২.০৬ তিনু চক্রবর্তীর দৌত্য
অনেকগুলো পালে বাতাসের ঠেলায় দুখানা বজরা জল কেটে ছুটছে। কিন্তু বজরা গুরুভার, ছিপ হালকা, দুয়ের ব্যবধান ক্রমেই কমে আসছে।
বজরার ছাদে বন্দুক হস্তে কেরী, পাশে ন্যাড়া ও রাম বসু।
ন্যাড়া বলল, জ্ঞান হওয়ার আগে একবার বোম্বটে দেখেছিলাম, এবারে সজ্ঞানে দেখব। তার অনন্ত কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা।
রাম বসু শুধাল, তোর ভয় করছে না?
ভয় করবে কেন? তা ছাড়া আমিও তো বোম্বেটে!
সে আবার কেমন?
মাতুনি সাহেব আমার স্বভাব দেখে আমার নাম দিয়েছিল বোম্বেটে।
সে বোম্বেটে নয় রে, এরা আসল বোম্বেটে।
এবারে ছিপ ও বজরার ব্যবধান খুব কমে এসেছে, কথা বললে শোনা যায়। ছিপের আরোহীদের ভয় দেখাবার উদ্দেশ্যে কেরী বন্দুকের আওয়াজ করল।
ছিপ থেকে একজন হেঁকে বলল, সাহেব, মেলা গুলি-টুলি ক’র না, আমরা তোমাদের বন্ধু।
কেরী হেঁকে বলল, আমরা বোম্বেটিয়াদের বন্ধু হতে চাই না।
তবে না হয় আমরাই চাইলাম। কিন্তু আমরা বোম্বেটে-ফোম্বেটে নই।
এমন সময়ে রেশমী মুখ বার করে শুধাল, কে, তিনু দাদা নাকি?
হ্যাঁ রে ছুঁড়ি, হ্যাঁ।
তার পরে বলল, তোর ঐ সাহেব বাবাকে বন্দুক হুঁড়তে নিষেধ কর। ছেলেবেলায় একবার বাজের আওয়াজে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। সেই থেকে বন্দুকের আওয়াজে বড় ভয়। তা ছাড়া বন্দুকের গুলি এমনি বদখেয়ালী যে শরীরটা এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে ছাড়ে।
রাম বসু হেসে উঠল, যা বলেছ দাদা, বন্দুকের গুলি আর গিন্নির বচন দুইই মর্মভেদী।
কেরী বুঝল, লোকটা আর যে-ই হক শত্রু নয়, এবং খুব সম্ভব বোম্বেটেও নয়।
ওরে রেশমী, আমার পরিচয়টা এদের দে!
রেশমী রাম বসুকে তিনু চক্রবর্তীর পরিচয় দিল—আর রাম বসু কেরীকে সব বুঝিয়ে দিল।
পরিচয় ও শিষ্ট সম্ভাষণের পালা সাঙ্গ হলে তিনু চক্রবর্তী অতর্কিত আগমনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করল।
তিনু বলল, বসুজা, মেয়েটা আগুনের মুখ থেকে বেঁচে গেল বটে কিন্তু পড়েছে এখন বাঘের মুখে। আগুন এক জায়গায় বসে পোড়ায়, বাঘ তাড়া করে শিকার ধরে।
পরে সূত্রটার ভাষ্য করে বলে–ঐ যে চণ্ডী বক্সী-যার একটুখানি পরিচয় পেয়েছ সেদিন, বিস্তারিত পরিচয় দিতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে, এখন থাক, বরঞ্চ এক সময়ে রয়ে বসে রেশমীর কাছে শুনে নিও।
তার পরে নিজ মনে বলে, ঐটুকু মেয়ে, ও আর কি জানে!
পুনরায় শ্রোতাদের উদ্দেশে বলে চলে, সেই চণ্ডী বক্সী পণ করেছে, যেমন করেই হক ওকে খুঁজে বার করবে।
বসুজা শুধায, বেশ, খুঁজে বের না হয় করল, তার পরে?
তারপরে সমাজরক্ষার নামে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারবে।
ভয়ে রেশমীর গায়ে কাঁটা দেয়।
কিন্তু সমাজরক্ষার নামে ওর এত মাথাব্যথা কেন?
তা জান না বুঝি? রেশমীর নিজের নামে কিছু বিষয় আছে, সেটা ওর স্ত্রীধন। কাজেই রেশমী জীবিত থাকা অবধি নিশ্চিন্তে কেমন করে ভোগ করবে চণ্ডী?
বসুজা বলে ওঠে, তাই বল।
তবু শুধায়–কিন্তু চণ্ডী কি ওর উত্তরাধিকারী?
তিনু চক্রবর্তী বলে, এ অঞ্চলে যাবতীয় বেওয়ারিশ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী চণ্ডী।
সকলে হেসে ওঠে।
রাম বসু বলে, এমন দু-একটি লোক বাংলা দেশের প্রায় সমস্ত গ্রামেই আছে।
তার পরে তিন পুনরায় শুরু করে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, সহজে ছাড়বার পাত্র নয় চণ্ডী। ভাবলাম যেখানে পাই দিদিকে শুভ সংবাদটা জানিয়ে আসি। তাই জেলেদের কাছ থেকে ছিপখানা চেয়ে নিয়ে ছুটতে ছুটতে এলাম।
রেশমী শুষ্ক কণ্ঠে শুধায়, আমি এখন কি করব তিনু দাদা?
কি করবি নে তাই আগে শোন। গাঁয়ে কখনও ফিরবি নে।
কোথায় থাকব?
এখন যেখানে আছিস, সাহেবের কাছে, সাহেবকে ভাল লোক বলেই মনে হয়।
কাঁদ-কাঁদ ভাবে বলে রেশমী, খিরিস্তানের কাছে থাকলে যে খিরিস্তান হয়ে যাব।
কেন যাবি রে পাগলী! এই যে বসু মশায় আছেন, তিনি কি খিরিস্তান হয়ে গিয়েছেন?
পুরুষমানুষের কথা আলাদা, বলে রেশমী।
সে প্রসঙ্গে না গিয়ে তিনু বলে—চণ্ডী বক্সীর মত হিন্দু হওয়ার চেয়ে খিরিস্তান হওয়াটা কোন খারাপ?
রাম বসু দেখে আশ্চর্য সংস্কারমুক্ত লোকটার মন, বিস্মিতভাবে বলে তোমার মুখে এমন কথা!
তিন বলে, আমার মুখেই তো শুনবে, লোকে যে আমাকে নাস্তিক বলে।
তার পরে একটু থেমে পুনরায় বলে, আমি কিন্তু নাস্তিক নই, দেবতা মানি, মানি নে চণ্ডীমণ্ডপের দলকে।
প্রসঙ্গ পাটে রাম বসু শুধায়, চণ্ডী খুড়ো এখন কি করবে ভাবছ?
ওরা ঠিক করেছে যাবে জাত-কাছারির কর্তা নবকৃষ্ণ বাহাদুরের কাছে, সাহেব সুবো তার হাতের মুঠোয়। তার পর খুব সম্ভব নবকৃষ্ণ বাহাদুরের ফরমান নিয়ে খুঁজতে বের হবে দিকে দিকে।
কথাটা রাম বসুকে গম্ভীর করে তোলে। তার ভাব লক্ষ্য করে তিনু বলে, বসু মশায়, রেশমীকে কখনও যদি কলকাতায় নিয়ে যাও, খুব সাবধানে রাখবে, চণ্ডী বক্সীর হাজার চোখ।
রেশমী বলে, তিনু দাদা, তোমার তো তিন কুলে কেউ নেই, চল আমাদের সঙ্গে।
তিনু হেসে বলে, না রে পাগলী, তা হয় না, আমাকে ফিরে যেতে হবে গায়ে।
কেন?
আমি থাকলে চণ্ডী খুড়োর দল তবু একটু ঠাণ্ডা থাকে—এই বলে রেশমীর পলায়নের পরবর্তী যাবতীয় ঘটনার বর্ণনা করে।
ব্যাখ্যান শেষ হলে বলল, আজ রাতটা বসু মশায়ের আশ্রয়ে থাকব, তার পরে কাল ভোরবেলা আবার রওনা হবে জোড়ামউ।
তিনু চক্রবতী ফিরে যাবে শুনে রেশমী কাঁদতে শুরু করল, বলল, তিনু দাদা, যাবে যদি তবে এলে কেন?
তিনু হেসে বলল, তার মানে না এলেই খুশি হতিস, কি বল্?
রেশমী কোন উত্তর করল না, কাঁদতেই লাগল।
আরও খানিকটা রাত হলে রেশমী উঠে গেল, তিনু চক্রবর্তীকে নিয়ে রাম বসু আহারের জন্য গাত্রোখান করল।
রেশমীর আর কিছুতে ঘুম আসে না। ঢেউ-এর ছলছল কলকল শব্দ সিন্ধ মাতৃকরতলের মত তার নিদ্রাহারা চিন্তা স্পর্শ করে যায়, ঢেউ-এর দোলায় অনুভব করে সে মাতৃক্রোড়ের আন্দোলন। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল, ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখা; দেখল, নদীতে নৌকো ডুবছে, ডুবছে অসহায় দম্পতি। গেল গেল, সব তলিয়ে গেল! একটি পদ্মপাতার উপরে দুটি শিশির-কণার মত ঝলমলিয়ে ওঠে দুটি হোট শিশু-মুখ। এমন সময় কে দেয় তাকে নদীতে খুঁড়ে, সে পড়ে গিয়ে পদ্মপাতার উপরে। টলমল করে ওঠে পাতা। হঠাৎ শুনতে পায়, কি রেশমী দিদি, চিনতে পার?
কে রে, ন্যাড়া নাকি? তাই বল, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
তোমার একটুতেই ভয়।
ওটা কে রে?
চিনবে চিনবে, সময়ে চিনবে।
ডুবল কারা রে?
নিজের বাপ-মাকে চিনতে পার না?
রেশমী কাঁদতে শুরু করে। ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখে বালিস ভিজে গেছে, চোখের কোণ তখনও সজল।
আশ্চর্য স্বপ্ন! তবে কি সত্যি সে সেই সেদিনকার অতি শৈশবের নৌকাডুবির ইতিবৃত্ত স্বপ্নে দেখল? ভাই-বোন বেঁচে গিয়েছিল, জনশ্রুতি। তাদেরই কি তবে শিশুমুখ? তবে একটা মুখ ন্যাড়ার কেন? আরেকটা তবে কার? দূর! স্বপ্ন কি কখনও সত্যি হয়! হায়, কেন সত্যি হয় না? ভাবতে ভাবতে আবার সে ঘুমিয়ে পড়ে।
২.০৭ জাত-কাঘরির কর্তা
শোভাবাজারে মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুরের প্রাসাদে দরবার-কক্ষ; দরবার ভাঙে। ভাঙে; অধিকাংশ লোক চলে গিয়েছে, মহারাজা এখনও ওঠেন নি, নিতান্ত অন্তরঙ্গ দু-চারজন পার্ষদের সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপে নিযুক্ত আছেন। মহারাজ একাকী উচ্চাসনে উপবিষ্ট, পাশে একটি মখমলের তাকিয়া, কিন্তু সেটি এমন তকতকে নতুন, মনে হয় না যে কখনও রাজ-অঙ্গের স্পর্শ পাওয়ার সৌভাগ্য তার হয়েছে। বস্তুত এই প্রবীণ বয়সেও মহারাজা ঋজুভাবে আসীন, ঠেসান দিয়ে বসা তাঁর অভ্যাস নয়। তার পরনে মলমলের ধুতি, স্কন্ধে মলমলের উত্তরীয়, মুণ্ডিত মস্তকের মধ্যভাগে শিখাসমন্বিত কেশগুচ্ছ; ললাটে তিলক, গলায় তুলসীর মালা। পায়ের কাছে মাটিতে হাতীর দাঁতের কাজ-করা খড়ম। একদিকে স্বতন্ত্র দুখানি আসনে দুজন প্রবীণ ব্যক্তি; তাঁদেরও বেশভুষা অনুরূপ, তবে সেগুলি মূল্যবান নয়। একজন প্রসিদ্ধ মহামহোপাধ্যায় পঙিত জগনাথ তপশ্যানন, মহারাজার সভাপতি; অন্যজন প্রসিদ্ধ কবিগান-রচয়িতা হরেকৃষ্ণ দীর্ঘাঙ্গী বা হরু ঠাকুর, মহারাজার আশ্রিত ও অনুগৃহীত গুণী ব্যক্তি। এই তিনজনের মধ্যে মৃদুস্বরে আলোচনা চলছে, এতক্ষণ দরবারে যে প্রসঙ্গ উঠেছিল তারই জের।
এমন সময় চণ্ডী দু-তিনজন সঙ্গী নিয়ে ঢুকল, মহারাজার পায়ের কাছে রুমালে করে দুটি আকবরী মোহর নজরানা-স্বরূপ রাখল আর তার পরে সকলে মিলে সাষ্টাঙ্গ দঙবং করল।
চণ্ডী উঠে দাঁড়ালে তাকে ভাল করে দেখে নিয়ে নবকৃষ্ণ বাহাদুর জিজ্ঞাসা করলেন, কে, চণ্ডী বল্পী নাকি? আজকাল চোখে ভাল দেখতে পাই নে!
চণ্ডী বক্সী মহারাজার পরিচিত।
মহারাজার মত লোক চণ্ডীর মত লোককে দেখে চিনতে পেরেছেন, এমন অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে বিগলিত বিচলিত পুলকিত চণ্ডী সব কয়টি দন্ত বিকশিত করে, বলল, মহারাজের অনুগ্রহে দাসানুদাস চণ্ডীই বটে।
মহারাজার অনুগ্রহের অভাব ঘটলেই চণ্ডীরও যেন রূপান্তর ঘটবে।
তার পর সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন, বলেছিলাম না যে আসল বড়লোক ছোটলোককে কখনও ভোলেন না?
চণ্ডী যে অর্থেই কথাগুলো বলুক না কেন, ক্লাইভ-হেস্টিংসের মত ধুরন্ধরদের মাথায় হাত বুলিয়ে যিনি বৈষয়িক সৌভাগ্যের শীর্ষে উঠেছেন, তাঁর পক্ষে কথাগুলো অন্য অর্থে সত্য। ছোটলোক চিনে তাদের ক্ষমতার সদ্ব্যবহার না করতে পারলে হেস্টিংসের মুন্সী মহারাজা নবকৃষ্ণ হতে পারতেন কি?
মহারাজা বললেন, তার পর, কেমন আছ?
গোপীনাথজীর, গোবিন্দজীর কৃপাতে ভালই আছি।
গোপীনাথজী ও গোবিন্দজী মহারাজার কুলদেবতা।
তার পরেই ভ্রমসংশোধন করে নিয়ে চণ্ডী বলল, আর ভাল আছি তাই-বা বলি কেমন করে?
কেন, কি হল আবার?
সে সব অনেক দুঃখের কথা, বলব বলেই মহারাজের চরণাশ্রয়ে এসেছি।
আগে বস, তার পরে সব শুনব।
মহারাজার আদেশে সপার্ষদ চণ্ডী আসন গ্রহণ করল।
কি হয়েছে বল তো? তোমাকে যেন বিচলিত বোধ হচ্ছে!
চণ্ডী জানে যে, হিন্দু ধর্মপ্রাণ জাতি, অর্থাৎ ধর্মটাকে ভাল করে খেলাতে পারলে এই নির্বোধ জাতের কাছ থেকে কাজ আদায় করা সহজ।
তাই সে আরম্ভ করল, মহারাজের আশ্রয়ে ও দৃষ্টান্তে আমরা কেবল ধর্মটুকু অবলম্বন করে কোনরকমে বেঁচে আছি। আর আছেই বা কি আর থাকবেই বা কি।
এই পর্যন্ত বলে একবার আড়চোখে শ্রোতাদের মুখের চেহারা দেখে নিয়ে বুঝল মন্দ নয়, আশাপ্রদ। তার পরে একটি দীর্ঘনিশ্বাস প্রক্ষেপ করল। ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টির মত দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে দেখা দিল বিন্দু বিন্দু চোখের জল। একবার কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, এবারে সেই আশ্রয়টুকুও বুঝি যায়। এখন শেষ আশ্রয় থাকল মহারাজের চরণ, তাই সেখানে এসেছি।
সঙ্গীগণ চণ্ডীর বাগ্মিতায় ও অভিনয়-ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু নূতন করে তার প্রয়োজন ছিল না, কারণ চণ্ডী শখের যাত্রাদলে শকুনির ভূমিকা গ্রহণ করে।
মহারাজ সংক্ষেপে বললেন, তা বটে।
অর্থাৎ এ এমন একটা বিষয় যে ঐ দুটি শব্দই যথেষ্ট, বেশি বলবার প্রয়োজন হয় না।
এবারে জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন মুখ খুললেন, বললেন, বাপু হে, আমাদের শাস্ত্রে বলেছে, ধর্মস্য তত্বং নিহিতং গুহায়া-ধর্মের তত্ব গুহাতে নিহিত। কিন্তু তোমার মনটি দেখছি সেই গুহার চেয়েও গোপন। আসল ব্যাপারটা কি বল তো? শুধু ধর্মের খাতিরে কেউ বিশ ক্রোশ মাটি ছুটে আসে এই প্রথম দেখলাম।
চণ্ডী বক্সী পাকা খেলোয়াড়, টলে তো পড়ে না, বলল, পণ্ডিত মশায়ের কাছে কিছু লুকোবার উপায় নেই। হাঁ, এবার আসল ব্যাপারটা বলি।
তার পরে সময়োচিত পরিবর্তন পরিবর্ধন ও পরিবর্জন করে রেশমী-সংক্রান্ত ঘটনা সে নিবেদন করল। রূপান্তরের ফলে বিষয়টা দাঁড়াল এই রকম
চণ্ডী বলে, সতীলক্ষ্মী নারী যখন স্বেচ্ছায় আর্যনারীর আদর্শ অনুসরণ করে পতি চিতায় অনুমতা হতে উদ্যত হয়েছে সেই সময়ে এক বেটা ম্লেচ্ছ সাহেব (এখানে তার মুখমণ্ডলে আর্য–পুরুষোচিত ঘৃণার ভাব প্রকট হল) একদল লেঠেল নিয়ে এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেল মেয়েটাকে।
মহারাজ শুধালেন, কেন, তোমাদের গাঁয়ে কি লাঠি ধরবার লোক ছিল না?
লাঠি ধরে কি হবে মহারাজ, সাহেবের হাতে যে বন্দুক ছিল।
থাকলই বা। বললেন তর্কপঞ্চানন, ধর্মের জন্য কত আর্যপুরুষ প্রাণ দিয়েছে, তোমরাও দু-চারজন না হয় প্রাণ দিতে।
চণ্ডী বলে, নিশ্চয় নিশ্চয়! কিন্তু বেটা ম্লেচ্ছ প্রাণ নেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করল কই। মেয়েটাকে নিয়েই নৌকোয় চড়ে সরে পড়ল।
তর্কপঞ্চানন বলেন, মেয়েটা যদি ইচ্ছা করে গিয়ে থাকে, তবে–
বাক্য শেষ করতে না দিয়ে চণ্ডী, বলে, সে রকম মেয়ে নয় জোড়ামউ গায়ের। মেয়েটার সে কি আছাড়ি-পিছাডি কান্না! ছেড়ে দাও সাহেব ছেড়ে দাও, ঐ যে আমি পতির আহ্বান শুনতে পাচ্ছি-আমর ইহকাল পরকাল নষ্ট ক’র না সাহেব, দোহাই তোমার!
এতক্ষণ হরু ঠাকুর চুপ করে শুনছিল, এবার সে বলল, তোমাদের গায়ে মেয়ে ম সব কি যাত্রাদলে ভর্তি হয়েছে নাকি?
কেন?
কেন কি! পুড়ে মরতে এমন আগ্রহ যাত্রার আসর ছাড়া তো শুনি নি।
এবারে মহারাজা বললেন, তা আমি কি করব?
মহারাজ জাত-কাছারির কর্তা, ধর্মের রক্ষক, হিন্দুধর্মের ধ্বজা, আপনি এখন না বক্ষা করলে যে হিন্দুধর্ম রসাতলে যায়।
এখানে জাত-কাছারি কথাটার একটু ব্যাখ্যা আবশ্যক। ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম আমলে কলকাতায় জাত-কাহারি নামে এক বিচিত্র প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হয়েছিল। কোম্পানির ধুরন্ধর রাজপুরুষগণ বুঝেছিল যে, জাতের গুমর হচ্ছে হিন্দুর মর্মস্থান। জাত মারলে হিন্দু জীবন্ত অবস্থায় মরে। জাত মারার ভয় ভাত মারার বাড়া এদের কাছে। এই সংস্কারটার উপরে মোচড় দিয়ে অনায়াসে হাঁ-কে না করে নেওয়া যায় হিন্দু সমাজে। তাই জাত-রক্ষার হলে জাতটাকে হাত করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে খাড়া করা হল জাত কাহারি। আর সেকালে ধনে মানে প্রতিষ্ঠায় কলকাতার হিন্দু সমাজের যিনি শিরোমণি সেই নবকৃষ্ণ বাহাদুরকে করে দেওয়া হল জাত-কাছারির জজ বা কতা। এই বিচিত্র উপায়ে পরোক্ষ মুষ্টিতে কোম্পানি হিন্দু সমাজকে আয়ত্ত করে নিল। হাতের জোরের চেয়ে সাঁড়াশির কামড় সব ক্ষেত্রেই প্রবলতর। কিন্তু আমরা যখনকার কথা বলছি তখন জাত কাছারির শাসন আলগা হয়ে এসেছে।
চণ্ডীর কথা শুনে মহারাজা বললেন, দেখ বাপু, জাত-কাছারির এলাকা কলকাতার হিন্দু সমাজ। তার বাইরে আমার দণ্ড অচল। তার উপর আবার এর মধ্যে দেখছি এক সাহেব আছে।
চণ্ডী এত সহজে নিবৃত্ত হওয়ার জন্যে এতদূর আসে নি। সে বলল, মহারাজ, কোন সাহেবটা আপনাকে ভয় না করে শুনি? বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায় আপনার নামে!
এবারে নবকৃষ্ণ বাহাদুর ম্লান হেসে বললেন, সে দিন আর নেই বক্সী। এখনকার নতুন লাট-বেলাটেরা আর আগের মত মানীজনের মান রাখতে জানে না। হত ক্লাইভ কি ওয়ারেন হেস্টিংসের সময়, তোমার মামলা সুরাহা করে দিতাম। তাছাড়া, দেখ, আমি প্রাচীন হয়ে পড়েছি, আগের সে উদ্যম আর নেই।
চণ্ডী বলল, আজ্ঞে, নামে করে কাজ, বয়সে কি আসে যায়!
তাছাড়া, আসামী ধরা পড়ত বড়লাটকে না হয় একবার বলে দেখতাম।
তর্কপঞ্চানন বললেন, কোন্ সাহেব, গেল কোনদিকে তার ঠিক নেই, এহেন অবস্থায় মহারাজ কি করবেন?
আজ্ঞে, ভাগীরথী বেয়ে উত্তরদিকে গিয়েছে।
আরে বাপু, ভাগীরথী তো একটুখানি নদী নয়, আর উত্তরদিকটাও নাকি প্রকাণ্ড, আসামী ধরা পড়বে কি করে?
একটা হুকুম পেলেই আসামী খুঁজে বার করি। আর কিছু নয়, শুধু মহারাজের মুখের একটা হুকুম!
বেশ, হুকুম পেলেই যদি আসামী খুঁজে বার করতে পার, না হয় তা-ই দিলাম। কিন্তু দেখো, খুব সাবধান, সাহেবের গায়ে হাত তুললো না।
চণ্ডী শিউরে ওঠে, বলে, সাহেবের গায়ে হাত তুলব, আমি কি বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ঘর করি নে! আমি কেবল মহারাজের হুকুম দর্শিয়ে মেয়েটার চুলের ঝুটি ধরে টেনে নিয়ে হাজির করে দেব শ্রীচরণের তলায়।
না না, আমার কাছে আনতে হবে না, তোমরা যা হয় ক’র, মানে শাস্ত্রে যা বলে তাই কর।
তখন চণ্ডী উঠে দাঁড়িয়ে বুকের উপর হাত দিয়ে বলল, মহারাজার হুকুমে দেহে দশটা হাতীর বল পেলাম, দেখি এবারে ম্লেচ্ছটা কেমন করে সতী নারীকে লুকিয়ে রাখে!
তার পরে সে সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলে, দেখলে তো, একটা মুখের কথার
আচ্ছা পণ্ডিত মশায়, সতীকে চিতায় আরোহণ করাবার আগে ম্লেচ্ছদোষ দূর করবার জন্যে তো একটা অঙ্গ-প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে নেওয়া আবশ্যক—কি বলেন?
তকপঞ্চানন উত্তর দেবার আগে উত্তর দিল হরু ঠাকুর, হাঁ, যেমন বেগুনটা পোড়াবার আগে এক দফা তেল মাখিয়ে নিতে হয়।
ব্যঙ্গে কর্ণপাত না করে চণ্ডী আর-এক প্রস্থ মহারাজার জয়গান করে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত অন্তে সদলবলে বিদায় গ্রহণ করল।
তর্কপঞ্চানন ও হরু ঠাকুরকে বিদায় দিয়ে মহারাজা অন্দরমহলে প্রবেশ করলেন।
২.০৮ অপূর্ব নীলকর
দু মাস হল সদলবলে কেরী মদনাবাটিতে এসে উপস্থিত হয়েছে।
মালদা জেলার উত্তরদিকে টাঙন নদীর তীরে ছোট্ট গ্রাম মদনাবাটি। গাঁয়ের বর্তমান অবস্থা ভাল নয়, কিন্তু ইতস্তত ভগ্ন অট্টালিকার তৃপ, পাথরের টুকরা, মজা দিঘি প্রমাণ করে যে, চিরকাল এমন ছিল না; কোন প্রাচীনকালে সমদ্ধি ছিল, হয়তো বা প্রতাপও ছিল গ্রামটির। সেই বিস্মৃত অতীতের প্রেতচ্ছায়ায় পঁচিশ-ত্রিশ ঘর অধিবাসী কায়ক্লেশে দিন যাপন করে। অধিংকাশই নিম্নবর্ণের লোক আর কিছু সাঁওতাল।
গাঁয়ের পশ্চিমদিকে নদীর ধারে জর্জ উডনীর নীলকুঠি। আম কাঁঠাল বট অশ্বথের ছায়ায় ঘেরা কুঠিবাড়ি উডনীর তৈরি নয়, পুরাতন ইমারত, খুব সম্ভব প্রাচীন সমৃদ্ধির শেষ জীবন্ত সাক্ষী। নীলের ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে উডনী কুঠিবাড়িটা কিনে নিয়েছিল কয়েক বছর আগে। ব্যবসা অবশ্য চলছে, কিন্তু মন্দা তালে, নিজে না দেখলে কোন ব্যবসা চলে! কেরী ভার নিয়েছে, উডনীর বিশ্বাস ব্যবসা এবার তেজের সঙ্গে চলবে। দুই নৌকায় পা রেখে চলা দুষ্কর, তবু হয়তো চলে নৌকা যদি এক শ্রেণীর হয়। ধর্মপ্রচার ও নীলের ব্যবসার মত ভিন্ন শ্রেণীর নৌকা অল্পই আছে।
দশ-বারো মাইল দূরে দিনাজপুর জেলা-ভুক্ত মহীপাল দিঘি গ্রাম। সেখানে উডনীর আর একটি নীলকুঠির ভার নিয়ে বসেছে টমাস। সে মাঝে মাঝে টাটু ঘোড়ায় চড়ে মদনাবাটিতে এসে উপস্থিত হয়–দু-চার দিন কাটিয়ে যায়।
কুঠির নায়েব, গোমস্তা, কারকুন, পাইক প্রভৃতি নৃতন কাজ পেয়েছে। এখন আর তাদের দাদন দেওয়া, নীলের চাষ তদারক, প্রজা-শাসন—এসব কিছুই করতে হয় না। তার বদলে এখন তারা কেরীর বাংলা বিদ্যালয়ের জন্য ছাত্র সংগ্রহ করে বেড়ায়। কেরীর হুকুম, যে বাড়ির হেলে পড়তে আসবে সে বাড়ির দু মাসের খাজনা মাপ, দুটি ছেলে পড়তে এলে বরাদ্দ নীলের বদলে টাকা দিলেই চলবে; তবু হাত্র জুটতে চায় না। লোকে ভাবে, এর চেয়ে নায়েবের জরিমানা, পাইকের লাঠি অনেক ভাল। এ কি নূতন উৎপাত!
ছাত্র জুটতে চায় না সত্য, তবু দু টাকা করে জলপানি দেবার লোভ দেখিয়ে আট দশটি ছাত্র যোগাড় করেছে কেরী। তারা সকালবেলা এসে তিন-চার ঘণ্টা পড়ে যায় শিক্ষক রাম বসু, পার্বতী ব্রাহ্মণ। আরও একটি শিক্ষক পাওয়া গিয়েছে, গোলকচরণ শর্মা, সে এই অঞ্চলেরই লোক।
কেরীর বাংলা বিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র রেশমী। যেমন তার মনোযোগ, তেমনি বুদ্ধি, তেমনি উৎসাহ। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ন্যাড়াকে ঢোকাতে পারা যায় নি বিদ্যালয়ে।
ন্যাড়া বলে, রেশমী দিদি, আমি আবার কি শিখব? কোন্ বিদ্যাটা আমার অজানা বল! জুতো-সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব জানি।
রেশমী বলে, পড় দেখি চণ্ডী।
অমনি বুঝি চী পড়া যায়! পূজোর যোগাড় কর, দক্ষিণা দাও।
বাঃ, আগেই বুঝি দক্ষিণা দেয়?
আচ্ছা না হয় পরেই দিও, পূজোর যোগাড় তো আগে করতে হয়।
রেশমী হেসে বলে, না রে, লেখাপড়া শেখ। কায়েৎ দাদার মত পন্ডিত হলে লোকে কত খাতির করবে, অনেক মাইনে পাবি।
রেশমী দিদি, যে বিদ্যা শিখেছি তারই বাবদ কে মাইনে দেয়। তাতে আবার—
কোথায় আবার লেখাপড়া শিখলি তুই? কেবল বাজে বকিস!
বাজে বকি? কেন, মাতুনি সাহেবের বাড়িতে যা শিখেছি—বলি নি তোমাকে?
সে তো কেবল ইংরেজ গালাগালি!
আর, বাংলা? বলব কি দিদি, আমরা বাঙালীরাও জানি নে সে-সব গালাগালি!
না না, অমন দুষ্টমি করিস নে। দুজনে একসঙ্গে পড়লে বেশ মজা হবে। চল।
তার চেয়ে চল তালডাঙায় বেড়িয়ে আসি, মাঠে নতুন জল পড়েছে, স্রোতে কত মাছ চলেছে, ধরি গে চল। দেখবে পড়ার চেয়ে তাতে আরও কত বেশি মজা।
ন্যাড়ারই জয় হয়, দুজনে নদী পেরিয়ে মাঠের দিকে চলে যায়।
জানার টানের চেয়ে প্রাণের টান প্রবল হলে ইস্কুল না পালিয়ে উপায় নেই। ইস্কুলে যারা পিছনের সারির ছাত্র, জীবনে তারাই প্রথম সারির লোক, কারণ বিদ্যালয় বস্তুটা জীবনের দিকে পিছন ফিরিয়ে প্রতিষ্ঠিত।
টমাস মাঝে মাঝে এসে দু-চার দিন থেকে যায়। কি কারণে জানি না, ন্যাডকে সে সুনজরে দেখে নি। টমাস বলে, ঐ ন্যাড়া ছোঁড়াটাই রেশমীকে মাটি করল!
রাম বসু মনে মনে বলে, এখন তোমার সুনজর রেশমীর উপর না পড়লেই বাঁচি, তোমার চরিত্র আমার তো জানতে বাকি নেই।
কেরী বলে, না না, ওরা দুটিতে বেশ আছে। রেশমীর একটা সঙ্গী তো চাই। তাছাড়া রেশমী বিবির খুব মেধা, আমার কাছে তো ইংরেজি পাঠ নিতে শুরু করেছে।
কখনও কখনও উডনীর চিঠি নিয়ে লোক এসে উপস্থিত হয়। তাতে থাকে নীলের চাষ সম্বন্ধে সমযোপযোগী উপদেশ, থাকে প্রজাশাসনের পরামর্শ; সেই সঙ্গে অবশ্য আনুষঙ্গিক ভাবে খ্রীষ্টধর্ম-প্রচার ও শিক্ষা-প্রসার সম্বন্ধেও উৎসাহ থাকে। নীলের চাষ সম্বন্ধে কেরীর অভিজ্ঞতার ও আগ্রহের অভাব থাকায় চিঠির মর্ম সে উটে বোঝে; তার ধারণা, খ্রষ্টধর্ম-প্রচার ও শিক্ষা-প্রসারের উদ্দেশ্যেই এখানে সে প্রেরিত, নীলের চাষটা নিতান্তই আনুষঙ্গিক। তবু কর্তব্যবুদ্ধির প্রেরণায় এক-আধবার নায়েব গোমস্তাকে তাগিদ দেয়। কিন্তু সে না জানে চাষের মর্ম না বোঝে হিসাব-কিতাব, সুযোগ পেয়ে নায়েব গোমস্তার দল দুহাতে চুরি করতে লাগল। কেরী কোনদিন খাতাপত্র তলব করলে ওরা জন-দুই নৃতন শিক্ষার্থী এনে হাজির করে। মুহূর্তে খাতাপত্রের প্রসঙ্গ ভুলে কেরী বলে ওঠে-অসীম কৃপা! প্রভুর খাতাপত্র যায় কৃপা-সমুদ্রে তলিয়ে, ছাত্র দুটিও দিন দুই বিদ্যালয়ে দেখা দিয়ে যায় তলিয়ে! এই রকমই ব্যবস্থা তাদের পিতামাতার সঙ্গে নায়েবের।
একদিন কেরী নায়েবকে বলল, হরিশপুরের চাষ দেখতে যাব আজ।
তখনই গোমস্তা এসে বললে, হজর, তালপুকুরের একটা গেরস্ত খিরিস্তান হবার ইচ্ছা জানিয়েছে।
খ্রীষ্টান হবার! কেরীর মুখ আশায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তখন সে ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে তালপুকুরের উদ্দেশে রওনা হল। তালপুকুর হরিশপুকুরের ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত আর দূরত্ব প্রায় চৌদ্দ-পনেরো ক্রোশ; যাতায়াতে দুদিনের ধাক্কা।
হরিশপুরের চাষীরা নায়েবের কৃপায় নীলের বদলে ধানের চাষ শুরু করেছে। এই ভাবে বাস্তবক্ষেত্রে নায়েবের কৃপার সঙ্গে প্রভুর কৃপার প্রতিযোগিতা চলে। প্রভুর কৃপা এঁটে উঠতে পারে না।
.
২.০৯ না-বনের না-বাগানের
এক একদিন রাত্রে ঘুম ভেঙে গিয়ে রেশমী বিছানার উপরে উঠে বসে। অসহ্য দুঃখে সমস্ত মনটা টনটন করে। বীণায় তার চড়াতে চড়াতে এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে, সামান্যতম নিশ্বাসে, এমন কি যে নিশ্বাস কেবল মনের মধ্যে দুলে উঠেছে এখনও বাইরে প্রকাশ পায় নি, সেই গুপ্ত নিশ্বাসেও যেন ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে। রেশমী ভাবে, দুঃখের এ কি সর্বনাশা মূর্তি। দুঃখের বন্যা প্রবল হয়ে উঠলে কূলের বাধা মানে না, তখন তীরে নীরে এক হয়ে যায়। মানসিক দুঃখ যে শরীরকে বিকল করে দেয়, তা কে জানত? দুঃখের সঙ্গে রেশমীর নৃতন পরিচয়। অবশ্য শৈশবে মস্ত একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল তার জীবনে। হঠাৎ শুনতে পেল বাবা-মা-ভাই-বোন আর ফিরবে না। তখন ব্যাপারটিকে যথাযথ ভাবে গ্রহণ করবার বয়স তার হয় নি। পরে সব বুঝেছে। কিন্তু সেসব হয়ে বয়ে চুকে গিয়েছে, শৈশবের অতি দূর দিগন্তে একটুখানি অশ্রুবাষ্প এখন তার একমাত্র চিহ্ন। ঐটুকু ছেড়ে দিলে তার জীবন সুখেই কেটেছে বলতে হবে, দিদিমার স্নিগ্ধ হৃদয়ের সমস্ত ভালবাসা পড়েছিল তার উপরে। কিন্তু তখন কে জানত যে, এমন এক নিদারুণ বজ্র নির্মিত হচ্ছে তার জন্যে। সে কি অশনি! যেমন অতর্কিত তেমন নির্মম! শেষ কদিনের কথা সে ভাল করে ভাবতে পারে না, ভাবতে চায় না। কিন্তু দুঃখের এ কি বিচিত্র প্রকৃতি, ঘুরেফিরে তাকে দেখা দিয়ে যায়। আর না যাবেই বা কেন? ঐ একটি অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কোন অভিজ্ঞতা আছে তার জীবনে।
কতক্ষণ সে বসে আছে ঠাহর করতে পারে না। খুব সম্ভব দু-চার মুহূর্ত মাত্র। কিন্তু না, যখন উঠে বসেছিল, ঘুলঘুলি দিয়ে চেয়ে দেখেছিল আকাশটা অন্ধকার, এখন উজ্জ্বল, চোখে পড়ল আকাশের প্রান্তে একটুখানি চাঁদের ফালি। কৌতূহলী চন্দ্রকলা উকি মারছে তার মনের মধ্যে।
তার হঠাৎ মনে হল ঘরের বাইরে কার যেন পায়ের শব্দ। চমকে উঠে রেড়ির তেলের আলোয় দেখে নিল দরজার খিল বন্ধ আছে।
প্রথম যখন এখানে এসেছিল, অনেকদিন পর্যন্ত রাতে তার ঘুম হত না, দিনে সে কুঠিবাড়ির হাতা ছেড়ে বাইরে যেত না। দিনে রাতে তার চণ্ডী বীর গুপ্তচরের ভয়। তিনুদাদার কথা মনে পড়ে—‘চণ্ডী সহজে ছাড়বে না, খুব সাবধানে থাকিস দিদি।‘ কিন্তু ই মাসের মধ্যে চণ্ডী বজীর লোকজনের সাক্ষাৎ না পাওয়ায় সে অনেকটা নিশ্চিত হয়েছিল, ভেবেছিল চণ্ডী তার সন্ধান হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু জীবনে একমাত্র চণ্ডীই তো ভয়াবহ নয়, আরও ভয় আছে, অন্য ধরনের ভয়। রেশমী বুঝেছে, বয়সের ভয় বলতে একটা বিশেষ দুর্বিপাক বোঝায়। মনে পড়ে তার টমাস সাহেবকে। তার মতিগতি দৃষ্টি সে মোটেই পছন্দ করে না।
টমাস একদিন তাকে বললে, রেশমী বিবি, তোমাকে আমি বাইবেলের গল্প শোনাব।
কেরী পরিহাস করে ডাকে রেশমী বিবি। রেশমীর ভাল লাগে-ঠাকুর্দা-নাতনীর সম্পর্কে এমন পরিহাস চলে। কিন্তু টমাসের মুখে ‘বিবি’ শব্দটা তাকে ভাবিয়ে তোলে, মনে হয়, ওর মধ্যে লালসার তাত আছে।
টমাস বেছে বেছে বাইবেলের প্রাচীন খণ্ড থেকে এমন সব গল্প বলে, যাতে আছে কামনার দাগ। তার কানের ডগা লাল হয়ে ওঠে। এসবের কোন-কোনটা শুনেছে সে কেরীর মুখে। কিন্তু কি আশ্চর্য, মুখান্তরে এমন রসান্তর ঘটে কিভাবে?
রেশমী বলে, এবারে আমি উঠি।
না না বিবি, আর একটু বস। যাবে তুমি একদিন মহীপাল দিঘিতে? মস্ত বড় দিঘি আছে, খুব সাঁতার কাটবে।
রেশমী ইতিমধ্যেই বুঝেছে যে কেরীকে টমাসের বড় ভয়।
সে বলে, জিজ্ঞাসা করে দেখি কেরী সাহেবকে!
আরে না না, কেরীকে এসব কথা ব’ল না। আচ্ছা, এখন যাও।
রেশমী মুক্তি পায়। রেশমী বোঝে জীবনের পর্বে পর্বে দুর্ভাগ্য নূতন নূতন মূর্তিতে দেখা দেয়।
সত্যি কথা বলতে কি, একলা ঘরে শুতে তার ভয় করে, কোনদিন অভ্যাস ছিল না। কিন্তু এখানে কে শোবে তার ঘরে? ছিরুর মা জ্যাভেজকে নিয়ে শোয় কুঠিবাড়ির একটি কামরায়। কুঠির উত্তর-দক্ষিণে এক সার করে কতকগুলো ছোট ছোট কামরা আছে। উত্তরদিকের একটা ঘরে শোয় রেশমী—অদূরে আর একটা ঘরে ন্যাড়া। ন্যাড়া বলে, রেশমী দিদি, ভয়ে পেলে ডাক দিও-চণ্ডীর ঘাড়ে চামুণ্ডার মত লাফিয়ে পড়ব। দক্ষিণদিকের ঘরগুলোয় শোয় রাম বসু, পার্বতী ব্রাহ্মণ প্রভৃতি। কে শোবে রেশমীর সঙ্গে, সে একাই শোয়। মনে মনে বলে, ক্ষতি কি? সারা জীবন তো একাই থাকতে হবে—অভ্যাস হয়ে যাক।
হঠাৎ একদিন রাত্রে বাজনাবাদ্যির আওয়াজে রেশমীর ঘুম ভেঙে গেল, চমকে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠল; ভাবল, এত শোরগোল কিসের, ডাকাত পড়ল নাকি? জানালার কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে হেসে উঠল, বিয়ের শোভাযাত্রাকে ডাকাতের দল ভেবেছিল সে। কিন্তু তখন আবার মনে হল এ-ও একরকম ডাকাতি বইকি! কোন ঘরের মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়ে কোথায় চলল? নিজের কথা মনে পড়ল। কিন্তু ভাবনা বাধা পায় আলো, কোলাহল, সানাইয়ের তরুণ আলাপ রাত্রির অন্ধকারকে উদ্ভ্রান্ত করে দিয়ে চলেছে। তার চোখে পড়ে পালকির খোলা দরজার ফাঁকে বরের করুণ মূর্তি। কি সুন্দর! এক মুহূর্তে আনন্দের শিখরে উঠে তখনই আবার গড়িয়ে পড়ে বিষাদের খাদে তার মনটি। সুখ আর দুঃখ পাশাপাশি প্রতিবেশী, কি আশ্চর্য! আর ঐ বন্ধ পালকিখানায় নিশ্চয় কনে। সে-ও কি এমনি সুন্দর হবে? না না, সুন্দর মেয়ে এত সুলভ নয়। আর হলেই বা কি, রূপ দিয়ে কি দুর্ভাগ্যকে ঠেকানো যায়? তাহলে তার অমন অবস্থা হবে কেন? রেশমী জানে যে সে অপূর্ব সুন্দরী। কেমন করে জানল? যে ভাবে সমস্ত নারী জানে সেইভাবে জেনেছে, পুরুষের চোখের দর্পণে আপনাকে প্রতিফলিত দেখে জেনেছে।
আর একটা হঠাৎ-ঘুমভাঙা রাত্রির কথা তার মনে পড়ল। রাত্রিটাই বিশেষ করে তার নিজস্ব। শুনেছিল সেদিন, শ্মশান-যাত্রীর উচ্চ হরিবোল ধ্বনি। একাকী জেগে জেগে সে ভাবতে লাগল, ঐ হরিবোল ধ্বনি যেন জীবনের প্রান্তে আঁচড় কেটে সীমান্তরেখা টেনে দিচ্ছে। কিন্তু এই প্রকাণ্ড অনন্ত মানবজীবনের মধ্যে তার স্থান কোথায়? সে না-সংসারের না-পরলোকের। পরলোকের গ্রাস থেকে পালিয়েছে সে, সংসারের পাশ। থেকে ছিঁড়ে এসেছে সে, হোমানল চিতানল কারও সঙ্গে নেই তার সম্বন্ধ। মনে হল সে বড় অদ্ভুত! এমনটি আর আছে কি? একবারেই কি নেই? হ্যাঁ, আর একটি মাত্র আছে। সেটি একটি কুসুম গাছ। মাঠের মধ্যে উদাসীন নিঃসঙ্গ নিরর্থক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দুজনের একই দশা, তারা দুজনেই না-বনের না-বাগানের।
.
২.১০ দুই সখীতে
লোকের সঙ্গে মেশবার ক্ষমতা একটি মস্ত সামাজিক গুণ, এই গুণটি রেশমীর প্রচুর পরিমাণে ছিল। গাঁয়ে থাকতে কোমরে কাপড় জড়িয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াত সে, সব খবর সকলের আগে আসত তার কানে। দিদিমা মোক্ষদা বুড়ী বলত, ও বাতাসে খবর পায়। কার ছেলের বিয়ে, কার নাতনীর বিয়ে, বাড়ির লোকে জানবার আগে জানত ও। লোকে ঠাট্টা করে বলত—ঘটকী ঠাকরুন।
কোমরে-কাপড়-জড়ানো, মুখে-হাসি, সর্বত্র অবাধ-গতিশীল রেশমী ছিল গাঁয়ের আনন্দলহরী। তার পর অকস্মাৎ এল দুঃখের রাত্রি। সংসারের যাবতীয় দুর্দৈব হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল তার ঘাড়ে। রেশমীর সঙ্গে গাঁয়ের হাসিটুকু গেল এক ফুয়ে নিতে। সুখী মানুষ শিশু, চিরসুখী মানুষ চিরশিশু। দুঃখে মানুষের বয়স ভিতরে ভিতরে বাড়িয়ে তোলে। দুঃখের ধাক্কায় এক ধমকে রেশমীর বয়সটা গিয়েছে বেড়ে। তবু পুরনো অভ্যাসটা যায় নি।
মদনাবাটির কুঠিতে পৌঁছে দু-চার দিন পরেই ন্যাড়াকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল গায়ের মধ্যে। বাঁশবনের মধ্যে সৌদামিনী বুড়ীর ঘর। সেখানে গিয়ে উপস্থিত হল।
বুড়ী শুধাল, তোমরা কাদের ছেলেমেয়ে গো?
রেশমী বলল, কায়েদের গো।
দেখে ভাইবোন বলে মনে হচ্ছে!
রেশমী বলে, ঠিক ধরেছ দিদিমা।
তা বেশ, বস বস।
তার পরে শুধাল, এখানে কোত্থেকে গা?
ঐ কুঠিবাড়িতে এসেছি।
তা বয়স এত হয়েছে, বিয়ে হয় নি কেন?
আমাদের কুলীনদের ঘরে এমন হয়।
হয়ই তো, হয়ই তো। আমার বর জুটতে বয়স দুকুড়ি পেরিয়ে গিয়েছিল, আমরাও কুলীন কিনা।
সৌদামিনী বিধবা।
রেশমী বলে, সে কি কথা দিদিমা, তোমার বয়স এখনই তো দুকুড়ি হয় নি।
প্রতিবাদ করে না বুড়ী। তৎপরিবর্তে দলেশহীন মুখগহবরে হাসি ফুটিয়ে বলে, এসেছ চাড়ি চালভাজা খেয়ে যাও। চাড্ডি চালভাজা খেয়ে যাও।
চালভাজা খেতে খেতে ন্যাড়া শুধায়, চালভাজা খাও কি করে দিদিমা, তোমার দাঁত তো দেখছি না!
মাড়ি দিয়ে খাই দাদা, মাড়ি দিয়ে খাই (প্রত্যেক কথার দ্বিত্বভাষণ বুড়ীর এক মুদ্রাদোষ)। মাড়ির জোর কি দাঁতের আছে? দাঁত পড়লে তবে চালভাজা খেয়ে সুখ।
সেই অতিদূর অনাগত দিনের জন্য অপেক্ষা করবার ইচ্ছা দেখা গেল না ন্যাড়ার ব্যবহারে, কায়মনোবাক্যে চালভাজায় আত্মনিয়োগ করল সে।
আর একদিন গেল ছুতোরদের পাড়ায়। আজ সঙ্গে ছিল না ন্যাড়া, মাছ ধরবার মত একটা পুকুরের সন্ধান পেয়েছে সে। ছুতোরের মেয়েরা চিড়ে কুটছিল। যে মেয়েটি চেঁকিতে পাড় দিচ্ছিল সে একটু নামমাত্র বিনা ভূমিকায় রেশমী পেঁকিতে পাড় দিতে শুরু করল।
প্রথমে কেউ লক্ষ্য করে নি। তার পরে তার দিকে চোখ পড়তেই সবাই জিজ্ঞাসা করল, তুমি কোথায় থাক গা?
রেশমী গম্ভীরভাবে বলল, বাঁশবনে।
ওরা শুধাল, ডোমপাড়ায়?
ডোমপাড়ায় কেন হতে যাবে? বাঁশবনে, আমি বাঁশবনের পেত্নী।
অপ্রত্যাশিত উত্তরে সকলে স্তব্ধ হয়ে গেল, অনেকেরই তার প্রেতযোনিত্বের দাবিতে বিশ্বাস হল। সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি ও কানাকানি শুরু করল।
তখন একটি বর্ষীয়সী গিন্নীবান্নি গোছের মেয়ে শুধাল, তা এখানে কেন মা?
আর-জন্মে আমার বাপের বাড়ির অবস্থা ভাল ছিল না, চিড়ে কুটে, খই মুড়ি ভেজে আমাদের চলত। তার পরে বিয়ে হল বড়লোকের ঘরে। চিঁড়ে কোটা গেল বন্ধ হয়ে। চিঁড়ে কুটতে না পেরে হাঁপিয়ে উঠলাম। একদিন ছুতোরদের পাড়ায় চিঁড়ে কোটা হচ্ছিল, লুকিয়ে গিয়ে চিঁড়ে কুটে এলাম। কথাটা জানাজানি হয়ে গেলে শাশুড়ী বাপের বাড়ির খোঁটা দিয়ে গালাগালি করল। সেই দুঃখে গলায় দড়ি দিয়ে মরলাম।
তার গতজন্মের বিবরণে ইহজন্মবাসিনীরা ভয়ে বিস্ময়ে বসে পড়ল, কারও মুখে কথা নেই।
তখন সেই বর্ষীয়সী মেয়েটি বলল, তা এখানে কেন মা?
ওই যে বললাম, চিড়ে কোটার শখ, বিশেষ করে ছুতোরদের চিঁড়ে কোটা।
পেত্নী মাঝে মাঝে ভাজা মাছ দাবি করে উপদ্রব করে এই সংবাদটাই সকলের জানা ছিল, চিঁড়ে-কোটা পেত্নীর বিবরণ কেউ শোনে নি,তার উপরে আবার পেত্নীটা অত্যন্ত বেয়াড়া রকমের নাছোড়বান্দা।
নিরুপায় দেখে সেই বর্ষীয়সী মেয়েটি গলায় কাপড় দিয়ে গড় হয়ে প্রণাম করল, মিনতি জানাল, মা, তুমি দেবী কি মানবী যেই হও, দয়া করে এখন স্বস্থানে যাও।
রেশমী দেখল তামাশায় আশাতীত ফল ফলেছে, সে রোধের সঙ্গে বলে উঠল, তার প্রত্যেকটি শব্দের উপরে সানুনাসিক ঝোঁক দিল ( কথাটা এতক্ষণ তার মনে পড়ে নি)—না, কখনও যাব না, তোঁদের আঁড়াই মণ চিঁড়ে কুঁটে দিয়ে তঁবে যাঁব। শাশুড়ীর গালাগাঁলের জ্বালায় এখনও গাঁ জ্বলছে।
প্রণতা মহিলা বলল, মা, আমরা বড় গরিব।
আঁরে সেঁই জন্যেই তঁ এসেছি। রাঁজারা কি চিঁড়ে কোঁটে, তাঁরা তঁ চিঁড়ে খাঁয়, ক্ষীর দিয়ে, সঁন্দেশ দিয়ে, কঁলা দিয়ে মেঁখে।
পেত্নী বড়ই নাছোড়বান্দা।
দলের মুখপাত্ররূপে সেই মেয়েটি বলল, দয়া করে তুমি অন্তধন কর মা, চিঁড়ে ক্ষীর সন্দেশ কলা দিয়ে তোমার ভোগ দেব।
কোথায় দিবি? কখন দিবি?
বলা বাহুল্য, শব্দের অনুনাসিক প্রয়োগ চলল, কিন্তু অভ্যাস না থাকায় মাঝে মাঝে ভুল, হয়ে যায়, আবার সংশোধন করে নেয় রেশমী। পেত্নী না হয়ে পেত্নীর অভিনয় করা যে সহজ ব্যাপার নয় এই ঘটনাতে তা সকলেই বুঝতে পারবেন।
যেখানে বল, আসছে শনিবারে অমাবস্যা পড়ছে—সেইদিন।
পেত্নী বলে, না, মানুষের কথা বিশ্বাস করি নে। তারা মানৎ করে দেয় না।
রেশমীর এ বিশ্বাসের বিশেষ কারণ আছে, বিপদে পড়ে অনেকবার মানৎ করেছে, বিপদ কেটে গেলে দেয় নি।
আজই দিতে হবে, এখনই, এখানে।
সকলের পুনরায় বিস্মিত নির্বাক ভাব।
একজন বলল, বডগিন্নী, দাও না এনে।
বড়গিন্নী, মানে সেই মুখপাত্র, বলল, আমার ঘরে আর সবই তো আছে, কেবল কলাটা নেই।
পেত্নী ক্ষোভে বলে উঠল-(অনুনাসিক উচ্চারণে) তা হবে না, কলা আমার ভাল লাগে। পাকা কলা না পেলে ছেড়ে যাব না।
একজন বলল, ছিদামদের গাছে বোধ করি আছে।
পেত্নী–সানুনাসিক) তবে যাও না, নিয়ে এস না, হাঁ করে দাঁড়িয়ে কি দেখছ? পেত্নী কি কখনও দেখ নি?
সত্য কথা বলতে কি, ইতিপূর্বে তারা কেউ পেত্নী দেখে নি-আর পেত্নীর যে এত রূপ হয় তা-ও কেউ শোনে নি।
দু-তিনজন অগ্রণী হয়ে পেত্নীর ভোগের উপকরণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করল, একটা আস্ত পেত্নীকে সশরীরে ক্ষীর সন্দেশ ও কদলী সহযোগে চিপিটক ভক্ষণ করতে দেখবার দুর্দমনীয় কৌতূহল তাদের পেত্নীভীতিকে অভিভূত করে ফেলেছিল।
একটা ক্ষুধিত কুপিত পেত্নীর সঙ্গে এই অবকাশে ঠিক কিরূপ ব্যবহার করা উচিত জানা না থাকায় সকলে নির্বাক হয়ে রইল।
এমন সময় ছুটে প্রবেশ করল গোলগাল কালো-কোলো রঙের চুল-ছোট-করে ছাঁটা একটি মেয়ে, বলল, তোমরা সবাই অমন হাঁ করে বসে আছ কেন? কি হয়েছে?
একজন বলে উঠল, ফুলকি, চুপ কর, দেখছিস নে পেত্নীর আবির্ভাব হয়েছে।
ফুলকি রেশমীকে লক্ষ্য করে নি, এবারে দেখে চীৎকার করে উঠবে, রেশমী চোখের ইশারায় তাকে নিষেধ করল।
অন্য একজন বলল, এদিকে সরে আয়, উনি চিঁড়ে-দুধের ভোগ চান, নইলে সর্বনাশ করবেন!
ফুলকির সঙ্গে এই কদিনেই রেশমীর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, এরা তা জানত না। কিন্তু ফুলকি বিলক্ষণ জানত রেশমীর স্বভাব, বুঝল একটা কিছু চলছে। তাই সে বলল, ভোগ চান তো দাও।
আনতে গিয়েছে।
এমন সময়ে চিঁড়ে ক্ষীর, সন্দেশ ও কলা নিয়ে একটি মেয়ে প্রবেশ করল। তখন সমস্যা হল—কে এগিয়ে দেবে?
ফুলকি বলল, সেজন্যে ভাবনা কি? আমি দিচ্ছি গিয়ে।
তোর হাতে কি উনি খাবেন?
কেন খাবেন না! পেত্নীতে জাতবিচার করে না।
তবে এগিয়ে নিয়ে যা, গিয়ে মর।
কিন্তু ভয়ের কিছুমাত্র লক্ষণ দেখা গেল না ফুলকির আচরণে। সে ভোগের উপকরণ পেত্নীর কাছে নিয়ে যাওয়া মাত্র পেত্নী দিব্য মানুষটির মত এসে বসল। আর সবাই হতচকিত হয়ে রুদ্ধনিশ্বাসে দেখল যে, শুধু পেত্নী নয়, পেত্নী ও ফুলকি দুজনে যথাশাস্ত্র সেগুলি মেখে-মুখে নিয়ে খেতে আরম্ভ করেছে।
ক্রমে আসল রহস্য প্রকাশ হয়ে পড়ল। সব শুনে মেয়েদের কেউ কেউ হেসে উঠল, অনেকেই রাগ করে চলে গেল। কেবল সেই বর্ষীয়সী মেয়েটি বলল, ওঁদের বিষয়ে এমন করে ঠাট্টা-তামাশা করা ভাল নয়, মেয়েটা মরবে!
.
কুঠিতে আসবার পরদিনেই ফুলকির সঙ্গে রেশমীর দেখা হয় আর অল্পক্ষণের আলাপের পরেই দুজনের খুব ভাব জমে যায়।
রেশমী শুধাল, তুমি ভাই কোথায় থাক?
ফুলকি বলল, আলেডালে।
সে আবার কি?
আজ এখানে কাল ওখানে। রেশমী বুঝল, মেয়েটি একটু অন্য ধরনের, শুধাল, কাল রাতে কোথায় ছিলে তাই না হয় বল?
কাল রাতে ছিলাম কালীবাড়ির পোড়ড়া মন্দিরটায়।
ভয় করল না?
আমার ভয় করবে কেন? ভয় করল ওদের।
কাদের?
মা কালীর ডাকিনী-যোগিনীদের।
সে আবার কি রকম?
তারা আমার চেহারা দেখে মা কালী ভেবেছিল তাই কাছে ঘেঁষে নি।
এবারে রেশমী ঠাট্টা করে বলল, আর শিবঠাকুরটি?
জানতে পারলে অবশ্য তিনি পোড়ো মন্দিরেই দেখা দিতেন।
দেবতারা তো ভাই অন্তর্যামী।
তা আর জানি নে! বলে উঠল ফুলকি।
বেশ তো, কাল না হয় কাটালে কালীবাড়িতে, আজকে কোথায় থাকবে?
ভাবছি ভোলা বাগদির ঘরেই থাকব।
বিস্মিত রেশমী শুধায, সে আবার কে?
এই গাঁয়েই থাকে লোকটা। কিছুদিন আগে তার বউ মরেছে–আমার পিছু পিছু আজ কদিন ঘুরছে। দেখ না, এই শাড়িখানা তারই দেওয়া।
এই স্পষ্ট ইঙ্গিতে রেশমী নিতান্ত বিব্রত বোধ করল, নিজের অজ্ঞাতসারে বসল একটু সরে, এতক্ষণ ঘেঁষাঘেঁষি বসেছিল।
ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ফুলকি বলল, এতেই সরে বসলে?
অপ্রস্তুত রেশমী বলল, না না।
না ভাই, তোমার আর দোষ কি! সরে বসাই তো চাই। কিন্তু সব কথা শুনলে বোধ করি দশ রশি দূর থেকে আমাকে গড় করবে।
মেয়েটির কুথায় রেশমীর কৌতূহল বাড়ছিল, অস্ফুট স্বরে বলল, কি শুনি না?
ফুলকি শুরু করল, পুরুষ বড় লোভী, ঠিক যেন বাড়ির লোভী ছেলেটা। সন্দেশের থালা দেখলেই হুঁক হুঁক করে আশেপাশে ঘুরে বেড়াবে। এখন সারাদিন কি ভাই সন্দেশ পাহারা দিয়ে থাকা যায়, তাই একটু-আধটু ভেঙে তাদের হাতে দিতে হয়, খুশি হয়ে চলে যায়, নিশ্বাস ফেলবার সময় পাওয়া যায়। সন্দেশ যতই দামী হক, দিনরাত্রি পাহারা বসিয়ে রাখবার মত দামী নিশ্চয়ই নয়।
রেশমী বলল, তা কতজনকে সন্দেশ ভেঙে দিলে?
এবারে কথায় মিশল একটু ঝাঁজ।
হেসে উঠে ফুলকি বলল, তুমি রাগ করেছ দেখছি।
তার পরে গুন গুন সুরে গান ধরল–
‘তা গুনতে গেলে গুণের নাহি শেষ।’
রেশমী তার নির্লজ্জতায় রেগে উঠে বলল, এ তো গেরস্ত মেয়ের মত কাজ নয়। নয়ই তো। যার ঘর নেই দুয়োর নেই, সে আবার গেরস্ত কি!
তোমার কি বাপ-মা নেই?
ছিল নিশ্চয়ই, নইলে হলাম কেমন করে?
তবে?
তবে আবার কি?
এই বলে আবার সে গান ধরে–
‘আমরা যে ভাই মায়ের ছেলে
বাপ চিনি নে কোনকালে।‘
তার পরে ব্যাখ্যা করে শোনায়, আমরা তরাই অঞ্চলের লোক। মা সাঁওতাল, বাপ শুনেছি কোন্ জমিদার কি তার নায়েব কি অমনি একটা কেউ। দেখি নি কোনকালে। ওলাউঠায় মা মরে যাওয়ার পরে ঘুরতে ঘুরতে এদেশে চলে এসেছি, ভাল না লাগলে আবার ভেসে অন্যত্র চলে যাব। ঐ দেখ—এই বলে আকাশে একখানা কালো মেঘ দেখায় ঐ কালো মেঘখানা কেমন জল দিতে দিতে এক দেশ থেকে আর এক দেশে চলে যাচ্ছে।
কিছুদিন গেল রেশমীর এই মেয়েটির সম্বন্ধে মনস্থির করতে। একদিকে তার সামাজিক মন বলে, এ অন্যায় এ অন্যায়, এ ঘৃণাই এ ঘৃণাৰ্থ; অন্যদিকে তার আদিম মন বলে, এমন কি হয়েছে, এমন কি হয়েছে! একদিকে আকর্ষণ, অন্যদিকে বিকর্ষণ; এ সেই সোনার আপেল দর্শনে আদি রমণী ইভের দ্বন্দ্ব আর কি! ইভের ক্ষেত্রে যেমন রেশমীর ক্ষেত্রেও তেমনি, শেষ পর্যন্ত সোনার আপেলেরই হল জয়। দুজনের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য হয়ে উঠল, দুই সখী।
শুধু তাই নয়, গাঁয়ের লোকের সঙ্গেও সম্বন্ধ পাতিয়ে ফেলল রেশমী, কেউ মাসি, কেউ পিসি, কেউ দিদিমা, কেউ মামীমা ইত্যাকার।
এইভাবে বেশ চলছিল, এমন সময়ে কেমন করে রটে গেল রেশমীর জীবনের প্রকৃত বৃত্তান্ত, সে বিধবা এবং চিতাপলায়িতা। অমনি এই অলক্ষুণে মেয়েটার প্রতি মাসি পিসি দিদিমা মামীমার দল সর্বৈব বিমুখ হল। ফুলকির চরিত্র জানা সত্ত্বেও ফুলকিকে তারা ক্ষমা করেছে, কিন্তু এ যে আর এক কথা! হয়তো তাদের দৃষ্টিই যথার্থ, প্রবৃত্তির নিয়ম যে ভঙ্গ করেছে অদৃষ্ট তাকে শাসন করবে, কিন্তু সমাজবিধি-ভঙ্গের শাসক সমাজ।
গাঁয়ের লোকের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত রেশমীর আরও কাছে এসে দাঁড়াল ফুলকি, বলল, বেশ করেছ ভাই, খামকা মরতে যাবে কেন? বেঁচে থাকবার কত সুখ!
পদ্মদিঘির উঁচ পাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে দুজনে কথা বলছিল, দিঘির কালো জলরাশি দেখিয়ে ফুলকি বলল, চল নেমে খানিকটা সাঁতার কাটি, দেখবে কত আরাম!
তার পরে একটু থেমে বলল, চিতায় পুড়ে মরতে যাব-মরণ আর কি!
রেশমীকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখে শাডিখানা খুলে রেখে উঁচু পাড় থেকে সবেগে দিঘির বুকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল ফুলকি, মুহূর্ত-মধ্যে জল উথাল-পাথাল হয়ে উঠল। রেশমী দেখল, মন্থিত কালো জলের মধ্যে কালোদেহ স্নানরসরসিকা কালীয় নাগিনী।