দ্বিতীয় খণ্ড – ষষ্ঠ অধ্যায়: ব্যাকুলতা ও প্রথম দর্শন
ঠাকুরের এই কালের আচরণ
অতি অল্প বয়সেই ঠাকুরের পিতার মৃত্যু হয়। সুতরাং বাল্যকাল হইতে তিনি জননী চন্দ্রমণি ও অগ্রজ রামকুমারের স্নেহেই পালিত হইয়াছিলেন। ঠাকুরের অপেক্ষা রামকুমার একত্রিশ বৎসর বড় ছিলেন। সুতরাং ঠাকুরের পিতৃভক্তির কিয়দংশ তিনি পাইয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয়। পিতৃতুল্য অগ্রজের সহসা মৃত্যু হওয়ায় ঠাকুর নিতান্ত ব্যথিত হইয়াছিলেন। কে বলিবে, ঐ ঘটনা তাঁহার শুদ্ধ মনে সংসারের অনিত্যতা-সম্বন্ধীয় ধারণা দৃঢ় করিয়া উহাতে বৈরাগ্যানল কতদূর প্রবুদ্ধ করিয়াছিল? দেখা যায়, এই সময় হইতে তিনি শ্রীশ্রীজগন্মাতার পূজায় সমধিক মনোনিবেশপূর্বক মানব তাঁহার দর্শনলাভে বাস্তবিক কৃতার্থ হয় কি না, তদ্বিষয় জানিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিলেন। পূজান্তে মন্দিরমধ্যে শ্রীশ্রীজগন্মাতার নিকটে বসিয়া এই সময়ে তিনি তন্মনস্কভাবে দিন যাপন করিতেন এবং রামপ্রসাদ ও কমলাকান্ত-প্রমুখ ভক্তগণরচিত সঙ্গীতসকল ৺দেবীকে শুনাইতে শুনাইতে প্রেমে বিহ্বল ও আত্মহারা হইয়া পড়িতেন। বৃথা বাক্যালাপ করিয়া তিনি এখন তিলমাত্র সময় অপব্যয় করিতেন না এবং রাত্রে মন্দিরদ্বার রুদ্ধ হইলে লোকসঙ্গ পরিহারপূর্বক পঞ্চবটীর পার্শ্বস্থ জঙ্গলমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া জগন্মাতার ধ্যানে কালযাপন করিতেন।
হৃদয়ের তদ্দর্শনে চিন্তা ও সঙ্কল্প
ঠাকুরের ঐ প্রকার চেষ্টাসমূহ হৃদয়ের প্রীতিকর হইত না। কিন্তু সে কি করিবে? বাল্যকাল হইতে তিনি যখন যাহা ধরিয়াছেন, তখনি তাহা সম্পাদন করিয়াছেন, কেহই তাঁহাকে বাধা দিতে পারে নাই – একথা তাহার অবিদিত ছিল না। সুতরাং প্রতিবাদ বা বাধা দেওয়া বৃথা। কিন্তু দিন দিন ঠাকুরের ঐ ভাব প্রবল হইতেছে দেখিয়া হৃদয় কখন কখন একটু আধটু না বলিয়াও থাকিতে পারিত না। রাত্রে নিদ্রা না যাইয়া শয্যাত্যাগপূর্বক তিনি পঞ্চবটীতে চলিয়া যান, একথা জানিতে পারিয়া হৃদয় এই সময়ে বিশেষ চিন্তান্বিত হইয়াছিল। কারণ, মন্দিরে ঠাকুরসেবার পরিশ্রম, তাহার উপর তাঁহার পূর্ববৎ আহার ছিল না, এ অবস্থায় রাত্রে নিদ্রা না যাইলে শরীর ভগ্ন হইবার সম্ভাবনা। হৃদয় স্থির করিল, ঐ বিষয়ের সন্ধান এবং যথাসাধ্য প্রতিবিধান করিতে হইবে।
ঐ সময়ে পঞ্চবটী প্রদেশের অবস্থা
পঞ্চবটীর পার্শ্বস্থ স্থান তখন এখনকার মত সমতল ছিল না; নীচু জমি, খানাখন্দ ও জঙ্গলে পূর্ণ ছিল। বুনো গাছগাছড়ার মধ্যে একটি ধাত্রী বা আমলকী বৃক্ষ তথায় জন্মিয়াছিল। একে কবরডাঙ্গা, তাহার উপর জঙ্গল, সেজন্য দিবাভাগেও কেহ ঐ স্থানে বড় একটা যাইত না। যাইলেও জঙ্গলমধ্যে প্রবিষ্ট হইত না। আর রাত্রে? ভূতের ভয়ে কেহ ঐ দিক মাড়াইত না। হৃদয়ের মুখে শুনিয়াছি, পূর্বোক্ত আমলকী বৃক্ষটি নীচু জমিতে থাকায় তাহার তলে কেহ বসিয়া থাকিলে জঙ্গলের বাহিরের উচ্চ জমি হইতে কাহারও নয়নগোচর হইত না। ঠাকুর এই সময়ে উহারই তলে বসিয়া রাত্রে ধ্যানধারণা করিতেন।
হৃদয়ের প্রশ্ন, ‘রাত্রে জঙ্গলে যাইয়া কি কর?’
