2 of 3

২.০৯ প্রেসিডেন্সি কলেজের গেট দিয়ে

প্রেসিডেন্সি কলেজের গেট দিয়ে বেরিয়ে বকুল গাছের নিচে দাঁড়ালো অলি। চারটে বেজে গেছে, তাদের বাড়ির গাড়ি এখনও আসেনি। অলির কাছে পয়সা আছে, সে অনায়াসে বাসে চড়ে ফিরে যেতে পারে, কিন্তু গাড়িটা আসবার কথা, যদি জ্যামে আটকে গিয়ে থাকে তা হলে এরপর এসে ড্রাইভার কী করবে, বুঝতেই পারবে না। তাদের ড্রাইভার মন্মথর বুদ্ধি বড় কম, সে অলিকে না পেয়ে হয়তো এখানেই সারা সন্ধে বসে থাকবে।

শ্যামবাজারের দিক থেকে একটা মিছিল আসছে। মিছিলটা কাছে এসে পড়লে আর রাস্তা পার হওয়া যাবে না।

তার পাশে আর তিনটি মেয়ে এসে দাঁড়ালো। মালবিকা, নাসিম আর বর্ষা, এরা তিনজনেই হিস্ট্রি অনার্সের। মালবিকা থাকে ভবানীপুরের দিকে, মাঝে মাঝে অলির সঙ্গে ফেরে। সে জিজ্ঞেস করলো, অলি, এক্ষুনি বাড়ি যাবি? আমরা কফি হাউসে একটু কফি খেতে যাচ্ছি।

অলি ভাবছিল সে কোনো বইয়ের দোকানে গিয়ে বাড়িতে ফোন করবে কি না। কলেজ স্ট্রিট পাড়ার অনেক প্রকাশকই তার বাবার চেনা, অলিদের বাড়িতেও অনেকেই আসেন। কফি হাউসে যাবার প্রস্তাব শুনে অলি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল।

ওরা প্রায় দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে এলো মিছিলটা আসবার আগেই। একটা পুলিসের গাড়ি জোরে হর্ন বাজাতে বাজাতে আসছে উল্টো দিক থেকে।

সিঁড়ির মুখে ইসমাইলের সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুটি ছেলে, ওরাও প্রেসিডেন্সির, সায়েন্সের ছাত্র, মুখ চেনা। একজন মুখ ফিরিয়ে আলটা মন্তব্য করলো, এসপ্লানেডে লাঠি চার্জ হচ্ছে। আজ আর বাড়ি ফেরা হবে না।

মালবিকারা কান দিল না ওদের কথায়। অলি ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় কাঁপছে। ওপরে কি বাবলুদা থাকবে? বাবলুদা তো প্রায়ই কফি হাউসে আড্ডা মারতে আসে। অলি আজ নিয়ে মাত্র তৃতীয়বার এলো কফি হাউসে, এখানকার চাচামেচি ও সিগারেটের ধোঁয়া তার পছন্দ হয় না।

বাবলুর সঙ্গে অলির দেড় মাস দেখা হয়নি। সেদিন সেই ঝড়বাদলার দিনে বাবলু অলিকে খুব কাঁদিয়েছিল। আচম্বিতে বাবলু অলির শরীর নিয়ে খেলা করতে শুরু করে, অলির তা একটুও ভালো লাগেনি, চোরের মতন হুড়োহুড়ি করে ওরকম আদর অলির একটুও পছন্দ নয়। তার কাছে প্রেম একটা পবিত্র ব্যাপার, সে মনে মনে স্বপ্ন দেখতো, একদিন কোনো প্রিন্স চার্মিং তার হাতে আলতো করে ঠোঁট চুঁইয়ে বলবে, তোমার জন্য যদি আমি অপেক্ষা করতে চাই, তুমি কি তার অনুমতি দেবে?

অলি কোনোক্রমে বাবলুর আলিঙ্গন ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিল, ছিঃ, ছিঃ, বাবলুদা, তুমি এরকম? তুমি আর কোনোদিন আমাদের বাড়িতে এসো না!

বাবলু বিশেষ পাত্তা দেয়নি, হাসছিল। অলি দ্বিতীয়বার ঐ একই কথা বলায় বাবলু বলেছিল, এ বাড়িতে আসবো কি না আসবো, সে সম্পর্কে তুই বলার কে রে? এটা তোর বাড়ি? এটা কাকাবাবুর বাড়ি, আমার যখন খুশী আসবো!

অলি বলেছিল, আমার সঙ্গে তুমি আর কখনো দেখা করার চেষ্টা করো না! বাবলু অলির মাথায় একটা ছোট্ট চাঁটি মেরে বলেছিল, এতে কাঁদবার কী আছে? এমন কিছু করা হয়নি। তুই কি কচি খুকি নাকি?

তারপর সে শিস দিতে দিতে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় সে বুলির সঙ্গে হাল্কাভাবে দু’একটা ইয়ার্কি করে গেল।

কিন্তু সে আর সত্যিই আসেনি একবারও তারপর। আগে সে সপ্তাহে অন্তত দু’তিনদিন তার বাবার প্রফ বা পাণ্ডুলিপি পৌঁছে দেবার জন্য আসতো বিমানবিহারীর কাছে, সে জন্যও এলো না। বাবলু যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে।

সেদিন অলি অনেকক্ষণ কেঁদেছিল, বুকের মধ্যে একটা দুর্বোধ্য কষ্ট সে কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। সেই চমৎকার বৃষ্টির দিনের ভালো লাগা, তার ওপরে পড়েছিল কালো কালির ছাপ। রাগের চেয়েও বেশি অভিমান হয়েছিল বাবলুর ওপর, সে বন্ধুত্বের মূলা দিতে জানে না?

এরপর দেখা হলে সে বাবলুর সঙ্গে নিছক ভদ্রতার সম্পর্ক রাখবে ঠিক করেছিল। কিন্তু সে আর এলোই না? এটাও অলির কাছে অবিশ্বাস্য লাগে, এরকম যেন বাবলুর চরিত্রের সঙ্গে মানায় না।

কোনোক্রমে সাতটা দিন পার হবার পর অলিই বাবলুর জন্য ছটফট করেছে। অন্তত ঝগড়া করার জন্যও তার বাবলুকে দরকার। কিন্তু কোথায় বাবলু? সে যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। অলিদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই তার যাতায়াতের পথ, প্রত্যেক বিকেলবেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকেও অলি তাকে একবারও দেখতে পায়নি।

বাবলুদের বাড়ি বেশি দূরে নয়, অলি ইচ্ছে করলেই যেতে পারে। আগে তো তারা দুই বোনে বাড়ির একজন কাজের লোককে সঙ্গে নিয়ে কতবার গেছে। কিন্তু সেদিনের পর অলি কেন যেন বাবলুদের বাড়িতে যেতে সাহস পায় না। ওকে তো বিশ্বাস নেই, হঠাৎ সকলের সামনে কী বলে দেবে কে জানে!

কফি হাউসে বাবলু আসে, কিন্তু অলি একা একা কফি হাউসে বাবলুকে খোঁজার জন্য আসার কথা ভাবতে পারে না। বাবলু সম্পর্কে তার মনের মধ্যে একটা ভয়ও ঢুকে গেছে।

দোতলায় উঠে মালবিকা জিজ্ঞেস করলো, কোথায় বসবি?

বর্ষা বললো, ওপরে, আরও ওপরে, এই জায়গাটা বিচ্ছিরি!

দোতলায় কফির দাম একটু কম। এখানে সব টেবিল জুড়ে বসে থাকে আড্ডাধারীরা, কেউ কেউ দুপুর তিনটেয় বসে, রাত আটটার আগে ওঠে না। তিন কাপ কফি পাঁচজনে ভাগ করে খায়। কলকাতার একমাত্র এই কফি হাউসেই ফরাসী নিয়ম, এখানে কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কিছু অডার না দিয়ে চেয়ার দখল করে বসে থাকলেও বেয়ারারা তাকে উঠে যেতে বলার সাহস পায় না।

তিনতলার ব্যালকনিতে খরচ সামান্য বেশি, মেয়েরা সাধারণত এখানেই আসে। এখানে সহজে টেবিল ফাঁকা পাওয়া যায় না, চেয়ার টেনে নিয়ে অন্যের টেবিলে বসে পড়ার প্রথা আছে। আজ কিন্তু দু’তিনটি টেবিল খালি। কয়েকটি ছেলে জানলার পাশে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছে রাস্তায়।

ওরা চারজনে একটা টেবিলে বসলো। মালবিকা আঁচল দিয়ে মুখ মুছে বললো, আমার মাটন ওমলেট খেতে ইচ্ছে করছে। জানিস, বাড়িতে এটা বানাবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এখানকার মতন স্বাদ হয় না।

বর্ষা জিজ্ঞেস করলো, দুধ দিয়েছিলি?

–দুধ?

–ডিমটা ফ্যাটাবার সময় কয়েক ফোঁটা দুধ দিতে হয়। তাতে ওমলেটটা বড় হয়ে ফুলে যায় আর নরম হয়।

–ওমা, সেটা জানতুম না।

–আমাদের বাড়িতে আসিস একদিন, করে দেখিয়ে দেবো!

মালবিকা সবার দিকে তাকিয়ে বললো, তাহলে চারটে মাটন ওমলেট বলি?

নাসিম ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে বললো, কিন্তু ভাই, উই উইল গো ডাচ্।

বর্ষা বললো, ডেফিনিটলি!

প্রত্যেকেই ছোট ছোট পার্স খুলে দুটি করে টাকা বার করে রাখলো টেবিলের ওপর। নাসিম। বললো, আমি পরে কোল্ড কফি খাবো।

জানলার ধারের ছেলেগুলি কী যেন দেখে হৈ হৈ করে ছুটে গেল নিচে।

অলি টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে দোতলার দিকে তাকালো। সিঁড়ির ডান পাশের কয়েকটি টেবিল ছাড়া আর অনেকখানিই দেখা যায়। তার কোনো টেবিলেই বাবলু নেই। বাবলুর এক বন্ধু কৌশিককে চিনতে পারলো অলি, কৌশিক তার দিকে তাকালো একবার। বাবলু এলে ঐ টেবিলে বসাটাই স্বাভাবিক ছিল। কৌশিকদের টেবিলে কিসের যেন উত্তেজিত তর্ক হচ্ছে।

বর্ষা জিজ্ঞেস করলো, তুই কাকে খুঁজছিস রে, অলি?

টেবিলে ফিরে এসে অলি বললো, তুই চিনবি না। আচ্ছা, বাইরে এত গোলমাল হচ্ছে কেন?

মালবিকা বললো, ঐ যে কী একটা মিছিল এলো দেখলি না? আর পারা যায় না, রোজই মিছিল আর মিছিল।

পাশের টেবিলে বসে আছে তিনটি ছেলে, ওদের অচেনা। তাদের একজন হঠাৎ উঠে এসে বললো, এক্সকিউজ মি, আপনাদের কার কাছে কলম আছে? একটু দেবেন?

‘আপনাদের’ বললেও ছেলেটি হাত বাড়িয়েছে নাসিমের দিকে। এই চার কন্যার মধ্যে নাসিমই সবচেয়ে দর্শনীয়া। সে খানদানি মুসলমান বংশের মেয়ে, তার গায়ের রং দুধে-আলতা। অন্য তিনজনের তুলনায় সে বেশি লম্বা।

নাসিম কলমটা এগিয়ে দিল। ছেলেটি নিজের বাঁ-হাতের তালুতে একটুকরো কাগজ রেখে খস খস করে কিছু লিখে কলমটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো, থ্যাঙ্ক ইউ!

অন্য তিনজন মুখ লুকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। সবাই জানে, এই কলম চাওয়াটা আর কিছুই না, একটু আলাপ করার ছুতো। ওরা সম্পূর্ণ গম্ভীর না থাকলে হয়তো ছেলেটি আরও কিছু বলতো। কিংবা, ঐ ছেলেটি তার বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ফেলেছে, দ্যাখ, ঐ ফর্সা মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে পারি কি না।

নিচের তলায় কারা যেন হুড়োহুড়ি, দৌড়োদৌড়ি করছে, একটা চেয়ার উল্টে পড়ার শব্দ হলো। পাশের টেবিলের ছেলে তিনটি উঠে গিয়ে দেখলো উঁকি দিয়ে, কিন্তু এই চার কন্যার কোনো কৌতূহল নেই।

মাটন ওমলেট সত্যি বেশ উপাদেয়। ওদের খিদেও পেয়েছিল। পয়সার হিসেব করে দেখা গেল, ওরা সিঙ্গ-এর বদলে ডাবল ডিমের অডার দিলেও পারতো। এরপর কফি। প্রথম চুমুক দিয়ে নাসিম জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, ‘পরফিরিয়াজ লাভার’ কবিতাটা ব্রাউনিং-এর লেখা, তাই না?

অলি মাথা নাড়লো।

নাসিম আবার জিজ্ঞেস করলো, কবিতাটা ভালো মনে পড়ছে না, পরফিরিয়াকে তার প্রেমিক গলা টিপে মেরে ফেললো, তাই না?

অলি বললো, গলা টিপে নয়, পরফিরিয়ারই চুল জড়িয়ে।

–কেন মেরেছিল? একটু বলো না। অলি ইংলিশ অনার্সের ছাত্রী, তাকে ওরা মাঝে মাঝে এই সব প্রশ্ন করে।

অলি মৃদু গলায় কবিতাটা বর্ণনা করতে লাগলো, মালবিকা একটু অন্যমনস্ক, সে শুনছে না। বর্ষা তার ভোলা চুলে আঙুল চালাচ্ছে। বর্ষা কখনো চুলে খোঁপা করে না, ঐরকম আঙুল চালানো স্বভাবের জন্য তার চুল সব সময় উস্কোখুস্কো দেখায়। সে কোনোরকম প্রসাধনই করে না। দিনের পর দিন একটা শাড়ি পরে কলেজে আসতেও তার লজ্জা নেই। বর্ষার বাবা মারা গেছেন কিছুদিন আগে, তার বাড়ির অবস্থা সচ্ছল নয়।

বর্ষা হঠাৎ মন্তব্য করলো, অদ্ভুত কবিতা। শুধু শুধু মেয়েটাকে মেরে ফেললো? পুরুষরা এইরকমই লেখে। ওথেলো ডেসডিমোনাকে মেরে ফেললো কী একটা তুচ্ছ সন্দেহ করে!

অলি থেমে গেল।

বর্ষা আবার জিজ্ঞেস করলো, নাসিম, হঠাৎ তোর এই কবিতাটার কথা মনে পড়লো কেন?

নাসিম দুঃখিত স্বরে বললো, আমার এক বোন, আমার ফুফার মেয়ে, এলাহাবাদে থাকতো, সে হঠাৎ আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু তাকে একজন ভালোবাসতো খুব!

বাইরে রাস্তায় পর পর দুটি বোমা পড়ার প্রচণ্ড শব্দ হলো।

বর্ষা বললো, সেই লোকটা তোর বোনকে মেরে ফেলেছে?

মালবিকা বললো, এই, বোমা টোমা পড়ছে, কী করে যে বাড়ি যাবো?

বর্ষা বললো, ওসব একটু বাদে থেমে যাবে! বোস্ না! নাসিম কী বলছে শোন।

নাসিম বললো, আমার বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সে সুখী ছিল না, আমি জানতাম, আমাকে চিঠি লিখতে প্রায়ই, ঐ যে আর একজনের কথা বললাম, সে-ও আমার দূর সম্পর্কের ভাই হয়।

–তাহলে তার সঙ্গেই বিয়ে হলো না কেন? তোদের তো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে বিয়ে হয়।

–আমার সেই ভাইয়ের একবার টি বি হয়েছিল।

হুড়মুড় করে লোক ঢুকে আসছে দোতলায়। দড়াম দড়াম করে জানলা বন্ধ হবার শব্দ হচ্ছে। কৌশিক দৌড়ে তিনতলায় উঠে এসে ওদের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললো, বাইরে সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হচ্ছে, আর আপনারা এখানে নিশ্চিন্তভাবে গল্প করছেন?

বর্ষা মুখখানা কঠোর করে বললো, আপনি?

অলি বললো, এর নাম কৌশিক, আমি চিনি। কী হচ্ছে বাইরে?

কৌশিক বললো, আপনারা সত্যি অদ্ভুত। শুনতে পাচ্ছেন না? পুলিস গুলি চালাচ্ছে।

নাসিম সরলভাবে জিজ্ঞেস করলো, কখন থামবে?

কৌশিক বললো, পুলিস কি আমাকে জিজ্ঞেস করে গুলি চালাচ্ছে? শিয়ালদার দিক থেকে আর একটা মিছিল আসছে, এরপর আর আপনারা বাড়ি ফিরতে পারবেন না!

মালবিকা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, এই, চল চল।

রাস্তায় আবার দুটি বোমা ফাটলো। ধুপ ধুপ শব্দে টিয়ার গ্যাস সেল ফাটার আওয়াজ। তারই মধ্যে মুহুর্মুহু ইনক্লাব জিন্দাবাদ শ্লোগান।

মালবিকা কৌশিককে জিজ্ঞেস করলো, পুলিস কেন গুলি চালাচ্ছে? কিসের মিছিল?

কৌশিক বললো, কিছুই খবর রাখেন না? ক’দিন ধরে খাদ্য আন্দোলন চলছে জানেন না?

বর্ষা বললো, আপনি অত ধমকে ধমকে কথা বলছেন কেন? কাগজে সবই পড়েছি। কিন্তু সে আন্দোলন তো মফস্বলে, কৃষ্ণনগর না কোথায় যেন হচ্ছিল!

কৌশিক অলির দিকে তাকিয়ে বললো, সামনের দিকে বেরুবার উপায় নেই। পেছন দিকে একটা রাস্তা আছে, সেদিক দিয়ে আমি বার করে দিতে পারি। যেতে চান তো চলুন। এরপর যদি আরও গণ্ডগোল বাড়ে…

অলি বললো, আপনি অতীন মজুমদারকে দেখেছেন?

কৌশিক বললো, হ্যাঁ, অতীন একবার এসেছিল দুপুরে, তারপর আর দেখছি না। বোধ হয়। ও মিছিলে গেছে।

–মিছিলে?

–দেরি করবার সময় নেই। যাবেন তো চলুন।

অন্য কোনো টেবিলে এখন আর কেউ নেই। নিচে বিরাট কলরব। ওরা দৌড়ে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। দোতলায় এসে কৌশিক ওদের বাঁ-পাশের একটা গলি পথে নিয়ে এলো। এর দু’পাশে বইয়ের গুদাম। পুরোনো কাগজ আর আঠার গন্ধ। গ্যামাক্সিন আর মরা আরশোলার গন্ধে দম আটকে আসে।

গলিটা ক্রমশ ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হয়ে আসছে। কৌশিক এগিয়ে যাচ্ছে সামনে সামনে, মেয়েরা হোঁচট খাচ্ছে বার বার। ঝলমলে আলোকিত কফি হাউসের বাড়িটার মধ্যেই যে এরকম একটা এঁদো-অন্ধকার গলি থাকতে পারে তা ওরা কেউ কল্পনাই করতে পারেনি।

মেয়েদের মধ্যে একজন হুমড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল একবার, সে চেঁচিয়ে উঠতেই কৌশিক বললো, আস্তে! শুনতে পেলে সবাই এদিক দিয়ে ছুটে আসবে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে সে নাসিমের হাত চেপে ধরে জোরালো ফিসফিসানিতে বললো, আমার সঙ্গে আসুন!

একগুচ্ছ বালিকার পরিত্রাতার ভূমিকায় নেমে পড়ে কৌশিক বেশ উত্তেজিত সাহসী হয়ে উঠেছে। বুকের মধ্যে সে বোধ করছে একটা অতিরিক্ত বলিষ্ঠতা।

গলিটা এক প্রান্তে এসে আর একটা সিঁড়ির সঙ্গে মিশেছে। সে সিঁড়িটাও অন্ধকার, ইদানীং ব্যবহারই হয় না মনে হয়। অলি সিঁড়িটা দেখে বুঝতে পারলো, এককালে এটা এ বাড়ির মেথরদের ব্যবহারের সিঁড়ি ছিল। অলিদের বাড়িতেও এরকম আছে।

কোনোরকমে নিচে এসে আরও কয়েকটা দোকান ঘরের পেছন দিক দিয়ে দৌড়ে তারা এসে পড়লো মহাত্মা গান্ধী রোডে। এদিকের মিছিল এখনো এসে পৌঁছোয়নি, পুলিস কর্ডন করে রেখেছে দু’দিকের রাস্তা, সেখানটা ধোঁয়ায় ভরা। একটু দূরেই কোথাও বোমার আওয়াজ হচ্ছে ঘন ঘন।

কৌশিক বললো, কফি হাউসের দোতলা থেকে বোমা ছুঁড়ছে, আপনারা আর একটুক্ষণ থাকলে আর দেখতে হতো না!

মেয়ে চারটি নির্বাক হয়ে গেছে। বছর দু’এক কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় এমন বোমাবাজি আর পুলিসের লাঠি-গুলি চলেনি। সেই জন্য অলি মালবিকাদের এই সব ব্যাপারে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। তারা কলেজ করতে আসে, বাড়ি চলে যায়। এইরকম দৃশ্য আগে দেখেনি। খবরের কাগজে মিছিল, আন্দোলন, বোমা-গুলি চালনার খবর তারা দেখে, সব সময় মন দিয়ে পড়েও না, ওসব যেন অন্য জগতের ব্যাপার, তাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই। একটু আগে তারা ব্রাউনিং-এর একটি প্রণয় গাথার সঙ্গে একটি সত্য ঘটনা মেলাচ্ছিল, জানলার বাইরে কী হচ্ছে তাতে গুরুত্ব দেয়নি।

মালবিকা বললো, কী করে বাড়ি যাবো?

কৌশিক ধমক দিয়ে বললো, আমি না ডাকলে তো আপনারা এখনো বসে বসে গল্পই করতেন। তাহলে বাড়ির বদলে হাসপাতালে যেতে হতো।

সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েকজন পুলিস দপদপিয়ে ছুটে যাচ্ছে এদিক ওদিক। মূল গোলমালটা হচ্ছে ইউনিভার্সিটির দিকে, বোমার শব্দের বিরাম নেই।

টিয়ার গ্যাসে ছলছল করছে ওদের চোখ। অলির শাড়ির আঁচলে জড়িয়ে গেছে অনেকখানি মাকড়সার জাল।

বর্ষার বাড়ি কাছেই, ঠনঠনের দিকে। সে রাস্তা পার হতে চায়। কৌশিক বললো, সবাই রাস্তা পার হয়ে চলুন, পেছন দিকেই গোলমালটা বেশি। মাথার ওপর হাত তুলুন!

আরও কিছু কিছু লোক রাস্তা পার হচ্ছে, সকলেরই মাথার ওপর হাত তোলা। ওরাও সেইরকম করলেও পুলিসের পক্ষ থেকে কী যেন ধমক দিয়ে বলা হলো তাদের। অলি চোখ বুজে ফেললো। বাবলুদা মিছিলে গেছে? বাবলুদাও পুলিসের দিকে বোমা ছোঁড়ে? কিছুই আশ্চর্য না! বাবলুদা একদিন গর্ব করে বলেছিল, আমি সহজে মরবো না, জানিস! দেখলি না, আমি গঙ্গায় ডুবে যাচ্ছিলুম, কিন্তু আমি মরলুম না, মরে গেল আমার দাদা!

রাস্তাটা পার হয়ে এসেই বর্ষা সাহস ফিরে পেল। চুলে আঙুল চালিয়ে সে বললো, আমি এবার দৌড়েই বাড়ি চলে যেতে পারবো। তোরা কি করবি? আমার বাড়িতে আসবি?

মালবিকা বললো, না, না, আমাকে যেমন করে তোক বাড়ি ফিরতেই হবে। মা দারুন চিন্তা করবে।

কৌশিক বললো, বাদবাকি আপনারা সব সাউথে? শিয়ালদার দিকে চলুন, ওখানে ট্যাক্সি পাওয়া যেতে পারে।

বর্ষা ঢুকে গেল একটা গলির মধ্যে, ওরা এগোলো শিয়ালদার অভিমুখে। বেশি দূর যাওয়া গেল না, ওদিক থেকেও একটা মিছিল আসছে এতক্ষণে। হঠাৎ ছুটতে লাগলো সবাই, পুলিসের কর্ডন ভেঙে গেল, আবার লাঠি চার্জ, ইঁট পাথরের বৃষ্টি।

একটা মানুষের ঢেউতে ধাক্কা খেয়ে ওরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অলি দেখলো, সে কিছু অচেনা লোকের সঙ্গে দৌড়োচ্ছে, আর কোনো উপায়ও নেই, স্রোতের বিরুদ্ধে ফেরা যাবে না।

বেশ কিছু দূরে এসে সেই স্রোতের বেগটা কমে গেল। অলি দেখলো সে একটা পোস্ট অফিসের কাছে চলে এসেছে। এই জায়গাটা তার চেনা নয়, মালবিকা, নাসিম, কৌশিককে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ওরা কি একসঙ্গে আছে, না প্রত্যেকেই আলাদা হয়ে গেছে। অলি এইখানে দাঁড়িয়ে থাকলে কি ওরা তাকে খুঁজে নিতে আসবে?

টিয়ার গ্যাসের জ্বালা তো আছেই, তা ছাড়া প্রচণ্ড অভিমানে অলির কান্না এসে গেল। বাবলুদা কেন আজ কফি হাউসে ছিল না? বাবলুদা থাকলে সে এরকমভাবে হারিয়ে যেতে পারতো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *