২.৬
রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। অভ্যাসবশত হলওয়ের সুইচবোর্ডে চলে গেল হাত। বালবটার ফিউজ কেটে গেছে বেশ কিছুদিন হতে চললো, বদলাবো বদলাবো করেও বদলানোনা হচ্ছে না।
বাসায় পা দেয়া মাত্র বুঝতে পারলাম যে ক্যাথি বাইরে। বড় বেশি চুপচাপ ভেতরটা; ক্যাথি থাকলে এরকমটা হবার কথা নয়। ও শোরগোল পছন্দ করে এমনটা বলা উচিৎ হবে না, কিন্তু ওর জগতটা আর যা-ই হোক, নিশ্চুপ নয়। হয় ফোনে কথা বলবে, নয়তো সাউন্ড জোরে দিয়ে টিভি দেখবে-কিছু না কিছু একটা তো করবেই। আজ ফ্ল্যাটের ভেতরটা কবরস্থানের মতন নীরব। তবুও অভ্যাসবশত ওর নাম ধরে ডাকলাম কয়েকবার। জানতাম যে কোন জবাব পাবো না, তবুও বোধহয় নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলাম যে বাসায় আসলেও সম্পূর্ণ একা আমি।
“ক্যাথি?”
জবাব নেই।
অন্ধকারেই কোনরকমে লিভিং রুম অবধি চলে এলাম। বাতি জ্বালতেই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো চারপাশ। নতুন আসবাবপত্র সবসময়ই চমকে দেয় আমাকে। অভ্যস্ত হবার আগ অবধি মনে হয় অন্য কারো বাসায় এসে পড়েছি বুঝি। চারপাশে নতুন চেয়ার, নতুন কুশন আর রঙের সমারোহ। কে বলবে যে আগে এখানটায় কোন রঙই ছিল না? টেবিলের ওপর একটা ফুলদানিতে ক্যাথির পছন্দের গোলাপি লিলি সাজিয়ে রাখা। ওগুলোর কড়া মিষ্টি গন্ধে থকথক করছে চারপাশ।
কটা বাজে? সাড়ে আটটা। এতক্ষণে তো ওর বাসায় থাকার কথা। রিহার্সাল আছে নাকি? ওদের নাটকের দলটা ওথেলো’ করছে এখন, কিন্তু দর্শকদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পায়নি। অতিরিক্ত পরিশ্রমের খেসারত দিতে হচ্ছে সবাইকে। বাসায় আসার পর ভীষণ ক্লান্ত থাকে ক্যাথি। চেহারায় শুকিয়ে গেছে। মরার ওপর খড়ার ঘায়ের মত ঠাণ্ডা লেগেই থাকে বেচারির। “সবসময় অসুস্থ,” প্রায়ই বলে ও। “শরীর আর চলছে না।”
কথাটা সত্য; রিহার্সাল থাকলে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যায়। চেহারা দেখেই বোঝা যায় যে কতটা পরিশ্রম গেছে সারাদিনে। হাই তুলতে তুলতে বিছানায় উঠে পড়ে। অন্তত আরো দুঘন্টার আগে ফিরবে না নিশ্চিত। তাহলে ঝুঁকিটা নেয়াই যায়।
গাঁজার বয়ামটা বের করে একটা জয়েন্ট বানানো শুরু করে দেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই এই বদভ্যাসের শুরু আমার। প্রথম সেমিস্টারে একটা পার্টিতে গিয়ে যখন কারো সাথে কথা বলার সাহস করে উঠতে পারছিলাম না, তখন নিজেকে সপে দিয়েছিলাম গাঁজার ধোয়ার মধ্যে। আমি বাদে সেখানে উপস্থিত অন্য সবাইকে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী আর সুদর্শন বলে মনে হচ্ছিল। আর আমি হলাম সেই কুৎসিত হাঁসের ছানা। পার্টি থেকে পালাবো এমন সময় পাশের মেয়েটা একটা জিনিস হাতে ধরিয়ে দেয় আমার। প্রথমে ভেবেছিলাম সিগারেট, কিন্তু কড়া গন্ধটায় ভুল ভেঙে যায়। জয়েন্টটা যে ফিরিয়ে দেব, সেই সাহসও ছিল না। অগত্যা ঠোঁটে নিয়ে টান দেই। ভালো করে রোল করা হয়নি জয়েন্টটা, খুলে খুলে যাচ্ছিল। তা সত্ত্বেও প্রভাবটা ঠিকই বুঝতে পারি। সিগারেটের ধোঁয়া থেকে একদম আলাদা, মাথায় গিয়ে লাগে। তবে হ্যাঁ, লোকে যেরকম বাড়িয়ে বলে সেরকম কিছু মনে হয়নি। অনেকটা সেক্সের মতন ব্যাপারটা, নিজের অভিজ্ঞতা না হবার আগ অবধি মনে হবে না জানি কত্ত দারুণ অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
তবে কিছুক্ষণ যেতেই আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। কী যেন একটা হয়ে গেল। কোত্থেকে এক রাশ প্রশান্তি এসে ভর করলো আমার চিত্তে। নিজেকে খুবই সুখি মনে হচ্ছিল সেসময়। যাবতীয় দুশ্চিন্তা ভেসে গেল বানের জলে।
সেই থেকেই শুরু। কয়েকদিনের মধ্যে পাক্কা গাঁজাখোর হয়ে গেলাম। আমার নিত্যদিনের সঙ্গি। জয়েন্ট রোল করার সময় মনে হতো দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো কাজটার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কাগজ ভাঁজ করার শব্দ কানে আসতেই নেশা ধরে যেত যেন।
নেশার উৎপত্তি কিভাবে সেটা নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর। ব্যাপারটা বংশগত হতে পারে; বিশেষ রাসায়নিকের প্রতি তীব্র আকর্ষণ থেকেও হতে পারে; আবার মানসিকও হতে পারে। কিন্তু গাঁজা যে শুধু আমার মাথা ঠাণ্ডা রাখতে সাহায্য করছিল এমনটা নয়। বরং বলা যায় আমার আবেগগুলো সামলানোর ধরণই পাল্টে দিয়েছিল। মায়েরা যেভাবে বাচ্চাদের আগলে রাখে, ঠিক তেমনি আমাকে আগলে রেখেছিল গাঁজা। জানি, কতটা অদ্ভুত শোনাচ্ছে কথাটা।
সোজা কথায়, আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল গাঁজার নেশা।
বিখ্যাত সাইকোঅ্যানালিস্ট ডঃ বিয়ন শিশুদের দৈনন্দিন জীবনের বিপদ থেকে রক্ষা করার মায়েদের যে তাগিদ, সেটাকে আখ্যায়িত করেছেন ‘সংযমন হিসেবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে এক্ষেত্রে, শৈশবকাল কিন্তু নিছক আনন্দের খোরাক নয়। বরং এর প্রতি পদে পদে আছে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা। একটা বাচ্চা শুরুতে নিজে থেকে কিছুই করতে পারে না। ক্ষুধা লাগলেও ভয় পায় আবার বাথরুম পেলেও ভয় পায়। সেজন্যেই আমাদের প্রত্যেকের প্রয়োজন আমাদের মায়ের। কারণ মায়েরা যখন এসব চাহিদা পূরণ করে, তখন থেকেই নিজেদের খুঁজে পেতে শুরু করি আমরা। এক পর্যায়ে গিয়ে নিজেদের সাহায্য নিজেরাই করতে পারি। কিন্তু আমাদের পারিপার্শ্বিকতার সাথে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতাটা নির্ভর করে মায়েদের ‘সংযমন ক্ষমতা কতটা নির্ভরযোগ্য সেটার ওপরে। ডঃ বিয়নের মতে কেউ যদি শৈশবে এই অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে বাকিটা জীবন একধরণের অজানা আশঙ্কা নিয়ে কাটাতে হবে তাকে। আর চিত্তের সেই অস্থিরতা কমানোর জন্যেই মাদক বা নেশাজাতীয় বস্তুর শরণাপন্ন হয় মানুষ। অনেককেই বলতে শুনবেন যে নার্ভ ঠিক রাখার জন্যে ড্রিঙ্ক করে তারা। আমার গাঁজার প্রতি আসক্তির কারণও এটাই।
থেরাপি চলাকালীন সময়ে রুথের সাথে গাঁজার ব্যাপারটা নিয়ে অনেক কথা বলেছি। বারবার ছেড়ে দেয়ার কথা ভেবেছি, কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারিনি। রুথ তখন বলে, জোর করে কোন কিছু করার ফল কখনোই ভালো হয় না। এর চেয়ে বরং জোর করে গাঁজার নেশা ছাড়ার চেষ্টা করার চাইতে আমার এটা মেনে নেয়া উচিৎ যে স্বাভাবিকভাবে বাঁচার জন্যে নেশাটার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি আমি। আমার জীবনে গাঁজার প্রভাবটা তখন অবধি ইতিবাচকই ছিল। এমন একটা সময় আসবে যখন আর স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্যে গাঁজার কোন প্রয়োজন হবে না। তখন নেশাটা খুব সহজেই পরিত্যাগ করতে পারবো।
ঠিকই বলেছিল রুথ। ক্যাথির প্রেমে পড়ার পর গাঁজার নেশা কেটে যায়। তখন বরং ওর প্রেমে নেশাতুর থাকতাম সারাটা সময়, তাই মন ভালো করার জন্যে বাড়তি কোন কিছুরই দরকার ছিল না। তাছাড়া ক্যাথির ধূমপানের অভ্যাস না থাকায় ব্যাপারটা আরো সহজ হয় আমার জন্যে। ক্যাথির মতে গাঁজাখোরদের ইচ্ছেশক্তি বলতে কিছু নেই আর তাদের পরোটা জীবন একটা ঘোরের মধ্যেই কাটে। যদি ছয়দিন আগে তাদের শরীরের কোথাও কেটে যায়, তাহলে ছয়দিন পরে গিয়ে সেটা বুঝতে পারবে। ক্যাথি আমার অ্যাপার্টমেন্টে ওঠার দিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গাঁজা ফোকা ছেড়ে দেই আমি।
ক্যাথির বান্ধবী নিকোলের পার্টিটায় না গেলে আমি হয়তো জীবনে আর কখনো ঠোঁটে গাঁজা ছোঁয়াতাম না। নিউ ইয়র্কে চলে যাবার আগে বড় একটা পার্টি দেয় সে। কিন্তু ওখানে ক্যাথি বাদে আমার পরিচিত আর কেউ না থাকায় কিছুক্ষণ বাদেই একা হয়ে পড়ি। এসময় গোলাপী চশমার এক গাট্টাগোট্টা লোক আমার দিকে জয়েন্ট বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে চলবে নাকি? না করে দিতে গিয়েও কেন যেন থেমে যাই। কারণটা ঠিক বলতে পারবো না। হয়তো ক্যাথি জোর করে ওরকম একটা পার্টিতে নিয়ে যাওয়ায় অবচেতন মনে অসন্তুষ্টি কাজ করছিল। চারপাশে তাকিয়ে যখন ওকে দেখলাম না, মাথায় জেদ চেপে গেল। জয়েন্টটা ঠোঁটে নিয়ে লম্বা একটা টান দিলাম।
আর ঠিক এভাবেই আবারো পুরনো নেশাটা পেয়ে বসলো আমাকে। মাঝখানে যে লম্বা একটা সময় গাঁজা ছাড়া ছিলাম, এমনটা মনেই হচ্ছিল না। যেন বিশ্বস্ত কুকুরের মত নেশাটা অপেক্ষা করছিল আমার জন্যে। ক্যাথিকে অবশ্য কিছু বলিনি এ ব্যাপারে। বরং তক্কে তক্কে ছিলাম। ছয় সপ্তাহ পর নিজ থেকেই হাজির হলো সুযোগ। নিকোলের সাথে দেখা করতে এক সপ্তাহের জন্যে নিউ ইয়র্কে গিয়েছিল ক্যাথি। তার অনুপস্থিতিতে একাকীত্ব আর একঘেয়ে সময় কাটানোর জন্যে গাঁজার শরণাপন্ন হই আবারো। পরিচিত কোন ডিলার নেই আমার। তাই ছাত্র বয়সে যা করতাম, সেই পথেই হাঁটলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে রওনা হয়ে গেলাম ক্যামডেন টাউন মার্কেটের উদ্দেশ্যে।
স্টেশন থেকে বাইরে পা দিতেই গাঁজার ঘ্রাণ এসে লাগলো নাকে। সেই সাথে ধপ আর নানারকম খাবারের গন্ধ। ক্যামডেন লকের পাশে অবস্থিত ব্রিজটায় পৌঁছে যাই খানিক বাদেই। পর্যটকদের ভিড়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ। চারপাশে বেশিরভাগই কিশোর-কিশোরী।
ইতিউতি তাকিয়ে কোন ডিলারের দেখা পেলাম না। আগে ব্রিজ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পাশ থেকে ডাকাডাকি করতে ডিলারের দল। এসময় লক্ষ্য করলাম জনতার ভিড়ে দু’জন পুলিশ অফিসার হেঁটে বেড়াচ্ছে। তারা স্টেশনের দিকে চলে যেতেই ভোজবাজির মত আমার পাশে উদয় হলো একজন।
“লাগবে নাকি, বস?”
ভালোমতো তাকানোর পর খেয়াল করলাম খাটো করে একটা লোক তাকিয়ে আছে আমার দিকে। দূর থেকে দেখলে অবশ্য শারীরিক গঠনের কারণে কিশোর মনে হবে। সামনের দুটো দাঁত না থাকায় কথা বলার সময় মখ থেকে বাতাস বেরিয়ে শিষের মতন শব্দ হয়।
“একদম টাটকা জিনিস। লাগবে?”
মাথা নেড়ে সায় জানালাম।
মাথা নাড়িয়ে তাকে অনুসরণের ইশারা করে উল্টোদিকে ঘুরে হাঁটা দিল। গলি-ঘুপচি পেরিয়ে একটা পাবে উপস্থিত হলাম কিছুক্ষণ পর। ভেতরটা মোটামুটি খালি হলেও পরিবেশ একদম নোংরা। বমি আর সিগারেটের গন্ধে টেকা দায়।
“বিয়ার, বার কাউন্টারের কাছে গিয়ে বলে সে। উচ্চতা আরেকটু কম হলেই কাউন্টারের ওপরের জিনিস দেখতে পেত না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে আধগ্লাস বিয়ার কিনে দেই। গ্লাস নিয়ে একদম পেছনের টেবিলে গিয়ে বসে পড়ে…আমি বসি তার উল্টোদিকে। এরপর টেবিলের নিচ দিয়ে হাত বাড়িয়ে সেলোফেনে মোড়া একটা ছোট প্যাকেট আমার দিকে এগিয়ে দেয় সে। দাম চুকিয়ে উঠে পড়ি।
বাসায় এসে দ্রুত প্যাকেটটা খুলে ফেলি, মনে মনে আশঙ্কা করছিলাম হয়তো আমাকে ঠকিয়ে দিয়েছে লোকটা। কিন্তু পরিচিত গন্ধটা নাকে আসতেই বুঝলাম যে ভেতরে ঠিক জিনিসটাই আছে। মনে হচ্ছিল যেন হারানো কোন বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি।
তখন থেকে ফ্ল্যাটে একা সময় কাটানোর সুযোগ পেলেই আপনা আপনি গাঁজা বের করে ফেলি।
সেই রাতে যখন ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে দেখলাম ক্যাথি নেই, একটা জয়েন্ট তৈরি করে ফেললাম। বাথরুমের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শেষ করি জয়েন্টটা। কিন্তু খুব অল্প সময়ে বেশি গাঁজা টানার ফলটাও পেলাম হাতেনাতে। মাথাটা একদম হালকা হয়ে গেল। নেশা ধরেছে খুব ভালোভাবেই। এমনকি হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছিল। তবুও ধীরে ধীরে গন্ধ দূর করার জন্যে এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করলাম চারপাশে, দাঁত মাজলাম। সব শেষে গোসল করে লিভিং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিলাম।
টিভি রিমোটটা খুঁজে পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক তাকানোর পর খেয়াল করলাম কফি টেবিলে ক্যাথির ভোলা ল্যাপটপের পেছনে রাখা ওটা। কাঁপাকাঁপা হাতে রিমোট নিতে গিয়ে নড়ে গেল ল্যাপটপটা। সাথে সাথে জ্বলে উঠলো স্ক্রিন। ইমেইল অ্যাকাউন্ট থেকে লগ-আউট করেনি ক্যাথি। কোন এক অদ্ভুত কারণে নজর সরাতে পারছিলাম না স্ক্রিন থেকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লেখাগুলো পড়তে শুরু করলাম; মনে হলো কেউ ভারি কোন কিছু দিয়ে সজোরে বাড়ি বসিয়েছে আমার মুখ বরাবর। ইমেইলের হেডিং আর সাবজেক্টে ‘সেক্সি’, ‘সেক্স’-কথাগুলো বড় অচেনা ঠেকছিল। BADBOY22 নামের এক ইউজার পাঠিয়েছে ইমেইলগুলো।
ওখানেই থেমে যাওয়া উচিৎ ছিল আমার। কিন্তু থামিনি।
সর্বষেষ যে ইমেইলটা এসেছে সেটায় ক্লিক করলাম।
Subject: RE: লিটল মিস সেক্সি
From: Katerama_1
To: BADBOY22
আমি বাসে। তোমার জিনিসটাকে আদর করতে ইচ্ছে করছে এখনই। ওটার স্পর্শ না পাওয়া পর্যন্ত ভালো লাগবে না। নিজেকে একটা বেশ্যা মনে হচ্ছে!
