দুদিন পর সন্ধের আগে আগে চাল, ডাল, আটা, আলু, তেল, মশলা, গুঁড়ো দুধ ইত্যাদি নিয়ে একটা লরি সরাসরি ক্যাম্প অফিসের সামনে এসে থামল। কলোনাইজেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট পরিতোষ বণিক খুবই চিন্তায় ছিল। কী কী জিনিস এখানে দরকার তার তালিকা নিয়ে বিশ্বজিৎ সেই যে পোর্ট ব্লেয়ার চলে গিয়েছিলেন তারপর তিনি একেবারে চুপচাপ। পরিতোষের দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, বিশ্বজিৎ যেরকম ব্যস্ত মানুষ, অনেকগুলো দপ্তরের দায়িত্ব তাঁকে সামলাতে হয়–হয়তো সেটেলমেন্টের ব্যাপারটা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়ে থাকবে। এদিকে দু-তিন দিনের ভেতর জেফ্রি পয়েন্টে রসদ এসে না পৌঁছুলে মহা সমস্যা হয়ে যাবে। কিন্তু না, বিশ্বজিৎ ভুলে যাননি। লরি বোঝাই করে ঠিক পাঠিয়ে দিয়েছেন।
অন্যদিনের মতো উদ্বাস্তুদের সঙ্গে জমি থেকে বিনয় আর শেখরনাথ ফিরে এসেছিলেন। সমুদ্র থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে সবাই চাটা খাচ্ছিল। লরি দেখে উদ্বাস্তুরা সেখানে চলে গেল। পায়ে পায়ে বিনয়রাও গেল।
পরিতোষ, লা ডিন, ধনপত এবং পুনর্বাসন আর বনদপ্তরের কর্মীরা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। লরিতে অগুনতি চটের বস্তা, সারি সারি টিনের আর কার্ডবোর্ডের বাক্স। তক্ষুনি মাল নামানোর ব্যবস্থা হয়।
কর্মীরা কাঁধে পিঠে বস্তাটস্তা চাপিয়ে ক্যাম্প অফিসের পেছন দিকের গুদাম ঘরে নিয়ে রাখতে থাকে।
লরির ড্রাইভার শেখরনাথ আর পরিতোষের জন্য দুটো সাদা খামের চিঠি নিয়ে এসেছিল, বিনয়ের জন্য একটা বড় প্যাকেট বিশ্বজিৎ পাঠিয়েছেন। ড্রাইভার তিনজনকে সেগুলো বুঝিয়ে দিল।
পরিতোষ তক্ষুনি তার খামটা খুলে চিঠি বার করল। দ্রুত পড়ে নিয়ে বিনয়দের বলল, সারের সব দিকে খেয়াল আছে। এদিকে আমি চিন্তায় অস্থির হইয়া উঠছিলাম। সার লেখছেন এইবার কইলকাতা থিকা যে মাল আইছে, পোর্ট ব্লেয়ারের বিজনেসম্যানরা হেগুলান (সেগুলো) খালাস করতে তিন দিনের জাগায় (জায়গায়) নয় দিন লাগাইছে। হের পর সার চাউল ডাইলের অর্ডার দিছেন। মাল আইতে হেই লেইগা (সেজন্য) এত দেরি অইছে। যাউক, আমার ট্যানশান কমল।
শেখরনাথও তার চিঠিটি পড়ে ফেলেছেন। বিনয়কে বললেন, তোমার সম্বন্ধে বিশু অনেক কথা লিখেছে। রিফিউজি সেটেলমেন্ট কীভাবে গড়ে উঠছে তা তো তুমি নিজের চোখেই দেখছ। বিশুকে তুমি বলেছ, পেনাল কলোনি দেখাবে। সে সম্বন্ধে কাগজে লিখবে। বিশু লিখেছে আমি যেন তোমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাই। কাছেই, দুটো পাহাড়ের পর একটা বড় পেনাল কলোনি আছে। খুব শিগগিরই তোমাকে নিয়ে ওখানে যাব। লেখার প্রচুর মেটিরিয়াল পেয়ে যাবে।
এতবড় একটা সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। উৎসুক সুরে বিনয় বলল, নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে যাব। বলল বটে, কিন্তু পরক্ষণে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। হাতের প্যাকেটটা বেশ ভারী। বোঝাই যাচ্ছে, প্রচুর কাগজপত্র রয়েছে ওটার ভেতর। প্যাকেটে বিশ্বজিতের চিঠি নিশ্চয়ই আছে; কিন্তু সে চিঠি আর কত বড় হতে পারে? তার মনে হল, কদিন আগে এখান। থেকে বিশ্বজিৎ যখন পোর্ট ব্লেয়ারে যান, তাঁর হাতে কলকাতা পাঠাবার জন্য শুধু রিপোর্টই নয়, কটা চিঠিও পাঠিয়েছিল। খুব সম্ভব সেগুলোর জবাব এসেছে। বিনয় উদগ্রীব হয়ে উঠল।
এদিকে সন্ধে নেমে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীরা আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন। বিনয় বলল, কাকা, মনে হচ্ছে আমার অনেকগুলো চিঠি এসেছে। মনে হচ্ছে কলকাতা থেকে। ঘরে গিয়ে দেখি
শেখরনাথ বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাও। আমি এখানে এদের সঙ্গে একটু গল্প করি।
বিনয় তাদের ঘরে চলে এল। ঘরে জোরালো লণ্ঠন জ্বলছিল। যে কমিটির ওপর আলো জ্বালাবার দায়িত্ব তাদের কোনওদিনই ভুল হয় না; সন্ধে নামতে নামতেই জ্বেলে দিয়ে যায়।
হাতের প্যাকেটটার মুখ খুলে টেবলের ওপর রেখে চেয়ারে বসল বিনয়; তারপর প্যাকেটটার ভেতর থেকে পাঁচখানা খাম বার করল। পাঁচটা খামের ওপরেই তার নাম, পোর্ট ব্লেয়ারে বিশ্বজিৎ রাহার বাংলোর ঠিকনা এবং নিচে কোণের দিকে প্রেরকের নাম লেখা আছে। শুধু একটা খামে গোটা গোটা পরিচ্ছন্ন হরফে তার। আন্দামানের নাম-ঠিকানাই শুধু রয়েছে। কে চিঠিটা লিখেছে তার নাম নেই।
প্রথম চিঠি বিশ্বজিতের। তিনি লিখেছেন, প্রিয়বরেষু, কাকা জেফ্রি পয়েন্টে গেছেন। তার কাছ থেকে ব্রিটিশ আমলের আন্দামান সম্পর্কে যতটা পারেন জেনে নেবেন। এই দ্বীপপুঞ্জ সম্পর্কে ওঁর মতো বিশেষজ্ঞ আর জীবিতদের মধ্যে কেউ নেই। আশা করি আপনার কাজকর্ম ভালো চলছে। কলকাতায় পাঠানোর জন্য চিঠি এবং প্রতিবেদন, যা-যা এর মধ্যে লিখেছেন, যে ড্রাইভারটি লরিতে মালপত্র নিয়ে গেছে তার হাতে দেবেন। পাওয়ামাত্র সেগুলো পাঠানোর ব্যবস্থা করব। আপাতত এখানেই শেষ করছি।-বিশ্বজিৎ।
দ্বিতীয় চিঠিটি নতুন ভারত-এর চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়ির। তিনি লিখেছেন
প্রিয় বিনয়, আন্দামান থেকে তোমার পাঠানো তিনটি প্রতিবেদন পেয়েছি। আমাদের কাগজে ছাপাও হয়ে গেছে। পাঠকদের রেসপন্স দুর্দান্ত। এডিটর জগদীশ গুহঠাকুরতা খুব খুশি। আমাকে এবং নিউজ এডিটর তারাপদদাকে তার চেম্বারে ডেকে নিয়ে তোমার লেখাগুলোর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। অবিলম্বে আরও লেখা পাঠাও। তোমাকে যেমন বলে দিয়েছিলাম, নিশ্চয়ই সেসব মনে আছে। শুরু রিফিউজি সেটেলমেন্ট নয়, পেনাল কলোনি, ওখানকার ট্রাইবালদের লাইফ, সেলুলার জেলের বর্তমান অবস্থা, তার ইতিহাস, প্রাকৃতিক পরিবেশ-কোনও কিছুই বাদ দেবে না।
তোমার লেখাগুলোর সঙ্গে ছবি থাকলে গুরুত্ব আরও বাড়ত। রিপোর্টিংয়ের সঙ্গে ফোটোটা খুব জরুরি। আমাদের একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। তোমাকে একটা ক্যামেরা দেওয়া উচিত ছিল। জগদীশবাবু বলেছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। যতদিন না ওটা পৌঁছাচ্ছে, ওখানকার কারওকে দিয়ে যদি ফোটো পাঠাতে পার, সেই চেষ্টা করো।
এবার কলকাতার কথা জানাই। তুমি আন্দামানে যাবার আগেই রিফিউজিদের নিয়ে নানারকম মুভমেন্টে শহরটা অস্থির হয়ে উঠেছিল। এখন একেবারে উত্তাল। তুমি দেখে গেছ, লেফট পার্টিগুলোর অর্গানাইজেশন ইউনাইটেড সেন্ট্রাল রিফিউজি কাউন্সিল (আর.এস.পি বাদে), সংক্ষেপে ইউসিআরসি, রিফিউজি সেন্ট্রাল রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল, সংক্ষেপে আর সি আর সি, দক্ষিণ কলিকাতা শহরতলি বাস্তুহারা সংহতি–এইসব সংগঠন রোজ সারা শহর জুড়ে কত যে মিছিল বার করছে তার লেখাজোখা নেই। শুধু রিফিউজিদের নিয়ে মিছিল, মিটিং আর স্লোগান।
কলকাতার চারপাশে জলাজমি পতিত জমি আর হোগলাবনে উদ্বাস্তুরা অগুনতি জবরদখল কলোনি বসিয়েছে, সেসব কলোনির নানা বিবরণ নতুন ভারত-এ দিনের পর দিন তুমি লিখে গেছ। গুন্ডাবাহিনী দিয়ে জমির মালিকরা তাদের উৎখাত করতে চেয়েছে। উদ্বাস্তুরা তাদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে তাদের দখল কায়েম রেখে চলেছে। কিন্তু মালিকপক্ষ এবার অন্য পথ ধরেছে। সরকারের ওপর চাপ দিয়ে বাস্তুহারাদের কলোনিগুলো থেকে উচ্ছেদ করবে, এমন একটা বিল আনতে চলেছে। ইউ সি আর সি, আর সি আর সি এবং উদ্বাস্তুদের অন্য সংগঠনগুলো এই উচ্ছেদ বিলের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রামের ডাক দিয়েছে। কলকাতা খুব শিগগিরই বিশাল রণক্ষেত্র হয়ে উঠতে চলেছে। কত যে রক্তক্ষয় হবে, কে জানে। সুষ্ঠু পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নেই, পোড় জমি, জলা উদ্ধার করে পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষগুলো কোনওরকমে মাথা গোঁজার একটু জায়গা করে নিতে চাইছে সেটাও তাদের দেওয়া হবে না। তাহলে লক্ষ লক্ষ এই মানুষের কী ভবিষ্যৎ?
যা-ই হোক, কলকাতার এই রিফিউজি মুভমেন্টের অ্যাসাইনমেন্টটা পাওয়ার জন্য রমেন বিশ্বাস আমাকে আর তারাপদদাকে খুব ধরাধরি করেছিল। লোকটা ভালো নয়, তোমাকে ভীষণ ঈর্ষা করে, তুমি যে ভালো কাজ করছ সেটা ওর দুচোখের বিষ। আমরা ওকে অ্যাসাইনমেন্টটা দিইনি, দিয়েছি সুধেন্দুকে। জগদীশবাবু চান, তুমি ফিরে এলে তোমাকেই এটা দেওয়া হবে।
আশা করি ভালো আছ। তোমার চিঠি এবং প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করে থাকব।-হতি প্রসাদদা।
চিঠিটা পড়ে মন ভালো হয়ে গেল। তার লেখার সমাদর হয়েছে, পাঠকরা তার কাছ থেকে আন্দামান দ্বীপমালা সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানার জন্য আগ্রহী, এটা তার উদ্দীপনাকে যেন উসকে দিতে লাগল।
সবচেয়ে বড় কথা, রমেন বিশ্বাসকে কলকাতার উদ্বাস্তু আন্দোলন কভার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এই কুচুটে, হিংসুটে ঈর্ষাকাতর লোকটাকে বিনয় যে আদৌ পছন্দ করে না প্রসাদদারা তা জানেন। ওঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল বিনয়ের।
তৃতীয় চিঠিটা আনন্দর। খুবই সংক্ষিপ্ত চিঠি। সে লিখেছে, বিনয়ের জন্য তাদের দুশ্চিন্তা ছিল। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অতটা পথ গেছে! চিন্তাটা স্বাভাবিক। তার পৌঁছানো সংবাদ পেয়ে আনন্দদারা খুশি। বিনয়ের লেখা তারা কাগজে পড়ছে। খুব আন্তরিক লেখা, মনকে নাড়া দিয়ে যায়। তাদের বাড়ির সবাই ভালো আছে। সুধাদের সঙ্গে এর মধ্যে দেখা হয়নি। খুব শিগগিরই একদিন সুনীতিকে নিয়ে তাদের বাড়ি যাবে। বিনয় যেন নিয়মিত চিঠি লেখে ইত্যাদি ইত্যাদি।
চতুর্থ চিঠিটা সুধার। সে লিখেছে:
স্নেহের বিনু, তোর চিঠি আসতে বেশ কয়েকদিন লাগল। তুই বলে গিয়েছিলি, আন্দামান থেকে কলকাতায় চিঠিপত্র পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে। তবু ভাবনা হয় বইকি। যাক, তোর চিঠি পেয়ে চিন্তা কাটল। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে আছিস। লিখেছিস চারদিকে জঙ্গল, পাহাড়, সাপখোপ, বড় বড় চেলা বিছে, জেঁক, সমুদ্রে হাঙর। এসব জেনে ভীষণ ভয় হয়। খুব সাবধানে থাকবি। সময়মতো খাওয়াদাওয়া করবি। অবশ্য ওই ঘোর জঙ্গলে খাবারদাবার কী জোটে, সে সম্বন্ধে কিছু লিখিসনি। মনে হচ্ছে, খাওয়া দাওয়ার খুব অসুবিধা হচ্ছে। কলকাতায় ভালো চাকরি নিয়ে কত আরামে থাকতে পারতিস কিন্তু ঘাড়ে ভূত চাপল, খবরের কাগজে কাজ করবি। এখন বোঝা কষ্ট কাকে বলে। নিজেই এমন একটা কাজ বেছে নিয়েছিস। কে আর কী করতে পারে?
এবার এখানকার খবর জানাচ্ছি। আমার দাদাশ্বশুর, তোদের। দ্বারিকদাদুকে নিয়ে কদিন যমে-মানুষে টানাটানি গেল। ধুম জ্বর, সেই জ্বর আর রেমিশন হয় না। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। মনে হচ্ছিল বাঁচানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত মা কালী, মা দুর্গা, মা লক্ষ্মীদের করুণায় ধাক্কাটা সামলে উঠতে পেরেছেন। এ-যাত্রা বেঁচেই গেলেন। তবে ভীষণ কাহিল হয়ে পড়েছেন। কাল ডাক্তার অন্নপথ্য দিতে বলেছেন। এই বয়সে শরীর পুরোপুরি সেরে উঠতে কতদিন লেগে যাবে, ভগবানই জানেন। আমার জেঠশাশুড়িকে যেমন দেখে গিয়েছিলি তেমনই আছেন। ওই ধুঁকতে ধুঁকতে টিকে থাকা। তোর হিরণদার অফিসে কাজের চাপ ভীষণ বেড়েছে। তার ওপর দাদাখশুরের জন্য রাত জাগা। বেচারি একেবারে হিমশিম খেয়ে গেছে। আমার এবং উমারও একই হাল।
সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার ব্যাপার, রাজদিয়া থেকে হেমদাদুর কোনও চিঠিপত্র পাচ্ছি না। দেশের কী হাল, ওঁরা কী অবস্থায় আছেন, কিছুই বুঝতে পারছি না। নিত্য দাসের মারফত দাদুর চিঠিটিঠি পাই। তুই আন্দামানে চলে যাবার পর থেকে সে একবারও আমাদের বাড়ি আসেনি। কসবায় ওদের ঠিকানা জানি। ভাবছি, তোর হিরণদাকে সামনের রবিবার নিত্য দাসের বাড়ি পাঠাব। দেখা যাক, রাজদিয়ার কোনও খবর পাওয়া যায় কিনা।
যুগল অবশ্য ফি সপ্তাহে একবার দেখা করে যায়। ওদের কলোনি নিয়ে খুব হুজ্জ্বত চলছে। সরকার নাকি বিল আনতে চলেছে জবরদখল কলোনি থেকে উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদ করবে। এই নিয়ে রাজনৈতিক কটা দল তুমুল আন্দোলন শুরু করেছে। যুগলরাও সেই আন্দোলনে রয়েছে। তবে একটা সুখবর মুকুন্দপুরে আশু মাস্টারমশাইয়ের স্কুল খুব জমে উঠেছে। যুগলরা সবাই চায়। তাদের জীবন তো নিরক্ষর হয়েই কেটে গেল। তাদের। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হোক। পেটে বিদ্যা না থাকলে এদেশে এসে টিকে থাকা যাবে না।
আজ এখানেই শেষ করছি। তুই আমাদের বুকভরা স্নেহ-ভালোবাসা নিস। চিঠি পাওয়া মাত্র উত্তর দিবি। ইতি ছোটদি।
চিঠিটা ভাঁজ করে খামের ভেতর পুরে রাখল বিনয়।
বাকি রইল শেষ চিঠিটা। খামের ওপর সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে তার নাম লেখা রয়েছে: শ্রীবিনয়কুমার বসু। অন্য খামগুলোর তলায় বাঁ দিকে প্রেরকের নাম রয়েছে। কিন্তু এটার তলায় সেরকম কিছু নেই। হাতের লেখাটাও চেনা চেনা মনে হচ্ছে না। কে হতে পারে? কার চিঠি?
রীতিমতো কৌতূহলই হল বিনয়ের। হাত বাড়িয়ে খামটা তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে খুলে ফেলল সে। খুব বড় চিঠি নয়। পুরোটা পড়ার আগে একেবারে তলার দিকটা দেখে নিল। সেখানে ঝুমার নাম লেখা রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরে তীব্র ঝংকারের মতো শিহরন খেলে গেল।
সুধা আনন্দ প্রসাদ লাহিড়িকে চিঠি লিখেছিল বিনয়। ঝুমা বাদ। কিন্তু সে যে তাকে চিঠি লিখবে, কে ভাবতে পেরেছিল। রুদ্ধশ্বাসে বিনয় পড়তে লাগল।
প্রিয়তম, তুমি আন্দামানে যাবার সময় কথা দিয়ে গিয়েছিলে, দু-তিনদিন পর পর তুমি আমাকে চিঠি লিখবে। তারই জন্য আশায় আশায় প্রতি মুহূর্ত কাটিয়ে গেছি। রোজ পোস্টম্যান আসে, বাড়ির অন্য সবার চিঠি দিয়ে যায়। যার চিঠির জন্য চোখ মেলে বসে থাকি সেটাই শুধু আসে না। ব্যর্থ আমার প্রতীক্ষা।
হঠাৎ একদিন শুনলাম, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবাইকে তুমি চিঠি লিখেছ, শুধু আমিই বাদ। শুনে আমার যে কী কষ্ট, কী যাতনা, মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর জ্বলন্ত শেল বিঁধে যাচ্ছে। কটা দিন ভালো করে ঘুমোতে পারিনি, খেতে পারিনি। উদ্ভ্রান্তের মতো কাটিয়ে দিয়েছি।
জানো না, তুমি রয়েছ আমার জীবনজুড়ে? তুমি যে আমার কতখানি, কী করে বোঝাই? চোখ মেললেও তোমাকে দেখতে পাই, চোখ খুললেও তুমি! আমার ছোট্ট ভুবনে শুধু তুমি, তুমি আর তুমি!
আন্দামান তো কলকাতা থেকে মাত্র আটশো পঞ্চাশ-যাট মাইল দূরে। অন্য কোনও গ্রহে নয়। এতটুকু দূরত্বে গিয়ে, মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে তুমি আমাকে ভুলে গেলে? অন্যদের চিঠি লেখার আগে আমাকেই তো তোমার লেখার কথা। কী আমার অপরাধ, কোথায় আমার ত্রুটি, তার তলকূল পাচ্ছি না।
শেষ পর্যন্ত কতরকম চাতুরি করে আনন্দমামার কাছ থেকে তোমার ঠিকানা জোগাড় করেছি তা আমিই জানি। ঠিকানাটা পেয়েই চিঠি লিখতে বসে গেলাম।
অন্যের চিঠিতে জানতে পেরেছি তুমি যেখানে আছ সেই জায়গাটায় গভীর জঙ্গল, পাশেই সমুদ্র। নিশ্চয়ই খুব অস্বাস্থ্যকর। এলাকা। খুব সাবধানে থাকবে। নিজের শরীরের ওপর যত্ন নিও।
একটাই মিনতি, আমাকে ভুলো না, ভুলো না, ভুলো না। তোমাকে ঘিরে, তোমাকে নিয়েই আমার একমাত্র স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন যদি পূরণ না হয়, আমি ভেঙে চুরমার হয়ে যাব।
তুমি চলে যাবার পর থেকে সারাক্ষণ আমি অস্থির হয়ে থাকি। আমাকে আর কষ্ট দিও না। এই চিঠি পেয়েই উত্তর দেবে। ইতি তোমার ঝুমা।
চিঠিটা পড়ার পর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে বিনয়। সারা শরীরে। কেমন একটা অসাড় অসাড় ভাব। জানালার বাইরে, একটু দূরে হ্যাঁজাক আর জোরালো লণ্ঠনের আলোয় শেখরনাথ উদ্বাস্তুদের সঙ্গে গল্প করছেন। এত আলো তবু তাদের যেন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। সব যেন সারি সারি ছায়ামূর্তি। আরও দূরে পশ্চিম আর দক্ষিণ দিকের পাহাড়গুলোকে ঝাপসা দৈত্যের মতো মনে হচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ অনভূতিশূন্যের মতো কেটে গেল বিনয়ের। তারপর, আচমকা সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলজুড়ে তুমুল আলোড়ন শুরু হয়ে গেল।
পূর্ব বাংলার সুদূর স্বপ্নের মতো এক ভূখণ্ডে সেই কোন অল্প বয়স থেকে দুই কিশোরীকে নিয়ে আরম্ভ হয়েছিল দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর টানাপোড়েন। সেই কিশোরীরা এখন ভরপুর যুবতী, বিনয় নিজেও পূর্ণ যুবক। মনে হয় শত আলোকবর্ষ ধরে এই দুই নারীকে নিয়ে নিজের সঙ্গেই তার অবিরল যুদ্ধ চলেছে। কখনও চিরদুঃখী ঝিনুক নাড়ি ধরে টান দেয়, কখনও তীব্র আকর্ষণে তাকে যেন শিকড়সুদ্ধ উপড়ে তার কাছে নিয়ে যায় ঝুমা। এটাই বুঝিবা তার ভবিতব্য।
রস আইল্যান্ডে চকিতের জন্য চলুঙ্গা জাহাজে ঝিনুককে দেখার পর থেকে সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে একদিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল সে। ভুলে গিয়েছিল ঝিনুক যখন নিরুদ্দেশ, জীবনের অপার শূন্যতাকে ধীরে ধীরে ভরিয়ে দিয়েছিল ঝুমা। অসীম আগ্রহে তারই জন্য প্রতীক্ষা করে আছে মেয়েটা। কোনওদিনই রূঢ়ভাবে তাকে সরিয়ে দিতে পারেনি, বলতে পারেনি ঝিনুক ছাড়া অন্য কোনও নারীর কথা সে ভাববে না, ভাবতে পারে না। বরং কলকাতা থেকে আসার সময় ঝুমার হাতে স্বপ্নের একটি ভূমণ্ডল তুলে দিয়ে এসেছিল। শুধু ঝুমাই নয়, তার বাবা-মা-ঠাকুরদা-ঠাকুমা, মামাবাড়ির সবাই তার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
কিন্তু বহুদিন বাদে ঝিনুককে দেখার পর পৃথিবী ওলপালট হয়ে গেছে। যে মেয়েটা কোন ছেলেবেলা থেকে তার শ্বাসবায়ুতে মিশে আছে, তাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না বিনয়। সে ভীরু, সে কাপুরুষ, একনিষ্ঠ হতে কোনও দিনই পারেনি। এজন্য নিজেকে আগেও ধিক্কার দিয়েছে, আজও দিতে লাগল। আর তারই মধ্যে একটা যুক্তি খাড়া করে নিজেকে শক্ত করে নিল।
ঝুমা রূপসী, শিক্ষিতা, বনেদি বংশের মেয়ে। তার বাবার অঢেল অর্থ, বিপুল প্রতিষ্ঠা। তারা চোখের পলকে ঝুমার ঝলমলে, চোখধাঁধানো ভবিষ্যৎ তৈরি করে দিতে পারবেন। একটা আঙুল তুলে ইশারা করলে কলকাতার সেরা সেরা বিত্তবান বংশের উচ্চশিক্ষিত, ঝকঝকে, রূপবান ছেলেরা তাদের বাড়ির সামনে ভিড় জমিয়ে দিত। নেহাত ঝুমা বিনয়ের জন্য জেদ ধরে বসেছিল সেজন্য হয়তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিশির রামকেশব হেমনলিনীরা রাজি হয়েছিলেন।
কিন্তু ঝিনুক? সে ধর্ষিত। অপমানে, অসম্মানে, অন্তহীন গ্লানিবোধে সে কুঁকড়ে থাকত। একদিন তো ক্ষোভে অভিমানে নিখোঁজই হয়ে গেল। যাদের সঙ্গে সে মিডল আন্দামানে গেছে, তাদের সন্ধান কীভাবে পেল, কে জানে। তারা যে উদ্বাস্তু তা নিয়ে, অবশ্য সংশয় নেই। তা না হলে আন্দামানে তাদের আসাই হত না। কিন্তু তারা কেমন মানুষ, তাদের মধ্যে কতটা মর্যাদা নিয়ে সে। আছে, তার আশ্রয়দাতারা কি তার বেদনাদায়ক ইতিহাসটা জানে? সেসব তার সঙ্গে দেখা না হলে জানার উপায় নেই।
ঝিনুক পা রাখার একটু জায়গা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু অন্যের আশ্রয়ে বাকি লম্বা জীবনটা কাটানো কি সম্ভব? যাদের কাছে সে আছে, একদিন তারা বোঝা মনে করে ছুঁড়েও তো ফেলে দিতে পারে। মানুষের পক্ষে কতটা মহানুভব, কত হৃদয়বান হওয়া সম্ভব? তখন?
না, আর ভাবতে পারে না বিনয়। কবে যে ঝিনুকের সঙ্গে দেখা হবে। তার চারপাশ ঘিরে এখন শুধু ঝিনুক, ঝিনুক আর ঝিনুক।
ঝিনুককে নিয়ে কলকাতায় ফিরে গেলে খুবই দুঃখ পাবে ঝুমা, কষ্টে তার বুক চৌচির হয়ে যাবে। কিছুদিন মুহ্যমানের মতো কেটে যাবে তার। খাবে না, ঘুমোবেনা। সবার সামনে না হলেও গোপনে অঝোরে কাঁদবে। তারপর? তারপর আহ্নিক গতি বার্ষিক গতির মতো সব কিছু সহজ, স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তার জীবন থেকে একদিন দূর নীহারিকায় বিলীন হয়ে যাবে বিনয়।
কতক্ষণ আচ্ছন্নের মতো বসে ছিল, খেয়াল নেই। হঠাৎ শেখরনাথের ডাকে চমকে ওঠে বিনয়।
বেশ রাত হয়েছে। খাবার দেওয়া শুরু হয়েছে। চল
খাওয়ার ইচ্ছা একেবারেই ছিল না বিনয়ের। জীবনের দুই প্রান্তের দুই নারী তাকে ভেতরে ভেতরে এতটাই ব্যাকুল, এতটাই বিচলিত করে রেখেছিল যে খিদে-তেষ্টার বোধটাই নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু খেতে ইচ্ছে নেই বললে শেখরনাথ ছাড়বেন না, তাঁকে হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হবে। নিঃশব্দে চিঠিগুলো টেবিলের দেরাজে রেখে ধীরে ধীরে উঠে পড়ল বিনয়।