কারণে, কিন্তু পুলিশকে ‘মিসলিড’ করতে চেহারা দেওয়া হল লুঠপাটের। তেমন কিছু তো এখনও মনে হচ্ছে না, ফিরতে ফিরতে ভাবেন মলয়। যা যা জানা গেল আজ দিনভর জিজ্ঞাসাবাদে, মনে মনে ঝালিয়ে নেন একবার।

ডলি রায়, যিনি আবিষ্কার করেন মৃতদেহ, মঞ্জুর ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশিনী ছিলেন। দু’জনে ছিলেন প্রায় সমবয়সিই। এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিলেন দু’জনে, যে দুই পরিবারের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য আলাদা কলিংবেল ছিল দুটো ফ্ল্যাটেই। আলাদা বেল, আলাদা আওয়াজ।

মঞ্জু বছর পাঁচেক ধরে নানা রোগে ভুগছিলেন। ব্লাডপ্রেসারের দোসর হয়েছিল ব্লাডসুগার। বছরখানেক হল ব্যাধির তালিকায় নতুন সংযোজন হয়েছিল আর্থারাইটিস। হাঁটুর ব্যথায় কাবু হয়ে থাকতেন বছরভর।

বাড়ির বাইরে বেরতেন মাসে একবারই। রিকশা করে ব্যাংকে যেতেন পেনশনের টাকা তুলতে। ব্যস, ওই একবারই। বাকি সময় ঘরেই। মাসকাবারি বাজার করে দিয়ে যেতেন মেয়ে মানসী বা জামাই দীপঙ্কর। রোজকার বাজারহাট আর টুকটাক কেনাকাটা, যখন প্রয়োজন হত, করে দিতেন প্রতিবেশীরাই। দিনে অন্তত দু’বার ডলি নিয়ম করে মঞ্জুর ফ্ল্যাটে আসতেন। ডলির থেকে আরও জানা গেল, মঞ্জু বাড়িতে সবসময় গলায় সোনার চেন পরে থাকতেন। আর হাতে সোনার চুড়ি। যা পাওয়া যায়নি মৃতদেহে। নিয়ে গেছে আততায়ীরা।

—কিছু দরকার হলে, বা এমনিই গল্প করার ইচ্ছে হলে মঞ্জুদি কলিংবেল বাজাত আমাদের ফ্ল্যাটে। যখন আমার যাওয়ার হত মঞ্জুদির ফ্ল্যাটে, আমিও বেল বাজাতাম উপর থেকে। মঞ্জুদি দরজা খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত দরজার মুখটায়। অপরিচিত কাউকে এমনিতে দরজা খুলতই না। ভিতর থেকে হাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করত, ‘কে? কী দরকার?’ চেনা কেউ এসেছে, একশোভাগ নিশ্চিত হয়ে তবেই খুলত।

—আজও উপর থেকে বেল বাজিয়ে নীচে এসেছিলেন?

—হ্যাঁ, ওটা অভ্যেস হয়ে গেছে আমাদের। মঞ্জুদির হাঁটুর ব্যথা শুরু হওয়ার পর থেকেই ওই ব্যবস্থা। রোজ সকালে এগারোটা নাগাদ নীচে আসতাম জর্দা আর সেদিনের ‘আনন্দবাজার’ কাগজটা নিয়ে। আজও বেল বাজালাম। নীচে এলাম, দেখি দরজা বন্ধ। ডাকলাম, সাড়া দিল না। দরজা ঠেললাম একটু পরে। খুলে গেল। ঢুকে দেখি এই কাণ্ড….।

হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেন ডলি।

আতঙ্কের ঘোর কাটার পর স্বামী শেখরকে উপর থেকে ডেকে এনেছিলেন ডলি। শেখর রায়, বয়স সত্তরের উপর। রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। শেখর স্নেহ করতেন মঞ্জুকে, ডাকতেন ‘মা’ বলে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এমন কোনও তথ্য পাওয়া গেল না, যা ডলি জানাননি পুলিশকে।

ডলি-শেখরের একমাত্র সন্তান সুমিত। বয়স সবে চল্লিশ পেরিয়েছে। অবিবাহিত। নেপাল ভট্টাচার্য লেনেই একটা ট্র্যাভেল এজেন্সির অফিস চালান। সুমিত রায়ের বয়ান অনুযায়ী, পৌনে দশটা নাগাদ রোজকার মতো অফিসে বেরিয়েছিলেন পায়ে হেঁটে। সাড়ে এগারোটা নাগাদ বাড়ি থেকে ফোন পান, মঞ্জুদেবী খুন হয়ে গেছেন। তড়িঘড়ি ফিরে আসেন।

আর একটি তথ্য দিলেন সুমিত। আন্দাজ সাড়ে ন’টা নাগাদ এক যুবক বেল বাজিয়েছিল তাঁদের তিনতলার ফ্ল্যাটে। বলেছিল, আনন্দবাজার পত্রিকার মার্কেটিং বিভাগের কর্মী। আনন্দবাজার এবং টেলিগ্রাফের দৈনিক গ্রাহক হওয়ার ‘কম্বো অফার’ নিতে আগ্রহী কিনা, জানতে চেয়েছিল। সুমিত আগ্রহ দেখাননি। যুবক উঠে গিয়েছিল চারতলায়।

চারতলায় কোথায় গিয়েছিল? ভরদ্বাজ পরিবারের ফ্ল্যাটে। স্ত্রী-কন্যা নিয়ে দীর্ঘদিন এই ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন ওমপ্রকাশ ভরদ্বাজ। ব্যবসা করেন। স্ত্রীর নাম মধুবালা। একমাত্র কন্যা প্রীতির বয়স একুশ। কস্টিং পড়ার পাশাপাশি চাকরি করেন সল্টলেকের একটি বিপিও-তে। প্রীতি জানালেন, আনন্দবাজারের ওই কর্মী তাঁদের ফ্ল্যাটেও গিয়েছিল। ‘কম্বো অফার’ নিতে রাজি হয়েছিলেন প্রীতিরা। ফর্মে সই করে রিসিট দিয়ে গেছে যুবকটি। নিজের নাম আর ফোন নম্বরও লিখে দিয়েছে রিসিটের পিছনে। কী নাম? শুভঙ্কর দে।

ফোনে সঙ্গে সঙ্গেই শুভঙ্করকে ধরেছিলেন মলয়। বিকেল চারটে নাগাদ। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই আনন্দবাজারের প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের অফিস থেকে কালীঘাটে চলে এসেছিলেন বাইশ বছরের শুভঙ্কর। মিনিট পনেরো কথা বলেই মলয় বুঝেছিলেন, ছেলেটি সত্যিই মার্কেটিং-এর কাজে এসেছিল। কোথাও কোনও গণ্ডগোল নেই। একটাই জিনিস শুধু জানার ছিল।

—যখন উঠছেন সিঁড়ি দিয়ে, বা নেমে আসছেন, কাউকে উঠতে বা নেমে যেতে দেখেছিলেন? মনে করে দেখুন…।

একটু ভাবেন শুভঙ্কর।

—না স্যার, অত খেয়াল করিনি। আমি ফোনে কয়েকটা এসএমএস চেক করতে করতে উঠছিলাম। খেয়াল করিনি।

—তবু মনে করে দেখুন না একটু…

শুভঙ্কর হাসেন।

—ভাল করে দেখলে তবে তো মনে থাকবে। দেখিইনি তো খেয়াল করে। এখন কিছু বলতে গেলে বানিয়ে বলতে হবে স্যার।

সূত্রের খোঁজে মরিয়া মলয় তবু প্রশ্ন করেন।

—যখন দোতলা থেকে তিনতলায় উঠছেন, দোতলার দরজা খোলা ছিল?

