2 of 3

২.০৮ রক্ষা করো হে

রক্ষা করো হে।
আমার কর্ম হইতে আমায় রক্ষা করো হে।
আপন ছায়া আতঙ্কে মোরে করিছে কম্পিত হে;
আপন চিন্তা গ্রাসিছে আমায়–রক্ষা করো হে।

সামনেই ট্রামের কনডাক্টর হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। শূন্য পকেট থেকে আমার নিরালম্ব হাত বের করে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমি হাহা করে হেসে উঠলুম। এমন মুক্ত হাসি বহুকাল আমার গলা ছেড়ে বেরোয়নি।

ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, কী হল?

একজন সহযাত্রী বাঁকা মন্তব্য করলেন, ঢিলে হয়ে গেছে। ভাড়া দেবার সময় অনেকের এমন হয়।

আমি পাত্তা না দিয়ে বললুম, কেল্লা মার দিয়া।

দরজার দিকে এগিয়ে গেলুম। ভাড়া যখন দিতে পারব না, তখন নেমে যাই। ভদ্রলোক আমার হাত চেপে ধরে বললেন, মেরে দিয়েছে তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ। একেবারে ক্লিয়ার।

ভদ্রলোক রসিক। বললেন, কোষ্ঠ সাফ! উঠলেন তো ঠনঠনিয়া থেকে। কালীবাড়ি গিয়েছিলেন বুঝি!

আজ্ঞে হ্যাঁ।

টাকা মাটি, মাটি টাকা। তা নামছেন কেন? বসুন। ভাড়া দিতে হবে না। শ্যামবাজারেই বাড়ি?

তা হলে তো ভাবনা ছিল না। মাইল চারেক আরও যেতে হবে।

বাসে চড়তে হবে। এই নিন একটা টাকা রাখুন।

হতভম্ব হয়ে গেলুম। এমন হৃদয়বান মানুষ এখনও পৃথিবীতে আছেন। প্রায় তোতলা হয়ে গেছি, আপনি আমাকে ভাড়া দিচ্ছেন! আমি শোধ করব কীভাবে!

খুব সহজভাবে। কাল কালীবাড়িতে প্রণামী দিয়ে দেবেন এক টাকা।

যে-ভদ্রলোক একটু আগে ব্যঙ্গ করেছিলেন, তিনি বললেন, আরে ভাই যা পাওয়া যায় নিয়ে রাখো না।

লোকটির দিকে এইবার তাকাবার সুযোগ হল। নিখুঁত বাঙালি! সেই দাঁত-বের করা বোকাবোকা হাসি। সবজান্তা ভঙ্গি। সন্দেহপ্রবণ। তেলচকচকে মুখ। কনডাক্টর ভদ্রলোক সোজা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, টিকিট?

ভদ্রলোক বললেন, মান্থলি।

দেখান।

বুকপকেটে দু’আঙুল ঢুকিয়ে কী একটা তোলার ভঙ্গি করলেন। বেরোল না কিছুই।

কনডাক্টর এইবার ধমকের সুরে বললেন, নকশা ছেড়ে টিকিটটা দেখান।

হোয়াট ডু ইউ মিন?

বাঙালির মুখে ইংরেজি বেরোলেই বুঝতে হবে, ডাল মে কুছ কালা।

জানো আমি বোনাফাইড প্যাসেঞ্জার।

প্রথমে আপনি বলতে শিখুন, তারপর টিকিটটা কেটে বোনাফাইড প্যাসেঞ্জার হন। এমন বোনাফাইড প্যাসেঞ্জার আমরা সারাদিনে শয়ে শয়ে দেখছি।

আমি কমপ্লেন করব অথরিটির কাছে। হোয়াট ইজ ইয়োর নাম্বার?