রাত্রে ঠাকুর ঐ স্থানে গমন করিতে আরম্ভ করিলে হৃদয় একদিন অলক্ষ্যে তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিল এবং তাঁহাকে জঙ্গলমধ্যে প্রবিষ্ট হইতে দেখিতে পাইল। তিনি বিরক্ত হইবেন ভাবিয়া সে আর অগ্রসর হইল না। কিন্তু তাঁহাকে ভয় দেখাইবার নিমিত্ত কিছুক্ষণ পর্যন্ত আশেপাশে ঢিল ছুঁড়িতে থাকিল। তিনি তাহাতেও ফিরিলেন না দেখিয়া অগত্যা সে স্বয়ং গৃহে ফিরিল। পরদিন অবসরকালে সে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “জঙ্গলের ভিতর রাত্রে যাইয়া কি কর বল দেখি?” ঠাকুর বলিলেন, “ঐ স্থানে একটা আমলকী গাছ আছে, তাহার তলায় বসিয়া ধ্যান করি; শাস্ত্রে বলে, আমলকী গাছের তলায় যে যাহা কামনা করিয়া ধ্যান করে, তাহার তাহাই সিদ্ধ হয়।”
ঠাকুরকে হৃদয়ের ভয় দেখাইবার চেষ্টা
ঐ ঘটনার পরে কয়েক দিন ঠাকুর পূর্বোক্ত আমলকী বৃক্ষের তলায় ধ্যানধারণা করিতে বসিলেই মধ্যে মধ্যে লোষ্ট্রাদি নিক্ষিপ্ত হওয়া প্রভৃতি নানাবিধ উৎপাত হইতে লাগিল। উহা হৃদয়ের কর্ম বুঝিয়াও তিনি তাহাকে কিছুই বলিলেন না।
হৃদয়কে ঠাকুরের বলা – ‘পাশমুক্ত হইয়া ধ্যান করিতে হয়‘
হৃদয় কিন্তু ভয় দেখাইয়া তাঁহাকে নিরস্ত করিতে না পারিয়া আর স্থির থাকিতে পারিল না। একদিন ঠাকুর বৃক্ষতলে যাইবার কিছুক্ষণ পরে নিঃশব্দে জঙ্গলমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া দূর হইতে দেখিল, তিনি পরিধেয় বস্ত্র ও যজ্ঞসূত্র ত্যাগ করিয়া সুখাসীন হইয়া ধ্যানে নিমগ্ন রহিয়াছেন। দেখিয়া ভাবিল, ‘মামা কি পাগল হইল নাকি? এরূপ তো পাগলেই করে; ধ্যান করিবে, কর; কিন্তু এরূপ উলঙ্গ হইয়া কেন?’ ঐরূপ ভাবিয়া সে সহসা তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইল এবং তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিল, “এ কি হচ্ছে? পৈতে কাপড় ফেলে দিয়ে উলঙ্গ হয়ে বসেছ যে?” কয়েকবার ডাকাডাকির পরে ঠাকুরের চৈতন্য হইল এবং হৃদয়কে নিকটে দাঁড়াইয়া ঐরূপ প্রশ্ন করিতে শুনিয়া বলিলেন, “তুই কি জানিস? এইরূপে পাশমুক্ত হয়ে ধ্যান করতে হয়; জন্মাবধি