—না, বন্ধ ছিল। আমি তো দোতলাতেও বেল বাজিয়েছিলাম। মিনিট খানেক অপেক্ষা করেছিলাম। কেউ খোলেনি দরজা। তারপর তিনতলায় উঠে গিয়েছিলাম।

—সময় তখন আন্দাজ ক’টা হবে?

—এই সাড়ে ন’টার আশেপাশে হবে।

—যখন নেমে আসছিলেন, তখনও বন্ধ ছিল দোতলার দরজা?

শুভঙ্কর সামান্য হেসে ফেলেন এবার।

—খেয়াল করিনি এত স্যার।

এঁকে আর জিজ্ঞাসা করে নতুন কিছু পাওয়ার নেই। বরং জানা দরকার, কার কার রোজ মঞ্জুদেবীর ঘরে ঢোকার প্রবেশাধিকার ছিল। উত্তর পাওয়া গেল মানসী মৈত্রর কাছে। মৃতার একমাত্র সন্তান। যিনি কেঁদেই চলেছেন মায়ের ফ্ল্যাটে চলে আসার পর থেকে। সান্ত্বনা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন স্বামী দীপঙ্কর।

কান্নাভেজা গলায় যতটুকু বললেন সদ্য মাতৃহারা মানসী, মোটামুটি এই।

—মা একা থাকত বলে খুব সতর্ক ছিল অচেনা লোককে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়ার ব্যাপারে। আমিও মা-কে সাবধান করতাম নিয়মিত। একা মানুষ থাকে। কখন কী হয় বলা যায়?

—ওঁর বাজারহাট-টাট… এসব কি আপনিই…

—হ্যাঁ, সপ্তাহে একবার আমি এসে করে দিয়ে যেতাম। আমি না পারলে আমার স্বামী আসতেন। সপ্তাহের বাজার, ওষুধপত্র, এই সব। বাকি ডলি কাকিমারা দেখে নিতেন হঠাৎ কিছু দরকার হলে। আর উষাদি তো ছিলই।

‘উষাদি’ বলতে ‘উষারানি দেবী’। আটপৌরে মলিন শাড়ির পঞ্চাশোর্ধ্বা মহিলা, যিনি ফ্ল্যাটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন ঠায়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছেন। উষারানি এ বাড়িতে ঠিকের কাজ করছেন প্রায় বছর দশেক হল। এই আবাসনের আরও তিনটে ফ্ল্যাটেও কাজ করেন। বাড়ি ক্যানিংয়ে। রোজ সকালের ট্রেনে আসেন কলকাতায়। মঞ্জুর ফ্ল্যাটে সাতটা-সাড়ে সাতটায় ঢুকে ঝাড়পোঁছ করে অন্য ফ্ল্যাটগুলোর কাজ সারেন। দুপুরে ফের মঞ্জুর ফ্ল্যাটে চলে এসে কাপড় কাচা, বাসন মাজা, একটু রান্নাবান্না, টুকটাক ফাইফরমাশ খাটা, এবং বিকেলের ট্রেনে বাড়ি ফেরা। মঞ্জুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন।

—‘মা’ আমাকে মেয়ের মতই ভালবাসতেন…

—আর কে আসত? কাজের লোক আর কেউ ছিল?

—‌হ্যাঁ স্যার, জগদীশ।

—কে জগদীশ?

জগদীশ যাদব। সুইপার, তিরিশ বছর বয়স। রোজ আটটার মধ্যে চলে এসে সাফসুতরো করে যেতেন বাথরুম। তারপর যেতেন আরও কয়েকটা ফ্ল্যাটে।

জগদীশ থাকেন কাছেই, চেতলার লকগেটের কাছে। বাড়িতেই ছিলেন। খবর পাঠাতেই এলেন শক্তপোক্ত চেহারার যুবক। কালো গেঞ্জি আর নীলরঙা বারমুডা পরিহিত জগদীশ জানালেন, যতক্ষণ ছিলেন মঞ্জুর ফ্ল্যাটে, অস্বাভাবিক কিছু দেখেননি।

—আমি আটটায় ঢুকেছিলাম রোজকার মতো। বেরিয়েছিলাম সোয়া আটটা নাগাদ। উষাদি তখন ঘর ঝাঁট দিচ্ছিল।

মলয় তাকান উষার দিকে। উষা ঘাড় নাড়েন, জগদীশ মিথ্যে বলছে না। আরও দুটো প্রশ্ন ছিল মলয়ের।

—অন্য ফ্ল্যাটগুলোর কাজ সেরে কখন বেরিয়েছিলেন?

—এই স্যার, দশটার কাছাকাছি হবে। পাঁচ-দশ মিনিট এদিক-ওদিক হতে পারে।

—হুঁ, বাড়ি কোথায় আপনার?

—বিহার স্যার। ছাপড়া। বছর সাতেক আগে কলকাতায় এসেছি পেট চালাতে।

এতগুলো ফ্ল্যাট, বাসিন্দাদের সবার ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজখবর নিতেই কেটে গেল আরও দিনদুয়েক। স্বাভাবিক নিয়মে ওই চারতলা বাড়িতে কার কখন প্রবেশাধিকার ছিল, জানা জরুরি ছিল। কোন ফ্ল্যাটে কে কাগজ দিত, কোন ফ্ল্যাটে কে সুইপারের কাজ করত, ঠিকে কাজের লোক কে ছিল কাদের বাড়িতে, কোন দুধওয়ালা সকালে আসত দুধ দিতে, কেবল অপারেটর কারা কারা আসত ফ্ল্যাটবাড়িতে, এই সব।

তথ্য সংগ্রহের এই কাজটা যে কী পরিমাণে ‘শুষ্কং কাষ্ঠং’ হতে পারে, সেটা তদন্তকারী অফিসার মাত্রই জানেন হাড়েহাড়ে। অপরাধটা করেছে হয়তো এক বা দু’জন বা তিন। তদন্তের চূড়ান্ত পর্বে হয়তো সন্দেহভাজনের সংখ্যা দাঁড়াবে বড়জোর পাঁচ কিংবা ছয়ে, তবু কমপক্ষে পঞ্চাশ-ষাট জনকে একই প্রশ্ন করে যেতে হয়। যাঁকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, তাঁর খুনের সঙ্গে কোনও যোগ থাকার সম্ভাবনা শূন্য, এটা জেনেও। এটা জেনেও, বাড়তি কোনও তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনাও হয়তো শূন্যেরই কাছাকাছি।

উদ্দেশ্য একটাই। ‘Process of elimination’, দুধের থেকে জলটা আলাদা করা। অপ্রয়োজনীয় তথ্য একটা একটা করে ছেঁটে ফেলা। মাঠটাকে ছোট করে আনা।

এই আলাদা করার প্রক্রিয়ায় বিস্তর খাটাখাটনি করলেন মলয়। একতলায়, গেট দিয়ে ঠিক ঢোকার মুখে ‘ইলেকট্রোক্রাফট’ বলে একটা দোকান ছিল। ইলেকট্রিক্যাল সরঞ্জামের যে দোকান রোজ সকাল সাড়ে আটটায় ঝাঁপি খুলত, সেই দোকানের সমস্ত কর্মচারীর সঙ্গে কথা বললেন মলয়। পাশেই পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান ছিল একটা। সেখানেও তথ্যতালাশ। রোজকার চেনামুখের বাইরে অন্য কাউকে ঢুকতে দেখছিলেন? কেউই মনে করতে পারলেন না বলার মতো কিছু।

কী করেই বা পারবেন? ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে, খুনটা হয়েছে ন’টা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে। এমন একটা সময়ে, যখন বাসিন্দারা কাজে বেরচ্ছেন একের পর এক। কাজের লোকদের যাতায়াতও লেগেই আছে। রোজকার সকাল-সন্ধে-দুপুর-বিকেল কে আর অত মনে রাখে আলাদা করে, কে-ই বা খেয়াল করে খুঁটিয়ে?