Sent from my iPhone
Subject: RE: re: লিটল মিস সেক্সি
From: BADBOY22
To: Katerama 1
তুমি তো বেশ্যাই! আমার বেশ্যা। তোমার রিহার্সেলের পর দেখা করি?
Subject: RE: re: re: re: লিটল মিস সেক্সি
From: Katerama 1
To: BADBOY22
ঠিক আছে।
Sent from my iPhone
Subject: RE: re: লিটল মিস সেক্সি
From: BADBOY22
To: Katerama 1
দেখা যাক কখন বের হতে পারি। জানাবো।
Subject: RE: re: re: re: re: লিটল মিস সেক্সি
From: Katerama 1
To: BADBOY22
ঠিক আছে। ৮.৩০? ৯.০০?
Sent from my iPhone
ল্যাপটপটা সাথে করে সোফায় নিয়ে এলাম। কোলের ওপর রেখে কতক্ষণ ওটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম বলতে পারবো না। দশ মিনিট? বিশ মিনিট? আধা ঘন্টা? হয়তো এর চেয়েও বেশি। সময় যেন বড় ধীর হয়ে গেছে।
এতক্ষণ যা দেখলাম সেটা বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু মাথা ঠিকঠাক কাজ করছে না। ভুল দেখিনি তো? নাকি গাঁজার প্রভাবে স্বাভাবিক কথোপকথনের উল্টোপাল্টা মানে বের করছি।
জোর করে আরেকটা ইমেইল পড়লাম। এরপর আরেকটা।
একসময় ক্যাথির BADBOY22-কে পাঠানো সবগুলো ইমেইলই পড়ে ফেললাম। অনেকগুলোয় যৌনতার ইঙ্গিত, অশ্লীল কথাবার্তায় ভরপুর। আর বাকিগুলোয় প্রাণ খুলে কথা বলেছে ক্যাথি, কোন রাখঢাক করেনি। কথাগুলো পড়ে মনে হচ্ছে যেন মাতাল অবস্থায় লেখা, হয়তো আমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পর। নিজের ঘুমন্ত অবস্থার ছবি ভেসে উঠলো মনের পর্দায়। আর পাশেই ক্যাথি বসে অন্য একটা লোককে এই অন্তরঙ্গ মেসেজগুলো পাঠাচ্ছে। যার সাথে শারীরিক সম্পর্কও আছে ওর।
হুট করে মাথাটা পরিস্কার হয়ে গেল। নেশা কেটে গেছে পুরোপুরি।
পেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করতেই ল্যাপটপটা পাশে সরিয়ে রেখে বাথরুমে দৌড় দেই। কমোডের সামনে ঠিকমত হাঁটু গেড়ে বসার আগে বমি করে ফেললাম।
.
২.৭
“গতবারের চেয়ে একটু অন্যরকম লাগছে,” বললাম।
কোন সাড়া পেলাম না।
আমার উল্টোদিকে একটা চেয়ারে বসে আছে অ্যালিসিয়া, নজর জানালার দিকে। পিঠ শক্ত করে একদম সোজা হয়ে বসেছে আজ। অনেকটা চেলো বাদকদের মত লাগছে দেখতে। কিংবা সদা সতর্ক কোন সেনা।
“গত সেশনটা কিভাবে শেষ হয়েছিল, সেটাই ভাবছিলাম। আমাকে ওভাবে আঘাত করেছিলেন দেখেই বাধ্য হয়ে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়াতে হয়েছিল আপনাকে।”
এবারেও কোন জবাব পেলাম না। একটু ইতস্তত বোধ করছি এখন।
“ব্যাপারটা কি আমার জন্যে কোন পরীক্ষা ছিল? আমি কেমন ধাতুতে গড়া সেটাই দেখতে চাইছিলেন? খুব সহজে হাল ছাড়বার পাত্র নই, এটা জেনে রাখুন। সব রকম পরিস্থিতি সামলে নেয়ার ক্ষমতা আছে।”
এখনও জানালার বাইরের ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অ্যালিসিয়া। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম আমি।
“আপনাকে একটা কথা বলতে চাই অ্যালিসিয়া। আমি কিন্তু আপনার পক্ষে। আশা করি একদিন এটা বিশ্বাস করবেন। ভরসা তৈরি হতে সময় লাগে, জানি। আমার পুরনো থেরাপিস্ট প্রায়ই বলতেন যে ঘনিষ্ঠতার জন্যে নিয়মিত মনের ভাব আদান প্রদানের প্রয়োজন। আর সেটা রাতারাতি হয় না।”
শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো অ্যালিসিয়া। সময় কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এখন মনে হচ্ছে এটা থেরাপি সেশন তো নয়, ধৈৰ্য্য পরীক্ষা।
এখন পর্যন্ত কোন দিক দিয়েই অগ্রগতি হয়নি। বোধহয় সময় নষ্ট করছি। ডুবন্ত জাহাজ থেকে ইঁদুরদের লাফিয়ে পড়ার ব্যাপারে ভুল বলেনি ক্রিস্টিয়ান। এরকম একটা জায়গায় যোগ দিয়ে মাস্তুল ধরে কোনমতে ভেসে থাকার মানে হয় না। কি আছে এখানে?
উত্তরটা আমার সামনেই। যেমনটা ডায়োমেডেস সতর্ক করেছিলেন, মৎসকুমারীর বেশে অ্যালিসিয়া আমাকে আমার সর্বনাশের দিকে ডেকে এনেছে।
মনে মনে হঠাই ভীষণ মরিয়া হয়ে উঠলাম। ইচ্ছে করছে চিৎকার করি, কিছু একটা বলুন। যা খুশি। একবারের জন্যে মুখ খুলুন।
কিন্তু সেরকম কিছু করলাম না। বরং থেরাপির স্বতঃসিদ্ধ পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। ধীরে সুস্থে না এগিয়ে সরাসরি কাজের কথা তুলোমঃ
“আপনার নীরবতা নিয়ে কথা বলতে চাই। এই নীরবতার পেছনের অর্থটা বুঝতে চাই…আশা করি বোঝাতে পারছি আপনাকে। কথা বলা কেন বন্ধ করলেন সেটা জানাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি।”
আমার দিকে তাকালোও না অ্যালিসিয়া। কথা কানে যাচ্ছে তো?
“জানেন, আমার মাথায় একটা ছবি ভাসছে এখন। মনে হচ্ছে কেউ যেন জোর করে নিজেকে দমিয়ে রেখেছে, ফেটে পড়বে যে কোন মুহূর্তে, অনবরত ঠোঁট কামড়াচ্ছে, দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ। প্রথম যখন থেরাপি শুরু করেছিলাম, কাঁদতে পারতাম না কোনভাবেই। মনে হতো সেই অশ্রুপ্রবাহে আমি নিজেই হারিয়ে যাবো। আপনারও বোধহয় সেরকমই অনুভূত হচ্ছে। এটা জেনে রাখুন যে এই যাত্রায় আপনার সঙ্গি আমি। আমাকে ভরসা করতে পারেন।”
মৌনতা।
“আমি নিজেকে একজন রিলেশনাল থেরাপিস্ট ভাবতে পছন্দ করি। এর অর্থ কি জানেন?”
