আংটি, তবে বাদশাহি নয়
[শ্যামপ্রসাদ রায় হত্যা
শুভজিৎ সেন, মেট্রো রেল পুলিশের ওসি।]
ওরা ছুটছে। পাশাপাশি, ঊর্ধ্বশ্বাসে। নিজের নিজের ট্র্যাকে। শুরুর দিকে পরস্পরের মধ্যে ব্যবধান উনিশ-বিশ। কিন্তু সেটা ওই শুরুর দিকেই যা। তিরিশ-চল্লিশ মিটার পরেই ছবিটা বদলে যাচ্ছে দ্রুত। তিন-চারজনের একটা দল ছিটকে বেরিয়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তাল রাখতে পারছে না বাকিরা।
ফিনিশিং পয়েন্টের একশো মিটার আগে একটা টার্ন আছে। তারপর এসপার-ওসপারের দৌড়। হাতে দূরবিন উঠে এসেছে জনতার। প্রতিটা ইঞ্চি-সেন্টিমিটারের এগোনো-পিছনোয় জান্তব উল্লাস ছিটকে আসছে গ্যালারি থেকে। উত্তেজিত ধারাভাষ্য যথেচ্ছ বারুদ জোগাচ্ছে সে উল্লাসে, ‘Number 3 in the lead, but for how long? 2 catching up fast, so is 5 and keep an eye on number 4 too.. Goodness me, this is as close as it gets!’
ওরা ছুটতে থাকে মরণ-বাঁচন। দৌড় শেষ হয়। আনন্দ-হতাশা-উচ্ছ্বাস-আক্ষেপের কোলাজ তৈরি হয় গ্যালারিতে। ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড, ফলাফল ঘোষণার পর ধারাভাষ্যকার রাশ টানেন নাটকীয়তায়, স্বাভাবিক গলায় জানিয়ে দেন পরের দৌড়ের সময়। অন্য ঘোড়া, অন্য দৌড়।
শুভজিৎ দেখছিলেন উদাসীন। রেসের মাঠে জীবনে আসেননি এই খুনটা হওয়ার আগে। আজ এই প্রথমবার এলেন। কে জানে, আর কতবার আসতে হবে? যখন ফোনটা থানায় এসেছিল সপ্তাহখানেক আগে, কে ভেবেছিল, এত ঝক্কি পোহাতে হবে? কে ভেবেছিল, এতটা সময় কাটাতে হবে ঘোড়দৌড়ের মাঠে?
.
১৬ অগস্ট, ২০০৭, বৃহস্পতিবার।
—নমস্কার, টালিগঞ্জ থানা…
স্বভাবসিদ্ধ কেজো গলায় ফোনটা তুলেছিলেন শুভজিৎ। থানায় ঢুকে নিজের চেয়ারে বসেছেন আধঘণ্টা হল। লম্বা দিন সামনে। একটু পরে আলিপুর কোর্টে যেতে হবে একটা পুরনো মামলায় সাক্ষী দিতে। একটা বধূনির্যাতন আর একটা চুরি, অন্তত দুটো মামলার চার্জশিট লিখে ফেলতেই হবে আজ। নানা ঝামেলায় লেখা হয়ে ওঠেনি। একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। বড়বাবু গত রাতেও তাগাদা দিয়েছেন। বকাঝকাও করেছেন একটু।
চুরির কেসটার চার্জশিটে হাত দিতে না দিতেই ফোনের ক্রিং ক্রিং। একটু বিরক্তি নিয়েই রিসিভার কানে নিয়েছিলেন শুভজিৎ। এবং দূরভাষের অন্য প্রান্ত থেকে যা ভেসে এসেছিল, শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়তে কয়েক সেকেন্ডই লেগেছিল মাত্র।
—স্যার, এখানে একটা মার্ডার হয়ে গেছে।
—এখানে মানে?
—পার্ক সাইড রোড, ২৪ নম্বর। তাড়াতাড়ি আসুন স্যার… খুন…
গাড়িতে থানা থেকে দূরত্ব খুব বেশি হলে মিনিট পাঁচেক। আর একটা কেস সম্ভবত ঘাড়ে চাপতে যাচ্ছে, যেতে যেতে ভাবছিলেন শুভজিৎ। সব মামলায় মগজের পুষ্টি হয় না। চুরি-ছিনতাই ইত্যাদির অধিকাংশই তো ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ ঘরানার তদন্ত। আর খুনের মামলা মানেই যে রহস্য হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে, এমনও নয়।
দশের মধ্যে ন’টা মামলায় রোমাঞ্চ-অ্যাডভেঞ্চার-উত্তেজনা অনেক দূরের গ্রহ। বেশিরভাগ খুনের মামলায় প্রথম দিনই জানা হয়ে যাচ্ছে, খুনি কে। হয় গৃহভৃত্য মনিবকে খুন করে টাকাপয়সা লুঠ করে পলাতক, নয় পুরনো শত্রুতার জেরে বন্ধুকে খুন বন্ধুর। বা, প্রত্যাখ্যান সহ্য না করতে পেরে প্রেমিকাকে খুন প্রেমিকের। রহস্য কই? শুধু ফেরার অপরাধীকে গ্রেফতার, গুচ্ছের লোকের জবানবন্দি নেওয়া, চার্জশিটে যাতে ফাঁকফোকর না থাকে, সেটা দেখা। মাথা খাটানোর মতো মামলা বছরে বড়জোর একটা-দুটো। ওই বুদ্ধি খরচ করার প্রক্রিয়াটা দারুণ লাগে শুভজিতের। ওই জন্যই তো পুলিশের চাকরিতে আসা।
ছোটবেলা থেকে গোয়েন্দা গল্পের পোকা। ফেলুদা-ব্যোমকেশের মতো একটার পর এক রহস্যের সমাধান করবেন, এমনই ভাবতেন শুভজিৎ স্কুলবেলায়। চাকরিতে এসে সাময়িক মোহভঙ্গ ঘটেছিল, কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের আকাশপাতাল তফাতে। কোথায় ফেলুদার মগজাস্ত্রের রোম্যান্স, আর কোথায়ই-বা ব্যোমকেশ বক্সীর সত্যান্বেষণের রোমাঞ্চ! কল্পনার গোয়েন্দাকাহিনির গা-ছমছম উত্তেজনা যদি হয় সবুজে সবুজ ইডেন গার্ডেন্স, বাস্তবের তদন্ত তুলনায় ছিরিছাঁদহীন কাঁকরভরতি পাড়ার ফুটবল মাঠ।
ভাবনায় ছেদ পড়ে ড্রাইভারের ব্রেক কষার শব্দে। গাড়ি থেমেছে একটা জটলার সামান্য দূরে। পুলিশের গাড়ি দেখে কয়েকজনকে উৎসুক ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে দেখে শুভজিৎ বোঝেন, ‘স্পট’-এ পৌঁছে গেছেন।
রাসবিহারী মোড় থেকে যদি হাঁটা দেন গড়িয়াহাটের দিকে, কিছুটা এগিয়ে বাঁ হাতে পড়বে পার্ক সাইড রোড। ঢোকা যায় শরৎ বোস রোডের দিক থেকেও। রাস্তার দু’ধারের বাড়িগুলোর দিকে একবার চোখ বুলোলেই বোঝা যায়, এ মহল্লায় উচ্চবিত্তেরই বাস প্রধানত।
বছর তিরিশের এক যুবক এগিয়ে আসেন শুভজিতের দিকে।
—স্যার, থানায় আমিই ফোন করেছিলাম। কয়েকটা বাড়ি পরেই থাকি। বাজার করে ফিরছিলাম। ২৪ নম্বরের ফ্ল্যাটগুলোয় যে ছেলেটা সপ্তাহে দু’বার সিঁড়ি-টিঁড়ি ঝাঁট দিতে আসে, সেই প্রথম নেমে এসে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেছিল। গন্ধ পেয়ে ওর সন্দেহ হয়েছিল। ভয়ও পেয়েছিল। অনেকবার বেল বাজিয়েও সাড়া পায়নি ভিতর থেকে। আমরা কয়েকজন গেলাম। যা বিশ্রী গন্ধ বেরচ্ছিল… দরজা ভেজানো ছিল, ভিতরে ঢুকে দেখলাম…
শুভজিৎ থামিয়ে দেন যুবককে।
—দাঁড়ান, দেখছি।
দুটো তিনতলা বাড়ি। একটার পিছনে আরেকটা। সামনেরটা ২৪বি, পিছনেরটা ২৪এ। সামনের বাড়ির পাশ দিয়ে একটা সরু প্যাসেজ। যা পেরিয়ে পৌঁছতে হয় পিছনের ২৪এ-র সিঁড়ির কাছে। কৌতূহলী জটলা পেরিয়ে সিঁড়িতে পা রাখতে না রাখতেই গন্ধ নাকে ছিটকে আসে শুভজিতের। সেই গন্ধ, যার সঙ্গে ডাক্তার বা পুলিশের পরিচয় ঘটে যায় চাকরির শুরুতেই। একদম প্রথম দিকে গা গুলোত শুভজিতের, পচাগলা দেহ দেখলে। অবশ্য সয়েও গেছিল দ্রুত। এখন তো কিছুই মনে হয় না আর। অভ্যেস।
প্রতি তলায় একটা করে ফ্ল্যাট। তিনতলায় উঠে ফ্ল্যাটের অর্ধেক খোলা দরজার দিকে তাকান শুভজিৎ। কেউ খুলেছিল, না কি খোলাই ছিল, খোঁজ নেওয়ার জন্য অনেক সময় পড়ে আছে। আগে তো দেখা যাক, আদৌ খুন, আত্মহত্যা, না অন্য কিছু?
