দিবাবসানে দিবাকরের বিরহে পূর্ব্ব দিক্ আমার ন্যায় মলিন হইল। মদীয় হৃদয়ের ন্যায় পশ্চিম দিকের রাগ বৃদ্ধি হইতে লাগিল। দুই এক দণ্ড বেলা আছে এমন সময়ে ছত্রধারিণী আসিয়া কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! আমরা স্নান করিতে গিয়া যে দুই জন মুনিকুমার দেখিয়াছিলাম, তাঁহাদের এক জন দ্বারে দণ্ডায়মান আছেন। বলিলেন, অক্ষমালা লইতে আসিয়াছি। মুনিকুমার, এই শব্দ শ্রবণমাত্র অতিমাত্র ব্যস্ত হইয়া কহিলাম, শীঘ্র সঙ্গে করিয়া লইয়া আইস। যেরূপ রূপের সহায় যৌবন, যৌবনের সহায় মকরকেতন, মকরকেতনের সহায় বসন্তকাল, বসন্তকালের সহায় মলয়পবন, সেইরূপ তিনি পুণ্ডরীকের সখা, নাম কপিঞ্জল, দেখিবামাত্র চিনিলাম। তাঁহার বিষণ্ণ আকার দেখিয়া বোধ হইল যেন, কোন অভিপ্রায়ে আমাকে কিছু বলিতে আসিয়াছেন। আমি উঠিয়া প্রণাম করিয়া সমাদরে আসন প্রদান করিলাম। আসনে উপবেশন করিলে চরণ ধৌত করিয়া দিলাম। অনন্তর কিছু বলিতে ইচ্ছা করিয়া আমার নিকটে উপবিষ্ট তরলিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করাতে আমি তাঁহার দৃষ্টিতেই অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া বিনয়বাক্যে কহিলাম, ভগবন্! আমা হইতে ইহাকে ভিন্ন ভাবিবেন না। যাহা আদেশ করিতে অভিলাষ হয় অশঙ্কিত ও অসঙ্কুচিত চিত্তে আজ্ঞা করুন।
কপিঞ্জল কহিলেন, রাজপুত্ত্রি! কি কহিব, লজ্জায় বাক্যস্ফূর্ত্তি হইতেছে না। কন্দমূলফলাশী বনবাসীর মনে অনঙ্গবিলাস সঞ্চারিত হইবে ইহা স্বপ্নের অগোচর। শান্তস্বভাব তাপসকে প্রণয়পরবশ করিয়া বিধি কি বিড়ম্বনা করিলেন! দগ্ধ মন্মথ অনায়াসেই লোকদিগকে উপহাসাস্পদ ও অবজ্ঞাস্পদ করিতে পারে। অন্তঃকরণে একবার অনঙ্গবিলাস সঞ্চারিত হইলে আর ভদ্রতা নাই। তখন প্রগাঢ় ধীশক্তিসম্পন্ন লোকেরাও নিতান্ত অসার ও অপদার্থ হইয়া যান। তখন আর লজ্জা, ধৈর্য্য, বিনয়, গাম্ভীর্য্য কিছুই থাকে না। বন্ধু যে পথে পদার্পণ করিতে উদ্যত হইয়াছেন, জানি না, উহা কি বল্কলধারণের উপযুক্ত, কি জটাধারণের সমুচিত, কি তপস্যার অনুরূপ, কি ধর্ম্মের অঙ্গ, কি অপবর্গ লাভের উপায়! কি দৈবদুর্ব্বিপাক উপস্থিত! না বলিলে চলে না, উপায়ান্তর ও শরণান্তরও দেখি না, কি করি বলিতে হইল। শাস্ত্রকারেরা লিখিয়াছেন, স্বীয় প্রাণবিনাশেও যদি সুহৃদের প্রাণরক্ষা হয় তথাপি তাহা কর্ত্তব্য; সুতরাং আমাকে লজ্জায় জলাঞ্জলি দিতে হইল।
তোমার সমক্ষে রোষ ও অসন্তোষ প্রকাশ পূর্ব্বক বন্ধুরে সেই প্রকার তিরস্কার করিয়া আমি তথা হইতে প্রস্থান করিলাম। স্নানানন্তর সরোবর হইতে উঠিয়া তুমি বাটী আসিলে ভাবিলাম, বন্ধু এক্ষণে একাকী কি করিতেছেন গুপ্ত ভাবে এক বার দেখিয়া আসি। অনন্তর আস্তে আস্তে আসিয়া বৃক্ষের অন্তরাল হইতে দৃষ্টিপাত করিলাম; কিন্তু তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম না। তৎকালে আমার অন্তঃকরণে কত বিতর্ক, কত সন্দেহ ও কতই বা ভয় উপস্থিত হইল। একবার ভাবিলাম, অনঙ্গের মোহন শরে মুগ্ধ হইয়া বন্ধু বুঝি, সেই কামিনীর অনুগামী হইয়া থাকিবেন। আবার মনে করিলাম সেই সুন্দরীর গমনের পর চৈতন্যোদয় হওয়াতে লজ্জায় আমাকে মুখ দেখাইতে না পারিয়া বুঝি কোন স্থানে লুকাইয়া আছেন; কি আমি ভর্ৎসনা করিয়াছি বলিয়া ক্রুদ্ধ হইয়া কোন স্থানে প্রস্থান করিয়াছেন; কিংবা আমাকেই অন্বেষণ করিতেছেন। আমরা দুই জনে চিরকাল একত্র ছিলাম; কখন পরস্পর বিরহদুঃখ সহ্য করিতে হয় নাই। সুতরাং বন্ধুকে না দেখিয়া যে কত ভাবনা উপস্থিত হইল তাহা বাক্য দ্বারা ব্যক্ত করা যায় না। পুনর্ব্বার চিন্তা করিলাম, বন্ধু আমার সমক্ষে সেই রূপ অধীরতা প্রকাশ করিয়া অতিশয় লজ্জিত হইয়া থাকিবেন। লজ্জায় কে কি না করে। কত লোক লজ্জার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইবার নিমিত্ত কত অসদুপায় অবলম্বন করে। জলে, অনলে ও উদ্বন্ধনেও প্রাণত্যাগ করিয়া থাকে; যাহা হউক, নিশ্চিন্ত থাকা হইবে না অন্বেষণ করি। ক্রমে তরুলতাগহন, চন্দনবীথিকা, লতামণ্ডপ, সরোবরের কূল সর্ব্বত্র অন্বেষণ করিলাম, কুত্রাপি দেখিতে পাইলাম না; তখন স্নেহকাতর মনে অনিষ্ট শঙ্কাই প্রবল হইয়া উঠিল।
পুনর্ব্বার সতর্কতা পূর্ব্বক ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিতে করিতে দেখিলাম সরোবরের তীরে নানাবিধলতাবেষ্টিত নিভৃত এক লতাগহনের অভ্যন্তরবর্ত্তী শিলাতলে বসিয়া বাম করে বাম গণ্ড সংস্থাপন পূর্ব্বক চিন্তা করিতেছেন। দুই চক্ষু মুদ্রিত, নেত্রজলে কপোলযুগল ভাসিতেছে। ঘন ঘন নিশ্বাস বহিতেছে। শরীর স্পন্দরহিত, কান্তিশূন্য ও পাণ্ডুবর্ণ। হঠাৎ দেখিলে চিত্রিতের ন্যায় বোধ হয়; এরূপ জ্ঞানশূন্য যে, কল্পপাদপের কুসুমমঞ্জরীর অবশিষ্টরেণুগন্ধলোভে ভ্রমর ঝঙ্কার পূর্ব্বক বারংবার কর্ণে বসিতেছে এবং লতা হইতে কুসুম ও কুসুমরেণু গাত্রে পড়িতেছে তথাপি সংজ্ঞা নাই, কলেবর এরূপ শীর্ণ যে সহসা চিনিতে পারা যায় না। তদবস্থাপন্ন তাঁহাকে ক্ষণকাল নিরীক্ষণ করিয়া অতিশয় বিষণ্ণ হইলাম। উদ্বিগ্ন চিত্তে চিন্তা করিলাম মকরকেতুর কি প্রভাব! যে ব্যক্তি উহার শরসন্ধানের পথবর্ত্তী হয় নাই সেই ধন্য ও নিরুদ্বেগে সংসারযাত্রা সংবরণ করিয়া থাকে। এক বার উহার বাণপাতের সম্মুখবর্ত্তী হইলে আর কোন জ্ঞান থাকে না। কি আশ্চর্য্য! ক্ষণকালের মধ্যে এরূপ জ্ঞানরাশি ঈদৃশ অবস্থান্তর প্রাপ্ত হইয়াছেন। ইনি শৈশবাবধি ধীর ও শান্তপ্রকৃতি ছিলেন। সকলে আদর্শস্বরূপ জ্ঞান করিয়া ইঁহার স্বভাবের অনুকরণ করিতে চেষ্টা করিত ও গুণের কথা উল্লেখ করিয়া যথেষ্ট প্রশংসা করিত। আজি কি রূপে বিবেকশক্তি ও তপঃপ্রভাবের পরাভব করিয়া এবং গাম্ভীর্য্যের উন্মূলন ও ধৈর্য্যের সমূলচ্ছেদ করিয়া দগ্ধ মন্মথ এই অসামান্য সৎস্বভাবসম্পন্ন মহাত্মাকে ইতর জনের ন্যায় অভিভূত ও উন্মত্ত করিল! শাস্ত্রকারেরা কহেন, নির্দ্দোষ ও নিষ্কলঙ্ক রূপে যৌবনকাল অতিবাহিত করা অতি কঠিন কর্ম্ম। ইঁহার অবস্থা শাস্ত্রকারদিগের কথাই সপ্রমাণ করিতেছে। এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে নিকটবর্ত্তী হইলাম এবং শিলাতলের এক পার্শ্বে উপবেশন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, সখে! তোমাকে এরূপ দেখিতেছি কেন? বল আজি তোমার কি ঘটিয়াছে?
তিনি অনেক ক্ষণের পর নয়ন উন্মীলন ও দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক, সখে! তুমি আদ্যোপান্ত সমুদায় বৃত্তান্ত অবগত হইয়াও অজ্ঞের ন্যায় কি জিজ্ঞাসা করিতেছ! এই মাত্র উত্তর দিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। তাঁহার সেইরূপ অবস্থা ও আকার দেখিয়া স্থির করিলাম, এক্ষণে উপদেশ দ্বারা ইঁহার কোন প্রতিকার হওয়া সম্ভব নহে। কিন্তু অসন্মার্গপ্রবৃত্ত সুহৃদ্কে কুপথ হইতে নিবৃত্ত করা সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য কর্ম্ম। যাহা হউক, আর কিছু উপদেশ দিই। এই স্থির করিয়া তাঁহাকে বলিলাম, সখে! হাঁ আমি সকলই অবগত হইয়াছি; কিন্তু ইহাই জিজ্ঞাসা করি, তুমি যে পদবীতে পদার্পণ করিয়াছ উহা কি সাধুসঙ্গত? কি ধর্ম্মশাস্ত্রোপদিষ্ট পথ? কি তপস্যার অঙ্গ? কি স্বর্গ ও অপবর্গ লাভের উপায়? এই বিগর্হিত পথ অবলম্বন করা দূরে থাকুক এরূপ সঙ্কল্পকেও মনে স্থান দেওয়া উচিত নয়। মূঢ়েরাই অনঙ্গপীড়ায় অধীর হয়। নির্ব্বোধেরাই হিতাহিত বিবেচনা করিতে পারে না। তুমিও কি তাহাদিগের ন্যায় অসৎ পথে প্রবৃত্ত হইয়া সাধুদিগের নিকট উপহাসাস্পদ হইবে? সাধুবিগর্হিত পথ অবলম্বন করিয়া সুখাভিলাষ কি? পরিণামবিরস বিষয়ভোগে যাহারা সুখ প্রাপ্তির আশা করে, ধর্ম্মবুদ্ধিতে বিষলতাবনে তাহাদিগের জলসেক করা হয়, তাহারা কুবলয়মালা বলিয়া অসিলতা গলে দেয়, মহারত্ন বলিয়া জ্বলন্ত অঙ্গার স্পর্শ করে, মৃণাল বলিয়া মত্ত হস্তীর দন্ত উৎপাটন করিতে যায়, রজ্জু বলিয়া কালসর্প ধরে। দিবাকরের ন্যায় জ্যোতি ধারণ করিয়াও খদ্যোতের ন্যায় আপনাকে দেখাইতেছ কেন? সাগরের ন্যায় গম্ভীরস্বভাব হইয়াও উন্মার্গপ্রস্থিত ও উদ্বেল ইন্দ্রিয়স্রোতের সংযম করিতেছ না কেন? এক্ষণে আমার কথা রাখ, ক্ষুভিতচিত্তকে সংযত কর, ধৈর্য্য ও গাম্ভীর্য্য অবলম্বন করিয়া চিত্তবিকার দূর করিয়া দেও।
এইরূপ উপদেশ দিতেছি এমন সময়ে ধারাবাহী অশ্রুবারি তাঁহার নেত্রযুগল হইতে গলিত হইল। আমার হস্ত ধারণ পূর্ব্বক বলিলেন, সখে! অধিক কি বলিব, আশীবিষবিষের ন্যায় বিষম কুসুমশরের শরসন্ধানে পতিত হও নাই, সুখে উপদেশ দিতেছ! যাহার ইন্দ্রিয় আছে, মন আছে, দেখিতে পায়, শুনিতে পায়, হিতাহিত বিবেচনা করিতে পারে, সেই উপদেশের পাত্র। আমার তাহা কিছুই নাই। আমার নিকটে ধৈর্য্য, গাম্ভীর্য্য, বিবেচনা এ সকল কথাও অস্তগত হইয়াছে। এ সময় উপদেশের সময় নয়; যাবৎ জীবিত থাকি এই অচিকিৎসনীয় রোগের প্রতীকারের চেষ্টা পাও। আমার অঙ্গ দগ্ধ ও হৃদয় জর্জ্জরিত হইতেছে। এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য কর, এই বলিয়া নিস্তব্ধ হইলেন।
যখন উপদেশবাক্যের কোন ফল দর্শিল না এবং দেখিলাম তাঁহার হৃদয়ে অনুরাগ এরূপ দৃঢ় রূপে বদ্ধমূল হইয়াছে যে, তাহা উন্মূলিত করা নিতান্ত অসাধ্য, তখন প্রাণরক্ষার নিমিত্ত সরোবরের সরস মৃণাল, শীতল কমলিনীদল ও স্নিগ্ধ শৈবাল তুলিয়া শয্যা করিয়া দিলাম এবং তথায় শয়ন করাইয়া কদলীপত্র দ্বারা বীজন করিতে লাগিলাম। তৎকালে মনে হইল, দুরাত্মা দগ্ধ মদনের কিছুই অসাধ্য নাই। কোথায় বা বনবাসী তপস্বী, কোথায় বা বিলাসরাশি গন্ধর্ব্বকুমারী। ইহাদিগের মনে পরস্পর অনুরাগ সঞ্চার হইবে ইহা স্বপ্নের অগোচর। শুষ্ক তরু মঞ্জরিত হইবে এবং মাধবীলতা তাহাকে অবলম্বন করিয়া উঠিবে ইহা কাহার মনে বিশ্বাস ছিল? চেতনের কথা কি, অচেতন তরু লতা প্রভৃতিও উহার আজ্ঞার অধীন। দেবতারাও উহার শাসন উল্লঙ্ঘন করিতে পারেন না। কি আশ্চর্য্য! দুরাত্মা এই অগাধ গাম্ভীর্য্যসাগরকেও ক্ষণ কালের মধ্যে তৃণের ন্যায় অসার ও অপদার্থ করিয়া ফেলিল। এক্ষণে কি করি, কোন্ দিকে যাই, কি উপায়ে বান্ধবের প্রাণরক্ষা হয়। দেখিতেছি মহাশ্বেতা ভিন্ন আর কোন উপায় নাই। বন্ধু স্বভাবতঃ ধীর, প্রগল্ভতা অবলম্বন করিয়া আপনি কদাচ তাহার নিকট যাইতে পারিবেন না। শাস্ত্রকারেরা গর্হিত অকার্য্য দ্বারা সুহৃদের প্রাণরক্ষা কর্ত্তব্য বলিয়া থাকেন; সুতরাং অতি লজ্জাকর ও মানহানির কর্ম্মও আমার কর্ত্তব্যপক্ষে পরিগণিত হইল। ভাবিলাম, যদি বন্ধুকে বলি যে, তোমার মনোরথ সফল করিবার জন্য মহাশ্বেতার নিকট চলিলাম, তাহা হইলে, পাছে লজ্জাক্রমে বারণ করেন এই নিমিত্ত তাঁহাকে কিছু না বলিয়া ছলক্রমে তোমার নিকট আসিয়াছি। এই সময়ের সমুচিত, সেইরূপ অনুরাগের সমুচিত ও আমার আগমনের সমুচিত যাহা হয় কর, বলিয়া কি উত্তর দি শুনিবার আশয়ে আমার মুখ পানে চাহিয়া রহিলেন।
আমি তাঁহার সেই কথা শুনিয়া সুখময় হ্রদে, অমৃতময় সরোবরে নিমগ্ন হইলাম। লজ্জা ও হর্ষ একদা আমার মুখমণ্ডলে আপন আপন ভাব প্রকাশ করিতে লাগিল। ভাবিলাম, অনঙ্গ সৌভাগ্যক্রমে আমার ন্যায় তাঁহাকেও সন্তাপ দিতেছে। শান্তস্বভাব তপস্বী কপিঞ্জল স্বপ্নেও মিথ্যা কহেন না; ইনি সত্যই কহিতেছেন, সন্দেহ নাই। এক্ষণে আমার কি কর্ত্তব্য ও কি বক্তব্য এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময়ে প্রতিহারী আসিয়া কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! তোমার শরীর অসুস্থ হইয়াছে শুনিয়া মহাদেবী দেখিতে আসিতেছেন। কপিঞ্জল এই কথা শুনিয়া সত্বরে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক কহিলেন, রাজপুত্ত্রি! ভগবান্ ভুবনত্রয়চূড়ামণি দিনমণি অস্তগমনের উপক্রম করিতেছেন। আর আমি অপেক্ষা করিতে পারি না; যাহা কর্ত্তব্য করিও, বলিয়া আমার উত্তরবাক্য না শুনিয়াই শীঘ্র প্রস্থান করিলেন। তিনি প্রস্থান করিলে, এরূপ অন্যমনস্ক হইয়াছিলাম যে, জননী আসিয়া কি বলিলেন, কি করিলেন, কিছুই জানিতে পারি নাই। কেবল এইমাত্র স্মরণ হয়, তিনি অনেকক্ষণ আমার নিকটে ছিলেন।
তিনি আপন আলয়ে প্রস্থান করিলে ঊর্দ্ধে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দেখিলাম, দিনমণি অস্তগত হইয়াছেন। চতুর্দ্দিক্ অন্ধকারে আচ্ছন্ন; তরলিকাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তরলিকে! তুমি দেখিতেছ না আমার হৃদয় আকুল হইতেছে ও ইন্দ্রিয় বিকল হইয়া যাইতেছে? কি কর্ত্তব্য কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। কপিঞ্জল যাহা বলিয়া গেলেন, স্বকর্ণে শুনিলে। এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য উপদেশ দাও। যদি ইতর কন্যার ন্যায় লজ্জা, ধৈর্য্য, বিনয় ও কুলে জলাঞ্জলি দিয়া, জনাপবাদ অবহেলন ও সদাচার উল্লঙ্ঘন করিয়া, পিতা মাতা কর্ত্তৃক অননুজ্ঞাত হইয়া স্বয়ং অভিসারিকাবৃত্তি অবলম্বন করি, তাহা হইলে, গুরুজনের অতিক্রম ও কুলমর্য্যাদার উল্লঙ্ঘন জন্য অধর্ম্ম হয়। যদি কুলধর্ম্মের অনুরোধে মৃত্যু অঙ্গীকার করি তাহা হইলে প্রথমপরিচিত, স্বয়মাগত, কপিঞ্জলের প্রণয়ভঙ্গজন্য পাপ এবং আশাভঙ্গ দ্বারা সেই তপোধনযুবার কোন অনিষ্ট ঘটিলে ব্রহ্মহত্যা ও তপস্বিহত্যা জন্য মহাপাতকে লিপ্ত হইতে হয়।