মানুষ ঘৃণা, লজ্জা, কুল, শীল, ভয়, মান, জাতি ও অভিমান – এই অষ্ট পাশে বদ্ধ হয়ে রয়েছে; পৈতেগাছটাও ‘আমি ব্রাহ্মণ, সকলের চেয়ে বড়’ – এই অভিমানের চিহ্ন এবং একটা পাশ; মাকে ডাকতে হলে ঐসব পাশ ফেলে দিয়ে এক মনে ডাকতে হয়, তাই ঐসব খুলে রেখেছি, ধ্যান করা শেষ হলে ফিরিবার সময় আবার পরব।” হৃদয় ঐরূপ কথা পূর্বে আর কখন শুনে নাই, সুতরাং অবাক হইয়া রহিল এবং উত্তরে কিছুই বলিতে না পারিয়া সেস্থান হইতে প্রস্থান করিল। ইতিপূর্বে সে ভাবিয়াছিল মাতুলকে অনেক কথা অদ্য বুঝাইয়া বলিবে ও তিরস্কার করিবে – তাহার কিছুই করা হইল না।
শরীর ও মন উভয়ের দ্বারা ঠাকুরের জাত্যভিমাননাশের, ‘সমলোষ্ট্রাশ্মকাঞ্চন‘ হইবার এবং সর্বজীবে শিবজ্ঞানলাভের জন্য অনুষ্ঠান
পূর্বোক্ত ঘটনাপ্রসঙ্গে একটি কথা এখানে বলিয়া রাখা ভাল। কারণ, উহা জানা থাকিলে ঠাকুরের জীবনের পরবর্তী অনেকগুলি ঘটনা আমরা সহজে বুঝিতে পারিব। আমরা দেখিলাম, অষ্টপাশের হস্ত হইতে মুক্ত হইবার জন্য কেবলমাত্র মনে মনে ঐ সকলকে ত্যাগ করিয়াই ঠাকুর নিশ্চিন্ত হইতে পারেন নাই; কিন্তু স্থূলভাবেও ঐ সকলকে যতদূর ত্যাগ করা যাইতে পারে, তাহা করিয়াছিলেন। পরজীবনে অন্য সকল বিষয়েও তাঁহাকে ঐরূপ করিতে আমরা দেখিতে পাই। যথা –
অভিমান নাশ করিয়া মনে যথার্থ দীনতা আনয়নের জন্য তিনি, অপরে যে স্থানকে অশুদ্ধ ভাবিয়া সর্বথা পরিহার করে, সে স্থান বহু প্রযত্নে স্বহস্তে পরিষ্কৃত করিয়াছিলেন।
‘সমলোষ্ট্রাশ্মকাঞ্চন’ না হইলে অর্থাৎ ইতরসাধারণের নিকট বহুমূল্য বলিয়া পরিগণিত স্বর্ণাদি ধাতু ও প্রস্তরসকলকে উপলখণ্ডের ন্যায় তুচ্ছ জ্ঞান করিতে না পারিলে, মানবমন শারীরিক ভোগসুখেচ্ছা হইতে আপনাকে বিযুক্ত করিয়া ঈশ্বরাভিমুখে সম্পূর্ণ ধাবিত হয় না এবং যোগারূঢ় হইতে পারে না – একথা শুনিয়াই ঠাকুর কয়েক খণ্ড মুদ্রা ও লোষ্ট্র হস্তে গ্রহণ করিয়া বারংবার ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’ বলিতে বলিতে উহা গঙ্গাগর্ভে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন।
সর্বজীবে শিবজ্ঞান দৃঢ় করিবার জন্য কালীবাটীতে কাঙ্গালীদের ভোজন সাঙ্গ হইলে তাহাদের উচ্ছিষ্টান্ন তিনি দেবতার প্রসাদজ্ঞানে গ্রহণ (ভক্ষণ) ও মস্তকে ধারণ করিয়াছিলেন। পরে, উচ্ছিষ্ট পত্রাদি মস্তকে বহন করিয়া গঙ্গাতীরে নিক্ষেপপূর্বক স্বহস্তে মার্জনী ধরিয়া ঐ স্থান ধৌত করিয়াছিলেন এবং নিজ নশ্বর শরীরের দ্বারা ঐরূপে দেবসেবা যৎকিঞ্চিৎ সাধিত হইল ভাবিয়া আপনাকে কৃতার্থম্মন্য জ্ঞান করিয়াছিলেন।
ঠাকুরের ত্যাগের ক্রম
ঐরূপ নানা ঘটনার উল্লেখ করা যাইতে পারে। সকল স্থলেই দেখা যায়, ঈশ্বরলাভের পথে প্রতিকূল বিষয়সকলকে কেবলমাত্র মনে মনে ত্যাগ করিয়া তিনি নিশ্চিন্ত থাকিতেন না। কিন্তু স্থূলভাবে ঐ সকলকে প্রথমে ত্যাগ করিয়া অথবা নিজ শরীর ও ইন্দ্রিয়বর্গকে ঐ সকল বিষয় হইতে যথাসম্ভব দূরে রাখিয়া তদ্বিপরীত অনুষ্ঠানসকল করিতে তিনি উহাদিগকে বলপূর্বক নিয়োজিত করিতেন। দেখা যায়, ঐরূপ অনুষ্ঠানে তাঁহার মনের পূর্ব সংস্কারসকল এককালে উৎসন্ন হইয়া যাইত এবং তদ্বিপরীত নবীন সংস্কারসকলকে উহা এমন দৃঢ়ভাবে ধারণ করিত যে, কখনই সে আর অন্য ভাব আশ্রয় করিয়া কার্য করিতে পারিত না। ঐরূপে কোন নবীন ভাব মনের দ্বারা প্রথম গৃহীত হইয়া শরীরেন্দ্রিয়াদিসহায়ে কার্যে কিঞ্চিন্মাত্রও যতক্ষণ না অনুষ্ঠিত হইত, ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ বিষয়ের যথাযথ ধারণা হইয়া উহার বিপরীত ভাবের ত্যাগ হইয়াছে, একথা তিনি স্বীকার করিতেন না।
ঐ ক্রম সম্বন্ধে ‘মনঃকল্পিত সাধনপথ‘ বলিয়া আপত্তি ও তাহার মীমাংসা
পূর্ব সংস্কারসমূহ ত্যাগ করিতে নিতান্ত পরাঙ্মুখ আমরা ভাবি, ঠাকুরের ঐরূপ আচরণের কিছুমাত্র আবশ্যকতা ছিল না। তাঁহার ঐরূপ আচরণসকলের আলোচনা করিতে যাইয়া কেহ কেহ বলিয়া বসিয়াছেন – “অপবিত্র কদর্য স্থান পরিষ্কৃত করা, ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’ বলিয়া মৃত্তিকাসহ মুদ্রাখণ্ডসকল গঙ্গায় ফেলিয়া দেওয়া প্রভৃতি ঘটনাবলী তাঁহার নিজ মনঃকল্পিত সাধনপথ বলিয়া বোধ হইয়া থাকে; কিন্তু ঐরূপ অদৃষ্টপূর্ব উপায়সকল অবলম্বনে তিনি মনের উপর যে কর্তৃত্বলাভ করিয়াছিলেন তাহা অতি শীঘ্রই তদপেক্ষা সহজ উপায়ে পাওয়া যাইতে পারে।”1 উত্তরে বলিতে হয় – উত্তম কথা, কিন্তু ঐরূপ বাহ্য অনুষ্ঠানসকল না করিয়া কেবলমাত্র মনে মনে বিষয় ত্যাগ-করা-রূপ তোমাদের তথাকথিত সহজ উপায়ের অবলম্বনে কয়জন লোক এ পর্যন্ত পূর্ণভাবে রূপরসাদি বিষয়সমূহ হইতে বিমুখ হইয়া ষোল আনা মন ঈশ্বরে অর্পণ করিতে সক্ষম হইয়াছে? উহা কখনই হইবার নহে। মন একরূপ চিন্তা করিয়া একদিকে চলিবে, এবং শরীর ঐ চিন্তা বা ভাবের বিপরীত কার্যানুষ্ঠান করিয়া অন্য পথে চলিবে – এই প্রকারে কোন মহৎ কার্যেই সিদ্ধিলাভ করা যায় না, ঈশ্বরলাভ তো দূরের কথা! কিন্তু রূপরসাদিভোগলোলুপ মানব ঐ কথা বোঝে না। কোন বিষয় ত্যাগ করা ভাল বলিয়া বুঝিয়াও সে পূর্বসংস্কারবশে নিজ শরীরেন্দ্রিয়াদির দ্বারা উহা ত্যাগ করিতে অগ্রসর হয় না এবং ভাবিতে থাকে, ‘শরীর যেরূপ কার্য করুক না কেন, মনে তো আমি অন্যরূপ ভাবিতেছি!’ যোগ ও ভোগ একত্রে গ্রহণ করিবে ভাবিয়া সে আপনাকে আপনি ঐরূপে প্রতারিত করিয়া থাকে। কিন্তু আলোকান্ধকারের ন্যায় যোগ ও ভোগরূপ দুই পদার্থ কখনো একত্রে থাকিতে পারে না। কাম-কাঞ্চনময় সংসার ও ঈশ্বরের সেবা যাহাতে একত্রে একই কালে সম্পন্ন করিতে পারা যায়, এরূপ সহজ পথের আবিষ্কার আধ্যাত্মিক জগতে এ পর্যন্ত কেহই করিতে পারেন নাই।2 শাস্ত্র সেজন্য আমাদিগকে বারংবার বলিতেছেন, ‘যাহা ত্যাগ করিতে হইবে, তাহা কায়মনোবাক্যে ত্যাগ করিতে হইবে এবং যাহা গ্রহণ করিতে হইবে তাহাও ঐরূপ কায়মনোবাক্যে গ্রহণ করিতে হইবে, তবেই সাধক ঈশ্বরলাভের অধিকারী হইবেন।’ ঋষিগণ সেজন্যই বলিয়াছেন, মানসিক ভাবোদ্দীপক শারীরিক চিহ্ন ও অনুষ্ঠানরহিত তপস্যাসহায়ে – ‘তপসো বাপ্যলিঙ্গাৎ’ – মানব কখনো আত্মসাক্ষাৎকারলাভে সমর্থ হয় না। যুক্তির বলে, স্থূল হইতে সূক্ষ্ম এবং সূক্ষ্ম হইতে কারণে মানবমন ক্রমশঃ অগ্রসর হয় – ‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায়’।
1.
৺শিবনাথ
শাস্ত্রী
মহাশয়ের
লিখিত
– “Personal Reminiscences of Ramakrishna Paramahamsa.” Vide ‘Modern
Review’ for November, 1910.
2. Ye cannot serve
God and Mammon together. – Holy Bible
ঠাকুর এই সময়ে যেভাবে পূজাদি করিতেন
আমরা বলিয়াছি, অগ্রজের মৃত্যুর পর ঠাকুর শ্রীশ্রীজগদম্বার পূজায় অধিকতর মনোনিবেশ করিয়াছিলেন এবং তাঁহার দর্শনলাভের জন্য যাহাই অনুকূল বলিয়া বুঝিতেছিলেন, তাহাই বিশ্বস্তচিত্তে ব্যগ্র হইয়া সম্পন্ন করিতেছিলেন। তাঁহার শ্রীমুখে শুনিয়াছি, এই সময়ে যথারীতি পূজাসমাপনান্তে ৺দেবীকে নিত্য রামপ্রসাদ-প্রমুখ সিদ্ধ ভক্তদিগের রচিত সঙ্গীতসমূহ শ্রবণ করানো তিনি পূজার অঙ্গবিশেষ বলিয়া গণ্য করিতেন। হৃদয়ের গভীর উচ্ছ্বাসপূর্ণ ঐ সকল গীত গাহিতে গাহিতে তাঁহার চিত্ত উৎসাহপূর্ণ হইয়া উঠিত। ভাবিতেন – রামপ্রসাদ-প্রমুখ ভক্তেরা মার দর্শন পাইয়াছিলেন; জগজ্জননীর দর্শন তবে নিশ্চয়ই পাওয়া যায়; আমি কেন তবে তাঁহার দর্শন পাইব না? ব্যাকুলহৃদয়ে বলিতেন – “মা, তুই রামপ্রসাদকে দেখা দিয়েছিস, আমায় কেন তবে দেখা দিবি না? আমি ধন, জন, ভোগসুখ কিছুই চাহি না, আমায় দেখা দে।” ঐরূপ প্রার্থনা করিতে করিতে নয়নধারায় তাঁহার বক্ষ ভাসিয়া যাইত এবং উহাতে হৃদয়ের ভার কিঞ্চিৎ লঘু হইলে বিশ্বাসের মুগ্ধ প্রেরণায় কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়া পুনরায় গীত গাহিয়া তিনি ৺দেবীকে প্রসন্না করিতে উদ্যত হইতেন। এইরূপে পূজা, ধ্যান ও ভজনে দিন যাইতে লাগিল এবং ঠাকুরের মনের অনুরাগ ও ব্যাকুলতা দিন দিন বর্ধিত হইতে লাগিল।
দেবীর পূজা ও সেবা সম্পন্ন করিবার নির্দিষ্ট কালও এই সময় হইতে তাঁহার দিন দিন বাড়িয়া যাইতে লাগিল। পূজা করিতে বসিয়া তিনি যথাবিধি নিজ মস্তকে একটি পুষ্প দিয়াই হয়তো দুইঘণ্টা কাল স্থাণুর ন্যায় স্পন্দহীনভাবে ধ্যানস্থ রহিলেন; অন্নাদি নিবেদন করিয়া, মা খাইতেছেন ভাবিতে ভাবিতেই হয়তো বহুক্ষণ কাটাইলেন, প্রত্যূষে স্বহস্তে পুষ্পচয়ন করিয়া মালা গাঁথিয়া ৺দেবীকে সাজাইতে কত সময় ব্যয় করিলেন, অথবা অনুরাগপূর্ণ হৃদয়ে সন্ধ্যারতিতেই বহুক্ষণ ব্যাপৃত রহিলেন! আবার অপরাহ্ণে জগন্মাতাকে যদি গান শুনাইতে আরম্ভ করিলেন, তবে এমন তন্ময় ও ভাববিহ্বল হইয়া পড়িলেন যে, সময় অতীত হইতেছে একথা বারংবার স্মরণ করাইয়া দিয়াও তাঁহাকে আরাত্রিকাদি কর্মসম্পাদনের সময়ে নিযুক্ত করিতে পারা গেল না! – এইরূপে কিছুকাল পূজা চলিতে লাগিল।
ঠাকুরের এই কালের পূজাদি কার্য সম্বন্ধে মথুর প্রমুখ সকলে যাহা ভাবিত
ঐরূপ নিষ্ঠা, ভক্তি ও ব্যাকুলতা দেখিয়া ঠাকুরবাটীর জনসাধারণের দৃষ্টি যে এখন ঠাকুরের প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল, একথা বেশ বুঝা যায়। সাধারণে সচরাচর যে পথে চলিয়া থাকে, তাহা ছাড়িয়া নূতনভাবে কাহাকেও চলিতে বা কিছু করিতে দেখিলে লোকে প্রথম বিদ্রূপ-পরিহাসাদি করিয়া থাকে। কিন্তু দিনের পর যত দিন যাইতে থাকে এবং ঐ ব্যক্তি দৃঢ়তাসহকারে নিজ গন্তব্যপথে যত অগ্রসর হয়, ততই সাধারণের মনে