এই যে আমার বুকে। পয়সা ছাড়ুন।

ভদ্রলোক একটা দশ টাকার নোট বের করলেন। খুব গোলমেলে লোক। গুরুদেব টাইপের। ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো। কনডাক্টর বললেন, খুচরো দিন। দশ টাকার নোটের ভাঙানি হয় না। আপনার মাথার ওপর নোটিশটা পড়ুন।

খুচরো নেই।

ভাবছেন ওই কায়দায় বেরিয়ে যাবেন? দিন, আমি আপনাকে চেঞ্জ দোব।

একটা খালি আসনে বসে কনডাক্টর ভদ্রলোক ব্যাগ উলটে চেঞ্জ বের করলেন। ঠোঁটে মুচকি হাসি। আমার খুব ইচ্ছে করছিল, সিক করে অসভ্য ছেলের মতো একটা সিটি মারি। শ্যামবাজারের মোড়ে না নেমে আমি ডিপো পর্যন্ত চলে গেলুম, শুধুমাত্র কনডাক্টর ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করার জন্য। অতুলনীয় মানুষ। তা ছাড়া বাড়ি গিয়েই বা কী হবে। নির্বান্ধব, নিরানন্দ পুরী। স্মৃতিভারাতুর। যে-যাই বলুক, যতই অস্বীকার করুক, আমাদের ওই ওলন্দাজ আমলের বাড়িতে অশরীরী আত্মার উপদ্রব আছে। পাশেই ছিল ওলন্দাজ শাসকের বাড়ি। সেই বাড়ি এখন এক বিশাল ব্যবসায়ীর প্রমোদ ভবন। আমাদের বাড়িটা ছিল সেই বিদেশি বণিকদের কুঠি। খুন-জখম-অত্যাচার-ধর্ষণ সবই হয়েছে। যত রাত বাড়ে তত ভয় বাড়ে।

এই আমার শেষ ট্রিপ, বলে কনডাক্টর ভদ্রলোক ট্রামগুমটির অফিসের সামনে একটা বেঞ্চে বসে পড়লেন। কথা বলতে বলতেই টিকিট আর পয়সার হিসেব চলছে। ভদ্রলোকের নাম পরেশ মৌলিক। বেহালায় থাকেন।

হিসেব চুকিয়ে বললেন, এক ভড় চা চলবে নাকি?

আমার পকেটে তো আপনার দেওয়া টাকাটাই পড়ে আছে!

ভদ্রলোক জিভ কেটে বললেন, আরে ছি ছি। কে কাকে দেয়? দেনেঅলা সেই একজন। ‘ লেনেঅলাও সেই একজন। বিশ্বজুড়ে সেই একের খেলা। আমরা শালা ধরতে পারছি না। ভদ্রলোক জিভ কাটলেন, অ্যায় শালা, শালা বলে ফেলেছি। এই অভ্যাসটা আমার এসেছে দাদুর কাছ থেকে। আমাকে শালা বলেই ডাকতেন। চলে আসুন, গুডনাইট চা-টা মেরে আসি। ওই স্টিমে এখনও আমাকে অনেকদূরে যেতে হবে। ট্রাম চলে বিদ্যুতে। বড়লোক চলে বোতলের ইস্পিরিটে। মধ্যবিত্ত চলে চায়ের ইস্টিমে। গরিব চলে কলকেতে। গরিবের ভগবান মহাদেব। বড়লোকের ভগবান কালী। মহাদেব হয়ে চিতপাত, বুকে নাচছেন মকার। দুই ম-য়ের পায়ের তলায় সারাজীবন ফ্ল্যাট।

আপনি ইস্পিরিট ইস্টিম বলছেন কেন?

ধুর বোকা, স্পিরিট আর স্টিম বললে তো ভদ্দরলোক হয়ে গেলুম। ভদ্দরলোক কে হতে চায়। ভদ্দরলোক হলেই তো ট্রামবাসে, ভাড়া মারার টেনডেন্সি হবে, ঘুষ নিতে ইচ্ছে করবে। ভায়ের। পোঁ, সরি, গাঁ, সরি, পেছনে বাঁশ ভরতে ইচ্ছে করবে। বাঁশ ভরে দে, বাঁশ ভরে দে হুউউউ। জেন্টলম্যান হবার ইচ্ছে আমার একদম নেই। অতটা নীচে নামতে পারব না ভাই। মাপ করো রাজা। দাঁড়ান আপনাদের হিসেবটাকে জমা করে দিয়ে আসি। কুচো পয়সা, কঁচা পয়সা।