.

—কী দাঁড়াচ্ছে তা হলে?

মলয়কে প্রশ্ন করেন ওসি হোমিসাইড। লালবাজারের গোয়েন্দাবিভাগে পর্যালোচনা চলছে মামলার অগ্রগতির। দিন সাতেক পেরিয়ে গেছে খুনের পর। ‘ক্লু’ বা ‘লিড’ এখনও অধরা।

—স্যার, পসিবল সাসপেক্টদের একটা লিস্ট করেছি। তবে এর বাইরেও হতে পারে অন্য কেউ।

—শুনি।

—এক নম্বরে সুমিত রায়। ডলি-শেখরের ছেলে। আমি খোঁজ নিয়েছি স্যার। ওই ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা মোটেই ভাল চলছিল না। টাকার দরকার ছিলই।

—‘মোটিভ’ বুঝলাম, কিন্তু ‘অ্যালিবাই’?

—আছে, তবে দুর্ভেদ্য কিছু নয়। বলেছেন, পৌনে দশটা নাগাদ অফিস গেছিলেন। সেটা সত্যিই বলেছেন, ভেরিফাই করেছি। কিন্তু সময়টা ভাবুন স্যার। খুনটা হয়েছে সকাল ন’টা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে। সুমিতবাবু অফিস যাওয়ার পথে কাজটা করে রোজকার মতো বেরিয়ে গেছেন, একেবারে অসম্ভব নয়।

—অসম্ভব নয়….

—আরও একটা জিনিস স্যার, খুনটা যে পরিচিত কেউ করেছে এটা তো পরিষ্কার। যদি দুটো চায়ের কাপ থেকে ধরে নিই, আততায়ী দু’জন ছিল, তা হলেও দু’জনের একজনকে পরিচিত হতেই হবে। না হলে দরজা খুলতেন না মঞ্জুদেবী।

—বুঝলাম, কিন্তু…

—বলছি স্যার। একটা ব্যাপার মাথায় রাখা দরকার, ডলির ফ্ল্যাটের আলাদা কলিংবেলটা, যা দিয়ে মঞ্জুর ফ্ল্যাটের বেল বাজানো যায়, সেটা কিন্তু ইচ্ছে করলেই সুমিতও বাজাতে পারতেন। অ্যাকসেস ছিল।

—হুঁ!

—ধরুন স্যার, উনি বেলটা বাজালেন অফিস বেরনোর আগে। মঞ্জু এসে দাঁড়ালেন দরজার বাইরে। অন্য কাউকে, সে ফ্ল্যাটেরই হোক বা অন্য কোনও লোক, হয়তো আগে থেকে সুমিত বলে রেখেছিলেন। সে-ও ওই সময়ে ঢুকল বাড়িতে। উঠল দোতলায়। সুমিত নেমে এলেন। মঞ্জুকে হয়তো কোনও দরকারি কথার ব্যাপারে বললেন। সঙ্গের বন্ধুকেও ডেকে নিলেন, চা খাওয়ার পর দু’জনে মিলে খুনটা করলেন।

—থিয়োরেটিকালি অসম্ভব নয়, প্র্যাকটিক্যালিও হয়তো নয়, হতেই পারে। আর, সুমিত এবং তার সঙ্গী করেছে বলে ধরে নেওয়াটাও ঠিক নয়, হয়তো করিয়েছে। ভাড়াটে লোক দিয়ে। যারা অপেক্ষায় ছিল নীচে। নির্দিষ্ট সময় বলা ছিল। যারা সময়মতো উঠে এসে বেল বাজিয়েছে। আর মঞ্জু কিছু বোঝার আগেই সুমিত ভিতর থেকে খুলে দিয়েছেন দরজা, এবং খুলে দিয়ে বেরিয়ে গেছেন সঙ্গীকে নিয়ে, ভাড়াটে খুনিরা ‘অ্যাকশন’ করে বেরিয়ে গেছে।

—পসিবল স্যার…

—কিন্তু সুমিতই হোক বা অন্য কেউ, লাভ তো কিছু হল না। ওই তো কয়েকটা গয়না, যা পরে থাকতেন। বেচে বড়জোর দশ হাজার। আর ব্যাগে ট্যাগে হয়তো কিছু টাকা ছিল। সেটা নিয়ে গেছে। কতই বা হবে? হাজার দুই-তিন খুব বেশি হলে। তার বেশি টাকা তো বাইরে থাকার কথা নয়।

—সেটা অপরাধীদের ব্যাড লাক স্যার। ভদ্রমহিলা এবং ওঁর স্বামী, দু’জনেই সরকারি চাকরি করেছেন দীর্ঘদিন। টাকাপয়সার অভাব ছিল না। যে কেউ ভাববে, আলমারি ভাঙতে পারলে ভালই আমদানি হবে। আলমারির চাবি মঞ্জু রাখতেন রান্নাঘরে একটা শিশির মধ্যে। ওটা খুঁজে পায়নি খুনিরা।

—হুঁ।

—সাসপেক্ট নাম্বার টু, জগদীশ। সুইপার। পেটানো চেহারা।

ওসি হোমিসাইড হেসে ফেলেন।

—মলয়, চেহারা গুন্ডার মতো হলেই যে গুন্ডা হতে হবে, এমন কথা নেই কিন্তু।

মলয়ও মৃদু হেসেই উত্তর দেন।

—সে তো জানি স্যার। কিন্তু এর ক্ষেত্রেও ওই ফ্যাক্টর দুটো অ্যাপ্লিকেবল। টাকা এবং পরিচিত হিসেবে প্রবেশাধিকার।

—কিন্তু উষা তো বলছেন, কাজ সেরে বেরিয়ে গিয়েছিল জগদীশ!

—উষা বেরিয়ে যাওয়ার পর ফিরে আসেনি কাউকে নিয়ে, কী গ্যারান্টি আছে?

—হ্যাঁ, কিন্তু সুইপারকে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে চা খাওয়ায় কেউ?

—রাইট স্যার, ওখানেই খটকা।

—ব্যাক গ্রাউন্ড চেক করেছ জগদীশের?

—করেছি স্যার। বলার মতো কিছু পাইনি। রাত্রে মদ-টদ খায়, এই পর্যন্ত। ক্রিমিনাল রেকর্ড কিছু নেই। লোক লাগানো আছে। টাকা ওড়াচ্ছে কিনা, খবর রাখতে বলেছি।

ওসি হোমিসাইড বুঝতে পারেন দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায়, মলয় দিনরাত খাটছে ঠিকই, কিন্তু তদন্ত এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে সম্ভাব্যতার গণ্ডিতে। নির্দিষ্ট ‘ক্লু’ এখনও নেই। নেই প্রমাণ।

—আর কোনও সাসপেক্ট?

—সে-অর্থে সাসপেক্ট বলব না স্যার, কিন্তু মঞ্জুদেবীর জামাই দীপঙ্করের আর্থিক অবস্থাও যে খুব ভাল ছিল এমন নয়। আরও খোঁজ নিচ্ছি স্যার। ক্লিন চিট দেওয়ার জায়গায় কেউই নেই।

—গুড। আমরা যখন ট্রেনিং-এ ছিলাম, কী বলা হত জানো? তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। ‘Believe nobody, trust nobody’। সব কিছু বারবার যাচাই করে তবেই বিশ্বাসের প্রশ্ন, সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার প্রশ্ন। সে যে-ই হোক না কেন। মৃতের মা-বাবাই হোক বা স্ত্রী-পুত্র, বা মেয়ে-জামাই। আচ্ছা, হোয়াট অ্যাবাউট ভরদ্বাজ ফ্যামিলি? যারা চারতলায় থাকত?