পূর্বোক্ত ভাব পরিবর্তিত হইয়া উহার স্থলে শ্রদ্ধা আসিয়া অধিকার করে। ঠাকুরের এই সময়ের কার্যকলাপ সম্বন্ধে ঐরূপ হইয়াছিল। কিছুদিন ঐরূপে পূজা করিতে না করিতে তিনি প্রথমে অনেকের বিদ্রূপভাজন হইলেন। কিছুকাল পরে কেহ কেহ আবার তাঁহার প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইয়া উঠিল। শুনা যায়, মথুরবাবু এই সময়ে ঠাকুরের পূজাদি দেখিয়া হৃষ্টচিত্তে রানী রাসমণিকে বলিয়াছিলেন, “অদ্ভুত পূজক পাওয়া গিয়াছে, ৺দেবী বোধ হয় শীঘ্রই জাগ্রতা হইয়া উঠিবেন!” লোকের ঐরূপ মতামতে ঠাকুর কিন্তু কোনদিন নিজ গন্তব্যপথ হইতে বিচলিত হন নাই। সাগরগামিনী নদীর ন্যায় তাঁহার মন এখন হইতে অবিরাম একভাবেই শ্রীশ্রীজগন্মাতার শ্রীপাদোদ্দেশে ধাবিত হইয়াছিল।
ঈশ্বরানুরাগের বৃদ্ধিতে ঠাকুরের শরীরে যে সকল বিকার উপস্থিত হয়
দিনের পর যত দিন যাইতে লাগিল, ঠাকুরের মনে অনুরাগ, ব্যাকুলতাও তত বৃদ্ধি পাইতে লাগিল এবং মনের ঐ প্রকার অবিরাম একদিকে গতি তাঁহার শরীরে নানাপ্রকার বাহ্য লক্ষণে প্রকাশ পাইতে লাগিল। ঠাকুরের আহার এবং নিদ্রা কমিয়া গেল। শরীরের রক্তপ্রবাহ বক্ষে ও মস্তিষ্কে নিরন্তর দ্রুত প্রধাবিত হওয়ায়, বক্ষঃস্থল সর্বদা আরক্তিম হইয়া রহিল, চক্ষু মধ্যে মধ্যে সহসা জলভারাক্রান্ত হইতে লাগিল এবং ভগবদ্দর্শনের জন্য একান্ত ব্যাকুলতাবশতঃ ‘কি করিব, কেমনে পাইব’, এইরূপ একটা চিন্তা নিরন্তর পোষণ করায় ধ্যানপূজাদির কাল ভিন্ন অন্য সময়ে তাঁহার শরীরে একটা অশান্তি ও চাঞ্চল্যের ভাব লক্ষিত হইতে লাগিল।
শ্রীশ্রীজগদম্বার প্রথম দর্শনলাভের বিবরণ – ঠাকুরের ঐ সময়ের ব্যাকুলতা
তাঁহার শ্রীমুখে শুনিয়াছি, এই সময়ে একদিন তিনি জগদম্বাকে গান শুনাইতেছিলেন এবং তাঁহার দর্শনলাভের জন্য নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া প্রার্থনা ও ক্রন্দন করিতেছিলেন। বলিতেছিলেন, “মা, এত যে ডাকছি; তার কিছুই তুই কি শুনছিস না? রামপ্রসাদকে দেখা দিয়েছিস, আমাকে কি দেখা দিবি না?” তিনি বলিতেন –
“মার দেখা পাইলাম না বলিয়া তখন হৃদয়ে অসহ্য যন্ত্রণা; জলশূন্য করিবার জন্য লোক যেমন সজোরে গামছা নিঙড়াইয়া থাকে, মনে হইল হৃদয়টাকে ধরিয়া কে যেন তদ্রূপ করিতেছে! মার দেখা বোধ হয় কোনকালেই পাইব না ভাবিয়া যন্ত্রণায় ছটফট করিতে লাগিলাম। অস্থির হইয়া ভাবিলাম, তবে আর এ জীবনে আবশ্যক নাই। মার ঘরে যে অসি ছিল, দৃষ্টি সহসা তাহার উপর পড়িল। এই দণ্ডেই জীবনের অবসান করিব ভাবিয়া উন্মত্তপ্রায় ছুটিয়া উহা ধরিতেছি, এমন সময়ে সহসা মার অদ্ভুত দর্শন পাইলাম ও সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িয়া গেলাম! তাহার পর বাহিরে কি যে হইয়াছে, কোন্ দিক দিয়া সেদিন ও তৎপরদিন যে গিয়াছে, তাহার কিছুই জানিতে পারি নাই! অন্তরে কিন্তু একটা অননুভূত জমাট-বাঁধা আনন্দের স্রোত প্রবাহিত ছিল এবং মার সাক্ষাৎ প্রকাশ উপলব্ধি করিয়াছিলাম!”
পূর্বোক্ত অদ্ভুত দর্শনের কথা ঠাকুর অন্য একদিন আমাদিগকে এইরূপে বিবৃত করিয়া বলেন, “ঘর, দ্বার, মন্দির সব যেন কোথায় লুপ্ত হইল – কোথাও যেন আর কিছুই নাই! আর দেখিতেছি কি, এক অসীম অনন্ত চেতন জ্যোতিঃ-সমুদ্র! – যেদিকে যতদূর দেখি, চারিদিক হইতে তার উজ্জ্বল ঊর্মিমালা তর্জন-গর্জন করিয়া গ্রাস করিবার জন্য মহাবেগে অগ্রসর হইতেছে! দেখিতে দেখিতে উহারা আমার উপর নিপতিত হইল এবং আমাকে এককালে কোথায় তলাইয়া দিল! হাঁপাইয়া হাবুডুবু খাইয়া সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িয়া গেলাম!” ঐরূপে প্রথম দর্শনকালে তিনি চেতন জ্যোতিঃ-সমুদ্রের দর্শনলাভের কথা আমাদিগকে বলিয়াছিলেন। কিন্তু চৈতন্য-ঘন জগদম্বার বরাভয়করা মূর্তি? ঠাকুর কি এখন তাঁহারও দর্শন এই জ্যোতিঃ-সমুদ্রের মধ্যে পাইয়াছিলেন? পাইয়াছিলেন বলিয়াই বোধ হয়; কারণ শুনিয়াছি, প্রথম দর্শনের সময়ে তাঁহার কিছুমাত্র সংজ্ঞা যখন হইয়াছিল, তখন তিনি কাতরকণ্ঠে ‘মা, মা’ শব্দ উচ্চারণ করিয়াছিলেন।
পূর্বোক্ত দর্শনের বিরাম হইলে শ্রীশ্রীজগদম্বার চিন্ময়ী মূর্তির অবাধ অবিরাম দর্শনলাভের জন্য ঠাকুরের প্রাণে একটা অবিশ্রান্ত আকুল ক্রন্দনের রোল উঠিয়াছিল। ক্রন্দনাদি বাহ্যলক্ষণে সকল সময়ে প্রকাশিত না হইলেও উহা অন্তরে সর্বদা বিদ্যমান থাকিত এবং কখনো কখনো এত বৃদ্ধি পাইত যে, আর চাপিতে না পারিয়া ভূমিতে লুটাইয়া যন্ত্রণায় ছটফট করিতে করিতে ‘মা, আমায় কৃপা কর, দেখা দে’ বলিয়া এমন ক্রন্দন করিতেন যে, চারিপার্শ্বে লোক দাঁড়াইয়া যাইত! ঐরূপ অস্থির চেষ্টায় লোকে কি বলিবে, এ কথার বিন্দুমাত্রও তখন তাঁহার মনে আসিত না। বলিতেন, “চারিদিকে লোক দাঁড়াইয়া থাকিলেও তাহাদিগকে ছায়া বা ছবিতে আঁকা মূর্তির ন্যায় অবান্তর মনে হইত এবং তজ্জন্য মনে কিছুমাত্র লজ্জা বা সঙ্কোচের উদয় হইত না! ঐরূপ অসহ্য যন্ত্রণায় সময়ে সময়ে বাহ্যসংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িতাম এবং ঐরূপ হইবার পরেই দেখিতাম, মার বরাভয়করা চিন্ময়ী মূর্তি! – দেখিতাম ঐ মূর্তি হাসিতেছে, কথা কহিতেছে, অশেষ প্রকারে সান্ত্বনা ও শিক্ষা দিতেছে!”