মৌনতা।
“এর অর্থ আমার ধারণা ফ্রয়েড কিছু ব্যাপারে ভুল বলেছিলেন। একজন থেরাপিস্টকে কোনভাবেই সাদা কাগজের সাথে তুলনা করা যাবে না। সচেতন বা অবচেতন মনে নিজেদের সম্পর্কে অনেক কিছুই আমরা প্রকাশ করে ফেলি। মানে কেউ কেমন মোজা পরেছে, কিভাবে কথা বলছে, কিভাবে বসেছে-এগুলো দেখেও তো অনেক কিছু বোঝা যায়। হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও কিন্তু নিজেকে পুরোপুরি লুকোতে পারবো না আমি।”
মুখ তুলল অ্যালিসিয়া। ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে এখন-আমাকে চ্যালেঞ্জ করছে? অন্তত তার মনোযোগ আকর্ষণে তো সক্ষম হয়েছি। নড়েচড়ে বসলাম চেয়ারে।
“মূলত যেটা বলতে চাচ্ছি, এ ব্যাপারে আমরা কি করতে পারি? চাইলে সত্যটাকে উপেক্ষা করতে পারি। ধরে নিতে পারি যে এই থেরাপিটার মধ্যমণি কেবলই আপনি। অথবা এটা মেনে নিতে পারি যে গোটা ব্যাপারটাই দ্বিপাক্ষিক। এভাবে সামনে এগোনোই বোধহয় সুবিধের হবে।”
আমার বাম হাতটা সামনে মেলে ধরে আঙটি পরা আঙুলটা নাচালাম।
“এই আঙটিটা দেখে কি মনে হচ্ছে আপনার?”
ধীরে ধীরে আঙটিটার দিকে তাকালো অ্যালিসিয়া।
“নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমি বিবাহিত। আমার একজন স্ত্রী আছে যার সাথে নয় বছর ধরে সংসার করছি।”
কোন জবাব পেলাম না এবারেও, তবে আঙটিটার দিক থেকে দৃষ্টি সরায়নি অ্যালিসিয়া।
“আপনার বিবাহিত জীবন তত সাত বছরের ছিল, তাই না?”
জবাব নেই।
“আমার স্ত্রীকে প্রচণ্ড ভালোবাসি আমি। আপনি কি স্বামীকে ভালোবাসতেন?”
নড়ে উঠলো অ্যালিসিয়ার চোখজোড়া। আমার মুখের ওপর এসে স্থির হলো দৃষ্টি। একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকি লম্বা একটা সময়।
“ভালোবাসা কিন্তু নানারকম অনুভূতির মিশেল, তাই না? ভালো খারাপ দুটোই। আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি, ওর নাম ক্যাথি। মাঝে মাঝে কিন্তু ভীষণ রাগও হয়…সেই সময়গুলোয় ওকে ঘৃণা করি।
এখনও অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে অ্যালিসিয়া; নিজেকে রাস্তা পার হবার সময় হেডলাইটের সামনে জমে যাওয়া ছোট্ট খরগোশের মতন মনে হচ্ছে আমার। পার্সোনাল অ্যাটাক অ্যালার্মটা আজকে হাতের কাছেই রেখেছি। ওটার দিকে না তাকাতে বেশ কসরত করতে হলো।
জানি যে এভাবে কথা চালিয়ে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু নিজেকে থামাতে পারলাম না। গোঁয়ারের মতন বলতেই থাকলাম:
“এই ঘৃণার অর্থ কিন্তু এটা নয় যে পুরোপুরি মন থেকে অপছন্দ করি ওকে। বরং বলা যায় আমার মনের একটা ক্ষুদ্র অংশ এরকম অনুভূতির জন্যে দায়ি। সেসময়টা ভালোবাসা আর ঘৃণা সহাবস্থান করে। গ্যাব্রিয়েলের ক্ষেত্রেও বোধহয় ওরকম কিছুই হয়েছিল। আপনার একটা অংশ তাকে ভালোবাসতো, আবার একটা অংশ তাকে ঘৃণাও করতো।
মাথা ঝাঁকায় অ্যালিসিয়া। যেন অমত প্রকাশ করছে আমার কথার সাথে। ভালো করে খেয়াল না করলে ধরতেই পারতাম না। অবশেষে! অবশেষে একটু হলেও প্রতিক্রিয়া দেখালো অ্যালিসিয়া। উত্তেজিত হয়ে উঠলাম ভেতরে ভেতরে। জানি যে থেমে যাওয়া উচিৎ, কিন্তু থামলাম না।
“আপনার একটা অংশ তাকে ঘৃণা করতো,” আগের তুলনায় দৃঢ়কণ্ঠে বললাম।
আবারো মাথা কঁকালো অ্যালিসিয়া। চোখে আগুন জ্বলছে রীতিমতো। রেগে উঠছে, ভাবলাম।
“এটাই সত্য, অ্যালিসিয়া। নাহলে তাকে খুন করতেন না আপনি।”
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো অ্যালিসিয়া। ভাবলাম এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়বে আবারো। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে দরজার দিকে হনহন করে হেঁটে গেল সে। হাত মুঠো করে সজোরে কিল দিল কয়েকবার।
নবে চাবি ঘোরানোর শব্দ কানে এলো সাথে সাথে-বাইরেই অপেক্ষা করছিল ইউরি। অ্যালিসিয়া যে আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েনি এটা দেখে স্বস্তি ফুটলো তার চেহারায়। তাকে পাশ কাটিয়ে করিডোরে বেরিয়ে যায় অ্যালিসিয়া।
“আস্তে যাও, আস্তে আমার দিকে তাকালো নজর ফেরায় ইউরি। “সব ঠিক আছে তো? কি হয়েছে?”
কিছু বললাম না জবাবে। উদ্ভট দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে যায় সে। এখন ঘরে একা আমি।
গর্দভ, মনে মনে বলে উঠলাম। আস্ত গর্দভ। এটা কি করলাম আমি? তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বেশি বেশি বলে ফেলেছি। পেশাদার কোন সাইকোথেরাপিস্টের এরকম ভুল করা সাজে না। অ্যালিসিয়ার মানসিক অবস্থা জানতে গিয়ে নিজেকে উন্মোচিত করে দিয়েছি পুরোপুরি।
কিন্তু অ্যালিসিয়ার ব্যাপারটাই এমন। তার মৌনতা অনেকটা আয়নার মতন-যে আয়নায় নিজের ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।
আর দশ্যটা সবসময় সুখকর হয় না।
.
২.৮
ক্যাথির ল্যাপটপটা এভাবে খুলে রেখে যাওয়ার পেছনে যে কোন কারণ আছে সেটা বোঝার জন্যে আপনাকে সাইকোথেরাপিস্ট হতে হবে না। হয়তো অবচেতন মনে হলেও সে চাইছিল যাতে আমি তার পরকীয়ার বিষয়টা জানতে পারি।
পদ্ধতিটা কাজে দিয়েছে। জেনে গেছি আমি।
সেই রাতের পর থেকে এখন অবধি ওর সাথে কথা হয়নি আমার। ও বাসায় আসার পর ঘুমের অভিনয় করেছি, এরপর সকাল সকাল ও ওঠার আগেই বেরিয়ে গেছি। ওকে এড়িয়ে চলছি-নিজেকে এড়িয়ে চলছি। পুরো ব্যাপারটা মেনে নিতে এখনও কষ্ট হচ্ছে। তা সত্ত্বেও সত্যটার মুখোমুখি হতে হবে, নতুবা নিজেকে হারিয়ে ফেলবো আবারো। শক্ত হও, একটা জয়েন্ট রোল করতে করতে নিজেকে বিড়বিড় করে বললাম। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে জয়েন্টটা শেষ করে চলে এলাম রান্নাঘরে। কেবিনেট থেকে ওয়াইনের বোতল বের করে একটা গ্লাসে ঢেলে নিলাম। মাথায় নেশা ধরে গেল এতক্ষণে।
চেষ্টা করেও গ্লাসটা তুলতে পারলাম না। বরং হাত থেকে ছুটে কাউন্টারের ওপর পড়ায় ভেঙেই গেল। কাঁচের টুকরো লেগে একটা আঙুল কেটে গেছে।
হঠাই আবিষ্কার করলাম, রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। কাঁচের টুকরোয় রক্ত, আমার হাতে রক্ত, সাদা টেবিলের ওপর রক্ত। একটা কিচেন ন্যাপকিন ছিঁড়ে নিয়ে কাটা আঙুলে গিঁট দিয়ে বেঁধে রক্তের ধারা সামাল দেয়ার চেষ্টা করলাম। হাতটা ওপরে তুলে রেখেছি। আঙুল থেকে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে চামড়ার ভেতরের শিরাগুলো কেউ উল্টে দিয়েছে।
ক্যাথির ব্যাপারে ভাবছি।
এরকম একটা মুহূর্তে সবার আগে ক্যাথির কথাই মনে আসে আমার। যখনই কোন বিপদে পড়ি বা সান্ত্বনার প্রয়োজন হয়, ওর কাছে সপে দেই নিজেকে। গালে একবার চুমু খেয়েই আমার ভেতরের সব দুশ্চিন্তা দূর করে দিতে পারে ক্যাথি। আমি চাই, সবসময় আমার খেয়াল রাখুক ও। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে রাতারাতি আমাদের মাঝে একটা দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে। ওকে হারিয়ে ফেলেছি আমি। অদ্ভুত বিষয়, সত্যটা জানার পর এখন অবধি চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়ায়নি আমার, আপ্রাণ চেষ্টা করেও কাঁদতে পারছিলাম না। ভেতরটা যেন কেউ কাঁদা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে।
“কেন, বারবার বলতে থাকি আমি, “কেন।”
ঘড়ির কাটার শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। স্বাভাবিকের চাইতে জোরে মনে হচ্ছে আওয়াজটা। সেই আওয়াজের ওপর মনোযোগ দিয়ে বিক্ষিপ্ত মনটাকে স্বাভাবিক করতে চাইলাম; কিন্তু আমার মাথার ভেতরে একসাথে কয়েকটা কণ্ঠ তারস্বরে চিৎকার করেই চলেছে। এরকমটাই তো হবার কথা ছিল, ভাবলাম। তার জন্যে যে আমিই যথেষ্ট, এটা ধরে নেয়াই তো মারাত্মক ভুল। আমি একটা আস্ত অপদার্থ। বামন হয়ে চাঁদের পানে হাত বাড়ালেই কি চাঁদটাকে পাওয়া যায়? আমার প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই ইতিমধ্যেই ফুরিয়ে গেছে ওর কাছে। আসলে ওকে নিজের করে পাবার যোগ্যতা আমার কখনোই ছিল না। মাথার ভেতরে এই চিন্তাগুলোই ঘুরপাক খেতে লাগলো বারবার।
ওকে চিনতে ভুল করেছিলাম। ইমেইলগুলো পড়ার পর থেকে মনে হচ্ছে এতদিন সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ব্যক্তির সাথে সংসার করেছি আমি। এখন সত্যটা বুঝতে পারছি। ক্যাথি আমাকে আমার দুর্দশা থেকে উদ্ধার করেনি-আসলে কাউকে উদ্ধার করার ক্ষমতাই নেই ওর। কোন দেবী নয়। সে, বরং খারাপ চরিত্রের ব্যাভিচারী একটা মেয়ে। ওকে আর আমাকে নিয়ে সুখি জীবনের আকাশ কুসুম যেসব কল্পনা করে এসেছি এতদিন, তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়লো সব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের সেই দিনগুলোয় যেন ফিরে গেলাম আবারো। প্রতিনিয়ত নিজেকে শেষ করে দেয়ার কথা মনে হতো যখন। সেই ভোতা অনুভূতিটা ফিরে এসেছে। মার কথা মনে হলো এসময়। তাকে ফোন দিব? আমার এরকম একটা পরিস্থিতিতে তার কাছে আশ্রয় চাইবো? কল্পনা করলাম যে ফোনের ওপাশ থেকে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আমার সাথে কথা বলছে সে। গলার স্বর কতটা কাঁপবে, সেটা নির্ভর করে বাবার মেজাজ আর সে কতটা মাতাল, এই দুটো বিষয়ের ওপর। হয়তো সহানুভূতি নিয়েই আমার কথা শুনবে সে, কিন্তু তার মন পড়ে থাকবে অন্যখানে। বাবা আর তার বদমেজাজ নিয়েই ভাববে সারাক্ষণ। এরকম একটা মানুষ কিভাবে আমার সাহায্য করবে? একজন ডুবন্ত ব্যক্তি তো আরেকজনকে বাঁচাতে পারে না।
বাসা থেকে বের হতে হবে। ভেতরে রীতিমতো দম আটকে আসছে এখন। তার ওপর লিলিগুলোর উটকো গন্ধ। খোলা বাতাসে শ্বাস নেয়া প্রয়োজন।
বেরিয়ে এলাম ফ্ল্যাট থেকে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকি। কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই, ইতস্তত হেঁটে বেড়াচ্ছি এদিক সেদিক। মনে মনে ক্যাথি আর আমার সম্পর্কের কথা ভাবছি। বোঝার চেষ্টা করছি কবে থেকে এসবের শুরু। বেশ কিছুদিন ধরেই ঘনঘন কথা কাটাকাটি হতো আমাদের, প্রায়ই দেরি করে বাসায় ফিরতো ও। কিন্তু আমার প্রতি তার আবেগে তো কখনো ঘাটতি ছিল বলে মনে হয়নি। এটা কি করে সম্ভব? পুরোটা সময়ই অভিনয় করেছে ও? আমাকে কি আদৌ কখনো ভালোবেসেছিল?
ওর বন্ধুদের সাথে প্রথম দেখা হবার দিনে ক্ষণিকের জন্যে হলেও সন্দেহ ভর করেছিল আমার মনে। ওরা সবাই অভিনেতা-অভিনেত্রী। নিজেদের ছাড়া কিছু বোঝে না, অন্যদের সমালোচনা করতেই থাকা ক্রমাগত। হঠাই স্কুলের দিনগুলোয় ফিরে গেলাম, দূর থেকে অন্য বাচ্চাদের খেলা করতে দেখতাম তখন। আমাকে কেউ খেলায় নিত না। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে ক্যাথি ওদের মতো নয়, কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম। যে রাতে বারে ওর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল, তখন যদি ওর বন্ধুরা উপস্থিত থাকতো, তাহলে কি আমাদের সম্পর্কটা হতো না? অবশ্যই হতো। ক্যাথির ওপর প্রথমবার চোখ পড়ার পর থেকেই বুঝে গিয়েছিলাম যে আমার ভাগ্যটা ওর সাথেই বাঁধা।
কী করা উচিৎ এখন আমার?
অবশ্যই ক্যাথিকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা উচিৎ এ ব্যাপারে। যা দেখেছি, সেগুলো খুলে বলা উচিৎ। প্রথমে হয়তো অস্বীকার করবে, কিন্তু প্রমাণের কথা বললে সত্যটা স্বীকার না করে পারবে না। অনুশোচনার বশবর্তী হয়ে তখন আমার কাছে ক্ষমা চাইবে সে, তাই না?
আর যদি না চায়? যদি উল্টো আমাকেই কথা শোনায়? পুরো বিষয়টা হেসে উড়িয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে কি করবো?
দুজনের কথা চিন্তা করলে, হারানোর ঝুঁকিটা আমারই বেশি। ক্যাথির মানিয়ে নিতে সমস্যা হবে না, সবসময়ই বলে এসেছে যে ওর নার্ভ খুব শক্ত। নিজেকে ধাতস্থ করে আমাকে ভুলে যাবে একসময়। কিন্তু আমি তো ভুলতে পারবো না। কি করে ভুলবো? ক্যাথিকে ছাড়া আমাকে আবারো ফিরে যেতে হবে সেই একাকীত্ব আর শূন্যতা ভরা জীবনে। ওর মত কারো সাথে আর কখনো পরিচয়ও হবে না। কারো প্রতি এরকম আত্মিক বন্ধনও টের পাবো না। ও হচ্ছে আমার জীবনের সত্যিকারের ভালোবাসা, আমার জীবন। ওকে ছেড়ে দেয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ও, এটা সত্য। তবুও ভালোবাসি ওকে।
আমার মাথা বোধহয় আসলেও খারাপ।
পাখির ডাকে হুঁশ ফিরে পেলাম। চারপাশে নজর বুলিয়ে দেখি বাসা থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছি হাঁটতে হাঁটতে। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে এখন যেখানে আছি, তার কয়েকটা রাস্তা পরেই রুথের বাসা।
কোনরকমের পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই বিপর্যয়ের মুহূর্তে অবচেতন মনে হাঁটতে হাঁটতে আমার থেরাপিস্টের কাছে চলে এসেছি। অতীতেও এমনটাই করতাম। আমার অবস্থা কতটা খারাপ, তা আরো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এখন।
কিন্তু এটা নিয়ে এত ভাবনা চিন্তার কি আছে? ভাবলাম। হ্যাঁ, একজন সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে কাজটা অপেশাদার, কিন্তু এ মুহূর্তে আমি মরিয়া, সাহায্য দরকার। রুথের সবুজ দরজাটার বাইরে দাঁড়িয়ে কলিংবেলে চাপ দিলাম।
দরজা খুলতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো তার। হলওয়েতে বাতি জ্বেলে দরজা খুলল, চেইনটা অবশ্য সরায়নি।
দরজার ফাঁকটুকু দিয়ে মাথা বের করলো রুথ। বয়সের ছাপ পড়েছে। চেহারায়। আশির কোঠায় এখন তার বয়স। আগের তুলনায় ভেঙে পড়েছে শরীর। ফ্যাকাসে গোলাপী রঙের নাইট গাউনের ওপরে একটা ধূসর কার্ডিগান পরে আছে।
“হ্যালো?” বিচলিত কণ্ঠে বলল রুথ। “কে ওখানে?”
“হ্যালো, রুথ,” আলোয় বেরিয়ে এলাম।
আমাকে চিনতে পেরে অবাক হয়ে গেল সে। “থিও? তুমি হঠাৎ-” আমাকে আপাদমস্তক দেখলো একবার, হাতে কোনরকমে জড়ানো ব্যান্ডেজটার ওপর দৃষ্টি স্থির হলো। “ঠিক আছো তুমি?”
“না, ঠিক নেই। ভেতরে আসতে পারি? আমি…আমি তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই।”
একমুহূর্তের জন্যেও দ্বিধা দেখতে পেলাম না রুথের দৃষ্টিতে, বরং আমার জন্যে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। “অবশ্যই,” মাথা নেড়ে বলল। “ভেতরে এসো।” চেইনটা আলগা করে সরে দাঁড়ালো সে।
ভেতরে পা দিলাম আমি।
.
২.৯
আমাকে লিভিং রুমে নিয়ে এলো সে।
“চা খাবে?”
রুমটার কিছুই বদলায়নি। সেই আগের কার্পেট, ভারি পর্দা, ম্যান্টেলের ওপর রাখা রূপালী ঘড়ি, আর্মচেয়ার, নীল কাউচ। ভেতরে ভেতরে স্বস্তি অনুভব করলাম।
“সত্যি বলতে, চায়ের থেকে শক্ত কিছু হলেই ভালো হবে।”
তীক্ষ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেও কিছু বলে না রুথ। মানাও করলো না। অবশ্য মানা যে করবে এরকমটা আশাও করিনি।
একটা গ্লাসে শেরি ঢেলে আমার দিকে এগিয়ে দিল। কাউচে বসেছি আমি। আগে থেরাপির জন্যে আসলেও এখানেই বসতাম সবসময়। একদম বামদিকে, হাতলে হাত রেখে। আমার হাতের নিচের কাপড়টা এতদিনের ব্যাবহারে পাতলা হয়ে এসেছে। থেরাপির জন্যে আসা অন্য রোগিরাও নিশ্চয়ই আমার মত আঙুল দিয়ে অনবরত খুটিয়েছে জায়গাটা।
গ্লাসে চুমুক দিলাম একবার। উষ্ণ আর অতিরিক্ত মিষ্টি তরলটুকু গিলতে কষ্ট হলেও কোন রা করলাম না। গোটা সময়টা কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো রুথ। তবে দৃষ্টিটার মধ্যে অস্বস্তিদায়ক কিছু নেই। গত বিশ বছরে এক মুহূর্তের জন্যেও আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেনি সে। শেরির গ্লাসটা শেষ করার আগ পর্যন্ত মুখ খুললাম না।
“গ্লাস হাতে তোমার সামনে বসে থাকতে অদ্ভুত লাগছে, রুথ। জানি যে রোগিদের ড্রিঙ্ক করাটা পছন্দ নয় তোমার।”
“তুমি তো আর আমার রোগি নো, থিও। এখন আমরা বন্ধু। আর তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, কোমল কন্ঠে বলল রুথ, “এ মুহূর্তে একজন বন্ধুর খুব দরকার তোমার।”
“আমার অবস্থা এতটাই শোচনীয়?”
“হ্যাঁ। আর গুরুতর কিছু না হলে তো এভাবে আমার কাছ ছুটে আসতে না। তাও এত রাতে।”
“ঠিক ধরেছো। আসলে, আসলে আমার আর কোন উপায় ছিল না।”
“কি হয়েছে থিও? খুলে বলো সবকিছু।”
“জানি না কীভাবে বলবো। কোথা থেকে শুরু করবো।”
“একদম প্রথম থেকেই বলল নাহয়?”
মাথা নেড়ে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে শুরু করলাম। যা ঘটেছে, একে একে সব খুলে বললাম ওকে। কিভাবে আবারো গাঁজার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছি, ক্যাথির ইমেইল চালাচালি, বাসায় দেরি করে আসা, পরকীয়া-সব। টের পাচ্ছিলাম যে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত কথা বলছি। আসলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে এগুলো বলে বুকটাকে হালকা করতে চাইছিলাম।
আমার কথার মাঝে কিছু বলল না রুথ। একমনে শুনে গেল পুরোটা। চেহারা দেখে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না মনে কি চলছে। “তোমার জন্যে খুব কষ্ট লাগছে থিও। জানি যে ক্যাথি তোমার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কতটা ভালোবাসো ওকে।”
“হা। আমি-” ক্যাথির নামটা মুখে আনতে পারলাম না। গলা কেঁপে উঠলো। সেটা বুঝতে পেরে একটা টিস্যু বক্স আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো রুথ। এর আগে আমাদের সেশনের মাঝে ও এই কাজ করলে রেগে উঠতাম। বলতাম যে ইচ্ছে করে আমাকে কাঁদানোর চেষ্টা করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবশ্য সফলও হতো। কিন্তু আজ নয়। আজ যেন চোখের পানি শুকিয়ে গেছে আমার।
ক্যাথির সাথে পরিচয় হবার অনেক আগে থেকেই রুথের এখানে নিয়মিত যাতায়ত করতাম আমি। এমনকি আমাদের সম্পর্কের প্রথম তিন বছরেও থেরাপির জন্যে এসেছি। ক্যাথির সাথে পরিচয় হবার কিছুদিন পর একটা কথা বলেছিল রুথ। “জীবনসঙ্গি বেছে নেয়া অনেকটা থেরাপিস্ট বাছাই করার মতন। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, এই ব্যক্তি কি জীবনের প্রতিটা ধাপে সৎ থাকবে আমার প্রতি আমার অভিযোগগুলো শুনবে? ভুল স্বীকার করে নেবে? মিথ্যে ওয়াদা করবে না তো?”
ক্যাথিকে এই কথাগুলো বলেছিলাম আমি। তখন ও পরামর্শ দেয় নিজেদের মধ্যে একটা চুক্তি করার। একে অপরকে আমরা কথা দেই যে কখনো পরস্পরের সাথে মিথ্যে বলবো না, কিছু লুকোবো না। সত্যিটাই বলবো সবসময়।
“কি হলো এটা?” বললাম। “ভুলটা কি আমার?”
মুখ খোলার আগে কিছুক্ষণ ইতস্তত করলো রুথ। ও যা বলল শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না।
“এর জবাব জানাই আছে তোমার। সত্যটা কেবল স্বীকার করে নিতে হবে নিজের কাছে।”
“আমি জানি না,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলি। “আসলেও জানি না।”
অস্বস্তিদায়ক একটা নীরবতা ভর করলো ঘরে। কল্পনার চোখে দেখতে পেলাম হাসিমুখে ইমেইলগুলো টাইপ করে চলেছে ক্যাথি। তৃপ্তি খেলা করছে চোখেমুখে। অচেনা লোকটার সাথে সম্পর্কে কোন রাখঢাক নেই। ওর। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করার বিষয়টা ওর কাছে একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতন। বাস্তব জীবনে অভিনয় করার মজাই আলাদা।
“আমাদের সম্পর্কটা একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছে ওর কাছে।”
“এরকমটা মনে হবার কারণ?”
“কারণ জীবনে উত্তেজনার প্রয়োজন ওর। সোজা বাংলায়, নাটকীয়তা। প্রায়ই বলতো যে, আমাদের সম্পর্কটা পানসে হয়ে গেছে, সবসময় ক্লান্ত থাকি আমি, বেশি কাজ করি। বেশ কয়েকবার কথা কাটাকাটিও হয়েছে গত কয়েক মাসে। জ্বলে ওঠা শব্দটা ব্যবহার করেছে বারবার।”
“জ্বলে ওঠা?”
“একে অপরের সংস্পর্শে আমরা নাকি আর জ্বলে উঠি না।”
“ওহ, আচ্ছা।” মাথা নাড়ে রুথ। “এই ব্যাপারে তো আগেও কথা হয়েছে আমাদের, তাই না?”
“জ্বলে ওঠার ব্যাপারে?”
“ভালোবাসার ব্যাপারে। প্রায়ক্ষেত্রেই ভালোবাসার মধ্যে নাটকীয়তা খুঁজতে চাই আমরা। যেন বারবার একে অপরের জন্যে নাটুকে কিছু করাই ভালোবাসার নিদর্শন। কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসা নীরব, নির্লিপ্ত।” লম্বা শ্বাস ছাড়ে রুথ। “ভালোবাসা হচ্ছে গভীর, প্রশান্ত একটা অনুভূতি। ধ্রুব। ক্যাথির প্রতি তোমার ভালোবাসার মধ্যে কোন খাদ নেই। কিন্তু সেই ভালোবাসাটুকু তোমাকে সে ফিরিয়ে দিতে পারছে কি না, এটা ভিন্ন প্রশ্ন।”
টিস্যুর বক্সটার দিকে চেয়ে আছি। রুথের কথার ধরণ ভালো লাগছে না। বিষয় পরিবর্তনের চেষ্টা করি।
“আমারও দোষ আছে। মিথ্যে তো আমিও বলেছি, গাঁজার ব্যাপারটায়।”
হাসলো রুথ। “মাঝে মাঝে নেশা করা আর অন্য এক ব্যক্তির সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এক কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে আমার। এই ব্যাপারটা থেকে কিন্তু আমরা মানুষটার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা করতে পারি-সে এমন একজন, যে অবলীলায় মিথ্যে বলে যেতে সক্ষম। কোন প্রকার অনুতাপ ছাড়াই ভালোবাসার মানুষটাকে ঠকিয়ে চলেছে-”
“এটা তো নিশ্চিতভাবে বলতে পারো না তুমি।” কথাটা নিজের কানেই বড় খেলো শোনাচ্ছে। “হয়তো ভেতরে ভেতরে খারাপ লাগে ওর।”
মুখে বললেও কথাটা আমি নিজে বিশ্বাস করি না।
রুথও করলো না। মনে হয় না। আমার ধারণা মানসিক সমস্যায় ভুগছে সে। সহমর্মিতা, সততা, মায়া-ওর কাছে কিছু শব্দ মাত্র। কিন্তু তোমার মধ্যে কিন্তু এগুলোর কোন অভাব নেই।”
মাথা ঝাঁকালাম। “এটা সত্যি না।”
“এটাই সত্যি, থিও।” জোর দিয়ে বলল রুথ। “তোমার কি মনে হচ্ছে না যে আগেও এরকম পরিস্থিতির শিকার হয়েছো?”
“ক্যাথির কারণে?”
মাথা ঝাঁকায় রুথ। “না, তোমার বাবা-মার কথা বলছি। আবারো সেই একই ঘটনা ঘটছে তোমার সাথে। হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন, কিন্তু অনুভূতিগুলো তো একই?”
“না,” হঠাৎই বিরক্তি ভর করলো আমার চিত্তে। “ক্যাথির সাথে যা ঘটছে, তার সাথে আমার শৈশবের কোন সম্পর্ক নেই।”
“আসলেই কি?” রুথের কণ্ঠে অবিশ্বাস। “সবসময় একজনকে খুশি করার অবিরাম চেষ্টা। এমন একটা মানুষ,যার মধ্যে মায়া বা আবেগের ছিটেফোঁটাও নেই-তার ভালোবাসার পাত্র হবার চেষ্টা। আগের কথা মনে হচ্ছে না তোমার, থিও?”
হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল আমার, কিছু বললাম না।
দ্বিধান্বিত স্বরে পরবর্তী কথাগুলো বলল রুথ। “আমি জানি তোমার কতটা খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি চাই যেন বাস্তবতাটুকু বুঝতে পারো। ক্যাথির সাথে দেখা হবার অনেক আগে থেকেই এই বেদনাটা তোমার সঙ্গি। অনেক বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছো কষ্টটাকে। খুব পছন্দের কেউ আমাদের পাল্টা ভালোবাসেনা, এই সত্যটা স্বীকার করে নেয়া প্রচণ্ড কষ্টের, থিও। অসহ্য একটা অনুভূতি।”
ঠিক বলেছে সে। আসলে আমার ভেতরে জড়ো হওয়া বিশ্বাসঘাতকতার এই অনুভূতিটাকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিলাম না এতক্ষণ। রুথের বলা-”খুব পছন্দের কেউ আমাদের পাল্টা ভালোবাসেনা’-কথাটা একই সাথে আমার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের গল্প। ব্যাপারটা শুধু ক্যাথির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আমার বাবা, নিঃসঙ্গ শৈশব, না পাবার কষ্ট-সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। যা চাইছি, তা ভবিষ্যতেও পাবার সম্ভাবনা নেই।
রুথের মতে, এজন্যেই আমি ক্যাথিকে বেছে নিয়েছি। আমি যে একটা আস্ত অপদার্থ, ভালোবাসার অনুপযুক্ত-বাবার এই কথাটা প্রমাণ করার জন্যে এতদিন ধরে অপাত্রে নিজের ভালোবাসা ঢেলে এসেছি আমি, যার আসলে আমাকে ভালোবাসার কোন ইচ্ছেই নেই।
দু’হাতে মুখ ঢাকলাম। “তাহলে এমনটাই হবার ছিল? নিজের এই দশার জন্যে আমি নিজেই দায়ি? কোন আশাই নেই?”
“আশা নেই, এই কথাটা ভুল। তুমি তো আর বাবার করুণায় বেঁচে থাকা সেই ছোট্ট থিও নও। এখন পরিণত বয়স্ক একজন মানুষ তুমি। এটাই তোমার সুযোগ-অতীতের নাগপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করো, নতুবা আসলেও প্রমাণ করো যে ভালোবাসার অনুপযুক্ত তুমি। আর একবার যদি নিজেকে মুক্ত করতে পারো, তাহলে আর কখনো এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে না।”
“কিভাবে করবো সেটা? ওকে ছেড়ে দেব?”
“পরিস্থিতিটা তোমার জন্যে আসলেও কঠিন।”
“কিন্তু তোমার মনে হচ্ছে ওকে ছেড়ে দেয়াটাই আমার জন্যে উত্তম হবে, তাই না?”
“আজকের এই অবস্থানে আসতে তোমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আবারো পুরনো সেই দিনগুলোয় ফিরে যাওয়া কোনভাবেই তোমার প্রাপ্য নয়। সেই মানসিক অত্যাচার আর সহ্য করতে পারবে না। যদি গোটা ব্যাপারটা অস্বীকার করো, তাহলে নিজেকে নিজেই ফাঁদে ফেলবে। তোমার জীবনে এমন কাউকে দরকার, যে মন থেকে ভালোবাসবে।”
“এভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার দরকার নেই, রুথ। সোজাসুজিই বলো কথাটা। তোমার ধারণা ক্যাথিকে ছেড়ে দেয়া উচিৎ আমার।”
আমার চোখে দিকে তাকালো রুথ। “আমার মনে হয়, ওকে ছেড়ে দেয়াটাই তোমার জন্যে সবচেয়ে ভালো হবে। কথাটা শুধু থেরাপিস্ট হিসেবে নয়, পুরনো বন্ধু হিসেবে বলছি। আমার মনে হয় না এরকম একটা ঘটনার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে তুমি। বড়জোর কিছুদিন মানিয়ে চলার চেষ্টা করতে পারো। কিন্তু এরপর আবারো তোমাকে এই কাউচে ফিরে আসতে হবে। সত্যটা স্বীকার করে নাও থিও, নিজের আর ক্যাথির ব্যাপারে। মনে রেখ যে ভালোবাসার সম্পর্কে সততা নেই, সেটা। কখনোই প্রকৃত ভালোবাসা হতে পারে না।”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার বুক চিরে।
“ধন্যবাদ রুথ, এভাবে খোলাখুলি কথাটা বলার জন্যে। আমি আসলেও কৃতজ্ঞ।”
বেরিয়ে আসার সময় দরজার কাছে আমাকে একবার জড়িয়ে ধরলো রুথ। আগে কখনো এরকম কিছু করেনি। ওকে বড্ড বেশি দুর্বল লাগছে আজকে, একদম নাজুক। ওর সেই পুরনো পারফিউমটার গন্ধটা নাকে আসতেই মনে হলো এই বুঝি কেঁদে ফেলবো। কিন্তু কাঁদলাম না। কিংবা, কাঁদতে পারলাম না।
বরং একবারও পিছে না ফিরে চলে এলাম সেখান থেকে।
বাসায় ফেরার জন্যে বাসে উঠে জানালার পাশে একটা সিটে বসলাম। বারবার ক্যাথির কথা মনে হচ্ছে, বিশেষ করে ওর সবুজ চোখজোড়ার কথা। কিন্তু রুথ ঠিকই বলেছে, যে ভালোবাসার সম্পর্কে সততা নেই, সেটা কখনোই প্রকৃত ভালোবাসা হতে পারে না।
বাসায় ফিরে ক্যাথির মুখোমুখি হতে হবে আমাকে।
ওকে ছেড়ে দিতে হবে।
.
২.১০
বাসায় এসে দেখি ক্যাথি ফিরেছে। কাউচে পা তুলে বসে কাকে যেন মেসেজ পাঠাচ্ছে সে।
“কোথায় গিয়েছিলে?” মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করলো ও।
“হাঁটতে বেরিয়েছিলাম একটু। রিহার্সাল কেমন গেল?”
“যেরকম যায়।”
ওকে মেসেজ টাইপ করতে দেখলাম, কার সাথে কথা বলছে? জানি যে কিছু বলতে চাইলে এখনই বলা উচিৎ আমার। তোমার পরকীয়ার ব্যাপারে জেনে গেছি আমি, এভাবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কোন মানে হয় না। কথাগুলো বলার জন্যে মুখও খুললাম, কিন্তু কোন শব্দ বেরুলো না। যেন বোবা হয়ে গেছি। আমি কিছু বলার আগেই ক্যাথি কথা বলে উঠলো। ফোন নামিয়ে রেখেছে।
“থিও, আমাদের কিছু বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলা উচিৎ।”
“কোন বিষয়ে?”
“তোমার কি আমাকে কিছুই বলার নেই?” ক্যাথির কণ্ঠে রূঢ়তার আভাস।
ইচ্ছে করে ওর দিকে তাকাচ্ছি না, ভয় হচ্ছে যে আমার মনের কথা পড়ে ফেলবে। রীতিমতো লজ্জা লাগছে, যেন আমি নিজেই বড় কোন ভুল করে ফেলেছি।
তবে ক্যাথির দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে আসলেও ভুল করেছি আমি। সোফার পেছন থেকে একটা বয়াম বের করে সামনের টেবিলে রাখলো ও। পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে সাথে সাথে। এই ছোট বয়ামটাতেই গাঁজা রাখি আমি। আঙুল কেটে যাওয়ার পর লুকোতে ভুলে গেছি।
“এটা কি?” বয়ামটা উঁচু করে জিজ্ঞেস করলো ক্যাথি।
“গাঁজা।”
“সেটা ভালো করেই জানি আমি। কিন্তু এটা এখানে কি করছে?”
“আমি নিয়ে এসেছি। মাঝে মাঝে
“মাঝে মাঝে কি? নেশা করো?”
কাঁধ ঝাঁকালাম জবাবে। এখনও চোখ নামিয়ে রেখেছি।
“এসব কি থিও! জবাব দাও!” চেঁচিয়ে উঠলো ক্যাথি। মাঝে মাঝে মনে হয় যে তোমাকে চিনতে ভুল করেছি আমি।”
মাথায় আগুন ধরে গেলো। ইচ্ছে করছে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। পুরো ঘরে ভাঙচুর চালাই, আগুন লাগিয়ে দেই। বাচ্চাদের মত কাঁদতে কাঁদতে আবার ওর কাছেই নিজেকে সমর্পণ করি।
কিন্তু এরকম কিছু করলাম না।
“চলো ঘুমিয়ে পড়ি,” বলে ওখান থেকে সরে আসলাম।
বিছানায় উঠেও কেউ কোন কথা বললাম না। অন্ধকারে ওর পাশে চুপচাপ শুয়ে থাকি। ঘুমের বালাই নেই আমার চোখে। ক্যাথির শরীরের উত্তাপ পরিস্কার টের পাচ্ছি। ওর ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
আমার সাথে কেন আলাপ করলে না? বলতে চাইছিলাম। কেন আসলে না আমার কাছে? তোমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু তো আমিই। আলোচনার মাধ্যমে সবকিছুর সমাধান করতে পারতাম আমরা। আমার সাথে কেন কথা বললে না? আমি তো এখানেই ছিলাম। ঠিক এখানেই।
ইচ্ছে করছে ওকে কাছে টেনে নিতে, শক্ত করে ধরে রাখতে। কিন্তু পারলাম না। আমি যে ক্যাথিকে ভালোবাসতাম, তার আর কোন অস্তিত্ব নেই।
অবশেষে চোখ দিয়ে পানি গড়াতে লাগলো আমার। কিছুক্ষণের মধ্যে ভিজে উঠলো দুই গাল।
অন্ধকারে, আমার নিঃশব্দ সেই কান্না দেখার মত কেউ ছিল না।
***
পরদিন সকালে আমাদের দৈনন্দিন নিয়মের কোন ব্যত্যয় ঘটলো না। ও বাথরুমে গেলে কফি বানালাম দু’জনের জন্যে। রান্নাঘরে আসামাত্র কফির কাপটা ধরিয়ে দিলাম হাতে।
“রাতের বেলা অদ্ভুত শব্দ করছিলে,” বলল ক্যাথি। “ঘুমের মধ্যে কথাও বলছিলে।”
“কি বলছিলাম?”
“জানি না। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিনি। নেশার ঘোরে কেউ প্রলাপ বকলে সেটা বোঝার কথাও না।” একবার ঘড়ি দেখে চোখ গরম করে দিকে তাকালো ও। “যেতে হবে এখন, নাহলে দেরি হয়ে যাবে।”
কফি শেষ করে কাপটা সিঙ্কে রেখে দিল ক্যাথি। বেরিয়ে যাবার আগে গালে আলতো করে একবার চুমু খেল। ওর ঠোঁটের স্পর্শে প্রায় আঁতকে উঠলাম।
ক্যাথি যাওয়ার পর গোসলে ঢুকলাম। পানি ইচ্ছে করে বেশি গরম করেছি। আরেকটু গরম হলেই শরীর পুড়ে যাবে। সেই গরম পানির নিচে দাঁড়িয়েই বাচ্চাদের মত গলা ছেড়ে কাঁদলাম কিছুক্ষণ। গোসল শেষে শরীর থেকে পানি মুছে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালাম। দেখে মনে হচ্ছে রাতারাতি বয়স ত্রিশ বছর বেড়ে গেছে।
সেখানেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
ক্যাথিকে ছেড়ে দেয়ার অর্থ হচ্ছে আমার নিজের একটা অংশ বিসর্জন দেয়া। আর সেরকম কিছু করার জন্যে একদমই তৈরি নই আমি, রুথ যা-ই বলুক না কেন। মানুষ হিসেবে সে-ও ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে নয়। ক্যাথি আর আমার বাবার মধ্যে কোন মিল নেই; অতীতের পুণরাবৃত্তি ঘটছে না আমার জীবনে। ভবিষ্যতে কি হবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আছে আমার হয়তো একদিন ভুলটা স্বীকার করবে ক্যাথি, সবকিছু খুলে বলবে। তাকে মাফ করে দিব তখন। আলোচনার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্তে আসবো।
কিন্তু ক্যাথিকে ছেড়ে দেয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। এমন ভাব করবো যেন ইমেইলগুলো কখনো পড়িইনি। ভুলে যাবো ওগুলোর কথা। এছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। হার মানবো না আমি, ভেঙে পড়লে চলবে না। তাছাড়া আমার রোগিদের কথাও তো চিন্তা করতে হবে। তারা নির্ভর করে আছে আমার ওপরে।
এতগুলো মানুষকে আশাহত করা সম্ভব নয় কিছুতেই।