—মিস্টার ভরদ্বাজের ব্যবসা সংক্রান্ত কোনও আর্থিক সমস্যা ছিল না। মধুবালার সঙ্গে, আই মিন মিসেস ভরদ্বাজের সঙ্গে মঞ্জুদেবীর সুসম্পর্ক ছিল। ওঁদের মেয়ে প্রীতিকে মঞ্জু খুবই ভালবাসতেন। প্রতি পুজোয় জামাকাপড় কিনে দিতেন। ঘটনার সঙ্গে এই ফ্যামিলির কোনওরকম ইনভলভমেন্টের সম্ভাবনা দেখছি না। অন্তত এখনও পর্যন্ত।

—বেশ …

—রইল বাকি উষারানি। ট্র্যাক রাখছি মহিলার। মঞ্জুদেবীর মেয়ে মানসীকে আলাদা করে জিজ্ঞেস করেছি উষারানির ব্যাপারে।

—কী বললেন?

—বললেন, ‘উষাদিকে দশ বছর ধরে দেখছি। নিজের মায়ের মতো ভালবাসত মা-কে। আমাকে ভালবাসে মেয়ের মতো। এর সঙ্গে উষাদি জড়িত, দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারি না। উষাদি আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে গেছিলেন।’

—হুঁ… উষার বাড়িতে কে কে আছেন?

—স্বামী মারা গেছেন। একা থাকেন ক্যানিং-এ। এক মেয়ে। বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই।

—সোর্সকে তবু বলে রেখো।

—বলেছি স্যার। এমন তো কতই হয়, দীর্ঘদিনের কাজের লোক বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে বাইরে কাউকে খবর দিয়ে দিল…

—হ্যাঁ, ভেরি কমন। ট্র্যাক রাখো।

—ইয়েস স্যার।

মলয় উঠে পড়ার মুখে থামান ওসি হোমিসাইড।

—আর হ্যাঁ, ইলেকট্রনিক সারভেল্যান্স…কাউকে বাদ দিয়ো না কিন্তু… সে যে-ই হোক… কাউকেই না…

—ওটা চলছে স্যার। ফ্ল্যাটের সমস্ত বাসিন্দাদের কল ডিটেল রেকর্ডস চেয়েছি। কে কার সঙ্গে কখন কথা বলেছে বা বলছে, আপডেট রাখছি।

.

পরের দিন বিকেল। হন্তদন্ত হয়ে মলয় ঘরে ঢুকলেন গোয়েন্দাপ্রধানের। হাতে ‘কল ডিটেলস’-এর শিট একটা।

—স্যার, এই দেখুন!

—কী হল মলয়?

মলয় ‘কল ডিটেলস’-এর একটা পাতা মেলে ধরেন।

—গত রাতে সুমিত রায় একজন অ্যাডভোকেটের সঙ্গে কথা বলেছে। মোস্ট প্রবাবলি অ্যান্টিসিপেটরি বেল মুভ করবে কাল-পরশুর মধ্যে।

গোয়েন্দাপ্রধান নড়েচড়ে বসেন।

—কী করে বুঝছ, অ্যান্টিসিপেটরি বেল মুভ করবে?

—অ্যাডভোকেটের নম্বর তো কল রেকর্ডসেই আছে। একটু আগে ফোনে কথা বললাম ওঁর সঙ্গে। আলিপুর কোর্টে প্র্যাকটিস করেন। উনিই বললেন।

—হুঁ, সুমিতকে নিয়ে এসো লালবাজারে। এখনই।

—রাইট স্যার।

‘ইন্টারোগেশন রুম’ বলতে সাধারণত যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, একটা আধো-অন্ধকার ঘর। সিলিং থেকে অল্প পাওয়ারের একটা বালব ঝুলছে। গা-ছমছমে একটা পরিবেশে সন্দেহভাজনকে হাড়হিমকরা গলায় জেরা করছেন অফিসার।

লালবাজারের ‘ইন্টারোগেশন রুম’-এ ওই ‘সিনেমায় যেমন হয়’ জাতীয় ব্যাপারই নেই কোনও। সাদামাটা ঘর, খুব বেশি হলে আট ফুট বাই ছয়। একটা টেবিল, যার দু’দিকে দুটো চেয়ার পাতার মতোই জায়গা আছে শুধু। একটায় তদন্তকারী অফিসার বসেন। উলটোদিকে সন্দেহভাজন।

পরিবেশ আপাতদৃষ্টিতে নিরীহই। কিন্তু যত সময় যায়, সন্দেহভাজনের পক্ষে ‘নিরীহ’ থাকে না আর তেমন। লালবাজারের একটা স্থানমাহাত্ম্য আছে। গোয়েন্দাবিভাগের তো আরও। একতলার প্রশস্ত প্রাঙ্গণে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের গাড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে চোখে পড়ছে পোশাকে বা প্লেন ড্রেসে পুলিশকর্মীদের ওঠানামা। চোখে পড়ছে বিভিন্ন শাখার বোর্ড। গুন্ডাদমন শাখা, ব্যাংক ফ্রড সেকশন, ডাকাতি-ছিনতাই দমন শাখা, হোমিসাইড… একটার পর একটা। হয়তো কোমরে দড়ি বেঁধে হাঁটিয়ে কোনও আসামিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে করিডর দিয়ে, কোনও নির্দিষ্ট ঘরে। যে আসামির চুপসে যাওয়া চোখমুখ দেখে মনে হবে, ঝড় নয়, শরীর-মনের উপর দিয়ে সুনামি বয়ে গেছে। মায়া হবে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম লোকেরও।

আবহটাই এমন, কোনওরকম বলপ্রয়োগ বা ‘আদরযত্ন’ ছাড়াই অধিকাংশের স্নায়ু বিদ্রোহ করতে শুরু করে, চোখে চোখ রেখে ওই একচিলতে ঘরে যখন প্রশ্নের পর প্রশ্ন ঠান্ডা গলায় ছুটে আসতে থাকে। কপালে স্বেদবিন্দু দেখা দেয়, ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরতে থাকা সত্ত্বেও। থানায় বা অন্যত্র জিজ্ঞাসাবাদে কিছুতেই চিড় ধরানো যায়নি রক্ষণে, অথচ লালবাজারে এসে পোড়খাওয়া অভিযুক্তের যাবতীয় প্রতিরোধ অদৃশ্য হয়ে গেছে একঘণ্টার জেরায়, এমন যে কত দেখেছি আমরা।

সুমিত রায়কে অবশ্য বিচলিত দেখাচ্ছিল না বিশেষ। মলয়ের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে।

—হ্যাঁ, কথা বলেছি অ্যাডভোকেটের সঙ্গে। গত সাতদিনে আপনারা পাঁচবার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। বাড়িতে দু’বার, থানায় ডেকে তিনবার। আমার ধারণা হয়েছে, আপনারা আমাকে অ্যারেস্ট করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাই উকিলের কাছে গিয়েছিলাম।

—আমরা তো অন্য অনেককেও একাধিকবার ডেকে কথা বলেছি। প্রয়োজনে আবার বলব। কারও মাথায় আগাম জামিনের কথা এল না, উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রয়োজন শুধু আপনারই হল? এর থেকে কী বোঝা যায় বলুন তো?

—কী?

