বহুব্রীহি
প্রসঙ্গ
আদি কাণ্ড
এইসব দিনরাত্রির পর ঠিক করেছিলাম অরি না, যথেষ্ট হয়েছে, এখন থেকে ঘরে বসে থাকব, লেখালেখি সীমাবদ্ধ থাকবে গল্প এবং উপন্যাসে। নটিক আমার লাইন নয়। বিশেষ করে টিভি নাটকে অনেক টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি মাথায় রাখতে হয়–খুব চাপ পড়ে। এরচে ক্লান্ত দুপুরে চমৎকার একটা উপন্যাস হাতে নিয়ে শুয়ে থাকা অনেক লোভনীয়।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে–একবার বেলতলায় গেলে বার বার যেতে হয়। ব্যাপারটা অনিবার্য নিয়তির মত। কাজেই দ্বিতীয় দফায় বেলতলা যাবার প্রস্তুতি নিলাম। নীরস গল্প নামে দুটি এপিসোড লিখে নিয়ে গেলাম প্রযোজক নওয়াজীশ আলী খানের কাছে। তিনি না পড়েই বললেন অপূর্ব। আগামী প্রান্তিক থেকে এই জিনিস যাবে। যাবে বললেই সব জিনিস যায় না, এটিও গেল না। দুমাস পড়ে রইল। এই ছমাসে কিছু কিছু পরিবর্তন হল, নাম বদলে গেল। শীরস গল্প থেকে বহুব্রীহি। কাহিনীও নামের সঙ্গে পাল্টে গেল। হাসি তামাশার ফাঁকে হাস্যকর নয় এমন কিছু জিনিস ঢুকিয়ে দেয়া হল। এইবার চরিত্র নির্বাচনের পালা। আমি বললাম অর্ধেক নেয়া হোক একেবারে আনকোরা শিল্পী, বাকি অর্ধেক পুরনো লোকজন। নওয়াজীশ আলি খান বললেন–অপূর্ব! প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি এই ভদ্রলোক আমার সব আইডিয়াকেই অপূর্ব বলে থাকেন। একবার সংলাপবিহীন একটি নাটকের আইডিয়া তাঁকে দিয়েছিলাম–তিনি যথারীতি বলেছিলেন, অপূর্ব।
তিন নতুন
তিনজন নতুন যুক্ত হলেন টিভিতে। কাদের, পুতুল এবং মিলির বড় বোন। অডিশন ছাড়া নতুনরা টিভিতে অভিনয় করতে পারেন না বলে একটি আইন আছে। সব আইনের যেমন ফাঁক আছে–এই আইনেরও আছে। কাজে কাজেই (স্পশাল অডিশনের ব্যবস্থা হল। পাঠকরা শুনে বিস্মিত হবেন যে কাদের (আফজাল শরীফ) অডিশনে পাশ করতে পারল না। বেচার: কাদেরকে থিয়েটার থেকে আমি এনেছিলাম এবং আমি তার মহাপুরুষ নাটকে অভিনয় দেখে তার অভিনয় ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম অথচ সে অডিশনে পাশ করতে পারছে না। এর মানে কি? তাহলে কি আমি ধরে নেব অডিশন বোর্ডের কর্মকর্তারা প্রতিভা যাচাইয়ের ব্যাপারটায় মাঝে মাঝে ভুল করেন? কে জানে, কাদেরের মত অনেক প্রতিভাবান অভিনেতাদেরও হয়ত অডিশনে ফেল করে চলে যেতে হয়েছে।
যাই হোক কাদেরের ভাগ্য ভাল ছিল। কারণ বহুব্রীহির প্রযোজক নাট্যকারের ইচ্ছার কথা মনে রেখে কিভাবে জানি কাদেরের জন্যে শুধুমাত্র বহুব্রীহিতে অভিনয়ের অনুমতি জোগাড় করলেন।
বহুব্রীহিতে পুতুলও যুক্ত হল আমার অনুরোধে। এই মেয়েটি কেমন অভিনয় করে কিছুই জানতাম না শুধু জানতাম তার অভিনয়ের খুব আগ্রহ এবং সে এ বছরেই এসএসসি পরীক্ষায় হিউম্যানিটিজ গ্রুপে ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে প্রথম হয়েছে। এরকম স্মার্ট একজনকে সুযোগ না দেয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না।
পুতুল (দীপা ইসলাম। বেশ ভালভাবে অডিশনে পাশ করলে। তবু আমার মনে হচ্ছিল, যে অভিনয় তার কাছ থেকে আমি আশা করছি তা পাব না। এই মেয়ে ছোটবেলায় অভিনয় করেছে তবে স্টেজে বাচ্চাদের নাটকে অভিনয় এক জিনিস আর টিভির তিনটি ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো অন্য জিনিস। মুখের উপর যখন হাজার ওয়াটের আলো এসে পড়ে তখন সব গুলিয়ে যায়। শিল্পী নামের মেয়েটির বেলায়ও একই কথা মনে হল।
চরিত্র ভাগ করে দেয়া হল। বাবা হিসেবে আবুল হায়াত এলেন তবে মন খারাপ করে এলেন। তিনি চাচ্ছিলেন মামার ভূমিকা। বাবার ভূমিকা পেয়ে এতই বিমর্ষ হলেন যে এক পর্যায়ে আমাদের ধারণা হল তিনি হয়ত অভিনয় করবেন না। অভিনেতা আফজাল হোসেনকেও তাঁর চরিত্র নিয়ে খুব চিন্তিত মনে হল। তিনি বার বার বলতে লাগলেন, আমি তো ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করি না। কাজেই চরিত্রটি সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চাই। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করলাম। বললাম–চরিত্রটিতে আপনি অভিনয়ের সুযোগ পাবেন। তিনি দুটি এপিসোড পড়ে বেশ খুশী মনেই রাজি হলেন। নওয়াজীশ আলি খান হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আফজালকে দলে পাবার জন্যে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। সেই আন্তরিক আগ্রহের মর্যাদা যদিও শেষ পর্যন্ত আফজাল দিলেন না। লেখকের তৈরি চরিত্র তাঁর অপছন্দ হবার কারণে বহুব্রীহি ছেড়ে চলে গেলেন। আমার জন্যে তা বেদনাদায়ক ছিল!
গল্পের কাঠামো
আমি কখনো খুব চিন্তা-ভাবনা করে কিছু লিখতে পারি না। সব সময় ভরসা করি কলমটার উপর কিংবা বলা যেতে পারে কলমের টানের উপর। কলমের টানে কিছু না কিছু এসে যাবেই, এটাই আমার বিশ্বাস। তবে বহুব্রীহি নিয়ে আমি যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করলাম। একটা পরিবার হল গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। পরিবারের প্রতিটি পুরুষ আধা-পাগল ধরনের কিন্তু মেয়েগুলি সুস্থ ও স্বাভাবিক। যাত্রা দলের বিবেকের মত একটি চরিত্র থাকবে যে বিশেষ মুহূর্তে উপস্থিত হবে এবং বিবেকের দায়িত্ব পালন করবে। পরিবারের বাইরের একজন প্রেমিক বোকা (ডাক্তার) থাকবে। এই চরিত্রটিকে ব্যালান্স করবার জন্যে থাকবে একজন বেকি প্রেমিকা (এশা, মামার সেক্রেটারী)। পরিবারের প্রধান ব্যক্তি একজন নিতান্তই সরল, ধর্মভীরু, ভাল মানুষ যিনি পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যায় কাতর। সমস্যা সমাধানের তাঁর পরিকল্পনা নিয়েই গল্প আবর্তিত হবে।
মুল গল্প হাস্যরস প্রধান হলেও পাশাপাশি একটি করুণ স্রোত প্রবাহিত হবে। মাঝে মাঝে সেই স্রোত ব্যবহার করা হবে।
বিশেষ বিশেষ কিছু বক্তব্যও হাসি তামাশার ফাঁকে ফাঁকে রাখা হবে। কিছু সত্যিকার সমস্যার প্রতিও ইঙ্গিত করা হবে। তবে সমস্যাগুলি নিয়ে বেশিদূর যাওয়া হবে না। সরকার প্রচারিত একটি মাধ্যমে সেই সুযোগও অবশ্যি নেই।
এত ভেবে-চিন্তে কেন গল্পের কাঠামো দাঁড় করালাম। কলমের টানের উপর বিশ্বাস কেন করলাম না? কারণটা খুব সাধারণ। হিউমার করার কাজটা কঠিন। বিশেষ করে আমাদের দেশে। কোন একটি দৃশ্য দেখে হেসে ফেললেও আমরা সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে বলি–কুরুচিপূর্ণ ভাঁড়ামে। অন্য কোথাও লজিক খুঁজি না, অথচ হাসির নাটক এলেই ভ্রু কুঁচকে লজিক খুঁজতে বসি। কখনো ভাবি না হাসির নাটক মানেই চড়া রঙের ব্যাপার। জীবন যে রকম আছে হুবহু সেই রকম তুলে আনলে আমাদের হাসি আসে না। জীবনকে কোন এক অদ্ভুত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারলেই শুধু হাসা যায়। কলার খোসায় পা পিছলে পড়ে যাওয়া একটা দুঃখজনক ব্যাপার। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার দেখেও আমরা হাসি। কেন হাসি?
জাতি হিসেবে বাঙ্গালীর রসবোধ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। সাধারণ কথাবার্তায় আমরা চমৎকার রসিকতা করি। তবুও কেন জানি নাটকে রসিকতা করে তাদের ঠিক হাসানো যায় না। তারা গম্ভীর হয়ে বলেন, এর মধ্যে শিক্ষণীয় তো কিছু দেখছি না।
এ জাতীয় কথাবার্তা যাতে কম শুনতে হয়, যাতে দর্শকদের এক অংশকে অন্তত সন্তুষ্ট করতে পারি, সেই কারণেই আমার আটঘাট বাঁধা। দীর্ঘ প্রস্তুতি পর্ব। তবুও আমি ধরেই নিয়েছিলাম নিম্নলিখিত মন্তব্যগুলি আমাকে হজম করতে হবে।
(ক) এইসব দিনরাত্রির পর এই জিনিস? ওয়াক থু।
(খ) ব্যাটা কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা করছে–গোপাল ভাড় কোথাকার।
(গ) নাট্যকার কি ভেবেছে আমরাও তাক মত ব্ৰেইনলেস?
(ঘ) কত বড় ফাজিল–নাটকের মধ্যে আবার সমস্যাও বলে–আরে তুই সমস্যার জানিস কি?
এই জাতীয় মন্তব্যের জন্যে আমি মানসিকভাবে তৈরি ছিলাম। যার জন্য তৈরি থাকা হয় সচরাচর তা ঘটে না। তার চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার ঘটে। আশার ক্ষেত্রেও ঘটল। একদল মানুষ আমার উপর ক্ষেপে গেলেন।
গোড়ায় গলদ
প্রথম পর্বের মহড়াতেই ঝামেলা বেঁধে গেল। শিল্পী নামের মেয়েটি বলল প্রথম পর্বের শেষ অংশ সে করতে পারবে না। কারণ সে পানিতে নামবে না। প্রথম পর্বটির শেষ দৃশ্যে ডাক্তারকে বাচানোর জন্যে মেয়েটির পানিতে ঝাঁপ দেয়ার কথা। শুরুতেই যন্ত্রণা। আনা হল লুৎফুন্নাহার লতাকে। তিনি পানিতে বাপ দিতে রাজি হলেন। শিল্পীকে দেয়া হল অন্য একটি চরিত্র। সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। গল্পের যে কাঠামো আমার মাথায় ছিল তাতে বড় রকমের হেরফের করতে হল। পুতুল ছিল সোবহান সাহেবের ছোট মেয়ে, সে হয়ে গেল এমদাদের নাতনি। আরো কিছু ছোটখাট যন্ত্রণা পার করে প্রথম পর্বের রেকডিং শেষ হল। যথারীতি প্রচারিত হল। দ্বিতীয় পর্ব প্রচারিত হল না। শুরু হল বন্যা। চরম দুঃসময়ে কি আর হাসি তামাশা দেখতে ইচ্ছে করে? বহুব্রীহি বাক্স বন্দী হয়ে গেল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম–বহুব্রীহির কপালে অনেক দুঃখ আছে।
নওয়াজীশ আলি খান সাহেবও খুব মন খারাপ করলেন। তবে তিনি মন খারাপ করলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। প্রথম পর্বে আনিসের মৃত স্ত্রীর যে ছবিটি টানানো ছিল সেটি তার স্ত্রীর। বেচারা কোন জীবিত মহিলাকে মৃতা হিসাবে ছবিতে দেখাবার ব্যাপারে রাজি করাতে না পেরে তাঁর স্ত্রীর ছবি স্ত্রীকে না জানিয়েই ব্যবহার করলেন। বেচারী গেলেন রেগে। এবং ঘোষণা করলেন এই ছবি আর ব্যবহার করা যাবে না। অথচ গল্পটা এমন যে এই ছবি অনেকবার ব্যবহার করতে হবে। এই জটিল সমস্যার সমধান বেচারা নওয়াজীশ আলি খান কি করে করবেন বুঝতে পারলেন না।
নতুন যাত্রা
বন্যার পানি নেমে যাবার পর আবার বহুব্রীহি শুরু হল। দ্বিতীয় পর্ব থেকে নয় প্রথম পর্ব থেকে। নওয়াজীশ আলি খান সুযোগ পেলেন তাঁর স্ত্রীর ছবি পাল্টানোর। নতুন ছবি টানানো হল।
নতুন যাত্রা মন্দ হল না। অভিনেতা অভিনেত্রীরা চমৎকার অভিনয় করলেন। বাবা, মামা, নূর, তার দুই পুত্র কন্যা, আফজাল, মিলি, আফজাল শরীফ, রহিমার মা। কেহ কারে নাহি পারে সমানে সমান। আলাদাভাবে এদের কথা বলা অর্থহীন। এঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের প্রতিভার পূর্ণ ব্যবহার করলেন। শুধু বড় মেয়েটি এই সুপারস্টারদের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারল না। তার দিক থেকে চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। কিন্তু কিছু জিনিস আছে চেষ্টাতে হয় না।
আমার মন খারাপ হয়ে গেল কারণ বড় মেয়েটিকে নিয়ে গল্পের যে কাঠামো ছিল তা এখন ভাঙ্গতে হবে। নতুন কাঠামো তৈরী করতে হবে। অথচ গল্প এগিয়ে গেছে।
প্রথমদিকে পুতুলও আমাকে খানিকটা আশাহত করেছিল। দেখলাম ক্যামেরায় তাকে ভাল দেখাচ্ছে না। দুঃখের ব্যাপারগুলি যত সহজে ফুটিয়ে তুলছে অন্যগুলি তত সহজে আসছে না। তার দ্রুত কথা বলার নিজস্ব ভঙ্গি নাটকেও চলে এল।
বড় মেয়ে এবং পুতুল এই দুজনকেই চতুর্থ পর্বে বাদ দেয়ার পরিকল্পনা করলাম। মাঝে মাঝে আমি খুব নির্মম হতে পারি। পুতুল শেষ পর্যন্ত টিকে গেল নওয়াজীশ আলী খান সাহেবের অনুরোধে। তিনি বললেন, আরো দুএকটা পর্ব দেখুন। দেখলাম। মনে হল–এ পারবে। তার গল্প অনুভব করবার ক্ষমতা আছে। বড় অভিনেতা হবার মা প্রথম শর্ত। বড় মেয়েটিকে বাদ দিতে হল। নবম পর্বে আমি আবার তাকে আনতে চেয়েছিলাম। নওয়াজীশ আলী খান সাহেব রাজি হলেন না।
খুব উৎসাহ নিয়ে নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিল। উৎসাহ পুরোপুরি বজায় রইল না। আমাকে বারবার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হল। তুচ্ছ সব বিষয়–কিন্তু তুচ্ছ থাকল না।
সৈয়দ বংশ
আমি যতদূর জানি, আরবী ভাষায় সৈয়দ হচ্ছে একটি সম্মানসূচক পদবী যার মানে জনবি বা ইংরেজী মিষ্টার। যে কোন মুসলমান তাঁর নামের আগে সৈয়দ ব্যবহার করতে পারেন। সৌদী আরবে কিছু সম্মানিত অমসুলমানের নামের আগেও এই সৈয়দ ব্যবহার করে তাঁদের সম্মান জানানো হয়। অথচ ভারতবর্ষে এই পদবীর ব্যবহারকারীরা দাবী করে তাঁরা হযরত মোহাম্মদ (দঃ)-এর বংশধর।
ধরা গেল তাদের দাবী সত্য–তাহলেও কিন্তু সমস্যা মেটে না। যে ইসলাম সাম্যের বাণী প্রচার করে সেই মহান সাম্যবাদ দূরে ফেলে আমরা কিন্তু জাতিভেদ তৈরি করি। এক সময় সৈয়দরা বংশ মর্যাদার ধুয়া তুলে অন্যদের শোষণ করেছে। আমি রসিকতার কারণেই সৈয়দ বংশ ব্যবহার করেছি। কারণ আজ আজ সৈয়দ বংশ কোন সমস্যা নয়।
কেউ যদি মনে করেন সৈয়দ নিয়ে রসিকতা মানে আমাদের নবীর সম্মানহানি করা তাহলে তিনি খুব বড় ধরণের ভুল করবেন। নবীর বংশধররা (?) সবাই নবীর মত এরকম মনে করার কোন কারণ নেই। তাদের নিয়ে কিছু রঙ্গ রসিকতা অবশ্যই করা যায়।
ধর্ম!
আমার জন্য একটি ধর্মভীরু মসুলমান পরিবারে যেখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি কঠিনভাবে মানা হয়ে থাকে। যার প্রতিফলন আছে বহুব্রীহিতে। বহুব্রীহির কেন্দ্রীয় চরিত্র সোবাহান সাহেব একজন অত্যন্ত ধর্মভীরু মানুষ। ধর্মীয় অনুশাসন যিনি কঠিনভাবে মানেন। যার সৎ আত্মর জন্মও হয়ত ঐ কারণেই হয়েছে। সোবাহান সাহেব নিয়মিত রোজা রাখেন। তারপরেও ক্ষুধার স্বরূপ বোঝার জন্যে তিনি দীর্ঘ উপবাসে চলে গেলেন। তিনি বললেন–রোজা রেখে তিনি ক্ষুধার স্বরূপ বুঝতে পারেন না, কারণ সারাক্ষণই তার মনে থাকে ইফতারের সময় প্রচুর খাবার দাবার পাওয়া যাবে। প্রকৃত ক্ষুধার্তদের এরকম খাবারের নিশ্চয়তা নেই। এটা হচ্ছে সৎ মানুষের সৎ উক্তি। এখানে রোজার প্রতি কটাক্ষ কোথায়?
সিমের বীচি এই নাটকে ব্যবহার করা হয়েছে এক লক্ষবার কানে ধরে উঠবস করার হিসেবের জন্যে। আপত্তি উঠেছে এখানেও। ধর্মীয় কাজে এই বীচি ব্যবহার করা হয়। খতম পড়ানো হয়। কাজেই এর অন্য কোন ব্যবহার করা যাবে না। একসময় ধর্মযুদ্ধে তরবারী ব্যবহার করা হয়েছে। কাজেই আমরা কি ধরে নেব তরবারী একটি ধর্মীয় জিনিস, এর অন্য কোন ব্যবহার চলবে না? আমাদের লজিক এত হালকা হবে কেন? ধর্ম কি এমন কোন ব্যাপার যে সিমের বীচিতেও তা থাকবে?
রহিমার মা
আমি কঠিন বিপদে পড়লাম রহিমার মাকে নিয়ে যখন তিনি খাবার টেবিলে সবার সঙ্গে একত্রে খেতে বসলেন। এটি নাকি খুবই কুরুচিপূর্ণ দৃশ্য। কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর অপচেষ্টা, আমার স্থূল বুদ্ধির পরিচায়ক। কোন কোন পত্রিকাতেও তা লেখা হল।
কি গভীর বেদনার একটা ব্যাপার। মুখে মুখে আমরা সাম্যবাদের কথা বলি। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই ইত্যাদি। অথচ যেই একটি কাজের মেয়ে একসঙ্গে খেতে বসে গেল ওমি আমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেল।
একজন অত্যন্ত নামী বুদ্ধিজীবী (নাম বলছি না কারণ তাকে লজ্জা দিতে চাই না। নাটকের এই পর্ব প্রচার হবার সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকে টেলিফোন করে বললেন, হুমায়ূন সাহেব, আপনার কাজের মেয়েটি কি আপনার সঙ্গে এক সঙ্গে খেতে বসে?
আমি বললাম–না।
যদি আপনার কাজের মেয়ে আপনাদের সঙ্গে খেতে না বসে তাহলে কোন স্পর্ধায় আপনি টিভিতে এই জিনিস দেখালেন?
আমি ঠাড়া গলায় বললাম, আমার কাজের মেয়ে আমার সঙ্গে খেতে বসে না তার কারণ আমি আপনার মতই একজন। সাম্যের কথা মুখে বলি কাজে দেখাই
কিন্তু সোবহান সাহেব আপনার বা আমার মত নন। তিনি অন্তরে যা বিশ্বাস করেন কাজেও তা প্রতিফলিত হয়।
একদিনের কথা। বহুব্রীহির রিহার্সেল হচ্ছে। রহিমার মা আমার কাছে এসে ক্লান্ত গলায় বললেন, বাবা লোকজন আমাকে খুব গালাগালি করে।
আমি বললাম, কেন?
আমি যে খাওয়ার টেবিলে খাইতে বসছি।
আমি বললাম, আপনি বলবেন এটা একটা পাগলদের নটিক। এখানে অনেক কিছুই হবে এর কোনটাই সত্যি না।
ডাক্তার ডাক্তার!!
পনেরো বছর আগে আমার বড় মামীর ইউরিনারী ব্লাডার ফুটো হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ পনেরো বছর তিনি অমানুষিক জীবন-যাপন করলেন। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তাররা বললেন–কিছু করার নাই। শেষ পর্যন্ত সিলেট মেডিক্যাল কলেজের সার্জারীর প্রফেসর (নাম খুব সম্ভব রাজা চৌধুরী) সাহস করে এগিয়ে এলেন। তিনি একটি সাহসী পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন–মামীর জরায়ু কেটে–সেই কাটা জরায়ু দিয়ে ব্লাডারের ফুটো বন্ধ করে দিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, মামী সুস্থ হয়ে গেলেন। বলা যেতে পারে তার নব জন্ম হল। আমি ঐ সার্জনের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য লিখলাম টিভি নাটক অবসর। একজন নিবেদিতপ্রাণ সার্জনকে নিয়ে গল্প। যিনি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন ছুরি কাঁচি হাতে। যাদের তিনি সারিয়ে তোলেন, তাদের প্রতি তার কোন মমতা নেই। মমতা নেই–স্ত্রী এবং কন্যার প্রতি। ভালবাসেন ছুরি ও কাঁচিকে।
সমাজের সব ডাক্তার তার মত নয়। এই সমাজের দায়িত্বজ্ঞানহীন ডাক্তার আছেন। অর্থলোলুপ ডাক্তার আছেন। এমন ডাক্তার আছেন যিনি ঠান্ডা মাথায় নিজের স্ত্রীকে হত্যা করেন। এঁদের নিয়ে নাটক লেখার কথা আমার কখনো মনে হয়নি। মানুষের চরিত্রের অন্ধকার দিক আমাকে কখনো আকর্ষণ করে না। আমি সবসময় মানুষের চরিত্রের আলোকিত অংশ নিয়ে কাজ করি। আমার লেখা সেই কারণে অনেকের কাছে বাস্তবতা-বর্জিত এক ধরণের কল্পকাহিনী বলে মনে হয়। তার জন্য আমার মনে কোন ক্ষোভ নেই।
মানুষের হৃদয়ের অন্ধকার অলিগলি নিয়ে তো সব লেখকরাই কাজ করেন। আমি না করলে কোন ক্ষতি হবে না। তাই আমার বহুব্রীহির ডাক্তার বোকা, কিন্তু সে দরিদ্র মার অনুরোধে নিজের বিয়ের কথা ভুলে গিয়ে হাসপাতালে ছুটোছুটি করতে থাকে। আশ্চর্যের ব্যাপার, একজন বোকা ডাক্তার দেখে ডাক্তাররা এবং হবু ডাক্তাররা আমার উপর ক্ষেপে যান। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের আইডেনটিফাই করতে থাকেন বহুব্রীহির ডাক্তারের সঙ্গে। অথচ ভুলে যান সোবহান সাহেবের বড় মেয়েটিও ডাক্তারী পড়ে। সে বোকা নয়। শান্ত, বুদ্ধিমতী ও হৃদয়বান একটি মেয়ে। তারা সেই মেয়েটির কথা মনে না করে আফজালের কথা মনে করেন। তারা তাদের ক্ষোভের প্রকাশ যে ভঙ্গিতে কৃরন তা ভাবতেও লজ্জা লাগে। আমার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়, বইপত্র পুড়িয়ে দেয়া হয়। অনবরত টেলিফোন করে আমাকে বলা হয় আমার বা আমার পরিবারের কোন সদস্যদের চিকিৎসা ডাক্তাররা করবেন না।
একদিনের কথা বলি। নওয়াজীশ আলী খান বহুব্রীহির ইউনিট নিয়ে গিয়েছেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। অপারেশনের একটি দৃশ্যের চিত্রায়ন হবে। ডাক্তাররা যেই শুনলেন ইউনিটটি বহুব্রীহির তাঁরা সহযোগিতা করতে অস্বীকার করলেন।
বেয়াদব শিশু
নিষা এবং টগর।
যথেষ্ট মমতা নিয়ে এই দুটি চরিত্র তৈরি করেছিলাম। মা নেই, দুটি শিশু–বাবার স্নেহে বড় হচ্ছে। যারা বিশ্বাস করে একদিন তাদের মা ফিরে আসবে–অথচ আসে না। এরকম দুটি শিশুর আচরণ যা হওয়া উচিত আমি চেষ্টা করেছি। বাচ্চা দুটিকে সে রকম রাখতে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কোন কোন পত্রিকায় লেখা হতে থাকল, আমি শিশুদের বেয়াদব বানাচ্ছি। শিশুরা কিছুই শিখছে না। নাটক দেখে দেখে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
প্রেস ক্লাবের সামনে পাগল
বহুব্রীহির এক পর্বে একটি ডাক্তার আনিসকে বলল কোথায় একটা ভদ্র পাগল। পাওয়া যায় বলতে পারেন? আনিস বলল, অনেক জায়গায় আছে তবে প্রেস ক্লাবের সামনে প্রায়ই একজনুকে দেখা যায়।
এরপর পরই একটা কঠিন চিঠি ছাপা হল। সংবাদ কিংবা ইত্তেফাঁকে। পরলেখক অতি কঠিন ভাষায় আমাকে আক্রমণ করলেন। কারণ আমি নাকি প্রেস ক্লাবের সামনে যেসব বিপ্লবী মানুষ অনশন করেন তাদের অপমান করছি। এই হাস্যকর চিঠি সংবাদপত্রের সম্পাদকরা যখন ছাপেন তখন তা অরি হাস্যকর থাকে না। কারণ সম্পাদক চিঠির বক্তব্যকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বলেই ছাপছেন।
জাপানী একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে।
বল দেখি কোথা যাই
কোথা গেলে শান্তি পাই
ভাবিলাম বনে যাব
তাপিত হিয়া জুড়াব,
সেখানেও অর্ধরাতে
কাঁদে মৃগী কম্প গাত্রে।
পাকুন্দিয়া কলেজ
খুব সম্ভব বহুব্রীহির দ্বিতীয় পর্বে পাকুন্দিয়া থেকে এলেন এমদাদ সাহেব। টাউট ধরনের লোক। সোবাহান সাহেব এমদাদের কাছে জানতে চাইলেন–তাঁর কলেজ কেমন চলছে। যে কলেজ তিনি নিজের টাকায় গড়ে তুলেছেন। টাউট এমদাদ বলল–কলেজ খুব ভাল চলছে। নকলের এমন সুযোগ আর অন্য কলেজে নেই। শিক্ষকরাও নকলের ব্যাপারে সাহায্য করেন।
এই চরিত্রটি কিন্তু বেশ কিছু প্রাইভেট কলেজের বাস্তব ছবি। কিন্তু নাটকে বলা মাত্র পাকুন্দিয়া কলেজের অধ্যক্ষ আইনের আশ্রয় নেবেন বলে কঠিন চিঠি পাঠালেন নওয়াজীশ আলি খানকে। কারণ তাঁর কলেজের সম্মান হানি করা হয়েছে।
এই ভদ্রলোক একবারও ভাবলেন না যে তাঁর কলেজটি সোবাহান সাহেবের টাকায় তৈরি হয়নি। যে কলেজের কথা নাটকে বলা হয়েছে সেই কলেজ সোবাহান সাহেবের দানে তৈরি। অথচ পাকুন্দিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ধরে নিলেন যে তাঁর কলেজ সম্পর্কে বলা হচ্ছে। কলেজের অধ্যক্ষের বিচার বিবেচনা যদি এরকম হয় তাহলে অন্যদের দোষ দিয়ে লাভ কি?
আমার তো মনে হয় মেডিকেলের ছাত্ররা ঠিকই করেছে। আমার কুশপুত্তলিকা দাহ করে বাড়াবাড়ি করেনি। যেমন গুরু তেমন শিষ্যই তো হবে।
শেষ কথা
বহুব্রীহিতে যা করতে চেয়েছিলাম তার সবটাই কি জলে গেছে? মনে হয় না। আমার দুঃসময়ের অনেকেই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। কঠিন আক্রমণের জবাব তারাই দিয়েছেন–আমাকে কোন জবাব দিতে হয়নি। যে মমতা ও ভালোবাসা তাঁরা আমাকে দেখিয়েছেন আমি দীর্ঘদিন তা মনে রাখব।
একটা বিরাট দর্শক শ্রেণীর ভালবাসাও আমি পেয়েছি। আমার সমস্ত অক্ষমতা তাঁরা দেখেছেন ক্ষমার চোখে এবং কিছুটা প্রশ্রয়েরও চোখে।
এই ভালবাসার মূল্য দেবার সাধ্য আমার নেই। যদি থাকত বড় ভাল হত।