ফ্ল্যাট আয়তনে বড় নয় খুব। কত হবে? সাড়ে ছ’শো স্কোয়ারফুট মেরেকেটে। একটা মাঝারি মাপের ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং, একটা শোয়ার ঘর, বারান্দা একফালি। রান্নাঘর আর বাথরুম। এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক অবিকল নিল ডাউন অবস্থায় বসে রয়েছেন শোওয়ার ঘরে ঢোকার মুখে। বয়স মাঝপঞ্চাশ মনে হয় দেখে। আলতো পিঠ ঠেকে আছে দেওয়ালে। স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরে আছেন। ‘আছেন’ লেখা ভুল হল, ‘ছিলেন’। প্রাণহীন দেহে পচন ধরার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দড়ি দিয়ে হাত বাঁধা পিছমোড়া করে। মুখে কাপড় গোঁজা। নাক থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ে জমাট বেঁধেছে ঠোঁটের কোণে। দেহে কোনও আঘাতের চিহ্ন চোখে পড়ছে না তেমন। প্রতিরোধজনিত ক্ষত (defensive wound) অবশ্য আছে কিছু শরীরে। ছড়ে যাওয়ার দাগ, আঁচড়ের চিহ্ন কিছু। ধস্তাধস্তি হয়েছিল সম্ভবত খুনি বা খুনিদের সঙ্গে।
ফ্ল্যাটের বাইরে যাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন উৎসুক, তাঁদের জিজ্ঞেস করে মৃতের পরিচয় জানলেন শুভজিৎ। শ্যামপ্রসাদ রায়। একাই থাকতেন এবাড়িতে। আরও অনেক কিছু জানার আছে। তবে তার আগে তদন্তের প্রাথমিক কাজগুলো সেরে ফেলা দরকার। বডি পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠানো, ডগ স্কোয়াডকে খবর দেওয়া, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের তলব করা। এবং বড়বাবুকে ফোনে জানানো ঘটনাটা।
.
শ্যামপ্রসাদ রায় হত্যা মামলা। আজ থেকে এগারো বছর আগের ঘটনা। টালিগঞ্জ থানা। কেস নম্বর ২২২, তারিখ ১৬/৮/২০০৭। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায়। খুন এবং একই অপরাধের উদ্দেশ্যে একাধিকের সম্মিলিত পরিকল্পনা।
দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত পাড়ার ফ্ল্যাটে একাকী বসবাসকারী প্রৌঢ় খুন। প্রতিক্রিয়ায় যা যা হওয়ার, হল। শহরে নিরাপত্তার অভাব নিয়ে কাগজে নিউজ়প্রিন্ট খরচ কিছু, এলাকায় পুলিশ পিকেট, ডিসি ডিডি, ডিসি সাউথ-সহ সিনিয়র অফিসারদের অকুস্থলে আসা একাধিকবার। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের হোমিসাইড শাখার অফিসাররা পুরো দিনটাই কাটালেন পার্ক সাইড রোডে। বিকেল নাগাদ সিদ্ধান্ত হল, আপাতত টালিগঞ্জ থানাই থাকবে তদন্তের দায়িত্বে, প্রয়োজনে সাহায্য করার জন্য হোমিসাইড বিভাগ তো রইলই। তদন্তভার ন্যস্ত হল শুভজিতের উপরই। শুভজিৎ সেন, টালিগঞ্জ থানার তৎকালীন সাব-ইনস্পেকটর (বর্তমানে মেট্রো রেল পুলিশের ভারপ্রাপ্ত অফিসার-ইন-চার্জ)।
ময়নাতদন্তের ফল তেমনই, যেমনটা প্রত্যাশিত ছিল। ‘Death was due to the effects of violent Asphyxia by the process of smothering added with gagging and homicidal in nature.’ মুখে কাপড় গুঁজে, চেপে ধরে, শ্বাসরোধ। মৃতদেহের কাটাছেঁড়ার পর ডাক্তারবাবু আরও জানালেন, defensive wounds দেখে যা মনে হচ্ছে, একজন নয়, প্রৌঢ়কে কাবু করতে প্রয়োজন হয়েছিল একাধিক ব্যক্তির উপস্থিতির।
খুনটা কখন হয়েছিল? নির্দিষ্ট ডাক্তারি মতামত পাওয়া গেল, ময়নাতদন্তের আনুমানিক ছেষট্টি থেকে সত্তর ঘণ্টা আগে। থানায় ফোন এসেছিল ১৬ অগস্ট সকাল দশটা নাগাদ। তারপর দেহ উদ্ধারের পর পদ্ধতিগত খুঁটিনাটি মিটিয়ে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠাতে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। ১৭ তারিখ দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল পোস্টমর্টেম সম্পূর্ণ হতে। হিসেব করে যা দাঁড়াল, খুনটা হয়েছিল ১৪ অগস্ট সন্ধে ছ’টা থেকে রাত দশটার মধ্যে।
ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা ফ্ল্যাটের ডাইনে-বাঁয়ে-উপর-নীচে খুঁটিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও এমন কিছু পেলেন না, যা তদন্তে দিশা দেখাতে পারে। ‘ডেভেলপ’ করে ‘ম্যাচ’ করানোর মতো ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ফুটপ্রিন্ট নেই। শোওয়ার ঘরের আলমারি হোক বা অন্যান্য আসবাবপত্র, অক্ষত। আলমারির চাবি পড়ে আছে ড্রয়ারে। খুলে দেখা হল। অবিকৃত সব কিছু। জামাকাপড় নিপাট সাজানো, হাজার চারেক টাকা পড়ে আছে। দুর্মূল্য কিছু বাড়িতে ছিল, এমন ইঙ্গিত নেই। ফ্ল্যাট বৈভবহীন। ডাকাতির উদ্দেশ্যে খুন, ভাবার দূরতম কারণ নেই আপাতদৃষ্টিতে।
খুন হওয়ার প্রায় বাহাত্তর ঘণ্টা পরে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না ঘ্রাণযোগ্য এমন কিছু, যা তদন্তে সাহায্যের হাত বাড়াবে। তবু এল পুলিশ কুকুর। নিয়মরক্ষার আসা-যাওয়া। কাজের কাজ হল না কিছু। মৃত প্রৌঢ়ের ব্যাপারে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে শুভজিৎ প্রাথমিকভাবে যা জানলেন, এরকম:
শ্যামপ্রসাদ রায়ের বয়স হয়েছিল চুয়ান্ন। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। মেজোভাই সলিলপ্রসাদের বয়স সত্তরের কাছাকাছি। সপরিবারে অবসরজীবন কাটান চেতলার জৈনুদ্দিন মিস্ত্রি লেনে। বড়ভাই থাকেন কলকাতার বাইরে বহু বছর ধরে।
তিন ভাই যে যার নিজের মতো থাকতেন। পরস্পরের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ-কথাবার্তা ছিল না বললেই চলে, জানালেন সলিলপ্রসাদ। বড়ভাই অসুস্থ। খবর দেওয়া হল, কিন্তু আসতে পারলেন না। কিন্তু মৃতের স্ত্রী-ছেলেমেয়ে কেউ?
জানা গেল, পেশায় উকিল শ্যামপ্রসাদবাবু আলিপুর কোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। বিবাহিত। এক মেয়ে আছে। কিন্তু প্রায় দশ-বারো বছর হয়ে গেল স্ত্রী এবাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন মেয়েকে নিয়ে। এখন থাকেন যাদবপুর থানা এলাকার গোলাম মহম্মদ শাহ রোডে দাদার আশ্রয়ে। মেয়ে বেহালার একটি স্কুলের হস্টেলে থেকে পড়াশুনো করে। ক্লাস এইট। আইনি ডিভোর্স দু’জনের হয়নি ঠিকই, কিন্তু সম্পর্ক ছিল না কোনও উভয় পক্ষে। মৃত্যুর খবরেও এলেন না স্ত্রী, মেয়েও না।
কেন মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন শ্যামপ্রসাদের স্ত্রী কৃষ্ণা? বনিবনার অভাব কী কারণে? সদুত্তর পাওয়া গেল না সলিলবাবুর কাছে। সাফ জানালেন, ভাইয়ের ব্যক্তিজীবন নিয়ে মাথা ঘামাননি কখনও।
গোলাম মহম্মদ শাহ রোড বেশি দূরে নয়। শুভজিৎ যখন কৃষ্ণাদেবীর বাড়িতে গিয়ে অতীত দাম্পত্য নিয়ে প্রশ্ন করলেন সন্ধের দিকে, মহিলা সোজাসাপটা জানিয়ে দিলেন, ‘উনি অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক মানুষ ছিলেন। নিজেরটার বাইরে কিছু ভাবতে পারতেন না। চেষ্টা করেছিলাম অ্যাডজাস্ট করার। একটা পর্যায়ের পর পারিনি। এর বেশি বলার কিছু নেই। বহু বছর হল কোনও যোগাযোগ ছিল না। উনি কখনও খোঁজ নেননি। আমরা মা-মেয়েও কোনও উৎসাহ দেখাইনি।’
শুভজিৎ তবু খুঁচিয়েছিলেন মহিলাকে, ‘আচ্ছা ম্যাডাম, লাস্ট কোয়েশ্চেন, মানে, মিস্টার রায়ের কি চরিত্রের কোনও দোষ ছিল, আই মিন অন্য কোনও মহিলার সঙ্গে…?’ দৃশ্যতই বিরক্ত কৃষ্ণা থামিয়ে দিয়েছিলেন মাঝপথে। উত্তর দিয়েছিলেন কেটে কেটে, ‘যতদিন একসঙ্গে ছিলাম, চোখে পড়েনি অমন কিছু। পরের কথা বলতে পারব না।’ শুভজিৎ আর কথা বাড়াননি।
.
১৭ অগস্ট, শুক্রবার।
দেহ উদ্ধারের পরের দিনটা, সকাল থেকে সন্ধে অবধি শুভজিৎ কাটিয়েছিলেন ২৪এ এবং ২৪বি পার্ক সাইড রোডের ফ্ল্যাটগুলোর বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে। প্রত্যেকের বয়ান নিয়েছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। ১৪ তারিখ বিকেল থেকে রাত, কে কোথায় ছিলেন, খোঁজ নিয়েছিলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। পাতা ভরতি হয়ে গিয়েছিল নোটবুকের। দিশা তবু ছিল দূর অস্ত। তথ্য অবশ্য মিলেছিল কিছু।
তথ্য বলতে, শ্যামপ্রসাদের বাবা সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। কলকাতায় সম্পত্তি করেছিলেন প্রচুর। একাধিক বাড়ি কিনেছিলেন শহরে। তিন ভাইকে ভাগ করে দিয়েছিলেন অস্থাবর সম্পত্তি। পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ হিসেবে শ্যামপ্রসাদ পেয়েছিলেন পার্ক সাইড রোডের দুটো তিনতলা বাড়ি। প্রতি তলায় একটা করে ফ্ল্যাট। মোট ছ’টা। যার পাঁচটা বেচে দিয়েছিলেন। নিজে রেখেছিলেন একটা, ২৪এ-র তিনতলা।
পাড়াপ্রতিবেশীরা শ্যামপ্রসাদকে অন্তর্মুখী প্রকৃতির মানুষ হিসেবেই জানতেন। এ পাড়ায় ছিলেন প্রায় বছর কুড়ি। কারও সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা ছিল না। কোর্টে যাতায়াতের পথে বা বাজারহাট করার সময় পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলেও ‘কী কেমন আছেন?’ আর ‘হ্যাঁ, চলছে’-র গণ্ডি পেরনোয় ঘোর অনীহা ছিল ভদ্রলোকের।
নিজের মতো থাকতে ভালবাসতেন। নিজে রান্না করে খেতেন। নিজেই বাসন মাজতেন, কাপড় কাচতেন। খবরের কাগজ নিতেন না। কাজের লোক বলতে কেউ ছিল না। একজন শুধু এসে ঘরদোর-বাথরুম পরিষ্কার করে দিয়ে যেতেন, সপ্তাহে দু’বার। শুধু ওঁর ফ্ল্যাটের নয়, সবারই। এই সাফাইকর্মীই ১৬ অগস্ট সকালে সাফসুতরো করতে এসে দরজার বাইরে থেকে দুর্গন্ধ পান এবং হইচই করে লোক জড়ো করেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বাকি পাঁচটা ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের কাউকে সন্দেহ করার কোনও কারণ খুঁজে পেলেন না শুভজিৎ। তবে আরও খোঁজখবর করার আছে। একদিনে আর কী-ই বা বোঝা যায়? সোর্স লাগাতে হবে। যে যা বলেছেন সেদিন নিজের গতিবিধির ব্যাপারে, সেটা যাচাই করতে হবে।
এই যাচাই করার প্রক্রিয়াটা কী যে ভীষণ পরিশ্রমসাধ্য হত বছর বারো-তেরো আগে হলে! ভাগ্যিস মোবাইল ফোন ভারতে এসে গেছে নয়ের দশকের মাঝামাঝি, ১৯৯৫-তে। প্রাক্-মোবাইল যুগে ‘অ্যালিবাই’ যাচাই করতে কত না কাঠখড় পোড়াতে হত সেসময়ের গোয়েন্দাদের, ভাবলেই আঁতকে উঠতে হয় মোবাইল-উত্তর যুগের তদন্তকারীদের। যে যখন যেখানে ছিল বলেছে, সেখান থেকে অমুক সময়ে বেরিয়ে তমুক জায়গায় গিয়েছিল বলে দাবি করছে, সবটা মিলিয়ে নিতে হত জায়গায় গিয়ে, প্রত্যক্ষদর্শীদের খোঁজ করে।
আর মোবাইল এসে যাওয়ার পর? প্রযুক্তির আনুকূল্যে দ্রুত মিলবে CDR (Call Details Record) এবং টাওয়ার লোকেশন। যা নিমেষে প্রশ্নাতীত জানিয়ে দেবে, কে কখন কোথায় ছিলেন, কতক্ষণ ধরে কার সঙ্গে কথা বলেছেন বা মেসেজ চালাচালি করেছেন। কেউ মিথ্যে বলার চেষ্টা করলেই চেপে ধরা যায় নিমেষে, ‘টাওয়ার তো অন্য কথা বলছে!’
সন্ধেবেলা থানায় ফিরে নোটবই খোলেন শুভজিৎ। টাওয়ার সত্যিই অন্য কথা বলছে কিনা, জেনে যাওয়া যাবে স্বচ্ছন্দে। সবার মোবাইল নম্বর নিয়েছেন শুভজিৎ। পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন সংশ্লিষ্ট ‘সার্ভিস প্রোভাইডার’-দের কাছে। CDR হাতে এসে যাবে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। শুধু প্রতিবেশীদের নয়, আসবে শ্যামপ্রসাদের মোবাইল কলরেকর্ডও। যে বা যারাই ফ্ল্যাটে ঢুকে খুনটা করেছিল, তারা ফোনটা নিয়ে গেছে ওঁর। ফ্ল্যাটের কোথাও পাওয়া যায়নি। তারপর থেকে ফোন বন্ধ। রেকর্ডটা পেলে একটা ধারণা তো অন্তত হবে, ওঁর পরিচিত বৃত্তে কারা ছিলেন। আর কে বলতে পারে, অধরা সূত্রও চলে আসবে না হাতের মুঠোয়?
একগুচ্ছ কলরেকর্ডের পাতার পর পাতা ঘেঁটেঘুঁটে কাজের মধ্যে জানা গেল এই, প্রতিবেশীরা কেউ মিথ্যে বলেননি। যে যা বলেছিলেন ১৪ অগস্টের গতিবিধি নিয়ে, মিলছে হুবহু। এতেই যে সটান সন্দেহের বৃত্তের বাইরে ছিটকে গেলেন ওঁরা, এমন নয়। হতেই পারে, কেউ লোক লাগিয়ে খুনটা করিয়েছেন, এবং নিজের ‘অ্যালিবাই’ নিশ্ছিদ্র রেখেছেন। হতেই পারে, কারও সঙ্গে এমন কিছু শত্রুতা ছিল শ্যামপ্রসাদের, যা এখনও অজানা। সবে তো চব্বিশ ঘণ্টা হয়েছে।
শ্যামপ্রসাদের কলরেকর্ড বলছে, ১৪ তারিখ সকালে কোর্টে গিয়েছিলেন। বিকেল চারটে নাগাদ ফিরে আসেন বাড়িতে। সেই থেকে বাড়িতেই ছিলেন, বেরননি আর। গত এক মাসের কথোপকথন আর এসএমএস-এর খতিয়ান জানাচ্ছে, মোবাইলে দীর্ঘক্ষণের আলাপচারিতায় অভ্যস্ত ছিলেন না। কথাবার্তা মূলত পেশাগত পরিচিতির বলয়েই হত। মেসেজও যা কিছু, কাজের ব্যাপারেই। কোনও মহিলার সঙ্গে ফোন বা মেসেজ আদানপ্রদানের রেকর্ড নেই। বিপ্লব ঘোষ নামের একজনের সঙ্গে কথা বলতেন প্রায়ই, পাওয়া গেল রেকর্ড থেকে। সে-রাতেই শুভজিৎ ছুটলেন বিপ্লববাবুর কসবার বাড়িতে। যদি সূত্র মেলে কিছু।
সূত্র বলা যায় না সে অর্থে, কিন্তু একটা অজানা তথ্য পাওয়া গেল বাহান্ন বছরের বিপ্লববাবুর কাছে। ছোটখাটো ব্যবসা করেন। স্ত্ৰী-কন্যা নিয়ে সংসার। বিপ্লব জানালেন, শ্যামপ্রসাদের একটাই নেশা ছিল। ঘোড়দৌড়ের। বিপ্লববাবুও একই নেশায় আসক্ত এবং রেসকোর্সে যাতায়াতের সুবাদে ঘোড়দৌড়ের মাঠেই বছরদুয়েক আগে আলাপ শ্যামপ্রসাদের সঙ্গে। ফোনালাপ যেটুকু হত, সে ওই ঘোড়া নিয়েই। পরের শনিবারে কী কী রেস আছে, কোনটায় কোন ঘোড়া ফেভারিট, কত টাকা কোন রেসে কোন ঘোড়ার উপর লাগানো উচিত বা অনুচিত, এইসব।
রেসভাগ্য কেমন ছিল শ্যামপ্রসাদের? বিপ্লব জানালেন, ইদানীং কপাল মন্দ যাচ্ছিল শ্যামপ্রসাদের। গত কয়েক মাসে হারছিলেন লাগাতার। এবং মরিয়া হয়ে আরও বেশি টাকা লাগাচ্ছিলেন পরের রেসে। ভাগ্য তবু সহায় হচ্ছিল না কিছুতেই।
—জানেন শুভজিৎবাবু, আমি বারণ করেছিলাম। বুঝিয়েছিলাম, একটু বুঝেশুনে খেলতে। শ্যাম শুনত না। বলত, এখানে আজ যে ফকির, কাল সে রাজা।
—শেষ কবে দেখা হয়েছিল আপনার সঙ্গে?
—লাস্ট দুটো শনিবার যাইনি। শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না। তার আগের শনিবার শেষ দেখা হয়েছিল। সেদিনও আমি বারবার বললাম ‘প্লেস’ খেলতে। কিন্তু শ্যামের জেদ, ও সেই ‘উইন’-ই খেলবে।
—‘প্লেস’ মানে?
—ওটা রেসের মাঠের ভাষা। ধরুন ৫ নম্বর ঘোড়ার উপর ‘প্লেস’ খেললেন। মানে, প্রথম তিনটে ‘প্লেস’, ফাস্ট-সেকেন্ড-থার্ডের মধ্যে আপনার ঘোড়া থাকলে লাভ। পাঁচশো লাগিয়ে হয়তো ছ’শো-সাড়ে ছ’শো এল।
—আর ‘উইন’?
—‘উইন’ মানে ৫ নম্বর জিতবেই ধরে আপনি টাকা লাগালেন। জিতলে লাগানো টাকা ডবল হয়ে যেতে পারে প্রায়, কিন্তু হারলে পুরো টাকাই জলে। ‘প্লেস’ খেললেও হারতেই পারেন, তবে ন্যাচারালি ঝুঁকি কম। কিন্তু ওই যে, শ্যামের জেদ…
—তা এত যে টাকা জলে যাচ্ছিল, সমস্যা হচ্ছিল না?
—হচ্ছিল তো। শ্যামের ওকালতির পসার তো তেমন একটা ভাল ছিল না। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ফ্ল্যাটগুলো বেচে ভালই টাকা পেয়েছিল। ব্যাংকে ছিল। সেই ভাঙিয়েই চলত। কিন্তু ওভাবে কি অনন্তকাল চলে বলুন? ইদানীং বলত, বাড়ির ছাদ আর চিলেকোঠার ঘরটা বেচে দেবে। খদ্দের খুঁজতে বলেছিল। এ নেশা ভয়ংকর নেশা শুভজিৎবাবু। কপাল খারাপ হলে রাজাকেও পথের ভিখিরি বানিয়ে ছাড়ে। কাগজে শ্যামের খবরটা দেখেছি। খুব খারাপ লেগেছে। কে মারল ওভাবে? জানতে পারলেন কিছু?
—সেটাই তো বোঝার চেষ্টা করছি। আপনার কী মনে হয়?
—আমি তো অবাক হয়ে গেছি খবরটা শুনে। শ্যামের কোনও শত্রু ছিল বলে তো মনে হয় না। টাকাপয়সাও যে অনেক ছিল, তাও নয়।
—অন্য কোনও দোষ, মানে মহিলা-টহিলা…
—দেখুন, আমি শ্যামকে দু’বছর ধরে জানি। ওঁর নারীবিষয়ে কোনও আগ্রহই ছিল না। ধ্যানজ্ঞান একটাই ছিল, রেসের মাঠ।
—একবার রেসকোর্সে যেতে চাই। কবে গেলে ভাল হয় বলুন তো? কথাটথা বলতে হবে একটু ওখানের স্টাফদের সঙ্গে।
—কালই যান না। আজ ১৭, শুক্র। কাল শনি। কাল চারটে রেস। দুপুর দুপুর চলে যেতে পারেন। আমি একজনের নাম-নম্বর দিয়ে দিচ্ছি। মণিময়। ওখানের মাঝামাঝি স্তরের স্টাফ। ভাল ছেলে। আপনাকে সব ঘুরিয়ে দেখাবে।
—আপনি যাবেন না কাল?
—না, কাল বাড়িতে লোকজন আসার কথা আছে কিছু। আর আমি এভরি স্যাটারডে যাইও না। শ্যাম রেগুলার ছিল। আমি মাসে বড়জোর দু’বার।
.
১৮ অগস্ট, শনিবার। রেসকোর্সে ভরদুপুর।
ঘোড়াগুলো ছুটছে। পাশাপাশি, ঊর্ধ্বশ্বাসে। ধুলো উড়ছে ট্র্যাকে এলোমেলো। শুরুর দিকে একে-অন্যের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলা, তিরিশ-চল্লিশ মিটার পরেই ছবিটা বদলে গিয়ে ছিটকে বেরনো তিন-চারজনের দলের। এবং ফিনিশিং পয়েন্টে সবার আগে পৌঁছনোর মরণবাঁচন দৌড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্যালারির শব্দব্রহ্ম।
শুভজিৎ দেখতে থাকেন উদাসীন। এই প্রথম আসা রেসের মাঠে। কে জানে আর কতবার আসতে হবে? অথচ জায়গাটা কী সুন্দর! এত সবুজ চারদিকে। কী অপূর্ব লাগে এখান থেকে ভিক্টোরিয়াকে! ঘোড়দৌড়ে ন্যূনতম রুচি নেই শুভজিতের, কখনও ছিলও না। তবু ভাবেন, এই কেস মিটে গেলে এমনিই আর একদিন এলে হয়। খুনের তদন্তে নয়। স্রেফ সবুজ শুষে নিতে। কোনও এক উইকডে-তে, যেদিন কোনও দৌড় থাকবে না।
মণিময় এসে পড়েছেন। মধ্যতিরিশের সপ্রতিভ যুবক। চোখেমুখে বুদ্ধির ছাপ আছে। শুভজিৎ কোনও ভণিতা করেন না।
—বিপ্লববাবুর থেকে আপনার নম্বর পেয়েছি। বিপ্লব ঘোষ।
—হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার, উনি ফোন করেছিলেন সকালে। শ্যামদার খুনের ব্যাপারে বলছিলেন…
—হ্যাঁ, সেই ব্যাপারেই আসা। উনি তো নিয়মিত আসতেন এখানে।
—ইয়েস স্যার, আমি এখানে বছরচারেক আছি। হি ওয়াজ় আ রেগুলার। প্রতি শনিবার দেখা হত। একটু ইনট্রোভার্ট প্রকৃতির লোক ছিলেন। বেশি কথা হত না।
—বুঝলাম। গত কয়েক সপ্তাহে বিশেষ কিছু লক্ষ করেছিলেন ওঁর ব্যবহারে? মানে যতটুকু কথা হত, যতটুকু বোঝা যায় বাইরে থেকে?
মণিময়ের উত্তরে স্নায়ু সামান্য সক্রিয় হয়ে ওঠে শুভজিতের।
—হ্যাঁ স্যার। বিপ্লবদা সকালে ফোন করার পর থেকেই ভাবছিলাম এটা। গ্যালারিতে আমাদের যে স্টাফরা থাকে, তারাও সবাই প্রায় চিনত শ্যামদাকে। ওরাও বলল।… জানি না এটা জরুরি কিনা…
—কী?
—তেমন কিছু নয়। আমার কাজটা বেসিক্যালি রেসের সময় গ্যালারিতে রেসকোর্সের কর্মীদের উপর খবরদারি করা। শেষ দুটো শনিবার শ্যামবাবুর সঙ্গে তিনটে ইয়ং ছেলেকে বসতে দেখেছিলাম। গল্পগুজব করছিলেন খুব। একটু অবাকই হয়েছিলাম। শ্যামবাবু তো বড় একটা মিশুকে প্রকৃতির ছিলেন না।
—তিনটে ছেলে? কেমন দেখতে? আগে দেখেছিলেন কখনও ওদের?
—স্যার, সেভাবে তো খেয়াল নেই। হাজার হাজার লোক আসে এখানে। বিপ্লবদা বললেন আর আপনি জানতে চাইছেন বলে ভেবেটেবে যেটুকু মনে পড়ছে, বয়স বেশি নয় ওদের। এই ধরুন তেইশ-চব্বিশ হবে। দু’জনের ছিপছিপে চেহারা। একজন একটু গোলগাল। মাঝারি হাইট সবার। এর বেশি মনে নেই স্যার।
যতটুকু মনে ছিল মণিময়ের, তা দিয়ে ‘Portrait Parle’ হয় না, হয় না চিহ্নিতকরণের জন্য ছবি আঁকানো। ছিপছিপে-গোলগাল-কমবয়সি-মাঝারি হাইট, এ দিয়ে হয়? এমন শ’খানেক লোক তো এই রেসকোর্সেই এ মুহূর্তে পাওয়া যাবে। অবশ্য চেহারার বিশদ বিবরণ পেলেই যে সূত্র মিলত কোনও, এমন না-ও তো হতে পারে। তিনটে ছেলের সঙ্গে পরপর দুটো শনিবার শ্যামপ্রসাদ গল্প করেছিলেন গ্যালারিতে, কী এমন অস্বাভাবিক? মণিময় হয়তো একটু বেশিই চিন্তা করে ফেলেছেন। এমন হয়, অভিজ্ঞতায় দেখেছেন শুভজিৎ। সবাই গোয়েন্দা হতে চায়। এবং সুযোগ পেলে কল্পনার উড়ান ব্যস্ত হয়ে পড়ে দুইয়ে দুইয়ে চার করতে।
—মণিময়বাবু, চললাম আজ। একটু চোখকান খোলা রাখবেন প্লিজ়। ওই ছেলেগুলোকে আবার যেদিন দেখবেন, সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবেন।
—শিয়োর স্যার।
শুভজিৎ হাঁটতে শুরু করেন রেসকোর্সের মেন গেটের দিকে। নতুন দৌড়ের প্রস্তুতি ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে। ধারাভাষ্যকার তারস্বরে উত্তেজনা আমদানি করছেন আপ্রাণ, ‘There you are! Lightning speed lined up at No. 1, Whispering Beauty at number 2 and watch out for Sweet Silver at 3…’
অন্য ঘোড়া, অন্য দৌড়।
.
১৯ অগস্ট, রবিবার।
শুধু একটা কেস নিয়ে পড়ে থাকলে চলে না থানার অফিসারদের। অন্য কেসের ডায়েরি লেখা আছে। ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’ ডিউটি আছে। রোজকার রুটিন কাজ আছে। রবিবার ‘অফ’ ছিল। তবু থানায় এসেছেন শুভজিৎ বকেয়া কাজ সারতে। যা যা বেরিয়ে এসেছে এখনও পর্যন্ত খুনের তদন্তে, বাকি কাজ সেরে ঠান্ডা মাথায় সাজাতে থাকেন শুভজিৎ।
এক, শ্যামপ্রসাদের চরিত্র সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে রেস ছাড়া অন্য আসক্তি ছিল না। মহিলাঘটিত কিছু পাওয়া যাচ্ছে না।
দুই, শ্যামবাবুর অর্থকরী সমস্যা ছিল রেসের মাঠে বেপরোয়া টাকা ওড়ানোর ফলস্বরূপ। চিলেকোঠার ঘর সহ ছাদটা বেচে দেওয়ার কথা ভাবছিলেন। বিলাসী জীবনযাপন করতেন না।
এই লোককে খুন করে আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। ফ্ল্যাটের ফরেনসিক পরীক্ষাও বলছে, আলমারি-ড্রয়ার বা অন্য জিনিসপত্র ছোঁয়ইনি খুনি বা খুনিরা। ছোঁয়ার মতো দামি কিছু ছিলই না আদপে। ‘মার্ডার ফর গেইন’ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণতম।
তিন, সন্দেহভাজনদের তালিকা তৈরি করতে গিয়েই তো হোঁচট। কাকে সন্দেহ করবেন? প্রতিবেশীদের ‘অ্যালিবাই’ যাচাই করা হয়ে গেছে প্রযুক্তি-প্রমাণে। বিপ্লববাবু? যা বলেছেন, অক্ষরে অক্ষরে সত্যি, জানাচ্ছে মোবাইল-মানচিত্র। রইল বাকি রেসকোর্সের ওই তিনটে ছেলে। যাদের সম্পর্কে ধারণা করারই অবকাশ ঘটেনি। সন্দেহ তো পরের কথা।
চার, এবং সবচেয়ে মোক্ষম চার, মোটিভ? তদন্ত দু’ভাবে হয়। ‘কে’ থেকে ‘কেন’? আর, ‘কেন’ থেকে ‘কে’? অনেক মামলায় সন্দেহভাজন অপরাধী ধরা পড়ে যায় ঘটনাপরম্পরায় বা তথ্যসূত্রে। অপরাধের কার্যকারণ জানা যায় জেরায়। এসব ক্ষেত্রে আগে ‘কে’, পরে ‘কেন’। এ তদন্ত সরলরৈখিক।
জটিলতা আসে তখনই, যখন কূলকিনারা পাওয়া যায় না অপরাধীর, সংগৃহীত তথ্যের চুলচেরা বিশ্লেষণে পাওয়া যায় না কোনও সম্ভাব্য ইঙ্গিত। এই অবস্থাতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ‘মোটিভ’। ‘কেন’ থেকে শুরু হয় ‘কে’-র সন্ধান। কেন খুন হলেন শ্যামপ্রসাদ? ‘কে মারবে’-র থেকেও বড়, কেন মারবে? টাকা ছিল না, যৌন-ঈর্ষার গল্প ছিল না, ব্যক্তিগত শত্রুতারও হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না কোনও। তাহলে?
.
২০ অগস্ট, সোমবার।
অপরাধ সে যেমনই হোক, তদন্তের গতিপথ কিছু ক্ষেত্রে ধার ধারে না যুক্তি-তর্কের। তোয়াক্কা করে না প্রথাগত ব্যাকরণের। সব নিয়ম, সব পদ্ধতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কখনও কখনও কিনারাসূত্র অভাবিত সমাপতনে এসে পড়ে তদন্তকারীর নাকের ডগায়। শুধু সিনেমাতেই নয়, বাস্তবেও ঘটে এমন। কদাচিৎই, কিন্তু ঘটে।
সিনেমার প্রসঙ্গ উঠলই যখন, ‘সোনার কেল্লা’ ভাবুন। জয়পুরের রাস্তায় অটোসফরে লালমোহনবাবুর যদি চোখে না পড়ত সোনারংয়ের পাথরবাটির দোকান, যদি না দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন ফেলুদার, জয়সলমিরের কথা মাথায়ই আসত না ‘সোনার কেল্লা’-র সম্ভাব্য অবস্থান হিসেবে। ওই চোখে পড়াটা এবং দুয়ে-দুয়ে চারের সম্ভাবনার আবছা আভাস পাওয়ামাত্র অটো থামিয়ে প্রদোষ মিত্রের নেমে পড়া, রহস্যভেদে অন্যতম প্রধান deductive moment ওটাই। ‘Hajra’ আর ‘Hazra’-র তফাত তো আরও পরে। সার্কিট হাউসে, দুম করে ডক্টর হাজরার মুকুলকে নিয়ে বারমের রওনা হয়ে যাওয়ার খবর মন্দার বোসের থেকে পাওয়ার পর।
রক্তমাংসের গোয়েন্দাদের ভাগ্যে এহেন মুহূর্ত উদয় হয় কালেভদ্রে। কিন্তু যখন হয়, তখন ‘কোথা হইতে কী হইয়া’ যায়, হার মেনে যায় কল্পনার রহস্যকাহিনিও। ঠিক যেমনটা ঘটল ২০ অগস্টের সন্ধেয়।
রবিবার সারাদিন কাজ করেছেন। সোমবারও সাততাড়াতাড়ি এসেছেন থানায়, ডিসি সাউথের মাসিক ক্রাইম কনফারেন্সের প্রস্তুতি-পরিসংখ্যান তৈরি করতে সাহায্য করেছেন ওসি-কে। বড়বাবু সদয় হয়ে ছেড়ে দিয়েছেন সন্ধের মুখে, ‘বাড়ি যাও আজ। অত চাপ নেওয়ার কিছু নেই। সব কেস সাতদিনের মধ্যেই ক্র্যাক করতে হবে, এমন কথা নেই। দেখা যাক আর কয়েকদিন। ডিসি ডিডি ফোন করেছিলেন একটু আগে। ডেভেলপমেন্ট কিছু হল কিনা, জানতে চাইছিলেন।’
থানা থেকে বেরিয়ে মন একটু খারাপই হয়ে যায় শুভজিতের। গোয়েন্দাপ্রধানের এই ‘জানতে চাওয়া’-র অর্থ বুঝতে অসুবিধে হয় না। অগ্রগতি যদি দ্রুত না হয়, লালবাজারের গোয়েন্দাবিভাগ দায়িত্ব নেবে তদন্তের। স্বাভাবিক, এটাই প্রথা। হইচই ফেলে-দেওয়া মামলায় দ্রুত কিনারা থানাস্তরে সম্ভব না হলে এটাই হয়ে থাকে।
শুভজিৎ থাকতেন উলটোডাঙার পুলিশ আবাসনে। বাড়ি থেকে থানায় যাতায়াত মোটরসাইকেলে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে গিরিশ পার্কের কাছাকাছি পৌঁছনোর সময় শুভজিতের মনে হল, একবার সুরজিতের ঠেকে এক কাপ চা খেয়ে ফেরা যাক। একটু আড্ডা দিলে মাথাটা হালকা হতে পারে।
সুরজিত রায়ের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয় শুভজিতের। ভদ্রলোক বেশ কিছুটা ছোট বছর চল্লিশের শুভজিতের থেকে। গিরিশ পার্ক এলাকায় একটা শরীরচর্চার আখড়া চালান। যেখানে রোজ সন্ধেয় ছেলেছোকরারা আসে ঘাম ঝরাতে। সুরজিতের গ্রহরত্নের কারবারও আছে একটা। খুব বড়সড় কিছু ব্যবসা নয়, মাঝারিই। সুরজিতের ঠেকে মাঝে মাঝে অফিসফেরত ঢুঁ মেরে একটু গল্পগুজব করে আসেন শুভজিৎ।
—আরে শুভজিৎদা, অনেকদিন পরে? খবর কী?
—এই তো, চলছে ভাই। আসা হয়নি মাসখানেক হল, ভাবলাম একটু চা খেয়ে যাই।
—বেশ করেছ, কিন্তু তোমাকে এত উস্কোখুস্কো দেখাচ্ছে কেন? শরীর ঠিক আছে তো?
—শরীর তো ঠিকই আছে, মনটাই বিগড়ে আছে। একটা খুনের মামলা নিয়ে ফেঁসে আছি। একজন বয়স্ক মানুষ নিজের ফ্ল্যাটে…
—হ্যাঁ হ্যাঁ, কাগজে দেখেছি। ওটা তুমি ইনভেসটিগেট করছ?
—আর বলো কেন? তিনদিন হয়ে গেল, কোনও লিড নেই।
—সবে তো তিনদিন, পেয়ে যাবে ঠিক।
—সব অ্যাঙ্গল মোটামুটি দেখা হয়ে গেছে। তবু এগোনো যাচ্ছে না। এসব মামলায় কী জানো, শুরুর দিকে ‘লিড’ পেয়ে গেলে ভাল। যত দেরি হয়, তত মুশকিল হয়ে যায়। একটা কেসের উপরই তো আর দিনের পর দিন ফোকাস করা যায় না।
—হুঁ, নাও, চা খাও।
চায়ের কাপে আনমনা চুমুক দেন শুভজিৎ। চানাচুরের প্লেট এগিয়ে দিতে দিতে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন সুরজিৎ।
—অত চিন্তা কোরো না। হয়ে যাবে ঠিক। এক এক সময় লাক খারাপ যায়।
—যা বলেছ। কপাল খারাপ। নির্ঘাত রাহুর দৃষ্টি পড়েছে, বুঝলে? দাও না একটা ভাল দেখে আংটি-টাংটি।
সুরজিৎ হেসে ফেলেন।
—সে না হয় দেব দেখেশুনে। আংটির কথায় মনে এল, যা দিনকাল পড়েছে! সেদিন যা কাণ্ড হল…
—কী?
—আর বোলো না। এই তো দিনতিনেক আগে হবে, দুটো ছেলে একটা আংটি নিয়ে এখানে এসে বলে কী, ‘এটার দাম এক কোটি টাকা। আপনার তো স্টোনের ব্যবসা আছে। খদ্দের জোগাড় করে দিতে পারেন?’
—আরে, আমি তো হাঁ! বলে কী! আংটিটা অবশ্য সত্যিই অন্যরকম দেখতে। কারুকাজ আছে অনেক। মধ্যের পাথরটা বেশ বড়, আর খুব ঝকমকে। দেখলে হিরে বলে ভুল হতে পারে। তবে হাতে নিয়ে একটু উলটেপালটে দেখেই বুঝলাম, খুব দামি কিছু নয়। হিরে তো নয়ই। দাম মেরেকেটে ওই দশ-বিশ হাজার হতে পারে ম্যাক্সিমাম।
আংটির গল্পে কোনও উৎসাহ পান না শুভজিৎ। স্রেফ ভদ্রতার খাতিরেই বলেন, ‘তারপর?’
—তারপর আর কী? বললাম, ‘ভাই, এর দাম এক লাখও হবে না, কোটি তো অনেক দূরের ব্যাপার। বড়জোর হাজার দশেক পেতে পারো।’ শুনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল দু’জন। বললাম, ‘কোথায় পেয়েছ এটা?’
—কী বলল?
—কিছু বলল না। হনহন করে বেরিয়ে গেল।
—চোরাই মাল হতে পারে। কোথাও থেকে হাতিয়েছে, তারপর এখানে-সেখানে আগডুম-বাগডুম দাম হেঁকে বাজিয়ে দেখছে।
—দেখেশুনে কিন্তু চোর মনে হয়নি। ভদ্রঘরের ছেলে বলেই মনে হল।
—আগে দেখেছ ওদের? মানে আগে এসেছিল কখনও এখানে?
—না না, আগে দেখিনি। কেন?
—না, এমনিই। চেহারার ডেসক্রিপশনটা ভাল করে জেনে নিতাম আর কী, ডিডি-তে একটা anti-fraud সেকশন আছে, ওরা এসব গ্যাং-এর ব্যাপারে খবরটবর রাখে, জাস্ট বলে রাখতাম। যাক গে ছাড়ো, উঠি আজ…
—আমার তো খুব ডিটেলে মনে নেই, তবে দাঁড়াও দাঁড়াও, সাত্যকিকে ডাকি। সাত্যকির সঙ্গেই তো এসেছিল ওরা। সাত্যকি, এই সাত্যকি!
লাগোয়া ঘরটায় চলছিল যুবকদের রোজকার শরীরচর্চা। সেখান থেকে সাড়া দেয় এক যুবক।
—হ্যাঁ সুরজিৎদা …
—আয় না একবার এখানে…
পুলিশের পোশাকে শুভজিৎকে দেখে হঠাৎই একটু থমকে যায় যুবক। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সুরজিতের দিকে।
—হ্যাঁ রে, ওই সেদিন তোর সঙ্গে দুটো ছেলে এসেছিল না… ওই যে রে, আংটি নিয়ে একটা…
‘আংটি’ শব্দটা সুরজিৎ উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই চোখমুখ সাদা হয়ে যায় সাত্যকির। শুভজিৎ লক্ষ করেন, হাত-পা কাঁপছে ছেলেটির। কী হল হঠাৎ? সুরজিৎও ঘাবড়ে যান সাত্যকির চেহারা দেখে।
—শরীর খারাপ লাগছে নাকি রে? ইনি টালিগঞ্জ থানার অফিসার, ওই ছেলেদুটোর ব্যাপারে জানতে চাইছিলেন।
বলতে না বলতেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে সাত্যকি। কান্নায় জড়িয়ে যায় ভয়ার্ত গলার স্বর।
—স্যার… আমি যাইনি সেদিন। খুনে আমি ছিলাম না! বিশ্বাস করুন, আমি যাইনি ওদের সঙ্গে! ওরা মেরেছে।
শুভজিৎ শুনলেন, এবং উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। ক্লান্তি অন্তর্হিত। শ্রান্তি নিরুদ্দেশ। খুন? ওরা? সেদিন? সুরজিৎ কিছু বলতে যাওয়ার আগেই থামিয়ে দিলেন।
—সুরজিৎ, বাকিদের চলে যেতে বলো আজ। আরেক কাপ চা হলে ভাল হয়। এই ছেলেটার সঙ্গে কথা বলার আছে। সময় লাগবে।
সময় লাগল না বেশি। পরের যে বাক্যটি সাত্যকির মুখ থেকে বেরল, তাতে শুভজিৎ বুঝলেন, শ্যামপ্রসাদ হত্যা মামলা গোয়েন্দাবিভাগের হাতে যাচ্ছে না। ভাগ্য ফেরাতে আংটিরও প্রয়োজন পড়ছে না আপাতত।
—স্যার, ওরাই বলেছিল, আংটির খদ্দের খুঁজে দিতে। আমি সুরজিৎদার কাছে নিয়ে এসেছিলাম। ওরা বলেছিল, শ্যামদার আংটিটার দাম নাকি এক কোটি। কিন্তু আমি যাইনি স্যার সেদিন, খুনে আমি ছিলাম না।
.
সাত্যকি মল্লিক। বয়স বছর চব্বিশ। মধ্য কলকাতার পোস্তা এলাকার বনেদি এবং সম্পন্ন পরিবারের সন্তান। আশৈশব সঙ্গী থেকেছে সচ্ছলতা। স্কুলজীবন কেটেছে পার্ক সার্কাসের ডন বসকোতে। সপ্রতিভ চেহারা, কথাবার্তায় চৌকস।
স্কুল-কলেজের পাট চোকানোর পর আপাতত কর্মহীন। কিন্তু বেকারত্ব কোনও আঁচড় বসাতে পারেনি আয়েশি জীবনযাপনে। অফুরান হাতখরচা, যার অর্ধেক ব্যয় হত ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে খানাপিনায়, আর বাকি অর্ধেক রেসের মাঠে।
যে দুই বন্ধু নিয়মিত সাত্যকির সঙ্গী হত ঘোড়দৌড়ের মাঠে, তাদের মধ্যে একজনের নাম অরিন্দম। অরিন্দম ঘোষ ওরফে বাবলা। বয়স ২৬, টালিগঞ্জ রোডের বাসিন্দা। বিবাহিত, স্ত্রী এবং দেড় বছরের কন্যাসন্তান আছে। উপার্জন? টুকটাক জমি-বাড়ির দালালি করে যতটুকু হয়। অর্থাভাব ছিল। চটজলদি বড়লোক হওয়ার বাসনাও। অরিন্দমও ডন বসকোরই প্রাক্তনী।
রেসের মাঠে সাত্যকি-অরিন্দমের অন্য সঙ্গীর নাম অম্লান দত্ত। বয়স সবে কুড়ি পেরিয়ে একুশ। বাড়ি রসা রোডে। বেকার। অরিন্দম ঘোষের বন্ধু একসঙ্গে ফুটবল খেলার সূত্রে। পড়াশুনার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন অম্লান। ‘বাবার হোটেলেই’ দিন গুজরান। বাকি দু’জনের পকেটের জোর ছিল না, সাত্যকিই জোগাতেন ফুর্তির রসদ। পোস্তা এলাকার তারাসুন্দরী পার্কে নিয়মিত আড্ডা বসত ত্রয়ীর। আর মাসে অন্তত দুটো শনিবার গন্তব্য ছিল রেসকোর্স।
রেসকোর্সেই ত্রয়ীর আলাপ শ্যামপ্রসাদ রায় বা ‘শ্যামদা’-র সঙ্গে। কথায় কথায় একদিন শ্যামপ্রসাদ তিনজনকে বলেন, তাঁর কাছে একটা বহুমূল্য আংটি আছে। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। ‘অ্যান্টিক ভ্যালু’ প্রচুর এ আংটির। আংটির মধ্যে একটা দুর্মূল্য পাথর বসানো। ওই পাথরের জন্যই আংটিটার দাম প্রায় এক কোটি। একা মানুষ, বয়স হয়েছে। আজ আছেন, কাল নেই। আংটিটা বিক্রি করে দিতে চান এবার, খদ্দের খুঁজছেন। আশি-নব্বই লাখ পেলেও দিয়ে দেবেন।
প্রথমে বিশ্বাস হয়নি সাত্যকি-অরিন্দমদের। এত দামের আংটি আবার হয় নাকি? শ্যামপ্রসাদ ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরে বলেন, ‘তোমরা বাড়িতে এসো একদিন। দেখলে বুঝবে।’
—দেখে কী বুঝেছিলে?
বিধ্বস্ত সাত্যকির কাছে জানতে চান শুভজিৎ।
—বাড়িতে গিয়েছিলাম আমরা তিনজন। দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল স্যার। সত্যিই অমন আংটি দেখিনি আগে। শেপটা hexagonal, মধ্যের পাথরটা থেকে যেন আলো ঠিকরোচ্ছে। আমরা ভেবেছিলাম, শ্যামদা নির্ঘাত দামটা বেশি বাড়িয়ে বলছে, তবে এর দাম চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখ হতেই পারে।
—তারপর?
—বলছি স্যার। আমরা সন্ধেবেলা পোস্তার পার্কে আড্ডা দিতাম প্রায় রোজ। সঞ্জয়দাও থাকত।
—কে সঞ্জয়?
—সঞ্জয়দা। ব্যান্ডেলের ছেলে। আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড়। বড়বাজারে আসত টুকটাক ব্যবসার কাজে। এখানে ওর এক আত্মীয়ের বাড়িও আছে। পার্কেই আলাপ।
—বেশ…
—সঞ্জয়দাকে বললাম। সব শুনে বলল, ‘এক কোটি হয়তো হবে না, কিন্তু যদি ধর পঁচিশ-তিরিশ লাখও হয়, আংটিটা হাতাতে পারলে আমাদের ভাগ্য খুলে যাবে। তোরা ভদ্রলোককে বল, এখানে আংটিটা নিয়ে আসতে কোনও একদিন। বল, কাস্টমার পাওয়া গেছে। আংটি দেখতে চাইছে। আমি লোক ফিট করছি, যারা রাস্তায় ছিনতাই করে নেবে আংটিটা। নিয়ে পরে আমাদের দিয়ে দেবে। আর আমরাও কেস খাব না। ছিনতাই যারা করবে, তাদের কয়েক হাজার টাকা ঠেকিয়ে দেব।’
—তারপর?
—শ্যামদাকে রেসকোর্সে বললাম একদিন। উনি বললেন, অত দামি জিনিস বাইরে নিয়ে বেরবেন না। কাস্টমারকে বাড়িতে আসতে বলো।
—সঞ্জয়দা সব শুনে বলল, ‘এক কাজ কর। চল, ওঁর বাড়ি যাই। আমি কাস্টমার সাজব। আমাকে তো চেনে না। ভালয় ভালয় দিলে ভাল, নয় তো কেড়ে নেব। আংটিটা পেলে লাইফ বদলে যাবে আমাদের।’
—হুঁ…
—রেসকোর্সে শ্যামদার সঙ্গে দেখা হল গত শনিবার।
—মানে ১১ তারিখ?
—তাই হবে স্যার, তারিখ মনে নেই। শ্যামদাকে বললাম, ‘কাস্টমার পাওয়া গেছে। আপনার বাড়িতে আনব?’ উনি বললেন, ‘ঠিক আছে। মঙ্গলবার বিকেলে আনো।’
—মানে চোদ্দো তারিখ।
—তাই হবে স্যার। কিন্তু আমার ব্যাপারটা ভাল লাগছিল না শুরু থেকেই। আমি বলে দিয়েছিলাম, যেতে পারব না। নেমন্তন্ন আছে। আমি যাইনি স্যার।
—যাওনি?
—না স্যার, বিশ্বাস করুন। সঞ্জয়দা আরও চারজনকে জুটিয়েছিল।
—কোন চারজন?
—বলছি। কালো স্যান্ট্রো করে ওরা শ্যামদার বাড়ি গিয়েছিল স্যার। আগের রাতে পার্কে সব কথা হয়েছিল। পোস্তাতে একজন ব্যবসায়ী আছে। রাজেশ নাম। ওর ড্রাইভারের নাম রাম। ওই গাড়ি করে শ্যামদার বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল।
—চারজনের একজন হল, বাকি তিন?
—দু’জনের নাম বিজয়। একজন বিজয় রায়। হাওড়ায় বাড়ি। লিলুয়া বোধহয়। আরেকজনের পদবি সিং। বিজয়বাহাদুর সিং। বড়বাজারে শাড়ির দোকানে অর্ডার সাপ্লাই করে। সঞ্জয়দা চিনত এদের।
—আরেকজন?
—অমিত নাম। কী করে জানি না। ওরা জানে। আগে এক-দু’বার দেখেছি। কাছেপিঠেই থাকে। এগজ়্যাক্ট জানি না।
নির্দিষ্ট ভাবে সব জানার দরকারও ছিল না আর। সাত্যকির থেকে শুভজিৎ নিয়ে নিলেন অম্লান-সঞ্জয়-অরিন্দম ঘোষের মোবাইল নম্বর। কাজ বলতে বাকি ছিল একে একে সাতজনকে ধরা। সে-রাতে আর বাড়ি ফেরা হল না শুভজিতের। ফিরলেন থানায়। প্রথমেই হানা দিলেন টালিগঞ্জে অরিন্দম ঘোষের বাড়ি। বাড়িতে নেই। অরিন্দমের বাবা পুলিশে চাকরি করতেন। অবসরপ্রাপ্ত সাব-ইনস্পেকটর। জানতে চাইলেন শান্ত ভাবে, ‘বাড়িতে পুলিশ কেন?’ সব শুনে ততোধিক শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেছে জানতাম এমন ছেলে থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল। কোথায় আর যাবে? আশেপাশেই থাকবে। রাত দেড়টা-দুটোর আগে তো বাড়ি ফেরে না। ফোন নম্বরটা দিয়ে যান আপনার, বাবলা বাড়ি ফিরলেই খবর দেব।’
—একটা ছবি পাওয়া যাবে আপনার ছেলের?
বিনা বাক্যব্যয়ে ছেলের ছবি এনে শুভজিতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন অরিন্দমের বাবা। বাড়ি ফেরার আগেই ধরা পড়ল অরিন্দম। ফোনের উপর প্রযুক্তি-প্রহরা চালু হয়ে গিয়েছিল সে-রাতেই, জানা যাচ্ছিল গতিবিধি। ভবানী সিনেমা থেকে নাইট শো দেখে বেরনোর মুখে ধরা হল। টালিগঞ্জ থানায় জিজ্ঞাসাবাদ চলল রাতভর। খুনের বৃত্তান্ত জানা গেল বিস্তারিত।
ছকের আসল কারিগর ছিলেন ব্যান্ডেলের সঞ্জয় ব্যানার্জি। তারাসুন্দরী পার্কের আড্ডায় অরিন্দমদের কাছে আংটি-বৃত্তান্ত শোনার পর সঞ্জয়ই মাথায় ঢোকান বাকিদের, আংটিটা হাতাতে পারলে সারা জীবন আর কারও কোনও চিন্তা থাকবে না। সঞ্জয়ই জুটিয়েছিলেন কুকর্মের আরও চার শরিককে।
বিজয়বাহাদুর সিং ওরফে বাদল, বড়বাজারের একটা শাড়ির দোকানের অস্থায়ী কর্মী। লিলুয়ার বিজয় রায়, যার বড়বাজারেই ফলের রসের ছোট দোকান। হরিরাম গোয়েঙ্কা স্ট্রিটের বাসিন্দা কুড়ি বছরের বেকার যুবক অমিত সিং। এবং যেহেতু কাজ হাসিল করার পর পালাতে হবে দ্রুত, গাড়ি দরকার। স্থানীয় ব্যবসায়ী রাজেশ প্রসাদের ড্রাইভার রামকুমার মণ্ডলকে লোভ দেখিয়ে দলে টেনেছিলেন সঞ্জয়।
চিত্রনাট্য ছিল এরকম— শ্যামপ্রসাদ কোর্ট থেকে সাধারণত ফিরে আসেন পাঁচটার মধ্যে। সাড়ে তিনটে থেকে চারটের মধ্যে মালিকের কালো স্যান্ট্রো গাড়ি নিয়ে রামকুমার পৌঁছবে পার্কের কাছে। মালিককে আগের রাতে বলে রাখবে গাড়ি সার্ভিসিং-এর কথা। বাকিরা অপেক্ষা করবে পার্কে।
পৌনে পাঁচটার মধ্যে রাসবিহারী মোড়ের কাছে পৌঁছনো হবে। পৌনে ছ’টা থেকে ছ’টার মধ্যে এক এক করে সবাই পৌঁছে যাবে তিনতলায় শ্যামপ্রসাদের ফ্ল্যাটের সামনে। রামকুমার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় থাকবেন শরৎ বোস রোডের মুখে। সঞ্জয় যাবেন ‘কাস্টমার’ সেজে। আংটিটা দেখতে চাইবেন। এবং কিছুক্ষণ ‘নাম-কা-ওয়াস্তে’ দরদামের পর বলবেন, বাইরে ভাল দোকান থেকে যাচাই করে দু’-একদিন পরে আংটি ফেরত দিয়ে যাবেন। জানা কথা, শ্যামপ্রসাদ এ প্রস্তাবে রাজি হবেন না। তখন জোর করে কেড়ে নিতে হবে আংটি।
অরিন্দমকে বয়ানের মাঝপথেই থামান শুভজিৎ।
—শুধু কেড়ে নিয়ে পালালে তো সেটা একরকম হত। কিন্তু খুন…
—না স্যার, বিশ্বাস করুন, আমি জানতাম, আংটি নিয়ে পালিয়ে যাব। সঞ্জয়দা আর অম্লান যে অন্য প্ল্যান করেছে, ব্যাগে করে নারকেল দড়ি আর মুখে গোঁজার কাপড় নিয়ে গেছে, জানতাম না। বোকার মতো গেলাম ওদের সঙ্গে, ভুল হয়ে গেছে স্যার। সাত্যকি কিছু একটা আঁচ করে আগের রাতে আমাকে বলেছিল, ‘যাস না বাবলা, এই সঞ্জয় লোকটা ক্রিমিন্যাল টাইপের মনে হচ্ছে। উলটোপালটা কিছু করলে ফেঁসে যাব।’
—বন্ধুর কথা শুনলে খুনের দায়ে জেল খাটতে হত না, এখন বলে আর কী লাভ?
—স্যার, ও কিছুতেই যেতে রাজি হল না। নেমন্তন্ন আছে বলে কাটিয়ে দিল। বলল, টাকার ভাগ লাগবে না ওর। বড়লোকের ছেলে, টাকার অভাব নেই। আমি লোভ সামলাতে পারলাম না। সঞ্জয়দা বলেছিল, এক একজনের ভাগে কম করে পাঁচ-সাত লাখ করে পড়বে। টানাটানির সংসার, জমির দালালি করে আর কত হয়? বাবার পেনশনের টাকাতেই সংসারটা চলে। কিন্তু শ্যামদাকে খুন করার কথা কখনও মাথায় ছিল না, বিশ্বাস করুন।
—মাথায় এসেছিল কি না সেটা তো এখন আর জরুরি নয়…
—আমার কথাটা একটু শুনুন স্যার সঞ্জয়দা আংটিটা হাতে নিয়ে শ্যামদাকে বলল, ‘দাদা,
দু’-একদিন পরে ফেরত দিয়ে যাব এটা। টাকাপয়সার কথা সেদিনই ফাইনাল করব। আগে তো দেখি সত্যিই যত বলছেন, তত দাম কিনা।’ শ্যামদা এই শুনেই রেগে আগুন হয়ে চিৎকার শুরু করল, ‘চালাকি পেয়েছেন? ফেরত দিন আমার জিনিস। আমি বিক্রি করব না আংটি।’
—তারপর কী হল?
—আমার দিকে তাকিয়ে শ্যামদা বলল, ‘এসব কী ব্যাপার অরিন্দম? এ কেমন কাস্টমার নিয়ে এসেছ? আর এত লোক নিয়েই বা এসেছ কেন?’
—তারপর?
সঞ্জয়দা ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্যামদার উপর। ওর সঙ্গে অম্লান-অমিত আর দুই বিজয়। আমিও যোগ দিলাম স্যার। তখনও ভাবিনি, শ্যামদাকে মেরেই ফেলা হবে। সঞ্জয়দা বলতে থাকল, ‘একে বাঁচিয়ে রাখলে আমাদের সর্বনাশ হবে। পুলিশকে সব বলবে। ধরা পড়বই কাল নয় পরশু।’ আমি ভাবলাম, ঠিকই তো বলছে… তারপর তো জানেন স্যার, সবাই মিলে হাত-পা বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে…
—আংটিটা কোথায়? আর শ্যামবাবুর মোবাইল?
—মোবাইলটা ফেরার পথে গাড়ি থামিয়ে আছড়ে ভেঙে ফেলেছিল সঞ্জয়দা। বলেছিল, ‘এটা রাখা রিস্কি। পুলিশ ক্লু পাবে।’ আংটি সঞ্জয়দার কাছে আছে। পরদিন সকালে সাত্যকি সব শুনে বলল, ‘তোকে আগেই বলেছিলাম বাবলা, যাস না। এখন তো পুলিশ পিছনে লেগে যাবে।’ অম্লান আর আমি বললাম, ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে। আংটিটা বেচে টাকা যা পাব, নিয়ে পালিয়ে যাব কলকাতার বাইরে।’ সাত্যকি যেখানে জিম করতে যেত, তার মালিকের জেম-জুয়েলারির কারবার ছিল। বললাম, একবার আংটিটা ওঁকে দেখানোর ব্যবস্থা করতে।
—সাত্যকি রাজি হল?
—প্রথমে হচ্ছিল না। আমরা জোরজার করায় নিমরাজি হল। পরদিন সন্ধেয় আংটিটা নিয়ে গেলাম। জিমের মালিক ভদ্রলোক দেখেশুনে বললেন, দাম বড়জোর হাজার দশেক হবে। আমরা চলে এলাম মন খারাপ করে। বুঝলাম, শ্যামদাই কোনও শাঁসালো খদ্দেরকে ঠকানোর মতলব এঁটেছিল আমাদের থ্রু দিয়ে।
—এরপর?
—সঞ্জয়দা সন্ধেবেলা পার্কে এসেছিল। বললাম সব। শুনে বলল, ‘আমাকে আংটিটা দে। ব্যান্ডেলে ভাল দোকান আছে। আমি ওখানে দেখাব আংটিটা।’ দিয়ে দিলাম। তারপর থেকে সঞ্জয়দার সঙ্গে কথা হয়নি আর। ফোন বন্ধ।
.
রাজকুমার, অমিত, বিজয়বাহাদুর এবং বিজয় রায়, এই চারজনকে ধরাটা কষ্টসাধ্য হল না বিশেষ। এক সপ্তাহের মধ্যেই গ্রেফতার হল। সঞ্জয় ছিলেন ধূর্তচূড়ামণি। কাগজে বেরিয়েছিল খুনের কিনারার খবর। জানতেন, পুলিশ হানা দেবেই ব্যান্ডেল স্টেশন রোডের বাড়িতে। পালিয়েছিলেন, মোবাইল দিনভর বন্ধ রাখতেন। চালু করতেন দিনে এক বা দু’বার। সঞ্জয়ের বাড়ি থেকে জোগাড় করা হয়েছিল ছবি। যা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সোর্সদের মধ্যে।
আংশিক প্রযুক্তি-সূত্র, আংশিক সোর্সের খবরের ভিত্তিতে সঞ্জয় ধরা পড়লেন ৮ সেপ্টেম্বর। আমহার্স্ট স্ট্রিটের ‘ক্রাউন লজ’ থেকে। যেখানে ‘মনোজিৎ ব্যানার্জি’ নামে উঠেছিলেন ৬ সেপ্টেম্বর। আসাম থেকে আসা ব্যবসায়ীর পরিচয়ে।
আংটি পাওয়া গেল না সঞ্জয়ের কাছেও। গেল কোথায়? সঞ্জয়ের বয়ান, ‘আমি দু’-একটা দোকানে যাচাই করে দেখেছিলাম স্যার। বলল, পাথরটা দেখতেই দামি হিরের মতো। হিরে নয়। ভাবলাম, আরও কয়েকটা জায়গায় দেখাব। তার মধ্যেই কাগজে দেখলাম, বাবলা ধরা পড়ে গেছে। আংটিটা বেচা রিস্কি হয়ে যেত। নিজের কাছে রাখলেও প্রমাণ থেকে যেত। গঙ্গায় ফেলে দিয়েছিলাম স্যার।’
প্রত্যক্ষদর্শীহীন অপরাধ। পুলিশের কাছে দেওয়া বয়ানের অকাট্য প্রমাণমূল্য নেই আদালতে। যতক্ষণ না পারিপার্শ্বিক প্রমাণের সমর্থন থাকে ঠাসবুনোট। শুভজিতের পেশ করা চার্জশিটে ঘটনা-পরম্পরা উঠে এল চিত্রবৎ।
বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল রাজেশ প্রসাদের কালো স্যান্ট্রো গাড়িটা। রাজেশ নিজের সাক্ষ্যে জানালেন, গাড়িটা সার্ভিসিং-এর অজুহাতে ১৪ অগস্ট নিয়ে বেরিয়েছিলেন রামকুমার। সাত্যকি মল্লিক বিচারকের কাছে জবানবন্দি দিলেন (judicial confession, ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারায়)। যাতে ধরা থাকল শ্যামপ্রসাদের সঙ্গে রেসের মাঠের আলাপ হওয়া থেকে শুরু করে আংটি হাতানোর পরিকল্পনা, সব। সুরজিৎ আদালতে চিহ্নিত করলেন অরিন্দম ঘোষ এবং অম্লান দত্তকে। আমহার্স্ট স্ট্রিটের ‘ক্রাউন লজ’ থেকে বোর্ডার্স রেজিস্টার বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। যেখানে ‘মনোজিৎ ব্যানার্জি’ নামে সই করেছিলেন সঞ্জয়। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় সে হস্তাক্ষর মিলে গিয়েছিল ধৃত সঞ্জয়ের থেকে সংগৃহীত হাতের লেখার নমুনার সঙ্গে।
কেউ কি দেখেছিলেন সেদিন ধৃতদের শ্যামপ্রসাদের বাড়িতে ঢুকতে? রহস্যভেদের পর অনেক খুঁজেছিলেন শুভজিৎ। ঢুকতে দেখেছিলেন, এমন কাউকে পাওয়া না গেলেও খোঁজ মিলেছিল এক স্থানীয় বাসিন্দার। যিনি অরিন্দম ঘোষকে চেনেন দীর্ঘদিন, একই এলাকায় থাকার সুবাদে। পার্ক সাইড রোডের কাছেই কারমেল স্কুল। বিকেলবেলা স্কুলছুটির পর মেয়েকে নিয়ে ফিরছিলেন স্কুটারে করে। পার্ক সাইড রোডের মুখে সাড়ে চারটে-পৌনে পাঁচটা নাগাদ অরিন্দম এবং অন্যদের একটা সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন। পাশে পার্ক করা ছিল সেই কালো স্যান্ট্রো। কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী রে বাবলা, এখানে এখন?’ অরিন্দম বলেছিলেন, ‘এই তো ইভনিং শো-তে মেনকায় সিনেমা দেখতে যাব আজ।’ গুরুত্বপূর্ণ পারিপার্শ্বিক প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল এই সাক্ষ্য। যাতে সঙ্গত করেছিল ধৃত সাতের সেদিনের মোবাইল টাওয়ার লোকেশন, বিকেল পৌনে পাঁচ থেকে সাড়ে ছ’টার।
বিচারপর্বে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন অভিযুক্ত সাতজন। অরিন্দম-অম্লান-সঞ্জয়, অমিত-বিজয় রায়-রাম কুমার-বিজয়বাহাদুর সিং। দণ্ডাদেশ? যাবজ্জীবন কারাবাস। এখনও জেলেই দিনযাপন।
মার্ক টোয়েন লিখেছিলেন, ‘Truth is stranger than fiction, but it is because fiction is obliged to stick to possibilities. Truth isn’t.’
খাঁটি কথা। ‘সত্যি’ সত্যিই হার মানায় বাস্তবকে, ফিকশনকে বলে বলে গোল দিতে পারে কখনওসখনও। কল্পকাহিনির লক্ষ্মণরেখা চিহ্নিত থাকে সম্ভাব্যতার সীমায়। বাস্তবের সে দায় নেই। থাকলে এভাবে প্রাণ যায় শ্যামপ্রসাদের? এভাবে জেলকুঠুরিতে পচতে হয় সাতজনকে? অর্থলিপ্সা ছিল উভয়তই। যিনি খুন হলেন, তাঁর। যারা খুন করেছিল, তাদেরও।
স্নেহ অতি বিষম বস্তু। লোভ বিষমতর।
পুনশ্চ: সাত্যকি মল্লিক এবং সুরজিৎ রায়, এই দুটি নাম পরিবর্তিত। ওঁরা জীবিত। ওঁদের স্বাভাবিক সামাজিক জীবনে এই কেস নিয়ে কৌতূহলী প্রশ্ন আর অহেতুক বিড়ম্বনার আবির্ভাব হোক এত বছর পরে, অভিপ্রেত নয়, তাই।