—ঠাকুরঘরে কে জিজ্ঞেস করতে না করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন প্রমাণ করতে, আপনি কলা খাননি।

সুমিতকে একটুও প্রভাবিত দেখায় না মলয়ের খোঁচায়। চুপ করে থাকেন, এবং মলয় বলে যান একটানা।

—মোটিভ ছিল আপনার। ব্যবসা ভাল যাচ্ছিল না। ভেবেছিলেন মঞ্জুদেবীকে মেরে টাকাপয়সা পাবেন বিস্তর। কপাল মন্দ, অল্পই জুটল। বেলটা আপনিই বাজিয়েছিলেন, তারপর নেমে এসেছিলেন। ঘরে ঢুকে চা খেয়েছিলেন, তারপর বয়স্কা মহিলাকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছিলেন। ঠিক বলছি? শুধু সঙ্গে কে ছিল সেটা জানি না এখনও। আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই। বলুন, অনেক সময় আছে।

সুমিত নির্বিকার। থেমে থেমে উত্তর দেন।

—দেখুন মি. দত্ত, আপনি যা শুনতে চাইছেন, সেটাই বলব বলে যদি ভাবেন, ভুল ভাবছেন। আপনি যা যা বললেন, সেটা আপনার থিয়োরি, আপনার কল্পনা। খুনটা আমি করিনি। আগেও বলেছি, এখনও বলছি। প্রমাণ আছে কোনও? সারাদিন ধরে এখানে বসিয়ে রাখলেও একই কথা বলব। খুনটা করিনি আমি।

পুলিশ প্রশিক্ষণের সময় জেরার যা যা পদ্ধতি শেখানো হয়, সবই প্রয়োগ করলেন মলয় কয়েক ঘণ্টা ধরে। সুমিত ভাঙলেন না, মচকালেনও না। স্রেফ সন্দেহের বশে কাউকে খুনের মামলায় গ্রেফতার করা যায় না। হয় এমন প্রমাণ লাগে যা সন্দেহভাজনের সামনে ফেললে স্বীকারোক্তি আসা অবধারিত, নয় সোজাসাপটা স্বীকারোক্তি দরকার হয় জেরার মুখে। প্রমাণ সংগ্রহ পরে, বয়ান অনুযায়ী।

কোনওটাই হাতে নেই সুমিতের বিরুদ্ধে। গ্রেফতার করে আদালতে তুললে হাসির খোরাক হতে হবে। হতাশ লাগে মলয়ের। সুমিতকে অনুমতি দেন বাড়ি যাওয়ার।

—বেশ সুমিতবাবু, আজকের মতো এটুকুই। আবার ডাকতে হতে পারে আপনাকে। আপনার কথা বিশ্বাস করলাম, এমন ভাবার কারণ নেই, এটুকু বলে রাখলাম।

সুমিত উঠতে যাবেন, মলয় বসিয়ে দেন হাত ধরে।

—চা খেয়ে যান অন্তত। না হলে লালবাজারের বদনাম হবে। এতক্ষণ কথা বললাম, আর এক কাপ চা-ও অফার করলাম না!

লালবাজারের চায়ে বা সুনাম-বদনামে এতটুকু আগ্রহী দেখায় না সুমিতকে।

—নাহ, তার দরকার নেই। আমার এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে অনেক।

—আচ্ছা, চা নয়, জল তো এক গ্লাস খেয়ে যান। না হলে ওই যে কথায় বলে না, গৃহস্থের অকল্যাণ হয়।

সুমিতকে এইবার রাগত দেখায়। পুলিশের এই ‘গৃহস্থপনা’ অসহ্য ঠেকে। একে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই ছোট্ট ঘরে বসিয়ে চাপ দিচ্ছে, মুখের উপর ‘খুনি’ বলছে। তারপর ‘জল খেয়ে যান, চা খাবেন?’-এর ন্যাকামি। নেহাত এটা লালবাজার আর এই অকালপক্ব মলয় ছোকরাটা পুলিশ অফিসার। না হলে …।

কিছু বলতে গিয়েও সুমিত সংবরণ করেন নিজেকে। জলের গ্লাস এলে ঢকঢক করে খেয়ে বেরিয়ে যান।

এবং বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘সায়েন্টিফিক উইং’-এর অফিসারদের ডাকেন মলয়। গ্লাসে আঙুলের ছাপ পড়েছে সুমিতের। ‘ডেভেলপ’ করে মঞ্জুদেবীর ফ্ল্যাটে আলমারি আর চায়ের কাপে পাওয়া আঙুলের ছাপের সঙ্গে ‘ম্যাচ’ করানোর জন্য টিম রওনা হয়ে যায় ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে। ডিসি ডিডি ফোন করেন ল্যাবরেটরির ডিরেক্টরকে, ‘রিপোর্টটা একটু তাড়াতাড়ি পেলে ভাল হয়।’

তাড়াতাড়িই পাওয়া গেল, এবং মলয়কে হতাশায় ডুবিয়ে সেই রিপোর্ট জানাল, ‘ম্যাচ’ করেনি ফিঙ্গারপ্রিন্ট। মিলছে না সুমিতের আঙুলের ছাপ ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া ছাপের সঙ্গে।

এবার? অপরাধ স্বীকার করছেন না সুমিত। প্রমাণও হাতে নেই। আঙুলের ছাপও মিলল না। এবার? খুনটা তা হলে কে বা কারা করল? একদম অচেনা চোর-বদমাইশ কেউ? কিন্তু তা-ই বা হয় কী করে? সকালে কেউ করে এসব এভাবে? আর ঘুরেফিরে সেই পরিচিতির তত্ত্ব, অচেনা কাউকে দরজা খুলবেনই বা কেন মঞ্জু?

খুনটা তা হলে আনডিটেকটেড থেকে যাবে? দশ দিন হয়ে গেল। কিনারা করা গেল না, ‘এখনও অন্ধকারে পুলিশ’ জাতীয় স্টোরি তো প্রায় রোজই বেরচ্ছে খবরের কাগজে। অন্ধকারে আর কতদিন থাকতে হবে?

হতোদ্যম মলয় যখন বাড়ি ফিরছেন ১৮ নভেম্বরের রাতে, ভাবতেও পারেননি অন্ধকার কাটতে চলেছে দ্রুত। আলোর ফুলকি দেখতে পাবেন খুব শিগগিরই।

.

রুটি, আলু-গোবি, বেগুন ভর্তা।

অর্ডার দিয়ে অন্যমনস্ক বসে ছিলেন মলয়। বীরভূমে গ্রামের বাড়িতে শেষ গিয়েছেন প্রায় চার মাস হয়ে গেল। সেই জুলাইয়ে। পুজোয় ছুটিছাটার প্রশ্ন নেই। কিন্তু তারপরেও কাজের চাপে আর যাওয়া হল কই? বিজয়ার প্রণামটাও এখনও সারা হয়নি। ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দেবেন-দেবেন করছিলেন, তার মধ্যেই এই মহিলার খুন। এখন আর কিনারা হওয়ার আগে মুখ ফুটে বলাও যাবে না ছুটির কথা। এদিকে বাড়ি থেকে রোজই ফোন আসছে মা-বাবার, ‘কবে আসবি?’

আর আসা! সপ্তাহদুয়েক হতে চলল, তদন্ত আর এগোল কই? রোজ প্রায় একডজন সোর্সের সঙ্গে কথা বলছেন। মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। যা যা করা সম্ভব, করছেন সাধ্যমতো। অথচ না আছে ক্লু, না আছে কিছু।

খাবার এসে গেছে। চেতলার এক সোর্সের সঙ্গে দেখা করতে ভোর ভোর মলয় চলে এসেছিলেন কালীঘাট এলাকায়। তখনকার চা-টোস্ট হজম হয়ে গিয়ে এখন খিদে পেয়েছে বেজায়। রাসবিহারী মোড়ের ধাবায় ঢুকেছেন লাঞ্চ সারতে।

খাবার মুখে দিয়ে খিঁচড়ে থাকা মেজাজটা আরও খারাপ হয়ে যায় মলয়ের। একটা অদ্ভুত মশলা দেয় এরা এইসব ধাবাগুলোয়। সবজির স্বাভাবিক স্বাদটাই নষ্ট হয়ে যায়। বাড়ির রান্নার মতো হবে না ঠিকই, কিন্তু তা বলে এই?

—আর দুটো রুটি বলি?

ম্যানেজারের প্রশ্নের উত্তরে বিরক্তি লুকোতে পারেন না মলয়।

—আরে না মশাই, রান্নার যা ছিরি আপনাদের…

—কেন?

—সবজিটা খেয়ে দেখলেই বুঝবেন, কেন। কোনও স্বাদই নেই।

—কেন, সবজি তো ফ্রেশই ইউজ় করি আমরা।

ডিপার্টমেন্টে মলয় ঠান্ডা স্বভাবের ছেলে হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু সময় খারাপ গেলে যা হয়, স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই হঠাৎ মেজাজ হারালেন।

—আমি গ্রামের ছেলে মশাই। এখনও বাড়ি গেলে চাষের কাজে হাত লাগাই। আমাদের ভীমগড় বাজারের সবজি খেলে বুঝতে পারতেন, কোনটা টাটকা আর কোনটা নয়। ফ্রেশ সবজি চেনাবেন না আমাকে।

ম্যানেজার আর থাকতে পারেন না।

—কিছু মনে করবেন না। রান্নার এদিক-ওদিক হতে পারে, কিন্তু বাসি মাল আমাদের এখানে পাবেন না। এখানেও টাটকা সবজিই আসে। ক্যানিং থেকে, লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে, বজবজ থেকে। ট্রেনে করে এসে লোক দিয়ে যায়। আশেপাশের ভাতের হোটেলেও দেয়। অনেক বাড়িতেও দেয়।

মলয় আর কথা বাড়ান না। খারাপই লাগে একটু। সামান্য ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে খিটখিট না করলেই হত। বিল মিটিয়ে কাউন্টার থেকে মৌরি–মিছরি মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়েন। বাস্তুহারা বাজারে একজন সোর্স অপেক্ষা করছে।

কিছুটা হাঁটার পরই থমকে যান মলয়, মস্তিষ্কে হঠাৎই বিদ্যুৎঝলক। কী যেন বললেন ম্যানেজার ভদ্রলোক? ক্যানিং-লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে সবজি আসে? আর সেই সবজি আশেপাশের বাড়িতেও সাপ্লাই হয়? ক্যানিং… ক্যানিং… উষারানির বাড়ি তো ক্যানিং-এ। আর, খুনের দিন মঞ্জুদেবীর রান্নাঘরে ঝুড়িভরতি সবজি তো এখনও ভাসছে চোখের সামনে। তা হলে কি …

প্রায় ছুটেই ধাবায় ফেরেন মলয়। ম্যানেজার একটু অবাকই হন সামান্য হাঁফাতে থাকা মলয়কে দেখে।

মলয় বোঝেন, এবার আইডেন্টিটি কার্ডটা বার করা দরকার। লালবাজারের গোয়েন্দা, পরিচয় পেয়ে ম্যানেজারের ব্যবহার বদলে যায় নিমেষে। কেজো ভদ্রতার জায়গা নেয় সমীহ।

—কী ব্যাপার স্যার, কিছু ফেলে গেছেন?

—না, আচ্ছা ওই ক্যানিং-লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে সবজি আসে বলছিলেন না? ক্যানিং থেকে কারা আসে?

—এক-দু’জন নয় স্যার, পাঁচ-ছ’জন আসে। রোজ রোজ একই লোক তো আসে না। কোনওদিন দু’জন এল, কোনওদিন হয়তো তিন বা চার। কেন স্যার? কী ব্যাপার?

—ক্যানিং থেকে সবজি শেষ কবে এসেছিল এখানে?

—পরশু, বা তরশু হবে।

—তার আগে?

—তার আগে… তার আগে… সপ্তাহখানেক আগে বোধহয়… দাঁড়ান রেজিস্টারে তো লেখা থাকে কবে কোথাকার মাল ঢুকল।

—সপ্তাহখানেক আগে যারা সবজি দিয়ে গিয়েছিল, তাদের চেহারা মনে আছে?

—না স্যার, ডেলিভারি কর্মচারীরা নেয়, আমার তো কাউন্টারে বসেই কাটে বেশিরভাগ সময়টা…

—আপনি রেজিস্টারটা বের করে রাখুন, আমি আধঘণ্টার মধ্যে আসছি ঘুরে। ডেলিভারি যারা নেয়, তাদের সঙ্গে কথা বলব।

ম্যানেজার আঁচ করতে পারেন, গুরুতর কিছু একটা ব্যাপার আছে ক্যানিং-এর সবজি নিয়ে। জিজ্ঞেস করে ফেলেন, স্যার, শুধু ক্যানিং, না লক্ষ্মীকান্তপুর-বজবজও দেখে রাখব?

—আপাতত শুধু ক্যানিং। আসছি ঘুরে।

ঘুরে আর এলেন না মলয়। প্রয়োজন পড়ল না। উষারানিকে কালীঘাট থানায় ডেকে ফের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন সাড়ে চারটে নাগাদ। প্রাথমিক জেরায় উষা বলেছিলেন, এক মেয়ে তাঁর। বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই তেমন। এবারও একই কথা বললেন। কিন্তু মলয় এবার আর সেই ভুল করলেন না, যেটা প্রথমবার করেছিলেন। মঞ্জুদেবীর মেয়ে মানসী এককথায় উষারানিকে ‘ক্লিনচিট’ দেওয়ার পর সেভাবে আর গভীরে গিয়ে নাড়াচাড়া করেননি ওঁর পরিবারের দিকটা। এবার করলেন।

—কোথায় থাকে আপনার মেয়ে-জামাই?

—ক্যানিং লাইনেই থাকে। বারুইপুরের দিকে। গ্রামের নামটা জানি না।

—মেয়ের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় না?

—না স্যার, ন’মাসে ছ’মাসে একবার।

—শেষ কবে দেখা হয়েছিল?

—মাস ছয়েক আগে স্যার। টুম্পার, মানে আমার মেয়ের বাচ্চা হওয়ার সময়। বাচ্চাটা বাঁচেনি। হাসপাতালেই মারা গিয়েছিল।

মলয় আর দুটো প্রশ্ন করেন শুধু।

—জামাইয়ের নামটা বলুন। আর বাচ্চা হওয়ার সময় কোন হাসপাতালে ভরতি হয়েছিল টুম্পা?

—সুশীল সর্দার। ক্যানিং সদর হাসপাতাল।

সন্ধেয় আর বাড়ি ফেরা হয় না উষারানির। আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বসিয়ে রাখা হয় থানায়, মহিলা পুলিশের জিম্মায়।

বাড়ি ফেরা হয় না মলয়েরও। যাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল, ক্যানিং-কানেকশনেই লুকিয়ে আছে রহস্যের চাবিকাঠি। ওসি হোমিসাইডকে জানালেন সব। সাত-আটজন অফিসারের টিম পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছল কালীঘাট থানায় এবং রওনা দিল পত্রপাঠ। গন্তব্য, ক্যানিং সদর হাসপাতাল।

যেতে যেতেই মোবাইলে মানসীকে ধরলেন মলয়।

—মায়ের বাজার তো আপনিই করে দিতেন, না?

—হ্যাঁ, সপ্তাহে একবার। সাত-আটদিনের বাজার করে দিয়ে আসতাম। হয় আমি, নয়তো হাজ়ব্যান্ড।

—সবজি কেনাকাটার আলাদা লোক ছিল?

—না তো! আমিই যা কেনার, কিনে দিয়ে আসতাম। কেন?

—এমনিই। অন্য কেউ তরিতরকারি দিতে আসত না, শিয়োর আপনি?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, তেমন কেউ থাকলে আমি জানব না, হয়?

—আচ্ছা, মায়ের মৃত্যুর কতদিন আগে বাজার, আই মিন, সবজি-বাজার করে দিয়ে এসেছিলেন?

একটু ভেবে মানসী উত্তর দেন, ‘দিনপাঁচেক আগে হবে। কেন বলুন তো?’

—না, তেমন কিছু না। থ্যাঙ্ক ইউ।

কৌতূহলী মানসী আর কোনও প্রশ্ন করার আগেই ফোন রেখে দিয়েছিলেন মলয়। গাড়ি ছুটছিল ক্যানিং-এর দিকে, আর ধমনীতে অ্যাড্রিনালিনের বাড়তি ক্ষরণ দিব্যি টের পাচ্ছিলেন মলয়। সেই অনুভূতি, যা শব্দ খরচ করে বোঝানো দুঃসাধ্য। যা তদন্তকারী অফিসারমাত্রই অনুভব করেন কোনও জটিল মামলার সম্ভাব্য কিনারার অতর্কিত আভাসে। মানসী বলছেন, খুনের পাঁচ দিন আগে বাজার করে দিয়ে এসেছিলেন। আর কোন লোক ছিলও না তরিতরকারি সাপ্লাই করার। তা হলে পাঁচদিন পরও ঝুড়িভরতি সবজি থাকে কী করে? কারা দিয়ে গিয়েছিল সবজি? কবে? কখন?

ডিসি সাউথ ফোন করে রেখেছিলেন ক্যানিং হাসপাতালের সুপারকে। সুপার নিজেই উপস্থিত ছিলেন সংশ্লিষ্ট রেজিস্টার নিয়ে। হ্যাঁ, মাসছয়েক আগে একটি সদ্যোজাতা শিশুকন্যা মারা গিয়েছিল প্রসবের পরেই। মায়ের নাম টুম্পা সর্দার। বাবার নাম সুশীল সর্দার। ঠিকানা, বারুইপুর থানার মাঝেরহাট গ্রাম।

মলয় যখন টিম নিয়ে মাঝেরহাট গ্রামে সুশীলের বাড়িতে কড়া নাড়লেন, রাত প্রায় ন’টা। সুশীল পুলিশ দেখে হকচকিয়ে গেলেন। মলয় সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেন, ‘গয়নাগাটি যা কালীঘাট থেকে পেয়েছিলেন, বার করুন, আর যেটা দিয়ে খুনটা করেছিলেন, সেটাও।’

সুশীল ‘কোন খুন? আমি কিছু জানি না!’ জাতীয় প্রতিরোধের রাস্তায় গেলেনই না। কবুল করলেন সোজাসাপটাই, ‘বলছি স্যার, সব বলছি। তবে আমি একা করিনি। কাকাও ছিল।’

—কাকা?

—স্বপন সর্দার, কাছেই থাকে।

—নিয়ে চলুন কাকার বাড়ি।

—বাড়িতে পাবেন না স্যার। বাজারে কাকার অনেক ধারদেনা। পাওনাদারদের জ্বালায় বাড়িতে থাকে না। আমি জানি কোথায় থাকে। চলুন।

স্বপনকে গ্রেফতার করা হল সুশীলের দেখিয়ে দেওয়া ডেরা থেকে। কাকা-ভাইপোকে নিয়ে গোয়েন্দাবিভাগের টিম কলকাতা রওনা দেওয়ার পর গাড়িতে গা এলিয়ে দেন মলয়। যাক, ছুটির অ্যাপ্লিকেশনটা এবার করে ফেলতে হবে। আর রাসবিহারীর ধাবার ম্যানেজার ভদ্রলোককেও একটা থ্যাঙ্কস দিয়ে আসতে হবে কাল। ভাগ্যিস সবজিটা অমন বিস্বাদ হয়েছিল, ভাগ্যিস উঠেছিল ক্যানিং-এর কথা। আছে আছে, মলয় দত্তের টেলিপ্যাথির জোর আছে!

বারুইপুর থেকে কলকাতায় ফেরার পথে মলয়কে খুনের বৃত্তান্ত খুলে বললেন সুশীল-স্বপন। জানা গেল, ঠিক কী ঘটেছিল।

সুশীলের বয়স বাইশ-তেইশ। স্বপনের মধ্যতিরিশ। দু’জনেরই রুজিরোজগার অন্যের জমিতে চাষবাস করে। মাঝেমাঝে সবজি বেচতে আসতেন কলকাতায়, হোটেল-ধাবায়।

ঘোর অর্থাভাব ছিল দু’জনেরই। সুশীলের বাবা ছিলেন প্রতিবন্ধী। মা-ও ইদানীং অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। রান্নাঘরে পড়ে গিয়ে গুরুতর চোট পেয়েছিলেন মাথায়। সংসার চালানোর পুরো দায়িত্বই ছিল সুশীলের উপর। যে দায়িত্ব দুর্বহ হয়ে উঠছিল দিনের পর দিন। চাষবাসের কাজ করে কতটুকুই বা আয় হয়? তবু কষ্টেসৃষ্টে চলে যেত কোনওরকমে। মায়ের অসুস্থতার পর অর্থসংকট গভীর হয়েছিল। চিকিৎসার খরচেই মাসিক উপার্জনের অর্ধেক টাকা বেরিয়ে যাচ্ছিল। বছর দুয়েক আগে বিয়ে করার পর এমনিই খরচ বেড়েছিল সংসারের। টুম্পার ছোটখাটো সাধ-আহ্লাদ মেটাতে পারতেন আগে। এখন সে পাটও চুকেছে। বউয়ের মুখ আজকাল গোমড়াই থাকে সারাক্ষণ।

এভাবে আর কতদিন? রাত্রে শুয়ে শুয়ে ভাবতেন সুশীল। ঘটিবাটি বন্ধক রাখতে হবে এবার। কিন্তু তা দিয়েই বা কী হবে? বাড়িতে কী-ই বা আছে তেমন দামি কিছু? খেয়েপরে বাঁচতে গেলে, মায়ের চিকিৎসা চালাতে গেলে, টাকার দরকার। বেশ কিছু টাকার। কে দেবে? ধার নিলে আর এক বিপদ। শোধ তো দিতে হবে সুদসহ। না পারলে কাকার মতো অবস্থা হবে।

‘কাকার মতো অবস্থা’ মানে পাওনাদারদের তাগাদায় ভিটেছাড়া হওয়া। স্বপন সর্দারের জুয়ার নেশা ছিল দুরারোগ্য পর্যায়ের। যা রোজগার করতেন, পুরোটাই উড়িয়ে দিতেন জুয়ার ঠেকে। ফলে অবধারিত আর্থিক অনটন এবং পেট চালাতে ধার করা। পাওনাদাররা সকাল-সন্ধে হানা দিত স্বপনের বাড়িতে। ধার শোধ দিতে অপারগ স্বপন বাধ্য হয়েছিলেন বাড়ির মায়া ত্যাগ করতে। আজ এখানে, কাল ওখানে, পরশু সেখানে, এ-ভাবেই কাটত।

কাকার মতো পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো অসম্ভব মা-বাবা-বউকে ছেড়ে। তার চেয়ে

চুরি-ডাকাতি করাই বোধহয় ভাল। যা হবে, দেখা যাবে। আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতেই একদিন মাথায় এল কালীঘাটের ‘দিদার’ কথা। টুম্পার মা ওই বাড়িতে অনেক বছর ধরে কাজ করেন। বিয়ের পর টুম্পাকে নিয়ে গিয়েছিলেন একবার ওই ফ্ল্যাটে। শাশুড়িই নিয়ে গিয়েছিলেন মেয়ে-জামাইকে। ওই দিদার কাছে টাকা ধার চাইলে কেমন হয়? কিন্তু যদি না দেয়? কথা নেই বার্তা নেই, এতদিন পরে হুট করে গিয়ে টাকা চাইলে না দেওয়ারই কথা। না দিলে? সুশীল মনস্থির করে ফেলেন।

পরের সন্ধেয় কাকা-ভাইপোর দেখা হয়। সুশীল খুলে বলেন প্ল্যান।

—কালীঘাটে এক বুড়ি দিদার বাড়ি চিনি আমি। দাদু মারা গেছে। দাদু-দিদা দু’জনেই ভাল চাকরি করত। গিয়ে টাকা চাইব। না দিলে কেড়ে নেব। যাবে?

না গিয়ে উপায়ও ছিল না স্বপনের। আর্থিক সংকট থেকে রেহাই পেতে তিনিও একই রকম মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। স্বপন রাজি হয়ে গেলেন। এবং ৬ নভেম্বর ভোরের ট্রেনে চড়ে বসলেন কাকা-ভাইপো। খুন-জখম বাদ দিন, ছিঁচকে চুরি বা পকেটমারিরও কোনও পূর্বইতিহাস ছিল না যাঁদের।

সুশীল একটা ছুরি নিলেন সঙ্গে। আর একটা চটের ব্যাগ মাঝারি সাইজ়ের। যাতে রইল টাটকা সবজি কিছু।

মঞ্জুর ফ্ল্যাটে বেল বাজল ন’টা নাগাদ। উষা এবং জগদীশ তখন কাজ সেরে বেরিয়ে গেছেন। মঞ্জু বাড়িতে একা। ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে?’

—দিদা, আমি সুশীল। উষার জামাই। আপনার জন্য একটু টাটকা সবজি নিয়ে এসেছি। এদিকে কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম দেখা করে যাই।

অচেনা লোক নয়, উষার জামাই। আগেও এসেছে একবার। মঞ্জু দরজা খুলে দিলেন। সুশীল ফ্ল্যাটে ঢুকলেন কাকাকে নিয়ে।

—দিদা, এঁর নাম স্বপন। আমার কাকা।

চটের ব্যাগ থেকে সবজি বার করলেন সুশীল। মঞ্জু রেখে এলেন রান্নাঘরের ঝুড়িতে। এতদূর থেকে সবজি নিয়ে এসেছে, এক কাপ চা না খাওয়ালে খারাপ দেখায়। উষাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালবাসেন। তার জামাইকে চট করে বিদায় করে দেওয়া যায় না। সুশীল-স্বপনকে নিজের ঘরে বসিয়ে চা তৈরি করতে রান্নাঘরে ঢুকলেন মঞ্জু। নিজের জন্যও বানালেন এক কাপ।

চা খেতে খেতে এটা-সেটা কথার মধ্যেই সুশীল পাড়লেন টাকার কথা। বড্ড টানাটানি যাচ্ছে, কিছু টাকা ধার পেলে ভাল হয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শোধ দিয়ে দেবেন। মঞ্জু এবার বিরক্ত হলেন। এ যে দেখি খেতে পেলে শুতে চায়! সটান বলে দিলেন, ‘টাকা দিতে পারব না। আর উষা জানে, তোমরা এসেছ আজ?’ সুশীল যেটা সত্যি, সেটাই বললেন। উষা সত্যিই জানতেন না জামাই এবং তার কাকার এই প্ল্যানের বিন্দুবিসর্গও।

‘তোমরা এখন যাও’ বলে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার ছেড়ে মঞ্জু উঠে দাঁড়ানো মাত্রই তাঁর হাত চেপে ধরলেন সুশীল। বাকিটা রইল সুশীলেরই বয়ানে।

—দিদার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেল। দিদা চিৎকার করতে যেতেই কাকা ডাইনিং টেবিলের কোণে পড়ে থাকা একটা কাপড় দিয়ে মুখ চেপে ধরল। তারপর মুখে ঘুসি মারল খুব জোরে। আমি ছুরিটা বার করলাম। আমাদের তো চিনেই গেছে। মেরে ফেলা ছাড়া উপায়ও নেই। না হলে জেলের ঘানি টানতে হবে। গলায় চালালাম ছুরি। তারপর পেটে।

দিদা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। আমি ছুরিটা দিদার নাইটিতে মুছে নিলাম। রেখে দিলাম ব্যাগে। অনেক চেষ্টা করেও আলমারিটা খুলতে পারলাম না। চাবিই পেলাম না। ক্যাশ বলতে পেলাম বাইরে এদিক-ওদিক যা ছিল ব্যাগে-ট্যাগে, হাজার দুয়েক মতো। দিদার গলা থেকে সোনার চেন আর হাত থেকে চুড়ি খুলে নিলাম। যখন এসব চলছিল, তখন একবার বেল বেজেছিল। আমরা খুলিনি। একটু পরে চুপচাপ দরজা খুলে ফাঁক করে যখন দেখেছি কেউ নেই, তখন চট করে নেমে গিয়েছি।

মলয় বোঝেন, ওই যে একবার বেল বেজেছিল, ওটা শুভঙ্কর বাজিয়েছিলেন। আনন্দবাজারের কর্মী।

সাক্ষ্যপ্রমাণ ছিল ঠাসবুনোট। যে ব্যাগে ছুরি নিয়ে এসেছিলেন, ফেরার ট্রেন ধরার সময় বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে একটা ঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন সুশীল। বয়ান অনুযায়ী উদ্ধার হল সেই ছুরি। লুঠ করা গয়না বারুইপুরের এক দোকানে বন্ধক রেখেছিলেন স্বপন। উদ্ধার হল সেগুলোও, দোকানি আদালতে চিহ্নিত করলেন স্বপনকে। আর মানসী শনাক্ত করলেন মায়ের গয়না।

আলমারি আর চায়ের কাপে পাওয়া আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলে গেল আততায়ীদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট। স্বপন একটা আংটি পরতেন ডান হাতে। যে হাতে মঞ্জুকে ঘুসিটা মেরেছিলেন, গাল ছড়ে গেছিল মঞ্জুর। ওই ‘abrasive wound’ যে আংটির আঘাতে হওয়া সম্ভব, তারও উল্লেখ ছিল ফরেনসিক রিপোর্টে। সর্বোপরি আদালতে স্বপন স্বেচ্ছায় জবানবন্দিও দিয়েছিলেন, ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে।

২০১৭-র সেপ্টেম্বরে রায় বেরিয়েছিল। দোষী সাব্যস্ত করে সুশীল-স্বপনকে যাবজ্জীবন কারাবাসে দণ্ডিত করেছিলেন বিচারক।

পরিচিত ভেবে মঞ্জু দরজা খুলেছিলেন, বিশ্বাস করে। চা খাইয়েছিলেন। তারপর খুন হয়ে গিয়েছিলেন। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো যেমন পাপ, কখনও কখনও মানুষকে বিশ্বাস করাও? শেষ বিচারে তা হলে কী দাঁড়ায় এ মামলার নির্যাস?

বিশ্বাসই বিশ্বাসঘাতক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *