আমাদের ময়মনসিংহের একটি প্রবচন হচ্ছে–সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। কিলায় হচ্ছে কিল+খায়; এক ধরনের সন্ধি যেখানে একটা অক্ষর হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মধ্য অক্ষরলোপী সন্ধি বলতে পারেন।
মধ্য অক্ষর লোপী সন্ধির ব্যাপারটা আমার জীবনে ঘটল। সুখে ছিলাম হঠাৎ ভূতের কিল খেলাম–রাম কিল। মনস্থীর করে ফেললাম ভ্রমণে যাব। হাতের কাছে সমুদ্র, ঠিক হল সমুদ্র-দর্শন করা হবে। আমার তিন কন্যা আনন্দে লাফাতে লাগল। আমার স্ত্রী রাগে লাফাতে লাগলেন (আমার যে কোন সিদ্ধান্তের শুরুতে তার খানিকটা রাগ হয়। সেই রাগ সময়ের সঙ্গে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। সমুদ্র দর্শনে তার রাগের কারণ হচ্ছে লোকজন কোলকাতা, দিল্লী, ব্যাংকক কত জায়গায় যায় আর আমরা কিনা কক্সবাজার।
এটা আবার কি রকম ভ্রমণ? ভ্রমণের মূল আনন্দ হচ্ছে শপিং। কক্সবাজার থেকে কিনবটা কি? ঝিনুকের মালা?
প্রথম শ্রেণীর যুক্তি। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। ঠিক তখন ভূতের হাতে দ্বিতীয়বার কিল খেলাম অর্থাৎ পরিকল্পনা বদলে করলাম নেপাল। হিমালয় কন্যা নেপাল–অন্নপূর্ণা, কাঞ্চনজংঘা ইত্যাদি। তিন কন্যা আনন্দে চেঁচাতে লাগল–নেপাল, নেপাল। আমার স্ত্রী রাগে লাফাতে লাগলেন।
: এই শীতে কেউ নেপালে যায়? তোমার মাথাটা কি পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে? এখন নেপাল যাওয়া মানেতো শীতে জমে যাওয়া।
আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, আমরা তো আর এভারেষ্টের চূড়ায় উঠবো না। হোটেলে থাকবো।
: হোটেলেই যদি সারাক্ষণ বসে থাকতে হয় তাহলে ঢাকার হোটেলগুলি দোষ করল কি? রুম ভাড়া করে চল ঢাকার কোন একটা হোটেলে উঠে যাই।
আমি বহুব্রীহি নাটকের মামার মত গলায় বললাম, ডিসিসন ইজ ফাইনাল। তোমার যেতে ইচ্ছে হলে যাবে। ইচ্ছে না হলে যাবে না।
যখন সব পুরোপুরি ঠিক করা হল তখন পরামর্শদাতা বন্ধুদের আবির্ভাব ঘটতে লাগল। তাদের অদ্ভুত অদ্ভুত সব পরামর্শ। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে যার পরামর্শ যত অদ্ভুত হয় তার পরামর্শই আমার স্ত্রীর তত পছন্দ হয়। একজন এসে বলল–
সার্ক টিকিট করে ফেল। তিনটা দেশ দেখা হবে। টাকাও লাগবে কম।
: কত কম?
বন্ধু টাকার অংক বলল। আমার ভিমরি খাবার অবস্থা। দল বল পুলা পুটলি নিয়ে তিনটা দেশে যাব কেন? আমি কি যাযাবর নাকি? আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল রইলাম–নেপাল। শুধুই নেপাল। অন্য কোথাও নয়।
একদিন বাসায় ফিরে জানলাম, আমার স্ত্রী কাকে নিয়ে নাকি সার্ক টিকেট কিনে নিয়ে এসেছে। সঞ্চিত প্রতিটি টাকা ঐ টিকিটে বেরিয়ে গেছে। থাকা, খাওয়া, ঘুবা ফেরার বাকি টাকাটা আমাকে জোগাড় করতে হবে। আমি থমথমে গলায় বললাম–সেটা কিভাবে করব?
: আমি কি করে জানি কিভাবে করবে? দেশ ভ্রমণের প্ল্যানতো আমার না, তোমার।
অধিক শোকে লোকজন পাথর হয়, আমি লোহা হয়ে গেলাম। টাকার চিন্তায় ঘুম হয় না। শেষ রাতে তার মত হয়, তখন ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখি। অধিকাংশ দুঃস্বপ্নই ভ্রমণ-সংক্রান্ত যেমন পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে কিংবা হোটেলে বাচ্চাদের রেখে ঘুরতে বের হয়েছি, হোটেলের নাম গিয়েছি ভুলে। কোন রাস্তায় হোটেল তা-ও মনে নেই।
ভ্রমণ শুরু হবার আগেই আমার তিন কেজি ওজন কমে গেল। ডান দিকের জুলপি পেকে গেল। এই ব্যাপারটা যথেষ্ট রহস্যময়। ডান দিকের জুলুপির চুল সাদা হয়ে গেল বাঁ দিকেরটা হল না কেন? তা হলে কি মানুষের মস্তিষ্কের ভান অংশ ভ্রমণ সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে ডিল করে? অন্য সময় হলে এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতাম, এখন ভাবতে পারছি না। কারণ ক্রমাগত টেলিফোন আসছে। সবই আমাদের আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে। ভ্রমণ বিষয়ক টেলিফোন। দু একটা নমুনা দিচ্ছি।
: যাচ্ছ যখন অজিমীরটা ঘুরে এসো। তোমারতো ছেলে নেই। তিনটাই মেয়ে। আজমীরে গিয়ে খাস দিলে দোয়া করলে কাজ হবে। খুব গরম জায়গা যা চাওয়া যায় পাওয়া যায়। তোমার মত নাস্তিককে কিছু বলা বৃথা, তুমি বরং তোমার স্ত্রীকে টেলিফোন দাও। ওকেই বুঝিয়ে বলি।
: নেপাল থেকে আমার জন্যে একটা ষ্টোন অনবে। এ্যামেথিষ্ট। বাংলায় একে রলে চন্দ্রকান্ত মনি। দেখে শুনে আনবে। ওজন যেন ছয় রতির বেশী হয়। তোমার আবার আত্মসম্মানবোধ বেশী নয়ত টাকা পাঠিয়ে দিতাম।
ও আরে না না আমার জন্যে কিছু আনার দরকার নেই। যচ্ছি বেড়াতে বাজার করতে তো আর যাচ্ছ না। লাল বাবা জর্দা এক কৌটা নিয়ে এসো আর সস্তায় যদি কাজ করা শাল পাওয়া যায় তা হলে একটা আনতে পার, ঘিয়া রঙ্গ দেখে আনবে। তোমার ভাবীর বোধ হয় কি একটা ফরমাশ আছে। শাড়ি কাড়ি হবে। মেয়ে মানুষের এই এক রোগী। নাও তোমার ভাবীর সঙ্গে কথা বল।
ঘরে ভ্রমণের প্রস্তুতি চলতে থাকে। চারটা মেক্রোসাইজ স্যুটকেস কাপড়ে ভর্তি হয়ে যায়। গোদের উপর বিষ ফোড়ার মত চার স্যুটকেসের সঙ্গে আছে খালি দুই স্যুটকেস। এরা যথা সময়ে ভর্তি হয়ে ফেরত আসবে, এই পরিকল্পনা। আমি একবার শুধু ক্ষীণস্বরে বলেছিলাম, এই স্যুটকেসগুলি নিতেইতো ছোটখাট একটা প্লেন দরকার। এতে আমার স্ত্রী থমথমে গলায় বললেন,–সবকিছু নিয়ে কলিকতা করবে না। জীবনটা উন্মাদের এলেবেলে নয়।
আমি চুপ করে গেলাম এবং মনে মনে বললাম–যে কবি লিখেছিলেন–দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘরের বাহিরে দুই পা ফেলিয়া–তিনি যে কত সুখে ছিলেন তা তিনি জানেন না।