দিন পাঁচেক হল জেফ্রি পয়েন্টে এসেছেন শেখরনাথ। সারাদিন সারা রাত বিনয় তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। সকালে উঠে চা রুটি-টুটি খেয়ে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে তারা জমিতে ছোটে। লা ডিন, ধনপতদের কাজকর্ম দেখে। রিফিউজিদের জঙ্গল সাফাই দেখে। শেখরনাথের কথায় কাজ হয়েছে। সৃষ্টিধর বারুইয়ের জমির ঝোঁপঝাড় কাটার জন্য একজন লোক দিয়েছে পরিতোষ। আজকাল আর তার গর্ভবতী বউটিকে জমিতে দেখা যায় না।
অদ্ভুত মানুষ এই প্রাক্তন বিপ্লবীটি। বড়ই মায়াময়, উদ্বাস্তুদের জন্য তার কী যে অপার সহানুভূতি! কোনও জমিতে হয়তো গিয়ে দেখলেন অশক্ত চেহারার বুড়ো-ধুড়ো কেউ বুনো উদ্দাম গাছপালার গায়ে দা চালাতে চালাতে হাঁপিয়ে পড়েছে। তিনি তক্ষুনি দা-টি কেড়ে নিয়ে কাজে লেগে যান। চারপাশ থেকে সবাই!
হাঁ হাঁ করে ওঠে, তিনি কারও বারণ শোনেন না।
দুপুরে ফিরে এসে চান, খাওয়া, সামান্য বিশ্রাম। তারপর আবার জমিতে জমিতে ঘোরা। সন্ধের আগে আগে ক্যাম্পে এসে চা-টা খেয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেওয়া। তারপর রাতের খাওয়া চুকিয়ে শেখরনাথ চলে যান গানের আসরে, আর বিনয় লিখতে বসে।
রাতের এক প্রহর পেরুলে আসর ভাঙে। শেখরনাথ ঘরে এসে বিনয়ের পাশের খাটে শুয়ে পড়েন। ততক্ষণে বিনয়ের লেখাও শেষ। সেও শুয়ে পড়ে। এই হল দুজনের এখনকার দৈনন্দিন রুটিন।
এসবের ফাঁকে ফাঁকে নানা কথা হয়। তার বেশির ভাগটাই জুড়ে থাকে দাঙ্গা, দেশভাগ, স্বাধীনতা। আর এই স্বাধীনতার জন্য বাঙালিরা, বিশেষ করে পূর্ববাংলার হিন্দুরা, কতভাবে যে বঞ্চনার শিকার হয়েছে, বার বার এই প্রসঙ্গগুলো চলে আসে। এগুলো নিয়ে তার কত যে ক্ষোভ, কত রোষ এবং উত্তেজনা।
কোনও দিন শেখরনাথ বলেন, পার্টিশনের ঠিক আগে জওহরলাল নেহরু লর্ড মাউন্টব্যাটেনরে যে একটা চিঠি লিখেছিলেন সেটা জানো?
বিনয় বুঝতে পারে না। কোন চিঠির কথা বলছেন শেখরনাথ। সে তাকিয়ে থাকে।
শেখরনাথ বলেন, দেশ জুড়ে শুধুই ভয়াবহ আতঙ্ক আর আতঙ্ক। সরকার তা থামাতে পারছে না। শুধু চরম বিপর্যয় আর বিপর্যয়। বিশেষ করে লাহোরে যে নারকীয় ঘটনা ঘটছে তা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অমৃতসর গুরুগাঁও তো কার্যত যুদ্ধক্ষেত্র। অথচ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে কোনও বিশৃঙ্খলা সর্বশক্তি দিয়ে দমন করা হবে। একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ বিনয়?
বিনয় জিজ্ঞেস করে, কী?
ডাইরেক্ট অ্যাকশনের কল দেওয়ায় কলকাতায় যা ঘটেছে, নোয়াখালিতে যে গণহত্যা হয়েছে, সেসব নিয়ে নেহরু কতখানি বিচলিত তা জানা যায় না। আমি অন্তত জানি না।
একটু চুপ করে থেকে ফের শুরু করেন, বেঙ্গলে কী ঘটেছে তা নিয়ে ইন্ডিয়ার অন্য প্রভিন্সের নেতাদের চোখ থেকে রাতের ঘুম ছুটে গিয়েছিল কি না, আমার জানা নেই। গান্ধীজি অবশ্য নোয়াখালি রায়টের–রায়ট কী বলছি, একতরফা মার্ডার, অ্যাবডাকশন, রেপ, কনভারশন– এসবের পর সেখানে। গিয়েছিলেন। তখন তো মহাসর্বনাশ ঘটেই গেছে। হ্যাঁ, এটাও বলতে হবে বিহারেও হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে ঠান্ডা মাথায় খুন করে বিরাট বিরাট গর্ত খুঁড়ে রাতারাতি পুঁতে দেওয়া হয়েছে।
কোনও দিন শেখরনাথ বলেন, দাঙ্গা যখন বাধে ভারতবর্ষের নানা প্রভিন্সে হাজার হাজার ব্রিটিশ সোলজার ছিল। খোদ ইংল্যান্ড থেকে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট কড়া হুকুম পাঠিয়েছিল দাঙ্গা থামাতে সেই ফৌজকে যেন কাজে লাগানো না হয়। এতদূরের ইন্ডিয়ান কলোনির শাসনকর্তাদের এমন বুকের পাটা ছিল না যাতে সেই হুকুম অমান্য করে। কলকাতায় ছেচল্লিশের ডাইরেক্ট অ্যাকশনের সময় ফোর্ট উইলিয়ামে কম সৈন্য ছিল না। এই এলাকার ব্রিগেডিয়ার ম্যাকিনলে তাদের ব্যারাক থেকে বেরুতে দেননি। ভাবখানা এই স্বাধীনতা তো চাইছিস, তার মজাটা বোঝ।
বিমর্ষ সুরে শেখরনাথ কোনও দিন বলেন, ভারতীয় নেতারা পাঞ্জাবে মিলিটারি রুল জারি করার জন্যে যথেষ্ট কাকুতিমিনতি করেছেন। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। ইংরেজ সরকার তখন পুরোপুরি অন্ধ আর বধির। সব শুনেও তারা কিছুই শোনেনি, সব। দেখেও কিছুই দেখেনি। আবেদন নিবেদনে ফল না হওয়ায় তারা মুখে কুলুপ এঁটেছিল। অথচ সেদিন কংগ্রেস আর লিগের নেতারা রাস্তায় নেমে তুমুল আন্দোলন করতে পারতেন। দেশের সবাই হত্যাকারী বা নারীধর্ষক নয়। কোটি কোটি শান্তিকামী মানুষ রয়েছে, তাদের ডেকে বলতে পারতেন সমস্ত কিছু স্তব্ধ করে দাও, ব্রিটিশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে বলতে পারতেন, এত রক্তস্রোতের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই। কিছুই তাঁরা করেননি। দেশের অনন্ত দুর্গতি আর চরম বিপর্যয়ের জন্যে ইংরেজ যতটা তার চেয়ে কম দায়ী নয় এইসব ক্ষমতালোভী নেতা। দেশ। স্বাধীন হলে রাজপাট তাঁদের দখলে আসবে, এই প্রলোভন ত্যাগ করার মতো মহত্ত্ব এঁদের ছিল না।
কখনও বা বলেন, আমরা যারা সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাস করতাম, ইংরেজের চোখে তারা টেরোরিস্ট সন্ত্রাসবাদী। ভারতীয় নেতারাও তা-ই মনে করতেন। আমরা যে মুক্তি সংগ্রামী, দেশের জন্যে শত সহস্র বিপ্লবী যে প্রাণ দিয়েছে, জেলখানায় পচে পচে মরেছে তাদের আত্মত্যাগের কোনও মূল্য নেই। আমরা দেশের জন্যে কতটুকুই বা করেছি, নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ যখন ইম্ফল পর্যন্ত এসে নানা কারণে বিপর্যস্ত হল, হাজার হাজার সেনাকে বন্দি করে দিল্লিতে নিয়ে আসা হল, তখন কংগ্রেসের একজন সর্বভারতীয় নেতা বলেছিল, এরা গুন্ডাবাহিনী, কোনও বিচার নয়, এদের ধরে ধরে কঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দাও। যারা হাটু গেড়ে চুক্তিপত্রে সই করে হাত পেতে স্বাধীনতা নিল তারাই দেশপ্রেমী। আর যে বিপ্লবীরা জীবনদান করল বা মেনল্যান্ডের জেলখানায় জেলখানায় আর সেলুলার জেলে পচে গলে শেষ হল তারা টেরোরিস্ট। নেতাজির আই এন এ হল গুন্ডাবাহিনী! ভাবতে পারো? ক্রোধে-উত্তেজনায় তার চোখমুখ গনগন করতে থাকে।
এই মানুষটির মধ্যে কতখানি দাহ, কতটা ক্ষোভ জমা হয়ে আছে আন্দাজ করতে পারে বিনয়।
একদিন শেখরনাথ বললেন, ইন্ডিয়াকে স্বাধীনতা দেবার। সিদ্ধান্ত কীভাবে হয়েছিল, তুমি নিশ্চয়ই জানো। সেই সময়কার বড়লাটের বড়ই তাড়া। তাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইংল্যান্ডে ফিরতে হবে। কেননা যিনি ভবিষ্যতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজ-রাজেশ্বরী হবেন তার সঙ্গে মাউন্টব্যাটেনের ভাইপোর বিয়ে। সেই ছাদনাতলার পাশে উপস্থিত না থাকলে চলে! তাছাড়া ব্রিটিশ নেভির প্রধানের পদটি শীঘ্রই খালি হতে চলেছে। মাউন্টব্যাটেনের নজর সেই মসনদের দিকে। পদটি কম লোভনীয় নয়। কাজেই। ইন্ডিয়ার ব্যাপারে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাত ধুয়ে লন্ডনের প্লেনে উঠে বসো।
বিনয় জানে, মোটামুটি ঠিক হয়েছিল উনিশশো আটচল্লিশের মাঝামাঝি ভারতীয় উপমহাদেশের যাবতীয় দায়িত্ব এ দেশের নেতাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু মাউন্টব্যাটেনের ভীষণ তাড়া। তাঁর আর তর সইছিল না। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে তিনি বোঝালেন, এত দেরি করার প্রয়োজন নেই। সরকারও সেটা মেনে নিল। হঠাৎই ঘোষণা করা হল, সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্ট দেশটা কেটেকুটে দুটো ডোমিনিয়ন তৈরি করা হবে-ইন্ডিয়া আর পাকিস্তান। একই দিনে স্বাধীনতা এবং দেশ ভাগ। সেদিনই এ দেশের নেতাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। আশ্চর্যের ব্যাপারটা কী জানো বিনয়?
বিনয় নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছিল। জিগ্যেস করেছে, কী?
শেখরনাথ বলেন, দেশটাকে ভাগ করার জন্যে র্যাডক্লিফের হাতে যে ছুরি তুলে দেওয়া হয়েছিল, মাটিতে সেই ছুরি চালিয়ে কোন কোন অংশ কোন কোন ডোমিনিয়ন পাবে তখনও তিনি স্থির করে উঠতে পারেননি। তার আগে ডোমিনিয়ন বানানো হয়ে গেল।
কখনও শেখরনাথ বলেন, এসবের নিট রেজাল্ট কী হল, আমরা যা পেলাম তা ছেঁড়াখোঁড়া পোকায় কাটা এক স্বাধীনতা।
কখনও বা তিনি বলেন, একটা কথা ভেবে দেখ, দুশ বছর রাজত্বের পর মাত্র সাত সপ্তাহের মধ্যে এত বিশাল একটা দেশের ট্রান্সফার অফ পাওয়ার হয়ে গেল। এত বড় হঠকারী, অবিবেচক, দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত আর কোথাও কবে হয়েছে, আমার জানা নেই। কলোনিয়াল মাস্টাররা অন্য কোনও দেশকে এভাবে হেলাফেলা করে ফেলে চলে গেছে, এমন নজির আর একটা তুমি দেখাতে পারো?
দাঙ্গা, দেশ বিভাজন, স্বাধীনতা টুকরো টুকরোভাবে এইসব নিয়ে তিনি যা বলেন তার মধ্যে এই মুক্তি সংগ্রামী মানুষটির কত যে ক্ষোভ, আক্ষেপ, যন্ত্রণা, ধিক্কার, নৈরাশ্য আর তীব্র ক্রোধ মিশে থাকে!
.
অন্য দিনগুলোর মতো আজও সকালে চা, চিড়ে-টিড়ে খেয়ে জমিতে এসেছেন। তার কথামতো উত্তর দিকের জঙ্গল কাটা আপাতত স্থগিত রয়েছে। পুবে পশ্চিমে সাফাইয়ের কাজ চলছে। যেমন যেমন জমি বার করা হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সেসব উদ্বাস্তুদের ভাগ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
ওপর থেকে নির্দেশ ছিল, দশ পনেরো দিনের ভেতর জমির বিলিব্যবস্থা চুকিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু দেড়শো উদ্বাস্তু পরিবারকে অরণ্য নির্মূল করে জমি ভাগ করে দেওয়া কি মুখের কথা! একাশি বিরাশিটা পরিবার এখন অবধি জমি পেয়েছে। এখনও সত্তরটার মতো বাকি।
আগের কদিন উত্তর আর পুব দিকে ঘুরেছেন শেখরনাথরা। আজ গেলেন পশ্চিম দিকে। প্রথম চারটে জমিতে যে উদ্বাস্তুরা কাজ করছিল তাদের সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছে শেখরনাথের। ওদের সঙ্গে দু-একটা কথা বললেন, কোনওরকম অসুবিধা হচ্ছে কি না জিগ্যেস করলেন। হচ্ছে না জেনে পরের জমিটায় এলেন। এখানে ভারী সুন্দর চেহারার একটি যুবতী বয়স কুড়ি-একুশ, কপালে বড় সিঁদুরের ফোঁটা, সিঁথিতে সিঁদুরের চওড়া রেখা, পাতলা নাকের পাটায় নাকছাবি, কানের লতিতে মাকড়ি, হাতে রুপোর চুড়ি, গলায় রুপোর গোট-হার, গাছকোমর করে পরা লাল-পাড় শাড়ি- ধারালো বর্মি দা দিয়ে জলডেঙ্গুয়া অর্থাৎ বনতুলসীর ঝাড় কাটছিল। তার সঙ্গী বছর তিরিশেকের একটি পুরুষ, যুবকই তাকে বলা যায়, লম্বা হিলহিলে চেহারা, তামাটে রং, মাথায় কঁকড়া চুল সেও একটা দা দিয়ে কাটাঝোঁপ সাফ করছিল। দেখেই আন্দাজ করা যায় স্বামী-স্ত্রী। পরিশ্রমে দুজনেই ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে।
আগে এদের লক্ষ করেনি বিনয়, শেখরনাথও। এত এত উদ্বাস্তু এসেছে। কয়েকজনের সঙ্গে ভালোই আলাপ হয়েছে তাদের, কিন্তু এত অল্প সময়ে সবাইকে আলাদা আলাদা করে চিনে, তাদের পরিচয় জেনে মনে করে রাখা সম্ভব নয়।
শেখরনাথ যুবকটিকে জিগ্যেস করলেন, কী নাম তোমার?
যুবকটি হাতের দা ফেলে কাছে এগিয়ে এল। শেখরনাথ তাকে না চিনলেও সে তাকে চেনে। হাতের চেটো দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বিনয়ের সুরে বলল, আইজ্ঞা, বিন্দাবন বসাক
দেশ ছিল কোথায়?
ঢাকা জিলা। গেরামের নাম বেতকা- মুন্সিগঞ্জের নাম নি হুনছেন (শুনেছেন)?
শুনেছি। বিক্রমপুরে।
আমাগো বেতকা অইল মুন্সিগঞ্জের কাছে।
দেশ থেকে কবে এসেছ?
বছর দ্যাড়েক।
কথায় কথায় জানা যায়, বিন্দাবন অর্থাৎ বৃন্দাবন আর বউ মাইল পনেরো দূরে সিরাজদিঘায় এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল। বন্ধুরা শিগগিরই দেশ ছেড়ে চলে যাবে, এই খবর পেয়ে। সারা পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থাগতিক একেবারেই ভালো না, সর্বক্ষণ আতঙ্ক, সর্বক্ষণ দুর্ভাবনা। কখন কী ঘটে যাবে, কেউ জানে না। বন্ধুদের কাছে জানতে চেয়েছে কবে তারা দেশ ছাড়বে, ইন্ডিয়ার কোথায় গিয়ে উঠবে, ইত্যাদি। ঠিক হয়েছিল একসঙ্গেই তারা পাকিস্তান ছেড়ে ত্রিপুরায় যাবে। কেননা সিরাজদিঘা অঞ্চলের অনেকেই। ত্রিপুরায় যাচ্ছে। বহু মানুষ সঙ্গে থাকলে মনের জোর বাড়ে। বৃন্দাবন বন্ধুকে বলেছিল, বেতকায় ফিরে দু-একদিনের মধ্যে মা-বাবা-ভাইবোনদের নিয়ে চলে আসবে। তারপর এখান থেকেই ত্রিপুরায় রওনা হবে।
কিন্তু বেতকায় ফেরার পথে খবর পাওয়া গেল, বেতক একতরফা খুনখারাপি, আগুন, জোর করে নারীহরণ চলছে তাদের পরিবারের সবাই শেষ হয়ে গেছে। সিরাজদিঘায় ফিরবে তারও উপায় নেই, বেড়া আগুনের মতো দাঙ্গা সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে। বন্ধু এবং তার বাড়ির লোকজন বেঁচে আছে কি না, জানা যায়নি।
বৃন্দাবন আর বউ একটা বিরাট খালে পুরো একটা দিন ঠা কচুরিপানার ভেতর লুকিয়ে ছিল। তারপর রাত্তিরে খালের জ আর কচুরিপানা ঠেলে ঠেলে কীভাবে যে মুন্সিগঞ্জ স্টিমারঘাট চলে গিয়েছিল, তারাই জানে। না, ত্রিপুরা যাওয়া হয়নি। মুন্সিগ থেকে রিফিউজিদের জন্য নির্দিষ্ট স্টিমারে চেপে দমবন্ধ ভি চলে এসেছিল গোয়ালন্দে। সেখান থেকে ট্রেনে শিয়ালদা কদিন সেখানকার নরককুণ্ডে কাটিয়ে দমদমের রিলিফ ক্যাম্পে এক বছরেরও বেশি সেখানে কাটিয়ে আন্দামানে এসেছে।
প্রায় সব ছিন্নমূল মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আতঙ্কে ইতিহাস। বৃন্দাবনের বেলায় আলাদা আর কী হবে?
সেই বউটি জলডেঙ্গুয়া কাটা বন্ধ রেখে কাছাকাছি এসে দাড়ি দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে গালগলা কপাল পুঁছে নিল। তার বড় বড় লাজুক চোখে শেখরনাথকে দেখতে লাগল। প্রাক্তন ও বিপ্লবী সম্পর্কে সে খুব সম্ভব কিছু কিছু শুনেছে।
শেখরনাথ বউটিকে কাছে ডেকে জিগ্যেস করলেন, তোম দেশ কোথায়, নাম কী?
চেহারার মতো মেয়েটির কণ্ঠস্বর ভারী মিষ্টি। সে জানা তাদের বাড়িও ঢাকা জেলায়, মানিকগঞ্জের সোনাদিঘি গ্রামে। ত নাম মায়া।
কে কে আছে তোমার? বাবা মা ভাই বোন?
বিনয় লক্ষ করল, মেয়েটার চোখেমুখে কেমন যেন ভয়ের ছা। পড়েছে। মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল সে। তার কেউ নেই। একটু অবাকই হল বিনয়। এই ধরনের গ্রামের মেয়েরা লাজুকই হয়। কিন্তু শেখরনাথ ঝানু উকিলদের মতো জেরা করেননি, সাধারণ কৌতূহলে তার মা বাবা সম্বন্ধে জানতে চেয়েছেন, এতে এমন ভয় পাওয়ার কারণ কী থাকতে পারে? মেয়েটার আচরণ বেশ অস্বাভাবিকই মনে হল।
অথচ তার স্বামী বৃন্দাবনের কথায় কোনওরকম অস্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। খুব স্বাভাবিকভাবেই কোন পরিস্থিতিতে তাদের দেশ ছাড়তে হয়েছে তা বলেছিল।
শেখরনাথ মায়াকে খুব সম্ভব সেভাবে লক্ষ করেননি। সস্নেহে বললেন, যাও, তোমরা কাজ কর।
পরের জমিটা হরিপদর। সে তার বাবা, মা এবং একটি ছোট ভাই ফ্যামিলির সবাই মিলে জমি সাফ করছে।
হরিপদ এবং তার মা-বাবার সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছে বিনয়ের। শেখরনাথেরও। হরিপদর মা হল দুর্গা, বাপ রসময়, ছোট ভাইয়ের নাম গোপাল। হরিপদর এখনও বিয়ে হয়নি। ওরা খুলনা জেলার লোক।
হরিপদ একজন গুণী যুবক। শিল্পী। তার গানে g৪ বিশ্বজিৎ, শেখরনাথ, বিনয় থেকে শুরু করে সেটেলমেন্টের সবাই মুগ্ধ।
রসময় আর দুর্গা জমির এধারে আগাছা পরিষ্কার করছিল। খানিকটা দূরে একটা মাঝারি গাছের চারপাশে বুনো ঘাসের ঘন জঙ্গল। ধারালো বর্মি দা দিয়ে সেগুলো কাটছে গোপাল আর হরিপদ।
রসময় আর দুর্গা শেখরনাথ এবং বিনয়কে দেখে সসম্ভ্রমে এগিয়ে এসেছিল। কিছু বলতে যাবে, আচমকা গোপালের আর্ত তীক্ষ্ম চিৎকার ভেসে এল।
.
সবাই সচকিত হয়ে সেদিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কে তাদের বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায়।
বিনয় এমন দৃশ্য আগে আর কখনও দেখেনি। যে গাছটার চারপাশের ঘাস কাটছিল দুই ভাই সেখানে একটা কালো কুচকুচে সাপ, প্রায় পাঁচ ফুটের মতো লম্বা, ল্যাজের ওপর ভর দিয়ে হরিপদর মুখোমুখি খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল ফণায় সাদা চক্রের মতো দাগ, তার হিংস্র চোখ দুটো জ্বলছে। হরিপদ আর সাপটার মাঝখানে দূরত্ব মাত্র ফুট তিনেক। বিনয় সাপ চেনে না, তবে তার মনে হল, ওটা সাংঘাতিক বিষাক্ত। বুকের ভেতরটা কনকনে ঠান্ডা, কিন্তু সারা শরীর লহমায় ঘামে ভিজে গেছে।
ওদিকে গোপাল চিৎকার করেই ঘাড়মুখ গুঁজে লুটিয়ে পড়েছে, এখন আর তার গলা থেকে এতটুকু আওয়াজ বেরুচ্ছে না। ঘাড় ফিরিয়ে শেখরনাথ, দুর্গা এবং রসময়ের দিকে যে তাকাবে, সেই বিনয়ের শক্তিটুকুও কেউ যেন হরণ করে নিয়েছে। জিভটা ভয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
প্রাক্তন বিপ্লবীটি, মৃত্যু যার কাছে কোনও ঘটনাই নয়, পাশ থেকে তাঁর ত্রস্ত, কাঁপা কাঁপা, শুষ্ক কণ্ঠস্বর বিনয়ের কানে এল, সর্বনাশ। ওটা কাল কেউটে। কপালে ছোবল মারলে কয়েক কউ সেকেন্ডে শেষ।
রসময় আর দুর্গার সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে। তারা হয়তো বুঝতে পেরেছে, তাদের গুণী ছেলেটির আয়ু আর কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র।
সূর্য এর মধ্যে পুব দিকের পাহাড়ের মাথা ছাপিয়ে অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে। হলকার মতো রোদের তাপ ছড়িয়ে পড়েছে দুর্গম এই উপত্যকায়। রোদে সাপটার কালো পিছল শরীরটা ঝকঝক করছে। মাঝে মাঝে সেটার মুখ থেকে সরু লিকলিকে জিভটা বেরিয়ে আসছে।
বিনয়ের মনে হচ্ছিল সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। শরীরের সব হাড় যেন আলগা হয়ে গেছে। সে এবার হুড়মুড় করে আছড়ে পড়বে। তারই মধ্যে ঝাপসাভাবে যেন দেখতে পেল হরিপদ সাপটার চোখে চোখ রেখে অনড় দাঁড়িয়ে রয়েছে। পলকহীন একটা মানুষ এবং একটা বিষধর ভয়ংকর প্রাণীর মধ্যে চলছে প্রবল স্নায়ুযুদ্ধ।
একেকটা মুহূর্ত যেন একশো বছরের মতো দীর্ঘ, তা যেন ফুরোবে না। আচমকা, বিদ্যুৎ গতিতে আন্দামানের তীব্র, শানিত রোদ চিরে একটা ঝিলিক খেলে গেল।
হৃৎপিণ্ডে তীব্র ঝাঁকুনি খেল যেন বিনয়। শিথিল স্নায়ুমণ্ডলীতে আবার পুরানো জোর ফিরে এসেছে। সে দেখতে পেল সেই সাপটার মুণ্ডু গলার কাছ থেকে সাত আট হাত দূরে ছিটকে পড়েছে, ধড়টা মাটির ওপর মোচড় দিতে দিতে পাক খেয়ে চলেছে। আর হরিপদ ফের ঘাসবনে দা চালিয়ে যাচ্ছে।
শেখরনাথের খুব সম্ভব খাস আটকে গিয়েছিল। জোরে জোরে ফুসফুসে বারকয়েক বাতাস টেনে ব্যগ্র স্বরে বললেন, চল, হরিপদর কাছে যাই। বলে একরকম দৌড়াতে শুরু করলেন। বিনয়ও তার পাশাপাশি ছুটছে।
এদিকে দুর্গা আছাড়ি-পিছাড়ি খেতে খেতে ছেলের কাছে। চলেছে। তার সঙ্গে রসময়। দুর্গা সমানে কাঁদছে আর জড়ানো জড়ানো বিকৃত স্বরে বলে চলেছে, হে ভগবান, হে মা মনসা তুমি আমার ছেইলেটারে বাঁচায়ি দেয়। তোমাদের দয়া, তোমাদের দয়া
বিনয়রা কাছে চলে আসতে ঘাস কাটা বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়াল হরিপদ। ঝকঝকে দাঁত মেলে ভারী সরল, নিষ্পাপ মুখে একটু হাসল। বলল, আপনিরা বড় ডরায়ি গেছিলেন–না? সে হয়তো সাপটাকে মারার পর দূর থেকে বিনয়দের ভয়ার্ত মুখগুলো লক্ষ করেছিল।
ওধারে গোপালও উঠে এসে বিহুলের মতো বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
দুর্গা ছেলেকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে তার বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে যাচ্ছে, ও আমার সোনা রে, যমের মুখ থিকি ফিরি আসছিস রে। আমি পরের পুন্নিমায় হরির লুট দেব।
অনেক কষ্টে মাকে শান্ত করে তার পাশে দাঁড় করাল হরিপদ। হইচই কান্নাকাটি শুনে পাশের জমিগুলো থেকে অনেকে ছুটে এসেছে। এবং ঘটনাটা জেনে ফেলেছে।
শেখরনাথ জিজ্ঞেস করলেন, সাপটা কোথায় ছিল– ঘাসের জঙ্গলে?
না। পাশের গাছটা দেখিয়ে হরিপদ বলল, ওই গাছের মাথাতি। হঠাৎ ঝপ করি একটা আওয়াজ হল। দেখি যম আমার সামনে খাড়োয়ি (দাঁড়িয়ে) আছে। হয় আমি মরব, না হলি ও। আমার এই বয়সে মরার সাদ (সাধ) লেই। দেলাম হাতের দা-খান চালায়ে। শালো নিপাতি হয়ে গেল।
সাপটার মুণ্ডু এক জায়গায়, ধড় আরেক জায়গায়। ধড়ের ধড়ফড়ানি এখন থেমে গেছে। বনবিভাগের একজন কর্মী দৌড়ে গিয়ে কেরোসিনের টিন নিয়ে এল। সাপটার গায়ে-মাথায় কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল সে। যারা ভিড় জমিয়েছে, তারা সাপের শেষকৃত্য দেখতে লাগল।
নিচু গলায় শেখরনাথ বিনয়কে বললেন, ছেলেটার কী দুরন্ত সাহস। কী শক্ত নার্ভ। আমি এখন বিপদের মুখে হয়তো মরিয়া হয়ে দা চালিয়ে দিতাম, তারপরেই ফেন্ট হয়ে পড়ে যেতাম। আর হরিপদকে দেখলে, কেমন নির্বিকার হয়ে ঘাস কাটতে শুরু করেছিল। আমার ধারণা, কালাপনি পাড়ি দিয়ে যারা এই দ্বীপে এসেছে, সবাই ওরই মত। দে আর ইনভিনসিবল। এখানেই নতুন দেশ ওরা গড়ে তুলবে। বিনয় প্রায় এই কথাগুলোই একটু অন্যভাবে ভাবছিল। হরিপদ নামে যুবকটিকে এ কদিন দেখছে সে লাজুক, নম্র, বিনয়ী এবং একজন চমৎকার গাইয়ে। গানে গানে সবাইকে মোহিত করে দিয়েছে। কে ভাবতে পেরেছিল সে এভাবে দা চালাতে পারে। মানুষ সত্যিই অপরাজেয়।