পরেশবাবু এগিয়ে গেলেন কাউন্টারের দিকে। গুমটিতে গোল হয়ে ট্রামের পর ট্রাম দাঁড়িয়ে আছে। বেশিরভাগই এইবার ঘুমিয়ে পড়বে। আমার হাতে বাবার দেওয়া ঘড়িটা বাঁধা। সময় দেখছি যতটা কাটানো যায়। মুকুর কথা ভাবছি। কী হল মেয়েটার! নিশ্চয় ওদের সাংঘাতিক অধ্যক্ষা ঘরে তালাচাবি দিয়ে রেখেছেন। গোটা পাঁচেক মেয়েকে বসিয়ে রেখেছেন প্রহরায়। লেডিজ হস্টেল মানেই তো জেলখানা। কী জানি কী হয়েছে ভেতরে! যাই হোক, আর একবার আমি আহত হলুম। ঈশ্বর নাকি যা করেন, সবই মঙ্গলের জন্য। হে মঙ্গলময়, কোথায় বসে আছেন আপনি! কিতনি দূর! সামনেই বাগবাজারের খাল। দগদগে অন্ধকার। এ পারে ও পারে দু’সার ঝুপড়ি। টিমটিমে আলো কাঁপছে কোথাও কোথাও। মেয়েদের খ্যানখেনে গলা বাতাসে ওঠা-পড়া করছে।

পরেশবাবু অর্থমুক্ত নিরর্থ মানুষ হয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন, চলুন, তা হলে একটু ইস্টিম নিয়ে যে যার তাবুতে ফিরে যাই। আজকের মতো যুদ্ধ শেষ। কাল কোন ভোরে আমাকে উঠতে হবে, আপনার কোনও ধারণা আছে?

না পরেশদা।

দাদা বললেন? তা হলে আপনাকে তুমিই বলি। নামটা পেলে বেশ হত।

পিন্টু।

বাঃ, আমাদের দু’জনেরই প দিয়ে শুরু।

গ্যালিফ স্ট্রিটের মাঝামাঝি জায়গায় এলোমেলো একটা চায়ের দোকান। ঝাঁপসা শোকেসে ঠান্ডা লুরি বেগুনি গড়াগড়ি খাচ্ছে। তাকালেই অম্বল। আমরা নড়বড়ে বেঞ্চে পাশাপাশি বসলুম। একজন মহিলা চা তৈরি করছেন। রং ময়লা, কিন্তু বহত যৌবন। বেশ আদেশের ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলছেন সকলের সঙ্গে। চিবোনো সঁাতনের মতো চেহারার একটি লোক খিদমত খাটছে। আমরা আসার আগেই লোকটি কিছু একটা অন্যায় করে থাকবে। মহিলা তাকে বেদম ঝাড়ছে। আমাদের দেখে একটু নরম হল।

পরেশদা বললেন, দুটো, মোটা করে।

মেয়েটি একগাল হেসে বললে, দুধ কেটে গেছে এই মড়াটার জন্যে। মোটা হবে না, সরু করে দিচ্ছি।

মানুষ কারও দাঁতের প্রেমে পড়ে! আমি পড়ে গেলুম। দু’ সেট দাঁত যেন দু’সার মুক্তো। কত বয়স হবে! পঁচিশ-তিরিশের মধ্যে। আমার সহপাঠী সুখেন, জবা যাকে নিয়ে পালিয়েছে, সেই সুখেন এই রমণীকে দেখলে শাস্ত্রসম্মতভাবে প্রমাণ করে দিত, এ হল একটা সোনার মোহর, চিনতে পারছিস না অনেকদিন মাটি চাপা ছিল বলে। তোর কোম্পানির আধখানা সাবান দিয়ে প্রথমে ওয়াশ কর, তারপর পাতলা করে অলিভ অয়েল মাখিয়ে স্পঞ্জ। চুল রিঠে মেরে একটু সেন্ট। বিচিলি রঙের শাড়ি আর ব্লাউজ। কপালে একটা টিপ। পায়ে পড়ে যাও। কালবিলম্ব নয়।

পরেশদা বললেন, জীবন যদি দেখতে চাও, দোতলার ঘর ছেড়ে নেমে এসো ফুটপাথে। কড়া লিকারের চায়ের মতো কড়া জীবন। কোনও ফঁ্যাসফোঁস নয়, একেবারে বাঘা থাবা। আমি যা চাই, ভগবান আমাকে তাই দিয়েছেন। আহা ঈশ্বর পরম করুণাময়। পরেশদা দুটো হাত মাথার ওপর তুলে আকাশের স্লেটে তাঁর এই বার্তাটা লিখতে চাইলেন। ডানহাতে বেশ একটা মোটা লোহার বালা।

পরেশদা বললেন, ভগবানকে বললুম, ভগবান! আমার সংসার ঘুচিয়ে দাও। পনেরো বছর সময় নিলেন। সব ফৌত। পরিবার, পরিজন, আত্মীয়স্বজন সব চৌপাট। ভগবান বললেন, লেখাপড়া করলে কেরানি হবি। সারাদিন চেয়ারে বসে থেকে থেকে বাতে ধরবে, বদহজমে মরবি। এই তোর সব টাকাপয়সা কেড়ে নিলুম। নে ব্যাটা, এইবার বোঝ অন্নচিন্তা চমৎকারা, কালিদাস হয় বুদ্ধিহারা। একটু ভাগ্য খারাপ, রেলগাড়ি হল না, হল ট্রামগাড়ি। ভগবান বললেন, এমন করে দিলুম একেবারে ঘোড়ার মতো, সারাজীবন চেয়ারের সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না। সারাদিন দু’ঠ্যাঙে খাড়া হয়ে ঘড়ঘড় করে ঘোরো। রাস্তায় হাঁটার সময় মনে হয় ফুটকড়াইয়ের ওপর দিয়ে হাঁটছি। কেরানি হলে সাততাড়াতাড়ি বিয়ে করার জন্যে খেপে উঠতুম। বিয়ে মানে মাস তিনেকের স্বপ্ন তারপর সারাজীবন দুঃস্বপ্ন। আলপিনের শয্যা। সে পথেও আর যেতে হল না। মহাদেব মাথায় হাত রেখে বললেন, বাবা পরেশ, তুমি আমার চেলা বনে যাও, দালানকোঠা ফেলে দিয়ে শ্মশানে বৈঠকখানা।

শেষ কথাটা গান হয়ে পরেশদার গলা ছেড়ে চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল। বুঝলুম, বেশ ভালই চর্চা আছে গানের। ওদিকে দু’গেলাস চা নিয়ে প্রলয় কাণ্ড চলেছে। একটা লটরপটর হাতপাখা নিয়ে সেই মড়া নামধারী মানুষটি উনুনের আঁচের সঙ্গে লড়াই করছেন, আর শ্যামা মহিলাটি উত্তম-মধ্যম খিস্তি করে চলেছেন। তার মধ্যে দেহ আছে, ভাগ্য আছে, অদৃষ্ট আছে, ওই লোকটির চোদ্দো পুরুষের শ্রাদ্ধ আছে।

পরেশদা বললেন, ল্যাঙ্গোয়েজ শুনছ! স্বামী-স্ত্রীর কম্বিনেশনটা একবার দেখছ! যেমন লিকার তেমনি ফ্লেভার! আসাম দার্জিলিং ব্লেন্ড!

অবশেষে দু’গেলাস চা আমাদের হাতে এল। ভদ্রলোক গেলাসদুটো যখন আমাদের হাতে দিচ্ছেন, তখনই লক্ষ করলুম, তার হাতদুটো পোড়া। সমস্ত চামড়া গুটিয়ে পাকিয়ে এক জায়গায় জড়ো হয়ে গেছে। দেখামাত্রই সারাশরীর কেমন করে উঠল। লোকটির মুখ দেখে মায়া হল। একসময় দেখতে নেহাত খারাপ ছিলেন না। জীবন এখন সব রস নিংড়ে নিয়েছে। মুখে কোনও কথা নেই। অসম্ভব উজ্জ্বল দুটো চোখ। গাল ভেঙে যাবার ফলে নাকটা খাড়া। মুখটা ধারালো।

পরেশদা বললেন, হাতদুটো দেখলে?

পুড়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে।

ইতিহাস শুনবে? ওটা আগুনে পোড়া নয়, অ্যাসিডে পোড়া। ওই মেয়েটির নাম লতা। তিনজনে ফাঁইট করছিল ওই লতার জন্যে। এক ব্যর্থ প্রেমিক, সে আবার সোনার দোকানের কারিগর ছিল। লতাকে অ্যাসিডে গলিয়ে সোনা করতে চেয়েছিল মনে হয়। তখন এই ছেলেটা বাঁচিয়েছিল। ওর গোটা পিঠটা পোড়া, একটুর জন্য মুখটা বেঁচে গেছে। তুমি পারবে, তোমার প্রেমিকাকে এইভাবে বুক দিয়ে বাঁচাতে? পারবে না। মধ্যবিত্ত বাঙালির সবকিছুই ভাসাভাসা, অগভীর। আগে নিজেকে সামলাবে। বলবে, আপনি বাঁচলে বাপের নাম।

প্রেমটা তেমন সাকসেসফুল হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না!

তোমার মাথা! প্রেমের তুমি কাঁচকলা বোঝে। তোমার চোখের সামনে যা ঘটছে সবই প্রেম। তুমি ওই লোকটিকে কিছু বলে দেখো না একবার, কী হয়! আস্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। তুমি এখনও নাবালক। নবকার্তিকের মতো চেহারা, প্রেমট্রেম করেছ?

প্রেমে চুরচুরে হয়ে আছি। কী আর বলব! মিথ্যে কথাই বলতে হল। পেটের কথা পেটে রাখাই ভাল। দোকানে আর কোনও খদ্দের নেই। মেয়েটি বাইরে এসে বসল। ভগবান চোখ দিয়েছেন, নারীশরীরের আকর্ষণ বোঝার ইন্দ্রিয় আমার জেগেছে। আড়ে আড়ে তাকাচ্ছি। মেয়েটি বললে, আজ আর শালা কোনও খদ্দের নেই। তুমি ভাতের জলটা এইবার বসিয়ে দিয়ে চালটা বেছে ফেলল। আনাজের ঝুড়িতে কী পড়ে আছে দেখো।

এতক্ষণে লোকটির মুখে কথা সরল, আজ রুটি করো না, গরম গরম রুটি।

মেয়েটি আঁঝিয়ে উঠল, আমার একেবারে লোহার গতর দেখেছ, তাই না! কে এখন বসে বসে আটা ঠেসবে?

পরেশদা গেলাস নামিয়ে বললেন, চলো, এবার যাওয়া যাক।

হঠাৎ কোথা থেকে বেশ জমাটি গান ভেসে এল, সঙ্গে চালু হাতের হারমোনিয়ম। গানের বাণীও স্পষ্ট, চিন্তা না করো শ্যাম। কপাক কপাক করে তবলার ঠেকা। ফুরফুরে বাতাস। ঠুংরি অঙ্গের গান। আসছে খালের ওপার থেকে। পরেশদা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, ওস্তাদ, এসে গেছে। যাঃ, আজ রাতে আর বাড়ি যাওয়া হল না।

কেন পরেশদা?

অসম্ভব! এই গান ছেড়ে যাওয়া যায়? ওস্তাদ এসে গেছে। জোর মাইফেল।

কোথায় হচ্ছে?

ওই তো ওপারে! সাহাবাবুর গোলায়। যাও, তুমি বাড়ি চলে যাও। বাড়িতে ভাববে। আমি আসর মেরে কাল সকালে ডিউটিতে চলে আসব।

আপনার বাড়িতে ভাববে না?

যাতে কেউ না ভাবে তার ব্যবস্থা তো আমার শিববাবু করে দিয়েছে। কেউ নেই, তা ভাববে কে? এমনকী চোরেও আমার কথা ভাববে না। আমি কোথায় থাকি জানো? এক বড়লোকের বাড়ির দারোয়ানের গুমটি ঘরে। পড়তি বড়লোক। দারোয়ান দেহাতে ভেগেছে। পরিবারের ছোটবাবু বললেন, শেয়ালের আস্তানা হওয়ার চেয়ে তুমিই থাকো। পারলে একটু পাহারাটাহারা দিয়ো। তা মন্দ কী? বিনা পয়সায় থাকা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তেনারা, মানে শিববাবুর মাফলাররা।

সেটা কী?

বুঝলে না? জ্যান্ত মাফলার। ফণা আছে। ফোঁস করে। তারা মাঝে মাঝে দেখভাল করতে আসে। নাঃ, তোমার সঙ্গে আর কথা বলা যাচ্ছে না। শুনছ, ওস্তাদ কী ছাড়ছে?

পরিষ্কার কানে আসছে, চিন্তা না করো শ্যাম, আয়ি বাহার। গন্ধর্ব কণ্ঠ শোনাই ছিল, আজ কানে। এল। বললুম, পরেশদা, আমিও যাব। গান আমিও ভীষণ ভালবাসি।

তোমার বাড়িতে সবাই ভাববেন।

একই ব্যাপার, আমারও কেউ নেই।

তাই নাকি? আহা কী ভাগ্য! শিবুদার কী কেরামতি! রতনে রতন মিলিয়ে দিয়েছেন। চলো তা হলে।

রাতের খাওয়া?

সে ব্যবস্থাও হবে।

পরেশদা চায়ের ঝুপড়িতে ফিরে গেলেন। তার সঙ্গে কী একটা ব্যবস্থা করে ফিরে এলেন। বললেন, হয়ে গেল। তুমি আবার ভদ্দরলোক, শেষপর্যন্ত খেতে পারবে তো!

সন্দেহ আমারও আছে। ঘেন্না করলেও চেষ্টা করতে হবে। আর না। অনেক আদর খাইয়েছি।

নিজেকে। এইবার দেয়াল ভাঙতে হবে। সংসার-লেত্তি জীবন-লাটুকে ঘুরিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তালগোল পাকাবার সময় এসেছে। ভাল ছেলে, লক্ষ্মী ছেলে হয়ে লাভ কী? জীবন অনেক বড়। একটা দিক দেখা হয়েছে! এইবার আর একটা দিক দেখব। যেটাকে আমরা আলোর দিক বলি, সে তো আমাদের ব্যাখ্যা। সে আলোর কেমন আলো! মুকু কীরকম খেলাটা দেখালে! এই লতারা অনেক ভাল। বোঝা যায়। মুকুরা ধড়িবাজ।

রাস্তা পাক মেরে খালের ওপারে গিয়ে পড়েছে। অন্ধকারে বাগবাজার ব্রিজ হাতির মতো দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ব্রিজ পেরিয়েই গেলুম। গেট ঠেলে ঢুকতেই গান আরও স্পষ্ট হল। ভেতরটা বেশ প্রশস্ত। একটা মাথা-ঘেরা চাতাল। লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরে আসরে বসে আছেন ওস্তাদ। চেহারা দেখলে তেমন সমীহ হবার কথা নয়; কিন্তু গলায় সুরের ফুলঝুরি। শ্রোতারাও কেউ তেমন বিশিষ্ট নয়। আমরা একপাশে বসে পড়লুম। পরেশদাকে দেখে ওস্তাদজি গানের মধ্যেই ঘাড় নাড়লেন। তিনি চেনেন। আসরে তবলা আছে, ঢোলও আছে। খুব সেজেগুজে পাকা চেহারার এক মহিলা বসে আছেন। অবাঙালি। পরেশদা কানে কানে বললেন, নাচও হবে। এর নাচ দেখলে তোমার ষড়রিপুর প্রথমটা একেবারে ছেতরে যাবে। চোখের কায়দা কী, যেন অর্জুন তির ছুড়ছে। ওস্তাদের গান যেন। গলায় গামছার মোচড় মারছে, চিন্তা না করো শ্যাম। মহিলা বাবু হয়ে বসে আছেন মা ষষ্ঠীর মতো। উরুতে তাল দিচ্ছেন, সারা শরীরে ঢেউ খেলছে। ওস্তাদ যখন শ্যাম বলে সমে পড়ছেন, মহিলাও গলা মিলিয়ে হাঁটুতে চাপড় মারছেন। শব্দটা শুনতে পাচ্ছি, যেন ক্ষীরসাগরে কেউ ডাইভ মারছেন। শ্রোতারা সব টানটান হয়ে আছে। আমার পক্ষে একটু গুরুপাক হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশটা সহ্য হচ্ছে না। খালপাড়ের মশা মনে হচ্ছে তুলে নিয়ে যাবে। ছোট একটা কলকে হাত ঘুরতে ঘুরতে পরেশদার হাতে এসে গেল। শিশু যেভাবে ফিডিং বোতল চোষে সেইভাবে তিনটে প্রবল টান মেরে বললেন, পরীক্ষা করবে নাকি? শিববাবুর দাওয়াই।

আমার মাতামহের মুখে তার প্রথম গঞ্জিকাসেবনের গল্প শুনেছি, কংখলের এক সাধুর আখড়ায়। টান মেরেই উলটে পড়লেন। তারপর ফুলছে। পেট ফুলতে ফুলতে ফানুস। মনে হল আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে, দুলতে দুলতে। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর স্বর্গের সিংহদুয়ার খুলে ডাকছেন, আইয়ে, আইয়ে। ভোরবেলা মনে হল, রম্ভা তার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছেন। চোখ খুলে দেখলেন, তাগড়াই একটা কুকুর বুকের ওপর প্রেমসে ঘুমোচ্ছে। এর মধ্যেও তিনি করুণাময়ের প্রেম দেখতে পেয়েছিলেন। কুকুরটা জ্যান্ত জাম্পারের কাজ করেছিল। ওই প্রবল ঠান্ডায় তা না হলে নিউমোনিয়া হয়ে যেত!

পরেশদার মুখের একপাশে একটু আলো পড়েছে। চোখদুটো সুচের মতো সরু, ধারালো। শুনেছি গাঁজা খেলে চোখের মণি আলপিনের মতো হয়ে যায়।

পরেশদা বললেন, বড়প্রসাদ হাতে আটকে রাখার নিয়ম নেই। টান মেরেই ছেড়ে দিতে হয়। আবার রাউন্ড মেরে ফিরে আসবে। সর্বধর্ম সমন্বয়। এক কলকে বহু ঠোঁট। টানোনা-টানো, একবার টাচ করো। ছোট্ট কলকে। সাংঘাতিক গরম। একবার মনে হল, মারি টান। জীবনটাকে একটু অন্য প্ল্যাটফর্মে দেখি। অনেকদিন তো ভদ্দরলোক ছিলুম, যারা মশারি ফেলে প্রেম করে। ভাগবতের মধ্যে পর্নোগ্রাফি পুরে বলে, কৃষ্ণকথা পড়ছি। জীবে দয়া করো, বলে কাজের লোককে বেধড়ক জুতোপেটা করে। ব আর ভ এক করে ফেলে, নিজের জিভেই দয়া করে। যাদের বাড়িতে দু’রকমের। চালের ভাত হয়। বাবুদের জন্যে চামরমণি, কাজের লোকের জন্যে বোগড়া। পাওনাদার দেখলে বলবে, কাম কাঞ্চনে আমার আসক্তি নেই, আর নিজের টাকা আদায়ের সময় কলার খামচে ধরবে। গোঁফ থেকে দুধের সর মুছতে মুছতে বলবে, ভোগ একপ্রকার রোগবিশেষ।

পাশের লোকটি ছোঁ মেরে কলকেটা আমার হাত থেকে নিয়ে বললে, নালায়েক।

পরেশদা কানে কানে বললেন, ভালই করেছ। এ হল মুটেমজুরের নেশা। তোমাদের জন্যে বোতল। তবে কী জানো, গাঁজা খেলে কাম জয় করা যায়। ইন্দ্রিয় হল সাপ। দেখো, মহাদেব কেমন। মাফলার করে গলায় পরে আছেন, যেন টনসিল হয়েছে। ওই গাঁজার জোরে বউকে বলছেন, অন্ন দে মা।

কলকে উড়তে উড়তে চলে গেল নাচিয়ের কাছে। তিনি হাঁটু তুলে বসে, দু’হাঁটুর চাপের মধ্যে। হাতের কনুই রেখে তিনটি বেদম টান মারলেন। ওস্তাদ তখন গানের কলিতে অলংকার সাজাচ্ছেন, চিন্তা না করো শ্যাম। কাফি আর সিন্ধু মিলে ফাটাফাটি ব্যাপার।

ছোট একটা টিনের কৌটো হাত ঘুরতে ঘুরতে পরেশদার হাতে এল। কী একটা ঘিয়ের মতো জিনিস আঙুলের ডগায় নিয়ে চুষে খেয়ে ফেললেন। কৌটো আমাকে টপকে চলে গেল পাশের লোকের হাতে। পরেশদা বললেন, ভেসলিন।

ভেসলিন খেলেন?

গাঁজা খেলে ভেতরটা ড্রাই হয়ে যায়। ঘি দুধ আমরা পাচ্ছি কোথায়!

তিনটে তেহাই মেরে গান শেষ হল। নর্তকী দু’বার হাত আঁকালেন। চুড়ি বেজে উঠল কিনকিন করে। রাতের শালু যেন দুলে উঠল। সমস্ত লোক নড়েচড়ে বসল। যে ঢোল বাজাবে তার কোলে গিয়ে চড়ল ঢোল। দু’দিকে গোটাকতক চাটা মেরে জানিয়ে দিলেন, জাগো জাগো।

নাচিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে ছিলেন। ডান পা-টা সটান সামনে বাড়িয়ে দিলেন। যেন উলটানো এক কদলীকাণ্ড। মসৃণ, নিটোল। অন্তরালে থাকে বলে অতিশয় শুভ্র। আকস্মিক আত্মপ্রকাশে সকলেরই ভেতরটা গেল গেল করে উঠল। পায়ের নিটোল গোছে পটি বাঁধা ঘুঙুর। সদম্ভে তিনবার পা ঠুকলেন তালে। এক, দো, তিন। ঝনঝন করে উঠল ঘুঙুর। শরীরের ওপর দিকে তরঙ্গ খেলে গেল। ঢোল ধরে নিল সেই ছন্দ, তবলা কাটতে লাগল তাল। সেই সাংঘাতিক পদোভা ডাইনে-বামে দ্রুত আন্দোলিত হয়ে তালের পর তাল ছাড়তে লাগল। ঘুঙুরের ঝনাৎকার। নর্তকী কানে হাত রেখে তীব্র সুরে ধরলেন–সেঁইয়া না মারো লাথ। তেরি গোড় পড়ি সজনীয়া। শুনো মেরি বাত।।

কোমর থেকে নিতম্ব জলস্তম্ভের মতো হিল্লোলিত করে নর্তকী উঠে দাঁড়িয়ে সপাটে একবার ঘুরে গেলেন। শাড়ি ফুলে উঠল ঘাগরার মতো। আমার পাশের লোকটি উঃ করে উঠল। ঠিক জায়গায় গিয়ে লেগেছে।

হঠাৎ আমার কানে বাজল পরিষ্কার কণ্ঠস্বর, বাঃ, বেশ হচ্ছে! এই তো চাই! এই তো চাই! স্পষ্ট হরিশঙ্করের কণ্ঠস্বর, Virtue! a fig! ‘tis in ourselves that we are thus, or thus!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *